রূপমঞ্জরীর বিবাহ ও বৈধব্য – (1748-1757) – একাদশ পৰ্ব

রূপমঞ্জরীর বিবাহ ও বৈধব্য – (1748-1757) – একাদশ পৰ্ব

ষোলো-আনার ডাকে একবগ্গাকে কবজা করা গেল না। নন্দ চাটুজ্জে যৎপরোনাস্তি মর্মাহত। গ্রামের প্রায় সবকয়টি মাতব্বরকেই তিনি কবজা করতে পেরেছিলেন—শিরোমণি মশাই, চক্কোত্তি খুড়ো, ঘোষালদা ইত্যাদি। নব্যযুবকের দল—বড়খোকা, কালু, গজেনরা তো ছিল একপায়ে খাড়া। হুকুম পেলেই তারা ওই একবগ্গার চালাঘরের ভিটায় আগুন ধরিয়ে দিত। কিন্তু রূপেন্দ্র যে এভাবে দাবা ধরে ওঠসাই কিস্তি দিয়ে বসবে তা কে জানত? লোকটা ঘোর নাস্তিক, দুর্বিনীত, বেয়াদপ—একশোবার! কিন্তু নন্দ চাটুজ্জেও স্বীকার করতে বাধ্য যে, কোবরেজ হিসেবে ওই কালাপাহাড়টা পঞ্চগ্রামে একটা সাড়া ফেলে দিয়েছে। জমিদারগিন্নি জ্ঞানসুন্দরীর সেই তাকলাগানো চিকিচ্ছের দিন থেকে, ব্রজসুন্দরীর অন্তর্জলিযাত্রার সব আয়োজন যখন সমাপ্ত তখন ওই একবগ্গা ধন্বন্তরি যমদূতদের রুখে দিয়েছিল। সবাই তাজ্জব। অথচ সহজ হিসেবটা কেউ বুঝল না! ভাদুড়িগিন্নি তো জীবন ফিরে পেলেন অন্য কারণে : জমিদারের কুলগুরু দেবতার মন্দির চাতালে যে মহাযজ্ঞটা করলেন সেটা কি নজরে পড়ল না তোদের? কয়েক মন গাওয়া ঘি পুড়ে ছাই হয়ে গেল—ধোঁয়ায়-ধোঁয়ায় চতুর্দিক অন্ধকার। যমদূতেরা পালাবার পথ পেল না। এই সোজাকথাটা ওই অশিক্ষিত চাষাভুষোগুলো বুঝল না! তারা ওই একবগ্গার ওপর দেবত্ব আরোপ করে বসল।

পঞ্চায়েতের ষোলোআনার ডাকে রূপেন্দ্রনাথ চরিত্রগত দার্ঢ্যে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যালয়’ অমর! সোঞাই পঞ্চায়েত যদি বাধ্য করেন তবে তিনি এ গ্রামের বাস উঠিয়ে দেবেন। চলে যাবেন ত্রিবেণীতে। তাঁর গুরু মহামহোপাধ্যায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের আশ্রয়ে। তিনি নিশ্চয় সানন্দে স্বীকৃত হবেন তাঁর আশ্রমের একান্তে এই মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়। ভারত ভূখণ্ডের প্রথম স্ত্রীলোকের বিদ্যালয়ের স্থানান্তর ঘটতে পারে, তার মৃত্যু নেই। হতে পারে না।

সোঞাই গাঁয়ের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষেরা পঞ্চায়েতের বিধানে সন্তুষ্ট হয়নি। মেয়েরা বারোহাত কাপড়ে কাছা দেয় না। তাদের পাঠশালা কোথায় থাকবে, আদৌ থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাদের এক কথা : ধন্বন্তরি বাবাঠাকুরকে তারা গাঁ-ছাড়া হতে দেবে না। এই তাদের পণ! ওরা বুঝতে শিখছে, ওলাবিবি-শীতলা-মনসা মাথায় থাকুন; কিন্তু ধন্বন্তরির প্রয়োজন আছে। বিন্-চিকিচ্ছেয় মরতে তারা আর রাজি নয়। তাই ধন্বন্তরি বাবাঠাকুর গাঁয়ে থাকবেন। ব্যস্। শেষ কথা! হক্কতা!

পঞ্চায়েত বিচারসভা থেকে বিজয় গৌরবে ফিরে এলেন বটে কিন্তু শেষরক্ষা বোধহয় করা গেল না। হারাধনের দশটি ছেলের মতো তাঁর প্রথম যুগের আটটি ছাত্রী একে একে নেপথ্যে সরে যেতে থাকেন!

আদিযুগে ব্রজসুন্দরী স্ত্রীশিক্ষায়তনে বিদ্যারম্ভ করেছিলেন এই গ্রামের সাতজন মহিলা এবং একটি বালক—একুনে : আট। চারটি পর্যায়ে। একালের ভাষায় বলা যায় চারটি ‘পিরিয়ড’-এ। ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে রূপেন্দ্রনাথ অশ্বপৃষ্ঠে বেরিয়ে যেতেন গ্রাম-গ্রামান্তরে। রুগি দেখা সারা করে ফিরে এসে বসতেন প্রথম পর্যায়ের বিদ্যাদান আয়োজনে। সেটা বয়োজ্যেষ্ঠাদের শ্রেণি। তিনটি ছাত্রী। পীতাম্বর মুখুজ্জের দিদি—তিন কুড়ি পাড়ি দেওয়া গিরিবালা। তাঁর অন্তিম লক্ষ্য কৃত্তিবাসী রামায়ণ নিজে-নিজে পড়তে পারা। ব্যস! আর কিচ্ছু নয়। তিনি নাকি ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদ করে বর্তমানে রূপেন্দ্রনাথের সংসারে আশ্রয় নিয়েছেন। দুনম্বর ছাত্রী তারাসুন্দরী। রূপেন্দ্র অপেক্ষা সামান্য বয়োজ্যেষ্ঠা। জমিদার তারাপ্রসন্নের সহধর্মিণী। পিতৃদত্ত নাম তাঁর নিশ্চয় একটা ছিল, কেউ তা জানে না। জমিদারবাড়ির চিরকালের রেওয়াজ বিবাহরাত্রেই নববধূকে তার জীবনসঙ্গীর নামের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া। পিতৃদত্ত নামটা কনকাঞ্জলির থালায় তাকে পিতৃদেবকেই ফিরিয়ে দিতে হয়। যেমন তারাসুন্দরীর শাশুড়ি-মায়ের নাম ছিল ব্রজসুন্দরী। যেহেতু শ্বশুরের নাম ব্রজমোহন ভাদুড়ী।

তিন নম্বর ছাত্রীটি পুঁটুরানি। সেও বিধবা হবার পর বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে। এঁরা তিনজনে শিখতেন বাংলাভাষা। বাংলা অক্ষর পরিচয়ের কোনও বই ছিল না। থাকবে কোথা থেকে? হরফ নির্মাণ শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার—যাঁর গড়া হরফে প্রথম ছাপা বই প্রকাশিত হবে—তিনি তখনো জন্মাননি। বই ছিল না ঠিকই, তবে পুঁথি ছিল ফলে বাংলা হরফও ছিল। খাগের কলমে লেখা ভাষাটাও ছিল। চর্যাপদের প্রাকৃত পৈঙ্গল নয়, আ-মরি বাংলা ভাষা। কৃত্তিবাসী রামায়ণ সহজ সরল বঙ্গভাষে। তার লিখিত রূপ ছিল পণ্ডিতব্যক্তির স্মৃতিকোষে। রূপেন্দ্রনাথ সেই অক্ষরই পরিচয় করাতে উদ্যোগী। অক্ষর পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপেন্দ্র তাঁদের মুখে মুখে শেখান কিছু ধর্মকথা। উপনিষদের তত্ত্ব, পুরাণ আর মহাকাব্যের নানান কাহিনি। শুধু সতী-সীতা-সাবিত্রী নয়—গার্গী, মৈত্রেয়ী, মদালসা, বিশ্ববারার উপাখ্যান। সেই সঙ্গে হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের কথাও

দ্বিতীয় পাঠের আসরে দুইজন ছাত্রী। প্রথম, ঘনশ্যাম সার্বভৌমের বিধবা, মালতী। বর্তমানে তিনি ত্রিবেণী ত্যাগ করে এসে বাস করছেন রূপেন্দ্রর ভদ্রাসনে। তাঁর স্বামী ছিলেন মহাজ্ঞানী, কিন্তু তিনি নিজে ছিলেন নিরক্ষরা। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তিনি বাংলা পড়া শেষ করতে চান। দ্বিতীয়, শোভারানি। দুর্গা গাঙ্গুলীর অনুঢ়া কন্যা। কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মানোর অপরাধে দেড় কুড়ি পাড়ি দিয়েও যে সিঁথিতে সিঁদূর লাগাতে পারেনি। তার পাঠে যে খুব কিছু মনোযোগ আছে তা মনে হয় না। দুর্গা গাঙ্গুলী বর্তমানে গ্রামে অনুপস্থিত কিন্তু পরিবারের সকলেই শোভারানির বিদ্যালাভের বিরুদ্ধে। মেয়েটা তবু রোজ আসে। চুপচাপ বসে রূপেন্দ্রের কথা শোনে। তাঁকে দেখে দুচোখ মেলে। তার মূল আকর্ষণ যে মা সরস্বতী এমন মনে হয় না।

তৃতীয় পাঠের আসরে দুটি ছাত্রী এবং একজন ছাত্র। রূপমঞ্জরী আর শুভপ্রসন্ন। তারা শেখে বাংলা। পুঁটুরানির চার বছরের মেয়েটি এসে বসে থাকে চুপচাপ। তার এখনো অক্ষর পরিচয় হয়নি। বলা যায় নার্সারি ক্লাসের ছাত্রী। শুভপ্রসন্ন বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতও শিখতে শুরু করেছে। বয়সে সে রূপমঞ্জরীর চেয়ে বছর চার-পাঁচের বড়।

আর চতুর্থ পাঠের আসর বসে পড়ন্ত বেলায়। দামোদরের ওপার থেকে ছাত্রী আসে তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে। মৌলবিসাব মুর্শিদাবাদের নবাব সরকার থেকে একটি বিচিত্র বৃত্তিলাভ করেছেন : রামায়ণের একটি বিশেষ ‘কাণ্ড’ ফার্সিতে অনুবাদ করে দেওয়ার দায়িত্ব। নবাব আলিবর্দির খেয়াল। হিন্দু-মুসলমান প্রজার মধ্যে সম্প্রীতি আনার প্রচেষ্টায় আলিবর্দি এ কাজে হাত দেন। রামায়ণ ফার্সিতে অনূদিত হবে আর কোরানসরিফ বাংলায়। মৌলবিসাবের মাতৃভাষা বাংলা। কৃত্তিবাস বা কাশীরাম দাস পঠিত হলে বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু অক্ষর পরিচয় নেই। মৌলবিসাবকে তো আর মহিলা বিদ্যায়তনে ভর্তি করা যায় না, তাই এই বিকল্প আয়োজন। মেহের বোরখা পরে এসে বসে পাঠশালা সংলগ্ন মেঠো দাওয়ায়। মৌলবি বসে থাকেন সাবেক আমগাছের ছায়ায়। শ্রুতিসীমার ভিতরেই। তাঁর আশা : বাংলা হরফ শিখে মেহের একদিন কৃত্তিবাসী রামায়ণ ওঁকে পড়ে শোনাতে পারবে। বোরখার নিচে মেহেরের মুখটি কখনো দেখেননি রূপেন্দ্রনাথ। তালাক পাওয়া এ হতভাগিনীর মুখখানি বিষাদমাখা কিনা জানা নেই। তবে তার কণ্ঠস্বর সুমিষ্ট, তার মেদহীন দীর্ঘায়ত দেহে যৌবনের নানান উপচার।

গোল বাধল এই যবনীকে নিয়েই।

শনের দড়ি টানলে বাড়ে। হক কথা। কিন্তু সে বৃদ্ধির একটা শেষ সহ্যসীমা আছে। সেটা অতিক্রম করলে দড়ি ছিঁড়ে যায়। এই সহজ কথাটা মানতে রাজি নন একবগ্গা-ঠাকুর। অষ্টাদশ শতাব্দির মাঝামাঝি তিনি বিদ্যাসাগর-মশাই বা মদনমোহন তর্কালংকারকে ডিঙিয়ে একেবারে রোকেয়া সাকাওয়াৎ খাতুন বেগমসাহেবার জমানায় চলে আসতে চান। তা কি ‘ধৰ্ম্মে সইবে’? ‘বাউনের’ সাতপুরুষের ভিটেয় মেহেরউন্নেসা? যবনী!!

সামনাসামনি তর্ক করতে কেউ এগিয়ে এল না। কয়েকজন আচমকা অনুপস্থিত হতে শুরু করলেন। প্রথমে তারাসুন্দরী আর পুঁটুরানি। পরে শোভারানিও। তবে পাকাপাকিভাবে নয়। এভাবেই টালমাটাল কদিন চলল। তারপর পাকাপাকিভাবে নাম কাটাতে এলেন মৌলবিসাবই। সঙ্গে সেই বোরখা-ঢাকা বহিনজি।

মৌলবি এসে বললেন, ভাইসাব! আপনাকে লাখ লাখ শুক্রিয়া। লেকিন আমার বদনসিবে বাংলা শেখার সৌভাগ্য হল না। আমরা দু-ভাই বহিন্ এসেছি আপনার কাছে মাফি মাংতে আর বিদায় নিতে।

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, কেন বড়ভাই, আমার কী কসুর ছিল?

—না, ভাইসাব কসুর আপনার নয়, কসুর আমার বদনসিবের। শুনুন বলি : দুর্ভাগ্যই বটে। মৌলবিসাব-এর তলব এসেছিল সদরের বড়া-ইমাম-এর কাছ থেকে। তিনি ডেকে নিয়ে ওঁকে প্রচণ্ড ধমক দিয়েছেন। এ কী বেলেল্লাপনা! নিজের বহিনকে প্রতিদিন হাত ধরে এক কাফেরের বাড়িতে নিয়ে যাস্! লজ্জা করে না! বেশরম কাঁহাকা! শুনেছি তোরা দুজন নাকি ওই পুতুলপুজোর মেওয়া-মেঠাই খাস্! হক কতা?

মৌলবি বুঝিয়ে বলতে চেয়েছিলেন যে, নিতান্ত বাধ্য হয়ে তিনি বাংলা ভাষাটা শিখতে চান। আর কোনও হেঁদু পণ্ডিত রাজি হয়নি। বলেন, আপনি যদি আদেশ করেন এখন থেকে ওবাড়ির জলস্পর্শ করব না। লেকিন বাংলা ভাষাটা আমাকে শিখতে হবেই।

–কেন রে? ওই কাফেরদের ভাষা শিখে কী হবে?

মৌলবি বলেননি যে, যে ভাষায় ওঁরা দুজন বর্তমানে কথা বলছেন সেটা উর্দু, ফারসি বা আরবি নয়। শুধু বলেছিলেন যে, তিনি নবাব সরকার থেকে বায়না নিয়ে বসে আছেন। একটি বাংলা পুঁথি ফারসিতে অনুবাদ করার জন্য।

কায়দা করে বইটার নাম উল্লেখ করেননি। বড়া-ইমাম ওঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, আলিবর্দির সে খোয়াব দেখা শেষ হয়েছে। বাংলা হরফে কোরানশরিফ রচনার ইবলিসি পরিকল্পনা আর ফারসিতে ওই কাফেরদের কী-সব কিস্সা! আরও বললেন, বায়না যেটা পেয়েছিস সেটা গায়েব করে দে। নবাবের মীর মুন্সির সঙ্গে আমার বাতচিৎ খতম হয়ে গেছে।

আলিবর্দি ততদিনে তাঁর বিবি এবং জামাতাদের ষড়যন্ত্রজাল বিদীর্ণ করতে সত্যই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর সে খোয়াব আঁতুড়ঘরেই মারা গেল।

দীর্ঘদেহী যুবতীটি কোনও কথা বলেনি। নীরবে তিনবার কুর্নিশ করে বিদায় নিয়েছিল। সেই প্রথম ভাঙন!

হারাধনের আটটি মেয়ের একটি কুপোকাত
কাফের বাড়ি প্রসাদ পাওয়ায়। রইল বাকি সাত।

কিন্তু তারাসুন্দরী আর পুঁটুরানি আসে না কেন?

খোঁজ নিতে গেলেন জমিদার বাড়িতে। তারাপ্রসন্ন ওকে সমাদর করে বসালেন তাঁর বৈঠকখানায়। অভ্যর্থনায় ত্রুটি হল না। আবক্ষ অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে একটি দাসী ব্রাহ্মণের জন্য রেখে গেল কাঁসার থালায় কৃষ্ণগোবিন্দজির বৈকালি ভোগ আর বেলের পানা।

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, কদিন ধরে বউঠান আর পুঁটুরানি আমাদের বিদ্যায়তনে আসছেন না। তাই খবর নিতে এলাম। ওঁদের শরীর-গতিক ভালো তো?

—হ্যাঁ গো! শরীর-গতিক বেজুতের হলে তুমিই তো সবার আগে খবর পেতে, কিন্তু সেসব কথা পরে। প্রথমে মুখ হাত ধুয়ে প্রসাদটুকু সেবা কর দিকিনি।

সেসব পালা মিটলে রূপেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন, এবার বল তারাদা?

—শোন ভাই। তোমাকে খোলাখুলিই বলছি। শুভ তোমার বিদ্যাপীঠে যাবে, কিন্তু তোমার বৌঠান বা পুঁটুর পক্ষে আর তা সম্ভবপর নয়। মানে, তোমার ভদ্রাসনে তারা যাবে—একশোবার যাবে—কিন্তু ওই বিদ্যায়তনে তাদের পক্ষে আর পড়াশুনা করতে যাওয়া সম্ভবপর নয়।

কেন তারাদা? ওই যবনী ছাত্রীটির জন্যই তো? শোন। তোমাকে সে-কথাই জানাতে এসেছি। মেহের আর কাল থেকে বিদ্যায়তনে আসবে না। তুমি যদি চাও তাহলে গাঙ্গুলীখুড়োর বাড়ি থেকে বিশুদ্ধ গঙ্গাজল এনে আমি ওই দাওয়াটা গোময় দিয়ে নতুন করে নিকিয়ে নেব। কিন্তু ওঁদের লেখাপড়া শেখাটা তুমি বন্ধ করে দিও না। এ আমার সনির্বন্ধ নিবেদন তারাদা।

—না, রূপেন! এটাতে আমার কোনও হাত নেই। আমি নিতান্ত অপারগ। তোমার কাছে আমি মার্জনা চাইছি। স্ত্রীলোকের অক্ষর-পরিচয় হলে তারা ব্যাপিকা’ হয়ে যাবে, এমন কুসংস্কার আমার নেই। আমার জননী স্বয়ং ছিলেন বাংলা ও সংস্কৃত দুটি ভাষায় প্রগাঢ় পণ্ডিতা। তুমি জান। ফলে অমন একটা ভুল ধারণা আমার নাই।

—তাহলে বাধা কোথায়?

—দিনতিনেক আগে আমাদের কুলগুরু একটি পত্রে আমাকে আদেশ করেছেন এ জাতীয় ধর্মবিরুদ্ধ কাজ থেকে আমি যেন বিরত থাকি।

—ধর্মবিরুদ্ধ কাজ! জেঠিমা কি তাহলে….

–তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না, ভাই। কিন্তু আমার অবস্থাটাও বুঝে দেখ। তিনি আমাদের কুলপুরোহিত, কুলগুরু! তাঁর আদেশ আমি লঙ্ঘন করতে পারি না। তবে শুভ যাবে!

নতমস্তকে স্বগৃহে ফিরে এসেছিলেন রূপেন্দ্রনাথ

হারাধনের সাতটি মেয়ের দুটি হল গত।
কুলগুরুর অমোঘ বিধান! রইল বাকি কত?

তার ঠিক পরেই সোঞাই গাঁয়ে হয়ে গেল এক ইন্দ্ৰপতন!

সেদিন সকালে হঠাৎ গাঙ্গুলীবাড়ির সেজ-তরফের বড়কর্তা কালিচরণ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ওঁর বাড়িতে। পিছন পিছন শোভারানি।

কালিচরণ হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, তুমি খবরটা পেয়েছ তো রূপেন?

—খবর? কী খবর? কার খবর?

—বড়দা যে কাল একপ্রহর রাতে তীর্থ থেকে ফিরে এয়েছেন। চৌদোলায় চেপে। পুরীর পাণ্ডাঠাকুরের এক ছড়িদারকে সঙ্গে করে। খুবই কাহিল। বোধহয় এ যাত্রা আর তাঁকে বাঁচানো যাবে না। পিত্যিপুরুষের ভিটেয় যে প্রাণটুকু নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন এটা আমাদের পুণ্যিফল।

রূপেন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে যান। কালিচরণের বড়দা মানে দুর্গা গাঙ্গুলী। তার মানে, সেই ক্লেদাক্ত প্রসঙ্গটা আবার উঠে পড়বে। যে করুণ ইতিহাস উনি বুকের পাঁজরের ভিতর লুকিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন দীর্ঘদিন। মীনুর বাবা অথবা মাকে মন খুলে বলতে পারেননি। এমন কি শোভারানিকেও নয়। দুর্গা গাঙ্গুলী ফিরে আসায় সেই থিতিয়ে যাওয়া নিস্তরঙ্গ হ্রদে আবার জাগবে পঙ্কিল আলোড়ন। সোঞাই গাঁয়ের মানুষ হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠবে। খরজিহ্ব নরনারী যাচাই করতে চাইবে গাঁয়ের মেয়েটা কোথায় গেল শেষ পর্যন্ত? শ্রীক্ষেত্রের কোন লালবাতিজ্বলা দেহব্যবসায়ীর চাকলায়? নাকি একবগ্গাঠাউর সত্যিই গাঙ্গুলীবুড়োর নাকের ডগা দিয়ে তার ডবকা বউটাকে নিয়ে সংযুক্তা-হরণ করেছিল? বুড়োটা তো সে কতাই বলেছিল। তাই নয়?

কালিচরণ বলেন, কাল রাতে আর তোমারে বিরক্ত করিনি। কিন্তু উনি সারারাত যত্তন্নায় কাতরেছেন। তা আজ বাপু তোমাকে একটিবার আসতেই হবে। বাঁচবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তাঁর যন্তন্নাটা চোখ চেয়ে দেখা যায় না।

কথাগুলো রূপেন্দ্রের কর্ণগোচর হল কি না বোঝা গেল না। দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে তিনি নিশ্চল দাঁড়িয়েই রইলেন। কী ভাবছিলেন তিনি? মীনুর কোন্ কথাটা? বিষ প্রার্থনা? নাকি কোনার্ক তীর্থে আবির মাখানো? অথবা তার সেই বাঁধনছেঁড়া রাতের উন্মত্ত অভিসার? তৎক্ষণাৎ কে যেন ওঁর কর্ণমূলে হুঙ্কার দিয়ে উঠল : ক্যা রে বেটা, তু গঙ্গাপুত্র পিতামহ ভীষ্ম তো নহি হো?”

—রুপোদা!—নারীকণ্ঠের সনির্বন্ধ আকুতি।

—উ?—সম্বিত ফিরে পেলেন শোভারানির ডাকে।

—বাবাকে দেখতে একটিবার আসবেন না?

ম্লান হাসলেন ভেষগাচার্য। বললেন, না শোভা। তোমার বাবার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের কোনও স্পৃহা আমার নেই।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল কালিচরণের। অস্ফুটে যেন আপন মনেই বলে ওঠেন, এমন একটা আশংকা আমার ছিলই। সেকথাও ওঁর কানে গেল না বোধহয়। একই নিশ্বাসে বলে ওঠেন, তবে আতরুগীর চিকিৎসায় আমাকে যেতে হবে বইকি। চল-

উনি শুধু একাই খবরটা পাননি। দুর্গা গাঙ্গুলী যে শ্রীক্ষেত্র থেকে সশরীরে ফিরে এসেছেন, তিনি যে মৃত্যুশয্যায় শায়িত এ সংবাদটা সোঞাই গাঁয়ে আর কারো জানতে বাকি নেই। কালিচরণ আর শোভারানি যখন ও বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল তার অনেক আগেই সারা গাঁয়ের লোক ভিড় করে এসেছে। কিছু নিকট-আত্মীয়, ওঁর সম্পত্তির ওয়ারিশানরা, আর অধিকাংশই প্রজা, খাতক অথবা গঙ্গাজল সরবরাহ কারবারের কর্মী। এসেছেন গাঁয়ের মাতব্বরেরাও—নন্দ চাটুজ্জে, শিরোমণি মশাই, চক্কোত্তি অথবা ঘোষাল খুড়ো। একটু দূরে বসে আছেন দুর্গা গাঙ্গুলীর পূজ্যপাদ শ্বশুরমশাই—পীতাম্বর মুখোপাধ্যায়। মীনু নেই, তা হোক, বয়োজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ জামাতা বাবাজীবন আজ মৃত্যুশয্যায় একথা শুনে তিনিও এসে হাজির হয়েছেন, সস্ত্রীক। মীনুর-মা ঘরের অপরপ্রান্তে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন একগলা ঘোমটা টেনে। এ বাড়ির পুরললনাদের ভিড়ে।

কোনওদিকে দৃকপাত না করে ভেষগাচার্য কালিখুড়োর অনুগমন করে এগিয়ে গেলেন রোগীর দিকে। প্রকাণ্ড বড় ঘরটি। কর্তামশায়ের শয়নকক্ষ। বিরাট পালঙ্ক। সাবেককালের কারুকার্যখচিত দ্বৈতশয্যা। চিত হয়ে নিমীলিতনেত্রে শুয়ে আছেন গৃহস্বামী। একেবারে কঙ্কালসার। মুণ্ডিতমস্তকে বিরলকেশ-অর্কফলা। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। শিয়রের কাছে কে-এক অবগুণ্ঠনবতী একটি তালপত্রের পাঙ্খায় বীজন করে চলেছেন। রোগীর ললাটে একটি সিক্তবস্ত্র। মাঝে মাঝে সেটিকে ভিজিয়ে কপালে পট্টি দিচ্ছেন। তিনি বড় খুড়িমা না ছোট, তা রূপেন্দ্রের আন্দাজ হল না। কক্ষটি বিরাট, তবু আগন্তুকের ভিড়ে তা ‘উপচীয়মান’। রূপেন্দ্রনাথ বললেন, রোগীর ঘরে এত ভিড় কেন? ঘরটা ফাঁকা করে দিন। ওঁকে নিশ্বাস নিতে দিন।

মহড়া নিতে এগিয়ে এলেন নন্দখুড়ো : ঠিক কথা। এত ভিড় কীসের? অ্যাঁ? এ কি রথ, না দোলমঞ্চ? যাও, তোমরা সব বাইরে যাও।’

সুড়সুড় করে অনেকেই চলে গেলেন। ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল। গ্রামের মাতব্বর কজনই রইলেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। নন্দ আবার তাঁর গদি-মোড়া কেদারায় উপবেশন করে থেলো কড়িবাঁধা বামুন-হুঁকায় তাম্রকূট সেবন করতে থাকেন।

রূপেন্দ্র এগিয়ে এসে রোগীর জ্বর তাপ লক্ষ্য করলেন। না, দেহের উত্তাপ অধিক নয়। অবগুণ্ঠনবর্তীকে—বড় অথবা ছোট খুড়িকে–বললেন, আর জলপটি দিতে হবে না, মা। তবে পাখার হাওয়াটা চলবে।

রোগী নিমীলিতনেত্র। পাঁজরসর্বস্ব বক্ষদেশ ওঠাপড়া করছে নিশ্বাসের তালে-তালে। জ্ঞান আছে কিনা বোঝা গেল না। হয়তো অজ্ঞানেই কাতরাচ্ছেন বৃদ্ধ। রূপেন্দ্র ওঁর বলিরেখাঙ্কিত শীর্ণ হাতটি নিজ মুষ্টিতে তুলে নিয়ে বলেন, কী খুড়ো, আমাকে চিনতে পারেন?

বৃদ্ধের নিমীলিত কোটরগত চোখ দুটি খুলে গেল। ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে প্রশ্নকর্তার দিকে দৃকপাত করলেন। বহুদূর থেকে যেন ভেসে এল ক্ষীণ কণ্ঠস্বর : একবগ্গা

—এই তো চিনতে পেরেছেন। তাহলে আর ভয় কি? বলুন, কী কষ্ট হচ্ছে? কোথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?

—পেটে। না, না বুকে!

—পেটে না বুকে?

—ঠিক মধ্যিখানে।

রূপেন্দ্রনাথ ওঁর নাড়ির গতি লক্ষ্য করতে থাকেন। নিমীলিতনেত্রে। সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাম একাগ্র করে শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ওই শয্যালীন বৃদ্ধের শারীরিক বৈকল্যবার্তা। সবাই স্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। শুধু মাঝে মাঝে কী একটা ‘গুড়ুক গুড়ুক’ শব্দ! ভেষগাচার্যর তন্ময়তা ভঙ্গ হল। কালিচরণের দিকে ফিরে বললেন, সেজখুড়ো, যাঁরা হুঁকো খাচ্ছেন তাঁদেরও ঘরের বাইরে যেতে বলুন। শব্দে আমার অসুবিধা হচ্ছে।

নন্দখুড়ো শশব্যস্তে একজন খিদমদারের হাতে থেলোহুঁকোটা বাড়িয়ে ধরেন। ঘনিয়ে আসে পক্ষিপালকপতন নৈঃশব্দ্য। দীর্ঘকাল নাড়ি দেখার পর ধ্যানভঙ্গ হল। রোগীকে বললেন, জিবটা বার করুন তো।

দেখলেন। জিহ্বা, চোখের কোল, বুকের স্পন্দন। উদরে কয়েকটি টোকা মেরে কী যেন বুঝে নিতে চাইলেন। তারপর প্রশ্ন করেন, যন্ত্রণাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিন তো।

শীর্ণ তর্জনী সংকেতে বৃদ্ধ দেখিয়ে দিলেন বক্ষপঞ্জর ও উদরের মিলনস্থলটি।

রূপেন্দ্র তাঁর পুলিন্দা হাতড়ে বার করে আনলেন একটি কষ্টিপাথরের খলনুড়ি। কী একটি ভেষগচূর্ণ তাতে রেখে মধু সহযোগে পিষ্ট করলেন। ম্রক্ষণটি ঝিনুকের চামচে নিয়ে স্পর্শ করালেন রোগীর শুষ্ক ওষ্ঠে। বললেন, এটা লেহন করুন।

বৃদ্ধ বিনা বাক্যব্যয়ে চেটে চেটে ওষুধটা খেয়ে নিলেন।

রূপেন্দ্রনাথ ব্যজনকারিণীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, পথ্য কী পড়েছে? এখানে আসার পর? কাল রাত থেকে কী খেয়েছেন?

অবগুণ্ঠনবতীর পাঙ্খাসঞ্চালন বন্ধ হল। পরিবর্তে শুরু হল শিরঃসঞ্চালন।

—কী বলতে চাইছেন, খুড়িমা? ‘আপনি জানেন না, নাকি, ‘কিচ্ছু খাননি’?

কালিচরণ তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, ও…ইয়ে…তোমার খুড়ি নয়, ও হল গিয়ে মোক্ষদা!

সর্বসমক্ষে তার নামটা ঘোষিত হওয়ায় দাসীটি বোধহয় লজ্জা পেল। তালপাখাটা পালঙ্কে নামিয়ে রেখে দ্রুতপদে অন্তঃপুরের দিকে মিলিয়ে গেল।

রূপেন্দ্র জানতে চান, খুড়িমাদের দেখছি না কেন? তাঁদের কাউকে এখানে পাঠিয়ে দিন!

শোভারানি চোখে আঁচল দিল। ঘরে এক অস্বোয়াস্তিকর নীরবতা। আত্মীয়েরা পরস্পরের দিকে তাকায়। কালিচরণ অস্ফুটে বলেন, মানে…ইয়ে….বড়দা কাল রাতে একাই এয়েছেন। বৌঠানরা কেউ আসেননি।

—মানে? উনি এই অসুস্থ শরীরে একাই…

—না, না। একা নয়! পুরীর পাণ্ডাজির একজন ছড়িদার ছিল সঙ্গে। নৌকা থেকে চৌদোলা চেপেই এয়েছেন।

—তা তো বুঝলাম। উনি তো চতুর্দোলায় চেপে এলেন। তাহলে খুড়িমারা কোথায়? শ্রীক্ষেত্রে?

কালিচরণ নিঃশব্দে দুদিকে মাথা নাড়লেন।

রূপেন্দ্রনাথ ঝুঁকে পড়েন রোগীর দিকে।

—আপনি অন্তত কিছু বলুন? খুড়িমারা দুজন…?

কোথাও কিছু নেই ডুগরে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধ। সেই সঙ্গে শুরু হল হিক্কা! শোভারানি ঝুঁকে পড়ে বাবার পাঁজর বার-করা বুকে হাত বুলাতে থাকে। রূপেন্দ্রনাথ ব্যস্ত হননি। অপেক্ষা করেন। বৃদ্ধ হিক্কার ধকলটা সামলে নিয়ে বলেন, আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে, রূপেন! সতীলক্ষ্মী দুজনই দ্যাখ-না- দ্যাখ ড্যাংডেঙিয়ে সগ্যে চলে গেল। এই অভাগা বুড়োটার দিকে ফিরেও চাইল না একবার!

—স্বর্গে গেছেন? দুজনেই? কবে? কোথায়?

—ওই ছিরিক্ষেত্রেই। স্বগ্যোদ্বারে দাহ করতে হল। আমিই দুজনের মুখাগ্নি করেছি। রূপেন্দ্র সোজা হয়ে বসলেন। ওঁর ইচ্ছে করছিল ওই শায়িত মৃত্যুপথযাত্রীকে ধরে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকি দিতে। কিন্তু কিছুই করলেন না তিনি। এমনকি জানতেও চাইলেন না মৃত্যুর হেতু। কী লাভ? সেই পঙ্কিল মৃত ইতিহাস ঘেঁটে? হয়তো ক্ষেত্রজ সন্তান প্রসব করতে গিয়ে। কিংবা এই বাধ্যতামূলক পরপুরুষভজনার অপমান সইতে না পেরে মীনুর মতো উদ্বন্ধনে। অথবা উপর্যুপরি বলাৎকারের যন্ত্রণা সইতে না পেরে রক্তাক্ত মৃত্যুবরণ করেছিলেন খুড়িমারা!

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তাঁর। বললেন, আমার প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু মুলতুবি আছে। কাল এবাড়ি আসার পর রাত থেকে এখন পর্যন্ত কী খেয়েছেন উনি?

শোভা এতক্ষণে সামলেছে। বললে, ঢোক গিলতে পারছেন না ভালো করে। কিছুই খেতে চাইছেন না। আমি জোর করে আধবাটি দুধ খাইয়েছি। আর গঙ্গাজল। বারে বারে।

রূপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন। দুর্গাখুড়ো তৎক্ষণাৎ চেপে ধরেন ওঁর হাতটা। বলে ওঠেন, রুপো! আমি বাঁচব তো?

ওষুধটা ধরেছে। কণ্ঠস্বর আর মিনমিনে নয়! আশ্চর্য! বেঁচে থাকার কী উদগ্র বাসনা! তীব্র যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে মৃত্যুপথযাত্রীর প্রশ্ন : বাঁচব তো? আবার এই দুনিয়ার যাবতীয় ভোগ্যবস্তুর রসাস্বাদন করতে পারব তো? অর্থের বিনিময়ে?

—কী হল রুপো? কতা কইছ না কেন? এ যাত্রায় বাঁচব তো?

রূপেন্দ্র বললেন, কবিরাজ যন্ত্রণার উপশমের চেষ্টাই করতে পারে, মরা-বাঁচায় কি মানুষের হাত আছে?

—আছে, রুপো, আছে। মানুষের নেই। ধন্বন্তরির আছে। বোঠেনকে তুমিই তো….

—বৌঠান! কে বৌঠান?

নন্দ আগবাড়িয়ে শাঙ্করভাষ্য দাখিল করেন, উনি ভাদুড়ীবাড়ির গিন্নীমার কথা বলছেন।

—ও! না খুড়ো। আমি তাঁকে বাঁচাইনি। খুড়িমা পুনর্জন্ম লাভ করেছিলেন নিজের সুকৃতিতে, নিজের পুণ্যে! নিজের ধর্মে!

—ধৰ্ম্ম! তা বাবা, আম্মো তো ধম্মকম্ম কিছু কম করিনি। বল? এই তো ক’মাস আগে ৺জগন্নাথদেবের সোনার মুটুক গড়িয়ে দে’-এলাম।

—তবে আর চিন্তা কী? আপনিও পুনর্জন্ম লাভ করবেন! কিন্তু এবার আমি উঠব খুড়ো! আরোগ্য-নিকেতনে যেতে হবে!

কালিচরণের দিকে ফিরে বলেন, ওখানে কাউকে পাঠিয়ে দেবেন। ওষুধ আর নিদেন লিখে দেব। ওষুধটা তাড়াতাড়ি পড়া দরকার।

দুর্গা হয়তো বুঝলেন। এবার কালিচরণের দিকে ফিরে বলেন, আমার বালিশের নিচে সাতটা মোহর আছে। একটি একবগ্গাকে দাও। বৈদ্যবিদায়।

রূপেন্দ্র প্রবল আপত্তি জানালেন, না। আমাকে মার্জনা করবেন। বৈদ্যবিদায় আমি গ্রহণ করব না!

সকলেই স্তম্ভিত। কালিচরণ বলেন, কিন্তু বৈদ্যাবিদায় না দিলে যে, বড়দার…

—আমি মার্জনা চাইছি!

শিরোমণি-মশাই এবার মহড়া নিলেন, এটা যে তোমার অন্যায্য আবদার হয়ে যাচ্ছে রূপেন। তুমি বৈদ্যবিদায় গ্রহণ না করলে যে ওঁর জীবাত্মা মুক্তি পাবে না। এটাই শাস্ত্রের বিধান!

রূপেন্দ্রনাথ একে একে ঘরের প্রতিটি উদগ্রীব মানুষকে একনজর দেখে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ তাই! কপদকমাত্র বৈদ্যবিদায় না নিলে ওঁর নরকযন্ত্রণা অনিবার্য! আপনাদের শাস্ত্রে নাকি তাই লেখা আছে!

—আমাদের শাস্ত্র? তোমার নয়?

রূপেন্দ্র সে কথার প্রত্যুত্তর না করে অন্য কথা বললেন, ঠিক আছে! খুড়োকে নরকযন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দিতে আমি বৈদ্যবিদায় গ্রহণ করতে পারি; কিন্তু একটি শর্তসাপেক্ষে।

মরা পাবদা মাছের মতো দুটি চোখ মেলে দুর্গা গাঙ্গুলী শুধু তাকিয়েই রইলেন। জানতে চাইলেন না, শর্তটা কী?

কালিচরণের সে হিম্মত হল না।

এতক্ষণে সরব হলেন নন্দখুড়ো। হাজার হোক, তিনি সমাজের মাথা। সবাই যখন হেঁটমুণ্ড তখন তাঁরই এগিয়ে আসার কথা। তিনি এবার প্রতিপ্রশ্ন করেন, তোমার শর্তটা কী, বাবা?

স্পষ্টভাষে রূপেন্দ্র বললেন, দুর্গা খুড়ো একদিন এক সতীসাধ্বী রমণীর মাথায় সজ্ঞানে একরাশ মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন…

বাধা দিয়ে শিরোমণি-মশাই বলে ওঠেন, কার কথা বলছ রূপেন? কী মিথ্যা কলঙ্ক?

রূপেন্দ্র তাঁর দিকে ফিরে বলেন, আপনার স্মরণশক্তি তো এত দুর্বল নয় শিরোমণি-খুড়ো। মনে নেই, পঞ্চায়েতের ডাকে নন্দখুড়ো কী নালিশ করেছিলেন?—আপনিও তো তাতে সায় দিয়েছিলেন। বাচস্পতিমশায়ের বিধানে সেদিন সেটা মুলতুবি রাখা হয়েছিল, মনে পড়ে না?

রূপেন্দ্র থামলেন। কেউ কোনও কথা বলে না।

—কী হল? কারও স্মরণ হচ্ছে না? সেই যে দুর্গা-খুড়োর নাকের ডগা দিয়ে কোন এক ব্যভিচারী অশ্বপৃষ্ঠে সংযুক্তা-হরণ করেছিল? দুর্গা-খুড়ো ফিরে আসার প্রত্যাশায় সে-বিচারটা মুলতুবি রাখা আছে। তা আজ উনি ফিরেছেন। মনে পড়ছে এবার? সেই প্রসঙ্গেই বলছি : দুর্গা-খুড়ো যদি আজ গাঁয়ের পঞ্চজনার সমুখে স্বীকার করেন যে, অত্যাচার সইতে না পেরে মীনু গলায় দড়ি দিয়েছিল, আর উনি নিজেই তার মুখাগ্নি করেছিলেন, তাহলেই আমি প্রথামতো বৈদ্যবিদায় নিতে স্বীকৃত!

হঠাৎ ও-পাশ থেকে ভেসে এল একটা চাপা ক্রন্দনের শব্দ।

রূপেন্দ্রনাথ সেদিকে ফিরলেন। মীনুর মা। দু-চোখে আঁচল চাপা দিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত আর্তিতে ভেঙে পড়েছেন। শোভারানি ছুটে গেল সেদিকে। জড়িয়ে ধরল তাঁকে।

মরা পাবদা মাছটার জ্ঞান ফিরে এসেছে। একদাগ ওষুধেই কাজ হয়েছে। তিনি বললেন, নন্দভায়া, এট্টু এদিকে সরে এস তো?

নন্দ তাঁর কাছে এগিয়ে আসতেই মৃত্যুপথযাত্রী তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে স্বীকারোক্তি করেন, তোমার কাছে স্বীকার যাচ্ছি, নন্দ। রুপো বাঁড়ুজ্জে যা বলছে তা হক কথা! সেটাই নিজ্জ্বলা সত্যি! সেবার আমি তোমারে মিছে কথা কয়েছিলাম। মীনুটা গলায় দড়ি দিয়েই মরেছিল! আমারে মাপ করে দাও ভাই। ওই একবগ্গাটা বৈদ্যবিদায় না-নিলে আমার নরকদর্শন অনিবায্য।

নন্দ নড়েচড়ে বলে ওঠেন, আমি তোমারে মাপ করার কে? মাপ যদি চাইতেই হয় তবে মীনুর বাপের কাছে চাও! পীতুর কাছে….

পীতাম্বর তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে ওঠেন। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। রূপেন্দ্রনাথকে কী যেন বলতে গেলেন! পারলেন না। উদ্গত অশ্রুর আবেগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি এগিয়ে গেলেন—ভিড় ঠেলে একেবারে ঘরের বাইরে।

কালিচরণ যন্ত্রচালিতের মতো তাঁর বড়দার বালিশের তলা থেকে কী একটা বার করে আনার উপক্রম করতেই রূপেন্দ্র তাঁর হাত চেপে ধরেন : না!

—না? কিন্তু তুমি যে বললে…

—হ্যাঁ, শর্ত আমি পালন করব। খুড়োকে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে দেব না। তা বলে ওইটা নয়। শোভারানি! একটু এদিকে এগিয়ে এস তো। বৈদ্যবিদায়ের ফর্দটা তোমার হাতেই ধরিয়ে দেব।

শোভারানির হাতখানি ধরে তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মীনুর মা তখন অশ্রুর বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন।

একপ্রহর পরের কথা। সূর্য এখন প্রায় মধ্যগগনে। শল্যচিকিৎসাগার থেকে বার হয়ে এলেন রূপেন্দ্রনাথ। প্রসব নির্বিঘ্নে হয়েছে। পুত্রসন্তান।

এই শল্যচিকিৎসাগারটি আরোগ্য-নিকেতনে নতুন সংযোজন। আদিকালে এটি ছিল না। রূপেন্দ্র যখন তাঁর তরুণী ভার্যাকে নিয়ে তীর্থদর্শন করতে যান তার পরে এটি নির্মিত হয়েছে। অস্ত্রোপচার বা প্রসব করানোর সময় এ কক্ষটি ইদানীং ব্যবহার করা হয়। একবগ্গা-দিঘির জলের সঙ্গে প্রচুর নিমপাতা মিশিয়ে সেই জলে সে ঘরের মেঝে দিনে দুবার মার্জনা করা হয়। এটি নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করেছেন তারাপ্রসন্ন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এটি নির্মাণ করিয়েছে ওঁর শিষ্য জীবন দত্ত।

রূপেন্দ্র আরোগ্য নিকেতনের উদ্যানে একটি আমগাছের নিচে বাঁধানো চাতালে গিয়ে বসলেন। বৈশাখের শেষ। আমগাছে মুকুল এসেছে। আম্রমুকুলের গন্ধে বাতাস আমোদিত। জীবন বোধহয় এখনো ভিতরে ব্যস্ত। রূপেন্দ্র উত্তরীয়টি খুলে পাশে রাখলেন। চরাচর নিস্তব্ধ। নিদাঘ দ্বিপ্রহরে ঘুমপাড়ানো ঘুঘুর একটানা শব্দ। দু-তিনটি শালিক কী নিয়ে যেন ঝগড়া করছে। আকাশ থমকে আছে। হাওয়া নেই একেবারে। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। দূরে কোন মন্দির থেকে ভেসে আসছে কাংসধ্বনি। বোধকরি মধ্যাহ্ন ভোগ শুরু হল।

রূপেন্দ্রের মনটা আজ খুশিয়াল। এইমাত্র যে প্রসূতিটি পুত্রসন্তান লাভ করল সে পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক সম্পন্ন ঘরের বধূ। এতদিন এরা সন্তানবতী হত কাঁচা আঁতুড়ঘরে। আনাড়ি দাইয়ের মাধ্যমে। শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি। সূতিকারও ছিল প্রাবল্য। ধন্বন্তরির আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ইদানীং দু-একটি সম্ভ্রান্তঘরের সন্তানবতী পালকি চেপে এখানে মা হতে আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রসব করায় শিক্ষিতা ধাত্রী। তারা জমিদার-মশায়ের কাছ থেকে বৃত্তি পায়। তাছাড়া রোগীর বাড়ি থেকেও ‘সিধা’ পায়। কোনও কোনও জটিল ক্ষেত্রে রূপেন্দ্রনাথ স্বয়ংও প্রসব করান। যেমন আজ। হয়তো একদিন পালকি চেপে আসবে তাঁর আদরের শ্যালিকা তুলসী। সে কথা দিয়ে রেখেছে।

একটু পরে সদ্যজননীর স্বামী ও আত্মীয়রা ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, প্রণাম করে গেল। রূপেন্দ্র বললেন, মা-ছেলে দুজনেই ভালো আছে। চিন্তার কিছু নেই। পাঁচদিনের মাথায় পালকি পাঠিয়ে দেবেন।

—না বাবা! ছয়-যেটেরা সেরেই নিয়ে যাব, সাতদিনের মাথায়।—প্রসূতির শাশুড়ি বললেন।

—বেশ তাই হবে। সেক্ষেত্রে উমাকে আমরা অন্য একটি ঘরে রাখব। কারণ ইতিমধ্যে শল্যচিকিৎসাগারটির প্রয়োজন হতে পারে।

সদ্যপিতা হাত দুটি জোড় করে বললে, খোকার অন্নপ্রাশনে কিন্তু আমাদের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে হবে ঠাকুরমশাই।

—বেশ তো। যাব। সবান্ধব নিমন্ত্রণ তো? জীবনকেও নিয়ে যাব তো?

—নিশ্চয়ই। তাঁকেও আমি পৃথক নিমন্ত্রণ করে যাব।

ওরা চলে যাবার পর আবার নিদাঘ মধ্যাহ্নের স্তব্ধতা ঘনিয়ে এল। ঘুঘুপাখিটা কোথায় উড়ে গেছে। এবার তার বদলে শুরু হয়েছে কুবোপাখির একটানা কুক কুক-কুক-কুক।

অনেক অনেকদিন পরে মনটা আজ খুশিয়াল। ওঁর বাল্যসঙ্গিনীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন। সারা গাঁয়ে আজ ঘরে ঘরে তার নামটা উচ্চারিত হবে। মীনু মেয়েটা কলঙ্কিনী ছিল না!

একটু পরে জীবন এসে বসল ওঁর পায়ের কাছে। কিছুতেই চাতালে উঠে বসতে রাজি হল না। একটু অনুযোগও করল, আজকাল আর আপনি আরোগ্য নিকেতনের দিকে ঠিকমতো নজর দিচ্ছেন না গুরুদেব। আপনার সারা মনটা দখল করে আছে ওই মহিলা বিদ্যালয়।

মনটা খুশি খুশি। তাই শিষ্যকে রসিকতা করে বলে বসেন, সেটাই যে হয় জীবন। রাজা মশাইদের দেখনি? বড়রানি হয়ে যায় দুয়োরানি আর নতুন রানি সুয়োরানি।

জীবন লজ্জা পেল। বললে, আজ্ঞে না, সেকথা বলিনি। তবে…

—ওই ‘তবে’টাই যে বড় বিঁধছে জীবন। আমার মহিলা বিদ্যালয়ে ছিল আট জন। এখন সেটা কমে গিয়ে হল পাঁচ। নতুন ছাত্রী জোগাড়ই হচ্ছে না। অথচ এটাই যে আমার জীবনের ব্রত।

—কিন্তু আমার সমস্যাটা? আমার আরোগ্য-নিকেতনে একজন মহিলা চিকিৎসক না হলে …মানে, অনেক পরিবারে…

—জানি জীবন! মহিলা চিকিৎসক জোগাড় করার আগে আমাকে তো কিছু ‘শিক্ষিতা মহিলা’তৈরি করতে হবে? তবে তুমি কিচ্ছু চিন্তা কর না। আর বছর-দশেক পরেই মঞ্জরী সে দায়িত্বটা নিতে পারবে। সংস্কৃতটা একটু রপ্ত হলেই ওকে আয়ুর্বেদ শেখাব আমি। শুধু আমি একা কেন? তুমিও শেখাবে তাকে।

ঠিক তখনই আরোগ্য-নিকেতনের কঞ্চি-বেড়ার টাটি খুলে এগিয়ে আসতে থাকে একজন চাষাভুষো গোছের মানুষ। আদুল গা, আ-হাঁটু খেটো ধুতি। অল্প বয়স। ওই জীবনেরই বয়সি। তার হাতে একটি পুঁটুলি।

রূপেন্দ্রনাথ কৌতুক করে বলেন, ওর হাতে পুঁটুলিতে কী আছে বলতে পার?

—তা কেমন করে বলব? আমি তো গণৎকার নই!

—আমি পারি। শোন! ওর পুঁটুলিতে আছে একমুঠি আতপ তণ্ডুল, একটা বস্ত্ৰখণ্ডে একমুঠি কাঁচামুগের ডাইল, একটা কাঁচকলা, একটা পান পাতা, পাঁচটা সুপুরি, পাঁচটা বাতাসা আর পাঁচটা কড়ি!

লোকটা ততক্ষণে ঝোলা নামিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে ফেলেছে। সে কিছু বলার আগেই রূপেন্দ্রনাথ বলেন, তুমি চুপ করে বসে থাক। বুঝেছি! দেখ তো জীবন—ঠিক ঠিক মিলেছে কিনা।

জীবন দত্ত একেবারে আকাশ থেকে পড়ে। রূপেন্দ্র বললেন, এটা আমার বৈদ্যবিদায়। বলেছিলাম এখানে পৌঁছে দিতে। আরও বলেছিলাম যে, ফর্দর বাইরে কোনও কিছু থাকলে আমি সবকিছু ফেরত দেব। কী নাম গো তোমার?

শেষ প্রশ্নটা আগন্তুককে। লোকটা বলে, এজ্ঞে মোরা জাতে তাঁতি—মোর নামটো লবা গুই এজ্ঞে।

—আবার বলে ‘লবা’! সেদিন বলে দিলাম না, তোমার নাম ‘লবা’ নয় ‘নবা’। ভালো নাম নবীন গুঁই, বুঝলে? এত বোকা কেন তুমি?

লোকটা প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে বলে, এজ্ঞে না, বোকা হই, মুখ্যু হই, মোর নামটো ‘লবা’ আজ্ঞে।

তারপর জীবন দত্তের দিকে ফিরে বলে, আপনে বলেন তো ঠাউর, মোর নামটো মুই জানবনি? পণ্ডিতে আস্যে বিধান দিলি জানতি পারব?

রূপেন্দ্রনাথ অট্টহাস্য করে ওঠেন। বলেন, একে চিনে রাখ জীবন। এ হচ্ছে সোঞাই গ্রামের “দু-নম্বর একবগ্গা’!

তারপর বললেন, তোমাকে এবার একটা কাজ করতে হবে জীবন। পুবপাড়ার কালীমন্দিরের পশ্চিম পাশে বটগাছের নিচে একজন খঞ্জ সন্ন্যাসী থাকেন, দেখেছ?

—আপনি কি একমুঠি বাবার কথা বলছেন? যিনি দিনে একবার মাত্র ভিক্ষা নেন। সঞ্চয় যাঁর ধাতে নেই। তাঁকে কে না চেনে সোঞাই গাঁয়ে!

—হ্যাঁ, তাঁর কথাই বলছি। তাঁকে ওই ‘সিধা’টা পৌঁছে দেবে। আজ এক রোগিবাড়ি গিয়েছিলাম। তারই ‘বৈদ্যবিদায়’। কিন্তু ওগুলো আমি বাড়ি নিয়ে যেতে পারব না, জীবন।

—বৈদ্যবিদায়! পাঁচ কড়ি? আপনার?

—হ্যাঁ। হাত পেতে নিতে হল। না হলে মৃত্যুপথযাত্রী ধনকুবেরের নরকদর্শন নাকি অনিবার্য! কী করব বল?

‘আজ সকালে আর ফল-টল কাটিনি রে রুপো। মীনুর মা তোর নাম করে একবাটি পরমান্ন পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটাই সেবা কর।’

এটা ওঁর প্রাতরাশের সময়। অশ্বারোহণে রুগি দেখতে যাবার আগে কিছু কাটা-ফল আহার করেন। পূজার নৈবেদ্য। আজ তার ব্যতিক্রম হল। গিরিপিসিমার ভ্রাতৃবধূ, মানে মীনুর মা, তাঁর নাম করে একবাটি পরমান্ন পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর কীভাবেই বা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারতেন খুড়িমা? ভেষগাচার্য যে ওঁর এত বছরের দমবন্ধ করা রুদ্ধ কান্নাটা কাঁদবার সুযোগ করে দিলেন একদাগ ওষুধে।

এ পরমান্ন তাই বৈদ্যবিদায়।

উঠানের ওপাশে রান্নাঘর থেকে ভেসে এল মালতীর কণ্ঠস্বর। ‘এট্টু অপেক্ষা করুন, ঠাকুরপো। মামণি আপনার জন্যে একটা জিনিস নিয়ে যাচ্ছে। প্রসাদী পরমান্নটা তাই দিয়ে সেবা করবেন।

‘প্রসাদী পরমান্ন’! তার মানে মীনুর মা কোনও মন্দিরে গিয়ে পুজোও দিয়েছেন। দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। তা না হবে কেন? দেবতার কী অসীম করুণা! ওঁর একমাত্র কন্যাটিকে তরুণী বয়সেই উদ্বন্ধনে মৃত্যুর সৌভাগ্য প্রদান করেছেন। উনি মনে-মনে ভাবছিলেন, কোনোভাবে মীনুর বাবা-মাকে জানিয়ে দিতে হবে যে, পুত্রেষ্টি-যজ্ঞে তাঁদের আদরের মেয়েটির চরম সর্বনাশের আগেই সে হতভাগি বৈকুণ্ঠলোকে যাত্রা করতে পেরেছিল। কিন্তু কার মাধ্যমে, কীভাবে এটা জানানো যায়? গিরিপিসিমা বা বৌঠান নয়, শোভারানির কাছেও ওঁর সংকোচ হবে। সবচেয়ে ভালো হয় তারাদার সাহায্যে তারা-বৌঠানের মাধ্যমে মীনুর মাকে জানানো

একটু পরে মালতী এল। সঙ্গে রূপমঞ্জরী। মালতীর হাতে দুটি কাঁসার থালায় ঘৃতপক্ক একটি বিচিত্র খাদ্য। দুজনের সামনে দুটি থালা নামিয়ে দিল। রূপমঞ্জরী তার মাসিকে বলে, না, না, ওই থালাটা বাবার, এটা আমার।

রূপেন্দ্রের লক্ষ্য হল দুটি পাত্রেই একই মাপের দুটি করে ঘৃতপক্ব আহার্য রয়েছে, তাদের মাপও প্রায় একরকম। তাই মেয়েকে প্রশ্ন করেন, কেন রে মামণি? চারটে লোচিকাই তো সমান মাপের

—বা রে! ও দুটো যে আমি ভেজেছি। খুন্তি নেড়ে নেড়ে। তোমার জন্য।

মালতী বলে, ভেবেছিলাম আপনাকে অবাক করে দেব। তা আর হল না। আপনি তো এর নাম জানেন—লোচিকা’।

—হ্যাঁ বৌঠান! মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে এটি আস্বাদন করেছি। কিন্তু কী ভাবে এগুলি নির্মাণ করা যায় তা জানি না। জীবনে এই দ্বিতীয়বার এর স্বাদ পাব আজ।

মালতী পাঙ্খা-হাতে সামনে বসে পরেছে ততক্ষণে। বললে, এর উপাদান তিনটি—গোধূমচূর্ণ, গব্যঘৃত আর জল। তবে বানানোর কায়দা আছে। কারণ এগুলি প্রথমে ‘বেলতে’ হয়—বেলুনি আর চক্রতির সাহায্যে। কায়দাটা আমি শিখে নিয়েছিলাম আমার মামাশ্বশুরের বাড়ি। এক মচ্ছোবে বড়ঠাকুর এগুলি ভাজছিল।

রূপেন্দ্র ইষ্ট স্মরণ করে ততক্ষণে পরমান্নের বাটিতে লুচি ডুবিয়ে চর্বণ শুরু করেছেন। চোখবুজেই আস্বাদন করতে করতে বললেন, কথাটা ‘মচ্ছোব’ নয় বৌঠান, ‘মহোৎসব’।

মালতী বলে, সে যাই হোক, স্বাদ কেমন লাগল তাই বলুন।

—স্বাদ তো অপূর্ব! পরমান্নের সঙ্গে লোচিকা! সে তো মর্ত্যের অমৃত। কিন্তু আপনার আর পিসিমার জন্যে আরও আছে তো?

—প্রচুর। আপনাদেরও আবার দেব। গরম-গরম খেতে হয়। দাঁড়ান, আরও কিছু ভেজে আনি।

—দাঁড়াব?

—না, না, মানে বসুন। অপেক্ষা করুন। আপনার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। আমি আসছি।

একটু পরেই একটা ‘বোগ্‌নো’তে আরও খান ছয়েক লোচিকা নিয়ে ফিরে এল মালতী। দুজনের পাতেই দিল নতুন করে।

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, তা আপনি এ বাড়িতে বেলুনি আর চক্রতি পেলেন কোথায়?

কোথায় আর পাব? হাতেই টেনে টেনে লম্বা করে বানিয়েছি। ও যন্তর হাটে- বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।

—’যন্তর’ নয়, কথাটা ‘যন্ত্র’।

মালতীর ভ্রূকুঞ্চন হল। হঠাৎ বলে বসে, আচ্ছা ঠাকুরপো, কুসুমদি, মানে মামণির না যখন আপনার সঙ্গে মনখুলে গল্পগাছা করতেন, তখনো আপনি এভাবে তাঁর উশ্চারণ সুধরে দিতেন?

রূপেন্দ্রের সাহস হল না বলতে, কথাটা ‘উচ্চারণ’ নয়, ‘উচ্চারণ’!

ইতিমধ্যে দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন গিরিপিসিমা। ঘরের ভিতরে আসেন না। দু-হাতে চৌকাঠের দুটি কাঠ ধরে বলেন, কিরে রুপো, বউমা কেমন লোচিকা বানিয়েছে?

—চমৎকার! তবে বৌঠান কি একা-একা পারতেন? ‘রুপোমন্‌চুরি’ ওঁকে সাহায্য করেছিল বলেই না? মামণির ভর্জিত লোচিকাগুলিই বেশি ফুলেছে কিন্তু

পিসি বলেন, এ তোর একচোখোমি। মেয়ের দিকে টেনে কথা কইছিস। শোন রুপো, বৌমাকে ওই কী যেন যত্তর-বেলুনি আর চক্কোত্তি—একজোড়া বানিয়ে দিতে হবে। তুই লখা-সুধাধারকে ডেকে পাঠাত একবার।

রূপেন্দ্র বলেন, যন্ত্রটা চক্কোত্তি নয়, চক্রতি, অপভ্রংশে চাকতি আর লক্ষ্মণের উপাধি ‘সুধাধার’ নয়। সূত্রধর।

মালতী ত্রিং করে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনি না—একেবারে অসৈরণ! কথায়-কথায় সবার উচ্চারণের ভুল ধরেন।

রূপেন্দ্র সহাস্যে বলেন, কী করবেন বৌঠান! আমি লোকটা যে একবগ্গা!

দিনতিনেক পরে সকালে উনি রুগি দেখতে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। গিরিপিসি এসে দুঃসংবাদ দিলেন, বেরুবার আগে তুই একবার বউমারে দেখে যাস, রুপো! ওর শরীর-গতিকটা জুতের নয়।

—কেন? কী হয়েছে বৌঠানের? জ্বর?

—না, জ্বর হবে কেন? ষাট-বালাই! কাল রাতে তিন-চারবার বমি করেছে! ওর পেটে কিছু ঢুকেছে, ক্রমাগত গা-গুলাচ্ছে।

রূপেন্দ্র নতমুখে বললেন, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় পিসিমা, সদ্যপ্রসূতির এমনটা হয়েই থাকে। একটু কুলের আচার বা আমচুর—যা খেতে চান উনি—তাই দিন। মুখে জল আসবে। বমনের বেগ বন্ধ হবে।

গিরিপিসি রুখে ওঠেন, তুই আর আমারে এই বুড়ি বয়সে ‘বদ্যিগিরি’ শেখাতে আসিস না রুপো। পোয়াতি মাগির যে ‘ওয়াক’-আসে তা এই তিনকুড়ি বয়েসে জানবনি? তা হোক, তুই একটিবার দেখে দিলে আমি সোয়াস্তি পাই

রূপেন্দ্রনাথের সাহস হল না পিসিমার ‘প্রাকৃতভাষ’ মার্জনা করে দেবার। বললেন, ঠিক আছে। বৌঠানকে নিয়ে আসুন। আমি ওঁকে পরীক্ষা করে দেখব। আপনিও তখন উপস্থিত থাকবেন কিন্তু

পিসিমা মালতীর ঘরের দিকে চলে গেলেন। রূপেন্দ্রর মনে হল, সত্যই কর্তব্যে হয়তো কিছু অবহেলা হয়ে গেছে। এটা বৌঠানের পঞ্চম মাস। একেবারে আদিযুগেই ওঁর গুরুদেব জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুমি বউমাকে পরীক্ষা করে দেখেছ?’ আর উনি জবাবে বলেছিলেন, ‘পরীক্ষার কোনও প্রয়োজন নেই গুরুদেব, শতকরা শতভাগ নিশ্চিত না বুঝলে সার্বভৌম আত্মহত্যা করতেন না।’ সে কথা ঠিক। কিন্তু সেদিন যে প্রয়োজনে পরীক্ষা করার প্রশ্ন উঠেছিল, আজ তা নয়। আজ প্রসূতির স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনে চিকিৎসক হিসাবে এটা ওঁর কর্তব্য।

একটু পরেই মালতীর হাত ধরে পিসিমা ফিরে এলেন।

মালতী বলে, আপনি আমাকে ডেকেছেন ঠাকুরপো?

—হাঁ। কিন্তু মামণি কোথায়?

গিরিপিসিমা বলেন, ও এখনো ঘুমুচ্ছে।

—ও! তা বৌঠান, কাল রাত্রে আপনার কি বারবার বিবমিষার বেগ আসছিল?

মালতী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বললে, না তো!

রূপেন্দ্র বিস্মিতভাবে দৃকপাত করলেন পিসির দিকে।

তিনি বুঝিয়ে দিলেন, না, বাবা, ‘বিবমিষা-টিষা’ কিছু হয়নি। বারকতক বমি করেছিল শুধু। এই পর্যন্ত!

মালতী বহুকষ্টে হাস্য সংবরণ করে বলে, হ্যাঁ, তা হয়েছে, বমি করেছি। বার-চারেক। ‘বিবমিষা-টিষা’ কিছু হয়নি।

রূপেন্দ্র গম্ভীর হয়ে বলেন, আপনি এই শয্যায় উপবেশন করুন। আমি আপনাকে পরীক্ষা করব।

—পরীক্ষা করবেন? কেন? আমি তো অসুস্থ হয়ে পড়িনি। এ অবস্থায় ‘বমি’ তো অনেকেরই হয়।

—সেটা আমার জানা আছে। বসুন আপনি।

মালতী সাবধানে শয্যাপ্রান্তে উপবেশন করে।

—আপনার পায়ের পাতা কি ফুলেছে একটু? দেখি!

ত্রিং করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় মালতী–না, না, আপনি আমার পায়ে হাত দেবেন না।

—কেন?

—না-না-না! আমার সুড়সুড়ি লাগে।

এবার গিরিপিসিমাই ধমক দেন, এ তো তোমার অসৈরণ কতা, বউমা। সম্পর্কে ও তোমার দেওর! তায় কোবরেজ।

মালতী আঁচল দিয়ে তার পা-দুটি মুড়ে ফেলে : ন্-না!

রূপেন্দ্র পিসিকে প্রশ্ন করেন, আপনার কী মনে হয় পিসি? ওঁর পা কি ফুলেছে?

গিরিপিসিমা বলেন, আমার তো তা মনে হয়নি। কই দেখি

আশ্চর্য! মালতী এবার প্রতিবাদ করল না। পিসিমা ওর দুটি পায়ের পাতা টিপে-টিপে দেখলেন। বললেন, না। ফোলেনি তো।

মালতী উঠে পিসিকে প্রণাম করে।

রূপেন্দ্র প্রশ্ন করেন, এটা তো পঞ্চম মাস? ভ্রূণের নড়াচড়ার কোনও আভাস পান?

মালতী জবাব দিল না। নতনেত্রে দুদিকে মাথা নেড়ে জানাল, না!

—আপনি শুয়ে পড়ুন তো। আমি আপনার উদরে হ’ত দিয়ে কিছু অনুভব করব।

মালতী দাঁতে-দাঁত দিয়ে আবার বললে, না।

গিরিপিসি আবার ধমক দেন, ন্যাকামি করিস না মালু!

জোর করে ওকে শুইয়ে দিলেন বিছানায়

রূপেন্দ্রনাথ এগিয়ে আসেন। মালতী তা দেখতে পায় না। তার চোখ দুটি বোজা। রূপেন্দ্রনাথ অতি সাবধানে ওর নীবিবন্ধের গ্রন্থি উন্মোচন করে সাদা থানটা নিচের দিকে টেনে নামিয়ে দিলেন। শালীনতার শেষ সীমান্ত পর্যন্ত। তখনো মালতী নিমীলিত নেত্র। সে জানে না, এটা কার করস্পর্শ–পিসিমার, না ওঁর। কিন্তু তার অনাবৃত কিঞ্চিৎ-স্ফীত উদরদেশটা তির-তির করে কাঁপতে থাকে। গাভীর গলকম্বলে আদর করলে যেমন শিহরণ জাগে তার সর্বাঙ্গে। রূপেন্দ্র ইতিমধ্যে ওর শয্যাপার্শ্বে নতজানু ভঙ্গিতে বসেছেন। ওর সেই নিরাবরণ উদরদেশে কর্ণস্পর্শ করানোর সঙ্গে সঙ্গে মালতীর চোখ দুটি খুলে গেল। শিউরে উঠল সে। উঠে বসতে গেল। রূপেন্দ্রও রীতিমতো চমকে ওর চোখে-চোখে তাকান : কী হল?

দু-জনের মুখ খুব কাছাকাছি। এক বিঘতের ব্যবধানে। প্রচণ্ডভাবে শিউরে উঠল মালতী। দ্রুতহাতে তার নীবিবন্ধের গ্রন্থিটা ঠিক করতে থাকে।

—কী হয়েছে বলুন তো আপনার?

মালতী তখন থর থর করে কাঁপছে।

ওকে আশ্বস্ত করতে, ভরসা দিতে ওর দুই বাহুমূল ধরে বলেন, এতো কাঁপছেন কেন আপনি?—বৌঠান?

চোখ তুলে একবার তাকাল। চোখাচোখি হতেই ছিটকে সরে গেল মালতী। তারপর হঠাৎ পিছন ফিরে চোখে আঁচল চাপা দিল।

বিস্মিত রূপেন্দ্রনাথ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অবাক হয়ে পিসিকেই প্রশ্ন করেন, ওঁর কী হল বলুন তো?

গিরিপিসি তখন একদৃষ্টে দেখছিলেন পিছন-ফেরা ওই বেপথুমানা বিগতভর্তা তরুণীটিকে। কান্নার কোনও শব্দ হচ্ছে না—কিন্তু পিঠটা মাঝে মাঝে ফুলে ফুলে উঠছে। হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন, এখনো বুঝিসনি? আবাগিটা মরেছে!

—মরেছে! মানে?

গিরিবালা আপনমনেই গজগজ করে বলেন, আমি তখনি বলেছিনু পীতুকে। এ হয় না, হতে পারে না! আমি পারবনি বাপু! শুনল? সেই অঘটনটাই তো ঘটল। আমি কী করব? এদিকে লক্‌লকে আগুনের শিখা আর উদিগে ওই বোকা-হাঁদা শ্যামাপোকাটা। ঝাঁপ তো ও খাবেই

উদগত অশ্রুর বেগ সম্বরণ করে ভেসে এল মালতীর আর্ত প্রতিবাদ : পিসি।

—এখন আমারে ডাকলি কী হবে? এ রোগের চিকিচ্ছে নেই। আমি পারবনি বাপু।—গজগজ করতে করতে কক্ষত্যাগ করলেন গিরিবালা।

রূপেন্দ্রনাথ এতক্ষণে বুঝেছেন! এ ওঁর নিয়তি! শ্যামাপোকার দল ক্রমাগত অগ্নিশিখায় ঝাঁপ দিয়ে চলেছে! কিন্তু উনি কী করতে পারেন? কী অপরাধ করেছেন তিনি? অথচ ওঁর জীবনে একের পর এক সেই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি—মীনু, রাধারানি, তুলসী আর আজ আবার মালতী। একটু পরে মালতী শান্ত হল। মুখ থেকে আঁচলটা সরাল। চোখ তুলে কিন্তু তাকাতে পারছে না এখনো

—বৌঠান?

নতনেত্র মেয়েটি যেন পাষাণমূর্তি। সাড়া দিল না।

—সত্যই কি তেমন কিছু হয়েছে? পিসিমা যা বলে গেলেন?

আবার মুখটা ঢাকে। অসীম আয়াসে কোনওক্রমে বলে, আপনি এখন যান, ঠাকুরপো। পরে কথা হবে। আমাকে এট্টু সামলে নিতে দিন।

দীর্ঘশ্বাস পড়ে রূপেন্দ্রের। ধীরপদে নিক্রান্ত হয়ে যান ঘর থেকে ঠিকই বলেছেন গিরিপিসিমা : ‘এ রোগের চিকিচ্ছে নেই।’

শ্রাবণের ঘন মেঘে সমস্ত আকাশ যখন আবৃত হয়ে যায় তখনও সূর্যদেব তাঁর চরৈবেতিমন্ত্রে দীক্ষিত। সূর্যদেব থামতে জানেন না। যন্ত্রচালিতের মতো রূপেন্দ্রনাথও মগ্ন হয়ে গেলেন তাঁর নিত্যকর্ম পদ্ধতিতে। কাজ মিটল দ্বিপ্রহরে। সচরাচর এ সময়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। আজ কিন্তু মন সরল না। অশ্বটিকে চালিত করলেন আরোগ্য নিকেতনের দিকে। একজন অগ্রসর হয়ে এসে ওঁর অশ্বটির লাগাম ধরল। উনি এগিয়ে গেলেন সেই সদ্যপ্রসূতির ঘরের দিকে।

ওঁকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল জীবন। বললে, সকাল থেকে একজন আপনার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছেন। উনি এসেছেন ভিন গাঁ থেকে। তাঁকে ডেকে দেব?

—দাও!

আগন্তুক ব্রাহ্মণ। গৌরকান্তি, স্বাস্থ্যবান। রূপেন্দ্রনাথেরই প্রায় সমবয়সি। ললাটের উপরিভাগ ক্ষৌরিকৃত। পশ্চাতে অকফলা। গায়ে উড়নি। করজোড়ে বললেন, প্রাতঃপ্রণাম ভেষগাচার্য। আমি আসছি তিজলহাটি থেকে। অধমের নাম শ্রীতিনকড়ি ঘোষাল, পিতাঠাকুরের নাম ঈশ্বর এককড়ি ঘোষাল। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতার নাম শ্রীপাঁচকড়ি ঘোষাল। আমরা রাঢ়ীশ্রেণির। দাদার কনিষ্ঠ পুত্রটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বোধকরি সান্নিপাতিক। শুক্লাদ্বিতীয়ার দিন জ্বর এসেছিল, আজ নয় দিন ধরে একটানা জ্বরে ভুগছে। এতদিন ওকে দেখছিলেন আমাদের গাঁয়েরই কবিরাজ-মশাই; কিন্তু তিনি ঠিক ভালো বুঝছেন না। আপনাকে সংবাদ দিতে বললেন।

—বয়স কত আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রের?

—ত্রয়োদশ বর্ষ। নদীয়ার কৃষ্ণনগরে একটি গুরুগৃহে অধ্যয়নরত ছিল। এ মাসে তার উপনয়ন হবার আয়োজন করেছেন দাদা। কিন্তু এসেই সে জ্বরে পড়েছে।

—কী নাম বালকটির?

—আজ্ঞে সৌম্য। সৌম্যসুন্দর ঘোষাল।

—ভালো। ভালো।

—ভালো? কী বলছেন কোবরেজ মশাই? উপনয়নের অনুষ্ঠানে নিজ ভিটেয় প্রত্যাবর্তনমাত্র রোগে আক্রান্ত হল, আর আপনি বলছেন, ‘ভালো’?

—না ঘোষালমশাই। সে কথা বলছি না। আপনার পুণ্যশ্লোক পিতৃদেব ছিলেন ঈশ্বর এককড়ি ঘোষাল, দাদা পাঁচকড়ি, আপনি তিনকড়ি। আমার আশঙ্কা হয়েছিল বালকটির নাম হবে ‘সাতকড়ি’। সে যে ‘সৌম্যসুন্দর’ হয়ে উঠতে পেরেছে এতেই আমি আনন্দিত।

—আপনি কি কাল-পরশুর মধ্যে সময় করে একবার…

—না, না, সান্নিপাতিক জ্বরে কালবিলম্বে রোগীর ক্ষতিই হয়। আপনি নিশ্চয় অশ্বপৃষ্ঠে এসেছেন, তাই নয়? আমি এখনি রওনা হব। আমার অশ্বে

শিবনাথ দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। জীবন দত্তের ছোটভাই। বললে, এখনি কি করে যাবেন? আপনার তো মধ্যাহ্ন-সেবা এখনো হয়নি-

—না, শিবনাথ। আজ শুক্লা একাদশী। আমার উপবাস। তোমার দাদা জানে। সৈনগুপ্তকে কিছু দানা-পানি দেবার ব্যবস্থা কর। আমি তৈয়ারই আছি।

সৈনগুপ্ত রূপেন্দ্রনাথের প্রিয় অশ্বটির নাম।

তারপর হঠাৎ আগন্তুকের দিকে ফিরে বললেন, তিজলহাটির শ্রীপাঁচকড়ি ঘোষাল আপনার দাদা, বললেন না? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, সৌম্যসুন্দর কি বছর কয়েক পূর্বে সর্পদংশিত হয়েছিল?

—আজ্ঞে না। আপনার মনে আছে তাহলে? সাপে কামড়েছিল সৌম্যের দাদাকে, সাতকড়িকে। সেবার আপনিই তো তার প্রাণরক্ষা করেছিলেন।

—হ্যাঁ, স্মরণে আছে আমার, তিজলহাটি থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে একটি বিশ্রী সতীদাহের আবর্তে পড়ে যাই।

—সে কথাও জানি। আপনারই হস্তক্ষেপে সেবার বায়েনপল্লির একটি বিধবার সে সৌভাগ্য হয়নি। পঞ্চগ্রামের সবাই সে ইতিহাস জানে।

সৌভাগ্য হয়নি! রূপেন্দ্রের দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

১০

তিজলহাটির পাঁচকড়ি ঘোষাল রীতিমতো সম্পন্ন গৃহস্থ। একান্নবর্তী পরিবার। পঞ্চাশ বিঘে আউশের খেত, তিন-জোড়া ‘হেলে- বলদ’। এ ছাড়া একটি মুদি-দোকানেরও মালিক। বর্ধমান-কাটোয়া থেকে তিজলহাটি অঞ্চলে লবণ-সরবরাহের একচেটিয়া কারবার।

রোগীকে পরীক্ষা করলেন সযত্নে। সৌম্যসুন্দর সত্যিই সৌম্যসুন্দর। গৌরবর্ণ, খঙ্গনাসা, কিন্তু নয়দিনের সান্নিপাতিক জ্বরে বেচারী নিতান্ত কাহিল হয়ে পড়েছে। একটু আগে থেকে চিকিৎসা করলে হয়তো সৌম্যকে বাঁচানো যেত। এখন তার জীবনের আশা খুবই ক্ষীণ। স্থানীয় কবিরাজ-মশাই জানালেন, ইতিপূর্বে কী জাতীয় চিকিৎসা হয়েছে, কী পথ্যি পড়েছে।

রূপেন্দ্রনাথ বালকটির পিতাকে আড়ালে ডেকে বললেন, বড় দেরি করে আমাকে সংবাদটা পাঠালেন, ঘোষালমশাই। ওর অবস্থা ভালো বুঝছি না। তবে আশা আমি ছাড়িনি। বৈদ্যকে নিরাশ হতে নেই। আমি যথাসাধ্য করে যাব। আপনারাও এখনি নিরাশ হবেন না। সৌম্য মনে হল অপুষ্টিতে ভুগছে। এমন তো হবার কথা নয়, আপনাদের সচ্ছল সংসারে।

পাঁচকড়ি ম্লান হয়ে গেলেন। বললেন, আমারই ভুল। আমারই অপরাধ। ওকে গুরুগৃহে পাঠাবার পর থেকেই ও ক্রমশ শীর্ণকায় হয়ে পড়ছে। অথচ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ও কিছুতেই নদীয়ার সেই গুরুগৃহ ত্যাগ করে আসতে স্বীকৃত হচ্ছে না।

—কী নাম ওর গুরুদেবের? কার চতুষ্পাঠীতে ও পড়ছে?

—নদীয়ার স্বনামধন্য পণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত!

ম্লান হাসলেন রূপেন্দ্র। হাতদুটি এক করে উদ্দেশে প্রণাম করলেন।

—আপনি তাঁকে চেনেন?

রূপেন্দ্র বললেন, সমগ্র আর্যাবর্তের সংবাদ আমি জানি না। তবে গৌড়মণ্ডলে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। সর্বাগ্রগণ্য অধ্যাপক!

—ত্রিবেণীর মহাপণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন কি তাই নন?

পুনরায় উদ্দেশে প্রণাম করে রূপেন্দ্রনাথ বললেন, তিনি আমার গুরুদেব। তাঁর চতুষ্পাঠীতে আমি কিছুদিন অধ্যয়ন করেছি। কিন্তু এ আলোচনা পরেও হতে পারবে। আপাতত সৌম্যের দিকেই আমাকে নজর দিতে দিন।

তাই দিলেন। মধ্যাহ্নের সূর্য ক্রমে পশ্চিমে ঢলে পড়ল। রূপেন্দ্রনাথ প্রতি অর্থদণ্ডে কয়েক ফোঁটা করে তরল পানীয় বালকটির মুখবিবরে প্রদান করে নাড়ি ধরে কী যেন লক্ষ্য করতে থাকেন। শেষে পড়ন্ত বেলায় বললেন, ঘোষালমশাই, এবার আমাকে বিদায় দিতে হবে। রাতে কী ওষুধ পড়বে, কতক্ষণ পরে, পরে তা আপনার কবিরাজ-মশাইকে বুঝিয়ে দিয়েছি। রাতটুকু তিনিই পাড়ি দেবেন। কাল প্রত্যুষে আমি আবার আসব।

—আপনি যা ভালো বোঝেন। আমি কী বলব? তাহলে এই পুঁটুলিটা অনুগ্রহ করে গ্রহণ করুন। আপনার বৈদ্যবিদায়।

—না, ঘোষালমশায়। আমি তো কালই আবার ফিরে আসছি।

—তা হোক। এটা ধরুন। না হলে আমার তৃপ্তি হবে না।

—সেক্ষেত্রে আমাকে একমুষ্টি আতপ তণ্ডুল আর পাঁচটি কড়ি এনে দিন। সৌম্যকে সুস্থ করে তুলি, তারপর আপনার মনঃতুষ্টির মতো বৈদ্যবিদায় আমি গ্রহণ করব। কথা দিয়ে যাচ্ছি।

অপরাহ্ণবেলায় উনি রওনা দিলেন। দূরত্ব এমন কিছু নয়। মাত্র তিন-চার ক্রোশ। সমস্তদিন আকাশ থমকে ছিল। হঠাৎ পথেই ঘনিয়ে এল কালবৈশাখী। প্রথমে জোরে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন; কিন্তু প্রভঞ্জন-গতিতেই ধেয়ে এল প্রভঞ্জন। বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হল একটি দেবালয়ের মণ্ডপে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। গ্রামে যখন ফিরে এলেন ততক্ষণে সন্ধ্যা সমাগত। প্রথম প্রহরের শিবাধ্বনি অবশ্য এখনো শোনা যায়নি, কিন্তু অন্ধকার ঘনিয়েছে। ঝোপে-ঝাড়ে লাখ-লাখ জোনাকির নৃত্য শুরু হয়ে গেছে। বাড়ির দোরগোড়ায় যখন এসে পৌঁছালেন ততক্ষণে মেঘ সরে গিয়ে শুক্লা একাদশীর চাঁদ রুপালি আস্তরণ বিছিয়েছে গ্রামের বনবীথিকায়। বড় বড় ফোঁটায় গাছ থেকে তখনো জল ঝরছে।

পৈতৃক ভিটার সম্মুখে এসে দেখেন দোরের পাশে চাদর মুড়ি দিয়ে কে-যেন বসে আছে। রূপেন্দ্র হাঁকাড় পারেন, কে? কে ওখানে?

এগিয়ে এল লোকটি। বললে, আজ্ঞে, আমি শিবু।

—শিবনাথ? তুমি এখন এখানে?

—আজ্ঞে, দাদা বললেন, দুপুরে আপনি ফেরেননি। তারপর তো প্রচণ্ড ঝড়-জল গেল। আমাকে বললেন এখানে অপেক্ষা করতে। আপনি নিরাপদে ফিরে এলে সেই

খবর নিয়ে আমি বাড়ি যাব। কিন্তু আপনার এতটা দেরি হল যে?

—রোগীর অবস্থা ভালো নয়, শিবনাথ।

–আপনি তো একেবারে ভিজে গেছেন?

—যাবনা? বৃষ্টিটা কি কম হয়েছে?

উনি অশ্ব থেকে অবতরণমাত্র শিবনাথ এসে লাগামটা ধরল। সৈনগুপ্ত শিবনাথকে ভালোই চেনে। রূপেন্দ্রনাথের গৃহে ভৃত্যস্থানীয় কেউ নেই। উনি নিজেই সৈনগুপ্তের দানাপানি দেন। কখনো বা শিবনাথ। সৈনগুপ্তকে নিয়ে সে অশ্বাবাসের দিকে চলে গেল। ‘অশ্বাবাস’ শব্দটি গৌরবে। বাস্তবে উদ্যানপ্রান্তে তল্লা বাঁশের একটি একচালা। শীতাতপ এবং বৃষ্টি থেকে কিছুটা রক্ষা করার প্রয়াস। শিবনাথ সৈনগুপ্তকে নিয়ে ঘোড়াশালের দিকে রওনা হবার পর উনি সদর দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে আসেন। এতক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। বেল-জুঁই-হাসনুহানার একটি মিশ্র মৃদু সৌরভ। ঠেলে দেখলেন সদর দ্বার ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ। গৃহস্থ বাড়িতে সেটাই হবার কথা। উনি করাঘাত করামাত্র ভিতর থেকে সশঙ্ক বামাকণ্ঠে প্রশ্ন হল, কে?

—আমি বৌঠান। ফিরে এসেছি।

হুড়কো-খোলার শব্দ। কাঁঠালকাঠের দুটি পাল্লা গেল খুলে। ও প্রান্তে প্রদীপহস্তা শুভ্রবসনা মালতী, মাথায় আধো-ঘোমটা। একই প্রশ্ন করল সে, এত রাত হল যে ফিরতে?

—না রাত নয়, তবে দেরি হয়েছে কিছুটা। এখন তো সবে সন্ধে।

পিছন ফিরে সদর দরজাটি আবার অর্গলবদ্ধ করে দিলেন।

—আপনি তো একেবারে ভিজে গেছেন?

—তা তো যাবই। কী বৃষ্টিটা হল! ঝড়ে কাঁচা আম পড়েনি?

—আপনি কি এখন আম-কুড়োতে যাবেন নাকি?

—না, না! কী যে বলেন! মামণি কই?

—ভাদুড়ীবাড়ি। সকালবেলাতেই পুঁটুদি এসেছিলেন, শুভ্রকে নিয়ে। মামণিকে নিয়ে গেছেন। আবার কাল সকালে পৌঁছে দেবেন।

—কেন?

—ওঁরা যে জানেন, আজ আমাদের বাড়িতে অরন্ধন। দুটি বিধবা একটি বিপত্নীক। আজ আমাদের সকলেরই তো একাদশী। উনুন জ্বলবে না।

—আর গিরিপিসিমা? তাঁর সাড়া পাচ্ছি না যে? জপে বসেছেন?

মালতী নিঃশব্দে জলের ঘটিটা এগিয়ে দিল। জবাব দিল না।

রূপেন্দ্র সেই জলে হস্তপদ প্রক্ষালন করলেন। অঙ্গমার্জনবস্ত্রে হাতপা মুছে পুনরায় বললেন, কী বৌঠান? পিসিমা কোথায়? বললেন না যে?

—তিনি তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে চলে গেছেন। রাতে ফিরবেন বলে মনে হয় না।

ভ্রূকুঞ্চন হল রূপেন্দ্রের। বলেন, সে কি! মীনুর বাবার সঙ্গে কী যেন বিবাদ করে না এ বাড়িতে এসে উঠেছিলেন? বিবাদ কি মিটে গেল?

মালতী নতনেত্রে বলল, ও-বেলা নিজের কানেই তো শুনলেন। ওসব বাজে ওজর। ঝগড়াঝাঁটি কিছুই হয়নি। মীনুদির বাবা ওঁকে এখানে পাঠিয়েছিলেন পাহারা দিতে।

কথাটা কানে বাজল। রূপেন্দ্র সে কথা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, রাতে পিসি ফিরবেন না? তাই বলে গেলেন?

—রাতে কেন? তিনি আর এ বাড়িতে আসবেনই না। তাই বলে গেলেন! একটু বিহ্বল হয়ে পড়লেন যেন। তারপর হঠাৎ বলেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনি আসছি-

—আগে ভিজা কাপড়টা ছাড়ুন?

—না। ওকে ধরতে হবে। ও যেন না বাড়ি চলে যায়?

—ওকে মানে? কাকে ধরতে হবে?

রূপেন্দ্র সে কথার জবাব না দিয়ে আবার বার হয়ে গেলেন। সদর দরজার হুড়কো খুলে-জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বাগানে। মালতী প্রদীপ হাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইল।

একটু পরেই ফিরে এলেন আবার। বললেন, শিবনাথকে বলে এলাম। ও বাড়ি চলে গেল। রাতের আহার সেরে ও আবার ফিরে আসবে। এই দাওয়াতেই শোবে। মশারি আর কিঞ্জর সে নিজেই নিয়ে আসবে।

ধীরপদে নিজের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। পালঙ্কে মশারি টাঙানো। সন্ধ্যার আগে মশারিটা টাঙিয়ে না ফেললে ভিতরে মশা ঢুকে যায়। পালঙ্কটি বড়—সাবেক পালঙ্ক। ওঁরা বাবাবেটিতে এ ঘরে শয়ন করেন। মালতী আর পিসিমা রাত্রিবাস করেন পুবের ঘরে। আজ দুজনেই একক শয্যায় শয়ন করবেন। অবশ্য দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকবে শিবনাথ। রূপেন্দ্রনাথের ব্যবস্থাপনায়।

কিন্তু শিবনাথ ঠাকুরপোকে উনি কী বললেন? কী ভাষায় বললেন?

রূপেন্দ্র ভাঁড়ারঘর থেকে ততক্ষণে দুটি ডাব বার করে এনেছেন। কাটারিটাও। বললেন, দুটি পাত্র নিয়ে আসুন তো, বৌঠান।

—দুটি?

—হ্যাঁ, ডাবে জল আছে যথেষ্ট।

ডাব দুটির মুখ কেটে একটি পাথরের গেলাসে ডাবের জল টেনে নিলেন নিজের হাতে। একটি বাড়িয়ে ধরলেন মালতীর দিকে।

মালতী অবাক। নতমুখে বললে, একাদশীতে আমি নির্জলা উপবাস করি ঠাকুরপো।

—জানি। আজ থেকে ‘সজলা’ উপবাস করবেন। নিন ধরুন।

—আপনি আমাকে মার্জনা করবেন!

—ও! আপনি আমার অনুরোধ রাখবেন না? ঠিক আছে। তবে থাক।

—সেকি? আপনিও খাবেন না?

—কী করে পান করব? আমি যে ওই বোকামিটাতে বিশ্বাসী। সংসারে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার! অনেকটা অশ্বারোহণে এসেছি তো, তাই বড় তৃষ্ণা পেয়েছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে? আসুন, ঘরে যাই। দুজনেই নির্জলা একাদশী পালন করি।

মালতী নীরবে পাথরের গেলাসটি উঠিয়ে নিল। ওঁর দিকে পিছন ফিরে ঢকঢক করে পাত্রটা নিঃশেষ করে দিল।

রূপেন্দ্র খুশি হলেন। পিছন থেকেই ওর অবগুণ্ঠনাবৃত মস্তকে হস্তস্থাপন করে বললেন, এই তো লক্ষ্মী মেয়ে।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টার মতো দূরে সরে গেল মালতী। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠেছে তার। রূপেন্দ্রনাথের স্নেহস্পর্শে। রূপেন্দ্রনাথ ততক্ষণে নিজের পানপাত্রটি নিঃশেষ করেছেন। সহাস্যে বললেন, কী হল? অমন চমকে উঠলেন যে? পায়েও হাত দিতে দেবেন না আবার মাথাতেও নয়?

নতমুখী মালতীর কণ্ঠে স্বর ফুটল না। রূপেন্দ্র নিজেই বলতে থাকেন, কী জানেন, বৌঠান, মাসে দুদিন উপবাস করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। কিন্তু নির্জলা নয়—উপবাসের দিন অধিক পরিমাণে জল পান করা উচিত। দুগ্ধ হলেই ভালো। বিকল্পে পাতিলেবুর সরবত অথবা ডাবের জল।

এবারও মালতী কোনও জবাব দিল না।

রূপেন্দ্র ভাঁড়ারঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দেখেন, মালতী ইতিমধ্যে দাওয়ায় একটি শীতলপাটি বিছিয়ে রেখেছে। ক্লান্ত গৃহস্বামীর দিবসান্ত বিশ্রামের আয়োজন। গৃহাভ্যন্তর থেকে একটি উপাধানও এনে রেখেছে পাশে। একটু দূরে, পায়ের দিকে পিলসুজে একটি প্রদীপ জ্বলছে। শুক্লা একাদশীর ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠানে লুটোপুটি খাচ্ছে। কিন্তু দাওয়ায় এখনো আধো-অন্ধকার। জ্যোৎস্নালোক অতদূর হাত বাড়াতে সাহসী হয়নি।

রূপেন্দ্র শীতলপাটিতে উপবেশন করলেন। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে মালতী তাঁর পায়ের দিকে গিয়ে বসল। রূপেন্দ্র বললেন, শিবনাথকে তখন বলেছিলাম, কিঞ্জর নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। তা আমার ভদ্রাসনেই আছে। ওকে আরও বলেছিলাম, পিসিমা আজ অনুপস্থিত। তাঁর শয্যাটাও শূন্য পড়ে আছে। কিন্তু সে স্বীকৃত হল না। নিষ্ঠাবতী ব্রাহ্মণীর বিছানায় কি শোয়া যায়?

মালতী দূর থেকেই প্রশ্ন করে, কিঞ্জর কী?

রূপেন্দ্র তাঁর বক্তব্যের টীকাটিপ্পনি পেশ করেন, ‘মাদুর’ আর কি।

—ও! তা শিবনাথকে আপনি কী বললেন? কেন তাকে এখানে এসে রাত্রিবাস

করতে হবে?

—বলেছিলাম, পিসিমা আজ বাড়ি নেই। আমি পেশায় বৈদ্য তো? রাত-বিরেতে কোনও রুগিবাড়ি থেকে আহ্বান এলে আমাকে যেতেই হবে। তখন আপনি বাড়িতে একা পড়ে যাবেন, ভয় পাবেন। এই আর কি?

—সেটাই কি সত্যিকথা?

—নয়?

—আমার জ্ঞানমতে নয়। আপনি তো মিছে কথা বলেন না। তাহলে ওভাবে ছলনার আশ্রয় নিলেন কেন?

মৃদু হাসলেন রূপেন্দ্রনাথ। বললেন, সত্যং ব্রুয়াৎ, প্রিয়ং রুয়াৎ, মা ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্!

—উনস্বর-বিসর্গগুলো বাদ দিয়ে বুঝিয়ে বলবেন?

—দেখুন বৌঠান, শিবনাথকে আমি যা বলেছি তা অনৃতভাষণ নয়। আবার তা পুরোপুরি সত্যও নয়। কিন্তু এ কথা তো মানবেন যে, সত্য সর্বদা সুন্দরের সঙ্গে সম্পৃক্ত! নগ্ন সত্যটা প্রকাশ করলে সেটা কদর্য শোনাতো। শিবনাথ বুদ্ধিমান, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, কেন তাকে আজ রাত্রে এ বাড়িতে থাকতে বললাম। অথচ আমার বাকপ্রয়োগে সেই নগ্নসত্যটা, সেই অসুন্দর তথ্যটা অবারিতই রইল। যে কথায় কারও ক্ষতি হয় না, শোভনতা এবং সৌন্দর্যের বিকাশ হয়, তা কি সত্য নয়?

মালতী যেন আর নিজেকে সামলাতে পারল ন। প্রশ্ন করে বসে কিন্তু আসলে আপনার ভয়টা কাকে? আমাকে, না কি লোকনিন্দা?

—যদি বলি ‘নিজেকে’?

—তাহলে আবার বলব ‘আপনি সত্যি কথা বলছেন না।’ আপনি সিদ্ধপুরুষ। নিজের ওপর আপনার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। যথেষ্ট আস্থা আছে।

আবার হাসলেন রূপেন্দ্র। বলেন, তাহলে আমি ও কথা কেন বললাম?

—নিজেকে আমার সমতলে নামিয়ে আনতে। আপনি যে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী! আমি যে-ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। তাই আপনি ভয় না পেয়েও ভয়-পাওয়ার অভিনয় করে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চান। তাই ওকথা বলেছেন।

রূপেন্দ্র বলেন, বড় সুন্দর করে বলেছেন কথাটা। কী জানেন বৌঠান, কথাটা ‘লোকনিন্দা’ না হয়ে ‘লোকাচার’ বললে আমি সেটা স্বীকার করে নিতাম।

—কী প্রভেদ ও দুটো শব্দে? ‘লোকনিন্দা’ আর ‘লোকাচার’?

—’লোকনিন্দা’ অর্থে ‘লোকে নিন্দা করবে এই ভয়ে।’ আমি একবগ্গা–আপনি জানেনই। ‘লোকনিন্দা’-র ভয় থাকলে আমি স্বীকার করতাম না যে, বিপত্নীক হবার পূর্বযুগে আমি ‘বৃথামাংস’ গ্রহণ করতাম, অথচ ‘বলি’র মাংস আহার করতাম না। সে ভয় থাকলে আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসতাম না।

—সেটাই তো আমার প্রশ্ন। আপনি আপনার গুরুদেবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে যখন সোঞাই গাঁয়ে নিয়ে এলেন তখন তো আপনি জানতেন না যে, পিসিমা তাঁর ভাই-এর সঙ্গে আপসে ঝগড়া করে আমাদের দুজনকে পাহারা দিতে উপস্থিত হবেন! জানতেন?

—না, সেদিন তা আমার জানা ছিল না, তেমনি সেদিন তো আমার একথাও জানা ছিল না যে, আপনি হঠাৎ এমন….

মাঝপথেই থেমে যান। মালতী দু হাতে নিজের মুখটা ঢাকে।

একপ্রহরের শিবাধ্বনি হল হঠাৎ। যেন ব্যঙ্গ করে উঠল মালতীকে।

দুজনেই নীরব। রূপেন্দ্র শয়নের উপক্রম করলেন। মালতী পাঙ্খাটা উঠিয়ে নিয়ে বীজন করতে থাকে। মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে। রূপেন্দ্র উপাধানটি টেনে নিতেই একটা ধাতব শব্দ হল। উপাধানের পার্শ্বে রক্ষিত একটি কাঁসার রেকাবি উঠানে গড়িয়ে পড়ল দাওয়া থেকে। আর তখনি হঠাৎ একরাশ জুঁই ফুলের গন্ধে বাতাস আমোদিত হয়ে উঠল। মালতী বলল, আহা পড়ে গেল ফুলগুলো?

মাদুরের উপর ছড়িয়ে পড়া জুঁই ফুলগুলো টুকিয়ে টুকিয়ে হাতে তুলতে থাকে।

—ফুল ছিল নাকি থালাতে? জুঁই? দেখি দেখি—

কোথাও কিছু নেই মালতীর মুষ্টিবদ্ধ হাতটি টেনে মুঠি খুলে দিলেন। এবার আর শিউরে উঠল না মেয়েটি। কেমন যেন অবশ হয়ে পড়ে। কেমন যেন মোহমুগ্ধ আবেশে নেতিয়ে পড়ে! মুঠি তার আপনিই খুলে যায়। হাতটি তুলে নিয়ে আঘ্রাণ করলেন রূপেন্দ্রনাথ। অজান্তে তাঁর আনন্দোচ্ছ্বাস বেরিয়ে এল মুখ থেকে : আহ্!

ছেড়ে দিলেন হাতটা। মালতী নিঃশব্দে দাওয়া থেকে গড়িয়ে-পড়া ছোট্ট রেকাবিটা তুলে নিয়ে ফুলগুলি আবার তাতে সাজিয়ে রাখল। একটু দূরে সরে বসল। নীরবতা যেন সহ্য হচ্ছিল না তার। তাই একটা অহৈতুকী প্রশ্ন করে বসে, ফুল ভালোবাসেন না আপনি? জুঁই ফুল?

—বাসি। কে না ভালোবাসে? তবে গাছ থেকে তোলা ফুল নয়— যে ফুল আপনিই মাটিতে ঝরে পড়েছে সেই ঝরাফুল!

মালতীর ভ্রূকুঞ্চন হয়। একথার মধ্যে কি কিছু তির্যক ইঙ্গিত আছে? ওঁদের যখন প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন মালতী ছিল সীমন্তিনী। এক ঘনশ্যাম ঋজু পাদপকে বেষ্টন করে সে মালতীলতা পুষ্পিতা হয়ে মৃদুমন্দ বাতাসে তখন দোল খেত। আর আজ সে ঝরাফুল। তবু এবার আর সাহস করে প্রশ্ন করতে পারল না : কেন?

রূপেন্দ্রনাথ জোনাকজ্বলা চন্দ্রাহতা বনভূমির দিকে তাকিয়ে যেন স্বগতোক্তি করতে থাকেন। কী জানেন বৌঠান, আমি উপনিষদের ওই বাণী বিশ্বাস করি। এ বিশ্বপ্রপঞ্চ প্রাণময়। আকাশ-বাতাস, এই ‘নক্তম্’, ওই বনস্পতি সবই মধুময়। এরা সবাই প্রাণিত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ‘প্রাণ’ যদি সত্য হয় তবে বিশ্বসংসারে ‘মৃত্যু’ও সত্য! ‘প্রাণবন্ত’ হওয়ার অনুসিদ্ধান্ত ‘প্রাণনাশ’ হওয়া জুঁই ফুলগুলি যতক্ষণ ফুটেছিল ততক্ষণ তারা প্রাণিত ছিল, ঝরে পড়ার পর তারা মৃত। তবু তারা এখনো সৌরভমণ্ডিত। তারা জীবনের আশীর্বাদ সুগন্ধ এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে!

তারপর হঠাৎ কী খেয়াল হল। বললেন, এবার আমি কিন্তু ‘অং-বং’ বলিনি, বৌঠান। কী বললাম তা বুঝতে পারছেন?

মালতী তা স্বীকার করল না। অস্বীকারও নয়। বললে, ‘নক্তম্’ মানে কী?

—রাত্রি! আপনার-আমার কাছে আজ যে ‘অবাক রাতটা’ ধরা দিয়েছে তার কথা বলছি আমি।

মালতীর মনে হল, ওই মানুষটা বড় একা। ওকে কেউ কোনওদিন চিনতে পারেনি। কুসুমমঞ্জরীও নয়। ওকে পরিক্রমা করা যায়। ওর মনের ভিতরে প্রবেশ করা যায় না। তাই শ্যামাপোকার দল ওকে ক্রমাগত পরিক্রমাই করে চলে। যে হতভাগী ওর অন্তর্লীন সত্তাকে স্পর্শ করতে ঝাঁপ খেয়ে পড়ে তার মৃত্যু অনিবার্য—ঝরেপড়া জুঁই ফুলের মতো।

এখন হঠাৎ সে একেবারে ভিন্ন একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করল। এখন আমি কী করব, ঠাকুরপো?

রূপেন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তর যেন প্রস্তুত। বললেন, সিদ্ধান্তটা আপনাকেই নিতে হবে, বৌঠান! আমি শুধু তা কার্যকরী করব!

—বাঃ! দায়িত্বটা কি শুধু আমার একার। আপনার গুরুদেব তো আমাকে ত্রিবেণীতে তাঁর ভদ্রাসনেই আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন। আপনিই তো—

রূপেন্দ্রনাথ কী ভাবে জবাবটা দেবেন বুঝে উঠতে পারেন না।

মালতী নিজেই বলে, স্বীকার করছি, তখন আপনি জানতেন না যে, আমার…আমার…

উদ্গাত অশ্রুর আবেগে শেষ করতে পারে না কথাটা। রূপেন্দ্রনাথ এবার কিন্তু হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারলেন না ওর মাথায়। অথবা সাহস হল না ওর হাতটা ধরতে। কী জানি—যদি হতভাগিনী মূর্ছিতা হয়ে লুটিয়ে পড়ে ওঁর বুকের উপরেই।

দুজনেই সামলে ওঠেন। রূপেন্দ্রনাথ বলেন, নিজেকে ওভাবে ভর্ৎসনা করবেন না, বৌঠান! মানুষ তার নিজের মনটাকেই বা কতটুকু চিনতে পারে? মাঝে মাঝে সকলেরই মনের লাগামটা ছিঁড়ে যায়—

—আপনারও?

—হ্যাঁ, আমিও তো মানুষ! আবার কখনো কখনো অন্তর্লীন আবেগকে রুদ্ধ করার জন্যই লাগামটা বেশি জোরে টেনে ধরেছি। সেজন্য ভৎসিতও হয়েছি।

—ভর্ৎসিত হয়েছেন!! আপনি? কার কাছে?

—নাম বললে কি চিনতে পারবেন? কাশীধামে ত্রৈলঙ্গস্বামীর কাছে!

—কে তিনি?

—তাঁর কথা থাক। আপনার সামনে এখন তিনটি বিকল্প পথ। আপনি নিজেই নির্ণয় করুন : কোন পথে বাকি জীবন পরিক্রমা করবেন। প্রথমত, আপনি ত্রিবেণীতে মামাশ্বশুরের সংসারে ফিরে যেতে পারেন।

—বিনা আমন্ত্রণে? তাছাড়া সেক্ষেত্রে আপনার যে চরম অপমান হবে। লোকে ভুল বুঝবে। ভাববে আপনার হাত থেকে রক্ষা পেতেই আমি আবার ফিরে গেছি ত্রিবেণীতে। ভাববে : যে রক্ষক, সেই ভক্ষক!

—তার মানে ‘লোকনিন্দা’?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই। আপনি লোকনিন্দার পরোয়া করেন না জানি। আমি করি।

—আমার কথাটা তখন শেষ হয়নি, বৌঠান। আমি বলেছিলাম, ‘লোকনিন্দার’ পরোয়া আমি করি না, কিন্তু ‘লোকাচার’ মেনে চলি।

—দুটো কথার তফাত কী?

—তাই বলতে শুরু করেছিলাম। কথাটা শেষ হয়নি। আমরা প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলাম। সংসারে থাকতে হলে, সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে বাস করতে হলে, অর্থাৎ সমাজের কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নিতে হলে, তার কিছু-কিছু অনুশাসন আমাদের মেনে চলতে হবে। তাই নয়?

—’কিছু কিছু’?

—হ্যাঁ, সমাজের যে অনুশাসন মঙ্গলময়, সত্য-শিব-সুন্দর সম্পৃক্ত। যেটা তা নয় তার প্রতিবাদ করবার অধিকার আছে প্রতিটি সমাজবদ্ধ জীবের। যেমন আমি প্ৰতিবাদ করতে চাই সতীদাহের বিরুদ্ধে, ক্ষেত্রজাত-সন্তান উৎপাদনের বিরুদ্ধে, স্ত্রীলোককে অশিক্ষিত রাখার কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু সমাজের নির্দেশে লজ্জানিবারণ বস্ত্র পরিধান করি, বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান জানাই, দেবমন্দিরে প্রণাম করি…..

—দেবমন্দিরে প্রণাম’? সেটা তো আপনার ধর্ম! সামাজিক নির্দেশ কেন হতে যাবে?

—না বৌঠান, আমি শাক্তবংশের সন্তান হলেও অন্তর্লীন চেতনায় আমি ‘অদ্বৈত বৈদান্তিক’। আমার দার্শনিক তত্ত্বদৃষ্টিতে, আমার বিশ্বাস মতে, শালগ্রাম শিলা আর পাথরের নুড়িতে কোনও প্রভেদ নেই। তবু সত্যনারায়ণের পূজার ব্যবস্থা তো করেছিলাম। সামাজিক হেতুতে।

মালতী নতনেত্রে কী যেন ভাবল। তত্ত্বটা বুঝে নিতে চাইল সম্ভবত। তারপর বলল, ও-কথা থাক। আপনি তিনটি বিকল্প পথের কথা বলেছিলেন। একটা তো হল। মাথা মুড়িয়ে, উলেটো গাধায় চেপে ত্রিবেণীতে মামাশ্বশুরের বাড়ি অনিমন্ত্রিত ফিরে যাওয়া। বাকি দুটো?

—আপনি রাজি থাকলে, তারাদাকে বলতে পারি। তাঁর সংসারে এমন অনেকে বাস করেন, যাঁদের সঙ্গে ওঁদের রক্তের সম্বন্ধ নেই, আত্মীয়তার বন্ধন নেই!

—দাসীগিরি?

—সেভাবে নিচ্ছেন কেন?

—কিন্তু ভাদুড়ীমশাইকে কী বলবেন? শিবনাথকে যে ‘সত্য-সুন্দর’ যুক্তি দেখিয়েছিলেন সে যুক্তি তো এবার খাটবে না। আবার পিসির মতো মুখ ফুটে বলতেও পারবেন না—কী করব? আবাগি মাগিটা যে মরেছে!”

এবারও মালতীর ‘প্রাকৃতভাষে’ আপত্তি করতে পারলেন না।

কথাটা ভেবে দেখার। সোঞাই গ্রাম পদার্পণমাত্র তারাপ্রসন্ন বলেছিলেন, ‘এ হয় না।’ আর উনি প্রতিবাদ করেছিলেন, ‘কেন হবে না?’ আজ কোন মুখে উনি গিয়ে বলবেন, ‘আমিই ভুল বলেছিলাম, তারাদা—এ হয় না, হবার নয়।’ উনি মুখে না বললেও সবাই ধরে নেবে সেই মেয়েছেলেটা এমন অশালীন আচরণ শুরু করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত একবগ্গাকে জমিদারের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করতে যেতে হল।—না, না, ও কথা বল না তোমরা -ধন্বন্তরি-বাবা জিতেন্দ্রিয় সন্ন্যাসী মানুষ। ও মাগিই শয়তানী! কাঁচা বয়স তো! তাছাড়া চোখের সামনে অমন আগুনবরণ মানুষটা। দেখলে না—পীতু মুখুজ্জের দিদিটার পর্যন্ত সহ্য হলনি?

অনেকক্ষণ দুজনেই নীরব। নিজ নিজ চিন্তায় বিভোর। তারপর মালতীই বলে ওঠে, আর তৃতীয় বিকল্পটা?

—আপনি যদি নিজের মনকে বশে রাখতে পারেন। কোনওক্রমেই নিজের মনকে রাশছাড়া হতে দেবেন না।

একটু নীরব থেকে মালতী বলে, আমি কি তা দিয়েছি? মনকে রাশ ছাড়া হতে?

—না দিলে পিসি কেমন করে আপনার মনের কথা জানতে পারলেন?

—আপনিও পেরেছিলেন?

—প্রথমটায় নয়। কিন্তু আজ সকালে আপনার আচরণে সেটা নির্বোধেও বুঝে ফেলবে। আপনার উদরে স্পর্শ করা মাত্র আপনি….। তাছাড়া আজ বিকালে আপনার মাথায় হাত রাখতে আপনি অকারণে শিউরে উঠলেন। একটু আগে নিতান্ত কৌতূহলে আমি দেখতে গেলাম আপনার হাতে কী আছে, আর আপনি…

—চুপ করুন।

—করলাম। প্রসঙ্গটা আপনিই তুলেছিলেন বৌঠান।

আবার দুজনে নীরব। আবার মালতীই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, তৃতীয় বিকল্পটা কী?

—ওই যে বললাম। আপনি ইচ্ছা করলে মন্ত্রদীক্ষা নিতে পারেন। সাধনভজনে মনটাকে বশে আনার চেষ্টা করতে পারেন।

এতক্ষণ নতনেত্রে কী যেন ভাবছিল। এবার বলে, আপনি আমাকে মন্ত্রদীক্ষা দেবেন?

—না। আমি উপযুক্ত গুরুর ব্যবস্থা করে দেব।

—কেন? আপনি নিজে কেন তা দিতে পারেন না?

—আমি মন্ত্রদীক্ষা দিই না, মালতী! কখনও দিইনি।

মালতী? বৌঠান নয়? মালতী এবার চোখে-চোখে তাকাবার সাহস পেল। বলল, তাতে কী? কখনও বিবাহ করেননি—একবারই তা করেছেন। তাই নয়? কখনও সন্তানের পিতা হননি—একবারই তা হয়েছেন!

রূপেন্দ্রের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মনস্থির করে বললেন, না। বাধা আছে!

সেটাই তো জানতে চাইছি আমি। বাধাটা কোথায়? কীসের?

—গুরুকে মনের সব কথা খুলে বলতে হয়!

—তাই তো বলছি আমি। অস্বীকার তো কিছু করিনি।

—কিন্তু গুরুকেও যে সবকথা শিষ্যাকে খুলে বলতে হয়!

—আপনি তা পারবেন না?

—একথার জবাব আমি দেব না, মালতী।

কী বুঝল তা সেই জানে। হঠাৎ তার সংযমের বাঁধ গেল ভেঙে। সামনের দিকে একটু সরে এসে দু-হাতে ওঁর বাহুমূল ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে বলে, কেন? কেন? কেন? কেন জবাব দেবেন না?

ঠিক তখনই নৈশ স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে বাইরে থেকে কে-যেন ডেকে উঠল, বাবাঠাকুর!

রূপেন্দ্রনাথ সাড়া দিলেন, কে? শিবনাথ? আসছি আমি!

সসংকোচে লাফিয়ে সরে গেল মালতী। প্রবেশ করল তার একান্ত কক্ষে। সশব্দে

বন্ধ হয়ে গেল তার শয়নকক্ষের দ্বার।

রূপেন্দ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সদর দরজার অর্গল মোচন করতে।

১১

তিন-চার দিনের মধ্যেই সৌম্যসুন্দর অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। একাদশীর দিন উনি যখন রোগীকে প্রথম দেখেন তখন তার জ্ঞান ছিল না। এখন সে লোকজন চিনতে পারছে। ক্ষীণস্বরে কথাও বলতে পারছে। ভেষগাচার্য পরপর তিন দিনই এসে খবর নিয়ে গেছেন। ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থাদি করেছেন। আজ সকালে উনি পুনরায় এসেছেন। আজ শুক্লাচতুর্দশী। উনি প্রশ্ন করলেন, আজ কেমন আছ বাবা?

সৌম্যসুন্দর সপ্রতিভভাবে বলে, ভালো আছি ঠাকুরমশাই।

—শরীরে কোনও কষ্ট নেই?

—আজ্ঞে না। তবে বড় দুর্বল লাগছে।

—সেটা আরও দু-একদিন থাকবে। শরীর সুস্থ হতে কিছুটা সময় নেবে। মস্তিষ্কটা সুস্থ থাকলেই হল। আজ দুই সপ্তাহ তো অধ্যয়ন বন্ধ আছে। ব্যাকরণের সূত্রগুলো সব মনে আছে তো?

রোগাক্রান্ত ম্লান হাসল। প্রত্যুত্তর করল না।

—দেখি তোমাকে পরীক্ষা করে। বলতো বাবা, ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ কাকে বলে?

সৌম্য শান্তস্বরে বলল, ‘যা ব্যাকরণের সূত্র অনুসারে সিদ্ধ নয়, অথচ যা ভাষা বাধ্য হয়ে স্বীকার করে নিয়েছে, যা অর্থবহ এবং ভাষার উপকারসাধন করে।’

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, বাঃ। সব কিছুই তো তোমার মনে আছে দেখছি। আচ্ছা, এবার তার একটা উদাহরণ দাও তো ওই ‘নিপাতনে সিদ্ধ’-র।

বালকের চোখ দুটি কৌতুকে নৃত্য করে উঠল। নতনয়নে বললে, যেমন–আপনাদের সোঞাই গ্রামের ‘একবগ্গা দিঘি।’

রূপেন্দ্র বোধকরি এরূপ প্রত্যুত্তর প্রত্যাশা করেননি। কিন্তু অবাক হয়ে বলেন, তাই নাকি? সেটা নিপাতনে সিদ্ধ’? কোন সূত্রে?

—জলাশয়টা দীর্ঘিকা-নির্মাণের ব্যাকরণ মানেনি। দিঘির প্রতিটি প্রান্ত বিপরীত প্রান্তের সমান্তরাল হবার কথা। ওর তা হয়নি অথচ দীর্ঘিকাটি সিদ্ধ, স্বীকৃত এবং গ্রামের উপকারসাধন করে চলেছে।

রূপেন্দ্র মুগ্ধ। ওর মাথায় হাত রেখে বলেন, তুমি সে দীর্ঘিকা দেখেছ কখনও, সৌম্য?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, গতবছর মহাষ্টমীতে দাদা আমাকে আর বৌঠানকে আপনাদের গ্রামের জমিদারবাড়িতে দুর্গা-প্রতিমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন ‘একবগ্গা দীঘিকেও দেখে এসেছি।

রূপেন্দ্র গৃহস্বামীর দিকে ফিরে বললেন, ঘোষালমশাই, আপনার এ ছেলে বেঁচে থাকলে একদিন মহামহোপাধ্যায় হয়ে যাবে। একবগ্গা দিঘিটা যে ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ এমন কথা তো আমার ইতিপূর্বে খেয়াল হয়নি।

ঘোষাল বললেন, ওইটাই বড় কথা ভেষগাচার্য—’বেঁচে থাকলে।

—না, না, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। একপক্ষকালের মধ্যেই ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। বল, সৌম্য, তোমার কী খেতে ইচ্ছে করে?

—তিন্তিড়ী-আচার।

অট্টহাস্য করে ওঠেন রূপেন্দ্র। বলেন, মণ্ডা-মিঠাই, পরমান্ন-মৎস্য-মাংস কিছুই নয়? শুধু তিন্তিড়ী আচার? তিন্তিড়ী পত্রের ঝোল নয় তো?

বালক প্রত্যুত্তর করল না। মুখ লুকিয়ে হাসল।

ঘোষালমশাই সবিস্ময়ে বলেন, সেটা কী রকম? তেঁতুলের পাতা দিয়ে ঝোল হয় নাকি?

—হয়তো আপনার-আমার ভক্ষ্য নয়, শুধু ক্ষণজন্মা পুরুষেরাই তা গলাধঃকরণ করে থাকেন। আপনাকে জনান্তিকে বুঝিয়ে বলব। এটা আমাদের দুজনের একটা গোপন-ব্যাপার। তাই নয়, সৌম্য?

এবারও বালক জবাব দিল না। মুখ লুকিয়ে হাসল শুধু।

১২

নদীয়া রাজ্যে পণ্ডিতাগ্রগণ্য রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত গৌড়মণ্ডলের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যাপক দূর-দূর গ্রাম থেকে মেধাবী ছাত্রেরা দল বেঁধে তাঁর চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন করতে আসে। কিন্তু রামনাথ শহরাঞ্চলে বাস করেন না। আরণ্যক-পরিবেশে তাঁর অন্তেবাসীর আশ্রম। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যাতে তর্কসিদ্ধান্ত সদর কৃষ্ণনগরে একটি চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করেন—রাজকোষ তার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহনে স্বীকৃত। কিন্তু আরণ্যক সারস্বতসাধক তাতে স্বীকৃত হতে পারলেন না। তিনি বনচারীই থাকতে ইচ্ছুক। অবশেষে মহারাজ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিছু অর্থ সাহায্যের উদ্দেশ্যে পণ্ডিতকে বলেন, আপনার এখানে তো কোনো হাট-বাজার নেই। আপনার আশ্রমে কিছু সবজির বাগানও করেননি—

রামনাথ বাধা দিয়ে বলেছিলেন, না না, সবজি-বাগান নয়। প্রথমত, সবজির প্রয়োজনই হয় না। দ্বিতীয়ত, সবজির বাগানের তত্ত্বাবধানে বহু সময় নষ্ট হবে। তা আমারই হোক, অথবা ছাত্রদের।

—তাহলে আপনি কীভাবে অন্নসেবা করেন?

–কেন? আশ্রমে একটি তিন্তিড়ী-বৃক্ষ আছে। তার কচি পাতার ঝোল ব্ৰাহ্মণী তৈয়ার করেন। তাতেই তৃপ্তি সহকারে অন্নসেবা করি।

সেই তিন্তিড়ী-পত্রের ঝোলের ইঙ্গিত করেছিলেন রূপেন্দ্রনাথ।

সে হিসাবে রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত বঙ্গ সংস্কৃতিতে একজন ‘নিপাতনে সিদ্ধ’!

তিন দিনে সৌম্যের স্বাস্থ্যের উন্নতি হল বটে, কিন্তু রূপেন্দ্রর গৃহে সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দেখা গেল না। উনি পারতপক্ষে বাড়ি ফেরেন না—কী জানি যদি মামণি কোথাও খেলতে গিয়ে থাকে! তাহলে নির্জন পরিবেশে আবার তাঁকে মুখোমুখি হয়ে পড়তে হবে সেই হতভাগিনীর। শিবনাথকে অবশ্য দ্বিতীয়বার বলতে হয়নি। প্রতিদিনই একপ্রহর রাত্রে সে এসে এবাড়িতে হাজিরা দেয়—কী-জানি রাত-বিরেতে যদি বাবাঠাকুরের ডাক আসে! মালতীর সঙ্গে তার একটি স্নেহ-সৌহার্দ্যর বন্ধনও সৃষ্টি হয়ে গেছে। তার দাদা আছে, দিদি নেই। এতদিনে একটি দিদি পেয়েছে। তাই শুধু সন্ধ্যারাত্রিই নয়, দিনের বেলাতেও সে এসে মাঝে-মাঝে হানা দেয়। মালতীকে নানান গৃহকার্যে সাহায্য করে। জীবন দত্তও বুদ্ধিমান-গিরিপিসিমা যে তাঁর সাবেক ভিটেতে প্রত্যর্পণ করেছেন এ সংবাদ সে রাখে। তাই আরোগ্য নিকেতনে শিবনাথের যেসব নিত্যকর্ম ছিল তা থেকে যতদূর সম্ভব নিষ্কৃতি দিয়ে দিয়েছে তাকে। শিবনাথ ছিল নিরক্ষর। এই সুযোগে সে মামণির কাছে বাংলা হরফ চিনে নিতে শুরু করেছে। একটি স্লেট ও পেনসিল জোগাড় হয়েছে। সময়ে অসময়ে রূপমঞ্জরী তার প্রথম ছাত্রটিকে বাংলা ভাষা শেখায়। বলে, এটা কী লিখেছ শিবুদা? আমি বললাম তোমাকে ‘বক’ লিখতে, তুমি লিখেছ ‘বর’! ‘ব’য়ের নিচে শূন্য দিলে তো ‘র’ হয়ে যায়। ‘ক’ কি অমনি করে লেখে? ‘ক’ লিখতে ব’য়ের পাশে আঁকড়ি দিতে হয়। এই দেখ আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।

মালতী এগিয়ে এসে বলে, শিবুভাই তোকে ‘বক’ দেখাতে চায়নি, তাই ওটা লিখেছে। তোর জন্য ও একটা ‘বর’ খুঁজছে। শোন শিবু, এখন পড়াশুনা একটু বন্ধ থাক। বড় মুশকিলে পড়ে গেছি। তোমার বাবাঠাকুরমশাই শুক্রবারের হাটটা করেননি। ঘরে আনাজপাতি কিছু নেই। কী করি বল তো?

শিবনাথ স্লেট-পেনসিল রেখে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনাদের পশ্চিমের বাগানে গাছে বেশ বড় বড় এঁচোড় এসেছে। একটা পেড়ে এনে দেব?

—তাই দাও ভাই। আজ এঁচোড়ের ডালনা করব। তুমি বরং দত্ত-খুড়িমাকে বলে এস দুপুরে এই বামুনবাড়িতেই দুটি প্রসাদ পাবে। কেমন?

শিবনাথ চলতে গিয়েও ফিরে আসে। বলে, দিদি, আমাদের চালে বেশ বড় বড় চার-পাঁচটি চালকুমড়ো ধরেছে। মাকে বলে তাও একটা নিয়ে আসব?

মালতীকে ইতস্তত করতে দেখে নিজেই আবার সংযোজন করে। চালকুমড়োর খানিকটা তরকারি আপনি বরং একটা বাটিতে করে দিয়ে দেবেন। সন্ধ্যাবেলা আমি নিয়ে যাব। আমার বাবামশাই চালকুমড়োর তরকারি খুব ভালোবাসেন।

এভাবেই চলছে রূপেন্দ্রনাথের নড়বড়ে সংসার।

কিন্তু এটা তো নিতান্ত সাময়িক সমাধান। এভাবে কতদিন চলতে পারে? মামণি তো কালকে ওকে সরাসরি প্রশ্নই করে বসল, বাবা, আপনি কি সোনা-মাকে বকেছেন?

মালতীকে সে ‘সোনা-মা’ ডাকে। রূপেন্দ্র বলেছিলেন, না তো, মামণি। বকিনি তো! বকব কেন?

—তাহলে সোনা-মা সারাদিন অমন কাঁদেন কেন?

—সারাদিন কাঁদেন?

—না, সারাদিনই নয়। প্রায়ই কাঁদেন। লুকিয়ে-লুকিয়ে। আমি দেখেছি।

—ওঁর বোধহয় বাড়ির জন্যে মন কেমন করে।

—কী যে বলেন বাবা! বাড়িতে ওঁর কে আছে যে, তাঁদের জন্য মন-কেমন করবে? মা-বাবা, ভাই-বোন কেউই তো নেই সোনা-মার।

রূপেন্দ্রনাথ কী জবাব দেবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। রূপমঞ্জরী আবার বলে, আমারও তো মন কেমন করে। তাই বলে আমি কি কাঁদি?

–তোমারও মন-কেমন করে? কার জন্যে? দাদুর?

—ধুস্। তা কেন হবে। মামণির জন্য।

হতভাগিনী জন্মমুহূর্তেই মাতৃহীনা। বিকল্প-মা পেয়েছিল তুলসীকে। তার জন্য ওর মন কেমন করবে না? তুলসীকে সে ‘মামণি’ ডাকত।

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, তুলসীর সঙ্গে কিন্তু আবার তোমার দেখা হবে। তোমার মামণি এখানে আসবেন।

—এখানে? সত্যি? কবে বাবা? দাদু তাঁকে আটকে দেবেন না?

—না। তুলসীর যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন সে তো আর তোমার দাদুর কাছে থাকবে না। ওর শ্বশুর-স্বামীই তো ওকে আসবার অনুমতি দেবেন। তোমার মামণি তখন আসবেন এখানে।

—তুমি ঠিক জান?

—নিশ্চয়, তোমার মামণি যে আমার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

—তার মানে ‘কথা দিয়ে রেখেছেন’, তাই না বাবা?

—হ্যাঁ মা, তাই, ‘প্রতিশ্রুতি দেওয়া’ মানে ‘কথা দেওয়া।’ তোমার মামণির তখন ছোট্ট একটা বাচ্চা হবে। তোমার ছোট্ট ভাই।

—বোনও হতে পারে। পুঁচকে একটা বোন, তাই না বাবা?

রূপেন্দ্র নিজেকে সংশোধন করে নেন, হ্যাঁ তাও হতে পারে।

—আর সোনা-মার? তাঁর কী হবে? আমার ভাই না বোন?

—তোমাকে কে বলেছেন?

—দিদা। তবে সে কথা কাউকে বলতে বারণ করেছেন। আমিও দিদাকে কথা দিয়ে রেখেছি, মানে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।

—তাহলে আমাকে বলে দিলে যে?

—বা-রে! আপনি তো বাড়ির লোক।

১৩

রূপেন্দ্রনাথ সারাদিন বাইরে-বাইরে কাটান। মনটা পড়ে থাকে বাড়িতে। কিন্তু সাহস হয় না। আন্তর-উদ্বেগে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেই চান। এদিকে শিবনাথ সারাদিন পড়ে থাকে এখানে। অতীত দিনের নানান কাহিনি শোনায়। রূপমঞ্জরী সেসব ইতিহাস জানেই না। মালতীও অবশ্য আবছা শুনেছেন—ঠিকমতো জানা নেই। অথচ শিবনাথের অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ সত্য। কীভাবে রূপেন্দ্রনাথ ব্রজসুন্দরীর মৃত্যুশয্যায় যমদূতদের বিতাড়িত করেছিলেন, কীভাবে দামোদরে অকাল বন্যায় বর্গী সর্দারকে জলমগ্ন করেন। কীভাবে বায়েনপাড়ার এক সদ্যবিধবার ‘সতীদাহ’ আচমকা বন্ধ করে দেন।

মালতী জানতে চায়, তার কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত? ছেলে না মেয়ে?

—তা আমি জানি না, দিদি। কিছু একটা হয়েছিল নিশ্চয়। তারপর ওই যে বাবাঠাকুর এখন তিজলহাটিতে গিয়ে একটি ছোট ছেলের চিকিচ্ছে করছেন না-

রূপমঞ্জরী বাধা দিয়ে বলে, ‘চিকিচ্ছে’ নয় শিবুদা, কথাটা ‘চিকিৎসা’।

শিবনাথ তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করে নেয়। বলেন, হ্যাঁ, চিকিৎসাই তা ওর দাদাকে একবার সাপে কামড়েছিল। এক্কেবারে জাত সাপ! মানে নাগ! বাবাঠাকুর একচুমুকে বিষটা খেয়ে ফেললেন!

—খেয়ে ফেললেন!! কিছু হল না তাঁর?

—হবে কী করে? উনি যে মনসামায়ের বরে সপ্যসিধ্য।

রূপমঞ্জরী আবার প্রতিবাদ করে। কথাটা ‘সৰ্পসিদ্ধ’।

এবার আর শিবনাথ নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পায় না। তার পূর্বেই মালতী খিলখিল করে হেসে ওঠে—ঠিক বাপের মতো হয়ে উঠছে দিন দিন। গল্পে মন নেই। দিবারাত্র মানুষের ‘উশ্চারণ’ শুদ্ধ করে দেওয়া!

.

ঘুম-না-আসা রাত্রে রূপেন্দ্র বিছানার ২০কত করেন। পাশেই শুয়ে আছে মামণি। গভীর ঘুমে অচেতন। ওঁর মনে হয়, মালতীকে তিনটি বিকল্প পথের কথা সেদিন বলেছিলেন। কিন্তু সেটাই তো শেষ কথা নয়। আরও একটি বিকল্প সমাধান আছে। মালতীর তা নজরে পড়েনি। পড়ার কথাও নয়। সেটা অবাস্তব, অসম্ভব কথা, কিন্তু তার্কিক পণ্ডিতটিকে নিজের কাছে স্বীকার করতেই হয়! আরও একটি সমাধানের পথ আছে। সেটা অভাবনীয়, কিন্তু অসম্ভব নয়; অকল্পনীয় কিন্তু অপ্রাকৃত নয়। সে পথে যদি উনি পা বাড়াতে পারেন তাহলে ওই ভূলুণ্ঠিতা মালতীলতা আবার সজীব হয়ে উঠবে। পুনরায় একটি ঋজু পাদপের কাণ্ড বেষ্টন করে জীবনমুখী হয়ে উঠবে। সূর্যালোকের আশীর্বাদভিক্ষু মালতীলতা নতুন বৃক্ষকাণ্ডকে জড়িয়ে ধরে ফুলে ফুলে দুলে উঠতে পারে!

মামণি—ওই যে মাতৃহীন বালিকা ওঁর পাঁজর ঘেঁষে অঘোর ঘুমে অচেতন—ও আবার মায়ের স্নেহস্পর্শ ফিরে পাবে। মা—যাঁর অপার শুভ্রকরুণা মানবজীবনে প্রভাতসূর্যের আশীর্বাদ বহন করে আনে তাকে হারানো কি সহজ কথা? এভাবে ওকে বারম্বার মাতৃহীন করাই কি রূপেন্দ্রনাথের ধর্ম? ওই ছোট্ট জীবনে সে দু-দুবার মাতৃহীন হয়েছে। একবার আঁতুড়ে—সে-কথা বেচারি জানেই না, দ্বিতীয়বার ওর মামণির কাছ থেকে রূপেন্দ্রনাথ যখন ওকে ছিনিয়ে আনলেন। সেই মামণির জন্য ওর আজও নাকি মন-কেমন করে। তবে বাপের মুখ চেয়ে সে কাঁদে না—এই যা।… কুসুমমঞ্জরীও তো ওঁকে স্বপ্নের মধ্যে এসে সে কথাই বলে যায়। বলে, রাধাদিকে ফিরিয়ে দিয়ে ভালোই করেছিলে। সে তার কাঙ্ক্ষিত স্বর্গে পৌঁছে গেছে। তুলসীর জন্যও চিন্তা নেই—বড়ঘরেই পড়বে সে। পাবে সব কিছু—ঝকমকে ঘর, তকতকে বর, বকবকে বাচ্চা। কিন্তু মালতী? আমি তো আর ফিরে আসব না। তুমি মালতীকে পায়ে ঠাঁই দাও!

কিন্তু কী করে দেবেন? ‘বিধবাবিবাহ’ তো সম্পূর্ণ অসম্ভব কথা। ভূভারতে কোথাও হয়নি, কখনও হয়নি। শুধু সোঞাই গ্রামের পণ্ডিতসমাজ নয়, সমগ্র আর্যাবর্তের হিন্দুসমাজ তা মেনে নেবে না। হ্যাঁ পারেন, যদি রাধারানির মতো আউল-বাউল সম্প্রদায়ে গিয়ে দয়াভিক্ষা করেন। সেই আউলচাঁদের শিষ্য কর্তামশাইয়ের আখড়ায় গিয়ে হাজির হন। মালতীর হাতটি ধরে। না সেটাও কোনও সমাধান নয়।

আউলিয়া-সম্প্রদায়ের আস্থা নাই একান্ত প্রেমে। তাদের দৃষ্টিতে সব পুরুষই ‘কৃষ্ণ’, সব প্রকৃতিই ‘রাধা’। প্রতিরাত্রে তারা জোড়-ভাঙে, জোড়-গড়ে। সেটা রূপেন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারবেন না। পারবে না মালতীও।

ফলে একমাত্র সমাধান; যদি উনি কাটোয়ার বড় ইমামসাহেবের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন; আমাদের দুজনকে কলমা পড়িয়ে আপনি ইসলামে দীক্ষা দিন!

সেক্ষেত্রে কিন্তু তাঁকে সর্বস্বত্যাগে স্বীকৃত হতে হবে। গ্রাম-গোত্র-ব্রাহ্মণত্ব—নাম এবং রূপ। হয়তো ভেষগাচার্য রূপেন্দ্রনাথ দেবশর্মার নতুন নামরূপ হবে; হেকিম মহম্মদ ইমানুল হক! একবুক দাড়ি, পরনে লুঙ্গি, মাথায় সফেদ তালশির টুপি! জীবনের মূল আদর্শটাকেই বিসর্জন দিতে হবে। আর কোনওদিন সতীদাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার থাকবে না, অথবা ক্ষেত্রজপুত্র-উৎপাদনের পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে।

.

পরদিন প্রাতে রোগী দেখতে বার হবার সময় মালতীকে সংক্ষেপে বললেন, আজ আর আমি মধ্যাহ্নে আসব না, বৌঠান। আপনারা দুজনে আহারাদি সেরে নেবেন। আমার ফিরতে সেই সন্ধ্যা।

মালতী ডাগর দুটি চোখ মেলে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট্ট মেয়েটা কিন্তু আপ্তবাক্য এককথায় মেনে নিল না। বললে, কেন বাবা? আজও কি তোমার উপবাস?

ওকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, না মামণি। আজ মধ্যাহ্নে তিজলহাটিতে আমার আহারে নিমন্ত্রণ আছে।

তারপর মালতীর দিকে ফিরে বললেন, আজ সৌম্যসুন্দর প্রথম অন্নপথ্য করবে। সেই উপলক্ষেই এ নিমন্ত্রণ।

মালতী এখনও নিশ্চুপ। পরিস্থিতিটা সহজ করে তুলতে উনি আরও বলেন, সে অবশ্য পথ্য পাবে সিঙিমাছের ঝোল আর ভাতের মাড়। আমার জন্য নিশ্চয় কিছু বিকল্প আয়োজন হবে।

রূপমঞ্জরী জানতে চায়, সৌম্যসুন্দর কে বাবা?

—ওই যার অসুখ করেছিল। এখন ভালো হয়ে গেছে।

১৪

তিজলহাটি গ্রামটিও দামোদরের ধারে। কায়স্থদের বাস। নদের দক্ষিণপাড় বরাবর ঘন বসতি। জমিদারও কায়স্থ।

পাঁচ-সাতঘর ব্রাহ্মণের বাস। রাঢ়ী-শ্রেণির। তার মধ্যে ঘোষালমশাই সবচেয়ে ধনী। সব চেয়ে প্রতিষ্ঠাবান।

উনি তিজলহাটিতে গিয়ে পৌঁছালেন দ্বিপ্রহরে। ঘোষাল বাড়ির দ্বারদেশে উপনীত হতেই একটি ভৃত্যশ্রেণির লোক এসে ওঁর অশ্বটির লাগাম ধরল। সামনের দাওয়া থেকে এগিয়ে এলেন তিনজন ভদ্রলোক। পাঁচকড়ি, তিনকড়িকে চিনলেন—ওঁদের সঙ্গে অগ্রসর হয়ে এলেন আর একজন সম্ভ্রান্ত প্রৌঢ়। চুনট করা ধুতি-কুর্তা। পায়ে শুঁড়তোলা নাগরা, হাতে হস্তিদন্তমুণ্ড যষ্টি। সসম্ভ্রমে দু-হাত তুলে বললেন, প্রাতঃপ্রণাম ভেষগাচার্য! আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

পাঁচকড়ি তাঁর পরিচয় দিলেন, আমাদের ভূস্বামী শ্রীপ্রসন্নকান্তি মিত্র, পিতা ঈশ্বর দুর্লভকান্তি মিত্র-মহাশয়।

রূপেন্দ্র বললেন, যাতায়াতের পথে আপনার সিংহ-দরজাওয়ালা ভদ্রাসনটি নজরে পড়েছে। আপনার নামও শোনা ছিল। আজ আলাপ করে প্রীত হলাম।

সকলে এসে বৈঠকখানায় উপবেশন করলেন। হুঁকাবরদার দু-হাতে দুটি হুঁকা নিয়ে এগিয়ে এল। কড়ি-বাঁধা হুঁকাটি গ্রহণ করলেন ঘোষাল-মশাই। তারপর মিত্রমশায়ের দিকে ফিরে বললেন, না। উনি তাম্রকূট সেবন করেন না।

দ্বিতীয় হুঁকাটি এবার গ্রহণ করলেন প্রসন্নকান্তি। দু-টান ‘গুড়ুক’ টেনে বললেন, ভেষগাচার্য! এতদিন দূর থেকে দেখেছেন। এবার কিন্তু গরিবের ভিটেয় একবার পদধূলি দিতে হবে। সেজন্যই এখানে অপেক্ষা করে বসে আছি—গুড়ুক…গুড়ুক!

রূপেন্দ্র অপেক্ষা করলেন। হুঁকাটি হস্তান্তরিত করে উনি বললেন, আমার বধূমাতাকে আজ অপরাহ্ণে একবার দেখে যেতে হবে। প্রথম সন্তানটি তার নষ্ট হয়ে গেছে। প্রসবকালেই। দোষ ধাত্রীর কি আমার ভাগ্যের জানি না। এবার আমি আপনার শরণ নিতে চাই। শুনেছি, সোঞাই গ্রামে একটি প্রসূতি-আগার গড়ে তুলেছেন আপনি—

—আজ্ঞে না, গড়েছেন আমাদের জমিদার ভাদুড়ীমশাই। আমি তত্ত্বাবধানে আছি মাত্র। এ তো শুভ প্রস্তাব। এটা তাঁর কত মাস?

—পঞ্চম।

—তাহলে আজই ও-বেলায় তাঁকে দেখে যাব।

—তাহলে ওই কথাই রইল। আমি চলি। আপনি স্নানাহার করুন।

পালকি-বেহারার দল সচকিত হয়ে এগিয়ে এল। তাঁর প্রস্থানের পর ঘোষালমশাই প্রশ্ন করলেন, স্নান করবেন তো?

—প্রাতঃকালেই একবার স্নান করে এসেছি। কিন্তু জ্যৈষ্ঠের গরম! আর একবার করতে পারলে ভালো লাগত।

—কোনও অসুবিধা নেই। দামোদরেও যেতে পারেন আবার শ্যামসায়রেও স্নান করতে পারেন। ওই মিত্রমশায়ের পিতৃদেবের প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণী। তাঁর পিতার নামে। কাছেই।

রূপেন্দ্র জানতে চান, গ্রামে পাকা পুষ্করিণী কয়টি। উনি জবাবে জানালেন—ছোটো-ছোটো অনেকগুলি ডোবা আছে। বাঁধানো ঘাট নেই। প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণী দুটি। শ্যামসায়র আর রাধাসায়র।

—বাঃ! নামের বেশ মিল আছে তো? দুটিই কি মিত্রমশাইদের প্রতিষ্ঠিত?—আজ্ঞে না। মিল শুধু ওই নামেই। রাধাসায়র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার বাবামশাই। আমার ঠাকুমার নামে। আর সেটা রীতিমতো রেষারেষি করে

—রেষারেষি? অস্যার্থ?

শুনলেন সে কাহিনি। প্রসন্নকান্তির পিতৃদেব ছিলেন রাশভারি জমিদার। তাঁর প্রতিষ্ঠিত পুকুরে অন্ত্যজ ব্যতিরেকে বর্ণহিন্দু নরনারীর স্নানের অধিকার ছিল। কিন্তু দিনের একটি বিশেষ সময়—কর্তামশাই যখন স্নান করতে যেতেন—তখন স্নানঘাটে আর কারও নাকি প্রবেশাধিকার ছিল না। ঘোষালমশাইয়ের এক পিতৃত্বসা বুঝি ভ্রান্তিবশত নিষিদ্ধ সময়কালে স্ত্রীলোকদের ঘাটে অবগাহন স্নানে গিয়েছিলেন। প্রহরীরা তাঁকে রুখে দেয়। তাই এককড়ি ঘোষাল পাল্লা দিয়ে আর একটি পুষ্করিণী খনন করান। তাঁর মাতৃস্মৃতিতে। প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণী যথারীতি উৎসর্গ করা হয়। নাম হয় : রাধাসায়র। এখন একটি অলিখিত নির্দেশ মেনে চলেন তিজলহাটির বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়-শ্যামসায়রে শুধু পুরুষদের স্নানের অধিকার; আর রাধাসায়র থেকে জল নিয়ে যান কাপড় কাচেন, স্নান করেন শুধু মহিলারা।

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, তার মানে, রাধাসায়র আমার পক্ষে নিষিদ্ধ অঞ্চল। আমি কিন্তু শ্যামসায়রে যাব না। দামোদরে স্নান সেরে আসি।

১৫

ভোজনকক্ষটি আকারে বৃহৎ। স্নানান্তে রূপেন্দ্রনাথকে সে কক্ষে নিয়ে গেলেন পাঁচকড়ি ঘোষাল। মাত্র দুইজনের জন্য আসন পাতা হয়েছে। তিনকড়ি- সাতকড়ি-নকড়িরা অন্যত্র বসেছেন অথবা পরে বসবেন। মহিলারা তো আহারে বসেন পুরুষদের পালা শেষ হলে। সৌম্যসুন্দরের অন্নপথ্যও সমাপ্ত।

মাঝখানে দুটি পশমের ফুলকাটা আসন। তার সম্মুখে দুটি প্রকাণ্ড কাঁসার থালা। সে দুটিতে বেষ্টন করে আছে একসার বাটি—কিছু কাঁসার কিছু পাথরের। একটু দূরে বসে আছেন তিন-চারজন বয়স্কা মহিলা। গরম আছে। মক্ষিকাও আছে। এঘরে টানাপাখার ব্যবস্থা নেই, ফলে গিন্নিমায়েরা হাতপাখা নিয়ে বসেছেন।

রূপেন্দ্র লক্ষ্য করে দেখলেন, বিরাট কাঁসার থালার কেন্দ্রস্থলে এক একটি শঙ্কু আকারের ভর্জিত অন্নচূড়া। বিচিত্র তার বর্ণসম্ভার। পাঁচটি রং। পাঁচ দিক থেকে তা চুড়ো রচনা করেছে। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ ও শুভ্র। প্রতিটি অংশে বর্ণবৈশিষ্ট্য মেনে পাঁচটি পুষ্প অন্নে প্রোথিত। যথাক্রমে জবা, কলকে ফুল, অপরাজিতা, তুলসীমঞ্জরী এবং বেলফুল। এরূপ আয়োজন রূপেন্দ্র ইতিপূর্বেও দেখেছেন, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে। সেখানে ফুলের ব্যবস্থা ছিল না। সেটি ছিল ‘অপলান্ন’, এটি পুষ্পান্ন। বললেন, রন্ধনশিল্পের শেষ যবনিকাপাত পরিবেশন-পারিপাট্যে। বাঃ! সুন্দর! কিন্তু শিল্পীটি কে?

ঘোষাল তৃপ্তির হাসি হেসে বলেন, নকড়ির গর্ভধারিণী! তবে বধুমাতা তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন।

ঘোষালগৃহিণী একটু নড়েচড়ে বসলেন। তাতেই তাঁকে শনাক্ত করা গেল। আকণ্ঠ অবগুণ্ঠনবতী। তবু ঘোমটার ভিতর দিয়েই দেখা গেল তাঁর নাকে টানা-নথ। রূপেন্দ্র বলেন, বধূমাতা অর্থে নকড়িনী নিশ্চয়? কই তিনি?

রূপেন্দ্রের সম্মুখেই বসেছিল খাসা-মসলিন পরিহিতা এক অবগুণ্ঠনবতী। তার বাম হস্তে রতনচূড়। দক্ষিণ হস্তে তালপাখা। পিছনেই বসেছিলেন এক বৃদ্ধা বিধবা। তাঁর অবগুণ্ঠন শিরঃসীমায়। তরুণীর পৃষ্ঠদেশে একটি স্নেহস্পর্শ হাত রেখে বললেন, এইটিই আমাদের নাতবউ। ভা-রী লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে।

রূপেন্দ্র বলেন, অন্নগ্রহণের পূর্বে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে, বৌমা। তোমাকেই জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু অত বড়ো অবগুণ্ঠন থাকলে তো পারব না।

দিদা ওর পিঠের দিকে খাসা-মসলিনে একটু টান দিয়ে বলেন, বাবাঠাকুরের কাছে আবার অত লজ্জা কীসের লা?

অবগুণ্ঠন এবার ললাটস্পর্শী হল।

রূপেন্দ্র দেখলেন। লক্ষ্মীপ্রতিমাই বটে। নাকে নোলক, কপালে টায়রা। চোখে কাজল; কিন্তু নিমীলিত নেত্র।

ঘোষাল জানতে চান, আপনার প্রশ্নটি কী বিষয়ে? এই ‘পঞ্চরং পুষ্পান্ন’ কীভাবে সম্ভবপর হল? এই বর্ণবৈচিত্র্যের গূঢ় বিদ্যার বিষয়ে প্রশ্ন তো?

রূপেন্দ্র বলেন, আজ্ঞে না, ঘোষালমশাই। সে রন্ধনচাতুর্য সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। এমনটা তো হতেই পারে। বল বউমা? জবাফুলের অংশে পুষ্পান্ন লজ্জায় রাঙা হয়েছে কোচিনীলের করস্পর্শে। কলকে-ফুলের হরিদ্রাভা জাফরানের সঙ্গে মিতালী করায়। অপরাজিতার বর্ণসঙ্গী নীলাম্বর ধারণ করেছে সুপুরিচূর্ণ মিশ্রিত কালোজাম-রসের গাঙে অবগাহনান্তে। আর সবুজ তো হলুদ-নীল রঙে হোরি খেলায় মেতে! কী বৌমা? ভুল বলেছি কিছু?

গৃহস্বামী স্তম্ভিত। উনি ‘কবিরাজ’ না ‘রাজকবি’? নাকি ‘রন্ধনচঞ্চু ‘? ঢোক গিলে বধূমাতার দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, কী বউমা? তাই? উনি যা যা বললেন?

পঞ্চদশীর কজ্জ্বললাঞ্ছিত নিমীলিত হরিণ নয়ন দুটি ততক্ষণে বিস্ফারিত। রন্ধনবিদ্যার এই গুপ্তরহস্য ওই অং-বং-চং উনঃস্বর-বিসর্গের মানুষটি কোথায় পেলেন? শ্বশুরমশাই দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করায় সে সম্মতিসূচক গ্রীবাভঙ্গি করল। দুলে উঠল ঢেঁড়ি-ঝুমকো ওর কানে। আর দুলতে থাকে নাসিকাগ্রে মুক্তার নোলকটি।

ঘোষাল বলেন, এ তো বড়ো আজব কথা শোনালেন।

রূপেন্দ্র সহাস্যে বলেন, তাহলে আপনি আমার সঙ্গে যেতে রাজি?

—’যেতে রাজি!’ কোথায়? কেন?

—ওই বাংলা গ্রাম্য ছড়াটা শোনেননি; ‘জাদু, এ তো বড় রঙ্গ, জাদু এ তো বড় রঙ্গ/পাঁচ রং দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ!’

—না, না, রঙ্গ-রসিকতা নয়, এ তথ্য অত নিখুঁতভাবে জানলেন কেমন করে?

—ও আপনি বুঝি জানেন না? এ আমার একটি দৈবলব্ধ বিভূতি। কেউ আমার চোখে-চোখে তাকালেই আমি তার মনের সব কথা জানতে পারি। বউমা যেই আমার চোখের দিকে তাকালেন…

বধুমাতা শিউরে উঠলেন। তৎক্ষণাৎ নতনয়ন। পিছন থেকে দিদা ওর ঘোমটা আবক্ষ নামিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠেন, ওমা! এ কী সব্বোনেশে কতা গো?

বউমার বুক তখন ধড়াস ধড়াস করছে! ওই আজবমানুষটি তার অন্তরের কোন কোন গোপনবার্তা জেনে ফেলেছেন ইতিমধ্যে?

রূপেন্দ্রনাথ অট্টহাস্য করে ওঠেন, না, না, বউমা! এ শুধু কৌতুক। আমি অন্তর্যামী নই। ঘটনাচক্রে আমি এ গুহ্য রন্ধনবিদ্যার কথাটা জেনেছি মাত্ৰ!

কোন কথাটা সত্যি আর কোনটা কৌতুক, তা ওঁরা বুঝে উঠতে পারেন না। রূপেন্দ্র বললেন, সে যাহোক। আমার প্রশ্নটি মুলতুবি আছে। ভোজ্যতালিকার এই পঞ্চপুষ্পের অন্তিম গতি কী হবে? এগুলি ভক্ষ্য?

মেয়েটি জবাব দিল না। তখনও তার বুক ধড়াস ধড়াস করছে! কক্ষমধ্যে সকলেই নতনয়ন। কেউ আর ভরসা করে ওঁর চোখে-চোখে তাকাতে পারছেন না। ঘোষাল বলেন, ও! এই কথা? আজ্ঞে না। ওই পঞ্চপুষ্প পঞ্চদেবতার প্রাপ্য ‘নাগ-কূর্ম-কৃকরায়-দেবদত্ত আর ধনঞ্জয়।

রূপেন্দ্র সহাস্যে বলেন, পঞ্চদেবতা রক্ষা করেছেন। এই কোমলদেহ কুসুমগুলিকে রাক্ষসের মতো চর্বণ করতে হবে না। আসুন, এবার তাহলে শুরু করা যাক।

১৬

অপরাহ্ণে ভেষগাচার্যকে নিয়ে ঘোষালমশাই জমিদারের ভদ্রাসনে এলেন। অভ্যর্থনার ত্রুটি হল না। কিছু কুশল বিনিময়ের পর রূপেন্দ্রনাথ বলেন, এবার আপনি ভিতরে খবর দিন। আমি বধূমাতাকে পরীক্ষা করব। আর আপনার পুত্রটিকে একটু ডেকে দেবেন। তাকে দু-একটি প্রশ্ন করব জনান্তিকে।

ওঁরা দুজন পদব্রজে এসেছেন। সৈনগুপ্ত ঘোষালের ভদ্রাসনেই অপেক্ষা করছে। মিত্রমশাই ভেষগাচার্যের জন্য পালকি পাঠাতে চেয়েছিলেন। তিনি স্বীকৃত হননি। এ কথাও বলেননি যে, জীবনে তিনি মনুষ্যবাহিত পালকিতে কখনও ওঠেননি। বরং বলেছিলেন, অপরাহ্ণে কিছু পদচারণা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।

ঘোষালমশাইকে ‘তাই অপেক্ষা করতে হল। তাছাড়াও কারণ ছিল। রূপেন্দ্রনাথ এখনও বৈদ্যবিদায় গ্রহণ করেননি।

একটু পরেই এসে গেল জমিদারের পুত্রটি। প্রফুল্লকান্তি রূপেন্দ্রের সমবয়সিই হবে। সে কিন্তু সেকালীন শিষ্টাচারে দুই ব্রাহ্মণের পদধূলি গ্রহণ করে জোড়হস্তে দাঁড়িয়ে থাকে। পাঁচকড়ি বলেন, আপনারা কথাবার্তা বলুন, আমি উদ্যানে কিছু পদচারণা করে নিই। মধ্যাহ্নে কিছু গুরুপাক আহার হয়েছে।

ঘোষাল নিষ্ক্রান্ত হলে রূপেন্দ্রনাথ প্রফুল্লকান্তিকে বসতে বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবার কাছে শুনলাম তোমার স্ত্রীর একটি সন্তান ইতিপূর্বে নষ্ট হয়েছে। সেটা কতদিন পূর্বে।

—আজ্ঞে দু-আড়াই বৎসর।

—তোমার স্ত্রীর নাম কী? বয়স কত?

—ওর নাম ব্রজরানি। বয়স দ্বাবিংশতিবর্ষ।

—ঠিক কত তারিখে এবার ওর মাসিক চক্রাবর্তন বন্ধ হয়েছে?

প্রফুল্লকাত্তি চুপ করে রইল।

—এ সংবাদটি জরুরি। তুমি বধূমাতাকে জনান্তিকে জিজ্ঞাসা করে আমাকে জানিয়ে দিও।

একটু পরেই গৃহাভ্যন্তর থেকে আহ্বান এল। এবার একটি বয়স্কা দাসী এসে বলল, আপনি ভিতরে আসুন বাবাঠাকুর।

ওকে অনুসরণ করে তিনি প্রফুল্লের শয়নকক্ষে উপস্থিত হলেন। দ্বারের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন গৃহস্বামিনী। লালপাড় শান্তিপুরী শাড়ি। গায়ে জ্যাকেট, যা সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা ইদানীং পরেন। কপালে গিনি-মাপের অথবা গিন্নি-মাপের সিঁদুরের টিপ। প্রৌঢ়াও অনায়াসে প্রণাম করলেন যুবক ভেষগাচার্যকে। বললেন, আসুন বাবা। বৌমা এঘরে।

রূপেন্দ্র প্রবেশ করলেন শয়নকক্ষে। শয্যাপ্রান্তে বসেছিল ব্রজরানি। যথারীতি প্রণাম করল ওঁকে। শাশুড়িকেও।

রূপেন্দ্র বললেন, বস মা। আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব। কিছু পরীক্ষাও করব। তারপর জমিদার-গৃহিণীর দিকে ফিরে বললেন, আপনিও থাকবেন মা। দরজাটা বরং বন্ধ করে দিন ভিতর থেকে।

অনেক কিছু প্রশ্ন করে এবং যথাবিহিত পরীক্ষা করে গিন্নিমাকে বললেন, বৌমা ভালোই আছেন। চিন্তার কিছু নেই। এবার আমি বাইরের ঘরে যাব।

বৈঠকখানায় মিত্রমশাইকেও সব কিছু জানালেন। প্রসূতি ও ভ্রূণ স্বাভাবিক অবস্থাতেই আছে। ইতিমধ্যে প্রফুল্লকান্তি ওঁকে জনান্তিকে জানিয়ে গেছে প্রসূতির মাসিক চক্রাবর্তন ছন্দ ঠিক কোন তিথিতে বন্ধ হয়েছে। ফলে উনি গণনা করে জমিদার মশাইকে বললেন, আন্দাজ করছি আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রসব হবে। আপনি যদি আমাদের আরোগ্য-নিকেতনে সে ব্যবস্থা করতে বলেন, তাহলে আশ্বিনের দশ-বারো তারিখের ভিতর পাল্কিতে করে বৌমাকে সেখানে পাঠিয়ে দেবেন। তাঁকে আমি নিজ তত্ত্বাবধানে দিন দশ-পনেরো রাখতে চাই। ওঁর খাদ্যতালিকার একটি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন উনি যেন প্রত্যুষে এবং সন্ধ্যায় উদ্যানমধ্যে কিছুটা পদচারণা করেন। শারীরিক কোনও অসুবিধা হলে আমাকে তৎক্ষণাৎ সংবাদ দেবেন। প্রফুল্ল অশ্বারোহণে অভ্যস্ত নিশ্চয়। সে যেন স্বয়ং যায়, যাতে আমি তাকে প্রশ্ন করে রোগিণী সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পারি।

মিত্রমশাই সম্মত হলেন। ইতিমধ্যে ঘোষালমশাইও উদ্যান থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। মিত্রমশাই বলেন, আশ্বিন মাসের হিসাব আশ্বিনেই হবে। এবার বিজয়া দশমী পড়েছে আশ্বিনের ছয় তারিখে। কোজাগরী এগারো তারিখে। আমি বারোই আশ্বিন বধূমাতাকে প্রেরণের ব্যবস্থা করব। কিন্তু সেসব বিস্তারিত কথাবার্তা পরে হবে। আপাতত আজ আপনাকে কী বৈদ্যবিদায় দেব বলুন?

ঘোষালমশাই সঙ্গে সঙ্গে বলেন, আমার তরফেও সেই একই প্রশ্ন।

রূপেন্দ্র তৎক্ষণাৎ বললেন, এ বিষয়ে আপনাদের দুজনের কাছেই আমার একটি প্রস্তাব আছে। কিন্তু তার পূর্বে কিছু ভূমিকার প্রয়োজন। শুনুন : রূপেন্দ্রনাথ ওঁদের বিস্তারিত জানালেন যে, তিজলহাটিতে তিনি বহুবার এসেছেন। লক্ষ্য করে দেখেছেন যে, এখানকার রোগীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্ত্রিক রোগে আক্রান্ত হয়। তার একমাত্র হেতু—একমাত্র না হলেও মূল হেতু—তিজলহাটি গ্রামে পানীয় জল বিশুদ্ধ নয়। কীভাবে তিনি সোঞাই গ্রামের এই ব্যাধি প্রায় নির্মূল করেছেন তাও বুঝিয়ে বললেন। এ গ্রামেও ওই রকম একটি পানীয় জলের সংরক্ষিত পুষ্করিণী তৈরি করতে হবে। হয় শ্যামসায়র অথবা রাধাসায়র।

দুজনে স্বীকার করলেন যে, সোঞাই গ্রাম থেকে যে আন্ত্রিক রোগ প্রায় দূরীভূত হয়েছে এ তথ্যটি তাঁরা সবিশেষ জানেন। কিন্তু যেহেতু এ দুটি প্রতিষ্ঠিত পুষ্করিণী তাই অবগাহন-স্নানের জন্য নিষিদ্ধ করা সম্ভবপর নয়। কারণ ওঁদের দুজনের স্বর্গত পিতা প্রতিষ্ঠার সময় অঙ্গীকার করেছিলেন—”যাবৎচন্দ্রার্কমেদিনী’ এ পুষ্করিণীতে বর্ণহিন্দু অবগাহনের অধিকার সুরক্ষিত। এখন সে পিতৃ-প্রতিজ্ঞার ব্যত্যয় করা ওঁদের পক্ষে সম্ভবপর নয়।

রূপেন্দ্র বললেন, সেক্ষেত্রে আপনারা দুজনে একটি নূতন পুষ্করিণী খননের আয়োজন করুন। এ সমস্যা সোঞাই গ্রামেও হয়েছিল—এভাবেই তার সমাধান করেছিলেন ভূম্যধিকারী ব্রজেন্দ্রনারায়ণ।

ঘোষাল জানতে চান, একটা কথা বুঝিয়ে বলুন তো, ভেষগাচার্য। সোঞাই গাঁয়ের সেই সংরক্ষিত পুষ্করিণী থেকে জল-অচল জাতের মানুষ তো পানীয় সংগ্রহ করতে পারে না। তাহলে ওখানে আন্ত্রিক রোগ…

—আজ্ঞে না। তারাও ওখান থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করে। মানে, যারা দামোদরের এ পারে আছে। তিনজন জলচল জাতের ‘পানিবাবা’ নিয়োগ করা হয়েছে। তারা পর্যায়ক্রমে সকাল থেকে সন্ধ্যা তৃষ্ণার্তকে জল তুলে দেয়। জল-অচল জাতের রমণীরা হাঁড়ি বা হাণ্ডা নিয়ে আসে। কপিকলের সাহায্যে শঙ্কু আকৃতির লৌহ-জলপাত্রে পানিবাবা জল তুলে হাঁড়িতে জল ঢেলে দেয়। স্পর্শবাঁচানো সেই ব্যবস্থায় দামোদরের এপারের সকলেই বিশুদ্ধ পানীয় জল সংগ্রহ করে। পানিবাবারা জমিদারদের কাছে বৃত্তি পায়।

—আর দামোদরের ওপারের বাসিন্দা?

—বায়েনপল্লি, চামারপল্লি থেকে নৌকা করে জল নিতে আসে অনেকে। তাদের আন্ত্রিক রোগ হয় না। তবে পীরপুর বা ফুল্লরা থেকে কেউ আসে না। অতদূর থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করা সম্ভবপর নয়।

ঘোষাল বললেন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব, কথা দিচ্ছি। কিন্তু সেজন্য আপনি ‘বদ্যিবিদায়’ কেন নেবেন না?

—আপনারা দান করছেন। আমিও করছি।

মিত্র বলেন, মনে হচ্ছে অনেক টাকার ধাক্কা। আমরা পঞ্চায়েতে প্রস্তাবটা তুলব। পঞ্চায়েত যদি স্বীকৃত হন তাহলে আমরা প্রতিটি গৃহস্থের কাছে গিয়ে চাঁদা তুলতে পারি। সেক্ষেত্রে ‘একের বোঝা দশের লাঠি’ হয়ে যাবে।

—খুবই সত্য কথা। এ ব্যবস্থা তিজলহাটি গ্রামের স্বার্থে। কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ এতে জড়িত নয়।

—কিন্তু পঞ্চায়েত-প্রধানেরা যদি অস্বীকৃত হন? ওঁরা যে এসব বিশ্বাসই করতে চান না।

—সে ক্ষেত্রে আপনারা পঞ্চায়েতকে জানিয়ে দেবেন যে, এ গ্রামে আমি কোনও রোগী দেখতে আসব না। ওঁরা যা বিশ্বাস করেন সেই মতোই চলবেন। গ্রামে ওলাওঠা শুরু হলে চাঁদা তুলে ওলাবিবির পূজা দেবেন! আচ্ছা, আজ আমি চলি—

মিত্রমশাই ভেষগাচার্যকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন না। আজই সদ্যপরিচয়। তিনি ফস করে বলে বসেন, পঞ্চায়েত স্বীকৃত না হলে আপনি আমার পুত্রবধূর ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলতে চান?

ধক করে জ্বলে উঠল রূপেন্দ্রনাথের চোখদুটি। তবু ইন্দ্রিয়সংযম তাঁর করায়ত্ত। পরক্ষণেই হেসে বললেন, আপনি তো এইমাত্র বললেন, আশ্বিনের হিসাব আশ্বিনেই হবে। এত তাড়াহুড়ার কী আছে? পঞ্চায়েতের কাছে প্রস্তাবটা তুলেই দেখুন না।

–ধরুন যদি পঞ্চায়েত রাজি না হন। তাহলে….

—না, মিত্রমশাই। ব্রজরানির দায়িত্ব আমি গ্রহণ করেছি। আমার কথার নড়চড় হবে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি আপনার সঙ্গে দাতব্য-চিকিৎসালয়ের ব্যবহার করব। আপনাকে অর্থদান করতে দেব না।

—দাতব্য? কিন্তু আপনার দান আমি গ্রহণ করব কেন?

—করবেন না। আমি তো বাধ্য করছি না। সাবেক দাইয়ের মাধ্যমেই দ্বিতীয়বার নাতির ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। তবে আমি যেটুকু করেছি, যা করব, তার জন্য ‘যথাবিহিত কাঞ্চনমূল্যে’ আমি বৈদ্যবিদায় গ্রহণে অস্বীকৃত।

রূপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন। ঘোষালও উঠে দাঁড়ালেন। ভেষগাচার্যের দুটি হাত ধরে বললেন, আমার কথাটা কিন্তু শেষ হয়নি ভেষগাচার্য! মিত্তিরমশাই অগাধ সম্পত্তির মালিক, তিনি ইচ্ছামতো তাঁর বংশরক্ষার্থে কাটোয়া, বর্ধমান বা মুর্শিদাবাদেও বধুমাতাকে নৌকাযোগে নিয়ে যেতে পারেন। সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে। আমরা জানি না, কী হবে। কিন্তু আমার প্রসঙ্গটা ভবিষ্যতের নয়, অতীত কালের। আপনি দুই-দুইবার আমার বংশরক্ষা করেছেন। কেউ কোনও সাহায্য না করলেও সমস্ত ব্যয়ভার আমি একাই বহন করব। আমি প্রয়োজনে নিজ ব্যয়ে একটি সংরক্ষিত পুষ্করিণী খনন করাব। শুধু আপনার একটি অনুমতি সাপেক্ষে।

—অনুমতি! কীসের অনুমতি?

–দিঘিটির আকার-বিষয়ে। সেটা বর্গক্ষেত্র বা আয়তক্ষেত্র করা হবে না।

মিত্তিরমশাইয়ের রাগটা পড়েছে। বলেন, তবে কী হবে? বৃত্তাকার না ডিম্বাকার?

—না, মিত্তিরমশাই। সেটা চতুর্ভুজই হবে। তবে তার কোনও কোণ সমকোণ হবে না।

মিত্র বলেন, এ আবার কোন জাতের ধাঁধা? এমন চতুষ্কোণ কি ভূভারতে কোথাও আছে? আমি তো শুনিনি।

ঘোষাল বলেন, এজন্য আপনাকে ভূ-ভারত ছুঁড়তে হবে না মিত্তিরমশাই। আপনি পালকি-বেহারাদের ডাকুন। আমি ঠিকানা বাতলে দিচ্ছি। মাত্র চার ক্রোশ দূরত্বে দেখতে পাবেন অমন এক আজব পুকুর। চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হবে।

তারপর রূপেন্দ্রনাথের দিকে ফিরে বলেন, আর সেই নিপাতনে সিদ্ধ সংরক্ষিত দীর্ঘিকার নামকরণ করব আমি : রূপসায়র।

রূপেন্দ্র তীব্র আপত্তি জানান : না, না, আমার নামটা কোনওভাবেই জড়ানো চলবে না।

—বেশ কথা! জড়াব না আপনার নাম। আমরা ওর নামকরণ করব : ‘একবগ্গা দিঘি’। আশাকরি এবারও আপনি দাবি করবেন না যে, ওটাও আপনার নাম। কী বলেন? ওই ‘একবগ্গা’।

রূপেন্দ্র হেসে ফেলেন।

১৭

তিজলহাটি থেকে অশ্বারোহণে যখন স্বগ্রামে উপস্থিত হলেন তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। একপ্রহর রাত। এতটা দেরি হবার কথা নয়। কিন্তু উনি প্রত্যাবর্তনের পথে দামোদরের তীরে এসে অশ্ব থেকে অবতরণ করেন। দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ বসেছিলেন দামোদর কিনারে i একটি বিশাল বটবৃক্ষের পাদমূলে।

এ সেই মহাপাদপ। নিতান্ত বাল্যকাল থেকে এ বৃক্ষ ওঁর স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। বিশালাকার, বয়োবৃদ্ধ। চতুর্দিকে প্রসারিতবাহু দশভুজ যেন মহাকালের খাজাঞ্চি। পঞ্চগ্রামের ইতিহাস ওর শাখায় শাখায় লিখিত। অযুত-নিযুত ঝুড়ি নামিয়ে সে স্বধর্মরক্ষায় প্রাণিত। যুগে যুগে কত বিচিত্র বিহঙ্গ ওর শাখায় ভালোবাসার নীড় বেঁধেছে বছর বছর বসন্তকালে। মানসযাত্রী যাযাবরেরাও ওই মহাপাদপের ঊর্ধ্ববাহু-শাখায় দু-দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে গেছে—মরাল, বেলে হাঁস, শামকুট, সারস, সিল্লি।

ওই জ্ঞানবৃক্ষ মহাপাদপ যেন এই সর্বংসহা হিন্দুধর্মের প্রতীক। শতহস্ত প্রসারিত করে ও সবাইকে ডাক দেয় : গ্রিক, শক, হুন, পল্‌হব, য়ুচী—আফগান-পাঠান-মোঘল—দিনেমার, পর্তুগিজ, ফরাসি। দিগন্তচুম্বী ব্রহ্মডাঙার একান্তে যেন কোন মুনিবর ধ্যানমগ্ন। দামোদর রাক্ষস যে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আত্মসমাহিত অত্রি-অঙ্গিরা বশিষ্ঠের ও সগোত্র। কয়েক বছর আগে ওকে দেখেছিলেন। তখন দামোদরের বর্ষার সর্বগ্রাসী ধারা সন্ন্যাসীর আশ্রম থেকে বেশ কয়েক রশি তফাতে। আজ দেখলেন ললিতজ্বিহা দামোদরকে আশ্রমের দ্বারপ্রান্তে। হয়তো আগামী শ্রাবণ-ভাদ্রেই সে হেঁকে উঠবে : হা-রে, রেরে! ধ্যানরত মহাযোগীব লুটিয়ে পড়বেন দামোদর গর্ভে! সেই মহামৃত্যুমুহূর্তে কি শেষবারের মতো হাহাকার করে উঠবেন মহাবট? কী সেই চরম হাহাকার-ধ্বনি? কী তাঁর অন্তিম বিদায়মন্ত্র? নাকি জীবনে কখনও যে মন্ত্রটা উচ্চারণ করেননি, করতে জানেনই না, যা বইছে না ওঁর ধমনিতে সেটাই পুকার দিয়ে উঠবেন, লায় লাহা ইল্‌লল্লাহ্!

তাই এতটা বিলম্ব। অশ্বারোহণে যখন সংকীর্ণ বনপথ দিয়ে, সাতপুরুষের ভিটার দিকে এগিয়ে আসছিলেন তখন পাখ-পাখালি নীরব। গাছ-গাছালির লতাগুল্ম ওঁকে বার বার ছুঁয়ে দেখছিল। রৌদ্রদগ্ধ বিশীর্ণ স্বর্ণলতা, খরতাপ পীড়িত হলুদ-ফুল-হারানো তিপল্লার শাখা। আর কী জানি—উনি হয়তো খেয়াল করেননি—জৈষ্ঠের তাপদগ্ধ কোনও মালতীলতাও!

তোমরা বলবে : এটা তুমি কী লিখলে দাদু? সেটা যে কৃষ্ণপক্ষ! সোঞাই গাঁয়ে তো স্ট্রিটলাইট নেই, গৃহস্থবাড়ি থেকেও আসবে না কোনও আলোর আভাস। তাহলে কীভাবে নীরন্ধ্র অন্ধকারে অশ্বারোহণে…

তোরা ভুল করছিস, দিদিভাই! আমরা তো আছি আড়াইশো বছর আগেকার এক রাতে। গৌড়মণ্ডলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সে পরিমণ্ডলটা যে তোদের ধারণার বাইরে। আমি তা আমার এই ছানিপড়া চোখে দেখতে পাই—ঘুম-না-আসা রাতে। আবছা, অস্পষ্ট। তবু, দেখতে পাই। বিজলি বাতি নাই বা থাকল পথে, গৃহস্থবাড়ির তির্যক আলোকরশ্মি নাই বা পড়ল রাস্তায়। তবু ওরা তো আছে। ওই মুঠো মুঠো জোনাকির টুনি-বা্ল্‌ব্‌—যা তোরা আজ দেখতে পাস না, শহরে কিংবা গ্রামে। আছে এক-আকাশ কৌতূহলী তারাসুন্দরী। তাও তোরা দেখিসনি—দেখতে পাস না, লোডশেডিং হলেও নয়। কী করে দেখবি? আকাশটাকে তো ধুলোয়, ধোঁয়ায় আর কার্বন ডাইঅক্সাইডে লেপে-পুঁছে একশা করে দিয়েছি আমরা।

সেকালে, এই কালবৈশাখী-ধোওয়া জ্যৈষ্ঠের আকাশ ছিল নিরঞ্জন, নির্মল, নীল। প্রতি রাতের প্রতিটি মুহূর্তে চন্দ্রপুরীর প্রাসাদ থেকে প্রদীপহস্তা ত্রয়োদশ রাজমহিষী পথচারীদের পথ দেখাতেন; অশ্বিনী-ভরণী-কৃত্তিকা-রোহিণী মায়েরা। তোরা তাঁদের চিনিসই না। সপ্তর্ষির আশ্রমে জ্বলত সাতটি ঘৃতপ্রদীপ। চিত্রা-স্বাতী-জ্যেষ্ঠা মায়ের দল পথচারীকে ডেকে বলতেন; ভয় কি রে? ব্রহ্মহৃদয় স্বস্তিবচন শোনাতেন। আর দণ্ডধারী কালপুরুষ পাহারা দিতে হাঁকাড় পাড়তেন : হুঁশিয়ার!

তাছাড়া অশ্বচালনার রীতিনীতিও তো তোরা জানিস না। হয়তো ঘোড়ার গাড়িই চড়িসনি জীবনভর। তোদের দৌড় তো ট্রাম-বাস আর মেট্রোরেল! কিছু সৌভাগ্যবতী—ওই যাদের কর্তারা কম্পুটার শিখে আজ বিশ-পঞ্চাশ হাজারি মনসবদার–তারা হয়তো চেনে মারুতি অথবা টাটাসুমো। পাল্কির দুল্কি চাল তো শুনেছিস শুধু হেমন্তর গানে। গো-গাড়ির অস্থিবিদারক উথাল-পাতাল চিনিস? তাই জানিস না-গৃহাভিমুখী অশ্বারোহীকে লাগাম ধরতেই হয় না। নীরন্ধ্র অন্ধকার ভেদ করে সে আরোহীকে তার ভিটেয় পৌঁছে দেয়। যেখানে তার আস্তাবল।

১৮

অর্গলবদ্ধ সদরদ্বারে করস্পর্শমাত্র ভিতর থেকে সশঙ্ক প্রশ্ন হল : কে?

রূপেন্দ্রনাথ আত্মপরিচয় দেওয়া মাত্র দ্বার গেল খুলে। ভিতরে প্রবেশ করে দ্বারটি অর্গলবদ্ধ করতে করতে প্রশ্ন করেন, শিবনাথ আসেনি এখনও?

—না।

—মামণি কোথায়?—ঘুমিয়ে পরেছে।

—এত সন্ধ্যারাত্রে? খেয়েছে?

এ প্রশ্নের জবাবে মালতী যা বলল তাকে বলা যায় অবান্তর, অসংলগ্ন কথা। বললে, আপনি কি আর একটু ঘুরে আসবেন, ঠাকুরপো?

—ঘুরে আসব? কেন? কোথা থেকে?

—বনজঙ্গল অথবা দামোদরের ধার থেকে?

–কেন? এখন আবার ঘুরতে যাব কেন?

—না, মানে আর এক প্রহরের মধ্যেই শিবুভাই এসে যেত।

রূপেন্দ্র প্রত্যুত্তর করলেন না। এগিয়ে গেলেন দাওয়ার দিকে। ঘটিতে জল ভরাই ছিল। হস্তপদ প্রক্ষালন করে অঙ্গরাখায় মুছলেন। দেহ ক্লান্ত, মনও। দাওয়ায় মাদুর পাতা ছিলই। বসলেন তাতে। উপাধানটা টেনে নিলেন—না আজ আর তার পাশে কোন রেকাবি-টেকাবি নেই। তালপাখা ছিল। সেটাই তাড়াতাড়ি জবরদখল করলেন—যেন বে-হাত না হয়ে যায়।

—আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বউঠান? বসুন।

দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠায়। এবার বসল। মাদুরেই। তবে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে।

—মামণি সন্ধ্যারাতেই ঘুমিয়ে পড়ল যে? জ্বর-টর হয়নি তো?

—না।

—খেয়েছে?

—না।

—কেন? অভিমান?

—হ্যাঁ।

—কার ওপর? আপনার?

—না!

মালতী আজ ‘হাঁ-না’-র বাহিরে পা দেবে না। অস্তি আর নাস্তি। স্বস্তি নাই। কর্মক্লান্ত গৃহস্বামী সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এলে গৃহটি কলমুখরিত হয়ে ওঠে সেটাই স্বাভাবিক। এ ভদ্রাসনে তা হল না। রাতচরা প্যাঁচাটা পর্যন্ত আজ ডাকতে ভুলে গেছে। ঝিঁঝি পোকাগুলোর বোধহয় স্বরভঙ্গ হয়েছে। অস্বস্তিকর নীরবতা।

মালতীই স্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠল, আপনি ওকে ডেকে তুলুন। একবাটি দুধ অন্তত খাইয়ে দিন। আমার কথা ও শুনছে না। কেঁদে কেঁদে শেষে ঘুমিয়েই পড়ল।

—কান্না কীসের? অভিমান তাহলে আমার উপর?

—ও বলছিল ‘বাবা আমাকে একটুও ভালোবাসেননা। বাড়িতে থাকতেই চাননা, আজকাল! কোথায় কোথায় টো-টো করে ঘোরেন।’

রূপেন্দ্রনাথ প্রসঙ্গটা বদল করেন, শুভপ্রসন্ন আসেনি খেলতে?

—না!

—দুজনের ঝগড়া হয়েছে?

—জানি না।

আবার সেই অস্বস্তিকর নীরবতা। দীর্ঘসময়! এবারেও নীরবতা ভঙ্গ করল মালতী, আমি এখন কী করি, ঠাকুরপো?

—কালই তো বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আপনার সামনে এখন তিনটি বিকল্প পথ। আপনিই নির্বাচন করবেন। আমি তা শুধু কার্যকরী করতে পারি।

মালতী বলল না যে গতকাল আলোচনাটা শেষ হয়নি। কেন রূপেন্দ্রনাথ ওকে মন্ত্রদীক্ষা দিতে অস্বীকৃত সে কথা অকথিতই আছে।

আবার অনেকটা নৈঃশব্দ্য পাড়ি দিয়ে এবার রূপেন্দ্রনাথই বলে ওঠেন, কাল আপনাকে তিনটি বিকল্প পথের কথা বলেছিলাম। পরে চতুর্থ একটি সমাধানের কথা আমার মনে হয়েছে—

উনি থামলেন। মালতীর চোখদুটি প্রত্যাশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু সে কিছু প্রশ্ন করল না। ডাগর দুটি চোখ মেলে আরও শোনার জন্য প্রতীক্ষায় থাকল। রূপেন্দ্র বলেন, যদি আমরা দুজন ধর্মত্যাগ করি।

বক্তব্যটা মালতী প্রণিধান করতে পারল কিনা বোঝা গেল না।

রূপেন্দ্র অহেতুক তাঁর উপবীতটা আস্থূলে জড়াতে জড়াতে নতনেত্রে বলে চলেন, হিন্দুধর্মে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ। ভূভারতে তা কোথাও হয়নি, কখনও হয়নি। ব্যতিক্রম হিসাবে দ্রৌপদীর ছিল পঞ্চস্বামী; কিন্তু স্বামীর দেহান্তে পুনর্বিবাহের উল্লেখ পুরাণে বা মহাকাব্যে নাই।

নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় এমনভাবে বললেন যেন, একটা তত্ত্বকথা বুঝিয়ে দিচ্ছেন ছাত্রীকে। মালতী উৎকর্ণ, কিন্তু স্তব্ধ, অসার। আবার শুরু করেন রূপেন্দ্র, কিন্তু ইসলামধর্মে এর প্রচলন আছে।

উদ্গত অশ্রুকে গলাধঃকরণ করে মালতী কোনওক্রমে বললে, ও-কতা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করলে আমি কিন্তু গলায় দড়ি দেব, ঠাকুরপো!

—আপনি ভাববেন না বউঠান যে, ‘ধর্মত্যাগ’ মানে আমার আদর্শকে ত্যাগ করছি। ক্ষেত্রটা বদল হচ্ছে শুধু। যেমন ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যায়তন’কে আমি ত্রিবেণীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। মুসলমানদের মধ্যেও অনেক কিছু করার আছে। ‘সতীদাহ’ নেই, কিন্তু ‘তালাকপ্রথা’ আছে। চার-চারজন বিবি রাখার ধর্মীয় অনুশাসন আছে। স্ত্রীশিক্ষায় তারা আরও পশ্চাদপদ। বোরখা প্রথা—

—থামুন আপনি।

রূপেন্দ্র স্তব্ধ হলেন। এতক্ষণে একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠল। ব্যঙ্গ করল কাকে? রূপেন্দ্রের ওই উদ্ভট প্রস্তাবেই কি সে অট্টহাস্য করে উঠল?

আবার ঘনিয়ে এল নৈঃশব্দ্য। অনেকক্ষণ পরে মালতী আবার কথা বলে। আমি সব দিক ভেবে সিদ্ধান্তে এসেছি, ঠাকুরপো—আত্মহত্যা ছাড়া আমার আর কোনও পথ নেই।

—আপনার শরীরে কিন্তু এখন আপনি একা নন, বউঠান!

—জানি। কিন্তু মায়ের পাপে সন্তানকেও মরতে হয়। একথা কি শোনেননি কখনও?

অর্ধশায়িত রূপেন্দ্রনাথ এবার সোজা হয়ে উঠে বসলেন। অভ্যস্ত ‘সমংকায়শিরোগ্রীব’। বললেন, অনেক পণ্ডিত বিধান দেন: ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’। আমি সে কথা মানি না। মানুষমাত্রেরই অধিকার আছে আত্মহননের। আমার জীবন—আমি রাখব কি রাখব না, এটা শুধু আমার বিবেচ্য। আমার বিবেকের নির্দেশ।

—আপনি তাহলে অনুমোদন করছেন?

—না। করছি না। দৃঢ়ভাবেই করছি না। কারণ আপনার গর্ভে সার্বভৌমদাদার আশীর্বাদ আছে। আপনি তাঁর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনি তাকে হত্যা করতে পারেন না। তাকে এই রূপরসগন্ধস্পর্শময় জগতে ভূমিষ্ঠ করার দায়িত্ব আপনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছেন। সে দায়িত্ব পালন করার পর, সন্তানকে কোনও বিকল্প মাতার হস্তে সমর্পণের পর, নিশ্চয় আপনার অধিকার বর্তাবে আত্মহননের

—কিন্তু সে তো অনেকদিনের কথা, ঠাকুরপো। আত্মহত্যা যদি পাপ না হয়—

—আমার বক্তব্যটা শেষ হয়নি বউঠান! রাজপুতরমণীরা যৌথভাবে জহরব্রত পালন করতেন। তাঁদের নারীত্বের মর্যাদা রাখতে। টুলো পণ্ডিতদের সঙ্গে ‘দোহার’ দিয়ে আমি বলতে পারব না—তাঁরা মহাপাপী! আমার স্ত্রী মঞ্জু, কুমারী অবস্থায় আমার কাছে বিষ চেয়েছিল। আমি স্বহস্তে তাঁর অঞ্চলপ্রান্তে কালকূট বিষ বেঁধে দিয়েছিলাম। মীনুকে আমি শ্রদ্ধা করি। সে তার নারীত্বের মর্যাদা রাখতে আত্মহনন করেছিল। কিন্তু আপনি? আপনি কেন নিজের মনকে বশে রাখতে পারবেন না? আপনি কেন ও পথে পা বাড়াবেন?

—আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না, ঠাকুরপো!

—আরও খোলাখুলি বলি, বউঠান! আপনি আজ দু-মাস মাত্র আছেন এখানে। আমার সন্তানের বিকল্প জননীস্বরূপা। আমাকে আপনি নানাভাবে সেবাযত্ন করেছেন। আপনার সঙ্গে আমার একটা স্নেহ-শ্রদ্ধা-সৌহার্দ্যের নিবিড় সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি—কেন আমি আপনাকে মন্ত্রদীক্ষা দিতে অস্বীকৃত। আপনার-আমার সম্পর্কটা আজ আর গুরু-শিষ্যের নয়! তার চেয়ে মধুরতর কিছু একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শুধু আপনার নয়, আমার অন্তরেও। আমিও আপনাকে একই রকম ভালোবেসে ফেলেছি—

—ঠাকুরপো!

—কথাটা আমার শেষ হয়নি, বউঠান! আমার শেষ কথাটাও শুনুন। গুরুদেবের মতের বিরুদ্ধে, বস্তুত তাঁর বিরক্তি উৎপাদন করে, যেদিন আপনার হাত ধরে সোঞাই গ্রামে ফিরে এসেছিলাম, সেদিন শুধু আপনাকেই নয়, আরও একজনকে আমি কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সে তা জানে না—এই যা। সে আমার বন্ধুর ভবিষ্যৎ সন্তান সে আমার আশ্রিত। সে আমার অজাত অতিথি। আপনি যদি নিজের অসংযমে আমার সেই সন্তানতুল্য অতিথিকে হত্যা করেন, তাহলে সেই সঙ্গে আপনি আরও কিছু হত্যা করবেন। আমার এই দুই মাসের সুখস্মৃতিকেও! সেই অজাত অতিথিকে রক্ষা করার শক্তি আমার নাই, হত্যা করার ক্ষমতা আপনার আছে। সে ক্ষেত্রে আমি বাকি সারাটা জীবন মনে করব—মালতী নামে আমার কোনও ভালোবাসার ধন এ বাড়িতে কোনওদিন আসেনি। সে আমাকে ভালোবাসতে পারেনি—আমিও তাকে ভালোবাসতে পারিনি। সে এক ভ্রূণঘাতিনী মাত্ৰ!

এক আর্ত হাহাকারে লুটিয়ে পড়ল মালতী মাদুরের উপর। সৌভাগ্যটা কার জানি না—ঠিক তখনই ভেসে এল বহির্দ্বার থেকে একটা মুক্তির আহ্বান। মালতীকে সান্ত্বনা দিতে, নাকি রূপেন্দ্রনাথকে বিড়ম্বনা থেকে নিষ্কৃতি দিতে?

—বাবাঠাকুর!

১৯

কাহিনি যখন এমন ঘূর্ণিপাকে পড়ে, যখন কথাসাহিত্যিক আর হালে পানি পান না—মনে করেন, কাহিনির জটিলতা সমাধানের অতীত, তখন বাধ্য হয়ে তিনি একটা মৃত্যুদৃশ্যের অবতারণা করেন। এটাই প্রথা। ল্যাঠা চুকিয়ে দেবার!

আমাদের ক্ষেত্রে—কাহিনিকার তো ছাড়—তাঁর সৃষ্ট-চরিত্র মহাপণ্ডিত পর্যন্ত খুঁজে-খুঁজে মাত্র চারটি সমাধানসূত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন, তার মধ্যে কোনও একটাও গ্রহণযোগ্য নয়। সৌভাগ্য কাহিনিকারের, তাঁকে একটা মৃত্যুদৃশ্যের অবতারণা করতে হল না। কারণ কাহিনির চৌহদ্দির বাহিরে অবস্থিত এক নেপথ্য নাট্যকার—যিনি কোন নাট্যসমালোচকের তোয়াক্কা করেন না—তিনিই হঠাৎ সে হাল ধরলেন। একটা সহজ সমাধান উপহার দিলেন। যাতে ‘সর্পের মৃত্যু অথবা যষ্টির বিনাশ’ কোনওটারই প্রয়োজন হল না। ঘটনাটা ঘটল এভাবে :

জ্যৈষ্ঠের গরম। রোদ তেতে ওঠার পূর্বেই তারাপ্রসন্ন সপুত্র গিয়েছিলেন দামোদরে—অবগাহন স্নানে। সঙ্গে আমাদের কাহিনির নায়িকা—রূপেন্দ্রনাথের ‘রুপো-মন্-চুরি’।

ওরা দুজনে অনেকক্ষণ ঝাঁপাই জুরেছে। দুজনেই ইতিমধ্যে সাঁতার শিখেছে। নদীমাতৃক দেশের শিশুরা যেমন শেখে। অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে অনেক ধমক ও ‘পুনধর্মক’ শুনে পাড়ে উঠে এসেছে। তারাপ্রসন্নের বস্ত্র-পরিবর্তন পর্ব সমাপ্ত; কিন্তু তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে হল। কারণ শুভপ্রসন্ন আর রূপমঞ্জরী এবার পাণ্ডাজীর ছত্রছায়ায় এসে কপালে কৃষণজির শ্বেতচন্দনের চরণ ছাপ নেবে। হঠাৎ তারাপ্রসন্নের নজর হল ঘাট থেকে একজন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণপণ্ডিত উঠে আসছেন। ভিন গাঁয়ের মানুষ। ঊর্ধ্বাঙ্গে উড়ুনি। মাথায় জটাভার। আবক্ষ শ্মশ্রু। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তারাপ্রসন্নের সঙ্গে চোখাচুখি হতেই নমস্কার করে বললেন, আমি ত্রিবেণী-ঘাট থেকে আসছি। আমার নাম, শ্রী শীলভদ্র বাচস্পতি। আমার গুরুদেব মহামহোপাধ্যায় শ্রীল শ্রীযুক্ত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।

তারাপ্রসন্নও যুক্তকরে তাঁকে নমস্কার করে বলেন, কী সৌভাগ্য আমার এবং সোঞাই গ্রামের। আপনি স্বাগত। আমার নাম শ্রীতারাপ্রসন্ন ভাদুড়ী, পিতা শ্রীব্রজেন্দ্রনারায়ণ ভাদুড়ী। এই গ্রামেই আমার বাস!

—বিলক্ষণ! শুধু বাস কেন? আপনি এ অঞ্চলের ভূম্যধিকারী। রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোঘটির কাছে আপনার সবিশেষ পরিচয় পেয়েছি। রূপেন্দ্রনাথ আমার অপেক্ষা অনেক বয়ঃকনিষ্ঠ; কিন্তু আমরা গুরুভাই।

—জানি। আপনি কি রূপেন্দ্রনাথের সন্ধানে এসেছেন? চলুন, আমি আপনাকে নিয়ে যাব। কিন্তু আপনি এলেন কীসে?

—ওই নৌকায়। ওটি গুরুদেবের নিজস্ব নৌযান।

—তাহলে অনুগ্রহ করে মাঝি-মাল্লাদের নির্দেশ দিয়ে যান, ওরা যেন নৌকায় রন্ধনের আয়োজন না করে। আমাদের মন্দিরে যেন দ্বিপ্রহরে মায়ের ভোগ-প্ৰসাদ পেতে আসে। ওরা সোঞাই গ্রামের অতিথি—বিশেষ পঞ্চানন ঠাকুরের সেবক।

শুভপ্রসন্ন এবং রূপমঞ্জরী এসে ব্রাহ্মণের পদধূলি গ্রহণ করল।

ওঁরা সদলবলে এসে যখন রূপেন্দ্রনাথের ভদ্রাসনে উপস্থিত হলেন তার পূর্বেই তিনি রোগি দেখতে বেরিয়ে গেছেন। তবে দ্বিপ্রহরে বাড়িতেই এসে আহার করবেন। মালতী আগন্তুকের পা ধুইয়ে দিল। আসন পেতে বসতে দিল। বলাবাহুল্য, প্রণামও করল। ত্রিবেণীর পরিচিত নানানজনের কুশল সংবাদও গ্রহণ করে। বাচস্পতি বললেন, প্রাতঃকালীন আহ্নিকটা তাঁর বাকি আছে। সেটি সমাপ্ত না হলে তিনি জলস্পর্শ করেন না। মালতী ব্যবস্থা করে দিল। সাবেক ঠাকুরঘরে। যেখানে এককালে রূপেন্দ্রর পিতৃদেব পূজা করতেন, জগুঠাকরুণ বা গিরিপিসিমাও করে গেছেন। এখন মালতী ঠাকুরকে ভোগ-রাগ দেয়। রূপেন্দ্র সে কক্ষে নিত্যপূজা করেন না। নিজের শয়নকক্ষে কুশাসনে বসে ধ্যান করেন শুধু। শাক্তবংশের সন্তান হলেও আন্তরিকভাবে তিনি অদ্বৈত বৈদান্তিক।

তারাপ্রসন্ন এতক্ষণ দাওয়ায়-পাতা মাদুরে অপেক্ষা করছিলেন। বাচস্পতি পূজা-ঘরে প্রবেশ করার পর তারাপ্রসন্নের নির্দেশে শুভপ্রসন্ন মালতীকে প্রশ্ন করে, বাবামশাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, তিনি কি ওই ঠাকুরমশাইকে আমাদের বাড়িতে মধ্যাহ্ন আহারে মায়ের ভোগ গ্রহণের নিমন্ত্রণ করে যাবেন?

মালতী কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। বাচস্পতি মশাই এই ভদ্রাসনের অতিথি, অথচ গৃহস্বামী অনুপস্থিত! তাছাড়া ঘরে আনাজপাতি যা আছে…

রূপমঞ্জরী হঠাৎ বলে উঠল, সোনা-মা, জ্যেঠামশাইকে বরং গিয়ে বলি যে, উনি এখানেই খাবেন। কিছু অন্নব্যঞ্জন যেন জ্যেঠামশাই এ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বড়ঠাকুরমশাই নিয়ে আসবেন। দু জনের মতো? কেমন? বাবামশাইও তো দুপুরে আজ বাড়িতে অন্নসেবা করবেন। দুজনে একসঙ্গে বসলে—

শুভপ্রসন্ন ধমক দেয়, তোর কী বুদ্ধি, হটী! এ বাড়িতে চারজন লোক, আর দু-জনের মতো পাঠাতে বললি?

শুভ ওকে চিরকাল ওই ‘হটী’ নামেই ডাকে।

মালতী অবাক হল বালক-বালিকা দুটির উপস্থিত বুদ্ধি দেখে।

২০

মধ্যাহ্নআহারের পর বাচস্পতি জানালেন যে, তিনি পত্রবাহকমাত্র। গুরুদেব রূপেন্দ্রনাথকে একটি পত্র দিয়েছেন—সেই শীলমোহরাঙ্কিত পত্রে কী লেখা আছে তা অবশ্য তিনি জানেন না। তবে গুরুদেবের আদেশমতো কাল প্রত্যুষে তিনি মালতামায়ের সমভিব্যহারে ত্রিবেণীর দিকে যাত্রা করবেন।

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, গুরুদেব যদি তাই আদেশ করে থাকেন তবে তাই হবে। আপনি একটু বিশ্রাম করুন। অপরাহ্ণে আমার এক অনুজপ্রতিম শ্রীশিবনাথ দত্ত আপনাকে গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনবে। অনেকগুলি দেবালয় আছে। আমাদের আরোগ্য-নিকেতনও দেখিয়ে আনবে।

বাচস্পতি বলেন, সে সব তো দেখবই। আরও একটি আশ্চর্য জিনিস আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই সোঞাই গাঁয়ে।

—কী সেটি?

—’একবগ্গা দিঘি’ এবং তার কার্যক্রম।

—খুবই আনন্দের কথা। গুরুদেব কি অমন একটি সংরক্ষিত পুষ্করিণী ত্রিবেণীতে প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবছেন?

—শ্রীমন্ গুরুদেব কখন কী চিন্তা করেন তা দেবাঃ ন জানন্তি। তবে আমার কৌতূহল প্রচণ্ড। শুনেছি, সেই একবগ্গা দিঘির প্রভাবে সোঞাই গাঁ থেকে নাকি আন্ত্রিক রোগ সম্পূর্ণ বিদূরিত? সত্য কথা?

—আমার কথা কেন শুনবেন, ঠাকুরমশাই? আমি তো নিমিত্তমাত্র। অপরাহ্ণে তো গ্রাম-পরিক্রমা করবেনই। তখন গ্রামবাসীদের মতামত সংগ্রহ করবেন। সেটাই প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটন করতে পারে।

*

বাচস্পতি দিবানিদ্রায় অভ্যস্ত নন, যতই গুরুপাক মধ্যাহ্নভোজন হোক না কেন—তিনি উপনয়নের সময় যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেটি কঠোরভাবে মেনে চলেন : ‘দিবা মা শান্সি’।

তর্কপঞ্চাননের পত্রে সম্বোধন ছিল : কল্যাণীয়েষু।

পত্রটি ভূর্জপত্রে। দেবনাগরি হরফে, সংস্কৃতে।

রূপেন্দ্রনাথ একাগ্রমনে পত্রটি পাঠ করতে থাকেন। মামণি তখন নিদ্রাগত। জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে গ্রামীণ দ্বিপ্রহরে নেমেছে স্তব্ধতা। মালতী ওঁর শয়নকক্ষের প্রবেশপথে দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষারতা। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে লক্ষ্য করছে পত্রপাঠকের প্রতিক্রিয়া। কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। পত্রপাঠকের মুখ ভাবলেশহীন—কোনও প্রভাব পড়ছে না। পত্রপাঠ সমাপ্ত করে রূপেন্দ্র সেটি নামিয়ে রাখলেন। একটি পাথরের নুড়ি দিয়ে সেটিকে সুরক্ষিত করলেন—হাওয়ায় না উড়ে যায়।

মালতীর লক্ষ্য হল ভূর্জপত্রের সঙ্গে আরও একটি পত্র বাবলা-কাঁটায় গাঁথা। অধীরভাবে জানতে চায়, কী লিখেছেন উনি?

রূপেন্দ্র ম্লান হাসলেন। বললেন, আপনি আনন্দনাড়ু গড়া শুরু করতে পারেন বৌঠান। সংবাদ শুভ। আপনার মাতুল-মহাশয় আমাদের দুইজনকে আমন্ত্রণ করেছেন। আপনার ভগিনী অর্থাৎ মাতুল মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা কল্যাণীয়া সরস্বতীমায়ের বিবাহ স্থির হয়েছে। পাত্রটি আচার্যদেবের চতুষ্পাঠীতেই অধ্যয়নরত। কুলপুরোহিতের বংশ। সচ্ছল পরিবার।

—ওমা! সরির বিয়ে ঠিক হয়েছে! কবে?

—’আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে, মিথুনরাশিস্থে ভাস্করে’!

—আবার অংবং!

—অর্থাৎ আষাঢ়ের প্রথম দিন। এখনও এগারো দিন বাকি।

—আপনারও নিমন্ত্রণ হয়েছে বললেন না? আমরা দুজনেই যাচ্ছি?

—না, বৌঠান; আমার যাওয়া সম্ভবপর নয়। অনেকগুলি কঠিন রোগি এখন আমার তত্ত্বাবধানে। তাছাড়া আচার্যদেব নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি অতঃপর পাকাপাকিভাবে তাঁর ভদ্রাসনেই থাকবেন। সোঞাইয়ে আপনার অবস্থিতিতে তাঁর ঘোরতর আপত্তি।

মালতীর ভ্রূকুঞ্চন হয়। বলে, আপত্তি তো তাঁর চিরকালই ছিল। আবার নতুন করে আপত্তি জানানো হল কেন?

—আমার কয়েকটি আচরণ লোক মারফত তিনি জেনেছেন এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাই এই নির্দেশ। বোধকরি, আমাকে শাস্তি দিতে।

—আপনার কোন অপরাধ? কোনটায় তাঁর আপত্তি?

—তাঁর আপত্তি আমার একাধিক আচরণে। প্রথমত, সোঞাই পঞ্চায়েতের বিচারসভায় আমি বলেছিলাম যে, এ গ্রাম থেকে বিতাড়িত হলে আমি ত্রিবেণীতে চলে যাব। সেখানে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করব ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা শিক্ষায়তন’। সে ঘোষণা নাকি আমার পক্ষে ‘অনধিকারীর দম্ভ’! কারণ আমি তার পূর্বে আচার্যদেবের অনুমতি গ্রহণ করিনি। তৎভিন্ন, তিনি স্ত্রী-শিক্ষার বিরুদ্ধে। তাঁর বিশ্বাস, সম্ভ্রান্তগৃহের পুরললনার দল শিক্ষিতা হলে ‘ব্যাপিকা’ হয়ে উঠবেন—

মালতী জানতে চায়, ‘ব্যাপিকা’ কাকে বলে?

—যে স্ত্রীলোক স্বাধিকারপ্রমত্তা, চঞ্চলা, প্রগল্ভা। যারা সন্তানপালন অপেক্ষা প্রসাধনে বেশি আসক্ত, যারা পতিদেবতার সেবা করার পরিবর্তে পরপুরুষ সেবায় আগ্রহী!

—বুঝলাম। আর কী অভিযোগ এনেছেন আপনার গুরুদেব?

—গুরুদেব নয় বৌঠান, তিনি আমার আচার্যদেব।

স্তম্ভিত হয়ে গেল মালতী। ত্রিবেণীর পঞ্চানন ঠাকুরের উল্লেখ করতে উনি বরাবর ‘গুরুদেব’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। তাই প্রশ্ন করে, ‘গুরুদেব’কে ‘আচার্যদেব’ বলছেন যে আজ?

—সে প্রসঙ্গ থাক। আপনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘আর কী অভিযোগ’। হ্যাঁ, আরও একটি গুরুতর কারণে উনি আমাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন। লোকপরম্পরায় উনি জ্ঞাত হয়েছেন যে, একটি যবনীর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে আমি নাকি তাকে—

—’মোহগ্রস্ত’ হয়ে? তাই লিখেছেন উনি?

—বলা কঠিন। সংস্কৃতভাষায় তিনি মহাপণ্ডিত। তাই তিনি যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তার বিবিধ অর্থ। প্রথমত, ‘কামমোহিতের মনোভাব’, দ্বিতীয়ত, ‘করুণার মনোভাব’।

—তা, কোন্ অর্থে শব্দটা উনি ব্যবহার করেছেন?

—তা তো নিশ্চিত করে বলা সম্ভবপর নয়। তবে পরবর্তী পঙক্তিতেই তিনি যে ভাষায় আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন তাতে প্রথম অর্থটিই গ্রাহ্য। যাকে আমি মোলায়েম করে আপনাকে বলেছিলাম; ‘মোহগ্রস্ত’–বস্তুত ‘কামোন্মত্ত’!

হঠাৎ একেবারে অন্য কথা বলে বসল মালতী, ঠাকুরপো আমি ত্রিবেণীতে যাব না। সরির বিয়ের নিমন্ত্রণে গেলে তিনি আর আমাকে ফিরে আসতে দেবেন না।

—তাহলে কী করবেন? এখানেই কয়েকমাস যন্ত্রণা সহ্য করে যাবেন? ভারমুক্ত হবার পর আত্মহনন?

মালতী দাঁতে-দাঁত দিয়ে বললে, আপনি ভারি নিষ্ঠুর!

—না, বৌঠান! আমি শুধু আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যে, এটা আপনার শাপে বর’! আপনার ত্রিবেণী প্রত্যাগমনের একটি শোভন কৈফিয়ত। কেউ বলবে না—ভ্রষ্টাচারী কামুকটার হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে ঘনশ্যাম সার্বভৌমের বিধবা পালিয়ে বাঁচল!

মালতীর ডাগর চোখদুটি জলে ভরে উঠল।

—এ চোখের জল আপনার আনন্দাশ্রু হওয়ার কথা, বৌঠান। আপনি জানেন, যার ভদ্রাসনে আপনি আছেন সে লোকটা কামুক, ভ্রষ্টাচারী নয়; কিন্তু এ গাঁয়ের অনেক খরজিহ্ব সমাজপতি আমাকে সেই বিশেষণে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে খুশি হবেন। তাঁরা চান না, আমি স্ত্রীলোকদের শিক্ষিত করে তুলি। তাঁরা চান না যে, সতীদাহ প্রথায় আমি বাধা দিই, অথবা অন্ত্যজ পরিবারগুলিকে উন্নততর করায় সচেষ্ট হই। কিন্তু তাঁরা আমার বিরুদ্ধাচরণও করে উঠতে পারেন না। কারণ গ্রামের সাধারণ মানুষ আমার এই প্রতিবাদী চরিত্রটাকে শ্রদ্ধা করে। তাছাড়া রোগ-ভোগে আমাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখুন বৌঠান–এর অপেক্ষা শালীন, ভদ্র, সুন্দর সমাধান আর কিছু হতে পারত না।

মালতী নতনেত্রে অনেকক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলে, আপনি সরির বিয়েতে যাবেন না?

—এটা কি একটা প্রশ্ন হল? সে তো অসম্ভব।

—আর একটা কথা। আপনি আমার সে প্রশ্নটা চাপা দিয়ে দিয়েছিলেন। পঞ্চানন ঠাকুরকে আপনি ‘গুরুদেব’ না বলে আচার্যদেব বলছেন কেন?

—যেহেতু তিনি তাই। উনি আমার মন্ত্রগুরু নন, দীক্ষাগুরু নন, ‘শিক্ষাগুরু’—আচার্যদেব!

—আপনি পঞ্চানন ঠাকুরকে ‘গুরু’ বলে মানেন না? তাঁর সব আদেশ বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে প্রস্তুত নন?

—নিশ্চয় নয়। চতুর্বেদের সব অনুশাসনই আমি বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে পারি না।

—আপনি স্বীকার করেন না : বেদ অভ্রান্ত!

রূপেন্দ্র মৃদু হাসলেন। বললেন, বৈদিক বর্ণনায় পড়েছি তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে গো-মাংস ভক্ষণ করতেন! সেই নির্দেশে গো-মাংস ভক্ষণ এখন হিন্দু-সমাজে প্রচলিত হওয়া বাঞ্ছনীয়? আপনি কী বলেন?

মালতী স্তম্ভিত হয়ে যায়। বলে, আপনি মহাপণ্ডিত। আপনার সঙ্গে আলোচনা করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু ‘বেদ অভ্রান্ত’একথা না মানলে কি হিন্দু থাকা যায়?

—যায়। ব্রাহ্মণ্যধর্মে থাকা যায় না। জাবালি বৈদিক মন্ত্রকে অভ্রান্ত বলে স্বীকার করতেন না, তবু তিনি সর্বজনস্বীকৃত এক মহামুনি। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধও বেদকে স্বীকার করেননি।

—তিনি তো বৌদ্ধ?

—শ্রীচৈতন্যদেব যেমন বৈষ্ণব। কিন্তু এঁরা সকলেই ভারতবর্ষের মহান ঐতিহ্যের ধারক। এঁরা সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ!

মালতী আকুল হয়ে প্রশ্ন করে, ত্রিবেণীর পঞ্চানন ঠাকুরকে আপনি অপ্রতিবাদে মানেন না, শাস্ত্র মানেন না, বেদও মানেন না। তাহলে আপনি কী মানেন? কার নির্দেশ মানেন?

—বিবেকের। আমার সাধনায় ‘আত্মদীপ’ হয়ে ওঠার।

——আত্মদীপ’! তার অর্থ?

সে কথা বোঝাতে গেলে অনেক সময় লাগবে, বৌঠান। আপনি এখনও অভুক্ত। পরে আপনাকে বুঝিয়ে বলব।

২১

সন্ধ্যা সমাগমে ওঁরা ফিরে এলেন। অপরাহ্ণে শিবনাথ অতিথিকে গোটা গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। শুভ্রপ্রসন্ন আর রূপমঞ্জরীও সঙ্গে ছিল। সোঞাইয়ের দেবালয়গুলি বাচস্পতি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। প্রতিটি মন্দিরে প্রণাম করলেন। যে তালবৃক্ষ থেকে বেষ্টা-বায়েন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছিল সেই এক-পায়ে খাড়া শহিদমিনারটিকে দেখলেন। জমিদারবাড়ি এবং আরোগ্য নিকেতনও দর্শন করলেন। একবগ্গা দিঘিটাকে তিনি সবাইকে নিয়ে কী-জানি-কেন প্রদক্ষিণ করলেন। বলেন, এমন চতুষ্কোণ পুষ্করিণী আমি ইতিপূর্বে কখনও দেখিনি, যার কোনও কোণই সমকোণ নয়। এরই নাম ‘একবগ্গা দিঘি?

রূপমঞ্জরী বলে, সেটা ওর ‘ডাকনাম’। ভালো নাম, নিপাতনে সিদ্ধ’।

—কী নাম? ‘নিপাতনে সিদ্ধ’! বাঃ! কে দিয়েছে অমন নামটি? বন্দ্যোঘটি মহাশয়? মানে তোমার বাবামশাই?

—আজ্ঞে না। নামকরণ করেছে ভিন গাঁয়ের একটি ছেলে। তাকে আমি চিনি না।

–‘নিপাতনে সিদ্ধ’ কাকে বলে জানো? কেন ওর অমন নাম হয়েছে তা বলতে পারো?

রূপমঞ্জরী বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবামশাই আমাকে বুঝিয়ে বলেছেন। নিপাতনে সিদ্ধ’ মানে এমন একটা শব্দ যা ব্যাকরণ মানে না। অথচ তার মানে বোঝা যায়, সেটা সবাই মেনে নিয়েছে। আর যেটা ভাষার মঙ্গলবিধান করে।

—বাঃ! সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছ তুমি! তা একবগ্গা দিঘির অমন নাম কেন হল তা বলতে পারো?

ছয় বছরের বালিকাটি একটু বিহ্বল হয়ে পড়ে। তৎক্ষণাৎ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে তার বাল্যবন্ধু শুভপ্রসন্ন : দেখুন ঠাকুরমশাই, পুষ্করিণী নির্মাণের একটা প্রচলিত রীতি আছে। এ সেটা মানেনি। তবু সকলের স্বীকৃতি পেয়েছে। আর ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ শব্দ যেমন ভাষাকে সমৃদ্ধ করে এই সংরক্ষিত জলাশয়টিও তেমনি সমাজের সমৃদ্ধি বিধান করছে—আন্ত্রিক রোগকে বিদূরিত করে। তাই ও ‘নিপাতনে সিদ্ধ!’

বাচস্পতি অত্যন্ত প্রীত হলেন।

শিবনাথ ওঁদের ফিরিয়ে এনে মালতীকে বলেছিল, আজ রাতে আর আমি আসব না দিদি। রাত-বিরেতে যদি রোগি বাড়ি থেকে বাবাঠাকুরের ডাক আসে তাহলে ত্রিবেণীর ঠাকুরমশাই তো আজ থাকবেন।

মালতী বলেছিল, ঠিক আছে। তোমাকে আজ আর আসতে হবে না। কাল থেকেও নয়। কারণ কাল ভোরবেলায় আমি ওঁর সঙ্গে ত্রিবেণী ফিরে যাব।

—আবার কবে ফিরে আসবেন?

জবাব দিতে মালতীর গলাটা কেঁপে গেল। বললে, তা কি এখনই বলা যায়? সেখানে আমার ছোটবোনের বিয়ে। পয়লা আষাঢ়। সেসব মিটলে…দেখা যাক….

শিবনাথ তার দিদিকে প্রণাম করল। মালতী বলে, একটু বসে যাও ভাই। ওবেলা অনেকটা পরমান্ন দিয়ে গেছেন বড়ঠাকুর। তুমি একবাটি প্রসাদ খেয়ে যাও।

বাচস্পতি একাহারী। তদুপরি ওবেলায় গুরুপাক আহার হয়েছে। দু-একটি ফলমূল শুধু মুখে দিলেন। আর পূজার প্রসাদ কিছু ক্ষীরের নাড়ু।

সারাদিনে মালতী তার জিনিসপত্র বেঁধে নিয়েছে।

বিকালে মীনুখুড়িমার বাড়িতে গিয়েছিল। বিদায়-প্রণাম সেরে আসতে। ও যে আর কোনওদিন সোঞাইয়ে ফিরে আসবে না একথা কাউকে বলেনি। সবাই জানল ও বোনের বিয়েতে ত্রিবেণী যাচ্ছে, গিরিপিসিমা ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, হ্যাঁরে মালু, তুই কি আমার ওপর রাগ করে আছিস? কিন্তু দেখ…

মালতী বাধা দিয়ে বলেছিল, আপনাকে একটা গোপন কথা বলব পিসি। কিন্তু কাউখ্যে তা বলবেন না যেন!

গিরিপিসিমার চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেল। একটা আতঙ্কের আভাসও যেন ফুটে উঠল তাঁর মুখে। বলেন কী এমন কতা? ঠিগাছে বল! আমি কারেও বনি।

—আমি আর কোনওদিন এ-গাঁয়ে ফিরে আসব না, পিসি। এই যাওয়াই আমার শেষ যাওয়া।

পিসি বোধহয় খুশি হলেন মনে মনে। মুখে কিন্তু ধমক দিয়ে ওঠেন, ও আবার কী কতা? ষাট-বালাই! আসবি না কেন? মামণির বে-তে এসে তুই না ডাঁড়ালে কাজ্জসিদ্দি হবে?

মালতী জবাব দেয়নি।

২২

বিদায়পর্ব মিটিয়ে ফিরে এসে দেখে ঠাকুরপো দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে পাখার হাওয়া খাচ্ছেন। একটু দূরে হটী আর শুভ খেলা করছে। ওদের খেলা মানে হুটোপুটি নয়। শুধু তর্কাতর্কি। শুধু বকম্। শুভ বলে, ‘তোর মাথায় গোবর পোড়া। এমন সহজ কথাটা বুঝিস না?’ আর হটী জবাবে বলে, ‘তোমার মাথাতেও ঘোড়ায় ডিম পেড়েছে! তুমি কিছুই জানো না!’ ওদের এই দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই দ্বন্দ্ব।

মালতী ঘটির জলে পা ধুয়ে মাদুরের একান্তে বসে পড়ে। বলে, ঠাকুরপো, আপনি তো মহাপণ্ডিত! আমার একটা সমস্যার সমাধান করে দেবেন?

—কী সমস্যা?

–এ আমার জিত হল, না হার? জয় না পরাজয়?

—আর একটু বিস্তারিত করে বলুন?

—আমার এই ত্রিবেণীতে ফিরে যাওয়াটার কথা বলছি। এ কয়দিন দুশ্চিন্তায় পাগল-পাগল হয়ে উঠেছিলাম। মুক্তির কোনও আশা ছিল না। এমনকি—আপনি জানেনই—একটা চরম সিদ্ধান্তের কথাও আমার মাথায় এসেছিল। তারপর হঠাৎ এল এই সমাধান। সসম্মানে এই কারাগার থেকে মুক্তির সুযোগ—

—তবে তো জিতলেনই আপনি?

—কিন্তু সব কিছু ছেড়ে যেতে আমার যে বুকটা টনটন করে উঠছে, ঠাকুরপো। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। গিয়েছিলাম বলভদ্রের কারাগারে। সেখানে আমার অধিকার ছিল দাসীবাঁদিরও অধম। অথচ সোঞাই গাঁয়ে এসে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলাম। এ বাড়িতে গৃহিণীর মর্যাদা পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এ ভিটেটা আমার। ওই পূজার ঘর, ওই পাকঘর, ওই তুলসী মঞ্চ—সব—সব আমার। পেয়েছিলাম মামণিকে। আর আপনার স্নেহ-ভালোবাসা! এ সব ছেড়ে যেতে আমার যে বুক ফেটে যাচ্ছে! তাই তো জানতে চাইছি, এ আমার জয় না পরাজয়?

রূপেন্দ্র ম্লান হেসে বললেন, এইটাই যে মেয়েদের নিয়তি বৌঠান। তাঁদের যে জয়েই পরাজয়। জিতলেও হারতে হয়, হারাতে হয়!

—ঠিক বুঝলাম না!

—-তাহলে আপনাকে একটা গল্প বলি শুনুন।

হঠাৎ ওপাশ থেকে উৎকর্ণ হয়ে উঠল রূপমঞ্জরী। বললে, আপনি কি এখন সোনামাকে একটা গল্প বলবেন, বাবা?

—হ্যাঁ, মামণি। তুমি শুনবে? চলে এস এখানে।

শুভপ্রসন্নর সম্পর্কটা তো ওর সঙ্গে কানের সঙ্গে মাথার। দুজনেই এসে মাদুরের উপর টুটুম হয়ে বসল। পাশাপাশি। ঘেঁষাঘেঁষি

রূপেন্দ্রনাথ শুরু করলেন তাঁর কাহিনি :

—প্রায় সহস্রাব্দ পূর্বে আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ্য আর বৌদ্ধধর্মের একটা সংগ্রাম চলছিল—রূপমঞ্জরী বাধা দিয়ে বলে ওঠে, ‘সহস্রাব্দ’ মানে হাজার বছর। আর ‘সংগ্রাম’ মানে লড়াই! তাই না বাবা?

রূপেন্দ্র ওর পিঠে একটি হাত রেখে বলেন, হ্যাঁ মামণি। তবে এখানে সংগ্রাম মানে লড়াই বা মারামারি-কাটাকাটি নয়। মতবিরোধ।

ওঁর মনে পড়ে গেল—উপ্যাখানের ভাষা ‘বক্তার’ অধিকারে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত শ্রোতার গ্রহণ ক্ষমতার সমতলে। তাই এবার সহজ ভাষায় কাহিনিটি বিবৃত করতে থাকেন সংক্ষেপে-শঙ্কর বিজয়, শঙ্করদিগ্বিজয় গ্রন্থ অবলম্বনে।

প্রায় হাজার বছর আগে আর্যাবর্তের ধর্মজগতে ক্ষীণ হয়ে আসতে শুরু করেছে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রভাব। ধীরে ধীরে মাথা তুলছে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বৈদিক কর্মকাণ্ড : পূর্বমীমাংসা-দর্শন এই মতের প্রধান প্রবক্তা তখন গৌড়মণ্ডলের আচার্য কুমারিল ভট্ট। বৌদ্ধ অহতদের সঙ্গে তর্কে জয়লাভের জন্য তিনি ছদ্মবেশে সমকালীন শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ অহৎ আচার্য ধৰ্ম্মকীর্তির নালন্দা সংঘারামে উপনীত হলেন। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্নিহিত ভাব, বক্তব্য ও যুক্তিগুলি আয়ত্ত করে নিলেন। তারপর ফিরে আসেন হিন্দুধর্মে। খণ্ডন করেন বৌদ্ধধর্মের পণ্ডিতদের মত।

এই মহাপণ্ডিত কুমারিল ভট্ট যখন অশীতিপর বৃদ্ধ তখন তাঁর অন্তরে উপস্থিত হল অনুশোচনা এবং তা থেকে নির্বেদ! তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না যে, ছলনার আশ্রয়ে তিনি তাঁর গুরুর কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব এবং তার ছিদ্রগুলি শিখে এসেছিলেন। পণ্ডিতপ্রবর স্থির করলেন এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন তুষানলে আত্মাহুতি দিয়ে। সেই মতো সব আয়োজন যখন সম্পূর্ণ তখন গৌড়মণ্ডলে এসে হুংকার ছাড়লেন এক যুবক। তরুণ বেদান্তকেশরী : অয়ম্-অহং ভো!

তিনি বেদের কর্মকাণ্ডের উপর স্থাপিত পূর্বমীমাংসা মত খণ্ডন করে উত্তর- মীমাংসার সনাতন ও সার্বভৌম অদ্বৈতবাদ আর্যাবর্তে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। সেটি বৈদিক জ্ঞানকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ মীমাংসক আচার্য কুমারিল ভট্টের আশ্রমে উপনীত হয়েছেন। তাঁকে পরাজিত করতে পারলেই তাঁর আর্যাবর্ত জয় সম্পূর্ণ হবে। তিনি দাক্ষিণাত্যের মহাপণ্ডিত যুগাবতার শঙ্করাচার্য!

শঙ্করের অভিপ্রায় জ্ঞাত হয়ে কুমারিল বললেন, আপনি বড় বিলম্বে এসেছেন আচার্য শঙ্করদেব। আমি এখন প্রায়শ্চিত্ত করতে চলেছি। তবে আপনার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে না। আপনি গঙ্গাতীরে নবদ্বীপ মহাধামে চলে যান। সেখানে নগরপ্রান্তে অরণ্য-আশ্রমে আছেন আমার প্রিয়শিষ্য মীমাংসক মণ্ডন মিশ্র। তাঁকে তর্কে পরাস্ত করতে পারলেই আমি স্বীকার করে নেব যে আপনার গৌড়বিজয় সুসম্পন্ন। শঙ্কর বলেন ‘তথাস্তু’! কিন্তু আমাদের বিচারসভায় মধ্যস্থ বা বিচারক কে হবেন? কুমারিল বললেন, ‘বিচারক হবেন মণ্ডন মিশ্রের বিদুষী সহধর্মিণী কল্যাণীয়া উভয়ভারতী।’শঙ্কর কিছু বিচলিত। বলেন, ‘মহিলা বিচারক? তিনি কি.’ কুমারিল মধ্যপথেই বলে ওঠেন ‘তাঁকে অনুপযুক্তা,মনে করলে আমি তাঁর নাম প্রস্তাবই করতাম না। তদ্ভিন্ন তাঁর নিরপেক্ষতাও সন্দেহাতীত’।

শঙ্কর স্বীকৃত হলেন। এলেন নবদ্বীপে। রাজসভায় বিচারের আয়োজন হল। একপক্ষে মীমাংসক মণ্ডন মিশ্র। অপরপক্ষে অদ্বৈত বেদান্তের ধ্বজাধারী স্বয়ং আচার্য শঙ্কর। তর্কযুদ্ধের শর্ত হল এই রকম : শঙ্করদেব যদি পরাজিত হন তাহলে তাঁর সন্ন্যাস দণ্ডটি দ্বিখণ্ডিত করবেন। ভারতের চারপ্রান্তে চারটি অদ্বৈত বেদান্তের মঠ-প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করবেন! আর যদি মণ্ডন মিশ্র পরাজিত হন তাহলে তিনি আচার্য শঙ্করের শিষ্যত্ব নিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। আশ্রম ত্যাগ করে যাবেন চিরকালের জন্য।

দীর্ঘকাল উভয়পক্ষের বিচার চলতে থাকে। সভাস্থ পণ্ডিতবর্গ স্তব্ধ। ক্রমে তর্কযুদ্ধের আলোচ্য তত্ত্বগুলি এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যায়ে উপনীত হল যে, সভাস্থ পণ্ডিতবর্গ তার নাগাল পেলেন না। শুধু মধ্যস্থ বিচারক উভয়ভারতী নিমীলিত নেত্রে কর্ণময়। দু’পক্ষের বক্তব্যই তাঁর জ্ঞানসীমার পরিধি অতিক্রম করে যাচ্ছে না।

একসময় বিচার শেষ হল। সভাস্থ সকল পণ্ডিত বুঝে উঠতে পারেন না : কে জয়ী, কে পরাজিত। উভয় প্রতিযোগী বিচারকের দিকে দৃকপাত করলেন। উভয়ভারতী স্পষ্টভাষে বলে ওঠেন, বিজয়ী হয়েছেন : দাক্ষিণাত্যের মহাপণ্ডিত আচার্য শঙ্করদেব।

তার নির্গলিতার্থ : মণ্ডন মিশ্র তাঁর আশ্রম ত্যাগ করে, উভয়ভারতীকে পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। শঙ্করাচার্য গাত্রোত্থানের উদ্যোগ করতেই উভয়ভারতী বলে ওঠেন; আচার্যদেব! আপনার গৌড়মণ্ডল বিজয় কিন্তু এখনও সুসম্পন্ন হয়নি। আপনি আমাকেও তর্কে পরাস্ত করলে তবেই আপনার বঙ্গবিজয় সমাপ্ত হবে।

শঙ্করাচার্যের ভ্রূযুগলে জাগল কুঞ্চন। বলেন, এ কেমন কথা? গৌড়মণ্ডলের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত আচার্য কুমারিল ভট্ট তো বলেছিলেন মণ্ডন মিশ্রই গৌড় অঞ্চলের একমাত্র প্রতিনিধি। তাঁকে পরাস্ত করলেই আমার গৌড়বিজয় সুসম্পন্ন।

—যথার্থ কথা। কিন্তু যেমুহূর্তে আপনি আমাকে মধ্যস্থ বা বিচারক পদে ব্রতী হতে আহ্বান জানালেন সেই মুহূর্তেই তো আপনি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আপনার বিপক্ষপণ্ডিতের সহধর্মিণী আরও উচ্চমার্গের পণ্ডিতা। না হলে তিনি কেমন করে বিচারকের আসন অলংকৃত করেন। তাই নয়?

শঙ্করকে স্বীকার করতে হল, এ যুক্তি খণ্ডনের অতীত। বললেন, তথাস্তু! আপনাকেও আমি তর্কে পরাজিত করে আবার অদ্বৈত-বেদান্তের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করব। কিন্তু এবার কে হবেন বিচারক?

—আপনার সঙ্গে যে কয়জন অনুচর দাক্ষিণাত্য থেকে এসেছেন তাঁদের মধ্যে যে কোনও একজনকে স্বীকার করে নিতে আমি সম্মত।

শঙ্করাচার্য তাঁর প্রধান শিষ্য পদ্মপাদকে মনোনীত করে বলেন, এবার বলুন কোন শাস্ত্র বিষয়ে আমরা বিচার করব?

উভয়ভারতী বললেন, আপনিই আপনার মনোমতো বিষয়টি নির্বাচন করুন।

শঙ্কর সবিনয়ে প্রত্যুত্তর করেন, না, মা। কোনও মহিলা তার্কিকের সঙ্গে আমি ইতিপূর্বে তর্কসভায় যোগদান করিনি। ফলে, এ সুযোগ আমি আপনাকেই প্রদান করতে ইচ্ছুক। আপনি আপনার মনোমতো যে কোনও শাস্ত্র নিয়ে আমার সঙ্গে তর্কারম্ভ শুরু করুন। আমি তাতেই স্বীকৃত।

উভয়ভারতী বলেন : আপনি যখন আমার উপরেই নির্বাচনের অধিকার দিলেন—আমি নারী, এই দাক্ষিণ্য দেখিয়ে—তখন আমিই তা স্থির করছি। আমাদের আলোচ্য শাস্ত্র হবে : মহামুনি বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র!

‘মধুচক্রে’ লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল পতঙ্গের মতো সভায় জাগল একটা মৃদু গুঞ্জন। সর্বনাশ! এ কী অবান্তর অশালীন কথা উচ্চারণ করলেন উভয়ভারতী! প্রকাশ্য রাজসভায় বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্ৰ!!

২৩

হাজার বছরের ব্যবধানে সেই চঞ্চলতা যেন অনুনাদিত হল রূপেন্দ্রনাথের তিনটি শ্রোতার অন্তরে। প্রথমেই প্রশ্ন করল রূপমঞ্জরী—মাত্র ছয় বৎসরের বালিকা : ‘বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র’ কী বাবা?

আরক্তিম নতনয়না মালতী একটু নড়েচড়ে বসল। আর শুভপ্রসন্নের প্রতিক্রিয়া সর্বাধিক। সহসা সে বহির্দ্বারের দিকে দৃকপাত করে বলে ওঠে—এই যে আমি এখানে! যা-ই!

মুহূর্তে সে উঠে দাঁড়ায়। হটী তার বস্ত্রাকর্ষণ করে বলে, কেউ তো ডাকেনি, শুভদা! কই? কে ডাকছে?

শুভপ্রসন্ন সে কথায় কর্ণপাত করে না। ওর মুষ্টি আলগা করে দ্রুতপদক্ষেপে অন্তর্হিত হয়ে গেল আরক্তিম দশবৎসরের বালকটি।

রূপমঞ্জরী বলে ওঠে। আস্ত পাগল! কেউ ডাকেনি; অথচ—আপনি বরং গল্পটা শেষ করুন বাবা! আমি ওকে পরে বলে দেব।

আতঙ্কতাড়িতা মালতী কোনওক্রমে বলে, বড় তেষ্টা পেয়েছে, মামণি। তুমি ও ঘর থেকে আমাকে একঘটি জল এনে দেবে?

—এখুনি দিচ্ছি সোনামা। আপনি কিন্তু গল্পটা শেষ করবেন না বাবা।

রূপমঞ্জরী দৃষ্টির আড়াল হওয়ামাত্র মালতী ধমকে ওঠে, আপনার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। ওসব কথা কি ওদের সামনে বলতে হয়? শুভ তো ছুটে পালিয়ে বাঁচল! নিন, তাড়াতাড়ি শেষটা বলে দিন।

রূপেন্দ্র সকৌতুকে হেসে ওঠেন। বলে, তাই কি পারি? মামণি কী বলে গেল শুনলেন না?

—ও ছেলেমানুষ। না বুঝে বলেছে। চট করে বাকিটা বলে দিন।

রূপেন্দ্র নির্বাক। কৌতুকহাস্যে সমুজ্জ্বল। রূপমঞ্জরী ফিরে এল। জলের ঘটিটা নামিয়ে দিয়ে বলে, এবার বলুন—বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে কী আছে?

ছয় বৎসরের বালিকা। অসাধারণ তার স্মৃতিশক্তি। অজ্ঞাত শব্দ দুটি তার জিজ্ঞাসু মস্তিষ্ক বিস্মরিত হয়নি।

রূপেন্দ্র বুঝিয়ে বলেন, বাৎস্যায়ন ছিলেন পুরাকালের মহাপণ্ডিত এক মুনিঋষি। কামশাস্ত্র তাঁরই রচনা। সেটা কিন্তু কোনও চতুষ্পাঠীতে শেখানো হয় না।

—তাহলে পণ্ডিতেরা কী করে শেখেন?

—শুধু পণ্ডিত নয়, মামণি, প্রত্যেকটি মানুষ—নর এবং নারী সে শাস্ত্ৰ শিখতে পারে। শেখেও! আকাশের দুজন দেবদেবী—অনঙ্গদেব আর রতি—প্রত্যেককে সে শিক্ষা দেন। তার অক্ষর পরিচয় থাক বা না থাক। কেমন করে শেখান জানো? তাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করে। ওঁরা দেবতা তো? তাই অনায়াসে সূক্ষ্মশরীরে মানুষের মনের ভিতর প্রবেশ করতে পারেন। মনের ভিতর প্রবেশ করে ‘কামশাস্ত্র’ শিখিয়ে দেন।

—আমাকেও শেখাবেন?

—নিশ্চয়! যখন তোমার উপযুক্ত বয়স হবে। ছোটদের তিনি সে শিক্ষা দেন না। একটা বিশেষ বয়স না হলে কারও সে শিক্ষার অধিকার নেই।

রূপমঞ্জরী তার কাকপুচ্ছশোভিত ছোট্ট মাথাটি নেড়ে বলে, বুঝেছি। যেমন আপনি সেদিন শুভদাকে বললেন যে, উপনয়নের পূর্বে ‘গায়ত্রী’ মন্ত্র শেখানো শাস্ত্রবিরুদ্ধ। তাই না বাবা?

—হ্যাঁ মা। অনেকটা সে রকমই বটে। এবার উপাখ্যানের বাকি অংশটা শোন :

আচার্য শঙ্করদেব বললেন, আমাকে মার্জনা করবেন, মা। আমি তো ‘কামশাস্ত্রে’র কথা কিছু জানি না! আমি যে সংসারাশ্রমে আদৌ প্রবেশ করিনি। ব্রহ্মচর্যাশ্রম সমাপ্ত হতেই আমি সরাসরি সন্ন্যাসাশ্রমে প্রবেশ করেছিলাম।

উভয়ভারতী বলেন, সে সমস্যা আপনার। কোন হেতুতে কোন শাস্ত্র আপনার অনধীত তা জানার কোনও কৌতূহল আমার নেই, আচার্যদেব। কিন্তু আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন মহামুনি বাৎস্যায়নের ‘কামশাস্ত্র’ ভারতীয় জ্ঞানমার্গের একটি স্বীকৃত গ্রন্থ! তিনি জগৎহিতায় সে শাস্ত্রটি রচনা করেন। ‘গোত্রং নঃ বর্ধতাম্’ এই বৈদিক নিদের্শকে সার্থক করে তুলতে। সে জন্যই হিন্দুধর্মে চতুরাশ্রমের ব্যবস্থা।

—না, মা। আমি চতুরাশ্রমকে বাধ্যতামূলক বলে স্বীকার করি না। শাস্ত্র বলেছেন যদহরের বিরজ্যেত তদহরের প্রব্রজ্যেত।’*

[* মুমুক্ষুর অন্তরে যে মুহূর্তে মুক্তির ইচ্ছা জাগবে সেই মুহূর্তেই সে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারে। সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে পারে।]

—সেটা আপনার ব্যক্তিগত অভিমত। অদ্বৈত-বৈদান্তিকের মত। সেই মতাদর্শই প্রতিষ্ঠা করতে এসেছেন আপনি। তা কিন্তু এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

মানবসমাজের অবলুপ্তি যাতে না হয় তাই আমরা, মীমাংসকপন্থীরা, বিশ্বাস করি ত্রৈবর্ণিকের বেদে স্পষ্ট নির্দেশ আছে : চতুরাশ্রমের পথেই প্রতিটি হিন্দুর জীবনযাপন বাধ্যতামূলক। ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গ একটি ব্যতিক্রম। হয়তো আপনিও তাই হতে ইচ্ছুক। তা, ব্যতিক্রম তো নিয়মেরই পরিচায়ক কিন্তু গৌতমবুদ্ধ থেকে গুরু নানক, তুলসীদাসজি থেকে শ্রীচৈতন্যদেব চতুরাশ্রমকে স্বীকার করেছেন।* আমার বক্তব্য তা নয়, আচার্যদেব। আমার বক্তব্য : তর্কের প্রথম পর্যায়ে আপনি আমাকে নির্বাচনের সুযোগ দিয়েছেন। স্বেচ্ছায়। আমি তা নির্বাচন করেছি : ‘বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র। এক্ষণে আপনারও সম্মুখে চতুমার্গপথ উন্মুক্ত। এক : আমার নির্বাচিত বিষয়ে তর্কে অবতীর্ণ হওয়া। দুই : আপনার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে স্বীকার করা যে আপনি সর্বশাস্ত্রবিৎ নন। তিন : প্রমাণ করা যে, ‘বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র’ একটি স্বীকৃত শাস্ত্র নয়। চার : স্বেচ্ছায় পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। আমি আপনার শিষ্য বিচারক আচার্য পদ্মপাদ মহোদয়ের নির্দেশ প্রার্থনা করি।

[* এখানে আমরা সজ্ঞানে ‘কালানৌচিত্য’ দোষ ঘটিয়েছি—মার্জনা চাইছি।]

বিচারক তাঁর গুরুর——বর্তমানে উভয়ভারতীর প্রতিপক্ষের—দিকে দৃকপাত করে বলেন, আপনার কী বক্তব্য, পূর্বপক্ষ মহাশয়?

শঙ্করদেব বললেন, আমি স্বীকার করছি : বাৎস্যায়ন ঋষির ‘কামশাস্ত্র’ হিন্দুধর্মের একটি স্বীকৃত আবশ্যিক শাস্ত্র। ঘটনাচক্রে আমি সে বিষয়ে অনবহিত। আরও স্বীকার করছি, তর্কের বিষয়বস্তু আমি আমার প্রতিপক্ষকেই নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছিলাম। এখন তা প্রত্যাহারও করতে পারি না।

আবার বাধা পড়ল গল্পে। রূপমঞ্জরী সহসা প্রশ্ন করে বসে, একটা কথা বুঝতে পারলাম না, বাবা। আচার্য শঙ্কর তো বালক নন, যুবাপুরুষ—আপনিই বলেছেন, তাহলে অনঙ্গদেব আর রতি তাঁকে ‘কামশাস্ত্র’ শিখিয়ে দেননি কেন?

—আচার্য শঙ্কর যে তাঁর মনের দরজায় কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন। অনঙ্গদেব আর রতিকে প্রবেশ করতেই দেননি ওঁর অন্তরে। ছাত্র না শিখতে চাইলে কেমন করে শেখাবেন তাঁরা? বলো?

—বুঝলাম। তারপর কী হল, বলুন?

—বিচারক তখন উভয়ভারতীর দিকে দৃকপাত করে বলেন, এ বিষয়ে আপনার আর কিছু বক্তব্য আছে?

উভয়ভারতী বলেন, আছে। নিজের স্বীকৃতি মতে আচার্য শঙ্করের গৌড়বিজয় অসমাপ্ত। তবে এ আশ্রমের প্রধান ইতিপূর্বে পরাজিত। ফলে, তিনি এই দণ্ডেই আশ্ৰম ত্যাগ করে যাবেন। শঙ্করাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। আমার সমাধান: এক্ষেত্রে আপনার গৌড়বিজয় অসমাপ্ত থাকা সত্ত্বেও আপনি আর্যাবর্তের চারপ্রান্তে চতুরাশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। কিন্তু আপনার এবং আপনার চতুরাশ্রমের মঠাধীশের অধিকার শুধুমাত্র দশনামী সন্নাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমিত থাকবে। গৃহস্থের উপর, গার্হস্থ্যধর্মাশ্রয়ীর উপর, কোনও অনুশাসন জানাবার অধিকার আপনাদের থাকবে না।

মালতী বলে, তার মানে কি শঙ্করাচার্য গৌড়বিজয় করতে পারেননি?

—এ বিষয়ে দুটি মত আছে, বৌঠান। শঙ্করাচার্যের শিষ্যরা বলেন, এরপর আচার্যদেব এক সদ্যমৃত রাজার দেহে সূক্ষ্মশরীরে প্রবেশ করেন। তাকে পুনর্জীবিত করে রাজপ্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করেন। মহিষীদের সঙ্গে সহবাস করে কামশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। তারপর উভয়ভারতীর আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করে তাকে ‘কামশাস্ত্র’ বিষয়ে তর্কে আহ্বান করেন। উভয়ভারতী উপলব্ধি করেন শঙ্কর ঈশ্বর প্রেরিত আচার্য ও যুগমানব’—তিনি পরাজয় স্বীকার করেন বিনা তর্কে। পরে তিনি যোগবলে মরদেহ ত্যাগ করেন।

কিন্তু আমি মনে করি, এ কাহিনি পরবর্তীকালে মঠাধীশদের ‘প্রক্ষিপ্ত’ রচনা। অর্থাৎ তাঁদের মনোমতো সমাধান

—কেন তা মনে করেন, ঠাকুরপো?

—কারণ আমার বিশ্বাস কোনও যুগাবতারই অলৌকিক কোনও কিছু করতে পারেন না—যতক্ষণ তাঁরা নরদেহধারী ধর্মপ্রচারক। তাঁরা মহামানব, তাঁরা সর্বজনশ্রদ্ধেয়, তাঁরা যুগাবতার—কিন্তু যতক্ষণ নরদেহধারী ততক্ষণ তাঁদের প্রাকৃতিক বিধান মেনে চলতে হবে। তাই আমি বিশ্বাস করি না গৌতম বুদ্ধ পদব্রজে নিরঞ্জনা নদী অতিক্রম করেছিলেন। ‘নিরঞ্জন’ শব্দের অর্থ নির্মল, অকলঙ্ক, এবং পরমব্রহ্ম। লোকুত্তম বুদ্ধের জীবনীতে আদি সংকলক বলতে চেয়েছিলেন যে, বুদ্ধদেব পরমব্রহ্মের প্রসঙ্গ উত্থাপন না করেও চিত্তশুদ্ধি মাধ্যমে, তাঁর অহিংসা-ধর্মের মাধ্যমে নির্মল, অকলঙ্ক জীবন যাপন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী অর্হতেরা গল্প বানালেন যে, বুদ্ধদেব পায়ে হেঁটে নিরঞ্জনা নামে এক নদী অতিক্রম করে যান। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শঙ্করাচার্যকে ওঁরা সূক্ষ্ম দেহে মৃত মহারাজার দেহে প্রবেশ করিয়েছেন। মহারাজকে পুনর্জীবিত করেছেন।

রূপমঞ্জরী আবার প্রতিবাদ করে। একটা কথা বাবা। অনঙ্গদেব আর রতি তো সব মানুষের—মানে তারা একটু বড় হলে—সূক্ষ্মশরীরের তাদের মনের ভিতর প্রবেশ করতে পারেন। তাহলে শঙ্করাচার্যই বা মন্ত্রবলে তা পারবেন না কেন?

—যেহেতু অনঙ্গদেব আর রতি হচ্ছেন দেবদেবী। তাঁরা মানুষ নন। আর আচার্য শঙ্করদেব নরদেহধারী যুগাবতার।

বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে ছোট্ট রূপমঞ্জরী বলে, বুঝলাম!

সে স্থানত্যাগের পর রূপেন্দ্র বলেন, শিশুদের কৌতূহল কীভাবে মেটাতে হয় দেখলেন। ওদের বলতে নেই ‘এসব বড়দের কথা’! আর তাই বলছিলাম, বৌঠান, মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় জয়ই পরাজয়। উভয়ভারতী দু-দুবার বিজয়ী হলেন। প্রথমবার নিরপেক্ষতায় স্থিতধী থেকে, দ্বিতীয়বার কূটকৌশলে। অথচ তাঁর দাম্পত্যজীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তাঁরই বিধানে। বিজয়িনীর পুরস্কার তাঁর চিরবিরহের বেদনা!

২৪

রাত এক প্রহর অতিক্রান্ত। সোঞাই গ্রামে সেটা মধ্যরাত্রি। কারণ গ্রামবাসী সূর্যালোকে অভ্যস্ত। সূর্যোদয়ের পূর্বেই তারা কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে, সূর্যাস্ত হতে-না-হতেই শয্যাগ্রহণ।

মামণি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রূপেন্দ্রনাথের শয়নকক্ষে একটি ঘৃতপ্রদীপ প্রজ্বলিত। গৃহস্বামী ধ্যানমগ্ন। বাচস্পতি শয্যাগ্রহণ করেছেন। মালতী তার জিনিসপত্র—কীই বা আছে তার—খানকতক থান—বেঁধে নিয়েছে একটি পুঁটুলিতে। তাতে একটি লালপাড় শান্তিপুরীও আছে। এটি দিয়েছেন তারাসুন্দরী। ও যখন তাঁকে বিদায় প্রণাম করতে যায়। তিনি মালতীর হাতে শাড়িটা দিয়ে বলেছিলেন, বিয়েবাড়িতে খালি-হাতে যেতে নেই রে। এটা নিয়ে যা, তোর বোনকে দিস।

তিন চারবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছে। ঘৃতপ্রদীপ আর গৃহস্বামী তখনও একে অপরের উপমান। দুজনেই নিবাত-নিষ্কম্প। রূপেন্দ্র সেই একই ভঙ্গিতে ধ্যানমগ্ন : সমংকায়শিরোগ্রীব।

নিঃশব্দেই দু-তিনবার সে ফিরে গেছে। কিন্তু কাল প্রত্যুষে তাকে রওনা হতে হবে। সূর্যোদয় মুহূর্তে। মাঝিমাল্লারা দিনে দিনেই নৌকা বাইতে চায়। কাল সকালে কর্মচঞ্চলতায় রূপেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে না। মালতীর ইচ্ছা আজ রাত্রেই ঠাকুরপোর কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে যাওয়া। আর কেউ না জানলেও তাঁরা দুজন তো জানেন যে, এই ওঁদের শেষ সাক্ষাৎ। আরও—গিরিপিসিমা ব্যতিরেকে এ দুনিয়ায় শুধু ওঁরা দুজনেই জানেন মাত্র দুই মাসে এই দুজন একান্তবাসী নরনারীর মধ্যে গড়ে উঠেছে একটা অপ্রত্যাশিত স্নেহ-শ্রদ্ধা-সৌহার্দ্যের সম্পর্ক। বৌঠান আর দেবরের মধ্যে যেমনটা গড়ে ওঠা স্বাভাবিক।

কিন্তু সেটাও তো শেষ কথা নয়! শেষ কথাটা গিরিপিসিও জানেন না। জানেন না–কী কারণে ওই সন্ন্যাসীপ্রতিম মানুষটি ওকে মন্ত্রদীক্ষা দিতে অস্বীকৃত! অসীম আত্মিক শক্তিধর মহাপণ্ডিতটি সে-কথা স্বমুখে স্বীকার করেছেন। ওর মতো একটি অল্পশিক্ষিতা শ্যামাঙ্গিনীর কাছে!

চতুর্থবার এসে দেখল রূপেন্দ্রনাথের ধ্যানভঙ্গ হয়েছে। তিনি শয্যাগ্রহণের উপক্রম করছেন। বাইরে ঘনান্ধকার। ঘৃত প্রদীপের স্বপ্নালোকিত কক্ষে দেখা যায় মশারির ভিতর মামণি অঘোরে নিদ্রাগত। ঝিল্লির একটানা শব্দ। তাছাড়া চরাচর নিস্তব্ধ। দ্বারপ্রান্ত থেকে মালতী ডাকল, ঠাকুরপো?

একটু যেন চমকে উঠলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন। মুখোমুখি। তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গে দীর্ঘ উপবীত ব্যতীত কবাটবক্ষ অনাবৃত। খড়মজোড়া খুলে রেখেছেন। বললেন, বৌঠান? বলুন।

—কাল সকালে তো আর সময় হবে না। তাই শেষ বিদায়টা নিতে এসেছি।

একটু যেন বিহ্বল হয়ে পড়লেন। বললেন, এই সবথেকে ভালো হল বৌঠান! কাল থেকে অবশ্য মামণি তৃতীয়বার মাতৃহীন হয়ে যাবে! কিন্তু উপায় কী?

—আমি কি মামণিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতাম না?

—কী লাভ? মাত্র দু-মাস আগেই তো সে ছিল ত্রিবেণীতে।

—তা ছিল। তবু বিয়েবাড়ির হই-হন্না তার নিশ্চয় ভালো লাগত।

—তা হয় তো লাগত। কিন্তু…

—কী কিন্তু?

—আপনি তো জানেন, আচার্যদেব আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন। ওই যে মেহেরউন্নিসা সংক্রান্ত বিকৃত তথ্যে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। আপনি যে আমার ভদ্রাসনে থাকবেন এটা তিনি জানতেন। কিন্তু আপত্তি সেবারও জানিয়েছিলেন। আমি তাতে বিচলিত হইনি। কারণ সার্বভৌমদাদার ইচ্ছা ছিল না যে, আপনি ওঁর সর্বতোভদ্রে আশ্রয় নেন। তখন আচার্যদেব দৃঢ়ভাবে আমাকে বাধা দিতে পারেননি। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে, বলতে আমারও লাগছে, কিন্তু সার্বভৌমদাদা যে নিদারুণ আঘাতটা করেছিলেন, তার ক্ষত তখনও শুকোয়নি। আচার্যদেব মানসিকভাবে সে সময় কিছু বিচলিত ছিলেন। তাই আপনাকে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছিলেন

—তার সঙ্গে মামণির ত্রিবেণী যাবার কী সম্পর্ক?

—সে কথাই বলছি। উনি মুখে না বললেও মনে মনে আমার উপর প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। কারণ সার্বভৌমদার সেই ব্রাহ্মীহরফে লেখা তিরস্কার-পত্রটির পাঠোদ্ধার করেছিলাম আমরা তিনজন। লেখক স্বয়ং, আচার্যদেব আর আমি। ঘনশ্যামদার উপর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না। সে ওঁর অসীম ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু আমি? আমাকে তাই তিনি ক্ষমা করতে পারেননি। ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায় ওঁকে প্রকাশ্যে অপমান করেছিলেন। তাই প্রতিশোধ নিতে উনি মামণিকে ওঁর কবজা থেকে ছিনিয়ে নিলেন। আজও ঠিক তেমনি। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনাকে সোঞাই নিয়ে আসায় তিনি আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়েই ছিলেন। তাই এই শাস্তিবিধান।

—আবার একই প্রশ্ন করছি ঠাকুরপো। তার সঙ্গে মামণির ….

—কী আশ্চর্য! বুঝলেন না? আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া তো আমার প্রথম পাপের শাস্তি—স্ত্রী শিক্ষাবিস্তারের অশাস্ত্রীয় প্রয়াসের শাস্তি। কিন্তু তাঁর চতুষ্পাঠীর প্রাক্তন ছাত্রটি যে যবনীর সঙ্গে প্রেমাসক্ত তার শাস্তি হল কই? মামণিকে কবজার ভিতর পেয়ে যদি তিনি নতুন নিদান হাঁকেন?—না, এখন থেকে হটী তার পাতানো দাদুর ভদ্রাসনেই থাকবে। রূপেন্দ্রনাথ যেহেতু কুলীন ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও আচার্যদেবের নির্দেশমতো দ্বিতীয়বার বিবাহে অস্বীকৃত তাই মাতৃহীন সংসারে মামণিকে ফেলে রাখা চলবে না। আমার হিম্মত হবে দ্বিতীয়বার কন্যাটিকে উদ্ধার করে আনার?

মালতী স্তম্ভিত হয়ে গেল। একটু অধোবদনে কী যেন চিন্তা করে। শেষে স্বীকার করে, আমি এভাবে ভেবে দেখিনি ঠাকুরপো। হয়তো–হয়তো কেন, নিশ্চিতই আপনি ঠিক। মামণিকে ত্রিবেণীতে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না।

—এবার শয্যাগ্রহণ করতে যান। কাল খুব প্রত্যুষেই উঠতে হবে তো?

হঠাৎ কী যেন হল মালতীর। এভাবে মামুলি বিদায়পর্বটা শেষ হওয়া যেন তার সইল না। বললে, আমার একটি অনুরোধ রাখবেন, ঠাকুরপো? একটি ভিক্ষা?

—অনুরোধ? ভিক্ষা! কী?

—সেটা কিন্তু একটু অশাস্ত্রীয়। তা শাস্ত্র তো আপনি মানেন না।

রূপেন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল মহাভারতের কর্ণকুন্তী সংবাদের কথা। অর্জুনের সঙ্গে দ্বৈরথসমরের ঠিক পূর্বে মাতা কুন্তী এসে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দাতাকর্ণের কর্ণমূলে এমনই একটা কথা বলেছিলেন বটে। একটি অনুরোধ পেশ করেছিলেন। চেয়েছিলেন একটি ভিক্ষা!

বলেন, শাস্ত্রমতে অদেয় হলেও যা চাইছেন তা দিতে আমি স্বীকৃত, যদি তা আমার বিবেক-নির্দেশের পরিপন্থী না হয়। বলুন?

—আমি সম্পর্কে আপনার বৌঠান। কিন্তু কোনওদিন আপনাকে আমার পায়ে হাত দিতে দিইনি। কেন দিইনি, তা আপনি জানেন। তেমনি আপনি আমাকে কেন ‘মন্ত্রদীক্ষা’ দিতে পারেননি তা আমরা দুজনেই শুধু জানি। বিদায়কালে আমার ভিক্ষা—আপনার শ্রীচরণে আমি একটি প্রণাম করে যাব। আপনি কি গ্রহণ করবেন?

রূপেন্দ্র বললেন, মানুষের অন্তর্লীন সব হৃদয়বৃত্তিকে শাস্ত্রীয় বিধানে গণ্ডিবদ্ধ করা যায় না—বিশেষ যে আচরণে সমাজের কোনও অমঙ্গল নেই। তোমার শেষ মনোবাসনায় আমি বাধা দেব না, মালতী। তোমার প্রণাম গ্রহণে আমি স্বীকৃত।

মালতী ওঁর সম্মুখে নতজানু হয়ে বসে। তার থান শাড়িটা গলায় জড়িয়ে নিয়ে মাথাটা নামিয়ে দিল দণ্ডায়মান রূপেন্দ্রনাথের যুগলচরণে। ওর খোলা চুলে ঢেকে গেল ব্রাহ্মণের চরণদ্বয়।

কিন্তু ঠিক তখনই উচ্ছ্বসিত অন্তরের আবেগে মালতী কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়ল। রূপেন্দ্র বললেন, স্থির হও মালতী! ওঠ! উঠে দাঁড়াও। মালতী অবাধ্য হল। দুটি বাহুপাশে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল ওঁর দুটি চরণ। এবার আর অভ্যস্ত মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারলেন না : ওঁ নমো নারায়ণায়!

নত হয়ে দৃঢ়মুষ্টিতে ধরলেন মালতীর দুই অনাবৃত বাহুমূল

মালতী উঠে দাঁড়াল। ঘৃতপ্রদীপের স্তিমিতালোক দণ্ডায়মান দুটি বিদায়কামী নরনারীর দেহে লুটিয়ে পড়ল। মালতীর নয়নদ্বয় মুদ্রিত-চোখের কোণ দিয়ে নেমেছে জলের দুটি ধারা। রূপেন্দ্র সংযম হারাননি। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের কোন গোপন রন্ধ্রকোষে হঠাৎ ভেসে এল এক ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষের দূরাগত ভর্ৎসনা : ক্যা রে! তু পিতামহ ভীষ্ম তো নহি হো?

মালতী তার আনন্দলোক থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিতে এসেছে। তার অন্তরের আকুতিকে সে বাঙ্ময় করতে চেয়েছে একটি শ্রদ্ধানন্ত্র প্রণামের মাধ্যমে। সেটি তিনি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ওই ভাগ্যতাড়িতা সামান্যার প্রেমের মর্যাদা? সেটা কি উপেক্ষিতই থেকে যাবে? তিনি কি তা মিটিয়ে দিতে পারেন না?

এবার অসংকোচে ওকে টেনে নিলেন ওঁর অনাবৃত কবাটবক্ষে। মালতীর নিমীলিত ডাগর দুটি চোখ চরম বিস্ময়ে বিস্ফারিত। এ যে অঘটন! এ যে কল্পনাতীত! এ কী হতে চলেছে? জিতেন্দ্রিয় রূপেন্দ্রনাথ …

পরমুহূর্তে তার বিস্ফারিত দুটি চোখ সুখাবেশে পুনরায় নিমীলিত হয়ে গেল।

রূপেন্দ্রনাথ চুম্বন করলেন ওই উপেক্ষিতা মন্দভাগিনীর অশ্রুআর্দ্র অধরোষ্ঠ! মালতী শিউরে উঠল না। অনাঘ্রাতা কুমারী কন্যা সে নয়। এ আস্বাদনে সে অভ্যস্তা—কিন্তু এ কার কাছ থেকে পেল ও? সেই নরম স্পর্শের চরম পুলকে, পরম আনন্দে সে যেন অবশ হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে রূপেন্দ্রর বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে শান্তচরণে এগিয়ে গেল নিষ্ক্রমণ দ্বারের দিকে। কোনও কথা না বলে।

—মালতী!

দূর দ্বারপ্রান্তে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বলে, না! আর না। যা পেয়েছি তা আমার অমূল্য সম্পদ। এর বেশি আমার সহ্য হবে না। আর ডেক না আমাকে।

—সে কথা বলছি না। মালতী। এবার আমার একটা অনুরোধ তুমি রাখবে? আমারও যে একটা ভিক্ষা আছে!

কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ে। রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্য তার মতো সামান্যার দ্বারে অর্থী? ভিক্ষা চাইছেন তিনি? তার কাছে? কণ্ঠে ওর স্বর ফুটল না। অবাক বিস্ময়ে তার ডাগর দুটি চোখ মেলে রূপেন্দ্রনাথের মুখে তাকায়। সে দৃষ্টি সপ্রশ্ন। সে দৃষ্টি বাঙ্ময়।

—বিদায়বেলায় তোমাকে যা দেবার দিয়েছি। কিন্তু আমার আর এক অতিথিকে? তাকে যে কিছুই দিতে পারলাম না? খালি হাতে সে যে আজ ফিরে যাচ্ছে!

আবেশের ঘোর এখনও কাটেনি। প্রাপ্তির আনন্দে বোধকার সে এখনও তন্ময়, তাই বুঝে উঠতে পারে না, উনি কী বলছেন, কার কথা বলছেন।

—তোমার অজাত সন্তানের নামকরণটুকু আমি করে দেব। সে যদি মামণির ছোট্ট বোনটি হয়ে দুনিয়াদারি করতে আসে তবে তার নাম দিও শ্যামামালতী’। আর যদি ভাই হয়ে আসে তবে তার নাম হবে : আত্মদীপ!

—আত্মদীপ!

—হ্যাঁ মালতী। শেষ বিদায়কালে কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরও এই অনুরোধটি করেছিলেন আমাকে। কিন্তু ‘আত্মদীপ’ সেবার আসেনি। যদি এবার আসে তবে তাকে ওই নামে ডেকো।

মালতী এতক্ষণে সহজ হয়েছে, স্বাভাবিক হয়েছে। কেন হবে না? তার নারীত্ব, তার একান্ত গোপন প্রেমকে তো ওই বজ্রকঠিন পণ্ডিতটি স্বীকৃতি দিয়েছেন! তবে আর সংকোচ কীসের? বলে, তাই হবে! তোমার দেওয়া নামে তাকে যতবার ডাকব ততবারই মনে পড়ে যাবে তোমার কথা। আর এই শেষ বিদায়ের মুহূর্তে যে আশাতীত প্রাপ্তি আঁচলের খুঁটে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছি তার স্মৃতি। কিন্তু তুমি তো ওটা সঠিক বললে না গো! তোমার বন্ধুর অজাত-অতিথিকেও তুমি দিয়েছ কিছু সামান্য সম্পদ!

দিয়েছি? আমি? সামান্য সম্পদ! কী সেটা?

—ওর ছোট্ট জীবন। আত্মঘাতিনী রাক্ষসী-মায়ের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করেছ তোমার ‘নিরঞ্জন’ ভালোবাসায়।

২৫

কয়েক বৎসর পরের কথা। যাবনিক বিচারে 1753 খ্রিস্টাব্দ। এই কয়বছরে নবাব আলিবর্দি আরও বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। হেঁদুদের জন্য কোরানের বঙ্গানুবাদ অথবা মুসলমানদের জন্য রামায়ণের ফার্সি অনুবাদের খোয়াব অনেকদিন হল ঘুচে গেছে। এখন তিনি তাঁর মসনদ-প্রত্যাশী লোভাতুর দামাদ বাবাজিদের ষড়যন্ত্রজাল থেকে দৌহিত্রকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে দামোদর দিয়ে অনেক অনেক জল বয়ে গেছে। সমাজপতি দুর্গা গাঙ্গুলী মশাই এতদিনে নিশ্চয় বৈকুণ্ঠলোকে দেবতাদের মধ্যে তেজারতি কারবার খুলে বসার উদ্যোগ করছেন। গিরিপিসিমাও দেহ রেখেছেন।

আমাদের কাহিনির নায়িকা দশম বর্ষে উপনীতা। তার বাল্যসঙ্গী শুভপ্রসন্ন এখন চতুর্দশবর্ষীয় কিশোর। দুজনেই ব্যাকরণ এবং তর্কশাস্ত্রপাঠ শেষ করেছে। রূপেন্দ্রনাথের ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যালয়ে’ উপাধিদানের প্রথা নেই। তবে ছাত্র-ছাত্রীরা পরবর্তী পর্যায়ের পাঠের আসরে যোগদানের অধিকার পায়। সে বিদ্যালয়ে এখন একটিই ছাত্রী–কিশোরী হটী। একটিই ছাত্র—তারাপ্রসন্নের একমাত্র উত্তরাধিকারী। দুই বৎসর পূর্বে তার উপনয়ন হয়েছে। সে এখন উপবীতধারী সদ্য-ব্রাহ্মণ। সে শুভকার্যেও কিছু গণ্ডগোলের উপক্রম হয়েছিল। শুভ বায়না ধরেছিল সে মাথা মুড়িয়ে ‘বটু’ সাজতে রাজি যদি তার দীক্ষা-আচার্য হন রূপেন্দ্রনাথ। তাকে সবাই মিলে অনেক বুঝিয়েছিল যে, রূপেন্দ্রনাথ ভিন্ন গোত্রের—উপবীত গ্রন্থিদানের সময়ে গোত্রের আদিপুরুষের নামোচ্চারণ করে বলতে হয় ‘অমুক গোত্রস্য’। কিন্তু রূপেন্দ্রের বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন পাঠ করে শুভ রীতিমতো একবগ্গা হয়ে উঠেছে। তারাপ্রসন্ন বাধ্য হয়ে বন্দ্যোঘটিকেই আচার্য হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। উপবীতে গ্রন্থিদানের সময় ঔর্ব, চ্যবন, অত্রি, অঙ্গিরা, জমদগ্নি, ঠিক কার যে স্মরণ নিতে হবে সেটা স্বগোত্রের এক ব্রাহ্মণ যথাবিহিত কাঞ্চনমূল্যে শুভর কর্ণমূলে বলে দিয়েছিলেন।

একয় বৎসর রূপেন্দ্রর সংসারযাত্রা কীভাবে নির্বাহ হল? গৃহিণীহীন গৃহে?

শিবনাথও এতদিনে একবগ্গা। বারণ করলেও কর্ণপাত করে না, তাড়ালেও ফিরে আসে। প্রতি রাত্রে দাওয়ায় তার মাদুরটা বিছিয়ে মশারি টাঙিয়ে শয়ন করে : রাত-বিরেতে রোগিবাড়ি থেকে যদি বাবামশাইয়ের ডাক আসে তাহলে মামণি একা পড়ে যাবে না? ভয় পাবে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *