রূপসি ভূত

রূপসি ভূত

আমাদের কল্যাণপুর গ্রামে ভূতের সংখ্যা ছিল খুব বেশি। যেমন এক-একটা রাজ্যে জনসংখ্যা কম হয়, আবার এক-একটা রাজ্যে বেশি। তেমনি আমাদের গ্রামে মানুষের চেয়ে ভূতের সংখ্যা বেশি ছিল বলে আমাদের গ্রামের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ভূতগ্রাম’। আমরা ছোটোরা এর প্রকৃত কারণ জানতাম না। জানতে চাইওনি কোনোদিন। শুধু ভূতের ভয় পাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। সন্ধ্যে বেলা পাশের ঘর থেকে বই আনতে গিয়ে অন্ধকারে জানলার গ্রিল ধরে ভূতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। বৃষ্টির সন্ধ্যেবেলা এক-একদিন রান্নাঘর থেকে তালের বড়ার গন্ধে যখন নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না, তখন বৈঠকখানা থেকে রান্নাঘরে যেতে গিয়ে ভূতের মুখোমুখি হয়ে যেতাম। সন্ধ্যের মুখে মাঠ থেকে খেলার পর বাড়ি ফেরার পথ আগলে নিমতলায় অনেকবারই ভূতকে লম্বা পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।

এরপর আর দন্ডপাটদের পোড়ো বাড়িতে ঘটা করে ভূত দেখতে যাওয়া আমাদের সাহসে কুলোত না। আমরা কখনো সেরকম পরিকল্পনা নিইওনি কোনোদিন। ক্লাস সেভেনে উঠেই নাকি আমাদের পাড়ার নীলমাধব নিজের চোখে ভূত দেখে ফেলেছে দন্ডপাটদের পোড়ো বাড়িতে। আর আমরা এখানে-ওখানে যত ভূত দেখেছি, সেসব নাকি মিথ্যে। সেগুলোর কোনোটাই নাকি ভূত নয়। কোনটা সত্যি ভূত আর কোনটা মিথ্যে ভূত এই নিয়ে নীলমাধবের সঙ্গে আমাদের বিস্তর তর্ক হত। সে-তর্ক এক-একদিন রাগারাগিতেও গড়াত। পাঁচদিন এক নাগাড়ে কথা বলাবলি পর্যন্ত বন্ধ থাকত।

কেউ কেউ দন্ডপাটদের পোড়ো বাড়িতে ভূত দেখতে যেত অমাবস্যা রাতে। কিন্তু পূর্ণিমা রাতে নাকি একা বিধুকাকাই ওখানে ভূত দেখতে যেত। যেসব ভূত দেখতে ভালো, তারা নাকি জ্যোৎস্না রাত ছাড়া বেরোত না। এসব বিধুকাকার মুখ থেকে শোনা।

অনেকদিন আমরা বিধুকাকাকে দেখতে পাইনি। একলা মানুষ বিধুকাকার খোঁজ পেলে খোঁজ, না পেলে না। বড়োদের কারও কিছু যায়-আসত না। তবে আমাদের কিন্তু বিধুকাকাকে না হলে চলত না। বিধুকাকা ছাড়া কে বা অমন করে আমাদের ভূতের গল্প বলবে?

আর সত্যি কথা বলতে, ভূতের গল্প সে-ই তো বলতে পারবে ভালো যে নিজের চোখে ভূত দেখেছে। বড়োরা বলেন, বিধুকাকার নাকি সারাজীবন ভূত নিয়েই কারবার। অনেকের মুখে মুখে ফেরে, বিধুকাকার নাকি ভূত নিয়ে ঢালাও ব্যাবসা আছে। সত্যি কি মিথ্যে আমরা ছোটোরা জানি না। তার হদিশ আমাদের পাওয়ার কথাও নয়। তবে তার ভূতের গল্প আমাদের কাছে ভীষণ প্রিয়।

সেদিন বিকেল বেলা হঠাৎ আমাদের মাঠে বিধুকাকা এসে হাজির। আমরা হইহই করে ঘিরে ধরলাম বিধুকাকাকে। অনেকদিন পর খেলার মাঠে আমরা গোল হয়ে ভূতের প্রকার-প্রভেদের গল্প শুনছি বিধুকাকার মুখ থেকে। বিকেল পড়ো পড়ো। তবু সেদিন খেলার দিকে কারও তেমন গরজ নেই।

বিধুকাকা বলল, ‘একদিন দন্ডপাটদের পোড়ো বাড়িতে জ্যোৎস্না রাতে একবার একটা রূপসি ভূতকে আমি নিজের চোখে দেখেছি।’

আমরা তাজ্জব, ভূত আবার রূপসি হয় নাকি? অহীন্দ্র বলল, ‘বিধুকাকা, ভূত দেখতে ভালো হয় বলে তো কখনো শুনিনি। তায় তুমি বলছ, রূপসি?’

বিধুকাকার কারণে-অকারণে হেঁচকি উঠত। লোকে বলে, বিধুকাকা যখন বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প বলে, তখনই নাকি বেশি বেশি হেঁচকি ওঠে।

খিঁচ করে একটা হেঁচকি উঠল বিধুকাকার। সেটা সামলে নিয়ে বিধুকাকা বলল, ‘কে বলেছে ভূত দেখতে খারাপ? কোনো ভূতই দেখতে খারাপ হয় না, এই আমি তোদের বলে রাখলাম। তো সে রূপসিই শুধু নয় রে, একেবারে যেন উর্বশী।’

আমরা কেউ কখনো উর্বশীকে দেখিনি। দেখবই বা কী করে? তিনি তো স্বর্গের মানুষ। আমরা তো কেউ কখনো স্বর্গে যাইনি।

ঠাকুমা একদিন বলেছিল, যে ভালো কাজ করে আর সবসময় সত্যি কথা বলে, একটাও মিথ্যে কথা বলে না, সে নাকি স্বর্গে যায়। আমি ঠাকুরমার মুখে একথা শুনে ঠিক করেছিলাম, চেষ্টা করব স্বর্গে যাওয়ার। কিন্তু এর মধ্যে দিদির কাছে পড়তে বসে হোমটাস্ক নিয়ে দু-দিন মিথ্যে কথা বলে ফেলেছি। সেই থেকে ও কাজ আমার দ্বারা যে হবে না, সে আমি স্থিরভাবে জেনে গেছি।

এমনকী, যে অয়ন তার বাবা-মার সঙ্গে আজ হিল্লি-দিল্লি তো কাল টোকিও-হনুলুলু ঘুরে বেড়ায়, সেও কখনো স্বর্গে বেড়াতে গেছে, বলেনি। দাদু একদিন মহাভারতের গল্প বলছিলেন। তখন বলেছিলেন, ‘উর্বশী হলেন স্বর্গের একজন অপ্সরা। নারায়ণের ঊরু থেকে জন্ম হয়েছে বলে তাঁর নাম উর্বশী।’

উর্বশী যে দেখতে কতখানি সুন্দরী ছিলেন, দাদু সেকথা তো বলেননি। তাই আমরা আন্দাজ করতে পারলাম না, জ্যোৎস্না রাতে বিধুকাকার দেখা ভূতটা কতখানি রূপসি। তবে আমাদের পাড়ায় মনোহরজেঠুর মেয়ে শতদ্রুদিদি খুব সুন্দরী। সকলে তাকে দেখে বলে অপ্সরার মতো দেখতে। সেরকমই হবে হয়তো!

দেবাঞ্জন আমাদের মধ্যে বেশ সাহসী। সে ভূতকে ভূত বলে গ্রাহ্যই করে না। বলে, ‘ওসব মিথ্যে। মানুষের যত সব কল্পনা।’

সে বলল, ‘বিধুকাকা, সেই রূপসি ভূতটা একটা ঝাঁকড়া গাছ থেকে শোঁ শোঁ করে তোমার সামনে নেমে এল তো? নাকি ভূতটা পোড়ো বাড়ির ছাদে তার লম্বা পা ঝুলিয়ে বসে ছিল?’

বিধুকাকা সে-প্রসঙ্গে না গিয়ে বলল, ‘তুই কখনো ভূতের পা দেখেছিস? বড়ো বড়ো কথা বলছিস? ভূত যদি কলকাতার শহিদমিনারে উঠে বসে, তা হলে তার পা চলে যায় হাওড়া ব্রিজের মাথায়, তা জানিস?’

দেবাঞ্জন অমনি দু-দিকে ঘাড় নেড়ে না বলল। ওর দেখাদেখি ঘাড় নেড়ে আমরাও না বললাম।

আমরা কল্যাণপুর গ্রামের ছেলে। কখনো কলকাতা যাইনি। শহিদমিনারও দেখিনি। তবে হাওড়া ব্রিজের ছবি আমাদের এক্সারসাইজ খাতার পিছন দিকে আছে। দেখেছি। কিন্তু তা দিয়ে ভূতের পায়ের দৈর্ঘ্য আন্দাজ করা সিঁড়িভাঙা অঙ্কের চেয়েও কঠিন।

ভূত সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা দেখে খুশি হল বিধুকাকা। ফের একবার হেঁচকি উঠল তার। আমরা মনে মনে ধরে নিলাম, এবার বিধুকাকা ভূত নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে নিশ্চয়ই কিছু বলবে।

বিধুকাকা বলল, ‘সেই রূপসি ভূতটার জ্যোৎস্নার মতো গায়ের রং। দুগগা প্রতিমার মতো মুখ। কী টানাটানা দুটো চোখ। গায়ে কত মণিমুক্তোর গয়না।’

আমি বললাম, ‘বিধুকাকা, তুমি যা বলছ, এ তো ঠাকুরমার মুখে শোনা রূপকথার গল্পের রাজকন্যে গো?’

বিধুকাকা একটু কেশে নিয়ে বলল, ‘রূপকথার রাজকন্যেকে কি কেউ কোনোদিন চোখে দেখেছে? তবে যে তুই বলছিস? ওসব যারা বই লেখে, তাদের মনের কথা। কিন্তু এই রূপসি ভূত আমার নিজের চোখে দেখা।’

দেবেশ বলল, ‘কাউকে ভূতে ধরলে, তুমি নাকি ভূত তাড়ানোরও মন্ত্র জানো?’

বিধুকাকা বেশ খানিকটা হেসে নিয়ে বলল, ‘ওরে, ভূতকে তাড়াব কেন রে? ভূত তো কখনো কারও ক্ষতি করেছে বলে শুনিনি। ভূত তাড়ানোর নয় রে, আমি ভূত-আবাহন মন্ত্র জানি।’

আমি বললাম, ‘বিধুকাকা, ‘আবাহন’ মানে তো ডাকা? তুমি ভূতকে ডাকতে পারো? মানে, তুমি ডাকলে ভূত চলে আসে? তা হলে সেই রূপসি ভূতটাকে একবার আনিয়ে আমাদের দেখাও না।’

চোখ নাচিয়ে বিধুকাকা বলল, ‘তা আসে বই কী, খুব আসে। এই তো তিন মাস আমি ভূতগ্রামে ছিলাম না। আমি গিয়েছিলাম ভূতখালির চরে।’

দেবাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, ‘সেটা কোথায় বিধুকাকা?’

বিধুকাকা দু-দিকে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘সে কোথায়, বললে তোরা তার কী বুঝবি? তোদের তো আবার ভূগোলের জ্ঞান ভীষণ কম।’

দেবাঞ্জন বলল, ‘না বিধুকাকা, আমি এবারে পরীক্ষায় ভূগোলে বিরাশি পেয়েছি।’

আমিও তো এবার ভূগোলে তেষট্টি পেয়েছি। বিরাশির চেয়ে কম বটে, তবে বাবা বলেছেন, ভূগোলে আমার জ্ঞান নাকি খারাপ নয়। তবু চুপ করে রইলাম আমি।

বিধুকাকা বলল, ‘ভূতখালির চর যেতে হয় পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে ঝাড়খন্ড, তারপর উত্তরাখন্ড পেরিয়ে তিনটে বড়ো বড়ো বন, ছোটো-বড়ো পাঁচটা নদী পেরিয়ে একটা গলাখাঁকারির মাঠ পেরিয়ে তবে ভূতখালির চর। সেখানে যেতে হলে প্রাণ বেরিয়ে যায়।’

আমি বললাম, ‘তবে অত কষ্ট করে তুমি সেখানে গেলে কেন? কোনো জরুরি কাজ ছিল কি?’

‘খবর পেলাম, সেখানে ভূতেরা নাকি মহাসমস্যায় পড়েছে। ভূতেদের কোনো সমস্যা শুনলে আমি তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারি না।’

দেবেশ জিজ্ঞেস করল, ‘কী সমস্যা বিধুকাকা?’

‘তারা আমাদের ভূতগ্রামে চলে আসতে চায়। সেখানে নাকি তাদের থাকতে মন আর চাইছে না।’

আমি বললাম, ‘সে কী গো বিধুকাকা? এমনি তো আমাদের গ্রামে মানুষের চেয়ে ভূতের সংখ্যা নাকি বেশি। তার উপর আরও ভূত এলে তখন তো গ্রামে থাকাই দায় হবে?’

দেবাঞ্জন বলল, ‘তুমি কী করলে বিধুকাকা?’

বিধুকাকা বলল, ‘এর আগে আর একবার সুমন্তপুরের ভূতেরা আবদার জুড়ল, তারা সব আমাদের গ্রামে চলে আসবে। আমি দিলাম ব্যবস্থা করে। তাই তো আমাদের গ্রামে মানুষের চেয়ে ভূতের সংখ্যা বেড়ে গেল।’

আমি বললাম, ‘তাই তো আমরা অত ভূতের ভয় পাই। আমাদের গ্রামে তাদের আসতে দাওনি তো?’

বিধুকাকা ঘাড় দুলিয়ে বলল, ‘তা অবশ্য দিইনি।’

আজ যে পূর্ণিমা সেকথা আমরা জানতামই না। গল্পে গল্পে কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। হঠাৎ দেখলাম, পুব আকাশ জুড়ে রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে।

দেবেশ বলল, ‘ওই দ্যাখো বিধুকাকা, আজ কেমন জ্যোৎস্না উঠেছে। আজ একবার তোমার রূপসি ভূতকে আনো না, আমরা দেখি। তুমি তো বললে, তুমি ডাকলে নাকি ভূত আসে।’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ বিধুকাকা, তোমার সেই ভূত-আবাহন মন্ত্রটা বলো না। আমরা আজ একবার অন্তত রূপসি ভূতকে দেখতে চাই।’

লোকে যেমন মাঝে মাঝে নিরুপায় হয়ে মহাফাঁপরে পড়ে যায়, এখন বিধুকাকার মুখটা দেখে আমার সেরকমই মনে হল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিধুকাকা বলল, ‘না, এখন রূপসি ভূতের হাতে অনেক কাজ। সে এখন আসতে পারবে বলে তো মনে হয় না। তবে তোরা যখন সত্যি রূপসি ভূতকে দেখতে চাইছিস, তখন দেখি চেষ্টা করে। তোরা ভয় পাবি না তো?’

দেবাঞ্জন বলল, ‘না ভয় পাব না।’

আমি আর দেবেশ চুপ করে গেলাম। এখন মনে হচ্ছে, অনেক মানুষই তো আইফেল টাওয়ার দেখেনি, স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখেনি। টেমস নদীর সেতু দেখেনি, মানস সরোবরে ব্রহ্মকমল দেখেনি। ভূত না দেখলে কী এমন ক্ষতি হবে জীবনে? অনেক মানুষই তো কখনো ভূত দেখেনি। তবে তাদেরই বা জীবন আটকে যাচ্ছে কোথায়? এমন সময় মাঠের পাশের নিমগাছে ঘূর্ণি ঝড়ের মতো একটা ঝড় উঠল বলে মনে হল। আর কোথাও কিছু নেই। যেন সাইক্লোন এসে ভর করেছে ওই নিমগাছটায়।

আমরা আরও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলাম সকলে। একটা বাদুড় নিমগাছটা থেকে প্রাণের ভয়ে উড়ে পালাল বলে মনে হল।

তক্ষুনি ওই নিমগাছের মগডালে এক লক্ষ পূর্ণিমার চাঁদ যেন ভিড় করল। গোটা চরাচর যেন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। নিমগাছের উপর থেকে কেউ যেন বলে উঠল, ‘তোমাকে যে এতদিন দেখা দিয়ে এলাম, এত কথা শিখিয়ে এলাম, তার কিচ্ছু কি মনে রাখোনি? একটা ভূত কখনো আর একটা ভূতের সামনে হাজির হয় না, একথা কি মনে নেই? তবে খামোকা ডেকে আনলে কেন?’

তক্ষুনি একটা জোরে ধুলো-ঘূর্ণি উঠল আমাদের সামনে। আর আমাদের কিচ্ছু মনে নেই।

সেদিন আমাদের বাড়ির লোক অনেকটা রাতে মাঠ থেকে অজ্ঞান অবস্থায় তিনজনকে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। আজও আমরা কেউ মনে করতে পারি না, অত পূর্ণিমার চাঁদ আর অমন ধুলো-ঘূর্ণির পর কী ঘটেছিল সেদিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *