রূপমঞ্জরীর বিদ্যারম্ভ – দশম পৰ্ব

রূপমঞ্জরীর বিদ্যারম্ভ – দশম পৰ্ব

বৈশাখের শেষ সপ্তাহ। মেঘরাশিস্থে ভাস্করে, শুক্লে পক্ষে, তৃতীয়াং তিথৌ। অর্থাৎ পুণ্যাহ : অক্ষয় তৃতীয়া। সময়কালটা আজ থেকে প্রায় আড়াই শ বছর অতীতের। সঠিক হিসাবে এগারো শ’ পঞ্চান্ন বঙ্গাব্দ। যাবনিক বিচারে ক্রিস্টিয় 1748 সাল।

রঘুনন্দনের মতানুসারে এই পুণ্যাহেই ভগীরথের প্রার্থনায় জহ্নু-তনয়া হিমালয় থেকে অবতরণ করেছিলেন গাঙ্গেয় মর্ত্যভূমে—সগরপুত্রদের উদ্ধার করতে। শুধু তাই নয়, এই অক্ষয় তৃতীয়াতেই শুরু হয়েছিল বর্তমান কল্পের সত্যযুগ।

বর্ধমানভুক্তির একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম : সোঞাই। দামোদর নদের সমান্তরালে বিস্তৃত। ভদ্রপল্লী সবই দক্ষিণ তটে; ওপারে—উত্তরপাড়ে, জল-অচল অচ্ছুৎদের বাস। ঘননিবিড় গাছ গাছালির মধ্যে উলুখড়ের একচালা; কখনো বা দোচালা। মাটির দেওয়াল, কঞ্চির বেড়া। গ্রামের সীমানা—অস্তগামী সূর্যকে শ্রেষপ্রণাম জানাতে পশ্চিমে তেঁতুলবট; উদয়ভানুকে প্রথম প্রণাম জানাতে ভোলাবাবার মন্দিরের ধাতব ত্রিশূল। উত্তরে দামোদর নদ আর দক্ষিণে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেতের শেষ প্রান্ত।

এই গ্রামেরই মেয়ে আমাদের কাহিনীর প্রধানা চরিত্র : হটী বিদ্যালঙ্কার : রূপমঞ্জরী! যাঁর কথা শোনাব বলে এত আয়োজন, অথচ এখনো সেই গাঁয়ের মেয়ে গাঁয়েই এসে পৌঁছাননি। এবার আসছেন : এই দশম পর্বে! পিতৃহীন হতে।

সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকেই আজ দামোদরের ঘাটে স্নানার্থীদের ভিড়। জমিদারের অর্থানুকূল্যে চওড়া সোপানশ্রেণী নেমে গেছে জলে। মাঝখান দিয়ে দু ভাগ করা। একদিকে পুরুষদের ঘাট ভাঁটির দিকে; অপরদিকে, উজানে, স্ত্রীলোকদিগের স্নানঘাট। মাঝখানে ঘাটোয়াল লছমপ্রসাদের বিরাট গোলপাতার ‘ছত্র’। স্নানান্তে পুণ্যার্থীরা ঘনিয়ে আসে, পাণ্ডাজী প্রতিষ্ঠিত শিউজী মহারাজের মাথায় ফুল বেলপাতা চড়ায়। কমণ্ডলু থেকে গঙ্গোদক ঢেলে দেয় শিবের মাথায়—হ্যাঁ, এই অক্ষয় তৃতীয়ার পূণ্যদিনে দামোদরের জল গঙ্গাজলের মতো পবিত্র। স্নানার্থীরা দু-পাঁচ কড়ি প্রণামীও দেয়। পরিবর্তে কপালে নেয় চন্দনছাপ, শ্বেতচন্দনের মাঙ্গলিক চিহ্ন। গ্রহণ করে চরণামৃত, প্রাসাদী ফুল ও পেঁড়া।

পুরুষদের ঘাটে পুণ্যস্নান করছিলেন গ্রাম্য জমিদার তারাপ্রসন্ন ভাদুড়ী। বয়স দেড় কুড়ির কাছাকাছি। সঙ্গে তাঁর বালকপুত্র-বংশের সম্ভাবনাময় সন্তান। তার বয়স আট বৎসর। নাম : শুভপ্রসন্ন। শুভ্রের স্নান ও ঝাপাইজোড়া শেষ হয়েছে। ভিজা কাপড় ভৃত্য কালিপদকে দিয়ে, কাচা কাপড় পরে সে উঠে গেছে পাণ্ডাজীর ছত্রছায়ায়। হাঁটু গেড়ে বসেছে ললাটে কৃষণজীর আশীর্বাদ চরণছাপ নিতে। তারাপ্রসন্ন দামোদর নদে আবক্ষ নিমজ্জিত অবস্থায় বাল্মীকি বিরচিত গঙ্গাষ্টকং আবৃত্তি করছিলেন : “মাতঃ শৈলসুতাসপত্নি বসুধাশৃঙ্গারহারাবলি স্বর্গারোহণ- বৈজয়ন্তি ভগবতীং ভাগীরথীং প্রার্থায়…”

আদিকবি বাল্মীকি-বিরচিত এই গঙ্গাস্তোত্র, কী ছন্দে, কী সমাসবদ্ধতায় বেশ কঠিন। আর-সকলেই সেজন্য অবগাহনস্নানকালে যে গঙ্গাস্তব আবৃত্তি করে তা আদি শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য- বিরচিত, অতি পরিচিত “দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি গঙ্গে।” কিন্তু তারাপ্রসন্নের স্বর্গগত পিতৃদেব ছিলেন বিচিত্র মেজাজের মানুষ। গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসাতে গররাজি। সব বিষয়েই। এমনকি গৃহাবরোধের ভিতর জীবনসঙ্গিনীকে সংস্কৃত শিখিয়ে দুজনে শৃঙ্গারসের আস্বাদন করতেন। কালিদাস, ভবভূতি, ভাস-এর সঙ্গী হয়ে। তাই শৈশবেই পুত্রকে কণ্ঠস্থ করিয়েছিলেন বাল্মীকি-বিরচিত এই বিচিত্র গঙ্গাস্তবটি।

আগেই বলেছি, বর্ধমানভূমির জনগণের বিশ্বাস : অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যাহে দামোদরের জলও মা-গঙ্গার জলের মতো পবিত্র হয়ে ওঠে! এই ধারণাটা এসেছে অজয়নদ-তীরবর্তী গ্রামবাসীদের বিশ্বাস থেকে। গঙ্গা নাকি কালনা-কাটোয়া থেকে উজানে অজয় তীরবর্তী গ্রামে ঐ পুণ্যাহে আগমন করেন। দামোদরে তা হওয়ার উপায় নেই। দামোদর গঙ্গায় পাড়েনি। কিন্তু সে যুক্তি মানতে চায় না… দামোদরের তীরবর্তী গ্রামের মানুষজন। আর মানেই বা কী করে? মনকে কিছু একটা বুঝ দিতে হবে তো!

তারাপ্রসন্নের সহসা নজর হল পুবদিক থেকে একটা প্রকাণ্ড মহাজনী গহনার-নৌকা পালের পর পাল তুলে শুভ্র রাজহংসের মতো ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে। যদিও নৌকাটি মাঝ-দরিয়ায় এবং এই বৈশাখের শেষ সপ্তাহে দামোদর নদ শীর্ণকায়, তবু বড় বড় ঢেউ এসে ভাঙছে পাড়ে। ছোট-খাটো ডিঙিতে সামাল সামাল রব উঠেছে। ঘাট থেকে যারা সাঁতরে মাঝনদে চলে গিয়েছে তারা মজাসে ঢেউ খাচ্ছে। গহনার-নৌকা সচরাচর হয় বহুযাত্রীবাহী। মাল বহন করে না। এটি ঠিক তা নয়। এটিতে যাত্রী ব্যতিরেকে মালও বহন করা হয়। পাঠাতনের নিচে সার দেওয়া কলসি। গঙ্গাজলে পূর্ণ। উপরের ঐ ‘ওঁ’ লেখা গৈরিক নিশানটি দেখে সবাই চিনতে পেরেছে। এ-নৌকা একপক্ষে একবার করে নবদ্বীপ-কাটোয়া হয়ে এই সোঞাই পর্যন্ত আসে। আর একপক্ষে বাঁকা হয়ে চলে যায় শহর বর্ধমান। নৌকার মালিক বর্ধমানের ধনকুবের নগেন্দ্র দত্ত। বাঙলার নবাব আলিবর্দীর রাজ-সরকারের তরফে ইজারাদার। তারাপ্রসন্ন আরও জানেন, মাসে একবার এই নৌকায় আসে দুর্গা গাঙ্গুলীর ‘আগ- মার্কা’ গঙ্গাজল। দুর্গা এই সোঞাই গ্রামের একজন অত্যন্ত ধনী মহাজন। কুলীন, ব্রাহ্মণ, অর্থবান, ফলে সমাজের শিরোমণি। তাঁর কারবার দুই জাতের-তন্তুবায়-শোষণ এবং গঙ্গাজল বিতরণ। ওঁর বিশ্বাস, প্রথমটির সঞ্চিত পাপ দ্বিতীয়টির পুণ্যে ধুয়ে মুছে যায়। গঙ্গাজল ছাড়াও আসে লবণ। দুটিই গ্রামজীবনের আবশ্যিক উপাদান। লবণের নৌকা কিছু দেরী করে এলে তবু গ্রামের জীবনযাত্রা থেমে থাকবে না—বড় জোর আলুনি ব্যঞ্জনে অথবা কাঁচা-ফলারে গ্রামবাসী মানিয়ে নেবে; কিন্তু দুর্গা গাঙ্গুলী মশায়ের ‘ওঁ’-গঙ্গা ছাপ-মারা গঙ্গাজলের নৌকা যদি দেরী করে আসে তবে স্বয়ং ‘সূয্যিঠাউর মাঝ-আকাশে থাকে ভেঁড়িয়ে পড়বেন মনে লাগে।’

নৌকাখানি পারানি খেয়াঘাটের পাটাতনে এসে ভিড়ল। বড়-সারেঙ নামিয়ে দিল প্রকাণ্ড নোঙর, দামোদরের গর্ভে। তারপর অবতরণ করতে শুরু করল এক দিক দিয়ে গঙ্গাজলের কলসি, অন্য দিক দিয়ে যাত্রীরা।

হঠাৎ একটি চেনা-মানুষ দেখে চমকে উঠলেন ভাদুড়ী মশাই। মন্ত্রোচ্চরণ বন্ধ হয়ে গেল তাঁর : রুপো বন্দ্যঘটি নয়? হ্যাঁ, তাই তো! সঙ্গে একটি বছর-তিনেকের ফুটফুটে মেয়ে। টুকটুকে গায়ের রঙ, মাথায় বেড়া-বিনুনি। দলের সঙ্গে একজন বিধবা স্ত্রীলোক।

রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সোঞাই গাঁয়ের স্বনামধন্য কবিরাজ। আজ ছয় বছর প্রবাসে ছিলেন। জনশ্রুতি জগন্নাথধামেও গিয়েছিলেন। রওনা হন সস্ত্রীক, বিবাহের কয়েক মাস পরেই। তারপর দীর্ঘ ছয় বৎসর পরে আজ পুণ্যাহের দিনে গ্রামে ফিরে আসছেন।

কিন্তু…

রুপোর সঙ্গে ঐ বিগতভর্তা ভদ্রমহিলাটি কে? শাদা থান, আবক্ষ অবগুণ্ঠন। মুখখানি তাই দেখা যাচ্ছে না। সম্পূর্ণ নিরাভরণা, দুটি শ্যামবর্ণের সুডৌল বাহু। আন্দাজে তারাপ্রসন্নের মনের হল, বয়স এক কুড়ির এপারে-ওপারে। প্রায় চার বছর পূর্বেই দুঃসংবাদটি পেয়েছিলেন,—পিতৃগৃহে একটি কন্যাসন্তানকে প্রসব করে রূপেন্দ্রনাথের সদ্যোবিবাহিতা স্ত্রী কুসুমমঞ্জরী স্বর্গলাভ করেছেন। সুতরাং ঐ কুন্দ ফুলের মতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটি—ঐ যে বাপের হাত ধরে সাবধানে নৌকা থেকে নেমে আসছে—সে নিঃসন্দেহে কুসুমমঞ্জরীর মাতৃহীনা আত্মজা। কিন্তু ঐ অপরিচিতা বিধবাটি? শ্যামাঙ্গী যুবতীটি? কে উনি?

চকিতে আরও একটা কথা স্মরণে এল তাঁর…!

—আঃ! ছি, ছি, ছি! আজ এই অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যাহে অমন একটা বিশ্রী কথা যেন ভেসে এল স্মরণপথে? পরক্ষণেই নিজের মনকে ধিক্কার দেন : না। উনি মীনু-খুড়িমা নন! হতে পারেন না। দুর্গা-খুড়ো তো বহাল তবিয়ৎ! এ তো বিধবা! তবে কি দুর্গা খুড়োও ফৌত হয়েছেন ইতিমধ্যে?

পায়ে পায়ে তারাপ্রসন্ন এগিয়ে এলেন পারানি ঘাটের কাছে। ছোট মেয়েটি তখন শক্ত ডাঙায়। ওদের মালপত্র, বাক্স-প্যাঁটরা, পুঁটুলিও নেমেছে। এখন রূপেন্দ্রনাথ ঐ যৌবনবতী বিধবাটির নিরাভরণ বামমণিবন্ধটি দৃঢ়মুষ্ঠিতে ধরে অবতরণ করছিলেন। নৌকোর উপর থেকে কর্দমপিচ্ছিল ঘাটে।

: আস্তে, আস্তে, বৌঠান, খুব পিছল আছে কিন্তু…

শক্ত জমিতে পা পড়তে সে পায়ে নেই অলক্তক-চিহ্ন, কিংবা রূপার চুটকি- রূপেন্দ্রনাথ ওঁর মণিবন্ধকে মুক্তি দিলেন। ঘুরে দাঁড়াতেই চোখাচোখি হয়ে গেল তারাপ্রসন্নর সঙ্গে।

: তারাদা না?

এগিয়ে আসেন প্রণাম করতে। তারাপ্রসন্ন বাধা দিলেন। বুকে টেনে নিলেন আগন্তুককে। বলেন, তুমি আমার চেয়ে মাত্র চার বছরের ছোট, রুপেন। তুমি সেদিক থেমে আমার বয়স স্থানীয়। তারপর? এতদিনে সোঞাই মায়ের কথা মনে পড়ল? কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে গো তোমার?

ছয় বছর আগে সদ্যোবিবাহিত রূপেন্দ্রনাথ যখন সস্ত্রীক তীর্থদর্শনে যাত্রা করেন তখন তাঁর ভ্রূযুগলের উপর বিঘৎ-খানেক ছিল সযত্নে ক্ষৌরিকৃত। মাথার পিছন দিকে গুচ্ছবদ্ধ অর্কফলায় রক্তকরবী অনুবিদ্ধ। ক্ষৌরিকৃত ওষ্ঠলোম ও শ্মশ্রু। ললাট চন্দনচর্চিত, পরিধানে ফসারিডাঙার মিহি-বুনটের পৌনধনু* গিলে-করা ধুতি।

[* এক ধনু = 60 ইঞ্চি; ফলে পৌনধনু = 45” = 1143 মি. মি.]

আর আজ যখন গ্রামের ছেলে গাঁয়ে ফিরে এল তখন তার একমাথা তৈলভূষিত ঘনকৃষ্ণ কেশদাম। শ্মশ্রু ও ওষ্ঠলোমে অমন সুন্দর মুখখানা পূর্ণগ্রাস চন্দ্রের মতো আবৃত। পরিধানে অর্ধধনু মলিন বস্ত্ৰ—হাঁটু ঢাকেনি তাতে। ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ, যদি সামবেদী দীর্ঘ উপবীতটিকে অঙ্গাবরণ বলে গণ্য করা না হয়। বলা বাহুল্য : নগ্নপদ।

রূপেন্দ্রনাথ সে-কথার প্রত্যুত্তর না করে বলেন, এটি তো শুভ? হ্যাঁরে : তুই তো মস্ত বড় হয়ে গেছিস!

শুভপ্রসন্ন পাণ্ডাজীর হাত ফসকিয়ে ঘনিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে পারানি ঘাটে। সেও চিনতে পেরেছে রূপেন-খুড়োকে। এগিয়ে এসে প্রণাম করল—বয়ঃজ্যেষ্ঠ তিনজনকেই। বিধবা কিছু না বুঝেই ছেলেটিকে কাছে টেনে নিলেন।

রূপেন্দ্রনাথের লক্ষ্য হল, তাঁর কন্যাটি শিষ্টাচারসম্মত প্রণাম করতে এগিয়ে এল না। দোষ তার নয়, এ-শিক্ষা সে পায়নি এতদিন। তাই তাকে বললেন, এঁকে প্রণাম কর, সোনা-মা!

মেয়েটির পরিধানে দাদামশায়ের দেওয়া রক্তিম রেশম্ভবস্ত্র। দু-হাতে দু-গাছি করে আয়নামোর সোনার চুড়ি। নাকে নোলক, কানে পাৎলা ঢেঁড়ি-ঝুমকো; আর বিনা-কাজলে কাজলকালো অতলান্ত দুটি হরিণ নয়নে অপার বিস্ময়। পিতার আদেশে সে এগিয়ে এল। বোঝা গেল, মেয়েটি বুদ্ধিমতী—কেউ শেখায়নি, কিন্তু শুভপ্রসন্নের অনুকরণে সে শুধু তারাপ্রসন্নকে প্রণাম করেই থামল না—অপর দুজনকেও পদস্পর্শ করে প্রণাম করল।

শুভপ্রসন্ন বললে, এই মেয়েটা, ভেলভেলেটা! তুই আমাকে প্রণাম করলি নে যে? চার বছরের বালিকাটি এতদিনে দাসদাসীদের কাছে যে ভাষা শিখেছে সেই ভাষাতেই বললে, ওমা, আমি কনে যাব! তুমি কি বাঁউন? তোমার গলায় কি পৈতে আছে?

রূপেন্দ্রনাথ মর্মাহত হলেন। কন্যার ভাষায়, তার বাচনভঙ্গিতে। কিন্তু দোষ তো তাঁরই। অনাদৃতা আত্মজার শিক্ষার কোনও ব্যবস্থাই হয়নি এতদিন।

জবাবে শুভপ্রসন্ন কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিলেন তারাপ্রসন্ন : ছিঃ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অমন ঝগড়া করে না!

তারপর রূপেন্দ্রনাথের দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, এঁকে তো ঠিক….

গ্রামে পদার্পণমাত্র এই অনিবার্য প্রশ্নটির সম্মুখীন যে হতে হবে, এ-কথা জানা ছিল। ওঁর ভদ্রাসন এখন জনমানবহীন। সেই জীর্ণকুটিরে একজন যৌবনবতী বিধবাকে নিয়ে এক বিপত্নিকের পক্ষে বাস করাটা সমাজ মেনে নেবে না। ওঁর গুরুদেব জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ও এযুক্তি দেখিয়েছিলেন। মালতীও বলেছিল। কিন্তু একবগ্গা ঠাকুর কারও পরামর্শে কর্ণপাত করেননি। এখন লক্ষ্য হল, মালতী মরমে মরে গিয়ে দামোদরের স্রোতধারার দিকে তাকিয়ে প্রস্তরমূর্তির মতো পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, উনি আমার বৌঠান।

—বৌঠান! তোমার কোন বড় ভাইয়ের কথা তো কখনো শুনিনি?

—না, তারাদা, রক্তের সম্পর্ক নেই। এঁর স্বামী ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের মতো। আমার গুরুদেবের নিজের ভাগিনেয়—মহাপণ্ডিত ছিলেন তিনি : ঘনশ্যাম সার্বভৌম। সম্প্রতি লোকান্তরিত হয়েছেন। তাই নিয়ে এলাম। উনি এ গাঁয়েই থাকবেন।

তারাপ্রসন্নের কৌতূহল এতক্ষণে বিস্ময়ে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। বলেন, বল কী রূপেন! ত্রিবেণীর মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ভাগিনেয়? পণ্ডিতমশায়ের প্রকাণ্ড ভদ্রাসনে এঁর স্থানসঙ্কুলান হল না? শুনেছি, তর্কপঞ্চাননের সর্বতোভদ্রে প্রতিবেলায় শতাধিক কলাপাতা পড়ে!

রূপেন্দ্র বলেন, ঠিকই শুনেছ, তারাদা। এর ভিতরে অনেক কথা আছে। মাঝ-সড়কে দাঁড়িয়ে তা আলোচনা না করলেও চলবে। বলব তোমাকে সব কথা। জ্যেঠামশাই কেমন আছেন?

—বাবামশাই? ও! তুমি তো কিছুই জান না। তিনি আজ দু-বছর হল গোলকে গেছেন। আগামী শ্রাবণী শুক্লা দ্বাদশীতে তাঁর তৃতীয়-বার্ষিক শ্রাদ্ধ।

—বল কি! জ্যেঠামশাই নেই!

মর্মাহত হলেন রূপেন্দ্রনাথ। সমগ্র গৌড়বঙ্গে ঐ একটি মানুষকে নিশ্চিতভাবে স্বপক্ষে পাবেন, এই আশা ছিল মনে। বর্ধমানরাজ নয়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নয়, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ও নয়—সোঞাই গাঁয়ের সেই আধুনিকমন জমিদারটিই ছিলেন তাঁর অবচেতন মনের একমাত্র ভরসা। মুহূর্তমধ্যে যেন মনে হল, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। গ্রাম্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রূপেন্দ্রনাথের বিদ্রোহে তাহলে কে হবে সহায়? তারাপ্রসন্ন স্বভাবতই নির্বিরোধী–এবং প্রাচীনপন্থী।

জানতে চাইলেন, আর জেঠিমা?

—বাবামশায়ের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ পর্যন্ত তিনি গ্রামেই ছিলেন। তারপর বায়না ধরলেন, কাশীবাসী হবেন। তুমি তো জানই, কাশীর চৌষট্টিযোগিনী ঘাটে গঙ্গার উপর আমাদের একটি মোকাম আছে। এখন তিনি সেখানেই আছেন। স্বপাক আহার করেন, গঙ্গাস্নান করেন আর মন্দিরে মন্দিরে পূজা দিয়ে বেড়ান।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল রূপেন্দ্রের। হঠাৎ বলে বসলেন, “নিয়তি কেন বাধ্যতে?”

তারাপ্রসন্ন ম্লান হেসে বললেন, মনে আছে সে-কথা? তোমার ঐ প্রশ্নের জবাবে মা একদিন বলেছিলেন, ‘মনসা’!

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, জপের মন্ত্র কি ভোলা যায়?

শুভপ্রসন্নের শিক্ষারম্ভ হয়েছে। শিক্ষা বলতে সংস্কৃত। সে জানতে চায় : ও-কথার মানে কি, বাবামশাই?

তারাপ্রসন্ন বুঝিয়ে দেন, ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে?’ মানে, ‘নিয়তিকে কে বাধা দিতে পারে?’ প্রশ্নের মধ্যেই রয়েছে উত্তর : অর্থাৎ নিয়তি অপ্রতিরোধ্য! কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। তোমার ঠাকুমা তা মানতে চাননি। তাই তোমার ঠাম্মা বলেছিলেন : ‘মনসা’! অর্থাৎ ‘মনের জোর!

বালক প্রশ্ন করে, মনের জোরে ভাগ্যলেখা বদলানো যায়?

রূপেন্দ্র বলেন : যায় শুভ! তোমার পিতামহী তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। আমাকে মনে করিয়ে দিও, সে গল্প একদিন তোমাকে শোনাব।

মেয়েটি বাবার ধুতির খুঁট ধরে টানে : চলুন না?

তারাপ্রসন্ন নিম্নকণ্ঠে বললেন, একটা কথা রুপেন! তুমি ঠিক কথাই বলেছ—মাঝ- সড়কে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চলে না। কিন্তু জরুরী কথাটাকে তো চাপা দেওয়াও চলে না, ভাই। সোঞাই গ্রামখানি তোমার অচেনা নয়। খরজিহ্ব সমাজপতিরা ছিদ্রান্বেষণের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তোমার পৈত্রিক ভদ্রাসনটির বর্তমান অবস্থা যে কী, তা তোমার অজানা। আমি জানি। সেখানে এখনই তোমাদের পক্ষে আশ্রয় পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তোমাদের পুবের ঘরখানা ভেঙে পড়েছে, উত্তরের ঘরখানিও বাসোপযোগী নয়। শুধু ঐ দক্ষিণ দুয়ারী ঘরখানি এখনো খাড়া আছে। ভাঙা চালার নিচে জানলা-দরজা এখনও চাপা পড়ে আছে, চুরি হয়ে যায়নি! নেহাত বামুনের বাড়ি বলে। …শোন, রুপেন। আমার পালকি ঘাটেই অপেক্ষায় আছে। আমাদের নিয়ে এসেছিল। তাতে চেপে ছেলে-মেয়ে দুটিকে সঙ্গে নিয়ে বৌঠান বরং আমাদের বাড়িতে চলে যান। শুভপ্রসন্ন ওঁদের নিয়ে যাবে তার মায়ের কাছে। ইতিমধ্যে তুমি আর আমি পদব্রজে সেখানে পৌঁছে যাব। ত্রিরাত্রি না হয় আমাদের বাড়িতেই অতিথি হলে। মানে, যতদিন না তোমার ভিটেখানি বাসোপযোগী করে তোলা যায়।

রূপেন্দ্র তাঁর ঝাঁকড়া চুলে ভর্তি মাথাটা নেড়ে বললেন, তা হয় না, তারাদা। এটা যদি সোঞাই গাঁ না হত, তাহলে ত্রিরাত্রি কেন মাসাধিক কাল সানন্দে তোমাদের বাড়িতে পড়ে থাকতাম। কিন্তু গাঁয়ের ছেলে গাঁয়ে ফিরে যদি ধুলো-পায়ে প্রথমে বাস্তুদর্শনে না যায়, তাহলে স্বর্গে পিতৃপুরুষের অভিমান হয়। সবার আগে সেই ভাঙাভিটার চৌকাঠে মাথা ঠেকাবার অনুমতিটা আমাকে দিতে হবে তারাদা।

এই সময় একজন অল্পবয়সী জোয়ান এগিয়ে এসে দণ্ডবৎ হল। রূপেন্দ্রকে জিজ্ঞেস্ করল, পেন্নাম হই দা-ঠাউর! বাস্ক-প্যাঁটরা গুলান মাতায় করি আপনার ঠেয়ে নে-যাব দ্যাতা?

রূপেন্দ্র বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না, ভাই? এ-গাঁয়ের ছেলে? কী নাম গো তোমার?

—আজ্ঞে মোরা জেতে তাঁতি—মোর নামটো লবা গুই এজ্ঞে। জল-অচল নই! মালপত্তর ছুঁলি পরে…

রূপেন্দ্র রুখে ওঠেন, তোমার জাতি জানতে চেয়েছি আমি? বোকা কোথাকার! ঠিক আছে, মাল তোলো। আর শোনো—তোমার নামটা ‘লবা’ নয়, ‘নবা’! ভাল নাম নবীন, বুঝলে?

লোকটা প্রচণ্ড মাথা ঝাঁকানি দিয়ে প্রতিবাদ করে, এজ্ঞে না, ঠাউরমশাই, বোঝলাম না! বোকা হই, মুক্ষু হই, মোর নামটো ‘লবা’।

তারাপ্রসন্ন ধমকে ওঠেন, একটি চড়ে তোর মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেব, লবা! তুই জানিস্ কার সঙ্গে তর্ক করছিস্? উনি কত বড় পণ্ডিত তা জানিস?

লোকটা বাক্স-প্যাঁটরা মাথায় ওঠাতে শুরু করেছিল। বললে, সে-কতা তো বলচিনি। বলচি কি মোর নামটো মুই জানবনি, পণ্ডিতে এসে বিধান দিলি জান্তে পারব? সেই ন্যাংটো বয়স থিকে সবাই মোরে ডাকে ‘লবা’! আপনের ঐ বিরাশিশিকে চড়ে বাপের নামটো ভুলতি পারি, কিন্তুক নিজের নামটো ভুলি ক্যামনে?

তারাপ্রসন্ন বিরক্ত হয়ে বলেন, তুই বড় তর্ক করিস লবা। নে চল!

কোথাও কিছু নেই খিলখিল করে হেসে ওঠে রূপমঞ্জরী।

তারাপ্রসন্ন তার দিকে ফেরেন। বলেন, তোমার আবার কী হল? এত হাসি কিসের?

ছোট্ট মেয়েটি বললে, আপনি অরে গালমন্দ করছেন বটে, কিন্তু প্রিতিবারই ডাকছেন ‘লবা’ নামে, ‘নবা’ নয়।

তারাপ্রসন্ন অবাক হলেন। রূপেন্দ্রনাথের দিকে ফিরে বললেন, ভায়া, তোমার এ-মেয়ে কালে তর্কালঙ্কার হবে।

নেহাৎ রসিকতা। কিন্তু স্বগ্রামে পদার্পণমাত্র ভবিষ্যৎ-মহাপণ্ডিতা হটী শুনলেন এক অত্যাশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী। না ‘তর্কালঙ্কার’ উনি হননি—হয়েছিলেন ‘বিদ্যালঙ্কার’। বোধকরি ভারতভূখণ্ডে উপাধিদানপ্রথা প্রচলিত হবার পর প্রথম মহিলা ‘বিদ্যালঙ্কার’। কিন্তু সে সম্ভাবনার কথা এ রসিকতার ভিতর বাষ্পমাত্রও ছিল না। বিস্মিত হয়েছিলেন রূপেন্দ্রনাথও। আশ্চর্য! তারাপ্রসন্নের যুক্তি যে স্বয়ংবিরোধী এটা তো তাঁর নিজেরও খেয়াল হয়নি! অথচ ঐ এক ফোঁটা মেয়েটা নজর করেছে!

তারাপ্রসন্ন শুভকে প্রশ্ন করেন, রুপেন খুড়োর ভিটেটা চিনিস তো? তোরা তিনজনে পাল্কিতে রওনা দে, আমরা পায়ে হেঁটে আসছি।

মালতী পাল্কিতে ওঠার আগে স্পর্শ বাঁচানো একটি প্রণাম করল তারাপ্রসন্নকে পাল্কিবাহকেরাও দেখাদেখি প্রণাম করল রূপেন্দ্র, মালতী ও মালিককে। সর্দার পাল্কিবাহক বলে, ছুটকর্তারে চিনাতে হবে কেন গো, কর্তামশাই? ধন্বন্তরি-বাবাঠাউয়ের ভিটে না চিনে কুন সুম্বুদ্ধির পো?

শুভপ্রসন্ন আর রূপমঞ্জরীকে উঠিয়ে নিয়ে মালতী রওনা দিল পাল্কিতে। পিছন-পিছন ভিজে-কাপড় নিয়ে অনুগমন করল নীরবকর্মী কালিপদ। নবা-ই হোক অথবা ‘লবা’, বাক্স—প্যাঁটরা মাথায় নিয়ে চল্ল পাল্কির পিছু-পিছু। রূপেন্দ্র চলবার উপক্রম করতেই তাঁর হাতখানা চেপে ধরলেন তারাপ্রসন্ন। রূপেন্দ্র আন্দাজ করলেন হেতুটা। তবু বললেন, কী হল আবার?

—অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে এমন একটা দুঃসাহসিক কাজ করা কি ঠিক হবে রুপেন? সমাজ এটা কিছুতেই মেনে নেবে না। নিতে পারে না।

—কেন? আমরা অন্যায় তো কিছু করছি না। আমার যদি নিজের বড় ভাই থাকতেন, তাহলে তাঁর বিধবা…

—কী হলে কী হত সে আলোচনা থাক। জগু-পিসিমা অথবা কাত্যায়নী যদি তোমার ভিটায় থাকতেন তাহলে আমি আপত্তি করতাম না—

—তোমারও আপত্তি? সমাজপতি হিসাবে? জ্যাঠামশাই নেই বলে?

—তারাপ্রসন্ন মাথা নেড়ে বললেন, জিদ্দিবাজি কর না, একবগ্গা! এ হয় না, হতে পারে না। নিঃসম্পর্কীয় দুটি মানুষ—একজন ত্রিশবছরের বিপত্নিক যুবাপুরুষ, অপরজন বিংশতিবর্ষীয়া বিধবা—অন্য প্রাপ্তবয়স্কার অনুপস্থিতিতে এক ঘরে রাত কাটাতে পারে না। তুমি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি কি না সে প্রশ্ন অবান্তর। নবাবী ফতোয়ার মতো, সামাজিক আইনও ব্যক্তি বিশেষের চারিত্রিক দোষগুণে পরিবর্তিত হতে পারে না।

রূপেন্দ্র বললেন, আমি নিরুপায়, তারাদা। তুমি ব্রাহ্মীলিপি পড়তে পার?

—ব্রাহ্মীলিপি? সেই অশোকের অনুশাসন যে ভাষায় লেখা হত? না, পারি না। তা এর মধ্যে হঠাৎ ব্রাহ্মীলিপির প্রসঙ্গ এল কেন?

—বলব, তারাদা; সবকথা তোমাকে বুঝিয়ে বলব। আমি নিরুপায়। সমাজ যদি আমাকে একঘরে করে, শাস্তি দেয়, আমি ভ্রূক্ষেপ করি না। এটুকু তোমাকে বলি : ওঁর স্বামী ঘনশ্যাম সার্বভৌম ছিলেন এক অলোকসামান্য মহাপণ্ডিত। মৃত্যুকালে আমাকেই অনুরোধ করে গেছেন তাঁর বিধবাকে আশ্রয় দিতে। বৌঠানের পিতৃকূল-মাতৃকূলে কোথাও ঠাঁই হবে না। আমার গুরুদেবের আশ্রয়েও উনি থাকতে রাজি হলেন না, বিশেষ হেতুতে—বস্তুত বৌঠানের ধারণা ঘনশ্যামের মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার গুরুদেব। তাই প্রচণ্ড অভিমান হয়েছে ওঁর। ভেবে দেখ, তারাদা—আমি বিপত্নিক, একটি মাতৃহারা চারবছরের শিশুকে নিয়ে গ্রামে নিজের ভিটেতে এসে উঠছি—এখানে কেউ নেই। পিসিমা নেই, কাত্যায়নী নেই। এক্ষেত্রে আমরা দুজন তো পরস্পরের সমস্যার সমাধানমাত্র। আমি ওঁকে জোগান দেব আশ্রয়, আহার্য, লজ্জানিবারণের বস্ত্র এবং নিরাপত্তা। বিনিময়ে বৌঠান আমার সংসারটা দেখবেন। সন্ধ্যাবেলায় আমার বাস্তুভিটায় তুলসীমূলে প্রদীপ দেবেন। আমার সন্তানকে মানুষ করবেন। এতে আপত্তির কী আছে?

—আপত্তি তোমাদের দুজনের বয়সে। আপত্তি তোমাদের বাড়িতে তৃতীয়ব্যক্তির অনুপস্থিতি। এমন সহজ কথাটা কেন বুঝছ না? তুমি কুলীন, বিপত্নিক, অত্যন্ত সুদর্শন, সুপাত্র…

—তাতে কী হল?

—কী আশ্চর্য! কেন বুঝছ না, রুপেন? এ-গাঁয়ে তোমাদের পাটি ঘরের এক কুড়ি অরক্ষণীয়া কুলীন কন্যার নাম আমি এখনি বলে দিতে পারি। তারা এবং তাদের অভিভাবকদের খরজিহ্বা লক্লক করে উঠবে না এমন মুখরোচক কেচ্ছায়?

—কেচ্ছায়?

—নিশ্চয়ই! একটিমাত্র ঘরে চারবছরের মেয়েটিকে নিয়ে তোমরা কীভাবে শয়ন করবে? বৌঠান কি মাটিতে শোবেন, না তুমি? না কি আর পাঁচটা সদ্যসন্তানগর্বিত দম্পতি যেমন সন্ধ্যারাতে বাচ্ছাটাকে মাঝখানে রেখে থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়ায়, আর তারপর…

—আঃ! থাম তুমি, তারাদা!

তারাপ্রসন্ন হেসে বলেন, তোমার ধমকে আমি না হয় থামলাম, বিশেষ আমি ভালকরেই চিনি একবগ্গা ঠাকুরকে। কিন্তু দুর্গা গাঙ্গুলী? ন্যায়রত্ন মশাই? সদু-জ্যাঠাইমা? শশাঙ্ক ঘোষাল? নন্দ চাটুজ্জে? এঁদের খরজিহ্বাকে তুমি থামিয়ে দিতে পারবে? তার চেয়ে এক কাজ কর। ঐ ওনাকে—ঘনশ্যাম সার্বভৌমের বিধবাকে—আমাদের বাড়িতে রেখে দিয়ে এস। তুমি যদি ওঁকে আশ্রয়, আহার্য, বস্ত্র এবং নিরাপত্তা দিতে পার, রুপেন, তাহলে বাপ-ঠাকুর্দার আশীর্বাদে আমিও তা দিতে পারি। উপরন্তু আমি ওঁকে আরও একটি দুর্লভ বস্তুর জোগান দিতে পারি, যা তুমি পার না–

—সেটা কী?

—খরজিহ্ব, কুৎসারটনাকারীর আক্রমণ থেকে মুক্তি। আমার স্ত্রী বর্তমান, তোমার তা নেই। অন্তত যতদিন না তোমার ভদ্রাসনে দু-খানি শয়নকক্ষ খাড়া করা যাচ্ছে ততদিন তুমি আমাকে বাধা দিও না, রুপেন। এই আমার শেষকথা।

রূপেন্দ্র সম্মত হলেন। বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু ঠিক ঐ কয়দিনই। বৌঠান না হলে মনে ভাবতে পারেন আমি তাঁকে গলগ্রহ মনে করছি। আর তাছাড়া আমার কন্যাকে মানুষ করা, আমাদের ভিটায় সন্ধ্যাদীপ জ্বালানো ইত্যাদি করবে কে? দেখছ না দাসদাসীদের মধ্যে মানুষ হয়ে আমার মেয়ের মুখের ভাষাটা কী বিশ্রি হয়ে গেছে?

চলতে শুরু করেছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। হঠাৎ তারাপ্রসন্ন আবার ওঁর হাতটা চেপে ধরেন : ভাল কথা মনে পড়ে গেল! এট্টু এদিকে সরে এস তো। একটা গোপন কথা আছে। ভ্রূকুঞ্চন হয় রূপেন্দ্রনাথের। বিনাবাক্যব্যয়ে সড়ক ছেড়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দুজনে সরে আসেন। তারাপ্রসন্ন বললেন, আর একটি বিষয়ে তোমাকে সাবধান করে দেওয়া প্রয়োজন। হয়তো এ গ্রাম্য রটনাটার বিষয়ে তুমি এখনো কিছু জান না। যে-কোন সময়ে যে-কোন দিন থেকে অতর্কিত আক্রমণ আসতে পারে। তাই সতর্ক করা—

—রটনা! কী বিষয়ে রটনা?

—গেল বছর অঘ্রানমাসে গাঙ্গুলী-খুড়ো সস্ত্রীক পুরীধামে তীর্থ করতে গেছিলেন। প্রায় ছয়মাস পরে গাঁয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু একা! একা কেন? সবাই শুধায়, খুড়ো রা কাটে না। প্রথম কিছুদিন কাউকেই কিছু বলেনি। পীতুখুড়ো—মানে মীনুর বাবা গিয়েছিল জিজ্ঞেস করতে। দুর্গা খুড়ো তাকে মারতে বাকি রেখেছে। তারপর সে ধীরে ধীরে নানা মজলিসে নানান গুজব ছড়াতে থাকে। কখনো বলে, ‘আমার পোড়া কপাল’, কখনো বলে, ‘সে আবাগীর কপালে স্বর্গসুখ সইবে কেন?’ আবার কখনো বা জুৎসই সঙ্গী পেলে বলে, ‘সে কলঙ্কের কথা আর শুনতে চেও না ভায়া, আরে ছ্যা ছ্যা ছ্যা!’ কার মাধ্যমে কী-করে কথাটা প্রথম রটল জানি না, একদিন দেখা গেল গাঁ-শুদ্ধ লোক জেনে গেছে যে, তীর্থযাত্রীদলের সঙ্গে তোমার নাকি আচমকা দেখা হয়ে গেছিল! সত্যি কথা?

—হ্যাঁ! নিতান্ত ঘটনাচক্রে। ফরাসীডাঙার ঘাটে। বর্ধমানের ইজারাদার নগেন দত্ত আমাকে হঠাৎ ঘাটে বসে থাকতে দেখেন। চিনতে পারেন। নৌকায় তুলে নেন!

—তাহলে রটনাটা সত্যি! তুমি ঐ তীর্থযাত্রী দলের সঙ্গে শ্রীজগন্নাথ ক্ষেত্রে এক বজরায় গেছিলে?

—হ্যাঁ সত্যি। তাতে কী হল?

—নগেন দত্তের স্ত্রীর চিকিৎসা করেছিলে তুমি?

—হ্যাঁ, করেছিলাম। কিন্তু এসব কী জেরা শুরু করলে তুমি! কেন এসব প্রশ্ন করছ বলত? পাল্কি ওদিকে পৌঁছে গেছে।

–যাক। যা জানতে চাইছি তা বল। তুমি আগে থেকে জানতে না যে, নগেন দত্ত একটা বিরাট বজরা নিয়ে শ্রীক্ষেত্রে যাচ্ছে, আর তীর্থযাত্রীদলে আছে গাঙ্গুলী খুড়ো আর মীনু খুড়িমা? তুমি ফরাসীডাঙায় ওদের বজরার জন্যে ঘাটে প্রতীক্ষা করছিলে না?

এবার রূপেন্দ্রনাথ কিছুটা আঁচ পেলেন: গুজবটা কী আকারে ছড়িয়েছে! বললেন, না। আমি তো আগেই বলেছি, তারাদা। বজরায় বসে নগেন দত্ত দূরবীন দিয়ে চারিদিক দেখছিলেন। ঘটনাচক্রে আমাকে দেখতে পান, চিনতে পারেন, এবং প্রায় জোর করে বজরায় তুলে নেন। আমি গঙ্গার ঘাটে বসেছিলাম খালি গায়ে, খালি পায়ে। একবস্ত্রে। তুমি হয়তো জান না, নগেন দত্তের সহধর্মিণীর চিকিৎসা আমি করেছিলাম; কিন্তু বৈদ্যবিদায় নিইনি। বলেছিলাম, তিনি রোগমুক্তা হলে তার পর আমি বৈদ্যবিদায় গ্রহণ করব। নগেন দত্ত তাই আমাকে জোর করে নিয়ে গেলেন শ্রীক্ষেত্রে। সমস্ত খরচপত্র তাঁর, মায় আমার পরিধেয় বস্ত্র পর্যন্ত কিনে দিয়েছিলেন।

—শ্রীক্ষেত্রে পৌঁছবার পর গাঙ্গুলী খুড়ো, তুমি আর মীনু খুড়িমা তিনজনে মিলে কী একটা ভাঙা মন্দির দেখতে গিয়েছিলে? যেখানে মূর্তি নেই, নিত্য পূজার ব্যবস্থা নেই, লোকালয় নেই? সেখানে একরাত্রি বাসও করেছিলে?

—হ্যাঁ, কোনার্কের সূর্য মন্দির! ওঁরা দুজনে গো-গাড়িতে যান, আমি ঘোড়ায় চেপে গিয়েছিলাম। কেন বল তো?

—কেন সেখানে গেছিলে রুপেন? সে মন্দিরে তো দেবতা নেই, নিত্যপূজার ব্যবস্থাও নেই। আর ভাঙা মন্দিরে নাকি সারি সারি অশ্লীল মিথুনমূর্তি!

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, এ তো আজব কথা শোনালে তারাদা! কোনার্ক সূর্যমন্দিরের নাম তুমি শোননি অথচ এটুকু জান যে, সেখান ‘সারি সারি অশ্লীল মিথুনমূর্তি’।

—ঐ মন্দির সম্বন্ধে যা কিছু শুনেছি তা দুর্গা-খুড়োর কাছে। খুড়ো বলেছিল, সেখানে তোমরা তিনজন একরাত মাত্র ছিলে। আর তুমি একেবারে ভোররাতে ঘোড়া ছুটিয়ে পুরীতে ফিরে এসেছিলে। খুড়োকে কিন্তু না জানিয়ে।

—এসেছিলাম। না জানিয়ে নয়। ভোর রাত্রে যখন আমি ঘোড়া ছুটিয়ে পুরীধামের দিকে রওনা দিই তখন খুড়ো আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁকে না জানিয়ে আমি চলে আসিনি।

—আর মীনু খুড়িমা?

—কী মীনু খুড়িমা?

–সে তখন কোথায়?

—কী বলতে চাইছ? খোলাখুলি বল দিকি, তারাদা।

তারাপ্রসন্ন এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে প্রথমে নির্জনতার সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলেন। তারপর নিম্নস্বরে বললেন, দুর্গা খুড়ো এক-একজনকে এক-এক রকম গল্প বলেছেন। বাবামশাই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খবর নিতে, কেন মীনু খুড়িমা ফিরে আসেনি। আসলে তার আগে মীনুর বাবা—পীতু মুখুজ্জে গোপনে দরকার করতে এসেছিলেন বাবামশাইয়ের কাছে। তাঁর মেয়েটা কেন স্বামীর সঙ্গে ফিরে এল না, জানতে। বাবামশাইয়ের কাছে দুর্গা খুড়ো যে কথা বলেছিল তা এই: ঐ সূর্যমন্দিরের এক পাণ্ডার বাড়িতে তোমরা তিনজনে রাত্রিবাস করেছিলে। একঘরে খুড়ো আর খুড়িমা। অন্য ঘরে তুমি একা। ভোর রাত্রে দুর্গাখুড়োর ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে দেখে সে একা শুয়ে আছে। খাটের পাশের অংশটা খালি। খুড়ো প্রথমে কিছুটা অপেক্ষা করে—ভেবেছিল, মীনু খুড়িমা বুঝি বাগানে গেছে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। কিন্তু আধঘণ্টা পার হয়ে যেতে সে তোমার ঘরে গিয়ে করাঘাত করে। আশ্চর্য! সে ঘরে কেউ ছিলো না। সেই ভোররাত্রে! মীনু খুড়িমাকেও তারপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, এই কথা জ্যাঠামশাইকে বলে ছিল দুর্গাখুড়ো?

—হ্যাঁ! কিন্তু নন্দ চাটুজ্জেকে সে অন্য এক গপ্পো শুনিয়েছে। বলেছে, সেটা ছিল পূর্ণিমার রাত—বোধহয় দোলপূর্ণিমা। শেষ রাত্রে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনিতে ওর ঘুম ভেঙে যায়। পাশের বিছানা খালি দেখে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে। আর চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় তুমি মীনু খুড়িমাকে ঘোড়ায় তুলে নিয়েছ। হুবহু সংযুক্তাহরণ। বৃদ্ধের চোখের সম্মুখে তুমি ঘোড়া ছুটিয়ে ধু-ধু করা সমুদ্রের তটরেখা ধরে মীনুকে নিয়ে চলে গেলে—কী জানি কোথায়! তারপর থেকে দলের কেউ আর তোমাদের দুজনকে দেখেনি। না তুমি, ‘না মীনু খুড়িমা!

দুরন্ত ক্রোধ সংবরণ করে কিছুক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন রূপেন্দ্রনাথ। তারপর বললেন, এখনই চল, তারাদা। দুর্গাখুড়োর ভিটেতে! আমার চোখে চোখ রেখে এতবড় মিথ্যা কথাটা সে বলতে পারে কি না আমি দেখতে চাই। উঃ! কী পৈশাচিক মিথ্যাচার! খুড়ো জানে, মীনু কোথায়!

—কোথায়?

—সে গলায় দড়ি দিয়েছিল! কেন জান? খুড়ো তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পুরীধামে নিয়ে গিয়েছিল একটি ক্ষেত্রজ পুত্র সমেত প্রত্যাবর্তন করবে বলে। মীনু প্রথমে বুঝতে পারেনি বুড়োর চালাকি। বুঝলে, সে তীর্থে যেতই না। যখন বুঝল তখন সে প্রতিবাদ করেছিল। অজানা অচেনা একটা পুরুষের বলাৎকারকে সে ধর্মের অঙ্গ বলে মেনে নিতে পারেনি! তাই আত্মহত্যা করেছিল। সে আত্মহত্যা ঘটনার অন্তত দু’শ সাক্ষী আছে। অন্তত বর্ধমানভুক্তির ইজারাদার নগেন দত্ত—যিনি বজরা ভাড়া করে দু’শ যাত্রী নিয়ে পুরুষোত্তমক্ষেত্রে তীর্থযাত্রা করেছিলেন—তিনি জানেন! সম্ভবত তাঁরই খরচে পুরীর স্বর্গদ্বারে মীনুর সৎকার হয়; আর ঐ নরপিশাচই নিশ্চয় মুখাগ্নি করেছিল।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তারাপ্রসন্নের। বললেন, বাবামশাই তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু একটা কথা, তুমি কেন সেক্ষেত্রে যাত্রীদলের সঙ্গে ফিরে এলে না?

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, সেসব গবেষণা পরে কর, তারাদা, সবার আগে দুর্গা খুড়োর ভিটেতে চল দেখি!

তারাপ্রসন্ন বলেন, না! গাঁয়ের ছেলে গাঁয়ে ফিরলে সবার আগে তাকে ধুলো-পায়ে বাস্তুভিটাতে গিয়ে চৌকাঠে মাথা ঠেকাতে হয়।

থমকে যান রূপেন্দ্রনাথ!

—তাছাড়া আরও একটা অসুবিধা আছে। দুর্গা-খুড়ো এখন গ্রামে নেই। ফাগুনের শেষাশেষি তিনি গাঁ-ছাড়া হয়েছেন।

—কোথায় গেছে?

—আবার সস্ত্রীক পুরুষোত্তম-ক্ষেত্রে চলে গেছেন। ওঁর সেই গুরুদেবের ব্যবস্থাপনাতেই। এবার পুত্রলাভ নির্ঘাৎ! কারণ এবার সঙ্গে আছে জোড়া-বউ! উপর্যোপরি বলাৎকারে দুটোই যতদিন না নিশ্চিত গর্ভবতী হচ্ছে ততদিন খুড়ো ‘হত্যা’ দিয়ে পড়ে থাকবে। একটা না একটার পুত্রসন্তান হবেই। হবে না?

না। থামিয়ে দেওয়া যায়নি। ব্যর্থ হয়েছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। গোটা অষ্টাদশ শতাব্দীতে এইসব ন্যক্কারজনক সামাজিক বিধান চালু ছিল। প্রতিবাদের কণ্ঠ কোথাও সোচ্চার হয়ে ওঠেনি।

অধ্যাপক অসিতকুমার অপরিসীম আক্ষেপের সঙ্গে লিখেছেন, “ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু (1707 ) হইতে পলাশীর যুদ্ধের ( 1757 ) কাল—এই অর্ধশতাব্দীই জাতীয় জীবনের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের কার্য। মুঘল-মহিমা অনেক পূর্বেই অন্তমিত হইয়াছে, শাসন ব্যবস্থা ভাঙিয়া পড়িয়াছে, দুই-একজন সুবেদার বাংলা শোষণ করিয়া ঐশ্বর্যবিলাসে ঘৃণ্য জীবন যাপন করিয়া বাংলার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অনেক পূর্বেই অন্তঃসার শূন্য করিয়া ফেলিয়াছিলেন। সমাজেও তখন ঘূণ ধরিয়াছিল। পুরাতন ভূস্বামী-সম্প্রদায় ক্ষমতাচ্যুত হইয়া পড়িয়াছিল, শিক্ষাদীক্ষাও প্রায় সম্পূর্ণরূপে লোপ পাইতে বসিয়াছিল,—এই অর্ধশতাব্দীকাল বাংলা দেশের পক্ষে চূড়ান্ত হতাশার কাল; চারিত্র, মনুষ্যত্ব, সুস্থ জীবন—সব দিক দিয়াই বাঙালী জীবনে ক্ষয়ব্যাধি আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল।… রাষ্ট্র ভাঙিল, সমাজ ভাঙিল, জীবনের সুস্থ আদর্শ ভাঙিল এবং জীবন হইতে যে-সাহিত্যের জন্ম হয় তাহাও ভাঙিয়া পড়িল। তাই বাংলা দেশের অষ্টাদশ শতাব্দীর এই প্রথমার্ধকে ‘ভাঙিয়া পড়ার ইতিহাস’ বলা যাইতে পারে।” *

[* বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত।। তৃতীয় খণ্ড: দ্বিতীয় পর্ব: ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, 1982, পূঃ ২]

কিন্তু শুধু প্রথমার্ধটুকুই বা কেন? গোটা অষ্টাদশ শতাব্দীই তো বঙ্গ-সংস্কৃতিতে ভেঙে পড়ার ইতিকথা—একবারে অন্তিম দুই দশক বাদে। যখন রামমোহন রায় সাবালকত্ব লাভ করে ঐ আদ্যন্ত ক্লেদাক্ত পর্বতাকার পুরীষ হারকিউলিসের মতো পরিমার্জনা করতে উদ্যত হলেন।

শতাব্দীর ঊষাযুগে বাঙলার দক্ষিণাঞ্চলে শুরু হয়েছিল মগ-আরকান-পর্তুগীজ বোম্বেটে জলদস্যুদের অত্যাচার, যার ফলে, রাজশক্তির ব্যর্থতায় অবলুপ্ত হয়ে গেল প্রায় সহস্রাব্দীব্যাপী বাঙালির বাণিজ্য এবং সমুদ্রযাত্রা। তারপরেই শুরু হল বর্গীর হাঙ্গামা ( 1742 )। একটিমাত্র দশকে উড়িষ্যাসমেত বাঙলার পশ্চিম ও দক্ষিণাংশ শ্মশান হয়ে গেল। সে পর্ব মিটতে না মিটতেই পলাশী প্রান্তরে যৌথ বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতা হারালো গৌরবঙ্গ। শহীদ হলেন মীরমদন, মোহনলাল! কেউ খোঁজ নিল না: হিন্দু না ওরা মুসলিম! এল কোম্পানির রাজত্বের অরাজকতা। ক্রমান্বয়ে মীরজাফর, রেজা খাঁ এবং দেবীলালের নির্মম শোষণ। এবারেও কেউ খোঁজ নিল না: হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওদিকে বেনিয়া ইংরেজের রাজশক্তিলাভে অবলুপ্ত হয়ে গেল বাঙলার তাঁত আর রেশম শিল্প, যাবতীয় কুটিরশিল্প এবং লবণ-ব্যবসায়। দেশ- বিদেশ থেকে বাঙালি সওদাগর নানান বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে আসত সিংহল, কাম্বোজ, চীনদেশ থেকে: নানা জাতের মশলা, এলাইচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল, জাফরান, চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত আর পরিবর্তে সেসব দেশে পৌঁছে দিতে মসলিন, কাঁসার কাজ, রূপোর ফিলিগ্রি, হাতির দাঁতের শিল্প। ঐসব চারু ও কারু শিল্প তো শতাব্দীর প্রারম্ভেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবর্তে চালু হয়েছে মুসলমান রেজা খাঁ কিংবা হিন্দু দেবীলালের মতো পিশাচের নির্মম-নিষ্ঠুর কর আদায়! বন্যাই হোক অথবা খরা—মাঠে ফসল হোক বা না হোক কৃষিজীবী মানুষকে বউ-বেটি-বেচে কর যোগাতে হবে।

এইসব কিছুর মিলিত ফলশ্রুতি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (1769 )। আমরা এখনো তার দ্বারদেশে এসে উপনীত হইনি। তবু তিল তিল করে সেই মহামৃত্যুর অভিমুখেই চলেছি। মহামৃত্যু! অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্লেদাক্ত ইতিহাস! তাহলে সেই মানবিকতার চরম অবমাননার কথা যেন শোনাতে বসেছি তোদের? এ প্রশ্নের জবাব আগেই দিয়েছি—রূপমঞ্জরীর প্রথমখণ্ডের ‘কৈফিয়ত’-এ। দশবছরের পরিশ্রমে এতদিনে রূপমঞ্জরীকে তার স্বগ্রামে পৌঁছে দিয়ে আবার সেকথা কেন বলছি জানিস, দিদিভাই? কারণ: জপমন্ত্রে পুনরুক্তি দোষ হয় না।

কারণ আমি বিশ্বাস করি: নিষ্প্রভাত অমারাত্রি হয় না!

আমি সন্ধান করতে চেয়েছি—এই ক্লেদাক্ত পরিবেশে কী করে, কোন্ কার্যকারণসূত্রে, রাধানগরে আবির্ভূত হলেন নূতন যুগসূর্য। স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের মতো কোন অলৌকিক ক্ষমতায় মেদিনী বিদীর্ণ করে এই শ্মশানে এসে উপস্থিত হননি রাজা রাম। এমনটা হয় না, হতে পারে না। একথাই শিখিয়েছে সভ্যতার ইতিহাস। বিবর্তনের একটি ফল্গুধারা নিশ্চয় প্রবাহিত ছিল, যা আমরা নজর করিনি। লোকচক্ষুর অন্তরালে কেউ-না-কেউ নিশ্চয় পৌঁছে দিয়েছিলেন মশালটিকে নদীয়ার সেই প্রেমানন্দে পাগল বিদ্রোহী পণ্ডিতের পর্ণকুটীর থেকে রাধানগরের রাজপ্রাসাদে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূর্যোদয় যখন প্রত্যক্ষ সত্য, তখন এ তথ্য অবধারিত যে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে লোকচক্ষুর অন্তরালে কে বা কারা করে গেছেন ‘রাত্রির তপস্যা।’

বুড়ো-ইতিহাস সে-কথাটা বেমালুম ভুলে বসে আছে।

তাই খুঁজতে শুরু করেছিলাম কীটদ্রষ্ট পুঁথির পৃষ্ঠায় সেই সব সাধকদের নাম। দেশসেবক আর সমাজসেবক। শুধু অধ্যাত্ম সাধক নন।

তোমরা যদি জিজ্ঞেস কর: কেন গো দাদু? কী দায় পড়েছে তোমার? এই বৃদ্ধ বয়সে হরীতকীর বদলে ‘সরবিট্রেট’ চুষতে চুষতে কেন খুঁজে বেড়াচ্ছ সেই অতীত ইতিহাস? কেন জানতে চাও ঐ বিস্মৃত মানুষগুলোর কথা? বাস্তবের ঐ হটী, হটু, দ্রবময়ী অথবা বুনো রামনাথের কথা? অথবা তোমার মানসলোকের ঘনশ্যাম, রূপেন্দ্রনাথ অথবা রূপমঞ্জরীর অন্তরঙ্গ কথা?

তাহলে জবাবে আমি বলব: কী জানিস দিদিভাই? তোরা খেয়াল করে দেখিনি। পাতার মাথায় সালটা বদলে গেছে। 1748 নয়, আমি আছি 1996-এ। আড়াইশ বছর প্রগতির পথ অতিক্রম করে এসে আমড়াতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে এই পরিচ্ছেদটা রচনা করছি। আমরা আজ স্বাধীন! ভোট দিয়ে আমাদের শাসক-শোষক নির্বাচন করতে পারি, করছিও। লাল-নীল- গেরুয়া-সবুজ। রাজশয্যায় উপস্থিত আছেন ঔরঙ্গজেব, মীরজাফর, রেজা খাঁ আর দেবীলাল। যাকে ইচ্ছে বেছে নিয়ে তোরা গদীতে বসাতে পারিস।

সমাজ আছে একই অবস্থায়। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অসিতকুমারকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, বিংশ শতাব্দীর এই শেষ পাদে কি আমরা চূড়ান্তভাবে হারিয়ে দিতে পারিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে? আজ বাঙলা ও বিহার কি রেজা খাঁ দেবীলালকে হারিয়ে দিতে পারেনি? ক্লাইভ আর ওয়ারেন্ট হেস্টিং যে উৎকোচ গ্রহণ করেছিলেন তা কি আমাদের স্বাধীন ভারতের ষড়যন্ত্রীমশাইদের যৌথ উৎকোচের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর নয়? কলকাতায় বসে পুরীর নিশ্চলানন্দজী (বর্তমান শঙ্করাচার্য) নিদান হেঁকেছেন (জানুয়ারি ‘94): নারীর বেদপাঠের অধিকার নেই। কেন?

নিশ্চলানন্দর যুক্তি : যজ্ঞোপবীতধারী ব্যক্তিই বেদপাঠের অধিকারী। যজ্ঞোপবীত গ্রহণের জন্য কৌপীনধারী হিসাবে, উন্মুক্ত উরসে ভিক্ষা চাইতে হয়। এই ধরনের ধর্মাচরণের লজ্জা থেকে মেয়েদের অব্যাহতি দিতেই শাস্ত্রের এই নিষেধাজ্ঞা। কী অসাধারণ যুক্তি! প্রণাম জানাই যিনি এই সন্ন্যাসীর উপাধি দিয়েছিলেন: নিশ্চলানন্দ! সার্থকনামা এই শঙ্করাচার্য! কেউ প্রতিপশ্ন করতে পারবে না: তাহলে বেদের একাধিক শ্লোক কীভাবে রচনা করেছেন বিশ্ববারানাম্বী মহাপণ্ডিতা? কীভাবে কণ্ঠস্থ ছিল বেদের সূক্ত—গার্গী, মদালসা, মৈত্রেয়ী থেকে ঐতিহাসিক হটী বিদ্যালঙ্কারের? একথা নিশ্চলানন্দকে কেউ প্রশ্ন করেনি। কারণ প্রধানমন্ত্রী থেকে অনেক ভি. আই. পি. তাঁর শিষ্য—অন্ধস্তাবক। যিনি যত বড় ‘ফোর-টোয়েন্টি’ তিনি তত বড় অন্ধ ভক্ত!

দুঃখ হয় আদি শঙ্করাচার্যের জন্য। তাঁর সৃষ্টি পুরীধামের পীঠে আজ যে নিশ্চলানন্দ অধিষ্ঠিত তিনি জানেন না যে, সে-কালে ভারতবর্ষে স্ত্রী-জাতীয়ারা ছিলেন দুই প্রকারের—’ব্রহ্মবাদিনী’ এবং ‘সদ্যদ্বায়া’। তার ভিতর ব্রহ্মবাদিনীরা মৌঞ্জীবন্ধন, উপনয়ন, বেদাধ্যায়ন এবং স্বগৃহাভ্যন্তরে ভিক্ষাচর্যায় ব্রহ্মচারিনীর সকল ব্রতই পালন করতেন। ‘সদ্যদ্বায়া’রা স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে ধর্মাচারণ করতেন।

বৃদ্ধযম-সংহিতার তাই নির্দেশ আছে :

পুরা-কল্পে কুমারীণাং মৌঞ্জীবন্ধনমিষ্যতে।
অধ্যয়নঞ্চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা।।
পিতা পিতৃব্যো ভ্রাতা বা নৈমিধ্যাপয়েৎপর?।
স্বগৃহে চৈব কন্যায়া ভৈক্ষ্যচৰ্য্যা বিধীয়তে।
বর্জ্জয়েদজিনং চীরং জটাধারণমেবচ।।

অর্থাৎ, পুরাকল্পে কুমারীদিগের মৌঞ্জীবন্ধন (মেখলা-ধারণ, অর্থাৎ আজানুলম্বিত কটিবস্ত্রধারণ) বেদাধ্যয়ন এবং সাবিত্রীপাঠের ব্যবস্থা ছিল। তাঁরা গৃহাভ্যন্তরে পিতা, পিতৃব্য এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতার নিকট অধ্যয়ন করতেন। কৌপীনধারী নয়, কটিবস্ত্রধারিনী হিসাবে উন্মুক্ত উরসে শুধু জননীর কাছ থেকে স্বগৃহে ভিক্ষাগ্রহণ করতেন—ব্রহ্মচারিণী হিসাবে। জটা, বল্কল এবং অজিন ব্রহ্মচারিণীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ছিল। ব্রহ্মবাদিনী স্ত্রীগণ চিরকৌমার্য ব্রত অবলম্বন করে বৈদাধ্যয়নাদি করতেন। ব্যাপকভাবে আজ তা প্রচলিত নয় বটে; কিন্তু পুরীর শঙ্করাচার্য নিশ্চলাচন্দ্ৰ যদি ‘নিশ্চল’ না থেকে ভারতের যে-কোন সন্ন্যাসিনীদের আশ্রমে পদধূলি দেন, তা হলে আজও তা দেখতে পাবেন। এই কলকাতা শহরেই একাধিক সন্ন্যাসিনীদের আশ্রম আছে—সারদামায়ের নামে, আদ্যাপীঠে প্রভৃতি।

কিন্তু নিশ্চলানন্দ সেসব খোঁজ রাখেন না। অন্ধ বিশ্বাসে ভ্রান্ত নির্দেশ জারি করে সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চলেছেন।

শুধু এই ভারতে নয়—সর্বত্র। খোমেনি ফতোয়া জারি করে বসে আছেন : সলোমন রুসদির মুণ্ড চাই। প্রতিবেশী বাঙলাদেশ থেকে তসলিমা বিতাড়িতা। নোয়াখালি অঞ্চলের দুলালি বেগমের উপর ১০১ বার বেত্রাঘাত করার ফতোয়া জারি করেছেন কোরগঞ্জ মসজিদের বড়ে-ইমাম (18.1.96)। দুলালির অপরাধ? চার-বিবির অধিকারে স্বাধীকারপ্রমত্ত দুলালির খসম্ তাকে উপেক্ষা করত। ফলে সে এক বন্ধুর প্রতি অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। শুনেছি, এ ফতোয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান বাংলাদেশ মহিলামঞ্চ। সাময়িকভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন ইমাম। শেষ সংবাদ জানি না। তাহোক। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে পুরীর যে শঙ্করাচার্য রূপেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন—সতীদাহ শাস্ত্রসম্মত, স্ত্রীশিক্ষা বর্জনীয়, গঙ্গাবক্ষে সন্তানাবিসর্জন অনুমোদনীয়, সেই কূপমণ্ডুকের সঙ্গে আড়াইশ বছর পরেকার নিশ্চলানন্দের কোন পার্থক্য আছে কি? একটি প্রভেদ আছে অবশ্য তখন শঙ্করাচার্যের রাজনৈতিক সমর্থন ছিল না। এখন আছে। এখন সি. বি. আই. সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যাদের কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপার্জনের জন্য তদন্ত করছে তারা ঐ ধর্মের গোঁড়ামির সমর্থক। শঙ্খরাচার্য থেকে বাল থ্যাকারে।

ভিজা-কাপড়ের পুটুলিটা নিয়ে কালিপদ সরাসরি চলে গেছে জমিদার বাড়ি। তারাপ্রসন্ন তাকে গোপন নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন—মধ্যাহ্নভোজন আরও দু-জন করবেন। তিনি নিশ্চিত, বাস্তুভিটা দর্শনান্তে রূপেন্দ্রনাথ জমিদারবাড়িতে আতিথ্যস্বীকারে বাধ্য হবেন।

এদিকে পালকিটা এসে পৌঁছেছে ভগ্নস্তূপের সামনে। পাল্কি থেকে নেমে মালতী অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল রূপেন্দ্রনাথের বাস্তুভিটার ভগ্নস্তূপ। শুভপ্রসন্ন আর রূপমঞ্জরীর ঝগড়া-বিবাদ থেমেছে। পাল্কির মধ্যে মালতীর মধ্যস্থতায় তাদের ভাব হয়ে গেছে। হাত ধরাধরি করে তারা ধ্বংসস্তূপের দিকে অগ্রসর হতেই নিষেধ করল পাকি- বাহকদের সর্দার, ওদিকপানে যেওনি সোনামনিরা! মানুষের বাস তো লাই। তেনারা থাকতি পারেন।

রূপমঞ্জরী তার ডাগর-চোখ মেলে বলে, তেনারা কে গ?

মালতী ওদের দুজনকে কাছে টেনে নেয়। বলে, ও সাপখোপের কথা বলছে। তোমরা ঐ গাছতলায় গিয়ে বস। ওঁরা এখনি এসে যাবেন।

লবা তার মাথার বোঝাটা দেখিয়ে শুধালো, এগুলান খুব কুথায়?

সর্দার-বাহক ধরাধরি করে বাক্সপ্যাঁটরা নামালো। বলল, দেখতিই তো পাচ্ছ বাপ্, এ- ঠায়ে মানষে বাস করতি পারবেনি। কত্তামশাইরে আসতি দাও, তারপর ব্যবস্থা হবেনে।

একটু পরেই এসে গেলেন ওঁরা। তারাপ্রসন্ন বললেন, চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল তো i চল এবার, সবাই মিলে আমাদের বাড়ি।

রূপেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন না। একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিলেন ভগ্নস্তূপ। শুধু দক্ষিণদুয়ারি ঘরখানা দাঁড়িয়ে আছে গৃহস্বামীর প্রতীক্ষায়। পুবদুয়ারি আর উত্তর-দুয়ারি ঘরদুটি বন্দ্যোঘটিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে। তুলসীমঞ্চটা ভেঙে গেছে, কিন্তু আশ্চর্য, তুলসীর গাছ আছে খাড়া! কেউ জল দিত কি? আর খাড়া দাঁড়িয়ে আছে সৌরীন্দ্রনাথের স্বহস্তরোপিত কলমের আম গাছটা। পিতৃদেবের সযত্নরোপিত সেই আম্রবৃক্ষে এসেছে নতুন মঞ্জরী। কুসুমঞ্জরী চলে গেছে, কিন্তু রূপমঞ্জরীকে সম্বর্ধনা জানাতে প্রতীক্ষায় আছে গাছটা, আপাদমস্তক রসালমঞ্জরী নিয়ে।

রূপেন্দ্রনাথ বাস্তুভিটার প্রবেশদ্বারের সামনে নতজানু হয়ে উপবেশন করলেন। প্রবেশদ্বারের কাঁঠালকাঠের চৌকাঠের উপর কপালটা ঠেকালেন। ব্রাহ্মণের বাস্তুভিটাকে প্রণাম করল মালতীও। রূপমঞ্জরীকে কেউ কোন নির্দেশ দেয়নি। দেখাদেখি সেও চৌকাঠে তার ছোট্ট কপালটা ঠেকালো।

রূপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়ে মালতীকে বললেন, দিন চারপাঁচ লাগবে, বৌঠান। তার মধ্যেই দু-একখানা ঘর খাড়া করে ফেলব। আপনি এ কয়দিন মঞ্জরীকে নিয়ে তারাদার ভদ্রাসনেই থাকুন। তারাদা আমার বড় ভাইয়ের মতো। ঐ যে দীঘির ধারে চিকিৎসালয় দেখছেন তা গড়ে দিয়েছেন ঐ তারাদার বাবামশাই—আমি তাঁকে জেঠামশাই ডাকতাম। ওঁরা এ গ্রামের জমিদার।

মালতী জানতে চায়, আর আপনি? আপনি কী করবেন?

—আমাকে এখানেই থাকতে হবে, বৌঠান। নতুন করে ঘর তুলবার ব্যবস্থা করতে।

হঠাৎ নজর হল মাঠের ও-প্রান্ত থেকে ছুটতে ছুটতে এদিকে এগিয়ে আসছে জীবন দত্ত। উঠতি জোয়ান। সুঠাম দেহাবয়ব। জীবন ছিল রূপেন্দ্রনাথ কবিরাজের প্রিয় ছাত্র। এই গ্রামেরই ছেলে। মহিম দত্তের বড়ছেলে। আয়ুর্বেদ শিক্ষা করতে রূপেন্দ্রনাথের শিষ্যত্বগ্রহণ করে। একেই দাতব্য-চিকিৎসালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পাঁচ-ছয় বছর পূর্বে রূপেন্দ্রনাথ সস্ত্রীক তীর্থযাত্রা করেছিলেন।

জীবন এসে পথের উপরেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল তার গুরুদেবকে। তারপর প্রণাম করল তারাপ্রসন্নকে। কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে দেখল অবগুণ্ঠনবতী বিধবাটির দিকে। রূপেন্দ্রনাথ বললেন, আমার বৌঠান!

জীবন বোধকরি মালতীর বয়ঃজ্যেষ্ঠ—দু-চার বছরের। তবু সে-কালীন শিষ্টাচার অনুসারে ঐ ব্রাহ্মণের বিধবার চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করন। রূপেন্দ্রনাথকে বলল, এতদিনে গাঁয়ের কথা মনে পড়ল?

রূপেন্দ্র হেসে বললেন, গ্রামে বাস করতেই তো এসেছি, জীবন, কিন্তু…

—আপনি কিছুমাত্র চিন্তিত হবেন না, গুরুদেব। আমি এখনি ওপাড়ে যাচ্ছি, পীরপুরের তোরাবকে খবর দিতে। যাবার পথে নন্দদাদুর গোলাতেও খবর দিয়ে যাব। বাঁশ, দড়ি আর খড়ের জন্য। উলুখড়েই ছাইবেন তো? না ধানখড়?

—না, না, উলুখড় তো নিশ্চয়ই। তোরাবকে বল, দিন চারপাঁচের মধ্যে মোটামুটি দু- খানি ঘরের ছাউনি করে দিতে হবে। কাদার দেওয়াল তুলতে সময় লাগবে। আপাতত তোরাব যেন মনিরুদ্দির কাছ থেকে তল্লা-মুলিবাঁশের চাটাই নিয়ে আসে। বুকা-মুলি নয়, পিঠামুলি।

জীবন মাথা নেড়ে বলল, যে-আজ্ঞে। কিন্তু এ তিনচার দিন আপনি থাকবেন কোথায়? আমাদের বাড়িতে…

—না, জীবন। দেখতেই তো পাচ্ছ—তারাদা দামোদরের ঘাটেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছেন। এত বেলাতেও পালকি নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছেন। ধরে নিয়ে যাবেন। তবে তারাদা—মধ্যাহ্ন আহার সেরে আমি আবার এখানে ফিরে আসব। রাতটা এখানেই থাকব। এখন বোশেখ মাস। ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা নেই। নির্মেঘ আকাশ। আমার অসুবিধা হবে না।

তারাপ্রসন্ন বললেন, তোমার ইচ্ছায় আমি বাধা দেব না, রুপেন। দীর্ঘ-দীর্ঘ দিন পরে ভিটেয় ফিরে এসেছ। নাই বা থাকল কেউ কাছে টেনে নেবারণ বাস্তুদেবতা তো আছেন। তিনিই তোমাকে কোলে আশ্রয় দেবেন। লোক দিয়ে আমি চৌকি আর বিছানা পাঠিয়ে দেব। মশারি খাটাতে ভুল না হয়। বোশেখ মাস হলে কি হয়, মালোয়ারি হচ্ছে গ্রামে। আর দুবেলাই কিন্তু ঠাকুরের প্রসাদ পেতে আমাদের বাড়ি যেতে হবে।

রূপেন্দ্র বলেন, আজ্ঞে না। আমি একাহারী। তাছাড়া আমার আহারে কিছু বিধিনিষেধ আছে। বৌঠান জানেন—তারাবৌঠানকে উনি বুঝিয়ে বলবেন সে-সব কথা

—তবে ঐ কথাই রইল।

—একটু দাঁড়ান। আপনাকে একটি মঞ্জুষা গচ্ছিৎ রাখতে দেব। জেঠামশাই এগুলি দিয়েছিলেন রূপমঞ্জরীর মায়ের বিয়েতে। আমার ভাঙা ঘরে এগুলো রাখা ঠিক হবে না। নিয়ে যান রূপমঞ্জরীর বিয়ের সময় কাজে লাগবে।

মালতী নিরুপায়। তার বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে আবার পাল্কিতে উঠলেন। এখান থেকে জমিদারবাড়ি কাছেই। মঞ্জরী আর শুভ্র পাকিতে চাপতে রাজি হল না। তারাপ্রসন্নের পিছন পিছন দলটা জমিদার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল। তারাপ্রসন্ন, গহনার মঞ্জুষাটা সযত্নে স্বহস্তে বহন করে নিয়ে চলছেন।

জীবন জানতে চায়, আচ্ছা, ঐ ফুটফুটে মেয়েটি…

—চিনতে পারলে না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, চিনেছি। হুবহু মায়ের মুখ পেয়েছে। আমি তাহলে পীরপুরের দিকে রওনা দিই, গুরুদেব?

—এই অবেলায়? তোমার ফিরে আসতে তো অপরাহ্ণ হয়ে যাবে, জীবন! দুটি অন্নসেবা করে গেলে হত না?

—আজ্ঞে, আমি সকালে ভাল করে জলখাবার খেয়ে নিয়েই রোজ বের হই। রুগি- টুগি দেখে ফিরতে প্রায় বিকাল হয়ে যায়। মা জানেন।

—তুমি কি ইতিমধ্যে বিবাহ করেছ?

—আজ্ঞে না। বাবামশাই, মা আর আমি। আর আমার ছোট ভাই শিবনাথ। সবাই ভালই আছে।

—আমাদের চিকিৎসালয়ে রুগি আছে কজন?

—সব শয্যাই ভর্তি। সেসব কথা কাল হবে—

—বেশ। এস তাহলে।

জীবন রওনা হবার পর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু কুবোপাখির একটানা কক্‌-কুক-কুক- কুক। আর নিদাঘ দ্বিপ্রহরে ক্লান্ত ঘুঘুর ডাক। সে ডাকে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। ভগ্নস্তূপের ভিতর কোনও কাঠবিড়ালীদম্পতি বোধহয় নিশ্চিন্ত মনে বাসা বানিয়েছিল শেষবসন্তে। বাচ্ছাগুলো এখনো লায়েক হয়নি। তাই লোকজনের আনাগোনায় কাঠবিড়ালীদম্পতি আমগাছে চড়ে ক্রমাগত প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে। রূপেন্দ্রনাথ সেদিকে ফিরে বললেন, তোরা অহেতুক রাগারাগি করছিস, বাপু। বাড়িটা আমার—আমি বাস করতে আসব না? তোরাও থাক, আমিও থাকি।

হঠাৎ পদশব্দে এ পাশ ফিরে দেখেন একজন অচেনা মানুষ ভাঙা কাঠকুঠো সরিয়ে ওঁর দক্ষিণ-দুয়ারি ঘরের প্রবেশপথটা সাফা করছে। আর একজন স্ত্রীলোক—বছর ত্রিশ বয়স- -নারকেলকাঠির সম্মার্জনী দিয়ে ঐ গৃহের সংলগ্ন একচালাটা পরিষ্কার করছে। পুরুষটি উদাম গা, মালকোচা-সাঁটা, কিন্তু স্ত্রীলোকটি ভদ্রঘরের। তার দু-হাতে সোনার মকরমুখী বালা। পরিধানে শান্তিপুরী ডুরে-শাড়ি। সে-আমলে, বিশেষ উৎসব বা অনুষ্ঠান-রজনী না হলে সম্ভ্রান্তঘরের মহিলারাও একবস্ত্রা থাকবেন। “কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগে পুরুষ-স্ত্রী-নির্বিশেষে সাধারণ বাঙালী সামান্য পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করত।… বাঙালী মহিলারা একটিমাত্র শাড়ি দিয়ে শরীর আবৃত করত। বাঙালী মহিলারা মাথায় ঘোমটা দিত না।”* [মনে হয় আলেকজান্ডার ‘অবিবাহিতা’ মহিলাদের কথা বলতে চেয়েছেন। বিবাহিতাগণ অবগুণ্ঠনবতী হতেন।] তবে শাড়ি পরিধানের বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যে, কখনও অসতর্কতায় যুক্ত-উরসের আভাস চর্মচক্ষে দেখা যেত না।

[The History of Hindustan, by Alexander Duff, Vol I, 1770, London, p. 119]

রূপেন্দ্রনাথ গাছের ছায়ায় এতক্ষণ শুয়ে পড়েছিলেন। উঠে বসে প্রশ্ন করেন, কে তোমরা?

লোকটা পিছন ফিরে দেখল। ভ্রূক্ষেপ করল না। যা করছিল সেই কাজই করতে থাকে। মহিলাটি সম্মার্জনী নামিয়ে রাখে। পিতলের কলসি (কলসি? সেটা কখন এল দ্বার প্রান্তে?) থেকে ‘ফেরো’য়* জল গড়িয়ে হাতটা ধুয়ে ফেলে। এগিয়ে এসে গলবস্ত্র হয়ে পদধুলি নেয় রূপেন্দ্রনাথের।

[*ফেরো = পিতল বা কাঁসার ঘটি বিশেষ]

—শোভা না? কখন এলে তোমরা?

দূরত্ব বজায় রেখে শোভা গাছতলাতেই বসে পড়ে। দুর্গা খুড়োর অনুঢ়া কন্যা। বলে, অনেকক্ষণ এসেছি রূপোদা, আপনি টের পাননি। গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে। উঠুন, মুখে হাতে জল দিন। মাদুর পেতে দিয়েছি। তাতে উঠে শুয়ে পড়ুন আবার। তবে কৃষ্ণগোবিন্দজীর প্রসাদ নিয়ে এসেছি। মুখচোখ ধুয়ে একটু প্রসাদ মুখে দিন।

রূপেন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন। নিজের অজান্তেই কাঠবিড়ালীদের লাফালাফি দেখতে দেখতে গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। উনি আপত্তি করেন না। শোভা কলসি থেকে ফেলোয় করে জল ঢেলে দেয়। উনি মুখে-চোখে জল দেন। বৈশাখী মধ্যাহ্নে তাতে আরামই বোধ করেন। প্রশ্ন করেন, তুমি কী করে জানলে আমি এসেছি?

—সেসব গল্প পরে হবে। আপনি তো ছানটাও এখনো করেননি। এই গরমে ছান না করলে বিকালের দিকে শরীর অস্থির-অস্থির করবে। আমি শিশিতে করে তেল নিয়ে এসেছি। প্রসাদটুকু মুখে দিয়ে ‘আভান’ করে সারা গায়ে তেল মাখুন। ইন্দির একটা ছত্র নিয়ে এসেছে। আপনাকে ছত্র ধরে দামোদরে নিয়ে যাবে। ছানটা সেরে একেবারে সোজা তারাদার বাড়ি চলে যাবেন। গামছা-কাপড় আছে তো সঙ্গে?

—সেটুকুও থাকবে না?

—কী জানি! যেমন বাউণ্ডুলের মতো চেহারা করেছেন। কতদিন গায়ে তেল মাখেননি বলুন তো?

—চার বছর।

—চার বছর! কেন?

—তোমার বৌঠান যেদিন স্বর্গলাভ করেন সেদিন থেকে!

শোভার মুখে প্রশ্নটা এসেছিল। সামলে নিল নিজেকে। দীর্ঘ চারবছর ধরে অশৌচ পালনের কী অর্থ? এ তো নিছক পাগলামী। শোভা ভিতরের অনেক-অনেক কথা জানে। অনেক গোপনতত্ত্ব আবার জানেও না। কিন্তু ঐ পথশ্রান্ত ক্লান্ত মানুষটাকে এখন এসব প্রশ্ন করতে ওর মন সরল না।

রূপেন্দ্রনাথ মুখ হাত ধুয়ে নিলে শোভা গাছ তলায় জল ছিটিয়ে একটা কলাপাতা পেতে তাতে কৃষ্ণগোবিন্দজীর প্রসাদ সাজিয়ে দিল—পেঁপে, শশা, কলা, মুগ-ভিজা, কদমা, বাতাসা, খুর্মো আর সন্দেশ।

রূপেন্দ্রনাথ ইষ্ট স্মরণ করে খরমধ্যাহ্নে প্রাতরাশে বসলেন।

শোভা—কী হিসেবি মেয়ে—একটা হাতপাখাও নিয়ে এসেছে। বাতাস করতে করতে প্রশ্ন করে, দূর থেকে তারাদার সঙ্গে একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকেও দেখলাম….

—হ্যাঁ, যাবার আগে ওকে রেখে গেছে তোমাদের কুসুমবোঠান।

—ভারি সুন্দর দেখতে। কী নাম রেখেছেন?

—ওর দাদামশাই, মানে আমার পিসা-শ্বশুর নাম রেখেছিলেন হটী। আমি ডাকি ‘রূপমঞ্জরী’ নামে।

—রূপমঞ্জরী! বাঃ! ভারি সুন্দর নাম।

—নামটা আমার এক বয়স্যের দেওয়া। কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। তুমি তাঁর নাম শুনেছ, শোভা?

—আজ্ঞে না।

—মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নাম?

—না। কোথাকার মহারাজা তিনি?

—নদীয়ার। কৃষ্ণনগরের। তাঁরই সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। নামকরণের অর্থটা বুঝেছ?

—সেটুকু বুঝেছি, রূপোদা! রূপেন্দ্রনাথের ‘রূপ’ আর কুসুমমঞ্জরীর ‘মঞ্জরী’। তাই তো বলছিলাম—ভারি সুন্দর নামটি। যেমন দেখতে, তেমনি নাম। আর সঙ্গে যে বিধবা মহিলাটিকে দেখলাম, উনি…

—সম্পর্কে আমার বৌঠান। উনি এখানেই থাকবেন।

—এই সোঞাই গাঁয়ে? কোথায়? এই বাড়িতে?

হাসলেন রূপেন্দ্রনাথ। বললেন, হ্যাঁ। এ বাড়ির ঘর তিনখানি আবার খাড়া হয়ে উঠবার পর। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন তারাদার আশ্রয়ে থাকবেন উনি, রূপমঞ্জরীকে নিয়ে।

শোভা চুপ করে বসে রইল। রূপেন্দ্র বললেন, জানি তুই কী ভাবছিস্।

অজান্তেই ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ সম্বোধন। ওঁর যেন হঠাৎ মনে হল, কাতু ওঁকে বসে খাওয়াচ্ছে।

শোভা চকিতে একবার ওঁর দিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করল। বলল, সমাজপতিরা কি এটা মেনে নেবেন, রূপোদা?

—না, নেবেন না। কিন্তু তোদের একবগ্গা-ঠাকুরকে তো তুই চিনিস শোভা। আমি লড়াই করে যাব।

শোভা হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল, আর একটা কথা বলবেন? ছোটমা …

রূপেন্দ্রনাথের আহার শেষ হয়েছিল। ফেরোর জলে মুখ প্রক্ষালন করে কোঁচার খুঁটে হাত-মুখ মুছলেন। বললেন, তুই কতদূর, কী শুনেছিস্ জানি না, তবে এটুকু জেনে রাখ, তোর ছোটমার সব জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান হয়েছে।

—সেটা কোথায়?

—পুরীতে।

—মৃত্যুসময়ে তুমি উপস্থিত ছিলে, রূপোদা?

শোভাও সজ্ঞানে খেয়াল করে দেখেনি যে, সে ‘আপনি’ থেকে নিজের অজান্তে যুবকটিকে ‘তুমি’ সম্বোধন করছে—যে যুবকটির সঙ্গে কোন এক বিস্মৃত অতীতে তার বিবাহ- সম্বন্ধ উত্থাপিত হয়েছিল।

—না, আমি ছিলাম না। আমি তখন কাশীধামের পথে।

—বাবামশাই ছিলেন?

—মৃত্যুমুহূর্তে ছিলেন না। তবে তিনিই সৎকার করেছিলেন। মুখাগ্নি করেছিলেন। না- করার কোনও হেতু নেই।

—এ ঘটনার কোনও সাক্ষী আছে?

—আছে। অন্তত দেড়-দুশ জন। বর্ধমানের ইজারাদার নগেন্দ্রনাথ দত্ত—যার সঙ্গে তোমার বাবার কারবার, এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী!

—আমার একটা পরামর্শ শুনবে, রূপোদা?

—কী ব্যাপার?

—তুমি লোক পাঠিয়ে সেই নগেন দত্তর কাছ থেকে একটা হাতচিঠি আনাবার বন্দোবস্ত কর। যেন ইজারাদারের পাঞ্জাছাপ থাকে সে চিঠিতে। তিনি যেন সে পত্রে স্বীকার করেন যে, আমার ছোট মায়ের মৃতদেহ তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি শ্মশানযাত্রী ছিলেন। শাহ হতেও দেখেছেন।

—বুঝেছি। হ্যাঁ, আমার নামে যে কলঙ্ক রটেছে তার কথা আমি শুনেছি। তোর পরামর্শটা আমার স্মরণে থাকবে।

—ছোটমার মৃত্যু হল কেমন করে?

–সেসব কথা তুই শুনতে চাস্ না, শোভা!

—অসুখে ভুগে? কী অসুখ? তুমি চিকিৎসা করেছিলে?

—বললাম তো! সে-কথা থাক!

—না, থাকবে না। আমার মন বলছে, ছোটমা, রাগে, দুঃখে অভিমানে, তীব্র ঘৃণায় গলায় দড়ি দিয়েছিল। আমাকে ছুঁয়ে বল, সত্যি কিনা!

শোভা হাত বাড়িয়ে রূপেন্দ্রনাথের পদস্পর্শ করে।

রূপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। বলেন, হ্যাঁ রে শোভা। তুই ঠিকই আশঙ্কা করেছিস-—মীনু আত্মঘাতী হয়েছিল।

শোভাও বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়ায়। অসঙ্কোচে রূপোদার হাতখানি টেনে নিয়ে বলে, আর একটা প্রশ্ন—মাত্র একটা! এটাই শেষ! বল, রূপোদা! ছোটমা আত্মঘাতী হয়েছিল কবে? তার সর্বনাশের আগে না পরে?

রূপেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে ওর মুঠি থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। বলেন, কী বলতে চাইছিস? ‘সর্বনাশ’ মানে?

শোভা বলে, আমি কচি খুকি নই, রূপোদা। কুলীন ঘরে না জন্মালে অ্যাদ্দিনে তিনছেলের মা হতাম! আমি জানি। সব জানি। আমার পূজ্যপাদ বাবামশাই আমার জোড়া নতুন-মাকে নিয়ে আবার কেন তীর্থদর্শনে গেছেন, তা কি বুঝি না আমি? সব বুঝি, রূপোদা, সব বুঝি! তুমি শুধু আমাকে জানাও ছোটমা কখন গলায় দড়ি দেয়? পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আগে, না পরে? ভেব না, এ আমার মেয়েলি কৌতূহল। এই সংবাদটুকু জানবার জন্য চার-চারটি বছর দাঁতে- দাঁত দিয়ে প্রতীক্ষা করে আছেন একজন—তোমার ফেরার পথ চেয়ে!

—কে? কার কথা বলছিস্ শোভা?

—ঐ হতভাগিনীর মা! মুখুজ্জে-খুড়োর ধর্মপত্নি—খুড়িমা। সে দারুণ খুশি হত, খুশি হবে, জানলে যে, তুমি ছোটমাকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে ঐ পিশাচটার নাগের ডগা দিয়ে নিরুদ্দেশের পথে চলে গিয়েছিলে!

—পিশাচটা?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার পরমশ্রদ্ধেয় বাবামশায়ের কথাই বলছি। কিন্তু খুড়িমা জানে, ছোটমার অতবড় সৌভাগ্য হবে না!

স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রূপেন্দ্রনাথ। মনে পড়ে গেল ত্রিকালজ্ঞ ঋষির সেই তিরস্কার : “ক্যা তু গঙ্গাপুত্র পিতামহ ভীষ্ম তো ন হো?”

কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য!! তিনি সংযম হারালে শুধু মীনু নয়, শুধু ত্রৈলঙ্গস্বামী নন, এই সুদূর সোঞাই গাঁয়ের একটি মহিলা—যিনি জেনে-বুঝে তাঁর আত্মজাকে সামাজিক যুপকাষ্ঠে বলি দিতে পাঠিয়েছিলেন তিনিও মনে মনে দারুণ খুশি হতেন।

সোঞাই গাঁয়ের পীতাম্বর মুখুজ্জের আত্মঘাতী মেয়ে—মীনু, লেখকের কল্পিত চরিত্র; কিন্তু ত্রিবেণীর কাছে বিশপাড়া গ্রামের দরিদ্রব্রাহ্মণ ভূষণ রায় তো তা নয়। সমাজদেবতার যূপকাষ্ঠে যুগলকন্যাকে বলি দিয়েও ভূষণ মুক্তি পায়নি। ইতিহাস বলছে,

ত্রিবেণীর কাছে বিশপাড়া গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ জাতিচ্যুত হলেন। সমন্বয়ের আশায় তিনি সেদিনের হিন্দু সমাজপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র আর্থিক দিক থেকে তেমন লাভবান হবেন না মনে করে সেই ব্রাহ্মণের সমন্বয় করলেন না। পরে সেই ব্রাহ্মণ ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের শরণাপন্ন হলে জগন্নাথ তাঁর সমন্বয় করে দিলেন। কৃষ্ণচন্দ্ৰ জগন্নাথের এই বীরোচিত আচরণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। কৃষ্ণচন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে ‘বাজপেয়’ যজ্ঞের পনের দিন ব্যাপী বিরাট অনুষ্ঠানকালে ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে বাদ দিয়ে নানাদেশীয় বিভিন্ন পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ করেন।*

[* মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ : ডঃ অলোককুমার চক্রবতী, 1989, p. 104.]

কৃষ্ণচন্দ্র মনে করেছিলেন এতে জবর অপমান করা হল তর্কপঞ্চাননকে। কিন্তু ক্ষুরধারবুদ্ধি জগন্নাথ যে পালটা চালটি দিলেন তাকে দাবার ভাষায় বলা যায় ‘ওঠসাই কিস্তি’। বিনা আমন্ত্রণেই যজ্ঞের পঞ্চমদিনে একশত ছাত্র নিয়ে জগন্নাথ ত্রিবেণী থেকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে এসে হাজির : “মহারাজের জয় হৌক! আপনি তো মহারাজ দক্ষের মতো বিরাট শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। তাই অনিমন্ত্রিতই এসেছি।”

কৃষ্ণচন্দ্র অপ্রস্তুতের একশেষ! মহারাজের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান করে তাঁবু খাটিয়ে জগন্নাথ যজ্ঞস্থানের কাছাকাছি সশিষ্য অবস্থান করেন। সম্পূর্ণ ব্যয়ভার নিজে বহন করেন। যজ্ঞ শেষে প্রথা মতো কৃষ্ণচন্দ্র জগন্নাথকে প্রশ্ন করেন, “বাজপেয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন হয়েছে তো?” জগন্নাথ প্রত্যুত্তর করেন, “রবাহুত জগন্নাথের স্বীকৃতির কি কোনও মূল্য আছে, মহারাজ? আপনি অন্যান্য নিমন্ত্রিত-পণ্ডিতদের মত নিন।”

কৃষ্ণচন্দ্র এ ব্যাপারে অত্যন্ত লজ্জা পেলেন।

জগন্নাথ ত্রিবেণীতে প্রত্যাবর্তন করে তাঁর অপমানের কথা সবিস্তারে জ্ঞাপন করলেন ‘মহারাজ’ নন্দকুমারকে। নন্দকুমার তখন নবাবের দেওয়ান। নন্দকুমার কৃষ্ণচন্দ্রকে সমুচিত শাস্তি দিতে নবাবের পাওনা বারো লক্ষ টাকা চেয়ে পাঠালেন। কৃষ্ণচন্দ্ৰ অসমর্থ হওয়ায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হল। পরে “গলদেশে কুঠার বন্ধন” করে জগন্নাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলে জগন্নাথের সুপারিশেই নবাব কৃষ্ণচন্দ্রকে মুক্তি দেন।

এসব ইতিহাসের কথা। কিন্তু ইতিহাসে লেখা নেই বিশপাড়া গ্রামের সেই অরক্ষণীয়া কন্যাদ্বয়ের শেষপর্যন্ত কী হল। কতদিন বা কয় সপ্তাহ পরে বৃদ্ধের সঙ্গে তাদের দুই বোনকে সহমরণে যেতে হল!

1748 থেকে 1996—আড়াই শ বছর হতে আর মাত্র দু-বছর বাকি। আজ সাতাশে অক্টোবর, 1996 তারিখে সংবাদ পত্র থেকে একটি উদ্ধৃতি না দিয়ে থমতে পারছি না :

কথা ছিল সামনের অগ্রহায়ণে বিয়ে হবে বসিরহাটের তরুণী সোমা ঘোষের পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু পাত্র গৌতম ঘোষের অতিরিক্ত পণের দাবিতে সব কেমন যেন’ ওলটপালট হয়ে গেল।… নারায়ণপুর হাইস্কুলের শারীর শিক্ষক গৌতম ঘোষের সঙ্গে সোমার বিয়ের ব্যাপারে প্রায় এক বছর ধরে কথাবার্তা চলছে। বাঙলায় অনার্স পার্ট টু পাঠরতা সুশ্রী সোমাকে দেখে পছন্দ হয়েছিল গৌতমের। কিন্তু পণের টাকা এবং যৌতুকের জিনিসপত্র নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পাত্রপক্ষের নানারকম বায়নাক্কার ফলে বিয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে থাকে। সোমার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বেতন যা পান, তাতে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। তার উপর পাত্র গৌতমের পরিবার দাবি করে বসল নগদ সত্তর হাজার টাকা, ফ্রিজ, গোদরেজ আলমারি, আসবাবপত্রসহ খাট ড্রেসিং টেবিল, ইত্যাদি। সোমার বাবা কৃষ্ণপদবাবু আত্মীয় স্বজনের কাছে ধার নিয়ে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে রাজিও হয়ে যান। কিন্তু টাকার অঙ্ক কমাতে বলায় গৌতম এর পর দাবি করে একটি রঙিন টি. ভি.। সোমার বাবা বলেন, বিয়ে হয়ে যাবার এক বছরের মধ্যেই রঙিন টি.ভি. কিনে দেবেন। কিন্তু পাত্রপক্ষ তাতে রাজি হয়নি।

পাত্রপক্ষের দাবির কথা জানার পর সোমা এগারই অক্টোবর সরাসরি পাত্র গৌতম ঘোষের সঙ্গে দেখা করেন। অতিরিক্ত পণ কেন দাবি করা হচ্ছে জানতে চান। সেদিনই গৌতম সোমাকে জানিয়ে দেয় যা যা চাওয়া হয়েছে সবই দিতে হবে। সোমা তাঁদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা আবার ভালভাবে জানিয়ে দেন। কিন্তু তাতেও গৌতমের মন গলেনি। বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে সোমা মনমরা হয়ে পড়েন। অবশেষে মঙ্গলবার বিজয়া দশমীর বিসর্জনের দিনে সোমা নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন। কৃষ্ণপদবাবু এবং তাঁর স্ত্রী স্বপ্ন দেখেছিলেন ভাল পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন। কিন্তু শিক্ষক পাত্রও যে পণের লোভে একটি তরুণীকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে পারে, সে-কথা ভাবতে পারেননি ঘুণাক্ষরেও। বসিরহাট থানার কর্তৃপক্ষ সোমার আত্মহত্যার ব্যাপারে একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু সমাজ কী চিনে রাখবে গৌতম ঘোষের মতো পণলোভী পাত্রদের? প্রশ্নটি সাংবাদিককে করলেন সোমার শোকাহত বাবা-মা। কিন্তু তাঁর প্রশ্নের জবাব কে দেবেন জানা নেই।

প্রশ্নটি তুলেছেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার বসিরহাটের নিজস্ব সংবাদদাতা। আমি যদি সাহিত্যসেবীর বদলে সমাজসেবী হতাম। আর বয়স, যদি বছর দশেক কম হত তাহলে বলতাম “জবাব দেব আমি।

চলে যেতাম বসিরহাটে। খুঁজে বার করতাম—সোমাদের সাঁইপালা এলাকাতে না হলেও—বসিরহাট অঞ্চলে কোনও-না-কোন প্রগতিবাদী নারী-সংগঠনকে। থানা ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর মামলা নিয়ে কিছুই করতে পারবে না। সোমাকে কেউ আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিল এটা প্রমাণ করা শক্ত। দুর্গা গাঙ্গুলিকেই কি আজকের দিনে দায়রায় সোপর্দ করা যেত, মিনুকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিল বলে? ঘৃণার প্রকাশ আপনিই হয়। লক্ষ্য করে দেখুন, সংবাদদাতা পার্টটু পাঠরতাকে বরাবর ‘আপনি’ সম্বোধন করেছেন, অথচ তার চেয়ে বয়সে বড়, স্কুলের শিক্ষককে ‘আপনি’ সম্বোধন করতে প্রতিবারেই সাংবাদিকের কলম বিদ্রোহ করেছে। এই পণলোভী পিশাচের দল ও অপমানটুকু গায়ে মাখে না।

নারী-সংগঠন, স্ত্রীস্বাধীনতার সংগ্রামে যাঁরা ব্রতী, তাঁরাই পারেন প্রতিবাদ করতে প্রতিবিধান করতে। এইসব পাত্রকে নারী-সমাজের সমবেতভাবে বয়কট করা উচিত। পুলিশ কী করছে, বিধায়ক বা গ্রাম-পঞ্চায়েতী, রাজনীতি-ব্যবসায়ী দাদারা কী করছেন, তা জানার দরকার নেই। নারী সংগঠনগুলির কর্তব্য এ-সব ক্ষেত্রে নিজেরা অগ্রসর হয়ে পাত্র ও পাত্রীপক্ষের সঙ্গে কথা বলা। যদি মহিলা সংগঠন সিদ্ধান্তে আসেন যে, পাত্রপক্ষের পণের দাবির জন্যই কোনও অনুঢ়া কন্যা আত্মহত্যা করেছে-সেক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেবেন। ঐ পাত্রটি যাতে কোনও বিবাহযোগ্যাকে বিয়ে করতে না পারে তার জন্য আন্দোলন করতে পারেন। পোস্টার দিতে পারেন, স্থানীয় সাময়িক পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে সম্পাদকীয় লেখাতে পারেন—নিজেরাও প্রবন্ধ লিখতে পারেন। মোটকথা ঐ সব পণলোভী বর্বরদের সুস্পষ্টরূপ চিহ্নিত করা দরকার।

সংবাদদাতা বলেছেন, কৃষ্ণপদবাবু নাকি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ভাল পাত্র। পাত্র তো ভাল বটেই। শারীর শিক্ষার শিক্ষক। অন্তত ‘গঙ্গারাম’-এর তুলনায়—না, ভুল হল—গঙ্গারাম কোনও পণ দাবি করেছিল বলে জানা নেই। উনিশটিবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গঙ্গারামের পাত্র হিসাবে কী বাজারদর ছিল, তা আমরা জানি না। এখানে তা জানি।

যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে, কোনও পাত্রের ওজন সত্তর কিলোগ্রাম, এবং সে যদি সত্তর হাজার টাকা দর হাঁকে—পাত্রী স্বয়ং এসে অনুরোধ করা সত্ত্বেও (দু’জনের পরিচয় ছিল কি না বলা হয়নি) সত্তর হাজার টাকা দর কমাতে রাজি না হয়, তাহলে অঙ্কশাস্ত্ৰ অনুসারে সে পাত্রের বাজার দর হাজার টাকা/কে.জি/তা ভালজাতের জ্যান্ত পাঁঠার দর যখন একশ টাকা/কে.জি. তখন গঙ্গারামতুল্য সুপাত্রের দর তো হাজারটাকা/কে.জি হতেই পারে। মুশকিল এই, কৃষ্ণপদবাবু মেয়ের বিয়ের বাজার করতে গিয়ে—সে যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন অবশ্য—গোটা-পাঁঠা, নাও কিনতে পারতেন। কিন্তু পাত্রের ক্ষেত্রে রাঙ-এর মাংস, মেটুলি বা কলিজার মাংস কেনা যাবে না। গোটা পাঁঠাই কিনতে হবে—ঐ হাজারটাকা/কে.জি. দরে!

সোমা ঘোষ আজ আমার নাগালের বাইরে। ছোট্ট সোমা। তুমি আজ অমর্ত্যলোকের বাসিন্দা—’সেথা তুমি অগ্রজ আমার!’ আমার লেখা আর সেই বাঙলা অনার্সের ছাত্রীটি পড়তে পারবে না। তাই সোমার মতো দিদিভাইদের কাছে এই সুযোগে দুটো মনের কথা বলে নিই। জানি, এটা ধান ভানতে উমার গীত হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটা যে ঘটল উমামায়ের বিসর্জনের দিনেই। আমি থাকি-না-থাকি, উমা-মা ফিরে আসবেন,

আগামী বছর—তাই তাঁকে ‘পুনরাগমনায় চ’ মন্ত্রে বিসর্জন দিয়েছি। অভিমানিনী সোমা-মা ফিরে আসবে না কোনদিন।

প্রতি সপ্তাহেই অন্তত দু-তিনটি সংবাদ নজরে পড়ে—অভিমানিনী আত্মহত্যা করেছে। পরিসংখ্যান হাতের কাছে নেই, মনে হয় আত্মঘাতীর অপেক্ষা আত্মঘাতিনীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যাটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় সেকেন্ডারি, হায়ার-সেকেন্ডারি, বা, বার্ষিক-পরীক্ষার সময়ে। এরা খারাপ ফলের আশঙ্কায়, ‘ফেল’-করার আশঙ্কায়, আত্মহনন করে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি—পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে জীবনে সাফল্যলাভের একটা ক্ষীণ সম্পর্ক আছে বটে; কিন্তু সেটা নিতান্তই ক্ষীণ। বিভিন্ন পর্যায়ে—স্কুলে, কলেজে, যাদের ফার্স্ট-সেকেন্ড হতে দেখেছি তাদের অনেক-অনেককেই অফিসের বড়বাবু, মাঝারি ব্যবসায় বা স্কুলশিক্ষক হিসাবে জীবন শেষ করতেও দেখেছি। অপরপক্ষে জীবনে কখনও ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়নি এমন সহপাঠী সর্বভারতীয় সুনাম লাভ করেছে। সহপাঠী সত্যানন্দ প্রামাণিক পূর্বভারতের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ অ্যানাথিস্ট হয়েছিল—সর্বভারতীয় সংস্থার প্রেসিডেন্ট ছিল সে। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জিমমুকুল দত্ত বি.ই.-মিলিটারি সার্ভেয়ার হিসাবে এভারেস্টের উচ্চতা মেপে সেটা সংশোধন করেছিল। বাদল সরকার নাট্যজগতে আজ প্রবাদপুরুষ। আমার এইসব সহপাঠীর ভিতর কেউই পরীক্ষায় প্রথম-দ্বিতীয় হয়েছিল বলে তো মনে পড়ছে না। আমি নিজেও অঙ্কে একবার একশয় সতের পেয়েছিলাম। পরে ম্যাট্রিক অঙ্কে লেটার পাই এবং বি.এস.সি-তে অঙ্কে অনার্স নিই! আইনস্টাইনের স্কুল-শিক্ষক নাকি ছাত্রের অভিভাবককে লিখেছিলেন, ‘ছেলেটির রচনাশক্তি ভাল, বুদ্ধিও আছে, তবে অঙ্কে কাঁচা। ‘ম্যাথস্’ বাদে যে কোন বিষয়ে ও পারদর্শিতা দেখাতে পারবে।’

তাই বলছি, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রক তোদের ইঁদুর দৌড়ে বাধ্য করেছে, তা করুক। সেটাই জীবনের শেষ কথা নয়। স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকা, হয়তো বাড়ির অভিভাবক/অভিভাবিকার দল, বন্ধু-পড়শীরা বুঝিয়েছে পরীক্ষার ফলই জীবনের পরমার্থ। কথাটা—মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা! জীবন অনেক বড়, অনেক ব্যাপক। তার সাফল্যের মাপকাঠি অন্যরকম। এই প্রপঞ্চময় জগতকে ভালবাসা, তা থেকে আনন্দ আহরণ করা—আনন্দ দেওয়া, ভালবাসতে পারা এবং ভালবাসা পাওয়া—অনেক-অনেক বড় জাতের প্রাপ্তি!

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অথবা অভিভাবকদের কন্যাদায়ের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে অনেকে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়; যেমন সোমা দিল! কী অপরিসীম দুঃখের কথা! বাবা-মাকে বারণ করে দে, বলে দে যে, যে-মানুষ নিজের উপার্জনে স্ত্রীর ভরণপোষণে অক্ষম—এমনকি সখের রঙিন টি.ভি.টাও শ্বশুরের ঘাড় ভেঙে আদায় করতে চায়—তেমন নপুংশকের গলায় তোরা মালা দিবি না। হাজার টাকা দর থেকে নামতে নামতে একশ টাকা/কে.জি. দরে যদি পৌঁছায় তবু ঐ জাতির বোকা-পাঁঠা কিনিস্ না।

‘আত্মহত্যা’ ব্যাপারটা আজকাল বড় ‘জল-ভাত’ হয়ে গেছে। কেন বল্ তো? মাস চারেক আগে একদিন খবরের কাগজে একটা বিচিত্র খবর পড়লাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিল। বাড়ির গিন্নি-মা তাই খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করলেন। বাজার বসেনি, ফলে ঘরে যা ছিল তাই হল অনুপান। আলু, আর পাঁপর ভাজা। আর ছিল দুটো ডিম। হল ডব্‌ল ডিমের অমলেট। বাবা-মা; মেয়ে বড়, ছেলে ছোট। মেয়ে নাকি বায়না ধরল ডবল্ ডিমের অমলেটটা গোটাই খাবে সে। মা বললেন, বাবু! তা কি করে হয়? আমি না হয় খাব না, তিন ভাগ তো করতে হবে!

মেয়ে উঠে চলে গেল। নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিল। সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে!

সংবাদটা একাধিক সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা পরিবেশন করেছেন। ফলে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিদারুণ দুঃখজনক সংবাদ! মেয়েটির বাবা-মায়ের জন্য পূর্ণ সহানুভূতি সত্ত্বেও লিখতে বাধ্য হচ্ছে—কোথাও কিছু একটা ত্রুটি হয়েছিল। মেয়েকে মানুষ করে তুলতে। কতটা অবদান স্কুলের, কতটা বাড়ির, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশীর তা জানি না—কিন্তু বাবা আর ছোট ভাইকে বঞ্চিত করে গোটা ডবডিমের অমলেটখানা পেল না বলে যে মেয়ে আত্মহত্যা করে…

আমার নিজের একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর-পাঁচেক আগেকার কথা আমি নিজে হাসপাতাল থেকে সদ্য ফিরে এসেছি। বেশ দুর্বল। হঠাৎ রেজিস্ট্রি ডাকে একটি চিঠি পেলাম। লিখছে আমার রচনার একজন অপরিচিতা পাঠিকা। সাধারণ কাগজে–কোনায় তার নাম-ঠিকানা লেখা। ধরা যাক মেয়েটির নাম লিপিকা। ঠিকানাটা বহির্বাংলার। সংক্ষিপ্ত পত্ৰ :

লিখেছে ওর বয়স ত্রিশ। গত বৎসর বিবাহ করেছে। এখনো বিবাহ-বার্ষিকী আসেনি। সেটা কত তারিখে হবে তা জানায়নি; তবে তারিখটা যে প্রত্যাসন্ন এটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। লিপিকা লিখেছে, সে যাকে বিয়ে করেছ তাকে ভালবেসেই করেছে—বাবা-মার ব্যবস্থাপনায় নয়। কিন্তু এই সপ্তাহখানেক হল সে জানতে পেরেছে যে তার স্বামী—কর্মোপলক্ষ্যে তখন দিল্লিতে পোস্টেড—প্ৰাকবিবাহ-জীবনে একটি বিধবাকে ভালবাসত এবং ওদের দুজনের একটি অবৈধ সন্তানও আছে। এই সংবাদে জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে লিপিকা স্থির করেছে সে আত্মহত্যা করবে। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে। ওর স্বামী জানিয়েছে যে, ছুটি পাবে না—ওর কাছে আসতে পারবে না। লিপিকার আন্দাজ : বিধবা মেয়েটি তখন দিল্লিতেই কোথাও ছিল। সে আমাকে লিখেছিল, “কবে আত্মহত্যা করব তা স্থির করেছি, কিন্তু কীভাবে করব তা বলতে পারছি না। কারণ আমার ভাইঝি—শ্যামলী বসু আসানসোলে ঊষাগ্রাম হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে—সে আমাকে ভীষণ ভালবাসে। তার কাছে লুকাতে চাই যে, আমি আত্মহত্যা করেছি। কারণ সে তার পিসিকেও দারুণ ভালবাসে।… আপনাকে এ চিঠি লিখছি একটি বিশেষ কারণে। আমার এই ত্রিশ বছরের জীবনের ট্র্যাজেডিটা ডায়েরি আকারে বিস্তারিত লিখেছি। আপনাকে রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠিয়ে দেব। আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ : সেইটা অবলম্বনে একটা বই লিখবেন এবং তার এক কপি আমার স্বামীকে পাঠিয়ে দেবেন। আমাদের নামধাম বদলে দেবেন : স্বামীর নাম-ঠিকানা আমার ডায়েরিতে থাকবে। আশা করি মৃত্যুপথযাত্রীর এই অনুরোধটুকু রাখবেন।

বোঝ কাণ্ড!

আমি তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাবটা লিখে ক্যুরিয়ার সার্ভিসে লিপিকাকে পাঠিয়ে দিলাম। সংক্ষিপ্ত চিঠিতে আমি ওর পত্রপ্রাপ্তি স্বীকার করে লিখেছিলাম, “আমি দুঃখিত! তোমার অনুরোধটা রাখতে পারব না। আমার উপন্যাসের নায়িকা ঐ অবস্থায় পড়লে হয় তার স্বামীকে সংশোধনের চেষ্টা করত অথবা তাকে ডাইভোর্স করে নতুন করে সংসার পাতত। কিছুতেই আত্মহত্যা করত না। তুমি ইতিমধ্যে তোমার ডায়েরিটি যদি পাঠিয়ে দিয়ে থাক তাহলে আমি সেটি গ্রহণ করব। পড়ব না। রেজিস্ট্রি ডাকে আসানসোলে নবম শ্রেণীর শ্যামলী বসুকে ঊষাগ্রাম স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের কেয়ারে পাঠিয়ে দেব। তার জানা থাকা দরকার : পিসি কীভাবে জীবনে হার মেনে নিয়েছিল। তাহলে নিজের জীবনে সে ঐ একই ভুল করবে না।”

তোমরা খুশি হবে শুনলে : প্রায় মাস-খানেক পরে লিপিকা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল। এবার লেটার হেডে। সে এম.বি.বি.এস ডাক্তার—গাইনোতে ডিপ্লোমা আছে। একটা হাসপাতালে কর্মরতা। কী জানি চিঠির মাধ্যমে আমি তার গালে একটা থাপ্পড় না কষালে সে হয়তো সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঐ সোমা ঘোষের মতো আত্মহননের পথটাই বেছে নিত। লিপিকার সঙ্গে আর আমার পত্রালাপ হয়নি। সে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়েছে কি না, তাও জানি না। বলাবাহুল্য নামধাম সব বদলে লেখা। ঘটনাটা আদ্যন্ত সত্য!

মানছি, এই অনুচ্ছেদটা মূল-কাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত। কিন্তু খোলামনে এই কথাগুলো না বলে শান্তিও পাচ্ছিলাম না, রে। ভূষণ রায়ের দুই অরক্ষণীয়া কন্যা আত্মহত্যা করেনি—সমাজ তাদের হত্যা করেছে। তারা তো মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পীতাম্বর মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে মৃন্ময়ী সামাজিক পৈশাচিকতাটা মেনে নেয়নি। তার কোনও উপায় ছিল না—আত্মহনন ব্যতিরেকে। যে-অবস্থায় পড়ে শত শত রাজপুত রমনী জহরব্রত পালন করেছেন মীনু খুড়িমা পড়েছিল সেই অবস্থায়। হয় নারীধর্ম, নয় জীবন—একটা ত্যাগ করতে হবেই। সে জীবনটাকেই বেছে নিয়েছিল।

কিন্তু, দিদিভাইয়েরা। তোরা মীনুর চেয়ে আড়াই শ’বছর এগিয়ে আছিস—বুড়ো দাদুর এই কথাটা ভুলিস্ না। কিছুতেই হার স্বীকার করিস না। আবার বলি : জীবন ব্যাপক! জীবন মহান! ‘মনেরে আজ কহ যে/ভালমন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে।’

আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। অর্থাৎ রূপেন্দ্রনাথের স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তনের প্রায় দিন দশ-বারো পরের কথা। ভেবেছিলেন, দিন-তিনেকের ভিতরেই দু-খানি ঘর বাসোপযোগী করে ফেলবেন। বাস্তবে তা হয়নি। পিঠামুলি বাঁশের দেওয়াল বাঁধা, উলুখড়ের ছাউনি, ভিত ভরাট করিয়ে নিকানো, জানলা-দরজা স্বস্থানে স্থাপন করতে প্রায় একপক্ষকালই লেগে গেল। তারপর গোপনে আসতে শুরু করল মালপত্র, আসবাব। খাট-পালঙ্ক, তোরঙ্গ, তৈজসপত্র—মায় লক্ষ্মীর পট, গৃহদেবতা এবং তার সিংহাসন। পূজার নানা তৈজস-তাম্রপাত্র, ঘণ্টা, পিলসুজ, জলশঙ্খ, শঙ্খ, কোষাকুশি—সব কিছু। কালবৈশাখী ঝড়ে যখন বন্দ্যোঘটি পরিবারের বাস্তুখানি পতনোন্মুখ হয়ে পড়ে তখন পঞ্চায়েতের নির্দেশে জমিদার তারাপ্রসন্ন সেই অনুপস্থিত গৃহস্থের যাবতীয় অস্থাবর নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এটাই ছিল সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর গ্রামীণ ব্যবস্থাপনা। কোন গৃহস্থ সপরিবারে বিদেশে গেলে এবং তাঁর প্রত্যাবর্তনে অপ্রত্যাশিত বিলম্ব হলে পঞ্চায়েতে স্বয়ং-প্রবৃত্ত হয়ে ঐ গৃহস্থের যাবতীয় অস্থাবরের নিরাপত্তার বিধান করত! ইতিহাসে এ-কথা লেখা নেই—আর এই এতভঙ্গ বঙ্গদেশের সামাজিক ইতিহাস কেই বা লিখে রেখেছে! কিন্তু দু-একজন শিক্ষিত ভূম্যধিকারীর প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ ও রোজনামচা পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি। জমিদারের খাজাঞ্চিবাবু তালিকা ধরে অনুপস্থিত রূপেন বাড়ুজ্জের প্রতিটি গচ্ছিত-সম্পদের হিসাব দিলেন—মায় অঙ্গমার্জনাবস্ত্র, সৌরীন্দ্রনাথের বাতিল বৌলহীন খড়মজোড়া এবং সেই জীর্ণ বস্ত্রখণ্ড, যাতে রূপেন্দ্রজননীর অলক্তকরাগরঞ্জিত চরণদ্বয়ের ছাপ নেওয়া হয়েছিল শ্মশানযাত্রার পূর্বে—রূপেন্দ্রনাথ তখন শিশু।

ঘটনাচক্রে এবার বৈশাখী পূর্ণিমা পড়েছে বৃহস্পতিবারে। তারাপ্রসন্ন বললেন, এই দিনটি শুভ! ঐ দিনেই নূতন করে গৃহপ্রবেশ কর হে রূপেন। একে পূর্ণিমা, তায় লক্ষ্মীবার। সঙ্গে সত্যনারায়ণের একটা পূজার আয়োজন করে ফেল।

মালতীও জনান্তিকে তাতে সায় দিল, তাই করুন, ঠাকুরপো। সত্যনারায়ণের সিন্নি নিতে পাঁচবাড়ির মহিলারা আসবেন। সকলের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়ে যাবে এই সুযোগে।

বোধকরি মালতী মনে মনে আশা করছিল যে, সত্যনারায়ণ পূজার সিন্নি-প্রসাদ পেতে এসে প্রতিবেশিনীদের খরজিহ্বা শাণিত হবার অবকাশ পাবে না। রূপেন্দ্রনাথের বৌঠান হিসাবে গ্রাম্যনারীসমাজে সে স্বীকৃতি পাবে। শোভারাণী—দুর্গা গাঙ্গুলীর অরক্ষণীয়া মেয়েটিও নিত্যি হাজিরা দিয়ে চলেছে, সে-ও বলে, সবার প্রথমে একটা সত্যনারায়ণের পূজা লাগিয়ে দিন, রূপোদা। আপনি না হয় এ বাড়িতে ছেলেবেলায় কাটিয়েছেন রূপো-সোনা তো তার জীবনের প্রথম রাতটা কাটাবে আজ এর বাস্তুভিটার ছায়ায়।

কথাটা মনে ধরল রূপেন্দ্রনাথের। রাজি হয়ে গেলেন তিনি। একবার ক্ষীণ আপত্তি করতে গিয়েছিলেন, আর্থিক অনটনের কথা বিবেচনা করে—তারাপ্রসন্ন তাঁকে মারতে বাকি রেখেছেন। তারাপ্রসন্নের যুক্তিটাও ফেলে দেবার নয়। ঐ ধন্বন্তরী-কবিরাজের অলৌকিক চিকিৎসার আয়োজন না হলে ছয়-সাত বছর আগেই তারাপ্রসন্ন মাতৃহীন হয়ে যেতেন। যে মহিলাটির গঙ্গাযাত্রার আয়োজন সুসম্পন্ন সেই বৃদ্ধাকে তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন সংসারে! আজও তিনি কাশীধামে বর্তমান। সেই অবিশ্বাস্য চিকিৎসার পর থেকেই রূপেন্দ্রনাথ হয়েছেন : ধন্বন্তরী।

রূপেন্দ্র বলেন, সে জন্য জেঠামশাই তো আমাকে যথারীতি বৈদ্যবিদ্যায় দিয়েছিলেন, তারাদা।

তারাপ্রসন্ন বলেন, জানা আছে আমার! বাবামশাই তোমাকে দিয়েছিলেন একটা গ্রামীণ চিকিৎসালয় আর একটা একবগ্গা দীঘি। এই তো? সে তো তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসাবাবদ। কিন্তু আমাকে যে প্রায় একদশককাল মাতৃহীনদশা থেকে তুমি মুক্তি দিয়েছ, তার প্রতিদান আমাকে দিতে দেবে না? তাছাড়া, এ তো আমি তোমাকে বৈদ্যবিদ্যায় দিচ্ছি না। আমার ভগ্নী কুসুমমঞ্জরীর একমাত্র কন্যা রূপমঞ্জরী এই পূর্ণিমাতে তার বাস্তুভিটায় গৃহপ্রবেশ করবে। তাই আমি আর তোমার বৌঠান সত্যনারায়ণের পূজার ব্যবস্থা করেছি। তুমি বাধা দেবার কে? সব ব্যয়ভার আমার। রূপেন্দ্র বলেছিলেন, এরপর আর কথা চলে না।

একটু কী-যেন চিন্তা করে তারাপ্রসন্ন জানতে চেয়েছিলেন, তুমি মহাপ্রসাদ মুখে দাও না, অথচ ‘বৃথামাংস’ গ্রহণে তোমার বিকার নেই! সত্যনারায়ণ পূজায় তোমার নৈতিক আপত্তি নাই তো, রূপেন?

রূপেন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন, না, তারাদা, তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ। আমি বুদ্ধদেবকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা করি; কিন্তু তাই বলে আমি নাস্তিক নই। বস্তুত ব্রাহ্মণ্যধর্মের তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে সত্যনারায়ণকেই আমার সব চেয়ে ভাল লাগে।

তারাপ্রসন্ন অবাক হয়ে বলেন, ও আবার কী কথা? কেন?

—কারণ গ্রামীণ ভারতবর্ষে প্রধান যে দুটি সম্প্রদায়—হিন্দু আর মুসলমান—তারা ঐ দেবতার দরবারেই মিলিত হয়। ‘সত্যনারায়ণে’র পরিপূরক ‘সত্যপীর’! দোল-দুর্গোৎসব- দীপান্বিতার বিপ্রতীপ উৎসব গ্রামীণ মুসলমান সমাজে অপ্রচলিত –আবার মহরম, ফতেয়া- দোয়াজ-দাহম, বক্র-ঈদ-এর বিপ্রতীপ উৎসব প্রচলিত নেই হিন্দু সমাজে। স্বীকার্য, রঙ দোলে অন্তত বাঙলার গ্রামে মুসলমানেরাও রঙ মাখে, মহরমে হিন্দুর ছেলে হাসান-হুসেনের দুঃখে বুক চাপড়ে কাঁদে—কিন্তু সেটা ‘সত্যনারায়ণ-সত্যপীরের’ মতো একসুরে বাঁধা নয়। এই লৌকিক দেবতা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রাখিবন্ধন করেছেন।

—কিন্তু একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বল তো, রূপেন। তুমি শাক্ত বাড়ির সন্তান, পাঁঠার মাংস খাও—

—না, তারাদা, বিপত্নীক হবার পর…

—জানি, আমি তার আগেকার কথা বলছি। সস্ত্রীক তীর্থযাত্রা করার পূর্বে তুমি আমিষ আহার করতে অথচ মহাপ্রসাদ গ্রহণ করত না! তাই না? কেন?

—তুমি কী করে জানলে?

—আমি জানি, অনেকদিন আগেকার কথা—তুমি দুর্গা খুড়োর নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলে। শুনেছি, তার কারণটা ঐ—’মহাপ্রসাদ’ গ্রহণে তোমার আপত্তি। কারণটা কী জানি না।

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, খাদ্য-খাদকের সম্পর্কটা মানুষের সৃষ্টি নয়। এটা জীবগতের অনস্বীকার্য আইন। হরিণ, গরু, খরগোশ ঘাসপাতা খায়। ঘাসপাতার প্রাণ নেই। ফলে জীবহত্যা না করে তারা জীবনধারণ করতে পারে—বনের বাঘ, সিংহ তা পারে না। এ নিয়ম প্রাকৃতিক বিশ্ব-প্রপঞ্চ, যিনি সৃষ্টি করেছেন এ তাঁর নিয়ম। তাই মৎস্য বা মাংস-ভক্ষণে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু যাকে তোমরা ‘মহাপ্রসাদ’ বল, অর্থাৎ বলিদান করা পশুর মাংস তো দেহধারণের জন্য, জৈবিক বৃত্তির জন্য খাওয়া হয় না—সেটা ধর্মের অঙ্গ হিসাবে ভক্ষ্য। তাতেই আমার আপত্তি। আদিযুগ্রে শক্তি উপাসকেরা নির্দেশ দিয়েছিলেন : মায়ের বেদীসম্মুখে বলি দিতে হবে অন্তরের ষড়রিপুকে—‘কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য’কে। তারই প্রতীক হিসাবে বলি দেওয়া হত একটি কুষ্মাণ্ডকে। ক্রমে কুষ্মাণ্ডর স্থলে এল একটি ছাগশিশু—ষড়রিপুর প্রতীক। কালে মানুষ ভুলে গেল : কী ছিল মূল উদ্দেশ্যটা। ষড়রিপুকে বলি দেওয়া নয়, ঐ ছাগশিশুর মাংসে উদরপূর্তি করার মধ্যেই তারা মুক্তি পথ খুঁজতে থাকে। ‘পঞ্চ ম-কার’-এর পঙ্ককুণ্ডে ভেসে গেল তাদের শুভবুদ্ধি, ব্যভিচারের পঙ্কিল পাপকুণ্ডে। আমার ঐ সিদ্ধান্ত এই ধর্মীয় ভ্রান্তির প্রতিবাদে।

তারাপ্রসন্ন ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, কিন্তু তোমার ঐ নীরব প্রতিবাদে কী লাভ হল সমাজের? কেউ তো তা জানতে পারবে না।

—নিশ্চয় কিছুটা লাভ হবে। এই তো, দেখ না, তোমার দীর্ঘদিনের কৌতূহল চরিতার্থ করতে তুমি প্রসঙ্গটা আজ উত্থাপন করলে। ব্রাহ্মণ্যধর্মের একজনকে তো তত্ত্বটা বলার সুযোগ হল? হল না? তারপর ধর, কথাটা যদি তোমার মনে ধরে থাকে তবে হয় তো আজ রাতেই তুমি বৌঠানকে সবিস্তারে কেচ্ছাটা শোনাবে।

—’একবগ্গা’ কেন ‘মহাপ্রসাদ’ ভক্ষণ করে না জান? সে এক আজব কাণ্ড! শোন বলি—’। কাল সকালে বৌঠান হয়তো বলবে পুঁটুরানীকে।

সাড়ম্বরে ঁসত্যনারায়ণ পূজা সারা হল। সত্যনারায়ণের পূজা উপলক্ষে গৃহস্থ তার প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ করতে যায় না; তবে সংবাদটা জানাতে হয়। সে দায়িত্ব নিয়েছিল শোভারাণী আর জীবন দত্ত। শোভারাণী রূপমঞ্জরীকে শিখিয়ে দিয়েছিল আমন্ত্রণের কায়দা : “আমার বাবামশাই .হচ্ছে ভেষগাচার্য-রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা গায়ে ফিরে এসেছি। আজ রাত থেকে আমরা আমাদের সাবেক ভিটেতে আবার বসবাস শুরু করব। তাই আজ আমাদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজা হবে। আপনারা সিন্নি প্রসাদ নিতে আসবেন।”

শুনে পাঁচ বাড়ির মেয়েরা হেসেই বাঁচে না—ওমা! কী সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটি হয়েছে। রূপোদার/রূপোকাকার/রূপো ঠাকুরপোর!

একবেলার মধ্যেই সারা গাঁয়ে ‘রূপমঞ্জরী’ পরিচিতা হয়ে গেল। শোভারাণী ওকে জমিদার বাড়িতেও নিয়ে গেল। তারাসুন্দরী রূপোকে কোলে করে সব মহলে ঘুরিয়ে নিয়ে এলেন।

পূজা কিন্তু রূপেন্দ্রনাথ নিজে করলেন না। পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত করলেন শিরোমণি- মশাইকে—যাঁকে চিরকাল জগু-ঠাকরুণ ডেকে আনতেন পূজা-পার্বণে। বার-ব্রতে। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে গ্রন্থপূজার আয়োজনে। রূপেন্দ্রনাথ আন্তর গভীরে অদ্বৈত-বৈদান্তিক। তাছাড়া সাবেক পুরোহিতের রুজি-রোজগারে অহেতুক হস্তক্ষেপ করবেন কেন?

উঠানের মাঝখানে একটি ছোট্ট চাঁদোয়া। তার নিচে সত্যনারায়ণের সিংহাসন। উঠোনজোড়া আলপনা। শোভারাণী আর হরিমতি আলপনা দিয়েছে। আহা! আজ কাতুটা থাকলে কত খুশি হত! আর জগুপিসি!

হ্যাঁ, এতদিনে সংবাদ পেয়েছেন—সেই নারী বিদ্রোহিনী, ওঁর পিতৃস্বরূপ জগুঠাকরুণের প্রয়াণের মাসছয়েক পরে এ ভদ্রাসন ত্যাগ করে কাত্যায়নী। তার খঞ্জ স্বামীকে নিয়ে নতুন সংসার পাততে গিয়েছিল। বর্ধমান-সরকারের নায়েব-কানুনগো নগেন দত্ত মশায়ের, মাতৃশ্রাদ্ধর দান গ্রহণ করে নতুন বাস্তু বাঁধতে ওরা স্বামীস্ত্রী ভিনগাঁয়ে চলে যায়। আহা! তারা সুখে থাক। রূপেন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে প্রার্থনা করেন। যাক, তাহলে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার আগে জগুপিসি একটু গঙ্গাজল পেয়েছিল মেয়ের হাতে! বৈকুণ্ঠলোক যদি আদৌ থাকে- -আহা-পিসি যেন সেখানে একটু ঠাঁই পায়।

পাঁচ-প্রতিবেশীর এয়োস্ত্রী, কন্যা এবং বিগতভর্তার দল ভিড় করে এসেছিলেন সত্যনারায়ণের পূজায় সিন্নি পেতে। রূপেন্দ্রনাথকে সবাই আন্তরিক ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রটাকে ভয়ও করে। রূপোদাটা যেন কালাপাহাড়! বলে কি যে, ‘মহাপ্ৰসাদ’ মুখে দেব না! কী-অসৈরণ কতা। তা হোক, সমাজপতিরা যেখানে অন্যায় জুলুম করেন সেখানে ঐ প্রতিবাদী মানুষটাই বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় দুর্বলের পক্ষ নিয়ে। ঐ কন্দর্পকান্তি মানুষটিই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বেষ্টা-বায়েনের গর্ভবতী স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে। বেষ্টার সেই শিশুটি এখন হামা-দেওয়া ছেড়ে হাঁটতে শিখেছে। সে তো জীবন পেয়েছে ঐ রূপো-ঠাকুরপোর দয়াতেই!

ছোট্ট উঠানটিতে যেন সুন্দরীদের হাট। জমিদারবাড়ি থেকে এসেছেন তারাসুন্দরী, তাঁর ননদ পুঁটুরাণী, ননদের মেয়ে, নন্দদুলালের দুই সহধর্মিনী, তার ভগ্নী, ভাগিনেয়ী। কন্যা হরিমতী। মৃন্ময়ীর মা আর বৃদ্ধা পিসিমা বালবিধবা গিরিবালা। দুর্গা গাঙ্গুলীর কন্যা আর ভাইঝি- -আরও কত কত বাড়ি থেকে। পুরুষেরা বসেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রূপমঞ্জরী আর শুভপ্রসন্ন একেবারে পুরোহিতের নাকের ডগায়। হাত ধরাধরি করে। আর মালতী এক গলা ঘোমটা দিয়ে প্রায় সর্বত্র।

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এলেন পীতাম্বর মুখুজ্জে।

—এই যে বাবাজীবন। অ্যাদ্দিনে গাঁয়ের কতা মনে পড়ল?

রূপেন্দ্রনাথ মৃন্ময়ীর পিতাকে প্রণাম করে বললেন, বহু দূর দূর তীর্থ ঘুরে এলাম, খুড়ো পুরী এবং কাশীধাম ও।

—শুনেছি। তুমি একটু ইদিকে সরে আসবে, বাবা? তোমার সঙ্গে কিছু গোপন কতা ছিল-

রূপেন্দ্র একটু আড়ালে সরে এসে বললেন, আপনি যা জানতে চান তা আমি মোটামুটি তারাদাকে জানিয়েছি। শোভারাণীকেও বলেছি। জানি, আপনি বা খুড়িমা আরও বিস্তারিত জানতে চান—মীনুর বিষয়ে, তাই তো—কিন্তু এখন, এই পরিবেশে…

—বটেই তো, বটেই তো! আমি কাল সকালে আর একবার আসব বরং। খুকির প্রসঙ্গ ছাড়া আরও কিছু আলোচনা করার আছে।

—বেশ তো আসবেন। সব কথাই খুলে বলব আপনাকে। শুনব।

নন্দ চাটুজ্জেও ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে—তাঁর বাতের ব্যথাটা আবার চাগিয়েছে—ঘনিয়ে এলেন। তাঁকে এগিয়ে আসতে দেখে সরে গেলেন পীতাম্বর মুখুজ্জে। গ্রামসম্পর্কে খুড়ো- মশাইকে প্রণাম করতে হল রূপেন্দ্রনাথকে। নন্দ বললেন, চিরায়ুষ্মান হও বাবা! শুনলাম বৌমা নাকি ড্যাংডেঙিয়ে স্বর্গে গেছেন। প্রসব হতে গিয়ে, না কী? অন্য কোনও ব্যাধিতে?

নন্দের কর্ণমুল মুখটা নিয়ে এসে রূপেন্দ্র বললেন, সেসব কথা পরে আলোচনা করব খুড়ো। সত্যনারায়ণের পাঠ শুরু হয়ে গেছে।

সত্যি কথা। শিরোমণি ঠাকুর পাঁচালী পাঠ শুরু করে দিয়েছেন। অবগুণ্ঠনবতীরা গলায় আঁচল দিয়ে যুক্ত কর হয়েছেন। পুরুষেরাও গুড়ুক সেবনে ক্ষান্ত দিয়ে শান্ত হয়ে বসেছেন। নন্দ সেদিকে একটু দেখে নিয়ে বললেন, অ! তা এট্টু বাইরে এস না, রূপেন। একটা জরুরী কতা ছিল…

—জরুরী কথা? কী বিষয়ে?

—তোমার সঙ্গে নাকি একই নৌকায় একটি যুবতী বিধবা…

জনতার ভিতর থেকে কে যেন গম্ভীর গলায় ধমক দিয়ে ওঠেন, আস্তে। কথা বলবেন- না। ব্রতকথা পাঠ শুরু হয়ে গেছে।

রূপেন্দ্রনাথ ওষ্ঠাধরের উপর দক্ষিণ হস্তের তর্জনীটা স্থাপন করে নন্দকে ইঙ্গিত করলেন।

সমাজপতি বাধ্য হয়ে নীবর হলেন।

আপাতত।

একপ্রহর রাতের শিবাধ্বনি হওয়ার আগেই শেষ হল ব্রতকথা। পাঁচ বাড়ির এয়োরা এগিয়ে এল প্রসাদ নিতে এবং বিতরণ করতে। ছোট-ছোট করে কাটা কলা-পাতায় নানা ফল, লোচিকা, ব্যাঞ্জন, পরমান্ন, বাতাসা, খুর্মো, পাটালি, আর সিন্নি। প্রসাদ পাওয়ার নিয়ম হচ্ছে—বাতাবিলেবু বা আতা জাতীয় ফলের বীজ ছাড়া পাতায় কিছু পড়ে থাকবে না। বীজগুলি হাতে তুলে নিয়ে ‘পাঁদাড়ে’র দিকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। আর দু-হাতে কদলীপাত্রটা লেহন করে সাফা করতে হবে। সিন্নি প্রসাদ পাওয়ার পর হস্তপ্রক্ষালনের বিধি নাই। হাতটা মাথায় মুছে ফেলতে হয়। এ-কারণে খুব সাবধানে সবাই সিন্নি-প্রসাদ গ্রহণ করে। বাতাসা বা পাটালিকে চামচ হিসাবে ব্যবহার করে।

বাঁশঝাড়ের মাথার উপর বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ উঠল আসর ভাঙতে ভাঙতে। ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। সকলেই যে-যার বাড়ি পানে রওনা দিল।

শুধু একটিমাত্র ব্যতিক্রম। মীনুর পিসিমা অর্থাৎ পীতু মুখুজ্জের দিদি গিরিবালা একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন। বললেন বাব্বা! মাজাটা ধরে গেছে। আমি আর পারবনি বাপু, এতটা পথ হেঁটে যেতে।

‘এতটা পথ’ মানে দীঘির ও-পার। রূপেন্দ্র বুঝলেন। বললেন, বুঝেছি। তা খুড়িমাকে বলে রেখেছেন তো যে, রাত্রে আপনি ফিরবেন না?

গিরি-পিসিমা বললেন, আমি আবার তারে কী বলব? সেই তো আমারে বললে, তুমি রাতটা রূপোর ঠাঞেই থেকে যেও। মালতী বেচারি একা-একা ভয় পাবে। ওর সাথে শুয়ো। মালতী সলজ্জে নতনেত্রে বলল, হ্যাঁ, কথাটা উনি আমার সামনেই বলেছিলেন। পিসি আর আমি ঐ পশ্চিমের ঘরটায় শোব। আপনি মঞ্জরীকে নিয়ে উত্তরদুয়ারি ঘরে বড় পালঙ্কে শোবেন।

সেই মতোই ব্যবস্থা হল রাত্রিবাসের।

সৌরীন্দ্রনাথের আমলের বিরাট সাবেক পালঙ্ক। কর্তামশাই এককালে এই শয্যাতেই শয়ন করতেন। বাপের কোল ঘেঁষে টুমটুম্ হয়ে শুয়ে পড়ল রূপমঞ্জরী। বললে, আমারে অ্যাট্টা কিছছা শোনাবে বাবা?

—শোনাব। যদি তুমি ভাল করে আমাকে কথাটা বলতে পার!

—’ভাল করে’? কী খারাপ বলনু আমি?

—’বলনু’ নয় মা-মণি, ‘বললাম’ বা ‘বলেছি’। তুমি লক্ষ্য করে দেখ, আমরা সবাই কী ভাষায় কথা বলি। মালতী, বৌঠান, তারাদা, শুভপ্রসন্ন কী ভাষায় কথা বলে। তোমার কোন দোষ নেই—এতদিন তুমি ঝি-চাকরদের মাঝখানে মানুষ হচ্ছিলে। শুনে শুনে তাদের কথ্যভাষাটাই বলতে শিখেছ। তোমাকে আমি লেখাপড়া শেখাব। সংস্কৃত শেখাব, ফার্সি শেখাব। তার আগে নিজের চেষ্টায় তোমাকে শুধু বাংলা বলতে হবে। ঐ শুভপ্রসন্নের মতো। আমি কী বলছি, বুঝতে পারছ, সোনা-মা?

রূপমঞ্জরী তার ছোট্ট মাথাটা ইতিবাচক ভঙ্গিতে নেড়ে বললে, হ্যাঁ।

—তুমি এবার ঐ শুভপ্রসন্নের মতো ভদ্র ভাষায় আমাকে বল তো মা-মণি—যে-কথাটা একটু আগে বলেছ!

রূপমঞ্জরী সাবধানে একটা-একটা করে শব্দ উচ্চারণ করল : আমাকে একটা গল্প শোনাবে, বাবা?

রূপেন্দ্রনাথ ওকে কোলে টেনে নিয়ে গালে চুমু খেলেন। বললেন, এই তো। ঠিক বলেছ! ‘আমারে’ নয় ‘আমাকে’; ‘অ্যাট্টা’ নয়, ‘একটা’, ‘কিছছা’ নয়, ‘গল্প’। শুধু একটা ভুল হয়েছে—‘বলবে’ নয়, ‘বলবেন!’

.

…তোমরা অবাক হচ্ছ, তাই না, দিদিভাই? তোমরা শুধু ‘মা’কে নয়, হয়তো ‘বাবা’কেও ‘তুমি’ বল। আমার নিজের ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিরাও তাই বলে। কিন্তু আমি বা আমার দাদা-দিদিরা শুধু বাবা-মশাই বা কাকা-জেঠাদের নয়, নিজের নিজের দাদা-দিদিকেও, এমনকি মাকেও ‘আপনি’ বলতাম। অষ্টাদশ-শতাব্দীতেও সেটাই ছিল শিষ্টাচার।

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, আজকের এই দিনটি একজন মহাপুরুষের জন্মতিথি। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কপিলবস্তুর রাজপ্রাসাদে। রাজার সন্তান তিনি।

—আপনি কি রাজপুত্তুরের গল্প বলছেন, বাবা?

চমৎকৃত হলেন রূপেন্দ্রনাথ। প্রণিধান করলেন, অতি ক্ষুরধার বুদ্ধি তাঁর আত্মজার। একবার মাত্র নির্দেশেই সে সংশোধন করে নিয়েছে নিজেকে। তার বর্ষচতুষ্টয়ের প্রাকৃতজনপ্রভাবিত বালভাষ মুহূর্তমধ্যে সংশোধন করে নিতে পেরেছে। রূপেন্দ্রনাথ বললেন, ঠিকই বলেছ মা, তবে কথাটা ‘রাজপুত্তুর’ নয়, ‘রাজপুত্র’। শোন এবার গল্পটা—

আমাদের কাহিনীর সেই ছোট্ট নায়িকাটি—যিনি বিবেকনির্দেশিত পথে পুরুষশাসিত অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজে নারীজাতিকে সসম্মানে প্রতিষ্ঠার ব্রত সর্বপ্রথম গ্রহণ করেছিলেন—সেই অলোকসামান্যা তাঁর সপ্তপুরুষের পদরজধন্য বাস্তুভিটায় প্রথম রাত্রিযাপনের অবকাশে পিতৃদেবের কাছে প্রাকৃত ভাষায় শুনলেন এক মহা-’রাজপুত্রের’ গল্প। যে-রাজপুত্র বিবেকনির্দেশে গড্ডলিকা স্রোত শামিল হতে অস্বীকার করেছিলেন। নিন্দা করেছিলেন সেই যজ্ঞবিধিকে যা অবোধপণ্ডকে বলিদানের মাধ্যমে পরমার্থলাভের সন্ধান করত। রাজপুত্ৰ বস্তুতঃ জ্ঞাননিধৃতকল্মষ পরমবুদ্ধ। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে যিনি প্রিয় শিষ্য আনন্দকে দিয়ে গিয়েছিলে তাঁর শেষ নির্দেশ :

আত্মাদীপো ভব।
আত্মশরণো ভব।।
অনন্যশরণো ভব।।।*

[* নিজেকে প্রদীপের মতো প্রজ্বলিত কর। সেই আত্মদহনকারী দীপশিখার আলোকে জীবনপথ অতিক্রম করে চল। অপরের আপ্তবাক্যে প্রভাবিত হয়ে কাজ করবে না।]

রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম মহিলা বিদ্যানিকেতন—শুধু গৌড়মণ্ডলে নয়, বোধকরি এযুগের ভারতের প্রথম স্ত্রীশিক্ষানিকেতন। বিনা আড়ম্বরে, বিনা শঙ্খনির্ঘোষে, নীরবে, নিভৃতে তার প্রতিষ্ঠা হল দামোদরতীরের এক গণ্ডগ্রাম—সোঞাই-এ। জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। এ প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র স্ত্রীজাতীয়দিগের শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজন। ছাত্রীসংখ্যা মাত্ৰ আট। বহু আয়াসেও তদপেক্ষা অধিক ছাত্রী যোগাড় করা যায়নি। উপায় কী? অক্ষর পরিচয় এবং বৈধব্যযোগ যে পণ্ডিতমশাইদের মতে বাগর্থের মতো সম্পৃক্ত! আটজনের পরিচয় একে-একে দাখিল করা যাক।

সর্ববয়োঃজ্যেষ্ঠা ছাত্রীটির বয়স তিনকুড়ির ওপারে : গিরিবালাদেবী বালবিধবা—সুতরাং নূতন করে বৈধব্যযন্ত্রণার ব্যবস্থা করতে স্বয়ং যমরাজও অশক্ত। তিনি হচ্ছেন পীতাম্বর মুখুজ্জের জ্যেষ্ঠা ভগিনী—মৃন্ময়ীর পিসিমাতা ঠাকুরাণী। সেই যে সত্যনারায়ণ পূজার দিন বৈশাখী পূর্ণিমায় এই বাঁড়ুজ্জে বাড়িতে পদার্পণ করেছেন তারপর আর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেননি। রূপেন্দ্রনাথ সহজেই বুঝে নিয়েছিলেন এটি তাঁর হিতৈষীবর্গের গোপন ব্যবস্থাপনা। নীতু মুখুজ্জে আর তারাপ্রসন্নের যোগসাজশে গিরিবালা এই ঢং ধরেছেন : ‘আমি আর চলতে পারবনি বাপু।’

.

রূপেন্দ্রনাথকে তাঁরা এ বিষয়ে কিছুই জানাননি। জানাতে সাহস হয়নি। কী-জানি একবগ্গা যদি বেমক্কা রুখে দাঁড়ায়। তাই তারাসুন্দরী আর মীনুর-মা গোপনে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন মালতীকে। প্রকাশ্যে বলা হল : গিরিবালা ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাঁড়ুজ্জে- বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। স্থির হল রূপেন্দ্রনাথকে লুকিয়ে পীতাম্বর দিদির জন্য আতপ চাউল গোপনে যুগিয়ে যাবেন মালতীর ভাঁড়ারে। মালতী মনে-মনে স্থির করে এসেছিল সোঞাই গাঁয়ে বাস করতে এসে ঐ সত্যনিষ্ঠ কন্দর্পকান্তির কাছ থেকে কিছুই গোপন করবে না। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা গেল না। বুঝল, গিরিপিসি নিজে থেকে এ ভিটায় বাস করতে না এলে—একটি বিপত্নীক যুগপুরুষ এবং একজন নিঃসম্পর্কীয়া যৌবনবতী বিধবার একত্রবাস গ্রাম্যসমাজ ভালচোখে দেখত না।

তাছাড়াও একটি গুরুতর কারণ ছিল। কিন্তু মালতী সেকথা নিজের কাছেও স্বীকার করতে লজ্জা পায়। গিরিপিসি আসাতে সে ধড়ে প্রাণ পেল!

রূপেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় হেতুটার বিন্দুবিসর্গও আঁচ করেননি; কিন্তু প্রথম যুক্তিটা সহজেই আন্দাজ করলেন। স্বীকার করলেন না। বললেন, পিসি, ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু এ-বাড়িতে আপনাকে থাকতে দেব একটি শর্ত মেনে চললে। আপনাকে লেখাপড়া শিখতে হবে!

গিরিবালা আঁৎকে ওঠেন : ওমা আমি কোথায় যাব! আমার বয়স যে তিনকুড়ি পেরিয়ে গেছে রে! এই বুড়ি বয়সে তালপাতায় আঁক করব?

—না! অঙ্ক শিখতে হবে না আপনাকে। শিখবেন ভাষা। অ-আ, ক-খ! নিজে-নিজে কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণখানা পড়তে হচ্ছে করে না?

এবার থমকে গেলেন পিসি : পারব?

—আলবৎ! তিনমাসের মধ্যে! যদি না পারি…

—না, না, দিব্যি-দিলেস দিনি রূপো। তুই তো জানিস না, আমার মাথায় স্রেফ গোবর! তোর পিসেমশাই বলতেন!

বিদ্যানিকেতনের বাকি সাতজন ছাত্রীর কথা বলি; যারা সমাজপতিদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ওঁর অবৈতনিক পাঠভবনে নিত্যি হাজিরা দিতে আসতেন।

দ্বিতীয়ত তারাসুন্দরী। জমিদারের ঘরণী। তাঁর শাশুড়ি ঠাকরুণ কর্তার কাছে জনান্তিকে সাক্ষর হয়েছিলেন। সংস্কৃতজ্ঞ হয়েছিলেন। সেসব কথা আগেই বলেছি। ওঁরা দুজনে লুকিয়ে কালিদাস-ভবভূতি-ভাস পাঠ করতেন। পড়তেন ও শুনতেন। পালা করে। প্রথম যুগে শৃঙ্গার রস। ক্রমে মহাকাব্য। শেষে ‘যম-নচিকেতা সম্বন্ধ’, ‘গার্গী-যাজ্ঞবল্ক ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’, শ্রীমদ্ভগবৎ গীতা। এ সংবাদ প্রথম দিকে গোপন ছিল, অন্তত যতদিন ব্রজেন্দ্রনারায়ণের পিতৃদেব জীবিত ছিলেন। তারপর এ-কথা গ্রামে কারও জানতে বাকি ছিল না। কই ব্রজসুন্দরীকে তো অকাল বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি! ব্রজেন্দ্রনারায়ণ পরিণত বয়সে স্বর্গলাভ করেছেন। ব্রজসুন্দরী তাঁর বাৎসরিক শ্রাদ্ধকার্য সম্পাদন করে বার্ধক্যে বারাণসীধায়ে চলে গেছেন।

তারাসুন্দরীর কর্তার না আছে সময়, না ধৈর্য, না উদ্যম। তবে বাধাও তিনি দেননি। মাথায় অধো ঘোমটা টেনে জমিদারগৃহিনী তাই প্রত্যহ রূপেন-ঠাকুরপোর ভিটায় হাজিরা দিতেন। বাংলা, ক্রমে সংস্কৃত শিখবেন বলে। একটু সঙ্কোচ অবশ্য ছিল। বয়সটার জন্য। রূপেন আর তারাসুন্দরী প্রায় সমবয়সী। দুজনেই ত্রিশ-বত্রিশ। তা সে বাধাও ঘুচে গেল পুঁটুরাণীর আগ্রহে। সে এসে বললে, ‘তুমি দাদাকে বল বৌঠান, আমি রূপোদার পাঠশালায় পড়তে যাব। আমার তো আর ও-ভয় নেই।

না তা নেই। যমদূতগুলো আহাম্মকের বেহদ্দ। চোখ মেলে দেখল না : পুঁটুরাণী নিরক্ষরা! সিঁথের সিঁদুর মুছে মেয়ের হাত ধরে যে ফিরে এসেছিল বাপের বাড়ি।

ফলে পুঁটুরাণী হল তিনি নম্বর ছাত্রী। তার পাঁচবছরের কন্যাটি চার নম্বরের। বয়ঃপ্রাপ্তা অনূঢ়া ছাত্রী মাত্র একজন : শোভারাণী। রীতিমতো লড়াই করে সে ভর্তি হল রূপোদার পাঠশালায়। শোভারাণী সুন্দরী নয়। কুসুমমঞ্জরী বা মৃন্ময়ীর মতো চম্পকগৌর গাত্রবর্ণ থেকে সৃষ্টিকর্তা তাকে বঞ্চিতা করেছেন। কিন্তু তাই বলে স্বগ্রামের ঐ অনিন্দ্যকান্তির দিকে সে মনে মনে আকৃষ্ট হবে না কেন? না, রূপোদার শুধু রূপ নয়, শোভারাণী তার বেড়া-বিনুনী-বাঁধা যুগ থেকে দেখে আসছে ঐ গ্রাম্য বিদ্রোহীর অপরিসীম দাঢ়া। সমাজপতিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে বারে বারে দেখেছে তাঁকে সপ্তরথী বেষ্টিত অভিমন্যুর মতো রুখে দাঁড়াতে। সব কিছু সে বুঝতে পারেনি, আজও পারে না–বেচারির সে শিক্ষাটাই যে হয়নি। কিন্তু এটুকু বুঝেছে যে, ঐ রূপোদাই আসলে সেই পক্ষিরাজে-চড়া রাজপুত্তুর, যার কথা সে শুনেছে বহু জোনাকজ্বলা সন্ধ্যায়, ঠাম্মার কোল ঘেঁষে বসে। প্রায় যৌবনোত্তীর্ণা ঐ অরক্ষণীয়ার মর্মবেদনাটা কি তোমরা বুঝতে পার না? স্ত্রীশিক্ষা ভাল কি মন্দ, লেখাপড়া শিখলে আর দুটি হাত গজায়-কি-গজায় না তা জানে না শোভারাণী। জানতে চায়ও না! কী লজ্জার কথা—তার আসল উদ্দেশ্য ঐ আজব মানুষটাকে সে রোজ কাছে থেকে বসে দু-চোখ মেলে দেখতে পাবে, তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। প্রয়োজনে এক-’ফেরো’ ঠাণ্ডা জল কলসি থেকে গড়িয়ে এনে বলতে পারবে, রূপোদা আপনার তেষ্টা পেয়েছে নিশ্চয়! খান!

এর বেশি সেই মেয়েটি আর কিছু প্রত্যাশা করে না। করতে সাহস পায় না।

দুর্গা গাঙ্গুলী সমাজপতি। কট্টর প্রাচীনপন্থী। স্ত্রীলোক সাক্ষর হবে এমন ‘অসৈরণ কতা’ তিনি নিশ্চয় বরদাস্ত করতেন না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি গ্রামে অনুপস্থিত। দুই যৌবনবতী সদ্যোবিবাহিতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পুনরায় পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে তীর্থ করতে গেছেন—পুন্নামনরক থেকে নিস্তার পাওয়ার আশা নিয়ে। ফলে শোভারাণীর বর্তমান অভিভাবক গাঙ্গুলীবাড়ির সেজতরফের বড়কর্তা, অর্থাৎ দুর্গাচরণের অনুজ কালীচরণ। তিনি প্রচণ্ড আপত্তি করেছিলেন। শোভারাণী কর্ণপাত করেনি। কালীচরণ বাধ্য হয়ে শরণ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় সমাজপতি নন্দ চাটুজ্জে মশায়ের দরবারে। নন্দও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। শোভারাণী হাত দুটি জোড় করে বলেছিল, আমাকে বাধা দেবেন না, ফুলকাকা! তারা-বোঠান এতটা বয়সে ওঁর পাঠশালায় আসছেন, পুঁটুদি আসছেন! আমারই কী দোষ হল?

নন্দ ধমক দিয়ে উঠেছিলেন, গাধার মতো কতা বলিস না শোভা! ওরা হল বারিন্দির! ওদের নিয়মকানুন সব আলাদা। ওরা কি বামুন? ওদের ছেলেমেয়ের বে-তে পাকা দেখা হয় না, হয় ‘করণ’! তাই তো তারা-ভাদুড়ীর মা লুকিয়ে লুকিয়ে দিগ্‌গজ পণ্ডিত হতে চেয়েছিল…

শোভারাণী তখনো যুক্তকর। বলেছিল, দিগগজ পণ্ডিত হোন বা না হোন তিনি সমো স্কৃত পুঁথি পাঠ করতে শিখেছিলেন। আর সেই অপরাধে কোনও যমদূতের হিম্মৎ হয়নি তাঁর সিঁথির সিঁদুর মুছে দিতে!

—দ্যায়নি? তারা-ভাদুড়ীর মা সধবা অবস্থায় ড্যাংডেঙিয়ে সগ্যে যেতে পেরেচে? বিধবা হ’য়ে কাশীবাসী হতে হয়নি তাকে?

শোভারাণী তখনো যুক্তকর। জবাবে বলেছিল, আমিও ড্যাংডেঙিয়ে সগ্যে যেতে চাই না, ফুলকাকা। শেষ বয়সে আমিও না হয় বিধবা হতে রাজি। কিন্তু বিধবা হতে হলে একটা ‘বর’ তো প্রথমে যোগাড় করতে হয়ে? বাবামশাই তো নিজের বিয়ে নিয়েই সারাটা জীবন ব্যস্ত। আপনিই আমাকে তাই একটা যোগাড় করে দিন না? কানা-খোঁড়া-বুড়ো, যেমনটাই হোক। নাহলে বিধবা হব কি করে? লেখাপড়া আমি শিখবই!

নন্দ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মুখরা মেয়েটির বাচালতায়। দাঁতে-দাঁত দিয়ে বলেন, এক ফোঁটা মেয়ে তুই! বড় চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেছিস দেখছি।

শোভারাণী এবার হঠাৎ নন্দখুড়োর ঠ্যাং থেকে এক-খাম্‌ম্চা একটা ‘পেন্নাম’ উঠিয়ে নিয়ে বলে, আপনি স্নেহের চোখে দেখেন, তাই নজর হয়নি। মেঘে মেঘে দেড়-কুড়ি বয়স হয়ে গেছে আমার। কুলীনঘরে না জন্মালে অ্যাদ্দিনে তিন ছেলের মা হয়ে যেতাম।

বজ্রাহত নন্দ বলেন, ঘোর কলি একেই বলে! লজ্জা সরমের মাথা খেয়েছিস্? আসুক তোর বাবা ফিরে।

একগাল হেসে শোভারাণী বলেছিল, না, ফুলকাকা! উনিশ-কড়া কলি! ঘোর কলি হতে এখনো এক কড়া নাকি। সেটা হবে মেহেরউন্নিসা যখন ভর্তি হবে রূপোদার পাঠশালায়।

—কে? মেহেরউন্নিসা! মানে? সে কে?

—শোনেননি বুঝি? সে এক বেহেস্তের হুরি! রূপোদা তারেও ভর্তি করে নিতে রাজি হয়েছে! আমার মতো বুড়ি নয়। ছোট ফুলখুড়িমার বয়সী!

কথাটা মিথ্যা নয়। নন্দের শেষ ধর্মপত্নী বছর বাইশ।

তারা-পুঁটু-সুজাতা একুনে তিন;

শোভা-মালতী-রূপমঞ্জরী, আর গিরিবালা, হল সাত। রূপেন্দ্রনাথের অষ্টম ছাত্রী একজন যবনী : মেহেরউন্নিসা! পীরপুরের মৌলবী কলিমুদ্দিন সা’ব-এর ভগিনী! হ্যাঁ, খবরটা মিথ্যা নয়। কুলীন ব্রাহ্মণ রূপেন্দ্রনাথ মৌলভীসা’বকে ‘জবান’ দিয়েছেন : তাঁর পাঠশালায় ঐ যবনীকেও ভর্তি করে নেবেন। সেই অষ্টাদশ শতাব্দী যখন সবে পঞ্চাশোধা! বোঝ কাণ্ড!

দুঃসাহসিকতার একটা সীমা থাকবে তো!!

কিন্তু রূপেন্দ্র নির্বিকার। বিবেকনির্দেশ তিনি মৌলভীসা’বকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। বিচিত্র ঘটনা পরম্পরা। শোন বলি :

আয়ুর্বেদশিক্ষা সমাপনান্তে রূপেন্দ্রনাথ একসময় স্থির করেছিলেন বর্ধমানের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ মুসলমান হেকিমের কাছে হেকিমীবিদ্যাও শিক্ষা করবেন। হেকিমসাহেব তাঁকে বিদ্যাদান করতে স্বীকৃতও হয়েছিলেন; তবে বলেছিলেন শিক্ষারম্ভের পূর্বে ছাত্রকে আরবী- ফার্সি দুটো ভাষাতেই আলিম হতে হবে। রূপেন্দ্রনাথ সে জন্য সোঞাই গ্রামে ফিরে আসার পর পীরপুরের মৌলভীসা’বকে অনুরোধ করেন ঐ দুটি ভাষায় শিক্ষা দিতে। পীরপুর দামোদরের ওপারের একটি মুসলমান-প্রধান গ্রাম। মৌলভী কলিমুদ্দিন সা’ব স্বীকৃত হয়ে যান। প্রত্যহ পড়ন্ত বেলায় তিনি সোঞাই-গাঁয়ে চলে আসতেন—জুম্মাবার বাদ দিয়ে সূর্যাস্তকাল পর্যন্ত রূপেন্দ্রনাথকে ঐ দুটি ভাষা শেখাতেন। তারপর রূপেন্দ্রের পিসিমা জগুঠাকরুন একগলা ঘোমটা টেনে নিয়ে আসতেন কিছু প্রসাদী। ফলমূল-বাতাসা-খুরমো কদমা। মৌলভীসা’ব পদ্মদীঘিতে অজু করে সাম-ওয়াক্তের নামাজটা সেরে নিতেন। তারপর ঐ প্রসাদটুকু মুখে ফেলে বিদায় নিতেন। ফিরে যেতেন পারানি ঘাটে, দামোদর পার হয়ে পীরপুর গাঁয়ে।

সেসব গত দশকের কথা। তারপর ঘটনাচক্রে রূপেন্দ্রনাথের বর্ধমান যাওয়া হয়নি। হেকিমীবিদ্যা শেখাও হয়নি। তবে আরবী না হলেও ফার্সীটা আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন ঐ মৌলভী সাহেবের সহায়তায়।

তাই এতদিন পরে তিনি ঐ উদারচেতা মুসলমান মৌলভীসা’বকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি।

…কিন্তু ওঁর দুঃসাহসিকতার পরিমাণটা তোমরা একবার বিচার করে দেখবেন দিদিভাই? রাধানগরে যুগাবতার রামমোহন রায়-মশায়ের আবির্ভাব হতে তখনো উনিশ বছর বাকি—বর্ধমানভুক্তির একটি প্রত্যন্ত গ্রামে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ শুধুমাত্র স্ত্রীলোকদের জন্য একটি বিদ্যানিকেতনের প্রতিষ্ঠা করছেন—কৃত্তিবাস-কাশীরাম এবং খানকয় মঙ্গলকাব্যের লিখিত পুঁথি আর রায়গুণাকরের কিছু গ্রন্থ ব্যতীত বঙ্গভাষায় সে-সময় কোন কিছু ছিল না—আর সেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত স্ত্রীজাতীয়ার বিদ্যালয়ের আটটি ছাত্রীর অষ্টম বিদ্যার্থী হচ্ছেন : মেহেরউন্নিসা বেগম!

যবনী!!

রূপেন্দ্রনাথ সেই আয়োজনই করেছেন। বিবেকনির্দেশে! গৌড়দেশে কথ্য ভাষা বাঙলা। মেহেরউন্নিসার মাতৃভাষাও বাঙলা—উর্দু নয়, ফার্সি নয়! কোন্ যুক্তিতে সেই ছাত্রীটিকে প্রত্যাখ্যান করা হবে? তারাসুন্দরী-মালতী-রূপমঞ্জরীর চেয়ে ছাত্রী হবার দাবি তার কম কিসে?

কিন্তু মৌলভীসা’বই বা এমন বেয়াড়া অনুরোধ করে বসলেন কেন? তাহলে মূলকাহিনীটা মূলতুবী রেখে মেহেরউন্নিসার কিস্সটাই লিপিবদ্ধ করতে হয় প্রথমে :

মেহের হচ্ছে মৌলভীসাহেবের ভগিনী। প্রায় মালতীরাই বয়সী—বাইশ-চব্বিশ! সদ্যোবিবাহিতা এবং সদ্য-স্বামীত্যক্তা! হেতুটা মর্মান্তিক!

মেহেরের বুকে, তলপেটে, উরুতে শ্বেতির দাগ আছে। মুখে নেই। এই অপরাধে মেহেরের খসম সাদির সাতদিনের মধ্যেই তাকে তিন-তালাক শুনিয়ে দিয়েছে। মৌলভীসা’ব সত্যাশ্রয়ী। পাত্রের আব্বাজানকে সত্য কথা সাদির অনেক পূর্বেই নিবেদন করেছিলেন। পিতা সে বার্তা পুত্রকে জ্ঞাত করিয়েছিলেন কি না সেটা ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়। মেহেরের খসম্-এর দাবি ওটা শ্বেতি নয়। কুষ্ঠ। বিচক্ষণ হেকিম এবং স্বয়ং রূপেন্দ্রনাথ পরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে, রোগটা আদৌ কুষ্ঠ নয়, শ্বেতি। সচরাচর শ্বেতির দাগ মুখেই ফুটে ওঠে। কোন কোন ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে তা দেহের অন্যান্য স্থানে দৃষ্ট হয়। কাসেম আলী—ে

—মেহেরের খসম্—সেসব কথা কানেই নেয়নি। ধর্ম ও আইন তার পক্ষে। বিবাহের যাবতীয় যৌতুক হাতিয়ে নিয়ে সে তিন-তালাক দিয়ে মেহেরকে ঘাড় থেকে নামিয়েছে। মৌলভীসা’ব দ্বিতীয়বার মেহেরের নিকার আয়োজন করেননি। খোদাতালার ইচ্ছায় তাকে এভাবে জীবনটা কাটাতে হবে। উনি কর্মসন্ধানে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলেন। গত বছর। আলিবর্দীর মীর মুন্সীর সঙ্গে ওঁর খাতির ছিল। একই মোক্তবে দুজনে পড়েছেন। ফলে সহাধ্যায়ী, দোস্ত। মীর মুনসী ওঁকে একটা আজব খবর দিলেন। নবাব আলিবর্দ্দী নাকি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্যবৃদ্ধি- মানসে দুটি গ্রন্থ রচনায় ইচ্ছুক হয়েছেন। একটি বঙ্গভাষে কুরান-সরীফ। দ্বিতীয়টি ফার্সিতে কৃত্তিবাসী রামায়ণ। এজন্য তিনি উপযুক্ত পণ্ডিত নিয়োগ করতে ইচ্ছুক—যাঁরা বাঙলা এবং ফার্সি দুটি ভাষাতেই আলিম। মৌলভী সা’ব কৃত্তিবাসী রামায়ণের একটি বিশেষ কাণ্ড—অরণ্যকাণ্ড—ফার্সিতে অনুবাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। মীর মুন্সির কাছে দলিলে দস্তখ‍ করে অগ্রিমও নিয়ে এসেছেন। ফার্সীতে তিনি আলিম, কিন্তু বাঙলা হরফ চেনেন না। কথ্য ভাষাটা তো মাতৃভাষা—ভালো রকমই জানেন। আশা ছিল কোনও পণ্ডিতকে নিয়োগ করে হরফগুলো চিনে নেবেন—বাংলা পড়তে শিখবেন। দুর্ভাগ্য মৌলভী সাহেবের—কোনও ব্রাহ্মণপণ্ডিত ঐ যবনকে বিদ্যাদান করতে স্বীকৃত হননি। মুর্শিদাবাদে নয়, কৃষ্ণনগরে নয়, নবদ্বীপেও নয়। মৌলভী সাহেবের তখন স্মরণ হয়েছিল সোঞাই গাঁয়ের সেই আজব ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতটির কথা : একবগ্গা বাঁড়ুজ্জে!

একদিন সে ছিল ছাত্র। আজ সে নিশ্চয় রাজি হবে গুরু হতে। মৌলভী সাহেব ফিরে এলেন পীরপুরে। সাক্ষাৎ করলেন সেই ব্যতিক্রম পণ্ডিতটির সঙ্গে।

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, আমার যে এখন মরবার সময় নেই। মৌলভী সা’ব।

সে কথা সত্যি। তিনি যখন শয্যাত্যাগ করেন তখনো ঋগ্বেদের ঋষির বর্ণনায় “ঊষো যাতি স্বসরস্য পত্নী” * সুসম্পন্ন হয়নি। ভুলকো তারা জ্বলজ্বল করছে পূর্বাকাশে। প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে, মধ্যাহ্নিক সমাপনান্তে তিনি সূর্যোদয় মুহূর্তে উপস্থিত হতেন দাতব্য চিকিৎসালয়ে। জীবন দত্তের সমভিব্যাহারে প্রতিটি রোগাক্রান্তের তত্ত্বতালাস নেন। ব্যবস্থাদি দেন। তারপর অশ্বারোহণে দূর-দূর গ্রামে রুগী দেখতে যান। ফিরে আসেন মধ্যাহ্নে। আহারান্তে বসেন স্ত্রীজাতীয়ার বিদ্যালয়ে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর আটটি ছাত্রীকে শিক্ষা দিতে। বাঙলা- সংস্কৃত-অঙ্ক। গার্হস্থ্যবিদ্যা, পূজাবিধি, শিশুপালন। যে ছাত্রীর যেটি প্রয়োজন। তারপর সন্ধ্যা সমাগমে নিজের পড়াশুনা। তাঁর সময় কোথায়?

[* সূর্যপত্নী ঊষা স্বামীর পূর্বে আবির্ভূতা হন।]

মৌলভী কলিমুদ্দিন সা’ব হঠাৎ বলে ওঠেন, মেনে নিলাম আপনার সওয়াল! আপনার পাঠশালাতে এসে আমি বসতে পারি না। কারণ পাঁচ মেহমানের ঔরৎ এসে আপনার কাছে লিখাপড়ি শিখবেন। সেখানে আমার হাজিরা সরম-কী-বাৎ। লেকিন-উঠানের একান্তে যদি মেহের এসে বসে—মাদুর সে নিজেই নিয়ে আসবে—তাহলে তাকে কি বাঙলা হরফ শিখিয়ে দিতে পারেন না? বুঝতেই তো পারছেন, পণ্ডিতমশাই, এ বিদ্যাটা মেহের আয়ত্ত করতে পারলে আমরা ভাই বহিন দুজনে মিলে নবাব সরকারের চাহিদা মেটাতে পারব। ঐ তালাক- হুয়ী বদনাসিব লেড়কি রোজগার করতে পারবে। খেয়ে-পরে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করতে পারবে!

রূপেন্দ্রনাথ এককথায় সম্মত হয়ে গেলেন। মেহের ভাষাটা জানে—বাঙলা তার মাতৃভাষা। অক্ষর-পরিচয় সমাপ্ত হলেই সে অনায়াসে কৃত্তিবাসী রামায়ণের সহজ পয়ার ছন্দ পাঠ করতে পারবে। আর উচ্চারিত হলেই—অক্ষর পরিচয় থাক বা না থাক—মৌলভী সা’ব তার অর্থ বুঝতে পারবেন। হয়তো মেহেরের কাছ থেকে তিনি নিজেও বাঙলা হরফ, আ- কার ই-কার এবং যুক্তাক্ষর, চিনে নিতে পারবেন। তখন অনায়াসে কৃত্তিবাসী রামায়ণের ফার্সি অনুবাদ করতে পারবেন। নবাব আলীবর্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু-মুসলমানের মেলবন্ধনের একটি সম্প্রীতির সোপান অতিক্রান্ত হবে। হিন্দু কৌতূহলী হলে, উৎসাহী হলে জানতে পারবে কুরান-সরীফে কী লেখা আছে। মুসলমানও কৌতূহলী হলে জানতে পারবে রামায়ণ কাব্যের উপজীব্য।

দুর্ভাগ্য এ দেশের। আলিবর্দীর ঐ শুভপ্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। 1756 সালে আলিবর্দী খাঁ মহব্বত জঙ-বাহাদুর বেহেস্তে চলে গেলেন। মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আসীন হল সিরাজউদ্দৌল্লা—সপ্তদশ বর্ষীয় ইন্দ্রিয়াসক্ত অপরিণতবুদ্ধির এক কিশোর। আলিবর্দী আর তাঁর একমাত্র পত্নী শরফ উন্নিসা বেগমের শুভ প্রচেষ্টার আসান ঘটল। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের ভাষায় :

আলিবর্দীকে মুর্শিদাবাদের বা বাঙলার আকবর বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে। মুর্শিদাবাদ-নবাবদিগের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানের প্রতি সম্প্রীতি দেখাইয়া মহাবিপ্লবমধ্যেও শান্তভাবে প্রজাপালন করিতে তাঁহার ন্যায় আর কেহই সমর্থ হয় নাই। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মেলবন্ধনের নবাবী উদ্যোগের সেই বেহেস্তী মুবারকীর অবসান ঘটল; সিরাজের আমলে ঘনিয়ে এল দোজখী-ইবলিসি!

না কুরান-সরীফের বাঙলা-অনুবাদ, না রামায়ণের ফার্সি অনুবাদ; কিছুই আত্মপ্রকাশ করেনি। অথচ মোহনলাল আর মীরমদন সেই মেলবন্ধকে সার্থক করে পলাশী-প্রান্তরকে লালে লাল করে রেখে গেছে। আলিবর্দীর প্রয়াণের পর বছর না ঘুরতেই!

আদিযুগে সেই আদিমতম স্ত্রীজাতীয়ার বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের আয়োজন হয়েছিল চারটি পর্যায়ে। আজকের দিনের ভাষায় বলা যায় সওয়া ঘণ্টার চারটি পিরিয়ড। প্রথম পাঠ সূর্য যখন মধ্যগগনে। রোগী দেখে ফিরে এসে রূপেন্দ্রনাথ বসতেন তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠা ছাত্রী তিনটিকে নিয়ে গিরিবালা, পুঁটুরানী আর তারাসুন্দরী। এঁরা শেখেন বাঙলা ভাষা। অক্ষর পরিচয় করানো হয়। রূপেন্দ্রনাথ মুখে মুখে শোনান উপনিষদের কাহিনী—গার্গী, মৈত্রেয়ী, মদালসার ইতিকথা; নচিকেতা-সত্যকাম—উদ্বালকের উপাখ্যান। হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের সার কথা। সংস্কৃত সেখানে পড়ানো হত না।

দ্বিতীয় পাঠের আসরেও তিনজন ছাত্রী : মালতী, শোভারানী এবং পুনরায় তারাসুন্দরী। এখানে বাঙলার সঙ্গে সংস্কৃতও শেখানো হয়। গার্হস্থ্যধর্মের নীতিকথা, শিশুপালন, আর্তের সেবাপদ্ধতি এবং ধর্মের মূলতত্ত্ব।

তৃতীয় পাঠের আসরে, দুটি ছাত্রী এবং একজন ছাত্র—বালক ও বালিকা। রূপমঞ্জরী, সুজাতা আর শুভপ্রসন্ন। প্রথম দুজন শিখত বাঙলা, শুভপ্রসন্ন বাঙলার সঙ্গে সংস্কৃত। বয়সে সে ওদের অপেক্ষা বছর চারেকের বড়।

চতুর্থ পাঠের আসর পড়ন্ত বেলায়। প্রথম যুগে সেখানে উপস্থিত থাকত মাত্র একজন : মেহেরুউন্নিসা। পর্দার ওপাশে, দৃষ্টিসীমার, বাহিরে, কিন্তু শ্রুতিসীমার ভিতরে এসে বসতেন মৌলভী সা’ব। তারপর যখন দেখা গেল রূপমঞ্জরী ব্যতিরেকে আর কেউ মেহেরের সহাধ্যায়ী হতে স্বীকৃত হল না তখন রূপেন্দ্রনাথ মৌলভী সাহেবকেও পাঠের আসরে ডেকে নিলেন।

তিনচার মাসের মধ্যেই মোহের আর তার দাদা বাঙলা হরফ এবং যুক্তাক্ষর চিনে নিল। তখন মেহের সুর করে রামায়ণ পাঠ করত। পাশে নিমীলিত নেত্রে বসে শ্রবণ করতেন মৌলভীসাব। রূপেন্দ্র অপ্রচলিত শব্দের অর্থ বুঝিয়ে দিতেন। অলঙ্কারের ব্যাখ্যা করে দিতেন। ক্রমে শুভপ্রসন্ন আর রূপমঞ্জরী এসে যোগ দিল সে আসরে। কিমাশ্চর্যতঃপরম্। তারপর সেই যবনীর রামায়ণপাঠের আসরে এসে বসতে শুরু করলেন মালতী এবং গিরিবালা! পর্দার ওপাশে। দৃষ্টিসীমার বাহিরে, শ্রুতিসীমার নয়।

পাঠান্তে মেহের আল্লাতালাকে নমস্কার করে পুঁথি বন্ধ করে রাখত। ভাই-বহিন পদ্মদীঘিতে অজু করে সাম-ওয়াক্তের নামাজটা সেরে আসতেন। গিরিবালা দুটি ছোট-ছোট কলাপাতায় সাজিয়ে নিয়ে আসতেন দেবতার প্রসাদ। ফল-বাতাসা-খুর্মো পাটালি। এস. ওয়াজেদ আলীর ভাষায়—ভারতবর্ষের ট্র্যাডিশন অচ্ছেদ্যবন্ধনে চলতেই থাকত!

ব্যতিক্রমই নিয়মের পরিচায়ক। অর্থাৎ ব্যতিক্রম থাকে বলেই সামাজিক নিয়মকে নিয়ম বলে মানি। রূপেন্দ্রনাথ প্রথমে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে তাঁর বিদ্যালয়ে কোনও ছাত্র থাকবে না—সবই ছাত্রী। একাধিক হেতুতে। প্রথম কথা : তাঁর প্রতিবাদ সমাজপতিদের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। কী হিন্দু, কী মুসলমান। সমাজপতিরা স্ত্রীলোকদের অন্ধ সেবাদাসী করে রাখতে চায়। অসূর্যম্পশ্যার দল যেন জ্ঞানসূর্যালোকের সন্ধান না পায়। কারণ পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় ‘নারী’ একটি ভোগ্যপণ্য। সে বিনা প্রতিবাদে পুরুষের সেবা করে যাবে। সন্তান উৎপাদন করবে। প্রতিপালন করবে—স্বামীর দেহান্তে সহমরণে যাবে। মুসলমান সমাজে সহমরণ প্রথা নাই—তালাকপ্রথা প্রচলিত। গৃহকর্তার মর্জি হলে পাঁচ সন্তানের জননী, যৌবনোত্তীর্ণা সেবাদাসীটিকে তিন তালাক দিয়ে ‘গর্দানা-পাকাড়কে নিকাল’ দেওয়া যাবে। পরিবর্তে একটি নতুন যৌবনবতী ‘গুড়িয়া’কে সংসারে নিয়ে আসায় ধর্মীয় বা সামাজিক কোন বাধা নাই। বিলাতে শিক্ষিত রাজীব গান্ধীর কৃপায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে নস্যাৎ করে আজও সেই ধর্মীয় আইন বলবৎ। স্ত্রীলোক যদি ভাষাজ্ঞান লাভ করে তবে সবার আগে সে যে আয়ত্ত করবে : প্রতিবাদের ভাষাটাকেই তা সে বাঙলাতেই হোক অথবা উর্দুতে। রূপেন্দ্রনাথ ঐ প্রতিবাদটাই চান। এজন্য একটি ‘নারী-বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন নিজের ভিটেয়। তিনি জানতেন, গ্রামবাসীরা তাদের গৃহের ললনাদের সে বিদ্যালয়ে সহজে প্রেরণ করতে স্বীকৃত হবে না। কিছুটা কুসংস্কারের প্রভাবে, কিছুটা সমাজপতিদের আতঙ্কে কিছুটা বা স্বার্থান্ধ হয়ে। অপরপক্ষে পুত্র-পৌত্রাদিদের প্রেরণ করতে চাইবে রূপেন্দ্রনাথের চতুষ্পাঠীতে। ফলে বালিকাদিগের সঙ্গে কিছু বালককে ভর্তি করাতে স্বীকৃত হলে, জৈবিক নিয়মে, বিবর্তনের পরিচিত সূত্রে, একদশকের ভিতরেই কোণঠাসা ছাত্রীরা হয়ে যাবে বিলুপ্ত প্রাণী; ছাত্ররা জাঁকিয়ে বসবে। ওঁর বালিকা বিদ্যালয় মিশে যাবে গৌড়দেশের অগণিত চতুষ্পাঠীতে—শুধুমাত্র ছাত্রসমন্বিত বিদ্যায়তন।

দ্বিতীয় কথা : পুরুষছাত্র একই শ্রেণীতে বিদ্যাভ্যাস করলে অনেক প্রাচীনপন্থী পরিবারকর্তা সে-কারণেই হয়তো বাড়ির মেয়েদের বিদ্যালয়ে প্রেরণ করতে স্বীকৃত হবেন না। রূপেন্দ্রনাথের মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হবে।

তাহলে ঐ একমেবাদ্বিতীয়ম ব্যতিক্রমটি কেন?

ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। মহিলা-বিদ্যানিকেতনের ধারাটি অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়োজনে। রূপেন্দ্র যখন থাকবেন না তখনো যেন ঐ বিদ্যালয়টি চালু থাকে। আজকের অজাত ললনাকুল ভবিষ্যতেও যেন সোঞাই গাঁয়ে একটা আশ্রয় খুঁজে পায়, সেখানে তারা বাণীবন্দনার অধিকার লাভ করবে।

মহিলা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালেই রূপেন্দ্রনাথ গ্রামের জমিদারকে প্রশ্ন করেছিলেন, তারাদা, শুভপ্রসন্নের তো আট বৎসর বয়স হয়ে গেছে, ওকে কোনও গুরুগৃহে প্রেরণ করছ না কেন? তোমাকে জ্যেঠামশাই অবশ্য কোনও চতুষ্পাঠীতে পাঠাননি; কিন্তু তিনি নিজেই ছিলেন প্রগাঢ় পণ্ডিত। তোমাকে যথারীতি শিক্ষা দিয়েছেন নিজেই।

তারাপ্রসন্ন স্বীকার করেছিলেন, না ভাই, রূপেন। কিছু সংস্কৃত স্তব-স্তোত্র আমার মুখস্ত আছে বটে—বাঙলায় কৃত্তিবাস, ভারতচন্দ্র অথবা মঙ্গলকাব্য পড়তে পারি; কিন্তু ঐ দেবনাগরী- হরফে ক্রমাগত হোঁচট খাই। বড় বড় সমাসবদ্ধপদ দেখলে পুঁথি বন্ধ করে দিই। দোষ আমারই। বাবামশাই হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর শিক্ষকতার বাসনা চরিতার্থ করেছিলেন মায়ের উপর। আমি শুধু জমিদারী সেরেস্তার কাজটুকু শিখেছি।

—তা তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি তোমার পুত্রের ক্ষেত্রে কী করতে চাও? আমার মতো সে গুরুগৃহে যাবে, না তোমার মতো শুধু জমিদারী সেরেস্তার কাজটুকুই শিখবে?

তারাপ্রসন্ন প্রতিপ্রশ্ন করেন, হঠাৎ এ-কথা কেন রূপেন?

—বিশেষ কারণ আছে বলেই জানতে চাইছি। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি শুভ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ঠিক মতো গুরু পেলে ও কালে মহামহোপাধ্যায় হয়ে উঠতে পারে।

—হ্যাঁ। বাচস্পতিমশায়ও একদিন সেকথা আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, সোঞাই গাঁয়ের কাছে-পিঠে কোনও চতুষ্পাঠী নেই। আর আমার পুত্রসন্তান তো মাত্র একটিই। শুভর মা ওকে দূরে কোন গুরুগৃহে পাঠাতে রাজি নন।

তখন রূপেন্দ্রনাথ তাঁর পরিকল্পনার কথা খুলে বলেছিলেন। তিনি সোঞাই গাঁয়ে একটি মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর সেই সাবেক যুক্তি : হিন্দুসমাজের পতনের দ্বিবিধ হেতু! প্রথম কথা : সমাজপতিরা সমাজের আধখানাকে অশিক্ষা-কুশিক্ষা- অন্ধকুসংস্কারে ঢেকে রাখতে চাইছে। স্ত্রীলোকদের শিক্ষাদানে, তাদের, মুক্তিতে, তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় কূপমণ্ডুক সমাজপতিদের দৃঢ় আপত্তি। দ্বিতীয় কথা : একটি বৃহৎ মানবগোষ্ঠীকে ‘জল-অচল’ বলে দূরে সরিয়ে রাখা। যুগাবতার শ্রীচৈতন্য দ্বিতীয় ব্যাধিটা নিরাকরণের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন—যখন হরিদাসকে কোল দিয়েছিলেন—বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ব্রাহ্মণ ও শূদ্র সমান অধিকারে নামগানের আসরে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু স্ত্রীজাতীয়ার মুক্তির কথা আজ পর্যন্ত কেউ চিন্তা করেননি। রূপেন্দ্রনাথ সোঞাই গ্রামে সেই নারী-স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করে যাবেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কোন পুত্রসন্তান নেই—হবার সম্ভাবনাও নেই। রূপমঞ্জরীকে তিনি গার্গী-মৈত্রেয়ীর মতো শিক্ষিতা করে তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। কিন্তু রূপমঞ্জরী কালে সংসারী হবে, স্বামীর সহধর্মিনী হবে, স্বামীর গ্রামে জীবন অতিবাহিত করতে যাবে। এটাই প্রত্যাশিত, নিজের স্বার্থে, বিদ্যালয়ের স্বার্থে যদি তিনি রূপমঞ্জরীকে চিরকুমারী করে রাখেন তাহলে স্বর্গে বসে কুসুমমঞ্জরী মর্মাহতা হবে।

রূপেন্দ্রনাথ শুভপ্রসন্নকে ভিক্ষা করেছিলেন। তাঁর বালিকা বিদ্যালয়ের একমাত্র ব্যতিক্রম—যাবৎ বয়ঃসন্ধিকাল। তারপর শুভপ্রসন্নকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে দূরদেশের কোন গুরুগৃহে—ত্রিবেণীতে তর্কপঞ্চাননের চতুষ্পাঠীতে, অথবা কৃষ্ণনগরে শঙ্কর তর্কবাগীশের মহাবিদ্যালয়ে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আরণ্যক অধ্যাপক মহাপণ্ডিত বুনো রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত স্বীকৃত হন। মোটকথা, দু-তিন বছর গুরুগৃহে বাস করে উপাধিলাভ করে সে ফিরে আসবে সোঞাই গাঁয়ে। এবার সে শিখবে আয়ুর্বেদ। রূপেন্দ্রনাথ নিজে যখন থাকবেন না, জীবন দত্ত যখন থাকবে না, তখনো সোঞাই গাঁয়ের চিকিৎসালয় চালু থাকবে।

আর চালু থাকবে : ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যানিকেতন।

হ্যাঁ, সেই মহীয়সী অলোকসামান্যার নামেই হবে বিদ্যালয়। যিনি কূপমণ্ডুক সমাজের নির্দেশকে ছেঁড়া-কাগজের ঝুলিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে করেছিলেন সারস্বতসাধনা। ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে?’ প্রশ্নের জবাবে যিনি বলতে পেরেছিলেন : মনসা!

তারাপ্রসন্ন এককথায় রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু শর্তসাপেক্ষে।

তোমার সব প্রস্তাব আমি মেনে নিচ্ছি, রূপেন। তুমি সোঞাই গাঁয়ে চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা কর। শুভপ্রসন্নকে আমি তোমার হাতেই তুলে দিলাম। চতুষ্পাঠীর যাবতীয় ব্যয়ভার আমার। কিন্তু একটিমাত্র শর্তে : ওটা ‘বালিকা’ বিদ্যালয় হবে না। হবে চতুষ্পাঠী।

রূপেন্দ্রনাথ অট্টহাস্য করে উঠেছিলেন।

—হাসছ যে?

–মনে হচ্ছে, আমি যেন একটা বিবাহ-প্রস্তাব নিয়ে এসেছি তোমার দরবারে আর তুমি তা সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করেছ একটিমাত্র শর্তে। বিবাহে বর থাকবে, বরযাত্রী থাকবে, বরকর্তা থাকবে—আসর-বাসর-রন্ধনচৌকী-ছাঁদনতলা ফুলশয্যা সব; সব, থাকবে—শুধু একটি জিনিস রাখা চলবে না : কনে!

তারাপ্রসন্ন বলেছিলেন, তুমি বুঝছ না, একবগ্গা! তুমি স্ত্রীলোকদের নিয়ে একটি শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে গ্রামপঞ্চায়েত তোমাকে ক্ষমা করবে না। নিশ্চিত একঘরে করবে।

—দেখা যাক গ্রাম-পঞ্চায়েতের হিম্মৎ!

—তুমি চিরটাকাল একবগ্গাই রয়ে গেলে, রূপেন!

সেই যেদিন শোভারানী তার ফুলকাকাকে এক দামোদর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তার পরেই।

দীর্ঘদিন ধরে সোঞাই গাঁয়ের অন্যতম প্রধান সমাজপতি মনে মনে ফুঁসছিলেন ঐ একবগ্গা ছোঁড়াটার উপর। ছেলেটার সব সময় কেন যেন ‘গাঁয়ে-মানে-না-আপনি-মোড়ল ভাব। দুর্গাদার মতো মানী সমাজপতির মুখের উপর ছেলেটা বলে দিয়েছিল, আপনার বাড়িতে ‘মহাপ্রসাদ’ পেতে যেতে পারব না; তবে হ্যাঁ, ‘বৃথামাংস’ হলে কবজি ডুবিয়ে সাঁটতে পারতাম! কী আস্পর্ধা! এসব দুর্বিনীত কলাপাহাড়কে ‘হেঁটোয়-কাঁটা-মুড়োয়-কাঁটা’ কে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো উচিত। দুর্গাদা তখনই বলেছিল ছেলেটাকে একঘরে করতে। নন্দ স্বীকৃত হননি। উনি চান, চণ্ডীপণ্ডপে ষোলো আনার ডাক দিয়ে অপরাধীকে একবারই ধরে আনা হবে—যখন তার পালাবার আর কোনও পথ থাকবে না। এক কিস্তিতেই মাৎ

ছোকরা বারে-বারে পাঁকাল মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গেছে। নেহাত বরাত-জোরে। সে-বার গাঁ-সুদ্ধ মানুষ একমত হল কেষ্টার রাঁঢ়কে সহমরণের চিতায় তুলতে হবে—মায় জমিদারের সেই ভুল-করে লালপাড় শাড়ি দেওয়ার ঘটনাকে কায়দা করে তারাপ্রসন্নকে পেড়ে ফেলেছিলেন—হঠাৎ কোথা থেকে ঘোড়ায় চেপে এসে হাজির হল ঐ কালাপাহাড়! এসেই নিদান হাঁকল : কেষ্টার বেধবা পোয়াতি। কোন মানে হয়? বহু বহু দিন পরে গাঁয়ে একটা জমকালো সহমরণের আয়োজন হয়েছিল। পাঁচ গাঁয়ের মানুষজন ভিড় করে দেখতে এসেছিল হিন্দুধর্মের মহিমা! দিল ছোকরা সব কিছু ভেস্তে!

এতদিনে ঐ দুর্বিনীত ছোকরাকে কব্জা করার একটা নিশ্চিত সুযোগ পাওয়া গেছে। এক নম্বর : একবগ্গা ত্রিবেণী থেকে নিয়ে এসেছে থান পরা একটা ডাঁটো-খাটো বেধবাকে! জেনে-বুঝে যে, তার ভিটেতে জগুঠাকরুণ, কাতু বা তার বউ নেই। তাহলে তার মানেটা কি দাঁড়ালো? রূপো-ছোঁড়া তো আগে থেকে জানত না যে, নীতু মুখুজ্জের দিদি ভায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ওর ভিটেয় এসে আশ্রয় নেবে! তাহলে? তুই হচ্ছিস কুলীন ঘরের বামুনের বেটা! মন চাইলে তো পাঁচ-সাতটা অগ্নিসাক্ষী-ময়না পুষতে পারিস—অবশ্য আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে হিম্মৎও থাকা চাই—তা নয়, এক ছামুতে বেধবা মেয়েছেলে পোষা।

কিন্তু এমন রগরগে অভিযোগটা ধোপে টিকলো না। দ্যাখ-না-দ্যাখ পীতু মুখুজ্জের দিদি ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একবগ্গার ছামুতে এসে আশ্রয় নিল।

আসল ঘটনা তো তাই? নাকি বড় খোকা যা বলছে তাই সত্যি? পীতু মুখুজ্জে কায়দা করে বালবিধবা দিদিটিকে ঘাড় থেকে নামিয়েছে? একবগ্গাকে একটা নচের আড়াল সরবরাহ করতে? কিন্তু পীতুর স্বার্থটা কি? ঐ একবগ্গা হারামজাদাই তো পীতুর ডগা মেয়েটাকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে দুর্গাদার নাকের সামনে সংযুক্তাহরণ করেছিল! তাহলে?

তারপর ধর গিয়ে একবগ্গার ঐ পৈশাচিক বেলেল্লাপনা! পাঁচবাড়ির সধবা-বেধবা, ছুঁড়ি- বুড়িকে নিয়ে দুপুরে-মাতন! কী? না মেয়েছেলের চতুষ্পাঠী! বাপের জন্মে শুনেছ তোমরা? কী হবে তোদের লেখাপড়া শিখে? বারোহাত কাপড়ও তোদের কাছে মোছলমানের লুঙ্গি—কাছা দিতে পারিস না—কী হবে দস্তখত করতে শিখে? ‘সগ্যের অপ্সরী’দের মতো পিঠে কি এক জোড়া করে ডানা গজাবে? ফুরুৎ করে উড়ে দাঁড়ে গিয়ে বসবি? ঠিকই করেছে বড়খোকা বউ-এর পিঠে আস্ত চ্যালকাঠ ভেঙে।

বড়খোকার ধর্মপত্নী—অর্থাৎ নন্দ চাটুজ্জের মেজ পুত্রবধূ বিশুর-মা আবদার ধরেছিল!তারা জেঠিমার মতো সেও রূপোদার পাঠশালায় নাম লেখাবে। লজ্জা-সরমের বালাই নেই ‘বিশু-এখনো তোর বুকের দুধ খায়, তুই পাঠশালায় ভর্তি হবি? বেশ করেছে বড়খোকা বউকে ঠেঙিয়ে।

ঠিকই বলেছেন শিরোমণি মশাই : গৃহস্থবধূরা ‘বিদ্যেধরী’ হলে বাস্তবে ‘ব্যাপিকা’ হয়ে উঠবে। রন্ধনাদি গৃহকর্মে তখন আর তাদের মন থাকবে না। পতিসেবা দূর-অস্ত, পুত্রকন্যাদের মলমুত্রাদি ধৌত করার কাজও স্বামীদেবতার স্কন্ধে চাপিয়ে দেবে। এ সর্বনাশ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা দরকার! না হলে সোঞাই গ্রামে আজ যে ব্যভিচার শুরু হচ্ছে তাতেই ক্রমে গোটা হিন্দুসমাজে ধ্বস নামবে

সমাজপতি নন্দ ঘরে-ঘরে গিয়ে এ-বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বড়খোকা-ছোটখোকা যুবকদলের মতামত গ্রহণ করেছে। বাচস্পতিমশাই অথবা ঘোষালখুড়োর মতো দু-একজনকে ব্যতিক্রম হিসাবে ধরলে গোটা গ্রাম এককাট্টা! এ সর্বনাশ শুরুতেই রুখতে হবে। একবগ্গা যদি তার জিদ্দিবাজি ছাড়তে রাজি না হয় তবে নবাব-সরকারে শিকায়েদ করা হবে।

বড়খোকা, কালু, গজেন প্রভৃতি নব্য যুবার দল অবশ্য ভিন্ন মন পোষণ করে। তাদের মতে একবগ্গা ঠাকুর মেনে নেয় ভাল, না হলে তার ঘরের চালায় আগুন দিয়ে বাপ-বেটিকে জীয়ন্তে পুড়িয়ে মারাই উচিত!

এই যখন অবস্থা, তখন শোনা গেল চরমতম বেলেল্লাপনার খবরটা—বারুদের স্তূপে যেন আগুনের ফুলকি : একবগ্গার পাঠশালায় ভর্তি হতে চলেছে এক মোছলমানের নিকা করা ডব্‌কা ছুঁড়ি! রমজানের মাসটা শেষ হলেই! .

এবার নন্দ নিজেই বললেন : ঠিকই বলেছিলি তোরা! ধম্মে সইবে না। দে, রূপো- বাঁড়ুজ্জের ঘরের চালায় আগুনই ধরিয়ে দো

১০

অনেকেরই আশঙ্কা ছিল একবগ্গা আসবে না। তাকে ধরে বেঁধে আনতে হবে। দেখা গেল, তাদের আশঙ্কা অমূলক। নির্ধারিত সময়ে কাঁধের উপর উড়ুনিটা চাপিয়ে জীবন দত্তকে সঙ্গে করে রূপেন্দ্রনাথ উপস্থিত হলেন চণ্ডীপণ্ডপে।’ষোলো আনার ডাকে’। এটাই ছিল সেকালীন বিধান। তারাশঙ্করের ‘চণ্ডীমণ্ডপ’ উপন্যাসে তার বর্ণনা আছে। সেটা অবশ্য বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ! গ্রামে সরকার নিয়োজিত চৌকিদার আছে। প্রহরে প্রহরে সে হাঁকাড় পাড়ে—হুঁ-শিয়ার’! সিঁদেল চোরদের হাত থেকে গৃহস্থকে সজাগ রাখতে। সেই চৌকিদারটিই পৃথক বেতন পায় পঞ্চায়েতের তরফে। পঞ্চায়েত-সমাজপতিদের হুকুম হলে সে পাড়ায়-পাড়ায় ঢেঁড়া বাজিয়ে জানান দেয়—কবে, কখন চণ্ডীমণ্ডপে সমাজপতিরা সমবেত হবেন, কে বাদী, কে প্রতিবাদী। সচরাচর সেটা হয় শুক্লপক্ষে সন্ধ্যার পর, তেঁতুল বটের বাঁধানো চাতালে। ছোট-খাটো অভিযোগ থাকলে বাদী-প্রতিবাদী বা সাক্ষী ছাড়া সমাজপতিরা দু-তিনজন আসেন। বাদীর অভিযোগ শোনেন। প্রতিবাদীর কৈফিয়ত শ্রবণ করেন। প্রয়োজনে সাক্ষীদের জবানবন্দীও নেওয়া হয়। তারপর সমাজপতিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে অপরাধীর শাস্তির বিধান করেন।

চুরি-চামারি, জোর করে অপরের ক্ষেতে ধান-কাটা অথবা অনধিকার প্রবেশ। ‘পরস্ত্রীকাতরতার’ অভিযোগ এভাবেই সমাজপতিরা মিটিয়ে দেন। খুন, জখমু, ডাকাতি হলে চৌকিদার কোতোয়ালকে খবর দেয়। নবাব-সরকারের তরফে তখন কাজী অপরাধীর বিচার করেন। কিন্তু গ্রামবাসীর ভিতর কেউ যদি বড় জাতের অপরাধ করে—যাতে কোতোয়ালকে সংবাদ প্রেরণ অপ্রয়োজনীয় অথচ সামাজিক অপরাধটা রীতিমতো গুরুতর, তখন হয় : ‘ষোলো-আনার ডাক’।

সে-ক্ষেত্রে পন্তিয়াস পীলেত যেভাবে যীসাস-এর বিচার করেছিলেন সমাজপতিরা ঠিক সেভাবেই গ্রামের সাধারণ মানুষকে বলেন, তোমরা দ-পক্ষের কথাই শুনলে। এবার বল আসামী দোষী, না নির্দোষ!

জনগণ তখন ‘জুরী’। তাদের রায় শুনে সমাজপতিরা নির্ধারণ করতেন আসামী দোষী না নির্দোষ। দোষী হলে কী শাস্তি দেওয়া হবে তাও নির্ধারণ করতেন ঐ সমাজপতিরাই।

এই ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রামীণ বিচার-ব্যবস্থা।

জনগণের আদালত।

চণ্ডীমণ্ডপে জনসমাগম বড় কম হয়নি। ধন্বন্তরি-বাবাকে ভালবাসে গাঁয়ের সাধারণ মানুষ। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি সকলকেই ওষুধপত্র বিতরণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে সমাজপতিরা কী অভিযোগ এনেছেন ‘তা অধিকাংশ লোকেই জানে না। সকলেই কৌতূহলী। শুক্লপক্ষের চতুর্দশী। জ্যৈষ্ঠ মাস। আলোয় চারদিক ফুটফুট করছে। রূপেন্দ্রনাথ জীবন দত্তকে সঙ্গে করে সহাস্যবদনে এগিয়ে এসে বললেন, কী ব্যাপার নন্দ খুড়ো? আমার বিরুদ্ধে কে কী অভিযোগ এনেছে, বলুন? আমি কৈফিয়ত দিতে একপায়ে খাড়া হয়েছি!

কথার সঙ্গে সঙ্গে তেঁতুলবটের বাঁধানো চাতালে গাঁথা তেলসিঁদূরে রাঙা প্রস্তরখণ্ডে দক্ষিণহস্ত স্পর্শ করিয়ে কপালে ঠেকালেন।

নন্দ বললেন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই, বাবাজী। লোকজন এখনো আসছে। বাচস্পতিদা এখনো এসে উপস্থিত হননি। তুমি বস এখানে।

নির্দেশমতো চাতালের একান্তে উপবেশন করলেন রূপেন্দ্রনাথ। স্বভাববশে পদ্মাসনে।

একটু পরে বাচস্পতিমশাই এসে গেলেন। সমাজপতিদের মধ্যে তিনিই বয়ঃজ্যেষ্ঠ। রূপেন্দ্রনাথ তাঁর পদধূলি নিয়ে জানতে চাইলেন, বাতের ব্যথাটা আর চাগায়নি তো, খুড়ো?

—না বাবা, ধন্বন্তরি! রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়েছে।

শিরোমণি বলে ওঠেন, সবাই এসে গেছেন মনে লাগে। ঘোষালদা, চক্কোতি খুড়ো, বাচস্পতিমশাই,—হ্যাঁ সবাই এসেছেন। এবার বল, নন্দভায়া, রূপেন বাঁড়ুজ্জের বিরুদ্ধে সমাজের অভিযোগটা কী?

নন্দ নড়ে-চড়ে বসলেন। বললেন, অভিযোগ তো একটা নয় যে, এক কথায় মিটে যাবে। একে একে বলি। কিন্তু অভিযোগটা দাখিল করার আগে আমি কিছু তথ্য যাচাই করে নিতে চাই। জানা কথাই, তবে প্রথমে কবুল করিয়ে নিলে সুবিধা হবে। বাবা রূপেন, তুমি কি বছর-দু-তিন আগে বদ্দমানের নগেন দত্তের বজরায় চেপে পুরীধামে তীথ্য করতে গেছিলে?

রূপেন্দ্র বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।

—এবার বলতো ভায়া, সেই বজরায় কি এ গাঁয়ের সমাজপতি শ্রীদুর্গা’ গাঙ্গুলী আর তাঁর ধর্মপত্নী মীনু, মানে আমাদের গাঁয়ের পীতাম্বর মুখুজ্জের কন্যা মৃন্ময়ীও গেছিল?

রূপেন্দ্রনাথের ভ্রূ-যুগলে বিরক্তির কুঞ্চন দেখা গেল। গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি একটা তথ্য বিস্মৃত হয়েছেন, খুড়ো। এটা কোন খোশগল্পের আসর নয়। গ্রামপঞ্চায়েত আমাকে আসামী হিসাবে তলব করেছে এবং আমি হাজির হয়েছি। আপনি প্রথমেই আমাকে বলুন : বাদী কে? আমার বিরুদ্ধে কী তাঁর অভিযোগ? এই তথ্য দুটি পেশ করার পরেই সমাজপতি হিসাবে আপনার অধিকার বর্তাবে আমাকে সওয়াল করার। কী বাচস্পতিকাকা? আমি কি পঞ্চায়েত-নিয়মবিরুদ্ধ কিছু দাবি করছি?

বাচস্পতি কিছু বলার আগেই নন্দখুড়ো বলে ওঠেন, বাদী হচ্ছে দুর্গা গাঙ্গুলী, যার বউ পুরীতে বেমক্কা চুরি গেছল!

রূপেন্দ্রনাথ বললেন, সেক্ষেত্রে আমার প্রথম দাবি : চণ্ডীমণ্ডপে বাদীকে উপস্থিত করুন। তাঁর যা অভিযোগ তিনি ব্যক্ত করুন। তারপর আমার বিচারের প্রশ্ন উঠবে।

নন্দ বললেন, এ তো তোমার অন্যায় আবদার, রূপেন। সবাই জানে দুর্গাদা এখন গাঁয়ে নেই। তাকে আমি এখন কী করে হাজির করব?

বাচস্পতি বললেন, সে-ক্ষেত্রে এ অভিযোগের বিচারটাও মূলতুবি থাকবে, নন্দ, যতদিন না দুর্গা গাঁয়ে ফিরে আসে।

নন্দ রুখে ওঠেন, কিন্তু দুর্গাদা আমাকে নিজমুখে বলেছে…

বাচস্পতি তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দেন : না। তা হয় না। বাদী যেখানে অনুপস্থিত সেখানে বিচার হতে পারে না।

নন্দ বললেন, বেশ। তাহলে মীনুর কেচ্ছাটা মূলতুবি থাক। দুর্গাদা ফিরে এলে তার ফয়সালা হবে। আমি দু-নম্বর অভিযোগের কতা বলি। এবার আমি নিজেই বাদী। রূপেন তার নিজের ভিটেয় পক্ষকাল হল একটা আজব চতুষ্পাঠী খুলেছে। সেখানে নাকি ছাত্র থাকবে না, বেবাক ছাত্রী! ইতিমধ্যেই নানান বয়সের সাত-আটটি স্ত্রীলোককে ও পাকড়াও করেছে। তার মধ্যে সধবা-বেধবা-অরক্ষণীয়া-পুঁচকে সব রকম চিড়িয়াই আছে। দুর্জনে একথাও বলছে যে, সেখানে নাকি একটি মোছলমান মেয়েছেলেও দুদিন পরে আসবে। বামুনের ভিটেয়! বামুন-কায়েত-জল-অচল যবনী সব এক পংক্তিতে! জাত-ধম্মো বলতে আর কিছু রইলে না! কী রূপেন? আমি কি মিছে কথা বলছি?

রূপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। সত্য কথা। তবে চতুষ্পাঠী নয়। এখানে চতুর্বেদের চর্চা আদৌ হবে না। এটি হবে স্ত্রীলোকদিগের জন্য একটি ‘মহিলা বিদ্যানিকেতন’। মহিলাদের এখানে অক্ষর পরিচয় করানো হবে। ছাত্রীরা প্রয়োজনমতো শিখবে শুধু বাঙলা ভাষা অথবা বাঙলা ও সংস্কৃত। এছাড়া শেখানো হবে মহিলাদের গার্হস্থ্যধর্ম, রোগীর সেবা, শিশুপালন, স্বাস্থ্যবিধি প্রভৃতি।… আর হ্যাঁ। ঐ কথাটাও সত্য। রমজানমাসের বাকি কটা দিন পার হলে একটি মুসলমান মহিলাও আমাদের বিদ্যাপীঠে বাঙলা ভাষা শিখতে আসবেন।

নন্দ বললেন, বাবা রূপেন! এমন আজব কতা আমরা বাপের জন্মে শুনিনি। তুমি বল তো, গৌড়দেশে, অথবা গোটা আর্যাবর্তে আর কোথাও এমন আজব বিদ্যাপীঠ কি একটিও আছে, যেখানে শিক্ষক ব্যতিরেকে আর কোনও পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই, শুধু সুন্দরী রমণী—মানে, বৃন্দাবনলীলার প্রসঙ্গটা বাদ দিয়ে প্রশ্ন করছি আমি।

জবাব দিতে কিছু বিলম্ব হল রূপেন্দ্রনাথের। তবু নন্দ চাটুজ্জের প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপকে উপেক্ষা করে জবাবে বললেন, না, আমার জ্ঞানমতে মহিলা-বিদ্যাপীঠ আর কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে জানি না।

—সেক্ষেত্রে, ভূ-ভারতে যে জিনিস নেই—হিন্দুধর্মে যে বস্তুটি সুস্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ, অর্থাৎ স্ত্রীজাতীয়ার অক্ষর-পরিচয়—সে জাতীয় বৃন্দাবনলীলার কথা তোমার উর্বর মস্তিষ্কে কী-ভাবে গজিয়ে উঠল, বাবা একবগ্গা?

রূপেন্দ্র প্রণিধান করলেন যে, প্রতিবাদ না করলে নন্দর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাত্রা উত্তরোত্তর বর্ধিতই হতে থাকবে। অথচ তিনি বয়োঃজ্যেষ্ঠ, সমাজপতি! তাই এবার বাচস্পতি-মশায়ের দিকে ফিরে বললেন, প্রশ্নকর্তার ভাষা ও বাচনভঙ্গিতে আমার দৃঢ় আপত্তি আছে, বাচস্পতিকাকা। পঞ্চায়েতের আহ্বানমাত্র আমি এসেছি। আমি কী করছি, কেন করছি কার স্বার্থে করছি, তা জানাতে আমি প্রস্তুত; কিন্তু কোনও অর্বাচীন প্রশ্নকর্তার অশালীন প্রশ্নের জবাব আমি দেব না! আমার এই অভিযোগ সম্বন্ধে আপনার বিচারের পর এ প্রশ্নের জবাব দেব।

নন্দ বুঝতে পারেন, একবগ্গা ঘুরিয়ে তাঁকে অর্বাচীন বলল। কিন্তু তিনি কিছু বলতে ওঠার পূর্বেই বাচস্পতি তাঁকে থামিয়ে দিতে বলে ওঠেন, তুমি থাম, নন্দ। ওকে বুঝিয়ে বলতে দাও : ও কী করতে চাইছে, কেন করতে চাইছে, কার-স্বার্থে করতে চাইছে। ও বলুক।

রূপেন্দ্রনাথ তখন একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। স্ত্রীলোকদিগের শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে। প্রাক-মুসলমান যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্ত্রীলোকদের বিদ্যাদানের যে ব্যবস্থা ছিল, বৌদ্ধধর্মে যে ‘থেরিগাথা’ রচিত হয়েছিল তা বুঝিয়ে বললেন। স্ত্রীলোকের অক্ষর পরিচয়ের সঙ্গে বৈধব্যযোগ সে সম্পর্কহীন সে-কথা মৈত্রেয়ী থেকে ব্রজসুন্দরীর উদাহরণ দাখিল করে প্রমাণ করতে চাইলেন। সোঞাই, গ্রামবাসীকে তিনি নিজ-নিজ পরিবারের স্ত্রীলোকদিগকে তাঁর সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যানিকেতনে’ প্রেরণ করতে অনুরোধ করলেন। না—গুরুদক্ষিণা কিছু দিতে হবে না। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবৈতনিক।

নন্দ এবং শিরোমণি ওঁর বক্তৃতার মাঝখানে দু-তিনবার বাধাদানের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বাচস্পতি-মশায়ের হস্তক্ষেপে তা প্রতিহত হল। উপসংহারে রূপেন্দ্রনাথ বললেন। নন্দ খুড়ো জানতে চেয়েছিলেন ভূ-ভারতে বর্তমানে যা নেই তা কেন প্রবর্তন করতে চাইছি আমি। জবাবে আমি বলব—চিরটাকাল যা বলে এসেছে সেটাই যে বাঞ্ছনীয় তা সবসময় ঠিক নয়। এক সময়ে আদিম মানুষ অগ্নি-প্রজ্বলন-প্রক্রিয়া জানত না, কৃষিকাৰ্য জানত না। যে যুগাবতার প্রথম সে-কাজ করেছিলেন তিনি সমাজের ক্ষতি করেনি—উন্নতিই করেছেন। অগ্নি প্রজ্বলিত করে, কৃষিকর্মের প্রবর্তন করে।

নন্দ ফাঁক বুঝে হঠাৎ বলে ওঠেন, তুমিও বুঝি তেমনি একজন যুগাবতার?

রূপেন্দ্রনাথ নন্দ খুড়োর মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন : নন্দ-খুড়ো! আপনি ভূ- ভারতে সোঞাই গাঁয়ের একবগ্গা দীঘির মতো কোনও সংরক্ষিত পুষ্করিণী দেখেছেন? আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে আন্ত্রিক-রোগ প্রবলভাবে চালু আছে অথচ একবগ্গা দীঘি থেকে যারা পানীয় জল সংগ্রহ করেন সেসব পরিবার থেকে আন্ত্রিক রোগ সম্পূর্ণ বিদূরিত? নন্দ কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার পূর্বেই বাচস্পতি বললেন, এ ব্যাপারে নন্দর মতামত নিষ্প্রয়োজন। এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। রূপেন বাবাজী সোঞাই গাঁ থেকে আন্ত্রিক রোগ…

কথার মাঝখানে নন্দ বলে ওঠেন, আপনি এভাবে বারে বারে আমাদের মুখ বন্ধ করতে পারেন না। সমাজপতিরা এ বিচারসভায় সবাই পর্যায়ক্রমে কথা বলবেন। এটাই প্রথা।

বাচস্পতি সামলে নেন নিজেকে। বলেন, বেশ তো, বল না নন্দ, কী বলতে চাও?

নন্দ এতক্ষণে উঠে দাঁড়ালেন। দৃঢ়স্বরে বললেন, আজ্ঞে না, বাচস্পতিদা বক্তৃতা দেবার অভ্যেস আমার নেই, তা আমরা কেউ দেবও না। তবে আমি গাঁয়ের ইতর ভদ্র সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। রূপেন বাঁড়ুজ্জের ঐ মেয়েছেলের চতুষ্পাঠী—যাতে হিন্দু-মোছলমান একসাথে অ-আ-ক-খ শিখবে—তা আমরা বরদাস্ত করব না। হতে দেব না। বিশ্বেস না হয় তো আপনি সবাইকে শুধিয়ে দেখুন। সবাই এ বিষয়ে একমত

বাচস্পতি রূপেন্দ্রের দিকে ফিরে বললেন, আশা করি এতে তোমার আপত্তি নেই, রূপেন? তোমার বক্তব্য তুমি বলেছ—গাঁয়ের পঞ্চজন তার অর্থ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছেন কি না জানি না; কিন্তু সংখ্যাগুরু মানুষের সিদ্ধান্ত তুমি নিশ্চয় মেনে নেবে। কী বল?

রূপেন্দ্র বললেন, নিশ্চয়ই। কিন্তু তার পূর্বে আপনি নিশ্চয় আসামীকে তাঁর শেষ বক্তব্যটা পেশ করার অনুমতি দেবেন?

—তোমার আরও কিছু বলার আছে?

—তা আছে, বাচস্পতিকাকা।

—তবে বল?

রূপেন্দ্রনাথ উচৈঃস্বরে বললেন, আমার এই ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যানিকেতন’ প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে রায়দানের আগে আপনাদের একটি কথা আমি নিবেদন করতে চাই। আমার গুরুদেব ত্রিবেণীর মহামহোপাধ্যায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন-মশাই এবার আমাকে সকন্যা সোঞাই গাঁয়ে প্রত্যাবর্তনে বাধা দিয়েছিলেন। তাঁকে বর্ধমানরাজ প্রায় হাজার বিঘা নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি প্রদান করেছেন। গুরুদেবের বাসনা সেখানে একটি আয়ুর্বেদ মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। আমাকে তিনি অধ্যক্ষরূপে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন একশত তঙ্কা মাসিক বেতনে। তদ্ভিন্ন বিনামূল্যে আমাকে বাসস্থান এবং সংবৎসরের চাউল প্রদান করা হবে। আমি সেই লোভনীয় প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে সোঞাই গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেছি। দুটি হেতুতে। প্রথম কথা : আয়ুর্বেদবিদ্যা শিক্ষা গ্রহণের জন্য আমাকে যখন আমার স্বর্গত পিতৃদেব গুরুগৃহে প্রেরণ করেন তখনি তিনি আদেশ করেছিলেন : ‘ফিরে এসে এই সোঞাই গ্রামেই তুমি গ্রামবাসীর চিকিৎসা করবে। এ গ্রামে চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই।’ তাঁর আদেশ আমি শিরোধার্য করেছিলাম। অক্ষরে অক্ষরে এতদিন পালন করে এসেছি। দ্বিতীয় কথা : আপনারা রাজি হন বা না হন আমি একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবই।

বাচস্পতি বলেন, সোঞাইবাসীর অধিকাংশ মানুষ যদি তাতে আপত্তি জানায়, তদ্‌সত্ত্বেও?

রূপেন্দ্রনাথ সহাস্যে বললেন, চণ্ডীমণ্ডপে বর্তমানে শতকরা শতভাগই পুরুষ। মহিলা—যাঁদের স্বার্থে আমি বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি, তাঁরা এখানে অনুপস্থিত, কাকা

নন্দ বলে ওঠেন, অন্তঃপুরচারিনীরা কোনদিনই চণ্ডীমণ্ডপে এসে তাদের মতামত জানায়নি। জানায় না। এটাই প্রথা।

—সেই প্রথাটাই আমি পরিবর্তন করতে বদ্ধপরিকর। তবে এটাও জানি আমি জোর করে আমার ভিটেয় ঐ বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আপনারা আমার ঘরের চালায় আগুন ধরিয়ে দেবেন।

—সেটাও জান? বাঃ তাহলে আর বেহুদ্দো, কপ্‌চাচ্ছ কেন?

—আপনাকে বলছি না, নন্দ-খুড়ো। আমি সোঞাইবাসীকে উদ্দেশ করে বলছি : তোমরা যদি চাও, আপনারা যদি চান, তাহলে পিতৃআদেশের বন্ধন আর আমার থাকবে না। ঠিক যেভাবে একদিন পিতার মুখাগ্নি করেছিলাম, সেইভাবেই আমার বাস্তুভিটার চালায় স্বয়ং অগ্নিসংযোগ করে গ্রাম ত্যাগ করে আমি ত্রিবেণীতে ফিরে যাব। সেখানে আয়ুর্বেদ মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করব এবং জেনে রাখুন, সেখানে একটি মহিলা বিদ্যানিকেতনও প্রতিষ্ঠা করব! আপনাদের ভাতে কিঞ্চিৎ অসুবিধা হবে এইমাত্র। পরিবারে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ত্রিবেণীতে লোক পাঠাতে হবে। সর্পদংশনের ক্ষেত্রে অবশ্য ওঝা ডাকতে হবে। ত্রিবেণী থেকে আমার পক্ষে সর্পদংশনের চিকিৎসা করতে আসা সম্ভবপর হবে না।

সভায় পক্ষিপালকপতনের নিস্তব্ধতা।

রূপেন্দ্রনাথ এবার বাচস্পতিমশায়ের দিকে ফিরে মৃদু হাসলেন। বললেন, গ্রামবাসীকে আমার যা বলার ছিল তা বলেছি, বাচস্পতিকাকা আমাদের দাতব্য চিকিৎসালয়ে কিছু রুগী এখনো মরতে বাকি আছে। তাদের কাছে যেতে হবে এবার। তবে আমার শিষ্য জীবন দত্ত আপাতত এখানে থাকল। তার মাধ্যমে আমাকে জানিয়ে দেবেন, ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যানিকেতনটা’ আমি কোথায় প্রতিষ্ঠা করব—সোঞাই গ্রামে, না ত্রিবেণীতে।

জীবন এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। এবার বলল, আপনি আবার গ্রাম ত্যাগ করে গেলে, আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে যাব, গুরুদেব।

রূপেন্দ্র বললেন, তোমার সিদ্ধান্তটি নন্দ-খুড়োকে জানিয়ে দিও জীবন। সেক্ষেত্রে ব্রজেন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত দাতব্য চিকিৎসালয়টি উঠে যাবে। নন্দ-খুড়ো আর পাঁচজন সমাজপতির সঙ্গে যুক্তি করে স্থির করবেন—ওখানে কোন্ দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে; ওলাবিবি, মনসা না শীতলা! চিকিৎসকের অভাবে ওঁরাই তো শুধু ভরসা!

রূপেন্দ্রনাথ চলবার উপক্রম করতেই ভিড়ের ওপাশ থেকে খখনে মহিলাকণ্ঠে কে যেন বলে উঠলেন, এট্টু ভেঁরিয়ে যা, বাবা রূপেন।

রূপেন্দ্রনাথ থমকে গেলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন মৃন্ময়ীর বৃদ্ধা পিসিমা : গিরিবালা দু-পা এগিয়ে এসে তিনি বাচস্পতিমশাইকে সম্বোধন করে বললেন, কতাটা আমি তোমারেই বলতে চাই, ঠাকুরপো!

—বলুন! বলুন! আপনি কখন এলেন?

গিরিবালা বললেন, রূপেন দেবতা। রাগ-অভিমানের বাইরে। তাই ও কারেও শাপ- শাপান্ত করতে পারবেনি, আমি জানি। কিন্তু সে যদি তোমাদের বিধেন শুনে নিজের হাতে নিজের ভিটেয় মুখাগ্নি করে গাঁ-ছাড়া হয়ে যায়, তাহলে বন্দ্যঘটি বংশের সাতপুরুষের বেস্হ শাপ অনিবায্য! সেই মহাভারতের জন্মেঞ্জয়-পরিক্ষিতের বেত্তান্ত! তা বেহশাপের ফলটা কোন সমাজপতি মাথা পেতে নিচ্ছেন সেটা আগে থির হোক

হঠাৎ নন্দ চাটুজ্জের দিকে ফিরে তিনি পুনরায় খখনে গলায় বলে ওঠেন, কি গো নন্দ-ঠাকুরপো? তোমার গলাটাই এতক্ষণ বেশি শোনা যাচ্ছিল, মনে লাগে। তা তক্ষকসাপের বিষটুকু তুমিই সপরিবারে হজম করতে রাজি আছ তো? চণ্ডীমণ্ডপের ঐ তেলসিঁদূরমাখা পাতরখানা ছুঁয়ে আগে কবুল খাও দিনি। তারপর তোমার সমাজপতিগিরি কর!

দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *