অধ্যায় ২৬
অ্যালবামটা অনেক দিন আগে দেখেছিল ও। তবে জানে যে ভেতরে পুরনো কিছু ছবি আছে। শেষবার যখন ছবিগুলো দেখেছিল তখন মিডল স্কুলের ছাত্র আকিও। সেই সময়ে অ্যালবামে নতুন ছবি ঢোকানো বন্ধ হয়।
প্রথম যে ছবিটা দেখল আকিও, সেটায় ও একটা বেজবল ক্যাপ মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লম্বা কালো স্ক্রল। পাশেই হাসিমুখে দাঁড়ানো মাসায়ে। প্রাইমারি স্কুলের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামে সার্টিফিকেট পাওয়ার পর তোলা হয়েছিল ছবিটা। সেই অনুষ্ঠানে ওর সাথে গিয়েছিল মাসায়ে।
চোখে পানি এসে গেল আকিওর। ওর মা সব কিছু ভুলে গেছে, তবুও ছেলের এই ছবিগুলো তার মানসিক প্রশান্তির খোরাক।
অথচ সেই ছেলেই কিনা তাকে জেলে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছে।
সে যদি কোন অপরাধ করতো, তাও হয়তো মানা যেত। কিন্তু মাসায়ে সম্পূর্ণ নির্দোষ। নিজের ছেলেকে বাঁচানোর জন্যে মা’র কাঁধে দোষ চাপিয়েছে ও। পরিকল্পনাটা কাগজে কলমে যতটা না বোঝা যায়, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থপর দেখায়। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ঠিক কিন্তু ভেসে থাকা অন্য কাউকে টেনে ধরে নিচে নামায় না।
ওর মা মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও তাকে দোষী প্রমাণ করাটা ভীষণ গর্হিত একটি কাজ।
চোখে পানি নিয়ে অ্যালবামটার দিকে আরেকবার তাকালো আকিও।
“দেখে নিয়েছেন তো ভালো করে? আপনার মা’কে হাজতে নিয়ে গেলে আর দেখতে পারবেন না কিন্তু। দরকার হলে সময় নিন, আমাদের হাতে কোন তাড়া নেই।”
“ধন্যবাদ, কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট। ছবিগুলো দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”
“আপনার যেমনটা ইচ্ছে,” কাগা বলে।
অ্যালবামটা বন্ধ করে হারুমির হাতে ওটা দিয়ে দেয় সে।
এই অফিসার মনে হয় সব বুঝে গেছে, আকিও ভাবে। সে জানে আসল কালপ্রিট এই বয়স্ক মহিলা নয়, বরং উপরতলায় দরজা আটকে বসে থাকা কিশোর ছেলেটা। আমার মুখ দিয়ে সত্যটা বের করাতে চাইছে, এজন্যেই চাপ প্রয়োগ করছে এভাবে।
নিজেকে শক্ত করে আকিও, এই ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। পুলিশের কাছে কোন প্রমাণাদি নেই। মানসিক চাপ সৃষ্টি করেই তারা কর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করছে। চুপ করে থাকলেই আর কোন বিপদ হবে না।
শক্ত হতে হবে ওকে।
একটা ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো এসময়। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে চাপালো মাতসুমিয়া।
“হ্যাঁ, মাতসুমিয়া বলছি। ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি।”
“লেফটেন্যান্ট জানালো বাড়ির সামনে থানা থেকে ভ্যান এসে পরেছে।”
“আচ্ছা,” কাগা বলে।
এসময় ইয়াইকোর কন্ঠস্বর শোনা গেল হলওয়ে থেকে।
“আমি তৈরি।”
ব্লাউজের উপরে একটা সোয়েটার গায়ে চাপিয়েছে সে, সাথে নীল জিন্স। ক্যাজুয়াল।
“আপনাদের ছেলের কি হবে?” আকিওকে জিজ্ঞেস করে কাগা। “ওকে তো একাই থাকতে হবে বাসায়। “
“হ্যাঁ….সেটা সত্যি…হারুমি….তুই একটু দেখে রাখতে পারবি ওকে?”
এখনও শক্ত করে অ্যালবামটা ধরে আছে হারুমি। মাথা নেড়ে সায় জানাল সে। “ঠিক আছে।”
“ধন্যবাদ,” মাথা নুইয়ে বলে আকিও।
“ঠিক আছে, মিসেস তাজিমা, আপনার মা’কে এখন নিয়ে যাব আমরা।“
“জ্বি,” বলে সামনে এগিয়ে মাসায়ের কাঁধে হাত রাখল হারুমি। “মা-চান, আমাদের এখন উঠতে হবে।”
মেয়ের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আকিও আর মাতসুমিয়ার দিকে ঘোরে মাসায়ে।
“মাতসুমিয়া! হাতকড়া পরাও ওনাকে!” কাগা বলে।
“কি?” অবাক হয়ে যায় মাতসুমিয়া।
“হাতকড়া.” আবারো বলে কাগা। “তোমার কাছে না থাকলে আমি বের করছি।”
“না, আছে আমার কাছে,” তার সহকর্মী বলে।
“দাঁড়ান! এক মিনিট! হাতকড়া কেন পরাচ্ছেন মা’কে!” আকিও বলে ওঠে।
“পরাতেই হবে। এটাই নিয়ম।”
“কিন্তু…কিন্তু…” মা’র হাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আকিও। “এটা কি?“
“তোকে তো গতকাল এই ব্যাপারে বলেছিলাম,” হারুমি জবাব দেয়। “মেকআপ নিয়ে অনেক আগ্রহ। আঙুলের এই লাল দাগটা লিপস্টিক থেকে লেগেছে। ওগুলো নিয়ে খেলতে ভালোবাসে মা।”
“ওহ আচ্ছা…”
মাসায়ের আঙুলের লাল দাগগুলো দেখে অনেক বছর আগের বাবার লাল আঙুলের কথা মনে পড়ে গেল আকিওর।
“আমরা যাব এখন?”
হ্যান্ডকাফ হাতে আকিওকে মাতসুমিয়াকে প্রশ্নটা করলো মাতসুমিয়া। জবাবে মাথা নাড়ল ও। মা’র হাতের দিকে তাকাতে পারছে না।
মাতসুমিয়া পা সামনে বাড়িয়েছে এমন সময় কথা বলে উঠলো কাগা। “এক মিনিট! উনি তো লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন, তাই না?”
“জ্বি…ঠিক বলেছেন,” হারুমি বলে।
“হাতকড়া পরালে সেটা ব্যবহার করতে পারবেন না। লাঠিটা কোথায়? “সামনের দরজার কাছে ছাতাগুলোর পাশে রাখা আছে ওটা। ভাইয়া, নিয়ে আসবি একটু?”
“আনছি,” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আকিও।
জুতার র্যাকের পাশে আরেকটা ছোট, লম্বা র্যাক আছে যেখানে ছাতাগুলো রাখা আছে। আকিও’র এই র্যাকটা খোলার দরকার পড়ে না কারণ ও তার ছাতা অন্য জায়গায় রাখে। পাল্লা খোলার পর জিনিসটা নজরে পড়লো ওর। লাঠিটার হাতল ধূসর। একটা ছোট ঘন্টা বাঁধা ওটার সাথে।
মাসায়ের ঘরে ফিরে এলো ও। একটা কাপড় বিছিয়ে সেটার মধ্যে মাসায়ের প্রয়োজনীয় সব জিনিস আর অ্যালবামটা রাখছে হারুমি। ইয়াইকো আর পুলিশ অফিসার দু’জন একপাশে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছে।
“পেয়েছেন লাঠিটা?” কাগা জিজ্ঞেস করে।
তার হাতে ওটা তুলে দেয় আকিও। কাগা সেটা বাড়িয়ে দেয় হারুমির দিকে।
“সব ঠিকঠাক? এবারে বের হই আমরা?”
লাঠিটা মা’র হাতে দেয় হারুমি।
“এই যে, মা-চান, তোমার লাঠি। শক্ত করে ধোরো কিন্তু,” ধরা গলায় কথাগুলো বললো হারুমি।
নিস্পৃহ ভঙ্গিতে সেটা ধরে হাঁটতে শুরু করে মাসায়ে। আকিও’র চোখের সামনে দরজার দিকে এগোয় সে।
ঘন্টাটা শব্দ করে ওঠে। লাঠিটার দিকে আবারো ভালো করে তাকায় আকিও। একটা ছোট কাঠের ফলক লাগানো ঘন্টার সাথে, যেখানে লেখা ‘মাসায়ে মায়েহারা’
আবেগের তাড়নায় আবারো কেঁপে ওঠে ওর শরীর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এখন।
ফলকটা আগে খেয়াল করেনি ও। এলিমেন্টারি স্কুলে থাকার সময় আর্ট ক্লাসে এই জিনিসটা বানিয়েছিল। টিচার বলেছিলেন নিজের বা সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার নাম খোদাই করতে কাঠে। আকিও মা’র নাম লিখেছিল।
এত বছর পরেও জিনিসটা রেখে দিয়েছে মাসায়ে। মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারাবার আগে নিশ্চয়ই বেঁধে নিয়েছিল লাঠির সাথে। পছন্দের জিনিস বলেই এমনটা করেছে। খুব সম্ভবত ওটাই ছিল মা’কে দেয়া ওর প্রথম উপহার।
আবেগ সামলাতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছে আকিও’কে। খুব বেশিক্ষণ সামলাতে পারবে বলে মনে হয় না।
মাথা নিচু করে বসে পড়লো।
“কি হলো আপনার?” কাগা করলো প্রশ্নটা।
আর পারছে না আকিও। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে। বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা ধড়ফড় করছে অনবরত।
“মাফ করবেন আমাকে….আমি…আমি…দুঃখিত,” কাগার উদ্দেশ্যে বাউ করে বলে ও। “আপনাদের মিথ্যে বলেছি আমরা। আমার মা কিছু করেনি। তার কোন দোষ নেই।”