রূপোল্লাস

রূপোল্লাস

‘রসো বৈ সঃ’—শ্ৰীভগবান রসময় এবং রসগ্ৰাহ্য। এই রস নাম এবং রূপের সাহায্যে অনুভূতিগম্য। এই রসকে বুঝিতে পারিলে শ্ৰীভগবানকে বুঝা যায়। সুতরাং নাম ও রূপ না বুঝিলে ভগবৎ-অনুভূতি সম্ভবপর হয় না। ইংরেজীনবীস দার্শনিকগণকে দুইটি ইংরেজী প্রতিশব্দে নাম ও রূপের মৰ্ম্মের কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত করা সম্ভবপর হইতে পারে। ইংরেজী দার্শমিক ভাষায় নামকে Concept বলিয়া ভাষান্তরিত করিতে পারি; রূপের প্রতিশব্দ Percept বলিলেই বোধ হয়, পৰ্যাপ্ত হইতে পারে। Concept এবং Percept এই দুই বিষয়ে সমন্বয় সাধন করিতে পারিলে ভগবৎবিভূতির আংশিক অনুভূতি হইতে পারে।

বিষয়টা আরও একটু খুলিয়া বলিবার চেষ্টা পাইব। কেন না, ভক্তিশাস্ত্র এবং ভগবদ্যারাধনাপদ্ধতি এই নাম ও রূপের বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতবর্ষের উপাসনাপদ্ধতি ঠিকমত বুঝিতে হইলে, নাম ও রূপের–অন্তর্নিহিত গুপ্ত কথা কিছু বুঝিতেই হইবে। অম্ভণকন্যা বাককথিত দেবীসুক্তের আত্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা অবলম্বন করিয়া শাণ্ডিল্য ও নারদ ভক্তিসূত্র রচনা করিয়াছেন–সেই ব্যাখ্যার বিবৃতি মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে সম্যক ভাবে করা হইয়াছে। —তন্ত্রের সকল সিদ্ধান্তগ্রন্থেই ঐ ব্যাখ্যাই হেঁট মুণ্ডে গ্ৰহণ করা হইয়াছে;-বৈষ্ণব ভক্তিসাধনপদ্ধতিতে ঐ ব্যাখ্যা অগ্ৰাহ করা হয় নাই। দেবীসূক্ত না বুঝিলে ভক্তিশাস্ত্র বুঝা যায় না। মনীষী শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্ৰিবেদী ‘কালস্রোত’ নামক একখানি পুস্তকের সূচনা লিখিতে যাইয়া দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিতে প্ৰয়াস পাইয়াছেন। ‘সাহিত্য’ নামক মাসিক পত্রে গত দুই বার দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে এই সন্দর্ভলেখকও দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিতে যত্নশীল হইয়াছেন। এই সকল গোড়ার কথার একটু পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন; কেন না, নাম ও রূপ বুঝিতে হইলে একটু গোড়ার কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক।

এই সৃষ্টিপ্ৰহেলিকার মধ্যে এক জ্ঞাত আমি; আমি ছাড়া আর যাহা কিছু, তাহা আমারই জ্ঞেয়; জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের সম্বন্ধ যাহার দ্বারা সাধিত হয়, তাহাই জ্ঞান। সুতরাং সৰ্ব্বাগ্রে জ্ঞাতাকে বুঝিতে হইবে। জ্ঞাতা আমি–দশোন্দ্ৰিয়সংযুক্ত, শ্রবণ-মনন-নির্দিধ্যাসনসমেত, একাদশ আসক্তিসমন্বিত দেহী আমিই জ্ঞাত। আমি কে? বলিতে পারিলাম না। আমি কে। তবে এইটুকু বুঝি যে, আমি সর্বময় ও সর্বব্যাপী। দর্শন, শ্রবণ, আস্বাদন, আত্মাণ প্ৰভৃতির সাহায্যে আমি যাহাদের বা যে সকল বিষয়ের অনুভূতি সাধন করিয়া থাকি, সে সকলই আমিময়, আমার আমিত্বে মাখা, আমার বৈশিষ্ট্যবিজড়িত। অম্ভণকন্যা বাক শ্রুতির অপূর্ব ভাষায় এই সিদ্ধান্তটি মানবসমাজকে এবং সাধকবর্গকে বুঝাইয়া দিয়াছেন। শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর যে প্ৰকার সরল ভাষায় দেবী সূক্তের ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা অধিকতর সরল ভাযায়। উহার ব্যাখ্যা সম্ভাবে না। বাহুল্যভয়ে আমি তাহার সন্দর্ভের পুনরুদ্ধার করিলাম না, এবং গত কার্ত্তিক মাসের ‘সাহিত্যে’ প্ৰকাশিত “উপাসনাতন্ত্ৰ” শীৰ্ষক আমার লিখিত সন্দর্ভের অংশবিশেষ উদ্ধার করিলাম না। সুধী পাঠক এই দুইটি সন্দর্ভ পড়িয়া লইলে, লেখকের পরিশ্রমের লাঘব হইবে। ঐ দুইটি সন্দর্ভের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করিয়া আমরা নাম ও রূপের আলোচনা করিব।

বলিয়াছি ত, নাম concept অর্থাৎ যাহা চিন্তার অভিজ্ঞান, যাহা নিজে বুঝি, পরকে নিজের মতন করিয়া বুঝাইতে পারি না,-যাহ ভিতরে ফুটিয়া উঠে, বাহিরে শব্দমাত্রে অভিব্যক্ত হয়,-যাহা অনেকটা মূকাস্বাদনবৎ, বোবার মিষ্টান্ন আস্বাদনের মতন, ভোজনান্তে যে আহিলাদের প্রকটন হয়, তাহা কদাচিৎ একটা চীৎকারে অভিব্যক্তি হইলেও হইতে পারে,-তাহাই নাম। শিশুকে দাম্পত্য রসের আস্বাদন দেওয়া যায় কি? যে জন্মমাত্রেই পিতৃহীন, তাহাকে পিতৃস্নেহের মৰ্ম্ম বুঝান যায় কি? সূৰ্য্যোদয়, সূৰ্য্যাস্ত প্রভৃতি নৈসৰ্গিক লীলা তুমি আমি সবাই দেখি-নয়ন ভরিয়া দেখি। পরন্তু সে রূপ দেখিয়া উভয়ের মনে যে ভাবোদয় হয়, তাহ কেহই কাহাকেও ঠিকমত বুঝাইতে পারি না। বুঝাইতে পারি না বটে, তবে বুঝাইবার চেষ্টায় ইঙ্গিত করিয়া থাকি। তুমি আমার ভাবের ভাবুক হইলে সে ইঙ্গিত কতকটা বুঝিলেও বুঝিতে পার। এই ইঙ্গিতই নাম। অন্তরঙ্গ ভাবের দ্যোতনাকেই নাম বলা যায়। তাই নাম বড়, রূপ তদপেক্ষা ছোট। তাই কৃষ্ণ অপেক্ষা কৃষ্ণনামের গুরুত্ব অধিক। রূপবিলাসিনী সত্যভামা এইটুকু বুঝিতে পারেন নাই,–কেবল রূপসাগরেই ডুবিয়াছিলেন, রূপের মহত্ত্বে বিমূঢ় ছিলেন ; দৰ্পহারী মধুসূদন অপুর্ব ছলে সত্যভামার সে ভ্রম অপসারণ করিয়াছিলেন। মহাভারতের পারিজাতহরণ এবং সত্যভামার দর্পচূৰ্ণ আখ্যায়িকা, নামের মাহাত্ম্যই, অর্থবাদের সাহায্যে বুঝাইয়াছেন।

রূপ–percept। যাহা রসগ্রাহ্য, তাহাই রূপ; যাহা অনুরাগ ও বিরাগের বিষয়ীভূত, তাহাই রূপ; যাহা অনুভবীর মানস পটে ফুটিয়া উঠে, যাহা ছায়া প্ৰতিচ্ছায়ার হিসাবে ভিতরে ও বাহিরে-বাহিত্যু প্ৰকৃতিতে এবং অন্তঃপ্রকৃতিতে প্রকট হয়, তাহাই রূপ। কেবল বাহ প্ৰকৃতি রূপ নহে, দশোন্দ্ৰিয়গ্ৰাহী যাহা, কেবল তাহাই রূপ নহে। প্রকৃতির আস্তরণে রসের বিকাশ হইলেই রূপ ফুটিয়া উঠে। রূপ ফুটে বটে, পরন্তু উহার উপভোগে তৃপ্তি নাই৷

“জনম অবধি হাম সে রূপ নেহারিনু
নয়ন না তিরপিত ভেল।“

তৃপ্তি হয় না, যত দেখি, তত আরও দেখিতে সাধ যায়,–নয়নময় হইয়া মীনের ন্যায় নির্নিমেষ নয়নে অনবরত দেখিতে থাকিলেও দেখার সাধ মিটে না। কেন না, অনুরাগাপিপাসার উপর দর্শন স্পৰ্শন আদি ক্রিয়ার প্ৰতিষ্ঠা। এই গতিশীল সৃষ্টিচাতুরীর মধ্যে স্থির কিছু নাই; সব চলিতেছে, ক্ষণে ক্ষণে সকলের পরিবর্তন হইতেছে। কাজেই যাহা দেখিতে সাধ যায়, নয়ন পালটিলে বা ক্ষণকাল অতিবাহিত হইলে তাহা ত আর থাকে না।–যে ছবি নিমেষের জন্য নয়নের উপর পাড়িয়াছিল, তাহা ত আর থাকে না-তাই দেখার সাধ আর মিটে না। অনুভূতিতে তৃপ্তি নাই। — রসের পিপাসা মিটে না। তাই রূপের সাগর-অনন্ত উৰ্ম্মিমালায় আন্দোলিত, কোটি বীচিবল্লৱীখচিত, তরঙ্গভঙ্গবাকুল রূপের সাগর। এ সাগরে স্থির থাকে কাহার সাধ্য! স্থির থাকে না, স্থির থাকা যায় না। বলিয়াই সাধ মিটে না। ‘লাখ লাখ যুগ’ সে রূপ হেরিলেও উহা নিতুই নূতন一ক্ষণে নূতন, পলে পলে নূতন। নবীনতার অসংখ্যা ও অব্যয় আন্দোলনে–প্ৰকম্পিনে–শিহরণে রূপের বিকাশ। ফলে সে রূপে তৃপ্তি নাই।

কিন্তু আছে—তুমি আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি-উভয়ের নবীনতা উভয়ের ভাবে ডুবিয়া যাউক—তাহা হইলেই রূপের তৃপ্তি নাই।

কিন্তু আছে—তুমি আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি—উভয়ের নবীনতা উভয়ের ভাবে ডুবিয়া যাউক—তাহা হইলেই তৃপ্তি সম্ভবপর হয়।

“তুয়া অপরূপ  রূপ হেরি দূর সঞে,
লোচন মন দুঁহু ধাব।“

যখন লোচন ও মন-দু-ই রূপ দেখিবার জন্য ধাবিত হইবে, তখন প্ৰাণ হইতে ঝঙ্কার উঠিবে,

‘সজনি, ভাল করি পেখন না ভেল।
মেঘমালা সঞে  তড়িতলতা জনু,
হৃদয়ে শেল দেই গেল।।“

এই অতৃপ্তি উভয়ের মনে জাগিয়া উঠিবে। যখন উঠিবে, তখন দেখিবে এবং বুঝিবে,–

‘যত রূপ তত বেশ  ভাবিতে পাঁজর শেষ,
পাপ চিতে নিবারিতে নারি।“

তখন মনে মনে স্বতই এই ভাব জাগিয়া উঠিবে, —

‘দুঁহু মুখ সুন্দর কি দিব তুলনা।
কানু মরকত মণি, রাই কাঁচা সোনা ৷।”

তখনই রূপের তৃপ্তি। বিভোরতায়—বিহ্বলতায়—বিমূঢ়তায়—রূপসাগরে ডুবিয়া অতল তলে ডুবিয়া যাওয়ায় রূপের পরিতৃপ্তি। উপভোগ এবং আস্বাদনে নহে। একেবারে আত্মহারা হইয়া পাথরের মত ডুবিতে হইবে, তবে তৃপ্তি সম্ভবপর হইবে।

বিকাশে ও বিলাসে রূপ, সঙ্কোচে এবং কেন্দ্রীকরণে নাম। নাম–বংশীরব; রূপ–ব্ৰজবিলাস। নাম–অনাহত ধ্বনি; রূপ–ধ্যানগম্য বিকাশ। নাম—শ্ৰীরাধা; রূপ–শ্ৰীমতী। নামের আহ্বানে রূপের বিকাশ। প্রথমে বংশীধ্বনি, তবে অভিসার। আর কেমন করিয়া বুঝাইব—নাম ও রূপ কি ও কেমন? জানি তোমায় নামে; সেই নামের উপর রসের ঢেউ খেলিয়া রূপের কোটিবালেন্দুবিকাশ হয়। গায়ত্রীর ঝঙ্কারে জগজ্যোতির অপরূপ রূপ ফুটিয়া উঠে। সে রূপ দেখিয়া তবে ‘তৎসবিতুৰ্বরেণ্যং’কে খুঁজিবার সাধ হয়। শিশু মহাঘোরে মা বলিয়া–ক্ৰন্দনের নাম-রোলে ভূমিষ্ঠ হয়; তাহার পর ধীরে ধীরে বয়ঃপ্ৰাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মাতৃরূপ দেখিতে পায়। নব বসন্তের সূচনার পূর্বেই ভিতরে ও বাহিরে কিসের ও কাহার ডঙ্কা বাজিয়াছে, কাহার কাড়া-নাকার পড়িয়াছে, তাই বৃক্ষচৰ্ম্ম ভেদ করিয়া নব কিশলয়সকল নবানুরাগে লোহিতাভ হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে, কোকিলের রবে পঞ্চমের শব্দমদিরা কে যেন ঢালিয়া দিতেছে,–আমি নয়নময় হইয়া তোমার নূতন রূপ দেখিতেছি। তুমিও আমায় দেখিতেছ। তোমার নবীনতার আপ্লাবনে আমিও ত নিতুই নৃতন; তুমি নবীন কিশোর, রসের সাগর; নবীনা কিশোরীর নবীনতার সুষম তুমিও ত দেখিবে! আমারই মতন নয়নময় হইয়া পলকহীন নয়নে তুমিও ত দেখিবে! আমি গাছভরা ফুলের আলোয় মুগ্ধ হইয়া,দেখিতে থাকি। ফুল কি আমায় দেখে না? নিশ্চয়ই দেখে; নহিলে আমি দেখিব কেন? আমি যাহাকে দেখিয়া পাগল হই, সে নিশ্চয়ই আমাকে দেখিয়া পাগল হয়। চাদ দেখে, সূৰ্য্য দেখে, তারকাগণ। দেখে,–গগনের কোটি শোভা কোটি নয়নে দেখে-তরু লতা পাতা, পুষ্প ফল কোরক,–আব্রহ্ম তৃণ পৰ্য্যন্ত সবাই দেখে। কেন না, আমি যে সকলকে দেখি-বিস্ময়বিস্মফারিত নেত্ৰে কেবলই দেখি। এই দেখাদেখিই রূপোল্লাস, এই নয়নে নয়নে মেশামিশিই রূপোল্লাস।

তুমি আমি দেখাদেখির ব্যাপারে মাতিয়া থাকিলে এ দেখাদেখির মাধুৰ্য্য উপভোগ করিবে কে? সাধকের সেইটুকুই লাভ। সাধক তৃতীয় ব্যক্তি হইয়া দূরে দাঁড়াইয়া কেবল দেখেন। এই মাধুৰ্য্য উপভোগ বৈষ্ণব ভক্তিশাস্ত্রের বিশিষ্টতা; এই তৃতীয়ের অবধারণই ভক্তিশাস্ত্রের মৌলিকতা। তৃতীয় ব্যক্তি না থাকিলে সাধনা যে দুষ্কর হইয়া পড়ে; বিশেষতঃ মধুর রসের সাধনা-প্রেমের উন্মেষ ঘটাইতে হইলে কিছু কালের জন্য তৃতীয় ব্যক্তি হইয়া দাঁড়াইতেই হইবে। দূতী না থাকিলে রসের বিকাশ ঘটবে কেমন করিয়া! ভক্তি এবং প্রেমের এই বিভিন্নতা বুঝিবার ও বুঝাইবার বিষয়। প্রয়োজন হইলে ইহার আলোচনা পরে করিব। আপাততঃ নাম ও রূপের বিবৃতি সংক্ষেপে দিয়া রূপোল্লাসের চিত্ৰ দেখাইলাম। বলিবার কথা বলা হইল না; যিনি বলাইবার মালিক, তিনি কুপা না করিলে বলা হইবে না।

“মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম।
যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম৷।“

(‘প্রবাহিণী, ১০ মাঘ ১৩২০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *