রুবি তোমাকে চিনি

রুবি তোমাকে চিনি

সানজিদা যখন ফোন করে রুবির কথা বলল, আমি তখন তাকে চিনতে পারছিলাম না। রুবি আফরোজ, আমাদের সাথেই নাকি স্কুলে পড়ত। একই ক্লাস, একই শাখা। কই মনে তো পড়ছে না! উল্টো যারপরনাই বিরক্ত হয়ে যাই রুবির বাসায় যেতে হবে শুনে। গত কয়েক বছরে সানজিদা বেশ সমাজসেবী হয়ে উঠেছে। ফেসবুকে প্রতিবাদী সব স্ট্যাটাস, রক্তদান, মানববন্ধন হ্যাঁন-ত্যান কিছু না কিছু চলছেই। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার স্বামী সাগরে সাগরে ঘুরে বেড়ায় আর এক কালের ননির পুতুল সানজিদা হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি। কার ঘর ভাঙল, কে নির্যাতিত হলো, কাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো এসব নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? এগুলো কি আজ থেকে হচ্ছে? সেই ছেলেবেলা থেকেই রোজ খবরের কাগজে পড়ে এসেছি। এতদিন ছিল কোথায় এই চেতনা? কোথাকার কোন রুবি আফরোজ অসুস্থ বলে এবং সে আমারই এলাকার কাছাকাছি থাকে বলে কেন আমাকেও সাথে যেতে হবে? স্কুলের নীল-সাদা পোশাকে সবাইকে তো দেখতে একই রকম লাগত কেউ কি আদৌ তখন ছিল এই নামে? আমার নিজস্ব সহপাঠী মহল বাদে মনে পড়ে, ঢঙ্গি কেয়া, রাস্কেল রাবিতা, ঘুষখোরের মেয়ে মুনিয়া, শত প্রেম করা নিলু আর ক্লাসে প্রথম হওয়া আবিদার কথা। ওহ না সাথে লেসবিয়ান মাহমুদাও ছিল। আর কাউকে তো মনে পড়ছে না।

টিং টিং করে শব্দ হয়। মোবাইলে মেসেজ আসে,

জিগাতলা, ৬৮নং বাড়ি, পুরোনো মদিনা হোটেলের পাশের সাদা বিল্ডিং। পাঁচতলা।

আমি বিরক্ত হয়ে উত্তর দিই, ওকে! সানজিদাকে আমি না বলতে পারি না। শহরের নামকরা স্কুলে আমার মেয়ের ভর্তি সম্ভব হয়েছে সানজিদার স্বামীর সুপারিশে। এছাড়াও ওর এক মামা প্রতিমন্ত্রী। সরকারি কোনো কাজে সাহায্য লাগলেই আমরা তাঁর পরিচয়ের বদৌলতে কার্যসিদ্ধি করি। এমন উপকারী সহপাঠীর উপকার ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চিত করতে মাঝে মাঝে কিছু যন্ত্রণা তো পোহাতে হবেই। তাই আমাকেও যেতে হবে কোনো এক রুবি আফরোজের বাড়িতে। হয়তো কিছুটা আর্থিক সাহায্যও করতে হবে। আমি মনে মনে এই সপ্তাহের ছক গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করতে থাকি। অফিসে তিনটা মিটিং, একটা পিচ, দেবরের মেয়ের জন্মদিন, কলিগের হাউজ ওয়ার্মিং পার্টি, উইকলি রিপোর্ট বাদেও মেয়ের স্কুলে একদিন যাওয়া দরকার। এছাড়া পার্লারে যাওয়া ও কিছু কেনাকাটা বাকি আছে। নাহ, আর ভালো লাগছে না। মনে মনে ক্লান্ত হয়ে উঠি। এ সপ্তাহটা খুব হেকটিক যাবে দেখছি।

অফিসে ঢুকেই ব্ল্যাক কফি আনার জন্য ধমকে দিই পিওন বেলালকে, ইন্টার্ন মেয়েটিকে পাঠাই গুলশানের সেরা টেইলরের কাছে বানাতে দেওয়া আমার নতুন সব্যসাচী কাট ব্লাউজ আনতে। সুগন্ধি সাবান নিয়ে কিছু আইডিয়া পিচ করার কথা ছিল। পাশের কেবিনের জিহানের কাছ থেকে সেই কাজের আপডেট নিতে গিয়ে জানতে পারি অফিসে সদ্য যোগ দেওয়া দুজন চ্যাংড়া ছেলেকে প্রেজেন্টেশন বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ভেতরে ভেতরে তেতে উঠি একদম। কেন আতিক ভাই বা রোমেনা আপার মতো কাউকে এদের সাথে জুড়ে দেওয়া হলো না? এই দুই আনাড়ি ছেলে কী করবে কে জানে! পরে দেখা যাবে এই ছেলেরা প্রোডাক্ট কমিউনিকেশন বোঝেনি, যাচ্ছেতাই প্রেজেন্টেশন বানিয়েছে আর আমাকে পিচের আগের দিন রাতভর বসে বসে স্লাইড ঠিক করতে হচ্ছে। অসহ্য।

বেলাল এসে কফি দিয়ে যায়। বেলালকে বলি ছেলেদুটাকে ডেকে আনতে। এক ফাঁকে জেনে নিই ওদের নাম। একজনের নাম মনে ছিল শাওন, অন্যজনের নাম জানলাম, রিফাত। ল্যাপটপ নিয়ে এসে শাওন আর রিফাত আমার সামনে ঝপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। বিরক্ত লাগে আমার। এক ভ্রু উঁচু করে বলি,

সব কাজ শেষ?

আরও কিছু কাজ বাকি আছে। আর কিছু জায়গায় ফিডব্যাক লাগবে ম্যাম।

আচ্ছা বলতে থাকো।

দুজনের মাঝে শাওন গলা খাকরে বলতে শুরু করে, আমাদের এই প্রেজেন্টেশন হবে মূলত সৌরভ বা পারফিউম নিয়ে। সেখান থেকে আমরা লিংক করব ফুলের, ফুল থেকে সাবানে! সাবান থেকে ক্রেতার কাছে। সে জন্য শুরুতেই আমরা বলব পারফিউম বা সুগন্ধির ইতিহাস ও টম টাইকারের বিখ্যাত সিনেমা পারফিউম নিয়ে। ইতিহাসে পরে আসি, আগে বলি কী এই সিনেমা। দেখুন, পৃথিবীর সব মানুষ দেখতে শারীরিকভাবে অনেকটা একরকম বা একই বৈশিষ্ট্যের হলেও চারিত্রিকভাবে কিন্তু একই রকম নয়। সবারই নাক, কান, চোখ, গলা, হাত-পা থাকার পরেও কেউ শিল্পী তো কেউ খুনি, কেউ নেতা কেউ বা ফকির। পারফিউম হলো সেইসব বৈশিষ্ট্যের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অন্যরকম তাৎপর্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গত বা ঘ্রাণের গল্প। আমরা যখন ফুলের ঘ্রাণ নিই আমাদের কেমন লাগে? ভালো, তাই না? নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিলে মন ভালো হয়ে যায়। আবার খাবারের ঘ্রাণে পেটে ক্ষিধে চাগিয়ে ওঠে। এই সব ঘ্রাণ নিয়ে আবর্তিত হয় আমাদের জীবন।

শাওন কণ্ঠে তীব্র সিরিয়াসনেস নিয়ে বলতে থাকে। আমি হাতের উলটা পিঠ দিয়ে মুখ ঢেকে হাই তোলা গোপন করি। শাওন বলে যায়, বলে যায়। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আমি বলি,

পারফিউম সেই সিনেমা না? গ্রানুইলি নামের এক ছেলেকে তার মা ফেলে চলে যায়। সেই ছেলে বড় হয়ে একের পর এক খুন করতে থাকে ঘ্রাণের প্রতি এফেকশন নিয়ে?

হঠাৎ শাওন থেমে যায়।

ম্যাম, আপনি দেখেছেন সিনেমাটা?

হ্যাঁ দেখেছি। তোমার মনে হচ্ছে না সুগন্ধি সাবানের শুরুই করছ তুমি একটা নেগেটিভ কাহিনি দিয়ে? আর তোমার টিজি মানে টারগেট গ্রুপ কারা? কারা সুগন্ধি সাবান ব্যবহার করে? পারফিউম সিনেমার মাছের বাজারে কাজ করতে থাকা গ্রানুইলি তোমার গ্রুপ নাকি এ সময়ের স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যাওয়া তুলতুলে মেয়েরা তোমার গ্রুপ? ফুল, লতা, পাতা, নায়িকাদের ত্বক, ঘ্রাণ পেয়ে পাগল হয়ে যাবে ছেলেরা, এমন ধরনের স্টেরিওটাইপ কিছু করলে বিরক্ত হতাম কিন্তু অন্তত বুঝতাম ঠিক দিকেই যাচ্ছ। অথচ শুরু করেছ এমন কিছু দিয়ে যা মাথামোটা ক্লায়েন্টদের মাথার চেয়ে অনেক উপরে উড়ে যাবে। এটা কি ফান? টাইম পাস? এই সপ্তাহের শেষেই পিচ আর তোমরা কিনা…

রিফাত আর শাওনের চেহারা পাংশুটে হয়ে যায়। আমি দেখতে পাই শাওনের গালের মাংস নার্ভাসনেসে তিরতির করে কাঁপছে।

প্লিজ গো অ্যান্ড ডু সামথিং। রোমেনা আপা লাঞ্চে যাওয়ার আগে তার থেকে আইডিয়া নাও। আরেকবার ব্রিফ নিয়ে এরপর আজকের মধ্যে আমাকে প্রথম ড্রাফট দেখাও।

আপনি কি এই সিনেমার অংশ বাদে বাকি স্লাইডগুলোতে চোখ বুলাবেন ম্যাম। বেশ কিছু ইউনিক আইডিয়া ছিল। হয়তো অন্যগুলো আপনার এত খারাপ লাগবে না।

নট ইন্টারেস্টেড। আমি দাঁত বের করে মেকি হাসি দিয়ে শীতলভাবে প্রত্যাখ্যান করি ওদের। ছেলে দুটা মাথা নিচু করে চলে যায়। ওদের প্রস্থান দেখে মনে মনে কিছুটা আরাম পাই। রোমেনা আপার ওপর আরেকটু প্রেশার দেওয়া গেল। আজকাল আমাকে একটু কম পাত্তা দিচ্ছেন উনি। মনোয়ার ভাইয়ের সাথে বেশি মাখামাখি করছিল। উনাকে এভাবে কিছুটা চাপে ফেলতে পারলে ভালোই লাগবে।

ডেস্কে জমা থাকা দুটা ফাইল ফলোআপ করে, কিছু জরুরি ফোনকল শেষ করে আমি দুপুরে খাই টুনা সালাদ, অলিভ অয়েল দেওয়া একটা পাতলা রুটি আর এক কাপ গ্রিন টি। এক ফাঁকে আহমেদ ভাইয়ের কেবিনে গিয়ে কিছুটা গালগল্প করে তাকে আলগা পাত্তা দিয়ে আসি। বাড়িতে ফোন করে কাজের লোকের কাছে ফারিজার স্কুল থেকে আসার খবর নেই, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে নানা কিছু সিদ্ধান্ত দিই। বুধবার বিকেলে পার্লারে যাওয়ার বুকিং দিয়ে দিই। অনলাইনে কিছু কেনাকাটা করে ফেলি দেবরের মেয়ের জন্য। এসব করতে করতে বিকেল হয়ে যায়। পাঁচটার দিকে একটা ঘরোয়া মিটিং করে, আধ ঘণ্টা রিপোের্ট লিখে আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। প্রেসড পাউডারের বক্স খুলে আয়নায় তাকিয়ে দেখি আমার মুখে দুইটা ব্রণ হয়েছে। কানের পাশ দিয়ে হালকা দেখা যাচ্ছে সাদা চুল। তৃকে ব্রেকডাউন হচ্ছে। রাত জাগার ফল। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। নাহ, শামিমের সাথে রাত জেগে নেটফ্লিক্সের সিনেমা দেখার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। আজকে রাতে ফেসপ্যাক দিয়ে আগে আগে ঘুমিয়ে যাব। শামিম তিন দিনের জন্য ব্যাংকক গিয়েছে, নিজের মতো করে গুছিয়ে থাকার এই তো সুযোগ!

আমি ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে নিই। ড্রাইভারকে ফোন করে জানিয়ে দিই রেডি থাকতে। এমন সময় রিফাত এসে নক করে, ম্যাম, একটু কথা ছিল।

ইয়েস!

আমাদের প্রেজেন্টেশনের ড্রাফট অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। রোমেনা ম্যাম দেখেছেন। আপনাকে এখন দেখাব?

না, আমি তো এখন বের হচ্ছি। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আমার। তুমি প্রেজেনটেশন মেইল করো। আমি দেখে নেব। আর কিছু মনে হলে তোমাকে ফোন করব। ফোনে ফোনে আমাকে স্লাইড ব্যাখ্যা করবে। ওকে?

ওকে ম্যাম। এক বাক্যে রাজি হয়ে যায় ছেলেটা। যদিও মিনিট পাঁচেক পর দেখা যায় রিফাতের মেইলে রোমেনা আপাও সিসিতে যুক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ আমি কী ফিডব্যাক দিই, কেমন ঘুরাই সেগুলো দেখার জন্য এই অবেলায় উনি সাথে সাথে থাকবেন অফিসিয়াল মেইলে। বিরক্তিকর। এতই যদি চিন্তা থাকে আগে কেন গাইড করেননি ছেলেগুলোকে?

গুলশান থেকে ধানমন্ডি ফিরতে ফিরতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক লেগে যায়। অফিস ফেরত জ্যাম, ভ্যাপসা গরম উত্তপ্ত করে রেখেছে শহরটাকে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে বসেও বাইরের উত্তাপ টের পাওয়া যায়। আমি ফেসবুক চেক করতে করতে দেখি, আহমেদ ভাইয়ের স্ত্রী শহরের সেরা কফিশপে গিয়ে চেক ইন দিয়েছে। আগের অফিসের শোয়েব স্যার কী যেন একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। পুরা টিমের সাথে ওয়াইড সেলফি দিয়েছেন। আমার প্রতিবেশীর ছেলে চলে যাচ্ছে আমেরিকা পড়তে। দুই-তিনটা অনলাইন বুটিক আর কসমেটিক শপ থেকে লাইভ হচ্ছে। দেখব না, দেখব না করেও আমি দেখে ফেলি। মুখে কয়েক প্রস্থ ফাউন্ডেশন মেখে প্রায় ব্রাইডাল সাজে লাইভ করছে মেয়েগুলো। লাইভে রি-অ্যাকশন এসে যাচ্ছে একের পর এক। লাইক, লাভ, হাহা। নামকরা বিদেশি ব্র্যান্ডের একটা নুড লিপস্টিক অর্ডার করে ফেলি। সামনের কোনো দাওয়াতে পরা যাবে। গাড়ি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে মোড় নিয়ে মিরপুর রোডে উঠে যায়। আহ! আর মাত্র অল্প কিছুক্ষণ। বাসায় গিয়েই সবার আগে শাওয়ার নিতে হবে। এরপর এক কাপ কফি খেতে খেতে ফারিজার স্যারের আসার ব্যাপারে খবর নিতে হবে, এক নজর চোখ বুলাতে হবে ওর বাড়ির কাজে। শামিমকে একটা ফোন করতে হবে। রিফাতের পাঠানো প্রেজেন্টেশন দেখে এমন কিছু ভুল ধরতে হবে যা দেখে রোমেনা আপাও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবেন। এছাড়াও সৌরভ বা সুগন্ধি সাবান নিয়ে বাইরের দেশের কিছু পুরস্কার ও প্রশংসাপ্রাপ্ত আইডিয়া দেখে কাছাকাছি কিছুর সাথে নিজের ভাবনা মিলিয়ে এমন কিছু যুক্ত করতে হবে যা এই মাথামোটা ক্লায়েন্টদের কাছে গ্রাউন্ড ব্রেকিং আইডিয়া মনে হবে।

মিরপুর রোডে কিসের যেন জটলা লেগে আছে! ঘন ঘন হর্ন দিচ্ছে সব গাড়ি। খালি গায়ে কদমফুল হাতে ছুটে বেড়াচ্ছে একটা ছেলে। ছোট্ট শিশু কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছে এক মহিলা। বাচ্চাটার নাক থেকে সর্দি ঝরছে অনবরত। আমি চোখ ঘুরিয়ে নিই। শহরটা নোংরা হয়েই যাচ্ছে। অতিরিক্ত মানুষ, যানবাহন, খাবার ও দোকান সবকিছু মিলিয়ে। অথচ দেশের বাইরের পথঘাট কী সুন্দর আর ঝকঝকে। আমার যেসব বান্ধবী দেশের বাইরে থিতু হয়েছে তাদের দেখে দেখে ঈর্ষা জাগে। হাল ফ্যাশনের গাড়ি, মোবাইল, রোড ট্রিপে বাচ্চাকাচ্চা ও স্বামী নিয়ে পাহাড় অথবা সমুদ্রের কাছে ঘুরতে যাওয়া। কী দারুণ জীবন। আর এখানে আমি! অফিসের পলিটিক্স, সংসারের দায়িত্ব আর সানজিদার অনুরোধের চেঁকি গিলে যাচ্ছি কেবল। এইসব মনে করতে করতে আবার মোবাইলের দিকে চোখ পড়ে, একটা সিনেমার ছোট্ট অংশ দেখাচ্ছে একটা পেজের ভিডিওতে। স্বামী স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অথচ স্ত্রী পুলিশের কাছে উল্টা স্বামীকেই ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। জমজমাট অবস্থা। জ্যামের মাঝ দিয়েই গাড়ি ধীরগতিতে একটু সামনে এগিয়ে যায়। আর চারপাশের সবকিছু ভুলে আমি মোবাইল স্ক্রিনের ভেতর ঢুকে পড়তে থাকি।

বাড়ি ফিরে যাওয়ার নিতে যাওয়ার আগে আগেই সানজিদার ফোন চলে আসে। আহহা! ভুলেই গিয়েছিলাম পনের নম্বরে যেতে হবে এখন ওর সাথে। ফেসওয়াশ আর উষ্ণ পানির ঝাঁপটা দিয়ে চটপট মুখ-হাত ধুয়ে কিছুটা ফ্রেশ হই। একটা জলছাপের কাজ করা ইন্ডিয়ান লনের কামিজ পরে নিই। চুলগুলো আঁচড়ে মুখে হালকা ও ন্যাচারাল মেকআপের ছোঁয়া কি বেশ গাঢ় দেখাচ্ছে? একটা লিপস্টিক দিই। বাড়ির নিচে গাড়ি পার্ক করে সানজিদা বার বার কল দিতে থাকে। বের হতে গিয়েও কী মনে করে থমকে ড্রয়ার থেকে হিরার আংটি আর দুটো পাতলা বালা পরি। মহিলাদের দেখলে আজকাল সবাই পোশাকের পাশাপাশি আংটি, চুড়ি আর নাকফুল দেখে বিচার করে নেয় যে তার আর্থিক অবস্থান কেমন। তাই কিছুতেই এই বিষয়ে হেরফের করা যাবে না। সবশেষে ব্র্যান্ডের ভ্যানিটি ব্যাগ আর মোবাইলটা নিয়ে লিফটের দিকে প্রায় ছুটতে থাকি আমি।

গলির মোড়ে কিছুদূর গিয়ে আর গাড়ি গেল না। রাস্তা খুব সরু। সানজিদা ড্রাইভারকে বলল, মেইন রোডে গাড়ি রেখে দিতে। আমি আর সানজিদা আশপাশের বাড়ির নম্বর দেখতে দেখতে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলাম। ৬১নং বাড়ি পাওয়া গিয়েছে। আরও বেশ কিছু বাড়ি আছে দুপাশে। আমি নম্বর মেলাতে মেলাতে সানজিদার দিকে তাকাই। কোনো একটা দামি পারফিউম মেখেছে ও। ঘ্রাণটা যেন বাতাসে ম ম করছে। কেমন যেন ফুল অথবা ক্রিমের ঘ্রাণ। বলে বোঝানো যাবে না। আহ, পারফিউম, সুগন্ধি। দারুণ কিছু ভাবতেই হবে এই পিচ নিয়ে। অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে থাকি আমি কেবল।

এই যে এদিকে মনে হয় হবে। আমি ৬৬নং বাড়ি পেয়েছি। চেঁচিয়ে ওঠে সানজিদা হঠাৎ।

আমি বিরক্ত হয়ে বলি,বাড়ির কাউকে কল করে কেন ডিরেকশন নিচ্ছিস না?

নিতে গিয়েছিলাম। শুধুই অসুস্থ শাশুড়ি, রুবি আর কাজের মেয়ে আছে। রুবির স্বামী ফোন ধরেনি। কোথায় যেন গিয়েছে কিছু টাকাপয়সার ব্যবস্থা করতে। আর ছেলেটা তো বখাটে। বাড়িতেই আসে না নিয়মিত। তুই বল কাকে জিজ্ঞেস করব?

আমি সাবধান হয়ে যাই। আমি পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এসেছি তবে চেষ্টা করব হাজার দুয়েক টাকাই দিতে। তবে যদি দেখি সানজিদা আমার চেয়েও অনেক বেশি দিচ্ছে তখন আবার ইগোতে লেগে যাবে, তখন না হয় পাঁচই দেব। আগে দেখা যাক ও কত দেয়।

সাদা দেয়ালের শ্যাওলাধরা পাঁচতলা বাড়িটা আর অল্পখানেক বাদেই খুঁজে পাওয়া যায়। আমি আর সানজিদা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি। লিফট নেই। বাড়ির ঠিক নিচে ময়লার স্তূপ থেকে কাঁচা মাছের গন্ধ ছড়াচ্ছে। ভো ভোঁ করে শব্দ করছে দুই-তিনটা মাছি। নিচের কলাপসিবল গেটের পাশে ভাঙা চেয়ার। ছেঁড়া পাপোশ আর রাজ্যের ধুলা পড়ে আছে। বোঝাই যায় বাড়ির দেখভাল করাই হয় না। কে জানে কত ভাড়া দেয়? এসবের জন্য হয়তো ভাড়াটা কমই দিতে হয়। তিনতলা পর্যন্ত এসেই হাঁপিয়ে যাই কিছুটা। যতই ইয়োগা করি না কেন, শরীরটার বয়স যে হচ্ছে তা এসব কাজ করতে গেলে ঠিকই বোঝা যায়। সানজিদাকে দেখি আমার চেয়ে বেশি গতিতে সিঁড়ি ভাঙছে। দেখে কেমন যেন রাগ লাগে আমার। পাঁচতলা পৌঁছেই হাঁফ ছাড়ি। দুই পাশে দুটা ফ্ল্যাট। অনেকটা এল শেপ হয়ে আছে। একটা ফ্ল্যাটের দরজা হাট খোলা। বাইরে নানারকম স্যান্ডেল, জুতা। বাড়ির ভেতর থেকে তেল ও মসলার স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ আসছে। জোরে জোরে হিন্দি গান বাজছে, সিটি বাজায়ে…।

আমরা পাশের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কলিংবেল টিপি। কোনো শব্দ হয় না। আরও কয়েকবার টেপার পরেও শব্দ না হলে সানজিদা হাত মুঠ করে কাঠের দরজায় ঠক ঠক শব্দ করতে থাকে। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই একটা তের-চৌদ্দ বছরের মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। সানজিদা পায়ের স্যান্ডেল খুলতে খুলতে নিচু স্বরে বলে, তোমার আপা কোন ঘরে?

এদিকে আসেন বলে মেয়েটা আমাদেরকে অনুসরণ করতে বলে। আমি ঘরের ভেতর যেতে যেতে দেখি জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল। ভ্যাম্প খেয়ে কেমন ভিজে আছে। দেয়ালঘড়ি আছে ঠিকই কিন্তু চলছে না। প্যাসেজ পেরিয়েই ডাইনিংটেবিল। সেখানে এঁটো বাসনকোসন পড়ে আছে অবহেলায়। চেয়ারগুলোর হাতল নড়বড়ে, দেখলে মনে হচ্ছে একটা জোর বাতাস আসলেই পড়ে যাবে। পাশের ঘরটা হয়তো বসার ঘর অথচ আসবাবপত্র প্রায় নেই বললেই চলে। এই অবস্থা কেন? সব আসবাবপত্র কি বিক্রি করে দিয়েছে? নাকি এতই গরিব যে অ্যাফোর্ড করতে পারেনি। আমি মনে মনে উত্তর মেলাতে চেষ্টা করতে থাকি। পেছনের একটা ঘর থেকে একটু জড়ানো কণ্ঠ ভেসে আসে। শুনতে পাই কেউ যেন সূরা পড়ছে আবার মাঝে মাঝেই অকথ্য সব গালি দিচ্ছে। সানজিদার দিকে সপ্রশ্নে তাকাতেই সে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় রুবির বৃদ্ধা শাশুড়ি এমন করছে। আমরা অল্পক্ষণেই পৌঁছে যাই রুবির ঘরে।

সম্ভবত বাড়ির সবচেয়ে ছোট্ট ঘর এটা। লম্বা বারান্দার মতো একটা ঘর। একটা মাত্র জানালা। মাথার ওপর দুর্বলভাবে ঘুরছে ফ্যান। আর মাঝে মাঝে চি চি শব্দ করছে। মাটিতে তোক বিছিয়ে বিছানার মতো বানানো হয়েছে। ঘরে কোনো খাট নেই। একপাশে শুধুই একটা কাঠের টুল তাতে নানারকম ওষুধ, পানির বোতল আর গ্লাস। ঘরের কোনায় একটা ভাঙা সুটকেসে তূপ করে জমে আছে। রাজ্যের ব্যবহৃত কাপড়। হয়তো এখান থেকেই কাপড় নিয়ে নিয়ে ব্যবহার করা হয়। সারা গায়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল আমাদের প্রাক্তন সহপাঠী রুবি। আমি ওকে চেনার জন্যই সানজিদার পাশ দিয়ে আরেকটু এগিয়ে যাই। সানজিদা দ্বিধান্বিতভাবে কোমল স্বরে ডাকে,

রুবি…

রুবি কোনো শব্দ করে না। কাজের মেয়েটি এসে কাঁধের থেকে ময়লা কথাটা সরিয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে বলে,

এই যে খালাম্মা। দেখতে আইসে আপনেরে। একটু তাকান। উইঠা বইবেন?

এবার মৃদু আলোড়ন দেখা যায় রুবির শরীরে। কাজের মেয়েটি কাথা সরিয়ে দিলেই সে ভীষণ ধীরে হালকা পাশ ফিরে তাকায়। কোটরে যাওয়া চোখ, মাথায় প্রায় নাই হয়ে আসা পাতলা চুল আর শুষ্ক ঠোঁটের অসুস্থ ও অভিব্যক্তিহীন চেহারা দেখে আমি ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠি। সানজিদা এগিয়ে গিয়ে তোশকের পাশে বসে পড়ে। হাত বাড়িয়ে দেয় রুবির দিকে।

রুবি সেদিকে না দেখে ওর কোটরে যাওয়া গর্তের মতো চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি স্মৃতি হাতড়াতে থাকি। আমি কি ওকে চিনি? আমি কি দেখেছি ওকে আগে? বসেছি কখনো পাশাপাশি? মনে করতে পারি না। সানজিদা ডাকে, রুবি, এই রুবি…

অথচ রুবি তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।।

আমার জিমের লকার কোড ৩১৪০, আমার পার্লারের সিরিয়াল নং২৫, আমার জুতার সাইজ ৬, আমি ৩৬ বি সাইজের ব্রা পরি, আমার নেটফ্লিক্সের বিল মাসে বারশ টাকা আর আগস্টের তিন তারিখে আমার মেয়ের জন্ম। আমাকে প্রথম প্রেমপত্র দিয়েছিল শোভন নামের এক হিন্দু ছেলে যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার হাতের বালাগুলো দুবাই থেকে কেনা, আমার চুলে বারগেন্ডি রঙ। আমি সব মনে করতে পারি। সব; কিন্তু আমি এই মানুষটার চেহারা বা পরিচয় মনে করতে পারি না। যে আমার দিকে এখন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চেহারা বলে দিচ্ছে এই দৃষ্টি শূন্য হলেও অচেনা নয়।

অথচ আমি ওকে চিনতে পারি না। পাগলের মতো আজন্ম স্মৃতি হাতড়াতে থাকি আর হাতড়াতে থাকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *