রেড ফিঙ্গার – ২৯

অধ্যায় ২৯

বসের কথামত আবারো ভেতরে ফিরে এলো মাতসুমিয়া। কাগাকে জানালো ওদের অন্য সহকর্মীরা মা-ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো শোনার পরেও কোন পরিবর্তন এলো না আকিওর অভিব্যক্তিতে।

মাসায়ে আর হারুমি বারান্দায় বসে আছে চুপচাপ। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে পুরোপুরি।

উঠে দাঁড়াল আকিও, শরীরটা সীসার মত ভারি মনে হচ্ছে ওর।

“আমাকেও যেতে হবে।”

“আর কিছু বলার আছে আপনার?” কাগা জিজ্ঞেস করে। “আপনার মা আর বোনকে কিছু বলবেন না?”

মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে নিচের দিকে তাকালো আকিও। “আমার মা যে মেকআপ দিয়ে বাচ্চাদের মতন খেলে, এটা মাথায় আসেনি আমার। হারুমি গতকাল বলেছিল, তখনও বুঝিনি ব্যাপারটা। এজন্যেই এত বড় ধাক্কা খেলাম।”

হাসল সে, যেন নিজের প্রতিই করুণা হচ্ছে। এসময় হারুমি এগিয়ে এল তার দিকে। আকিও মুখ তুলে দেখল দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে তার বোন। পানি গড়াচ্ছে গাল বেয়ে। চোখ বড় করে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে। পরমুহূর্তেই গালে তীক্ষ্ন একটা ব্যাথা অনুভব করলো আকিও। প্রথমে ধরতে পারল না কি ঘটছে। খানিক বাদে বুঝলো বোন থাপ্পড় কষিয়েছে ওর গালে।

“ভুল করে ফেলেছি আমি,” গালে হাত দিয়ে বলে আকিও। “উচিৎ হয়নি….”

“আমার কাছে মাফ চাওয়ার কোন মানে নেই,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলে হারুমি। “মানে?”

“মি. মায়েহারা,” হারুমির পাশে দাঁড়ানো কাগা বলে এসময়। “আপনি এখনও সত্যটা ধরতে পারেননি।”

“আসল সত্য?”

“আপনি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে, এটা ভালো কথা। কিন্তু আপনি এখনো অনেক কিছুই জানেন না,” বলে প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতরে থাকা লিপস্টিকটা দেখালো কাগা। “আপনার বোনের সাথে যখন দেখা করতে যাই, তখন তাকে অনুরোধ করেছিলাম সে যা লুকোচ্ছে, তা আমি না বলা অবধি গোপন রাখতে।”

“যা লুকোচ্ছে….কি বলছেন এসব?”

“আমিও আসলে পুরো সত্যটা বলিনি। লিপস্টিকটার ব্যাপারে আপনার বোনকে আমি জিজ্ঞেস করি, মিসেস মায়েহারার লিপস্টিকটা তার কাছে আছে কিনা। উত্তর যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে সেটা নিয়ে আসতে বলি।”

বোনের দিকে তাকালো আকিও। এখনো কিছু বুঝতে পারছে না সে।

“এই লিপস্টিকটা আমার না। অনেক দিন ধরেই মা’র কাছে আছে এটা।”

“মা’র? কিন্তু নিয়ে তো এসেছিলি তুই?”

“আমি এটা গতকাল বাগান থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি।”

“গতকাল?”

“মা আমাকে গতকাল ফোন দিয়ে বলে বাগানে একটা গাছের নিচে লিপস্টিকটা লুকিয়ে রেখেছে, সেটা যেন আমি বাসায় নিয়ে যাই। কারণটা নাকি পরে বুঝতে পারব।”

“কি বলছিস এসব তুই?” আকিওর চেহারায় বিভ্রান্তি ভর করলো এবারে। “তোকে ফোন দিয়েছিল মানে?”

“হ্যাঁ, যে ফোনটা মা’কে এনে দিয়েছিলাম আমি, সেটা থেকে কল করেছিল।”

“তুই এনে দিয়েছিস?”

ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকালো হারুমি। এরপর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

“তুই এখনও বুঝতে পারছিস না?”

“কি?”

চকিতে একটা ভাবনা খেলে গেল আকিওর মাথায়। যা দেখছে বা শুনছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সব তথ্য-প্রমাণ নির্দেশ করছে সেদিকেই।

“অসম্ভব,” বিড়বিড় করে বললো সে। বারান্দার দিকে তাকালো একবার।

ওর মা এখনো আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে। যেন পাথর কুঁদে বানানো কোন মূর্তি।

এবারে মিলে যাচ্ছে সব, নিজেকেই বলে আকিও। মাসায়ে শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছে তার ছেলে আর ছেলের বউ মিলে কি ফন্দি আটছিল। আর সেজন্যেই সেই পরিকল্পনা বানচালের ব্যবস্থা করেছে আঙুলে লাল দাগ লাগানোর মাধ্যমে। পুলিশের লোকেরা তার হাতে লাল দাগ দেখে ভাববে কখন ওখানে দাগটা লাগলো। লিপস্টিকটা মেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলে তারা ধরে নেবে খুনের আগেই হাতে লিপস্টিকের দাগ লেগেছিল তার। অর্থাৎ, সে নির্দোষ।

আর আসলেও যদি এরকম কিছু ঘটে থাকে তাহলে একটা সম্ভাবনাই থাকে।

ওর মা কি পুরোপুরি সুস্থ? মানসিক কোন সমস্যাই নেই তার?

বোনের দিকে তাকালো আকিও। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে তার। “জানতি তুই?”

“হ্যাঁ, জানতাম,” অকপটে বলে হারুমি। “আমিই তো মা’র সাথে সময় কাটিয়েছি।”

“কিন্তু এই অভিনয়ের মানে কি?”

বিষণ্ণ চিত্তে মাথা নাড়ল হারুমি। “তুই এখনো বুঝতে পারছিস না? বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।”

কিছু বললো না আকিও। ঠিকই বলেছে ওর বোন। প্রশ্নের জবাবটা জানে ও

ওরা এই বাসায় উঠে আসার পর পরিবেশ কেমন ছিল, তা মনে পড়ে গেল আকিওর। ওর মা’র সাথে সবসময় শীতল ব্যবহার করতো ইয়াইকো। এমনকি আকিও নিজেও মাঝে মাঝে বড্ড খারাপ আচরণ করতো তার সাথে। যার বাবা- মা এরকম, সেই ছেলে ভালো হবে কি করে? নাওমি দাদীর সাথে এমন আচরণ করতো, যেন সে অচ্ছুৎ কেউ। আকিও কিংবা তার স্ত্রী, কেউই তাকে এরকম আচরণের জন্যে কখনো বকেনি বা কিছু বলেনি।

সেটাই সব কথা নয়। এই ছাদের নিচে যে পরিবারের বসবাস, তাদের নিজেদের মধ্যে কোন স্নেহের বন্ধন নেই। কোনভাবেই সুখী পরিবার বলা যাবে না ওদের।

মাসায়ের আর কোন উপায় ছিল না। তাই নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। অবশ্য ওদের সংসারে তার কোন সম্পৃক্ততাও ছিল না। একমাত্র হারুমিকেই নিজের জগতে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল সে। মেয়ে আশপাশে থাকলে কিছুটা ভালো সময় কাটত তার।

আকিও আর ওর স্ত্রী বুঝতেও পারেনি যে পুরোটাই মাসায়ের অভিনয়। বরং ওরা তার এই মানসিক অবস্থার সুযোগ নিতে চেয়েছিল। ইয়াইকোর সাথে করা সেদিনের আলাপটা মনে পড়লো ওর।

“কাজ করবে বুদ্ধিটা, ভেবো না। মা’র এখন যেরকম মানসিক অবস্থা, পুলিশের লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করে সুবিধা করে উঠতে পারবে না। আমরা যদি বলি সে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন, আমাদের কথাই বিশ্বাস করবে।”

“কিন্তু আসলে সমস্যা হবে বিশ্বাস করানো যে মা-ই মেয়েটাকে মেরেছে।”

“মা”র যেহেতু মাথার ঠিক নেই, সে জানে না কখন কি করছে। আমরা যদি বলি পুতুল ভেঙ্গে ফেলেছে বলে মেয়েটাকে হত্যা করেছে সে, তাহলে?”

