রূপসী

রূপসী

কথায় বলে বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া কুছ নেহী তো থোড়া থোড়া। অর্থাৎ বাপের সঙ্গে ছেলের একটা সাদৃশ্য থাকে। কিন্তু মেয়েও যে বাপের সব গুণ পাবে এমন কথা প্রবাদেও বলা নেই।

সব প্রবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে রূপসী। বিশ্বনাথ চৌধুরীর মেয়ে রূপসী। বিশ্বনাথ দুর্গাপুরে কোন এক বড় কারখানায় কাজ করতো। গ্রাম থেকে টেনেটুনে মাধ্যমিক পাশ করে এদিক ওদিক চাকরির সন্ধানে ঘুরতো। তখন গ্রামের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। সে গাঁয়ে ঢোকার কোন পথ ছিল না। শালবন-লালমাটির চড়াই-উতরাই পার হয়ে পায়ে চলা প্রান্তরের বুকে পথের রেখা এঁকে বেঁকে গ্রামের দিকে এসেছিল—সেই ছিল পথ।

বনজমির থেকে যা আয় হতো তাতেই কোনমতে দিন চালাতো বিশ্বনাথ, আর সেসময় দুর্গাপুরও ছিল ঘন বনে ঢাকা। মধ্যে ছিল দামোদরের বিস্তীর্ণ বালুচর। গ্রীষ্মে একচিলতে জলধারা বইতো আর বর্ষার সেই বালুচর ছাপিয়ে বইতো হিংস্র গেরুয়া ঢল। দুপারের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। এই এলাকায় নামতো আদিম আরণ্যক পরিবেশ। তারপর দুর্গাপুরের রূপ বদলালো। বনকেটে গড়া হল বিরাট শিল্প নগরী। বিশাল সব কারখানা। আর আশেপাশের গ্রামের অনেক মানুষ চাকরী পেল। ভালো মাইনেও হল তাদের। গড়ে উঠলো হাজার কোয়ার্টার। গ্রামের জীবন থেকে তারা হঠাৎ আলোর ঝলকানি লাগা শহরে এসে ঘর বাঁধলো। গ্রামগুলোর রূপও বদলে গেল হঠাৎ পয়সার ছোঁয়ায়। পথঘাট হল, অর্থনৈতিক রূপটাও বদলে গেল। আর বদলে গেল সেই শান্তিপ্রিয় অল্পে তুষ্ট গ্রামীণ মানসিকতা।

বিশ্বনাথ এবার চাকরি পেয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে তবে গ্রামে জমিজায়গা কিছু আছে। তাই গাছেরও খাবার আবার তলায়ও কুড়োবার জন্য গ্রামেও যাতায়াত করে। কিছু জমিজায়গাও কিনেছে। গ্রামে এখন বিজলি বাতি এসেছে। বিশ্বনাথ জানে চাকরি করতে হবে। পরে রিটায়ার করার পর গ্রামে এসে নিশ্চিন্তে বসবাস করবে। তাই মাটির বাড়ি ভেঙে একতলা বাড়ি করেছে। বিশ্বনাথ অবশ্য চাকরি থেকে কি ভাবে দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করতে হয় তা ভালোই জানে। কোম্পানীর অনেক কাজ ঠিকাদারদের দিয়ে করানো হয়। অফিসারদের জন্য বেশকিছু গাড়িও ভাড়া নিতে হয়। তাদের বিলপত্র সব পাশ করানোর বিভাগে কাজ করে বিশ্বনাথ। সেও এর মধ্যে বুঝে গেছে কোথায় চাপ দিলে মাল বের হবে, সেইমতো চাপ দিয়ে বেশ কিছু মালও বের করে। তবে একা খায় না, দিয়ে থুয়ে খায়।

তার মেয়ে রূপসীও এখন কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। গ্রামে খুব সাধারণভাবে থাকতো ওরা। তবু মেয়ের নাম রূপসী রেখেছিল বিশ্বনাথ মেয়ের রূপ দেখে। গ্রামে সেই মেয়ে ছিল ছাইচাপা আগুনের মতো।

গ্রামে বিশ্বনাথ দাসের দিন চলতো চাষবাস করে। চাষীর সংসার। বিশ্বনাথকে তবু ওর বাবা স্কুলে পড়িয়েছিল। রূপসী ছেলেবেলা থেকেই মাঠে ঘুরতো। ডানপিটে ধরনের মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গেই বেশি মিশতো, মারপিট করতো। গরুগুলোকে মাঠ থেকে ডাকিয়ে আনতো। তেজী ঐ বেপরোয়া মেয়েটার নামে তাই নালিশ আসতো নানা ধরনের। কার গাছের আম—কার ক্ষেতের শশা চুরি করেছে মেয়েটা। রূপসীর মা বলতো—কোনদিন অপঘাতে মরবি তুই।

সেই গ্রামীণ জীবন থেকে বিশ্বনাথ চাকরি পেয়ে হঠাৎ যেন অন্যরকম হয়ে যায়। আর শহরের পরিবেশে এসে বদলে গেল রূপসীও। এবার স্কুলে যাবার চেষ্টা করে। তবে পড়াশোনার চেয়ে সাজগোজই বেশি তার। দেহে এসেছে কৈশোরের পূর্ণতা। শহর জীবনের বিলাস, প্রাচুর্য রূপসীকে নেশা লাগায়। রূপসী দেখে সেজেগুজে বের হলে কত পুরুষের চোখে কি নীরব ব্যাকুলতা— সেই চাহনিতে কি যেন আহ্বান। রূপসীও জানে পুরুষকে প্রলুব্ধ করার মতো অফুরান সম্পদ ঈশ্বর তাকে দিয়েছে। তাই এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে। তার মনেও অনেক কিছু পাবার স্বপ্ন জাগে।

এদিকে বিশ্বনাথ-এর কাছে অনেক সাপ্লায়ার আসে। ঠিকাদার বিশেষ ব্যবস্থা করে বিলের টাকা আগে পাবার জন্য। তারাও রূপসীকে খুশী করার চেষ্টা করে। রূপসী এর মধ্যে সুমিত সিং-এর প্রেমে পড়ে গেছে। সুমিত সিং বয়সে তরুণ। এর মধ্যে ঠিকাদারী কাজ করে গাড়ি বাড়ি করেছে। সেও রূপসীকে নিয়ে তার জিপে করে এদিক ওদিক ঘোরে। দামী হোটেলে খানাপিনাও করে। এ নিয়ে রূপসীর মা ওকে বকাবকি করে। পড়াশোনার নাম নেই এইসব নষ্টামি করবি?

রূপসী তখন সুমিতের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ যেন তার অনেক পাওয়া। বিশ্বনাথও মেয়ের এইসব বেতাল দেখে চটে ওঠে। কারণ বাইরে আধুনিক ঠাটবাট থাকলেও তার মনটা এখনও সেই গ্রাম্য স্বভাবের গোঁড়ামিটাকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই সেদিন মেয়ে বেশি রাতে বাড়ি ফিরতে বিশ্বনাথ মেয়ে রূপসীকে বেশ কয়েক ঘা চড় চাপড় বসিয়ে গর্জে ওঠে।—কালই গ্রামে পাঠিয়ে দেব। সেখানেই থাকবি, শহুরে নষ্টামি তোর ঘুচিয়ে দেব।

রূপসীও বুঝেছে এবার এই জগৎ থেকে তাকে নির্বাসিতই করে দেবে তার বাবা। সেই গ্রামে আর ফিরে যেতে চায়না সে। তাই রূপসীও মনস্থির করে ফেলে। সুজিত সিং তাকে ফেরাতে পারবে না। দু’জনের মধ্যে এমনি একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে। সেই রাতেই রূপসী প্রথম ঘর ছাড়ে। সুজিত সিং-এর ডেরাতে এসে পড়ে রূপসী। রূপসীকে অবশ্য ফিরিয়ে দেয়নি সুজিত সিং, তবে বুঝেছে দুর্গাপুরে রাখা নিরাপদ নয়—পুলিশের ঝামেলা আছে। তাই রাতারাতি রূপসীকে পাচার করে ধানবাদের ওদিকে।

বিশ্বনাথও মেয়েকে খোঁজাখুঁজি করে। কিন্তু পাত্তা পায় না। সুজিতও সাধু সেজে থাকে। সে জানায় যে এসবের সে কিছুই জানেনা। রূপসী কোথায় আছে জানে না সে। অবশ্য রূপসী যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছিল সেটা পূর্ণ হয়নি। সুজিত সিং তাকে দিয়ে ধানবাদ অঞ্চলে নিজের ঠিকেদারী কাজ বাড়াবার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। কোলিয়ারীর কর্তাদের পার্টিতেও নিয়ে যায়। আর রূপসী সেদিন বুঝতে পারে সুজিতের প্রকৃত চরিত্র। লোকটাকে সে চিনতে পারেনি। অপমানিত রূপসীও চেয়েছিল সুজিতের এই জঘন্য আচরণের প্রতিশোধ নিতে। এই প্রথম রূপসীর জীবনে আসে একটা আদিম হিংস্রতা। কিন্তু সুজিতকে খুন করতে পারেনি সে। তাই রূপসীকে আবার দুর্গাপুরে তার বাবার কাছে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। সেদিন রূপসী হেরে গেছিল। বিশ্বনাথও বাধ্য হয়েই মেয়েকে ঘরে নেয় কিন্তু স্পষ্টই বুঝেছিল সেই গ্রাম্য রূপসী মরে গেছে। তার জায়গায় জন্ম নিয়েছে এক নতুন রূপসী। আজকের মানুষের আদিম লালসা সভ্যতার বিকৃতি তাকে আমূল বদলে দিয়েছে, রূপান্তরিত করেছে আজ অন্য একটা নারীতে।

সব জীবনেই থাকে শৈশব-কৈশোর-যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব—তারপর আসে মৃত্যুর স্তব্ধতা। জীবনের চিরন্তন ধর্ম। দুর্গাপুরের শহর জীবনের বৈচিত্র্যেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অনেক আশা স্বপ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছিল এক নতুন শহর, বহু কারখানা। নানা কারণে সেই দীপ্ততাকে ধরে রাখা গেল না। শহর জীবনেও নেমে এল অকালবার্ধক্য। একে একে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করলো। হাজার হাজার মানুষ বাসা বেঁধে ছিল। রুজি রোজগার করতে এখানে গড়ে উঠেছিল দোকান বাজার স্কুল। সাজানো বাংলোর চারিপাশে গজিয়েছিল বাগান ফুলের বাহার—গাছগাছালি সবুজ সমারোহ। সব কেমন ম্লান হয়ে গেল। নানা নতুন শব্দেরও প্রচলন হল। ভি-আর-এস, অর্থাৎ স্বেচ্ছা অবসর। কেউ আদর করে বলে,—সোনালী করমর্দন। গোল্ডেন হ্যান্ডশেক। এ করমর্দন নয়—গলা ধাক্কাই।

কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেল একে একে আর সাজানো নগরী সেইসব বাংলোও পরিত্যক্ত হল। বাগানের ফুলের বাহার শুকিয়ে গেল। জনহীন হয়ে গেল পথঘাট। ক্রমশ পরিণত হল পরিত্যক্ত নগরীতে। এতদিনের ঘর বাঁধার পর আবার এল সব হারিয়ে ঘর ভাঙার পালা। বিশ্বনাথের সেই আমদানী অবশ্য আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবু মাইনেটা পেতো—থাকতো এখানের বাসায়। রূপসী তখন এখানের কোন হোটেলে পার্ট টাইম রিসেপশানিষ্ট-এর চাকরিও পেয়েছিল। সেজেগুজে চাকরিতে যেতো। সন্ধ্যার পরই তার ডিউটি পড়তো। বিশ্বনাথ প্রথম দিকে আপত্তি করেছিল,—ওসব চাকরিতে দরকার নাই।

কারণ সে জানে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ওই শহরে এমন ব্যাঙের ছাতার মতো অনেক হোটেল বারও গজিয়েছে। আর এখানে কারখানার দুর্দিন হলেও, শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলেও, এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী আর সদ্য গজিয়ে ওঠা বেশ কিছু শ্রমিকদরদী নেতাদের দিন বদলাচ্ছে। কারখানার মালিকদের সঙ্গে তাদের দহরম মহরম ভালোই আছে, শ্রমিকদের অগোচরে ওদের পার্টি বসে হোটেলে। মদেরও অভাব নেই। জোর খানাপিনা চলে রাতের অন্ধকারে। আবার দিনের আলোয় ওই সব নেতারাই শ্রমিকদের নিয়ে কারখানার গেটে মিটিং করে মালিকদের মুণ্ডুপাত করে। তাদের দেখা যেতো আগে বিড়ি ফুঁকতে, ময়লা পোশাক পরে ভাঙা সাইকেলে ঘুরতে। ক’বছরেই তাদের গাড়ি বাড়িও হয়েছে। এখন বিলাতী সিগারেট তাদের ঠোঁটে। আর রাতে তাই ভ্রমর হয়ে নিশিপদ্মের মধুর সন্ধানে হোটেলে ঘাঁটি গড়ে অন্যের পয়সায়। রূপসীও দেখেছে চিনেছে এদের। তার মনের অতলে সেই সুজিত সিং-এর জঘন্য ব্যবহারের কথাটা মনে পড়ে। তাকে সুজিত এমন সব নতুন গজিয়ে ওঠা জীবদের কাছেই পাঠিয়েছিল আর অসহায় রূপসীর চরম সর্বনাশ করেছিল তারাই। রূপসী তাদের অত্যাচারের জবাবও দিতে পারেনি। তারপর থেকে রূপসীও বদলে গেছে। তার জীবনে অনেক পুরুষই এসেছে আর তারা শুধু জ্বলে পুড়ে মরেছে। রূপসী দেখেছে এদিকে দু-তিনটে কারখানাও বন্ধ হয়ে গেল। মিটিং মিছিল হল। কাজের কাজ কিছুই হল না। নেতারাও নাকি শেষবারের মতো দক্ষিণা নিয়ে উধাও হল। হোটেলও বন্ধ হয়ে গেল।

ওদিকে বিশ্বনাথের কারখানা আগেই বন্ধ হয়েছে। কোয়ার্টার না ছাড়লে টাকা দেবে না। তাই বিশ্বনাথ সেই কোয়ার্টার ছেড়ে মালপত্র নিয়ে গ্রামেই ফিরে এল সপরিবারে। রূপসীও এতদিনের স্বপ্নজগৎ ছেড়ে ফিরে এল গ্রামে।

কয়েকটা বছর রূপসীর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে। গ্রামের জীবনে মেয়েদের দেখছে সে। সব অভাব অভিযোগকে মেনে নিয়েই ঘর সংসার করেছে। দেখছে তার পাশের বাড়ির অনন্তদা আর তার স্ত্রী কমলাকে। অনন্ত চাকরি খুইয়ে এখন ট্রেনে হকারি করছে। আগে দুর্গাপুরে কোন কারখানাতে কাজ করতো। কমলা আর বাসাতেও যায়নি। সে তার ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই ছিল। অনন্ত ডেলি প্যাসেঞ্জারী করতো কষ্ট করে।

কমলা সেদিনও বদলায়নি। আজও এই অভাব কষ্টকে মেনে নিয়েই ঘর করছে, শান্তিতে আছে। রূপসী দেখছে কমলাকে। গ্রামের অনেক বৌ গিন্নীর দিকে কেমন বাঁকা চোখে চেয়ে থাকে। সেদিন রূপসী গেছে দত্তদের বাড়িতে।

দত্ত পরিবারই গ্রামের মধ্যে এখন সমৃদ্ধশালী পরিবার। খগেন দত্তের বয়সও তেমন নয়। আগে সামান্য জমিজমা মাত্র ছিল। খগেন কলেজ থেকে পাশ করে গ্রামের আশেপাশের গ্রামের কৃষক চাষীদের নিয়ে তাদের সেচের জল, সরকারী সাহায্য, সার, বীজধান—এসব পাবার জন্য মিটিং মিছিল করতো আর গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিও পেয়েছিল। কোনমতে দিন চলতো তাদের।

খগেন ওইসব মিটিং মিছিল নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। বাড়ির অবস্থা তেমন ছিলো না। খগেনের মা সৌদামিনী গজগজ করতো,—নিজের কথা ভাববি না রে খগেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবি। লেখাপড়া শিখে একটা চাকরিও পেলি না।

খগেন তখন এ অঞ্চলের একটা পরিচিত নাম। সে বলে,—মা, তোমার খগেন গোলামী করতে জম্মেনি।

বুড়িও ফুঁসে উঠতো,—তবে কি রাজত্বি করবি রা, মুখপোড়া।

হাসতো খগেন। সে বোধহয় অনুমান করেছিল এই দিন বদল, যুগ বদলের পালায় তার বিশেষ ভূমিকাই থাকবে। মায়ের কথায় বলে,—দেখা যাক, কি হয়?

ধাপে ধাপে উপরে উঠতে হবে খগেনকে। সে দেখেছে শহরের নেতাদের প্রতিষ্ঠা এমনকি ওই শিল্প নগরীর নেতাদেরও দেখেছে। তাদের প্রতিষ্ঠা অর্থ মান তারও নজর এড়াইনি। খগেন তখন থেকেই স্বপ্ন দেখেছে তার দিনও বদলাবে।

অবশ্য খগেনের হিসাবটা ভুল হয়নি। খগেনও অনেক কিছু দেখে শুনে শিখেছে আর তার বাস্তব বুদ্ধিটাও প্রখর। তাই সামান্য অবস্থা থেকে খগেন আজ উঠে এসেছে সমাজের উপর তলায়। জীর্ণ খড়ের বাড়িটাতে ছিল তার পৈত্রিক বাস। আর সম্পত্তি বলতে ছিল বিঘে ছয় সাত ধান জমি।

তখন গ্রামের জমিদার ছিল মুখুজ্যেরা। ওদিকে মুখুজ্যে পাড়াটাই ছিল গ্রামের সমৃদ্ধ অঞ্চল। বড় তরফ আর ছোট তরফের বেশ কয়েকখানা বাড়ি, ওদিকে কাছারি বাড়ি—সামনে বিশাল দিঘী তার ধারে মুখুজ্যেদের কুলদেবতা গোবিন্দজীর মন্দির। সেখানে সমারোহ করে দোল দুর্গোৎসবও হতো।

ওদিকে মুখুজ্যে পরিবারের দাক্ষিণ্যে গড়ে উঠেছিল স্কুল, ওদিকে বাজার। কিন্তু বাঁধা দোকান ছিল, আর সপ্তাহে দুদিন হাট বসতো। এখন দিন বদলেছে। জমিদারী চলে যাবার পর মুখুজ্যে পরিবারের রমরমাও শেষ হয়ে যায়। কর্তাবাবুও আজ নেই। ওই বাড়ির ছেলেরা এখন কেউ আসানসোলে, কেউ কলকাতায় চাকরি করে। আর কাছারি বাড়িটার রূপও বদলে গেছে। সেই নায়েব গোমস্তা পাইকের দলও আর নেই। এখন ওটা হয়েছে পঞ্চায়েত অফিস। আর জমিদারের খাস কামরায় সাবেকী রূপ বদলে গেছে। গদি-ফরাস-তাকতা-ঝালর দেওয়া বাহারের টানা পাখা, খসখসের পর্দাও আর নেই। সেখানে এখন নতুন রং করে গদিওয়ালা ঘূর্ণায়মান চেয়ার বসানো হয়েছে। এসেছে সিলিং ফ্যান। সুদৃশ্য টেবিল ল্যাম্প। সেই আসন আলো করে বসে ওখানে নতুন গজিয়ে ওঠা শ্রেণীর পঞ্চায়েত প্রধান ওই খগেন দত্ত।

খগেনের জীর্ণ মাটির বাড়ির অস্তিত্বও তার নেই। সেখানে উঠেছে তিনমহলা হাল ফ্যাসানের বাড়ি। ওদিকে ঘোষদের তিন বিঘে পতিত জমি কিনে চারিদিকে সীমা প্রাচীর তুলে গড়ে উঠেছে খগেনের খামার। বড় বড় কটা খড়ের পালুই। ওদিকে গোয়ালে কয়েকটা দামী জার্সি গরুও রয়েছে। এখন তার জমির পরিমাণ প্রায় পঞ্চাশ ষাট বিঘে। এসব জমি চাষ করার জন্য বলদ ছাড়াও আছে পাওয়ার টিলার, নিজের পাম্প আর বাড়ির জন্য একটা জেনারেটর। প্রায়ই লোডশেডিং হয় এদিকে। আকাশে মেঘ দেখা দিলেই বিপদের ভয়ে ওভারহেড লাইনে কারেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া লোড শেডিং নিত্যকার ঘটনা। সেজন্য যাতে তার বাড়ি সর্বদা আলোকিত থাকে সেজন্য এ ব্যবস্থা। খগেনের দূরদৃষ্টি খুবই প্রখর। সে প্রথমে কিশোর বয়সেই একটা আদর্শ স্বপ্ন নিয়েই সমাজের সেবা করতে এসেছিল সেদিনের শিক্ষক কানাইবাবুর অনুপ্রেরণাতেই। কানাইবাবু মারা যেতে খগেন ক্রমশ তার জায়গাটাই নেয়। কিন্তু ক্রমশ দেখেছে খগেন এখানে হিসাবমতো চলতে পারলে অনেক কিছুই করা যায়। তাই তার আদর্শও বদলাতে থাকে সেই হিসাবের চাপে।

সে জানতো জমিদারী প্রথা চলে যাবার পর সমাজের বুকে নতুন এক শ্রেণীর উদ্ভব হবে। জমিদারদের তবু বংশ মর্যাদা, সংস্কৃতি, মানবিকতার বোধ কিছু ছিল। তাদের অনেকেই প্রজাদের জন্য স্কুল, হাসপাতাল, পানীয় জলের ব্যবস্থা, পথঘাট এবং সামাজিক কাজ কিছু করেছিলেন। কিন্তু জমিদারী চলে যাবার পর সমাজের বুকে নতুন এক শ্রেণীর সরকারের উপর আর সরকারের প্রতিভূ হিসাবে গজিয়ে ওঠা এই নতুন প্রভু শ্রেণীর কোন দায়বদ্ধতাই থাকবে না সমাজের কাছে। শুধু কৌশলে লুঠ করে গদিতে বসে সমাজের মাথাই হবে তারা।

খগেনও তাই সেই পথই নিয়েছে। মুখুজ্যেদের একটা বাগান বাড়ি ছিল নদীর ধারে। খগেন সেটাও দখল করে এখন দেশ সেবার কাজে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছে।

খগেনদের বাড়িতেও যায় রূপসী, দেখেছে এখন তাদের বাড়বাড়ন্ত। খগেনের মা সদু গিন্নী তখন বাড়তি কলাই ভিজিয়ে রকমারি বড়ি দিত, সেগুলো দোকানে দিয়ে কিছু রোজগার করতো। এখন তারও হালচাল বদলেছে। খগেনের বৌ এর পরনে দামী শাড়ি, গা ভর্তি গহনা। খগেনের বৌ রূপসীকে শুধোয়— তাহলে এখানেই থাকবি?

রূপসী অবশ্য শহরে গিয়ে বাবার বকুনি খেয়ে স্কুলে যেতে বাধ্য হতো। অবশ্য মাঝে মাঝে ফেলও করতো। তবু কোনমতে মাধ্যমিকটা পাস করেছিল। রূপসী বলে,—কি যে হবে জানিনা বৌদি, এতদিন শহরে রইলাম, তারপর চলে আসতে হল, বাবারও রোজগার নাই।

খগেনের বৌ নন্দিনী বলে,—এখন তো পঞ্চায়েতেও মেয়েদের কাজকর্ম রয়েছে, দ্যাখ না চেষ্টা করে।

নন্দিনী সহজ সরল প্রকৃতির মেয়েই। রূপসীও দেখেছে এখন পঞ্চায়েত অফিসে অনেক লোকজন যাতায়াত করে। মেয়েরাও আসে। সরকার গ্রামের সাধারণ মানুষের রোজগারের জন্য, শিক্ষার জন্য, স্বাস্থ্যের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা নিয়েছে। গ্রাম উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কাজও করার পরিকল্পনা চলছে। তার জন্য লাখ লাখ টাকাও আসছে। পঞ্চায়েতের প্রধানের হাতে এখন অনেক ক্ষমতা। রূপসীও ভেবেছে সে এতকাল যা করে এসেছে তা ঠিক নয়। শহরে গিয়ে এই গ্রামের কেশব ঘোষের ভাইপো তার ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার করেছে আর মেয়ে মৌসুমীও গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে শহরের আলেয়ার মোহে না পড়ে নিজের পরিশ্রমে এম.এ পাস করে শহরে কোন কলেজে অধ্যাপনা করেছে। মৌসুমী নিজের ভবিষ্যৎ গড়েছে সেখানে। আর রূপসী কি মোহের বশে পড়াশোনাও করেনি তেমন। বিলাস ব্যসনের স্রোতে গা ভাসিয়েছে। সুজন সিং-এর মতো বেইমান লোকদের পাল্লায় পড়ে অন্ধকারের জগতে পা বাড়িয়ে নিজের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাছন্ন করে তুলেছে।

শহরে তাদের কলোনীতে সকলেই তাকে চিনতো। অনেক বাবা মা তাকে এড়িয়ে যেতো। বন্ধুরাও আড়ালে হাসাহাসি করতো। রূপসীর মুখে সমাজ যেন একটা ঘন কালো কলঙ্কের পোঁচ মাখিয়ে দিয়েছিল। তবু বিশ্বনাথ মেয়ের বিয়েটা দিয়ে ঘরবাসী করার চেষ্টাও করেছিল। রূপসীও সেদিন ছিল কলোনীর উপেক্ষিত একজন। তাই সেও চেয়েছিল যদি বিয়ে থা হয় অন্যত্র গিয়ে এখানের পরিচয় ভুলে গিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধবে। সুখী হবে। তাই সেও বিয়েতে মত দিয়েছিল। তাই সেইমতো বিশ্বনাথ ছেলের সন্ধানও শুরু করেছিল। একমাত্র মেয়ে। বিশ্বনাথের জমিজমাও আছে দেশের বাড়িতে। তাছাড়া চাকরিতে ভালো উপরি পায় মাইনে ছাড়া। তাই ছেলের খবরও আসে।

তাদের মধ্যে একজনকে রূপসীরও চোখে লাগে। ছেলের বাড়ি বর্ধমানে। বাড়িতে বাবা মা আছে। ছেলেটি এখানের অন্য কোন কারখানাতে কাজ করে। ছেলেরও অমত হয় না। ছেলেটিও আসে বিশ্বনাথের কাছে। রূপসী স্বপ্ন দেখে নতুন করে বাঁচবে সে। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়ে যায়। বিশ্বনাথও মেয়েকে থিতু করবার জন্য বেশি টাকাই খরচ করবে। বাড়িতে উৎসাহের বান ডাকে।

এমনি দিনে এক রবিবার বিশ্বনাথ বাড়িতে বসে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে নিমন্ত্রিতের ফর্দ করছে। বিয়ের জিনিসপত্র আর কী কী বাকী আছে কিনতে—সে সব ফর্দ নিয়ে বসে রূপসী বাবার কাছে। হঠাৎ বেল বেজে ওঠে। বিশ্বনাথ দেখে একটা গাড়ি থেকে একজন বয়স্ক লোক, ভদ্রমহিলা আর সঙ্গে তিন-চারজন মস্তান চেহারার ছেলে নামছে। বিশ্বনাথবাবু তাদের বাইরের ঘরে বসায়—তারপর জানতে পারে ওরা ছেলের বাবা মা আর সঙ্গের ওরা এলেমদার প্রতিবেশী। ভদ্রলোকের নাকি সিলকাটা মালের চালু ব্যবসা। অর্থাৎ রাতের অন্ধকারে ওর লোকজন ওয়াগন ভেঙে মাল বের করে আর উনি সে সব মালের মহাজন। বেশ করিতকর্মা লোক। মহিলাও রীতিমতো জাহাঁবাজ ধরনের আর সঙ্গের ওরা তো বিশিষ্ট মস্তান। ছুরি ছোরা চেম্বার-টেম্বার যে সাথে নেই তা কে বলতে পারে। ছেলের বাবা গর্জে ওঠে,—একটা বাজে মেয়েকে আমার ছেলের ঘাড়ে চাপাতে চান মশাই। আমি প্রতাপপুরের কেষ্ট বাগ। বাঘের ঘরে ঘোঘের বাস করা আমি এক মিনিটে ঘুচিয়ে দেব।

মহিলাও ফাটা কাঁসরের মতো গলার শব্দ তুলে শাসায়,—ঝেটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেব। ওই নষ্টা মেয়ে হবে আমার ছেলের বউ। রাত্রির পোয়াবে না— বিষ দিয়ে শেষ করে লাশ গায়েব করে দোব।

মস্তান বাহিনীর একজন পকেট থেকে চেম্বার বের করে বিশ্বনাথের সামনে ধরে বলে,—এটা কি জানো তো হে মাল! এর একটা দানা মগজে সেধিয়ে দিলে আর নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যাবে। ওসব বিয়ের মতলব ছাড়ো। চালু মেয়েকে ভাড়া খাটাও—আরও মাল পাবে।

বিশ্বনাথ স্তব্ধ হয়ে গেছে। কাঁদছে ওর স্ত্রী আর রূপসী দেখে তার স্বপ্নের সমাধি রচিত হয়ে গেল। সে এ বিয়ে করবে না। কারণ এরা যা বলছে তা কাজে পরিণত করতে পারে, এতে আর সন্দেহ নেই রূপসীর। তাই সে বলে,— আপনারা যান। আমি কথা দিচ্ছি এ বিয়ে হবে না। রূপসী জানে তাদের সংসারের অবস্থা। বাবার সেই রোজগার আর নেই। কলসীর জল গড়াতে গড়াতে একদিন তলানিতে এসে ঠেকে। বিশ্বনাথ চাকরি ছাড়ার পর যে টাকা পেয়েছিল সেইটুকু সম্বল। আর রূপসীও যেন তার কাছে বোঝাই হয়ে গেছে। বিয়ে থাও দিতে পারেনি মেয়ের। এখন রাগ পড়েছে রূপসীর উপর। তাই বিশ্বনাথও তুচ্ছ কারণে রূপসীর ওপর চটে উঠে বলে,—নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেছিস। আর তার জন্য সারাজীবন তোর বোঝা বইতে হবে আমাকে। এবার নিজের পথ নিজেই দেখে নে।

মা তবু বলে,—একটা মাত্র মেয়ে তাকেও পুষতে পারে না?

মেয়ে নয় শত্রু। ও আমার মুখ পুড়িয়েছে। বংশের মুখে পুড়িয়েছে।

বিশ্বনাথের রাগটা এখন কারণে অকারণে প্রকাশ পায়। তাই রূপসীও চেষ্টা করছে যদি পঞ্চায়েতে কোন কাজ পায়। অনেক মেয়েরাই এখন নানা কাজ করে কিছু রোজগার করছে। আজ তাকেও নিজের অন্ন নিজেকেই সংগ্রহ করতে হবে। সেই আশা নিয়েই রূপসী খগেন বাবুকে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু খগেন খুবই ব্যস্ত। সকালেই বের হয়ে যায় জিপ নিয়ে। বিভিন্ন কাজের সাইটে ঘোরে, না হয় সদর শহরেও যায়। সেখান নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। সেখান থেকে নানা নির্দেশ আসে। সেই নেতাদেরও নানাভাবে খুশী করতে হয়। তারপর যেতে হয় বিভিন্ন সরকারী অফিসে। নানা বিভাগ থেকে টাকা আসে নানা কাজের জন্য। সেইসব টাকার জন্য তার কতটা কোন দিকে যাবে—কিভাবে সেই হিসাব রাখতে হবে এইসব নানারকম ভাবনা চিন্তাও করতে হয়।

তারপর সারা এলাকার বেশকিছু গ্রামেও যেতে হয়। তখন খগেন অন্য মানুষ। বিনয়ের অবতার। নানাজনের নানা অভিযোগ-এর কথা শুনতে হয়। কোথায় পথ নেই, কোথায় জল নেই, কোন স্কুল বাড়ি তৈরি করা দরকার— এসব খাতে টাকাও আসে। কিন্তু সামান্য কাজ করার পর সেই কাজ আর এগোয় না, বন্ধ হয়ে যায় কাজ—টাকার দেখাও আর মেলেনা। তবু খগেন সেই এলাকার মানুষদের বেশ মোলায়েমভাবে বলে—তাই নাকি, কাজ আর হয়নি?

—হ্যাগো! গ্রামের লোক বলে, দেখেন না ওই তো ভাঙা পথ, টিউকলে জল নাই, ইস্কুল ভেঙে পড়বেক। খগেন পকেট থেকে নোটবই বের করে সব লিখে নিয়ে বলে,—আমি দেখছি। কথা দিচ্ছি এসব কাজ হয়ে যাবে।

কোথাও কোনও গ্রামে গিয়ে বলে, খাদ্যের বদলে কাজের নীতি ঘোষণা করে বলে,—কাজ শুরু করছি। সবাই মজুরী, গম-টাকা পাবে। তোমাদের জন্য একেবারে খোদ কলকাতার মন্ত্রীর কাছ থেকে সাংশন করে আনিয়েছি। খগেন বাবু এই সব নানা কাজে ব্যস্ত, তাই তাকে সহজে পাওয়া যায় না। রূপসী তাই ওর স্ত্রী নন্দিনীর কাছেই আসে। মেয়েটা বড়ই ভালো। কিন্তু রূপসীর এই বাড়িতে আসা যাওয়া, নন্দিনীর সঙ্গে ওই মেলামেশা মোটেই খগেনের মা সৌদামিনীর ভালো ঠেকে না। এখন তার সেই অতীতের অভাবের দিনগুলো বদলেছে। এখন আর জীর্ণমাটির বাড়িতে নয়—তিন মহলা দালানে থাকে। সুদিনের মুখ দেখেছে সৌদামিনী। তাই ইতিজনের থেকে একটু দূরেই থাকতে চায় তার আভিজাত্য নিয়ে। তাছাড়া নানা খবর দেবার জন্য সৌদামিনীর আশেপাশে অনেক বাড়ির বৌ গিন্নীরা যাতায়াত করে। তাদের মুখেই সৌদামিনী রূপসীর স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে শুনেছে। শহরে থেকে মেয়েটা একনম্বর বেয়ারা হয়ে উঠেছে। এর আগেও নাকি দুতিনটে স্বামীকে ছেড়ে এসেছে।

সৌদামিনীও দেখেছে রূপসীকে, মেয়েটার দেহে এখনও রয়েছে উচ্ছল যৌবনের ঢল। ওর চোখের আগুন এখন অনেককেই পুড়িয়ে ছাই করতে পারে। রূপসী গ্রামে ফেরার পর থেকেই গ্রামের বৌ গিন্নীদের মনে একটা নীরব আতঙ্ক দেখা দিয়েছে আর সেই খবরটা তারা তাদের কর্ত্রী সৌদামিনীকেও জানিয়েছে বেশ রঙ চাপিয়ে। নন্দিনীও দেখেছে রূপসী এবাড়িতে যখন তখন যাতায়াত করে। সৌদামিনীর এটা ভালো লাগে না। সেই এবাড়ির কর্ত্রী, তাই এবার সৌদামিনীই এর ব্যবস্থা করে। সেদিন রূপসী এসেছে। সিঁড়ির মুখে ওকে দেখে সৌদামিনী বলে,—শোন!

রূপসী এগিয়ে আসে,—কিছু বলছো বুড়িমা? খগেনদা আছে কিনা দেখতে এলাম।

—অফিসের কথা অফিসেই গিয়ে বলো বাছা। ওসব কথা নে কেউ দিনরাত বাড়িতে আসুক আমি চাই না।

রূপসী ওর কথায় একটু অবাক হয়। গ্রামে যে যার বাড়িতে যখন তখন যাতায়াত করে। কিন্তু এবার সৌদামিনী সেইটাতেই আপত্তি তুলেছে। সৌদামিনী বলে—আর শোন—নিজের মুখ তো পুড়িয়েছিস—তোমার কাণ্ডকলাপের কথা আর জানতে কারো বাকী নেই—তাই বলে, নিজের মান ইজ্জৎ না থাক অপরের তো আছে। তাদেরও মুখে কালি দেবার চেষ্টা করো না। এ বাড়িতে না এলেই খুশী হবো।

রূপসীর পা দুটো যেন আটকে গেছে, গ্রামে অনেকেরই চোখে সে দেখেছে তার প্রতি একটা নীরব ঘৃণা লালসাজড়িত চাহনি।

অনেক বাড়ির গিন্নী-বৌরা কৌশলে তাকে এড়িয়ে গেছে পথে ঘাটে। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে তাকে অপমান করেনি। নন্দিনীও এসে পড়েছে শাশুড়ির হাঁকে ডাকে। সেও শুনেছে ওইসব কথা। তবু নন্দিনী থামাতে চায় তার শাশুড়িকে। তাই বলে,—মা! রূপসী তেমন মেয়ে নয়।

সৌদামিনী ফুঁসে ওঠে,—বাঃ বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি কদিন মেলামেশার পর, কানে মন্ত্রও পড়েছে বুঝি। চুপ কর বৌমা। যাও উপরে যাও। যাও। নন্দিনী তার শাশুড়ীকে চেনে। না গেলে তার বাপের শ্রাদ্ধই করে দেবে, তাই সরে যায়। সৌদামিনী দেখছে রূপসীকে। রূপসীও বুঝেছে এখানে থাকলে আরও অপমানিত হতে হবে তাকে। তাই সেও পায়ে পায়ে বের হয়ে আসে। সৌদামিনী তখন গর্জাচ্ছে।

—ফের এ বাড়িতে পা দিলে ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেব। আমার বাড়িতে নষ্টামির মতলব।

রূপসী বের হয়ে আসে। তার মনে পড়ে সুজিতের সেই কথাগুলো। প্রতিপদে সে আঘাত পেয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে অপমান। আজও এক শ্রেণীর মানুষ যাদের জন্য তার সব হারিয়ে গেছে। তাদের কাছেই আবার অপমানিত হয়েছে।

রূপসীও এবার যেন বদলে যেতে চায়। তার মধ্যে একটা অন্য সত্তা আজ বিদ্রোহী হতে চায়। নিজের দাবীকে ছিনিয়ে নিতে চায়।

পথ দিয়ে আসছে রূপসী। ঝড়ো বাতাস বয় বাগানে। ওই পথে ফিরছে রূপসী। হঠাৎ দেখে পথের ধারে খগেনবাবুর গাড়িটা বিগড়ে গেছে। আর খগেনবাবুও গাড়ি থেকে নেমে কি দেখছে। খগেন ফিরছে শহর থেকে।

বেশ খোশমেজাজেই রয়েছে সে। তার পঞ্চায়েত এলাকাতে একটা ছোট নদীর উপর ড্যাম করার কথা চলছিল বেশ কয়েক বছর থেকেই। কয়েক কোটি টাকার কাজ। আর ড্যাম হলে এই এলাকার মানুষেরাও নিয়মিত জল পাবে প্রচুর। এই এলাকার ভোট তার বাক্সেই আসবে। খগেন এবার এম. এল. এ হবার কথা ভাবছে, কারণ এম. এল. এ. হতে পারলে তাকে জেলার কোটাতে মন্ত্রীই করা হবে। আর বেশ জেনেছে সে এই ড্যামের কাজ দেখিয়ে সে বিরোধীদের সব প্রতিবাদকে নস্যাৎ করে দেবে। আর এবার ভোটে সেই-ই জিতবে।

এটাতো একদিকের কথা, অন্যদিকে এই বিশাল কয়েক কোটি টাকার কাজটা হলে সেই কর্মকাণ্ডের বেশ কিছু ঠিকাদারীও পাবে খগেন বেনামীতে এবং নানাভাবে তার পকেটেও কয়েক কোটি টাকা আসবে। মন্ত্রীত্ব পাবে—এত টাকাও পাবে, এই খুশীতে সেও খুশী। হঠাৎ বাড়ির কাছে এসে গাড়িটা বিগড়েছে। তবু রক্ষা যে গ্রামের এদিকে গাড়িটা গেছে। এটুকু পথ হেঁটেই ফিরতে পারবে।

ছায়াঘন বাগানে ঝড়ো হাওয়া মাতামাতি করছে। খগেন গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই ফিরছে বাড়ির দিকে। বাগানে আলোছায়ার জালবোনা। পাখিদের কলরব ওঠে। আমের বোলের মিষ্টি সুবাস মিশেছে মৌমাছিদের গুঞ্জন। হঠাৎ সামনে রূপসীকে দেখে চাইল খগেন।

সুন্দর যৌবনবতী নিটোল দেহ, ঝড়ো বাতাসে শাড়ির আঁচল পড়ছে। রূপসীও নির্জন বাগানে এসে যেন নিজেকে একটু অগোছালো করে তুলেছে। দেখা যায় তার উন্নত বুক, নিটোল পুরুট কোমর, বাহমূলও অনাবৃত। ডাগর কালো চোখে তখনও সেই অশ্রুরেখা মুছে যায়নি। খগেন দেখছে ওকে। খগেন চেনে রূপসীকে। ওই চাহনির অর্থ বোঝে রূপসী, আজ চকিতের মধ্যে মনে পড়ে তার বাড়ি থেকেই বিতাড়িত হয়েছে রূপসী। তবু তার মধ্যে সেই নতুন সত্তা যেন জেদ নিয়েই জেগে উঠেছে। আজ আর হার মেনে পিছু হটবেনা রূপসী। সে জিতবেই। তাই তার চোখের দৃষ্টিতে ফুঁটে উঠেছে নীরব আহ্বান-আমন্ত্রণ।

খগেন জীবনে অনেক পেয়েছে। নাম-প্রতিষ্ঠা-অর্থ—আরও অনেক কিছু পাবে। কিন্তু আজ তার মনে হয় অনেক পাওয়াই অপূর্ণ রয়ে গেছে। নন্দিনী তাকে সব কিছু দিতে পারেনি। এইটাই যেন আজ নির্জন ছায়াঘন এই ব্যাকুল সুরভিত বাগানের মধ্যে সে আবিষ্কৃত করেছে। আর সেই অপূর্ণতাকে যেন পূর্ণ করতে পারে ওই রূপসীই। খগেন শুধায়,—রূপসী না?

রূপসীও এবার সারাদেহে ছন্দ তুলে এগিয়ে আসে। তার ডাগর কালো চোখে কি যেন নেশা। ঝড়ো বাতাসে আধ আদুর উন্নত বুক তার দেহটাকে ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস করে তাকে সোচ্চার প্রকাশ করে বলে রূপসী।

—যাক চিনেছ তাহলে। কি ভাগ্য আমার গো।

—চিনবো না কেন?

হাসে রূপসী,—তুমি এক মস্ত লোক। এলাকার একনম্বর মানুষ, আর আমরা তো তুচ্ছ।

—না-না! খগেন এগিয়ে আসে।

রূপসীও বুঝেছে তার চোখের নেশার ঘোর লেগেছে কিছুটা, খগেনের সেই চাহনিকে আরও মোহময় করে তুলে বলে,

—কদিন ধরেই ভাবছি তোমার সঙ্গে দেখা করবো। তা দেখাই পাইনি, যা ব্যস্ত লোক।

খগেনও খুশি হয়। বলে,—তাই নাকি। তা আমার কাছে কেন?

রূপসী বলে,—সেই কথা কি এই বাগানেই শুনবে? অবশ্য সময় তো তোমার নেই।

খগেন বলে,—না, না। দিনভোর কাজে ডুবে থাকি। তবে সন্ধ্যার পর আমার বাগান বাড়িতে একটু ফ্রি থাকি। যদি ওখানে আসো কথা হবে। না হয় দুপুরে অফিসেও আসতে পারো। তবে সেখানে লোকজনের ভিড় থাকে, নানা কাজে ব্যস্ত থাকি।

রূপসী একটু আশার আলো দেখে। সে বলে,—তাহলে সন্ধ্যার পর বাগান বাড়িতেই যাবে।

—তাই এসো।

—চলি তাহলে, ওখানেই কথা হবে।

চলে যায় রূপসী বাগানের মধ্যে দিয়ে। খগেন তখন ওর সেই ছন্দময় ভঙ্গীতে যাবার দৃশ্যটা দেখছে। তার কানে আসে কোকিলের ডাক। বাগানের আমের বোলের সুবাস খগেনের মনে আজ নেশা জাগায়। এবার সব চাওয়াই তার পূর্ণ হবে। টাকা-প্রতিষ্ঠা সবই পেয়েছে। এবার আরও কিছু পাবে খগেন। এ যেন তার অনেক পাওয়া। রূপসী তার মনে একটা ঝড়ই তুলে গেছে।

সুকুমার এই গ্রামেরই ছেলে। ওর বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তিনি আশা করেছিলেন সুকুমারও পাস করে স্কুলের চাকরি পাবে। শিক্ষকতা করবে। সুকুমার পড়াশোনায় খুবই ভালো। ছেলে হিসাবেও গ্রামের সেরা। মানুষের সেবার জন্য সে নিজেই বেশ কিছু তরুণদের নিয়ে একটা সংস্থা করেছে। সেখানে তারা গরিব মানুষদের সাহায্য করে। সন্ধ্যার পর লোকজন-ছেলেদের পড়ায়। এই থেকে ওর গ্রাম সেবার শুরু। পাস করার পর গ্রামে স্কুলে চাকরির চেষ্টাও করে। বাবা ওই স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এখন রিটায়ার করেছে, খুবই সাধারণ অবস্থা ওদের। খগেনবাবু এখন পদাধিকার বলে স্কুলের প্রেসিডেন্ট, আর খগেন জানে দল রাখতে গেলে পাঁচজনকে কিছু পাইয়ে দেবার সুযোগও করে দিতে হবে। তাই সেক্রেটারী করেছে তারই দলের একজনকে আর নিজের চেষ্টাতেই স্কুল কমিটিতে প্রতিপক্ষের তেমন কাউকে ঢুকতেও দেয়নি। পঞ্চায়েতে যেমন সব সিট দখল করেছে তার দল, এখানেও একই পথ নিয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগ করা হবে তার জন্য বেশ ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। কয়েকজন ইন্টারভিউ দিয়েছে, আর সুকুমার-এর নম্বর অন্যান্য নম্বরের সাথে বেশি। ইংরেজীতে তার হাইসেকেন্ড ক্লাস, অনার্সও রয়েছে। কিন্তু কমিটির দু একজন সুকুমারকে বলে,—আশি হাজার টাকা দিতে হবে তবেই তার মাষ্টারীর চাকরি হতে পারে। পোষ্টের দর উঠেছে একলাখ—তবে সুকুমারকে আশি হাজার টাকা দিতে হবে। কমিটি তার জন্য এইটুকু বিবেচনা করবে।

সুকুমার, তার বাবা খবরটা শুনে অবাক হয়। ওর বাবা বলেন,—সেকি! যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার হবে না—বিচার হবে টাকা দিয়ে।

সেক্রেটারী বলে,—স্কুল ফান্ডে টাকার দরকার। খগেনবাবু বলেছেন টাকা অন্যরা দিতে চাইছে। সুকুমার না হয় কমই দেবে।

কিন্তু এতটাকা তাদের নেই। ফলে সুকুমার চাকরি পায়না, চাকরি পেলো খগেনের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়। সুকুমারকে তারা এইভাবে এড়িয়ে গেছিল।

সুকুমারও বুঝেছে তাকে খগেনবাবু তার চক্রে ভিড়তে দেবে না। কারণ— সুকুমার এর মধ্যে গ্রাম সেবার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে আর সদরে অন্যদলের কাছ থেকে সাহায্যও পাচ্ছে। এদিকে তার জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।

সেবার ভোটে খগেনবাবুর বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল সুকুমার। সেও দেখেছে এদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই হবে। খগেনবাবু সর্বত্রই দুর্নীতির জাল ছড়িয়ে রেখেছে। ওদের মুখোস খুলে দিতেই হবে।

সুকুমার ও তার দল কিছু চেষ্টা করেছিল, কিন্তু খগেনের টাকার জোর বেশি। তার দলের নামডাকও আছে। আর খগেন পঞ্চায়েতেরও প্রধান। উন্নয়ন খাতে বেশ কিছু টাকাও সে রেখেছিল আগে থেকে। ভোটের আগেই গ্রামে গ্রামে উন্নয়নের বন্ধ কাজগুলো শুরু হল।

খাদ্যের বিনিময়ে কাজের প্রকল্পও চালু হল। গম-টাকা-মায় কাপড় কম্বলও বিলি করা হতে লাগল গ্রামে গ্রামে। গরীব গ্রামবাসীদের কাছে খগেনবাবু হয়ে উঠল আদর্শ নায়ক। তাদের কাছের মানুষ। খগেনও জানে ভোটের আগে এই টাকাও তার নয়। সেই টাকা দিয়ে ভোটে জিততে পারলে এসব টাকা সে সুদসুদ্ধুআদায় করে নেবে। এর আগেও নিয়েছে, এবারও নেবে।

সুকুমার তবু থামেনি। বেশ কিছু মানুষ জানে খগেনবাবুর এইসব চালগুলো। ক’মাস কাজ করে বাকী পাঁচবছর ধরে লুটপাঠ চালাবে। তাই বেশ কিছু লোক সুকুমারদের মতো নিঃস্বার্থ সৎ কর্মীদের জেতাবার কথাও ভাবে। কিন্তু দেখা যায় ভোটের দিন বাইরে থেকে বেশ কিছু ছেলেকে আনে খগেন। ওদের কোমরে চেম্বার, মুখে খিস্তি আর শাসানি। ওরাই বলে,—ভোট তোমাদের দিতে যেতে হবে না, ওসব যা করার তা আমরাই করে দোব।

সুকুমার তার দলবল তবু থামে না। হাটতলায় স্কুল চত্বরে শিবমন্দিরের সামনে বেশ কিছু বোমাও পড়ে। বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে চারিদিক। কয়েকটা গ্রামেই এই বিস্ফোরণ ঘটে, ফলে গোলমালের ভয়ে অনেকেই ভোট দিতে আসতে পারে না। অবশ্য ভোট ঠিকই হয়ে যায়। খগেনবাবুর দল পেয়েছে বেশিরভাগ সিট। সুকুমার জিতেছিল মাত্র তার দলের দুজনকে নিয়ে। ফলে বিরোধী পক্ষ তেমন জোরালোও হয়নি। সুকুমারবাবু এখনও এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে চলেছে। বিশ্বনাথবাবুর পাড়াতেই সুকুমারবাবুর বাড়ি। তার বাড়িতেও আসে সুকুমার। সদরেও তার যোগাযোগ আছে। রূপসীও চেনে সুকুমারকে ছেলেবেলা থেকে। দু’জনে একসঙ্গে খেলাধুলাও করেছে, মানুষ হয়েছে। সুকুমার ছিল ভালো ছাত্র। রূপসীকে তখনই বলতো সুকুমার,—ভালো করে লেখাপড়া করো রূপসী।

রূপসী হেসে বলতো,—লেখাপড়া করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে।

ছোটবেলায় সুকুমার একটা স্বপ্ন দেখতো, কিন্তু তারপর রূপসী চলে গেল বাবার কোয়ার্টারে। সেখানেই রয়ে গেল রূপসী। সুকুমার তখন শহরে কলেজে পড়ছে। আর গ্রামে সেবার কাজও শুরু করেছে। তারপর দীর্ঘ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। গ্রামের চেহারাও বদলে গেছে। বদলে গেছে সমাজের রূপটা। সুকুমার এখন তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সে বিশ্বাস করে খগেনের দুঃশাসনের দিনও শেষ হবে। মানুষ একদিন সব ভয় জয় করে অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠবে। তারই প্রস্তুতি করে চলেছে সে।

এমনি দিনে রূপসী আবার ফিরে এল গ্রামে। শুধু বিশ্বানাথই নয়। এই গ্রামের আশেপাশের গ্রামের বেশ কিছু লোকই চাকরি হারিয়ে আবার গ্রামে ফিরে এসেছে। সুকুমার খবরটা আগেই পেয়েছিল। সেদিন বিশ্বনাথ ফিরতে সুকুমার আসে দেখা করতে। তার বাবা আগেই মারা গেছেন। সুকুমার রূপসীকে দেখে বলে,—আরেব্বাস এ যে একেবারে লেডি হয়ে গেছে রূপসী।

—তা হবে না? মানুষতো দিন বদলের সঙ্গে বদলায়। তুমিও তো এখন ঘোর সংসারী।

সুকুমার বলে,—সংসারী আর হতে পারলাম কই। বেকার একটা ছেলে, তার সংসারী হওয়া সাজে না। তাই অন্যের ঘর সংসার যাতে শান্তিতে বজায় থাকে সেই চেষ্টাই করছি।

রূপসীও দেখেছে সুকুমার ঘর সংসার করেনি। দেশসেবা-গ্রামসেবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রূপসী বলে,—আজকাল দেশসেবার কাজও বেশ লাভজনক।

বিশ্বনাথ বলে,—সুকুমার খগেন নয় রে। দু’জনের পথ আলাদা। তাই সুকুমারের কিছুই হল না। ও ভালো ছেলে।

রূপসী বলে,—ভালো ছেলেরা বোকাই হয় বাবা।

বিশ্বনাথ সুকুমারকে বলে এবার, —সদরে তো তোমার যাতায়াত আছে, গ্রামের পঞ্চায়েতে মেয়েরা কাজ করছে। দ্যাখো না, রূপসীকে যদি কোথাও কোন কাজে ঢুকিয়ে দিতে পারো।

—দেখুন, এখানে তো খগেনবাবুর রাজত্ব। আমাদের কথা ওরা কি রাখবে? দেখি সদরে চেষ্টা করে যদি কিছু হয়।

রূপসীও ভেবেছে কথাটা। সে জানে এখানের রাজা খগেনবাবু, তাই খগেনকে ধরার জন্য ওর বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিল।

সুকুমার অবশ্য এর মধ্যে রূপসীর দরখাস্ত নিয়ে সদরে দু’এক জায়গাতে ঘুরেছে কিন্তু এখনও তেমন কিছু করতে পারেনি। রূপসীও নিজেই খগেনকে ধরার চেষ্টা করছে এতদিন। এবং আজ খগেন নিজে থেকেই ধরা দিতে এসেছে সেটা বুঝেছে রূপসী।

গ্রামে অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলে, কিন্তু খগেন তাকে এড়িয়ে চলেনি। বরং তাকে দেখা করতে বলেছে। বাঁচার তাগিদে রূপসীর কিছু কাজ দরকার। তার চেয়ে একটা বড় জ্বালা রয়েছে রূপসীর মনের অতলে। ওই স্বার্থপর লোভী পুরুষরাই রূপসীকে তাদের লোভের শিকারে পরিণত করে তার জীবন বরবাদ করেছে, পুরুষ জাতটার উপরে রূপসীর একটা নীরব ঘৃণা রয়ে গেছে, রয়ে গেছে প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা। রূপসী আজ মনে মনে যেন নিজেকে তৈরিই করেছে তার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। খগেনের বাগান বাড়িতে যাবে সে। নিজের পায়ের নীচে মাটি তাকে পেতেই হবে।

সুকুমার সাইকেল নিয়ে ফিরছিল অন্য কোন গ্রাম থেকে। দুপুর হয়ে গেছে। দেখে ওই নির্জন বাগানে রূপসী আর খগেনকে। ওরা ঘনিষ্ঠ হয়ে কি যেন কথা বলছে—হাসছে খগেন।

সুকুমার একটু অবাকই হয়। রূপসীর সম্বন্ধে সুকুমারের একটা দুর্বলতা ছিল। রূপসী গ্রামে ফিরতে সুকুমারও একটা স্বপ্ন দেখেছিল রূপসীকে নিয়ে।

কিন্তু রূপসীর দিকে খগেন হাত বাড়াবে এটা ভাবেনি, খগেনের লোভী সত্তাটাকে চেনে সুকুমার। তাই ব্যাপারটা তার ভালো লাগে না। সে দেখে মাত্র। আর সরে যায় রূপসী খগেনের নজরের আড়ালে। সুকুমারের মনে হয় খগেনের আসল পরিচয়টা রূপসীকে জানানো দরকার।

তাই বিকেলে সুকুমার আসে রূপসীর বাড়িতে। বিশ্বনাথ তখন তার একজন চাষীর সঙ্গে বেশ চড়া গলাতেই কি কথা বলছে। সুকুমার ভিতরে চলে যায়। রূপসীর সঙ্গে তার দরকার। রূপসী ওদিকে কি কাজ করছিল। সুকুমারকে দেখে চাইল।

—কি ব্যাপার!

সুকুমার প্রথমে কিভাবে কথাটা শুরু করবে তাই ভাবছে। রূপসীই বলে,— একটা কাজের ব্যবস্থা হয়তো হয়ে যাবে।

—মানে! সুকুমার শুধোয়।

রূপসী বলে,—খগেনদার সঙ্গে কথা হল, ওকে বললাম। ওতো দেখা করতে বল্লে ওর বাগানবাড়িতে। মনে হচ্ছে কাজটা হয়ে যাবে।

—খগেনের বাগান বাড়িতে যেতে বল্লে? ওই লোকটার সম্বন্ধে কিছু জানো? ওই বাগানবাড়িতে কি হয় জানো?

রূপসীর এসব অভিজ্ঞতা আছে অনেক। সুজিত সিংকে ও দেখেছে। হোটেল রিসর্টেও যেতে হয়েছে রূপসীকে। সেইদিনগুলোর কথা আজও ভোলেনি রূপসী। এবার তাকে পায়ের নীচে মাটি পেতে হবে। তাই সচেতন হয়েই যাবে সে ওই বাগানবাড়িতে।

তাই রূপসী বলে,—এমন লোকদের আমি চিনি। কাজ আদায় করার জন্যে যেতে হলে যাবে। বাঁচার মাশুল তো দিতে হবে। আমার আর হারাবার কি আছে বলো? গ্রামের লোকতো সবাই অনেক কিছু বলে আমার সম্বন্ধে। তারা না হয় আরও দুটো কথা বলবে। লোকের কথায় কি এসে যায়—আমার কাজ নিয়ে কথা।

সুকুমার দেখছে রূপসীকে। রূপসীকে বলে,—দুটো দিন অপেক্ষা করতে পারো না রূপসী। হয়তো সদরে কিছু একটা হবে।

রূপসী হাসে,—কবে কি হবে তার জন্য হা পিত্যেস করে বসে থাকার সময়তো নেই।

উঠে পড়ে রূপসী, যেন তার কথাটা জানিয়ে দিতে পেরেছে সে সুকুমারকে। তাই চলে গেল ভিতরে। সুকুমারের কথায় কান দেবার ইচ্ছাও যেন রূপসীর নেই।

বিশ্বনাথ-এর কিছু জমিজমাও রয়েছে। চাকরিতে যাবার আগে গ্রামে নিজেই হালবলদ রেখে নিজেই চাষ-আবাদ করতো। ওই জমিতে কিছু ফসল পেতো। কিন্তু চাকরিতে যাবার পর আর গ্রামে থাকেনি। তাই হালবলদ বিক্রী করে গ্রামের সনাতনকে ভাগে চাষ করতে দিয়েছিল।

সনাতনদের সঙ্গে বিশ্বনাথদের অনেকদিনের চেনাজানা। আর পাশেই তার বাড়ি। সনাতন লোকটা ধর্মভীরু নিরীহ ধরনের। সে জমিতে ভাগচাষ করতো আর ঠিকঠাক সব ধান বিশ্বনাথের খামারে তুলে বিশ্বনাথকে খবর দিত। বিশ্বনাথ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে এসে সেই ফসলের ভাগ নিয়ে যেতো। সনাতন বলতো,—বামুনের জমি। ভাগচাষ করি, তাকে ঠকাবো না। ন্যায্য ভাগই দোব, সেইমত চলে আসছিল। ক্রমশ খগেনরা এই গ্রামের আশেপাশের গ্রামের চাষীদের কাছে পরম উপকারী বন্ধু সাজার জন্য তাদের কিছু পাইয়ে দেবার জন্য লড়াই শুরু করলো। তারা গ্রামে গ্রামে চাষীদের শোনালো,—লাঙল যার জমি তার।

অবশ্য একেবারে জমির মালিকানা থেকে জমির মালিকদের হটানো গেল না। তখন বর্গাদারী আন্দোলন শুরু করলো। অর্থাৎ যার জমিতে চাষী ভাগ চাষ করছে, সেই জমির উপরই তার হক থাকবে। জমির মালিক সহজে তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে কাউকে ভাগচাষ করতে দিতে পারবে না। তারজন্য দরকার হলে কোর্টকাছারিও করতে হবে।

অর্থাৎ ভাগচাষীরও জমির উপর কিছুটা স্বত্ব থাকবে। খগেনবাবুরা এইভাবে দমকা কিছু চাষীকে কিছু পাইয়ে দিয়ে কৃষি ব্যবহার উন্নতি করতে চায়।

কিন্তু এই বর্গাদারীর নাম করে শুরু হল অনেক খেলা। আসলে সে ভাগচাষী নয় অন্য কোন লোক চাষ করে। কিন্তু পরে দেখা গেল বর্গাদারীতে সেই চাষীর নামই নেই আছে অন্য কোন কৃপাধন্য চাষীর নাম, এই নিয়েই শুরু হল গণ্ডগোল।

অন্য চাষীদের বলা হল বর্গাদারী রেকর্ড করাতে। সনাতন বলে, ইতে কি হবেক গো! জমি এখন চাষ করছি। বাবু কিছুই দেখে না। দশ পনেরো বছর আমিই এসব করছি। এই বর্গাদারীর নাম লিখিয়ে কি হবেক।

অনেকে যুক্তি দেয়,—তোমার ছেলেও জমি পাবে—আর চাষের উৎপন্ন বাড়বে।

কি করে বাড়বেক। আমি একা চাষ করছি এখন। আমার চারটে ছেলে বর্গাদারী করে জমি পাবে দুবিঘে জমি তো বাড়বেক নাই। তাতে চার শরিকই বাড়বেক। তালি বর্গা করে আজ লাভ হলো চাষীর কিন্তু পরে জমিতো আরও টুকরো হবেক। কি উৎপন্ন হবেক?

সনাতন হিসাব করে দেখেছে এতে চাষীদের লাভ হবে সাময়িক, কদিনের জন্য আখেরে চাষের কোন উন্নতিই হবে না এপথে। তবে আজকের নেতারা— তোদের পাইয়ে দিলাম বলে কিছু ভোট অবশ্যই পাবে। তাই সে বর্গাদারী করেনি।

তারপর চাকরি থেকে দেশে ফিরেও বিশ্বনাথ সনাতনের কাছ থেকে জমি ফেরতও নেয়নি। সনাতনই চাষ করে চলেছে। তার জমিতে বর্গাদারী হয়নি এটা জানে বিশ্বনাথ।

কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। মানুষেরও লোভও বেড়েছে। আর এক শ্রেণীর মানুষ হঠাৎ বেশকিছু টাকার জোরে নিজেদের দাপট বাড়িয়ে চলেছে। তারাই নিজেদের স্বার্থে গোলমাল বাঁধিয়ে ফায়দা তোলে। গোবিন্দ এখন খগেনবাবুর কাছের মানুষ। লোকটা আগে দিন মজুরী করতো তারপর খগেনবাবুর সুনজরে পড়ে। অবশ্য দিন মজুরীর সঙ্গে রাতের অন্ধকারে ছিচকে চুরিও করতো। বেশ ধূর্ত আর বচনবাগীশ লোক। ক্রমশ খগেনবাবুর সঙ্গেই লেগে পড়ে। ওর বাড়িতেই কাজকর্ম করে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে ছায়ার মতো। আর এর মধ্যেই পঞ্চায়েত অফিসেও সাফসুতরোর কাজ করে। দেখা যায় কবছরের মধ্যেই বলদ হাল কিনে নিজেই চাষী হয়ে গেছে। তার দুই ছেলে কাজ করে।

গোবিন্দর দিনও বদলে যায় কোন এক রহস্যময় কারণে। এখন গোবিন্দ পঞ্চায়েত কর্মী। সেখান থেকে মাইনে ছাড়াও এদিক ওদিক থেকে বেশ ভালোই আমদানী করে। আর ছেলেরা কৃষি ঋণ—বলদ ঋণ নিয়ে, মিনিকেট নিয়ে এখন ভালোই রোজগার করে।

খগেনবাবুর দয়াতে এখন অনেকেই করে খাচ্ছে। সেদিন খগেন পঞ্চায়েতের অফিসে কাজ করছে। এখন পঞ্চায়েতের ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব। টাকাও আসছে কেন্দ্র সরকার, প্রাদেশিক সরকার থেকে অনেক টাকা। এবার নতুন একটা পরিকল্পনা এসেছে। এতদিন ধরে চলেছে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযান। সারা জেলার মানুষকে স্বাক্ষর করে তুলতে হবে। গ্রামে গ্রামে সেই কাজ শুরু হয়েছিল, বিভিন্ন কেন্দ্র করে।

তারপর অনেক টাকাই চলে গেল। অবশ্য কাগজে কলমে দেখানো হয়েছে অধিকাংশই স্বাক্ষর হয়ে গেছে। এবার আরও বেশিদূর অবধি পড়তে হবে তাদের। তারজন্য মাসিক ভাতা দিয়ে বেশ কিছু শিক্ষাকর্মী নিতে হবে অর্থাৎ আবার কাজের অজুহাতে খগেনের কেন তার অনুগৃহীত অনেকেরই বেশ কিছু আমদানী হবে।

খগেনের সহকারী বলে,—এসব কাজ করতে পারলে সমাজের উপকারই হবে। যে সব পরিকল্পনায় টাকা আসছে সে সব ঠিকঠাক ব্যয় করে আমরা আমাদের পঞ্চায়েতকে আদর্শ পঞ্চায়েত করতে পারি।

কালীবাবু সত্যিকার কর্মী। তিনি এই সব কাজ করতে চান নিষ্ঠার সঙ্গে। খগেনও জানে সেটা, তবে সেও কালীবাবুকে ওই নিষ্ঠার জন্যই এড়িয়ে চলে। ওর সততাকে ভয় করে খগেন। আর দু’চারজন ইয়ার মেমসাহেবও আসে। আজ তাদের কেউ আসবে না।

গোবিন্দ অবশ্য থাকে এই সময়। তাই গোবিন্দও জানে ব্যাপারটা। রূপসীর কথা উঠতেই গোবিন্দ বলে,—মেয়েটার ব্যাপারস্যাপার সুবিধার নয় বাবু।

—কেন? কেন? খগেন সবে মোজ করে পেন নিয়ে বসেছে। গোবিন্দ বলে,—ওই সুকুমার এর সঙ্গে মেয়েটার একটা ইয়েটিয়ের ব্যাপার আছে অনেকদিন থেকেই। আজও সুকুমারবাবুকে দেখলাম ওদের বাড়িতে কি হাসাহাসি হচ্ছিল।

খগেন গভীর জলের মাছ। তাই সাবধানী। এবার এসব খবর শুনে অবশ্য খগেনেরও জেদ চেপে যায়। খগেনের মনে হয় সুকুমারকে সে কোনভাবেই পাত্তা দেয়নি। এবার এই প্রেমের ব্যাপারেও সে সুকুমারকে হটিয়ে দেবে। তাই রূপসীর ব্যাপারটা যেন তার কাছে এটা চ্যালেঞ্জ হয়েই দাঁড়িয়েছে। খগেনও বলে—গোবিন্দ তুই একটু নজর রাখবি ওদের উপর। তোরও লাভ হবে।

গোবিন্দ জানে খগেন বেইমান নয়। খগেনের জন্য গোবিন্দ অনেক অকাজ কুকাজ খুন-জখমও করছে। কিন্তু খগেনই তাকে বাঁচিয়েছে শুধু তাই নয় পাইয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। আজ গোবিন্দর হাল ফিরেছে খগেনের জন্যই।

গোবিন্দ বলে,—তাই হবে বাবু। আপনি সব খবরই পাবেন।

রূপসী এসেছে বাগানে। রূপসী আজ সেজে গুজেই এসেছে। সেও জানে খগেনকে তার এখন দরকার। এতদিন অনেকেই রূপসীকে তাদের দরকারে ব্যবহার করেছে। এখন রূপসীও জীবনের পাঠশালায় ঠকে ঠকে অনেক কিছু শিখেছে।

খগেন দেখছে রূপসীকে। এখনও ওর দেহে যেন রূপতরঙ্গ খেলে যায়। চোখের তারায় আলোর ঝিলিক।

এসো। রূপসী বসে। খগেন বলে,—বলো কি করতে পারি তোমার জন্যে।

রূপসী বলে, এখনতো তোমার হাতে অনেক ক্ষমতা। অনেকের জন্যই অনেক কিছু করো, আমার একটা কাজকম্মের ব্যবস্থা যদি করে দাও খগেন দা। জানোইতো বাবার চাকরি নাই। সংসারের বোঝা আর কত বাড়াবো।

খগেন একটু নিশ্চিন্ত হয়। মেয়েটার চাহিদা সামান্যই। তাই খুশী হয়ে বলে খগেন,—কি খাবে বলো। গোবিন্দ ভালো কাটলেট বানাতে পারে। তারপর মদের বোতলটা দেখিয়ে বলে,—চলে টলে? এতদিন শহরের লোকেদের সঙ্গে মিশেছো।

রূপসী জানে সহজে ধরা দিতে নাই। সেও খগেনকে নিয়ে একটু খেলতে চায়। তাই বলে,—ওসব খাই টাই না খগেন দা। তবে গরম কাটলেট চলতে পারে।

—শুধু কাটলেট। একটু হতাশই হয় খগেন। বলে—ঠিক আছে তাই খাও। জোরাজুরি করবো না। কাটলেট আসে ওর জন্যে।

খগেন বলে,—কাজের ব্যাপারে একটা কিছু করতে হবে। মাধ্যমিক পাস তো?

ঘাড় নাড়ে রূপসী,—হ্যাঁ।

খগেন বলে,—আপাততঃ পঞ্চায়েতের পোষ্ট খালি নেই—সামনের বছর হবে। তখন তোমার জন্যে চেষ্টা করব।

—ওমা! ততদিন তাহলে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হবে।

খগেন বলে,—না-না, ততদিন স্বাক্ষরতা স্কীমেই তোমার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করছি। কাল কাগজপত্র দরখাস্ত নিয়ে অফিসে এসো। বারোটার সময় ওগুলো জমা দিয়ে যেও। আমি সদর থেকে তোমার পোষ্টটা মঞ্জুর করিয়ে আনবো। তবে এখন স্কুলের সেন্টারে সকালে গ্রামের বাচ্চাদের পড়াতে হবে—ওই নামতা লেখানো এইসব। মাসে হাজার দেড়েক করে দেব। বছর খানেক এই কাজ করো। তার মধ্যে পঞ্চায়েতে ঢুকিয়ে নিতে পারবো। তখন পাকা সরকারী চাকরি পাবে। ভালো মাইনে, পেনসন।

অর্থাৎ খগেন তাকে অনেক কিছুই পাইয়ে দেবে তবে একবছর তাকে বিশ্বস্ত হয়ে থাকতে হবে। কথাটা ভাবছে রূপসী। আজ এই প্রস্তাবেই তাকে রাজী হতে হবে। কিন্তু রূপসীও বুঝেছে খগেন তার এই উপকার করার জন্য কিছু দামও উশুল করতে চাইবে। এরা বিনা স্বার্থে কিছুই করে না।

—কি ভাবছ!

রূপসী মনের দ্বিধা সংশয় কাটিয়ে বলে,—না কিছু না।

—তাহলে কাল দুপুরে অফিসে এসো।

—তাই আসবো।

—ভেরি গুড। খগেনও খুশী হয়, বুঝেছে মাছ টোপ গিলেছে। এখন খেলিয়ে ডাঙায় তুলতে পারলে কাজ সিদ্ধ।

সন্ধ্যাটা ভালোই কাটে খগেনের রূপসীর সান্নিধ্যে। খগেন জানে সাবধানে এগোতে হবে। আর স্থির করেছে রূপসীকে হাতে আনতে পারলে তারই লাভ হবে। ওকে দিয়েই তার অনেক কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। তাই এবার খগেন রূপসীকে নানাভাবে জালে জড়ানোর কথাই ভাবছে। আর ওই অস্থায়ী কাজেই ওকে লাগিয়ে কিছু টাকা পাইয়ে দিতে হবে।

সুকুমারও খবর রাখছে। সে পঞ্চায়েত সমিতির সভ্য। তার দলের বেশি সভ্য নেই। তাই তারা বিরোধীর আসনে রয়েছে। কিন্তু সুকুমার চায় যে পঞ্চায়েতের কাজগুলো পরিকল্পনামতো শেষ হোক। কিন্তু তা হয় না। এই নিয়েই ওদের মতান্তর। আর সুকুমার এর মধ্যে লাখদশেক টাকার দুর্নীতির সন্ধানও পেয়েছে। একটা বড় দিঘী সংস্কারের কাজেই এই দুর্নীতি ধরে ফেলেছে সুকুমার। খগেনও সেটা জেনেছে।

রূপসী এখন ওই শিক্ষা প্রকল্পের কাজে ঢুকেছে। সে দেখেছে তাকে কিছুই করতে হয় না। স্কুলে যায়—কিছু ছেলে আসে মাত্র। বইপত্র পোশাক এসব অবশ্য খাতায় কলমে দেওয়া হয়। আসলে ওসব টাকা কোনদিকে চলে যায় আর ছেলেদের রান্নাখাবার দেওয়ার কথা, তার জন্য প্রচুর চালডাল আসে। ছেলেদের জন্য খাবার রান্না করার লোকও আছে একজন। সে ওই গোবিন্দ। মাসে মাসে তার জন্য মাইনেও পায়।

ছেলেমেয়েগুলো খাবার পাবার আশাতেই আসে স্কুলে। কিন্তু খাবার রান্না হয় না। ছেলেদের খেতে দেওয়া হয় না। ওই চালডালের জন্য সামান্যতম অংশ ছেলেদের মাসে একদিন দিয়ে বাকী সব চলে যায় হাটতলায় নীরেন দাসের গুদামে। ছেলেরা খিদে নিয়েই বাড়ি ফিরে যায়।

রূপসী দেখেছে এই ব্যাপারটা। সুকুমার মাঝে মাঝে আসে বিশ্বনাথের বাড়িতে। রূপসীর কাছে সুকুমার বলে,—ওদের চাকরি নিয়েছ, ওদের গুণের কথাতো জানো না। অবশ্য ওদের দলে ভিড়তে পারলে তোমারও বেশকিছু আমদানী হবে। তবে তার জন্য নিজেকে বিক্রী করে দিতে হবে।

রূপসীও সেটা বুঝেছে খগেনের হাবে ভাবে। কিন্তু রূপসী জানে ওই খগেনকে। সে ওকে আঘাত করতে চায়। ধরা দিতে চায় না। তাই সুকুমারকেই তার দরকার। রূপসী বলে,—ওদের কিছু কাজের নমুনা আমি দেখেছি।

সুকুমার বলে,—এতো সামান্যই দেখেছো। লাখ লাখ টাকার ঋণ ফাঁকির প্রমাণও পেয়েছি। সেটা প্রকাশ্যে সরকার থেকেই তদন্ত শুরু হবে।

রূপসী চায় খগেনদের শ্রেণীকে আঘাত দিতে। তাই বলে—ওইসব প্রকাশ করতেই হবে। ওদের মুখোসটা খুলে দিতে হবে। সুকুমারও খুশী হয় রূপসীর কথায়। আজ সেও যেন রূপসীকে সঙ্গী হিসাবেই পেতে চায়।

খগেন অবশ্য গোবিন্দ মারফৎ সব খবরই পায়। রূপসী কিন্তু এখনও খগেনের বশংবদ কর্মী হবার চেষ্টাই করে। সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে বাগানে আসে। এখন রূপসী খগেনের কথা রাখতে এক আধ পেগ মদও নেয়। সেদিন রূপসী বলে,—ছেলেদের স্কুলে খাবার কিছু দেওয়া যায় না। সরকার তো সবই দেয়। খগেন কথাটা শুনে চমকে ওঠে। তার মনে হয় সুকুমারের কথা। খগেন তবু সেসব কথা প্রকাশ না করেই বলে,—দিচ্ছি তো। তবে কি জানো এতসব করার সময় কই। টাকাও ঠিকমতো আসে না।

রূপসী বলে,—টাকা ঠিকমতো খরচও হয় না।

ওই গুপীনাথপুরের দিঘীর কাজও শেষ হলো না অথচ শুনি টাকা সব এসে গেছে।

খগেন এবার চমকে ওঠে। এসব খবর সুকুমারই তাকে দিয়েছে আর রূপসীও যে অনেক কিছু জেনেছে সেটাও বুঝেছে সে। খগেন বলে,—এসব কথা তুমি শুনলে কোথা থেকে?

—অনেকেই বলে। তাছাড়া সেদিন সেক্রেটারীও বলছিলেন।

খগেন কথাটা শোনে মাত্র। সেও শুনেছে এ নিয়ে সুকুমারও উপরমহলে গণদরখাস্ত পাঠাচ্ছে আর বিশ্বনাথবাবুও এই দলে মিশেছে। তারা খগেনকে অপদস্থ করতে চায়। এসব খবর বের হলে তদন্তও হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে কিছু করা দরকার।

বর্ষার প্রথম দিক। এতদিন গ্রীষ্মের দাবদাহের পর এবার আকাশে এসেছে বর্ষার কালোছায়া। বৃষ্টি সবে নেমেছে। এবার চাষদিয়ে বীজধান ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্বনাথও ব্যস্ত। তার ভাগচাষী সনাতন মাঠে লাঙল নিয়ে গেছে। দেখে তার আগে বিশ্বনাথের জমিতে লাঙল নামিয়েছে গোবিন্দর ছেলেরা। ওরাই সেই জমি চাষ দিতে শুরু করেছে। আর গোলমাল-এর আশঙ্কা করে গোবিন্দ নিজে কয়েকজন লোক নিয়ে আলের ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে। লাঠি সোটা নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছে তারা। সনাতনকে দেখে গোবিন্দ গর্জে ওঠে—এ্যাই সোনা। মাঠে নামবি না।

সনাতন দীর্ঘ পনেরো বিশ বছর এই জমি চাষ দিয়ে এসেছে, বাধা পেতে বলে,—মানে। এ জমি বিশু ঠাকুরের। আমি এতকাল চাষ করছি।

—এখন আর করবি না। এ জমির বর্গাদার আমি। পাকা কাগজপত্রও আছে। মাঠে নামলে শেষ করে দোব।

ওরা লাঠি তুলে এগিয়ে আসে। সনাতন নিরীহ ধরনের মানুষ। গোবিন্দর এখন অনেক দাপট। এর আগে গোবিন্দ পঞ্চায়েতের মদত নিয়ে আরও কয়েকজনের জমি জবরদখল করেছে। কিন্তু এই জমিতেও দখল বসাবে তা ভাবেনি সনাতন।

সে ছুটে আসে বিশ্বনাথের কাছে। বিশ্বনাথ ওসব শুনে অবাক। সুকুমারও এসে পড়ে। রূপসীও শুনেছে খবরটা। ওরা মাঠে গিয়ে দেখে গোবিন্দ তার দুই ছেলেকে নিয়ে গোটা চারেক লাঙল নিয়ে বিশ্বনাথের কয়েকখানা জমি আগেই চষে ফেলেছে। এখন তারই অন্য জমিতে চাষ দিয়ে দখল কায়েম করার কাজ করছে। বিশ্বনাথ বলে,—এসব কি হচ্ছে গোবিন্দ। আমার জমি চাষ করবে তুমি—এ কেমন কথা। ওঠো জমি থেকে।

গোবিন্দ বলে, বর্গাদারী রেকর্ড আমার নামে। আমিই চাষ করবো ঠাকুর মশাই। আপনি বাধা দিলেও শুনবো না। তার লোকেদের বলে,—জলদি লাঙল দে।

সুকুমারও দেখছে ব্যাপারটা। সে বিশ্বনাথকে বলে,—জে. এল. আর. অফিসে রেকর্ডপত্র দেখে আসছি। তারপর যা করার করতে হবে, কাকাবাবু।

রূপসীও চটে ওঠে,—এসব কি হচ্ছে। যে যার ইচ্ছামতো কাজ করবে? দেশে আইন নেই।

সুকুমার বলে,—আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে হাতিও গলে যায়। দেখি কি করছে ওরা।

বিশ্বনাথও জে. এল. আর অফিসেই এসেছে সুকুমারকে নিয়ে। এখানেই বর্গাদারীর কাগজপত্র থাকে। আর দেখা যায় বিশ্বনাথের ওই জমিতে নাকি গত কয়েক বছর আগে থেকেই চাষ করছে ওই গোবিন্দ। বিশ্বনাথ বলে,—এসব মিথ্যা। আমি গোবিন্দকে কোনদিনই জমি চাষ করতে দিইনি। আমার জমি চাষ করছে সনাতন।

অফিসার বলেন,—কিন্তু রেকর্ড তো ও কথা বলে না। গোবিন্দই ওই জমির বর্গাদার দেখা যাচ্ছে।

—ওসব পরে বসানো হয়েছে। বিশ্বনাথ গর্জে ওঠে। কিন্তু করার কিছুই নেই।

অফিসার বলে,—আপনি দরখাস্ত করে যান। আমরা তদন্ত করবো। তাতে নাহলে কোর্টে-কাছারিতে যেতে হবে।

বিশ্বনাথ বেশ বুঝেছে তার ওপর সুপরিকল্পিত একটা আক্রমণ করেছে ওই খগেনের দল। সে খগেনের বহু অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেছে। সুকুমারকে সমর্থন করেছে। তাই ওরা তার কণ্ঠরোধ করার জন্যই এই আঘাত করেছে।

রূপসীও বুঝেছে এই ব্যাপারটা। এবার সে আসে খগেনের কাছে। খগেন সন্ধ্যার পর বাগানবাড়িতে দু’একজন গুণমুগ্ধ মোসাহেব নিয়ে একটা আয়েশ করে বসেছিল। রূপসীকে আসতে দেখে মোসাহেবের দলও কেটে পড়ে তারা জানে এসময় খগেনবাবুর ধারে কাছে থাকা সঙ্গত হবে না।

খগেন বলে,—কি ব্যাপার—রূপসী হঠাৎ এসময়?

রূপসী আজ এসেছে গোবিন্দর সম্বন্ধে নালিশ করতে। তাই জানায় গোবিন্দ তাদের জমি দখল করেছে।—এতবড় সাহস ওই গোবিন্দর। আমাদের জমি দখল করবে?

সবই জানে খগেন। বিশ্বনাথ রূপসীদের চাপে রাখার জন্যই সেই-ই এই কাজ করিয়েছে। আর পঞ্চগ্রামের বেশ কিছু অনুগত লোকও জানবে খগেনবাবুর কথামতো চললে তাদেরও এরকম দমকা প্রাপ্তিযোগ ঘটবে। অন্যদিকে রূপসীকেও হাতে রাখা যাবে। সেও সুকুমারের দিকে আর যাবে না। অকপটে এবার খগেনকেই ভজনা করবে। কিন্তু এসব কূটনীতির কথা বাইরে প্রকাশ করে না খগেন।

এ তার নিজের রণকৌশল। কিন্তু সে অন্য মানুষ। মুখে ফুটে ওঠে বিস্ময়ের ভাব। খগেন বলে,—সেকি! ব্যাটা গবা এইসব করছে। এ্যা—নিজের দলের লোক তুমি, তোমাদের জমিতেই সাব্যস্ত করতে গেছে?

—হ্যাঁ। তাই করেছে। রেকর্ডেও নাকি নাম তুলেছে। রূপসী জানায় উত্তেজিত ভাবে।

খগেন উত্তেজিত রূপসীকে দেখেছে। এবার সে তার হাতেই আসবে পুরোপুরি। তাই খগেন ওর দিকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,—এতো উত্তেজিত হয়ো না। আরে আমিতো আছি। নাও এক পেগ নীট গলায় ঢেলে নাও, দেখবে মেজাজটা ঠাণ্ডা হবে। তারপর দেখা যাবে গবার দৌড়। নাও— সকাল থেকে সারাদিন মাঠে—সেই অফিসে, বাড়িতে কি তীব্র উত্তেজনার মধ্যে কেটেছে। রূপসীও ক্লান্ত-শ্রান্ত। কি ভেবে আজ মদটা গিলে ফেলে। তবু তৃষ্ণা মেটে না। খগেনও বুঝেছে সেটা। সে আবার এক গ্লাস মদ এগিয়ে দেয় রূপসীর দিকে। পুরো মদটাই গিলেছে রূপসী আজ, খগেনও যে তাকে এইভাবেই চেয়েছিল। সেও আবার মদ এগিয়ে দেয় রূপসীর দিকে।

খগেন জানে কি করে অন্যের সর্বস্ব দখল করতে হয়। এতদিন ধরে সে চারই ফেলেছিল। আজ রূপসীর মতো পাকা রুইমাছকে চারে টেনে এনেছে সে। রূপসীর মনে আজ এতদিনের অতল শূন্যতার জ্বালাটাই ফুটে উঠেছে। এতগুলো বছর ধরে নিজ পথে চেষ্টা করে নিজের জন্য কিছুই করতে পারেনি। তার চিরন্তন নারী মনের নিজস্ব কোন চাহিদার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সেই নিঃস্বতার বেদনার সুর মাঝে মাঝে তার মনকে বিষাদে আচ্ছন্ন করে। সেই দুঃখকে ভোলার জন্যই আজ যেন মদই গিলে বেহুঁশ হতে চায় সে। আর খগেনও সেই সুযোগটা আজ নিতে চায়।

দেখছে ক্রমশঃ রূপসীর দেহটা অবশ হয়ে আসে। আর খগেনের সামনে শিকার নিজে থেকে এসে ধরা দিয়েছে আর লোভী খগেনও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। রাতের অন্ধকারে খগেন যেন একটা আদিম মানবে পরিণত হয়েছে। সেই পাশবসত্তা আজ প্রকট হয়ে উঠেছে খগেনের মধ্যে। রাত কত জানে না। রূপসীর অর্দ্ধ অচেতন দেহটা পড়ে আছে। খগেন বের হয়ে যায় বাগানবাড়ি থেকে। তখন চারিদিকে রাতের স্তব্ধতা নেমেছে। আজ সে বিজয়ী।

ভোরের দিকে চেতনা ফেরে। এবার বুঝেছে সে যে খগেনকে নিয়ে খেলতে এসে সেই খেলায় নিদারুণভাবে হেরে গেছে। তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খগেন তার সর্বনাশ করে গেছে। আজ রূপসীর মনে হয় ওই খগেন নিঁপুণভাবে তাকে জালে জড়িয়েছে এবং তাকে চরম অপমানই করেছে। আর তাদের পরিবারের সর্বনাশই করেছে। সব জমিজায়গাও প্রায় বেদখল করিয়ে জন- সাধারণের সামনে নিজের প্রতিষ্ঠাকে আরও কায়েম করেছে।

রূপসীর সারামন বিষিয়ে ওঠে। বার বার সে লোভী পুরুষের কাছে প্রতারিত হয়েছে। এত চেষ্টা করেও ওদের প্রতারণার কোন জবাবই দিতে পারেনি, তাই রূপসীও এবার মনে মনে আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

গোবিন্দ তখন বিশ্বনাথের সব জমির বর্গাদারী পেয়েছে খগেনের দয়ায়। এবার গ্রামে মিছিলও বের হয় মানুষের। এতদিন পর তারা এই জমি পেয়েছে। যেন তাদের বঞ্চনাই করা হয়েছিল। এতকাল ওইসব জমি না দিয়ে, খগেনবাবুই তাদের এই বঞ্চনার প্রতিবাদ করার সাহস দিয়ে দেশনেতার মহান কর্তব্য পালন করেছে। তাই খগেনকে আবীর মাখিয়ে মালা পরিয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে শোভাযাত্রা করে চলেছে বহু মানুষ।

সুকুমার তার দলও এই জবরদখলের কোন সোচ্চার প্রতিবাদ করতে পারেনি। তবু তারাও মিছিল করেছিল কিছু মানুষকে নিয়ে। বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত মানুষ ইচ্ছা থাকলেও ওই মিছিলে সামিল হতে পারেনি ওদের ভয়ে। কারণ খগেনবাবু অনেক শক্ত মনের লোক। ওদের বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বললে তার জমিও আর কাউকে দিয়ে বেদখল করিয়ে দেবে। না হয় তাদের জমিতে কাজ করার জন্য কোন শ্রমিকও পাবে না। মাঠের পাকা ধান মাড়াই পড়ে থাকবে, না হয় ধান পোঁতাই হবে না। তাই মিছিলেও লোক হয় না।

বিশ্বনাথ বলে, আর কি সর্বনাশ বাকী থাকলো সুকুমার? দেশে কি বাস করাও যাবে না?

সুকুমার এর জবাব দিতে পারে না। রূপসীও দেখছে এই বঞ্চনা। তার সর্বস্বই চলে গেছে। মান ইজ্জত, মুখের গ্রাসও। খগেনের মতো মানুষরাই আজ সমাজের উপরের তলার বসেছে। তাদের কাছে বারবার প্রতারিত হয়েছে রূপসী।

খগেন জানে ওদের সব ভাষাকেই সে স্তব্ধ করে দিতে পারে আর নিজের প্রতিষ্ঠা কায়েম রাখতে গেলে অন্যপক্ষকে মাথা তুলতে দেওয়াই উচিত নয়। এবার সে সুকুমারকেও উচিত শিক্ষা দেবে। ওর কণ্ঠরোধ করতে হবে যাতে খগেনের বিরুদ্ধে সারা এলাকায় একজনও কিছুমাত্র প্রতিবাদ করতে না সাহসী হয়।

রূপসীও যেন এবার হার মেনে সামান্য নিয়েই খুশী থাকতে চায়। চাকরিটা তবু করছে। রূপসীও মনে মনে ভেবেছে এবার তার মনের জ্বালার প্রকাশ সেও করবে না খগেনের কাছে। বরং এসব কিছু যেন মেনে নিয়েছে সে চাকরির জন্যই। সরকারী চাকরিটা তার দরকার। তখন ঘর বাঁধবে সুকুমারকে নিয়ে। সামান্য নিয়েই খুশী থাকবে সে।

সেই চাকরির জন্য খগেনকে তার দরকার। খগেনও এখন নিশ্চিন্ত হয়েছে। রূপসীও তার উপর সেই নির্মম পৈশাচিক ব্যবহারের জন্য প্রতিবাদও করেনি। সবকিছু মেনে নিয়েছে সহজভাবেই। খগেনের বিশ্বাসও অর্জন করেছে। খগেনও আশা দিয়েছে তার চাকরি হবেই। কিন্তু খগেন জানে সুকুমারকে হটাতে হবে। তাই বেশ সুন্দরভাবে ছকও করেছিল। আর তেমনি একটা সুযোগ তৈরি করে নেয়।

পঞ্চায়েত অফিসে হঠাৎ একরাতে ডাকাতি হয়ে যায়। পঞ্চায়েত ভবনটা এরাই তৈরি করেছিল গ্রামের বাইরে। রাতের পাহারাদারও থাকে। কিন্তু কারা রাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে পঞ্চায়েতের ক্যাশঘরের সিন্দুক ভেঙে প্রায় সত্তর হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। পুলিশও তদন্ত শুরু করে। আর পঞ্চায়েতের যাতায়াত সমেত সেই টাকা বের হয় সুকুমার-এর ঘর থেকে।

সুকুমারও অবাক হয়। অবশ্য তার ঘরে সকলের অবারিত দ্বার। দিনে রাতে অনেকেই আসে ঘরে তেমন কিছু নেই তাই সাবধান হবার কারণও ছিল না। সেই ঘরে খাটের ভাঙা টিনের বাক্সে ওই খাতাপত্র সমেত টাকাটাও পাওয়া যায়।

সুকুমার বলে,—এসবের কিছু জানি না। ঘর তো খোলা পড়ে থাকে। কেউ রেখেও যেতে পারে অনায়াসে। গ্রামের লোকজনও জুটে গেছে। ভিড় করেছে অনেকে। কেউ বলে,—সুকুমার একাজ করতে পারে না। নিশ্চই এসব কোন ষড়যন্ত্র। খগেনও এসে পড়ে। সে বলে—আমিও তাই ভাবছি, কিন্তু সুকুমার এমন কাজ করলো শেষকালে। ছিঃ ছিঃ।

খগেনও যেন বিশ্বাস করে এই ব্যাপারটা। রূপসীও এসেছে আজ সে দেখছে খগেনকে। সুকুমার বলে,—না এসব ষড়যন্ত্র।

কিন্তু পুলিশ টাকা সমেত সুকুমারকে থানায় নিয়ে গিয়ে সদরেই চালান করে। আর খগেনের দলই চারিদিকে খবরটা ছড়িয়ে দেয়। গ্রামের অনেকেই বিশ্বাস করে। খগেনবাবুও খুনী। তার প্রতিপক্ষকে এবার সে জালে ফেলেছে। এরপর এখানে তার বিপক্ষে কথা বলার কেউই থাকবে না।

বিশ্বনাথও এবার বুঝেছে তার ওই জমি গেছে সুকুমারের জন্যই। সুকুমারের আসল রূপটা সেও চিনেছে এবার। বিশ্বনাথও ভাবছে এবার খগেনের কাছেই আত্মসমর্পণ করবে। তবু যদি কিছু নিয়ে এখানে বাঁচা যায়। এতদিন সেই ভুলই করেছিল।

রূপসী সবই দেখেছে। সে কিন্তু এই অভিযোগ আদৌ বিশ্বাস করেনি। খগেন এখন নিশ্চিন্ত। এবার ভোটে সেইই জিতবে। কারণ কোন প্রতিপক্ষকেই সে রাখেনি। তাই তার সিংহাসন নিষ্কণ্টকই থাকবে। সেদিন সন্ধ্যার পর বাগান- বাড়িতে এসেছে খগেন। মনটাও বেশ খুশী। রূপসীর সরকারী চাকরি করে দিতে পেরেছে। তাই রূপসীও এখন অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। মেয়েটা আসার পর থেকে খগেনেরও প্রভূত উন্নতি হয়েছে।

রূপসী এবার যেন পায়ের তলে মাটি পেয়েছে। তার জন্য অবশ্য অনেক অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছে। এবার পোস্টিংও পেয়েছে সদরের ওদিকে কোন পঞ্চায়েত অফিসে।

খগেনই বলে,—এখন চাকরিটা নিয়ে নাও ওখানেই যাও। এখানে পোষ্ট খালি হবে সামনের জুলাইতে। তখন তোমাকে এখানে বদলি করিয়ে আনবে।

রূপসীও তাই মেনে নিয়েছে। এখন সে সেই দূরেই চাকরি নিয়ে রয়েছে। তবে মাঝে মাঝে গ্রামে আসে। আজ বেশ কিছু দিন পর এসেছে রূপসী। খগেনও খুশী। আজ রূপসী বাগানে আসবে নিশিবাসরে। তাই খগেন এখানে বিশেষ আয়োজন করেছে আর লোকজনদেরও ছুটি দিয়েছে যাতে তাদের অভিসার বেশ ভালোই জমে ওঠে।

বর্ষার রাত। রূপসীও একটা রাতের জন্য এসেছে এখানে। তার মনে পড়ে এতদিনের পুঞ্জীভূত জ্বালাটা। সুকুমারও জেলে। ক’মাস পর সে মুক্তি পাবে। রূপসী মাসে মাসে জেলেও যায় সুকুমারের সঙ্গে দেখা করতে। সুকুমারও ভাবেনি যে মিথ্যা চুরির দায়ে খগেন এইভাবে তার সর্বনাশ করবে।

—এত ভেঙে পড়ছ কেন? দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

—তবু এই অপমান, মিথ্যা কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। বলে সুকুমার।

রূপসী বলে,—আর আমি। আমি তো এত কলঙ্ক অপমান যন্ত্রণা সয়ে বেঁচে আছি। তবু বাঁচতে হবে সুকুমার। আবার নতুন করে বাঁচবো।

খগেন দেখছে রূপসীকে। রূপসীও আজ অভিসার করে সাজে। যেন নতুন করেই ধরা দিতে এসেছে রূপসী। এসেছে তার কৃতজ্ঞতা জানাতে। রূপসীই আজ নিজে মদের গ্লাস এগিয়ে দেয় খগেনের দিকে। নিজের গ্লাসেও মদ ঢালে।

খগেন বলে,—সত্যিই তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। সদরে চেষ্টা করছি যত শীঘ্রই পারি তোমাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

রূপসী সারা দেহ যৌবনের লহর তুলে বলে—ওসব তোমার মুখের কথা, কাজে তো দেখি না।

খগেন ওকে কাছে টেনে নেয়—না রূপসী। দেখবে মাস কয়েকের মধ্যে অর্ডার করাবোই। রূপসী আজ ওকে যেন নিজের শিকারে পরিণত করতে চায়। মদের গ্লাস এগিয়ে দেয়।

ক্রমশঃ খগেনের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসে। ওকে রূপসী দেখছে। তার সারা মনে সেই পুঞ্জীভূত জ্বালার প্রকাশ। এতদিন ধরে সে বঞ্চিত-অপমানিত হয়েছে ওদের মতো লোভী পুরুষদের হাতে। তাদের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে ওরা। সুকুমারকে আজ চরম অপবাদ দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। আর একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।

রূপসী আজ তারই জবাব দেবে। এবার মদের গ্লাসে সঙ্গে আনা তীব্র বিষটাই মিশিয়ে দেয়। হাত কাঁপে না রূপসীর। সেই বঞ্চনাই আজ তাকে এমন কঠিনভাবে জবাব দেবার শক্তি জুটিয়েছে। গ্লাসটা তুলে দেয় খগেনের হাতে। কম্পিত হাতে খগেন গিলছে সেই তীব্র বিষ। ক্রমশঃ তার দেহটা লুটিয়ে পড়ে।

রূপসী জানে সে আট-ঘাট বেঁধেই এসেছে। আজ ইচ্ছা করেই সে তার অফিসে নাইট-ডিউটি নিয়েছে। হাজিরা খাতায় ওই রাতে গিয়েই সই করে দেবে। আর গ্রামের কেউ তাকে এখানে দেখেনি। সে এখানে কয়েক ঘণ্টার জন্য এসেছে সেই সাক্ষ্য প্রমাণও নেই। সরকারী খাতায় সে এখন অফিসে কর্তব্যরত। বের হয়ে পড়ে রূপসী, সাইকেলে করে পাঁচ মাইল পথ গিয়ে মাঝরাতের ট্রেনে করে কটা ইষ্টিশন পার হয়ে নিজের অফিসেই গিয়ে ঢুকবে।

আজ তার মনে সাহস শক্তি এনেছে সেই দুর্বার জ্বালাটা। এতদিন সে আঘাত-অপমান বঞ্চনা সহ্য করেছে। কিন্তু সহ্যেরও একটা সীমা আছে। সেই সীমা পার হয়ে আজ একটা মেয়ে কঠিন দুঃসাহসী হয়েছে।

রাতের অন্ধকারে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ওই বৃষ্টি আর এলোমেলো হাওয়ার বুক চিরে বনের পথে রূপসী সাইকেল নিয়ে উধাও হয়। তার মনে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জাগে। সুকুমার-এর মুখটা ভেসে ওঠে তার সামনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রূপসী

রূপসী

রূপসী

আমি অবিবাহিত এবং অনাত্মীয় যুবক। একটি ছোট্ট বাড়ি বাড়া করিয়া থাকি এবং দালালি করি।

আমাকে বোধ হয় ভগবান দালাল করিয়াই পৃথিবীতে পাঠাইয়াছিলেন। পরের মাল পরের কাছে বিক্রয় করিয়া তাহারি ভিতর হইতে দুপয়সা লাভ করিয়া আমার একান্ত অদ্বৈতবাদী সংসার চলিত। নিজের বলিয়া কোনও দিন কোনও বস্তুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি নাই। পৃথিবীর সব জিনিসই আমার কাছে পরস্ব; শুধু দালালিটুকু আমার।

এরূপ জীবন যাত্রার একটা সুখ এই যে ভাবনা চিন্তা বড় একটা থাকে না। মানুষের সহিত যাহার সামাজিক বন্ধন নাই, শুধু টাকার বন্ধন, সে মুক্ত। আমিও ছিলাম মুক্ত। একেবারে ঋষিকল্প পুরুষ ছিলাম এমন কথা বলি না। এ জগতে সেরূপ লোক কজনই বা আছে? তবে ঋষি না হইয়াও যাহারা মুক্ত, যাহারা শরীরটাকে সুখ দিয়াও মনটাকে বন্ধনের জাল হইতে বাঁচাইয়া রাখে আমি ছিলাম তাহাদেরি একজন।

বছরখানেক পূর্বের কথা বলিতেছি। প্রতি রবিবারে একটি স্ত্রীলোক আমার বাড়িতে ভিক্ষা লইয়া যাইত। একদিন হঠাৎ চোখে পড়িয়া গেল। স্ত্রীলোকটির সর্বাঙ্গে বস্ত্রাবৃত; এমন কী মুখ পর্যন্ত পুরু কাপড়ের ঘোমটায় ঢাকা। পা ছাড়া শরীরের কোনও অংশ চোখে পড়ে না। কিন্তু কি অপূর্ব গতিভঙ্গি! পূর্ণ যৌবন না হইলে এরূপ দর্পিত অথচ সুমন্দ, উচ্ছল অথচ সংযত গতিভঙ্গি হয় না! পরিপক্ক ডালিম যেমন বস্ত্র বন্ধনের অন্তরালে থাকিয়াও নিজের পরিপূর্ণ শ্রীকে প্রস্ফুট করিবার চেষ্টা করে, তাহার প্রত্যেক অঙ্গসঞ্চালন যেন তাহার অবরুদ্ধ যৌবনের আভাস ইঙ্গিতে ব্যক্ত করিতেছিল।

আমি তাহাকে নিকটে ডাকিলাম। কাছে আসিলে তাহার ঘোমটার ভিতর একটা ব্যর্থ দৃষ্টি হানিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—তুমি প্রতি রবিবার আস? প্রশ্নটা নিতান্তই অর্থহীন; কিন্তু যখন ডাকিয়াছি তখন কিছু বলা চাইত।

সে ঘাড় নাড়িয়া প্রশ্নর উত্তর দিল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—তুমি একলা আস দেখতে পাই তোমার কী কেহ নেই?

সে ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিল—না নাই! কিন্তু তাহার মুখ দেখিবার চেষ্টা আমার সফল হইল না। ঘোমটা মুখ হইতে এক চুলও সরিল না।

আমি একটু ইতস্তত করিয়া বলিলাম—তোমার বয়স কাঁচা বলে বোধ হচ্ছে। তুমি আর দোরে দোরে ভিক্ষে করে বেড়িও না। যখন অভাব হবে আমার কাছে এসো। বলিয়া তাহার আঁচলের উপর চার আনা পয়সা দিলাম। সে পয়সা লইয়া চলিয়া গেল। আমার কথার ইঙ্গিত বুঝিল কিনা জানি না, কিন্তু তাহার অদৃশ্য দেহটা যেন অদম্য হাসির উচ্ছ্বাসে তরঙ্গায়িত হইতে হইতে দূরে চলিয়া গেল।

পরের রবিবারে সে আবার আসিল। আমি তাহাকে ঘরের ভিতর আসিতে বলিলাম, সে আসিল, দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল।

আমি বলিলাম—তুমি মুখ খোল না কেন?

কোনও জবাব নাই। সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

আমি তাহাকে কথা কহাইবার জন্য বলিলাম—তুমি কথা কও না কেন? বোবা বুঝি!

ঘোমটার ভিতর হইতে হাসির শব্দ আসিল। আমার সমস্ত অন্তরাত্মা সেই হাসির শব্দে তড়িৎপৃষ্টের মতো চমকিয়া উঠিল। কি মিষ্ট অথচ কি বিষাক্ত হাসি! স্বর্গের সুধা যেন নরকের অন্ধকারে পচিয়া পচিয়া বিষ হইয়া উঠিয়াছে! বুক শিহরিয়া উঠে কিন্তু শরীর পুলকিত হয়। আমি তাহার দিকে তাকাইয়া রহিলাম। এ কীরূপ ভিখারিণী?

তাহাকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া আমার চমক ভাঙিল। উঠিয়া তাহাকে আট আনা পয়সা দিলাম। শুধু বলিলাম–আবার এসো।

তারপর সমস্ত সপ্তাহ আমার মন একটা মোহে আচ্ছন্ন হইয়া রহিল। সেই হাসি! এত অল্প যেন একটি আঙুরের রস, এত তীব্র যেন সাপের ছোবল, এত গভীর যেন পাতাল ভেদ করিয়া উঠিয়াছে। এই অবগুণ্ঠনতার দেহই বা কিরূপ, তাহার অন্তঃকরণই বা কেমন! সবই যেন যবনিকার অন্তরালে রহিয়াছে! আমার মুগ্ধ ইন্দ্রিয়গুলা তাহার অন্তর বাহিরের আবরণ উদঘাটন করিয়া দেখিবার জন্য অনুক্ষণ উন্মুখ হইয়া রহিল।

রবিবারে পূর্ববৎ সে দেখা দিল। আমি তাহার প্রত্যাশাতেই বসিয়া ছিলাম। একসঙ্গে অনেকগুলা প্রশ্ন করিয়া ফেলিলাম—তুমি কে? কোথায় থাক! মুখ খোলো নাকথা কওনা কেন? ভিক্ষা কর কেন? আমার মনে হয় তুমি বাস্তবিক ভিকিরি নও—চিরদিন এমন ছিলে না।

সে চুপ করিয়া রহিল।

আমি বলিলাম—আমার কথার জবাব দাও। এই সাত দিন আমি তোমার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবিনি।

আমার কথা শুনে আপনার কী হবে?

তাহার কথা না কহাটা আমার এতই অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল যে এই কথাগুলা ধাক্কার মতো আমার বুকে আসিয়া লাগিল। কিছুক্ষণ অভিভূত থাকিয়া বলিলাম—কী সুন্দর গলা। তুমি কী কণ্ঠস্বর লুকোবার জন্যেই চুপ করে থাক!

হ্যাঁ।

কেন?

শুনে আপনার লাভ কি?

আমি বলিলাম—ও কথা থাক। তুমি মুখ খোল—আমি দেখি।

বস্ত্রান্তরাল হইতে উত্তর আসিল—কেন?

আমি হাসিলাম—কেন আবার! মেয়ে মানুষের মুখ লোকে দেখতে চায় কেন,ভাল লাগে বলে।

আমার মুখ আপনার ভাল লাগবে না।

সে আমি বুঝব। তোমার রূপ কী কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পার? ভরা কলসীর মতো চলতে গেলেই যে চকে ওঠে!

সত্যি? কথাটার আনুসঙ্গিক যে ভঙ্গি ও অধর কুঞ্চন বস্ত্রের মধ্যেই লুকাইয়া রহিল তাহা মনের মধ্যে অনুভব করিলাম। আমি দালাল, জিনিস চিনি। বুঝিলাম এ নারী রসিকা। আরও বুঝিলাম এ সত্যকার ভিখারিণী নয়—এত সুনিপুণ বাক্যভঙ্গি আজন্ম ভিখারিণীর হয় না। কৌতূহল এবং আকর্ষণ দুই-ই বাড়িতে লাগিল। বলিলাম—রূপ লুকিয়ে রাখবার জিনিস নয়।

সে কথার কোনও জবাব না দিয়া সে বলিল—আজ উঠি।

আমি তাহাকে একটা টাকা দিয়া বলিলাম—অন্তত তোমার নাম কি বল।

রূপসী বলিয়া সে দ্রুতবেগে চলিয়া গেল। দূর হইতে সেই তীব্র তিক্ত চাপাহাসি আবার শুনিতে পাইলাম।

যাহা ভাল করিয়া বুঝিতে পারি না তাহার একটা দুর্দমনীয় আকর্ষণ আছে; তাহার উপর আমার আর একটা টান ছিল—ওই অবগুণ্ঠিতার যৌবন। কথায়, কণ্ঠস্বরে, অঙ্গভঙ্গিমায় যেটুকু পাইয়াছিলাম তাহাতে আমার তৃষ্ণা আরও বাড়িয়া গিয়াছিল। নারীর যৌবন ও রূপ এতদিন আমার কাছে কেবল ক্ষণকালের উপভোগের বস্তু ছিল— বিশেষের প্রতি আমার কোনও পক্ষপাত ছিল না। কিন্তু এই নারী আমাকে আমার সমস্তটাকে—সর্বাঙ্গ দিয়া টানিতেছিল। আমি স্থির করিলাম এবার আসিলে তাহাকে আমি মুখ খুলিয়া দেখিব—তাহাকে—যাক, আমার মনের সঙ্কল্প শুনিয়া পাঠকের কাজ নাই।

রবিবার যখন সে আসিল তখন প্রথম চোখে পড়িল তাহার মুখের উপর ঘোমটার এক জায়গায় একটু রক্ত শুকাইয়া আছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—ওকি, রক্ত কিসের। ক্ষণকালের জন্য সে যেন ত্রস্ত হইয়া উঠিল। তারপর স্থির হইয়া বলিল—ও কিছু নয়।

আমার অসংযত মনটা তাহাকে লইয়া একটা উচ্ছুঙ্খল কাণ্ড বাধাইবার জন্য ক্ষুধিত শ্বাপদের মতো ভিতরে ভিতরে গর্জন করিতেছিল। কিন্তু আমি তাহাকে সবলে সংযত করিয়া আস্তে আস্তে আরম্ভ করিলাম— দেখ রূপসী, আমি কদিন থেকে ভাবছি যে তোমাকে একটা প্রস্তাব করব।

সে বলিল—কী প্রস্তাব, বলুন। কথার মধ্যে বোধ হয় একটা নিগূঢ় ব্যঙ্গ ছিল যাহার অর্থ–তুমি যা প্রস্তাব করিবে আমি জানি। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে তখন তরল আগুন ছুটাছুটি করিতেছিল। আমি বলিলাম—তার আগে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। তোমার কি আত্মীয়-স্বজন বাপ ভাই কেউ নেই?

রূপসী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পরে বলিল—আছে।

আমি বলিলাম—তবে তোমার এ দশা কেন? তুমি তো ছোটলোকের মেয়ে নও।

সে বলিল—না। কিন্তু বাপ ভাই থাকতেও কী করে মেয়ে মানুষের এদশা হয় আপনি জানেন না?

আমি সাগ্রহে বলিলাম—বেরিয়ে এসেছ?

সে অস্বাভাবিক কণ্ঠে বলিল—চার বৎসর স্বামীর ঘর করার পর আমি বিধবা হই। বিধবা হবার দুমাস পরে একজন মুসলমানের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। আবার সেই হাসি–তিক্ত মধুর; আমার বক্ষের মধ্যে মদের মতো ফেনাইয়া উঠিতে লাগিল।

আমি গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বলিলাম—তবে আর কোনও কথা নেই। তুমি আমার কাছে থাকবে?

সে বলিল—আমাকে একবার দেখবেন না!

আমি দুহাত বাড়াইয়া তাহার দিকে অগ্রসর হইলাম।

সে দ্রুত সরিয়া গিয়া বলিল-আমাকে ছোঁবেন না। আগে দেখুন—এই বলিয়া ঘোমটা সরাইয়া মুখ খুলিয়া দাঁড়াইল!

অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ তীব্র আলো জ্বলিয়া উঠিলে মানুষের চোখ যেমন ধাঁধিয়া যায় আমারও তাহাই হইল। তারপর চক্ষু পরিষ্কার হইলে দেখিলাম,—মুখ নয়, মুখের পরিবর্তে একটা রক্তাক্ত দগদগে ঘা! সে মুখ কখনও সুন্দর ছিল কিনা বুঝিবার কোনও উপায় নাই। চক্ষুর নিম্নের মাংস পচিয়া খসিয়া গিয়াছে, যেখানে নাক ছিল সেখানে কেবল একটা গভীর রক্তবর্ণ গহ্বর; ঠোঁট দুটা ফুলিয়া অত্যন্ত পুরু এবং শ্বেত হইয়া উঠিয়াছে। গালে ও কপালে রক্তমুখ ব্রণ ফুটিয়া ঘা হইবার অপেক্ষায় আছে। এই জীবন্ত বিভীষিকাকে দেখিয়া আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম——কুষ্ঠ-কুষ্ঠ-কুষ্ঠ—আর কোনও কথা মুখ দিয়া বাহির হইল না। তারপর শরীরের সমস্ত স্নায়ুগুলা যেন শিথিল হইয়া গেল, আমি মুখ ঢাকিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলাম। সেই অবস্থায় অর্ধমূৰ্ছিত ভাবে শুনিলাম—কেমন? চান আমাকে?

আমি মুখ তুলিলাম না—শুধু তাহার তীব্র সূচ্যগ্র সূক্ষ্ম হাসি আমার সর্বাঙ্গে বিঁধিতে লাগিল।

১৩৩৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *