রেডার যন্ত্রের ঝড়ের সংকেত
তেরতলা নতুন সেকরেটারিয়েট ভবনের ছাতে গত ১৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় অসামরিক পরিবহণ এবং পর্যটন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীমতী সরোজিনী মহিষী, কিছুদিন আগে চালু ঝড়ের সংকেত নির্দেশক রেডার যন্ত্রটিকে ঠিক সময়মতো আনুষ্ঠানিকভাবে বোতাম টিপে আবার চালু করে দেওয়ায় আমাদের পশ্চিমবঙ্গ এক দারুণ ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। শ্রীমতী মহিষীকে আমরা তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
শ্রীমতী সরোজিনী মহিষী অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে জাপানে নির্মিত ঝড়ের সংকেত নির্দেশক ওই রেডার যন্ত্রটি যদি বোতাম টিপে ওইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না করতেন তবে ওই রেডার যন্ত্রটির পক্ষে পরদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঝড়ের সংকেত পাঠানো সম্ভব হত না। ফলে আমাদের গতিশীল মুখ্যমন্ত্রী ১৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতায় এসে পৌঁছাতেন এবং পৌঁছেই প্রচণ্ড এক ঝড়ের মুখে পড়তেন।
তাহলে সর্বনাশ যে কতদূর গড়াত সে-কথা আপনারা আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মহাশয়ের মুখেই শুনুন।
সত্যি বলতে কি আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ বললেন, এমন প্রচণ্ড একটা ঝড় যে উঠবে, এমন কোনও ইঙ্গিত আমরা খালি চোখে ধরতে পারিনি। ঝড়ের সংকেত নির্দেশক রেডারই আমাদের এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। আগে থেকে কোনও রকম ইঙ্গিত না দিয়েই এই আকস্মিক ঝড় শাসক কংগ্রেসের কর্ম সমিতির বৈঠকের উপর আছড়ে পড়ে। প্রায় ঘণ্টা চারেক ধরে এই ঝড়ের প্রচণ্ড আক্রমণ একটানা চলে। কোনও এক সময় এর গতিবেগ একশ কুড়ি কিলোমিটার পর্যন্ত উঠেছিল। আমাদের খাদ্যমন্ত্রী এই ঝড়ের দাপটে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে যান।
জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে বলা হয়, আমি দেখলাম ঝড় উঠল। বাতাসের প্রচণ্ড কোলাহল শুনে এক সময় মনে হল, শ দুয়েক রমণী বুঝি তারস্বরে চীৎকার করছেন। খাদ্যমন্ত্রী ঝড়ের একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলেন। তিনি নিচু হয়ে উঁচু হয়ে কোনও কিছুর আড়াল খুঁজে প্রাণপণে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু বৃথা। ঝড়ের এক একটা ঝাপটায় তাঁর সহজাত প্ৰফুল্লভাব উড়ে বেরিয়ে গেল, চাদর-জামা, ডিউ স্লিপ, ইমেজ সাঁ সাঁ করে ঘূর্ণী ঝড়ের প্রচণ্ড টানে কোথায় উড়ে গেল।
পাছে মুখ্যমন্ত্রীরও এই অবস্থা হয় রেডার বিশেষজ্ঞ জানালেন, তাই আগেভাগেই আমরা হট লাইনে তাঁকে রেডারের সংকেত জানিয়ে দিয়েছিলাম।
মুখ্যমন্ত্রীকে জানালাম স্যর, রেডার ঝড়ের সংকেত দিচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী : ঝড়, কোথায় ঝড়?
বিশেষজ্ঞ : স্যর, রেডার বলছে, আপনি এখন আসবেন না, কলকাতায় আসবেন না। ওখানেই থাকুন।
মুখ্যমন্ত্রী : ননসেন্স। আমি কলকাতার কাজে দিললি এসেছি। এখন দিল্লির কাজে কলকাতা যাব। রেডার তাতে নিষেধ করার কে? আমি শুধু আমার নেতা আই মিন মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চলি। তিনি চান না আমি খামাখা দিল্লিতে পড়ে থাকি। কলকাতায় আমাকে যেতেই হবে। বিশেষজ্ঞ : সরি স্যর, আমার হয়তো বলাটা ভুল হয়েছে। মানে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারিনি। আপনি স্যর নিজেই রেডারের সঙ্গে কথা বলুন। এই যে, লাইন দিলাম।
অতঃপর মুখ্যমন্ত্রী এবং রেডার যন্ত্রের মধ্যে যে সংকেত-বার্তা বিনিময় হয়, তার পাঠোদ্ধার করলে সেটা হয়তো এইরকমই দাঁড়াবে। যথা :
রেডার : হ্যালো চিফ। আরি গাতো গদাই মস্তা।
মুখ্যমন্ত্রী : কি হে। কী সব ভুল বকছ?
রেডার : সরি চিফ! জাপানী বলে ফেলেছি। অনেক দিনের অভ্যেস কি না। চিফ হাওয়া খারাপ। ঝড় উঠেছে।
মুখ্যমন্ত্রী : কি রকম ঝড়?
রেডার : ফিমেল ঝড় স্যর!
মুখ্যমন্ত্রী : ফিমেল ঝড়? হোয়াট ডু ইউ মিন?
রেডার : ফিমেল মানে মেয়েছেলে স্যর! আই মিন্ লেডি। লেডি-ঝড় স্যর।
মুখ্যমন্ত্রী : ঝড়ের কারেকটার কী?
রেডার : ঘরের ঝড় স্যর! লেডি-মেড়।
মুখ্যমন্ত্রী : কী বললে? রেডি-মেড ঝড়?
রেডার : রেডিমেড নয় স্যর, লেডি-মেড্। এ স্যর মহিলা কংগ্রেসী ঝড়।
মুখ্যমন্ত্রী : কোন্ কংগ্রেস? সংগঠন?
রেডার : না স্যর। প্রগতিশীল মহিলা কংগ্রেসী ঝড়। এর সঙ্গে শিক্ষা বাঁচাও ঝড়ের ধাক্কাও মিশে আছে।
মুখ্যমন্ত্রী : এখন অবস্থা কী?
রেডার : লেডি-মেড্ ঝড়ের দাপট একেবারে তুঙ্গে উঠেছে। ওঃ ওঃ ওঃ চিফ্! এখন প্রার্থনা করুন। প্রার্থনা করুন।
মুখ্যমন্ত্রী : কী হল? কী হল? হ্যালো হ্যালো রেডার, কী হল?
রেডার : খাদ্যমন্ত্রী, চিফ খাদ্যমন্ত্রী!
মুখ্যমন্ত্রী : গড হেভেনস! হ্যালো হ্যালো হ্যাললো রেডার।
রেডার : হ্যালো চিফ।
মুখ্যমন্ত্রী : খাদ্যকান্তি আই মিন খাদ্যমন্ত্রী। আমার সব থেকে প্রিয় সব থেকে বিশ্বস্ত সব থেকে সুদক্ষ সহকর্মী, সহযোগী, সেনাপতি। তোমায় আমি ভুলব না ভাইটি!
রেডার : চিহ্ন চিফ্! গুড নিউজ! খাদ্যমন্ত্রী—
মুখ্যমন্ত্রী : হ্যাঁ হ্যাঁ, খাদ্যমন্ত্রী—
রেডার : আত্মরক্ষার জন্য চার ঘণ্টা ধরে—
মুখ্যমন্ত্রী : হ্যাঁ, হ্যাঁ, চার ঘণ্টা ধরে—
রেডার : বীরের মতো লড়াই করে—
মুখ্যমন্ত্রী : বল বীর চির উন্নত মম শির।
রেডার : অবশেষে-
মুখ্যমন্ত্রী : বল বল রেডার। তাঁর গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বের কথা বল!
রেডার : আশ্চর্য কৌশলে ত্রাণমন্ত্রীর হাত ধরে পিছনের দরজা দিয়ে সাফল্যজনক পশ্চাদাপসরণ করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী : বরাবরই ও চতুর কৌশলী।
রেডার : চিফ তারপরই ঝড় থেমে গিয়েছে। কোসট ইজ ক্লিয়ার। এখন আপনি আসতে পারেন।
মুখ্যমন্ত্রী : আজকের প্লেন চলে গিয়েছে। কাল ভোরেই পৌঁছাবো।
পরবর্তী সংবাদ এই যে, রেডারের নির্দেশে মুখ্যমন্ত্রী পরদিন নিরাপদে কলকাতায় এসে পৌঁছান।
২৩ জানুয়ারি ১৯৭৪