অধ্যায় ১৫
স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে এই বাড়িতে আসার পর প্রথম কয়েক মাস আকিও’র মনে হতো সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছে ও। ইয়াইকো আর নাওমিও মানিয়ে নিয়েছিলে এখানকার পরিবেশের সাথে। ওদিকে মাসায়ের ঘাড় থেকে সংসার সামলানোর দায়িত্ব নেমে যাওয়ায় সে-ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনেক দিন পর। তবে স্বস্তিটা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বাসার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে ক্রমশ।
মাসায়ে যেদিন প্রথম ওদের সাথে রাতের খাবার খায়নি, সেদিনই প্রথম বিষয়টা টের পায় আকিও।
“তোমার মা বলেছে ঘরেই খাবে,” আকিওর প্রশ্নের জবাবে বলে ইয়াইকো। কারণ জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় সে জানে না। সেদিনের পর থেকে ওদের সাথে আর রাতের খাবার খায়নি মাসায়ে। ইয়াইকো পার্ট-টাইম চাকরি করে। সেই বাইরে থাকার সময়টায় নিজের জন্যে রান্না করে নেয় আকিওর মা।
“তোমার মা’কে বলবে ফ্রাই-প্যান যেন না ধোয়। এত জোরে জোরে ঘষে যে সবকিছু উঠে যায়। অনেক দেখেশুনে এটা কিনেছিলাম,” আকিওর উদ্দেশ্যে নিয়মিত এরকম কথা বলতে শুরু করে ইয়াইকো। ওদের আলাদা খাওয়ার ব্যাপারটা যে ওর পছন্দ হচ্ছে না এটা বলার মত সাহস যুগিয়ে উঠতে পারেনি সেই সময়। এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে ইয়াইকো নিশ্চয়ই বলতো তাদের রান্না করার ধরণ এক না বিধায় বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে।
বউ-শ্বাশুড়ির মধ্যে এরকম দ্বন্দ্বের কথা আগেও শুনেছে আকিও, তাই নিজে এসবের মধ্যে জড়াতে চায়নি। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে নিয়মিত বারে যেতে শুরু করে সে। বাসার গুমোট পরিবেশে মন একদম টিকত না ওর। শিমবাশির এরকমই একটা বারে নিয়মিত যাতায়তের পর ওখানকার এক ওয়েটারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে আকিও।
তখন একদিন ইয়াইকো বলে নাওমিকে তার কয়েকজন সহপাঠী বিরক্ত করছে। কথাটা শুনে খারাপ লেগেছিল আকিওর, কিন্তু খুব যে দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছিল তা বলা যাবে না। বরং নতুন এই সমস্যার কথা শুনে ছেলেকে পাল্টা বকুনি দেয় ও
সেই সময়ের পরিবারের প্রতি আগ্রহ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল আকিও। প্রেমিকাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো বেশিরভাগ সময়। আগের তুলনায় ঘনঘন দেখা করতে শুরু করে। প্রথমে প্রতি দুই সপ্তাহে একবার তার কাছে যেত, এরপর প্রতি সপ্তাহে একবার, শেষ পর্যন্ত প্রতি তিনদিনে একবার করে যাওয়া শুরু করে। মেয়েটার নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থাকায় তার সাথে রাত কাটিয়ে ভোরে বাসায় আসত আকিও।
ঘটনা বুঝতে অসুবিধা হয়না ইয়াইকোর।
“কি করে মেয়েটা?” এক সন্ধ্যায় জিজ্ঞেস করে সে।
“কার কথা বলছো?”
“তোমার কি আসলেই মনে হয় আমি এতটা বোকা? প্রতি রাতে কোথায় থাক তুমি? সাহস থাকলে স্বীকার করো!”
“বন্ধুদের সাথে ড্রিঙ্ক করতে যাই, আর কিছু না। তুমি কি ভেবেছ?”
“তোমার এই কথা বিশ্বাস করতে বলছো? আমাকে আসলেই বড্ড বোকা ভাব তুমি।”
সেই সময় প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া হতে থাকে ওদের। আকিও কখনো কিছু স্বীকার করেনি আর ইয়াইকো-ও তার দাবির সপক্ষে কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। কিন্তু স্বামীকে ঠিকই সন্দেহ করতো সে। সেই প্রেমিকার সাথে কয়েক বছর আগেই সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে আকিও’র। কিন্তু ও জানে যে ইয়াইকো এখনো ওর ফোনের কল লিস্ট দেখে প্রতিদিন।
এসময় প্রথম মাসায়ের রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। একদিন প্রায় চব্বিশ ঘন্টা ঘর থেকে বের হয়নি। চিন্তিত আকিও তার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে উদাস দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে ওর মা।
“কি করছো?”
জবাবে মাসায়ে যা বলে তাতে ভড়কে যায় আকিও।
“অতিথিদের সামনে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। তাদের বিরক্ত করতে চাই না আমি।”
“অতিথি! কেউ তো আসেনই বাসায়!”
“ওই যে শব্দ শোনা যাচ্ছে!”
ইয়াইকো আর নাওমি বাদের অন্য কারো কন্ঠস্বর শুনতে পায় না আকিও।
কথাটা শুনে আকিও ভীষণ অবাক হয়। একবার মনে হয় ওর স্ত্রী আর ছেলেকে কটাক্ষ করছে মা।
“দেখো মা, তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে জানি না। আমি শুধু চাই তোমরা মিলেমিশে থাকো।”
জুলুজুলু চোখে ছেলের দিকে তাকায় মাসায়ে।
“কিন্তু আমি তো মেহমানদের চিনি না!”
“ধুর! যা ইচ্ছে করো!” বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে আকিও।
তখনও আসল কারণটা ধরতে পারেনি ও। মনে হয় ইয়াইকো আর নাওমিকে অপছন্দ করে বিধায় ওরকম আচরণ করছে মাসায়ে। পরদিন সবার সাথে একদম স্বাভাবিক আচরণ করে ওর মা। একে অপরের খুব ঘনিষ্ঠ না হলেও একই ছাদের নিচে থাকতে সমস্যা হচ্ছিল না।
কিন্তু ততদিনে জল অনেকদূর গড়িয়েছে।
একদিন রাতের বেলা ইয়াইকো ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে নিচতলা থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছে। উল্টোদিকে ঘুরে আবারো ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করলেও স্ত্রী’র জোরাজুরিতে নিচে যেতে বাধ্য হয় আকিও। সেখানে মাসায়েকে কফি টেবিলটা তাতামি রুম থেকে ডাইনিং রুমের দিকে ঠেলতে দেখে ও।
“কি হলো তোমার?”
“কফি টেবিলটা তো ওখানে থাকে, তাই না?”
“না। আমরা ওটা তাতামি রুমে রেখেছিলাম, ভুলে গেছ?”
“কিন্তু আমাদের তো খেতে হবে।”
“কি বলছো এসব? ডাইনিং রুমে তো টেবিল আছেই।”
“টেবিল?”
দরজা খুলে তখন তাকে দেখাতে হয় আকিওর। এই বাড়ীতে ওঠার পর রান্নাঘরের পাশের তাতামি রুমটাকে ডাইনিং রুমে বদলে ফেলে ওরা। একটা টেবিলও এনে রাখে সেখানে।
দৃশ্যটা দেখে মুখ থেকে বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে আসে মাসায়ের।
“তুমি শুয়ে পড়ো এখন, যাও। আমি টেবিলটা জায়গামত রেখে দিচ্ছি।”
আর কোন কথা না বলে নিজের রুমে ফিরে যায় মাসায়ে।
আকিও ধরে নেয় মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল ওর মা। কিন্তু ইয়াইকো দ্বিমত পোষণ করে এই কথার সাথে।
“মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে মা, “ শীতল স্বরে বলে সে।
“কিভাবে বুঝলে?”
“তুমি তো দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকো, এজন্যে খেয়াল করোনি। খামখেয়ালিপনা খুব বেড়ে গেছে মা’র। অনেক সময় খাবার রান্না করার পর সেটা আর ছোঁয় না। জিজ্ঞেস করলে বলে সে নাকি রান্না করেনি। সবসময় এমন করে, তা নয়। কিন্তু প্রায়ই ঘটে এমনটা।”
পুরোটা শোনার পর মুখের রা সরে না আকিও’র। ও ভাবতেও পারেনি যে বাবার পরে মা-ও সেই একই অসুখে পড়বে। ওর মন একদম ভেঙ্গে যায়।
“কি করবে ভেবে দেখ। তোমার মা’র খেয়াল রাখার জন্যে কিন্তু এই বাড়িতে আসিনি আমি।”
সমস্যার কোন সমাধান মাথায় আসে না আকিও’র। তবে ইয়াইকো যে ওর মা’র খেয়াল রাখবে না, এটা না বললেও চলতো।
মাসায়ের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। স্মৃতি হারাতে শুরু করে সে। কিছুক্ষণ আগে শোনা কথাও ভুলে যায়। পাঁচ মিনিট আগে কোথায় কি রাখলো সেটা মনে করতে পারে না। এমনকি নিজের আর পরিবারের সদস্যদের পরিচয়ও ভুলে যায়। হারুমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় মাসায়েকে। কিন্তু সেখান থেকে বলা হয় তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না।
ইয়াইকো পরামর্শ দেয় মাসায়েক বিশেষায়িত হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়নে রাখার। তবে শ্বাশুড়ির মঙ্গলের চাইতে তাকে বাসা থেকে বের করাই মূল লক্ষ্য ছিল তার। কিন্তু হারুমি সাফ মানা করে দেয়।
‘এই বাসাতেই সবচেয়ে ভালো থাকবে মা। তোমরা এসে সবকিছু বদলে ফেলার আগে বাড়িটা কেমন ছিল, তা কিন্তু ভোলেনি। মা’র ধারণা বাবা এখনও এখানে আছে। বাড়ির ভেতরেই যা একটু শান্তি পায়। তাকে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গেলে কষ্ট পাবে, আর সেটা আমার পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব।”
“হতে পারে। কিন্তু তার প্রতিদিনকার দেখভাল তো আমাদেরই করতে হবে, নাকি?” ইয়াইকো পাল্টা যুক্তি দেয়।
“না, তোমাদের কিছু করতে হবে না। আমিই নাহয় যা করার করবো,; খেয়াল রাখব মা’র। প্লিজ এখান থেকে বের করে দিও না মা’কে। আমি যদি খেয়াল রাখি, তাহলে তো কোন সমস্যা নেই, নাকি?”
বোনের এই প্রস্তাবে না বলতে পারনি আকিও। শেষ পর্যন্ত ইয়াইকো-ও মেনে নেয়।
প্রথম দিকে হারুমি বাসায় এসে সারাদিন থাকত, মা’কে খাইয়ে আকিও অফিস থেকে আসার আগে ফিরে যেত। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর থেকে সন্ধ্যায় আসতে শুরু করে সে কারণ দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটাত মাসায়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট একটা সময়ে খাবার নিয়ে আসত হারুমি কারণ ইয়াইকোর রান্না ছুয়েও দেখত না মাসায়ে।
“মা ভাবে সে আমার মেয়ে,” হারুমি একদিন আকিও’কে বলে। “তার ধারণা আমি অপরিচিত মানুষদের মাঝে রেখে গেছি তাকে, এজন্যে প্রতি সন্ধ্যায় দেখতে আসি।”
বোনের কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস হতে চায় না আকিওর, কিন্তু নিজের চোখে দেখা জিনিস অবিশ্বাস করে থাকবে কি করে? মাসায়ে আসলেও ছয় সাত বছরের শিশুদের মতন আচরণ শুরু করে। এই বিষয়ে বেশ কয়েকটা বই পড়ে ফেলে ও, সব ক’টাতেই একই পরামর্শ লেখা ছিল।
ডিমেনশিয়ায় ভোগা মানুষেরা নিজেদের আলাদা একটা জগতে বসবাস করে। কোন অবস্থাতেই তাদের সেই জগত থেকে বের করে আনার চেষ্টা করা যাবে না। বরং সেই জগতে গিয়েই তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে হবে, তাদের মত করে।
মাসায়ের এখন মনে হয় সে সম্পূর্ণ অচেনা একটা পরিবেশে, অচেনা মানুষদের মাঝে বসবাস করে।