রূপের মঞ্জরি, বেদনার নিনাদ

রূপের মঞ্জরি, বেদনার নিনাদ

একটা সমাজের চিত্র আঁকছি এই বর্ণনায়। তার ভেতরের নারীদের অবস্থা আলাদা করে না বললে সে চিত্র পূর্ণতা পায় না। তাই কাশ্মীরের কন্যা ও ললনাদের রূপ, গুণ এবং জীবনের কথা কিছুটা তুলে ধরা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, হাটেবাজারে, পথে-ঘাটে পুরুষদের পাশাপাশি দেখেছি নারীদের। দেখেছি বৃদ্ধা-যুবতী, ভীত ও সাহসী নারীদের। ঠাণ্ডায় অথবা লজ্জায়, সঠিক কারণটা আমার অজানা, লাল হয়ে যাওয়া গাল দেখেছি নারীর। স্কুল ছুটির পর লাইন ধরে হেঁটে চলা ছোট্ট কিশোরীদের রক্তাভ কপলে কতবার যে হাতের ছোঁয়া দিতে ইচ্ছা হয়েছে তা বলে বোঝাতে পারব না।

কিশোরীর চেয়ে একটু বয়সী, তরুণীর দিকে যখন দৃষ্টি দিয়েছি, মনে হয়েছে, গাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসে এখনি বুঝি আমাকে আহত করবে। তাই দৃষ্টি নত করতে বাধ্য হয়েছি। কালো দীঘল কেশরাশি হাঁটুর নিচে দোল খেতে দেখেছি; তবে খুবই কম, শতকরা দু’একজনের। অধিকাংশের চুল কিছুটা বাদামি আঁচ লাগা হালকা কোঁকড়ানো। রূপসী নারীর দিকে দৃষ্টি পড়ার পর সরিয়ে নিতে ভুলে গিয়েছি কখনও। কারও নির্লজ্জ হাসি আর দুষ্টুমির কাছে আমিই বোকা বনেছি। কেউ সাবলীলভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্যামেরা এগিয়ে দিয়ে একটি ছবি তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। ছবিটি ক্লিক করেছি।

আর কোনো আলাপের সুযোগ না রেখে ধন্যবাদ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছে। কারও কারও নীরবতা আর লজ্জার খোলস ভেঙে ভেতরে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছি। পথে চলতে চলতে এক নারীর রূপ দেখে চমকে উঠেছি। পলক ফেরানোর আগেই আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হয়েছি স্তম্ভিত। একি? এত রূপসী হয় নাকি! তবে, দূর থেকে উজ্জ্বল-ঝলমল নারীর মুখ দেখে যতটা চমকৃত হতাম, কাছে গেলে তার অনেকখানি যেত ফিকে হয়ে। অতি-সুন্দর যেন আমার চোখে সইত না।

বাংলাদেশে প্রচলিত আছে কাশ্মীরের মেয়েরা সুন্দর। শুধু বাংলাদেশ কেন, এ খবর সারা পৃথিবীরই জানা। যদিও সেই সুন্দরের সংজ্ঞা বড় পুরুষালি। কাশ্মীরে যাওয়ার আগে ফেসবুকে লিখেছিলাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষই সুন্দও; রূপসী বা রূপময়। কারও রূপ লজ্জার আবরণে আবৃত, লুকায়িত কিংবা পাপড়ির ভঁজে মোড়া মঞ্জরির মতো। কারও রূপ আবার উজ্জ্বল, উন্মুক্ত উদ্দাম; উল্লাসে হেসে খেলে কাছে আসে; দৃষ্টি কাড়ে সহজে। সহজে দৃষ্টি কাড়ে বলেই আমরা বলি

সুন্দর’ বা ‘সুন্দরী’। সুন্দরের খোঁজে আমরা অনুসন্ধানে ব্যপৃত হই না; আমরা চক্ষুমেলিয়া দেখি না। যাদের লুকায়িত সৌন্দর্য আমাদের দৃষ্টিতে আসে না আমরা বলে দেই তারা অসুন্দর।’ এই সুন্দরের বৈচিত্র্যের মধ্যে কাশ্মীরি মেয়ের রূপ হলো যেন আবৃত রাখার পরও অনাবৃত। সে যেন গভীর কোনো খাদ, যার কিনারে গেলে ডুবতে হয়।

এমন সুন্দরের মেলা দেখে একদিন কাশ্মীরের বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সব মেয়েই তো সুন্দর! তোমরা কাশ্মীরি যুবকেরা এত সুন্দরের মধ্য থেকে একটা মেয়েকে বৌ হিসেবে কিভাবে বাছাই করে থাকো? বন্ধুও ঠাট্টা করে জবাব দিল, এজন্যই অনেক (সবাই নয়) কাশ্মীরি যুবক একাধিক প্রেম করে। আজ একজনকে কমিটমেন্ট দেয়। কাল নতুন কাউকে দেখে অস্থির হয়ে ওঠে। তবে, এই বর্ণনার বৃহদাংশ গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর শহরের মধ্যবিত্তের। সংখ্যার বিচারে পথে দেখা পাওয়া নারীদের অধিকাংশই হিজাব পরা। বোরখা বা সালোয়ার কামিজের ওপর ওড়না দিয়ে মাথা মোড়ানো, মুখ খোলা।

দ্বিতীয় সংখ্যক দেখেছি সালোয়ার-কামিজ ও ওড়না পরা। সামনের দিকে মাথার চুল কিছুটা দেখা যায় এমন। ওড়নার শেষ দিয়ে পেছনের চুলের অগ্রভাগও দেখতে পেয়েছি অনেকের। তৃতীয় সংখ্যা হচ্ছে নেকাব মোড়ানো- সমস্ত শরীর। এমনকি দুই চোখেও কালো চশমার আবরণ দেওয়া। এই সংখ্যা নিরূপণের জন্য একটি সাংখ্যিক গবেষণার কোশেশ করেছিলাম কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ৭ই মে ২০১৫ সকাল ৯:৫০ মিনিটে প্রধান ফটকে (স্যার সাঈদ গেট) বসে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম ক্যাম্পাসে আগমনরত নারী-মেয়েদের। ২০ মিনিটে সর্বমোট ২০৪ জন নারীকে প্রবেশ করতে দেখেছি। এর মধ্যে হিজাব পরা ছিল ১১৫ জন। সালোয়ার-কামিজ ও ওড়না পরা ছিল ৫৯ জন। কালো নেকাব মোড়ানো ছিল ২২ জন এবং মাত্র ৮ জনকে দেখেছিলাম স্যালোয়ার কামিজের ওপর কোনো ওড়না না পরেই ক্যাম্পাসে আসতে।

৪ জন নারী গাড়ি চালিয়ে এসেছিলেন, ৫ জন এসেছিলেন স্কুটি (মোটরসাইকেল বিশেষ) চালিয়ে। তাদেরও দেখেছি বেশিরভাগ হিজাব পরা। স্কুটি চালিয়ে ছুটে চলা কাশ্মীরি মেয়েদের দেখতে আমার কাছে ঘোড় সওয়ারী দুরন্ত যোদ্ধার মতো মনে হতো। আরেকদিন দুপুরে এক ঝাউগাছের ছায়ায় বসে আলাপ করছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে। পাশ থেকে হেঁটে যাচ্ছিল নারী-পুরুষের দল। সহসা আমার দৃষ্টি বন্দি হলো একজনের দিকে। কালো বোরখার ওপর ঘিয়ে রংয়ের হিজাব। আপাদমস্তক অদৃশ্য। কেবল মুখাবয়ব দৃশ্যমান। দুধেল সফেদ ত্বক আর রক্তাভ গাল সচারাচর দেখা পাওয়া কাশ্মীরি রমনিদের থেকে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম নয়। অবনত দুই চোখ হাটার তালে তালে যেন দোদুল্যমান। দৃষ্টি সরিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতো। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে আমার অনুসন্ধানী মনে একটা খোঁচা লাগল। মনে হলো, কী যেন একটা রহস্য আছে এখানে। ফের

ফেরালাম দৃষ্টি তার দিকে। নিষ্ঠুর মাইক্রোস্কোপিক দৃষ্টিতে তাকালাম তার মুখে। লক্ষ করলাম, কানের লতির পাশ দিয়ে হিজাবের ফাঁক গলে ভুলক্রমে একগাছি বাঁকা লালচুল গাল পেরিয়ে থুতনিতে গিয়ে মিশেছে। গ্রামীণ কাশ্মীরের নারীরা এখনও সকাল সন্ধ্যা কাজ করে ফসলের জমিতে। বাড়ির মধ্যে, সবজির বাগানে। পাহাড়ি জঙ্গলে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য। কপুওয়ারা জেলার লোলাব এলাকায় এক নারী জ্বালানি কাঠের খোঁজে সুউচ্চ দেবদারু গাছে উঠেছিলেন। সেখান থেকে ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছেন। স্পটডেড!” ছোট্ট একটি খবর। কিন্তু, এই খবরটি বলছে, গ্রামীণ নারীরা কী রকম পরিশ্রম করে! ডাল লেকের আশপাশে ও মধ্যে বসবাসকারী গুজার কিংবা হাজি নারীদের দেখেছি। মাছ ধরা, আর ঘাসের বস্তা বহন করে ক্লান্ত হয়ে যেতে। তারা রাজধানীর বাসিন্দা।

কেন্দ্রে থেকেও তারা প্রান্তিক। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকাল পাঁচটার পর মানুষের দেখা মেলে কদাচিৎ। কিন্তু, ওইসব পরিশ্রমী নারীদের দেখা মেলে। তারা ক্যাম্পাসে ক্লাস শেষ হলে আসেন তাদের গরুর জন্য ঘাস কাটতে। ঘাস কেটে বস্তাভরে তারা মাথায় তুলে নিয়ে যান ঘরে। একটি-দুটি গাইগরু তাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। ওইসব নারী মাথায় পট্টি বাঁধেন। দুই হাত উপরে তুলে শক্ত করে ধরেন শরীরের সমান ঘাসের বস্তা। তারপর সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফেরেন।

কাশ্মীরের ঘরে ঘরে ঘুরেছি-বেড়িয়েছি, সেখানেও দেখা হয়েছে শিশুদের, মেয়েদের ও তাদের মায়েদের সঙ্গে। তবে কম। মনে হয়েছে ঘরের মধ্যে নারীরা বুঝি খুবই নিরাপদে’ লুকায়িত, রক্ষিত-গচ্ছিত, নীরব, নিস্তব্ধ। আমার উপলব্ধি, ঘরে এবং বাইরে কাশ্মীরের মেয়েরা ভিন্ন রকমের। ১০ মে, ২০১৫ তারিখে গ্রেটার কাশ্মীরে (পৃ:৩) একটি খবর এলো, কপুওয়ারা জেলায় গোলাম রসুল খান নামে এক স্বামী তার তিন সন্তানের মা নাজীম জানকে (৬০) পিটিয়ে মেরেছে। উপলব্ধি করলাম, নারীর ওপর ঘরোয়া নির্যাতন কাশ্মীরেও হয়। আরেকটি রিপোর্টে জানাল, নারীদের ওপর বিভিন্ন সহিংসতার ৩-৪টি অপরাধ প্রতিদিন নিবন্ধিত হয় কাশ্মীরের পুলিশের খাতায়। ২০১৪ সালে নারীকে হয়রানি ও উত্যক্তকরণের ১৩০০ ঘটনা পুলিশের কাছে নিবন্ধিত হয়েছে। স্টেট উইমেনস কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৪ সালে ১৯০০ টি পারিবারিক কলহের ঘটনা

নথিবদ্ধ হয়েছে। এসএমএইচএস হসপিটালের হিসেবে বাড়িতে সহিংসতার জেরে প্রতিদিন ২/৩টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এছাড়া অসংখ্য ঘটনা রয়ে গেছে অনুল্লেখিত একটি গবেষণার তথ্য অনুসারে কাশ্মীরের ৬২.০৮ শতাংশ পরিবার যৌতুক দিয়ে কন্যার বিয়ে সম্পন্ন করেছে। প্রায় ২০ শতাংশ মুসলিম মেয়ের বিয়ের সময় নির্ধারিত মোহর বাস্তবে পরিশেষ করা হয়নি।” একই গবেষণা অনুসারে প্রায় ৮% পুরুষ দুইজন স্ত্রী গ্রহণ করেছেন। তিন ও চার স্ত্রীর সংখ্যা অবশ্য সীমিত, এক শতাংশের কম।

৪৩ শতাংশ নারী ধর্মীয়ভাবে (ইসলামী শরিয়ত) নির্ধারিত উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। ফিদা ইকবাল তার কলামে মন্তব্য করেছিলেন, Maiage made in heaven and celebrated in Kashmir end at the burn word tette, Gigico সংঘটিত, কাশ্মীরে উদযাপিত বিয়ের সমাপ্তি হয় হাসপাতালের অগ্নিদগ্ধ-ওয়ার্ডে। ন্যাশনাল ফেমিলি হেলথ সার্ভে-৩ অনুসারে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের (আগের তথ্যগুলো কেবল কাশ্মীরের) অন্তত ১৫% নারী কোনো না কোনোভাবে ঘরোয়া নির্যাতনের শিকার হন। নিবন্ধের শুরুতে তুলে ধরা কাশ্মীরি নারীদের রূপ আর রহম তাদের ঘরোয়া নিপীড়ন নির্মূল করতে কোনো ভূমিকা রাখছে না। এই বক্তব্যটিকে হয়তো ভারত অথবা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য এলাকার নারীদের অবস্থা সংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত দিয়ে তুলনা করা যায়। কিন্তু, আমার দৃষ্টিতে এটি তুলনা যোগ্য বিষয় নয়।

কোনো সমাজে একজন নারীও যদি নিপীড়িত হন, ঘরে কিংবা বাইরে, তাহলে সেটির প্রতিবিধানের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। অন্য অনেকের চেয়ে সংখ্যায় কম এই যুক্তিতে নিপীড়নের দায়মুক্তি হতে পারে না। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে নারীদের মোট সংখ্যা পুরুষের চেয়ে সামান্য কম। তবে, গড়ে ৫০:৫০ বলা যায়। শতাব্দী ধরেই অধিকাংশ নারী অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনক্ষম। কাশ্মীরি হস্তশিল্পের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তাই এর কারণ। তবে, অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মতোই কাশ্মীরেও অর্থনীতিতে নারীদের অবদান বা উৎপাদন পরিবারের যৌথ উৎপাদন হিসেবে বিবেচিত হতো।

আবহমান কাশ্মীরি সমাজে নারী অসম, অনুত্তম, দুর্বল হিসেবেই চিত্রিত ও চিহ্নিত হয়ে এসেছে। তবে একথা সত্য, কাশ্মীরের নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থা অন্য অনেক স্থানের চেয়ে ভাল। সমাজবিজ্ঞানী ও জেন্ডার স্পেশালিস্ট হুমায়রা শওকত ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় একাধিকবার দাবি করেছেন, জম্মু কাশ্মীরের সমাজ বর্তমানে কম পুরুষতান্ত্রিক। বশির আহমেদ ডাবলা লিখেছেন, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের নারীদের অবস্থার ব্যাপক উন্নতি শুরু হয়েছে ১৯৩০এর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর পর থেকে। সে সময়ে ঘোষিত নয়া কাশ্মীর মেনিফেস্টে নারী ও পুরুষকে সবক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রদানের ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের জন্য সর্বপ্রথম। ১৯৪৭ সালের পর ভারত শাসিত কাশ্মীরে নারীদের টেকনিক্যাল ও প্রফেশনাল শিক্ষা ফ্রি করা হয়।)

অনেক মেয়েকেই, (বিশেষ করে শ্রীনগরের) পরিবারের অগোচরে প্রেম করে দেখেছি। একদিন ক্লাস শেষে ডাল লেকের পাশে বসেছিলাম। লক্ষ করলাম, ছোট্ট একটি ঝাউ গাছের নিচে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বেশ নিবিড় হয়ে বসে কথা বলছে। মেয়েটার মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা। ছেলেটা তার কোট খুলে মাথার উপর দিয়ে আড়াল সৃষ্টি করে আছে। কিছুক্ষণ যেতেই দূর থেকে তিনজন স্থানীয় যুবক এলো। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিন যুবক পৌঁছে গেল ঝাউগাছের পাশে। কোমরের বেল্ট ততক্ষণে তাদের হাতে শোভা পাচ্ছিল আঘাতের অস্ত্র হিসেবে। কোনো কথা-বাত-চিতের আগেই শপাং-শপাং আঘাতে লুটিয়ে পড়ল ছেলেটা। মেয়েটা উঠে দাঁড়াল।

হতবিহ্বল হয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল। তারপরই, পেছন ফিরে সোজা হেঁটে চলে গেল। ছেলেটা মার খেতে থাকল। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা উঠে দিলো দৌড়। যুবকেরা পেছনে পেছনে মারতে মারতে তাকে নিয়ে গেল। উপলব্ধি করলাম, মেয়েদের প্রতিবাদের ভাষা নেই সেখানে। অবশ্য, উন্মুক্ত স্থানে মুখখামুখি বসে আলাপরত জুটিদের এমন অবস্থায় পড়তে দেখিনি। কাশ্মীরের বন্ধুর কাছে জেনেছিলাম, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরে উন্মুক্ত আলিঙ্গনের সুযোগ মেলে জুটিদের। অধিকাংশ মানুষ একে মনে করে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফল। শ্রীনগরের বাইরে অবশ্য অন্যরকম। দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম জেলার এক গ্রামের নাম জঙ্গলপুরা। সেখানে একটি বাড়িতে কাটিয়েছিলাম একরাত। রাতে খাবার খেয়েছি, সকালে পান করেছি কুলচার সঙ্গে নুনচায়।

কিন্তু, নারীদের দেখা মেলেনি। সকালে বেরিয়ে যাবার সময় হয়েছে। আমার বন্ধুরা বেরিয়ে পড়েছে। আমি জুতার ফিতা বাঁধছিলাম সিড়িতে বসে। তখন দেখা হলো, ওই বন্ধুর দাদার সঙ্গে। তার হাতে হুকা, পরনে ফেরেন। আমি সালাম দিলাম। তারপর দেখা হলো, ওই বন্ধুর মায়ের সঙ্গে। গায়ে সবুজ ফেরেন। মাথায় আলাদা কাপড়ের পট্টি। আমার দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে হাসছিলেন। আমি সালাম বললাম। পেছন থেকে শুনলাম কেউ বেরিয়ে এসে বলছে আসসালামু আলাইকুম। জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে ফিরে তাকালাম। ১২/১৩ বছরের কিশোরী।

তার গায়েও ফেরেন। দুই গালে তার টোল পড়া, ভুবনভোলানো হাসি তার ঠোটে। নিঃশব্দ দৃষ্টিতে দেখছে আমাকে। সেই দৃষ্টির মধ্যে ছিল বিস্ময়। আমার পাল্টা দৃষ্টি তাতে ছেদ ঘটাল। তার বিস্ময়কে আচ্ছন্ন করল এক রাশ লজ্জা। আমার বন্ধুরা রাস্তায় অপেক্ষা করছে তখন। আমিও বেরিয়ে এলাম। তিন কাশ্মীরি বন্ধুর সঙ্গে একদিন গেলাম কোকরনাগ বেড়াতে। ফেরার পথে এক মাটির ঘরের সামনে থামলাম। বন্ধুদের পূর্বপরিচিত, তাই দেখা করাই ছিল উদ্দেশ্য। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি তখন। বৈকালিক নুনচায় পানের ওয়াক্ত হয়েছে। ঘরের মধ্যে ঢুকলাম, শিশু-কিশোরেরা বেরিয়ে এল। সালাম বিনিময় হলো। অতিথি কক্ষে কার্পেট বিছানো। তার ওপর বসলাম। কিছুক্ষণ পরে এলেন,

ষাটের্ধ্ব এক মা। বন্ধুরা সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মা তাদের কাছে গিয়ে একে একে মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু খেলেন। আমিও দাঁড়ালাম। সালাম বললাম। মা হাসিমুখে আমাকে শুধালেন, ঠিক পইঠ? আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “আসুল পইঠ। ঠিক পইঠ?’ তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন না। মাথায় হাত দিলেন না। গালে চুমুও খেলেন না। অপরিচিত-বিদেশি বলেই হয়তো। আমার এখনও মনে

হয়, ওই মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হলোম! পরে আরেকদিন আমার সবচেয়ে সহজ-সরল বন্ধু মেরাজের বাড়িতে দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম। সেদিন ওর মোজি আমার কপালে চুমু খেয়েছিলেন। আমার কাছে, মেরাজের মা আসলে কাশ্মীরের আমারই মা। মে’রাজের বোনেরা যেন আমারই বোন। প্রথমবার যখন গিয়েছি তখন আমি কাশ্মীরি ভাষার কিছুই বুঝতাম না। দ্বিতীয়বার বেশ কিছু কাশ্মীরি শব্দ বুঝতে শুরু করেছিলাম। আমার মুখে দুচারটা কাশ্মীরি শব্দ শুনে তিনি কী যে খুশি হয়েছিলেন!

শ্রীনগরের লোকাল বাসে যাতায়াত করছি একদিন। মধ্য বয়সী এক মা’র কোলে বছর দুয়েকের শিশু। তার পাশে আমি বসলাম। পিচ্চিটা বড্ড দুষ্টু। ব্যাপক হইচই করছিল। জানালার বাইরে দুই হাত দিয়ে করছিল চিঙ্কার। কখনওবা আমার দিকে তাকিয়ে ওর মা’কে কী যেন বলছিল। হয়তো আমার গায়ের রং দেখে শিশুটাও বুঝেছিল, আমি বিদেশি। বাচ্চাটার বাঁদরামিতে বিরক্ত মা তখন অতিষ্ঠ। বারবার জড়িয়ে ধরেন। মুখ চেপে ধরেন। কিন্তু, তাতে থামছে না পিচ্চিটা। কাশ্মীরি ভাষায় চিউচিউ করে কী যেন বলছেন মা। ক্ষেপে যাচ্ছেন। আমি বাবুটার গাল ধরে বললাম, চুপ রহ! ইহা পর বেঠো! কাজ হলো না। সে আরও মজা পাচ্ছে। হাসছে।

ফের শুরু করেছে হইচই। ত্যক্ত-বিরক্ত মা এবার চপাস-চপাস করে কয়েকটা চড় বসালেন সন্তানের গালে। তারপর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল মায়ের কোলে নিস্পাপ শিশুটি। আমি তার লাল গাল, রক্তিম ঠোট আর ধবধবে সাদা কপালের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, কী নিখুঁত সৃষ্টি বিধাতার। মেরাজের বাড়িতে ওর দুই ভাতিজি মিল্লাত আর মিদ্দাতকে আমি ভালবাসি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া বড়বোন মিল্লাত বড় লাজুক। কাছে আসেনি। দূর থেকে কেবল হেসেছে। ছোটবোন মিদ্দাত পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। মেরাজের বাড়িতে আমার অবস্থানকালে মিদ্দাত ছিল যেন প্রিয় সঙ্গী। আমি বসে ছিলাম বারান্দায়। আশপাশের তিনচারটা শিশু এসে আমার চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল। আমি হাতবাড়িয়ে দিলে হ্যান্ডসেক করল। তারপর ক্রমে শুরু হলো হইচই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের অদ্ভুত খেলার উপকরণ হয়ে পড়লাম। সবাই মিলে আমার চারপাশে ঘুরছে আর কী কী যেন বলছে। আমি মনোযোগ দিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করলাম। একটা শব্দই কেবল বুঝতে পারলাম, ‘পা-গল।

খানিক পরে মিদ্দাতকে ডেকে কোলে নিয়ে শুধালাম, কী বলছে ওরা? ও বলল, “ও বোল রাহা হ্যায়, তুম পা-গাল হ্যায়’। আমি হাসলাম। মজা পেলাম এই ভেবে যে, অনেক অমিলের মধ্যেও ‘পাগল’ শব্দে মিল পাওয়া গেছে। সোপিয়ান জেলায় এক বাড়িতে ছিলাম এক রাত। সেখানে দুই শিশু ফারহান ও হানান। তারা রাতে খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছিল ভেতরের ঘর থেকে। আমি কাছে ডাকলাম। একজন আসি আসি করে, অন্যজন বলে না। বড়রা অভয় দিলো। বলল, মেহমান। দুজন। করল হ্যান্ডসেক। মুখে তাদের ভাষা নেই। আমি বললাম, কারু কা’থ? কাশীর পইঠ। ঠিক পইঠ? আসল পইঠ ছুয়া? দুজন এমন ভাবে হেসে উঠল যেন, রাজ্যের সব খুশি ওদের ভর করেছে। আরেকবার বাসের সিটে বসে আছি। বেশ ভিড়। এক মাঝারি বয়সের মা উঠলেন। সঙ্গে বছর দুয়েকের ছেলে আর কিশোরী মেয়ে। সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মামেয়ে-ছেলে সবাই। আমি ছেলেটাকে কাছে টেনে কোলে বসিয়ে বললাম, “আপ ইহা পর বেঠিয়ে। ছেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কেঁদে উঠল। আমার মনে পড়ল, আমিতো ভিনদেশি। আমি ওর কাছে অস্বাভাবিক এক ভূত।

কাশ্মীরি ভাষায় ভূত হলো ব্রাব্রামচোক’। মাথায় দুইটা মশাল জ্বালানো বিশাল ভয়ঙ্কর ভূতের নাম ব্রাব্রামচোক। মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালাম। মাকে বললাম, মাজি, আপ বেঠিয়ে’। তিনি বসলেন। বললেন, ‘শুকরিয়া’। ছেলেটার কিশোরী বোন আমার দিকে বারবার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল আর হাসছিল। কৃতজ্ঞতার হাসি। ও হয়তো জানে না, বাস-গাড়িতে মা-বোন কিংবা মুরব্বিকে বসতে দেওয়া কেবল কাশ্মীরের সংস্কৃতি নয়, ওই সংস্কৃতি আমারও।

এবার নিয়ে যাই ইতিহাসে। কাশ্মীরি লোককথা, গান-কবিতায় নারীরা আছেন। কেবল উপমা হিসেবেই নয়, কবি হিসেবেও। কেবল নিপীড়নের লক্ষবস্তু নয়। প্রতিবাদের ভোকাল হিসেবেও। ষোড়শ শতকের হাব্বা খাতুন কাশ্মীরি সাহিত্যের এক স্তম্ভ। তিনি ছিলেন ফার্সি ও আরবি ভাষায় দক্ষ। তার বিয়ে হয়েছিল এক নিরক্ষর কৃষকের সঙ্গে। সে বিয়ে টেকেনি। পরে, কাশ্মীরের শাসক” ইউসুফ শাহ চাক তাকে বিয়ে করেন। নিরক্ষর কৃষকের স্ত্রী থেকে তিনি হন ফার্স্ট লেডি’। মোগল সম্রাট আকবরের শঠতায় নির্বাসিত হন (১৫৮৬) ইউসুফ শাহ। হাব্বা খাতুন সেই বিরহের কথা তুলে ধরেন তার কাব্য আর গানে। এখনও তা কাশ্মীরের লোককথা। পরে ধাতুনকে পাঠানো হয় বিহারে। সেখানেই শেষ হন এই নারী কবি আর স্বাধীন কাশ্মীরের শেষ শাসক।

আর গত শতকের শেষের দিকে শুরু হওয়া সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম আর তার রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ায় কাশ্মীরের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীদের জন্য বয়ে এনেছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা। সারা পৃথিবীর নারী অধিকার কর্মীরা এ বিষয়ে একমত যে, যেখানেই সশস্ত্র সংঘাত হয়, সেখানেই নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। তাই নারী অধিকারের আলোচনা হয় দুই পরিবেশে, যুদ্ধকালীন ও শান্তিকালীন। কাশ্মীরও তার ব্যতিক্রম নয়। সংঘাতের জের ধরে স্বজনহারা, বৈধব্য ওখানে নারীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছে আরও বেশি দায়িত্ব। তার ফলেই সম্ভবত কাশ্মীরি নারীদের কোমল দৃষ্টির মধ্যে লক্ষণীয় আশ্চর্য রকমের কঠোরতা, আপসহীনতা আর আত্মবিশ্বাস। যুদ্ধে নিখোজ হয়েছে যার স্বামী তার জন্য সেখানে রয়েছে আরেকটি নাম। অর্ধবিধবা। এমন নারীর সংখ্যা সেখানে অন্তত দুই হাজার। তাদের কেউ কেউ দুই দশক ধরে অপেক্ষা করছেন প্রিয়জনের ফিরে আসার। তারা জানেন না, তাদের স্বামী আদৌ বেঁচে আছে কিনা! সংঘাতসংকুল সমাজের নারীর জীবনের সকরুণ সেই গল্প আলাদাভাবেই বলতে হবে।

নোট/সূত্র

১. Greater Kashmir; August 30, 2015; 13.

২. The Kashmir Monitor; May 12, 2015; 1.

৩. Bashir Ahmed Dabla, Multi-Dimensional Problems of Women in Kashmir, New Delhi: Gyan Publishing House, 2007. 17-18.

৪. প্রাগুক্ত, ১৬৯

৫. Fida Iqbal; The brutalized society; Greater Kashmir, 15 October, 2015; P8.

৬. Greater Kashmir, May 16, 2015; 1.

৭. Bashir Ahmed Dabla, 2007. 43-44.

৮. প্রাগুক্ত, ৯

৯. শেষ স্বাধীন শাসক ইউসুফ শাহ চাক ও হাব্বা খাতুন সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন চতুর্থ অধ্যায়ে।

১০. এই অধ্যায়টি কাজল ঘোষ সম্পাদিত দৈনিক মানবজমিনের ঈদ সংখ্যা ২০১৬-এ একই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে মূল লেখাটির সঙ্গে তথ্যসূত্র যুক্ত করা হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *