অধ্যায় ২১
বাস স্টেশন থেকে একশো মিটার দূরে একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় থাকে কাসুগাই পরিবার। পুলিশ সদস্যদের সাথে সকাল সকালই কথা বলতে সম্মত হয়েছে তাদাহিকো কাসুগাই। তার সহযোগিতায় তদন্তের গতি যদি তরান্বিত হয়, তবে সেটাই করতে রাজি সে। গতদিনের তুলনায় আজকে তুলনামূলক শান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
“আপনার স্ত্রী কেমন আছে?” মাতসুমিয়া জিজ্ঞেস করে। গতদিন ভদ্রমহিলার সেই নিঃশব্দ কান্না এখনো ভোলেনি ও।
“ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে? নিয়ে আসব? এখন কথা বলতে পারবে।”
“জ্বি, নিয়ে আসুন,” কাগা বলে।
ভাইয়ের কথা শুনে কিছুটা অবাকই হলো মাতসুমিয়া। মহিলাকে এরকম অবস্থায় কোন প্রশ্ন না করার পক্ষপাতী ও।
“একটু অপেক্ষা করুন,” বলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল কাসুগাই।
“বেচারি এখনও নিশ্চয়ই সামলে উঠতে পারেনি…” বিড়বিড় করে বলে মাতসুমিয়া।
“খুব সম্ভবত, কিন্তু আমাদের হাতে আর কোন উপায় নেই। মেয়েকে তার চেয়ে ভালো করে নিশ্চয়ই আর কেউ চেনে না। গতকাল ইউনা কি কি করেছে সেই ব্যাপারেও তার ধারণা সবচেয়ে ভালো হবার কথা। মি. কাসুগাই বাইরে থাকায় তার পক্ষে খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব না,” গোটা ঘরে চোখ বুলিয়ে বললো কাগা।
ভাইয়ের মতন মাতসুমিয়াও চারপাশে নজর বুলালো একবার। ঘরটায় আসবাব বলতে একটা টেবিল, চেয়ার, সোফা আর টিভি। দেয়ালের তাকগুলো ভর্তি সিনেমা আর নানারকম কার্টুনের ডিভিডি। ওগুলো নিশ্চয়ই বাচ্চা মেয়েটা পছন্দ করতো, ভাবে ও।
রেস্তোরাঁ থেকে কিনে আনা দু’টো লাঞ্চবক্স পড়ে আছে টেবিলের উপরে। একটা খোলা হয়েছে কেবল। আরেকটা এখনও প্যাকেটে মোড়ানো। গত রাতের দু’জনের খাবার।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এল কাসুগাই। সাথে ছোটখাট এক ভদ্রমহিলা। চুলগুলো পেছনে টেনে পনিটেইল স্টাইলে বাঁধা আর চোখে চশমা তার। হালকা লিপস্টিক বাদে চেহারায় আর কোন মেকআপ নেই। অতিরিক্ত কান্নার কারণে মুখ ফুলে আছে।
“আমার স্ত্রী, নাতসুকো,” কাসুগাই পরিচয় করিয়ে দিল ওদের সাথে। নিজেদের পরিচয় দিল মাতসুমিয়া আর কাগা।
“চা খাবেন আপনারা?”
“না, না। ওসবের কোন দরকার নেই। বসুন প্লিজ। আপনাকে এখন বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।”
“তদন্ত কি চলছে?” দূর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে নাতসুকো।
“হ্যাঁ, কিন্তু এখনও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। এই যেমন আমরা এখনো বুঝতে পারছি না আপনাদের মেয়ে কেন বাইরে বের হয়েছিল গতকাল। এরকমটা কি প্রায়ই ঘটে?”
জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করলো ভদ্রমহিলা। “আমি সবসময়ই ওকে বলেছি কোথাও যাওয়ার আগে অবশ্যই আমাকে বলতে, কিন্তু মাঝে মাঝে বেরিয়ে যেত ও। কথা শুনতো না। এলিমেন্টারি স্কুলে ওঠার পর
এই অভ্যেস হয়েছে। বাইরে বন্ধুদের সাথে খেলতে যেত।”
“শুক্রবারেও কি সেজন্যেই বেরিয়েছিল?
““না, খুব সম্ভবত। ও সাধারণত যাদের সাথে খেলে, তাদের সবার সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কারো সাথেই দেখা হয়নি ইউনার সেদিন।”
“বাইরে যাওয়ার পর একটা পর্যায়ে আইসক্রিম কিনেছিল ও। আপনার কি মনে হয়? সেজন্যেই বেরিয়েছিল?“
“আমাদের ফ্রিজে আইসক্রিম থাকেই সবসময়,“ ঘাড় একদিকে কাত করে বলে নাতসুকো।
“ওর কাছে কি কোন মোবাইল ফোন ছিল?”
মাথা ঝাঁকায় ইউনার মা। “না, ইচ্ছে করেই কিনে দেইনি আমরা। এই বয়সে মোবাইল ফোন….বুঝতেই পারছেন। যদি জানতাম আমার বাচ্চার সাথে এমন কিছু হবে, তাহলে অবশ্যই কিনে দিতাম,” ছলছল চোখে বলে নাতসুকো।
“আসলে, মোবাইল ফোন থাকলেই যে বেঁচে যেত, এমন নয় ব্যাপারটা। অনেক সময় ফোনই বিপদ ডেকে আনে,” স্বান্তনার সুরে বলে কাগা। “ওর কোন বন্ধুর কি ফোন ছিল?”
“ছিল বোধহয়।”
ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই নিশ্চয়ই কিনে দিয়েছে বাবা-মায়েরা, ভাবে মাতসুমিয়া। ফোনের জিপিএস লোকেশন দিয়ে বাচ্চাদের সার্বক্ষণিক অবস্থান জানা যায়। কিন্তু কাগাও ভুল বলেনি, এই ফোনই অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে।
“ইউনার কি নিজের রুম ছিল?”
“জ্বি।”
“দেখতে পারি আমরা?”
সম্মতির আশায় স্বামীর দিকে তাকায় নাতসুকো।
“নিশ্চয়ই, চলুন দেখাচ্ছি,” উঠে দাঁড়িয়ে বলে কাসুগাই।
ছোট্ট বেডরুমটার তাক ভর্তি সুপার প্রিন্সেস নামের একটা কার্টুন চরিত্রের বিভিন্ন আকৃতির পুতুল।
“সুপার প্রিন্সেসের বড় ভক্ত দেখি,” বলে মো।
“হ্যাঁ, খুব পছন্দ ছিল ওর,” কাঁদো কাঁদো গলায় বলে নাতসুকো। “সুপার প্রিন্সেস?” কাগার কন্ঠস্বরে পরিষ্কার যে সে চিনতে পারেনি।
“একটা অ্যানিমের চরিত্র,” মাতসুমিয়া বলে।
“আপনাদের টিভির পাশের ডিভিডিগুলোও কি সুপার প্রিন্সেস শো’এর?”
“হ্যাঁ! প্রতিদনই ওগুলো দেখত ও। অনেকগুলো অ্যাকশন ফিগার আর পুতুলও সংগ্রহ করেছে। কিছুদিন পরপরই বায়না ধরতো নতুন একটা কিনে দেয়ার।” ইউনার টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কাগা। সবকিছু সুন্দরমত গুছিয়ে রাখা। স্কুলের ব্যাজটা শোভা পাচ্ছে উপরের দিকে। স্কুলে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই পরে যেত।
“এটা কি?” প্রশ্ন করে কাগা।
“ওর স্কুলের ব্যাজ।”
“না, আমি এই লেখাগুলোর কথা বলছি। দেখে তো একটা ঠিকানা বা ফোন নম্বর বলে মনে হচ্ছে।”
ব্যাজটা ঘুরিয়ে দেখাল কাগা। আসলেও একটা ফোন নম্বর আর ইমেইল অ্যাড্রেস লিখে রাখা হয়েছে ওখানে।
“এগুলো আমাদের ফোন নম্বর আর ইমেইল অ্যাড্রেস,” কাসুগাই বলে।
“আপনাদের দু’জনেরই মোবাইল ফোন আছে?”
“হ্যাঁ। সেজন্যেই দু’জনের নম্বর লিখে রেখেছি এখানে। জরুরি প্রয়োজনে যেন যোগাযোগ করতে পারে।”
“কিন্তু এখানে তো ইমেইল অ্যাড্রেস তিনটা।“
“জ্বি, একটা কম্পিউটারে ব্যবহার করি আমরা। অন্য দু’টো ফোনের। “ “আপনাদের কম্পিউটারটা কোথায়?”
“আমাদের বেডরুমে।”
“ইউনা কি ব্যবহার করতো ওটা?”
“মাঝেমধ্যে ইন্টারনেটে এটাসেটা দেখতাম আমরা।”
“অর্থাৎ, একা একা কম্পিউটার চালাত না ও?“
“না। কি বলো তুমি?” স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে কাসুগাই। “কক্ষনো না,” নাতসুকো জবাব দেয়।
“আপনারা শেষবার কম্পিউটারে বসেছিলেন কখন?”
“গত রাতে। কোন ইমেইল এসেছে কিনা দেখছিলাম।”
“উল্টোপাল্টা কিছু চোখে পড়েছিল?”
“উল্টোপাল্টা মানে? “
“এমন কোন ইমেইল, যেটা একটু অদ্ভুত মনে হয়েছে আপনার কাছে।”
“না, সেরকম কিছু চোখে পড়েনি। কেন? আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন?”
“নাহ,” হাত নেড়ে বলে কাগা। “কিন্তু আমাদের হয়তো আপনাদের কম্পিউটারটা চালিয়ে দেখতে হতে পারে। কোন সমস্যা হবে কি?”
“এতে যদি আপনাদের সাহায্য হয়, তাহলে নিশ্চয়ই…” জবাব দেয় কাসুগাই। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে না বিষয়টা খুব একটা পছন্দ হয়েছে।
“আমরা যদি আসলেও কম্পিউটারটা নিয়ে যাই, তাহলে অবশ্যই আপনাদের কারণ জানানো হবে,” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে কাগা। “আপনাদের এতক্ষণ ধরে বিরক্ত করা জন্যে দুঃখিত। আসলে কথা না বললে হচ্ছিল না।”
কাসুগাইরা বুঝতে পারে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শেষ। মাথা নিচু করে ধন্যবাদ জানায় দু’জনে। তাদের চেহারায় বিষাদের প্রগাঢ় ছায়া নজর এড়ায় না মাতসুমিয়ার।
“কোবায়াশিকে ফোন দাও, “ বিল্ডিংটা থেকে বের হওয়া মাত্র বলে কাগা।
“কম্পিউটারটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।”
“তোমার কি ধারণা? খুনীর সাথে ইন্টারনেটে যোগাযোগ হয়েছিল মেয়েটার?”
“হতেই পারে।”
“কিন্তু কাসুগাইরা তো বললো একা একা কম্পিউটার চালাত না ইউনা।“ জবাবে একবার কাঁধ ঝাঁকায় কাগা।
“তাদের মুখের কথা মেনে নিলে চলবে না এক্ষেত্রে। বাচ্চারা আমাদের কল্পনার তুলনায় অনেক বুদ্ধিমান। বড়দের অনেক কাজ অনায়াসে করে ফেলতে পারে। বিশেষ করে সেই কাজটা করে যদি মজা পায়। ইমেইল পাঠিয়ে সেটা হপিস করে ফেলা খুব একটা কঠিন কিছু না।”
ভাইয়ের সাথে এই বিষয়ে একমত মাতসুমিয়া। ইদানিং এমন অনেক কেস আসছে যেখানে বাচ্চাদের গোপনে ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করা মাত্র বেজে উঠলো সেটা। কোবায়াশিই ফোন দিয়েছে।
“হ্যালো, আপনাকেই ফোন দিচ্ছিলাম।“
“কেন?”
সংক্ষেপে সব খুলে বললো মাতসুমিয়া।
“ঠিক আছে। আমি এখনই লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“আমরা কি এখানেই থাকব?”
“না, তোমাদের অন্য এক জায়গায় যেতে হবে।”
“কোথায়?”
“মায়েহারাদের ওখানে।”
“কিছু জানতে পেরেছেন?”
“না। আসলে ওরাই ফোন দিয়েছিল।“
“কি? ওরা ফোন দিয়েছিল?” কোবায়াশির কথার পুনরাবৃত্তি করে মাতসুমিয়া।
“কিছুক্ষণ আগে আকিও মায়েহারা ফোন দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তাদের বাসায় যেতে বলে আমাদের। গিঙ্কগো পার্কে খুঁজে পাওয়া মেয়েটাকে নিয়ে নাকি কিছু বলার আছে তার।”