রেড ফিঙ্গার – ১৭

অধ্যায় ১৭

মায়েহারাদের ঠিকানার উল্টোদিকে তুলনামূলক সাদা রঙের একটা বাড়ি। ওটা পরিবারের বসবাস সেখানে। তাদের ইন্টারকমের বাটনে চাপ দেয়ার কিছুক্ষণ পর এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো কিছুক্ষণ পর। পুলিশ থেকে এসেছে এটা জানালো। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সী এক ভদ্রমহিলাকে পোর্চে দেখা গেল মিনিট দুয়েক বাদে। “আপনাদের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ছিল। মায়েহারাদের কথা বলছি।”

“জ্বি, বলুন,” সাবধানী কন্ঠে বললো মহিলা। কিন্তু তার দৃষ্টিতে খেলা করছে কৌতূহল। আমাদের সাথে কথা বলতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই, ভাবে মাতসুমিয়া। “তাদের মধ্যে কি পরিবর্তন লক্ষ করেছেন, বিশেষ করে গত দুই-তিন দিনের মধ্যে?”

মাথা কাত করে কিছুক্ষণ ভাবে মিসেস ওটা।

“আপনারা বলার পর মনে হলো, মিসেস মায়েহারাকে গত দুই দিনে খুব একটা দেখনি আমি। সাধারণত প্রতিদিনই কথা হয় আমাদের। আপনারা কি ওই ছোট মেয়েটার খুনের তদন্তে এখানে এসেছেন?”

“দুঃখিত ম্যাম, এই মুহূর্তে আপনাকে সেই ব্যাপারে কিছু জানাতে পারছি না আমরা। আপনি কি মি. মায়েহারাকেও চেনেন?”

“হ্যাঁ, দেখা হয়েছে কয়েকবার।”

“তার সম্পর্কে একটু বলুন।”

“বেশ চুপচাপ। তবে মিসেস মায়েহারা খুব চটপটে স্বভাবের, এজন্যেই বোধহয় একটু বেশি চুপচাপ মনে হয় তাকে।”

“তাদের একটা ছেলে আছে না খুব সম্ভবত, হাই স্কুলে পড়ে?”

“হ্যাঁ, নাওমি। ওকেও চিনি?”

“কেমন ছেলেটা?”

‘একদম স্বাভাবিক। শান্ত। আমরা যখন এখানে আসি, তখন এলিমেন্টারি স্কুলের ছাত্র ছিল। তবে ওকে কখনো বাইরে খেলতে দেখিনি। এলাকার ছেলেমেয়েরা আমাদের বাড়ির সামনে প্রায়ই ফুটবল বা বেইজবল খেলে। খেলার সময় মাঝে মাঝে বল আমাদের উঠানে এসে পড়ে, কিন্তু নাওমিকে কখনো আমাদের এখান থেকে বল নিয়ে যেতে দেখিনি।”

ভদ্রমহিলা গত দুই দিনে বলার মত কিছু ঘটতে দেখেনি খুব সম্ভবত, মাতসুমিয়া ভাবে। এমনি সময় নষ্ট হচ্ছে।

“তবে মায়েহারাদের জীবন কিন্তু সহজ নয়,” মিসেস ওটা বলে এসময় “কিভাবে?”

“মি. মায়েহারার মা থাকেন ওনাদের সাথে। উনার অসুখের কথা জানেন বোধহয়।”

“জ্বি।”

“মিসেস মায়েহারা বলেছিল আমাকে। এরকম অবস্থায় কোন বৃদ্ধাশ্রম বা বিশেষায়িত হাসপাতালে রাখা গেলে ভালো হতো। কিন্তু উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। তাছাড়া মি. মায়েহারা এবং তার বোনও রাজি নন মা’কে অন্য কোথায় রাখতে। ভদ্রমহিলা এত দ্রুত অসুখে পড়ে গেলেন। আলঝেইমার’স। আগে কিন্তু অনেক মিশুক স্বভাবের ছিলেন। ছেলের পরিবার থাকতে আসার কিছুদিন পরেই সমস্যা দেখা দিল।”

মাতসুমিয়া এমনটা আগেও শুনেছে যে স্বাভাবিক পরিবেশের পরিবর্তন ঘটলে অনেক সময় গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনে। একটা পর্যায়ের পর মানুষ আর নতুন কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারে না।

“যাইহোক,” মুখে হাসি টেনে বললো মিসেস ওটা। “মিসেস মায়েহারার জন্যে সংসার সামলানো সহজ নয়। কিন্তু এরকম আরো অনেক পরিবার আছে। তাছাড়া তার সবকিছু করতেও হয় না।”

“মানে?”

“মি. মায়েহারার বোন প্রায় প্রতি রাতেই আসেন মায়ের দেখাশোনা করতে। তাকেও কম ঝক্কি পোহাতে হয় না।”

“মি. মায়েহারার বোন? উনি এই এলাকাতেই থাকেন?”

“হ্যাঁ। স্টেশনের সামনে তাদের একটা ফ্যাশন বুটিকের দোকান আছে। ‘তাজিমা’ নাম।”

“শুক্রবার সন্ধ্যায় এসেছিলেন তিনি?” এবার কাগা করলো প্রশ্নটা। “শুক্রবার সন্ধ্যায়? ইয়ে…” বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর মাথা ঝাঁকালো মিসেস ওটা। “সেটা মনে পড়ছে না।”

“সমস্যা নেই,” হেসে বলে কাগা।

“আপনাদের কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে, গত দুই দিনে তাকে দেখিনি। সবসময় ছোট একটা গাড়ি নিয়ে আসে সে। বাড়ির সামনেই পার্ক করে রাখে গাড়িটা। কিন্তু ওই গাড়িটা চোখে পড়েনি আমার।”

“গাড়িটা তাহলে দেখেননি আপনি?” আগের ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে কাগা। কিছু একটা ঘুরছে তার মাথায়।

মাতসুমিয়ার মনে হলো ওদের আর কিছু জানার নেই ভদ্রমহিলার কাছ থেকে।

“সাহায্যের জন্যে আপনাকে…”

“তানাকাদের চেনেন আপনি?” মাতসুমিয়ার কথার মাঝেই বললো কাগা। বিস্ময় ফুটল মিসেস ওটার চেহারায়। মাতসুমিয়াও অবাক হয়েছে। নামটা কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না ও।

“মায়েহারাদের বামদিকের বাসায় যারা থাকেন, তাদের কথা বলছি,” কাগা বললো। “উনাদের ক্ষেত্রে কি অদ্ভুত কিছু চোখে পড়েছে আপনার? মি. তানাকা তো এই এলাকার কল্যাণ সমিতির সভাপতি ছিলেন খুব সম্ভবত?”

“ঠিক বলেছেন। এই এলাকায় আসার পর উনাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমরা। অনেক দিন আগের কথা অবশ্য।”

তানাকাদের সম্পর্কে আরো কয়েকটা প্রশ্ন করলো কাগা। রাস্তাটার অন্য বাড়িগুলোতে যারা থাকে, তাদের নিয়েও প্রশ্ন করতে ছাড়ল না। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের সাথে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল মিসেস ওটা।

“অন্য পরিবারগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কেন?” ওটাদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পর জিজ্ঞেস করে মাতসুমিয়া। “কোন দরকার ছিল না তো।”

“আসলেও দরকার ছিল না,” কালক্ষেপণ না করে বলে কাগা।

“তাহলে…কেন…?”

থেমে ভাইয়ের দিকে তাকালো কাগা। “মায়েহারাদের সাথে যে কেসটার সম্পৃক্ততা আছে, এই বিষয়ে কিন্তু আমরা এখনো নিশ্চিত নই। পুরোটাই আমাদের অনুমান, যেটা ভুলও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তার যেন কোন প্রকার সমস্যার সম্মুখীন না হয়, সেদিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে আমাদের, তাই না?“

“আমাদের কারণে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে?’

“হ্যাঁ। আমরা যদি শুধু মায়েহারাদের সম্বন্ধে প্রশ্ন করে চলে আসতাম তাহলে মিসেস ওটা কিন্তু তাদের ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করতো। অন্য কারো সাথে তার এই বিষয়ে কথা হবে না, সেটাও বলা যায় না। আর এভাবেই গুজবের সূত্রপাত হয়। সেক্ষেত্রে দোষ না থাকা সত্ত্বেও ভুগতে হবে মায়েহারা পরিবারকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই না কারো সাথে এমনটা হোক। যদিও আমাদের করা প্রশ্নগুলো তদন্তের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”

“সেজন্যেই যাদের ব্যাপারে আমাদের কোন আগ্রহ নেই, তাদের কথাও জিজ্ঞেস করলে?

“আমি ভদ্রমহিলাকে এতগুলো প্রশ্ন করার কারণে এখন আর মায়েহারাদের খুব একটা গুরুত্ব দিবে না সে। তাছাড়া এটাও নিশ্চয়ই বুঝবে যে অন্যান্য পরিবারগুলোর সাথে কথা বলার সময় উনাদের নিয়েও প্রশ্ন করবো আমরা।”

চোখ নামিয়ে নিল মাতসুমিয়া। “এতদূর চিন্তা করিনি আমি।”

“আমি এভাবেই কাজ করি। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে তুমিও সেভাবেই করবে। যাইহোক….” মায়েহারাদের বাড়ির দিকে নজর ফেরাল কাগা। “মি. মায়েহারার বোন যে গত দুই দিন আসেনি, এই ব্যাপারটা একটু কেমন যেন লাগছে আমার।”

“তিনিই তো বোধহয় মায়ের দেখভাল করেন, তাই না?

“মি. মায়েহারা বলেছিল তার মা বেশ অস্থির হয়ে ওঠেন মাঝেমধ্যেই। এরকম একটা ব্যক্তির নিয়মিত যে খেয়াল রাখে, তার না আসাটা একটু অস্বাভাবিকই বটে। ভুল বলেছি?”

“হয়তো বাইরে কোথাও গিয়েছেন।”

“সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের।”

একটা ট্যাক্সিতে চেপে স্টেশনে চলে এলো অরা। ‘তাজিমা’ নামের দোকানটা বাসস্টপের পাশেই। কাপড় ছাড়াও জুয়েলারি আর মেক-আপও বিক্রি হয় ওখানে। ভেতরে ঢুকতেই ক্যাশ রেজিস্টারের পেছনে দাঁড়ানো চল্লিশোর্ধ এক মহিলা স্বাগত জানালো ওদের। কিছুটা অবাকই হয়েছে নিশ্চয়ই, সাধারণত তার দোকানে পুরুষ খদ্দের খুব একটা বেশি আসে না।”

মাতসুমিয়া পুলিশের পরিচয়পত্র দেখাতেই শক্ত হয়ে গেল তার চোখমুখ।

“আমরা যতদূর জানি, মি. আকিও মায়েহারার বোন এখানে কাজ করেন।“

“আমার কাছেই এসেছেন আপনারা।”

“ওহ, বেশ। আপনার নামটা জানতে পারি?”

“হারুমি তাজিমা।”

“আপনার মা, মাসায়ে মায়েহারা তো আপনার ভাইয়ের সাথে থাকেন, তাই না?”

“কিছু হয়েছে মা’র?” চেহারায় দুশ্চিন্তা ফুটলো হারুমির।

জবাবে মাতসুমিয়া বললো গত দুই দিন মা’র দেখভাল করতে গিয়েছে কিনা সে।

“না। একবার গিয়েছিলাম, কিন্তু ভাইয়া বললো মা’র শরীর ঠিকই আছে। ও নিজেই দেখাশোনা করতে পারবে। আমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে না।”

“আপনার মা’র শরীর ঠিক আছে বলেছিলেন? ওহ, কিন্তু … “

মাতসুমিয়া আরেকটু হলে বলেই ফেলেছিল যে আকিও ওদের জানিয়েছে মাসায়ে খুব সমস্যা করছে সেদিন, কাগার কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে চুপ হয়ে গেল। অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো ও; কিন্তু কাগা পাত্তা দিল না।

“এরকমটা কি প্রায়ই আপনাকে বলেন উনি?” নিস্পৃহ কন্ঠস্বরে জানতে চাইল সে।

বিভ্রান্তি ফুটল হারুমির চেহারায়।

“না, এই প্রথম এমন কিছু হলো। আমার ভাইয়ের কিছু হয়েছে?”

“গিঙ্কগো পার্কে একটা বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, এই ব্যাপারে কিছু শুনেছেন?”

“আপনারা কি সেজন্যে এসেছেন?” চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল হারুমি তাজিমা’র।

মাথা নেড়ে সায় দিল কাগা।

“খুনী একটা গাড়ি ব্যবহার করেছে খুব সম্ভবত। তাই পার্কের আশপাশে কেউ কোন অপরিচিত গাড়ি দেখেছে কিনা। সেই বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গিয়েই আমরা জানতে পেরেছি যে মায়েহারাদের বাড়ির সামনে প্রায় প্রতিদিনই একটা গাড়ি এসে থামে।”

“ওটা আমারই গাড়ি। আসলে ওখানটায় পার্ক করা উচিৎ না, কিন্তু আরে কোন জায়গাও নেই যেখানে…”

“সেটা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। প্রতিদিন মা’র দেখভাল করতে যাওয়াটা নিশ্চয়ই সহজ নয় আপনার জন্যে!”

“না, না, এমন নয় ব্যাপারটা। আমার ভালোই লাগে যেতে,” হেসে বলে হারুমি।

“ভালো লাগে? ডিমেনশিয়ার রোগীরা যে সবসময় ভালো আচরণ করে, এমন তো নয়। মাঝে মাঝে তো হুল্লোড় জুড়ে দেয় বলে শুনেছি,” কাগা বললো। তার কথা বলার ভঙ্গিতে মনে হবে সবসময়ই বেশি কথা বলে।

“আমার মা’র ক্ষেত্রে কথাটা প্রযোজ্য না। তাছাড়া সন্তানেরাই তো মা- বাবার খেয়াল রাখবে, তাই না?”

কাগাকে মাথা নাড়তে দেখে চোখ সরু করে তাকাল মাতসুমিয়া। হারুমিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা।

“কোবায়াশির সাথে কথা বলার সময় এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করো,” দোকান থেকে বেরুনোর পর বলে কাগা।

“বলবো,” বলে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো মাতসুমিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *