রূপকথা

রূপকথা

চা খুব বাজে হয়েছে। চিনি কম। দুধ প্রায় নেই বললে চলে। পাতা ভেজানোর সময়টাই যা বেশি হয়েছে। ফলে তেতো স্বাদ মারাত্মক। মনে হচ্ছে, চা-পাতার বদলে নিমপাতা দিয়ে চা হয়েছে।

বিশ্বনাথ নিমপাতার চা আরাম করে শেষ করেছে। এখন সে খালি কাপ হাতে বসে আছে। চায়ের এই একটা মজা। খেয়ে তৃপ্তি লাগলে কাপ রাখতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, খালি কাপ হাতে খানিকক্ষণ বসে থাকি। বারান্দার গ্রিল টপকে রোদ পড়ছে বিশ্বনাথের গায়ে। সকালের রোদ হলেও শরতের রোদে তেজ আছে। একটু যেন গরম গরম লাগছে। বিশ্বনাথ সরে বসল না, দু’কামরার ভাড়াবাড়ির এই ফালি বারান্দাটুকর রোদ বৃষ্টি একেবারেই বাড়তি পাওনা। প্রথমদিন এ-বাড়িতে ঢুকে রেবা ভয়ংকর বিরক্ত হয়েছিল। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এমা! ঘরগুলো তো দম চাপা। আলো বাতাস নেই, একটু হাত-পা মেলার জায়গা নেই। দুই মেয়েকে নিয়ে থাকব কী করে? রান্নাঘরটা দেখেছ?’

‘দাঁড়াও এখন তো নিয়ে নিই। এর থেকে কম ভাড়ায় কলকাতায় টু রুম ফ্ল্যাট কোথাও পাব না। পরে মাইনেকড়ি বাড়লে বাড়ি বদলাতে কতক্ষণ? তা ছাড়া শুনছি, অফিস নাকি রাজারহাটে কো-অপারেটিভ ফ্ল্যাট বানাবে। হাই লেভেলে কথা চলছে। সহজ কিস্তিতে দিলে নিয়ে নেব। এই ধরো মাসে বাইশশো টাকার মতো পড়বে। বাহশশো আর এমন কী টাকা। তা ছাড়া তখন তো আমার প্রমোশন টোমোশন হয়ে একটা কাণ্ড হবেই। বাইশশশা কেন তখন তিন হাজার পর্যন্ত গায়ে লাগবে না। আসলে কী জানোর, প্রাইভেট কোম্পানির এই একটা খেলা। ওঠবার সিড়ি পেতে দেরি হয়, কিন্তু একবার পেয়ে গেলে আর দেখতে হয় না। তখন শুধু ওঠো আর ওঠো। উঠতে উঠতেই হাঁপিয়ে যাবে। মনে হবে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি, আর উঠতে চাই না। হা হা।’

রেবা বিশ্বনাথের হাসিতে উৎসাহ পেল না। সে ভুরু কুঁচকেই রইল। সেই ভুরু সোজা হল এই বারান্দা দেখার পর।

‘বাঃ বারান্দাটা তো চমৎকার। এখানে ক’টা বেতের চেয়ার আর একটা ছোট টেবিল নিয়ে নেব।’

বিশ্বনাথ স্ত্রীর উৎসাহ বাড়িয়ে দিতে বলল, ‘বিনু-মিন চাইলে এখানে বসে পড়াশোনা করতে পারে। চারিদিকে গ্রিল দেওয়া। ভেরি সেফ। পরদা ঝুলিয়ে একটা টিউব দিলে তো একেবারে আস্ত একটা ঘর। ফ্রিতে একস্ট্রা একটা ঘর হয়ে গেল রেবা, সেটা একবার ভেবে দ্যাখো। গরমকালটা আমি এখানেই শোব। স্লিপ ইন ন্যাচারাল এয়ার অ্যান্ড মুনলাইট।’

গত বারো বছরে কিছুই হয়নি। প্রোমোশনের সিঁড়ি পাওয়া যায়নি, ফলে মাইনের অবস্থা আজও সেই ভয়ংকর। রাজারহাটে ফ্ল্যাট তো দুরের কথা, বারান্দার জন্য সামান্য কটা বেতের চেয়ারও হয়নি। এখনও সেই গুটিকয়েক মোড়া আর যাদবপুরের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা মান্ধাতার আমলের একটা চেয়ার। মোড়া ক’টার বেত ছিঁড়ে গেলেও, চেয়ারটা মোটামুটি অক্ষতই আছে। শুধু আশ্চর্যভাবে পেছনের দিকে একটা পা কী করে যেন খানিকটা ছোট হয়ে গেল! বসলে ঢকঢক করে। এ আবার কী কাণ্ড! পুরনো চেয়ারের পা ছোট হয়ে যায় নাকি ? মিনু বলে, ‘বাবা, চেয়ারদাদুকে মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই হাতে লাঠি দিতে হবে। ভদ্রলোক আর নিজের পায়ে দাড়াতে পারছেন না।’

সুখবর শুধু একটাই। বড়লোকি কায়দায় বারান্দা সাজানো না গেলেও, রোদ বৃষ্টি আলো বাতাসরা তেমন কিছু মনে করেনি। তারা আগে যেমন আসত, এই গরিব বারান্দায় এখনও তেমন আসে।

বিশ্বনাথের মতো মানুষের চারপাশে ভাল লাগার মতো কিছু থাকে না। বিশ্বনাথেরও নেই। যা আছে সবটাই খারাপ লাগার মতো। মুখে আছে চায়ের তেতো স্বাদ। চাল, ডাল, চিনির খালি কৌটো দেখে দেখে ক্লান্ত স্ত্রী রান্নাঘরে বসে আছে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে। বারান্দা থেকে তার একটানা গজগজ শোনা যাচ্ছে। রান্নাঘরের লাগোয়া শোবার ঘরে তক্তপোশে শুয়ে আছে, মেয়েরা। বিনু আর মিনু। তারা বড় হচ্ছে। এ বছরই বিলুর মাধ্যমিক। মিটার ক্লাস এইট। দুজনেই রোগা এবং দু’জনেরই গায়ের রং ময়লা। এই মেয়েদের দিকে তাকালে যে-কোনও বাবার বুকের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার কথা। মনে হয় না এদের কখনও বিয়ে হবে। তার মধ্যে মিনুটা আবার ঘন হল জ্বরে ভোগা শুরু করেছে। হোমিওপাহি চলছে। ওষুধ এখনও পুরোপুরি কাজ শুরু করেনি। এর পানে আছে তিন প্রকারের ধারবাকি। বড় মেজ ও ছোট। খারাপ লাগার যাবতীয় আয়োজন পরিপাটিভাবে সাজানো।

এসবের মধ্যেও বিশ্বনাথের কেন যেন সকালবেলা ঘুম ভেঙে উঠে মাঝেমধ্যে ভাল লাগে। মনে হয়, বাঃ কী সুন্দর! সবকিছু কত চমৎকার : এই মনোভাবের জন্য তার অবশ্য এজার শেষ নেই। এর জন্য অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। চারপাশে অজস্র খারাপ লাগার কারণ, লু যদি বলি ও ‘সাও ভাল লাগে লজ্জা তো হবেই। নিশচয় লজ্জা হবে।

তবে আজ অন্যরকম ঘটনা। বিশ্বনাথের আজ ভাললাগার পেছনে জোরদার কারণ আছে। সে ঠিক করেছে, মেয়েদের আজ একটা বড় সারপ্রাইজ দেবে। বিন-মিন একেবারে হা হয়ে যাবে, তারা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইবে না। মেয়েদের মা ঘাবড়ে গিয়ে ভাববে, লোকটা বোকা ছিল, এবার কি পাগল হয়ে গেল?

বিনু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করায় তার চোখ ফোলা। একটা সবুজ মাকি পরেছে। হাতে দাঁত মাজার ব্রাশ। মুখ ধোওয়ার জন্য চোখের পাতায় জলের ফোঁটা লেগে। সকালের আলো সেই ফোঁটায় পড়ে চিকচিক করছে। রোগা কালো মেয়েকে দেখে ভয়ে বাবার মুখ শুকিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্বনাথের তা হচ্ছে না। বরং বিনুকে তার খুব সুন্দর লাগছে। দুর্বলতা গোপন করে বিশ্বনাথ গম্ভীর গলায় বলল, ‘বিনু, তুমি হাতে ব্রাশ নিয়ে ঘুরছ কেন?’

বিনু একটা মোড়া টেনে বাবার কাছে বসল। বলল, ‘কারণ আছে বাবা।’

‘কী কারণ?’

‘গোপন কারণ। তুমি যদি ব্যাপারটা ফাঁস না করে তা হলে বলতে পারি। তোমার কি শুনতে ইচ্ছে করছে?’

কারণটা শুনতে বিশ্বনাথের খুব ইচ্ছে করছে। ছেলে-মেয়েদের বাবা-মা’রা যত্ন করে কত কিছুই না শেখায়। গান, নাচ, ছবি আঁকা। আজকাল আবার কম্পিউটার শেখানোর খুব হিড়িক পড়েছে। পাড়ায় পাড়ায় ঝলমলে সব শিক্ষাকেন্দ্র দেখে বিশ্বনাথের খারাপ লাগে। সবাই কত কী শিখে গেল। শুধু তার মেয়েদুটোই বাদ পড়েছে। তবু বিনু-মিনু নিজেরা কোথা থেকে যেন মজার মজার কথা বলতে শিখেছে। শুধু মজা নয়, মনে হয়, মেয়েদুটোর কথায় কী যেন একটা আছে। সেই জিনিসটা দিয়ে তারা অনেকরকম দুঃখ কষ্ট মুছে নিতে পারে। বড় ভাল লাগে। মেয়েদের এই স্বভাব তাদের মা একেবারেই পছন্দ করে না। সে রেগে যায়। কাল রাতেই যেমন মিনু খেতে খেতে কী যেন একটা বলছিল। রেবা ঝাঝিয়ে ওঠে, ‘অনেক হয়েছে। কালো ভূতগুলোর শুধু পাকা পাকা কথা। শুনলে মনে হয় চড় লাগাই। এসব আদিখ্যেতা কোথা থেকে শিখেছ? নিশ্চয় বাবার কাছ থেকে?’ মিনু গম্ভীর গলায় বলল, ‘ভূত নয় মা, কালো পেতনি!’ রেবা এবার সত্যি সত্যি মেয়ের গালে চড় লাগাল। মিনুর গালে ভাল লেগে গেল। সে উঠে গিয়ে ডাল ধুয়ে এসে ফের খেতে বসল। স্বাভাবিক গলায় বলল, “তোমার চড়ে কোনও কাজ হল না মা। আমাদের ক্লাসের নন্দিতাকে ওর মা একবার খেতে বসে কান মুলে দিয়েছিল। নন্দিতা তো কাদতে কাদতে খাওয়াটাওয়া ফেলে উঠে পড়ল। ঘোষণা করল, তিনদিনের অনশন চালাবে। নন্দিতার বাবা রাতে গাড়ি বের করে পার্ক স্ট্রিট থেকে আইসক্রিম নিয়ে এল। চোখ-ভরতি জল নিয়ে বাবা হাত থেকে সেই আইসক্রিম মুখে নিয়ে নন্দিতা অনশন ভাঙল গভীর রাতে। ও এতসব করতে পেরেছিল কেন জানো? কারণ ও হল মানুষ। কিন্তু আমরা তো মানুষ নই। আমরা হলাম পেতনি। এসব আমরা করতে পারব না। সুতরাং চড় খেয়ে আবার ভাত খেতে বসে গেলাম। দাও আর একটু তরকারি দাও তো, উফ, কুমড়োতে এত ঝাল দাও কেন মা? তোমাকে বারণ করেছি না।’

বিনু আবার গলা নামিয়ে বলল, ‘কী বাবা, ব্রাশের রহস্যকথা শুনবে নাকি?’

‘তোমার ইচ্ছে হলে বলতে পারো।’

‘বাথরুমে গিয়ে দেখলাম পেস্ট ফুরিয়ে গেছে। মা এখনও খবরটা জানে বলে মনে হাচ্ছে না। আমি চাই না এই সকালে সামান্য একটা পেস্ট নিয়ে বাড়িতে ঝামেলা শুরু হোক। তাই মিছিমিছি ব্রাশ হাতে ঘুরছি। পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজার অভিনয় করছি। আরও কিছুক্ষণ ঘুরব। রান্নাঘরে যাব, মায়ের সঙ্গে কথা বলব। সেরকম হলে বাগানে খানিকটা হাঁটাহাঁটি করতে পারি।’

বিশ্বনাথের এত ভাল লাগছে যে তার মনে হচ্ছে, বড়মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। সেই অবস্থাতেই বলল, তোর পড়া কেমন হচ্ছে?’

‘ভাল। তবে যতটা হলে ভাল হত ততটা নয়।’

‘কেন, ভাল নয় কেন?’

বিনু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘মাধ্যমিকে একটা ফার্স্ট টার্স্ট হতে পারলে সংসারে খুব সুবিধে হত। আজকাল বড়লোক ফার্স্ট সেকেন্ডের কোনও দাম নেই, গরিব ঘর থেকে স্ট্যান্ড করলে দারুণ খাতির। ঘনঘন সংবর্ধনা, পুজোতে ফিতে কাটা, গানের জলসায় আবৃত্তি। ছ’মাস দম ফেলতে পারতাম না। বাড়িতে গিফট নিয়ে আসার জন্য তখন একটা মাসকাবারি ঠেলাগাড়ির ব্যবস্থা করতে হত। আমি অবশ্য সরাসরি বলে দিতাম, দেখুন জিনিসটিনিস আমাকে দেবেন না, কালার টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, কম্পিউটারে ঘর একেবারে ঠাসাঠাসি অবস্থা। রোজ রোজ জিনিস নিয়ে যাচ্ছি দেখে আমার মা খুব রাগ করছেন। বলছেন, এত জিনিস রাখব কোথায় ? আমাদের তো তিনতলা বাড়ি নয়, দুটো মাত্র ঘর। তার মধ্যে একটা আবার ডাইনিং কাম বেডরুম। আপনারা বরং একটা কাজ করুন, নগদ টাকা দিন। টাকা রাখতে বেশি জায়গা লাগবে না সেরকম হলে মা একটা ছোট সিন্দুক কিনে নেবে।’

বিশ্বনাথ হাসিমুখে বলল, ‘তোর মতো একটা বাচ্চা মেয়ের হাতে ওরা টাকা দেবে কেন?’

‘আমি মোটেও বাচ্চা নই, তবে টাকা নিতে আমার বয়ে গেছে। আমি বলব, টাকাপয়সা সব আমার বাবার হাতে দিতে হবে। উনি বিশ্বাস অ্যান্ড বিশ্বাস কোম্পানির লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে টুয়েন্টি ইয়ারস টানা কাজ করছেন। কোনওদিন চার আনার গোলমাল হয়নি। ভদ্রলোক হলেন সততা এবং পরিশ্রমের প্রতিমূর্তি।’

মিনু কখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে দু’জনের কেউ খেয়াল করেনি। বাবা আর দিদির হাসির মধ্যেই সে বলল, তবে ভদ্রলোক খুব শিগগিরই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ ইদানীং উনি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাকে বারান্দায় বসে বেলা পর্যন্ত চা খেতে হয় এবং বড়মেয়ের সঙ্গে হাসির গল্প করত হও। অফিস যাওয়ার সময় পান না।’

বিশ্বনাথ মিনুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুইও আয়। ছোটমেয়ের সঙ্গেও আমি হাসির গল্প করতে পারি। কী রে বিনু, পারি না?

মিনু এসে ঢকটকে চেয়ারটায় বসল। বলল, ‘আমার একটা গল্প আছে, কিন্তু সেটা হাসির গল্প নয়, দুঃখের গল্প।’

বিনু বোনের দিকে না তাকিয়ে বলল, ‘অঙ্কে নিশ্চয় আবার ডাব্বা খেয়েছিস। তোর দুঃখ মানে তো অঙ্ক পরীক্ষায় গোল্লা পাওয়া।’

মিনু বিনুর কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘বাবা, তুমি জানো না, কাল সন্ধেবেলা আমাদের ঘরের পাখাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করেছিলাম, ঘটনা এখন তোমাকে জানানো হবে না। মাসের শুরুতে জানানো হবে। কিন্তু গল্পের খাতিরে জানাতে বাধ্য হচ্ছি।’

বিশ্বনাথ অবাক হয়ে বলল, ‘সেকী! আমাকে তো বলিসনি? এই গরমে তোর শুচ্ছিস কীভাবে?’

মিনু বলল, ‘আঃ গল্পটা বলতে দেবে?’

মিনু পাখার কথাটা বলে দেওয়ায় বিনু খানিকটা বিরক্ত হয়েছে। সব দোকানেই এ বাড়ির বাকি পড়ে থাকে। কে জানে ইলেকট্রিকের দোকানেও হয়তো কিছু ধার হয়ে আছে। সে বলল, চট করে শেষ কর মিনু। আমার পড়া আছে। তোর দুঃখ শুনে এখন কাঁদার সময় নেই।’

দিদির কথায় পাত্তা না দিয়ে মিনু বলতে লাগল, ‘কাল ঘুমের মধ্যে হঠাৎ দেখি শীতশীত করছে। ভাবলাম আবার বোধহয় জ্বর এল। হঠাৎ শুনি শব্দ হচ্ছে— হিজ হিজ। আরে! ‘ঘরে এয়ারকন্ডিশন মেশিন চলছে নাকি? ঠিক তাই। চোখ খুলে দেখি, ঘরে এয়ারকন্ডিশন মেশিন চলছে। সেই মেশিন থেকেই শব্দ হচ্ছে। আমার খুব রাগ হতে লাগল। এসি মেশিনটা এত বাড়িয়ে দিয়েছে কে? নিশ্চয় দিদি। দিদির এই এক কাণ্ড! রাতে মেশিন বাড়িয়ে দেবে। আমি ঠকঠক করে কাপতে লাগলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি, দিদি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছ। তার গায়ে একটা কম্বল। কম্বলটার রং গোলাপি। সেটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখি কী নরম গো! মনে হচ্ছে, পশমের বদলে মাখন দিয়ে কম্বল তৈরি হয়েছে। আমি সেই মাখন কষল ধরে টান দিলাম, দিদি ছাড়ল না। শক্ত করে চেপে ধরল। আমি আরও টানলাম। দিদি আরও চেপে ধরল। কত বড় হিংসুটে একবার দ্যাখো বাবা, ছোটবোন ঠান্ডায় কাঁপছে একটু দয়ামায়া নেই। এমন সময় তুমি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলে। আমাকে বললে, অ্যাই মিনু, কী হচ্ছে কী? সামনে বিনুর মাধ্যমিক পরীক্ষা আর তুই ওর কম্বল নিয়ে নিচ্ছিস?’ আমার উত্তর দেওয়ার আগেই তুমি এসে আমার গালে একটা চড় লাগালে।-সকালে উঠে দেখছি কোথায় এসি মেশিন? গরমে যে ঘামছি! শুধু এই গালটায় কেমন যেন ব্যথাব্যথা। এটা খুব দুঃখের ঘটনা। স্বপ্নের চড়ে গাল ব্যথা হবে কেন বাবা?’

বিনু বলল, ‘কী ব্যাপার বল তো মিনু? কাল দেখলাম তুই মায়ের হাতে সাতকারের চড় খেলি, রাতে আবার বাবার হাতে স্বপ্নে চড় খাচ্ছিস, ব্যাপারটা কী? আমার মনে হয় তোর ওপর চড় দেবতা ভর করছে। তুই বরং পুজো দে। চড় ঠাকুরের মন্দির টন্দির কোথাও আছে নাকি বাবা?’

কিশোরী মেয়ের স্বপ্ন হবে আনন্দের, মজার। সারাদিন সে সেই স্বপ্নের ওপর আলবে। স্বপ্নের কথা মনে পড়লে মাঝেমধ্যে হাসবে। অথচ মিনু স্বপ্ন দেখল তার বাবা তাকে চড় মারছে! বিশ্বনাথের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যি; মেয়েগুলো শত কষ্টে বড় হচ্ছে। একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখার মতো ক্ষমতাও এদের নষ্ট হয়ে গেছে।

বিশ্বনাথ উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘শোনো মেয়েরা, আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঠিক করেছি, আজ আমি অফিস কামাই করব। কামাই করে তোমাদের নিয়ে বেরোব। বেরিয়ে টইটই করে ঘুরব। দুপুরে বিনুর ফেবারিট খাবার ইনিজ খাব। বিন, তুই কত দিন চাইনিজ খাস না? কোনও চিন্তা করিস না, চাইনিজ একসময় তার মায়েরও প্রিয় খাবার ছিল। আজ দেখব তুই না তোর মা— কে বেশি খেতে পারে। বিকেলের মেনু অন্যরকম। মিনুর হট ফেবারিট ফুচকা দিয়ে টিফিন হবে। আমার এই পরিকল্পনায় তোমাদের কোনও আপত্তি আছে? আপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই। কারণ, আজ তোমাদের কোনওরকম আপত্তিই শোনা হবে না। আমার সিদ্ধান্ত খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত।’

বিনু মিনু দু’জনেই বাবার কথা শুনে অবাক। মানুষটা একেবারেই অফিস কামাই করে না। জ্বরটর হলে পকেটে হোমিওপ্যাথির গুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তার আজ হল কী?

মিনু চিন্তিত গলায় বলল, ‘বাবা, তোমার শরীরটরির খারাপ লাগছে না তো? চার ফোঁটা রাসটক্স খাবে?’

বিনু বলল, ‘শরীর না খারাপ হলেও তোমার মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়েছে। তুমি কি ভুলে গেলে আমার পরীক্ষা। এখন বলছ বেড়াতে যাব। কই এতদিন তো বলোনি?’

বিশ্বনাথ বলল, “এতদিন বলিনি তো কী হয়েছে, আজ বলছি। আর পরীক্ষার আগে মাঝেমধ্যে ফ্রেশ এয়ার দরকার হয়। এয়ার ফুল অব অক্সিজেন। আমরা তোদের বয়েসে কত যে নদীর ধারে বেড়িয়েছি। আমাদের গ্রাম থেকে মিনিট কুড়ি হাঁটলেই নদী পেয়ে যেতাম। সোনাই নদী! পরীক্ষার আগে খানিকটা টাটকা বাতাস দারুণ উপকারী। ঠিক আছে বিনু, আজ তোর পরীক্ষা উপলক্ষে আমরা নদীতেই বেড়াব।’

মিনু ফিসফিস করে বলল, “দিদি, অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না। এখন বলছে নদী দেখবে, এরপর বাবা হয়তো পাহাড় দেখানোর জন্য ঝুলোঝুলি করবে। সন্ধের সময় বলবে, চল দার্জিলিং ঘুরে আসি।’

বিশ্বনাথ ছোটমেয়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। বলল, ‘কেন? কলকাতায় কি নদী নেই? গর্দভ কোথাকার। কলকাতায় কী চমৎকার গঙ্গা। ভাল করে দেখেছিস কখনও? আজ দেখবি। আজ আমরা একটা বোকো ভাড়া করে সারাদিন গঙ্গায় ঘুরব। খাওয়াদাওয়া সব নৌকোতে হবে। গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ। আইভিয়া কেমন লাগছে? মেয়েরা, যাও স্নানটান সেরে তৈরি হয়ে নাও।’

বিনুর ভীষণ অনিন্দ হচ্ছে। কেন লাগছে তা সে বুঝতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে, এত আনন্দ সামান্য বেড়াতে যাওয়ার জন্য পাওয়া যায় না। এই আনন্দর জন্য আরও অনেক বড় কিছুর দরকার হয়। সেই বড় কিছুটা কী ? তার বাবার মতো একটা মানুষ ? বিনু উঠে ঘরে চলে গেল। আলোর সামনে সে কখনও চোখের জল ফেলে না।

রেবা কড়াই থেকে মুখ না ঘুরিয়েই বুঝতে পারল, ছোটমেয়ে ঢুকেছে। মিনু যখন চলাফেরা করে তখন কোন শব্দ হয় না। মনে হয়, তার কোনও অদ্ভুত কায়দা আছে। সেই কায়দায় সে পায়ের শব্দ লুকিয়ে ফেলতে পারে। রেবার এটা পছন্দ নয়। এ আবার কেমন অলক্ষুন ধারা?

রেবা মুখ না ফিরিয়েই বলল, ‘কী রে, আবার পা টিপে টিপে চলছিস? তোকে না কতবার বলেছি, পা টিপে হাঁটবি না। তুই কি চোর নাকি?’

মিনু হেসে বলল, ‘চোরেরা পা টিপে চলে একথা তোমায় কে বলেছে মা? তা ছাড়া এখন কি আর তোমার আমল আছে ? এখনকার চোরেরা সবাই পাড়া দাপিয়ে ঘোরাফেরা করে। যে যত বড় চোর তার চলাফেরায় তত শব্দ। এই সোঁ করে গাড়ি চেপে আসবে, এই প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন দেবে। কোনও কোনও চোর আবার সাইরেন বাজিয়েও যায়।

‘আবার পাকা পাকা কথা? তোর দেখছি কোনও কিছুতেই শিক্ষা হবে না। বাবাকে চট করে বাজার থেকে একবার ঘুরে আসতে বল। বল তেল নেই। উফফ এভাবে সংসার চলে?’

মিনু এগিয়ে এসে মায়ের কাঁধে হাত রাখল। বলল, ‘মা, আজ তেল লাগবে না। তুমি রান্না বন্ধ করো।’

‘রান্না বন্ধ করো মানে? তোর বাবা কি আজ না খেয়ে অফিস যাবে? ক’টা বাজে খেয়াল আছে ?’

‘বাবা আজ অফিস যাবে না।’

হাতা নাড়ানো বন্ধ করে রেবা এবার মেয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘যাবে না কেন? শরীর খারাপ?’

মিনু তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘শরীর না মা, মনে হয়, বাবার মাথার দিকে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। বলছে, আজ সারাদিন আমাদের নিয়ে গঙ্গায় ঘুরে বেড়াবে। একটা নৌকো ভাড়া করা হবে। বাবা হাল ধরবে, তুমি পাল টানবে আর আমরা দু’বোন মিলে বইঠা বাইব। নৌকোর মাঝি বসে বসে তামাক খাবে আর গান করাবে— মন মাঝি তার বইঠা নে রে…। খাওয়াদাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট সব নৌকাতেই হচ্ছে। বড় অ্যারেঞ্জমেন্ট। চিলি চিকেন, মিক্সড ফ্রায়েড রাইস।’

রেবা কী একটা বলতে গেল। মিনু তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘প্লিজ মা, আজ তুমি না বোলো না। বাবার খুব উৎসাহ দেখলাম একটা দিন রাজি হয়ে যাও। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের নিয়ে বেড়াতে পারলে আমরা যত না আনন্দ পাব, তার থেকে বাবা নিজে অনেক বেশি আনন্দ পাবে। সুতরাং তোমার যতই কষ্ট হোক আজ চলো।

কাঁধ থেকে মেয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে রেবা গম্ভীর গলায় বলল, ‘আনন্দ ভাল। কিন্তু আনন্দের জন্য যে পয়সা লাগে সেটা কি তোমার বাবা জানে? নাকি না জেনেই এতসব প্ল্যান প্রোগ্রাম করেছে ?’

মিনু বলল, ‘উফ মা, বাবা একটা কিছু ভেবেই তো বলেছে। তা ছাড়া কী আর এমন খরচ হবে? গঙ্গাবক্ষে পিকনিকের পর বিকেলে গঙ্গার ধারে সবাই মিলে বসে একটা ফাংশনের মতো করতে পারি। গঙ্গাতীরে ফাংশন। এই ধরো, বাবা কিছু একটা বলল, যে-কোনও বিষয়। নদীর বিশুদ্ধ বায়ুর উপকারিতা নিয়েও বলতে পারে। তারপর বরো তুমি একটা পুরনো বাংলা সিনেমার গান করলে। বেশি নয়, দু-চার লাইন করবে। তোমার গলা এত খারাপ যে বেশিক্ষণ গান সহ্য করা যাবে না। নদী বিষয়ক গান হলে ভাল হয়। দিদিও কিছু করবে। সব থেকে ভাল হয়, দিদি ফাস্ট হওয়ার পর খবরের কাগজে কীভাবে ইন্টারভিউ দেবে তার একটা ছোট নমুনা যদি আমাদের দখাতে পারে। আর আমি? আমি প্রথমে কিছুই করব না, তখন তোমরা খুব চাপাচাপি করবে। বলবে, মিন, পাকামি কোরো না। সবাই করছে তোমাকেও করতে হবে। তখন আমি—। না থাক এখন বলব না। সারপ্রাইজ দেব। যাই বলো, খুব মজা হবে কিন্তু, দারুণ জমবে। চিন্তা কী মা, আমরা দু’বোন তো আছি। তোমার দুই পেতনি মেয়ে। যাও চট করে তৈরি হয়ে নাও।’

সকালবেলা রেবা কখনও হাসে না! গত পনেরো বছর ধরেই এক ঘটনা। চোখ খুলে সংসারের মারাত্মক অবস্থা দেখে হাসি তো দূরের কথা, প্রথমদিকে তার চোখে জল আসত। আজকাল জলও আসে না। সেই রেবার মেয়ের কথা শুনে আজ অনেক বছর পর সকালবেলা হাসি পেল। সে মেয়ের সামনে হাসি চাপার চেষ্টা করল। তারপর লজ্জা পেয়ে হড়বড় করে বলল, হারে মিনু, ডিমসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ দিয়ে কটা স্যান্ডউইচ করে নিয়ে গেলে কেমন হয়? দুটো ডিম আছে। টিফিনবাক্সটা কোথায় আছে দ্যাখ তো। সাতসকালে তোর বাবা কী যে ঝামেলা শুরু করল।’

মিনু তার দিদির মতো নয়। সে চোখের জল একদম লুকোতে পারে না। মাকে দেখে তার খুশিতে চোখে জল এল এবং সে চোখ মুছতে শুরু করল।

বাইরে পরার মতো বিনুর মাত্র দুটো সালোয়ার কামিজ আছে। একটা বেগুনি, একটা সাদার ওপর সবুজ পাতা আঁকা। খাটের ওপর সালোয়ার কামিজ দুটোকে রেখে সে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কোনটা পরবে ঠিক করতে পারছে না। তাকে দেখলে মনে হচ্ছে, দুটো নয়, একশো পোশাক নিয়ে সে অথই জলে পড়েছে। মিনুর পোশাকের সমস্যা নেই। তার সমস্যা জুতো নিয়ে। জুতোর স্ট্র্যাপ ছেঁড়া। ছেঁড়া জুতো পরে দোকান বাজারে যাওয়া যায়, স্কুলে যাওয়া যায়, কিন্তু বেড়াতে যাওয়া যায় না। সে কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, ‘দিদি, কী হবে?’

বিনু বিরক্তমুখে বলল, ‘কী আর হবে। ছেঁড়া জুতো পরেই চল। গঙ্গার ওপর তুই তো আর হাটাহাটি করবি না। আর যদি একান্তই করতে চান, তা হলে খালি পায়ে হটলেও চলবে। কাটা ফোটার কোনও চান্স নেই। জুতো নিয়ে ঘ্যানঘ্যান না করে কোন সালোয়ারটা পরব সেটা বল তো।’

মিনু রেগে গিয়ে বলল, ‘না বলব না। যেটা খুশি পর। যেটাই পরবি সেটাতেই তোকে জঘন্য লাগবে।’

বিনু হেসে বলল, ‘রেগে গেলি নাকি মিনু ? বেরিয়ে জুতোটা সারিয়ে নিলেই তো হবে, তুই এত চিন্তা করছিস কেন?’

দিদির কথায় মিনুর রাগ কমল না। সে বলল, ‘বাবা বোধহয় সিনেমা যাওয়ার প্ল্যান কষছে।’

বিনু বলল, ‘ওরে বাবা, সন্ধেবেলায় আমায় পড়তে হবে। আমি সিনেমা টিনেমায় যাব না।’

‘এসব বলতে যাস না দিদি। মাকে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছি। মা’র খুব সিনেমা দেখার ইচ্ছে। শুধু বাবার তালে নাচলে তো হবে না, মায়ের দিকটাও দ্যাখো।’

‘তোরা যাস। আমি ফিরে আসব।’

মিনু এসে দিদির হাত ধরল, ‘আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়, আমরা দু’জনে বাড়ি ফিরে এলাম, মা-বাবা সিনেমায় চলে গেল। হয় না?’

বিনু চোখ কুঁচকে বোনের দিকে তাকাল। বলল, ‘ডেঁপোমি হচ্ছে? মা ঠিকই বলে, তুই অল্প বয়েসে বেশি পাকা পাকা কথা শিখেছিস।’

‘প্লিজ দিদি, এটাই ভাল। একটা ছুতো করে আমরা চলে আসব। মা বাবা কতদিন সে একসঙ্গে সিনেমায় যায় না। বাড়িতে তো টিভিও নেই যে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখবে। আজ বাবা যখন খেপেছে, তখন আজই সুযোগ। তুই রাজি?’

বিনু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, রাজি। হ্যাঁরে, মা কি সত্যি স্যান্ডুইচ বানাচ্ছে নাকি?’

‘বানাচ্ছে, তবে আলু শর্ট আছে। তিনটে আলু নিয়েই মায়ের উৎসাহ দেখার মতো। বাবার নামে গজগজ করছে, আর আলু মাখছে। আমার কিন্তু দারুণ লাগছে। খুব মজা হচ্ছে।’

‘ভাল তো লাগবেই, কতদিন আমরা চারজনে একসঙ্গে বেড়াতে যাই না বল তো।’

‘লাস্ট কবে গিয়েছিলাম মনে পড়ছে তোর?’

বিনু চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, ‘কেন মনে পড়বে না? খুব মনে পড়ছে। তুই তখন খুব ছোট, নাইনটিন ফিফটি টু কি ফিফটি থ্রি হবে। তুই ট্যাক্সিতে উঠেই কাঁথা ভিজিয়ে ফেললি। দে ক্লিপটা দে।’

মিনু ছুটে এসে বিনুর কাঁধ চেপে ধরে বলল, ‘ভাল হবে না কিন্তু।’

বিনু বলল, ‘আঃ ছাড় মিনু। জামা নষ্ট হয়ে যাবে।’

দুই বোনের তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না। বিনু পাতা আঁকা সালোয়ারটাই বেছেছে। মিনু পরেছে তার সবথেকে পছন্দের লং স্কার্ট। দুজনেই টিপ পরেছে। পোশাকের রঙে মিল না থাকলেও দু’বোনের টিপের রং একইরকম, লাল। কালো মেয়েদের লাল টিপে মানায় না। এদের দু’জনকেও মানাচ্ছে না।

সাজগোজে ফিনিশিং টাচ দিতে দিতে বিন বলল, ‘ওদের এত দেরি হচ্ছে কেন? মায়ের কাছে একবার যা তো মিনু, মা নিশ্চয়ই এখনও শাড়ি বেছে উঠতে পারেনি। তুই একটু বলে দিয়ে আয়।’

মিনু গালে পাউডারের পাফ বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আমি পারব না। তুমি যাও। না বেরিয়ে বেরিয়ে মায়ের এই অবস্থা হয়েছে। রান্নার জন্য তো আর শাড়ি বাছতে হয় না।’

বিনু ঘর থেকে বেরোনোর আগে বিরক্ত গলায় বলল, ‘একটা কাজ যদি তোকে দিয়ে হয়। পাফটা আর কত গালে ঘষবি? পাউডার তো নেই।’

পাশের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল বিনু। দরজায় সামান্য ফাঁক। ভেতর থেকে মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে। মা বাবাকে কিছু বলছে। রাগরাগ গলা। বিনু দরজার ফাক দিয়ে তাকাল। মা বসে আছে চেয়ারে। বাবা খাটের একপাশে। দুজনের কেউই এখনও তৈরি হয়নি। বাবার মুখের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। সেই মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মানুষটা খুব ভেঙে পড়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার, আলমারি থেকে জিনিসপত্র সব নামিয়ে যাটের ওপর রাখা কেন? কী হয়েছে? মনে হচ্ছে, তন্ন তন্ন করে আলমারিতে কিছু খোজা হয়েছে। খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকী মায়ের ভাজ করা শাড়ি, বাবার ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবিও এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। বিনু দেখতে পেল, মেঝেতে একটা লক্ষ্মীর ভাড় ভেঙে পড়ে আছে। অল্প কয়েকটা খুচরো পয়সা পড়ে। মা কিছু বলল। বাবা ক্লান্ত গলায় বলল, ‘প্লিজ, আস্তে বলো রেবা, মেয়েরা শুনতে পাবে।

মা হিসহিস করে বলে উঠল, ‘শুনতে পাক। ওদের নাচানোর সময় তোমার মনে ছিল না? একসময় আমাকে নাচিয়েছ, এখন মেয়েদের নাচাচ্ছ। নিজের দৌড় জানো না? এখন লজ্জা পেলে কী হবে।’ বাবা কাতর গলায় বলল, ‘প্লিজ রেবা, প্লিজ।’

বিনু নিজের ঘরে ফিরে এসে বলল, ‘মিনু, শোন।’

মিনু বলল, ‘কী হয়েছে রে দিদি? নিশ্চয় বাবা-মা’র ঝগড়া লেগেছে?’

বিনু হেসে বলল, ‘কিছু হয়নি, তবে এবার হবে। তোর মাথা ব্যথা হবে, তারপর তোর জ্বর আসবে। তুই এখন জামাকাপড় বদলে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়বি। সেরকম হলে দুপুরে কিছু খাবি না। বাবা হোমিওপ্যাথির গুলি দিলে টক করে গিলে ফেলবি। কী রে পারবি? পারবি না?’

এক মুহূর্ত থমকে গেল মিনু। ঘটনা বুঝতে তার সামান্য সময় লাগল। তারপর শুকনো হেসে বলল, ‘খুব পারব। শুধু জ্বর কেন, দরকার হলে শরীর খুব খারাপ লাগছে বলে গলা ছেড়ে কাঁদতেও পারি। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, সত্যি সত্যি চোখের জল চলে আসবে। সেটাকে কাজে লাগাব দিদি?’

বিনু এগিয়ে এসে বোনের কাঁধে হাত রাখল।

বারান্দাটা যেমন বিশ্বনাথের, তেমনি এবাড়ির ন্যাড়া ছাদটা বিনু আর মিনুর। কোনও কোনও গভীর দুঃখ বা আনন্দের রাতে অভাগা এই দুই কিশোরী ছাদে এসে বসে৷ আজও বসেছে। এখন অনেক রাত। চারিদিক নিঃশব্দ আর অন্ধকার। আলো শুধু আকাশে। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি তারার আলো। ন্যাড়া ছাদের ওপর তাদের নরম আবছা আলো এসে পড়ছে। ছাদ উপচে সেই মায়াবী আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে যাচ্ছে নীচে। কালো পেতনির মতো দেখতে মেয়েদুটোকে আজ কেন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দু’জন পরি এই আলোর জলপ্রপাতের ওপর বসে আছে। বসে আছে চুপ করে। বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও এদের থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *