৩৫
প্রচন্ড অভিমানে আজ সকালে ঘর ছেড়েছে রুদ্র। সুরভী ছাড়া কেউ জানে না তার ঘর ছাড়ার কারণ। প্রত্যেকে জানে রুদ্র সিলেট গিয়েছে কী এক কাজে। সুরভীও আটকায়নি তাকে। জেদ ধরে বসে ছিল সে-ও। তখন একদম গায়ে লাগেনি, কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন গায়ে হুল ফুটছে। কয়েকবার ফোন চেক করা হয়ে গেছে রুদ্রের কল কিংবা টেক্সটের আশায়। এই কয়দিনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রুদ্রের টেক্সট, কলের অভ্যেস হয়ে গেছে খুব। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো বলে অথচ কল, টেক্সট কিছুই এল না। কী এক হাহাকারে ভারী হয়ে আছে মন। তার উপর শীতের এই শুষ্ক হাওয়া, আরো খানিকটা মন খারাপ বোধ হয় সে-ও বয়ে বেড়ায় দুপুরের পর থেকে। অজানা এক বিষন্নতা আশপাশ জুড়ে! রুদ্রকে ভাবতে ভাবতেই ছাদের এপাশ-ওপাশ হাঁটছিল সুরভী। সময় যাচ্ছে, আর মানুষটাকে নির্দোষ মনে হচ্ছে। আবার হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে গতরাতে করা ধারণাটাই ঠিক! জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা যার দখলে তাকে নিয়ে মনের এত দোটানা বয়ে বেড়ানো বড্ড কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে চোখ ভিজে আসছে শুধু!
— “ভাবী?” কাজের লোকের ডাকে ঘাড় ফেরালো সুরভী।
— “হুম?”
— “ম্যাডাম নিচে ডাকছে আপনাকে।”
শাশুড়ীর ডাকে সবসময় দৌড়ে হাজির হলেও, আজ যেন গায়ে সেই জোরটাও মিলছে না। হাত-পা সব বুঝি ভেঙেচুরে আসছে। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে তার দুনিয়াদারি।
অনেকটা সময় নিয়ে ধীর পায়ে নিচে নেমে এল সুরভী। ফেরদৌসী ডাইনিং টেবিলে বসে। ওকে দেখামাত্রই টেবিল ভর্তি নাস্তা ইশারা করে বললেন,
— “সকালে নাস্তা করোনি, দুপুরেও ঠিকমতো খাওনি। খাওয়ার রুচিটা বোধহয় নষ্ট হয়েছে। সব এখন বাইরে থেকে আনিয়েছি। ফুচকা, দইবড়া, পাপড়ি চাট, চিকেন তন্দুরিসহ আরো পাঁচটা আইটেম আছে এখানে, সব আলীর দোকানের। ওকে কল করে বলেছি যা আছে সবগুলো মেন্যু থেকে আমার সুরভীর জন্য পাঠাও। যা ভালো লাগে খাও আমার সামনে বসে।”
ম্লান হাসলো সুরভী।
— “আপনি এনেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি মা। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না, সত্যি!”
সুরভীর চোখে-মুখে লক্ষ্য করলেন ফেরদৌসী। অরুচির কারণ শারীরিক অসুস্থতা কিংবা সাময়িক কোনো ব্যাপার নয়। সমস্যা সুরভীর মনে। বাম হাতে সুরভীকে টেনে পাশে বসালেন ফেরদৌসী। নাজনীনকে ইশারা করলেন দইবড়া বাটিতে তুলে দিতে। আজ সারাদিনে চুলে চিরুনিও লাগায়নি সুরভী। কী এলোমেলো লাগছে ওকে! তার চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে ফেরদৌসী বললেন, – “এই ঘরে কিন্তু তুমি একা না। আমি তো আছি, কখনো মন খারাপ হলে চলে আসো না কেন আমার কাছে? সমাধান না করতে পারি, অন্তত শুনতে তো পারবো।”
মাথা নিচু করে রইলো সুরভী। ফেরদৌসীর প্রত্যুত্তরে বললো না কিছু।
কাঁপা হাতে সুরভীর মুখের সামনে চামচ ধরলেন তিনি।
— “নিজেই এই হাতে খেতে পারি না অথচ তোমাকে খাইয়ে দিতে চাইছি। ফিরিয়ে দেবে?”
শাশুড়ীকে ফেরানোর সাধ্য হলো না সুরভীর। খাবার মুখে তুললো সে।
— “আমার ছেলে বাসায় থাকলে তোমাকে খাইয়ে দিতো। নেই যেহেতু তাই আমাকেই খাওয়াতে হবে। এভাবে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলে হবে নাকি? রুদ্র এসে যদি দেখে তুমি শুকিয়ে গেছ, আমাকে ও বলবে তোমার খেয়াল রাখিনি আমি। শুনতে ভালো লাগবে আমার?”
সুরভীর দু’গাল বেয়ে পানি ঝরছে। মন খারাপের কারণ তবে রুদ্র!
সুরভীর হাত চেপে ধরলেন তিনি। বললেন,
— “আমাকে ঘরে নিয়ে চলো তো! আর নাজনীন, দই বড়াটা আমার ঘরে নিয়ে এসো।”
মুখোমুখি অনেকটা সময় সুরভীকে নিয়ে বসে রইলেন ফেরদৌসী। কেউ কিছু বললেন না। একটু একটু করে বাটির খাবারটুকু সুরভী শেষ করা পর্যন্ত ওর দিকে চেয়ে রইলেন। খাওয়া শেষে ওরদিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
— “রুদ্র চলে গেছে বলে এত খারাপ লাগছে? মনে পড়ছে খুব?”
ফেরদৌসীর জিজ্ঞেস মিথ্যে নয়। মনে তো পড়ছে সত্যিই! ভীষণ মনে পড়ছে। তবুও স্বীকার করতে ইচ্ছে হলো না।
মাথা দুলিয়ে অস্বীকৃতি জানালো ও।
— “তবে কি ঝগড়া হয়েছে দু’জনের মাঝে?”
ফেরদৌসীর দিকে একবার চোখ তুলে তাকালো সুরভী। কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। হয়তো সম্পর্কের দিক থেকে দ্বিধায় পড়ে আছে সে!
সুরভীকে দ্বিধামুক্ত করতে চাইলেন ফেরদৌসী।
— “দেখো আমি টিপিক্যাল শাশুড়ী না, তা এ কয়দিনে বুঝেছো নিশ্চয়ই? আমার ছেলের মন্দটা তুমি আমাকে চাইলে বলতে পারো। তোমাদের দু’জনের মাঝের দ্বন্দ্বটাও আমি শুনবো উইদাউট এ্যনি জাজমেন্ট। তুমি তোমার মাকে যা কিছু বলতে পারো, আমাকে ঠিক তা বলতে পারো। শোনার সময় আমি ভুলে যাবো আমাদের সম্পর্ক কী! আমি তোমার শাশুড়ী না কিংবা তুমি আমার ছেলের বউ না। পুরোটা সময় আমি শুধুই ফেরদৌসী আর তুমি সুরভী হয়েই থাকবে আমার কাছে। তবুও যদি মনে হয় আমাকে বলতে তুমি কমফোর্টেবল না, তাহলে বলো না। কোনো আপত্তি নেই তাতে। তোমার মা আছেন, বান্ধবীরা আছেন; যাকে ভালো লাগে তাকেই বলো।”
— “আমি খুব দ্বিধায় আছি উনাকে নিয়ে।”
প্রায় আট মাস পর সিলেটের বাংলোতে এসে পা রাখলো রুদ্র। ইচ্ছে ছিল এখানে পরবর্তী যাত্রা সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে হবে। হলো না। ভীষণ মনে পড়ছে ওকে। সুরভী এই জীবনে পা রাখার আগে ওকে ছাড়াই চলছিল সবকিছু। নিজস্ব সব অশান্তি, অস্থিরতা মন্দ লাগা নিয়েই চলছিল জীবন। এখন মনে হচ্ছে সুরভী সঙ্গে না থাকার যন্ত্রণা সমস্ত যন্ত্রণাকে হার মানাচ্ছে। কোনো কাজে মন বসছে না। সবকিছুতেই ভীষণ অনীহা আর বিতৃষ্ণা! বিয়ের পর থেকে প্রতিঘন্টায় অন্তত একটা টেক্সট করে হলেও সুরভীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। সুরভী আছে, কথা হচ্ছে এটাই যেন তার সমস্ত শক্তির আঁধার, সমস্ত অস্থিরতার টনিক হয়ে ছিল এ ক’টাদিন। আজ গোটাদিনে সুরভী নেই, শক্তিও নেই, শান্তিও হারিয়ে গেছে। কয়েকবার ফোন হাতে নিয়েও রেখে দিলো রুদ্র। কোনো প্রকার যোগাযোগ সে করবে না। সে নিজেও দেখতে চায় সুরভীকে নিয়ে শূণ্য শূণ্য অনুভূতি কোথায় গিয়ে ঠেকে? ঠিক কতখানি পর্যন্ত সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে?
বিনা প্রশ্নে এতটা সময় ধরে সুরভীর সমস্ত কথা শুনলেন ফেরদৌসী সব শেষে মুচকি হেসে জানতে চাইলেন,
— “সব বলা শেষ?”
— “হ্যাঁ।”
— “কেঁদেকেটে কী হাল করেছো! এখন আর কান্না দেখতে চাই না, প্লিজ! আমার কথা শোনো, এর মাঝেই তুমি তোমার জবাব পাবে।”
চোখ মুছে মুখ তুলে তাকালো সুরভী জবাবের আশায়।
— “তুমি যেই রুদ্রকে দেখো, গোটা পৃথিবী কিন্তু তা দেখে না। আমার ছেলেটা অমানুষ হয়ে গেছে আরো বহু আগেই। অথচ কী মিষ্টি স্বভাবের ছিল একটা সময়! সেই রুদ্র আর এই রুদ্রকে চেনার উপায়ই নেই। ওর বাবা ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। আমার শ্বশুর, তার বাবা উনারা সবাই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারই জের ধরে আশরাফেরও রাজনীতিতে আসা। ব্যবসা আর রাজনীতি ওদের রক্তে আছে। অথচ রুদ্রটা হলো ভিন্ন। ওর বাবার এত প্রাচুর্য, ক্ষমতার লোভ কিছুই ওকে কখনো স্পর্শ করতো না। ও বরাবরই বাসার বাইরে থাকতে চাইতো। ওকে ধরে বেঁধে স্কুল পর্যন্ত আমরা বাসায় রাখতে পেরেছি। কলেজ জীবন থেকে ও বাসার বাইরে থাকতে শুরু করলো। শুধু বাসার বাইরে কী বলছি! ও এই শহরই ছেড়ে দিলো। সাদামাটা জীবন ওর বড্ড পছন্দ! সাধারণ মানুষ, প্রকৃতি, পশু-পাখি এসবের মাঝে থাকতেই ও পছন্দ করতো। এমনকি ও কার ছেলে সেই কথাটা পর্যন্ত ও বলতে চাইতো না। প্রচন্ড কাইন্ড, সফট হার্টেড ছেলে ছিল ও। ইচ্ছে ছিল মিউজিশিয়ান হবে। খুব ভালো গান, সুর করতো ও। আমি আর আশরাফও কখনো আপত্তি করিনি তাতে। রুদ্রের জীবন, সেটা ওর পছন্দ মোতাবেকই হবে। ও খুব সুখী একজন মানুষ ছিল জানো? খুব হাসিখুশি, সবখানে আনন্দ বিলিয়ে বেড়ানো একজন মানুষ। বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল ওর নেশা।”
— “উনি গান করতো?”
— “হ্যাঁ।”
— “আজ পর্যন্ত একটু গুনগুনও করতে শুনিনি!
— “ওর সমস্ত গান মুছে গেছে!”
— “কী হয়েছে?”
— “একটাই ছেলে ও আমাদের। ভালোবাসার কোনো কমতি কোনদিন আমরা রাখিনি। আশরাফ খুব ব্যস্ত মানুষ ছিল। কিন্তু ছেলের জন্য তার সময়ের কখনো অভাব হয়নি। একেবারে বুকে আগলে মানুষ করা বলতে আমরা যা বুঝি, আশরাফ ঠিক ওভাবেই রুদ্রকে বড় করেছে। আশরাফ ছিল রুদ্রের পৃথিবী। সারাদিন পর বাবার সঙ্গে ঘন্টা ধরে কথা না বললে ও ভীষণ অস্থির হয়ে যেত। ও বাসা ছেড়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের ছাড়েনি। দিনে কতবার যে কল করতো আমাকে! ওর বাবাকেও। ছেলেমেয়েরা সাধারণত বড় হয়ে গেলে মা-বাবার প্রতি আকর্ষণ কমে আসে। নিজের আলাদা জগত তৈরী করে সেখানেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে। অথচ রুদ্র ছিল আলাদা। ওর সমস্ত অপরাধের কথা ওর বাবা জানে। কবে কোন মেয়েকে ভালো লেগেছে, কবে কোথায় কার সঙ্গে ড্রিংক করেছে, উইড স্মোক করেছে সে কথাও ওর বাবার জানা। এই সখ্যতা অবশ্য পুরোটা আশরাফের তৈরী করা। ওর বরাবরই একটা কথা ছিল, আমার ছেলের ভালো দিক, মন্দ দিক বাইরের লোক জানার আগে আমি জানবো। আশরাফ ছিল রুদ্রের অক্সিজেন। সারাদিন যেখানেই ঘুরুক ফিরুক, দিনশেষে বাবাকে তার চাই –ই চাই। রুদ্রের জীবনে সবকিছু পার্ফেক্টলি চলছিল। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাবার কাছে বিজনেসটা একটু একটু করে বুঝে নিচ্ছিলো। একটাই উত্তরাধিকারী আমাদের। ওর অমত থাকলেও, ও নিজেও বুঝতো ও ছাড়া আর তো কেউ নাই বাবার এসব ধরে রাখার। মিউজিকের পাশাপাশি বিজনেসটাও ধরতে চাইলো। কিন্তু পলিটিক্সে একদম না! রুদ্রের সবচেয়ে অপছন্দের জায়গা হলো রাজনীতি।”
— “কিন্তু এখন সেই রাজনীতিই তো করছে।”
— “আশরাফ মারা যাবার পর। ওর সাধারণ মৃত্যু হয়নি। খুন করা হয়েছিল ওকে।”
— “হ্যাঁ টেলিভিশনে দেখেছিলাম। তবে এতটাও খেয়াল করে দেখা হয়নি। বিস্তারিত জানি না কিছু।”
— “আশরাফকে খুন করেছে আমারই দেবর। আশরাফের ভীষণ আদরের আজহার। জানো তো সুরভী, আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটাই করে। কারণ তারা কাছে আসার সুযোগ পায়। তোমার শ্বশুরের বেলায়ও ঠিক তাই হয়েছে। ওর শত্রুর অভাব ছিল না। কিন্তু কেউ কোনোদিন একটা আঁচড় দিতে পারেনি। অথচ সেই লোকটাকে কিনা মেরে ফেললো তারই ভাই।”
— “কেন?”
— “ক্ষমতার লোভ। রাজনীতির সঙ্গে আজহারও জড়িত ছিল। কিন্তু আশরাফের সম্মানটা ছিল বরাবরই আলাদা। তাই বলে আজহারকে কেউ ছোট করেছে তা কিন্তু না! ওর প্রাপ্য সম্মান ওকে দেয়া হতো সবসময়, তবুও ওর ক্ষোভ ছিল সবসময়। অপজিশন পার্টি তারই সুযোগ নিলো। আজহারকে উস্কে আশরাফকে খুন করালো। আমি সামনে ছিলাম, আমাদের বেডরুম ছিল এই করিডোরের শেষ ঘরটা। ওখানে আমার সামনেই আশরাফকে গুলি করলো ও। তোমার শ্বশুর স্পট ডেড। বিয়ের পর থেকে এই মানুষটাকে আমি ভীষণ যত্নে আগলে রেখেছিলাম। আমি থাকতে আশরাফের জ্বর আসবে, সর্দি হবে সেটাই মেনে নিতে পারতাম না। মনে হতো আমার দায়িত্বে কোনো অবহেলা রয়ে গেল না তো! আমার এত ভালোবাসার মানুষ, যার সঙ্গে আমি ৩০ বছর কাটিয়েছি সেই মানুষটা আমারই চোখের সামনে এভাবে মরে গেল! মানতে পারিনি আমি। সেদিনই স্ট্রোক করেছিলাম আমিও। ফেরার কথা ছিল না আমার, তবুও ফিরেছি। পুরো ২৯দিন আই সি ইউ তে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর উপরওয়ালা আমাকে এই পৃথিবীতেই ফেরত পাঠিয়েছেন। আশরাফ চলে যাবার সেই রাতের পর রুদ্র আর রুদ্র নেই। একদিকে বাবার রক্তমাখা লাশ, মা ওদিকে যাই যাই করছে এসব যথেষ্ট ছিল ওকে অমানুষ বানানোর জন্য। হসপিটাল থেকে ফিরে এসে আমি আমার ছেলেকে আর খুঁজে পাইনি। আশরাফের সঙ্গে রুদ্রও মরে গেছে। তারপর কী ভেবে যে ও রাজনীতিতে এল, জানি না আমি ঠিক! তবে কারণ যাই হোক, পুরোটা ও করছে জেদের বশেই। রুদ্র এখন যে জীবন কাটাচ্ছে, এই জীবন ও কখনো চায়নি। অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব ভরা জীবন ও টেনে যাচ্ছে আজ ছয় বছর। এতগুলো বছরে আমি ওকে ঠিকঠাক হাসতে দেখিনি, রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে দেখিনি। সেই সরল রুদ্রটাকে আমি দেখিনি। যার জীবনে আনন্দের কোনো কমতি ছিল না, মন খারাপ যাকে কখনো ছুঁতে পারেনি, তার জীবন থেকে হাসি আনন্দ মুছে গেছে, তা আমি মা হিসেবে কত কষ্টে মেনে নিয়েছি জানো? আমি ওর জন্য কিছু করতে পারিনি। আশরাফকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতেই আমার লেগে গেল বছরখানেক। প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম দেড় বছর। এই দেশ, সেই দেশ ঘুরে, চিকিৎসা করিয়ে হাঁটাচলার উপযুক্ত হতে লেগে গেল আরো একবছর। রুদ্রকে আমার আর সামলানো হলো না, ও হারিয়ে গেল ওর মতোন করে। রুদ্রের সব আছে, ছিল না শুধু শান্তি। দিনশেষে কারো কাছে নিজের সমস্ত গল্প করার মতো একটা মানুষ ছিল না, যার কাছে ভেঙেচুরে ও নিজেকে সঁপে দিতে পারবে নিজের মতো করে। সবার সবকিছু সামলে নেয় যে, দিনশেষে সেও একজন চায় যে তাকে সামলে নেবে, আগলে রাখবে। রুদ্রও খুব করে চাইতো। আমি বুঝতাম এই জীবনটা টেনে নেয়া সত্যিই অসহ্য ঠেকছে ওর কাছে। ভাগ্যক্রমে সেই চাওয়া গিয়ে ঠেকলো তোমার কাছে। কী করে হলো, কেমন করে হলো এত কথা জানতাম না আমি। ও বলেনি আমাকে। আজ তোমার কাছে জানলাম। আমি তোমাকে মোটেও জাজ করছি না কিংবা রুদ্র আমার ছেলে বলে ওর পক্ষও টানবো না। যা সত্যি তাই বলবো। ও সত্যিই তোমাকে চায় সুরভী। এই নিয়ে সন্দেহ করো না। তবে তুমি যেমনটা ভাবছো সেভাবে না, গোটা তুমিটাকেই ও চায়। জানো, যেদিন আমাকে ও বললো তোমার কথা সেদিন ওর চোখে, কন্ঠে, চাওয়ার মাঝে ভীষণ কাতরতা খুঁজে পেয়েছিলাম। বলছিল, ওকে আমার লাগবেই আম্মু। ওকে ছাড়া চলবে না। মনে হলো যেন রুদ্র তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, যে আশ্রয় হন্যে হয়ে খুঁজছিল ও। ওর চাহনীতে, চাওয়ার মাঝে সত্যি বলতে কোনো খারাপ ইন্টেশন আমি দেখিনি। তার চেয়েও বড় কথা, রুদ্রের ইচ্ছে যদি শুধু তোমার শরীরেই আটকে থাকতো তাহলে বিয়ে করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। যখন তখন তোমাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ওর যা খুশি করতেই পারতো। সেই ক্ষমতা ওর আছে। কিন্তু ও তোমাকে বিয়ে করেছে। এখনো কোনো প্রকার জোর তোমাকে করেনি। তবুও কেন এসব সন্দেহ করছো তুমি?”
অপরাধবোধে ভুগছে সুরভী। রুদ্রও সকালে বলে গেল একই কথা। তবুও শুনতে ইচ্ছে হলো না, বুঝতে ইচ্ছে হলো না। কেন? রুদ্র ওভাবে ধরে নিয়ে বিয়ে করেছে তাই?
— “একজন পুরুষের বিবাহিতা স্ত্রী তুমি। তাছাড়া নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। হয়তো তোমার প্রতি রুদ্রের আগ্রহের কারণটা অসম্ভব রকমে অদ্ভুত। কিন্তু হয়ে গেছে সেটা, কিছু করার তো নেই! রুদ্র কিন্তু অন্যায় কিছু করেনি তোমার সঙ্গে। হ্যাঁ বিয়েটা হয়তো জোর করে করা উচিত হয়নি। কিন্তু ও তোমাকে ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করবে। ও তোমাকে কাছে পেতে চায় এটা ভুল না। লজিক্যালি ভেবে দেখো একবার, ওর চাওয়ায় অন্যায় কিছু তো নেই। তুমি নিজেও কি ওর কাছাকাছি যেতে পছন্দ করো না? হয়তো মুখে বলো না, কিন্তু ওর সান্নিধ্য তোমারও প্রিয়। একটুও কি দুর্বলতা তুমি খুঁজে পাও না ওর মাঝে?”
— “পাই।”
— “তাহলে কেন উল্টাপাল্টা ভেবে নিজে কষ্ট পাচ্ছো, ওকেও দিচ্ছো? ও তোমার কাছে আশ্রয় চায় সুরভী। ও চায় যখন ওর মন খারাপ হবে, রাগ হবে, অস্থির হবে তখন তুমি ওকে সামলে নাও, আগলে রাখো। ও তোমার উপর নির্ভর হতে চায়। তোমার ভালোবাসা চায়। অনেক আশা নিয়ে ও তোমাকে আপন করেছে সুরভী। ওর বাবার পর এখন তুমিই আছো যাকে ও ভরসা করে নিজেকে ভেঙেচুরে সঁপে দিতে চায়। ওকে তোমার কাছে আশ্রয় দিও, সামলে নিও প্লিজ!” ফেরদৌসীর চোখে চোখ তুলে তাকালো সুরভী।
মুচকি হেসে বললো,
— “নিবো।”
— “কী করবে এখন? কল করবে ওকে?”
— “হ্যাঁ।”
— “না। দূরে থাকো একটু। দুই চারদিনের একটা গ্যাপ ভীষণ প্রয়োজন আপাতত। ছোটখাটো দূরত্ব মাঝেমধ্যে আমাদের সম্পর্ক আর মানুষটার গুরুত্ব বোঝায়। ভালোবাসা, টান আরো গাঢ় হয়। গুরুত্ব বুঝে গেলে ভুলভাল ভাবনা মাথায় আসে না।”
— “কিন্তু আমার যে খারাপ লাগছে!”
— “লাগতে দাও। যখন মনে হবে আর পারছো না তখন কল দিও।”
— “উনি আমার সঙ্গে কথা বলবে তো?”
— “বোকা মেয়ে! কেন বলবে না? ও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে নাকি! সময় হলে নিজেই ছুটে আসবে তোমার কাছে। দূরত্বের পর কাছে আসাটা কিন্তু ভীষণ সুন্দর হয়। তোমাদেরও হবে। সম্পর্ক নতুন মোড় পাবে। দেখে নিও তুমি।”
৩৬
‘সাবেক সড়ক মন্ত্রী মতিউর রহমান হত্যা মামলায় মডেল সিনথিয়াকে তার মানসিক অবস্থা বিবেচনায় বেকসুর খালাস করেছে উচ্চ আদালত।’
টিভি চলছে। প্রতিটি চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট চলছে আদালত প্রাঙ্গন থেকে। মতিউর হত্যার সমস্ত আলাপ-আলোচনা আজ থেকে এখানেই থেমে যাবে। প্রচন্ড ক্ষোভে টিভি অফ করলো হাবিব। হসপিটালে আজগরের পাশে বসে আছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আজগর।
— “মতির সঙ্গে যখন আমার আলাপ হয় তখন বয়স একেবারে কম। আরো ৩২ বছর আগের গল্প। কতকিছু করলাম একসঙ্গে। আরো কত কী করার ছিল একসঙ্গে। সব শেষ!”
— “আস্ত একটা মানুষ গিলে খেয়ে নিলো শালা! এক মাসের মধ্যে কেইস ডিসমিস।”
— “রুদ্রকে ভাঙার সময় হয়েছে।”
— “তাকেই ভাঙা যায় যার দুর্বলতা আছে। ও তো মানুষই না, দুর্বলতা আসবে কোথা থেকে?”
— “অমানুষ যে মজনু হয়ে গেছে সে খবর রাখো?”
— “মানে?”
— “এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে, জোর করে সেই মেয়েকে বিয়ে করেছে। মাথায় করে রাখে বউকে। বউ ছাড়া ও অন্ধ!”
— “বিয়ে করেছে! কিছুই তো শুনলাম না। আপনি জানেন কেমন করে? “খোঁজ রাখতে হয় হাবিব। শত্রু সেকেন্ডে কয়টা নিঃশ্বাস নিলো সেই খোঁজ রাখতে হয়। নয়তো শত্রু গিলে খায়।”
হেরে যাবার তীব্র হতাশা ক্রমশ গিলে খাচ্ছিল হাবিবকে। আজগরের কথায় একটুখানি আশার আলো মিললো বোধহয়! নড়েচড়ে বসলো সে।
— “নেক্সট টার্গেট ওর বউ?”
— “দেখা যাক!”
সকালের নাস্তা আজ সময়মতো করা হয়নি। শুধু আজ কেন? ঢাকা ছাড়ার পর থেকেই খাবারে অনীহা! গতকাল থেকে একেবারেই আর গলা দিয়ে কিছু নামছে না। দেড়টার দিকে শুভ এক প্রকার জোর করেই ধরে এনে খাবার টেবিলে বসিয়েছে। সামনে প্রিয় সব খাবার। অথচ কিছু মুখে তুলতে ইচ্ছে হলো না তার। খাবার ফেলে আবারও উঠে গেল সে। এভাবে তাকে দেখতে আর ভালো লাগছে না শুভর। চাইলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, কেন অযথা জেদ করে তা ঝুলিয়ে রাখছে ভেবে পেলো না সে। কষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে মানুষটা, তবুও জেদ ছাড়ছে না। ওদিকে বউটাও হয়েছে একই। ঝগড়ার কারণ তার জানা নেই। তবুও যাই হোক, একটা কল তো অন্তত করতে পারতো! ওপাশের একটা কলেই সব সমাধান হয়ে যেত তৎক্ষণাৎ।
উপায়ন্তর না পেয়ে রুদ্রকে বাড়ি ফেরার কথা নিজেই বললো সে,
কী এক জেদ নিয়ে পড়েছেন! এভাবে খাওয়া-ঘুম সব ছেড়ে দিয়ে কতদিন আর সুস্থ থাকবেন? ভালো লাগছে না এভাবে। ঢাকায় চলুন।”
সুরভীকে ছাড়া আজ এই চতুর্থদিনে নিঃশ্বাস আটকে আসছে রুদ্রের। সিনথিয়ার জামিন হয়ে গেছে এই নিয়ে বিন্দুমাত্র আনন্দও অনুভব হচ্ছে না তার। ধূসর লাগছে সবকিছু। সামনে মেয়র ইলেকশন। অনেক প্ল্যানিং, কাজ মাথার উপর। কিচ্ছু হচ্ছে না তাকে দিয়ে। খাওয়া, ঘুম সব এলোমেলো হয়ে আছে ওকে ছাড়া। এভাবে আর এক মুহূর্তও না! সুরভীকে সে ভালোবাসে এর চেয়ে সত্যি এই জীবনে আপাতত আর কিচ্ছু নেই। সুরভীকে এই বুকে তার চাই, এক্ষুনি চাই। এই চাওয়ার চেয়ে বড় আর কোনো চাওয়া এই মুহূর্তে তার নেই।
শুভকে ডাকলো সে,
— “টিকিট বুক করো। বাসায় ফিরবো আমি।”
৩৭
দুপুরের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরলো রুদ্র। বাড়ির সদর দরজা খুলতেই সে দেখলো সুরভী ড্রইংরুমে। কাজের লোকেরা লাইন ধরে সব দাঁড়িয়ে আছে। সুরভী কী যেন বলছে ওদের। এটা বসার ঘর, কাজের লোকেরা এখানে, বসার ঘরের চার কোণায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো, সিকিউরিটিরা ক্যামেরায় বসে এই ঘরের সমস্ত কিছু দেখছে সেসব কিছু ভাবতে ইচ্ছে করলো না রুদ্রের। একটা চুমুর তৃষ্ণায় প্ৰতি মুহূর্তে খুন হচ্ছে সে। ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে, কাজের লোকদের ঠেলে সুরভীর কোমর দু’হাতে চেপে ধরলো সে। হঠাৎ রুদ্রের চলে আসা, এভাবে আঁকড়ে ধরায় খানিকটা আঁতকে উঠলো সুরভী। ওর চোখে চোখ রেখে কাতর হয়ে রুদ্র বললো,
— “ভালোবাসি কি না জানতে চেয়েছিলে না?”
— “… … … … … …”
— “আমাকে পুঁড়িয়ে মারছো তুমি। সাতটা দিনও পার করতে পারিনি আমি। কী অসহ্য যন্ত্রণা! উফ্! জ্বরের মতো মাথায় চড়ে বসেছো আমার। রুদ্র ভালোবেসে পুঁড়ে মরছে!”
ঝড় আসার পূর্বাভাস শুভ টের পেল। রুদ্র সজ্ঞানে নেই। লোকলজ্জার বালাই নিয়ে ভাবার মতো বোধটুকুও নেই তার। মানুষটা রীতিমতো মরছে তার ব্যক্তিগত নারীর জন্য। কাছে টেনে নেয়ার এই পর্ব আরো গভীরে যাবার আগেই উপস্থিত সব কর্মচারীদের তুড়ি বাজিয়ে সরে যেতে ইশারা করলো শুভ। সদর দরজা আটকে নিজেও দাঁড়িয়ে রইলো বাড়ির বাইরে রুদ্রকে এভাবে এত কাছে পেয়ে খানিকের জন্য ঘোর লেগেছিল সুরভীর। ঘোর কাটতেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে চাইলো সে রুদ্রকে। তার আগেই সুরভীর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গোটা সুরভীকেই যেন শুষে নিতে চাইলো সে। যেন বহু জনমের তৃষ্ণা মেটানোর সুযোগ নাগালে এল! পুরোদমে সায় এল সুরভীর কাছ থেকেও। উল্টো পায়ে শোবার ঘরের দিকে যাচ্ছে সুরভী। রুদ্র এখনো ছাড়েনি ওকে। দু’হাতে কোমর, ঠোঁটে ঠোঁট বন্দী করে রেখেছে এখনো। ওভাবেই এক পা, দু’পা করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে নিজ ঘরে।
নিজেকে আজ বিলীন করে দেবার তীব্র নেশা দু’জনকেই পেয়ে বসেছে। ঘরে এসেই বিছানায় সুরভীর গায়ে নিজের গা এলিয়ে দিলো রুদ্র। দরজা খোলা, পর্দা বন্ধ করা হয়নি সেদিকে খেয়াল নেই কারো। বুকের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে সুরভীর গলায়, কাঁধে অবিশ্রান্ত চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে রুদ্র। সুরভীর তরফ থেকে কোনো বাঁধা নেই, আপত্তি নেই। সাদরে গ্রহণ করছে সে সবটা। রুদ্রকে কাছে পাবার, প্রাণ ভরে ওর গায়ের ঘ্রাণ নেয়ার আকাঙ্ক্ষা যে গিলে খাচ্ছিলো তাকেও!
হঠাৎ থেমে গেল রুদ্র। সুরভীর গলায় মুখ গুঁজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলো সে। এভাবে থেমে যাবার কারণ খুঁজে পেলো না সুরভী। দরজা, জানালা খোলা তাই? নাকি অন্যকিছু? এক মুহূর্ত বাদে রুদ্র ফিসফিসিয়ে বললো,
— “স্যরি!”
— “কেন?”
— “অনেকদিন পর কাছে পেয়েছি তোমাকে। মাথা ঠিক ছিল না। কী থেকে কী করে ফেলছি, নিজেও বুঝিনি!”
সুরভীকে ছেড়ে উঠে গেল রুদ্র। বিরক্তি ধরে এল সুরভীর। ভালোমানুষির একটা সীমা থাকা উচিত! বোকামিরও! এই লোক কি একদম অবুঝ? সম্মতি আছে কি নেই একদম বোঝে না? মুখ ফুটে বলতে হবে এখন?
৩৮
বাসায় ফেরার পর থেকে রুদ্র আজ সুরভীর পিছুই ছাড়ছে না। সমস্ত কাজ ফেলে, ফোনের সুইচ অফ করে পড়ে আছে সুরভীর পেছনে। বেশ লাগছে সুরভীর। কানের কাছে রুদ্রের অকারণ ফিসফিসিয়ে কথা বলা, খোলা চুল আঙুলে পেঁচিয়ে ওকে কাছে টেনে নেয়া, ঠোঁটে গলায় খানিক পর পর ছুঁয়ে দেয়া সবকিছুই যেন কেটে যাচ্ছে সুখ-ঘোরের মাঝে। মা ঠিক বলছিলেন, রাগের পর ফিরে আসার মুহূর্তটা অসাধারন হয়!
সুরভীর কানে নাক ঘষলো রুদ্র। সুরসুরিয়ে উঠলো কানের চারপাশ। ঘাড় হেলিয়ে কাঁধে কান আড়াল করতে চাইলো ও। পারলো না। রুদ্র কোনোভাবেই মুখ সরালো না। নিচু স্বরে বললো,
— “চলো গায়ে একটুখানি কুয়াশা মেখে আসি।”
— “কোথা থেকে?”
— “ছাদে।”
ছাদের এককোণায়, খুঁটি বেয়ে উপরে লতাপাতা ছড়িয়েছে নীল অপরাজিতার গাছটা। সুরভীর চোখে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে রুদ্র। ওর চোখের দিকে নজর নেই সুরভীর। সমস্ত মনোযোগ রুদ্রের সিগারেটের ধোঁয়ায়। কুন্ডলি পাকিয়ে কেমন মেঘের মতন করে উপরের দিকে ভাসছে, তারপর বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে একবার ধরতে চাইলো ও। হাসলো রুদ্র।
— “ধোঁয়া কখনো নাগালে আসে?”
— “উঁহু। তবুও ধরতে ইচ্ছে হলো একটু! ভালো লাগছে দেখতে।”
— “তুমিও নাগালে আসো না। তবুও পেতে ইচ্ছে হয়, ভালোবাসি তাই।”
রুদ্রের চোখে তাকালো সুরভী। কী গভীর চাহনিতে চেয়ে আছে মানুষটা! চোখের সমস্তটা মাদকতায় আচ্ছন্ন। কাছে পাবার তীব্র নেশা রুদ্র চাহনীতেই স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে।
— “আমাকে তোমার মনে পড়েনি সুরভী?”
— “ভীষণ!”
— “একটা কল কেন করলে না?”
— “দেখতে চাইছিলাম আপনাকে ছাড়া কতখানি যন্ত্রণা হয় আমার। বুঝতে চাইছিলাম যন্ত্রণার কারণ কী?”
— “খুঁজে পেলে?”
— “পেলাম।”
— “কী?”
— “সব বলে দেবো না। থাকুক আরো কিছুক্ষণ গোপন।”
— “আর কত?”
— “দেখা যাক!”
সুরভীর রহস্যে হাসলো রুদ্র। উত্তর তার জানা। তবুও সে চায় সুরভী তার চোখে চোখ রেখে নিজে সে কথা জানাক।
সুরভী যেখানে দাঁড়িয়ে তার ঠিক পেছনেই অপরাজিতার গাছ। খুব কাছাকাছি ঝুঁকে, ওর পেছন থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিলো রুদ্র। আঙুলের ভাঁজে অপরাজিতা রেখে, তার রন্ধ্রে জ্বলন্ত সিগারেট ঢুকিয়ে বললো,
— “সুরভী?”
— “হুম?”
— “তোমার অপরাজিতায় আমার অধিকারটুকু দেবে আমাকে?”
গোটা শরীরে সুখময় শিহরণ দোলা দিয়ে উঠলো সুরভীর। লজ্জা, সংকোচ কিছুই আর বাঁধা হলো না ওর সামনে।
দু’পা সামনে এগিয়ে, রুদ্রের কলার চেপে সুরভী বললো,
— “মুখে সবকিছু বলে দেয়া জরুরি? বোঝেন না কিছু?”
— “বুঝি। তবুও তোমার মুখ থেকে জানতে চাই!”
— “দিলাম অধিকার।”
— “আজ?”
— “এখনই।”
এক মুহূর্ত দেরী করলো না রুদ্র। হাতের সিগারেট নিচে ফেলে, পায়ে পিষে আগুন নিভিয়ে সুরভীর হাত ধরে নিজের ঘরে চললো সে কামনার আগুন মেটাতে!
৩৯
আজ প্রথম মিলনের রাত। নেই কোনো জাঁকজমক, কিংবা ফুলসজ্জা। বিশেষ কোনো ছোঁয়াও নেই সুরভীর অঙ্গসজ্জায়। বাসায় পরনের জামা, পাঞ্চক্লিপের বাঁধন পেরিয়ে বেরিয়ে আসা অবাধ্য কিছু চুল, লিপবামে ভেজানো হালকা তেলতেলে ঠোঁট; এই-ই যেন রুদ্রের কাছে হুরের চেয়েও ঢের! একান্ত নিজস্ব রূপেই সুরভী তার কাছে বহু আরাধ্য, যাকে দেখলে কাম আর ভালোবাসা দু’টো একসঙ্গে ঘাড়ে চেপে বসে।
দরজা আটকে ধীর পায়ে সুরভীর কাছে এগিয়ে এল রুদ্র।
রুম হিটার চালু করে সুরভীকে বললো,
— “আমার গায়ের গেঞ্জিটা খুলে দাও।”
আজ আর কোনকিছুতেই আটকাবে না সুরভী, না রুদ্রকে বাঁধা দেবে। শেষ চারদিনে রুদ্রের অনুপস্থিতিতে ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই লোকটাকে ওর চাই। পুরোপুরি নিজের করে চাই। ভালোবাসা কিংবা গভীর ছোঁয়া অথবা গাঢ় চুমুতে ঠোঁট জোড়া শুষে নেয়া সবকিছু বড্ড ভুগিয়েছে রুদ্রের না থাকা শেষ ক’টাদিন। বুকের মাঝে বড্ড তৃষ্ণা জমেছিল তার ভালোবাসা ফিরে পাবার, এই শরীরে তার স্পর্শ পাবার। সারাদিনে রুদ্রের বারবার কাছে এসেও ফিরে যাওয়া যেন সেই চাওয়াটাকে আরো তুঙ্গে তুলে ছেড়েছে। কোনো দ্বিধা সংকোচই আর তার মাঝে ঠাই পাচ্ছে না। ঠাই পাচ্ছে রুদ্র। শুধুমাত্র রুদ্র আর তাদের ভালোবাসা। সামনে দাঁড়ানো এই পুরুষটা তার। শুধুমাত্র তার। আজ নিজের সমস্তটা বিলিয়ে দেবার, ব্যক্তিগত পুরুষের সবটা আদায় করে নেবার রাত!
একটানে রুদ্রের গেঞ্জি খুলে নিলো সুরভী। ওর ঘনঘন নিঃশ্বাস স্পষ্ট রুদ্রকে জানান দিচ্ছে নিজেকে সঁপে দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত ও। অধিকার নিয়ে সুরভীর গা থেকে ওড়না সরালো রুদ্র। তারপর খুলে নিলো ওর জামা। গলা থেকে পেট অব্দি নজরে ওকে গিলে খাচ্ছে রুদ্র। ডান স্তনের উপর অংশের ছোট্ট তিল, নাভির কাছে বাদামী জন্ম জড়ল কিংবা বাহুতে কাটা দাগ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম দাগ, আঁচড়ও রুদ্রের চোখের আড়াল হচ্ছে না। আজ এই মুহূর্তে সুরভীর ঠোঁট নিজের দখলে নিতে চাইলো না রুদ্র। আঙুলের উল্টোপিঠে সুরভীর থুতনি, ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে দাবি করলো অন্যকিছু।
— “ওয়ান্না লাভ ইউর ইচ স্কারস এ্যান্ড মোলস ফার্স্ট!”
সুরভী চোখ বুজে অপেক্ষায় রইলো গায়ের প্রতিটা তিলে, দাগে রুদ্রের ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করতে। এক হাতে সুরভীর কোমর পেঁচিয়ে অন্যহাতে সুরভীর পায়জামার ফিতা খুলে দিলো রুদ্র। ফ্লোরে পড়ে রইলো তার নিম্নাঙ্গের বস্ত্র। খুঁজে খুঁজে প্রতিটা দাগে, তিলে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে রুদ্র। প্রথমে বাহুর দাগ থেকে ঘাড়ের বসন্তের দাগে, তারপর স্তনের উপর, আর তারপর নাভির পাশে; ধীরে ধীরে তার ঠোঁট নেমে এল উরু আর হাঁটুতে। প্রতি চুমুতে কেঁপে কেঁপে উঠছে সুরভী। গায়ের টাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকা বড্ড দায় হয়ে গেছে। দেয়ালের সাহায্য নিতেই সুরভীকে টেনে নিজের বাহুবন্দী করলো রুদ্র। গলায়, কাঁধে চুমু দিতে দিতে বিছানায় উপুড় করে শুইয়ে দিলো ওকে। পিঠে, কোমরে, পায়ে কোথায় কোন দাগটা, কোন তিলটা বাকি রয়ে গেল, তা খুঁজতে লাগলো সে। পুরো শরীরজুড়ে অভিযান শেষে রুদ্র ফিরে এল সুরভীর মুখোমুখি। অধর চুমুতে সুরভীকে মাতাল করে ধীরে তার হাতজোড়া নিয়ে গেল সুরভীর পিঠে। রুদ্রের চাওয়া বুঝতে পারলো সুরভী। পিঠ খানিকটা উঁচিয়ে ওর কাজ আরেকটু সহজ করে দিলো। ব্রায়ের হুঁক খুলে সে ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। পেট, কোমর ছুঁয়ে তার হাত নেমে এল নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাসে। কালবিলম্ব না করে ফ্লোরে ছুঁড়ে দিলো সেটাও। সুরভীকে ছেড়ে উঠে এল রুদ্র। কোনো নগ্ন নারী শরীরের অভিজ্ঞতা তার ছিল না কখনো। আজই প্রথম! মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে। এ তো শুধু শরীর নয়, যেন শ্রেষ্ঠ কবির হাতে লেখা কোনো কাব্য! সুরভীর পাশে, কনুইয়ের উপর ভর করে মাথা রাখলো রুদ্র। অন্য হাতের আঙুলগুলো আপনমনে খেলছে সুরভীর নাভি বিবরে। সুরভীর চুলগুলো ফুঁ দিয়ে কপালের উপর থেকে সরিয়ে দিলো রুদ্র। ঠোঁটের কোণে ওর লাজুক হাসি। মুখ ফিরিয়ে, চোখ বুজে রেখেছে ও। কানের পাশে চুমু খেল রুদ্র।
আদুরে কণ্ঠে ডেকে বললো,
— “এভাবে চোখ বুজেই থাকবে তুমি? এত সুন্দর মুহূর্তটা নিজে চোখে না দেখলে স্মৃতির ঝুলিতে রাখবে কী?”
চোখ মেলে তাকালো সুরভী। প্রতিটা সেকেন্ড মনে-প্রাণে ওকে সুখী করছে তা যেন ওর পুরো চেহারা জুড়েই স্পষ্ট হয়েছে! আঙুলগুলো আর নাভি বিবরে নেই। সেই সীমানা ছেড়ে, একটু একটু করে উঠে এসেছে বুকে। স্তনবৃন্তের আশপাশটা আলতো ছুঁয়ে দিতে দিতে সে বললো,
— “ঠিক যেন সূর্যমুখী!”
সুরভীর চোখে চেয়ে রইলো রুদ্র অনেকটা সময়। আরো কাছে পাবার, সর্বোচ্চ গভীরে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করার কামনা ওর চোখে ফুটে উঠেছে। সুরভীর চাহনীতে প্রশ্রয় পেয়ে সাহস বাড়লো রুদ্রের। আলতো ছোঁয়া বদলে গেল শক্ত মুঠোর পেষনে। ওর কানে নাক-মুখ ঘষে রুদ্র বললো,
— “যদি আমি এখন মৌমাছি হই?”
সুরভীর জবাবের অপেক্ষা করলো না রুদ্র। মুখ ডোবালো সুরভীর বুকে। মৃদু শিৎকারে রুদ্রের চুল নিজ মুঠোয় টেনে ধরে রইলো সুরভী।
পৃথিবীতে সে বুঝি আর নেই! সুখের ভেলায় ভাসিয়ে রুদ্র তাকে নিয়ে গেছে স্বর্গে কিংবা স্বর্গ নেমে এসেছে চার দেয়ালের এই কামড়ায়! রাত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সুখ। এই রাতটা আর না ফুরোক। এই স্বর্গ সুখের মুহূর্ত শেষ না হোক। এই চার দেয়ালে বন্দী হয়ে, একান্ত রুদ্রের হয়ে কেটে যাক অনন্তকাল!