রুদ্র – ৩০

৩০

শ্বশুরবাড়ি থেকে আজ বউ নিয়ে ফিরেছে রুদ্র। আয়োজনে কোনো কমতি তারা রাখেনি, বরং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই মনে হলো রুদ্রের। মেয়ে তো নিয়েই এসেছে তাদের, এবার সারাজনমে একগ্লাস পানি না খাওয়ালেও কখনো মনে হবে না কেন তাকে শ্বশুরবাড়িতে একগ্লাস পানি কেউ সাধেনি? তবে সুরভীটা কি একটুখানি বদলেছে? মনে হচ্ছে তেমনই। এই বাড়িটা, তার মাকে আর তাকে সহজভাবে মেনে নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা ফিরেই মায়ের ঘরে চলে গেল, এখনো ফেরেনি। মাঝে একবার মায়ের ঘর থেকে ওর হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছিল রুদ্র। কী নিয়ে হাসছে জানা নেই তার। কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই উঠে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এদিকেও এসেছিল মাঝে দু’বার। প্রথমবার এল, কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে। পরেরবার এল, কিছু লাগবে কিনা জানতে। তাতেই যেন সব পাওয়া হলো রুদ্রের। লোকে শুনলে হয়তো বলবে, এইসব সাধারণ খোঁজে এতখানি খুশি হওয়ার কী আছে? কিন্তু তাদের কে বুঝাবে, সুরভী চোখ তুলে তাকালেই ভালো লাগে। সুরভী নিজ থেকে কিছু বললেই জাদু মন্ত্রের মতোন লাগে। ওর মুখটা কল্পনায় ভাসতেই অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো রুদ্রের। ল্যাপটপ বন্ধ করে সে চললো মায়ের ঘরে।

*****

সিনথিয়ার হাতে মাংস কাটার চাপাতি। ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে আছে ও। হাঁপাচ্ছে। গাল, গলা বেয়ে ঘাম ঝরছে। শীতল চোখে তাকিয়ে আছে মতির দিকে। রক্তের মাঝে পড়ে আছে তার দেহ। শেষ নিঃশ্বাস যাই যাই করছে। আবারও দ্বিগুন ক্রোধে উঠে এল সিনথিয়া। বুক বরাবর অনবরত কোপাতে থাকলো সে, “মর তুই। মর! মর!”

*****

মায়ের ঘরে বসে স্ত্রী আর মায়ের গল্প শুনছিল রুদ্র। তবে শোনার চেয়ে দেখছে বেশি সুরভীকে। আজ দুপুরে সেজেছিল ও। বাসায় ফিরে সাজ ধুয়ে ফেলার সময় কাজল চোখে লেপ্টে গেল। লেপ্টানো কাজলে দারুণ লাগছে ওকে। খোলা চুলগুলো বারবার কানের পাশ ছেড়ে মুখের উপর এসে পড়ছে। নিজ হাতে সরিয়ে দেবার ইচ্ছে হলো কয়েকবার। চাইলেই ওর পাশে বসে ওর গালে, কানে আঙুলের ছোঁয়া লাগিয়ে চুলগুলো গুঁজে দেয়া যায়, কিন্তু রুদ্র তা করবে না। সবসময় কাছে যেতে নেই। কখনো সৌন্দর্য ছোঁবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দূর থেকে দেখার মাঝে এক বর্ণনাতীত মুগ্ধতা থাকে।

কল এল রুদ্রের। শুভ করেছে। মা আর স্ত্রীর গল্পে হাসছিল সে-ও। হাসতে হাসতেই ফোনটা ধরলো,

— “হ্যাঁ শুভ?”

ক্রমশ হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে রুদ্রের। সুরভী আর ফেরদৌসী দেখলো রুদ্রের হাসি মিলিয়ে যাওয়া। নিশ্চুপ তারা চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে।

— “আলতাফ হাশিমি সিনথিয়াকে ডিফেন্ড করবে। কথা বলো তার সঙ্গে।”

মায়ের ঘর ছেড়ে উঠে চলে গেল রুদ্র।

ফেরদৌসী নিচুস্বরে সুরভীকে বললেন,

— “ওকে দেখো! যাও।”

শাশুড়ীর ঘর থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে কোথাও দেখতে পেলো না সুরভী। তাদের ঘরেও নেই। স্টাফদের জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল রুদ্র ছাদে গেছে। সুরভীও দৌড়ে ছাদে উঠলো। এক কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে সে। পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখলো সুরভী। পেছন ফিরলো না রুদ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরভীর হাতটা চেপে ধরলো।

— “কী হয়েছে?”

— “যা প্ল্যান করেছিলাম উল্টে গেছে।”

— “খুব এলোমেলো হয়ে গেছে? গোছানো সম্ভব না?”

পেছন ফিরলো রুদ্র। সুরভীর চুলগুলো ঘাড়ের পেছন থেকে ধীরে সামনে এনে দিতে দিতে বললো,

— “সম্ভব! রুদ্রের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই।”

— “তাহলে অস্থির কেন লাগছে আপনাকে?”

— “কাছে থাকো আমার।”

— “আমি থাকলে স্বাভাবিক লাগবে সব?”

— “হ্যাঁ।”

— “আছি।”

সিগারেটের ধোঁয়া বেরিয়ে এল রুদ্রের নাক, ঠোঁট ভেদ করে। দু’জনের মাঝে সাদা ঘোলাটে ধোঁয়া উড়ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো যেন আরো আবছা হলো। তবুও সুরভী দেখতে পাচ্ছে রুদ্রের চোখ। কী এক বিষণ্ণতা তার দু’চোখ জুড়ে! ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো রুদ্র। সুরভীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

— “আমার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়াবে? ভালো লাগবে আমার।”

রুদ্রের হাত জড়িয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো সুরভী। পাশাপাশি দু’জনে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। নিশ্চুপ। হাতের সিগারেটটা তখনও ফুরোয়নি। বড্ড সময় নিয়ে ফুঁকছে সে। খানিক সময় বাদে, তর্জনী আর মধ্যমার ভাঁজে সিগারেট রেখে, অনামিকা আর কনিষ্ঠায় সুরভীর চুল কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বললো,

— “তুমি একটা ঘোর সুরভী। আমাকে ডুবিয়ে ফেলো তুমি। আমার খারাপ মুহূর্তে, তুমি আমার গা ছুঁয়ে থাকলে নেশা নেশা লাগে আমার। মনে হয় কোথায় ভেসে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি।”

কিছু বললো না সুরভী। চোখ বুজে কানের পাশে রুদ্রের স্পর্শ, রুদ্রের কথা অনুভব করছে ও।

রুদ্রের আঙুল কানের পাশ ছেড়ে সুরভীর গালের উপর বিচরণে ব্যস্ত। আরেকটুখানি মাতাল স্বরে সুরভীকে ডাকলো রুদ্র,

— “সুরভী …”

— “হুম?”

— “ভালোবাসি।’

৩১

— “দলের পুরোনো সদস্য। দলে নেই যদিও, তবুও প্রবীন নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা তো ছিলই। আলতাফ হাশিমি যার-তার কেইস লড়ে না। শিল্পপতি, পলিটিশিয়ানদের সুপারিশ ছাড়া এসব মডেল, অভিনেত্রীদের কেইস ও লড়বে না, প্রত্যেকে জানে। যতই চাপিয়ে রাখতে চাও না কেন, খবর জানাজানি হবেই সিনথিয়ার জন্য আলতাফকে তুমি হায়ার করছো। আবার দলীয় কোন্দল শুরু হবে।”

— “এই খবর আপনি, আমি, শুভ আর হাশিমি ছাড়া আর কেউ জানে না। হাশিমি মুখ খুলবে না, শুভও না। বাকি রইলেন আপনি। দলে খবরটা আপনি প্রচার করবেন?”

বিরক্ত হলেন ইকবাল মাহমুদ। বেশ অভিমান জড়িয়ে ইকবাল মাহমুদ বললেন,

– “তোমার বয়সী ছেলেটা আমার মরে গেছে। আমার বয়সী তোমার বাপটা মরেছে। তোমাকে দেখলে আমার ইমতিয়াজের কথা মনে পড়ে। তোমাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসি। অথচ তুমি খোঁচাতে ছাড়ো না। কেমন করে বললে আমি তোমার খবর প্রচার করবো?”

ইকবাল মাহমুদের অভিমানে হেসে ফেললো শুভ আর রুদ্র।

সিগারেটটা অ্যাশ ট্রেতে ফেলে ইকবাল মাহমুদের কাঁধ জড়িয়ে বললো,

— “বয়স হয়ে যাচ্ছে আপনার। বুড়োদের মতো আবেগী আর অভিমানী হয়ে যাচ্ছেন দিনদিন।”

— “ভেবেছিলাম বিয়েশাদী করিয়ে দিলে, মেয়ে লোকের ছোঁয়া লাগলে চ্যাটাং চ্যাটাং কথার ধাতটা বদলাবে। একটু নমনীয়তা, সভ্যতা ফিরবে। হলো না! বিয়েটাই বৃথা মনে হচ্ছে এখন।”

— “আপনার এই মুখে মুখেই আমাকে যত ছেলে ভাবা। আসলে তো ভাবেন না আপনি! বউ নিয়ে এসেছি পর একবারও আন্টি আর ইরা, নীরাকে নিয়ে গেছেন বাসায় বউ দেখতে?”

— “যা একটা ঝামেলা করে বউ আনলে! মেয়েটার স্বাভাবিক হতেও তো সময় লাগবে। তার উপর দলবেঁধে ওকে দেখতে গেলে কেমন না! ইরা, নীরা তো শুনেই বলেছিল দেখতে যাবে। মিসেস আর আমিই বারণ করলাম।”

— “সব ঠিক আছে। সময় করে ওদের নিয়ে যাবেন নয়তো ওদের পাঠিয়ে দেবেন। “ – “তা দিবো। কিন্তু দলে আপাতত ঝামেলা চাচ্ছি না। কী দরকার ছিল ঐ

মেয়েটার পক্ষ নেবার? মতি মরে গেছে, শেষ তো লেনদেন। ঐ মেয়ে ওর মতন ফেঁসে জেলে যাবে। ব্যস!”

— “মেয়েটা প্রেগন্যান্ট।”

— “এমন অহরহ প্রেগন্যান্ট আছে জেলের ভেতর।”

ইকবাল মাহমুদের নরম সুরে বিরোধিতা ভালো লাগছে না রুদ্রের। ভ্রু কুঁচকানো চেহারা দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। খানিকটা কর্কশ হলো সে,

— “আছে। কিন্তু সিনথিয়ার হিসেব ভিন্ন। মতি আর সিনথিয়ার মাঝে আমি জড়িয়ে গেছি। মতি সম্পর্কে কিছু না জানালে আজকে এই খুনটা সিনথিয়া করতো না। হয়তো ও মরে যেত। কিন্তু এই অবস্থায় জেল তো আর খাটা লাগতো না।”

— “তা হিসেব ঠিকই আছে তোমার।”

— “আরো হিসেবও আছে এখানে।”

— “কী?”

— “আগেই বলে নিচ্ছি ভীতুর মতো আচরণ করবেন না। আপনি আজকাল

কোনোভাবেই দক্ষ রাজনীতিবিদের মতো আচরণ করছেন না। এভাবে চলবে না আংকেল।”

— “সবে দল ক্ষমতায় এসেছে। এখনই দলীয় কোন্দল ভালো হবে না। তাই এত ভাবি।”

— “বিশ্বাস করেন না আপনি আমাকে?”

— “অবশ্যই করি।”

— “মতিকে নিয়ে আমার প্ল্যান ছিল ওকে মার্ডার মামলায় ফাঁসিয়ে ওর সমস্ত রেইপ কেইস, দুর্নীতি টেনে আনবো। ওর ম্যাক্সিমাম চ্যালারা নারীঘটিত কেলেংকারীতে জড়িত। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মতির এলাকায়, ওর ছত্রছায়ায়। সব কয়টাকে জেলে ঢুকাতাম, কয়েকটাকে ক্রসফায়ারে দিতাম। ক্রাইমের উপর সেটা ডিপেন্ডেবল ছিল। টাকা-পয়সা নিয়ে দুর্নীতি পর্যন্ত মানা যায় আংকেল। বাট রেইপ? নেভার! মতি, হাবিব আর আজগর এই তিনজন মিলে দলের যা কলংক করেছে তা ওদের মরণ ছাড়া সাফ সাফাই হওয়া সম্ভব না। রাঘব বোয়াল মেরে হজম করতে বেগ পেতে হতোই। তাই কিছু করছি না। নয়তো কিছু কীট পতঙ্গ দুনিয়া থেকে মুছে ফেলাই ভালো। চুনোপুঁটিগুলোকে কিছু একটার জেরে গিলে ফেলা যাবে। তাই আপাতত টার্গেট ওরাই। দলের জন্য যতদিন খেটেছে, ততদিন আমরাও ওদের পুষেছি। কিন্তু দলের নাম ভাঙিয়ে কুকর্ম করে বেড়াবে, তারপর ইলেকশনে গিয়ে নাকানিচুবানি খেতে হবে আমাদের, তা হবে না। স্ট্রেইট গায়েব করে ফেলা হবে সব। এবারের ইলেকশন আপনার আমার জন্য শিক্ষা ছিল। কেমন বেগ পেতে হয়েছে সিট দখল দিতে, তা আশা করি ভুলবেন না আর ভবিষ্যতে সেভাবেই এগিয়ে যাবেন।”

— “তা ভুলি কেমন করে!’

— “এটাই মনে রাখতে হবে আংকেল। সিস্টেম বদলানো সম্ভব না। চুরি, দুর্নীতি সব হবে, তবে অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে। কোনো প্রমাণ থাকা চলবে না কোনোভাবেই। যার কারণে দলের উপর বাজে প্রভাব পড়বে তাকেই সরিয়ে দিতে হবে। হয় জেলে, নয়তো নির্বাসনে, নয়তো কবরে।”

— “এখন কাকে কবরে পাঠাতে চাইছো সেটা বলো।”

— “মতির সাতটা চ্যালা আছে, মতির এলাকার ওসির কাছ থেকে লিস্ট নেয়া। এগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আর ২৫জনকে আপাতত জেলে ঢুকানো হবে।

সব হবে সিনথিয়ার কেইসে। মতির জের ধরে ওগুলোকে টানবো সাক্ষী প্রমাণ সহ। বাকিগুলোকে ঢুকাবো আরো কয়দিন পর। সবাইকে এখনই একসঙ্গে জেলে টানা সম্ভব না। সাতজনকে এখনই একসাথে এনকাউন্টারে দেয়া যাবে না। সময় বুঝে সব সাইজ করা হবে। তবে সিনেমা শুরু হবে এখনই।

— “সব ঠিকঠাক সামলে নিলেই হলো!”

— “আপনি আজকাল স্ট্রেস নিচ্ছেন বেশি। ইলেকশন পর্যন্ত একদম ঠিক ছিলেন। আজগরের হুমকি ধমকির কেমন চুপসে গেছেন। ইকবাল মাহমুদের এই চুপসানো চেহারা দেখে আমি অভ্যস্ত নই। বিরক্ত ধরে যায় আমার। আগের ফর্মে ফিরুন তো জলদি!”

হাসলেন ইকবাল মাহমুদ।

— “একটু আগে তুমিই তো বললে বুড়ো হয়ে গেছি।”

— “ক্ষমতায় বসলে বুড়ো হওয়া যায় না। জোর করে নিজেকে ধরে রাখতে হয় নয়তো ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়।”

— “রাখবো। কিন্তু আজগরকে কী করেছো বলো তো? বাকি কথা আমাকে কিন্তু তুমি বলোনি!”

— “থাকুক না। এত জেনে আর কী হবে? ওর চ্যাপ্টার ক্লোজ। আমি আজ উঠি। রাত অনেক হয়েছে. ফিরতে হবে।”

ইকবাল মাহমুদকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল রুদ্র। তাকে আর আটকালেন না ইকবাল নিজেও। নতুন বিয়ে শাদী করেছে, বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হবে, রাত এগারোটার আগে বাসায় ফিরবে এই তো স্বাভাবিক! ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি উঁকি দিলো তার। নিজ দাম্পত্যের প্রথম দিকের সময়গুলো মনে নাড়া দিচ্ছে। আহা, জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেইসব মধুর স্মৃতি!  

গাড়িতে বসতেই আদনানের কল এসেছিল। এতটা সময় তার সঙ্গেই কথা বলছিল রুদ্র। কল কাটতেই শুভ জিজ্ঞেস করলো,

— “ঐ প্ল্যান তাহলে ক্যান্সেল ভাইয়া?”

— “আপাতত হ্যাঁ। মতিকে নিয়ে মিডিয়া গরম। এই মুহূর্তে আদনান আর ওর ওয়াইফকে সামনে আনা অযৌক্তিক। যাক আরো এক সপ্তাহ, তারপর সোমাকে মিডিয়ার সামনে আনবো।”

— “ওদের মাঝে এখন সব ঠিক?”

— “একদম! আদনান ছেলেটা রাজনীতি ভালো বুঝে। সংসার, প্রেম এসবে একদম কাঁচা। সোজা কথায় জঘন্য হাজবেন্ড ও। এত সোজাসাপ্টা বউকে সামলাতে জানে না ঠিকঠাক। বুঝিয়ে শুনিয়ে দিয়েছি, এবার থেকে বুঝে-বুঝিয়ে চললেই হয়। নেক্সট মান্থ আয়োজন করে বউ ঘরে তুলবে।”

— “আর আপনি? একটু আনন্দ করার সুযোগ পাবো না?”

— “সব হবে, একটু গুছিয়ে নেই। সুরভী আরেকটু স্বাভাবিক হোক। তারপর ওর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সপ্তাহ বেঁধে আয়োজনের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলবো।

*****

বাইরের জগত ছেড়ে একান্ত সুরভীর মানুষটা হয়ে ঘরে ফিরলো রুদ্র। মিনিট দশেক আগেই কল করেছিল সুরভী- কখন ফিরছে জানতে। ঘরে ঢুকে রুদ্র দেখলো, সুরভী খাটে বসে অস্থির হয়ে পা দোলাচ্ছে। রুদ্রকে দেখা মাত্রই ছুটে এল তার কাছে, যেন তারই অপেক্ষায় ছিল এতটা সময়। ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো রুদ্র। গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বললো,

— “আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

রুদ্রের নাক বরাবর পারফিউমের কৌটা তুলে ধরলো সুরভী।

— “আপনার পারফিউম কালেকশনগুলো দেখছিলাম, এটা পেলাম তখন।”

— “আচ্ছা! ভালো লেগেছে এটা?”

— “রিসেন্টলি একটা ইন্সিডেন্ট হয়েছিল। কে যেন বাসার বেল চাপলো আর তখনই বাসায় কারেন্ট চলে গেল। আমি গেট খুলতেই আমার হাত চেপে জড়িয়ে ধরলো। এই পারফিউমটাই সেই অজানা লোকের গায়ে ছিল। সেই অজানা মানুষটা আপনি ছিলেন, তাই না?”

সজোরে হেসে উঠলো রুদ্র। গায়ে পারফিউম স্প্রে করে সুরভীকে বললো,

— “কাছে এসো, তোমার হাত চেপে জড়িয়ে ধরি। তারপর নাহয় মিলিয়ে নিও আমিই সেই মানুষটা কি না!”

কপট রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেললো সুরভী।

— “আপনার এত দুঃসাহস!”

— “তোমার জন্য এই সামান্য একটু সাহস করাই যায়।’

— “আমি কেমন ভয় পেয়েছিলাম জানেন?”

— “আহা! তখন বুঝতে পারলে আরও দুটো চুমু দিয়ে আসতাম। চুমু খেলে ভয় কেটে যায়।”

— “ধুর! আপনি গোপনে গোপনে কত কী করে ফেললেন, অথচ আমাকে নিয়ে কেউ এত ভাবছে সে খবরটাই আমি জানলাম না!”

— “জানলে কী করতে? প্রেম করতে?”

— “কী জানি! হতেও পারতো একটা দুর্দান্ত প্রেমের গল্প।”

— “এখনও হতে পারে।”

— “হ্যাঁ, পারে।”

— “ধরে নিলাম তুমি আমার প্রেমিকা। কী করবে তোমার প্রেমিকের জন্য?”

— “তাকে তার প্রিয় কিছু উপহার দিতে পারি।”

— “যদি প্রেমিক তোমার কাছে সময় চায়? বিশেষ কিছু মুহূর্ত চায়?”

— “দেবো। আর প্রেমিক? সে কী করবে?”

— “প্রেমিক একটু অসভ্য! শুধু মিষ্টি মিষ্টি প্রেম দিতে পারবে না। মিষ্টির সঙ্গে দুষ্টুমিও থাকবে।”

রুদ্রের ইশারা খুব টের পেল সুরভী। এতটা সময় রুদ্রের চোখে চোখ রেখে খুনসুটিতে মাতলেও চোখ নামিয়ে নিলো তক্ষুনি। সুরভীর লাজুক চোখজোড়া রুদ্রের দেখতে ইচ্ছে হলো ভীষণ। দু’হাতে সুরভীর মুখ আঁজলা করে তুলে ধরলো। বৃদ্ধাঙুলিতে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার গালজুড়ে। কী এক আবেশে সুরভীর চোখ বুজে আসতে চাইলো। তবুও চোখ জোর করে টেনে ধরে রইলো ও। সুরভীর চোখে মাদকতা দেখতে পাচ্ছে রুদ্র। এই মুহূর্তটা হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না তার। সুরভীর পিঠ জড়িয়ে আরো কাছে টেনে নিলো সে।

— “সারাদিন পর ফিরেছি, আমি যখন থাকি না আমাকে মনে পড়ে তোমার?” মাথা দুলিয়ে সায় দিলো সুরভী।

— “বলো না কেন আমাকে? জানতে ইচ্ছে হয় তো আমার! সুরভী আমাকে মিস করছে, আমাকে দেখতে চাইছে তা কেন আমার অজানা থাকবে? হুম?”

— “লজ্জা পাও বলতে?”

— “কী জানি!”

— “আমি তোমার জন্য মরি অথচ তুমি কিনা লজ্জায় পড়ে আমার মনের খোড়াকটুকু আমাকে দাও না! কেন?”

— “হুট করে ধরে নিয়ে বিয়ে করে ফেললে এমনই হয়।”

— “শাস্তি দিচ্ছো?”

— “হ্যাঁ।”

— “শাস্তি ভোগ করছি তো! এই যে এত কাছে তুমি, তবুও রোজ সকাল বিকাল নিয়ম করে জড়িয়ে ধরছি না। এখন পর্যন্ত একটা চুমু দেইনি। তোমার নগ্ন কোমরে হাত রাখিনি, বুকে ছুঁয়ে দেখিনি; অথচ সবকিছুর ইচ্ছে তো আমার হয়। কখনো কখনো নেশা চেপে ধরে। তবুও চেয়েছি একবারও? নিজেকে নিজে সামলে নিচ্ছি বারবার। কঠিন তপস্যা বললে ভুল হবে না! এরচেয়ে কঠিন শাস্তি আর কী আছে বলো? তবুও তুমি আরো আরো শাস্তি দিতে চাও। মেরে ফেলবে আমাকে?”

রুদ্রের চুলগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলো সুরভী। বললো,

— “যা ইচ্ছে হয় তা কেন চান না?”

— “চাই না জোর করতে।”

— “কেন? সম্মান নাকি ভালোবাসা?”

— “দুটোই।”

— “খুব ভালোবাসেন?”

— “বাসি।”

ভালোবাসা জন্মেছে কি না সে কথা এখনো অজানা সুরভীর। তবে এখন এই মুহূর্তে মনে হলো, রুদ্রকে অবশ্যই জড়িয়ে ধরা উচিত। অন্তত একবারের জন্য, এক মুহূর্তের জন্য হলেও তাকে জড়িয়ে ধরা চাই! রুদ্রের গায়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেল সুরভী। চোখ বুজে রইলো তার বুকে। রুদ্র আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে ওকে। এই হাতজোড়ায় বন্দী হয়ে যেন আশ্রয় খুঁজে পেল সুরভী। মনে হচ্ছে যেন এই আশ্রয় জন্ম-জন্মান্তরের।

৩২

দেখতে দেখতে নভেম্বরের মাঝামাঝি পেরিয়ে যাচ্ছে। এই বাড়িতে সুরভীর আজ বাইশতম দিন। প্রকৃতিতে শীত নেমে এলেও, রুদ্রের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ছে রোজ। রুদ্রের যত্ন, ভালোবাসা, প্রতিদিন একটু একটু করে কাছে টেনে নেয়া… সবকিছু সুন্দর! কোনো পুরুষের মাঝে এতখানি ধৈর্য্য থাকতে পারে বলে জানা ছিল না সুরভীর। নয়তো এতদিনেও দু’বার গাঢ় চুমু ছাড়া আর কিছুই চাইবে না, তা কখনো হয় নাকি! রুদ্রের চোখে তাকিয়ে তার চাওয়া খুব বুঝতে পারে সে। রুদ্র অধিকার খাটিয়ে তার চাওয়া পূরণ করলেও সুরভী বিন্দুমাত্র অমত করবে না। তবে সে কথা এখনও বুঝতে দেয়নি ও। যেভাবে চলছে, এগোচ্ছে এই স্মৃতিগুলো ভীষণ মিষ্টি। একবার ছুটে গেলে আর পাওয়া হবে না। হয়তো কাছে আসার সুখ পাওয়া যাবে, ভালোলাগা-ভালোবাসা সব থাকবে। তবে এই একই অনুভূতি কি আর থাকবে? এই ভেবেই এতগুলো দিন পেরোলো তাদের দাম্পত্যের। গতরাতে রুদ্র চুমুর মুহূর্তে অজান্তেই জামায় হাত গলিয়ে, তার পিঠে এলোমেলো হাতড়াতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই কেঁপে উঠেছিল সে। টের পাওয়া মাত্র রুদ্র ছিটকে গেল দূরে। কাজের বাহানায় পড়ে রইলো অন্য ঘরে। কয়েকবার ডাকা সত্ত্বেও এল না এই ঘরে। পুরো রাত ঘুম হয়নি সুরভীর। এপাশ-ওপাশ করে কেটে গেছে সারা রাত। কয়েকবার রুদ্রকে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আমি তো তোমারই। যা চাইছো তা আদায় করে নিতে পারো। আপত্তি নেই তো আমার!

তবুও কী এক সংকোচে বলা হয়নি মুখ ফুটে। সকালে রুদ্র ঘরে এল। সুরভী তখনও বিছানা ছাড়েনি। রুদ্রের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র লাফিয়ে উঠলো সে বালিশ ছেড়ে।

— “তুমি ঘুমাওনি রাতে?”

ডানে-বামে মাথা নাড়লো সুরভী।

ভ্রু কুঁচকে এল রুদ্রের।

সুরভীর পাশে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— “কেন?”

— “আপনি গতকাল এভাবে বেরিয়ে কেন গেলেন?”

— “কাজ ছিল।”

— “রাগ হয়েছেন আমার উপর?”

— “কিসের রাগ?”

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সুরভী।

রুদ্র বুঝে নিলো সবটা।

ঠোঁটের পাশে আলতো চুমু খেয়ে বললো,

— “সামান্য একটা ঘটনায় রাগ করবো? তোমার উপর রাগ করে থাকতে পারবো আমি? আমি তো বলেছিই তুমি যতদিন না নিজে এসে ধরা দেবে ততদিন আমি দূরেই থাকবো। সিদ্ধান্তটা আমারই। তাহলে রাগের প্রসঙ্গ আসছে কেন?”

— “মনে হলো রাগ করে চলে গেছেন।”

— “তাই ঘুমাওনি?”

— “আসেনি।”

সুরভীর মাথার পেছনে, চুলের গোড়ায় রুদ্রের স্পর্শ আরো গাঢ় হলো। নেশাতুর

চাহনীতে চেয়ে রইলো সুরভীর চোখে। জানতে চাইলো,

— “আমার অভিমান, রাগ তোমাকে ভাবায় খুব?”

— “ভাবালো তো! অস্থির হয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছি।”

— “কেন ভাবায়? কেন অস্থির হও আমার জন্য? ভালোবাসো?”

— “না।”

হাসলো রুদ্র। সুরভীর ঠোঁট, নিজের ঠোঁটে ভিজিয়ে দিলো সে।

— “রাখো চেপে যতদিন পারো। যখন আর চেপে রাখতে পারবে না, দম বন্ধ লাগবে সেদিন নিজেই ছুটে এসে বলে দেবে। আমি নাহয় ভালোবাসি শোনার অপেক্ষায় রইলাম!”

৩৩

— “কেইস ফার্স্ট হিয়ারিংয়েই ডিসমিস করে দেবো।”

— “প্রুফ সব এই ফাইল আর পেনড্রাইভে আছে। আরো কিছু প্রয়োজন হলে জানাবেন।”

— “অবশ্যই। হাতে আরো চারদিন সময় আছে। আজ রাতেই আমি আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সব চেক করবো। যদি কিছু প্রয়োজন হয়, কাল সকালে জানাবো।”

— “সিনথিয়া আদালতে ঠিকঠাক অভিনয়টা করে যেতে পারলেই হয়!”

— “পারবে। আসলে ও এমনিতেও পুরোপুরি স্ট্যাবল না। সাইকিয়াট্রিস্টের আন্ডারে ছিল একবছর যাবৎ। তবে এই কন্ডিশন দেখিয়ে পার পাওয়া সম্ভব না। টোটালি আউট অফ সেন্স হওয়া জরুরি। প্রথমে খুব একটা হেলদোল দিচ্ছিলো না। মানে, বিচার হলে হোক। তাতে ওর কিছু আসে যায় না। পরে বাচ্চার কথা, ওর ভবিষ্যতের কথা বলে পাক্কা তিনঘণ্টা ধরে কাউন্সেলিং করলাম। এখন ঠিকঠাক আছে সব। মতির হয়ে কেইস লড়বে কে জানো?”

— “শুনেছি। সাফিনা আমিন।”

— “ওর জন্যই স্টং ড্রামা সাজাতে হচ্ছে। শি ইজ টাফ।”

— “নট মোর দ্যান ইউ। নয়তো ওকেই হায়ার করতাম।”

— “তবুও! অপনেন্টকে কখনো আন্ডারস্টিমেট করতে হয় না।”

হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আলতাফ হাশিমির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত রুদ্র। এরই মাঝে কল এল সুরভীর।

— “হ্যাঁ সুরভী?”

— “ফিরছেন কখন?”

— “আমি এখন একটা মিটিংয়ে আছি, সেখান থেকে যাবো বন্ধুর পার্টিতে। ফিরতে আরো তিনঘন্টা।”

— “এত দেরী?”

— “অপেক্ষা করছো?”

— “একটু আধটু করছি আরকি।”

— “করো। ফিরছি বারোটার মধ্যে।”

*****

রুদ্রের ফিরতে রাত দেড়টা বাজলো। এই প্রথম কথার হেরফের হলো তার। গাল ফুলিয়ে প্রচন্ড অভিমানে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো সুরভী। আজ রাতটা বিশেষ হবার কথা ছিল। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল রুদ্রের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে। ঘরটা নতুন বেডশিট আর কিছু ফুলে সাজিয়েছিল নিজেই। গায়ে জড়িয়েছিল রুদ্রের প্রিয় কালো রঙের শাড়ী আর ছোট্ট ডায়মন্ডের গয়না। সেই সকাল থেকে কতশত কল্পনায়, অনুভূতিতে বারবার লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া, ভালো লাগায় ভেসে যাওয়া আরো কত কী! অথচ মানুষটা সময় মতো আসেনি। দশটার পর আর একটা কলও রিসিভ করেনি। রাগে একটু আগে কেঁদেই দিয়েছিল সুরভী। রুদ্রের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলো ও।

টলতে টলতে ঘরে এল রুদ্র। চোখের সামনে সুরভী দাঁড়িয়ে। কী দারুণ লাগছে ওকে দেখতে! কালো শাড়ীতে গায়ের রং যেন খোলতাই হয়েছে। গলাটা কী সুন্দর লাগছে। ইশ্! শাড়ীর ফাঁক গলে বেরিয়ে আছে পেটের উন্মুক্ত অংশ; মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা। ওর গলা বেয়ে বুকের খাঁজে গড়িয়ে নেমে আসা বিন্দু বিন্দু পানি। সুরভীর বুকে চোখ গেল রুদ্রের। ওখানটায় আজ পর্যন্ত কোনো খাঁজের দেখা মেলেনি। কেন দেখতে দেয় না মেয়েটা? কেন অমন ঢেকেঢুকে সামনে আসে সবসময়? অধৈর্য্য হলো রুদ্র। ওর কাছে এগিয়ে, কোমরে চেপে ধরে গলায় চুমু খেল রুদ্র।

— “তুমি পারো না আমার সামনে বোরকা পরে আসো! কেন সুরভী? আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। গায়ে ওড়না, জামা, ব্রা কিচ্ছু থাকবে না সেই সুরভীকে আমার দেখতে ইচ্ছে হয়।”

রুদ্রের কথা জড়িয়ে আসছে। গা থেকে বাজে গন্ধ ভেসে আসছে। রুদ্র মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফিরেছে, সে কথা সুরভীর বুঝতে বাকি নেই। এতটা সময়ের রাগ ঝেড়ে সামলাতে চাইলো তাকে। রুদ্রকে সোফায় বসিয়ে ছুটতে চাইলো রান্নাঘরে লেবুপানি আনবে বলে। আনা হলো না সুরভীর। একটানে সুরভীকে নিজের কোলের উপর বসালো রুদ্র। দু’হাতে সুরভীর কোমর জড়িয়ে বললো,

— “সেদিন রাতের সুরভীকে আমি চাই।”

— “কবেকার?”

— “ঐ তো দুপুরে গোসল করে ব্রা বারান্দায় শুকাতে দিলে, আমি শুভর বাসায় দাঁড়িয়ে দেখলাম। তারপর রাতে ঐ ব্রা পরে আমার কোলে বসে পড়লে। বুকের অর্ধেক দেখিয়েছিলে আমাকে সেদিন। তোমার গলা বেয়ে পানি বেয়ে পড়ছিল তোমার ক্লিভেজে। নিজে হাত টেনে তোমার বুকের খাঁজে রেখেছিলে।” সুরভীর গলা থেকে বুকের মধ্যখান পর্যন্ত তর্জনীতে ছুঁয়ে দিলো রুদ্র। অসহ্য লাগছে সুরভীর, তবুও বসে রইলো ও। পুরোটা শুনতে হবে, বুঝতে হবে।

— “কেমন পাগলের মত চুমু খেয়েছিলে আমার ঠোঁটে। ব্যথা পাচ্ছিলাম আমি। আমাদের চুমুটা শেষ হয়নি। আমাদের আরো কাছে আসা হয়নি। তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল, কিন্তু আমার ঘোর কাটলো না। তোমাকে পাবার নেশা ছড়িয়ে গেল আমার শিরায় শিরায়। মনে হলো, তোমাকে না পেলে আমার সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যাবে। তোমাকে চাই-ই। এবার তুমি আমার হয়ে যাও প্লিজ! সেই রাতের চুমুটা শেষ করো। আরো কাছে টেনে নাও আমাকে, আমার তৃষ্ণা মেটাও।”

এবারে সবকিছু স্পষ্ট হলো সুরভীর। হুট করে তার জীবনে রুদ্রের আসা, তাকে পাবার জন্য এত উন্মাদনা, অস্থিরতা সবকিছুর কারণ স্পষ্ট হলো। এখানে ভালো লাগা, ভালোবাসা কিচ্ছু নেই। আছে শুধু মোহ। এই শরীরের প্রতি, কামবাসনার প্রতি। নিজেকে কেমন ছোট মনে হলো সুরভীর। একজন এসেছিল টাকার লোভে অন্যজন এল শরীরের লোভে। সত্যিকারে শুধুই মানবী সুরভী কি প্রেমিকের প্রেম পাবার অযোগ্য? কারো কি কখনো ইচ্ছে হয়নি এই মেয়েটাকে আবেগের জায়গা থেকে ভালোবেসে দেখি, কাছে চেয়ে দেখি?

আরো কিসব এলোমেলো বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো রুদ্র। মুখে হাত চেপে চিৎকার করে কাঁদছে সুরভী। এসব যত্ন ভালোবাসা সব মিথ্যা। সব! তৃষ্ণা মিটে গেলেই সব মুছে যাবে। হয়তো মুছে যাবে চিরতরে রুদ্রের মন থেকে সে নিজেও।

৩৪

সকালের আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো রুদ্রের। নিজেকে আবিষ্কার করলো সোফার উপর। তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে শোয়া থেকে উঠলো সে। ড্রেসিং টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে, সুরভী বসে ঘুমুচ্ছে। বিধ্বস্থ দেখাচ্ছে ওকে। পরনে কালো শাড়ী। চোখের আশপাশে আইলাইনার লেপ্টে কালো হয়ে আছে। ঠোঁটের লাল লিপস্টিকটাও মুছে গেছে প্রায়। মুখ ফুলে আছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে কেঁদেছে খুব। মনে মনে আঁতকে উঠলো রুদ্র। গতরাতের কথা স্পষ্ট কিছু মনে নেই তার। কখন বাসায় ফিরেছে, কী হয়েছে কিছুই না! অজান্তেই কি সুরভীকে সে…

ছুটে এল সে সুরভীর কাছে। গাল ছুঁয়ে দিয়ে ডাকলো,

— “এই সুরভী?”

ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল সুরভীর। রুদ্রের ডাকে চোখ মেললো ও।

— “তুমি এভাবে এখানে কেন?”

কিছু বললো না সুরভী। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রুদ্রের চোখে। রুদ্রের ভয় বুঝি আরো গাঢ় হলো। সুরভীর মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলো,

— “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তুমি? কী করেছি আমি গতকাল? বলো আমাকে!”

— “সত্যিটা বলে দিয়েছেন।”

— “কোন সত্যি?”

— “বিয়ে কেন করেছেন।”

— “বিয়ের পেছনে আবার কোন সত্যি?”

— “স্বপ্নে যা দেখেছিলেন।”

সুরভীর মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো রুদ্র এক মুহূর্ত নীরব বসে রইলো সে।

— “স্বপ্ন তো স্বপ্নই সুরভী। আমি ইচ্ছে করে তো দেখিনি।”

— “আমার বাসার বারান্দায় আমি আন্ডারগার্মেন্টস শুকাতে দিচ্ছি তা দেখেই আপনার কামনা জেগে গেল?”

— “আর ইউ আউট অফ সেন্স? সামান্য একটা ভেজা ব্রা দেখে রুদ্রের সেক্স ডিসায়ার হবে? রাস্তার থার্ড ক্লাস লোক আমি?”

— “নয়তো এমন রগরগে স্বপ্ন দেখেন কী করে?”

— “লেট মি এক্সপ্লেইন সুইটহার্ট। ঠান্ডা মাথায় শোনো আমার কথা তুমি। মাথার উপর তখন আমার পাহাড় সমান চাপ সুরভী! এত স্ট্রেস আমি আর নিতে পারছিলাম না। নিজের বাসা, বিজনেস সব ফেলে শুভর বাসায় মুখ লুকিয়ে পড়েছিলাম। তখন জাস্ট দুদিন দেখেছি তোমাকে। ঠিকমতো তোমাকে খেয়ালও করিনি। হতে পারে স্ট্রেসের কারণে ওসব হাবিজাবি দেখেছি স্বপ্নে। বাট বিলিভ মি, তোমার ব্রা দেখে তোমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কু-ইচ্ছা আমার মনে আসেনি।”

— “কিন্তু তারপর তো পেতে ইচ্ছে করলো! নগ্ন শরীরটা হাতড়ে দেখার শখ হলো। নিজেই বলেছেন গতকাল।”

— “কী বলেছি?”

— “ওড়না, জামা, ব্রা ছাড়া আমাকে দেখার ইচ্ছে হয়। জাস্ট এই শরীরটার জন্য বিয়ে করলেন আমাকে? আমি মানুষটাকে পাবার কোনো ইচ্ছে নেই? সব চাওয়া মিটে গেলে ছুঁড়ে ফেলবেন আমাকে?”

— “রাবিশ! কথা না বুঝে উল্টাপাল্টা বলো না প্লিজ। সেই স্বপ্নের পর আমি তোমাকে চেয়েছি তা ঠিক, বাট নট ফর মাই ফিজিক্যাল ডিমান্ড। আমি তোমাকে চেয়েছি আমার শান্তির জন্য। এ ঘটনার আগে আমি দিশেহারা হয়ে ছিলাম। ব্রেন হ্যাং ছিল আমার। অস্থিরতার কথা আর না বলি। তুমি স্বপ্নে এলে, আমার মনে হলো সবকিছু থেকে দূরে কোথায় আমাকে তুমি ভাসিয়ে নিয়ে গেলে। আমি সবকিছু ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছি। নতুন করে সবকিছু ভাবার এনার্জি পেয়েছি। বহুবছর আমি স্বস্তি পাইনি সুরভী। বিশ্বাস করো! হন্যে হয়ে একটু স্বস্তি খুঁজেছি যদিও শুনতে উইয়ার্ড লাগছে, কিন্তু এটাই সত্যি। আমার শুধু তোমার শরীরটা না, গোটা তোমাকেই লাগবে এমনটাই ফিল করেছি। সেদিন, সেই মুহূর্তের পর থেকে আমি এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে অন্য কারো ভাবতে পারিনি। বারবার মনে হয়েছে আমার ওকে চাই। লাগবেই। যাকে চোখ বুজে কল্পনা করে, দূর থেকে একনজর দেখে আমার অশান্ত মন শান্ত হয়, তাকে কাছে পেলে আমি কেমন সুখী হবো সেই লোভ থেকেই তোমাকে আমি বিয়ে করেছি। আর রইলো কথা তোমাকে ওড়না, জামা ছাড়া দেখতে চাওয়া, আমি কি অন্যায় কিছু চেয়েছি সুরভী? তুমি আমার লিগ্যালি ওয়েডেড ওয়াইফ। তোমাকে নিয়ে এই ইচ্ছে হওয়া কি খুব অমূলক? হবেই। স্বাভাবিক। তাই বলে চাপিয়ে তো দেইনি কিছু! ইট’স আওয়ার টুয়েন্টি ফোর্থ ডে অফ ওয়েডিং এ্যান্ড আ’ম স্টিল ওয়েটিং ফর ইউর কন্সেন্ট! তবুও তুমি বলছো আই জাস্ট ম্যারিড ইউ ফর মাই সেক্সুয়াল ডিসায়ার! হাহ্!”

এক টানা সমস্তটা বলে ফেলে লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে রুদ্র। সুরভীর অপবাদ যেন বুকের ঠিক বাঁ পাশে খোঁচাচ্ছে। প্রচন্ড অভিমানে চেয়ে রইলো সে সুরভীর চোখে।

তবুও থামলো না সুরভী। কোনো যুক্তিই যেন ওর মাথায় খেলছে না!

— “সত্যিই ভালোবাসেন আমাকে?”

— “তুমি স্টিল কনফিউজড? সিরিয়াসলি!”

— “হ্যাঁ। আই থিংক আপনার ভ্রম হচ্ছে। কাম আর ভালোবাসাটা গুলিয়ে ফেলছেন। নিজেও পার্থক্য করতে পারছেন না। দূরে গিয়ে মেপে নেয়া উচিত আসলেই ভালোবাসা আছে কি না?”

— “আবোলতাবোল বকছো কেন? দূরে গেলে কাম মুছে যাবে?”

— “সুন্দরী মেয়েদের মাঝে ক’টাদিন থেকেই দেখুন না আমাকে ছাড়া। তফাৎটা তখনই টের পাবেন।”

— “তুমি বলছো না তোমার ব্রা দেখে আমার কাম জেগেছে? দেশে বিদেশে ঘুরে আসা মানুষ আমি। বিকিনি পরা মেয়ে বিচে, বারে কম দেখিনি। কোনোদিন একবারের বেশি দু’বার তাকাতে পর্যন্ত ইচ্ছে হয়নি। কত সুন্দরী মেয়েরা সেধে কোলে এসে বসতে চেয়েছে, কাউকে আমি গ্রহণ করিনি। আর আমার ওয়াইফ কিনা আমাকে এসব বলছে? ঠিক আছে, চাইছো তো দূরে গিয়ে যেন মাপি! তোমার কথাই রাখবো আমি যাবো, কিন্তু নিজেকে মাপতে না, তোমাকে মাপতে। দেখি আমার এবসেন্স তোমাকে কিছু রিয়েলাইজ করায় কি না? আমাকে ছাড়া থাকতে পারো কি না দেখো।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *