রেড ফিঙ্গার – ১৩

অধ্যায় ১৩

দরজার পাশের নামফলকটায় ‘ইয়ামাদা’ লেখা। সেটার নিচে অবস্থিত কলিংবেলটায় চাপ দিতেই ভেতর থেকে এওটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো- “কে?”

“থানা থেকে এসেছি আমরা। কিছু প্রশ্ন ছিল,” ইন্টারকমে বললো মাতসুমিয়া। আমাদের কয়েক মিনিট সময় দিতে পারবেন?“

“হ্যাঁ….হ্যাঁ….” এবারের লোকটার কন্ঠে আর আগের মত জোর নেই।

কিছুক্ষণ পর খুলে গেল দরজা। টেকো মাথার একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে, চেহারায় চিন্তার ছাপ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে মাতসুমিয়া এবং তার সহকর্মীর দিকে এগোলো সে।

“এত সকাল সকাল আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত,” কাগা বললো।

“কি জানতে চান আপনারা?” দুই ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে লোকটা।

“আপনাদের বাগানে তো ঘাস আছে, তাই না?”

“হ্যাঁ,” মাতসুমিয়ার প্রশ্নের জবাব দেয় ইয়ামাদা।

“ওখান থেকে আমরা একটু স্যাম্পল নিব।”

“কি? আমাদের বাগান থেকে স্যাম্পল?”

“আপনি নিশ্চয়ই জানেন গিঙ্কগো পার্কে একটা বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আমরা সেই কেসেরই তদন্ত করছি।”

“কিন্তু…বাগান থেকে স্যাম্পল কেন? কিসের স্যাম্পল?”

“ঘাস বা আগাছা বলতে পারেন। মিলিয়ে দেখা হবে।”

“মিলিয়ে দেখা হবে?” আঁধার ঘনাল লোকটার চেহারায়।

“আমরা যে কেবল আপনার বাসার বাগানের ব্যাপারেই আগ্রহী, তা নয়, কাগা বলে। “এটা আমাদের সামগ্রিক তদন্তের অংশ। এই এলাকার বাড়িগুলোর বাগানে কোন জাতের ঘাস জন্মে, সেটা বের করতে হবে। আমাদের দু’জনের উপর দায়িত্ব পড়েছে স্যাম্পল সংগ্রহ করার। আপনি চাইলে মানাও করতে পারেন।”

“না, মানা করবো কেন। আপনারা আমাকে সন্দেহ করছেন, এমন তো না।”

“জ্বি, ঠিক বলেছেন,” কাগা বললো। “শনিবার সকালে এভাবে বিরক্ত করার জন্যে আসলেও দুঃখিত। খুব বেশি সময় নষ্ট করবো না। অল্প একটু স্যাম্পল নিয়েই চলে যাব। আপনার বাগানেরও কোন ক্ষতি হবে না।”

“সেক্ষেত্রে আমার কোন সমস্যা নেই। আসুন…”

স্বস্তির ছাপ পড়েছে লোকটার চেহারায়। দরজা খুলে দিল সে।

আশপাশের যতগুলো বাসার বাগানে ঘাস জন্মেছে, সবগুলোতে ঘুরে ঘুরে ঘাস আর মাটির স্যাম্পল সংগ্রহ করছে ওরা দু’জন। সবাই যে খুশি হচ্ছে ব্যাপারটায়, তা নয়। অনেকেই জিজ্ঞেস করলো তাদের ওরা সন্দেহ করছে কিনা।

“এভাবে কাজ করাটা ঠিক কতটা কার্যকরী, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে আমার, “ ইয়ামাদাদের বাসা থেকে বেরিয়ে বলে মাতসুমিয়া।

“হঠাৎ একথা?”

“সব জায়গায় গিয়ে সেই একই কথা বারবার বলছি। এরচেয়ে এলাকার সবাইকে আমাদের অফিস থেকে কেউ একজন আগে ফোন করে জানিয়ে দিলে ভালো হতো আমরা কি কাজ করছি।”

“অর্থাৎ আমাদের মধ্যে একদল ফোন করে সবাইকে বলবে আর বাকিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করবে?”

“আমার কথার সাথে একমত না তুমি?”

“না,” কাগা বলে।

“কেন না?”

“এতে কার্যকরিতা আরো কমে যাবে।”

“কিভাবে?”

“তদন্তের কাজ আর দাপ্তরিক কাজের ধরণ মিলিয়ে ফেললে হবে না। তুমি যখন কাউকে কিছু বুঝিয়ে বলবে, তখন সেই মানুষটা কেমন তা গোণার মধ্যে নিতে হবে। এমনটাও হতে পারে যে সে-ই অপরাধটা করেছে। সামনাসামনি কথা বললে আমরা এমন অনেক কিছু খেয়াল করতে পারি যেটা ফোনে সম্ভব না। “

“তাই? গলার স্বর শুনেও কিন্তু অনেক কিছু বোঝা যায়।“

“তা ভুল বলোনি। ধরা যাক, তুমি যেভাবে বলছো, আমরা সেভাবেই কাজ করছি। সেক্ষেত্রে ফোন করে আমাদের যে সহকর্মীরা এই এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলবে, তাদের কাছে যদি কিছু সন্দেহজনক মনে হয়, তখন সেটা স্যাম্পল সংগ্রহকারীদের নিশ্চয়ই বলে দিবে? বুঝতে পারছ কি বলছি?”

“জ্বি।”

“এতে কার্যকরিতা আরো কমবে। তাছাড়া নিজ থেকে কিছু অনুভব করা আর সেটা অন্য কাউকে বুঝিয়ে বলার মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। শেষমেষ যদি ঠিকমতন বুঝিয়ে না বলতে পারে আর স্যাম্পল সংগ্রহকারী ভুল বোঝে, তাহলে আগে থেকেই একটা মন্দ ধারণা নিয়ে সে স্যাম্পল সংগ্রহ করতে যাবে। তাছাড়া আমরা আসবো, এটা জানলে আসল অপরাধী সতর্ক হয়ে যেতে পারে। আমি বুঝতে পারছি এরকম রসকসহীন কাজ করতে তোমার ভালো লাগছে না, কিন্তু তদন্ত এভাবেই করতে হয়।“

“কখন বললাম ভালো লাগছে না,” মাতসুমিয়া দ্রুত বলে। কাগা এবারে পাল্টা কিছু বললো না।

আশপাশের সবগুলো বাড়িতে গিয়ে ঘাস আর মাটি সংগ্রহ করে প্লাস্টিক ব্যাগে ঢুকিয়ে নাম লিখে রাখল ওরা। কোবায়াশি ওদের বারবার করে বলে দিয়েছে কার্ডবোর্ডের বাক্সের দিকে অজর রাখা, কিন্তু এখন অবধি একটাও ওরকম বাক্স চোখে পড়েনি ওদের। মাতসুমিয়া অবশ্য এতে অবাক হয়নি, কারণ সে আশাও করেনি যে এরকম কিছু পাওয়া যেতে পারে।

পরবর্তী বাসাটার গেটের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে কাগা। মায়েহারা লেখা নামফলকে। তাদের বাগানেও ছোট একটা খালি জায়গা আছে। কিন্তু অন্য বাড়িগুলোর থেকে এই বাড়িটার দিকে কাগার তাকানোর ধরণ একটু অন্যরকম। তার হঠাৎ এরকম গম্ভীর হয়ে যাওয়া দেখে অবাকই হলো মাতসুমিয়া

“কি হয়েছে?”

“কিছু না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলে কাগা।

দোতলা বাড়িটা বেশ পুরনো।

গেট থেকে মূল দরজা বেশ ভেতরে। ঢুকেই হাতের ডান দিকে বাগান। সেখানে বেপরোয়াভাবে বেড়ে উঠেছে ঘাস, খুব একটা পরিচর্যা হয় না।

ঘাস বাদেও ইউনা কাসুগাইয়ের কাপড়ের ক্লোভার পাতার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছে ফরেনসিক টেকনিশিয়ানরা। বাগান করার অভ্যাস আছে এরকম একজন অফিসার জানিয়েছে যেসব বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়, সেখানে সাধারণত ক্লোভার জন্মায় না।

মাতসুমিয়া ইন্টারকমের বাটন চাপ দেয়ার কিছুক্ষণ পর একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো স্পীকারে। যা বলার তাকে বুঝিয়ে বললো ও।

নারিমা থানা থেকে স্থানীয় সবার তথ্য কাগজে প্রিন্ট করে দিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের। সেখান থেকে এই পরিবার সম্পর্কিত লেখাগুলোর উপরে এক নজর চোখ বুলিয়ে নিল মাতসুমিয়া। বাড়ির কর্তার নাম আকিও মায়েহারা, বয়স সাতচল্লিশ বছর। তার স্ত্রী ইয়াইকোর বয়স বেয়াল্লিশ। চোদ্দ বছর বয়সী একটা ছেলে আছে তাদের। আকিও’র মা, বাহাত্তর বছর বয়সী মাসায়ে-ও এখানেই থাকে।

“খুবই সাধারণ একটা পরিবার,” মন্তব্য করে ও।

“বয়স্ক ভদ্রমহিলা ডিমেনশিয়ার রোগী,” কাগা বলে। “কোন পরিবারকেই আগেভাগে সাধারণ বলে দেয়া উচিৎ না। বাইরে থেকে সব পরিবারকেই সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু ভেতরের গল্পটা অন্য।”

“জানি আমি এসব। তবে আমার মনে হয় না আমাদের তদন্তের সাথে এই পরিবারের কোন লেনদেন আছে।”

সামনের দরজা খুলে গেল এসময়। মাঝবয়সী একটা লোককে দেখা যাচ্ছে। পোলো শার্টের উপরে ট্র্যাক জ্যাকেট পরনে তার। নিশ্চয়ই আকিও মায়েহারা, ভাবে মাতসুমিয়া। দুই ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে একবার মাথা নাড়ে সে। আরো একবার বিরক্ত করতে আসার জন্যে তার কাচ্ছে ক্ষমা প্রার্থনা করে কাগা।

মাতসুমিয়া খুলে বলে কেন এসেছে ওরা। এক মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা খেলে যায় লোকটার চেহারায়, বিষয়টা চোখ এড়ায়না তরুণ ডিটেকটিভের।

“ওহ, নিশ্চয়ই…” কিছুক্ষণ পর বলে আকিও

বাগানে ঢুকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে মাতসুমিয়া। টেকনিশিয়ানরা বলে দিয়েছে যত বেশি স্যাম্পল নেয়া যায়, তত ভালো।

“ইয়ে…” খানিকটা বিব্রত শোনায় মায়েহারার কন্ঠস্বর। “কি করবেন এসব নিয়ে।”

“আপাতত আপনাকে শুধু এটুকু বলতে পারব যে আমরা আশপাশের সব বাসা থেকেই স্যাম্পল সংগ্রহ করছি।”

“ওহ…আচ্ছা।”

মায়েহারা খুব সম্ভবত জানতে চেয়েছিল স্যাম্পলগুলো তদন্তের কাজে ব্যবহৃত হবে কিনা। কিন্তু আর কোন প্রশ্ন করলো না সে।

স্যাম্পল প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়াল মাতসুমিয়া। সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ জানাতে যাবে এসময় বাড়ির ভেতর থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো।

“প্লিজ, মা, থামুন!”

এরপরই কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পেল ওরা।

“এক মিনিট,” বলে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে মায়েহারা।

“কি করছো এসব?” তার উত্তেজিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো কিছুক্ষণ পর।

মাতসুমিয়া আর কাগা একটা নারীকণ্ঠ শুনতে পেল আবারো, কিন্তু সে কি বলছে তা বোঝা সম্ভব না এখান থেকে।

কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলো মায়েহারা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকালো। সে যে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে, তা স্পষ্ট।

“দুঃখিত, আপনাদের দাঁড় করিয়ে রাখলাম।”

“কোন সমস্যা?”

“না, ওরকম কিছু না। আমার মা আজকে একটু অস্থির আচরণ করছে সকাল থেকে।”

“আপনার মা?” কাগার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল তরুণ ডিটেকটিভের। “আমরা কি কোনভাবে সাহায্য অরতে পারি। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কিন্তু সিনিয়র কাউন্সিলরও আছে।”

“ধন্যবাদ। আমরা মানিয়ে নিয়েছি আসলে,” কাষ্ঠল হাসি ফুটলো মায়েহারার মুখে।

দুই ডিটেকটিভ গেট থেকে বের হওয়া মাত্র বাড়ির ভেতরে উধাও হয়ে গেল সে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাতসুমিয়া।

“অফিসে নিশ্চয়ই প্রতিদিন নানারকম সমস্যা সামলাতে হয় ভদ্রলোককে। এরপর বাসায় এসে মা’র পাগলামী। সহজ না নিশ্চয়ই।”

“জাপানের অনেক পরিবারেই এরকম দেখবে। জনসংখ্যার বড় একটা অংশ বার্ধক্যের দিকে এগোবে, এটা তো জানা কথা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বিধায় এই অবস্থা।”

“প্রতিদিন আলঝেইমারে আক্রান্ত এক ব্যক্তির দেখভাল করতে হবে, এই কথাটা ভাবতেই যেন কেমন লাগছে। আমার ক্ষেত্রে যে এমনটা হবে না, তা তো বলা সম্ভব না। আমার মা’র আমি ছাড়া আর কেউ নেই।”

“ইদানিং অনেকেই এই সমস্যায় ভুগছে। সরকারের কাছ থেকে যেহেতু কোন সাহায্য পাওয়ার আশা নেই, নিজেদেরই মানিয়ে চলতে হবে আমার।”

কাগার কথা শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল মাতসুমিয়ার।

“তুমি তো শুধু এসব বলেই খালাস। বাবাকে একা ফেলে নিজের মত থাকছ। কোন পিছুটান নেই।”

কথাটা বলেই থমকে গেল মাতসুমিয়া। একবার মনে হল কাগা রেগে যাবে বুঝি

“ঠিক বলেছ,” জবাবে কেবল এটুকুই বললো কাগা। “একা জীবন যাপন করাই ভালো।”

“তুমি চাও তোমার বাবা একা একা মারা যাক?”

ফুপাতো ভাইয়ের মুখে এই কথা শুনেও অভিব্যক্তি বদলায় না কাগার।

একবার কেবল মাথা নাড়ল সে।

“যে যেভাবে জীবন কাটিয়েছে, তার মৃত্যু সেভাবেই হয়। বেশিরভাগ সময় নিজেকে নিয়েই থেকেছে বাবা, মৃত্যুর সময়ও একাই থাকতে পারবে। এটুকুই বলার আছে আমার।”

“নিজের বাবার ব্যাপারে এসব বলছো?”

“যারা পরিবারের সাথে সুন্দর সময় কাটায়, তাদের সময় দেয়, তারা জীবনের শেষ মুহূর্তে কাউকে না কাউকে পাশে পাবে। কিন্তু যারা এমনটা করেনি, তারা তো আর এসবের আশা করতে পারে না, তাই না?”

“তোমার বাবা আমাদের সবসময় ভালো ব্যবহার করেছে। মা আর আমার ভালো থাকার পেছনে মামার অবদান আছে; তার কারণেই বাবার অভাবটা বুঝিনি আমি। শেষ সময়ে এসে তাকে একা ছেড়ে দিব আমি, এমনটা হতেই পারে না। তোমার যদি মনে হয় মামা তোমার যথাযথ খেয়াল রাখতে পারেনি, সেটা তোমার সমস্যা। আমি আমার মত করে মামার খেয়াল রাখব। একদম শেষ পর্যন্ত।”

মাতসুমিয়া মনে মনে আশা করছিল তার মামাত ভাই এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে তর্ক করবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না।

“সেটা তোমার মর্জি। এই বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই,” কাগা জবাব দেয়।

উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করেও হঠাৎ থমকে যায় মাতসুমিয়া। মায়েহারাদের বাসার বাইরে রাখা একটা সাইকেলের দিকে নজর পড়েছে ওর।

“সাইকেলটা কি অদ্ভুত ঠেকছে তোমার কাছে?”

“নাহ। তাড়াতাড়ি চলো, আমাদের আর অনেকগুলো বাসায় ঢুঁ মারতে হবে.” তাড়া দিল কাগা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *