অধ্যায় ১০
মায়েহারাদের বাসায় কলিং বেলটা যখন বাজল তখন সকাল দশটা। সেই সময় বাথরুমে ছিল আকিও। দ্রুত হাত ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো ইন্টারকমের রিসিভার কানে চেপে রেখেছে ইয়াইকো।
“জ্বি। আপনারা চাইলে আসতে পারেন, কিন্তু আমরা কিছু জানি না। “ অপর প্রান্ত থেকে নিশ্চয়ই কোন প্রশ্ন করা হয়েছে। “ঠিক আছে।”
রিসিভার নামিয়ে রাখলো সে।
“এসে পড়েছে।”
“কে?”
“পুলিশ,” জলদগম্ভীর স্বরে জবাব দিল ইয়াইকো। “আর কে?”
হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল আকিওর। অনেক আগে থেকেই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ওর, কিন্তু স্ত্রী’র মুখ থেকে কথাগুলো শুনে দুশ্চিন্তার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণে। হঠাৎ করেই প্রচন্ড গরম অনুভব করছে কেন যেন।
“আমাদের বাসায় এসেছে কেন?”
“জানি না। দ্রুত গিয়ে দরজা খোলো, যাও। নাহলে ওদের সন্দেহ হবে।” মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে সদর দরজার দিকে এগোলো আকিও। লম্বা শ্বাস টানল কয়েকবার। বুকের ধড়ফড়ানি কমেনি।
পুলিশের লোক যে আসবে তাতে এত বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই। মেয়েটাকে খুন করার আগে নাওমি কি কি করেছে সেই বিষয়ে কোন ধারণা নেই আকিওর। হয়তো কেউ ওদের দু’জনকে একসাথে দেখে ফেলেছিল। সেই ক্ষেত্রে কোন একটা যুতসই ব্যাখা দিতে হবে ওকে। এখন আর কাহিনী বদলাবার কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু পুলিশের লোকেরা যে ওর বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, এটা ভাবতেই পুরো শরীর ভয় এবং আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো ওর। বানিয়ে গল্প বলে এরকম পেশাদার তদন্ত কর্মকর্তাদের বোকা বানাতে পারবে বলে মনে হয় না।
শেষ মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে শ্বাস প্রশ্বাস যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করলো। ওর বুক ধড়ফড় করলে কেউ টের পাবে না, কিন্তু হাপড়ের মতন শ্বাস নিলে সেটা চোখে পড়বেই। সেক্ষেত্রে সন্দেহ করবে নিশ্চিত।
কোন সমস্যা হবে না আমার, নিজেকে প্রবোধ দিল আকিও। “কোন তথ্য খুঁজে পেয়ে এখানে এসেছে পুলিশের লোকেরা, এমন তো নয়। নিয়মরক্ষার তদন্তের জন্যে এসেছে। কোন অপরাধ সংঘটিত হলে আশপাশের সব বাড়িতে খোঁজ নেয়া হয়।
জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দরজা খুললো ও।
“শনিবার সকালে এভাবে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত,” পুলিশের লোকটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথা বলছে। “কয়েক মিনিট সময় হবে আপনার?
ভেতরে আসার অনুমতি চাইছে সে। “নিশ্চয়ই,” জবাব দিল আকিও।
বাগানের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আকিওর দিকে এগোলো পুলিশের লোকটা। কাছাকাছি এসে নিজের পরিচয়পত্র বের করে দেখালো পকেট থেকে। ভদ্রলোকের নাম কাগা, নারিমা পুলিশ স্টেশন থেকে এসেছে। বেশ নমনীয় কন্ঠস্বর। পুলিশ অফিসার শুনলেই যেরকম চিত্র ভেসে ওঠে মনের পর্দায়, তার একদম বিপরীত সে। তবে তার দৃষ্টিতে এক ধরণের শীতলতা অনুভব করলো আকিও।
ওদের উল্টোদিকের প্রতিবেশীর সাথেও কথা বলছে এক পুলিশ অফিসার। আসলেই এই এলাকায় খোঁজখবর নিচ্ছে পুলিশের লোকেরা।
“কিছু হয়েছে নাকি?”
আকিও ঠিক করেছে এমনভাবে কথা বলবে যেন সে কিছু জানে না। আর ওর আসলেই কিছু জানার কথা না।
“এখানকারা গিঙ্কগো পার্কটা চেনেন?” কাগা জিজ্ঞেস করলো। “হ্যাঁ। কেন?”
“সকাল বেলা ওখান থেকে ছোট একটা মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করেছি আমরা।”
“ওহ, আচ্ছা,” আকিও বলে। পরক্ষণেই গাল দেয় নিজেকে। আরেকটু অবাক হওয়া উচিৎ ছিল অর।
ওকে দেখে মনে হচ্ছে না খবরটা শুনে বিস্মিত হয়েছে।
“আপনার কথা শুনে মনে পড়লো, সকাল বেলা পুলিশের গাড়ির সাইরেন কানে এসেছিল।”
“এত সকালে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত,” একবার মাথা নুইয়ে বললো পুলিশ অফিসার।
“কোন সমস্যা নেই। মেয়েটা কোথাকার?”
“ফোর্থ সেকশনে পরিবারের সাথে থাকত,” পকেট থেকে একটা ছবি বের করে বললো কাগা।
ভিক্টিমের নাম বলার নিয়ম নেই খুব সম্ভবত।
“এই যে ছবিটা দেখুন। “
ছবিটা দেখে এবারে দৃশ্যতই চমকাল আকিও। খুব সম্ভবত শীতকালে তোলা হয়েছিল ছবিটা, কারণ বাচ্চা মেয়েটার গলায় একটা স্কার্ফ পেচানো। মুখে মিষ্টি হাসি।
ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না যে ঠিক এই মেয়েটাকে গত রাতে একটা নোংরা টয়লেটে ওভাবে রেখে এসেছে ও। ঠিকমত চেহারার দিকে তাকায়ওনি একবার।
কি আদুরে একটা মেয়ে, ভাবে আকিও। পা কাঁপছে ওর। ইচ্ছে করছে মাটিতে বসে গলা ছেড়ে কিছুক্ষণ চিৎকার করতে। উপরে ছুটে গিয়ে হারামজাদাটাকে কান ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে আসতে পারলে ভালো লাগত কিছুটা। গতকাল যা যা করেছে, সবকিছু খুলে বলতে ইচ্ছে করছে পুলিশের লোকটাকে।
তবে সেরকম কিছু করলো না ও। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো অনেক কসরত করে। চেহারা নিরাবেগ।
“মেয়েটাকে দেখেছেন কোথাও?” হেসে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলেও কাগার চোখের কোণের সন্দেহের ছায়া টের পেল আকিও।
“ইয়ে….” বিভ্রান্ত কন্ঠে বললো ও। “এলাকায় তো এই বয়সী অনেক মেয়েই আছে। কিন্তু তাদের কাউকেই মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করিনি কখনো। তাছাড়া দিনের বেলা বাসাতেও থাকি না। “
“চাকরি করেন আপনি?”
“হ্যাঁ।”
“সেক্ষেত্রে আপনার পরিবারের লোকদের সাথে একটু কথা বলা যাবে কি?”
“আমার পরিবারের লোকদের সাথে?”
“আপনি কি বাসায় একা এখন?”
“না, কিন্তু…“
“আর কে আছে?”
“আমার স্ত্রী,” ছেলের কথা চেপে গেল আকিও।
“ওনাকে একটু ডাকবেন দয়া করে? এক মিনিটের বেশি সময় নিব না।”
“ঠিক আছে। দাঁড়ান একটু।”
দরজা বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল আকিও।
ভেতরে ঢুকে দেখে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ডাইনিং রুমে বসে আছে ইয়াইকো। পুলিশ অফিসার কথা বলতে চায় শুনেই জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলো সে।
“এখন কথা বলতে পারব না আমি। কিছু একটা বলে দাও!”
“কিন্তু তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে।”
“বলো এই মুহূর্তে কথা বলতে পারব না। একদমই পারব না,” উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইয়াইকো।
“দাঁড়াও!”
কিন্তু আকিও’র কথা কানে তুলল না ইয়াইকো। হনহন করে উঠে গেল উপর তলায়।
মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো দরজার কাছে ফিরে এলো ও। দরজা খুলতেই কাগার হাসিমাখা মুখটা চোখে পড়লো আরো একবার।
“আমার স্ত্রী এই মুহূর্তে একটু ব্যস্ত।”
“ওহ,” বিস্ময় ফুটল কাগার চেহারায়। “সেক্ষেত্রে ওনাকে একটু ছবিটা দেখাতে পারবেন?”
“অবশ্যই,” বলে ছবিটা হাতে নিল আকিও। “ওকে জিজ্ঞেস করবো এই মেয়েটাকে দেখেছে কিনা, তাই তো?”
“হ্যাঁ, এটুকু বললেই হবে,” আরো একবার মাথা নুইয়ে বলে কাগা।
দরজা বন্ধ করে বাড়ির ভেতরে চলে এলো আকিও। সিঁড়ি বেয়ে উপরেও উঠলো।
নাওমির ঘর থেকে কোন শব্দ আসছে না। অর্থাৎ এই মুহূর্তে কম্পিউটারে গেম খেলছে না সে।
ছেলের ঘরের বিপরীত দিকের ঘরের দরজাটা খুললো ও। মাস্টার বেডরুম এটা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে ইয়াইকো। সাধারণত মেকআপের সময় ওখানে বসে সে, কিন্তু এখন কোন মেকআপ চোখে পড়লো না।
“গেছে পুলিশের লোকটা?”
“না, তোমাকে এই ছবিটা দেখাতে বললো।
তার হাতে ছবিটা দিল ও।
“এখানে কেন এসেছে?”
“জানি না। আশপাশের সব বাসাতেই খোঁজ-খবর নিচ্ছে। খুব সম্ভবত প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে খুঁজছে।
“বলে দাও আমি কাউকে দেখিনি।”
“সেটা তো বলবোই, কিন্তু ছবিটা দেখ।’
“কেন?”
“দেখে বোঝার চেষ্টা করো কি করেছি আমরা!”
“না, দেখতে চাই না আমি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আকিও। ও জানে যে মেয়েটার নিষ্পাপ চেহারা দেখলে সহ্য করতে পারবে না ইয়াইকো।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ও। ছেলের ঘরের ডোরনবে মোচড় দিল একবার। ভেতর থেকে আটকানো। নিজেকে ওদের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে নাওমি।
“কি করছো?” পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো ওর স্ত্রী।
“ওকে ছবিটা দেখাতে চাই।”
“তাহলে লাভ কি হবে?”
“ওর মাথায় একটু ঢুকুক যে কি করেছে।”
“সেজন্যে ছবি দেখার দরকার নেই। অপরাধবোধের কারণেই ঘর থেকে বেরুচ্ছে না।”
“না। বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে ও। মেয়েটাকে দেখতে চায় না।”
“তাতে কি?” আকিও’র হাত ধরে বললো ইয়াইকো। “ওকে ওর মত থাকতে দাও, প্লিজ। সবকিছু…স্বাভাবিক হবার পর আমরা ওর সাথে কথা বলবো। ঠিক আছে? একটা শান্তিতে থাকতে দাও এখন। তুমি তো ওর বাবা, নাকি?”
স্ত্রী’কে কাঁদতে দেখে ডোরনব থেকে হাত সরিয়ে নিল আকিও। মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইয়াইকোর সাথে একমত ও। আপাতত বাড়ির দরজা পর্যন্ত চলে আসা বিপদ থেকে নিস্তার পেতে হবে।
কিন্তু পরে কখনো কি ছেলের সাথে এসব বিষয়ে আলাপ করতে পারবে? কি মারাত্মক ভুল সে করেছে, সেই বিষয়ে কি বিন্দুমাত্র ধারণা আছে আহাম্মকটার?
নিচে নেমে এসে পুলিশ অফিসারকে ছবিটা ফিরিয়ে দিল আকিও। একথাও বললো যে ওর স্ত্রী মেয়েটাকে দেখেনি।
“ওহ, আচ্ছা। বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত,” ছবিটা পকেটে ঢোকানোর সময় বললো কাগা।
“আর কিছু?”
“জ্বি,” বলে বাগানের দিকে তাকালো কাগা
আকিওর মনে হচ্ছে কেউ বুঝি ওর বুকের ভেতরে হাতুড়িপেটা করছে। “কিছু জানতে চান?”
“আমি যে প্রশ্নটা করবো, সেটা আপনার কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে, “ কাগা বললো জবাবে। “আপনাদের উঠানের ঘাস কোন জাতের?
“কোন জাতের?” খসখসে কন্ঠে বললো আকিও।
“জানা নেই আপনার?”
“আসলে অনেক আগে থেকে দেখে আসছি তো। কবে লাগানো হয়েছে সেটাও মনে নেই। বাড়িটা আমার বাবার করা।”
“বেশ।”
“কেন? হঠাৎ ঘাসের কথা জানতে চাইলেন?”
“না, কিছু না। এটা নিয়ে আপনার মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই,” হাতে নেড়ে বললো পুলিশ অফিসার। “শেষ প্রশ্ন। গতকাল রাত থেকে আজকে সকালের মধ্যে কি আপনি বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন?
“না। বাসাতেই ছিলাম।”
এই প্রশ্ন করার কারণ জিজ্ঞেস করতে যাবে আকিও এমন সময় ডাইনিং রুমের দরজা খুলে গেল। চমকে উঠলো ও। মাসায়ে বের হয়েছে ভেতর থেকে।
কাগাও অবাক হয়েছে।
“ইনি কে?”
“আমার মা। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। মা ডিমেনশিয়ার রোগী, কিছু মনে রাখতে পারে না,” কপালে টোকা দিয়ে বললো আকিও। “এজন্যেই আপনাকে কিছু বলিনি।”
টবে লাগানো গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো মাসায়ে।
বিরক্ত ভঙ্গিতে তার দিকে এগোলো আকি ও
“কি করছো মা?”
“গ্লাভসগুলো কোথায়?” ফিসফিস করে বললো সে।
“গ্লাভস?”
“দু’টো গ্লাভস না দেখলে আমাকে বকা দিবে।”
সামনে ফিরে আবারো গাছগুলোর মধ্যে খুঁজতে শুরু করলো মাসায়ে। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকালো। এখন তার হাতে শোভা পাচ্ছে নোংরা গ্লোভস। রক্ত হিম হয়ে গেল আকিওর। এই গ্লাভসগুলোই গত রাতে ব্যবহার করেছিল। বাসায় ফিরে কোথায় ছুড়ে ফেলেছে, সেটা মনে ছিল না। সাতপাঁচ না চিন্তা করেই নিশ্চয়ই ছুড়ে মেরেছে।
“এবার তো ঠিক আছে, তাই না স্যার?” দুই হাত মেলে ধরে কাগার দিকে এগিয়ে বললো মাসায়ে।
“উফ মা! কি করছো এসব? অনেক হয়েছে! যাও, ভেতরে গিয়ে খেল। বৃষ্টি পড়বে এখন,” বাচ্চাদের সাথে যেভাবে কথা বলে সবাই, সেই ভঙ্গিতে বললো আকিও।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বাগান পার হয়ে গেল মাসায়ে, যেন বুঝতে পেরেছে যে আকিও ঠিক কথাই বলছে। ডাইনিং রুমে ঢুকে পড়লো সে।
ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটা বন্ধ করে দিল আকিও। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গোটা দৃশ্যটা বিস্মিত দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলো কাগা।
“দেখেছেন মা’র অবস্থা?” আকিও ফিরে এসে বলে। “এজন্যেই ভেবেছিলাম তার সাথে কথা বলে কোন লাভ হবে না আপনার।”
“এরকম একজনের সাথে বাসায় থাকাটা নিশ্চয়ই সহজ নয়। এখানেই রাখেন ওনাকে?
“জ্বি, আর কিছু জানতে চান অফিসার?”
“না। সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ।”
তাকে চলে যেতে দেখল আকিও। কাগা দৃষ্টিসীমার বাইরে যাবার পর বাগানের দিকে তাকালো।
মেয়েটার পিঠে লেগে থাকা ঘাসগুলোর কথা মনে পড়ে গেল এসময়।
মাথা চাপড়াতে ইচ্ছে করছে ওর।