২৫
জানালার ধারে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সুরভী। ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। কখন রুদ্র এই ঘরে এসে, খাটের এক কোণায় ওর এলোমেলো শাড়ীটা সরিয়ে সোফার উপর রাখলো, গয়নাগুলো ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নিয়ে বাক্সে গুছিয়ে রাখলো, কিছুই জানে না সে। প্রায় ১৫মিনিট পর রুদ্র জানালার আরেক প্রান্তে, বুকে দুইহাত ভাঁজ করে, মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ানোর পর তার উপস্থিতি চোখে পড়লো সুরভীর। সৌজন্যতার খাতিরে হাসলো ও। ম্লান হাসি।
— “সুরভী।”
— “জি?”
— “তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ফর্মালিটিজ মেইনটেইন করে চলার মতো না। আমরা দু’জন আমাদের “র ভার্সন” নিয়ে দু’জনের কাছে ধরা দেবো এটাই এই সম্পর্কের নিয়ম। তুমি আমার বিজনেস ক্লায়েন্ট না, আমি তোমার পাশের বাসার ভাই লাগি না। তোমাকে আমি যেতে দেইনি, তোমার মন খারাপ হয়েছে সেটা আমাকে বুঝাও। বুঝতে না দিলে যে বাড়তি প্যাম্পার আমি তোমাকে করবো সেটা তুমি পাবে না। আমি শুধু তোমার ভালোবাসা চাই না। আমি গোটা সুরভীকেই চাই। আমি সুরভীর রাগ চাই, হাসি চাই, সবরকম পাগলামি-বাচ্চামি দেখতে চাই, মন খারাপ, রাগ, গালি, বকা সব চাই। সব। এসব ভয়, ফর্মালিটিজ ছাড়ো। মাথা পেতে দিয়েছি, চড়ে বসো তাতে। আবদার করতে শেখো। আমি কতকিছুই না করবো, তাই বলে তুমি চুপচাপ মেনে নেবে? আমার কাছ থেকে আদায় করে নেবে না? তুমি যদি একটু ঢঙ করে বা রাগ করে আমাকে বলতে আমি বাবার ওখানে যাবো খুব জোর মিনিট পাঁচেক আমি তোমাকে বারণ করতাম। কারণ আমি সত্যিই চাচ্ছি না তুমি যাও। কিন্তু তুমি জেদ করলে আমি তোমাকে বারণ করতাম না কখনোই। আমি তোমার মুখ দেখছিলাম বারবার, কিছু বলবে নাকি দেখতে চাইছিলাম, অথচ তুমি বললে না। সবসময় আমি যা বলি সেটাই মেনে নিলে চলবে নাকি? আমার উল্টোটা বলতে হবে। নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করতে হবে। তোমার যুক্তি আমাকে দেখাতে হবে। নয়তো এভাবে সংসার করা যাবে নাকি? বোর হবো না আমি?”
জড়তাহীন হাসলো সুরভী। ভালো লাগায় মন পূর্ণ হলো রুদ্রের। সুরভীর মাথার চুলগুলো হাতের আঙুলে এলোমেলো করে দিয়ে রুদ্র বললো,
— “এতক্ষণে মনে হচ্ছে আমার ওয়াইফ ঠিকঠাকভাবে হাসছে।”
রুদ্রের চোখে তাকানোর সাহস হলো সুরভীর। রুদ্র নিজেই তাকে দিয়েছে এই সাহসটুকু। “আমার ওয়াইফ “ শব্দটায় আলাদা ভালো লাগা আছে। বিয়েটা এখনও মন থেকে মানতে পারেনি যদিও, তবুও ভালো লাগা এই মনটাকে একটু হলেও স্পর্শ করছে। সেই প্রথম আলাপ থেকে রুদ্র বারবার করে বলছে, বুঝাতে চাইছে তুমি আমার। চূড়ান্ত অধিকারবোধ নিয়ে বারবার দাবি করে যাচ্ছে সে কথা। গতকাল অধিকার দাবির সঙ্গে চোখ জোড়ায় যে আধিপত্য বিস্তারের নেশা স্পষ্ট ছিল, আজ সেই একই চোখ জোড়ায় সুরভী নমনীয়তা খুঁজে পাচ্ছে। আকুল হয়ে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সুরভী। এই চাহনি কি মিথ্যা? আপন জীবনের গন্ডিটা ভীষণ ছোট। অনেক মানুষ কিংবা খুব ঘটনবহুল জীবন তার না। মানুষ চেনাটা ঠিক ওকে দিয়ে হয়নি কোনোদিন। তবে এই চাহনী মিথ্যা না। এই চাহনী সত্য। রুদ্রের চোখ যা বলে তা সত্য, এতটুকু বুঝে গেছে সুরভী। রুদ্রের চোখজোড়াই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। কোনোরকম অবিশ্বাসে মন সায় দিচ্ছে না। তবে এই কাতরতার শুরু কবে? একচ্ছত্র অধিকার দাবির গোড়াটা ঠিক কোনদিন থেকে? কিচ্ছু জানা নেই সুরভীর। দূর থেকে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ এত গাঢ় অনুভূতি নিয়ে দিন পার করছে তা কোনোদিন টেরই পাওয়া হলো না!
চোখ বরাবর সুরভীর চেয়ে থাকা যেন রুদ্রকে আরেকটু কাছে যাবার, সম্পর্কে আরেকটুখানি বোঝাপড়া বাড়াবার প্রশ্রয় দিলো। এই সময়টা, সুযোগটা হাতছাড়া করবে না রুদ্র।
চট করে সুরভীর সামনে বাহানা হাজির করলো সে,
— “পুরো বাড়ি ঘুরে দেখা হয়েছে?”
— “উঁহু। এই ঘর থেকে মায়ের ঘরে যেতে যতটা জায়গা পেরোতো হয় ঠিক ততটুকুই দেখা। এরবাইরে এক ইঞ্চিও না।”
— “ঘরের প্রতিটা কোণ তোমাকে চিনতে হবে। এই বাড়ির কোন দেয়ালে কয়টা করে পেরেক গাঁথা আছে তা জানতে হবে। এখন থেকে এই ঘর, সবকিছুর দায়িত্ব তো তোমারই। তবে সবার আগে আমি।”
সুরভীর হাত টেনে নিজ বাহুতে জড়িয়ে, ঘর ছেড়ে বেরোতে বেরোতে সে বললো, – “আমি যখন তোমাকে আমার পাশে চাইবো তখনই আমার কাছে চলে আসবে। যত ব্যস্ত তুমি হও, যত কাজের চাপই থাকুক। সব ফেলে আমার কাছে চলে আসবে। অপেক্ষা করাবে না একদম!”
সুরভী খুব টের পাচ্ছে, রুদ্র চাইছে তার হাতটা ও শক্ত করে আঁকড়ে ধরুক। সংকোচ হচ্ছে ভীষণ, তবে আপত্তি নয়। খুব একটা দাবি দাওয়া উনি করেনি। কিছুক্ষণের জন্য হাত জড়িয়ে রাখার আবদার সে তার বিবাহিতার কাছে করতেই পারে! রুদ্রের দাবি আর নিজ সংকোচের ডামাডোলে, সুরভী তাকে আঁকড়ে ধরছে না আবার ছাড়াতেও চাইছে না। সুরভীকে পড়তে পারছে রুদ্র। ছাড়াতে না চাওয়াটাই যেন আকাশ সমান স্বাধীনতা দিলো তাকে। সুরভীকে কাছে টেনে হাত ধরে রাখা, গায়ের একপাশে সুরভী লেগে থাকা এ যেন তার কাছে স্বর্গসুখ। গোটা সুরভীটাকে এখনও পাওয়া যায়নি। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা-ও জানা নেই। তবে সেই ভাবনা মাথাতেই আসছে না রুদ্রের। এই যে সুরভী একান্ত তার হয়ে গেছে, পাশে গা ঘেঁষে ঘরময় হাঁটছে এই প্রাপ্তিও কি কম? এত বছরের এই জীবনে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এটাই!
২৬
আয়নার সামনে বসে সাজগোজে ব্যস্ত সুরভী। বাবার বাড়ি যাবে ও। এই বাড়িতে পা রাখার পঞ্চম দিন আজ। গতরাতে অফিস থেকে ফেরার পরই বায়না করলো, আম্মু আব্বুর কাছে যাবো। মনটা একটু খারাপ দেখাচ্ছিল। নিজের বাসা, নিজের মানুষদের জন্য মনটা ছুটে গেছে সে কথা স্পষ্ট বুঝে নিলো রুদ্র। আর আপত্তি করেনি। তখনই বললো, “কাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরি, তারপর তুমি যেও।”
আয়নায় রুদ্রকে দেখা গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে এসেছে। অফিস থেকে ফিরলো মাত্র। ঘাড় ফিরিয়ে মুচকি হাসলো সুরভী।
—” ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কাজের চাপ ছিল খুব?”
— “একটু তো ছিলই।”
— “আমি কিন্তু রেডি।”
— “ব্যাগ গোছগাছ শেষ?”
— “সব গোছানো হয়ে গেছে। আপনি জলদি ফ্রেশ হয়ে নিন না!
— “তোমাকে গাড়িতে তুলে তারপর ফ্রেশ হবো।”
ভ্রু কুঁচকালো সুরভী।
— “গাড়িতে তুলে দিয়ে মানে? আপনি যাবেন না সঙ্গে?”
— “না।”
— “কেন?”
— “কাজ আছে।”
— “আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। ডিনার করে চলে আসবেন। ব্যস!”
— “তুমি যাও। আমি পরে আসবো।”
— “এমন হয় নাকি! বিয়ের পর প্রথম যাচ্ছি আমি। আপনি সঙ্গে না গেলে কেমন দেখাবে?”
— “আমাদের বিয়েটাই তো কেমন যেন! কোনো নিয়মকানুন হয়েছে নাকি?”
— “তখন হয়নি বলে এখন কিছুই হবে না?”
— “জেদ করো না সুরভী। তুমি যাও। আমি পরে সময় করে আসবো। সত্যিই কাজ আছে আমার।”
— “একটা দিন কি এডজাস্ট করা যেত না?”
— “হচ্ছে না আসলে।”
বিষন্ন হলো সুরভী। এতক্ষণের উচ্ছ্বাসটা চোখে ধরা পড়ছে না আর। খারাপ লাগলো রুদ্রের। তবুও মুখে হাসি ধরে রইলো।
— “চলো, গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি তোমাকে।”
— “সত্যিই যাচ্ছেন না?”
— “উঁহু।” ডানে বামে মাথা নাড়লো রুদ্র।
*****
শাশুড়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল সুরভী। গাড়িতে উঠে বসেছে ও। গাড়ির জানালায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র।
— “আপনি সঙ্গে এলে ভালো লাগতো।”
— “সত্যিই ভালো লাগতো আমি তোমার সঙ্গে গেলে?”
— “হ্যাঁ।”
— “আমাকে এক্সেপ্ট করতে পারছো সুরভী?”
— “হয়তো।”
— “আমাকে পুরোপুরি মেনে নিতে, আমার জন্য মায়া জন্মাতে আরো সময় লাগবে, তাই না?”
উত্তর করলো না সুরভী। মাথা নিচু করে ফেললো ও।
সুরভীর গাল টানলো রুদ্র।
— “মুখ লুকানোর কী আছে? মুখের উপর ধমক দিতে পারো না আমাকে? বলবে, হারামজাদা ধরে এনে বিয়ে করেছিস, চারদিনেই ভালোবাসা খুঁজিস কেমন করে?”
সজোরে হেসে উঠলো দু’জনই।
— “আমি ধমক দিতে জানি না।”
— “শিখতে হবে তো! আমাকে লাঠির উপর না রাখলে বখে যাবো না? আমাকে শাসন করার কেউ নেই তো! তোমাকে কি শুধু আদর যত্ন পাবো বলে ধরে এনেছি? শাসন পাবো বলেও তো এনেছি। আমি তোমার সব চাই সুরভী।”
মুখ সরিয়ে লাজুক হাসলো সুরভী। বললো,
— “আপনি এত ফ্লার্ট করেন উফ! মাথা ধরে যায় আমার।”
— “ভালোবাসা জেঁকে ধরে না?”
— “আপনি যান তো!”
গাড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়ালো রুদ্র।
— “নিজের খেয়াল রেখো।”
ডানে মাথা হেলালো সুরভী। ঠোঁটের কোণে মুগ্ধ হাসি লেপ্টে আছে ওর। গাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে মির্জা বাড়ির প্রাঙ্গন। মূল ফটকের কাছাকাছি যেতেই জানালা দিয়ে মাথা বের করে পেছনে উঁকি দিলো সুরভী। রুদ্র এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার পথে চেয়ে ছিল। সুরভী তাকাতেই হাত উঁচিয়ে বিদায় দিলো সে। ঠোঁটজুড়ে তার প্রশস্ত হাসি জানান দিচ্ছে, সুরভীর একটাবার পিছু ফিরে তাকাবার অপেক্ষাতেই সে ছিল।
২৭
ফয়েজের মাথার চারদিকে চারটা পিস্তলের নল ঠেকানো। সামনে টেবিলের উপর রাখা আছে ২৫ লক্ষ টাকা। ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকিয়ে আছে সে। বিশমিনিট ধরে এই খেলাই চলছে ফয়েজের বাসায়। হুট করে এইরাতে ছয় জনের দল নিয়ে রুদ্র এসে হাজির হয়েছে এখানে। রুদ্র সচরাচর সশরীরে কোথাও যায় না। তাকে দেখে তখনই সন্দেহ হয়েছিল ফয়েজের। নিশ্চিত কোনো বড়সড় ঘাপলা আছে! ভেবেছিল নতুন কোনো সুপারিশ হাতে এল বুঝি! কিন্তু তার মাথায়ই যে এভাবে পিস্তল ঠেকানো হবে কে জানতো?
— “পিস্তল কি ধরেই থাকবে নাকি ওরা? সমাধান করেন না জলদি!” ফয়েজকে তাড়া দিলো শুভ।
ফ্রিজে কিছু ফল ছিল। ঘরে ঢুকেই কিছু না বলে রুদ্র সোজা চলে গেল ফ্রিজ চেক করতে। একটা আপেল বের করে এখন সে ঘরময় হাঁটছে আর আপেল চিবুচ্ছে।
অসহায় কণ্ঠে রুদ্রকে ডাকলো ফয়েজ,
— “ভাই…”
— “বলো ভাই।”
তখনও ঘরময় হাঁটছেই রুদ্র। একটাবার ফয়েজের দিকে তাকাচ্ছেও না। চেহারা কুঁচকে এল ফয়েজের।
— “তাকান না একটু?”
— “আগের মতো বাঁদরমুখোই আছো তুমি, নতুন করে তোমাকে দেখার কিছু নেই।”
ঘরে হাসির রোল পড়লো। তাতে বিন্দুমাত্র অপমানবোধ করলো না ফয়েজ। সে জানে সে সুন্দর এবং স্মার্ট। লোকে ধরতেই পারবেনা এই পর্যন্ত ২৩টা খুন সে অবলীলায় করে ফেলেছে। তার মনের মানুষ সবসময় গাল টেনে আদর করে বলে, “তুমি খুনী! আমার তো লাগে তুমি মডেল। বুকে ধুকুরপুকুর উঠানো রূপ তোমার!”
রুদ্রের এসব বলার কারণ সে জানে। রুদ্রের কথায় সায় ব্যতীত আর একটা শব্দও রুদ্র শুনতে চাইছে না।
তবুও নিজ নীতির কথা জানালো সে,
— “এইটা কিন্তু হইতাছে না ভাই। মানুষ ফালানোর সুপারিশ নেয়া আমার কাজ। আপনার হইয়াও তো কাজ করলাম। করি নাই? কাকপক্ষী জানছে কোনোদিন? আমি খুনী হইতে পারি কিন্তু নীতি বলতে কিছু আছে তো আমার। বিশ্বস্ত না হইলে আমি কাস্টমার পামু?”
— “প্রতি মার্ডারে মিনিমাম ১০লক্ষ করে গুনেছো তুমি। ভিক্টিম যত হাই প্রোফাইলের, তোমার এমাউন্ট তত বেড়েছে। ব্যাংক ব্যালেন্স তো আর কম করোনি। আর কাস্টমার দিয়ে কাজ কী? এবার আলোর পথে এসো।’
— “আমার মাথায় পিস্তল ঠেকায়া আমারে আলোর পথে আসতে বলতাছেন? পিস্তল
ঠেকানো আলোর পথযাত্রীর কাজ?”
আবারও হাসির রোল পড়লো ঘরে।
মেজাজ খারাপ হলো ফয়েজের। তার সামনে চেয়ার টেনে বসলো রুদ্র।
— “আপেলটা মজা ছিল। খুব মিষ্টি!”
— “ভাই!”
— “সিনথিয়াকে খুন করার জন্য ১৫ লক্ষ পাবার কথা, আমি তোমাকে ২৫ দিচ্ছি। তবুও কেন আপত্তি তোমার?”
— “প্রসঙ্গ টাকার না। প্রসঙ্গ নীতির।”
— “যাকে খুন করার সুপারিশ এসেছে, জানো তার সম্পর্কে?”
— “জানি। ফেমাস মডেল। মতি ভাইর প্রেমিকা সিক্রেট কিছু জাইনা গেছে। ব্ল্যাকমেইল করতাছে। তাই রাস্তা থেইকা সরাইবো।”
— “মিথ্যা। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। চারমাস চলছে। ও মতির কাছে সামাজিক স্বীকৃতি চায়। বাচ্চাটাকে সুস্থ সুন্দর একটা জীবন দিতে চায়, বাবার নাম দিতে চায়। মতির ঘরে বউ বাচ্চা আছে, ও কখনোই এসব মেয়েকে ঘরে তুলবে না। তাই পথ থেকে সরাতে চাইছে।”
মাথা নিচু করে রইলো ফয়েজ। শুভ ইশারা করলো তার লোকদের সরে দাঁড়াবার জন্য। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নিচু করেই গালি দিলো ফয়েজ,
— “খানকির পোলা! যে দুনিয়াতেই আসলো না ঐ মাসুমরে আমার হাতে মারাইতে চাইলো!”
— “তোমাকেও কিন্তু ধোঁকাই দিলো।”
— “হ দিলোই তো। জানলে কি আমি জীবনে এই কেইস হাতে নেই নাকি? আপনি টাকা নিয়া যান। লাগবে না এটা। কী ইনফরমেশন লাগবে, সব বইলা দিবো।”
— “শুধু ইনফরমেশন না। তোমার সঙ্গে আরো জরুরি কাজ আছে। ফ্রীতে করাবো না নিশ্চয়ই!”
— “কী কাজ?”
— “আগে তথ্য দাও, প্ল্যান কী ছিল?”
— “বাসা থেকে মতি ওরে বের করতো, জরুরি কথার বাহানায় ওরে গাড়িতে বসায়া মতি বের হইয়া যাইতো। তারপর গাড়িতে ঢুইকা ওরে অজ্ঞান কইরা গাড়িতেই সাইজ করতাম। তারপর মুখে এসিড ঢাইলা চেহারা নষ্ট করতে বললো।”
— “কী হারামী! যে রূপের প্রেমে মজে ঘরের বউকে ঠকিয়েছে, সেই চেহারাটাই নাকি এসিডে ঝলসে দিতে চাইছে!”
— “হ্যাঁ।”
— “তারপর?”
— “তারপর আর কী? লাশ নিয়ে শীতলক্ষ্যায় ছুঁইড়া মারো।”
— “এই এক নদী আর কত লাশের ঠিকানা যে হবে! মেয়েগুলো এত বোকা কেমন করে হয় বুঝি না আমি। টাকা, ক্ষমতা দেখলেই শুয়ে পড়ে কেন ওরা? মিনিমাম আত্মসম্মান বোধটুকু বাঁচিয়ে রাখে না। কিসব বুড়ো বাচ্চার বাপেদের সঙ্গে ফিজিক্যালি এটাচড হয়। প্রেগন্যান্ট হয়ে তারপর শুরু করে বিবাদ- দায়িত্ব নাও, বিয়ে করো। এরা কি বিয়ে করে দায়িত্ব নেবার লোক? এদের কাছে বেঁচে থাকার মিনিমাম সেইফটি পাবে কি না সেটা নিয়ে ভাবে না একবার! যাই হোক, প্ল্যান এক্সাক্ট সেইম থাকবে। কিন্তু লাশ সিনথিয়ার বদলে থাকবে অন্য কারো।”
— “বিস্তারিত বলেন।”
— “সিনথিয়া আজ চেকআপের জন্য বেরিয়েছে। চেম্বার থেকেই ওকে উঠিয়ে আনবে। ছেলেপেলেরা আছে ওখানে। ওকে বিস্তারিত জানানো হবে। যেদিন মার্ডার প্ল্যান, সেদিনই মার্ডার হবে। মতি গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকবে না নিশ্চয়ই?”
— “না। এলাকা ছাড়বে তৎক্ষনাৎ।”
— “সিনথিয়াকে আমরা সরিয়ে নেবো। তুমি প্রতি বিশমিনিট পরপর মতিকে কল করে আপডেট দেবে সিনথিয়ার। অজ্ঞান করলাম, খুন করলাম, এসিড দিলাম। গুছিয়ে বলবে কলে। ঐ রাতে তোমার নাম্বার মতির কল লিস্টে থাকা চাই।”
— “আচ্ছা।”
— “ফার্স্ট টার্গেট থাকবে বিকৃত চেহারার কোনো মহিলার বেওয়ারিশ লাশ বের করা যার বডি হাইট সিনথিয়ার সঙ্গে ম্যাচ হয়।”
— “না পাইলে?”
— “কোনো বেওয়ারিশ লাশের চেহারা বিকৃত করতে হবে। কিছু করার নেই। সিনথিয়ার পরনের জামা ওকে পরানো হবে। মার্ডারের দুইদিন পর লাশ ভাসবে নদীর পাড়ে। সেখান থেকে থানা, পুলিশ, মিডিয়া।”
— “পোস্ট মর্টেমেই ধরা পড়ে যাবে এই বডি আরো পুরানা। তখন?”
— “প্রশাসন সামলানো কোনো সমস্যাই না। কল যাবে, টাকা যাবে ব্যস! সমস্যা হলো মিডিয়া, জনগন, বিরোধী দল। এদের আইওয়াশ দিতেই এত নাটক।”
— “বুঝলাম।”
— “শেষ খেলাটা তোমার খেলতে হবে ফয়েজ।”
— “কী?”
— “সাক্ষ্যী।”
— “কী সেটা?”
— “মার্ডার লোকেশনের পুরো এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা সেট করবো। ওর গাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়াবে, সেখানে অবশ্যই ক্যামেরা থাকবে।”
— “জায়গা তো অন্ধকার। ক্যামেরায় ওকে দেখা যাবে না।”
— “আশপাশে বাসা বাড়ি আছে তো?”
— “আছে।”
— “গায়েবী আলো চলে আসবে। নন্দী দেখবে সেটা। ঐ এলাকার দু’জন লোক ওখানে থাকতে হবে। মতি গাড়ি থেকে বেরোচ্ছে তার চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা জরুরি। আমাদের কোনো একজন লোক ঐ দুইজনকে কথার ছলে সেখানে নিয়ে যাবে। মতি বেরিয়েছে তার খানিক সময় বাদে তুমি গাড়িতে বসছো সেটা ক্যামেরায় থাকা চাই। পুলিশ যখন তোমার জবানবন্দি নেবে, তুমি বলবে, খুন মতি করেছে। তুমি শুধু লাশ সরিয়েছো। ওদিকে সিনথিয়াকে বলে দেবো, বের হওয়ার আগে অন্তত তিনজনকে কথায় কথায় জানিয়ে বের হবে মতি তোমাকে নিয়ে বেরোচ্ছে। ইদানীং তার আচরণ সন্দেহজনক। কখন কোন ক্ষতি করে বসবে!”
— “এসব কইরা মতিরে আটকাইতে পারবেন?”
— “এই দিয়ে শুরু হবে। মতি আজ পর্যন্ত কম মেয়ের ক্ষতি তো আর করলো না। মিডল ক্লাস ফ্যামিলির বহু মেয়েকে চাকরির লোভ দেখিয়ে বা কখনো জোর করে তুলে এনে ও আর ওর ঘনিষ্ঠ চামচারা রেইপ করেছে এমন কেইস অন্তত ৫০টার উপর আছে। সব কয়টা এবার টানবো। সাংবাদিক, নারী সংস্থা, সোশ্যাল মিডিয়া সবকটাকে উল্কাবো। দেখি ও কেমন করে বের হয়!”
— “তারপর সিনথিয়ারে কী করবেন? মরা মানুষ তো জিন্দা হইয়া ঘুরতে পারবো না।”
— “ওকে চোরাই পথে ইন্ডিয়া পাচার করে দিবো। সেখান থেকে লন্ডন।”
— “এত ঝামেলার চেয়ে মতিরে ধরে নিয়ে মাইরা ফেললেই হয়।”
— “দলের লোক। চাইলেই ধরে নিয়ে মেরে ফেলা যাবে না। হিসেব নিকেশ আছে।”
— “এত বছরে পুলিশের কাছে সারেন্ডার করা লাগে নাই। এই চেহারার কোনো দাগ নাই, এখন দাগ ফালায়া দিতে বলতাছেন?”
— “তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াবো নাকি? সাক্ষ্য দেয়া মাত্র জেল থেকে বের করবো তোমাকে। সর্বোচ্চ একসপ্তাহ থাকবে তুমি। মাথার চুল, দাঁড়ি সব ছেটে ফেলো, পরিচিতরা চিনতে অসুবিধা হবে। চেষ্টা করবো মিডিয়ার সামনে একবারের বেশি তোমাকে না আনার। তাও সেটা খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য।”
— “তবুও….”
— “শুনেছি নতুন নতুন প্রেমে পড়েছো। বয়সও বাড়ছে। এসব খুন খারাবা করে আর কতদিন? নতুন জীবন শুরু করো।”
— “প্রেমিকা রাজি হয় না।”
— “রাজি করাও। তার বন্দোবস্ত আমি করে দেবো। ইউরোপের যেকোনো দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সঙ্গে থাকা, নতুন চাকরি বাকরির বন্দোবস্তও করে দিচ্ছি। বিয়ে শাদী করো, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সুখে ঘর করো। হয়তো এখনের মতো কামাই হবে না, তবে সুখের একটা জীবন তো পাবে। ঐ মেয়েটাও এমন জীবনের লোভ
কোনোভাবেই ছাড়বে না। জিজ্ঞেস করো ওকে।”
সামিরাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে ফয়েজ। ওর সঙ্গে সংসারের স্বপ্নটা একদম শুরু থেকে। আজ রুদ্র সেই স্বপ্নে ছোট ছোট বাচ্চা যোগ করে দিলো। চোখের সামনে দুই বেণী করে, গোলাপী ফ্রক পরা দুটো বাচ্চা ছুটছে। এই স্বপ্ন নিজ নাগালে পেতে অস্থির লাগছে ফয়েজের। এই সুন্দর মুহূর্তটা তার চাই। অবশ্যই, অবশ্যই চাই। আর সাত পাঁচ ভাবলো না ফয়েজ। মাথা দুলিয়ে বললো,
— “পুরোটা হয়ে যাবে। ভাববেন না।”
২৮
রাতের খাওয়া শেষে বারান্দায় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে সুরভী। রাতের আকাশের তারাদের পানে চেয়ে ভাবছে নিজেকে নিয়ে, অতীত আর বর্তমান নিয়ে। ভীষণ ভালোবাসা, বহুবছরের লালিত মায়া এক মুহূর্তে মন থেকে মুছে যেতে পারে, তা জানা ছিল না সুরভীর। নিজেকে দিয়ে প্রমাণ হলো তা। যাকে নিয়ে এতগুলো বছর ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল সেই স্বপ্নপুরুষ চোখের পলকে হলো মন ভাঙা খলনায়ক। মানুষটা ওকে ভালো না বাসতেই পারে, মনের উপর জোর নেই। সে কথা মুখোমুখি বলে দিলেও চলতো। তবে এই প্রতারণা! এই প্রতারণা মেনে নেবার মতো উদারতা তো তার নেই! আসিফের প্রতারণাই সমস্ত ভালোবাসা, মায়া মুছে দিলো মুহূর্তেই। এখন এই মন তন্নতন্ন করে খুঁজেও কেউ কোথাও আসিফকে পাবে না!
বাবার বাড়িতে দ্বিতীয় দিন আজ সুরভীর। সেদিনের পর আসিফকে মনে পড়েনি আর। মন থেকে উঠে যাবার ব্যাপারটাই হয়তো এমন। দুঃখ শোক যা-ও ছিল, বিয়ের ধাক্কায় তা-ও কেটে গেছে। জীবন লীলায় পাওয়া নতুন অধ্যায় সামলে বুঝে নিতেই টালমাটাল হচ্ছে ও। গত দুইদিনে রুদ্র মনের দরজায় কড়া নেড়েছে বারবার। ভালোবাসা নেই তার প্রতি, তবে ভালো লাগা জন্মাচ্ছে। যত্নের কোনো কমতি নেই মানুষটার কাছে। রুদ্র কেন তাকে বিয়ে করেছে সেই হিসেবটা আর
চাহনী কষতে ইচ্ছে করছে না। শুধু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে রুদ্রের এই যত্ন, কিংবা ভালোবাসায় মাখামাখি কথাগুলো কোনোটাই মিথ্যে নয়। সব সত্যি। ঐ বাড়িতে কাটানো চারদিনে হয়তো রুদ্রের সঙ্গে গাঢ় কোনো মুহূর্ত নেই, কিন্তু ছোট ছোট মুহূর্তগুলো মনের ঘরে গাঢ় দাগ কেটে গেছে। জীবনে বহু পুরুষের গল্প শুনেছে সুরভী, কখনো কাজিনদের, কখনো বান্ধবীদের কাছে। রুদ্র কারো মতো নয়। রুদ্র ভিন্ন। তার চাহনী ভিন্ন, বলার ধরণ ভিন্ন, মানসিক অন্তরঙ্গতা তৈরীর পারদর্শীতা ভিন্ন। তাকে দেখলে পুরুষের প্রতি নারীর চিরায়ত ধারণাটাই বদলে যাবে।
— “কী করছিস?”
মা এসেছে। পেছন ফিরে মুচকি হাসলো সুরভী।
— “কিছু না, এসো।”
ঘর থেকে একটা চেয়ার টেনে আনলেন মিতা। তাতে পা তুলে বেশ আয়েশ করে বসলেন তিনি।
— “জামাই ফোন করেছিল?”
— “হ্যাঁ। একঘন্টা আগেও কথা হলো।”
— “ও এল না। আমি মানতে পারছি না বিষয়টা।”
— “আমারও কেমন লাগছে।”
— “একটা কথা মাথায় এল, তাই তোকে বলতে এলাম।”
— “কী?”
— “সেদিন তোর শ্বশুরবাড়ির দাওয়াতে গিয়ে একটা ভুল করেছি আমরা। এত মানসিক চাপে খেয়ালই ছিল না একদম।”
— “কী সেটা?”
— “আমরা শুধু তোকে সঙ্গে আনতে চেয়েছি। নিয়ম অনুযায়ী জামাইসহ মেয়েকে বাপের বাড়ি আনতে হয়। রুদ্রকে আমরা বলিইনি সে কথা।”
— “তাই তো! উনিও আমাকে কিছু বললো না এই নিয়ে।”
— “ভুলই হলো। তারপর আমি কল করলাম গতকাল, পরে আসবে বললো। এটারও একটা কারণ আছে মনে হয়। কারণটা তোর বাবা। ও কল করেনি এখনো রুদ্রকে।”
— “পয়েন্ট!”
— “এখন তোর বাবাকে বলবো, বেয়াইনকে কল দিয়ে পরশু দুপুরের দাওয়াত করতে। ছেলের শ্বশুরবাড়ি উনারও তো দেখা চাই।”
— “হ্যাঁ। মা তো দেখলোই না কিছু। বিয়েটাও না।”
— “তোকে ওরা সবই দিয়েছে। জামাইকে উপহার দেয়া দূরের কথা, ঠিকঠাক আপ্যায়নই করলাম না, অথচ আমরা গিয়ে দাওয়াত খেয়ে এলাম। লজ্জার ব্যাপার! ভাবছি ওকে স্যুট, ঘড়ি, আংটি আর চেইন গিফট করবো। তোর শাশুড়ীকেও গোল্ডের চেইন, আংটি আর শাড়ী উপহার দেবো।”
— “তা দেয়া যাবে। আগে দাওয়াত তো করো।”
— “তোর ওখানে ভালোই লাগে, তাই না?”
— “হ্যাঁ। কেমন কেমন লাগাটা আর নেই। মা আর উনি খুব সহজ করে ফেলেছে আমার জন্য পুরো ব্যাপারটা। পুরোপুরি খাপ এখনো খাওয়াতে পারিনি। তবে যতটা পেরেছি ভালোভাবে থাকার জন্য যথেষ্ট।”
— “তোর বাবা এখনও গাল ফুলিয়ে আছে। আজ বিকেলেও তোর চাচা বুঝিয়ে বলছিল তাকে। মুখে মুখে হুম হ্যাঁ বললেও, মন থেকে মেনে নিচ্ছে না এখনও।
তবে আমি কী ভাবছি, জানিস? বিয়ে হয়ে গেছে। এটাই এখন তোর বর্তমান, তোর ভবিষ্যৎ। যত দ্রুত মেনে নিবি, যত দ্রুত রুদ্রকে আর এই সংসারটাকে আঁকড়ে ধরবি, ততই তোর জন্য ভালো। পুরুষ মানুষ বেশিদিন দূরে সরিয়ে রাখতে নেই। তার উপর যা অবস্থা ওর! গিয়ে দেখ বনেদী ঘরের মেয়েরাই ওর পেছনে বিবাহিত জেনেও লেগে থাকবে। তোর এমন ঘরে বিয়ে হবে ভাবিনি কখনো। জোর করে হলেও ভালো সম্বন্ধ জুটে গেছে এ-ই অনেক। তোকে দেখছি পর থেকে সব দ্বিধা, সংশয় কেটে গেছে আমার। রুদ্র তোকে কেমন করে বিয়ে করলো সেটা আর ভাবতে চাই না। ওটা অতীত। তুই এখন কেমন আছিস সেটা আমি দেখবো। তুই ভালো আছিস মানে ওরা তোকে ভালো রাখছে। তোর চাচী ফুফুরা তো এই নিয়ে গল্প করেই কূল পাচ্ছে না। সবার একই কথা, যা হবার হয়েছে। এবার মেনে নিয়ে সুরভী আগে বাড়ুক। সবকিছু সামলে চলতে জানলে ওর সুখের সীমা থাকবে না। তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস তো?”
মায়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট বুঝলো সুরভী। বাইরে চোখ ফিরিয়ে, মাথা দুলিয়ে, লম্বা নিঃশ্বাস নিলো ও। শরীরী অন্তরঙ্গতার পার্ট কবে চুকবে, কবে মন পুরোপুরি সায় দেবে তা জানা নেই সুরভীর। তবে রুদ্র যেহেতু আপাতত চাইছে না, থাকুক না সেসব। এখন যেমন চলছে তা ভীষণ ভালো। এই সময়টা, এই অনুভূতিটা থাকুক আরো কিছুদিন। সময় যাক, যা কিছু গাঢ় হওয়ার সময়ের তালে, অনুভূতির জোয়ারে ভেসে সবটা আপনাআপনি হয়ে যাবে।
মিতা আরো কিছু বলতে চাইছিল, তখনই কল এল রুদ্রের।
— “হ্যালো?
— “খাওয়া দাওয়া শেষ?”
— “হ্যাঁ। আপনার?”
— “উঁহু।”
— “এখনো বাইরে?”
— “সুরভী …”
— “জি?”
— “আমাকে মনে পড়ে তোমার?” ঠোঁট চেপে হাসলো সুরভী।
— “নাহ।”
— “বাট আই এ্যাম মিসিং ইউ এ্য লট! দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। পাশে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। আমি তোমার বাসার নিচে সুরভী। আসবে আমার কাছে?”
— “আপনি নিচে দাঁড়িয়ে!”
একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মা-মেয়ে। গ্রিলের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো সত্যিই রুদ্র বাসার নিচে। গাড়ির উপর বসে কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলছে। এক ছুটে স্বামীর কাছে গেলেন মিতা। জামাই এসেছে! তাকে বাসায় আনতে হবে।
— “চলো কোথাও থেকে একটু বেরিয়ে আসি। আমি তোমার সঙ্গে একটু সময় কাটাতে চাই।”
দ্বিধায় পড়ে গেল সুরভী। রুদ্রকে বাসায় ডাকবে নাকি বাইরে যাবে সে দোটানায় পড়ে গেল ও। পাঁচ সাত সেকেন্ড চুপ থেকে, দ্রুত ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো ও। – “বাইরে না। বাসায় আসুন। আমার ঘরে বসে গল্প করবেন।”
— “না। তুমি ঝটপট জামাটা পাল্টে নেমে এসো।”
— “আসবো না, আপনি আসবেন।”
রুদ্র আবারও কিছু বলতে যাবে তখনই নিচে নেমে এল শরীফ সাহেব আর মিতা। উপর থেকে মা-বাবাকে দেখলো সুরভী। গায়ে কোনোরকম ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে এক দৌড়ে নিচে নেমে এল সে।
বাবা-মা মিলে রুদ্রকে পীড়াপীড়ি করছে উপরে আসার জন্য। তাদের সঙ্গে সুরভীও তাল মেলালো।
— “চলুন না, এত করে বলছে!”
— “আজ না।”
— “এক কাপ চা অন্তত আমার সঙ্গে খেয়ে যাও।”
— “আসবো বাবা। অন্য একদিন সময় নিয়ে আসবো। আজ সুরভীকে নিয়ে একটু বেরোবো। জরুরি কাজ আছে।”
বলেই সুরভীর হাত টেনে ধরলো রুদ্র।
স্বামী-স্ত্রী মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এক মুহূর্ত নীরব থেকে রুদ্রের ইচ্ছেতেই সায় দিলেন শরীফ সাহেব।
— “আচ্ছা! কাজ আছে যেহেতু, যাও তাহলে।”
মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চরম বিরক্তি নিয়ে স্বামীর পেছন পেছন এলেন মিতা। ঘরে ঢুকেই রাগ ঝাড়তে লাগলেন তিনি।
— “তুমি যেতে দিলে কেন?”
— “ও আসতে চাইছে না। সুরভীকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইছে। তাই যেতে দিলাম।”
— “বাহানা করো না। এই বিয়ে আর মেয়েজামাইকে তুমি এখনো মেনে নিতে পারছো না, জানি আমি। তোমার অভিমান স্পষ্ট বুঝা যায়।”
— “মেনে না নিতে পারা কি স্বাভাবিক না?”
— “এই মুহূর্তে স্বাভাবিক না। সুরভী তো ভালোই আছে। সৌভাগ্য নিজে এসে
মেয়ের কাছে ধরা দিয়েছে। এমন পাত্র তুমি আমি খুঁজেও তো মেয়ের জন্য আনতে পারতাম না।”
— “এমন পাত্র আমি খুঁজতামও না। আমি সাধারণ, মেয়েকেও সাধারণ ঘরেই বিয়ে দিতাম।”
— “যা হবার তা তো হয়ে গেছে মাহিনের আব্বু। রুদ্রই এখন সুরভীর বর। বদলে ফেলা যাবে সে কথা?”
— “যাবে না, কিন্তু মেনে নিতে একটু সময় তো লাগবে।”
— “সময়-টময় বুঝি না আমি। মেয়ে জামাইরা ঘরের মুকুট, তাকে সেই সম্মানই দিতে হবে। মেয়ে একা এসেছে বেড়াতে, এমন হয় তুমিই বলো? তুমি কালই ওর আত্মীয়সহ ওকে দাওয়াত করবে। পরশু এসে মেয়েকে ওরা নিয়ে যাবে।”
— “এসেছেই মাত্র, এখনই কেন চলে যাবে?”
— “যাওয়া জরুরি তাই যাবে। বাসা তো আর ঢাকার বাইরে না। ইচ্ছে হলে চলে আসবে যখন খুশি।”
— “তবুও, থাকতো না হয় আরো কয়েকটা দিন।”
— “তুমি এত কেন ভাবছো? ভালো আছে ওখানে সুরভী। ও নিজ মুখে বলেছে আমাকে। মেয়েকে তুমি দেখতে পাও না?”
— “এসব ছাড়ো বুঝলে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখো, থাকো। কাল সকালেই তুমি রুদ্র আর ওর মাকে কল করে দাওয়াত করবে। তারপর সোজা বাজার। আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা প্রথম মেহমান হয়ে আসবে, তাদের আপ্যায়নে ত্রুটি থাকা চলবে না।”
মিতা একাই বলে চলছে। শরীফ সাহেব চুপচাপ শুনছেন সেসব। সুরভী ভালো আছে মেয়েকে দেখেই বুঝে গেছেন তিনি। তবুও কোথায় একটা গিয়ে যেন বারবার আটকে যান। এই সম্পর্কটা মানতে গিয়েও ঠিক মেনে নিতে পারছেন না।
গাড়ি ছুটছে উদ্দেশ্যহীন। গন্তব্য রুদ্রের জানা ইেন। গাড়ি আজ সে-ই ড্রাইভ করছে। পেছন পেছন ছুটছে বডিগার্ডের গাড়ি। শুভ আজ পেছনের গাড়িতে। ছায়ার মতো লেগে আছে ওরা রুদ্রের পেছনে।
— “আমরা কি এভাবেই রাস্তায় ঘুরতে থাকবো?”
— “হ্যাঁ।”
— “তারচেয়ে বাসায় বসলে ভালো হতো না?”
— “বিরক্ত লাগছে?”
— “একদম না! বিরক্ত কেন লাগবে? তবে একটু মন খারাপ লাগছে। আপনি আমাদের বাসায় যেতেই চাচ্ছেন না!”
— “আহা! সময় কি চলে যাচ্ছে? যাবোই তো।”
— “সত্যি করে একটা কথা বলুন তো?”
— “কী?”
— “আপনাকে আলাদা করে বাবা দাওয়াত করেনি, তাই আসছেন না, তাই না?” এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো রুদ্র। পর মুহূর্তেই মুচকি হেসে বললো,
— “হ্যাঁ উনি আসলে আমাকে মেনে নিতে পারছেন না। এটা নিয়ে আমার অভিযোগ নেই একদম। এমন হওয়াই স্বাভাবিক। আমি জাস্ট স্পেস মেইনটেইন করছি। যাক কিছু সময়। উনি ব্যাপারটা সহজভাবে নিক। তারপর যাওয়া-আসা সব হবে। তোমাকে সেদিন মা-বাবার সঙ্গে আসতে দেইনি এই একই কারণে। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারবো না। আগেরদিন মাত্র আমার ঘরে এলে, ঠিকমতো তখনো কথাই হলো না আমাদের। ঐ মুহূর্তে কী করে বাপের বাড়ি যেতে দেই তোমাকে? ভালো লাগতো না আমার একদম। তাই যেতে দেইনি।”
— “এখনও তো আমি নেই। ভালো লাগছে?”
— “আমাকে দেখে একদম বুঝতে পারো না তুমি? কেমন থাকলে একটা মানুষ কাজ ফেলে এই রাতে তোমাকে দেখার জন্য হুট করে ছুটে চলে আসে? তোমার অভ্যেস হওয়ার মতো সময় আমাদের একসাথে কাটানো হয়নি। তবুও তুমি নেই, ঘরে ফিরে তোমাকে পাচ্ছি না, ভালো লাগে না আমার। ফিরে এসো না জলদি! নয়তো রোজ সমস্ত কাজ শেষ করে তোমার বাসায় আসতে হবে তোমাকে দেখতে।” রুদ্রের চোখে তাকালো সুরভী। চাহনীর মাঝে তার প্রতি দুর্বলতা স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে। এই চাহনীতে মন গলে যাওয়া কি খুব স্বাভাবিক না?
বাইরে চোখ ফেরালো সুরভী। কারণে অকারণে বহু অবহেলা পেয়েছে সে আসিফের কাছে, তবুও সম্পর্ক আঁকড়ে রেখেছিল ভালোবাসে বলে। বারবার একটুখানি ভুল হয়ে গেছে ভেবে তাকে ক্ষমা করেছে। বিনিময়ে কী পেল তার কাছে? শুধু প্রতারণা। পৃথিবীতে কারো কর্তৃক শুধুই ব্যবহৃত হবার চেয়ে অপমান হয়তো আর কিছুই নেই। আর এই মানুষটা! চেনা নেই, জানা নেই। কখনো কিছুই দেয়নি যাকে, সেই মানুষ কিনা তাকে পাবার জন্য এত মরিয়া? প্রয়োজনে সবকিছু উল্টে পাল্টে ফেলবে শুধুমাত্র তার জন্য? এত চাওয়া উপেক্ষা করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত না। ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক, তার এই চাওয়াটুকুকে সম্মান করাই যায়। এই মানুষটাকে অনেক যত্নে রাখা যায়। জীবনের নতুন মোড় যেহেতু না চাইতেও এসে গেছে, তবে সে মোড় ধরেই নাহয় নতুন করে পথচলা শুরু হোক। তবে তার আগে পুরোনো এক হিসেব বরাবর করার বাকি আছে। রুদ্রের কাছে বিনা সংকোচে আবদার রাখলো সুরভী।
— “একটা জিনিস চাওয়ার ছিল। আসিফ যেখানে আছে আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন। শেষ একটা হিসাব বাকি আছে ওর সঙ্গে। ওটা মিটিয়ে ফেলতে চাই।” তৎক্ষনাৎ ব্রেক কষলো রুদ্র।
— “কিসের হিসাব?”
— “এতবড় ধোঁকা দিয়েও একেবারেই শাস্তি না পেয়ে আয়েশের জীবন কাটাবে, তা তো হতে পারে না।”
— “তো কী চাও? ওকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনি?”
— “নাহ! থাকুক। ওসব কাফ্ফারা হয়ে থাকুক। ওর কাছে গেলে সারাজীবনের জন্য যা কিছু ভুগতে হতো তা থেকে বেঁচে গেছি সেইসব কিছুর কাফফারা এসব।”
— “তো কী চাও?”
— “চড়।”
— “দিতে চাও?”
— “হ্যাঁ।”
— “ওকে ডান। রাজশাহী আছে। ফ্লাইট বুক করে কালই নিয়ে যাবো।”
২৯
সুসজ্জিত ফ্ল্যাট। খুব একটা বড় না, কিন্তু একা মানুষের জন্য যথেষ্টের চেয়ে বেশি। চোরমুখো হয়ে বসে আছে আসিফ। ঘাড়ই তুলছে না। ভয়টা সুরভী না, আসল ভয় হলো সুরভীর পাশে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির লোকটা। মনে হচ্ছে যেন ঘাড় তুলে সুরভীর দিকে তাকানো মাত্র এক কোপে শরীর থেকে ঘাড়টা আলাদা করে ফেলবে।
বসার ঘরে, সোফায় বসে ঘরের মধ্যে চোখ যতদূর যায় ততটুকুই দেখলো সুরভী। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এল ওর। আসিফের চুলের মুঠো ধরে, মাথা টেনে উপরে তুলে মনের ভেতর জমে থাকা সমস্ত রাগকে শক্তি করে সজোরে তার গালে চড় কষালো। মুখ টিপে হাসলো রুদ্র। মনের ভেতর যেন দখিন হাওয়া বইছে।
রাগে সুরভী কাঁপছে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। রুচি হচ্ছে না এই প্রতারকটার সঙ্গে কথা বলতে। আসিফের মুখ বরাবর একদলা থুতু মেরে বেরিয়ে এল সুরভী। এক দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসলো ও। পেছন পেছন ছুটে এল রুদ্রও। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সুরভীর চোখের পানি অস্থির করে তুললো রুদ্রকে। সুরভী আসিফের জন্য কাঁদছে! এখনো অনুভূতি রয়ে গেছে ঐ ছেলেটার জন্য? মানতে ইচ্ছে করছে না একদম। ইচ্ছে করছে আসিফকে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে।
রুদ্রের রাগ তুঙ্গে উঠার মুহূর্তে একাই সুরভী বলতে লাগলো,
— “আমার নিজের জন্য ভীষণ আফসোস হয়। এমন একটা মানুষের পেছনে নিজের এতগুলো বছর কী করে দিয়ে দিলাম? আব্বু-আম্মুকে ঠকানোর প্ল্যানটাও করে ফেলেছিলাম। বিয়ের বউ বাসা থেকে পালিয়ে গেছে, সে কথা জানাজানি হলে আব্বু-আম্মু আর কখনো কারো সামনে মুখ দেখাতে পারতো না। একটা অমানুষের পেছনে সমস্ত আবেগ ইনভেস্ট করেছি আমি। আব্বু-আম্মু খুব ভালো মানুষ। কখনো কাউকে কষ্ট দেয়নি, সবাইকে যথাসাধ্য সাহায্য করেন। আত্মীয়দের খুশি রাখার চেষ্টা করেন। তাদের পূণ্যের জোরে আমি বেঁচে গেছি। নয়তো ঐ অমানুষটার কাছে আমাকে একটু একটু করে রোজ মরতে হতো।”
বলেই আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো সুরভী। ওর কান্নার কারণ এবারে স্পষ্ট হলো রুদ্রের কাছে। রাগের জায়গাটুকু মুহূর্তেই মায়া দখল করে নিলো। ওকে কাছে টেনে নিলো রুদ্র। তার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে সুরভী। দু’হাতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো রুদ্র
*****
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সিনথিয়া। দু’গাল নোনাজলে সিক্ত। শুভ তার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো।
— “আপনার এই মুহূর্তে স্ট্রেস নেয়া উচিত হবে না। আমরা দেখবো পুরো ব্যাপারটা। কিছু হবে না আপনার।”
আরো কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর মুখ খুললো সিনথিয়া,
— “আপনাকে যদি কিছু বলি আপনি কি সেটা বিশ্বাস করবেন?”
— “কী?”
— “আই রিয়েলি লাভড হিম! হ্যাঁ, প্রথমদিকে ক্যারিয়ারে গ্রো করার জন্য মতিকে আমি ইউজ করতে চেয়েছিলাম। সবাই যেমন ভাবে, মডেল মানেই খারাপ পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়ে, মডেল মানেই ইমোশনলেস। সবসময় তা না! খোঁজ নিলে জানতে পারবেন আমিসহ আরো অনেকে আছে যারা রিলিজিয়াস ফ্যামিলি থেকে বিলং করে বা আমাদের বেড়ে উঠা খুবই সুন্দর পরিবেশে হয়েছে। ইমোশন আমাদেরও আছে। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকটায় নিজের ভালো দিকগুলো নৈতিকতাগুলো টিকিয়ে রাখতে পারাই চ্যালেঞ্জ। শোবিজের চাকচিক্য, নতুন নতুন ফেইম এসব দেখে প্রথম প্রথম কারোই মাথা ঠিক থাকে না। তখন মনে হয় উপরে উঠতেই হবে, তাতে আমার নৈতিকতা বিসর্জন হোক কিংবা সম্ভ্রম। আমিও টিকতে পারিনি। কিন্তু যখন সুপার মডেল হলাম, খ্যাতি, সম্মান, টাকা সব হলো, তখন এসে মনে হলো অনেক কিছু খুইয়েছি, যার সামনে এই খ্যাতি তুচ্ছ। মোহ কেটে গেছে। আবেগ, নৈতিকতা আবারো অনুভব করতে শিখেছি। তার মাঝে কী করে যেন মতিকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনেক দিনের একটা প্রেম ছিল আমার, মিডিয়ায় আসার আগে। খুব লক্ষ্মী ছেলে ছিল সে। মডেলিংয়ে পা রাখা মাত্র ওর সঙ্গে আমি ব্রেকআপ করলাম। কষ্ট পেয়েছিল খুব। সুইসাইড এটেম্পটও নিয়েছিল। কপাল গুণে বেঁচে গেছে। সেই অন্যায়ের শোধটাই বোধহয় উপরওয়ালা নিলেন। কখনো কোনো পুরুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার গল্প আমার নেই। আমার এক্সের সঙ্গেও না। মতির সঙ্গে শুরু থেকে এটাচড ছিলাম। তাই কেউ ওসব প্রস্তাব দেবার সাহস করেনি। কোনো পুরুষ আমার এত কাছে এসেছে বলেই হয়তো ওর জন্য এই ভালোবাসা, মায়ার জন্ম। যাক, বেশ প্রতিদান পাচ্ছি আমি!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সিনথিয়া। কেমন বুক ভাঙা কষ্ট হচ্ছে শুভর। মাকে মনে পড়ছে। তার জন্মের ঠিক বারো বছর পর মা তৃতীয়বারের মতো গর্ভবতী হয়েছিল। বাবা আর নিতে চায়নি তারাসহ নতুন বাচ্চার দায়িত্ব। মায়ের কান্নাভেজা চোখ, চাপা বিলাপ শুনে নীরবে মুখ লুকিয়ে কাঁদতো সেও। কী বিভীষিকার সেইসব দিনরাত্রি! তারপর এক সকালে পেটে থাকা সেই ভাইটা মারা গেল। হয়তো মায়ের কষ্টের বোঝা ঐ ছোট্ট শরীরটা নিতে পারেনি। তিন ভাইবোনের মাঝে সে-ই তো ছিল মায়ের ভেতর। কষ্টটাও অনুভব করেছি সবচেয়ে বেশি সে-ই।
এখানে আর বসতে ইচ্ছে হলো না তার। সিনথিয়ার মাথায় আলতো করে হাত রেখে চলে এল সে।
পেছন পেছন বেরিয়ো এল নন্দী। বললো,
— “মেয়ে মানুষের রুচি এত খারাপ! কিসব খাটাশ পুরুষদের জন্য জীবন দিয়ে দেয়া প্রেম ওদের। ছিঃ!”