অধ্যায় ৩১
হার্ট মনিটরে ৭০ এর কাছাকাছি রিডিং দেখাচ্ছে। রোগীর চেহারায় মমতাভরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাতসুমিয়া। অক্সিজেন মাস্কে বড় একটা অংশ ঢাকা পড়ে গেছে। তাকামাসার পক্ষ থেকে কোন সাড়া নেই।
কাতসুকো বসে আছে বিছানার অপর পাশে। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু চোখের তারায় সেই আগের মতনই দীপ্ততা। বড় ভাই, যে ওদের জন্যে এত কিছু করেছে, তার একদম শেষ সময়টা অবধি পাশে থাকতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে।
ভাইকে দেখতে প্রতিদিনই আসে কাতসুকো। গতকাল রাতে মাতসুমিয়াকে জানায় তাকামাসা গত কয়েক দিন ধরে বলছে তার নাকি কেবলই ঘুম পায়। এত বেশি ঘুমায় যে সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে
গত সন্ধ্যায় বোনকে তাকামাসা বলে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিতে। সে একাই থাকতে পারবে। এরপর থেকে আর কোন কথা বলেনি। যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ছুটে এসেছে মাতসুমিয়া। কিন্তু ও মামা’র কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করলেও মাতসুমিয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
ডাক্তার ওদের জানিয়েছে তাদের পক্ষে আর কিছু না। মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আর নতুন ধরণের কোন চিকিৎসার দিকে এগোবে না। অন্যভাবে বললে, তাকামাসাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বাড়তি কিছু আর করবে না তারা।
আরো আগে কেন আসল না সেটা নিয়ে এখন আফসোস হচ্ছে ওর। গিঙ্কগো পার্কে মেয়েটার মরদেহ আবিষ্কার হবার দিন সেই যে এসেছিল, এরপর আর হাসপাতালমুখো হয়নি মাতসুমিয়া। ও যে কাগার সাথে একটা কেসে কাজ করেছে সেই ব্যাপারেও মামাকে কিছু বলা হয়নি, পরিণতি কি হলো সেটা জানানো তো দূরের কথা।
আসলে সময়ই বের করতে পারেনি ও।
কাতসুকোর মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এলো এসময়। সে কেবলই খেয়াল করেছে তাকামাসার হার্টবিট কমে আসছে ধীরে ধীরে। এখন হার্ট মনিটরে দেখাচ্ছে ৬০।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানার পাশের টেবিলটার দিকে তাকালো একবার মাতসুমিয়া। শোগি বোর্ডটা রাখা আছে ওখানে। কয়েকটা গুটির অবস্থান বদলেছে অবশ্য। কিন্তু মামার শেষ চাল কোনটা ছিল তা বুঝতে পারল না ও। কে জিতেছে সেটাও বলা সম্ভব না।
উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার মামার চেহারায় হাত বুলিয়ে জানালার কাছে চলে এলো মাতসুমিয়া। মামার মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে চায় ও, কিন্তু সেজন্যে অপেক্ষা করা বড্ড বেশি বেদনাদায়ক।
পূবাকাশ ধীরে ধীরে রাঙ্গা হচ্ছে বাইরে। মাতসুমিয়া হাসপাতালে এসেছে পাঁচ ঘন্টা আগে, রাত বারোটার দিকে।
একটা নতুন দিনের শুরু, কিন্তু ওদিকে ওর মামার জীবন সুতোয় ঝুলছে। ওপারে পাড়ি জমাতে পারেন যে কোন মুহূর্তে। এসময় হাসপাতালের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের দিকে নজর পড়লো ওর।
প্রথমে বিশ্বাস হতে চাইল না কি দেখছে।
“কিয়োচিরো দাঁড়িয়ে আছে বাইরে,” ফিসফিসিয়ে বলে মাতসুমিয়া।
“কি?” বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওর মা।
“কিয়োচিরোই, আমি নিশ্চিত,” ভ্রু কুঁচকে বললো মাতসুমিয়া।
একটা গাঢ় রঙের স্যুট পরনে কাগার।
“ভেতরে আসছে না কেন?”
“জানি না। আমি নিয়ে আসছি,” বলে দরজার দিকে এগোতে যাবে ও, এসময় এক তরুণ ডাক্তার আর নার্স কানামোরি তোকিকো প্রবেশ করলো ভেতরে। নীরবে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল তারা।
নার্সের অফিসে বসে সব কেবিনের মনিটর রিডিং দেখা যায়। ওখান থেকেই এসেছে তারা। তাকামাসার মৃত্যু আসন্ন।
কাতর কণ্ঠে ভাইকে আরেকবার ডাকল কাতসুকো। তাকামাসার নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলেন ডাক্তার।
হার্টবিট আগের তুলনায় আরো কমে এসেছে। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
মাতসুমিয়া কিছুতেই বুঝতে পারছে না কাগা এরকম একটা মুহূর্তে বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আসতে কি সমস্যা? দোটানায় ভুগছে ও। একবার মনে হচ্ছে গিয়ে নিয়ে আসবে কাগাকে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই মামা যদি….
৪০ এর নিচে নেমে এলো হার্টবিট। এরপর দ্রুত কমতে লাগলো। মনিটরে “০” ভেসে উঠলো কিছুক্ষণ পর।
“মারা গেছেন উনি,” আনুষ্ঠানিকতা পালন করলো ডাক্তার।
অক্সিজেন মাস্ক খুলে নিল নার্স। ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে কাতসুকো।
ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো মাতসুমিয়া। মামার মৃত্যু বড্ড অবাস্তব ঠেকছে ওর কাছে। কোন কষ্ট হচ্ছে না ভেতরে। শুধু মনে হচ্ছে জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
নিচতলায় চলে এলো মাতসুমিয়া। মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কাগা। ভাইকে ডাক দিল ও।
ধীরে ধীরে ওর দিকে ফিরল সে। চোখেমুখে বিস্ময়ের ছিটেফোটাও নেই, বরং হাসি ফুটলো তার মুখে।
“বাইরে বের হয়েছ যখন, সব শেষ তাহলে…”
জবাবে কেবল মাথা ওপর-নিচ করলো মাতসুমিয়া।
“ঠিক আছে,” ঘড়ির দিকে দেখলো কাগা। “পাঁচটা বাজছে… খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে?”
“না, ঘুমের মধ্যেই চলে গেছে।”
“যাক, সেটাই ভালো। কাগজপত্রে কিছু সই করতে হবে বোধহয়।“
“কিন্তু তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? ভেতরে আসলে কি হতো?”
“কারণ আছে। শুনতে হয়তো খুব ভালো লাগবে না তোমার…চলো…” হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে পড়লো কাগা।
কেবিনে ফিরে ওরা দেখলো কাতসুকো একা বসে আছে।
“কিয়োচিরো…তুমি বাইরেই ছিলে?”
“বাবার খেয়াল রাখার জন্যে তোমাদের ধন্যবাদ,” বাউ করে বলে কাগা।
“মামাকে….কোথায় নিয়ে গেছে?”
“গোসল করাচ্ছে,” ছেলে আর ভাতিজার দিকে তাকিয়ে বললো কাতসুকো।
মাথা নেড়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লো কাগা। মাতসুমিয়াও একই কাজ করলো।
“তোমার কি ধারণা, আকিও মায়েহারার মা মানসিক ভারসাম্যহীন হবার অভিনয় করলো কেন?”
“কি? ওহ, নিশ্চয়ই ভিন্ন কোন কারণ ছিল তার,” এরকম একটা সময়ে কাগার এমন প্রশ্নে অবাক না হয়ে পারল না মাতসুমিয়া।
“কি কারণ?”
‘ছেলের পরিবারের সাথে মেশাটাই তার মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।”
“এটা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু এছাড়াও আরো কারণ আছে।”
“কিরকম?”
“একবার এক বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, স্ত্রী মারা যাবার পর তার রেখে যাওয়া কাপড়গুলো পরে দেখেছিলেন তিনি। আমি তখন জিজ্ঞেস করি মৃত স্ত্রী’র কাপড় পরে তার কাছাকাছি যেতে পেরেছেন কিনা। এই প্রশ্নের জবাব খুব একটা গুছিয়ে দিতে পারেননি তিনি। শুধু এটুকু বলেছেন, মৃত্যুর আগে তার স্ত্রী কেমন অনুভব করছিলেন সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন মাত্র।”
চোখ বড় বড় করে কাগার দিকে তাকালো মাতসুমিয়া।
“মিসেস মায়েহারাও কি সেই চেষ্টাই করছিলেন?”
“আমি নিশ্চিত নই সেই ব্যাপারে। তিনি নিজেও বোধহয় জানেন না।” পকেটে হাত দিয়ে একটা পুরনো ছবি বের করে আনে কাগা। তরুণ এক দম্পতি আর তাদের ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ওখানে।
ঢোক গিলল মাতসুমিয়া। “এটা তো তোমার বাবা আর….“
“আমার মা। তখন খুব সম্ভবত এলিমেন্টারি স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি আমি। স্কুলের কাছাকাছি একটা পার্কে ছবিটা তোলা। এই ছবিটা নিয়ে এসেছি কফিনে দিয়ে দেয়ার জন্যে।”
“তোমার মা’কে কখনো দেখিনি আমি।”
“তখন ত্রিশের আশপাশে ছিল বোধহয় মা’র বয়স। গোলগাল চেহারা। সবসময় নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো। তুমি তো জানো যে সে মারা গেছে?”
“হ্যাঁ, তাকে সেন্দাইয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।”
মাথা নাড়ে কাগা। “একাই থাকতো মা। দেখাশোনা করার মত কেউ ছিল না। মৃত্যুর আগের সময়টাও নিভৃতেই কেটেছে। বাবা প্রায়ই দুঃখ করতো বিষয়টা নিয়ে। আমাকে একবার বলেছিল পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় আমার কথা নিশ্চয়ই অনেক ভেবেছে মা। আমি ওখানে থাকলে খুশি হতো খুব। তাই বাবা সিদ্ধান্ত নেয় তার যখন শেষ সময় চলে আসবে, তখন একা থাকবে। মৃত্যুর আগ অবধি আমাকে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিল।
“এজন্যেই তুমি…” কাগার দিকে তাকিয়ে বলে মাতসুমিয়া।
এসময় কেবিনের দরজা খুলে নার্স তোকিকো প্রবেশ করলো ভেতরে।
“আমাদের কাজ শেষ। আপনারা আসতে পারেন এখন।”
“আমি একবার দেখতে চাই,” কাগা উঠে দাঁড়িয়ে বলে।
তাকামাসাকে দেখে মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। চেহারায় শান্তির আভাস।
বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় কাগা। “শান্তি পেয়েছে শেষ পর্যন্ত,” বলে শোগি বোর্ডটার দিকে তাকায় সে।
“একদম শেষদিন পর্যন্ত খেলেছে আপনার বাবা।”
হঠাৎই লজ্জিত মনে হলো তোকিকোকে। কাগার দিকে তাকালো সে। “এবারে সব কথা বলে দিলে হয় না?”
একবার গাল চুলকায় কাগা। “ঠিক বলেছেন আপনি।”
“কি নিয়ে কথা বলছেন আপনারা?” নার্সকে জিজ্ঞেস করে মাতসুমিয়া। “আপনার মামার সাথে এতদিন আসলে আমি খেলিনি। আমি শুধু ইমেইলে আসা নির্দেশ অনুযায়ী চাল দিচ্ছিলাম।”
“ইমেইল?”
“হ্যাঁ, মি. তাকামাসা কোন চাল দিলে সেটা আমি ইমেইলে জানিয়ে দিতাম।”
মাতসুমিয়া প্রায় জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল কাকে ইমেইল পাঠাতো সে। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে কাগাকে বলে, “তুমি খেলতে মামার সাথে?”
এবারে কাগার মুখে লাজুক হাসি ফোটে।
“দুই মাস ধরে চলেছে খেলাটা। আরেকটু বেশি খুব সম্ভবত। প্ৰায় শেষ হয়েই এসেছিল।”
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মাতসুমিয়া। কাগা এতদিন ধরে মনে মনে শাপ- শাপান্ত করার জন্যে লজ্জা লাগতে থাকে। নিজের মত করে কাগা তার বাবার সাথে ঠিকই যোগাযোগ রেখেছিল।
“ওহ, দাঁড়ান,” বলে কাগার হাতে একটা গুটি ধরিয়ে দেয় নার্স। “এটা তার হাতে ছিল।”
গুটিটার দিকে তাকায় কাগা। “ঘোড়সওয়ার?
“আমি নিশ্চিত আপনার বাবা জানত তিনি কার সাথে খেলছেন।”
কিছু না বলে মাথা নাড়ল কাগা।
“মামার চাল দেয়ার কথা ছিল নাকি?” মাতসুমিয়া জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ। আমার মনে হয় গুটিটা এখানে বসাতে চেয়েছিল বাবা,” বলে বোর্ডের নির্দিষ্ট একটা জায়গায় গুটিটা রাখে কাগা।
এরপর বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে।
“দারুণ একটা চাল! তুমিই জিতলে বাবা!”
-: শেষ :-