রেড ফিঙ্গার – ২৫

অধ্যায় ২৫

মাতসুমিয়াকে বাইরে থেকে শান্ত দেখালেও ভেতরে ভেতর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে সে। হাতের তালু ঘামছে অনবরত।

কোবায়াশির সাথে ফোনে কথা বলার পর কাগা ওকে বলেছিল নাওমি মায়েহারার অ্যালিবাই যাচাই করে দেখতে।

“ওর বাবা-মা খুব সম্ভবত বাঁধা দিবে এই কাজে, কিন্তু তোমার সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই। যদি বেশি সমস্যা করে তাহলে বলবে ছেলেটার সাথে তার রুমে গিয়ে একা দেখতে করতে চাও। আর যদি সে বাইরে আসে, তাহলে চেষ্টা করবে যত বেশি সম্ভব প্রশ্ন করার। গতকাল তারা ফোনে জানিয়েছিল একটা গেইমিং আর্কেডে সময় কাটিয়েছে ছেলেটা, তাই জিজ্ঞেস করবে কোন আর্কেডে গিয়েছিল সে, কি কি গেম খেলেছে- এসব। যদি সে বলে তার মনে নেই, তাহলে এমনভাবে প্রশ্ন করতে থাকবে যেন রেগে যায়। কিন্তু আমার মনে হয় না সেরকম কিছু হবে। আর এটাও দেখ ছেলেটার নিজের কোন কম্পিউটার আছে কিনা।“

সবশেষে কাগা বলে হারুমি তাজিমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে। আকিওর বোন।

“কি জন্যে?”

“আমি চাই পারিবারিক সমস্যার সমাধান সবার সামনেই হোক,” জবাব দেয় কাগা।

এখন সে হারুমিকে নিয়ে মায়েহারাদের বাসায় ফিরে এসেছে।

কিছুক্ষণ পর ডাইনিং রুমে ফিরে এলো ইয়াইকো। চেহারায় মেঘ ডেকেছে তার।

“তোমার বোন এসেছে!”

জবাবে নাক দিয়ে একবার অস্ফুট শব্দ করলো কেবল আকিও। কিছুক্ষণ পর কাগার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকল হারুমি। চেহারায় তার স্পষ্ট বিষাদ। “আমার বোনকে নিয়ে এসেছেন কেন?” আকিও জানতে চাইল।

“কারণ আমার ধারণা আপনার মা’কে তিনিই সবচেয়ে ভালো করে চেনেন। আমি সব খুলে বলেছি তাকে।”

“ওহ…ইয়ে….” লজ্জিত দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো আকিও। “তুই নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিস সবকিছু শুনে। কিন্তু এমনটাই ঘটেছে।”

“মা কোথায়?”

“পেছনের ঘরে।”

“আচ্ছা,” বলে কাগার দিকে তাকালো হারুমি। “আমি কি একবার মা’র সাথে দেখা করতে পারি?”

“নিশ্চয়ই। যান না। “

উঠে দাঁড়িয়ে মায়েহারা দম্পতির সামনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হারুমি। “মাতসুমিয়া,” এবারে ওর দিকে তাকালো কাগা। “ছেলেটার সাথে কথা বলেছো?“

“হ্যাঁ।”

“শুক্রবারে কি কি করেছে সে?”

“গেইমিং আর্কেডে গিয়েছে আর একটা কনভিনিয়েন্স স্টোরে গিয়েছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেছিল শুনলাম।”

এরপর কাগার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো ছেলেটার একটা নিজস্ব কম্পিউটার আছে। সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নাড়ল কাগা, এরপর মায়েহারা দম্পতির দিকে তাকালো।

“থানা থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের লোকজন সবাই এসে পড়বে। যা যা করা দরকার, করো।”

মাতসুমিয়া বিস্মিত হলো কথাটা শুনে।

“ফোন দিয়েছিলেন আপনি?” মায়েহারাদের সামনে ইচ্ছে করেই কাগাকে আপনি করে বললো ও।

“হ্যাঁ, আসার পথে ফোন করেছি। কিন্তু আমার কাছ থেকে সংকেত না পাওয়া অবধি বাইরেই অপেক্ষা করবে সবাই। “

সহকর্মীর উদ্দেশ্য ঠিক বুঝতে পারছে না মাতসুমিয়া। ওর চেহারা দেখে সেটা ধরতে পারল কাগা। পরক্ষণে এমন ভাবে ওর দিকে তাকালো সে, যার অর্থ পরিষ্কার- ‘ভরসা রাখো’।

“আপনারা কি আমার মা’কে গ্রেফতার করবেন?” আকিও জিজ্ঞেস করে।

“অবশ্যই,” কাগা জবাব দেয়। “সবচেয়ে হীন অপরাধটা করেছে সে। এর চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে?”

“কিন্তু আপনারা তো মা’র অবস্থা জানেন। সে বুঝেশুনে কিছু করে না। এই অবস্থায় দোষারোপ করা কি উচিৎ হবে?”

“তার মানসিক অবস্থা কেমন, সেটা যাচাই করে দেখব আমরা। এরপর বিচারক মূল সিদ্ধান্ত নেবেন। পুলিশের দায়িত্ব অপরাধীকে গ্রেফতার করা। তাকে দোষারোপ করা উচিৎ না অনুচিত সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। “

“এমনও তো হতে পারে যে বিচারে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হলো।”

“এরকম ক্ষেত্রে নির্দোষ’ কথাটা প্রযোজ্য কিনা, তা ঠিক জানি না আমি। তাকে শাস্তি দেয়া হতেও পারে, না-ও পারে। এই বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। পাবলিক প্রসিকিউটর থাকবেন এসবের দায়িত্বে। যদি দোষী সাব্যস্ত হন, সেক্ষেত্রে বিচারক সিদ্ধান্ত নিবেন।”

“তবু…” আকিও বলে। “তার যেন কোন কষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা যায় না? মা’কে এরকম অবস্থায় জেলে রাখা যাবে না। আপনি তো দেখেছেন তাকে। বয়সও হয়েছে…”

“আমার উর্ধ্বতন অফিসাররা যা বলবেন, তাই হবে। কিন্তু আমি যতদূর বুঝতে পারছি, প্রাথমিকভাবে কারাগারে থাকতেই হবে কয়েক দিন। তাছাড়া আপনার মা একা একা টয়লেটে যেতে পারে, খাওয়া দাওয়া করতে পারে। অন্য সবার মতনই তাকে কারাগারে পাঠানো হবে খব সম্ভবত।”

“সেটার কি আসলেই কোন দরকার আছে?”

“তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে অবশ্যই দরকার আছে। তাছাড়া আপনাদের দু’জনকে কারাগারে যেতে হবে।”

“আমরা সেজন্যে তৈরি।”

“হ্যাঁ, একজন বয়স্ক মানুষের জন্যে এসব ধকল সামলানো একটু কঠিন। কষ্টই হয়ে যাবে হয়তো। কারাগারে যে সেলগুলো আছে, সেগুলোর অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। গ্রীষ্মকালে গরমে তেতে থাকে পরিবেশ। ঠাণ্ডায় বড্ড বেশি ঠাণ্ডা লাগে। খাবারও ভালো না। ব্যক্তিগত কোন জিনিস সাথে নেয়ার জন্যে বিশেষ অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। আপনার মা পুতুলগুলো সাথে করে নিতে পারবেন না। একা একা দিন কাটাতে হবে ওখানে। একঘেয়ে লাগতে শুরু করবে খুব দ্রুত।”

থেমে একবার কাঁধ ঝাঁকায় কাগা।

“আপনারা এসব দেখার জন্যে মানসিকভাবে তৈরি কিনা জানি না।”

কালো হয়ে গেছে আকিও মায়েহারার চেহারা। সে হয়তো ভেবেছিল তাকে কারাগারে যেতে হবে, কিন্তু তার মা’র সাথেও যে একই রকম আচরণ করা হবে, তা মাথায় ছিল না, ভাবে মাতসুমিয়া।

“মি. মায়েহারা,” এবারে নরম কণ্ঠে বললো কাগা। “আপনি কি এসব মেনে নিতে পারবেন? “

চমকে উঠলো মায়েহারা। রক্ত সরে গেছে চেহারা থেকে। কেবল তার কান আর গলার কাছটা লালাভ দেখাচ্ছে।

“মানে?”

“না, আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম আর কি। আপনার মা তো নিজে থেকে কিছু বলতে পারেননি। আপনি তার হয়ে সবকিছু বলেছেন। আর এখন তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হচ্ছে। আমি একদম নিশ্চিত হতে চাই যে আপনি এটাই চাইছেন।”

“আমি চাইছি? এছাড়া আর কি কোন উপায় ছিল আমার হাতে? চাইলে ধামাচাপা দিতে পারতাম পুরো ঘটনা, কিন্তু সেটা তো সম্ভব না,” আকিও’র নিজের কানেও কথাগুলো বড্ড ঠুনকো শোনাচ্ছে।

ইয়াইকো উঠে দাঁড়াল এসময়।

“আমি কি কাপড় বদলে আসব?”

“নিশ্চয়ই। আপনিও কি যাবেন মি. মায়েহারা?”

“আমি এখানেই থাকব।“

চলে গেল ইয়াইকো।

“সিগারেট খেতে পারি একটা?

“অবশ্যই, আপনারই বাসা,” কাগা জবাব দেয়।

একটা সিগারেট বের করে ধরালো আকিও। তবে সিগারেটের ধোঁয়াও

আজকে তার চঞ্চল মনকে শান্ত করতে পারছে না।

“‘কেমন বোধ করছেন আপনি?“

“বলে বোঝানো সম্ভব না,” সত্যি কথাটাই বললো আকিও। “সবকিছু নিজের চোখের সামনে তছনছ হয়ে গেল।”

“আর আপনার মা’র ক্ষেত্রে?”

“মা’র ক্ষেত্রে…আসলে…

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়ল আকি ও।

“মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার পর থেকেই তাকে বড় অচেনা লাগে। আমাকেও নিশ্চয়ই চিনতে পারে না সে। মা-ছেলের স্বাভাবিক সম্পর্ক তাই আমাদের মাঝে নেই।

“আপনার বাবাও তো আলঝেইমারের রোগী ছিলেন।”

“জ্বি।”

“তার খেয়াল কে রাখত?”

“মা।”

“আচ্ছা, কাজটা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না।”

“না। বাবা মারা যাওয়ায় মা’র জীবন সহজ হয়েছে।”

লম্বা শ্বাস নিল কাগা। “আপনার তাই মনে হয়?”

“হ্যাঁ। কারণ আমার মা’কে অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।”

জবাব না দিয়ে মাতসুমিয়ার দিকে তাকালো। কারণটা বুঝতে পারল না আকিও।

“একই ছাদের নিচে দীর্ঘ সময় ধরে আছে এমন দম্পতিদের মধ্যে আলাদা এক ধরণের বন্ধন সৃষ্টি হয়। এজন্যেই প্রয়োজনের সময়ে একে অন্যের খেয়াল রাখে তারা। চাইলেও বন্ধন ছিন্ন করে সেই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব, কিন্তু তেমনটা হয় না। সঙ্গীর মৃত্যু হলে তাতে স্বস্তি মেলে কিনা, সেই বিষয়ে আমি আসলেও সন্দিহান। বরং আমার ধারণা এতে প্রবল অপরাধবোধ এবং বিষাদ বাসা বাঁধে মনে।”

“এই ধারণার কারণ?”

“কারণ তাদের মনে হয় সঙ্গীর জন্যে আরো কিছু হয়তো করার ছিল। সেক্ষেত্রে আরো কয়েকটা দিন একসাথে থাকা সম্ভব হতো কিংবা করুণ পরিণতি বরণ করে নিতে হতো না তার স্বামী বা স্ত্রী’কে। এরকম ধারণা থেকেই অপরাধোবোধ আর বিষাদ বাসা বাঁধে মনে। “

“আপনার ধারণা আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে?”

“তা জানি না। শুধু এটুকু বলবো বয়স্ক মানুষদের অনুভূতির রসায়ন আমাদের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। বিশেষ করে তারা যেহেতু জানে মৃত্যু ওঁত পেতে আছে জীবনের প্রতিটি বাঁকে। আমাদের উচিৎ তাদের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। তাদের মনে কি চলছে এটা বাইরে থেকে জানা সম্ভব না। কিন্তু আমাদের মতনই তাদের অনুভূতিরও দাম আছে।”

“জানি আমি! মা’র অনুভূতির প্রতিও আমি শ্রদ্ধাশীল,” মায়েহারা বলে।

একদৃষ্টিতে আকিওর চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে কাগা। আগের তুলনায় এখন কিছুটা নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে তাকে।

“তাই নাকি? তাহলে শুধু শুধু এত লম্বা লেকচার ঝারার জন্যে দুঃখিত।”

“সমস্যা নেই,” সিগারেট নিভিয়ে বলে মায়েহারা।

একবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো কাগা।

“আপনার মা’কে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারবেন?”

“নিশ্চয়ই।”

মায়েহারাও উঠে দাঁড়াল। মাতসুমিয়ার দিকে তাকাল কাগা, যেন ওদের সাথে আসতে বলছে।

পেছনের রুমে ফিরে এলো ওরা। দরজার কাছেই বসে আছে হারুমি আর বারান্দায় কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে মাসায়ে। হারুমির চেহারা তুষারের মতন সাদা দেখাচ্ছে এখন। যেন এমন কিছু শুনেছে যা বিশ্বাস করতে পারছে না।

“আপনার মা’কে এখন নিয়ে যাব আমরা,” ঘোষণার সুরে বললো কাগা। “জ্বি,” বলে উঠে দাঁড়িয়ে মাসায়ের দিকে এগোলো হারুমি।

“কিন্তু তার আগে,” কাগা বললো। “আপনি কি আমাদের আপনার মায়ের প্রিয় জিনিসগুলো দিতে পারবেন? যদি ওরকম কিছু থেকে থাকে আর কি। সেগুলোও নাহয় নিয়ে গেলাম আপাতত।“

মাথা নেড়ে রুমের চারপাশে নজর বুলালো হারুমি। নিশ্চয়ই কোন একটা জিনিসের কথা মাথায় এসেছে তার। ওয়ার্ডোবটার দিকে এগোলো পরক্ষণে। কি যেন একটা জিনিস বের করে আনল।

“এটা নিয়ে যেতে পারবে?“

“হ্যাঁ,” ছোট অ্যালবামটার দিকে তাকিয়ে বলে কাগা। এরপর জিনিসটা আকিওকে দেখাল সে, “এটাই আপনার মায়ের সবচেয় প্রিয় জিনিস।”

আকিওর পুরো শরীর কাঁপছে এখন।

এই অ্যালবামটা তার চেনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *