রূপমঞ্জরীর বৈধব্য – 1757 – ত্রয়োদশ পর্ব

রূপমঞ্জরীর বৈধব্য – 1757 – ত্রয়োদশ পর্ব

1757 : ভারতেতিহাসের এক চিহ্নিত বৎসর।

নবাব আলিবর্দির এন্তেকাল হয়েছে। তাঁর গদিলোভী দামাদবর্গকে দৃঢ়হস্তে অবদলিত করে আলিবর্দির দৌহিত্র হয়ে উঠেছে বাঙলা-বিহার-উৎকলখণ্ডের মহান অধিপতি। ইতিমধ্যে কলকাতায় সসৈন্য অভিযান করে ইংরেজদের কুঠি লুটও করেছে। উচ্ছৃঙ্খল নব্যযুবক। তার নামে ইতিহাসের একতরফের পণ্ডিতবর্গ নানা কুৎসা রচনা করেছেন। তার কতখানি সত্য, কতখানি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শাসকদলের চাটুকারিতা তা নিয়ে ইতিপূর্বেই আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখন তার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। পলাশী প্রান্তরে অস্তমিত হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য! বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর অধিকার করেছে গদি। তার সাকরেদরা, ষড়যন্ত্রকারীরা-রাজবল্লভ, রাজদুর্লভ, কৃষ্ণচন্দ্রের দল, তাঁদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। সমকালীন প্রতিষ্ঠাবান ভূম্যধিকারীদের মধ্যে একমাত্র একজন—যিনি ষড়যন্ত্রে যোগদান করতে স্বীকৃতা হননি তিনি—রানি ভবানী। অমর্যাদার আশঙ্কায় তাঁর বিগতভর্তা পরমাসুন্দরী কন্যাটিকে নিয়ে বরানগর ত্যাগ করে কাশীবাসী হয়েছেন।

পলাশী যুদ্ধের শহিদদ্বয়ের সম্বন্ধে—একজন মুসলমান, একজন হিন্দু—ইতিহাস নীরব। মীরমদনের বিশেষ ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি, মোহনলাল সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য পেয়েছি তার উপর কথাসাহিত্য-অনুমোদিত চিত্র রচনা করে অন্যত্র তা লিপিবদ্ধ করেছি। * ফলে সে প্রসঙ্গও পুনরালোচনা নিষ্প্রয়োজন। সিরাজ সম্বন্ধে বোধকরি শেষ কথাটা বলে গেছেন পণ্ডিতপ্রবর ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় : ‘Siraj was more unfortunate than wicked!

[* দর্পণে প্রতিবিম্বিত কাঁটা]

আমরা বরং আমাদের পরিচিত পল্লীপ্রান্তে দৃকপাত করি। এই কয় বৎসরে সেখানেও বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। বাচস্পতিমশাই গঙ্গালাভ করেছেন। নন্দখুড়ো বাতব্যাধিতে বড়ই বিব্রত। তার পরিবর্তে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বড়খোকা এখন পঞ্চায়েতের অন্যতম প্রধান। যেমন দুর্গা গাঙ্গুলীর অবর্তমানে হয়েছেন কালিচরণ। তবে নন্দখুড়োর তো গঙ্গালাভ ঘটেনি। তাই নেপথ্যে অবস্থান করেও তিনি আজও কলকাঠি নাড়েন-যাতে সমাজে অনাচার প্রবেশ না করে।

তারাপ্রসন্ন যেন বজ্রাহত তালবৃক্ষ। গোঁফদাড়ি ক্ষৌরি করেন না। কাঁচাপাকা শ্মশ্রুতে তাঁকে আর চেনাই যায় না। তারাসুন্দরী শোকস্তব্ধা। সংসারের সব কাজ করে যান যন্ত্রচালিত পুত্তলিকার মতো। এ কয় বছরে কেউ তাঁকে হাসতে দেখেনি। তবে এসব তো অনেক পরের কথা। বিগত কয়েক বছরের বিবর্তনের চুম্বকসারটা বরং শুনিয়ে দিই :

শুভবিবাহের পরদিন অপরাহ্ণের পূর্বেই যাত্রা করল বর-কনে, যাতে গোধূলিলগ্নে ও বাড়িতে বধূবরণ সম্ভব হয়। কনেযাত্রার পূর্বে বড়বাড়ি সংক্রান্ত মর্মান্তিক সংবাদটা মামণিকে জানানো হয়নি। কান্নাকাটি, প্রণাম, আশীর্বাদের পালা মিটলে রূপমঞ্জরী গিয়ে বসল পালকিতে। শাঁখ বাজলো, হুলুধ্বনি শোনা গেল। ‘জয় দুর্গা’ বলে বরযাত্রীদল রওনা হয়ে গেল। রূপেন্দ্রনাথ জোড়হস্তে দাঁড়িয়ে আছেন গৃহদ্বারে। জীবন-শিবনাথরা বরযাত্রীদের অনুগামী হয়ে গ্রামসীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। পালকি নামল গ্রামছাড়া রাঙামাটির পথে।

হুহুম্-না, হুহুম্-না করে পালকি চলেছে। মামণির দু-চোখে বারে বারে নামছে জলের ধারা। কানাইয়ের মা ওকে ধমক দেয়—আর কাঁদিনি মা, চন্দনছাপ সব ধূয়ে গেল যে!

একই পালকিতে চলেছে কানাইয়ের মা। মুখোমুখি দুজন। কানাইয়ের-মা গাঙ্গুলীবাড়ির বহুদিনের দাসী। এটাই ছিল প্রথা। বালিকাবধূর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাত্রাকালে কনের বাড়ির কোন দাসী যেত সঙ্গে। তা রুপো বাঁড়ুজ্জের তো ও বালাই নেই, তাই কালিখুড়ো তাঁকে ধার দিয়েছেন তাঁর দাসীকে, আটদিনের জন্য। অষ্টমঙ্গলায় যখন ওরা ফিরে আসবে তখন দাসীও ফিরবে।

আজ থেকে দু-আড়াই শ বছর আগে এটাই ছিল সামাজিক প্রথা। সেটা যে ‘অষ্টমবর্ষে তু ভবেৎ গৌরী’র জমানা। এমন আরও কিছু নিয়মকানুন প্রচলিত ছিল। যেমন : ফুলশয্যা। সেটা অনুষ্ঠিত হত, তবে বিবাহের ছয়-সাত বছর পরে। অনিবার্য হেতুতে।

যে সাত রাত-দিন বালিকাবধূ নতুন বাড়িতে থাকত সেই বাপের বাড়ির দাসী শয়ন করত বালিকা বধূর সঙ্গে একই কক্ষে। মেঝেতে মাদুর বা কম্বল পেতে। দাসীটি যদি বৃদ্ধা বা রাত-অন্ধ হত তখন নববধূর দিদিশাশুড়ি জাতীয় কোনও বৃদ্ধা এসে বলতেন, ‘ও নাতবউ! আমারে তোমার সাথে টুক শুতি দিবা? আমার শোবার কুন ঠাঁই নাই গো’।

উদ্দেশ্যটি প্রাঞ্জল। বরের পক্ষে যদিও প্রাণ-জল নয়। এ ব্যবস্থা করা হত যাতে গভীর রাতে ‘চোরে-কামারে’ মুখোমুখি সাক্ষাৎ না হয়ে যায়। বধূটি বালিকা। ডাগর নয়। হয়তো বোধগম্যি হয়নি। কিন্তু আর একজন? তিনি যে দিবারাত্র ছোঁক ছোঁক করছেন সেটা কি ঠাম্মার নজরে পড়ে না?

তিনি তো আর রাত-অন্ধ নন!

রূপমঞ্জরী চলেছে দুল্কি চালে–হুম্‌ব্রো, হুম্‌ব্রো ছন্দে।

সে মর্মান্তিক আহতা হয়েছে শুভদার শম্বুকবৃত্তিতে। এমন শুভদিনে সে একবার এসে হাসিমুখে দাঁড়াতে পারল না? আন্তরবেদনাকে অন্তর্লীন রেখে? পরাজিত সেনাপতির মতো মুখ লুকিয়ে বসে রইল! কিসের পরাজয়? তার মঞ্জু তো স্বয়ম্বরা হবার সুযোগ পায়নি। তা পেলে কি এমনটা ঘটত? শুভদাকে তো লক্ষ্যভেদের অনুমতিই দেওয়া হল না। হাঁ-হাঁ করে সবাই রুখে উঠল : তুমি বারিন্দির!

মঞ্জুতো বলেনি ‘বারিন্দিরে বরিব না কভু!’

তবু শুভদার অনুপস্থিতির একটা যুক্তি আছে। যদিও তা অর্থহীন। কিন্তু জেঠিমা? পুঁটুপিসি? জ্যাঠামশাই? কেউ—কেউ এসে তাকে আশীর্বাদ করে গেলেন না!

পালকির পর্দার ফাঁক দিয়ে একজন অশ্বারোহীকে দেখা যাচ্ছে। সাদা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। যেন যুদ্ধজয় করে ফিরছে। লোকটার কিন্তু বিবেচনা আছে। বাসি-বিয়েতে তাকে প্রকাণ্ড নতুন কাঁসার থালায় পুষ্পান্ন দেওয়া হয়েছিল। সে খুব সাবধানে তার এক-চতুর্থাংশ এলাকায় অন্নব্যঞ্জন মেখে খেয়েছে। আহার্য-থালিকার তিন-চতুর্থাংশ অস্পর্শিত। সে অংশটা ঝকঝকে কাঁসার নতুন থালা। ও জানে যে, নববধূ জীবনে কখনো কারও উচ্ছিষ্টপাত্রে অন্নগ্রহণ করেনি; এটাই প্রথম। এই স্ত্রী-আচার সেই ঘৃণিত গৃহ্যসূত্রের ধারাবাহী : ‘ভুক্তেবাচ্ছিষ্টংবধৈব দদাৎ’ (আহারান্তে যা খেতে পারলে না তা এঁটোপাতায় রেখে দিও, স্ত্রী খেয়ে নেবে)। লোকাচার সৌম্যকেও মানতে হয়েছে, কিন্তু কী সুন্দরভাবে সেই কদর্যরীতিটা মেনেছে! কী নাম যেন ওর? সৌম্যসুন্দর?

সাতদিন ছিল শ্বশুরবাড়িতে। সবাই খুব আদর যত্ন করেছেন। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই একবাক্যে বলেছেন : ‘এমন ঘর-আলো করা নতুন বউ জীবনে দেখিনি’! একমাত্র বড়-জা ছাড়া সবাই নববধূর রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এই সাতদিনে অনেকের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় হয়েছে। সেই কিশোরটিকেও দেখেছে। তবে দূর থেকে। ঠিকই বলেছিলেন বাবামশাই। দৈর্ঘ্যের জন্যই ওকে একটু শীর্ণকায় লাগে। কিন্তু কণ্ঠস্বরটি মিষ্ট। একান্তে কোনদিন আলাপ হয়নি। একদিন দুপুরে দিদিশাশুড়ি তো তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলেন। বললেন, এই দ্যাখ নাত-বৌ, কারে ধরে এনেচি! এক নম্বর চোর! জানলার ফাঁক দে’ তোরে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে! কেনে দাদা? বৌড়া তো তোরই! দ্যাা চোকের আমিটিয়ে!

সৌম্যসুন্দর বলে, আহ্! কী অসভ্যতা করছ ঠাম্মা!

—অসব্যতা! আমি পিছন ফিরলিই তো চুচুক করে অরে চুমু খাবি!

—তোমার মুখে কোন আড় নেই?

কেমন করে জানলি দাদা? তুই কি আমার মুখে কোনদিন চুমু খেয়ে দেখেছিস্? আড় আছে, না নেই!

সৌম্যসুন্দর পালিয়ে বাঁচে। সেকালে ঠাম্মারা এই জাতীয় রঙ্গ-রসিকতাই করতেন। কেউ দোষ ধরত না। হাসত। আজকের দিনে হয় তো মনে হবে রসিকতাগুলো স্থূল!

অষ্টমঙ্গলার দিন ওরা সোঞাইমুখো যাত্রা করল একই সময়ে, অর্থাৎ অপরাহ্ণের অনেকটা পূর্বে। ছয় বেহারার কাঁধে ওরা দুজন; আর অশ্বপৃষ্ঠে বর। সোঞাই গাঁয়ের কাছাকাছি এসে অশ্বারোহী পাল্কি-বাহকদের কী যেন বলল। তারা সাবধানে মাটিতে নামিয়ে রাখল পালকিটা। সৌম্য পালকির দ্বারের কাছে অগ্রসর হয়ে এসে বলে। তোমরা ওই গাছতলায় গিয়ে একটু বিশ্রাম কর। আমার ঘোড়ার পায়ে একটা নাল্ আলগা হয়ে গেছে, একটু ঠুকে নিয়ে আসি।

কানাইয়ের-মা জানতে চায়, আপনার কাছে নাল ঠোকার যন্তর আছে তো জামাইদাদা?

—না, নাই। কিন্তু শম্ভু কাকার ছাপরাটা কাছেই। সেজন্যেই এখানে থেমেছি। শম্ভুকাকা জাতে কামার। ওঁর ঘরে যন্ত্র পাবই। বেশি দেরি হবে না। আমি যাব আর আসব। ভয় পেও না।

কানাইয়ের-মা রূপমঞ্জরীর হাতখানি ধরে তেঁতুল-বটের ছায়ায় এগিয়ে গেল। গাছের তলাটা বাঁধানো। তেলসিঁদুরের দাগও নজরে পড়ে। ওরা সেখানে গিয়ে প্রণাম করল। বসল বাঁধানো চাতালে। পালকি-বেহারার দল একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। সৌম্য ঘোড়ার লাগাম ধরে পদব্রজে এগিয়ে গেল একটা পর্ণকুটিরের দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল সে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে গতর নাড়ালো কানাইয়ের মা। না-বিইয়ে সে কানাইয়ের মা হয়নি। বুঝলো, জামাইদাদাকে এ সুযোগটা দেওয়া তার কর্তব্য। হয়তো ঘোড়ার পায়ের নাল মোটেই আল্গা হয়ে যায়নি। হয়তো জামাইদাদা একটু নিরিবিলির সুযোগ নিতেই এই অছিলার আশ্রয় নিয়েছে। আহারান্তে একটি মিঠে খিলি বাঙলা পান মুখে দিয়েছিল কানাইয়ের মা। আবার একটা ঠেসে দিল গালে। হেলতে দুলতে এগিয়ে গেল জোয়ান বেহারাগুলো যেখানে বসে আছে। ওর পানে-রাঙা ঠোঁট দেখে ওই মরদগুলো মুগ্ধ হয় কিনা সেটা দেখতে চায়।

রূপমঞ্জরী বলে, তুমি আবার কোথায় চললে, কানাইয়ের-মা?

কানাই-জননী পিচ করে পিক ফেলল। মুচকি হেসে জামাইবাবুর ভাষা অনুকরণ করে বললে, আমি যাব আর আসবো। ভয় পেওনি। আর ওই দ্যাখ জামাইদাদা আসতিছেন। দুটো মনের কথা কয়ে নাও না বাপু! এমন সুযোগ আর পাবা?

অশ্বটিকে একজন বেহারার জিম্মায় দিয়ে সৌম্য এগিয়ে এল। খুশি হল কানাইয়ের মায়ের বিবেচনায়। এসে বসল রূপমঞ্জরীর পাশে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে। বললে, এ কয়দিন তোমার খুব খারাপ লাগছিল, তাই না? বাবামশাইকে ছেড়ে কখনো তো থাকনি।

রূপমঞ্জরী অধোবদনে নীরবই রইল।

—কী? তুমি কথা বলছ না যে?

অস্ফুটে এবার বলে, খারাপ লাগবে কেন? সবাই আমায় কত আদরযত্ন করলেন!

—তুমি অনেক পুঁথি পড়েছ, তাই না মঞ্জু?

হঠাৎ চোখ তুলে তাকায়। বলে, আপনি আমাকে ও নামে ডাকবেন না।

সৌম্য একটু অবাক হল। বোধকরি আহতও।

বললে, কেন বল তো? ‘মঞ্জু’ তো ‘মঞ্জরীর’ সংক্ষিপ্ত রূপ, যেমন ‘মঞ্জরী’ হচ্ছে ‘রূপমঞ্জরী’র।

সে জন্য নয়। ‘মঞ্জু’ ছিল আমার মায়ের নাম। তাঁর পুরো নাম ছিল ‘কুসুমমঞ্জরী’।

বঙ্কিম হলে হয়তো এই সময়ে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে ধমক দিয়ে উঠতেন, “ও রূপমঞ্জরী! কী বলিলে? সেটাই কি আপত্তির মূল হেতু? না কি ও নামে ডাকিবার অধিকার আর কাহাকেও দিতে মন সরিতেছে না”?

তা এ অধম তো বঙ্কিমচন্দ্রের জমানার নয়। তাই তাকে নীরব থাকতে হচ্ছে।—সে ক্ষেত্রে তোমাকে যদি ‘রূপা’ নামে ডাকি?

—তা ডাকতে পারেন।

—তুমি আমাকে ‘আপনি’ করে কথা বলছ কেন? তোমার-আমার কী সম্পর্ক তা কি আটদিনেই ভুলে গেছ?

—আমি তো জানি সব স্ত্রীই স্বামীকে ‘আপনি’ বলে কথা বলেন!

—ভুল জান। সেটা প্রকাশ্যে। জনান্তিকে নয়।

রূপমঞ্জরী নিরুত্তর অধোবদনে বসে থাকে।

—কই বললে না? তোমার বাবা আমার বাবাকে বলেছিলেন তুমি তাঁর কাছে আয়ুর্বেদশাস্ত্র পড়। কাব্যগ্রন্থ পড়নি কিছু? অথবা মহাকাব্য?

—পড়েছি। মহাভারত অবশ্য পড়িনি এখনো

—কার কাব্যরচনা তোমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে?

অধোবদনেই বললে, কবি কালিদাসঃ শ্রেষ্ঠঃ!

সৌম্যসুন্দর উচ্ছ্বসিত। বলে, আশ্চর্য! আমারও তাই অভিমত। তুমি তাঁর সব পুঁথি পড়েছ?

—না। সব আর কোথায় পড়লাম? শুধু বিক্রমোর্বশীয়ম্, নলোদয়, মেঘদূতম্ আর কুমারসম্ভবম্।

—কুমারসম্ভবম্ও? কতটা? মানে কোন সর্গ পর্যন্ত?

রূপমঞ্জরী কৌতুক বোধ করে। বলে, আপনি কোন সর্গ পর্যন্ত পড়েছেন?

–এটা অন্যায় প্রতিপ্রশ্ন। আমি প্রথমে জানতে চেয়েছি।

—সবটা!

—সপ্তম সর্গের শেষ পর্যন্ত?

রূপমঞ্জরী তার কাজলকালো দু-চোখ মেলে কী যেন বুঝে নিতে চাইলো।

—কই বললে না? সপ্তম সর্গের শেষ পর্যন্ত?

—আপনি কি অতটাই পড়েছেন? তারপর পড়েননি? “পাণিপীড়নবিধেরনন্তরং শৈলরাজদুহিতুরং প্রতি….”

সৌম্যসুন্দর একথার জবাব দেবার সুযোগ পেল না। এগিয়ে এল কানাইয়ের মা। বললে, পাল্কি বেয়ারারা গা তুলতে বললে। ওদের তো আজই তিজলহাটি ফিরতে হবে।

সৌম্য তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। রূপমঞ্জরীর সঙ্গে তার আবার চোখাচোখি হয়ে যায়। দুজনেই হাসে। ঠোঁটের প্রান্তে নয়। চোখে-চোখে!

মাত্র তিনরাত্রি শ্বশুরবাড়িতে বাস করে তিজলহাটিতে প্রত্যাবর্তন করল সৌম্যসুন্দর। এ তিন রাত্রি রূপমঞ্জরী শয়ন করেছে শ্যামা আর মালতীর সঙ্গে। আর সৌম্যসুন্দর রূপেন্দ্রের শয়নকক্ষে।

প্রত্যাবর্তনের পূর্বে সৌম্যসুন্দর রূপেন্দ্রনাথকে বললে, আপনি আমার বাবামশাইকে বলেছিলেন আমাদের দ্বিরাগমন হবে চার বছর পরে। পিতৃদেব সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু আন্দাজ করছি আর দুই-এক বছরের ভিতরেই নদীয়ায় আমার শিক্ষা সমাপ্ত হয়ে যাবে। আমি আপনার কাছে অতঃপর অথর্ববেদ, আয়ুর্বেদ এবং চিকিৎসা-বিদ্যা শিক্ষা করতে ইচ্ছুক। এটা কী ভাবে সম্ভবপর হতে পারে?

—তুমি একটি শর্ত স্বীকার করে নিলেই। আমার দ্বার তোমার জন্য সদা উন্মুক্ত। যে কোনদিন তুমি এ ভদ্রাসনে আসতে পার।

আমিও মহাচার্য রামনাথপন্থী—গুরুদক্ষিণা গ্রহণ করি না। তোমার ক্ষেত্রে সে প্রসঙ্গ তো আদৌ ওঠে না। তুমি আমার একমাত্র জামাতা।

—কিন্তু শর্তটি কী?

—তুমি আমার ভিটেয় যে কোনদিন আসতে পার। আমরা যা আহার করি—তা তিন্তিড়ীপত্রের ব্যঞ্জন হলেও—গুরুশিষ্য ভাগ করে নেব। তোমরা দুজনেই-স্বামী- স্ত্রী—আমার কাছে, আয়ুর্বেদশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠ। দক্ষ হয়ে ওঠ—এটাই আমার মনোগত ইচ্ছা। তারপরে তুমি সেদিন যা বলেছিলে তাই হবে। অর্থাৎ তোমরা দুজনে তিজলহাটিতে একটি চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু শর্তটি হচ্ছে এই : যাবৎ দ্বিরাগমন তুমি রাত্রিবাস করবে সোঞাই আরোগ্যনিকেতনের অতিথিশালার একটি নির্দিষ্ট কক্ষে।

—আমি সানন্দে স্বীকৃত, বাবা! এ শর্ত তো প্রত্যাশিত!

*

দশ-দশটা দিন যেন পাহাড়ি ঝরনার মতো নাচতে নাচতে চলে গেল। কত অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল। ঘোষালবাড়ির আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী “এঁকে প্রণাম কর বৌমা, ইনি তোমার পিসাশ্বশুর, এঁকে পেন্নাম কর নাতবৌ, এ হল গে তোমার সেজ খুড়শ্বশুর, এনাকে দণ্ডবৎ কর, ইনি তোমার জেঠশাশুড়ি…” একের পর এক। সোঞাই গাঁয়ে ফিরে আসার পরেও তা চলেছে। ওখানে সবাই দেখতে আসতো নতুন বউ। এখানে নতুন-জামাই।

এই প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে ওর মনে পড়ত না যে, একটা প্রকাণ্ড ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। একেবারে যে পড়েনি তাও নয়। এ বাড়ি সে-বাড়ি থেকে এত লোক এল কিন্তু বড় বাড়ি থেকে তো কেউ একবারও এলেন না। মীনুর মা নতুন জামাইয়ের নাম করে পরমান্ন বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন, গাঙ্গুলীবাড়ির সেজখুড়িমা পাঠিয়েছেন গোকুলপিঠে। মায় নদীর ওপার থেকে একটা ঢাউস কুমড়ো ঘাড়ে করে এসে হাজির বায়েন-পল্লীর মাতব্বর পেল্লাদ বায়েন। তার গাছের পেরথম কুমড়োটা। ওর হাত ধরে এল একটি ফুটফুটে শ্যামলা ছেলে, মাজায় শুধু ঘুনসি বাঁধা। মালতীই দ্বার খুলে দিয়েছিল। পেল্লাদ সাষ্টাঙ্গে তাঁকে প্রণাম করে বললে, গাছের পেরথম ফলটা বাবা-ঠাউরের জন্যি নে-এলাম মা-জননী। শুনলাম জামাইবাবাজিও নাকি ভিন-গাঁ থিকে এয়েছেন।

মালতী জানতে চায়, এটি কি তোমার ছেলে? কী নাম?

প্রহ্লাদ বলে, না-মাঠান, এডা বেষ্টা-বায়েনের ব্যাটা বটে! বাবাঠাউরই তো এর পেরানডা দিলেন। নাম…

বাচ্চাটার পেটে একটা খোঁচা মেরে বলে, তর নামডো ক’।

শিশুটি বললে, গুপাল

—ওর বুঝি অসুখ করেছিল? কী অসুখ?

—না মাঠান। অর কিছু হয় নাই। অ তখনো জান্মায়ইনি! অর মা যমুনারে সবাই পোড়ায় মারতে চাইছিল। বাবাঠাউর না বাঁচলি এই ছ্যামডাও পুইড়ে মরত আজ্ঞে।

মালতী বলে, তোমরা দুজন কিছু প্রসাদ পেয়ে যেও।

ওর মনে হল, ওই অন্ত্যজ পরিবারের অবোধ বালক গোপাল আর তার নিজের শিশুকন্যা শ্যামামালতীর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। দুজনেই ঈশ্বরের দান এবং একবগ্গা-ঠাকুরপোর আশীর্বাদ।

রূপমঞ্জরী জানতে চায়নি কেমন করে এই অঘটনটা ঘটল। কেন ওরা সপরিবারে রূপমঞ্জরীর বিবাহকার্যটা বর্জন করলেন। বোধকরি তার অবচেতনে জন্ম নিয়েছিল এক তীব্র অভিমান। জেঠামশাই যদি মনে করে থাকেন বরযাত্রীদের জন্যে অতিথিশালা খুলে দেওয়াই যথেষ্ট, জেঠাইমা যদি ভেবে থাকেন ‘আইবুড়োভাতে ভরপেট তো খাইয়েই দিয়েছি, আবার কী চাই?’ অথবা পুঁটুপিসি যদি বলে, “ওমা! আমিই সেদিন তো ওর খোঁপা বেঁধে দিলাম। দিইনি? তাহলে মামণির কিছু বলার নেই। আর শুভদা? সে তো প্রেমদাস বাবাজির ধ্বংসস্তূপে ভাঙা আতস কাচ দেখেই মুগ্ধ! তার ঘোর বোধহয় এখনো কাটেনি। কিন্তু শুভদা কি একটা কথা ভেবে দেখেছে? ‘বসুধালিঙ্গন ধূসরস্তনী’ আতসকাচটা যখন দেখবে যে, মাঘের শেষে সূর্যদেব উত্তরায়ণের পথে যাত্রা করেছেন, তখন তার কী দশা হবে? তখন তো ওই ভাঙা ছাদের ফোকর দিয়ে সূর্যালোক ওর দিকে আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবে না? সূর্যাশীর্বাদবঞ্চিতা তখন কী করে পালন করবে তার স্বধর্ম? তারপর যদি নীরন্ধ্র অন্ধকারে কোন এক নতুন অতিথি মশালধারী রূপে এগিয়ে আসে? ভুলুণ্ঠিতা আতসকাচের দিকে? তখন সে কি সূর্যালোকের বিকল্প সেই মশালের আলোককে প্রতিফলিত করবে না?

আজ অপরাহ্ণে সৌম্যসুন্দর তিজলহাটিতে প্রত্যাবর্তন করবে। এ বাড়িতে আসার পর জনান্তিকে সাক্ষাতের সুযোগ ওদের একবারও আসেনি। হয়তো অনেক দিন দেখা হবে না। মামণির খুব ইচ্ছা করছিল ওর সঙ্গে আড়ালে দুটো কথা বলতে। আর কিছু নয়, দুটো অসংলগ্ন আলাপচারী। বাবামশাই ওকে নিয়ে দামোদরে স্নান করতে গেছেন। মামণি এঘর-ওঘর করছে তার সোনা-মার সন্ধানে। হঠাৎ নজরে পড়ে তিনি তাঁর ঘরেই আছেন। খোলা বাতায়নপথে তিনি কী যেন দেখছেন, জানলার দুটি গরাদ দৃঢ়মুষ্টিতে দু-হাতে ধরে, একেবারে তন্ময় হয়ে।

ঘরের বাইরে থেকে ডেকে ওঠে, কী দেখছো সোনা-মা?

দ্রুতহস্তে মালতী বাতায়নপথের কাঠের পাল্লাটা বন্ধ করে দেয়। বলে, কিছু না। আয় বোস। না, বরং ওঘরে চল।

দুরন্ত কৌতূহল হল মামনির। এগিয়ে এসে বলে, জানলাটা বন্ধ করে দিলেন কেন? কী দেখছিলেন এতক্ষণ?

—না, না! ওসব দেখতে নেই। ও একটা বিশ্রী ব্যাপার।

–বিশ্রী ব্যাপার? মানে? কী সেটা?

জোর করে জানলাটা খুলে দেয়।

মালতী দু-হাতে মুখ ঢেকে বলে, হয়েছে? কৌতূহল মিটেছে? বন্ধ করে দে এবার।

হ্যাঁ দেখেছে। চমকে উঠেছিল প্রথমে। এমন দৃশ্য সে আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু ওটা বিশ্রী হবে কেন? অশ্লীল হতে যাবে কী কারণে?

উদ্যানে দুটি বৃহদাকার না-মানুষ মেতেছে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে।

রূপেন্দ্রনাথের বাহন সৈনগুপ্ত হচ্ছে অশ্ব। আর সৌম্যসুন্দর যার পিঠে সওয়ার হয়ে অষ্টমঙ্গলায় এ বাড়ি এসেছে সেটি ঘোটকী! এতদিন দুজনেই পড়ে ছিল একা-একা। বৃহদারণ্যকের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার প্রসঙ্গেই বলেছেন :

 স বৈ নৈব রেমে তস্মাদেকাকী ন রমতে স দ্বিতীয়মৈচ্ছ‍ৎ।
স হৈতাবানাস যথা স্ত্রীপুমাংসৌ সংপরিম্বক্তৌ স ইমমেবাত্মানং
দ্বেধাপাতয়ত্ততঃ পতিশ্চ পত্নী চাভবতাং তস্মাদিদমধিবৃগলমিব
স্ব ইতি স্মাহ যাজ্ঞবল্ক্য মাদয়মাকাশঃ স্ত্রীয়া পূর্যত এব
তাং সমভবত্ততো মনুষ্যা অজায়ন্ত।”*

[* কিন্তু তিনি (ব্রহ্ম) আনন্দলাভ করিলেন না। কারণ একাকী থাকিয়া কেহই আনন্দলাভ করিতে পারে না। তিনি দ্বিতীয় সত্তায় রূপান্তরিত হইতে ইচ্ছা করিলেন। স্ত্রী ও পুরুষ আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় যে পরিমাণ (আনন্দিত) হয়, তিনি সেই পরিমাণ (আনন্দিত) হইলেন। তিনি স্বীয় সত্তাকে দ্বিধাবিভক্ত করিলেন। এইরূপে পতি ও পত্নী সৃষ্টি হইল। এজন্য যাজ্ঞবল্ক্য বলিতেছেন ‘প্রত্যেক পুরুষ স্বয়ং অসম্পূর্ণ। সেই শূন্যস্থান প্রকৃতি কর্তৃক পূর্ণ হয়।’ তিনি (ব্রহ্ম) স্বীয় পত্নী সত্তায় মৈথুনমাধ্যমে উপগত হইলেন। এইরূপে উৎপন্ন হইল মনুষ্যজাতি।]

মালতী জোর করে বন্ধ করে দিল পাল্লাটা। বলে, ওসব দেখতে নেই। সরে আয়। রূপমঞ্জরী অবাধ্য হয় না। সোনা-মাকে বৃহদারণ্যকের তত্ত্বকথা বেঝানোর চেষ্টা করে না। বলে না, মনুষ্যদৃষ্টিতে আপাত অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হলেও এটা একটা জাগতিক জৈবিক সত্য। এভাবেই সৃষ্টিকর্তা প্রাণীজগতকে প্রাণবন্ত করে রেখেছেন। কিন্তু তা-সত্ত্বেও একটা খটকা লাগে। সৈনগুপ্তের এ কী বিচিত্র রূপান্তর! সম্মুখের দুটি পা তুলে দিয়েছে গ্রামান্তরের ওই ঘোটকীর পৃষ্ঠদেশে! সৃষ্টিসুখের এ কী বিচিত্র উল্লাস! আর… আর… এ কী বিচিত্র বিস্ফারণ! মিলনমুহূর্তে কি মানুষেরও এমনটা হয়? ও জানে না। কপোত-কপোতীর কুক্কুট-কুক্কুটীর এ জাতীয় আচরণ সে ইতিপূর্বেও দেখেছে। কিন্তু এই উন্মাদ-স্ফীতি তো কখনো দেখেনি! আশ্চর্য! অষ্টম সর্গে তো এমন কথা নেই! ভারতচন্দ্রের অনাবিল বর্ণনাতেও তো সে কথা বলা হয়নি? এটাই কি তাহলে কাব্যের সীমারেখা? সাহিত্যের লক্ষ্মণগণ্ডী?

ওর সারা দেহ কণ্টকিত হয়ে উঠেছে। ললাটে ফুটে ওঠে স্বেদবিন্দু।

দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত। মধ্যাহ্ন আহারের পালা মিটেছে। এবার সৌম্যসুন্দর ফিরে যাবে। পাল্কি-বেহারার দল যথাবিহিত আপ্যায়িত হয়ে তিন দিন পূর্বেই প্রত্যাগমন করেছে। সৌম্যসুন্দর তার শ্বশুরকে প্রণাম করে দাওয়ায় বার হয়ে এল। প্রণাম করল সোনা-মাকে। তারপর ইতিউতি চাইতে থাকে। মালতী নির্বোধের অভিনয় করে বলে, কিছু কি খুঁজছ, বাবা?

—আজ্ঞে না। এবার তাহলে যাই?

—’যাই” বলতে নেই বাবা। বল : ‘আসি’। কিন্তু একটু অপেক্ষা কর। মামণিও যে তোমাকে একটা প্রণাম করবে। তাকে ডেকে দিই।

—ও!

মালতী ফিরে এল তার শয়নকক্ষে। শ্যামা পালঙ্কে ঘুমোচ্ছে। শান্তিপুরী লাল ডুরে শাড়ি পরে শ্যামার পাশে চুপচাপ বসে ছিল রূপমঞ্জরী। জানতে চায়, এবার কি আমি যাব? প্রণাম করতে?

—এ কী! তুই পানটা খাসনি?

মামণির হাতে ধরা আছে একটা মিঠেখিলি। আহারান্তে এটা তাকে দিয়েছিলেন তার সোনা-মা। ও বলে, আমি পান খাই না সোনা-মা! জীবনে খাইনি কখনো!

—এর আগে মাথায় কখনো ঘোমটা দিয়েছিস পোড়ারমুখি? সিঁথিতে সিঁদুর?

—ঠিক আছে বাপু! খাচ্ছি।—পানটা মুখে দিয়ে চিবোতে থাকে।

মালতী ওর চিবুকটা তুলে ধরে বলে, দেখি হ্যাঁ, এইবার ঠিক রাঙা হয়েছে! নতুন বৌকে পান খেতে হয় রে। বোস, আমি ওকে ডেকে দি’।

মালতী বাইরে যায়। সৌম্যকে বলে, আমার ঘরে যাও, বাবা। ও ওখানে অপেক্ষা করছে।

সৌম্য কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই মালতী নিষ্ক্রান্ত হল। দ্রুতহস্তে বাইরে থেকে শিকলটা তুলে দিল কবাটে। রূপমঞ্জরী চমকে ওঠে। কিন্তু কী বলবে? লাফিয়ে নেমে পড়ে পালঙ্ক থেকে। সৌম্য বলে, সোনা-মা বলেছেন, ‘যাই’ বলতে নেই। তাই বলি, ‘এবার আসি, রূপা?’

—একটু দাঁড়াও। আমি তোমাকে একটা প্রণাম করব!

—এই তো! জ্ঞানলাভ হয়েছে দেখছি!

—জ্ঞানলাভ?

—এতদিন তোমার ধারণা ছিল বরকে বউ ‘আপনি’ বলে। জনান্তিকেও। তাই বলছিলাম আর কি।

রূপমঞ্জরী কয়েকপদ অগ্রসর হয়ে আসে। নতজানু হবার উপক্রম করতেই সৌম্য ধরে ফেলে ওর দুই বাহুমূল। রূপমঞ্জরী একটু শিউরে ওঠে। বলে, কী?

—তুমি তো আমাকে ‘প্রণাম’ করবে। কিন্তু আমি কী করব?

নতনয়নে বালিকাবধূ বলে, আশীর্বাদ!

—ব্যস? এত কৃপণ কেন গো তুমি? আর কিছু পাব না? দেব না?

মাথার মধ্যে এমন টলমল করে উঠল কেন? অনভ্যস্ত পান-গুবাকের প্রভাবে? নাকি কালিদাস-ভবভূতির আশীর্বাদে প্রত্যাসন্ন অনুভূতিটার প্রত্যাশায়?

নতনয়নে কোনক্রমে বললে, জানি না! যাও!

—যাব’ তো বটেই! না, ‘যাব’ না, ‘আসব’। কিন্তু দখলদারীর পাঞ্জাছাপটা না দিয়ে যাওয়া কি উচিত? চার বছর তো আর দেখা হবে না।

ডুরে শাড়ি-পরা তার বালিকা বধূকে টেনে নিল বুকে। অনাঘ্রাতার নয়ন দুটি মুদ্রিত। সৌম্যসুন্দর ওর চিবুকের নিচে হাত দিয়ে নতদল শতদলকে করে দিল সূর্যমুখী। প্রত্যাশিত স্পর্শমাত্রে শিহরিত হয়ে উঠল কুসুমাত্মজা কুসুমকলির সর্বাবয়ব।

‘দুখানি অধর হতে কুসুম-চয়ন’
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে।
দুটি অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসর-শয়ন।।’

আমার কাহিনির নায়িকা তার নারীত্বের প্রথম স্বীকৃতি পেল।

‘প্রথম’? লিখতে আমার কলম সরছে না, দিদিভাই। আমি-কাহিনিকার হিসাবে যে জানি : এটা শুধু ‘প্রথম’ নয়, এটাই ‘শেষ’। মালিকা গাঁথার সুযোগ ও আর কোনদিন পাবে না। তাই মহাকবি ওই পংক্তিতে অনেক পরবর্তী কালে লিখেছিলেন “বুঝি”। কবি জানেন, সকলের সে সৌভাগ্য হয় না। মালা গাঁথার আগেই শুকিয়ে যায় অনেক ফুল! অনেকের ফুল!

বিশ বছর আগে ব্রজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি মাত্র পংক্তিকে পাথেয় করে যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম তখন পরমশ্রদ্ধেয়া হটী বিদ্যালঙ্কার ছিলেন আমার ঠাকুমার ঠাকুমার-এনএতমা বৃদ্ধ প্রপিতামহী! ভারতবর্ষের ‘ আধুনিক যুগে নারী-স্বাধীনতার প্রথম প্রবক্তা! শ্রদ্ধায় মাথা নত করে তাঁর কথা লিখে গিয়েছিলাম। তারপর কখন ধীরে ধীরে সব কিছু বদলে গেল। আমি টেরও পাইনি। পরমশ্রদ্ধেয়া জননী হয়ে উঠলেন আমার কন্যা। বুলবুল অথবা মৌয়ের মতো। সেই যখন ত্রিবেণীতে প্রাকৃতভাষে সে আমাকে অনুরোধ করেছিল তাদের গোল্লাছুট খেলায় ‘বুড়ি’ হতে। আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘তুমি এত বোকা কেন গো? আমি কি তোমারে খুখুনে জটিবুড়ি হতে বলিছি?’

তারপর কেটে গেছে আরও দশটা বছর। এখন এই অশীতিপর বৃদ্ধ লেখক যখন রূপমঞ্জরীর উপসংহার লিখতে বসল তখন তার চোখে ছানি, বার্ধক্যজনিত কারণে তার হাত কাঁপে। সে অবাকচোখে তাকিয়ে দেখল তার সেই নায়িকার দিকে। না! ‘কন্যা’ তো আর নয়! ও যে এতদিনে হয়ে গেছে আমার ‘নাতনি’। অন্তরার মতো, নীনার মতো! তাই আমি আজ কোন লজ্জায় ওকে বলি : ওরে হতভাগি! আজ এই যা পেলি এটাই তোর সারাজীবনের সঞ্চয়। যত্ন করে আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখ! এই পরশমণির স্পর্শ আর জীবনে দ্বিতীয়বার পাবিনারে। এই প্রথম, আর এই শেষ! আমি কী করব? আমার যে হাত-পা বাঁধা!

তবে হ্যাঁ, আমার ওই নাতনি তো হার মানবার মেয়ে নয়। সমাজ বালিকা-বয়সেই খুলে নেবে ওর লালরঙা ডুরে শাড়ি। পরিয়ে দেবে সাদা থান। রিঠে দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবে কিশোরী সীমন্তিনীর লাজে রাঙা সিন্দূরবিন্দু! তবু আমার নাতনি হার মানবে না—তাকে যে হতে হবে হটী বিদ্যালঙ্কার!

ও যে সেই উপনিষদের মন্ত্রে দীক্ষিতা : “তদ্বিজ্ঞানেন পরিপশ্যন্তি ধীরা আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি।*

[* বিশ্বসত্তাকে ধীর ব্যক্তি বিজ্ঞান এবং পরাবিদ্যার মাধ্যমে শুধু আনন্দরূপে নয়, অমৃতরূপেও আস্বাদনে সমর্থ। মুণ্ডকোপনিষৎ।।২।৭]

তুই ধীরা, তুই বিজ্ঞানী, পরাবিদ্যা তোর আয়ত্তাধীন! আনন্দ আর অমৃত তোর কাছে সমার্থক। আনন্দস্বরূপকে যে জেনেছে তাকে তো অপমানে দলিত-মথিত করা যায় না! কাশীনরেশের পাশবিক অত্যাচার থেকে—হ্যাঁ রে দিদিভাই, তুই দেখে নিস আমার কলমটা আপ্রাণ চেষ্টা করবে তোকে বাঁচাতে—কিন্তু যদি সে ব্যর্থ হয়? তবু তোর আত্মাকে সে পাষণ্ড স্পর্শ করতে পারবে না। তোর আনন্দ যে অবিনশ্বর! পাশব বলাৎকারে তোর দেহটার মৃত্যু হতে পারে? কিন্তু আত্মার?

সুখ আর দুঃখ। আনন্দ আর বেদনা। ক্রমাগত চক্রাবর্তন। অপরাহ্ণে হয়েছিল পরম অমৃতলাভ। মাত্র দুদণ্ড পরেই চরম আঘাত!

গোধূলি অতিক্রান্ত। গ্রাম্য পরিবেশে নেমে আসছে সন্ধ্যা। কুলায় প্রত্যাবর্তন করছে এক ঝাঁক টিয়া পাখি। সন্ধ্যাদীপ হাতে রূপা-মা এগিয়ে গেল তুলসীমঞ্চের দিকে। তার ডুরে শাড়ির আঁচলে প্রদীপখানি আড়াল দিয়ে। মালতী শঙ্খধ্বনি করল। ওরা ফিরে এলে রূপেন্দ্রনাথ বললেন, মামণি, আমার ঘরে আয়। কথা আছে। আপনিও আসুন, বৌঠান।

শয়নকক্ষে মাদুরটা বিছিয়েই রেখেছেন। ওরা দুজন বসল। পদ্মাসনে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বসলেন গৃহকর্তাও। বললেন, একটা কথা তোকে এ কদিন বলা হয়নি। একটা চরম দুঃসংবাদ আছে।

ডাগর দুটি চোখে বাবামশায়ের দিকে তাকিয়ে ও বলল, বড়বাড়ি সংক্রান্ত?

—হ্যাঁ, মামণি। ওঁরা কেন তোর বিবাহে আসতে পারলেন না।

—৺কাশীধাম থেকে কি কোন দুঃসংবাদ এসেছিল?

—না রে! জ্যেঠিমা ভালই আছেন। সংবাদটা শুভপ্রসন্ন সংক্রান্ত।

—শুভদার! কী হয়েছে তার?

—সে গৃহত্যাগ করেছে।

—কী করেছে? গৃহত্যাগ! মানে?

—সে আত্মসন্ন্যাস গ্রহণ করেছে। সংসারাশ্রম ত্যাগ করে সদগুরুর সন্ধানে হিমালয়ের পথে যাত্রা করেছে।

কক্ষে শিশিরপতন নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ পরে রূপমঞ্জরী বলে, কেন?

—’কেন’, তা তো বলা যাবে না, মা। শ্রীচৈতন্যদেবের অগ্রজ বিশ্বরূপদেবও অশ্রুত বাঁশির ডাকে এভাবেই গৃহত্যাগ করেছিলেন। শুভও তেমনি কেন্দ্রাতিগ বেগে সোঞাই গ্রামকে চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করে চলে গেছে। তারাদাকে একটি পত্রে জানিয়ে গেছে—সে সন্ন্যাস নিয়েছে। তার পার্থিব সমস্ত অধিকার সে স্বেচ্ছায় নির্ব্যঢ়স্বত্বে পরিত্যাগ করে যাচ্ছে। বিষয় সম্পত্তি যেন তারাদা অন্যান্য ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। সে আর ফিরবে না।

এতক্ষণে বোধহয় সংবাদের প্রত্যাঘাতটা ওর ছোট্ট বুকে ঠিক মতো বিঁধল। হঠাৎ সে জড়িয়ে ধরল তার সোনা-মাকে। বাবামশাই ছিল তার এতদিনের অবলম্বন। কিন্তু এটা এমন একটা বেদনা, এমন একটা আঘাত, যখন মেয়েরা মায়ের আঁচলের তলায় আশ্রয় নিতে চায়। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে চায়। শুভদা তো এখন আর তার বাল্যবন্ধু নয়, সহপাঠীও নয়, সে যে এখন পরপুরুষ। এখন এ কান্নাটা যে ‘ব্যর্থ অবৈধপ্রেম’ হারানোর হাহাকার!

মালতী ওকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে। কেঁদে মনটা হালকা করতে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে রূপেন্দ্রনাথ বলেন, অন্যায় সে কিছু করেনি। তার জীবন একটাই। সে যদি সেটা পরমেশ্বরের স্বরূপ সন্ধানে ব্যয়িত করতে চায়, তাহলে আমাদের আপত্তি করার কী থাকতে পারে? সে যে পথে চলতে চায়, তাকে সে পথেই যেতে দেওয়া উচিত। শুধু দুটি বিষয়ে আমি বেদনা পেয়েছি।

চোখ মুছে আবার সোজা হয়ে বসে রূপমঞ্জরী।

রূপেন্দ্র একই ভাবে বলে চলেন, আমার প্রথম ক্ষোভ কালনির্ণয়ে। শুভপ্রসন্ন ধীর, স্থির, স্থিতপ্রজ্ঞ। সে কেন এই অতিনাটকীয়তার আশ্রয় নিল?

—অতিনাটকীয়তা?

–নয়? অষ্টপ্রহর অপেক্ষা করলে কী ক্ষতি হত তার? কেন সে দুঃখেধনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহ’ রূপে এসে দাঁড়াতে পারল না বিবাহমণ্ডপে? আর পাঁচজন গ্রামবাসীর মতো? কালনির্ণয়ের ভ্রান্তিতে সে যে সোঞাই গাঁয়ের খরজিহ্ব মানুষগুলোকে একটা মুখরোচক আলোচনার সুযোগ দিয়ে গেল—এটা সে বুঝতে পারল না? ওই যারা বলেছিল, একই বিদ্যায়তনে বালক ও বালিকার শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হলে সমাজে অনাচার প্রবেশ করবে!

মালতীও সায় দেয় এই যুক্তিতে। বলে, সে-কথা একশবার! শুভ যদি দু-দিন সবুর করে গৃহত্যাগ করত, তাহলে এ-কথা উঠত না। কাল তো সেজখুড়ি আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেসই করে বসলেন, হ্যাঁগা বউমা, অরা দুজনে কি আড়ালে-আবডালে—

রূপমঞ্জরী তাকে চাপা ধমক দেয়, আপনি থামুন!

মালতীও রুখে ওঠে, আমি তো থামব। কিন্তু তুই কি পারবি সবাইকে ধমক দিয়ে থামাতে?

—না, পারব না। কিন্তু ভ্রূক্ষেপও করব না।

—কিন্তু কথাটা যদি তিজলহাটি পৌঁছে যায়?

রূপমঞ্জরী বিরক্ত হয়। বলে, কী কথা? গ্রামে একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে, আর একটি ছেলে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে কথার কী অবকাশ? কোনটাতে আপত্তি? বিবাহ না সন্ন্যাসগ্রহণ?

রূপেন্দ্র এবার অংশগ্রহণ করেন ওদের আলোচনায়। বলেন, আমার আপত্তিটা কোথায় সে-কথা আমি ইতিপূর্বেই বলেছি, মামণি। কালনির্ণয়ে! এটাই তার অপরাধ। এজন্যই সে দোষী।

তর্কশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছে বালিকা-তার্কিক। শান্তভাবে সে বলে, আপনি কিন্তু অপরাধীর অনুপস্থিতিতে—তার বক্তব্য না শুনেই—তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন, বাবা!

—কালনির্ণয়ের ভ্রান্তি বিষয়ে তার কোন বক্তব্য থাকতে পারে?

—জানি না। শুভদা অনুপস্থিত। তবে আমি তার সহপাঠিনী, তার বাল্যবন্ধু। সেই অধিকারে একটা কথা বলব?

—কী বলবি তুই?

—আপনি কিন্তু অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করার পূর্বে বিস্মৃত হয়েছিলেন যুগাবতার আদি শঙ্করাচার্যের সেই শাস্ত্রোক্ত নির্দেশ—যা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দিনী উভয়ভারতীর কাছে : ‘যদহরেব বিরজ্যেত তদহরেব প্রব্রজ্যেত।* একই লগ্নে গ্রামের একটি বালিকার বিবাহ এবং একটি কিশোরের গৃহত্যাগ যদি নিতান্ত কাকতালীয় ঘটনা হয়?

[* মুমুক্ষুর অন্তরে যে মুহূর্তে মুক্তির ইচ্ছা জাগরিত হবে সেই মুহূর্তেই সে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারে, সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে পারে।]

রূপমঞ্জরী নীরব হল। তাকিয়ে দেখল তার আচার্যের দিকে। দেখল, তিনি মুদিত নেত্রে ধ্যানস্থ। মালতী একবার এর দিকে একবার ওঁর দিকে তাকিয়ে দেখে। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে না।

দীর্ঘ সময় পরে যেন ধ্যানভঙ্গ হল রূপেন্দ্রনাথের। তিনি সস্নেহে একটি হাত বাড়িয়ে দিলেন আত্মজার মস্তকে। বললেন, শাস্ত্র বলেছেন, সর্বত্র জয়মিচ্ছুন্তি, পুত্রাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ম্—পুত্র এবং শিষ্যের কাছে পরাজয়ই কাম্য। শাস্ত্রবাক্য অসম্পূর্ণ। পুত্রীর ক্ষেত্রেও শ্লোকটি প্রযোজ্য! হ্যাঁ, মা! তাও হতে পারে। এ কথা আমার খেয়াল হয়নি। একটা পাষাণভার নেমে গেল আমার বুক থেকে।

রূপমঞ্জরী তৎক্ষণাৎ বলে, আপনি দুটি হেতুতে আহত হয়েছিলেন। একথাই প্রথমে বলেছেন। একটি তো কালনির্ণয়। শুভদার দ্বিতীয় অপরাধটা কী?

–শুভপ্রসন্ন তারাদাকে লিখেছে, গ্রামেই সে সদগুরুর সন্ধান পেয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই সে মানস সরোবরে চলেছে সদগুরুর সন্ধানে। শুভপ্রসন্ন বুঝতে পারল না যে, আমি তাকে আদৌ ত্যাগ করিনি। তাকে সাময়িক ভাবে আসতে বারণ করেছিলাম মাত্র। তোর সম্প্রদান হয়ে গেলেই আমি তাকে আবার আমার শিক্ষায়তনে ডেকে নিতাম।

—সে-কথা তাকে বলেছিলেন?

—কোন্ কথা?

—যে, আপনি তাকে সাময়িকভাবে নিষেধ করেছিলেন? অর্থাৎ আপনার কন্যাটিকে পাত্রস্থ করা মাত্র তাকে সর্বেশ্বরবাদ বা ব্রহ্মবাদে শিক্ষাদান শুরু করতেন?

আবার অনেকক্ষণ মুদিত নেত্রে স্মৃতিচারণ করলেন। তারপর আত্মজার দিকে দৃপাত করে বলেন, এবারও ঠিক বলেছিস, মা! না—তাকে সে ভাষায় স্পষ্টাক্ষরে তা বলিনি! এটাও আমারই দোষ।

—না, বাবা। দোষ কারও নয়, ভ্রান্তি। ভুল! ভুল আপনারা দুজনেই করেছেন। প্রচণ্ড অভিমানে। আপনাদের দুজনেরই উম্মার মূল লক্ষ্য সমাজের কুসংস্কার। নিতান্ত দুর্ভাগ্যক্রমে দুটি ক্ষেত্রেই তা প্রতিফলিত হল ক্ষেত্রান্তরে। আপনি ভুলে গেলেন শুভদাকে জানাতে যে, এ-একটা সাময়িক ব্যবস্থা—অগ্নি এবং দাহ্য পদার্থকে পৃথক রাখার আয়োজনে। আপনার কন্যাকে পাত্রস্থ করার পরেই আবার তাকে বুকে টেনে নেবেন। ভুল শুভদাও করেছে। প্রচণ্ড অভিমানে এই সহজ সরল সত্যটা তার মতো বুদ্ধিমানও বুঝে উঠতে পারল না।

রূপেন্দ্রনাথ অনেকক্ষণ নীরব রইলেন। তাঁর বালিকা কন্যার ক্ষুরধার বিশ্লেষণে মোহিত হয়ে গেলেন। মুখে শুধু বললেন, ঠিকই বলেছিস, মা।

রূপমঞ্জরী আবার বলে, আপনার বিষয়ে শুভদার সঙ্গে আমার সেদিন কিছু কথা হয়েছিল। সেই যেদিন আমি ওদের বাড়ি ‘আইবুড়ো ভাত’-এর নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলাম। শুভদা বলেছিল, আপনি সারাজীবনে একটাই দোষ করেছেন—যার উপর আপনার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না!

রূপেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন না। কিন্তু তাঁর চোখ দুটি প্রশ্নময় হয়ে উঠল।

মালতীর আর ধৈর্য রইল না। বলে, শুভ বলেছে যে, ঠাকুরপো সারাজীবনে একটাই দোষ করেছেন? কী দোষ?

—’কালানৌচিত্য দোষ’!

মালতী জানতে চায়, তার মানে?

—উনি ভুল করে দুই শতাব্দি পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছেন!

মালতী আবার বলে, তারই বা কী মানে?

রূপেন্দ্র তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, থাক ও আলোচনা। আর একটি কথা তোকে বলার আছে, মা। শুভ যাবার আগে তোকে একটি চিঠি দিয়ে গেছে। এটা ধর।

ভূর্জপত্রটি হাতে নিল। অন্ধকার ঘনিয়েছে এতক্ষণে। তাই সে দীপাধারের কাছে উঠে গেল। প্রদীপের আলোকে পাঠ করল সেই একছত্রের পত্রটি। সেই সম্বোধন ‘মঞ্জুভাষিনি!” সেই আশীৰ্বাদ :

‘মা ভূদেবং ক্ষণমপি চ তে সুন্দরাৎ বিপ্রয়োগঃ।

পাঠান্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরপদে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল কক্ষ থেকে। মালতী পিছন থেকে ডেকে ওঠে, কোথায় যাচ্ছিস?

রূপেন্দ্র বাধা দেন, ওকে যেতে দিন, বৌঠান। ও কেঁদে মনটা হালকা করতে যাচ্ছে!

–কেন?

—মন্দাক্রান্তায় ছন্দপতনে।

১০

মাসছয়েক পরের কথা। সমস্ত রাত্রি শ্রাবণের বর্ষণে ভেসে গেছে গ্রাম। ফুঁসছে দামোদর। সকাল বেলাতেই ভিজতে ভিজতে এসে উপস্থিত হল নকড়ি ঘোষাল।

—কী ব্যাপার নকড়ি? তুমি এই প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় করে?

—সর্বনাশ হয়ে গেছে তাঐমশাই। কাল শেষ রাত্রে বাবামশাই হঠাৎ পালঙ্ক থেকে পড়ে গেছেন!

—পড়ে গেছেন? জ্ঞান আছে?

—ওঁর জ্ঞান হবার পরেই রওনা হয়েছি। কিন্তু তাঁর দক্ষিণাঙ্গ অবশ হয়ে গেছে। বৈদ্য বললেন : সন্ন্যাস!

—চল, এখনি যাচ্ছি আমি।

ভাশুরঠাকুরকে একটু মিষ্টিমুখ করানো গেল না। দূর থেকে তাঁর চরণপ্রান্তে প্রণাম করল শুধু।

ওঁরা দুজন তৎক্ষণাৎ অশ্বপৃষ্ঠে তিজলহাটির দিকে রওনা দিলেন। সেখানে পৌঁছালেন একপ্রহর বেলায়। দূর থেকে দেখতে পেলেন ঘোষালবাড়ির সামনে অনেক মানুষজন এবং অন্দরমহল থেকে ভেসে আসছে পুরললনাদের সম্মিলিত আর্তবিলাপ। রূপেন্দ্র থমকে গেলেন, বললেন, উনি বোধহয় আমাকে চিকিৎসার সুযোগটা দিলেন না।

দুজনে অবতরণ করলেন অশ্ব থেকে। দুই জন গৃহভৃত্য এগিয়ে এসে লাগামজোড়া ধরল। নকড়ি দ্রুতপদে চলে গেল অন্দরমহলে। উনি প্রবেশ করলেন না। সদর দরজার সামনেই নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন। একজন অপরিচিত গ্রামবাসী বললে, আপনার আর কিছু করার নেই, বাবাঠাকুর। বড়কর্তা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, সজ্ঞানে ছিলেন?

—তা তো জানি না, বাবাঠাকুর। আমরা তো বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।

বাড়ির সামনেই একটা বড় গোলোকচাপার গাছ। নিচেটা ইট দিয়ে বাঁধানো। উনি স্থির করলেন আপাতত ওখানেই গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন। শোকের আঘাতটা স্তিমিত হওয়া পর্যন্ত। সেদিকে একপদ অগ্রসর হতেই সদর দরজা দিয়ে বার হয়ে এলেন এক বিধবা বৃদ্ধা। মাথায় ঘোমটা নাই, চুলগুলি কদমছাঁট। গলায় একটি রুদ্রাক্ষের মালা। খনখনে গলায় তিনি চীৎকার করে ওঠেন, ও কি! পালাচ্ছেন কোথায়? আসেন! ভিতরে এসে দেখেই যান আপনার কীর্তি।

অজান্তেই ওঁর মুখ দিয়ে বার হয়ে গেল প্রশ্নটা : আমার কীর্তি?

—আবার কার? আপনারই তো! কী যে ফুসমন্তর ঝাড়লেন পাঁচুর কানে! নিক্কথায় সে রাজি হয়ে গেল। সোনার চাঁদটাকে ওই বিষকন্যার সাথেই বে দিল। মাত্তর ছয় মাসের ভেতরেই হতচ্ছাড়ি খেয়ে ফেলল জলজ্যান্ত শ্বশুরটারে! এমন অপয়া বউ জন্মে দেকিনি বাবা!

অপরাধীর মতো নতনয়নে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। জবাব দেন না।

—কী হল? সঙের মতো দাঁইড়ে রইলেন কেন? এসে নিজের চখ্যে দেখে যান, কতবড় সব্বোনাশ সে হারামজাদি করেছে বছর না ঘুরতেই।

এতক্ষণে তিনকড়ি ঘোষাল বার হয়ে আসেন। বৃদ্ধার হাতটা ধরে বলেন, আঃ! এসব কী হচ্ছে বড়দি! আসুন আপনি, ভিতরে আসুন।

—যাবনি! আগে এর একটা বিহিত হোক! কেন ওই অলপ্পেয়ে কোষ্ঠিবিচার করতে দিলনি? কেন যোটক বিচের হলনি? পাঁচুটার হাতে পাঁচ কপদ্দক ধইরে দে’ গছিয়ে দিল ওই বিষকন্যারে।

তিনকড়ি ওঁর হাত ধরে টানাটানি করতে থাকেন। বৃদ্ধা দাওয়ার একটি থাম আঁকড়ে উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার চালিয়ে যান। রগড় দেখতে গ্রামবাসী ঘনিয়ে আসে। তাদের ভিড় ঠেলে হঠাৎ কে যেন অগ্রসর হয়ে এলেন। জনতা সসম্ভ্রমে তাঁকে পথ দিল। জমিদার মিত্রমশাই। রূপেন্দ্রনাথের হাতটা চেপে ধরে বলেন, আপনি চলে আসুন। বড়দি এখন উন্মাদ হয়ে গেছেন। কাকে কী বলছেন জানেন না। আপনি আসুন আমার সঙ্গে। আমার বাড়িতে।

নিজের ভদ্রাসনে রূপেন্দ্রনাথকে নিয়ে এসে বসালেন। রূপেন্দ্র জানতে চান, উনি কি পাঁচকড়ি ঘোষালমশাইয়ের দিদি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। বালবিধবা। প্রচণ্ড মুখরা। উনি যখন যে বাড়িতে থাকেন তখন তার ত্রিসীমানায় কাক-চিল বসতে পারে না। আপনার এখানে এখন কিছুই করণীয় নেই। আমার বাড়িতেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন। আপনার ঘোড়াটাকে এখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাকে আবার ও বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। শবযাত্রা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সামাজিক কর্তব্য! বুঝতেই তো পারছেন!

রূপেন্দ্রনাথ জানতে চান, সৌম্যসুন্দর কি এখানে আছে?

—আজ্ঞে না। সে কৃষ্ণনগরে। এখনি তাকে খবর দিতে লোক পাঠাব। ঘোষালভায়ার শবযাত্রা রওনা হয়ে গেলেই। মহাগুরুনিপাত বলে কথা!

রূপেন্দ্র নতনেত্রে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন : আমি কি আমার কন্যাটিকে পাল্কিতে চাপিয়ে নিয়ে আসব? কালদণ্ডের মধ্যে? মহাগুরুনিপাত তো তারও হয়েছে।

মিত্রমশাই বলেন, আমার পরামর্শে যদি কান দেন, তবে ওসব কিছু করতে যাবেন না। অন্তত যতক্ষণ না সৌম্য এসে উপস্থিত হয়। বড়দি একা নয়, তার দলে আরও অনেকে আছেন। মুখরা মেয়েদের ঘোঁট তো জানেনই! বন্ধু-নির্যাতনে তাঁরা সিদ্ধহস্তা। তাঁদের অভিমত—কিছু মনে করবেন না আমার স্পষ্টোক্তিতে—আমি আপনার শুভকামী বলেই এতকথা জানাচ্ছি। পরিবারের অনেকেই মনে করেন পাঁচকড়ি যথাযোগ্য কৌলিন্য মর্যাদা গ্রহণ না করে ওঁদের পূর্বপুরুষের অপমান করেছেন। এটাই ওঁদের ক্ষোভের মূল হেতু। পাঁচ মুঠি রজতখণ্ড বরদান দিলে তাঁরা ভাগ করে নিতেন। অথচ আমি জানি—ঘোষালভাষা আমাকে নিজেই বলেছিল—আপনি বরপণ দিতে অস্বীকার করেন, আর ও নিজ ইচ্ছামতো নামমাত্র কৌলীন্য মর্যাদা গ্রহণ করেছিল।

—আমি এই সমাজিক প্রথার বিরুদ্ধে!

—শুনেছি সে-কথা। কিন্তু আর একটা কথা বলুন তো ভিষগাচার্য। ঘোষালভায়া কি যোটক-বিচার আদৌ করায়নি? কন্যার জন্মপত্রিকাও দেখতে চায়নি?

—আজ্ঞে না।

—এটা কিন্তু আপনারা দুজনেই অন্যায় করেছেন! আমি জানি, সৌম্য ‘নরগণ’। আপনার কন্যা যদি রাক্ষসগণ’ হয় তাহলে এমন দুর্ঘটনা তো স্বাভাবিক। বিবাহের ছয় মাসের মধ্যেই নাহলে কেমন করে…..

রূপেন্দ্র কী বলবেন ভেবে পেলেন না।

—তাহলে আপনি আমাকে অনুমতি দিচ্ছেন? আমি আবার ঘোষালভায়ার ওখানে যাই? আমার পুত্রটি ওখানেই আছে—শবযাত্রায় যাবে। কিন্তু আমার এই ভৃত্যটিকে রেখে যাচ্ছি। যা প্রয়োজন হবে জানাবেন!

রূপেন্দ্র বলেন, আপনি পরামর্শ দিলেন মামণিকে যেন এখন এ বাড়ি না পাঠাই। অন্তত সৌম্যসুন্দর না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত। মেনে নিলাম। কিন্তু তা ছাড়াও তো আমার কিছু কৃত্য আছে।

—জানি। ও বাড়িতে কিছু ফল-মূল-মিষ্টান্ন পাঠানো। আতপ চাউল, কাঁচকলা ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘাটকামানোর আগে একপ্রস্থ ধুতি-শাড়িও পাঠাতে হবে। এ বিষয়ে আপনি কি আমার পরামর্শ শুনবেন?

—নিশ্চয়। বলুন!

—আমি সময়মতো সব কিছু পাঠিয়ে দেব ঘোষালভায়ার বাড়িতে। বলব যে, আপনি সেগুলি আমার মারফতে পাঠিয়েছেন। না, না, আপনি সঙ্কোচ করবেন না। আপনি আমাকে নাতির মুখ দেখিয়েছেন। বৈদ্যবিদায়’ গ্রহণ করেননি। বলেছিলেন, সেটা এ গ্রামের সংরক্ষিত দীঘির জন্য আপনার অনুদান। কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি এখনো পালন করতে পারিনি। আমি জোড়হস্তে প্রার্থনা করছি ভেষগাচার্য, এটুকু আমাকে করতে দিন! সামাজিক কৃত্য করেননি বলে কোন অনুযোগ আমি উঠতে দেব না। কথা দিচ্ছি।

এইসময় একটি দাসীর হাতে ডাবের জল আর কিছু প্রসাদী ফল-মিষ্টান্ন নিয়ে উপস্থিত হল ওঁর বধূমাতা। আবক্ষ ঘোমটা টেনে। রূপেন্দ্রের কাছে তার কোন সঙ্কোচ নেই। ভেষগাচার্য স্বহস্তে ওকে পুত্রবতী করেছেন। তিনি তো দেবতা। তার অবগুণ্ঠনটা শ্বশুরমশায়ের উপস্থিতির জন্য। দাসীর হাত থেকে পাত্রগুলি গ্রহণ করে শ্বেতপাথরের মেজ-এ নামিয়ে রাখে। কবিরাজ-মশায়ের কানে-কানে বলে, মা বললেন, আপনি মধ্যাহ্নে এখানেই দুটি ঠাকুরের প্রসাদ পেয়ে যাবেন।

রূপেন্দ্র বলেন, সে আর একদিন হবে রে মা। দাও গেলাসটা দাও আমাকে।

 ডাবের জলটুকু নিঃশেষ করে বলেন, বাকি সব নিয়ে যা রে মা। এখন কি ওসব—। হাঁ-হাঁ করে বাধা দেন গৃহস্বামী, ও-কথা বলতে নেই! এ যে ঁরাধাগোবিন্দজির প্রসাদ! রূপেন্দ্র অতঃপর একটি বাতাসা তুলে মুখে দিলেন।

১১

অশৌচাবস্থায় বাড়ির কনিষ্ঠা পুত্রবধূ কেন হাজিরা দিতে এল না এ নিয়ে ঘরে ঘরে ঘোঁট। “এ কী অসৈরণ কতা গো! কতায় বলে ‘সিঁথের সিঁদূর থাকলে জানি, শ্বশুরঘরের বহুরানী/ঘুচলে হাতের শাঁখা-খাড়ু, বাপের বাড়ি মারগে ঝাড়ু।” শ্বশুরের গঙ্গালাভ হলে তোরও তো মহাগুরুনিপাত হয়। এটা জানিস না? এমন বাপ্-চেংটি মেয়ে দেখিনি বাপু। একবার এসে ডাঁড়ালো না পয্যন্ত!

মামণি যেতে চেয়েছিল। স্বামীর মহাগুরুনিপাত হলে তারও হয়। তখন তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। চরু রান্না করে দিতে হয়। কম্বলের বিছানায় বালিশ-ইট দিয়ে তার শয়নের ব্যবস্থা হয়। স্বামীকে অশৌচকালে পদস্পর্শ করে প্রণাম করার বিধান নেই। তবু যেতে হয়। রূপেন্দ্র ইতস্তত করছিলেন—বিশেষ মিত্রমশাই নিষেধ করেছেন। সৌম্যের দজ্জাল বড়পিসির রণচণ্ডী মূর্তি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন। মালতী কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বলে, সে অত্যাচার যে কী বীভৎস তা আপনার আন্দাজের বাইরে, ঠাকুরপো। আমি নিজে ভুক্তভুগী বলে জানি।

সমাধান হয়ে গেল সৌম্যসুন্দরের পত্রে। অশ্বারোহী পাইকের হাতে সে শ্বশুরমশাইকে অনুরোধ করেছে এখন যেন ঘোষালবাড়ির ছোট বৌমাকে না পাঠানো হয়। কেন কী বৃত্তান্ত জানায়নি।

শ্রাদ্ধের দুদিন আগে নিমন্ত্রণ করতে এল প্রফুল্লকান্তি। ভূস্বামীতনয়। সঙ্গে সেকালীন সামাজিক রীতিতে নকড়ির এক জ্ঞাতিভ্রাতা। প্রফুল্লকান্তি রূপেন্দ্রনাথকে জনান্তিকে জানালো যে, তার বাবামশাই মৌখিক পরামর্শ দিয়েছেন : উনি যেন শ্রাদ্ধবাড়িতে একাই যান। যদিও সবান্ধব নিমন্ত্রণ হয়েছে।

১২

তাই গেলেন। বৃষোৎসর্গের আয়োজন। এলাহী কাণ্ড। বহু লোক জমায়েত হয়েছে। প্রাঙ্গণে বিরাট সামিয়ানা। তিনকড়ি, নকড়ি এবং সৌম্যসুন্দরের সঙ্গে দেখা হল। শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন হতে এবং আমন্ত্রিতদের মধ্যাহ্ন আহারে তৃপ্ত করতে অপরাহ্ণ হয়ে যাবেই।

মিত্রমশাই ওঁকে জনান্তিকে ডেকে এনে বলেন, এটা কী শুনছি বাঁড়ুজ্যেমশাই! আপনি নাকি জানিয়েছেন যে, শ্রাদ্ধবাড়িতে জলস্পর্শ করবেন না।

—না, না, সে কী কথা! আমি সরবৎ পান করব, ডাব অথবা বেলের পানাও পান করব। তবে আজ একাদশী তো? তাই আর কিছু খাব না।

—কেন? আপনি তো বামুনের বিধবা নন!

—না! আমি বিপত্নীক। স্ত্রী-বিয়োগের পর থেকে এই নিয়মই আমি মেনে চলি। মনুসংহিতায় তেমন কোনও নির্দেশ না থাকলেও

—এতো বড় আজব কথা। অন্তত ‘নিয়মভঙ্গের’ অনুষ্ঠানে আসছেন নিশ্চয়?

—আমি নিরামিষাশী! আমাকে মার্জনা করবেন!

গম্ভীর হয়ে গেলেন মিত্রমশাই। বলেন, আমি হয়তো করব। এঁরা কিন্তু করবেন বলে মনে হয় না। যাহোক, একটা জরুরি কথা বলি। আজ সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে কিছু গোপন বৈষয়িক কথা আলোচনার আছে। মানে, গোপনীয়তা আমার নয়। ঘোষাল পরিবারের স্বার্থে। আপনার জামাতাবাবাজীবনের পক্ষে পিতার সম্পত্তি লাভে কিছু বিঘ্ন উপস্থিত হয়েছে। বৈষয়িক ব্যাপার। নিমন্ত্রিতেরা বিদায় না হওয়া পর্যন্ত সেসব আলোচনা হতে পারে না। তাই তিনকড়ি-নকড়ি আর সৌম্যের স্বার্থে আপনাকে অনুরোধ করছি : আজ রাত্রি আমার গরিবখানায় আতিথ্য গ্রহণ করুন। আমি সোঞাই গাঁয়ে আপনার বাড়িতে সংবাদ পাঠিয়ে দিচ্ছি, যাতে তাঁরা চিন্তা না করেন। সন্ধ্যার পর আলোচনাটা হতে পারে। আপনি আমার ভদ্রাসনে শয়ন করবেন। কাল প্রাতে ঘোষালবাড়িতে আপনার একাদশীর পারণ সেরে ফিরে যাবেন। তাহলে ওদেরও ক্ষুণ্ণ হবার কোনও অবকাশ থাকবে না। সধবা অথবা বিপত্নীকের একাদশীতে ওরা তো অভ্যস্ত নয়।

—ঘোষাল-মশায়ের সম্পত্তির দখলের ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনার কী আছে? তিনি যদি কোন শেষ অছিয়তনামা রচনা না করে গিয়ে থাকেন তাহলে তো জীমূতবাহন-নির্দিষ্ট দায়ভাগশর্তানুসারে-

—আজ্ঞে না। ঘোষাল একটি শেষ ইচ্ছাপত্র’ রচনা করেই গঙ্গালাভ করেছেন। আর সেই অছিয়তনামায় আপনার নামোল্লেখ করে গেছেন। না হলে আপনাকে অহেতুক সে মন্ত্রণাসভায় আহ্বান করব কেন বলুন?

রূপেন্দ্র বলেন, শুনুন মিত্রমশাই! বেহাইমশায় কী ইচ্ছাপত্র রেখে গেছেন তা আমি জানি না। তিনি যদি তাঁর সম্পত্তির কোন অংশে আমাকে ওয়ারিশ করে গিয়ে থাকেন তা হলে তা গ্রহণে আমি অস্বীকৃত। ইচ্ছাপত্র মোতাবেক সম্পত্তির দখলনামা নিতে অন্যান্য ওয়ারিশদের স্বার্থে প্রয়োজন হলে আমি লিখিতভাবে একটি শংসাপত্রে স্বাক্ষর করে যাব। কিন্তু আমি বৈবাহিকের সম্পত্তির কোন অংশ গ্রহণে অস্বীকৃত। এমনকি যদি কোন জনহিতকর কার্যের জন্য সে অর্থ আমাকে দান করে থাকেন তদসত্ত্বেও নয়।

—ওই রকম একটি শংসাপত্রে আপনাকে স্বাক্ষর দেবার অনুরোধই করছি বাঁড়ুজ্যেমশাই। না হলে তিনকড়ি-নকড়ি আর সৌম্য নাম খারিজ করতে পারবে না। আপনি তা হলে এ বিষয়ে ওদের সাহায্য করতে স্বীকৃত? শংসাপত্রে স্বাক্ষর দিতে রাজি?

—নিশ্চয়! আমি বৈবাহিকের সম্পত্তির কপর্দকমাত্র গ্রহণে অস্বীকৃত।

—সে কথা আপনি ইতিপূর্বেই বলেছেন। মৌখিক। লিখিত শংসাপত্রে স্বাক্ষর দেবেন তো?

—সে কথাও আমি বলেছি। বেশ, আপনাদের সান্ধ্য মন্ত্রণাসভায় আমি উপস্থিত থাকব। আপনার ভদ্রাসনে রাত্রিবাস করব।

—আপনি আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন বাঁড়ুজ্যেমশাই। অথচ এই সহজ সরল কথাটা ওরা সাহস করে আপনার কাছে উত্থাপন করতেই সাহস পাচ্ছিল না। আমাকে দূত করে পাঠিয়েছে!

বৃষোৎসর্গের আদ্যশ্রাদ্ধ-সময় তো লাগবেই। নিমন্ত্রিতদের ভূরিভোজ সমাপ্ত হতে হতে অপরাহ্ণ পার হয়ে গেল।

সন্ধ্যার সময় ওঁকে ডেকে নিয়ে গেল নকড়ি। দ্বিতলের একটি নির্জন কক্ষে। কক্ষটি মাঝারি। মাঝখানে একটি চৌকি। ফরাস পাতা। দু-চারটি তাকিয়া। তাম্রকূট-সেবনের আয়োজনও আছে। উপরে টানাপাখা। ব্যজনকারী পার্শ্ববর্তী কক্ষে। তাকে দেখা যায় না। শ্রাবণেই ভাদ্রের গরম। সৌভাগ্যক্রমে আজ সকাল থেকে বৃষ্টি নামেনি।

রূপেন্দ্রনাথ দেখলেন কক্ষে মাত্র চারজন উপস্থিত : তিনকড়ি, নকড়ি, জমিদার মিত্রমহাশয় আর ঘোষমশাই। তিনি উকিল। আইন-পরামর্শদাতা। প্রয়োজনে যজমানের পক্ষে কাজির আদালতে ওকালতিও করেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল। রূপেন্দ্রের অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ, কিন্তু সমকালীন সামাজিক প্রথায় তিনি ব্রাহ্মণকে প্রণাম করলেন।

রূপেন্দ্র তাঁকেই প্রশ্ন করেন, ‘অছিয়তনামাটা’ কি আপনিই রচনা করেছেন?

—হ্যাঁ এবং না। অর্থাৎ রচনা আমারই। তবে সেটি স্বহস্তে আদ্যোপাত্ত অনুলিখন করে স্বাক্ষর করেছিলেন পাঁচকড়ি ঘোষালমশাই। মূল ইচ্ছাপত্রটি তাঁর স্বহস্তলিখিত ও স্বাক্ষরিত।

—বুঝলাম। তাতে কি আপনারও স্বাক্ষর আছে? সাক্ষী হিসাবে?

—এবারেও উত্তর হ্যাঁ এবং না। অর্থাৎ স্বাক্ষর আছে, তবে সাক্ষী হিসাবে নয়। দলিল রচনাকারী হিসাবে। সাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর দিয়েছে আমার দুই মুহুরি।

—স্বর্গত ঘোষালমশায়ের ইচ্ছাপত্রে কি এই দুইজন ওয়ারিশ আছেন? সৌম্যসুন্দর কি অন্যতম ওয়ারিশ নয়?

এবার প্রত্যুত্তর করলেন মিত্রমশাই, না, না। সৌম্যকেও যথাযোগ্য অংশ ঘোষালভায়া দিয়ে গেছেন। কিন্তু সে নাবালকমাত্র। তার তরফে তার দুজন অভিভাবক তো উপস্থিত—তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা ও খুল্লতাত।

রূপেন্দ্র বলেন, নবাবী আইনে কী নিয়ম আমার জানা নেই, কিন্তু এ আলোচনাসভায় তার উপস্থিতিতে কারও কি আপত্তি আছে?

—সে সাবালক হোক অথবা নাবালক?

মিত্রমশাই বলেন, না, না, আপত্তি থাকবে কেন? কী আশ্চর্য!

ডাক পড়ল সৌম্যসুন্দরের। মুণ্ডিতমস্তক কিশোরটি এসে উপস্থিত হল। তিনজনকে পদস্পর্শ করে প্রণাম করল। মিত্র ও ঘোষ মশাইদের দু-হাত তুলে নতশির নমস্কার।

ভকিল-সাহেব এবার তাঁর পুলিন্দার বাঁধন খুলে একটি ইচ্ছাপত্র বাহির করলেন। রূপেন্দ্র বললেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ওই ফার্সি শব্দে পরিপূর্ণ মূল দলিলটি পাঠ করা নিষ্প্রয়োজন। পরে দরকার হলে আমি দেখে নেব। মূল বিষয়বস্তুটা কী এবং সমস্যাটা কোথায় তা কেউ একজন আমাকে বুঝিয়ে বলুন।

মিত্রমশাই বলেন, আমি ওটি খুঁটিয়ে পড়েছি। আদালত ও নবাবী সেরেস্তায় ফার্সি শব্দে-ঠাসা দলিল পাঠে আমি অভ্যস্ত। ইচ্ছাপত্রের মূল বক্তব্যটি এই রকম :

ঘোষাল ইচ্ছাপ্রকাশ করে গেছেন যে, তাঁর স্বোপার্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রথমেই পরিশোধ করতে হবে একটি বন্ধকী ঋণ। মূল ঋণের পরিমাণ দুই শত রজতমুদ্রা। প্রাপক তিজলহাটির ভূম্যধিকারী। অর্থাৎ আমি। সুদ-সহ এই ঋণ পরিশোধের পর বাকি মূল্যমানের অর্ধাংশ গচ্ছিত থাকবে একটি অছিপর্ষদের দায়িত্বে। বাকি অর্ধাংশের দশ-শতাংশের প্রাপক : ইচ্ছাপত্র লেখকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীমান তিনকড়ি ঘোষাল এবং বিশ-বিশ শতাংশ তাঁর দুই পুত্র নকড়ি ও সৌম্যসুন্দর।

রূপেন্দ্র বলেন, তাহলে আমাকে ডাকা হল কেন? আমার কী ভূমিকা?

মিত্রমশাই বুঝিয়ে বলেন, আপনি ওই অছি-পর্ষদের সদস্যত্রয়ীর অন্যতম। বাকি দুজনের একজন আমি, অপরজন ঘোষালের গুরুদেব।

—তিনি এই পরামর্শ সভাতে এলেন না কেন?

—তিনি বৃদ্ধ। শ্রাদ্ধে উপস্থিত ছিলেন। এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর যা বক্তব্য তা তিনি আমাদের জানিয়েছেন। ভকিল সাহেবকেও। প্রয়োজনে কোন শংসাপত্রে স্বাক্ষরে তিনি সম্মত। আমিও তাতে সম্মত।

—বুঝলাম এবার ওই অছি-পর্যদ কেন গঠন করা হয়েছে, অছিপর্ষদের কী করণীয় একটু বুঝিয়ে বলুন।

‘একটু’ নয়, বেশ বিস্তারিতভাবেই সেটা বুঝিয়ে দিলেন মিত্রমশাই।

ঘোষাল জানাচ্ছেন : তাঁর সম্পত্তির অর্ধেক পৃথক করে রাখা হচ্ছে তিজলহাটি গ্রামে একটি সংরক্ষিত পুষ্করিণী খননের উদ্দেশ্যে। সেটি খননের জন্য তিনি সৌঞাই গ্রামের ভিষগাচার্য রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁরই তত্ত্বাবধানে দীঘিটি খনন করা হবে। তার জন্য কপিকল, কদলীপুষ্প আকারের ‘বারি-আহরণ-পাত্র’ প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তিনজন পানিবাবার জন্য পাঁচ বৎসরের মাসোহারার অর্থ পৃথক করে রাখতে হবে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। পাঁচ বৎসরে যদি গ্রামবাসী প্রণিধান করে যে, ওই সংরক্ষিত পুষ্করিণীতে এ অঞ্চলে আন্ত্রিক রোগ প্রশমিত হয়েছে—ইচ্ছাপত্রলেখকের আশা সেক্ষেত্রে গ্রামপঞ্চায়েত ব্যবস্থাটা চালু রাখার উপযুক্ত অনুদান বরাদ্দ করবেন। পুষ্করিণী সংক্রান্ত তাঁর তিনটি শর্ত। প্রথমত : সেটির আকৃতি সোঞাই গ্রামস্থ সংরক্ষিত পুষ্করিণীর মতো হবে। দ্বিতীয়ত : সেটি খননের এবং অন্যান্য যাবতীয় ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী ওই ভিষগাচার্য রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয়ত : পুষ্করিণীটির নামকরণ করা হবে : ‘একবগ্গা দীঘি’।

নিমীলিত নেত্রে এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। মিত্রমশাই নীরব হতে বলেন, তা এই ইচ্ছাপত্র কার্যকরী করায় কী অসুবিধা হচ্ছে? সমস্যাটা কোথায়?

মিত্রমশাই এবার ভকিল সাহেবের দিকে ফিরে বলেন : আপনি বুঝিয়ে বলুন বরং।

ভকিল-সাহেব একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, পাঁচকড়িদা বলেছেন, পুকুরটা হবে সোঞাই গ্রামের সংরক্ষিত পুষ্করিণীর আকৃতি অনুসারে। আমি সে পুষ্করিণী দেখেছি। সেটি চতুষ্কোণ, কিন্তু বর্গক্ষেত্র বা আয়তক্ষেত্র নয়। যাবনিক-জ্যামিতিতে শুনেছি তাকে বলে ‘রম্বস্’। তার দুই বিপরীত বাহু পরস্পরের সমান্তরাল। অপর দুটি বাহু বিপরীত বাহুর সমান্তরালে নয়। পুষ্করিণীর আকৃতি কী হবে তা দলিলে বলা আছে। কিন্তু কত বড় হবে বলা নেই। এটি এক নম্বর সমস্যা।

রূপেন্দ্র বলেন, এ সমস্যার তো সহজ সমাধান। আমরা ওই ‘রম্বস্’ আকৃতির একটি ক্ষুদ্র পুষ্করিণী খননের কাজ শুরু করব। তার গভীরতা এমন হওয়া চাই যাতে সংবৎসর তাতে জল থাকে। তারপর অছি-তহবিলে অর্থের পরিমাণ বুঝে আমরা স্থির করব কোথায় থামতে হবে। এখানে ‘আমরা’ বলতে অছি-পর্ষদের সদস্যত্রয়ী।

তিনকড়ি জানতে চান, দাদা কি আপনাকে এই ইচ্ছাপত্র সম্বন্ধে কিছু বলে গেছেন? কিংবা কিছু চিঠিপত্র লিখেছেন?

—না! এ কথা এই প্রথম শুনছি।

তিনকড়ি বলতে থাকেন, দেখুন বেয়াইমশাই! দাদা এ প্রস্তাব তাঁর জীবদ্দশাতেই উত্থাপন করেছিলেন। পঞ্চায়েত স্বীকৃত হননি। তাঁদের অভিমত এটা নিতান্ত ভস্মে ঘি ঢালা। তাই তাঁরা দাদার প্রস্তাবে সম্মত হননি। কোন অনুদান দিতে স্বীকৃত হননি। আপনি চারক্রোশ দূরে বাস করেন। চিকিৎসক হিসাবে আপনার সময়ের নিতান্ত অভাব। আপনি যদি একটি শংসাপত্রে জানিয়ে দেন যে, দাদা আপনার পরামর্শ ব্যতিরেকেই আপনার নাম ওই অছি-পর্ষদে লিখেছেন সেজন্য আপনি সে দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃত, তা হলে অর্ধেক সম্পত্তি জলে ফেলতে হয় না। সৌম্যসুন্দরও তাহলে পিতার সম্পত্তি থেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

ভ্রূকুঞ্চিত হল রূপেন্দ্রনাথের, বলেন, এইমাত্র শুনলাম ওঁর প্রস্তাবিত অছি-পরিষদের অপর দুই সদস্য এমন শংসাপত্র লিখে দিতে স্বীকৃত। কিন্তু সেটা প্রয়োজন হচ্ছে কেন? আমার নিকট তো কোন লিখিত দলিল বা কাগজপত্র নাই। আমি দাবী করলেও কাজী সাহেবের আদালতে প্রমাণ করতে পারব না যে, ঘোষালমশাই অমন একটি ইচ্ছাপত্র’ রেখে গেছেন। আপনারা তো জীমূতবাহন-নির্দেশিত ‘দায়ভাগ’ মতে সম্পত্তির দখল নিতে পারেন।

সেখানেই তো হয়েছে মুশকিল। দাদা একটি কেলেঙ্কারি করে গেছেন। তিনি এই ইচ্ছাপত্রের দুটি অনুলিপি করে দুজনকে লোকমারফত জানিয়েছিলেন। প্রথম জন কোতোয়ালসাহেব, দ্বিতীয়জন নায়েব-কানুনগো। তাঁরা ব্যপারটা জানেন। তাঁরাই প্যাঁচ কষছেন! বলছেন, অছি-পর্ষদের তিন সদস্য যদি পৃথক পৃথকভাবে এ দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করেন, তাহলেই নামখারিজ করে আমাদের তিনজনকে দাদার সমস্ত সম্পত্তির পত্তনি দেওয়া হবে। অবশ্য দুইজনকেই যথোচিত সম্মান-মর্যাদা দিতে হবে—তাঁদের হস্তগত ইচ্ছাপত্রের অনুলিপি দুটি বিনষ্ট করে ফেলার মূল্যস্বরূপ।

—বুঝলাম না। আমাদের শংসাপত্র হাতে না পেলে তাঁরা দুজন উৎকোচ গ্রহণ করতে পারছেন না কেন?

ভলিসাহেব প্রতিবাদ করেন, ‘উৎকোচ’ নয়, ‘সম্মান-মর্যাদা’! ওঁরা তো জানেন না যে, আপনাদের তিনজনের কারও কাছে এই ইচ্ছাপত্রের অনুলিপি আছে কি না। যদি সেটি নিয়ে উপরে দরবার করেন তখন ওঁরা বেইজ্জত হবেন।

রূপেন্দ্রনাথ এবার হেসে বলেন, এতক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। শুনুন, ভলিসাহেব! যদিও আমার সঙ্গে পরামর্শ করে বা আমার অনুমতিসাপেক্ষে অছি পরিষদটি গঠিত হয়নি, তবু এ দায়িত্ব গ্রহণে আমি সানন্দে স্বীকৃত। আমি চারক্রোশ দূরে থাকি বটে কিন্তু সেখান থেকে এই জনহিতকর কার্য সম্পাদন করা আমার পক্ষে অসম্ভব নয়। আমি মনে করি, পরলোকগত আত্মার ইচ্ছাপত্রটির যথাযোগ্য মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।

মিত্র বলেন, আপনি কিন্তু আমার কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, শংসাপত্রে আপনি স্বাক্ষর দিতে স্বীকৃত!

—না, মিত্ৰমশাই। আমি বলেছিলাম ওঁর সম্পত্তির কপর্দকমাত্র আমি গ্রহণে স্বীকৃত নই। শুধু সেই মর্মেই আমি শংসাপত্রে স্বাক্ষর করতে স্বীকৃত হয়েছিলাম।

এরপর অনেকক্ষণ বাদানুবাদ চলল, কিছু কটুকথার বিনিময়ও হল। কিন্তু রূপেন্দ্রনাথ ওই সংরক্ষিত পুষ্করিণী খননের প্রস্তাবটির শিশুমৃত্যুতে স্বীকৃত হলেন না।

একপ্রহর রাতে তিনি বললেন, আপনারা যা ভালো বোঝেন করবেন। আমি কোতোয়ালিতে বা নায়েব-কানুনগোর দরবারে যাব না। কারণ সে অধিকার আমার নাই। ক্ষমতাও নাই। কারণ আমার নিকট কোন প্রমাণপত্র দলিল-দস্তাবেজ কিছুই নাই। তদ্‌সত্ত্বেও আমার অভিমত : স্বর্গত ব্রাহ্মণের ইচ্ছাপত্রটিকে তাঁর আদ্যশ্রাদ্ধদিবসেই এরূপে অমর্যাদা করা অনুচিত।

রূপেন্দ্রনাথ জমিদারবাড়িতে রাত্রিবাসে স্বীকৃত হতে পারলেন না। জ্যোৎস্নালোকিত বনপথে মধ্যরাত্রে প্রত্যাবর্তন করলেন নিজ ভদ্রাসনে।

১৩

মাসখানেক পরের কথা।

সমস্ত রাত্রিব্যাপী শেষ ভাদ্রের একটানা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। দামোদর কূল ছাপিয়েছে। সারা গ্রাম জল-ছপছপ। কোথাও এক হাত, কোথাও বা এক বিঘত। নদীমাতৃক ভূখণ্ডের বৎসরান্তিক আশীর্বাদ পড়ছে নাড়ামুড়ো ধানের খেতে।

রূপেন্দ্রনাথ সে রাত্রে অনুপস্থিত। দূরগ্রামে গিয়েছেন আর্তরোগীর চিকিৎসায়। ফিরবেন পরদিন সন্ধ্যায়। যথানিয়মে দাওয়ায় মাদুর বিছিয়েছে শিবনাথ। এ ঘরে ওরা তিনজন। মাঝে শ্যামামালতী আর দু পাশে ওরা দুজন। রূপমঞ্জরী ও মালতী।

ভোররাত্রে একটা বিচিত্র স্বপ্ন দেখল রূপমঞ্জরী।

সে যেন উপনীত হয়েছে এক সর্পিল পার্বত্য পাকদণ্ডি পথে। ও যেন ধীর পদক্ষেপে চড়াই ভেঙে উপরে উঠছে। তুষারাবৃত এক পর্বতচূড়ায়। ‘উত্তরস্যাংদিশি’ পৃথিবীর মানদণ্ডস্বরূপ এক পর্বতমালা আছে জানো তো? তারই অযুত-নিযুত গিরিশৃঙ্গের এক অজানা শিখরে। সানুদেশ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে ‘ধূমঃ- জ্যোতি-সলিল-মরুতাং সন্নিপাতঃ জলভরা মেঘের দল। মাঝে মাঝে ঘন-কুয়াশায় আবৃত হয়ে যাচ্ছে দিগ্‌দিগন্ত। হঠাৎ নজর হল : অগ্রবর্তী এক পথিকের দিকে। চিনতে পারল না, অথচ খুব চেনা-চেনা লাগছে। মস্তকে অবিন্যস্ত ধূলিধূসরিত কেশদাম। পরিধানে গৈরিক কাষায়। ঊর্ধাঙ্গে কম্বল, হস্তে সন্ন্যাসদণ্ড। ও তাকে পিছন থেকে চিৎকার করে ডাকতে গেল। কী আশ্চর্য! নামটা মনে পড়ছে না। অগ্রবর্তী পথিক ইতিমধ্যে সম্মুখস্থ পাকদণ্ডি পথে অন্তহৃত। আর তখনই চরাচর আবৃত হয়ে গেল ঘন কুয়াশায়। জলীয় বাষ্প অপসারিত হবার পর দেখল সেই পাকদণ্ডি বাঁকে ওপাশে থেকে বিপরীত মুখে অগ্রসর হয়ে আসছেন এক অশ্বারোহী। ওকে দেখামাত্র অশ্বটি রূপমঞ্জরীর দুই স্কন্ধে তার সম্মুখের পদদ্বয় উঠিয়ে দিতে চাইল—সেই সেদিনের সৈনগুপ্তের মতো। দুরন্ত ভয়ে ও চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু কণ্ঠে স্বর ফুটল না। বিজয়োল্লাসে অশ্বটি হ্রেষাধ্বনি করে ওঠে।

তৎক্ষণাৎ ঘুমটা ভেঙে যায়। দুঃস্বপ্নের প্রভাবে অথবা ভাদ্রের প্রচণ্ড গরমে ও ঘর্মাক্ত। পালঙ্কে উঠে বসে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছতে থাকে!

তৎক্ষণাৎ পুনরায় হ্রেষাধ্বনি!

প্রচণ্ড চমকে ওঠে রূপমঞ্জরী। এ কী হচ্ছে! এখন তো ও স্বপ্ন দেখছে না! বাবামশাই তো সৈনগুপ্তের পিঠে সওয়ার হয়ে ভিন গাঁয়ে গেছেন। তাহলে ওদের সদর দরজায় এ হ্রেষাধ্বনির অর্থ কী? একটাই অর্থ হতে পারে। যে কোন হেতুতেই হোক রূপেন্দ্রনাথ প্রত্যাগমন করেছেন। ও দ্রুতপদে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। নজর হয়, শিবনাথ দাওয়াতে নিদ্রাগত নয়। সম্ভবত উত্তরের ছাটে বর্ষার জলে বিড়ম্বিত হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ইতিমধ্যে পুব আকাশে ফুটছে আলোর আভাস। গাছের শাখায় শাখায় সহস্র-বিহঙ্গের কাকলি-কলতান। হঠাৎ সদর-দরজায় করাঘাত হল। মামণি এগিয়ে গেল সেদিকে। জানতে চায় : কে?

ওপ্রান্তবাসী বলে, দ্বার খুলে দাও রূপা। অতিথি!

দুরন্ত আবেগে ওর দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। দ্বারের অর্গল অপসারিত করে। ও প্রান্তে সৌম্যসুন্দর। এখন ও মুণ্ডিতমস্তক নয়। কচি দুর্বাঘাসের মতো মাথায় ঘন সবুজরঙা কেশাঙ্কুর!

—তুমি! এত সকালে! কোথা থেকে?

সৌম্য বলে, হাত পাত দেখি। একটা জিনিস দেব।

রূপমঞ্জরী তার দুটি হাত অঞ্জলিমুদ্রায় প্রসারিত করে দেয়।

সৌম্য স্পর্শ-বাঁচিয়ে সেই অঞ্জলিতে নামিয়ে দেয় একটি ভাদ্রের ফোটা-কদম ওদেরই উদ্যানের। যে কদমগাছের কাণ্ডে এখন ফুল্লরা বাঁধা আছে। ‘ফুল্লরা’ ঘোষালবাড়ির অশ্বিনী।

রূপমঞ্জরী বলে, হাতে দিলে কেন? খোঁপায় গুঁজে দেবে না?

ম্লান হাসে সৌম্য। বলে, সেটুকু রসজ্ঞান আমার আছে, রূপা। কিন্তু আমার একটি ব্রত চলছে। তাই আমাকে যদি প্রণাম করতে চাও পদস্পর্শ কোরো না!

চমকে উঠে বলে, সেকি! তুমি আমাকে ছোঁবে না?

—মহাগুরুনিপাতের প্রথম বৎসরটুকু। চল, ভিতরে যাই। বাবামশাই গাত্রোত্থান করেননি এখনো?

রূপমঞ্জরী বোধহয় কিছু ক্ষুব্ধা। নিয়মভঙ্গের পর এ জাতীয় বিধিনিষেধ আর থাকে না। বলে, তিনি ভিন গাঁয়ে গেছেন। এস, ভিতরে এস। আমি সদরটা বন্ধ করি।

১৪

মালতী বলে, ঠাকুরপো আজই সন্ধ্যায় ফিরে আসবেন। তাঁকে যা বলতে এসেছ তখন বোলো।

—না, সোনা-মা। আমি এখনি রওনা হব। দ্বিপ্রহরে সোঞাই ঘাট থেকে একটি যাত্রীবাহী নৌকা ছাড়বে। আমি তাতেই নবদ্বীপ ফিরে যাব। মাঝিভাইকে বলা আছে। সে স্থান-সংরক্ষণ করে রেখেছে।

রূপমঞ্জরী প্রশ্ন করে, আর ফুল্লরা?

—মেঘুদা আসছে পদব্রজে। সে বাবার একজন বিশ্বস্ত পাইক। সেই ফুল্লরাকে এ বাড়ি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

নিয়মভঙ্গের পরদিনই সৌম্যসুন্দর নবদ্বীপ প্রত্যাবর্তন করেছিল। কিন্তু মাসখানেক পরে খুড়োমশায়ের জরুরি তলব পেয়ে তাকে আবার গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে। জানা গেল, কাকা ও দাদা ওর উপর প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছেন। যেহেতু সে রূপেন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করার কোনও চেষ্টা করেনি। সম্পত্তি দখলের সুরাহা এখনো হয়নি। নায়েব-কানুনগো-মশাই উপরমহলে সম্পত্তির অর্ধেক নবাবী তহবিলে খাশ করার সুপারিশ করেছেন। বাকি অর্ধেক ওয়ারিশবর্গের মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে। নবাবের অর্থদপ্তর এখন টালমাটাল। একটু স্থিরতা লাভ করলেই ঘোষালমশায়ের ‘ইচ্ছাপত্র’ অনুসারে সেই একবগ্গা দীঘির খননকার্য শুরু হতে পারে। সরকারি তত্ত্বাবধানে। যেহেতু অছি-পর্ষদের এক-তৃতীয়াংশ সহযোগিতা করছেন না, তবে সে কাজ কবে শুরু হবে, আদৌ হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে নবাবের ইচ্ছায়।

ফলে পরিবারের সকলেই সৌম্যসুন্দরের উপর মর্মান্তিক বিরক্ত।

মালতী জানতে চায়, মামণিকে তুমি শ্রাদ্ধবাড়িতে যেতে বারণ করেছিল কেন, বাবা?

—আপনি জানেন না, সোনা-মা, আমাদের পরিবারে—শুধু আমাদেরই নয়, তিজলহাটির সব ব্রাহ্মণ পরিবারেই—একটি কদর্য প্রথা প্রচলিত আছে। যে কয়জনের মহাগুরুনিপাত হয়েছে তাদের ধর্মপত্নীদের ওই দশ দিন একবস্ত্রা হয়ে থাকতে হয়। শ্রাদ্ধান্তে তারা বস্ত্র পরিবর্তনের অনুমতি পায়। কোনও অধোবাস বা উত্তরীয় বস্ত্রখণ্ড অননুমোদিত। সে এক বীভৎস ব্যাপার। পুরুষমানুষের ভিড়ে ঠাসা সেই জনাকীর্ণ শ্রাদ্ধবাড়িতে নববধূর সে এক চরম বিড়ম্বনা! এমনকি স্নানান্তে অঙ্গমার্জনার অধিকার পর্যন্ত তার নাই। সিক্ত বস্ত্র সেই একবস্ত্রার অঙ্গেই শুখায়! প্রচণ্ড মাঘের শীতেও!

রূপমঞ্জরী অবাক হয়ে বলে, দিদিকে তাই করতে হয়েছিল? একবস্ত্রে ভিজে কাপড়ে অমন ভিড়ে-ঠাসা বাড়িতে?

—হ্যাঁ, রূপা! সে দশদিন আমি বৌঠানের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। সৌম্য এতই উত্তেজিত যে, তার খেয়াল হয় না সোনা-মার সম্মুখেই সে তার স্ত্রীকে জনান্তিক-সম্বোধন করে বসেছে। রূপমঞ্জরীরও তা খেয়াল হল না।

মালতী প্রশ্ন করে, মাসখানেকের মধ্যেই এভাবে তোমাকে ডেকে পাঠানো হল কেন? কী জরুরি প্রয়োজন হয়েছিল?

ম্লান হাসল সৌম্য। বলল, সেও এক ন্যক্কারজনক ব্যাপার। বাবামশায়ের ‘ইচ্ছাপত্রে’র জন্য যেহেতু আমরা তিনজন সম্পত্তির অধিকার এখনো পাইনি সেজন্য ওঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। আমার পিতৃদেবের উপর তো শোধটা তোলা যাবে না, তাই ওঁদের সবটা রাগ এসে পড়েছে আমার শ্বশুরমশায়ের উপর। ওঁদের বক্তব্য, তিনি ওই শংসাপত্রে স্বীকৃতি দিলেন না বলেই আমাদের এতবড় আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেল—

—তার সঙ্গে তোমাকে ডেকে পাঠানোর কী সম্পর্ক?

—ওঁরা প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। দাদা এবং খুড়ামশাইয়ের নির্দেশ আমি যেন আমার প্রথমা পত্নীকে পরিত্যাগ করি।

—প্রথমা?

—হ্যাঁ মামণি। ওঁরা একটি দ্বিতীয়ার সন্ধান ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। কোষ্ঠি বিচার করে জানা গেছে যে, আমার সঙ্গে তার রাজযোটক। খুড়ামশাই এতদূর ক্ষিপ্ত যে, অবিলম্বে আমার দ্বিতীয় বিবাহের আয়োজন করতে চান!

—অবিলম্বে? মানে, কালাশৌচ না কাটতেই?

—আপনি জানেন না? শাস্ত্রে সে বিধান অনুমোদিত? জরুরি প্রয়োজনে এসব ক্ষেত্রে সপিণ্ডকরণ করা যায়!

মালতী অবাক হয়ে যায়। রূপমঞ্জরী প্রস্তরমূর্তি!

সৌম্যসুন্দরই আবার শুরু করে, সেই বিষয়েই বাবামশায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছিলাম।

ক্ষুব্ধ মালতী বলে ওঠে। ঠাকুরপো কী বলবেন? সে তো তোমার অভিরুচি, বাবা! কুলীন ঘরের সুপাত্র! পাঁচটা নয়, সাতটা নয়, মাত্র দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ তো স্বাভাবিক ব্যাপার!

—না, সোনা-মা! সর্বক্ষেত্রে তা স্বাভাবিক নয়; গুরুদেব তর্কসিদ্ধান্ত-মহাশয় কুলীন, কিন্তু একপত্নিক। আমার শ্বশুরমশাইও তাই, উপরন্তু তিনি বিপত্নীক!

রূপমঞ্জরী প্রশ্ন করে, সেই মেয়েটিকে তুমি দেখেছ?

হাসল সৌম্যসুন্দর। বলে, দেখেছি। দেখতে বাধ্য হয়েছি। কবেই তাকে আমাদের বাড়িতেই এনে রাখা হয়েছিল। যাতে আমি দেখি।

—তুমি রাজি হওনি?—জানতে চায় মালতী।

—এই অবান্তর প্রশ্নের প্রত্যুত্তর কি সত্যিই চাইছেন?

এতক্ষণে হাসি ফুটল আমাদের বালিকাবধূর মুখে। সে সোনা-মার দিকে ফিরে বলল, আমি কি উনানে দুটি ভাত বসিয়ে দেব?

মালতী সচকিত হয়ে ওঠে। বলে, না, না। আমি ওদিকটা দেখছি। তোরা দুজন গল্প কর।

মালতী চলে যেতে সৌম্য বলে, তোমার বাবার কাছে একটা প্রস্তাব আমি রেখেছিলাম, তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই। আয়ুর্বেদশিক্ষা শেষ করে আমরা দুজন তিজলহাটিতে একটি আরোগ্যনিকেতন প্রতিষ্ঠা করব। পুরুষ রোগীদের চিকিৎসা করব আমি, আর মহিলামহলের দায়িত্ব তোমার তো?

—জানি। শুনেছি বাবার কাছে।

—তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই প্রস্তাবটা করেছিলাম বলে তুমি ক্ষুণ্ণ হওনি

রূপমঞ্জরী ওর কথাটাই ফিরিয়ে দিল, এই অবান্তর প্রশ্নের প্রত্যুত্তর কি সত্যই চাইছ?

—না, চাইছি না। আমি জানতাম। কিন্তু অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, সেটা বোধহয় সম্ভবপর হবে না। ওঁদের সপিণ্ডকরণের প্রস্তাব আমি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছি। দাদা আর খুড়োমশাই বাবার শ্রাদ্ধান্তে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মভঙ্গ করেছেন। কিন্তু আমি করিনি! আমি এক বৎসর এই অশৌচ পালন করব। এই দ্যাখ রূপা, আমি নখ পর্যন্ত কাটিনি। ফলে ওঁরা আর পীড়াপীড়ি করতে সাহস পাননি। কিন্তু বাৎসরিক শ্রাদ্ধের পর একটা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম অনিবার্য! বাবামশাই যে একাদশীতে উপবাস করেন এটা নিয়ে ওঁরা উপহাস করেন। এই আচারের আন্তর-গভীরতায় ওঁরা প্রবেশ করতে পারেন না। ফলে, আশঙ্কা করছি, বাৎসরিক শ্রাদ্ধের পরে আমি পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত হব। আমার সম্পত্তির অংশ তখন ওঁরা দুজন দখল করে নেবেন। এ নিয়ে কাজির বিচার আমি চাইব না। তাহলে কোথায় পাতব আমাদের সংসার?

—কালোহ্যয়ং নিরবধি, বিপুলা চ পৃথ্বীঃ! আমাদের সারাটা জীবনই পড়ে আছে, আর এই গৌড়মণ্ডলে রোগশূন্য কোন গ্রাম আছে বলে তো আমার জানা নেই। আমাদের যদি নিষ্ঠার অভাব না থাকে তবে বঙ্গদেশের যেকোন বর্ধিষ্ণু গ্রামে গিয়ে আমরা আমাদের সাধনা শুরু করতে পারি!

সেদিন সন্ধ্যাতেই ফিরে এলেন রূপেন্দ্রেনাথ। শুনলেন সবকিছু। বললেন, এখনো এগারো মাস সময় আছে। একটা কোন উপায় হবেই।

১৫

দিনকতক পরে একদিন সকালে হাঁক শুনলেন, রুপোভায়া আছ নাকি?

চমকে উঠলেন রূপেন্দ্রনাথ। এ কণ্ঠস্বর তো ভুল হবার নয়। এ নির্ঘাৎ তারাদার আহ্বান। দ্রুত এগিয়ে গেলেন সদর দরজা খুলে দিতে।

শুভপ্রসন্ন গৃহত্যাগ করার পর এ কয় মাস তারাপ্রসন্ন গৃহের বাহিরে পদার্পণ করেননি। ক্ষৌরকর্ম করেন না। শ্মশ্রু এখন প্রায় বুক সই সই। দ্বিতলে বারান্দায় পদচারণা করেন শুধু। তারাসুন্দরীর অবস্থা আরও সঙ্গীন। তিনি বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। যন্ত্রের মতো চলাফেরা করেন। রূপেন্দ্রনাথ তাঁর চিকিৎসার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রোগি কোন কথারই জবাব দেননি। ফলে আয়ুর্বেদমতে তাঁর চিকিৎসা হতে পারেনি।

রূপেন্দ্র জানতে চান, বৌঠান এখন কেমন আছেন, তারাদা?

—সেই একই রকম! কাঁদে না, হাসে না। কারও সঙ্গে কোন কথাও বলে না। দুনিয়ার ওপর তার প্রচণ্ড অভিমান! এর কি কোন চিকিৎসা নেই রূপেন?

—আছে। তবে চিকিৎসা করার দায় তোমার। একটাই ওষুধ : ভালবাসা। সহানুভূতি।

—কিন্তু ও যে কথাই বলে না। ডাকলে সাড়া পর্যন্ত দেয় না। ও কিছু শুনতেও পায় না।

—না, তারাদা। ভুল করছ। বৌঠান শুনতে পান ঠিকই। অর্থগ্রহণও হয় তাঁর। কিন্তু প্রচণ্ড অভিমানে তিনি মূক হয়ে আছেন। ওঁর মানসিক শান্তি হয় তো ফিরে আসতে পারে যদি উনি মন্ত্রদীক্ষা নেন। জপতপের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন।

—আমি চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের কুলগুরু ওকে দীক্ষা দিতে স্বীকৃতও হয়েছিলেন। কিন্তু ও সাড়া দিল না। হাঁ-না কোন কথাই বলল না।

রূপেন্দ্র একটু নীরব থেকে বললেন, ওঁকে বল, আমি বলেছি বলেই বল—ঠিকই শুনতে পাবেন তিনি। বুঝতেও পারবেন। বল যে, রূপেন মনে করিয়ে দিতে বলেছে, তিনি যে আঘাতটা পেয়েছেন তার দ্বিগুণ আঘাত পেয়ে আর এক মা কিন্তু তাঁর ঈশ্বর ভক্তি থেকে বিচলিত হননি। বৌঠানই বা পারবেন না কেন?

একটু চিন্তা করে তারাপ্রসন্ন বলেন, তুমি কার কথা বলছ রূপেন?

—শচীমাতা! তাঁর দুই উপযুক্ত পুত্রই মাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। বিশ্বশুরদেব আর শ্রীচৈতন্যদেব।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তারাপ্রসন্নের। বললেন : তুমি তাকে নিজমুখে পরামর্শ দেবে মন্ত্রদীক্ষা নিতে?

—তোমাদের একটা ভুল হয়েছিল তারাদা। তোমাকে গুরুনিন্দা শোনাচ্ছি না। কিন্তু বৌঠানের দৃষ্টিভঙ্গিতে শুভপ্রসন্নের গৃহত্যাগের জন্য তোমার গুরুদেবই মূলত দায়ী।

—থাক রূপেন্দ্র, বাকিটা বুঝেছি। তুমি কোন সদ্গুরুর সন্ধান দিতে পার?

—পারি। তুমি বৌঠানকে বল : ‘রূপেন বাঁড়ুজে জীবনে কখনো কাউকে মন্ত্রদীক্ষা দেয়নি। সে তা দেয় না। কিন্তু বৌঠানের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম একবগ্গা ভাঙতে রাজি। তিনটি শর্তে! এক : মন্ত্র গ্রহণে তাঁর আন্তরিক আগ্রহ থাকা চাই, অর্থাৎ কারও উপরোধে এ কাজ করছেন না; দুই : আমাকে তিনি দীক্ষাগুরু হিসাবে স্বীকার করতে রাজি; তিন : গুরুকে উপযুক্ত গুরুদক্ষিণা দিতে তিনি স্বীকৃত।

তারাপ্রসন্ন অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন বক্তার দিকে। তারপর জানতে চাইলেন, গুরুদক্ষিণাটা কী?

—বৌঠানকে বল, রূপেন ধ্যানের দৃষ্টিতে মানসযাত্রী এক সন্ন্যাসীকে দেখতে পায়। দেখতে পায় যে, সেই সন্ন্যাসী তার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারছে না তার মায়ের দুর্মনস্যতার জন্য! সে মাতৃঋণ পরিশোধ করে যায়নি বলে। মা বিষ্ণুপ্রিয়ার তবু একজোড়া খড়ম জুটেছিল, কিন্তু শচীমাতা? তিনি আত্মহত্যা করেননি, মৌন অবলম্বন করেননি। ‘নামগানে’র মধ্যে ‘আনন্দস্বরূপ’কে লাভ করেছিলেন।

তারাপ্রসন্ন নীরবে অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বলেন : বলব তাকে। এখন যে কারণে তোমার কাছে এসেছি তা বলি। একটি মর্মান্তিক কথা কানে এল—জানতে চাইছি, সেটা কি সত্য? সৌম্যবাবাজি নাকি মামণিকে ত্যাগ করতে চলেছে? বাৎসরিক শ্রাদ্ধ সেরেই দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করবে?

রূপেন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন না এ খবর উনি কোথায় শুনেছেন। পরিবর্তে আদ্যোপান্ত সব কথা বিস্তারিত জানালেন।

তারাপ্রসন্ন বলেন, তুমি আমার কোন অনুরোধই কখনো শোননি। আজ একটা শুনবে?

—কী অনুরোধ!

–তোমরা বল কাল অনন্ত কাল নিরবধি। আমরা সাধারণ মানুষ। তাই জানি, মানুষের জীবনে কাল ক্ষণস্থায়ীমাত্র। কয়েক দশক পরে তুমিও থাকবে না। আমিও থাকব না। কিন্তু সোঞাই গ্রামটা থাকবে। থাকবে রোগাক্রান্ত নরনারীর আর্তনাদ। আমি তাই এক সাহ্মণকে একটি বাস্তু দান করতে চাই। যাতে পরবর্তী প্রজন্মেও তোমার ধারাটা এ গাঁয়ে বজায় থাকে। ওরা দুজন তোমার অধীনে চিকিৎসা শুরু করবে, ধীরে ধীরে দায়িত্বভার গ্রহণ করে নেবে। তোমার কোন পুত্রসন্তান নাই, আমার থেকেও নাই, তাই বৃদ্ধ বয়সে তুমি, আমি, তোমার বৌঠান ওদের সেবাযত্নে দিনযাপন করতে পারব। তবে হ্যাঁ, আমি জানি তার গুরুদেব রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত-মশাই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার শ্বশুরও একই রকম একবগ্গা। ফলে, সে যদি আমার দান গ্রহণে অস্বীকৃত হয়, তাহলে তাকে বল, ওটাকে সে যেন ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে। ওরা দুজন উপার্জনক্ষম হবার পর আমি সে ঋণশোধের অর্থগ্রহণ হাত পেতে নেব। সে অর্থ কার ভোগে লাগবে তা অবশ্য ঈশ্বরই জানেন!

রূপেন্দ্র সংক্ষেপে বললেন, তোমার প্রস্তাব তাকে জানাব।

—’জানাব’ নয়, রূপেন। তুমি এখনি নবদ্বীপে চলে যাও। তাকে সব কথা বলে ফিরে এসে আমাকে জানাও। আমি ওর গৃহনির্মাণের কার্য শুরু করে দিই। বাৎসরিক-শ্রাদ্ধান্তে সে এসে গৃহপ্রবেশ করবে। সেটা সে দান হিসাবে গ্রহণ করুক অথবা ঋণ।

*

মালতী আর মামণিকে তারাপ্রসন্নের প্রস্তাবের কথা জানালেন।

মামণি নতনয়নে নীরব রইল, মালতী কিন্তু ইতস্তত করে বলে, কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন, ঠাকুরপো যে, ষোলো বছর বয়স না হলে মেয়েদের দ্বিরাগমন হওয়া উচিত নয়?

—হ্যাঁ, তাই বলেছিলাম। কিন্তু সেটা হচ্ছে সাধারণ-সূত্র। আমার কন্যা এবং জামাতা অ-সাধারণ। সাধারণ সূত্রের পশ্চাদপটের তাৎপর্যটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলে ওরা বুঝবে। ব্যতিক্রমই নিয়মের পরিচায়ক।

১৬

প্রায় একটি বছর পার হয়ে গেল। আবার শ্রাবণ এসেছে ফিরে। আজ শ্রাবণের শুক্লাষ্টমী। তিন দিন পরে তিজলহাটিতে পাঁচকড়ি ঘোষাল মশায়ের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ। যতদূর খবর পেয়েছেন সৌম্যসুন্দর এখনো নবদ্বীপ থেকে এসে পৌঁছায়নি। বাৎসরিক শ্রাদ্ধে রূপেন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণ হয়নি। তিনি প্রত্যাশাও করেননি। কিন্তু স্থির করছেন, অনিমন্ত্রিতই যাবেন। মালতীর প্রচণ্ড আপত্তি, নেমন্তন্ন না করলে কেন যাবেন?

—যেহেতু তিনি ছিলেন আমার বৈবাহিক এবং খাঁটি মানুষ! তবে এবার আমি একা যাব না। মামণিকে সঙ্গে নিয়ে যাব। অবশ্য সে যদি আপত্তি না করে।

মালতী গর্জে ওঠে, না! ও তো আর আপনার মতো উন্মাদ নয়।

রূপমঞ্জরী প্রতিবাদ করে, না সোনা-মা। আমিও যাব। যাওয়াটা আমার কর্তব্য। সেবারও যেতাম, আপনাদের জামাই বারণ না করলে।

সংবাদ পেয়ে তারাপ্রসন্ন ছুটে এলেন, না রূপেন! তুমি যেও না!

—কেন এভাবে আপত্তি কর বল তো, তারাদা? বারে বারে তোমার অবাধ্য হতে আমার খারাপ লাগে না? তুমি জানই আমি যা স্থির করি—

—হ্যাঁ জানি! তুমি সংশোধনের বাইরে। চিরটাকাল একবগ্গা।

এবার কিন্তু কথা রাখতে পারেননি। বৈবাহিকের বাৎসরিক শ্রাদ্ধে তাঁর যাওয়া হয়নি। মর্মবিদারক হেতুতে। সূতিকাগৃহে কুসুমমঞ্জরীর মৃত্যু ব্যতিরেকে এতবড় আঘাত তিনি জীবনে পাননি!

১৭

যেকথা বলছিলাম—শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী। সেদিন সকালে রূপেন্দ্রনাথ প্রাতরাশে বসেছেন। রান্নাঘরের সম্মুখের দাওয়ায়। মালতী দুধটা জ্বাল দিচ্ছে। মামণি একটি পাঙ্খা হাতে বসেছে মক্ষিকা-বিতারণ মানসে। সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিল। এখন একটু ধরেছে। সহসা ওঁর গৃহদ্বারে শ্রুত হল এক বিকট তূর্যনিনাদ। ওই সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি। সচকিত হয়ে ওঠে সবাই! মালতী রান্নাঘর থেকে বলে ওঠে, ও কীসের শব্দ?

রূপমঞ্জরী বলে, দেখে আসব বাবা?

—না। আমিই দেখছি! আমার ভিটার সামনে শিঙা বাজায় কে? দ্রুতপদে উঠে গিয়ে সদরদ্বার উন্মুক্ত করে দাঁড়ালেন।

বিচিত্র দৃশ্য। গৃহসম্মুখে তিন-চার জন অশ্বারোহী। কিছু বাজনদার আর জনাবিশেক লাঠিয়াল পাইক! তাদের মালকোঁচা-মারা খাটো ধুতি, মাথায় পাগড়ি, হাতে তৈলাক্ত লাঠি! লক্ষ্য করে দেখেন, অশ্বারোহীরা ইতিমধ্যে অবতরণ করেছে। একজন টলতে টলতে এগিয়ে আসে। যেন আকণ্ঠ কারণবারি পান করেছে। ওঁর সম্মুখে এসেই সে কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল। হাউমাউ করে কী বলল বোঝা গেল না। রূপেন্দ্র তাকে চিনতে পারেন : নকড়ি ঘোষাল!

—কী হয়েছে নকড়ি? অমন করছ কেন?

হাউমাউ করে ভূপতিত জোয়ানটা কী বলল এবারও বোঝা গেল না। মনে হল, জড়িত ভাষে সে বললে, সব্বোনাশ হয়ে গেছে তাঐমশাই।

এতক্ষণে এগিয়ে এসেছেন তিনকড়ি। ভ্রাতুষ্পুত্রকে ধমক দিয়ে ওঠেন; প্রচণ্ড আঘাত তুমি পেয়েছ নকড়ি, মানছি! কিন্তু শুভকাজে চোখের জল ফেলতে নেই! ওঠ! ওঠ! উঠে দাঁড়াও।

এবার তাঁকেই প্রশ্ন করেন, কী হয়েছে? আপনিই বলুন?

–ও যা বলল তাই হয়েছে বেয়াইমশাই : সর্বনাশ! নিদারুণ সর্বনাশ!

—সেটা কী? কোথায় হল?

—তিজলহাটির ব্রহ্মডাঙার মাঠে। কাল সন্ধ্যারাত্রে। সৌম্য খেয়াঘাট থেকে বাড়ি ফিরছিল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে। হঠাৎ-মাঠের মাঝখানে—

—কী? সর্পাঘাত?

—না, বেয়াইমশাই! তাহলে তো কাল রাত্রেই খবর পেতেন। এ শিবের অসাধ্য ব্যামো! সৌম্য মারা গেছে বজ্রাঘাতে!

মাথার মধ্যে টলে উঠল ওঁর। চৌকাঠ ধরে ধীরে ধীরে বসে পড়লেন। গোময়লিপ্ত উঠানে। অজ্ঞান হননি; কিন্তু যেন বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেছে।

১৮

তূর্যধ্বনিতে সারা গ্রাম মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠেছিল। অনেকেই বাড়ির বাইরে এসে দেখতে পায় একবগ্গা-ঠাকুরের বাড়ির সামনে একটা অপ্রত্যাশিত জনসমাবেশ- ঘোড়সওয়ার, বাদক, লাঠিয়াল, পাইক। কী ব্যাপার? দাবানলের মতো কিছুক্ষণের মধ্যেই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটা ছড়িয়ে পড়ল সারা গাঁয়ে। এই তো সেদিন সেই ছেলেটি টোপর-মাথায় এসেছিল। চন্দনচর্চিত ললাটে। রাজপুত্রের মতো। সোঞাই গাঁয়ের রাজকুমারীর সন্ধানে। সে আজ অমর্ত্যলোকের বাসিন্দা। পিলপিল করে মানুষজন ছুটে আসে বাঁড়ুজেবাড়ির সামনে। অথচ গৃহস্বামী সেই যে প্রস্তরমূর্তির মতো দ্বারের পাশে বসে পড়েছেন তাঁর বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসেনি। তিনি জানতেও পারেননি—বাড়ির ভিতর তাঁর আদরের মামণি মূর্ছিতা হয়ে পড়ে আছে। মালতী দাঁতে-দাঁত দিয়ে বসে আছে তার মাথাটি কোলে তুলে নিয়ে। শোভারানী বারে বারে জলের ঝাপটা দিচ্ছে মুখে। বাতাস করছে জোরে জোরে।

বাড়ির দ্বারে এসে উপস্থিত হয়েছেন সমাজপতিরাও—নন্দখুড়ো, শিরোমণি এবং তারাপ্রসন্ন।

তারাপ্রসন্নই প্রশ্নটি পেশ করলেন প্রথমে, তা এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি জানাতে আপনারা বাজনদার সঙ্গে করে আনলেন কেন?

তিনকড়ি তাঁকে নমস্কার করে বলেন, আপনাকে চিনতে পেরেছি, ভাদুড়ীমশাই!

—সেটা আমার সৌভাগ্য, কিন্তু প্রশ্নের জবাব নয়!

—আমরা যে বধূমাতাকে নিয়ে যেতে এসেছি। ওদিকে তিজলহাটিতে সব ব্যবস্থা হচ্ছে। সারা গ্রাম প্রতীক্ষা করছে। বৌমার পদধূলি গ্রহণ করতে। পালকি আমরা সঙ্গে নিয়েই এসেছি। সতী-মা তিজলহাটিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত যে অপঘাতে-মৃত হতভাগ্যের সৎকার করা যাবে না!

তারাপ্রসন্নের ওষ্ঠাধর শুধু উচ্চারণ করল : সতী-মা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! বহুদিন পরে আজ পঞ্চগ্রামে সহমরণের আয়োজন করা হয়েছে!

একটু বিলম্ব হল প্রত্যুত্তর করতে। তারপর তারাপ্রসন্ন বললেন, রূপেন বাঁড়ুজ্জে—আমি যতদূর জানি—সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে। সে নিশ্চয় সম্মত হবে না–

বাধা দিয়ে তিনকড়ি বলেন, কন্যা-সম্প্রদানের পর ওঁর মেয়েটি আর তো বাঁড়ুজ্জে-বংশের নয় ভাদুড়ীমশাই। সে এখন সৌম্যসুন্দর ঘোষালের ধর্মপত্নী। তাকে তার স্বামীর সেবা করতে একই সঙ্গে স্বর্গে যেতে হবে। এটাই শাস্ত্রীয় নির্দেশ! এটাই আমাদের কুলপ্রথা!

তারাপ্রসন্ন জানতে চাইলেন না,—সেক্ষেত্রে পাঁচকড়ি ঘোষালমশায়ের সেবা করতে তাঁর ধর্মপত্নীকে আপনারা স্বর্গে পাঠাননি কেন?

তিনকড়ি বলেন, আপনারা বধূমাতাকে বধূবেশে সাজিয়ে দিন। অহেতুক বিলম্ব করবেন না। যে ভাবে কন্যাটি সম্প্রদান করা হয়েছিল সেই সাজে তাকে অনুগ্রহ করে সাজিয়ে দিতে বলুন!

তারাপ্রসন্ন ধমকে ওঠেন, কিন্তু বলবটা কাকে? দেখতেই তো পাচ্ছেন সে এই মর্মান্তিক আঘাতে পাথর হয়ে গেছে!

–শোক তো আমরাও পেয়েছি! কিন্তু ধর্মীয় আচার তো পালন করতেই হবে! দোষ তো ওঁরই। যোটক বিচার না করেই—একবছরের ভিতরে শ্বশুর এবং স্বামী—

নন্দখুড়ো এতক্ষণে যোগদান করেন আলোচনায়, এ বড় কঠিন কাজ তারাভাই। আমা:ই কি বুকটা ফেটে যাচ্ছে না? কিন্তু কী করবে? এই হচ্ছে শাস্ত্রের নির্দেশ। আমি বরং ‘তামার দুই খুড়িমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাঁরাই রূপমঞ্জরীকে বধূবেশে সাজিয়ে দেবেন।

তারাপ্রসন্ন কঠিন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। তারপর রূপেন্দ্রনাথের বাহুমূল ধরে ডাকেন, রূপেন! রূপেন! কথা শোন! ওঠ!

কোন সাড়া জাগল না। রূপেন্দ্রনাথ দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নিশ্চল বসে আছেন। সেই যেখানে বহুদূর আকাশে একটা সূর্যসাক্ষী চিল ক্রমাগত চক্রাকারে পাক খাচ্ছে।

তারাপ্রসন্ন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। কী একটা কথা বলতে গেলেন। পারলেন না। নন্দ তাগাদা দেন, অহেতুক বিলম্ব কর না তারাপ্রসন্ন! আমি জানি, মামণির যাবতীয় অলঙ্কার তোমার কাছে গচ্ছিত রাখা আছে, সেগুলি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর। সালঙ্কারা কন্যা সম্প্রদান করেছিল রূপেন। সেগুলি এখন ঘোষালবংশের সম্পত্তি! সে বেশেই সতী-মা যাবে!

হঠাৎ রুখে দাঁড়ান তারাপ্রসন্ন, না খুড়ো! আপনি ভুল করছেন। রূপেন সালঙ্কারা কন্যা সম্প্রদান করেছিল তার জামাতাবাবাজিকে। ঘোষাল পরিবারকে নয়। রূপেন যতক্ষণ না অনুমতি দিচ্ছে ততক্ষণ তার গচ্ছিত ধনও আমি অন্য কারও হাতে তুলে দিতে পারি না।

—তা বেশ তো! অনুমতি নাও। সর্বসমক্ষে। আমরা স্বকর্ণে শুনি সে শাস্ত্রবিরোধী কথা বলে কিনা।

তারাপ্রসন্ন আবার বাহুমূল ধরে ঝাঁকি দিলেন রূপেন্দ্রকে। তিনি নির্বাক।

নন্দ বলেন, দেখলে তো! সম্মতিও দিচ্ছে। মুখে বলছে না। তাই মৌনং সম্মতি লক্ষণম্!

তারাপ্রসন্ন বলেন, আজ্ঞে না। মর্মান্তিক শোকে মানুষ মূক হয়ে যায়। পাথর হয়ে যায়! আমি জানি। এটা তার সম্মতির লক্ষণ নয়।

তিনকড়ি বলেন, শুনুন ভাদুড়ীমশাই, এমন একটা বাধা সৃষ্টি হবে সেরকম আশঙ্কা আমাদের ছিলই। সেজন্য আমরা প্রস্তুত হয়েই এসেছি। আপনার ডানদিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। ওরা সুদক্ষ বিহারী লাঠিয়াল। কিন্তু এখানে এখন শুভকার্যের প্রারম্ভে আমি রক্তগঙ্গা বহাতে চাই না! আপনি কি বধূমাতার অলঙ্কারগুলি পাঠিয়ে দেবেন? সাজাবার দরকার নেই। সে কাজ আমরা ওখানেই করে নিতে পারব।

তারাপ্রসন্ন দেখলেন একসার লাঠিয়াল সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান। তারা প্রভুর আজ্ঞার প্রতীক্ষায় আছে। মুহূর্তে কেমন যেন পরিবর্তিত হয়ে গেলেন তারাপ্রসন্ন। বলেন; আজ্ঞে হ্যাঁ! দেখেছি। এটা আমি ইতিপূর্বে খেয়াল করিনি। আমি স্বয়ং গহনার পুঁটুলিটা নিয়ে আসছি। তা এখানে কেন? আমার অতিথিশালায়—

তিনকড়ি তৎক্ষণাৎ বলেন, ও ফন্দি করবেন না ভাদুড়ীমশাই। ইঁদুরকলে আমরা মাথা গলাব না। এখানেই অপেক্ষা করছি। আপনি অনুগ্রহ করে একটু তাড়াতাড়ি করুন।

ভাদুড়ীমশাই তৎক্ষণাৎ বড়বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। ছত্রধর মিশিরজি চলল তাঁর পিছন পিছন। বাড়ির কাছাকাছি এসে তাকে বললেন, মিশির! এই চাবির থোকাটা খাজাঞ্চিবাবুকে দিয়ে আয়। তুরন্ত! বলবি ভীমা বা ঈশেনরা যদি চাইতে আসে তাহলে তাদের হাতে অস্ত্রাগারের ভীল ধনুকগুলি যেন বার করে দেয়।

হনহন করে দ্বিতলে উঠে গেলেন। পুঁটুরানীকে দেখতে পেয়েই বললেন, মর্মান্তিক খবরটা শুনেছিস? মামণি বিধবা হয়ে গেছে। ওরা তিজলহাটি থেকে লাঠিয়াল আর পাল্কি নিয়ে এসেছে। জোর করে মামণিকে সহমরণে পুড়িয়ে মারতে চায়!

পুঁটুরানী দু-চোখে আঁচল দিয়ে বলে, শুনেছি!

—কান্নার সময় অনেক পাবি। তুই ঠাকুরঘর থেকে বড় শঙ্খটা নিয়ে আয় দেখি।

পুঁটুরানী মুহূর্তমধ্যে হুকুম তামিল করল। তারাপ্রসন্ন বলেন, এবার দৌড়ে ছাদে চলে যা। শাঁখটা বাজিয়ে দে!

—আমার …আমার যে একটা ওষ্ঠব্রণ হয়েছে দাদা!

—আহ্! শাঁখ বাজাতেও পারিস না? তবে ওদের কাউকে ডাক—সদু, মোতির-মা কে কাছেপিঠে আছে দেখ!

তারাসুন্দরী নির্বাক বসেছিলেন একটু দূরে। ওঁদের কথাবার্তা যে শুনতে পাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছিলেন তা বোঝা যায়নি। হঠাৎ অদ্ভুত ভাবান্তর হল তাঁর। উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে এসে ননদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন শঙ্খটা। ছুটেই বার হয়ে গেলেন দ্বিতলের খোলা বারান্দায়। সহসা তীব্র শঙ্খধ্বনিতে সচকিত হয়ে উঠল বড়বাড়ি।

বর্গীর হাঙ্গামা সদ্য-অতীত। সেই মর্মান্তিক দিনগুলোর কথা ভুলে যায়নি সোঞাই গাঁয়ের কুলবধূরা। সেই সেদিনের নির্দেশ, সেই সেদিনের সঙ্কেতময় শঙ্খের শাঙ্খভাষে! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গোটা গ্রামটা শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল! ওরা অনেকেই জেনেছে ভিন গাঁ থেকে আবার এসেছে লুটেরা বর্গীর দল!

এখানেও সচকিত হয়ে ওঠেন তিনকড়ি ঘোষাল। তিনিও রাঢ়বাংলার অভিজ্ঞ মানুষ। এ সঙ্কেতের অর্থ তাঁর ভালমতো জানা! তৎক্ষণাৎ জ্ঞাতিভ্রাতার দিকে ফিরে বলেন, সুবল! আমি ভাল বুঝছি না। ওরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইছে। এখনি কাজ হাসিল না করলে ওরা পিলপিল করে ছুটে আসবে।

—আসে আসুক! আমাদের সঙ্গে তো বিশজন দক্ষ লাঠিয়াল আছে দাদা?

—তর্ক করিস না সুবল। যা বলছি কর। লছমনপ্রসাদকে বল, বৌমাকে দু-তিনজন পাঁজাকোলা করে তুলে আনুক। পাল্কিতে উঠিয়ে দে! আমরা এই মুহূর্তেই রওনা দেব। গাঁয়ের মানুষ জড়ো হওয়ার আগেই—

—কিন্তু গহনাগুলো?

পরে এসে সে ফয়শালা করব। সেগুলো ন্যায়ত-ধৰ্মত আমাদের।

সুবল লেঠেল সর্দার লছমনপ্রসাদকে হুকুম দিল—ওই মূর্ছিতা নারীদেহটা পাঁজকোলা করে তুলে আনতে। দু-তিনজন লাঠিয়াল এগিয়ে এল।

ভিড়ের মধ্যে, একটু দূরে এতক্ষণ ‘তিনমাথা এক করে’ বসেছিল একজন কঙ্কালসার বৃদ্ধ। খালি গা, মিশকালো গায়ের রঙ। অবিন্যস্ত মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। লোকটা হাত দুটি জোড় করে উঠে দাঁড়ালো। তিনকড়ির দিকে ফিরে বললে, মনে লাগে আপনেই তিজলহাটির কত্তামশাই। শুনুন দ্যাবতা!

—আগে বল তুই কে? কী নাম তোর?

—আজ্ঞে বাপে মোর নাম রাখিছিল ‘ভীমা’। মোরা জেতে বাগদি আজ্ঞে!

—তা বামুনপাড়ায় নাক গলিয়েছিস কেন? হারামজাদা বাগদির পো! জানিস না, তোদের ছায়া মাড়ালে আমাদের স্নান করতে হয়?

—জানি, দ্যাবতা। জানব না কেনে? আমার বাপ জানতো, জেঠা জানত—বাপের বাপ, তেনার বাপ জানত-

এতক্ষণ দু’হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ঝিম মেরে বসে ছিল নকড়ি। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ায়। ভীমাকে বলে, হট যাও বত্তমিজ! ইয়ে হ্যায় হামারা ইজ্জৎ-কা-সওয়াল!

ভীমা লক্ষ্য করে দেখল ওই উঠতি জোয়ানের চোখ দুটো রক্তবর্ণের। কেঁদে-কেঁদে হয়েছে, নাকি ভ্রাতৃশোকে অতিরিক্ত কারণবারি পান, তা জানে না। কিন্তু ও যে কী বলল তা বুঝল না। পার্শ্ববর্তীর দিকে ফিরে বললে, উ কী বুললেরে পেল্লাদ?

পেল্লাদ বায়েন শাঙ্কেরভাষ্য দাখিল করে, ছুটো হুজুর বুললে কি যে এটা হতিছে তিজলহাটির ইজ্জতের কতা! অরা লাঠির জোরে বাবাঠাকুরের মাইয়াডারে…..

—অ। বুঝছি!—আবার ভীমা তিনকড়ির দিকে ফেরে। জোড়হস্তে সবিনয়ে বলে, শোনেন দ্যাবতা! সোঞাই গাঁয়েরও তো টুক ইজ্জৎ আছে? না কী বলেন? শুভকাজে আমাদের গাঁয়ের এড্ডা মাইয়ারে নে-যাবেন। আমারা বাধা দিব কেন? কিন্তুক এমন আদুল গায়ে তাঁরে বিদায় দি’ ক্যামনে? জমিদারমশাই গয়নাগুলান নে-আসুক। মায়েরে সাজায়ে দিই শ্যাষবারের মতো। তারপর…

তিনকড়ি বুঝতে পেরেছেন ওই বাগদি-পোর মতলব—সেই যাকে পণ্ডিতেরা বলেন ‘অশুভস্য কালহরণম্’! নিদেন হাঁকেন, না! যেমন আছে তেমনিই উঠিয়ে নিয়ে যাব। লছমনপ্রসাদ-

আবার এগিয়ে আসে দু তিনজন লাঠিয়াল।

ভীমা তার পাঁজর-সর্বস্ব বুকটা চিতিয়ে দু-হাত দুদিকে বাড়িয়ে দেয়। ক্রুশবিদ্ধ যীশু খ্রিস্টের ভঙ্গিতে। বলে : খবরদার!!

—কী বললি হারামজাদা? “খবরদার’? তোর এতবড় দুঃসাহস! হারামজাদা বাগদির-পো!

জনতার মাঝ থেকে কে যেন চিৎকার করে ওঠে, ব্যাপারডা কী খুড়ো? তোমারে কি গাল দিল ওই ভিনগাঁয়ের হারামজাদ্ বামুনডা?

—না, না, গালি দেয় নাই! অরা বামুন, অরা দ্যাবতা। অরা কি তুর-আমার মতো বললতি মুখ-খারাপ করতি পারে? তু মেজাজ খারাপ করিস না।

তিনকড়ি নজর করে দেখেন যাকে বলা হল সে একটি দশাসই জোয়ান। উদাম গা, খেটো ধুতি মালকোচা করে পরা। হাতে প্রকাণ্ড একটা ভীলধনু। এগিয়ে এল না সে। হাতদশেক দূরে স্থিরলক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কথা বলল আবার সেই বৃদ্ধ ভীমা বাগদি, তিনকড়িকে সম্বোধন করে, আপনের বাঁ-বাগে যায়ে দ্যাখেন দ্যাবতা। কয়জন আস্যে পড়ছে! আরো আসতিছে। অদের হাতে যেগুলান দ্যাখছেন, তারে কয় ভীলধনু! আপনের লাঠিয়ালদের মধ্যে যে নির্ব্বোধ লাঠিগাছখান মাথার উপর তুলবে তারে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করি দিবে। লাঠি নামার আগুতেই!

তিনকড়ি বিস্ফারিত নেত্রে দেখলেন প্রায় দশ-পনের-হাত দূরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সাতজন ধানুকী। তাদের ধনুকের জ্যা আকর্ণবিস্তৃত।

—পেত্যয় হলনি? তো দ্যাখেন! অরে ঈশেন! দ্যাবতার মাথার শামলাটারে নামায়ে দে তো! দেখিস্ বাপ্—চক্ষুরত্নটি যেন খুয়া না যায়।

‘টাং’ করে একটা শব্দ হল। বাণবিদ্ধ শিরস্ত্রাণটি লুটিয়ে পড়ল ধুলায়।

শিউরে উঠলেন তিনকড়ি।

—আপনারা ঘর পানে রওনা দ্যান দ্যাবতা। এই ছ্যারাটারেও লয়্যা যান। অর ইজ্জতের বড় দ্যামাক!

এবার গর্জন করে ওঠেন নন্দখুড়ো, ভীমা! ঈশেন!

তদোধিক উচ্চস্বরে গর্জে ওঠে ভীমা : আপনেও কম হারামজাদ’ নয়, দ্যাবতা! আপনেরে মোরা চিনি। বেতো ঠ্যাঙ লয়্যা আপনেও ঘরপানে রওনা দেন। অই দ্যাখেন ক্যানে ঈশেন তার ধনুতে আবার বাণ লাগায়েছে!

সর্বসমক্ষে এতবড় অপমান নন্দকে কখনো সইতে হয়নি।

আগন্তুক ‘বর্গী’র দল নতমস্তকে ফিরে গেল খালি হাতে।

ভীমা বাগদি এতক্ষণে রূপেন্দ্রনাথের দিকে ফেরে। ছুঁয়ে ফেললে বাবাঠাকুরকে যে আবার স্নান করতে হবে এ-কথা ওর আর মনে রইল না। দু-হাতে জড়িয়ে ধরল তাঁর চরণযুগল। মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে বলতে থাকে, আপনে থির হন দ্যাবতা! আপনি পাগল হই গেলি মোরা ডাঁড়াব কুথায়?

বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল শোকসন্তপ্ত মানুষটার। তিনি ওই অন্ত্যজ বৃদ্ধের ধুলিধূসরিত মস্তকটি দু-হাতে তুলে ধরলেন। শিরশ্ছম্বন করে বললেন, না রে ভীমা! আমি উন্মাদ হয়ে যাইনি। আমি উন্মাদ হয়ে গেলে তোরা আবার কেমন করে মাথা তুলে দাঁড়াবি? সব শোক আমাকে সইতে হবে। তোদের মুখ চেয়ে।

১৯

কালের রথচক্র এগিয়ে চলেছে।

চিতাভ্রষ্টা রূপমঞ্জরীর পিতৃদেবকে গ্রাম পঞ্চায়েত সমাজচ্যুত করেছে। জাতিভ্রষ্ট। ওই যাকে বলে ‘একঘরে’। অর্থাৎ ধোপা-নাপিত বন্ধ। বিবিক্তসেবী ব্রাহ্মণটি ভ্রূক্ষেপ করেননি। সংসারে মাত্র দুটি মানুষ। যে-যার বস্ত্রখণ্ড নিজেরাই পরিমার্জনা করে নেন, ফলে রজক নিষ্প্রয়োজন। পরামানিকের প্রয়োজন দু-জনের মধ্যে একজনেরই। তিনি ওষ্ঠলোম, শ্মশ্রু বা কেশদামের বৃদ্ধিতে ভ্রূক্ষেপ করেন না। ফলে সেদিক থেকেও কোনও অসুবিধা হয় নাই। দুজন কেন? কেন নয় সওয়া-তিনজন? সেকথাই এবার বলব। কিন্তু তার পূর্বে জানানো দরকার সমাজচ্যুত ব্রাহ্মণটির প্রধান অসুবিধার কথা। সপ্তাহান্তিক হাটে কোনও ব্যাপারি রূপেন্দ্রনাথকে কিছু বিক্রয় করতে পারে না। চায় না নয়, পারে না। কারণ সমাজপতিদের তরফে লগুড়হস্ত প্রহরীরা সচেতন! ভিন-গাঁয়ের হাট থেকেও সওদা ক্রয় করে আনার উপায় নাই। কারণ একবগ্গা-ঠাকুরকে এবার শুধু সোঞাই গ্রাম-পঞ্চায়েতই সমাজচ্যুত করেনি। করেছে পঞ্চগ্রামের মিলিত-পঞ্চায়েত। এতবড় অন্যায়ের শাস্তি দেবার জন্য পাশাপাশি চার-পাঁচটি ব্রাহ্মণপ্রধান গ্রামের মোড়লেরা মিলিতভাবে তাঁকে জাতিচ্যুত করেছেন। না করবেন কেন? প্রতিটি পরিবারের প্রত্যেকটি বিগতভর্তাকে সহমরণে যেতে হয় না; কিন্তু যেখানে শ্বশুরকুল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেখানে পিতৃকুলের ‘একবগ্গামিতে তা ভেস্তে যাবে, এমন অসৈরণ অসহ্য! অনাচারের পরিমাণটা তোমরা বিবেচনা করে দেখ :

রূপেন্দ্রনাথের জামাতাবাবাজি অপঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে। অপঘাত-মৃত্যুতে একটা ‘প্রাচ্চিত্তির’ অবশ্য কর্তব্য। এখানে তার শ্রাদ্ধই করা গেল না। কী করে যাবে? সৌম্যসুন্দর যে মারা গেল ‘অশৌচাবস্থায়’। দোষটা তারই! সে সামাজিক বিধান লঙ্ঘন করেছিল। তার শ্বশুরোচিত ‘একবগ্গামিতে’। মহাগুরুনিপাতের একাদশ তিথিতে অশৌচান্তের ব্যবস্থা শাস্ত্রে ছিল। আছে! জেদের বশবর্তী হয়ে সৌম্যসুন্দর সে নীতি লঙ্ঘন করেছিল। সেই পাপেই বজ্রাঘাতে সে নিহত হল। তখন তার মস্তকে তৈলভূষিত জটা, হাত-পায়ের নখ রাক্ষসাকৃতি! অশৌচ যার অনতিক্রান্ত তার তো শাস্ত্রবিহিত শ্রাদ্ধাদি অননুমোদিত! হয়তো পণ্ডিতেরা তার জন্য একটা ব্যতিক্রম বিধিব্যবস্থা করতেন, ‘মূল্য ধরে নিয়ে’–’প্রাচ্চিত্তিরে’র মাধ্যমে। কিন্তু প্রেতযোনি প্রাপ্ত হতভাগ্যের ধর্মপত্নী যে সে পথটাও রুদ্ধ করে দিল। চিতাভ্রষ্টা হয়ে অনাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করে বসল!

হয়তো তাকে বাগে আনা যেত, কিছু ধুতুরার রস-টস খাইয়ে।

কিন্তু তার অধার্মিক পিতৃদেব কিছু জল-অচল অনুচরের সাহায্যে গায়ের জোরে সে শুভকার্যটাও অসম্ভব করে তুলল!

এখন বোঝো : ধম্মের কল বাতাসে নড়ে কিনা স্বচক্ষে দেখে যাও!

চিতাভ্রষ্টা হবার মাত্র পক্ষকালের মধ্যে মালতীর ভাঁড়ারে মা-লক্ষ্মী হয়ে পড়লেন ‘বাড়ন্ত’। অথচ হাটে তণ্ডুল ক্রয় করা যায় না। তখনো সংসারে সওয়া-তিনটি প্রাণী। মালতী বলেছিল, ঠাকুরপো, চলুন আমরা এ-গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। আপনার তো অনেক যজমান আছেন—নদিয়ায়, কৃষ্ণনগরে, বর্ধমানে?

রূপেন্দ্র স্বীকৃত হতে পারেননি। কারণ তিনি তাঁর পিতৃদেবকে নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন আমৃত্যু সোঞাই গ্রামেরই সেবা করবেন।

—কিন্তু গ্রাম যদি না চায়?

—কে বলল, বৌঠান যে, গ্রাম আমাকে চাইছে না? এটা তো শুধু ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের বিধানে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হতভাগ্যগুলো কি তাই চায়?

—কিন্তু আপনিই তো একদিন বলেছিলেন প্রয়োজনে স্বহস্তে বাস্তুভিটার মুখাগ্নি করে ত্রিবেণী চলে যাবেন।

—বলেছিলাম। যদি সবাই চাইত। তারা তা চায়নি। চায় না।

সেবার গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সত্যই তা চায়নি। এবার ব্যবস্থাটা অন্যরকম। এবার হল পঞ্চগ্রামের সম্মিলিত পঞ্চায়েত সভা। পাঁচ গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে গণভোট তো আর নেওয়া যায় না। তাই নন্দ চাটুজ্জের উদ্যোগে পঞ্চগ্রামের সমাজপতি ব্রাহ্মণেরা গ্রামবাসী জনতার তরফে বিধান দিলেন। এবারও আসামীকে উপস্থিত হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আসামী সে সুযোগ গ্রহণ করেনি। সে আদৌ উপস্থিতই হল না ষোলো-আনার ডাকে।

ক্রমে মালতীর ভাঁড়ারে বাড়ন্ত মা-লক্ষ্মীর বৃদ্ধি এতটাই হয়ে গেল যে প্ৰতি সপ্তাহে তিন দিন ফিরে আসতে থাকে একাদশী। উনান জ্বলে এক দিন বাদ দিয়ে। শ্যামামালতী দুগ্ধপোষ্যই রয়ে গেল। অশ্বাবাসের পাশে এতদিনে একটি গোশালাও নির্মিত হয়েছে। গোমাতা এসেছেন সেখানে। রূপমঞ্জরী তাঁর নাম দিয়েছে সুরভি। সে উন্নীতা হয়েছে কন্যা থেকে দুহিতার পদে।

তারপর মা-লক্ষ্মী সত্যিই একদিন এলেন। গভীররাত্রে। ‘পেচকস্কন্ধসমারূঢ়ান’…….. ‘চতুষ্পুত্রস্কন্ধারূঢ়ান’ রূপে।

২০

নন্দ চাটুজ্জে মশায়ের শতেক খোয়াড়। একবগ্গাটাকে কিছুতেই কায়দা করা যাচ্ছে না। পাঁকাল মাছের মতো ক্রমাগত পিছলে পিছলে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যদিও গভীর রাত্রে অতি সন্তর্পণ পদক্ষেপে মা-লক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটল তবু নন্দ খবর পেয়ে গেলেন পরদিনই। ডেকে পাঠালেন ছিনাথ সাহাকে। জোড়হস্তে আসামী এসে হাজিরা দিল।

—হ্যাঁরে ছিনাথ! এসব কী শুনছি? তোরা চারভাই নাকি তোদের জ্যান্ত মা-টাকে খাটিয়ায় তুলে মাঝরাত্রে হরিধ্বনি দিতে দিতে শ্মশানে নে-গিয়েছিলি?

নতনেত্রে ছিনাথ বলে, আজ্ঞে না! শ্মশানে নয়। একবগ্গা-ঠাউরের ভিটেয়। বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল যে মায়ের। তাই নিরুপায় হয়ে

—তোরা জানিস্ না যে, একবগ্গাটা জাতিচ্যুত? সমাজচ্যুত? ওর ভিটেয় মাথা-গলানো মানা?

—জানব না কেন খুড়ো? আপনারা তো ঢোল-শহরৎ করে পাঁচ-গায়েই তা জানিয়েছেন! কিন্তু কী করব বলুন? মায়ের সে যন্ত্রণা যে চোখে দেখা যাচ্ছিল না। তাই আমরা চারজনে তাঁকে খাটিয়ায় তুলে—

—শুনলাম, পুঁটলি বেঁধে চাল-ডাল-সবজি ভেট দিয়েছিস। সত্যি?

—বৈদ্যবিদায় দিতে হবে না?

—তা তো হবে। কিন্তু এখন যদি তোদের চারভাইকে একঘরে করি?

ছিনাথ নতনেত্রে নীরব রইল।

নন্দ চাটুজ্জে বলেন, তুই স্বীকার করেছিস। কবুল খেয়েছিস। তাই এযাত্রা ছেড়ে দিলাম। আর কখনও যেন এমন অধর্মের কথা না শুনি। তোদের চারজনকে নামমাত্ৰ একটা টাকা জরিমানা করলাম!

ছিনাথের পচাই মদের দোকান আছে। জাতে শুঁড়ি। একটা সিক্কা টাকার জরিমানা দিলে সে দেউলিয়া হয়ে যাবে না। তবু সে হাতজোড় করেই বলে, তার চেয়ে এক কাজ করুন খুড়ো, আমাদের চার ভাইকেও ‘একঘরে’ করে দিন। তাহলে মায়ের চিকিচ্ছে করতে আর কোনও অসুবিধা থাকবে না। মাঝরাতে কাঁধে তুলতে হবে না।

নন্দের চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। ছিনাথ একনিশ্বাসে বলেই চলে, আর কি বলে ভাল, আমাদের তো আর ‘একঘরে’ হয়ে থাকতে হবে না। ধোপা-নাপিতও বন্ধ হবে না। গাঁয়ের ধোপা-নাপিত-কামার-কুমোর সবাই একে-একে হয়ে যাবে একঘরে’, মানে ‘এককাট্টা’। মুশকিল হবে আপনাদের তিনজনের। তিন সমাজপতি হয়ে যাবেন ‘তেঘরে’! চিকিচ্ছে বন্ধ!

নিজেকে সামলে নিতে বাধ্য হলেন নন্দ! মকুব করে দিলেন ওর জরিমানা। ওঁর নিজের বাতের মালিশটা ফুরিয়েছে। একবগ্গা ছাড়া আর কে দেবে সে দাওয়াই? উনি নিজেই পড়ে আছেন এক আতান্তরিতে।

২১

দুর্গতিনাশিনী যার দুর্গতি দূর করতে এগিয়ে আসেন না তার কী গতি? মিলিত হিন্দু-মুসলমানের এই গৌড়বঙ্গে সে হতভাগ্যের বিপত্তারী রূপে এগিয়ে আসেন স্বয়ং : আল্লাহতালা। সমুদ্রযাত্রা করার অপরাধে মধ্যযুগের অনেক দক্ষ বণিক—বিজয় সিংহ-চাঁদ সদাগরের উত্তরসূরিদের-জাতিচ্যুত করা হয়েছিল। তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পরিত্রাণ পায়। এবার অতদূর যেতে হয়নি রূপেন্দ্রনাথকে। ধর্মত্যাগের প্রয়োজন হয়নি অথচ আল্লাহ্র দোয়া পেলেন।

ভাদ্রমাসের সংক্রান্তি। অথচ মেঘমুক্ত ঝলমলে আকাশ। সে আকাশে কিন্তু ঘুড়ি উড়ছে না একটাও। ‘ঘুড়ি’ এসেছে পরবর্তী ‘বাবু-কালচারে’র জমানায়—প্রায় একশ বছর পরে। বিশ্বকর্মা পূজাও তখন এতটা ব্যাপক ছিল না। পঞ্চগ্রামের কারিগরি মানুষ—কামার, কুমোর, ছুতোর, তন্তুবায়েরা এককাট্টা হয়ে একটাই পূজা করত। কর্মকার শম্ভুকামারের ভিটের সম্মুখে। তারই দূরাগত ঢাকের বাদ্যি ভেসে আসছিল।

এমন সময় অশ্বপৃষ্ঠে এসে হাজির হলেন পীরপুরের হাজিসাহেব।

রূপেন্দ্র এগিয়ে এসে বলেন, আসুন, আসুন! এবার অনেকদিন পরে! কী ব্যাপার?

—বলছি। আগে এই পুঁটলি দুটো ঘরে রেখে আসুন।

—কী আছে ওতে?

—একটায় আমার ক্ষেতের কিছু শাক সবজি, তরি তরকারি, আর দ্বিতীয়টায়—ওই যাকে আপনারা বলেন : ‘মা লক্ষ্মী’!

গম্ভীর হয়ে গেলেন রূপেন্দ্রনাথ। বলেন : আপনি তো জানেন হাজি-সাহেব, আমি দান গ্রহণ করি না!

দু-হাতে নিজের দুই কর্ণস্পর্শ করে হাজিসাহেব বলেন, গোস্তাকি মাফ করবেন। আমার অতবড় স্পর্ধা নেই! এ শুধু বৈদ্যবিদায়। আমি এসেছি আপনার দ্বারে আয়ুর্বেদাচার্য হিসাবে পরামর্শ নিতে।

—আপনি অসুস্থ? কী হয়েছে আপনার?

—আজ্ঞে না। আমার নয়। মেহেরের। আমার ভগিনীর। তার জানুসন্ধিতে একটি বিষস্ফোটক হয়েছে। বড় যন্ত্রণা পাচ্ছে…

রূপেন্দ্রনাথ থমকে গেলেন এবার। একটু চিন্তা করে বললেন, কিন্তু আমার পক্ষে তো তার চিকিৎসা করা সম্ভবপর নয়। বহিনজীর মুখখানিও আমি কোনওদিন ভাল করে দেখিনি। এমন বেপর্দা হয়ে তিনি কি… তাছাড়া, আপনারা দুজন সম্মত হলেও আপনাদের সমাজ কি তা অনুমোদন করবে? মেনে নেবে?

অধোবদন হলেন হাজিসাহেব। বলেন, বড় কষ্ট পাচ্ছে বহিনটা। কোনও উপায়েই কি হতে পারে না, ভাইসাব?

—হ্যাঁ পারে। আমি একটি বিকল্প প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি কাল সকালে তাকে পালকি করে এ গ্রামে নিয়ে আসুন। আমার কন্যা রূপমঞ্জরীকে আমি চিকিৎসা-বিজ্ঞানের বেশ কিছুটা শিখিয়েছি। আমার নির্দেশমতো সে চিকিৎসা করবে। প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারও করবে।

হাজিসাহেব বলেন, কিন্তু এখানে সে থাকবে কোথায়? আপনি তো জানেন যে, আপনাদের আরোগ্য-নিকেতনে বিধর্মীদের জন্য যে দুটি পৃথক শয্যা সংরক্ষিত ছিল এখন তা নেই। আমাদের সে সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন বর্তমান পঞ্চায়েত।

—জানি। আপনিই বরং জানেন না যে, সেই সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু থাকলেও কোনও সুরাহা হত না। আমি জাতিচ্যুত। বর্তমানে ওই আরোগ্যনিকেতনে আমার প্রবেশাধিকার নেই। আপনি বহিনজীকে নিয়ে আসুন। সে আমার ভদ্রাসনেই থাকবে। আমার ভাবিজীর সঙ্গে।

হাজিসাহেব আদাব জানিয়ে বলেন, খোদা আপনার মঙ্গল করবেন!

২২

আমাদের ত্রয়োদশবর্ষীয়া নায়িকা জীবনে প্রথম শল্যচিকিৎসক হিসাবে সেই বিষস্ফোটকটি বিদীর্ণ করল। শোণিত ও পুঁজ পরিষ্কার করে দিল। প্রায় সপ্তদিবস চিকিৎসাধীন থেকে, নিরাময় হয়ে মেহের প্রত্যাবর্তন করল পীরপুরে। বিদায় মুহূর্তে মুখমণ্ডল বে-পর্দা করে পণ্ডিতজীকে আদাব জানাল। বলল, খোদাতালা আপনাকে দোয়া করুন ভাইসাব!

হাজিসাহেব ইতিমধ্যে সব খবরই পেয়েছেন। কীভাবে হিন্দুসমাজ ওই সেবাব্রতী ব্রাহ্মণকে জাতিচ্যুত করে শাস্তি দিচ্ছে। তিনি একটি বিচিত্র প্রস্তাব পেশ করলেন পণ্ডিতজীর কাছে :

পীরপুরে প্রতি মঙ্গলবার দ্বিপ্রহরে হাট বসে। উনি পীরপুর-গ্রামের প্রধান মোল্লাদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তাব দিলেন যে, প্রতি মঙ্গলবার প্রত্যুষে সেখান থেকে একটি পালকি আসবে। রূপমঞ্জরীকে সে গাঁয়ে নিয়ে যেতে। তার পিতৃদেব অশ্বপৃষ্ঠে তার সঙ্গে যাবেন। পাশাপাশি দু-তিনটি মুসলমান-প্রধান গ্রামের আর্ত নরনারী মঙ্গলবার সকালে সমবেত হবে হাজিসাহেবের ‘ছামু’তে। সারা সকাল পিতা-পুত্ৰী সারিবদ্ধ রোগাক্রান্তদের পরীক্ষা করে ঔষধাদি প্রদান করবেন। পিতা শুধু পুরুষদের। কন্যা পর্দানসিনদের। তারপরে কিছু ফলমূল-ভাবে তৃপ্ত হয়ে, পীরপুরে হাট সেরে ফিরে আসবেন সন্ধ্যায়। মালতী একাহারী তিনজনের জন্য নৈশাহার প্রস্তুত করে রাখবে!

রূপেন্দ্রনাথ সানন্দে স্বীকৃত হলেন। পীরপুরের আশপাশের মুসলমান-প্রধান গ্রামগুলিতে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। হাজিসাহেবের, পণ্ডিতজীর, আর মুন্নিহাকিমমাঈর।

*

শুধু আকাশ ভেঙে পড়ল একজনের মাথায়। তিনি নন্দ চাটুজ্জে। ইতিমধ্যে তিনি সোঞাই-গ্রামের প্রায় একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছেন। বাচস্পতিদাদা স্বর্গে গেছেন। দুর্গা গাঙ্গুলী চলে গেছেন তাঁর সাধনোচিত ধামে, উদাসীন তারাপ্রসন্ন প্রায় উদ্ভ্রান্তের মতো একান্তচারী। সে তো থেকেও নেই। এ ছাড়া আছেন কালিচরণ ও শিরোমণি। তারা নন্দভায়ার অনুগামী। কিন্তু নিরঙ্কুশ সুখ বলে দুনিয়ায় কিছু নেই। নন্দ চাটুজ্জের কাতর প্রার্থনায় মা দুর্গা নয়-হাতে তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু ওই দশমহস্তটি কিছুতেই বরদানে উবুড় হল না।

এক নম্বর—ওই বাগদিপাড়ার অসৈরণ অসুরগুলো। তাদের পাণ্ডা হচ্ছে ভীমা আর ঈশেন! সর্বজনসমক্ষে ভীমা বাগদি চিৎকার করে ওঁকে ‘হারামজাদ’-দ্যাবতা’ বলে সম্বোধন করেছিল! নন্দ রুখে দাঁড়াবার সাহস পাননি। তখনও তিনকড়ি ঘোষাল—মশায়ের বাণবিদ্ধ শামলাটা ধুলোয় লোটাচ্ছে। আর প্রতিবাদ করতে গিয়েই নজর হল ঈশেনটা তার ভীল ধনুতে নতুন করে বাণ জুড়েছে। আকর্ণ সম্প্রসারিত করে প্রতীক্ষা করছে খুড়োর নির্দেশের। ওই অসুরটাকে বিশ্বাস নেই! ব্রাহ্মণের রক্তপাতে ওর হাত কাঁপে না। আতঙ্কতাড়িত নন্দ সেবার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন নতমস্তকে।

কিন্তু সর্বসমক্ষে এতবড় অপমানটা হজম করে গেলে মান থাকে না। নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলেন অচিরেই। বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করতে হল অবশ্য। তা হোক! কুশাঙ্কুরকে সমূলে বিনষ্ট না করলে ব্রাহ্মণ্য সমাজের মর্যাদা থাকে না। তিনি শিকায়েত করলেন কোতোয়ালের দরবারে। একমুঠো রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে। যথাবিহিত রজতখণ্ডের সম্মানদক্ষিণা লাভ করে কোতোয়াল এলেন ‘ডাকাত’ ধরতে বাগদি পাড়ায়। নবাবি সৈনিকদের হাতে গাদাবন্দুক চড়িয়ে। বেশ কিছু তথাকথিত ‘ডাকাত’ মারা পড়ল। তার মধ্যে ওদের পাণ্ডা সেই পাঁজরসর্বস্ব ভীমা বাগদি। তবে ঈশেনটাকে কব্জা করা যায়নি। সে হারামজাদা ভাদ্রের ভরা দামোদরে ঝাঁপ খেয়ে পড়েছিল। তার মৃতদেহের সন্ধান আদৌ পাওয়া যায়নি। তবে নন্দর দৃঢ় বিশ্বাস এতদিনে দামোদর মোহনায় কুমীর-কামঠরা অসুর-মাংসে যথারীতি তৃপ্ত হয়েছে।

কিন্তু দ্বিতীয় কণ্টকটি উৎপাটিত করা যায়নি এখনও। পঞ্চগ্রামের ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা যাকে সম্মিলিতভাবে জাতিচ্যুত করলেন—যাকে হাটে এসে সওদা পর্যন্ত কিনতে দেওয়া হল না, সেই একবগ্গাটা আবার পাঁকাল মাছের মতো পিছলে গেল। এখন সে প্রতি মঙ্গলবারে পীরপুরে যায়। হাট করতে। পীরপুরের হাট নন্দখুড়োর এক্তিয়ারের বাহিরে। সেখানে অর্কফলার আন্দোলন নামঞ্জুর। কারও বামনাই-গিরিই চলে না।

“অরা হল গে মোছলমান। নেড়ে! নবাব-ছায়েবের সুয়োরানির পুত্তুর!

উপায় নেই। সে-কথা খাঁটি। তা ছাড়া সোঞাই গাঁয়ের অলিতে-গলিতে কেমন যেন একটা চাপা বিদ্রোহের লক্ষণ! গ্রামবাসী ইতরভদ্র যেন ফেটে পড়তে চাইছে : ইকী অসৈরণ কথা, মশাই! নিজ গাঁয়ের মানুষ বাবাগো মাগো করি চিল্লাতেই থাকবে, বিন-চিকিচ্ছেয় মরবে! আর ভিন গাঁর নেড়েগুলো আনন্দে নাচবে?

নন্দ চাটুজ্জে প্রণিধান করতে বাধ্য হলেন : খাঁটি কথাই বলে ‘গেলেন’ চাণক্যপণ্ডিত :

স্বগাঁয়ে পূজ্যতে মোড়ল
গাঁয়ে-না-মানা সর্বত্র ড্যাংড্যাঙায়তে!

২৩

অবশ্য মা-দুর্গা একেবারে অবিবেচক নন। মহাষ্টমীতে জোড়া-পাঁঠা বলিদানে তৃপ্ত হয়েছেন করুণাময়ী। এবার আঘাত এল ত্রিবেণী থেকে। বজ্রটি নিক্ষেপ করলেন সেই অলোকসামান্য পণ্ডিতটি স্বয়ং। রুপো বাঁড়ুজ্জে যে তার আত্মজাকে সহমরণে যেতে দেয়নি এই শাস্ত্রবিরোধী কার্যের জন্য তার কোনও শাস্তিবিধান করেননি পণ্ডিতাগ্রগণ্য। কারণ ছিল। তিনি নিজেই তাঁর কয়েকজন ধনী যজমানকে অনুরূপ নির্দেশ ইতিপূর্বেই দিয়েছেন। তারা তাদের তরুণী বিগতভর্তা কন্যার সহমরণ নিবারণে সমর্থ হয়েছিল। বেহাইমশাইদের মুণ্ডপাত আর ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি দিতে দিতে তারা ঘরে ফিরেছিল।

কিন্তু এবার? এ কী মর্মান্তিক অনাচার! আশা করেছিলেন তাঁর শিষ্যটি এতদিনে মোহমুক্ত হয়েছে। সংশোধন করেছে নিজেকে। কিন্তু না। পাকা খবর পেলেন সেই নিকা-নিপীড়িতা নবযুবতী যবনীকে রূপমোহিত রূপেন্দ্র পুনরায় স্বগৃহে এনে তুলেছেন! এবার বিদ্যাদানের অছিলায় নয়। রাত্রিবাস! পুরো একটি সপ্তাহ বামুনের ভিটায় সুন্দরী যবনী! বিপত্নীক রূপমোহিত রূপেন্দ্র আর স্বামীসুখবঞ্চিতা রূপসী : মেহেরুন্নিসা বেগম! অসহ্য!

গুরুদেবের আদেশ তামিল করতে আবার এসে উপস্থিত বৃদ্ধ শীলভদ্র বাচস্পতি!

মালতী আর শ্যামা-মা কাঁদতে কাঁদতে নৌকায় উঠে বসল।

মালতী জানে এবার সত্যিই চিরবিদায়।

তাই ওঁর সংসারে এখন আর সওয়া-তিনজন নয়। মাত্র দুজন। বাপ আর মেয়ে!

২৪

মাসকতক পরের কথা।

মহাপূজা আর কোজাগরী অতিক্রান্ত। দীপান্বিতা আসন্ন।

ওদের উঠানে কদমগাছটা এ বছরেও ফুলে-ফুলে মঞ্জরিত হয়ে উঠেছিল। কণ্টকিত-তনু ফোটা-কদমফুল একে একে ভূলুণ্ঠিত হল। কেউ তার একটিকেও তুলে এনে দিল না তার নববধূর অঞ্জলিবদ্ধ হাতে। ফোটা-কদমের মরশুম শেষ হল। এল শিউলি ফোটার শুভলগ্ন। দামোদরের ধারে-ধারে অযুত-নিযুত কাশফুল দুলতে থাকে। শিউলি-বোঁটার মতো রক্তিম নয় তাদের সীমন্ত—শুভ্রবসনা বিধবার বেশ! দূর থেকে শুনল বড় বাড়ির ঢাকের বাদ্য “টাক-ডুমাডুম-ডুম! এল পূজার ধুম! কাড়ব তোদের ঘুম! টাক ডুমাডুম ডুম!”

বালিকা বয়স থেকেই দুর্গাপূজার সময় সকাল-সন্ধ্যা পড়ে থাকত ভাদুড়ীবাড়ির পূজা-দালানে। একেবারে শুরু থেকে শেষ। সেই যখন বুড়ো কুমোরদাদু বাঁশ-কঞ্চির কাঠামোতে খড়ের হাত-পা গড়তেন তখন থেকে। খড়ের কাঠামো শেষ হলে মৃত্তিকার প্রলেপ। কুমোরদাদু যে সেই সময়ে এক নিষিদ্ধপল্লি থেকে এক মুঠি মৃত্তিকা সংগ্রহ করে আনতেন এ গূঢ় বার্তাটা অবশ্য জানতে পারেনি।

প্রলেপের পর প্রলেপ। মায়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রমে রূপায়িত হতে থাকে। বালিকা জানতে চাইত, ও কুমোরদাদু, মুখচোখ কই গো? মায়ের মুখখানি তো গড়ছ না?

শুভপ্রসন্ন ধমক দিয়ে উঠত। তোর মাথায় গোবর! এটাও জানিস নে? মায়ের মুখখানি তো আলাদা গড়তে হয়। সব শেষে বসবে। তাই না কুমোরদাদু?

সরল বালিকা তার শুভদাকে প্রশ্ন করত, আচ্ছা মানুষের বেলাতেও কি ওইরকম হয়? মায়ের পেটের ভিতর ধড় আর মুণ্ডু কি আলাদা-আলাদা গড়ে ওঠে! পরে ভগবান জুড়ে দেন?

শুভ বলত : তুই একটা পাগলি!

হটীও হটার পাত্রী নয়। বলত, আর তুমি একটা গাধা! জান না, তাই বলনা বাপু।

কোথায় হারিয়ে গেল সেই আনন্দমুখর বাল্যকালের দিনগুলো! আজও কুমোরদাদা—না দাদু নয়, দাদা, বুড়ো কুমোরদাদু দেহ রেখেছেন—তাঁর ছেলে এখন ঠাকুর গড়ে। হয়তো নতুন যুগের বালক-বালিকা একইভাবে মাটি চুরি করে পুতুল বানায়। ও জানে না। দেখেনি। এখন তো পূজাবাড়িতে যাওয়াই মানা! সে জাতিচ্যুতা। সে চিতাভ্রষ্টা।

বিজয়া দশমীতেও যায়নি। জ্যাঠা-জ্যেঠিকে প্রণাম করতে। অথবা পুঁটুপিসিকে। তবে ঠাকুর যখন বিসর্জনে চললেন—ষোলো-বেহারা কাঁধে চড়ে, ঢাকিরা চলল নাচতে নাচতে ড্যামকুড়াকুড়’ বাদ্য বাজিয়ে, তখন একবার দেখেছিল। জাতিচ্যুতার সদর দরজটি খুলে। সজল নয়নে।

এখন ও জানে ‘বিসর্জন’ হচ্ছে—’বি-পূর্বক সৃজ্ ধাতু অনট্’!

বিশেষরূপে জন্ম নেওয়া। ধাতুটা ‘সৃজ্’। তাই মন্ত্রটা : ‘পুনরাগমনায় চ’–মা ফিরে আসবেন। নিশ্চিত ফিরে আসবেন। কিন্তু ওর জীবনে আর সেই লালে-লাল সিঁদুর খেলার দিনটি ফিরে আসবে না। জাতিচ্যুতা বলে নয়, সমাজত্যক্তা বলেই শুধু নয়—সেই কিশোরটি যে আর কোনদিন ফিরে এসে বলবে না : হাতদুটি পাত রূপা, আমি তোমার অঞ্জলিতে একটি ফোটাকদম উপহার দেব!

২৫

তালপাতা কেটে-কেটে ও একটা ফানুসের মতো বানাচ্ছে। একাই। না, ফানুস নয়, পিদিম-আড়াল-করা একটা খাশ-গেলাস। আকাশ-পিদিম! কার্তিক মাস ভ’র সন্ধ্যা সমাগমে তা একটি বংশদণ্ডের উপর বেঁধে জ্বেলে দিতে হয়। তুলসীতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ দেওয়া শেষ হচ্ছে। না হলে বন্দ্যোঘটি পরিবারের পূর্বপুরুষেরা অন্ধকারে কেমন করে খুঁজে পাবেন সোঞাই গাঁয়ে তাঁদের ছেড়ে যাওয়া সাতপুরুষের ভিটে? হোক-না তাঁদের শেষ বংশধর জাতিচ্যুত, তবু তাঁরা তো লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন। বাপ-বেটিকে আশীর্বাদ করতে।

সমাজচ্যুত বাপবেটির একান্ত পরিবেশ। সোনা-মাও চোখের জলে ভাসতে ভাসতে চলে গেছেন। হটী-দিদির পায়ে-পায়ে ঘুর ঘুর করত আর একটা ফুটফুটে মেয়ে। সেটাও নেই। কিন্তু তাই বলে কি ওদের ভিটেয় আকাশপ্রদীপ জ্বলবে না? কাল বাদে পরশু আশ্বিনের সংক্রান্তি। তার পরদিন থেকেই আকাশ-পিদিম জ্বালতে হবে।

রান্নাবান্নার হাঙ্গামা নেই। না, আজ একাদশী নয়। আজ কৃষ্ণা দশমী। সে জন্য নয়। গতকাল রূপেন্দ্রনাথকে একটি দাঁত তুলে ফেলতে হয়েছে। কদিন খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। দাঁতের যন্ত্রণায়। কাল বিকালে জীবন দত্ত এসে দাঁতটা তুলে দিয়ে গেছে। ‘একঘরে’র ধোপা-নাপিত বন্ধ। মানলাম। তাই হলে কি তাঁর চিকিৎসাও হবে না? জীবন দত্ত মানে না সে-কথা। না হয় তাকেও ওঁরা একঘরে করে দিক। তাহলে ওরা ‘একঘরে’ থেকে ‘দু ঘরে’ উন্নীত হয়ে যাবে।

তাই হটী স্থির করেছে আজ ফেনা-ভাত বানাবে। কাঁচকলা আর কুমড়ো সিদ্ধ দিয়ে। ফ্যানসহ গলা-গলা ভাত। বাবামশাই যাতে গিলে-গিলে খেতে পারেন।

রূপেন্দ্রনাথ সকালে শুধু এক পাত্র গরম দুগ্ধ পান করেছেন। কী একটা পুঁথি নিয়ে রোদে পিঠ দিয়ে সকালবেলা বসেছেন দাওয়ায়। হঠাৎ সদর দরজার সামনে কী যেন একটা মিলিত কোলাহল! অনেক মানুষ যেন দূর থেকে দৌড়ে আসছে। কে একজন আর্ত-চিৎকার করে উঠল : বাবাঠাউর!

চমকিত হয়ে উঠলেন রূপেন্দ্রনাথ। পুঁথিটি রজ্জুবদ্ধ করে ললাটে স্পর্শ করালেন। উঠে দাঁড়ালেন : কে? কে ডাকে?

ছুটে গেলেন সদরদরজাটা খুলে দেখতে।

ও-প্রান্তে বায়েনপল্লির জনাদশেক উদাম-গা মানুষ। সঙ্গে একটি অবগুণ্ঠনবতী বিধবা। সবার সমুখে পেল্লাদ বায়েন। তার দু-হাতে কোলপাঁজা করে একটি মূর্ছিত বালক।

—কী হয়েছে রে প্রহ্লাদ?

—সব্বোনাশ হইছে বাবাঠাউর। গুপালরে নাগে দংশন করছে।

—’নাগ’? ‘সাপ’ নয়? কী করে বুঝলি?

—দ্যাখেন কেনে! গুপাল এক্কেরে ন্যাতিয়ে পড়ছে।

তোমাদের অভিধানে যাই লেখা থাক, আমরা এখন যে-কালে আছি তখন ‘অভিধান’ ছিল না। কিন্তু গ্রামবাংলার মৌখিক ভাষায় কিছু শব্দের নির্দিষ্ট গূঢ়ার্থ ছিল। যোগরূঢ় অর্থ। ‘সাপ’ আর ‘নাগ’ ভাষায় সমার্থক নয়। সাপ ‘কামড়ায়’। নাগ কিন্তু ‘দংশন করে’। আনপড় চাষাভুষোরাও তা জানে। কারণ সাপ নির্বিষ। ‘নাগ’ হচ্ছে মা-মসার পেয়ারের। তারা নির্বিষ হয় না। তাদের দংশনে যমরাজের দুন্দুভি বেজে ওঠে! সর্পকুলে ‘নাগ-বংশ’ কুলীন! শঙ্খচূড়, গোখুর, কেউটিয়া, কালনাগিনী। আর সাপেরা অন্ত্যজ :—হেলে, জলঢোঁড়া।

রূপেন্দ্র লক্ষ্য করে দেখলেন বালকের বাঁ-পায়ের গোড়ালিতে দুটি দংশন-চিহ্ন। দংশন-চিহ্নেই বোঝা যায় দংশনকারী নির্বিষ ‘সাপ’ নয়, ‘নাগ’! দুটি পাশাপাশি চিহ্ন। দেখেই বুঝলেন এটি বিষধরের দংশন। প্রশ্ন করেন, সাপটা দেখেছিস? মাথায় চক্র ছিল? কৃষ্ণবর্ণের না গৈরিক?

—আপনেই দ্যাখেন দ্যাবতা। মাইরা আনছি।

দলের কে একজন একটা ঝাঁপি খুলে মাটিতে নিক্ষেপ করল একটি মৃত নাগ। হ্যাঁ, বিষধরই! রাঢ় বঙ্গে দুর্লভ হলেও ক্বচিৎ তার দেখা মেলে। গোখুর বা কেউটিয়া নয় : বঙ্করাজ!

বলেন, গোপালকে দাওয়ায় শুইয়ে দে। ওর বাপ কোন্ জন?

পেল্লাদ ললাটে করাঘাত করে বলে, হায়রে আমার কপাল। অ্যারে চিনলেন না ঠাউর? গুপাল, গুপাল! ওই তো তার মা! যারে আপনে বাঁচাইছিলেন। বেষ্টা বায়েনের বেধবা! যম্না।

রূপমঞ্জরী ইতিমধ্যে এক ঘটি জল এনে অচৈতন্য বালকটির ক্ষতস্থান ধৌত করে দিয়েছে। সে জানে বাবামশায়ের বিচিত্র চিকিৎসা পদ্ধতি! তিনি মুখে শুষে নেন বিষটা-থু-থু করে ফেলে দেন। সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ভাবে মা-মনসার ভরে ভেষগাচার্য এই গুপ্ত বিদ্যাটি আয়ত্ত করেছেন। আসলে তা মোটেই নয়। রূপেন্দ্রনাথ হটীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন—মুখে বিষ টেনে নিলে কোনও বিপদের আশঙ্কা নাই। এমনকি কিছুটা পেটে গেলেও নয়, যদি না খাদ্যনালি বা পাকস্থলীতে কোনও ক্ষত থাকে। নাগের বিষ যতক্ষণ না দেহের রক্তচলাচল ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করতে পারছে, ততক্ষণ চিকিৎসক নিরাপদ।

রূপেন্দ্রনাথ বালকটিকে চিনতে পেরেছেন। বেষ্টা বায়েনের ছেলে। বেষ্টা বায়েন সেই শহিদ। যে তালগাছের মাথায় শিঙে ফুকে একদিন গ্রামকে রক্ষা করেছিল। গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। আর তার স্ত্রী ওই যমুনাকে চিতাভ্রষ্টা করে বাঁচিয়েছিলেন আর একদিন—সমস্ত গ্রামের বিরুদ্ধে একা সংগ্রাম করে।

রূপেন্দ্রনাথ বালকটির বাম পদ উঠিয়ে নিলেন। নিচু হয়ে ক্ষতস্থানে অধরোষ্ঠ স্পর্শ করালেন। রক্তচোষা রাক্ষসের মতো অনেকটা রক্ত মুখে তুলে নিয়ে থু-থু করে ফেলে দিলেন। একবার, দুবার, তিনবার। তারপর ঘটি থেকে মুখে জল নিয়ে দু-তিনবার কুকুচি করে মুখটা ধুয়ে ফেললেন।

সোজা হয়ে বসে বলেন, ওর পায়ে বন্ধনীটা কে বেঁধে দিয়েছে?

বালকের বাম-গুল্ কে ও জানুতে দুটি বস্ত্রখণ্ড দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ।

ভিড়ের ভিতর থেকে একজন মধ্যবয়সী অগ্রসর হয়ে এসে বলে, আজ্ঞে আমি, বাবাঠাউর। মহাদেব গুনিন। আপনার ছিচরণের দাস বটি।

—বড় সুন্দরভাবে বেঁধেছ গুনিন। এ বিদ্যা কোথায় শিখলে?

মহাদেব সলজ্জে হেসে বললে, আপনার মনে নাই দ্যাবতা? আপনার ঠেঞে।

ওঁর স্মরণ হল না। পঞ্চগ্রামে যখন যেখানে গেছেন ‘নাগগুনিন্ দের ডেকে ডেকে এ বিদ্যা শিখিয়েছেন। ‘বন্ধনদান বিদ্যা’। বলতেন, তোরা তোদের বাপপিতিমোর আদেশে সব কিছু করিস, আমি আপত্তি করব না। মন্ত্রপড়া, চাল-পরা, ধূপ-ধুনো যা তোদের মন চায়। কিন্তু এই কথাটি ভুলিসনে, বাবাসকল। নাগ দংশনে সবার আগে চাই ‘বন্ধন’!

ওরা প্রশ্ন করত, ক্যান দ্যাবতা? কিয়েল্লেগে?

অম্লানবদনে মিথ্যাভাষণ করতেন : মা-মনসা আমাকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন! উনি জানেন, উপলব্ধি করেন, ওভাবেই ওই অশিক্ষিত আপড় গুনিনগুলোকে স্বমতে আনা সম্ভব। ‘মিথ্যা’ যেখানে মঙ্গলের দিশারী, জনহিতকারী, সেখানে তা সত্যের চেয়েও সত্য!

ছেলেটির নাড়ির গতি পরীক্ষা করে বললেন, মহাদেব, এবার ওই বাঁধনদুটো অল্প-অল্প করে আলগা করে দে। দীর্ঘসময় রক্তচলাচল বন্ধ থাকলে পা-টা জন্মের মতো অসাড় হয়ে যাবে!

—আপনিই তা করেন দ্যাবতা!

—না। তুই করবি। আমি দেখিয়ে দেব। শিখিয়ে দেব। আয়।

বন্ধন আলগা হলে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আর ভয়ের কিছু নাই। ও প্রাণে বেঁচে গেল। তোমরা যে যার বাড়ি ফিরে যাও। শুধু যমুনা আর প্রহ্লাদ থাকবে। গোপালের সম্বন্ধে আশঙ্কার আর কিছু নাই।

ভিড়ের মধ্যে কে একজন বলে বসে, অর নাম ‘গোপাল’ নয় দ্যাবতা। ‘গুপাল’।

রূপেন্দ্রনাথ হাসলেন। বললেন, তোমাকে চিনেছি। তোমার নাম যেমন নবীন নয়, নবা নয়, লবা! তাই তো?

—আইনজ্ঞা হ!

রূপেন্দ্র হটীর দিকে বললেন, একে চিনে রাখ মা। এ হচ্ছে সোঞাই-গাঁয়ের দু-নম্বর একবগ্গা।

নবা মুখ নিচু করে হাসে। বায়েনপল্লির সবাই একে একে ফিরে যায়। রইল শুধু প্রহ্লাদ আর যমুনা। রূপেন্দ্রনাথ মামণিকে বললেন, ওদের দুজনের জন্যেও হাঁড়িতে দুটি চাল নিস। ভয় নেইরে। ওদের জাতই নেই তা জাতিচ্যুত হবে কেমন করে?

একগাল হেসে পেল্লাদ বলে, অ্যাইডা বড় ন্যায্য কতা বলিছেন দ্যাবতা। যার মাতা নাই তার আবার কিসের মাতাব্যাতা?

যমুনা তার ছেলের মাথাটি কোলে তুলে নিয়েছে। গোপালের এখনও জ্ঞান ফিরে আসেনি। পেল্লাদ একটু ওদিক বাগে গেল। নলচের আড়াল দিয়ে টুক্ বিড়ি ফুঁকতে।

রূপেন্দ্রনাথ পাতকুয়ো-তলার দিকে এগিয়ে গেলেন! নিষ্ঠিবন ত্যাগ করে একটু চমকে ওঠেন। কী আশ্চর্য। এখনও সেটা লাল! ঘটি থেকে জল নিয়ে বার কতক মুখ-প্রক্ষালন করলেন। ভ্রূকুঞ্চন হল তাঁর। এ কী! জলের রক্তিমতা বিদূরিত হচ্ছে না কেন? বারে বারে মুখ প্রক্ষালনের পরেও?

হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা চিন্তা জাগল মনে। তাই কি? স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দক্ষিণহস্তের তর্জনি প্রবেশ করিয়ে দিলেন নিজের মুখ-বিবরে। অনুভব করলেন উৎপাটিত দণ্ডের মূল গহ্বরটা। আবার চমকিত হয়ে ওঠেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো। তারপর ধীর পদক্ষেপে ফিরে আসতে থাকেন দাওয়ার দিকে। হঠাৎ টলে উঠল মাথার ভিতর। হাত বাড়িয়ে দেওয়ালটা ধরলেন। শৈশবের সেই হাঁটি-হাঁটি-পা-পা-ভঙ্গিতে অগ্রসর হতে থাকেন দাওয়ার দিকে।

চাল ধুয়ে হাঁড়িটা নিয়ে রূপমঞ্জরী এগিয়ে আসছিল রান্নাঘরের দিকে। হঠাৎ নজর হল তার। হাঁড়িটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এসে চেপে ধরল ওঁর বাহুমূল। বললে, কী? কী হয়েছে বাবা?

—মাথাটা হঠাৎ কেমন টলে উঠল রে!

—টলে উঠল? কেন? শরীরটা কি খারাপ লাগছে?

উত্তর দিলেন না। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বসলেন দাওয়ায়। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে।

—বালিশটা এনে দেব? শোবেন?

—না! শয়ন নিষিদ্ধ। বসেই থাকব।

—জীবনদাকে খবর পাঠাব?

—হ্যাঁ। জীবন, শিবনাথ আর শোভাকে।

—ওরা কী করবে?

—দরকার আছে। তুই এখানে বস দেখি। আমার পাশে।

রূপমঞ্জরী সে-কথায় প্রথমে কান দিল না। চিৎকার করে ডাকল প্রহ্লাদকে। সে দৌড়ে এল। তাকে আদেশ করল জীবন আর শিবনাথকে ডেকে আনতে। খুব জরুরি দরকার। তারপর বসে পড়ল বাবার কোল ঘেঁষে। বলে, কী হল বলুন তো হঠাৎ? দেখি, আপনার নাড়িটা?

লক্ষ্য হল রূপেন্দ্রনাথ নিজেই নিজের নাড়ির গতি লক্ষ্য করছেন।

—রক্তচাপের বৃদ্ধি?

নাড়ি দেখা শেষ হয়েছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। হঠাৎ কী যে হল—প্রচণ্ড ভাবাবেগে সবলে জড়িয়ে ধরলেন মামণিকে।

—বাবা! বাবা! কী হয়েছে বলুন?

দুহাতে আতঙ্কতাড়িত কন্যার মুখটি তুলে ধরে তার শুভ্র সিঁথিমূলে এঁকে দিলেন এক নিবিড় চুম্বনচিহ্ন।

রূপমঞ্জরী স্তম্ভিতা। এমন উচ্ছ্বাস, এমন আবেগ সে তো কখনও দেখেনি। দুঃখে যিনি অনুদ্বিগ্নমন, সুখে বিগতস্পৃহ। তাহলে এই বাঁধভাঙা দুরন্ত আবেগের কী অর্থ? বাবার বুকে লুকানো মুখটা তুলে আবার একই প্রশ্ন করে, বলুন, কী হয়েছে আপনার? ঔষধের পুলিন্দাটা কি এনে দেব?

এবার মামণিকে আলিঙ্গনমুক্ত করে স্থির হয়ে বসলেন তাঁর অভ্যস্ত ভঙ্গিতে—সমংকায়শিরোগ্রীব। অনুত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, না রে মা! এ রোগের কোনও চিকিৎসা আয়ুর্বেদশাস্ত্র জানে না!

—মানে? কী রোগ? কী হয়েছে আপনার?

—আমি একটা নিদারুণ ভুল করে বসেছি মা! কালান্তক-ভ্রান্তি! তার ক্ষমা নাই! আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম যে আমার মুখবিবরে একটি ক্ষতচিহ্ন আছে। বঙ্করাজের কিছুটা বিষ আমার ধমনিতে প্রবেশ করেছে! এ ভ্রান্তির কোনও মার্জনা নাই।

জীবনে কখনও যা করেনি, করে-না-বজ্রাঘাতে সৌম্যসুন্দরের মৃত্যু সংবাদ-শ্রবণেও যা করেনি আজ তাই করে বসল : একটা জান্তব আর্তচিৎকার। গগন বিদীর্ণ করে। সবলে জড়িয়ে ধরল পিতাকে।

ছুটে এল প্রহ্লাদ, যমুনা আর জীবন দত্ত।

শান্তস্বরে উনি শিষ্যকে বললেন, আমার একটি মারাত্মক ভ্রম হয়ে গেল, বাবা! তুমি আমার ক্ষতস্থানে যে কার্পাসখণ্ডটি গুঁজে দিয়েছিলে সেটি অতর্কিতে কখন পড়ে গেছে! আমার খেয়াল হয় নাই। বঙ্করাজের বিষ প্রবেশ করেছে আমার ধমনিতে!

প্রহ্লাদের কাছে জীবন ইতিপূর্বে শুনেছে সব কথা। বুঝেছে! সে জানে—এ ভ্রান্তির ক্ষমা নাই। আলিঙ্গনাবদ্ধ মামণিকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে বলে, কিন্তু সেবার তো নকড়ি ঘোষালকে আপনি বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন?

এতক্ষণে উনি সংযত। সংহত। নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় ব্যাখ্যা দিলেন : সেবার নাগটা বঙ্করাজ ছিল না। তাছাড়া সেবার বাঁধন দেওয়া গিয়েছিল। এবার যে শিরে সর্পাঘাত হয়েছে জীবন! কোথায় বাঁধবে তাগা?

উত্তেজিত জীবন স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেল। গুরুদেবের বাহুমূল চেপে ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে জানতে চায়, বঙ্করাজ বিষের কোনও প্রতিষেধক নাই শাস্ত্রে?

ম্লান হেসে রূপেন্দ্র বললেন,

অমোঘা পশ্চিমে মেঘাঃ*
অমোঘা উত্তরে বিদ্যুৎ।
অমোঘা শ্রীনাগচতুষ্টয়ঃ**
অমোঘা ব্রাহ্মণাশীষঃ।।

[* পশ্চিমে মেঘ সঞ্চার এবং উত্তরে বিদ্যুৎ অনিবার্যভাবে বর্ষণের সঙ্কেতবাহী। নাগচতুষ্টয়ের দংশন যেমন অব্যর্থ মৃত্যুর সঙ্কেতবাহী। সদব্রাহ্মণের আন্তরিক আশীর্বাদ যেরূপ অব্যর্থ।

** নাগচতুষ্টয়ের পরিচয় : (১) শঙ্খচূড় : King Cobra ( Hamadryad epihinophagus)

(২) গোখুর (কেউটে ) : Cobra (Naja naja )

(৩) চন্দ্রবোড়া : Russell’s Viper (Vipra russelli)

(৪) বঙ্করাজ : Saw scaled Viper (Echis carinatus )

আপাত-অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করি এই নাগচতুষ্টয়ের তিন-চতুর্থাংশের তীব্র বিষের প্রতিষেধক ভারতে সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন মুম্বাইয়ের Haffkine Research Institute । এখন ভারতে একমাত্র শঙ্খচূড়ের দংশন বজ্রাঘাতের মতো অমোঘ। সাম্প্রতিক তথ্য, শঙ্খচূড়ের প্রতিষেধকও আবিষ্কৃত হয়েছে থাইল্যান্ডে। ভারতে তা আজও অলভ্য।]

—আমরা… আমরা এখন কী করব?

—প্রতীক্ষা। আমার শরীরের অভ্যন্তরে একটা দ্বৈরথ-সংগ্রাম চলছে। এক পক্ষে বঙ্করাজের বিষ, অপরপক্ষে আমার জীবনীশক্তি। কে জয়ী হবে বলা অসম্ভব। তবে বঙ্করাজের বিষের অতি সামান্য অংশই আমার ধমনিতে প্রবেশ করেছে। আমার দেহও যোগাভ্যাসে প্রতিরোধে প্রস্তুত। তাই এখনি কিছু বলা যায় না। তদ্‌ভিন্ন মন্ত্রের শেষ পংক্তিটাও তো বিচার্য! সপ্তপুরুষের আশীর্বাদ আমার পক্ষে। এখন দেখা যাক কে জয়ী হয়!

২৬

ইতিমধ্যে দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সারা গাঁয়ে। ছোট্ট গ্রাম। এতবড় দুঃসংবাদ প্রচারিত হতে একদণ্ডও লাগেনি। বঙ্করাজের বিষে আহত হতভাগ্যের প্রহরান্তর হয় না। অর্থাৎ তিনঘটিকার ভিতরেই তার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু এক্ষেত্রে বঙ্করাজের বিষের অতি সামান্য অংশই প্রবেশ করেছে ওঁর রক্তবাহী শিরা-ধমনিতে। দুপক্ষের জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনা সমান-সমান!

বাড়ির বাহরে গোটা গ্রাম সমবেত। ভিতরে বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা। জাতিচ্যুতের এই প্রচণ্ড দুঃসংবাদে সামাজিক বাধা কেউই মানেনি। এসেছে সবাই।

শিরোমণি জীবনকে একটা ধমক দেন, ওঁকে অমন খাড়া করে বসিয়ে রেখেছ কেন? একটা মাদুর-বালিশ আনার কথাও কারও খেয়াল হয়নি?

জীবন এতই মর্মাহত, এতই অসহায় বোধ করছে যে, জবাব দেয় না।

রূপেন্দ্র মাঝে-মাঝে নিমীলিত নেত্র হচ্ছেন বটে, প্রচণ্ড নিদ্রাবেগে টলে-টলেও পড়ছেন; কিন্তু এখন তিনি অনেকটা সুস্থ। সজ্ঞানে আছেন। বললেন, না, শিরোমণি-খুড়ো। শয়ন এ অবস্থায় নিষিদ্ধ। তাতে বিষ মস্তিষ্কে প্রবেশের সুযোগ পায়। তাই উপবিষ্ট অবস্থায় পরিণতির প্রতীক্ষা করছি।

নন্দ বলেন, দোষটা বাপু তোমারই। তুমি কুলীন বামুন! রক্তচোষা বাদুড়ের মতো বায়েন-পোর রক্ত চুষে নিতে সঙ্কোচ হল না তোমার?

রূপেন্দ্র বলেন, তাতেই ও বেঁচে গেছে কিন্তু। ছেলেটিকে চিনতে পেরেছেন তো? বেষ্টাবায়েনের পুত্র। ওই তো দাঁড়িয়ে আছে ওর মা—যাকে সহমরণের চিতা থেকে উঠিয়ে আনা সম্ভবপর হয়েছিল।

রূপেন্দ্র ভাববাচ্যে বলেছেন। তবু নন্দের মনে হল এই ঘোষণার পশ্চাতে কিছু শ্লেষ আছে। স্মরণ হল সেদিনের পরাজয়ের কথা। গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে একলা সংগ্রাম করে রূপেন্দ্র যমুনাকে চিতাভ্রষ্টা করতে পেরেছিলেন। এটা তির্যকপথে ওঁকে অপমানই করা হল।

তাই ফিরিয়ে দিলেন শ্লেষাত্মক জবাব : তবে তো তুমি ওর দু-দুবার বাপ হয়ে গেলে, রূপেন্দ্র! দু-বার জন্ম দিলে যমুনার সন্তানটির। শুধু বাপ নয় এক্কেরে বাপ্-বাপ্!

জীবনের আর সহ্য হল না। বলে, তা যা বলেছেন দাদু! একবার যে বিয়ে করে তাকে বলি বর; বার বার যে মাথায় টোপর চড়ায় তাকে বলি বর্বর!

কর্ণমূল রাঙা হয়ে উঠল নন্দখুড়োর। তাঁর তিনটি সহধর্মিণী!

রূপেন্দ্রনাথ শুনতে পাননি। তাঁর প্রচণ্ড নিদ্রাবেগ এসেছে। ঘুমে টলে টলে পড়ছেন। পাশেই বসে ছিল শোভারানি। তাকে বললেন, তোর কোলে মাথা রেখে আমি একটু শোব রে? শোভা?

শোভা শিউরে ওঠে! ওর রাজপুত্র এমন কথা কোনওদিন বলেননি! ওর কোলে মাথা রেখে শয়নের এই আশাতীত অদ্ভুত প্রস্তাব! দাঁতে-দাঁত দিয়ে বললে, না রুপোদা! তোমার শোওয়া বারণ! তুমি নিজেই বলেছ। তুমি বসেই থাক। আমি বরং তোমাকে ধরে রাখছি।

সর্বসমক্ষে সম্ভ্রম বাঁচিয়ে সে তার রুপোদার দুটি বাহুমূল ধরে খাড়া করে বসিয়ে রাখল। এভাবে সে কখনও আলিঙ্গনাবদ্ধ করেনি ওই আগুনবরণ ছেলেটিকে। যার সঙ্গে বালিকা বয়সে তার নাকি একটা বিবাহ-প্রস্তাব উঠেছিল। তার নিমীলিত দু-চোখে জলের ধারা।

যমুনা তার মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা সন্তানটিকে আঁকড়ে নিশ্চুপ বসে আছে। এতক্ষণে গোপালের জ্ঞান হয়েছে। রূপমঞ্জরী অহেতুক ঘর-বার করছে।

২৭

অপরাহ্ণবেলায় শেষ হল দ্বৈরথ সমর। বঙ্করাজ বিজয়ী। পরাজিত করেছে কবিরাজের জীবনীশক্তিকে। জীবন ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল ওঁর মণিবন্ধ। তাতে আর স্পন্দিত হচ্ছে না প্রাণশক্তির প্রতিরোধী দুন্দুভি। শোভারানি ভেঙে পড়ল কান্নায়। চোখে আঁচল চাপা দিলেন তারাসুন্দরী। আর রূপমঞ্জরী? না, সে লুটিয়েও পড়ল না, মূর্ছিতাও হল না। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে রইল শূন্যে দৃষ্টি মেলে। প্রস্তর প্রতিমা!

একে-একে সবাই বাইরে বেরিয়ে গেলেন। পুরনারীদের এখন অশ্রুপাতে শান্ত হতে দিতে হয়। সেটাই প্রথা। তারপর করতে হবে সৎকারের আয়োজন।

ক্রমে ঘনিয়ে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। জীবনমৃত্যুর সংগ্রাম শেষ হবার পরেও কিছু কৃত্য থাকে। আবার সবাই একে একে ফিরে এলেন প্রাঙ্গণে। এল ফুল। মহাশবকে পরিয়ে দেওয়া হল গাঁদাফুলের মালা। শোভারানি যত্ন করে রুপোদার কপালে-গালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে দিল—সেই একদিন তার বিবাহ-রাত্রে যেমন এঁকে দিয়েছিলেন তাঁর বিমাতা—মৃন্ময়ী। তারাসুন্দরী দেবরের আঁখি-পল্লব দুটি নিমীলিত করে তার উপর স্থাপন করলেন দুটি চন্দনচর্চিত তুলসীপত্র।

শুধু আমাদের ত্রয়োদশবর্ষীয়া নায়িকার কোনও পরিবর্তন নেই। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে সে শুধু দূর-দিগন্তে দৃষ্টি মেলে একইভাবে বসে আছে। নির্বাক, নিষ্পন্দ। কী জানি, হয় তো এতক্ষণ সে দেখছিল পশ্চিমাকাশের রক্তরাঙা পটভূমিতে সেই নিঃসঙ্গ চক্রাবর্তনরত সূর্যসাক্ষী চিলটাকে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর সেটাও হারিয়ে গেল। সেখানে ফুটে উঠল সন্ধ্যাতারা।

নন্দ—যাঁকে তির্যক রসিকতায় ওই দুর্বিনীত ছোকরাটা ‘বর্বর’ বলেছিল—তিনি জীবনের দিকে ফিরে বললেন, খাটিয়া তো জোগাড় করে এনেছ বাবাজি, কিন্তু শববাহী পাবে কোথায়?

জীবনের চোখ দুটি রাঙা। বলে, কেন? গাঁয়ে কি বামুনের অভাব?

—তা নয়, কিন্তু রূপেনের ‘প্রাচ্চিত্তির’ তো হয় নাই, বাবা! জাতিচ্যুতকে বহন করার মতো বামুন তো তুমি খুঁজে পাবে না সোঞাই গাঁয়ে। তাইলে যে তাকেও জাতিচ্যুত হয়ে যেতে হবে!

তারাপ্রসন্ন প্রতিবাদ করে ওঠেন, এটা কী বলছেন আপনি! মৃত্যুতীর্থে যে পৌঁছে গেছে তার আবার জাত কী?

চাদরের প্রান্তে অশ্রুহীন চোখ দুটি মুছে নিয়ে নন্দ বললেন, বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে তারা! কিন্তু শাস্ত্রের বিধান যে সেইরকমই। চিরটাকাল এই নিয়মই চলে এসেছে গ্রাম্য সমাজে! ‘প্রাচ্চিত্তির’ না হলে জাতিচ্যুতের শ্মশানযাত্রী কেউ হতে পারে না।

সমবেত জনতার মধ্যে জাগল এক গুঞ্জনধ্বনি। পীতাম্বর কাতরকণ্ঠে বলে ওঠেন, তাহলে কীভাবে হবে ওঁর সৎকার? একটা কিছু করতে তো হবে?

—তাই তো ভাবছি! তুমি কী বল শিরোমণিভায়া?

শিরোমণি তাঁর অর্কফলাসমেত মাথাটি নেড়ে বললেন, কঠিন সমস্যা!

জীবন রুখে ওঠে : আপনাদের বিধান দিতে হবে না। আমরা দুভাই ওঁকে বহন করে নিয়ে যেতে পারব!

—দু ভাই! তাহলে খাটিয়ায় তো নেওয়া যাবে না, বাবা! মাদুরে জড়িয়ে বাঁশে ঝুলিয়ে নে-যেতে হবে! তা শিবনাথও কি রাজি আছে জাত দিতে?

শিবনাথ চিৎকার করে ওঠে, আজ্ঞে হ্যাঁ। বাবামশাইও রাজি হবেন। আমরা একুনে তিনজন। আপনি না হয় আমাদের গোটা পরিবারটাকেই ‘একঘরে’ করে দেবেন!

—বটে! আর চতুখ বাহকটি কে?

—হামি কাঁধ লগাবে বামুনমশা! ম্যয় সন্ন্যাসী হুঁ। হমার কুনো জাত না আছে। সমঝলেন?

একমুঠিবাবা! নিদারুণ দুঃসংবাদটি শুনে সে বৃদ্ধও এসে দাঁড়িয়েছে জনারণ্যের একান্তে।

জীবন বলে ওঠে, তবে আর একটা কথাও জেনে রাখুন চাটুজ্জে-দাদু! আরোগ্য-নিকেতনে এখনও কিছু রোগী মরতে বাকি। তাদের দায়িত্ব কিন্তু আপনার! সমাজপতি হিসাবে। আমি কাল থেকে পীরপুরে যাব। এ গাঁয়ে কারও চিকিৎসা করব না।

নন্দ গুম্ খেয়ে গেলেন। শিরোমণি বলেন, এটা তো তোমার অন্যায় কথা হল, জীবন। আমাদের উপর রাগ করে তুমি….

জীবন তাঁকে বাধা দিয়ে বলে ওঠে, ও আলোচনাটা কালকেও হতে পারে শিরোমণি-জ্যাঠা! আগে পঞ্চায়েত আমাদের একঘরে করুক! ততক্ষণে শ্মশানের কৃত্যটা আমরা সেরে আসি বরং।

নন্দ বলেন, কিন্তু কোন্ চিতায় ওঁকে পোড়াবে, বাবা?

–‘কোন্ চিতায়’ মানে?

—তুমি গাঁয়ের ছেলে হয়ে জান না, শ্মশানে তিনটি এলাকা আছে? বামুন, কায়েত আর জল-অচলদের? মৃতের শরীরে এখন যে রক্ত তাতে তো বায়েনের রক্ত মিশে গেছে। মৃত্যুর পূর্বেই সে নিজমুখে তা স্বীকার করে গেছে। যায়নি?

এতক্ষণে উঠে দাঁড়াল রূপমঞ্জরী। অনবগুণ্ঠিতা সদ্যপিতৃহারা একফোঁটা মেয়েটা। যুক্ত করে এগিয়ে এসে বললে, আপনারা এবার আসুন! আমরা ওঁকে ওই অচ্ছুতদের শ্মশানেই দাহ করব! আপনাদের দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই!

—তুমি আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছ হটী?

—না! কিন্তু এ ভিটে তো অপবিত্র! জাতিচ্যুতের ভদ্রাসন! আপনারা এবার আসুন!

তারপর তারাপ্রসন্নের দিকে ফিরে বললে, জোড় হস্তে অনুনয় করছি জেঠু! আমাকে আপনারা এবার রেহাই দিন!

নন্দ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তারাপ্রসন্ন প্রায় ধমক দিয়ে রুখে দিলেন, না! হার কোনও কথা নয়। আসুন, আমরা স্থানত্যাগ করি! মামণি সহ্যের শেষ সীমান্তে পৌঁছে গেছে!

নতমস্তকে সমাজপতিরা একে একে বিদায় হলেন। তারাপ্রসন্ন কিন্তু স্থানত্যাগ করলেন না। বললেন, মামণি, আমি যদি শ্মশানযাত্রী হতে চাই, তোর আপত্তি আছে? এতক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা। জড়িয়ে ধরল তার জ্যাঠামণিকে। যাঁর কোলেপিঠে ওর বাল্যকাল কেটেছে! বালিকা থেকে তরুণী হয়েছে।

২৮

দামোদরের তীরে। সোঞাই গ্রামের শ্মশানঘাট। লোকে লোকারণ্য। সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়েছে তাদের অতি প্রিয় একবগ্গা-ঠাকুরকে শেষ বিদায় জানাতে। সমাজপতিদের ভিতর উপস্থিত আছেন একমাত্র একজন : ভূস্বামী তারাপ্রসন্ন।

পরলোকগতের একমাত্র কন্যার ইচ্ছানুসারে মহাশব বহন করে এনেছে জল-অচল অচ্ছুতেরাই। তারাই তো ওঁর শ্মশানবন্ধু হবার অধিকারী। তাদের সেবাই তো তিনি করে গেছেন সারাটা জীবন। মহাশবের ধমনিতেও থমকে থেমে আছে বায়েনের রক্তকণিকা। ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের মিলিত জমাট-বাঁধা শোণিত।

কন্যা হিসাবে যা কিছু কৃত্য তা সম্পন্ন করে গেল নিরুচ্ছ্বসিত নিষ্ঠায়। মুখাগ্নিও করল। চোখে তার জল নেই। রাত এখন একপ্রহর। চিতায় অগ্নিস্পর্শ করল স্বহস্তে। না, চন্দন কাঠ জোটেনি। তাতে যে অনেক খরচ। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল চিতা। অচ্ছুতদের উপেক্ষিত একান্ত-শ্মশানে।

যুক্তকরে দণ্ডায়মানা দুচোখ মেলে দেখল। অস্ফুটে উচ্চারণ করল শেষ মন্ত্র “বিমুখা বান্ধবা যান্তি ধৰ্মস্তিষ্ঠতি কেবলম্”।*

[অনুমতি দাও : তোমার শ্মশানবন্ধুরা এবার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করবে। এখন থেকে তোমার সাথী, তোমার সঙ্গী : একমাত্র তোমার ধর্ম!]

২৯

গুরুদেবের আদেশ শিরোধার্য করে অয়োদধৌম্যের সাধক-শিষ্য আরুণি যাত্রা করেছিলেন অসাধ্য সাধনে। দুর্বার বন্যাস্রোত থেকে সুজলা-সুফলা মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে। প্রচণ্ড প্লাবনে যখন মৃত্তিকাবন্ধনী বিচূর্ণ হয়ে গেল তখন তিনি ভগ্নস্থানে অকুতোভয়ে স্থাপন করেছিলেন নিজের শরীর! গুরুর আশীর্বাদে তাঁকে প্রাণদান করতে হয়নি। জীবিত প্রত্যাবর্তন করেছিলেন আশ্রমে।

‘কেদারখণ্ড বিদারণপূর্বক উত্থান-হেতু’ গুরুদেব তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন নূতন উপাধিতে, নূতন সংজ্ঞায়। তিনি হয়ে গিয়েছিলেন : ঋষি উদ্দালক!

উদ্দালক সিদ্ধকাম। তিনি সার্থক।

কোনও অলক্ষ্য গুরুর অন্তর্লীন আদেশে রূপেন্দ্রনাথও ছুটে গিয়েছিলেন বন্যারোধের ব্রত গ্রহণ করে। কুসংস্কারের প্রচণ্ড প্লাবনে যখন শুভবুদ্ধির প্রাচীর বিদীর্ণ হয়ে গেল তখন তিনিও ভগ্নস্থানে স্থাপন করেছিলেন তাঁর শরীর। দুর্ভাগ্য তাঁর। জীবিত প্রত্যাবর্তন করতে পারেননি। পারেননি সেই অষ্টাদশ শতাব্দিতে সুজলা-সুফলা জন্মভূমিকে রক্ষা করতে।

রূপেন্দ্রনাথ ব্যর্থকাম। তিনি নিরর্থক!

ভুল লিখলাম না তো? ‘সিদ্ধকাম’ হওয়াই কি পরমার্থ? দুনিয়ার অযুত-নিযুত ব্যর্থকাম শহিদের জীবন কি নিরর্থক? রূপেন্দ্রনাথের সাধনা যে ছিল ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত! শুধু কর্মেই ছিল তাঁর অধিকার! ‘সিদ্ধকাম’ আর ‘ব্যর্থকাম’ জীবনদ্বয় তাঁর অদ্বৈতদর্শনে নিরর্থক!

তাই তাঁকে স্বাগত জানাতে অগ্নিদেবের লেলিহান শিখায় তাঁর সেই অলক্ষ্য গুরুদেব পাঠিয়ে দিয়েছেন শিষ্যের জন্য বিজয়রথ!

হিরণ্যগর্ভ সেই অন্তরীক্ষবাসী গুরুর সঙ্গে মিলন হল তার একনিষ্ঠ সেবকের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *