রেড ফিঙ্গার – ২৪

অধ্যায় ২৪

পুলিশের লোক দু’জন বাইরে গিয়ে কোন ব্যাপারে আলোচনা করছে সেটা ভাবছে আকিও। বাগানে তো এই মুহূর্তে খুঁজে পাওয়ার মত আর কিছু নেই। পুলিশের কাছে কি বলবে সেটা নিয়ে লম্বা সময় ধরে আলোচনা করেছে ও আর ইয়াইকো, যাতে ওদের কথায় অসামঞ্জস্যতা না থাকে, কোন ফাঁক ফোকর না থাকে। তদুপরি, ইয়াইকো কেবল একটা বিষয় বাদে বাকি কথাগুলো সত্যই বলেছে। কেবল খুনীর নামটা মাসায়ে না হয়ে নাওমি হবে।

“বাগানে কি এত আলাপ করছে দু’জন?” ইয়াইকো ওর মনের প্রশ্নটাই করলো।

“জানি না,” মাসায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় আকিও।

এই মুহূর্তে ওদের দিকে পিঠ দিয়ে মূর্তির মত স্থাণু হয়ে বসে আছে সে।

আমাদের হাতে আর কোন উপায় ছিল না, আরো একবার নিজেকে প্ৰবোধ দেয় আকিও।

কাজটা যে কতটা গর্হিত হয়েছে, সেই ব্যাপারে ধারণা আছে ওর। কিছুদিন আগেও কেউ যদি বলতো ওর পক্ষে এরকম কিছু একটা করা সম্ভব, তাহলে হয়তো বিশ্বাস করতো না তাদের কথা। কিন্তু পরিস্থিতি মানুষকে এমন কিছু কাজ করতে বাধ্য করে যা অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। ছেলেকে বাঁচানোর জন্যে নিজের মা’কে কেউ আগে দোষারোপ করেছে কিনা, সেই ব্যাপারে সন্দেহ আছে। নরক বলে যদি সত্যি কিছু থেকে থাকে, তাহলে আমার জায়গা সেখানেই, ভাবে ও।

কিন্তু এছাড়া ওদের হাতে আর কোন উপায়ও ছিল না। স্মৃতিভ্রংশের রোগী ওর মা’কে যদি মূল কালপ্রিট হিসেবে উপস্থাপন করা যায় তাহলে সমাজের মানুষজন ওদের ততটাও বাঁকা চোখে দেখবে না। এমনকি ওদের পরিকল্পনা সফল হলে সবার করুণাও পাওয়া যাবে। নাওমির ভবিষ্যত সেক্ষেত্রে অতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

আর একবার যদি একথা ছড়িয়ে পড়ে নাওমিই আসল খুনী তাহলে পুরো জীবন তাকে একজন হত্যা মামলার আসামী হিসেবে কাটাতে হবে। ছেলে মানুষ করতে পারেনি বলে আকিও আর ইয়াইকো’কেও ছাড়বে না কেউ। ওরা যেখানেই যাবে, লোকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, ওদের একঘরে করে রাখবে।

ও জানে যে মায়ের সাথে কাজটা ঠিক করা হচ্ছে না। কিন্তু সে নিশ্চয়ই বুঝছে না তার সাথে কি করা হচ্ছে। তাছাড়া স্মৃতিভ্রংশে ভুগছে এমন কাউকে আদালত থেকে শাস্তি দেয়া যাবে কিনা সেই ব্যাপারেও সন্দেহ আছে ওর। নাওমি বা অন্য কোন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি যে শাস্তি পেত, মাসায়ের শাস্তি নিশ্চয়ই তার চেয়ে কম হবে। কোথায় যেন শুনেছিল ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ ব্যক্তিদের শাস্তির ধরণ আলাদা। আর ওর মা’র মানসিক ভারসাম্য যে ঠিক নেই, তা যে কেউ বুঝতে পারবে।

তাছাড়া, মাসায়ে নিজেও নিশ্চয়ই নাতিকে বাঁচানোর জন্যে নিজের কাঁধে দোষ টেনে নিতে রাজি হতো। তবে সেজন্যে তাকে পুরো পরিস্থিতিটা বুঝতে হতো।

সামনের দরজাটা খুলে যাওয়ার শব্দ কানে এলো এসময়। হলওয়ে থেকে পদশব্দ শোনা যাচ্ছে।

“আপনাদের এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্যে দুঃখিত,” ঘরটায় ঢুকে বললো মাতসুমিয়া।

কাগা নেই তার সাথে।

“আপনার সহকর্মী কোথায়?”

“উনি একটা কাজে বেরিয়েছেন, এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যে। আমি… আসলে জানতে চাইছিলাম আপনারা যা যা বললেন, সেই ব্যাপারে অন্য কেউ জানে কিনা।“

এই প্রশ্নটার জন্যে তৈরিই ছিল আকিও। মনে মনে উত্তরও ঠিক করে রেখেছে।

“না, আমরা দু’জন বাদে এই ব্যাপারে আর কেউ জানে না।“

“আপনাদের ছেলে?“

“আমার ছেলে…” আকিও সর্বাত্মক চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। “ও কিছু জানে না। আমরা শুরু থেকেই খেয়াল রেখেছি যেন ও কিছু না বুঝতে পারে।”

“কিছুই জানবে না, এটা কি করে সম্ভব? আপনারা এত কিছু করলেন লাশটা সরানোর জন্যে আর সে কিছু খেয়াল করেনি, এটা হতেই পারে না।”

এই প্রথম সরাসরি ওর কোন কথার বিরুদ্ধে কিছু বললো মাতসুমিয়া। শুরু হলো তাহলে, ভাবে আকিও।

“না, আমার ছেলে আসলেই কিছু জানতো না। আপনারা আসার আগে ওকে কিছু ঘটনা বলেছি কেবল, তাও পুরোটা নয়। শুক্রবার বাসায় ফেরার আগে বাইরে কি করেছে ও, সেই ব্যাপারে আসলেও কিছু জানি না আমি। ও আসার আগেই মেয়েটার লাশ পড়ে ছিল বাগানে। একটা কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম আমরা; তাই কিছু খেয়াল করেনি।“

“আর,” এবারে ইয়াইকো মুখ খুললো। “ও আসলে বাসায় ফিরে নিজের ঘর থেকে খুব একটা বের হয় না। টয়লেটে যাওয়ার সময় কিংবা খেতে ডাকলে নিচে নামে কেবল। পুরো ব্যাপারটাই ওর জন্যে ভীষণ অপ্রত্যাশিত, আসলে

বয়স কম তো। আপনাদের কাছে অনুরোধ, দয়া করে ওকে এসবের মধ্যে টানবেন না।”

“অপরিচিত কারো সাথে খুব সহজে মিশতে বা কথা বলতে পারে না, লাজুক স্বভাবের একটু। আপনাদের কোন সাহায্য করতে পারবে বলেও মনে হয় না,” স্ত্রী’র সাথে তাল মেলায় আকিও।

ওরা কোনমতেই চায় না নাওমির দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিক পুলিশের লোকেরা। এটাই এখন ওদের একমাত্র লক্ষ্য।

সামনে দাঁড়ানো দম্পতির দিকে এক একে করে তাকালো মাতসুমিয়া।

“আপনাদের ছেলের সাথে একবার হলেও কথা বলতে হবে আমাদের,” বললো সে কিছুক্ষণ পর। “হয়তো ওর চোখে এমন কিছু পড়েছে, যেটা আর কারো চোখে পড়েনি। আর সেটা আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হতেও পারে। তাছাড়া খুনের তদন্তে সম্পৃক্ত সবার সাথে কথা বলাটা নিয়মের মধ্যেই পড়ে…..”

“সম্পৃক্ত সবাই….” মাতসুমিয়ার কথার পুনরাবৃত্তি করে ইয়াইকো।

“আপনাদের ছেলে যেহেতু এই বাসাতেই থাকে, সুতরাং তাকে ‘সম্পৃক্ত’ ব্যক্তিদের মধ্যেই গণ্য করা হবে,” মাতসুমিয়া বলে।

আকিও আর ইয়াইকো দু’জনেই জানে পুলিশের লোকেরা নাওমির সাথে কথা বলবেই। কিন্তু তারা এটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে চাইছিল যে নাওমি প্রাপ্তবয়স্ক নয়।

“ওর ঘর কি উপর তলায়? আমি যদি গিয়ে দেখা করি, কোন সমস্যা হবে?”

মাতসুমিয়ার অনুরোধ শুনে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল আকিও’র। এটা যে কোন মূল্যে এড়াতে চাইছিল ও। নাওমির সাথে কোন পুলিশ অফিসার একা একা কথা বললে ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। ইয়াইকো-ও তার সাথে এই বিষয়ে একমত।

“আমি নিয়ে আসছি ওকে,” ইয়াইকো দ্রুত বলে ওঠে এসময়। স্বামীর মনে কি চলছে এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে সে।

“ইয়ে মানে…” আকিও বললো। “আমরা অন্য কোন ঘরে গিয়ে বসলে ভালো হতো না? এখানে একটু কেমন যেন লাগছে।” মা’র দিকে তাকালো ও।

কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেল মাতসুমিয়া। তিনজনে ডাইনিং রুমে চলে এলো এবারে। আগের তুলনায় কিছুটা স্বস্তিবোধ হচ্ছে আকিওর। ও ভয় পাচ্ছিল নাওমি যখন শুনবে তার বদলে দাদীকে সবকিছুর জন্যে দোষারোপ করা হচ্ছে, তখন বেঁকে বসতে পারে।

“আচ্ছা,” বসতে বসতে বলে মাতসুমিয়া। “আপনার মা কি এর আগে কখনো কারো উপরে চড়াও হয়েছিল?“

“এরকম ঘটনা যে আগে ঘটেনি, তা বলবো না আমি,” আকিও বলে। “আসলে কোন কিছুই তো বুঝে-শুনে করে না। এক-আধটু ঝামেলায় পড়তে হয়েছে আমাদের। এই যেমন হাতের কাছে কিছু পেলে সেটা ছুড়ে মারা। “

“কিন্তু আপনার বোন তো বলেছে কখনো এরকম কিছু করেননি তিনি।”

“ও সামনে থাকলে কিছু করে না, এজন্যে বলেছে আর কি।” আকিও’র জবাব শুনে অবাক না হয়ে পারল না তরুণ ডিটেকটিভ।

সিঁড়ি বেয়ে কারো নেমে আসার শব্দ ভেসে এলো এসময়।

খানিক বাদে ছেলেকে সাথে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো ইয়াইকো। টিশার্টের উপরে একটা হুডি আর একটা সোয়েটপ্যান্ট পরনে ছেলেটার। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে উদ্ধত ভঙ্গিতে। দেখেই বোঝা যায় কাঁধ ঝুঁকিয়ে হাঁটার অভ্যাস।

“এই যে নাওমি, ওর কথা বলছিলাম আপনাকে,” ইয়াইকো বললো। “নাওমি, এই ভদ্রলোক একজন গোয়েন্দা।”

মা’র আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো মতন ছেলেটা একবার মাথা তুলে দেখলও না মাতসুমিয়াকে।

“দয়া করে একটু সামনে আসবে? তোমার সাথে একটু কথা ছিল,” একটা চেয়ার দেখিয়ে মাতসুমিয়া বলে।

তার কথা শুনে আড়াআড়ি একটা চেয়ারে বসে ছেলেটা। যেন পণ করেছে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাবে না আজ।

“তুমি কি জান কি ঘটেছে?“

আলতো করে মাথা নাড়ে নাওমি। জানে সে।

“কখন জানলে?”

“কেবলই।”

“আরেকটু ভেঙ্গে বলবে?

ঘড়ির দিকে তাকানোর আগে একবার মা’র দিকে তাকালো নাওমি।

“আটটার দিকে।”

“কিভাবে জানলে?”

এবারে জবাব দিল না নাওমি। পুলিশ অফিসারের কথা সে শুনতে পেয়েছে কিনা তা বুঝতে পারছে না আকিও।

“আমাকে এসব প্রশ্ন করা হচ্ছে কেন?” এসময় ওর দিকে তাকিয়ে গোমড়া স্বরে বলে নাওমি।

মাতসুমিয়ার মনে হয় ছেলেটার সাথে আসলেও বোধহয় এসবের সম্পৃক্ততা নেই, সেজন্যেই বিরক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে আকিও ভালো করেই জানে ছেলের অপরাধ সম্পর্কে। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ওর। কিন্তু মুহূর্তে বকাও যাবে না।

“স্যার আমাদের পরিবারের সাথে কথা বলতে চেয়েছেন। দয়া করে তার প্রশ্নের জবাব দাও।”

বিরক্তিভাব আরো প্রকট হলো নাওমির চেহারায়। আকিওর ইচ্ছে করছে ঠাস করে গাল বরাবর একটা চড় বসিয়ে দিতে, নিদেনপক্ষে একটা ধমক দিতে। কোনটাই সম্ভব না।

প্রশ্নের ধরণ পাল্টালো মাতসুমিয়া

“কার কাছ থেকে জেনেছ ঘটনাটার ব্যাপারে?”

“মা আর বাবা, পরে…”

“তারা তোমাকে কি বলেছে, সেটা আমাকে বলতে পারবে?”

নাওমিকে দেখে মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছে সে। ভুলভাল বললে নিজে ফেঁসে যাবে, এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে।

“বলেছে, দাদি নাকি একটা মেয়েকে মেরে ফেলেছে….”

“আর এরপর?” ছেলেটার দিক থেকে নজর সরালো না মাতসুমিয়া।

“এরপর বাবা মেয়েটাকে পার্কে ফেলে রেখে এসেছে। গিঙ্কগো পার্কে। “তারপর?”

“সবকিছু পুলিশকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় কারণ এত বড় একটা ঘটনা ধামাচাপা দেয়া সম্ভব না।”

“এটুকুই?”

আবারো বিরক্তি ভর করলো নাওমির চেহারায়। মা-বাবার দিকে তাকালো সে। মুখ একবার খুলছে আবার বন্ধ করছে। এই মুহূর্তে ছেলেকে একটা তৃষ্ণার্ত কুকুরের মত দেখাচ্ছে আকিওর কাছে। সাধারণত ভুলভাল কিছু করার পর প্রশ্ন করা হলে এরকম আচরণ করে নাওমি। ছোট্ট মেয়েটাকে খুনের ব্যাপারে তার বক্তব্য হচ্ছে, সে দোষের কিছু করেনি। পুলিশের লোকটা এত প্রশ্ন করছে দেখে এখন নিশ্চয়ই মা-বাবা’র প্রতি রাগ হচ্ছে তার।

“আর কিছু বলার আছে তোমার?” মাতসুমিয়া জিজ্ঞেস করে।

“না,” জবাবে বলে নাওমি। “আর কি বলবো!”

একবার মাথা নেড়ে বুকের ওপর হাত বাঁধে তরুণ অফিসার। মুখে হাসির আভাস। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা আরো প্রগাঢ় হয় আকিও’র। মাতসুমিয়ার মনে কি চলছে তা বুঝতে পারছে না সে।

“পুরোটা শুনে কি মনে হয় তোমার?”

“অবাক হয়েছিলাম। “

“হওয়ারই কথা। কিন্তু তোমার কি ধারণা? তোমার দাদীর পক্ষে এরকম কিছু করা সম্ভব?”

“দাদী যেহেতু পাগল হয়ে গেছে, তাই কখন কি করছে সেটা বুঝতে পারে না,” মুখ না তুলেই জবাব দেয় নাওমি।

“এর আগে কখনো কি এরকম কোন কিছু করেছে?“

“করতেও পারে। আমি ঠিক জানি না। বাসায় সাধারণত দেরি করে ফিরি আমি।”

“আচ্ছা। শুক্রবারেও বোধহয় দেরি করে ফিরেছিলে, না?”

জবাব দেয় না নাওমি। আকিওর মতে এবারে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রশ্নটা করেছে মাতসুমিয়া।

“কোথায় ছিলে সেটাও বলো।”

“আচ্ছা, শুনুন…” আর চুপ থাকতে পারল না আকিও। “এর সাথে তো কেসটার কোন সম্পর্ক নেই।”

“দুঃখিত, আপনার কথার সাথে একমত হতে পারছি না। এসব প্রশ্নের জবাব জানতে হবে আমাদের, নতুবা পরে সমস্যা হবে।” শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে কথাগুলো বললো মাতসুমিয়া।

মাথা নেড়ে সায় দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই আকিওর।

“কোথায় ছিলে সেদিন?”

মুখ খুলেই শব্দ করে শ্বাস টানল নাওমি। “একটা ভিডিও গেইম আর্কেডে গিয়েছিলাম, এরপর একটা কনভিনিয়েন্স স্টোরে,” দূর্বল কন্ঠে বলে সে।

“একাই ছিলে পুরোটা সময়?”

“হ্যাঁ।”

“কোন আর্কেডে? আর কোন কনভিনিয়েন্স স্টোরে? সেটা বলতে পারবে?”

নোটপ্যাড আর কলম বের করলো তরুণ অফিসার। এবারে আসলেও ভয় করছে আকিওর। মাতসুমিয়ার চেহারায় এটা স্পষ্ট যে প্রশ্নটার জবাব চাইই চাই তার।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর ঠিকানা দু’টো বললো নাওমি। এই বিষয়ে আগেই কথা হয়েছিল ওদের। যে গেইম আর্কেডটার নাম বললো নাওমি, সেটায় প্রায়ই যায় সে। ওখানে ওর পরিচিত কেউ নেই। কনভিনিয়েন্স স্টোরটায় অবশ্য খুব বেশি একটা যায় না। গেলেই বরং কর্মীরা চিনতে পারত। পুলিশের পক্ষে তখন এটা বের করা কষ্টকর হতো না যে নাওমি ওখানে যায়নি।

“কনভিনিয়েন্স স্টোরটা থেকে কিছু কিনেছিলে?’

“না, শুধু ম্যাগাজিন পড়েছি।”

“আর আর্কেডে কোন গেইমটা খেলেছিলে?”

চমকে উঠলো আকিও। এত কিছু নিয়ে আলাপ হয়নি ওদের। এরকম একটা প্রশ্ন যে করা হতে পারে তা মাথাতেই আসেনি ওদের। ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল যে উপযুক্ত একটা জবাব দেয় সে।

“ড্রাম ম্যানিয়া, ভার্চুয়াল ফাইটার, থ্রিল ড্রাইভ…” অনিশ্চিত স্বরে নামগুলো বললো নাওমি। “আর কয়েকটা স্লট মেশিন গেইম।”

ছেলের বলা কথাগুলোর শেষটুকু কেবল বুঝল আকিওর। অন্যগুলো কি সেটা জানে না। খুব সম্ভব্য নাওমি যে গেইমগুলো খেলে, সেগুলোর নাম।

“বাসায় ফিরেছিলে কখন?”

“আটটা কি ন’টার দিকে। ঘড়ি দেখিনি।“

“আর স্কুল থেকে বের হয়েছিলে কখন?”

“চারটার দিকে বোধহয়। “

“বন্ধু-বান্ধব কেউ ছিল তোমার সাথে? “না, একাই।”

“সবসময় কি বাসায় একাই ফেরো?”

“হ্যাঁ।”

এবারে নাওমির কথা বলার ধরণে বিরক্তিভাব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এসব থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার ইচ্ছে তার। তাছাড়া মাতসুমিয়া এমন কিছু প্রশ্ন করছে, যা শুনে তার খারাপ লাগার সম্ভাবনাই বেশি।

নাওমির কোন বন্ধু নেই। এলিমেন্টারি স্কুলেও ছিল না। বিভিন্ন গেইমিং আর্কেড আর কনভিনিয়েন্স স্টোরে একাই যায় সে। যদি আসলেও কোন বন্ধুবান্ধব থাকতো, তাহলে আজকে হয়তো এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না ওদের।

“স্কুল থেকে যদি চারটার দিকে বের হও, তাহলে চার ঘন্টা একাই ছিলে?” ফিসফিস করে বলে মাতসুমিয়া, যেন নিজের সাথেই কথা বলছে।

“এরকমটা প্রায়ই করে ও,” ইয়াইকো বললো। “আমি সবসময় বলি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে, কিন্তু কথা শোনে না।”

“এখনকার ছেলেমেয়েরা এরকমই,” বলে নাওমির দিকে তাকায় মাতসুমিয়া। “স্কুল থেকে বের হয়ে বাসায় আসার আগ পর্যন্ত পরিচিত কারো সাথে কি দেখা হয়েছিল তোমার সেদিন?”

“না,” সাথে সাথে জবাব দেয় ছেলেটা।

“আর্কেড বা কনভিনিয়েন্স স্টোরটায় এমন কিছু ঘটেছিল যেটা তোমার মনে আছে? এই যেমন কোন মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়া বা কারো ঝগড়া?“

মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে দিল নাওমি। “ঠিক মনে নেই, ওরকম কিছু ঘটেনি খুব সম্ভবত।”

“বেশ।”

“ইয়ে….” আকিও বলে এবারে, “ও যে ওসব জায়গায় গেছে, এটা প্রমাণ না করতে পারলে কি অসুবিধে হবে?”

“না, আমি আসলে সেজন্যে প্রশ্নগুলো করিনি। তবে প্রমাণ থাকলে ভালো হতো।”

“কেন?”

“তখন ওকে আর কোন প্রশ্ন করতে হতো না আমাদের। কিন্তু এমনটা হলে আবারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আপনার ছেলেকে।”

““ওর সাথে এসবের কোন সম্পর্ক নেই, বিশ্বাস করুন আমার কথা। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে মাতসুমিয়া। “বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মা-বাবা বাদেও তৃতীয় একজন প্রত্যক্ষদর্শী থাকতে হয়।”

“আমরা মিথ্যে বলছি না। পুরো ঘটনার সাথে আমাদের ছেলের কোন সম্পর্ক নেই। ওকে তো ইতিমধ্যে যা যা প্রশ্ন করার, করেই ফেলেছেন।”

“ও যদি সত্য কথা বলে থাকে, তাহলে আমরা সেটার প্রমাণ কোন না কোন আবে পাবই। কনভিনিয়েন্স স্টোরগুলোতে ক্যামেরা থাকে সাধারণত। আর্কেডগুলোতেও থাকে ইদানিং। এত লম্বা সময় ওখান থাকলে কোন কোন ক্যামেরাতে ধরা পড়ার কথা।”

কথাটা শুনে থমকে গেল আকিও। এই ভাবনাটাও মাথায় আসেনি ওর।

নাওমির দিকে ফিরল মাতসুমিয়া।

“ভিডিও গেইম খেলতে তাহলে ভালো লাগে তোমার?

মাথা নেড়ে সায় দেয় আকিও।

“কম্পিউটারেও খেল?”

এবারে জবাব দিল না নাওমি। ছেলের এই গোয়ার্তুমি এখন অসহ্য ঠেকছে আকিওর। খুনের সাথে সম্পর্কিত নয়, এরকম প্রশ্নের জবাব স্বাভাবিক দিলে কি সমস্যা নাওমির তা বুঝতে পারছে না।

“হ্যাঁ, কম্পিউটারেও খেলে ও,“ ছেলের হয়ে জবাব দেয় ইয়াইকো।

“ওর কি নিজের কম্পিউটার আছে?“

“নিজের বলতে পুরনো একটা কম্পিউটার। আমাদের পরিচিত একজন কয়েক বছর ব্যবহারের পর দিয়ে দিয়েছে, তার আর দরকার নেই।”

“বাহ, ভাল তো। এখনকার বাচ্চারা ভাগ্যবান, বলতেই হবে,” নাওমির দিকে তাকিয়ে বলে মাতসুমিয়া। “আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। এখন রুমে যেতে পার।”

কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নাওমি। কিছুক্ষণ পর তার ঘরের দরজা বন্ধের শব্দ কানে এলো ওদের।

আকিও এক প্রকার নিশ্চিত যে পুলিশ অফিসার ওর ছেলের কথা বিশ্বাস করেনি, কিন্তু সন্দেহের কারণটাও ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। হয়তো নাওমির কোন অ্যালিবাই নেই, এটাই মূল কারণ

স্ত্রী’র দিকে তাকালো ও। তার চোখেও একটা মরিয়া ভাব। দু’জনের মাথায় আসলে একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু একটা করতে হবে ওকে। আলতো করে একবার মাথা নাড়ল আকিও। মাথার চাকাগুলো ঘুরছে বনবন করে।

পুলিশের লোকটা নাওমিকে হয়তো সন্দেহ করেছে, কিন্তু তাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই। ওরা তিনজনই যদি মুখ বন্ধ রাখে, তাহলে কিছুই করতে পারবে না পুলিশ। আর আকিও যেহেতু বলেই দিয়েছে যে খুনটা ওর মা করেছে, তাই না বিশ্বাস করার মত কিছু নেই। কোন সার্ভেইলেন্স ক্যামেরায় নাওমির ভিডিও না পাওয়া গেলেও এটা প্রমাণ হয় না যে মিথ্যে বলেছে। আর মিথ্যে বললেও সে খুনী হয়ে যায় না।

কোন অবস্থাতেই এখন বক্তব্য পাল্টানো চলবে না ওদের। আকিও এসব ভাবছে এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।

“এই সময়ে আবার কে এলো?” না বলে পারল না ও।

“কোন ডেলিভারি বয় হয়তো,” ইন্টারকমের দিকে এগিয়ে বলে ইয়াইকো।

“এখন দরজা খোলার কোন দরকার নেই। বলে দাও পরে আসতে।”

হ্যান্ডসেট উঠিয়ে গেটের বাইরে থাকা ব্যক্তির সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো ইয়াইকো, এরপর তাকাল স্বামীর দিকে। লজ্জা ভর করেছে তার চোখমুখে।

“তোমার বোন…”

“আমার বোন?” হারুমি এই মুহূর্তে কেন এলো তা বোধগম্য হলো না আকিওর।

“উনি আমার সহকর্মীর সাথে এসেছেন। ভেতরে ঢুকতে দিন, প্লিজ,“ মাতসুমিয়া বললো ওদের উদ্দেশ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *