রেড ফিঙ্গার – ১

অধ্যায় ১

রাতের খাবারের সময় হতে আর খুব বেশি দেরি নেই, কিন্তু তাকামাসা জেদ ধরেছে মাতসুমিয়ার নিয়ে আসা স্পঞ্জ কেকটা এখনই চেখে দেখবে।

“এখন এটা খাওয়া কি উচিৎ হবে?” প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলে মাতসুমিয়া।

“উচিৎ না হওয়ার কি আছে? ক্ষুধা পেয়েছে, খাবো। শরীর ভালো রাখার জন্যে তো এটাই যথেষ্ট!”

“নার্স এসে আমাকে-সুদ্ধ বকবে।”

তবে মুখে যা-ই বলুক, মাতসুমিয়া আসলে খুশিই হয়েছে ওর বয়স্ক মামার মুখে রুচি ফিরতে দেখে। কাগজের ব্যাগ থেকে বক্সটা বের করে খুললো ও। কেকটা স্লাইস করে কাটা। প্রতিটা স্লাইস আবার আলাদাভাবে কাগজে মোড়ানো। সেখান থেকে একটা বের করে তাকামাসার কৃশ হাতে তুলে দিল মাতসুমিয়া।

কেকটায় এক কামড় বসিয়ে ধীরে ধীরে চিবুতে লাগলো তাকামাসা। সুস্থ শরীরের কেউ হলে দুই কামড়েই শেষ করে ফেলত পুরোটা। খাবার গিলতে অসুবিধা হয় তার, কিন্তু মুখের ভেতরে মিষ্টি স্বাদটা উপভোগ করছে।

“চা খাবে?”

“হ্যাঁ, দে।

বিছানার পাশের কার্ট থেকে একটা স্ট্র-সমেত বোতল তুলে অসুস্থ ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিল মাতসুমিয়া।

“জ্বর আছে এখন?”

“আছে, হালকা। আমার শরীর এরকম গরমই থাকে। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“কিন্তু বেশিদিন জ্বর থাকা তো ভালো না। তোমাকে দেখে অবশ্য আজকে ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।”

“আচ্ছা সুহেই, সত্যি করে বল। অফিসের কাজের ব্যস্ততার মধ্যে তোর কি আমার এখানে আসার সময় আছে আসলেই?”

“এখন সময় আছে। তোমাকে যে সেতাগায়া কেসটার ব্যাপারে বলেছিলাম, সেটার সমাধান হয়েছে।”

“হাতে সময় থাকলে প্রোমোশনের পরীক্ষার প্রস্তুতি নে।”

“আবার শুরু কোরো না তো,” মাথা চুলকে বলে মাতসুমিয়া।

“আর যদি পড়াশোনায় মন না বসে, তাহলে গার্লফ্রেন্ডকে সময় দে। আমার কাছে আসতেই হবে, এটা ভাবিস না। কাতসুকো তো আছেই।”

কাতসুকো হচ্ছে মাতসুমিয়ার মা। তাকামাসার ছোট বোন।

“কতবার বলবো তোমাকে। নেই আমার কোন গার্লফ্রেন্ড। দেখা করতে আসলে সমস্যা কি, তোমার তো কোন কাজ নেই।”

“কাজ নেই বলা যাবে না। একটা জিনিস নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়।“

“ওটা নিয়ে কথা বলতে চাও?” শোগি বোর্ডটার (জাপানি দাবা) দিকে ইঙ্গিত করে বলে মাতসুমিয়া। পুরো সেটটা ম্যাগনেটিক হওয়ার কারণে ঘুটিগুলো পড়ে যায় না।

“ধরিস না, খেলা শেষ হয়নি এখনো।”

“শোগি খুব বেশি বুঝি না আমি। কিন্তু বোর্ডটা দেখে তো মনে হচ্ছে না খুব বেশি কিছু বদলেছে গতবারের তুলনায়।”

“তোর ধারণা ভুল। শোগিতে প্রতিটা চাল দেয়ার আগে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। নাহলে একটা ভুলই পুরো খেলা নষ্ট করে দিবে। তাছাড়া আমার প্রতিপক্ষ যেনতেন কেউ নয়।”

এসময় রুমের দরজা খুলে একজন নার্স পা রাখলো ভেতরে। চেহারাটা গোলগাল। বয়স ত্রিশের কোঠায়।

“আপনার জ্বর আর প্রেশার মাপতে এসেছি।”

“তোমাকে নিয়েই কথা বলছিলাম আমরা।” শোগি বোর্ডের দিকে তাকায় তাকামাসা। “কি চাল দিবে, ভেবেছ?”

হাসে নার্স। “হ্যাঁ, ভেবেছি তো।” সামনে ঝুকে একটা ঘুটির অবস্থান বদলে দেয় সে।

বিস্মিত দৃষ্টিতে মামা আর নার্সের দিকে তাকায় মাতসুমিয়া। “তুমি ওনার সাথে খেলছ?”

“হ্যাঁ। প্রতিপক্ষ হিসেবে ভয়ংকর ও। সুহেই, বোর্ডটা একটু এদিকে নিয়ে আয় তো।”

মামার কথামতো কাজ করলো মাতসুমিয়া।

“হাতির চাল দিয়েছ…বাহ। এটা ভাবিনি আগে।”

“‘এখন খুব বেশি ভাবাভাবির দরকার নেই। প্রেশার বেড়ে যাবে।”

যত্ন নিয়ে তাকামাসার প্রেশার আর জ্বর মাপল নার্স। মাতসুমিয়া খেয়াল করলো ব্যাজে তার নাম লেখা কানেমোরি। কিছুক্ষণ পর মামা বললো কানেমোরির ভালো নাম হচ্ছে তোকিকো। চাইলে দু’জনে একদিন কফি খেতে যেতে পারে। লাল হয়ে গেল মাতসুমিয়ার ফর্সা চেহারা। কানেমোরি ওর চেয়ে বয়সে বড়ই হবে। এরকম কারো সাথে ডেটে যাওয়ার ইচ্ছে ওর আপাতত নেই। তাছাড়া কানেমোরির নিজেরও মত নেই এই ব্যাপারে, ও নিশ্চিত।

“আপনার কি কোথাও ব্যাথা করছে?” কাজ শেষে জিজ্ঞেস করে কানেমোরি।

“নাহ, সব ঠিকঠাক। “

“আচ্ছা। যদি কোন দরকার হয়, সাথে সাথে ডাক দিবেন কিন্তু,” বলে হেসে বেরিয়ে গেল নার্স।

সাথে সাথে আবারো শোগি বোর্ডের দিকে নজর ফেরাল তাকামাসা। “এই চালই দিল তাহলে। আমি ভেবেছিলাম অবশ্য একবার, কিন্তু এবারেই চালটা দিবে বুঝতে পারিনি।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো মাতসুমিয়া। তাকামাসার শোগি খেলার একজন সঙ্গী আছে এটা জেনে ভালো লাগছে ওর। একটু হলেও সময় কাটবে এতে।

“ঠিক আছে। আমি তাহলে উঠবো।”

মাতসুমিয়া বাইরে বের হওয়ার জন্যে দরজা খুলেছে, এসময় পেছন থেকে ডাক দিল মামা।

“জ্বি?”

“শোন, এত কষ্ট করে আমাকে ঘনঘন দেখতে আসার দরকার নেই। তোর নিশ্চয়ই অন্যান্য কাজও থাকে।”

“তোমাকে দেখতে এলে আমার কোন সমস্যা হয় না, আগেও বলেছি।” কিছুদিনের মধ্যেই আবার এসে দেখে যাবে বলে হাসপাতালের রুমটা থেকে বেরিয়ে এলো মাতসুমিয়া।

লিফটে ওঠার আগে নার্সদের বসার ঘরের সামনে গিয়ে তোকিকো কানেমোরির উদ্দেশ্যে একবার হাত নাড়ল। কিছু কথা আছে। প্রশ্নাতুর চোখে বেরিয়ে এলো তোকিকো।

“মামার সাথে কি কেউ দেখা করতে এসেছে এর মধ্যে? আমার মা বাদে।” ওদের এতদিনে চিনে গেছে হাসপাতালের সবাই।

“না, আমার জানামতে কেউ আসেনি,” প্রশ্নটা শুনে একটু অবাকই হয়েছে তোকিকো।

“আমার কাজিন আসেনি? মামাতো ভাই আর কি। মামার ছেলে?”

“ওনার ছেলে? না, আসেনি।”

লিফটে উঠে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মাতসুমিয়া। চেষ্টা করেও কোন কিছু বদলাতে না পারলে অস্থির লাগে ওর। সেটা পরিস্থিতি হোক কিংবা মানুষের মন। মামার জন্যে আরো কিছু করতে পারলে ভালো হতো।

তাকামাসার এরকম ফ্যাকাসে চেহারা এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণ মূলত যকৃত এবং পিত্তথলির ক্যান্সার। কিন্তু তাকে কিছু জানানো হয়নি। ডাক্তার শান্ত করার জন্যে বলেছে কোলানজাইটিস হয়েছে। আসলে তাকামাসার টিউমরটার এমন অবস্থা যে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র ঔষধ প্রয়োগে ব্যাথা কমানো সম্ভব। মাতসুমিয়া আর ওর মা-ও এই বয়সে তাকে কষ্ট দিতে চায়নি, তাই ব্যাথা বেশি হলে মরফিনের ডোজ দেয়ার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।

ডাক্তাররাও কোন আশার বাণী শোনাতে পারেনি। কেউ দেখা করতে এলে তাকামাসা হাসিখুশি থাকলেও, যে কোন মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে সবকিছু।

মাতসুমিয়ার সাথে ওর মামা তাকামাসা কাগার প্রথম দেখা হয় দশ বছর বয়সে। তাকাসাকি ছেড়ে তখন মা’র সাথে টোকিও শহরে পাকাপাকিভাবে চলে আসে ও। যখন মা বলেছিল চাকরির কারণে নতুন শহরে চলেছে ওরা। খুব বেশি কিছু বোঝেনি বিধায় কিছু বলেওনি মাতসুমিয়া

তবে মামার সাথে দেখ হয়ে ভীষণ অবাক হয়েছিল। মা’র দিকে আত্মীয়দের সম্পর্কে ছোট্ট মাতসুমিয়া কিছুই জানত না। ও ভাবতো, মা’র বুঝি কোন ভাইবোন নেই। নানা-নানীও মারা গেছে।

ততদিনে পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে একটা প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিতে কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছে তাকামাসা। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও মেয়ে আর ভাগ্নেকে প্রায়ই দেখে যেত সে। আর প্রতিবার আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসতো কেক, পেটিস বা ক্রোকেট। উঠতি বয়সের মাতসুমিয়া তাই সবসময় অপেক্ষা করে থাকতো মামার আগমনের। গরমের সময় তরমুজ নিয়ে আসতো তাকামাসা।

যে মামা ওদের এত ভালোবাসে তার সাথে এতদিন কেন পরিচয় হয়নি সেটা ভেবে প্রায়ই অবাক হতো মাতসুমিয়া। একদিন আর থাকতে না পেরে মা’কে জিজ্ঞেস করে বসে। জবাবে কাতসুকো বলে যে কিছু কারণে ভাইয়ের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার।

দীর্ঘ একটা সময় এমনকি নিজের বাবা সম্পর্কেও কিছু জানতো না ও। হাইস্কুলে ভর্তি হবার ফর্মে কাতসুকো ওর বাবার নামের জায়গায় ‘প্রযোজ্য নয়’ লিখলে জোরাজুরি শুরু করে মাতসুমিয়া। ছেলের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানে কাতসুকো। তখনই জানা যায় মাতসুমিয়া নামের এক লোকের সাথে সম্পর্ক ছিল তার। কিন্তু সেই লোকের বিবাহিতা স্ত্রী থাকায় সম্পর্কটাকে পরকীয়াই বলা চলে। এক সময় নিজের স্ত্রী’কে ছেড়ে কাতসুকোর সাথে থাকতে শুরু করে সে। কিন্তু আগের স্ত্রী তখনও ডিভোর্স দিতে নারাজ। কিন্তু দু’জনেরই মনে মনে আশা ছিল একসময় বিবাহিত দম্পতি হিসেবে জীবন যাপন করতে পারবে তারা। এসময় কাতসুকোর পেটে আসে মাতসুমিয়া। এর পরপরই ঘটে দুর্ঘটনাটা।

মাতসুমিয়ার বাবা ছিল রেস্তোরাঁর শেফ। এক দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় রেস্তোরাঁটা। মাতসুমিয়ার বাবাও তখন ছিল ভেতরে।

ছোট্ট একটা ছেলেকে নিয়ে তখন একদম একা হয়ে যায় কাতসুকো। একটা বারে কাজ জুটিয়ে নেয়। সেই সময়কার কিছু স্মৃতি এখনও আছে মাতসুমিয়ার প্রায় প্রতি রাতেই মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতো মা। বমি করতো কিচেন সিঙ্ক জুড়ে।

তাকামাসা কাগা একরকম উদ্ধারই করে ওদের। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বোনের ঠিকানা উদ্ধার করে সে। ইচ্ছে করেই নিজেকে পরিবার থেকে দূরে রেখেছিল কাতসুকো। অবশেষে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয় তাদের মধ্যে।

তাকামাসাই কাতসুকোকে সাহস যোগায় টোকিওতে ফিরে আসার জন্যে। সেখানে আরো ভালমতন বোনকে সাহায্য করার সুযোগ মিলবে তার। কাতসুকো ভাইয়ের জন্যে বোঝা হতে চায়নি, কিন্তু ছেলের ভবিষ্যত নিয়েও ভাবতে হয়েছে তাকে।

বোনকে থাকার জায়গার পাশাপাশি একটা চাকরি তো জোগাড় করে দেয়ই তাকামাসা, সেই সাথে মাসে মাসে টাকাও দিত।

মাতসুমিয়া পরে মা’র কাছ থেকে শুনে বুঝেছে যে মামা না থাকলে ওদের জীবনে কষ্টের সীমা থাকতো না। তার বদান্যতায় ঠিক মত মানুষ হতে পেরেছে।

হাইস্কুলে থাকাকালীন সময়েই মাতসুমিয়া পণ করে মন দিয়ে পড়াশোনা করার। নিজেই নিজেকে কথা দেয় যে মামাকে কখনো হতাশ করবে না। হাইস্কুল থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করার পর স্কলারশিপে ভর্তি হয়ে যায় ইউনিভার্সিটিতে।

ও যে পুলিশের চাকরি বেছে নেবে, সেটা আগে থেকে একপ্রকার ঠিক করাই ছিল। যে মানুষটাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে সম্মান করে মাতসুমিয়া, তার পেশাকে আপন করে নিতে সমস্যা কোথায়? এক সেকেন্ডের জন্যেও তাই কখনো অন্য কোন কিছু নিয়ে ভাবেনি।

মামার রোগটা যেহেতু নিয়াময়যোগ্য নয়, তাই মাতসুমিয়া ঠিক করেছে তার শেষ দিনগুলো যেন যতটা সম্ভব আনন্দ এবং শান্তিতে কাটে, সেটার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *