রুদ্র – ৫০

৪৯

সুরভীর জীবনের সবচেয়ে কুৎসিত রাতটা কেটেছে গতকাল। নিজের অসুস্থতা ভুলে গোটা রাত বসে ছিল এই আই সি ইউ তে। রুদ্রের পাশে।

শুভ বলছিল, “জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত শুধু আপনাকে এক নজর দেখার মিনতি করেছে মানুষটা।”

সেই থেকে একবারের জন্যও রুদ্রের পাশ থেকে নড়েনি সুরভী। অস্থির হয়ে চেয়ে ছিল রুদ্রের দিকে। কখন জ্ঞান ফিরবে তার? কখন হবে আবার তাদের দেখা, কথোপকথন?

সাত ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো রুদ্রের। চোখ মেলেই সে দেখতে পেলো সুরভীকে। সে ছুটে গিয়ে ডাক্তারকে ডাকতে যাচ্ছিল, তার হাত টেনে আটকালো রুদ্র।

— “বসো এখানে।”

— “ডক্টরকে আসতে বলি, এখনই একবার চেকআপ করতে হবে তো!”

— “কিচ্ছু লাগবে না আমার। তুমি বসো কিছুক্ষণ আমার পাশে।”

মাথা নিচু করে বসে রইলো সুরভী। ঠোঁট চেপে কাঁদছে ও। – “আমাকে মাফ করেছো তুমি?”

— “কিসব বলছো তুমি! এখনও এসব কথা বলা জরুরি?”

— “হ্যাঁ জরুরি। গায়ে শ’খানেক বুলেট সয়েও বেঁচে ফিরতে পারবো আমি। তবে তোমার অভিমান, প্রত্যাখ্যান নিয়ে এক মুহূর্তও না। মরে যাবো আমি সুরভী!” রুদ্রের হাত বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সুরভী।

— “আমি ভেবেছিলাম তুমি আর ফিরবে না। আমাদের আর দেখা হবে না। আমি গতকাল যা কিছু বলেছি, সব সত্যি হয়ে যাবে।”

— “বলো না ক্ষমা করেছো আমাকে?”

— “না করলে বসে বসে কাঁদছি কেন আমি? এই সাতঘন্টা বসে আছি কেন তোমার পাশে।”

— “সেজন্যই ফিরে এসেছি। এখনও ভালোবাসো, এখনও আমাকে চাও তাই বেঁচে আছি। নয়তো সত্যিই মরে যেতাম। অসুর কখনো অসুরের অস্ত্রে মরে না সুরভী, অসুর মরে দেবীর আঘাতে। আজগর আমাকে মারতে পারবে না। মারতে পারবে তুমি। তোমার ভালোবাসা না পেলেই আমি মরে যাবো।”

রুদ্রের হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদছে সুরভী। বুকের উপর ব্যান্ডেজে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ও। চোখ বুজে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে রুদ্র। জীবন থেকে বিশ্রী এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। হয়তো সুরভীকে ঠকিয়েছে সে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে। তাতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই তার। সুরভীকে নিজের করে রাখতে, আজীবন ওর ভালোবাসায় ঠাঁই পেতে সব করতে পারবে সে, সব! হোক তা ছলচাতুরী, মিথ্যা কিংবা খুন! তাতে কোনোদিনও অনুশোচনা হবে না তার।

৫০

ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট রেখে লাইটার খুঁজছিল রুদ্র। হঠাৎ কোথা থেকে সুরভী লাইটার হাতে এসে সিগারেটটা জ্বালিয়ে দিলো। মুচকি হাসলো রুদ্র।

— “জীবনটা স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে বুঝলে? না চাইতেই সবকিছু হাতের সামনে এনে হাজির করো। কখন কী চাই বুঝে ফেলো। আ’ম টুলি ব্লেসড। নয়তো কারো বউ এভাবে লাইটার খুঁজে এনে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দেবে নাকি?”

ভেংচি কাটলো সুরভী।

— “তোমার ঢঙ যতসব!”

পাশেই শুভ বসে আছে। মুখ আড়াল করে হাসছে সে। রুদ্রের ভীষণ ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে এই দম্পতিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ মেলে তার। সুরভীর প্রশংসায় কোনোদিন কার্পণ্য করে না এই মানুষটা। ভালোবাসতেও না। নিজ অনুভূতির সবটা নিংড়ে দিয়েছে সে সুরভীর ঝুলিতে। ভালোবাসা প্রকাশেও নেই তার লোকলজ্জার ভাবনা। ঘরভর্তি লোকের মাঝে বসেও সামনে উপস্থিত স্ত্রীর মাঝে পুরোপুরি খুইয়ে যেতে পারে বোধহয় এই লোকটাই। গালে হাত রেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে শুনতে থাকে তার স্ত্রীকে, এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। আশপাশে কে কী বলছে সেসব আর তার কানে কিছু ঢোকে না। সুরভীকে সে দেখতেই থাকে, দেখতেই থাকে। কারণে অকারণে সবার সামনে ভালোবাসি বলতেও এতটুকুন দ্বিধা নেই তার। এমনকি কথা বলার প্রিয় বিষয়ও সুরভীই। বাইরের জগতে স্বল্পভাষী এই লোকটাও মুখরা হয়ে উঠে আলাপের মাঝে সুরভীর প্রসঙ্গ এলে। তাকে নিয়ে রুদ্র বলেই চলে ক্লান্তিহীনভাবে। এই মানুষটাকে এখন আর মন খারাপ করতে কিংবা মানসিক চাপে সব ছেড়ে লুকিয়ে থাকার জন্য অস্থির হতে দেখা যায় না। রাত জাগার ছাপ চেহারায় বুঝা যায় না। গুনগুনিয়ে গান গাইতে শোনা যায়, প্রাণখুলে হাসতে দেখা যায়। প্রচন্ড একাকী জীবনটার জন্য সঙ্গী পেয়েছে সে। জীবনে ছন্দ ফিরে এসেছে, স্বস্তি এসেছে। রুদ্রের এইসব সুখের দিনগুলোর সাক্ষীই তো শুভ হতে চেয়েছিল এতগুলো বছর ধরে!

রুদ্রের ঘরে বসে এতটা সময় ধরে টিভিতে চোখ ডুবিয়ে রেখেছিল রুদ্র আর শুভ। রুদ্রের সঙ্গে দু-চারটে আলাপ শেষে সুরভী পেছন ফিরতেই দেখলো টক শো চলছে টিভিতে। আলোচনার বিষয়বস্তু আজগর। স্টেজের ব্যাকস্ক্রিনে আজগরের ছবি ভাসছে। দেখেই বিরক্তিতে চেহারা কুঁচকে গেল সুরভীর। রিমোট হাতে নিয়ে তক্ষুনি টিভি অফ করে দিলো সুরভী।

— “এই অমানুষটাকে এত মন দিয়ে দেখার কী আছে? ওর হাতে গুলি খেয়ে সাধ মেটেনি? আরো দেখতে হবে ওকে?”

— “ভাগ্যিস গুলি করেছিল। নয়তো ফিরতে নাকি আমার কাছে?”

বেরিয়ে গেল সুরভী। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো রুদ্র আর শুভ। কেউ কিছু উচ্চারণ করলো না। ঠোঁট চেপে হাসলো শুধু।

পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে। আসছে শুক্রবার সুরভী রুদ্রের রিসিপশন। আর চারদিন পর থেকে শুরু হবে বিয়ের সব রীতি-অনুষ্ঠান। বাড়ির কোথায় কিভাবে সাজানো হবে তা পুরো বাড়ি ঘুরে নির্দেশনা দিচ্ছে সুরভী নিজেই। ওদিকটা দেখতেই রুম থেকে বেরুলো ও। শুভ চেয়ে রইলো সুরভীর চলে যাবার পথে। রুদ্র যতটা প্রকাশ করে তার চেয়ে বেশি মরে তার জন্য, সেই আবগেটুকু কি উনি অনুভব করতে পারে পুরোপুরি? তাদের বিয়ের দিন ইকবাল মাহমুদ বলেছিল, এই মেয়ের জন্য রুদ্র প্রয়োজনে মাথা নোয়াবে, প্রয়োজনে মাথা কেটে আলাদাও করবে। ষোলোআনা সত্যি ছিল সে কথা! তাকে ফিরে পাবার জন্য রুদ্র কত কী যে ঘটালো, নিজেকে কেমন শাস্তি দিলো তার অজান্তে, সে কথা আজীবন রুদ্রের রানির অজানাই থাকবে! স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট কি শুধু রুদ্রই? সুরভীও তো! নয়তো এত ভালোবাসা, এতখানি আগলে রাখা, আঁকড়ে ধরা সবার ভাগ্যে জোটে নাকি?

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *