রুবাইয়ের রূপকথা – নবনীতা দেবসেন

রুবাইয়ের রূপকথা – নবনীতা দেবসেন

রুবাইয়ের বাবাও অফিসে চলে যান, মাও কলেজে চলে যান, বেচারি রুবাই সারাটা দিন বাড়িতে একলা। একলা ঠিক নয়—গীতাদিদি আছে, তবুও একলা। দুপুরে স্কুলবাস তাকে নামিয়ে দিয়ে যায়—গীতাদিদি হেসে তাকে দরজা খুলে দেয়, স্নানের ব্যবস্থা করে দেয়। আগে স্নান করিয়ে দিত, এখন রুবাই নিজে নিজে স্নান করে। আগে গীতাদিদি খাইয়েও দিত। এখন রুবাই নিজের হাতেই খায়। ইলিশমাছ কি কৈমাছ কি ট্যাংরামাছ থাকলে গীতাদিদি কাঁটা বেছে দেয়, যদিও রুবাই সেটাও নিজেই পারে। গীতাদিদিই ভরসা পায় না। রুবাইয়ের খাওয়া হলে, গীতাদিদি নিজে খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সেঘুম কুম্ভকর্ণের ঘুম। একেবারে সেই যখন মা কলেজ থেকে আসবেন তখন ঘুম ভাঙবে। রুবাই একা একা বসে বসে ছোটোবেলাতে মনে মনে কতরকমের গপ্পো বানাত। নানারকম সুন্দর সুন্দর গপ্পো। আর মা কলেজ থেকে ফিরলেই তাঁকে শোনাত। ‘মা জানো, আজ না, জানলা দিয়ে একটা ছোট্ট এত্তোটুকুনি পরি এসেছিল, ঠিক একটা বড়োসড়ো মশার মতো দেখতে—আমি তো মশা ভেবে মেরেই ফেলতাম, হঠাৎ দেখি মাথায় মুকুট, হাতে একটা জাদুর কাঠি—’

—‘তাই নাকি, রুবাই? তারপর? তারপর পরি কী বলল?’ মা একমুখ হেসে রুবাইকে কোলে তুলে নিতেন। একটু বড়ো হবার পরে রূপকথা বানানোর খেলাটা বন্ধ হয়ে গেছে রুবাইয়ের। ওই যে মা মুচকি হাসতেন। সেই হাসিটায় পরে ওর কেমন লজ্জা করত। তাছাড়া বাবা খুব খ্যাপাতেন। গীতাদিদি তো ফ্যাকফ্যাক করে কেবলই হাসত। গীতাদিদিকে গপ্পোগুলো বলাই যেত না কোনোদিন। বাবাকেও না। শুধু মা-ই যা শুনতেন চোখ বড়ো বড়ো করে।

এখন রুবাই একটু বড়ো। এখনও ওর দুপুরগুলো কাটতে চায় না। সামনের বছর, সেভেন থেকে দুপুরে ক্লাস হবে। বাব্বা: বঁাচা যাবে। এখন ওই দুপুরগুলো নিয়েই যত মুশকিল। কখনও হোমওয়ার্ক করে, কখনও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, চোখ দিয়ে একটা কাককে ফলো করে খানিকক্ষণ যতক্ষণ না সেউড়ে হারিয়ে যায়, একবার টিভি খোলে, যাচ্ছেতাই সব প্রোগ্রাম হয়। একবার রেডিও খোলে, একবার টেপ চালায়, একবার ‘লেগো’ নিয়ে বসে, একবার গল্পের বই নিয়ে শোয়। আর এক একদিন ভাবে, ছাদে গেলে কেমন হয়? ভবানীপুরে দাদুদিম্মার বাড়িটা তিনতলা। তার মস্ত ছাদ আছে। ছাদে চিলেকোঠা বলে একটা আশ্চর্য ঘর আছে, যাতে কী যে নেই তা কেউ জানে না। ভাঙা পিয়ানো থেকে আরম্ভ করে শিলনোড়া, পেতলের ফুলদানি, কুকুরের চেন—খালি শিশি বোতল, খবরের কাগজ, পুরোনো চিঠিপত্রের বাক্স, ট্রাঙ্ক সুটকেস সবকিছু। ওই ঘরের দরজায় মরচে ধরা একটা তালা ঝোলে। চাবি দিম্মার আঁচলে বঁাধা রিংয়ে। মাঝে মাঝে ঘরটা খুলে এটাওটা বের করা হয়, ঢোকানো হয়। ঘরভরতি শুধু আরশোলা আর টিকটিকিদের সংসার। মা বলেন, ইঁদুরও নিশ্চয় আছে। কিন্তু দিম্মা বলেন, না না, ইঁদুর নেই। আর দাদু বলেন, ইঁদুর নয় বাঘ বেরুবে একদিন ওই ঘর থেকে। রুবাইদের এ বাড়িটা দশতলা। এ বাড়ির ছাদের দরজায় বিরাট দুটো তালা মারা থাকে। কেউ কোনোদিন ছাদে যায় না। ছাদটা থেকেও নেই। না পারা যায় ঘুড়ি ওড়াতে, না পারে ওখানে গীতাদিদি কাচা কাপড় শুকতে দিতে।

দাদু দিম্মার ছাদে রোজ কত রঙিন পতাকার মতো কাপড় শুকোয়। মাঝে মাঝে দিম্মার দেওয়া বড়িও শুকোয়, জাল ঢাকনির তলায়। আর ওই ছাদে ঘুড়ি ওড়ান হয়। বড়োমামু ছোটোমামুর সঙ্গে জুটে রুবাইও কম ঘুড়ি উড়িয়েছে ওই ছাদে? নিজে নিজে কিন্তু রুবাই এখনো শেখেনি কী করে হুট করে আকাশে ঘুড়িটাকে পাঠিয়ে দিতে হয়; কী করেই বা লাটাইটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘুড়ির ওড়াউড়ি, ওঠানামা, কন্ট্রোল করতে হয়। বড়োমামু ছোটোমামু তো অনেক বড়ো। একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছে, আরেকজন কলেজে পড়ছে—তবুও ওরা এখনও ঘুড়ি ওড়ায়। ওরা ঘুড়ি-এক্সপার্ট। শুধু ওই ছাদটা ছিল বলেই না এক্সপার্ট হতে পেরেছে? রুবাই ঘুড়ি ওড়ানো শিখবেই বা কী করে? প্র্যাকটিস করবে কোথায়? তাদের কি ছাদ বলে কিছু আছে? আছে অবশ্য একটা ছাদ। কিন্তু রুবাইয়ের তাতে লাভ নেই। দোবেকাকুর মেয়ের ‘ভাত’ হয়েছিল ওখানে মস্ত শামিয়ানা টাঙিয়ে। শানুদার বৌভাতও হয়েছিল ওইখানে মস্ত ম্যারাপ বেঁধে। কী ভালোই আইসক্রিমটা খাইয়েছিল! তখনই দেখা গিয়েছিল, রুবাইদেরও ছাদ আছে। খুব সুন্দর, বিশাল বড়ো তেপান্তরের মাঠের মতো ছোটোবড়ো অনেকগুলো ছাদ, আবার নানারকম ব্রিজ দিয়ে দিয়ে জোড়া। খেলবার পক্ষে আদর্শ জায়গা। অথচ সেই ছাদে কিনা বারোমাস তালা দেওয়া থাকে। কারুর ওঠা চলবে না। রুবাই রোজই ভাবে একবার চুপি চুপি ছাদে চলে যাবে। যদি একদিন কেউ তালাটা ভুলে খুলে রাখে? অসম্ভব তো নয়? মা তো একদিন গডরেজ আলমারিতে চাবির থোলো ঝুলিয়ে রেখে কলেজ চলে গিয়েছিলেন—দুপুরবেলা গীতাদিদি রুবাইকে দেখাল। বিকেলে মা ফিরলে, রুবাই মাকে দেখাল। মা তক্ষুণি তাড়াতাড়ি আলমারি খুলে কী সব দেখলেন, তারপর খুব খুশি হয়ে গীতাদিদিকে দশ টাকা দিলেন। গীতাদিদি দশ টাকা পেয়ে কেমন একটা বিচ্ছিরি মুখ করে রান্নাঘরে চলে গেল। ভাবতে ভাবতে রুবাই দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে লিফটের সামনে দাঁড়াল। ছাদে কি এখন লিফটে করে উঠবে? না হেঁটে হেঁটে? মোটে তো একটা তলা। রুবাই ভাবল হেঁটেই ওঠা সহজ। এখন দুপুর, লিফট কতক্ষণে আসবে কে জানে? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ছুটতে ছুটতে রুবাই ছাদের সিঁড়িতে। একটা বঁাক ঘুরেই হঠাৎ রুবাই শুনতে পেল ওপরে কারা কথা বলছে।

দুপুরবেলা ছাদের সিঁড়িতে আবার কারা কথা বলবে? রুবাই কী ভেবে ওইখানেই থেমে গেল। দুটো গলা। একটু পরেই রুবাই বুঝল একটা গলা ওদেরই বিলডিংয়ের সিকিউরিটি ম্যান গণেশ সিং-এর, আরেকটা গলা চেনা নয়। দুজনেই খুব আস্তে আস্তে কথা বলছে বটে তবু নীচে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সব। অচেনা গলার লোকটা বলছে—‘এটা তোমার অন্যায় কিন্তু! পাঁচই যথেষ্ট। তুমি দশ চাইছ কী বলে? মালটা শুধু রাখা হয়েছে ছাদে, এটুকুই তো কেবল? এর জন্য দশ হাজার? তুমি কি উন্মাদ হয়েছ?’ গণেশ সিং বলছে—‘আমি তাহলে পুলিশকে খবর দিয়ে দিই’, ছাদে কন্ট্রাব্যাণ্ড মাল আছে? দশ হাজার ছাড়ো, নইলে মালও তুমি পাবে না। চাবি আমি খুলবোই না।’

অচেনা লোকটা বলছে—‘চাবি না খুলে কি প্রাণটা হারাবে বাপধন? আমরা যে-মালের কারবার করি, তাতে তোমার মতন দু-চারটে কাঁচামালকে টুকটাক সরিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। বুঝলি গণশ্যা? সময় থাকতে নরম হ। পাঁচ দিচ্ছি তুই চাবি খোল। নইলে….’

গণেশ সিং-এর গলা এবার খুব কঠিন হল। ‘—নইলে? কী করবি? ছুরি বের করছিস? কর না, এই যে আমারও ছুরি আছে। উপরন্তু এই দ্যাখ কোমরে রিভলভারটা নিয়ে ঘোরা একটা বদভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। লাইসেন্সড মাল—তোর ওপরেই পরীক্ষাটা তবে হয়ে যাক। কী বলিস ভোলা? তোকে মারলেও কিন্তু আমাকে কেউ ধরবে না—আমি সিকিউরিটি!’

‘দোরটা খুলবি? নাকি?’

‘দশ।’

‘ছয়।’

‘দশ।’

‘ছয় তো অনেক টাকা রে? রাজি হয়ে যা।’

‘দশ। বেশি বকাসনি ভোলা।’

‘আর আমিই যদি বলে দিই? এখানকার সিকিউরিটি অফিসার ছাদে কন্ট্রাব্যাণ্ড লুকিয়ে রাখে। দেখুক পুলিস ছাদের দোর খুলে! প্যাকেট ভরতি ভরতি মাল সব ওর। শালা বিলডিং সুদ্দু ছেলেদের মাল সাপ্লাই দিয়ে দিয়ে নষ্ট করে দিচ্চে।’

‘যা না বল না। পুলিশ বোকা নাকি রে? তোকে ধরবে না বুঝি?’

‘ফোনে বলব। গড়িয়াহাট থানার নয়া ওসি কড়া লোক। দেবে ঠেসে। চোদ্দ বছর বনবাস।’

‘আমাকে ধরলেই তোমার নামটি আমিই বলে দোব মাস্টার। বলব আমার নয়, মালপত্তর সব তোমার—কী মাল আমি মোটে জানিই না—শুধু রেখেছি তোমার জন্য—’

‘রেখেছ কেন? বন্ধ ছাদে অন্যের মাল রাখা উচিত বুঝি আইনে বলে? আমায় ধরলে তোকেও ধরবে।’

‘দ্যাখো মাস্টার, বেশি ভ্যানর ভ্যানর কোরো না, পাঁচে মাল তুমি পাবে না। ছাড়ো দশ। দরজা খুলে দিচ্ছি। নইলে কাল মাদকদ্রব্য বিরোধী দিবস আছে, আজই আমি ফোনে থানাকে বলব। আমি বলব আমি একজন পুরোনো ড্রাগ অ্যাডিক্ট। নিজেও সেরে উঠতে চাই, অন্যদেরও সারাতে চাই—তাই থানায় খবর দিচ্চি—তুমিই আমার সাপ্লায়ার ছিলে—’

রুবাইয়ের সারা গায়ে কাঁটা দিল—ড্রাগ-অ্যাডিক্ট শব্দটার মানে রুবাই জানে। বিষাক্ত নেশা করে যারা। টিভিতে বিজ্ঞাপনও দেখেছে। এ নেশায় মানুষ উচ্ছন্নে যায়। এরা তবে ড্রাগ লুকিয়ে রেখেছে ছাদে? ড্রাগের ব্যাবসা করে! রুবাই দৌড়ে নীচে পালিয়ে এল। বেল টিপতে গীতাদিদি ঘুম চোখে উঠে এসে রুবাইকে দেখে অবাক। ‘সেকি, রুবাই? তুমি আবার কখন বেরুলে? কোথায় গিয়েছিলে আমাকে কিচ্ছু না বলে কয়ে?’ গীতাদিদি চোখ গোল গোল করে বকতে বকতে দরজা বন্ধ করে। রুবাই বলে, ‘গীতাদিদি! চুপ কর তো? আমার একটা দরকারি কাজ ছিল—’ দৌড়ে ঘরের ভেতরে ফোনের কাছে যায় রুবাই। ডিরেক্টরি তুলে দেখে, এই ত পুলিশের নম্বর। পুলিশ, আগুন, অ্যাম্বুলেন্স। রুবাই পুলিশের নম্বরটা ঘোরায়। ভয়ে উত্তেজনায় তার হাত থরথর কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে। আড় চোখে দেখল গীতাদিদি আবার গিয়ে ফ্যানের নীচে শুয়ে পড়েছে। চোখের ঘুম কাটেনি তাই বেশিক্ষণ বকেনি। গীতাদি মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। তবুও রুবাই এ ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। থাক—গীতাদির এসব না শোনাই ভালো। নম্বর তো ঘোরাই, কী জানি কী হয়? ওই তো রিং হচ্ছে। এইবার:— ‘হ্যালো। লালবাজার? আমি বারো নম্বর বিশ্বনাথ স্ট্রিট থেকে বলছি। শুনুন, আমাদের বাড়ির ছাদে অনেক প্যকেট ড্রাগ, কন্ট্রাব্যাণ্ড মাদকদ্রব্য জমা আছে। ড্রাগ আর কি! সিকিউরিটি ম্যান গণেশ সিং আর তার বন্ধু ‘মাস্টার ভোলা’ দুজনে মিলে এগুলো রেখেছে। তারা এখন দুজনেই এ বাড়ির ছাদের সিঁড়িতে ছোরাছুরি নিয়ে ঝগড়া করছে—ধরতে চাইলে আপনারা এক্ষুনি চলে আসুন। বারো নম্বর বিশ্বনাথ স্ট্রিটের এ বাড়িটা মাল্ট্রিস্টোরিরিড। ‘বি ব্লকের’ ছাদের সিঁড়িতে এক্ষুনি অনেক পুলিশ পাঠান। এটা গড়িয়াহাট থানার আনডারে। বুঝেছেন? বারো নম্বর বিশ্বনাথ স্ট্রিট, বি ব্লক, ছাদের সিঁড়ি,’ বলেই ফোনটা রেখে দেয় রুবাই। তার এতই ভয় করছে, যে মনে হচ্ছে পাঁজরা ফেটে বোধহয় হৃৎপিন্ডটা ছিটকে বাইরে বেরিয়ে চলে আসবে। ফোন রেখেই বুকে বালিশ চাপা দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে রুবাই। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে পুলিশরা এখন কী করবে? লালবাজারের লোকরা তার কথা বিশ্বাস করে পুলিশ পাঠাবে কি? রুবাই তো ছোটো ছেলে, ফোনে তার গলা শুনে তাকে সবাই মেয়ে ভাবে, এখনও ছেলে বলেই চিনতে পারে না, তার কথা কি পুলিশ শুনবে? ছোটো ছেলেরা পুলিশে এসব খবর দেয় কি? তাছাড়া পুলিশ তো জানেই না কে খবরটা দিল। ইয়ার্কি ঠাট্টা ভাবল না তো? মিছে কথা ভাবে যদি? আর ফোন নম্বর থেকে পুলিশ যদি জানতে পরে রুবাইই ফোন করেছিল? যদি রুবাইকেই ধরে নিয়ে যায়? ভয়ে রুবাইয়ের কান্না পেয়ে গেল। কী দরকার ছিল পুলিশকে ঘাঁটাবার? পুলিশ-টুলিশকে ভীষণ ভয় করে রুবাই। কিন্তু ড্রাগের নেশা যে ভীষণ খারাপ ব্যাপার। জীবন একেবারে নষ্ট করে দেয়। ইস্কুলের সামনে ফুচকা খাওয়াও বারণ হয়ে গেছে রুবাইয়ের। তার ভেতরেও নাকি ড্রাগ পুরে দিচ্ছিল খারাপ লোকেরা। এই নেশা, ড্রাগ অজগর সাপের মতন, মানুষকে জড়িয়ে ধরে কঙ্কাল বানিয়ে দেয়। রাস্তায় বড়ো বড়ো ছবি দেখেছে এ বিষয়ে রুবাই। মা বুঝিয়ে বলেছেন। ভাবতে ভাবতে ভয়ে উদবেগে রুবাই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

হঠাৎ দরজায় ধাপর ধাঁই ধাক্কায় ঘুম ভাঙল। মা ধাক্কা দিচ্ছেন।

‘কি রে? দরজা বন্ধ করে ঘুম আবার কী? দরজা খোল—’ রুবাই দরজা খুলেই বুঝল সবাই খুব উত্তেজিত। গীতাদিদির চোখমুখে উত্তেজনা যেন ফেটে পড়ছে। বাব্বা। একদিন ভুল করে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে রুবাই—তাতেই এই?

মা বললেন—‘জানিস রুবাই? কী সব ভয়ানক কান্ড? আমি তো ঢুকতেই পাই না! এ বাড়ি আজ পুলিশ রেইড করেছিল। নারকটিকস স্কোয়াড।’

‘পুলিশ?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, পুলিশ! সিকিউরিটি ম্যান গণেশ সিংকে অ্যারেস্ট করেছে। ছাদে নাকি অনেক ড্রাগের প্যাকেট লুকিয়ে রেখেছিল—কী সব্বোনেশে লোক!’

‘সত্যি? কখন?’ রুবাই উত্তেজনায় আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলেছে।

‘এই তো একটু আগেই ওদের ধরে নিয়ে গেল পুলিশের গাড়ি করে। এ বাড়ি থেকেই একটি মেয়ে নাকি খবর দিয়েছিল লালবাজারে। খবর পেয়েই পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছে আর ছাদের সিঁড়ি থেকে গণেশ সিংকে আর তার এক শাগরেদকে ধরেছে। ছাদ থেকে ড্রাগের প্যাকেটগুলোও উদ্ধার করেছে। পুলিশ মেয়েটাকে কত খুঁজল, কিন্তু কেউই বলতে পারছে না খবরটা ঠিক কে দিয়েছে। খুবই ভালো কাজ করেছে কিন্তু মেয়েটি। খুব সাহসের কাজও করেছে। কিন্তু সেখবরটা পেল কেমন করে কে জানে?’ তোয়ালে নিয়ে এবার মা গা ধুতে বাথরুমে ঢুকছেন। রুবাই ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজল।

এক্ষুনি মাকে যদি সবকথা রুবাই বলে দেয়—ছাদে যাওয়া থেকে ফোন করা অবধি—মা কি বিশ্বাস করবেন? যদি বলে, ‘কোনো মেয়ে নয় মা, আমিই ফোন করেছিলুম। দুপুরবেলা আমি ছাদে—’ না:। থাক।

যদি মা, তেমনি মুচকি হাসেন? যদি মা ভাবেন রুবাই সেই ছোটোবেলার মতোই রূপকথার গপ্পো বানিয়ে বলছে? সেখুব কষ্টের হবে। থাক, এত বড়ো ঘটনাটা রুবাইয়ের একলার জন্যেই জমা থাক। রুবাই মাকে ছেড়ে দিল।

গীতাদিদি দুধের গেলাস নিয়ে এসে চোখ পাকিয়ে বলল—‘আর কোনোদিন দুপুরবেলাতে তুমি অমনি লুকিয়ে বেরুবে না! —আজ কী গন্ডগোল! ডাকাতগুলো এই ঘরের পাশেই, সিঁড়িতে! —এখনও ওখানে মানুষ গিজগিজ করছে—তুমি যদি ওর মধ্যে গিয়ে পড়তে? পুলিশে ডাকাতে আজ গুলি ছোঁড়াছুঁড়ি হতে হতে বেঁচে গেছে। কী কেলেঙ্কারিই না হতে পারত! দু-জনের কাছেই গোলা-গুলি ছিল, ছোরা-ছুরি ছিল—ওরে বাবারে’—গীতাদিদি শিউরে ওঠে। রুবাই দুধের গেলাসে মুখ ডোবাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *