রেডিয়ো
কীসে কী হয় কেউ জানে না। কোনও কোনও রহস্য চিরদিনই থেকে যায়, জ্ঞান বা বিজ্ঞানের কোনও ব্যাখ্যাই তার সমাধান করতে পারে না।
দেশের বাড়িতে আমাদের একটা আদ্যিকালের রেডিয়ো ছিল। সেই রেডিয়োটা আমরা কী করে পেয়েছিলাম, কবে কোথায় কেনা হয়েছিল এসব সংবাদ অল্পবয়সে আমরা জানতে পারিনি। বড় হয়ে জেনেছিলাম সে রেডিয়োটা আমাদের কেনা ছিল না।
ধলেশ্বরী নদীতে একবার এক পাটের সাহেবের নৌকা ডাকাতেরা লুট করে। পরের দিন অতি ভোরবেলা নদীতে স্নান করতে গিয়ে আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকতেন, নদীর জলে রেডিয়োটা ভেসে যেতে দেখে উদ্ধার করেন। তারপর তিন বছর, অর্থাৎ যতদিন সেই ডাকাতির মামলা জেলার দায়রা আদালতে চলছিল, আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের পাটকাঠির বোঝার নীচে লুকিয়ে রাখা হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধের ঢের আগেকার আসল জার্মান মডেলের রেডিয়ো ছিল সেটা। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা জলে চোবানির পর তিন বছর রান্নাঘরের জ্বালানির বোঝর নীচে থাকা সত্ত্বেও তার প্রাণশক্তি ছিল অদম্য।
ডাকাতির মামলা-টামলা মিটে গেলে প্রথম যখন সেটাকে চালু করা হল সে এক এলাহি ব্যাপার। ছাদের দুই প্রান্তের কার্নিশে দুই গগনচুম্বী বাঁশ, তার মাথায় দীর্ঘ এরিয়েল, বিশাল পায় আধমণি ওজনের ড্রাই ব্যাটারি। রেডিয়োটা খোলার পরে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে গোঁ গোঁ করে শেষে হুঙ্কার দিতে লাগল, আর সে কী হুঙ্কার! গোপনে বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে শেষের কোঠায় ঠাকুরঘরে সেই যন্ত্রটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই হুঙ্কারে সারা পাড়া কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। কিছুতেই বন্ধ করা যায় না, নব ঘোরালেও বন্ধ হয় না। শব্দ কমানোর জন্য শেয়ে দুটো তোশক চাপা দেওয়া হল রেডিয়োটাকে। শব্দ সামান্য কমল বটে কিন্তু ততক্ষণে পাড়ার বহু লোক আমাদের বাসায় ছুটে এসেছে। আর পুরনো তোশক ফেটে তুলো উড়তে লাগল—কোনও সুদক্ষ ধুনুরীও সে ভাবে তুলে ধুনতে পারে না।
সুখের বিষয়, পাড়ার অধিকাংশ লোকই আমাদের হিতৈষী ছিলেন। তাঁরা কী বুঝলেন কী জানি তবে তাঁদের মধ্যে একজন পরামর্শ দিলেন কয়েক কলসি জল রেডিয়োটার উপরে ঢালবার জন্যে। কী করে শেষে সেদিন রেডিয়োটা বন্ধ করা হয়েছিল, এখন আর ঠিক বলতে পারব না, সেসবই আমাদের খুব ছোটবেলার কথা।
আমরা জ্ঞান হতে দেখেছি রেডিয়োটা আমাদের বাড়ির সঙ্গে, বাড়ির চরিত্রের সঙ্গে সর্বতোভাবে মিশ খেয়ে গিয়েছিল। সেই যে প্রথম দিন খোলার পরে বন্ধ করা হয়েছিল, তারপর আবার কে যেন কবে সাহস করে খুলেছিল আর বন্ধ করা যায়নি। সারা দিন রাত মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একা একাই চলত। তখন নতুন ইলেকট্রিক এসেছে আমাদের শহরে। কী এক কৌশলে এক মফস্বল মিস্ত্রি সেই রেডিয়োটা থেকে একটা তার টেনে জুড়ে দিয়েছিল সরকারি পোস্টের সঙ্গে। সেই কারেন্টে সেই ড্রাই সেলের রেডিয়ো দিন-রাত্রি চলত। মাঝে মাঝে বিচিত্র সব রেডিয়ো স্টেশনের বিচিত্র সব কণ্ঠস্বর, হাসি-কান্না-গান শোনা যেত। যখন খুব অসহ্য হত, আমার এক কাকা, তিনিই আমাদের বাড়িতে সবচেয়ে সাহসী ছিলেন, দূর থেকে একটা কাঠের ডান্ডা দিয়ে রেডিয়োর মিটারের চাকাটা একটু ঘুরিয়ে দিতেন। তাতে একটু একঘেয়েমি কেটে যেত কিন্তু রেডিয়োটা কিছুতেই বন্ধ হত না।
আসলে রেডিয়োটা বন্ধ করার সাহস কারও ছিল না। কী এক অজ্ঞাত এবং অনৈসর্গিক কারণে যন্ত্রটার দেড় গজের মধ্যে কেউ গেলে পরে তার ভিতর থেকে সেই প্রথম দিনের হুঙ্কার মুহুর্মুহু বেরিয়ে আসত, অতি দুঃসাহসী লোকেরও তাতে হৃৎকম্প হওয়ার কথা। আমার যে সাহসী কাকা মিটারের চাকা ঘোরাতেন, তিনি চাকা ঘোরাতে যাওয়ার আগে পায়ে গাম-বুট হাতে চামড়ার দস্তানা পরে নিতেন। তারপর সেই দস্তানা-পরা হাতে একবার গৃহদেবতাকে প্রণাম করে নিয়ে অতি সন্তর্পণে রেডিয়োটার দিকে এগোতেন। কখনও কখনও শনিবারের বারবেলা বা জন্মবার হলে ঠাকুমা বাধা দিতেন, কান্নাকাটিও করতেন, কিন্তু কাকা তাতে দমতেন না একেবারেই।
রেডিয়োটা থাকায় আমাদের একটা পারিবারিক সুবিধা হয়েছিল। লোভী শিশু এবং কুকুর- বিড়াল ইত্যাদি গৃহপালিত জন্তুর মুখ থেকে রক্ষা করে আচার ফল মিষ্টি ইত্যাদি লোভনীয় খাবার রাখবার জায়গা সব একান্নবর্তী পরিবারেই দরকার পড়ে। রেডিয়োর ঘরটা আমাদের পরিবারে এই কাজে লাগত। আমাদের এক বৃদ্ধা পরিচারিকা, কাকার অনুপস্থিতিতে, কাকার গাম-বুট ও দস্তানা পরে ওই রেডিয়োর ঘরে খাবার-দাবার রেখে আসত, ট্রেজারিতে রেখে এলেও কোনও জিনিস ওর চেয়ে সাবধানে রাখা যেত না।
দুঃখের বিষয় উনিশশো বেয়াল্লিশ সালে আগস্ট বিপ্লবের সময় এই বেতারযন্ত্রটির জন্য আমরা ঘোরতর বিপদে পড়ি। পাড়ার আর দশটি বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়িও সার্চ হয়। সেই সময় রেডিয়েটি পুলিশের নজরে আসে, একজন সরল প্রকৃতির দারোগা রেডিয়োটায় হাত দিয়ে কী দেখতে গিয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। একজন পেটমোটা সেপাই এই দেখে, ‘বাপরে, মর গিয়ারে’ ইত্যাদি বলে প্রাণপণ চেঁচাতে থাকে। তারপর আর যা যা কেলেঙ্কারি হওয়া সম্ভব সবই হয়।
একে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তায় জার্মান মডেল, তারও নেই লাইসেন্স, তার উপরে সরকারি তার থেকে অবৈধভাবে একটানা কারেন্ট চুরি—সেবার সেই বিপদ থেকে আমার জজ-কাকারা কী করে উদ্ধার পেয়েছিলেন, ঈশ্বর জানেন। কিন্তু রেডিয়োটা আর উদ্ধার করা যায়নি। উচ্চতর তদন্তের প্রয়োজনে সেটাকে কলকাতায় আই বি বিভাগের সদর দপ্তরে চালান করা হয়েছিল তারপর কী হয়েছিল কেউ জানে না।