অধ্যায় ২
আকিও মায়েহারা কেবলই পরবর্তী মিটিংয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলোর খসড়া তৈরি করে কম্পিউটার বন্ধ করবে কিনা ভাবছে, এসময় তার সহকর্মী ইয়ামামোতো এসে টেবিলের উপরে ব্রিফকেসটা রাখলো।
“চলে যাচ্ছো?”
তারা দু’জন একই বছর কোম্পানিতে ঢুকেছে। কাজের ধরণও প্রায় এক
“হ্যাঁ, কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। কিন্তু ওগুলো আগামী সপ্তাহে করবো। তুমি আরো থাকবে নাকি? আজ তো শুক্রবার! দেরিও হয়ে গেছে অনেক।”
সামনে ঝুঁকে আকিও’র কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকালো ইয়ামামোতো। “ওরে বাবা, তুমি দেখি আগামী সপ্তাহের মিটিংটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছ।”
“আগে শেষ করে রাখলে পরে চাপ কম হবে।”
“তুমি পারোও বটে! তাই বলে শুক্রবারেও ওভারটাইম করবে? পয়সা কিন্তু পাবে না ভাই।”
“এমনিই এগিয়ে রাখছি কাজটা, আর কিছু না।” ফাইলটা সেভ করে আকিও। “আজকে রাতে কোন প্ল্যান আছে নাকি? বারে যাবে?”
“সরি, আজকে হবে না। আমার বউ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলে দিয়েছে। ওর বাড়ি থেকে লোক আসবে।”
“আহহা!”
“পরে একদিন যাব। তুমিও বেশি দেরি কোরো না। ইদানিং তো আগে বেরই হও না।”
“হই মাঝে মাঝে,” মুখে হাসি টেনে জবাব দেয় আকিও। ইয়ামামোতো নিজের চরকায় তেল দিলেই বেশি খুশি হতো সে।
“দেখো, শরীরের উপর বেশি চাপ দিও না। সোমবার দেখা হবে। আসি।” বেরিয়ে গেল ইয়ামামোতো।
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় আকিও। সোয়া ছয়টার মত বাজছে। সেলস
ডিপার্টমেন্টে চার পাঁচজন কর্মী বাদে আর কেউ নেই। এর মধ্য দু’জন ওর সেকশনে। একজনের বয়স কম, দুই বছর আগে যোগ দিয়েছে কাজে। তার সাথে খুব একটা কথা হয় না আকিওর। আর অন্যজন তার তিন বছর পরে চাকরিতে ঢুকেছে, কিন্তু অ্যালকোহল এড়িয়ে চলে। মোদ্দা কথা, তাদের কাউকেই আজকে রাতে একসাথে ড্রিঙ্ক করার জন্যে আমন্ত্রন জানাতে পারবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিল সে। অগত্যা বাড়িতেই ফিরতে হবে আজকে মনে হচ্ছে।
এসময় হঠাৎ বেজে উঠলো আকিওর মোবাইল ফোনটা। বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছে। স্ক্রিনে নম্বরটা দেখেই কুডাক দিল তার মনে। এই সময়ে তো ফোন আসার কথা না। কি হলো?
“হ্যালো।”
“আকিও? হ্যালো।”
“হ্যাঁ, বলো।”
“ইয়ে….একটু সমস্যা হয়েছে, আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো।”
কথা বলার সময় কাঁপছে ইয়াকো’র কন্ঠস্বর। ভয় পেলে বা আতঙ্কিত হলে এভাবে কথা বলে সে। চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো আকিও। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে অকস্মাৎ।
“এখন তো কাজ আছে। বের হতে পারব না।”
“পারবে না? খুব সমস্যা হয়ে যাবে তাহলে।”
“কি সমস্যা? কি হয়েছে?”
“ফোনে বলতে পারবো না। আসলে বিষয়টা নিয়ে কিভাবে কথা বলবো বুঝতে পারছি না। এক্ষুনি চলে এসো, প্লিজ।”
অনিয়মিত শ্বাস ফেলছে ইয়াইকো। কিছু একটা নিয়ে আসলেও উদ্বিগ্ন সে।
“হয়েছেটা কি? বলবে তো আমাকে!”
“ইয়ে…মানে….খুব খারাপ একটা ব্যাপার ঘটে গেছে।”
“আরে বাবা! সেই খারাপ ব্যাপারটা কি? পরিষ্কার করে বলো!”
ওপাশে চুপ হয়ে গেল ইয়াইকো। প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে আকিও। ধমকে উঠতে যাচ্ছিল এসময় টের পেল কাঁদছে ওর স্ত্রী। কপালের শিরাগুলো দপদপ করতে লাগলো এবারে।
ফোন যে রেখে দিবে, সেটাও পারছে না।
“শোনো…”
“কি?”
“আজকে হারুমিকে আসতে না বলে দাও।”
“কেন? ও আসলে সমস্যা নাকি?
“হ্যাঁ।”
“তাহলে তুমি ফোন করে বলে দাও। এমন কোন কঠিন কাজ তো না।”
“হ্যাঁ, কিন্তু…” কথাটা শেষ করলো না ইয়াইকো, ভাবগতিক দেখে মনে
হচ্ছে তার মাথা কাজ করছে না।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ফোন করে বলে দিব কিছু একটা।”
“বোলো কিন্তু। প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসো।”
“আচ্ছা, আসছি,” বলে ফোন কেটে দিল আকিও।
ওর তিন বছর পর কাজে যোগ দেয়া সেই সহকর্মী নিজের ডেস্ক থেকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সম্ভবত পুরো কথোপকথনটাই কানে গেছে তার।
“কোন সমস্যা?”
“বুঝতে পারছি না। বউ বললো এখনই বাসায় ফিরতে। কিন্তু কি দরকার সেটা বললো না। আচ্ছা, আমি আসি।“
“ঠিক আছে। সোমবার দেখা হবে!”
সহকর্মীর অভিব্যক্তিতে এটা স্পষ্ট যে আকিও এত দেরিতেও কেন অফিসে রয়ে গেছে তা বুঝতে পারছে না সে।
ও যে বাল্ব কোম্পানিটায় চাকরি করে সেটার হেডঅফিস চুয়ো ওয়ার্ডের কায়াবাচোতে। সাবওয়ে স্টেশনের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় মোবাইল থেকে বোন হারুমির নম্বরে ফোন দিল। ওর থেকে চার বছরের ছোট সে। বিবাহিত।
দুই বার রিং হতেই ফোন ধরলো হারুমি।
“কিছু হয়েছে নাকি?” ভাইয়ের কন্ঠস্বর শুনে দ্বিধান্বিত স্বরে জানতে চাইলো সে।
নিশ্চয়ই ওদের মা’কে নিয়ে ভালোমন্দ কিছু একটা ভাবছে।
“না, ওরকম কিছু না। কিন্তু কেবলই ইয়াইকো ফোন দিয়ে বললো যে মা ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই তোর আজকে আসতে হবে না। এমনি এমনি ঘুম ভাঙ্গিয়ে কাজ নেই।
“তাহলে…“
“আজকে আসার দরকার নেই কষ্ট করে। কাল আসিস।”
“কাল তাহলে একই সময়ে আসবো? “
“হ্যাঁ।”
“ভালোই হলো। আজকে ব্যস্ততা একটু বেশি এখানে।”
খুব সম্ভবত ক্যাশ রেজিস্টার সামলানোর কথা বললো হারুমি। তার স্বামীর একটা ফ্যাশন বুটিক আছে।
“জানি, তুই ব্যস্ত থাকিস। সব কাজ সামলে সময় বের করা সহজ না।”
“অতটাও আবার ব্যস্ত না,” শান্ত কন্ঠে বলে হারুমি।
তার কন্ঠস্বর শুনেই আকিও বুঝে গেল যে পরে আবার ফোন দিয়ে কোন অজুহাত দেয়া যাবে না।
“আগামীকাল দেখা হবে তাহলে,” বলে কলটা কেটে দিল ও।
সাবওয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটার পথে মনে পড়লো ছাতাটা অফিসে ফেলে রেখে এসেছে। সকালে অফিসে আসার সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। পরে কখন বৃষ্টি থেমেছে তা বলতে পারবে না। সারাদিনে আর অফিস থেকে বের হয়নি। এখন আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। এই নিয়ে তিনটা ছাতার কথা ভুলে গেল এভাবে।
ইকেবুকুরোতে চলে এলো আকিও। মাঝে একবার লাইন বদলিয়েছে। এখান থেকে সেইবু লাইনের ট্রেনে উঠতে হবে। সবসময়ের মতনই প্রচন্ড ভিড়। আশপাশের যাত্রীদের বিরক্ত না করে একবার হাত নাড়ার সুযোগটাও নেই, এমন গাদাগাদি করে উঠেছে সবাই। মাঝ এপ্রিলের তুলনায় গরমটা বেশি। সবার মুখ ঘর্মাক্ত।
একটা হ্যান্ডরেইল কোনমতে ধরে ঝুলে পড়লো ও। সামনের জানালার কাঁচের নিজের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে। চেহারাতে ক্লান্তি স্পষ্ট। অপরিচিত কেউ দেখে ভাববে ওর বয়স পঞ্চাশ। মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে, চোখের নিচে ফোলা ভাবটা এখন নিত্যসঙ্গী। অগত্যা চোখ বন্ধ করে ফেললো আকিও, দৃশ্যটা দেখতে চাইছে না।
স্ত্রী’র ফোনে বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবছে। হয়েছেটা কি আসলে? অসময়ে ফোন পেয়ে প্রথমেই মাথায় এসেছিল ওর মা, মাসায়ের কথা। কিছু হয়নি তো তার? সেক্ষেত্রে ইয়াইকো নিশ্চয়ই কিছু বলতো। এত ঢাকঢাক গুড়গুড়ের কোন দরকার ছিল না। তার উপরে হারুমিকে আসতে না বলে দিয়েছে, অর্থাৎ মাসায়ের কিছু হবার সম্ভাবনা বাদ দেয়া যায়।
চেহারায় চিন্তার ছাপ আগের চেয়ে প্রকট হলো আকিওর। ইয়াইকো আবার নতুন করে কি কথা শোনায় কে জানে। ভাবতেই বিরক্ত লাগছে। প্রতিদিন বাসায় ফিরেই এসব শুনতে হয় এখন। এক কথাই বারবার বলে ইয়াইকো। কাজ করতে করতে সে ক্লান্ত। মাঝে মাঝে কথা বলার ভঙ্গিতে মরিয়া ভাবটাও টের পায় আকিও। রাগত স্বরে বলা কথাগুলো শুনে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না ও, এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। আর একবার যদি ইয়াইকোর মনে হয় তার কথা বিশ্বাস করছে না আকিও, তাহলে কথা শোনানোর মাত্রা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
জরুরি কোন কাজ না থাকলেও অফিসে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় থাকে আকিও, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। জানে যে ওখানে গিয়ে শান্তি পাবে না। শারীরিক ভাবে না, মানসিক ভাবেও না।
ওর মা যে ওদের সাথে থাকে, এটা নিয়ে এখন প্রায়ই আফসোস হয়। কিন্তু বিকল্প কোন উপায় নেই। নিজের মায়ের সাথে তো আর সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না।
তবুও, একটু যদি অন্যরকম হতো পরিস্থিতি…
কারো সাথে এসব ব্যাপারে লম্বা সময় ধরে কথা বলতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু সেরকম কেউ নেই।