“হ্যাঁ, এটা বলা যায়। তাছাড়া মা’র কথা বললে তারা অপরাধটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেবে না।”

“এমনকি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ না-ও দায়ের করা হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কাউকে নিয়োগ দেয়া হবে। সে আরো ভালো বলতে পারবে মা’র মানসিক অবস্থা নিয়ে।”

মাসায়ে যখন ওদের এসব আলোচনা করতে শুনেছিল, তখন কেমন লাগছিল তার? ভীষণ রাগ হচ্ছিল নিশ্চয়ই? সেই সাথে কষ্টও পেয়েছে অবশ্যই। এরপরেও অভিনয় চালিয়ে যায় সে।

“মি. মায়েহারা,” কাগা বলে। “আপনার মা বারবার সংকেত দিতে থাকেন যেন আপনারা ভুলটা না করেন। আপনার মনে আছে প্রথমদিন গ্লাভস হাতে দিয়েছিলেন তিনি? কটু গন্ধ আসছিল ওগুলো থেকে। আমাদের তখনই তিনি জানাতে চাইছিলেন খুনটা কোথায় হয়েছে। এছাড়া লিপস্টিকের দাগ তো আছেই।”

“আমাদের জন্যে ফাঁদ পেতেছিল মা?”

“না,” দ্রুত বলে কাগা। “কোন মা কি তার ছেলের জন্যে ফাঁদ পাততে পারে? তিনি চাইছিলেন আপনি একটু ভাবুন ব্যাপারটা নিয়ে।”

“ভাইয়া, আমি তোকে গতকাল বলেছিলাম মা ইদানিং মেক-আপ নিয়ে খেলতে পছন্দ করতে। এটা সত্য না। কিন্তু মা এই কথাটা তোকে বলতে বলেছিল। আমি তখন বুঝিনি কারণটা, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। মা চাইছিল তুই যেন মা’র আঙুলের দিকে খেয়াল করিস। যদি তুই দেখতি সেখানে লাল রঙ লেগে আছে, তাহলে মুছে ফেলার চেষ্টা করতি। মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তুই সেই চেষ্টা করলে তোকে বাঁধা দেবে। তখন বাধ্য হয়ে তোদের পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হতো। বুঝতে পারছিস কি বলছি? এটাই ছিল মার মনে।”

এক হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলো আকিও।

“কিছুই বুঝতে পারিনি আমি।“

“নিজের জন্যে নিজেই ফাঁদ পেতেছিলেন আপনি,” শান্ত কন্ঠে বলে কাগা। “আপনার বোনের সাথে দেখা হবার পর এসব ব্যাপারে কথা হয় আমাদের। আমি চাইছিলাম আপনি যেন নিজ থেকেই বাস্তবতাটা বুঝতে পারেন। আপনার বোনেরও তেমনটাই ইচ্ছে ছিল। আপনার মা চাইলে অনে আগেই আপনাদের পরিকল্পনাটা বানচাল করে দিতে পারত। শুধু এটা বললেই হতো যে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু মিসেস মায়েহারা সেটা করেননি, কারণ উনার আশা ছিল শেষ পর্যন্ত হয়তো আপনি পরিকল্পনাটা বাতিল করবেন। আমরা তার ইচ্ছের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার চেষ্টা করেছি। আপনার বোনের সাহায্য নিয়ে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সে-ই বলেছিল আপনাকে আপনার মায়ের লাঠিটা দেখাতে…”

“হাঁটার লাঠি।”

“বুঝতে পারছেন তো কি বলছি? কাঠের ফলকটায় আপনার মায়ের নাম তো আপনিই লিখেছিলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নেই অ্যালবাম আর কাঠের ফলকটা দেখার পরেও যদি আপনি বিকারহীন থাকেন, তাহলে আমরা আর কিছু করবো না। কিন্তু আপনি নিজেকে সামলাতে পারেননি। আপনার মা নিজের কানে শুনেছেন সবকিছু।”

“মি. কাগা, আপনি কখন বুঝতে পারলেন যে আমার মা সুস্থই আছেন?”

“তার আঙুলে লাল দাগ দেখার পর থেকে।”

“লাল দাগ দেখার পর?”

“হ্যাঁ। তখন একবার চোখাচোখি হয় আমাদের। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল। আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম কেন কাজটা করেছিলেন তিনি। মানে আঙুলে লাল রঙ লাগানোর কথা বলছি। অসুস্থ কেউ অতটা প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন না।”

কাগার বলা প্রতিটি কথা শেল হয়ে বিধছে আকিওর বুকে। সেগুলোর ভারে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না ও। হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গিতে চার হাত পায়ে উবু হয়ে বসে পড়লো তাতামি ম্যাটের উপরে। মা’র দিকে তাকালো একবার।

তখনও একদৃষ্টিতে বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে মাসায়ে। এবারে আকিও খেয়াল করলো একটু পর মৃদু মৃদু কাঁপছে তার পিঠ।

চিৎকার করে কেঁদে উঠে তাতামি ম্যাটে কপাল ঠেকাল আকিও। নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *