রুদ্র – ১০

১০

মেয়েটার ঘর বেশ আলো ঝলমলে। দূর থেকে যতটুকু বুঝা যায় ওর ঘরে দু’টো বড় জানালা। একটা ওর ঘরের বারান্দা মুখী অন্যটা ওর বিছানার মাথার কাছে। দিনের আলোয় ঘরের ভেতরটা খুব স্পষ্ট না দেখালেও জানালার আশপাশের দিকটা বেশ দেখা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যেখানে কে হাঁটছে-ফিরছে তাও আবছা দেখা যাচ্ছে। ভোরে আদনানের সঙ্গে কথা বলার পর ঘন্টা দুয়েক ঘুম হয়েছিল রুদ্রের। সাড়ে সাতটায় ঘুম ভেঙে গেল, তারপর আর ঘুম হয়নি। ফ্রেশ হয়ে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে এল বারান্দায়। তখন থেকেই মিহি দৃষ্টিতে সেই অপরিচিতার জানালায়, বারান্দায় চেয়ে আছে রুদ্র। কখনো মেয়েটা আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছে, কখনো ঘরের একোণ-ওকোণ করছে, আলমারির দরজা খুলছে, বন্ধ করছে, টেবিলের বইপত্র নাড়াচাড়া করছে। মাঝে ঘরের মধ্যে দু’বার কে যেন এল। ওর মা হবে হয়তো! একেবারে স্পষ্ট ঘরের ভেতরটা দেখা না গেলেও অস্পষ্টও লাগছে না। তবে ওর মুখটা স্পষ্ট করে একবার দেখার সাধ হচ্ছে রুদ্রের। ওর ছুটোছুটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে ভার্সিটির জন্য বেরোবে ও। আয়নার সামনে একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। সেজেছে বোধহয়! সাজলে কেমন দেখায় ওকে, তা দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হচ্ছে রুদ্রের। দ্রুত চুমুকে কফিটা শেষ করলো রুদ্র। শোবার ঘরের তোশকের নিচ থেকে দু’টো রিভলবার, ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে সানগ্লাস আর মাস্ক নিয়ে বসার ঘরে গেল রুদ্র।

শুভ আর বডিগার্ড দু’জন কফি খেতে খেতে গল্প করছিল। বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুভর দিকে একটা রিভলবার ছুঁড়ে দিয়ে রুদ্র বললো,

— “কফিটা রাখো। এসো আমার সঙ্গে।”

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো বডিগার্ড দু’জন।

রুদ্র হাত ইশারা করলো,

— “তোমরা না। শুভ আছে আমার সঙ্গে। প্রয়োজন হলে কল করবো।”

— “ওকে ভাই।”

এক প্রকার দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙছে রুদ্র। রুদ্রকে পাশ কাটিয়ে তার আগে ছুটলো শুভ। গাড়ি বের করতে হবে।

*****

রাস্তার মাথায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ আর রুদ্র। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে রুদ্র তাকিয়ে আছে ফেলে আসা গলির দিকে।

গাড়ির ভেতর থেকে শুভ জানতে চাইলো,

— “কার জন্য অপেক্ষা করছেন?”

একটু করে বাঁকানো হাসি ফুটলো রুদ্রের ঠোঁটের বাম কোণে। ঐ তো আসছে মেয়েটা। হাতে টিস্যু পেপারে রোল করা পরোটা। ভেতরে কী আছে? ভাজি নাকি বুন্দিয়া? খেতে খেতে অনেকটা ছুটে আসছে এই রাস্তার দিকে। পাঁচ সেকেন্ডে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রায় স্ক্যান করে নিলো রুদ্র। পার্পেল কুর্তীর সঙ্গে ম্যাচ করে ঠোঁটে বেবি পিংক লিপস্টিক, কপালে কালো টিপ আর কাঁধ বেয়ে পেট অব্দি নেমে এসেছে বেণী। কান আর কপালে ছড়িয়ে আছে কয়েকগাছি চুল। বাম হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। ব্ল্যাক লেগিংসে পায়ের গড়ন স্পষ্ট মাপতে পারলো রুদ্র। হ্যাংলা- মোটা কিছুই না। একেবারে পারফেক্ট শেইপ! মুখ-হাতের তুলনায় পায়ের পাতা জোড়া যেন একটু বেশিই ফর্সা। চিকন জোড়া নুপুর, টো রিংগুলো যেন পায়ের সৌন্দর্য একটু বেশিই বাড়িয়ে দিয়েছে। ও যখন ছুটে আসছিল ঘাড় থেকে সামনে ঝোলানো স্কার্ফটা দু’পাশে সরে গিয়েছিল বুকের উপর থেকে। সেদিকে চোখ পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো রুদ্র। গতরাতের সেইসব অন্তরঙ্গতা মনে ঢেউ তুলে দিলো তক্ষুণি। এই ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া চলবে না। অন্তত এই মুহূর্তে না। মোবাইল টেপার বাহানায় চোখ নামিয়ে রাখলো রুদ্র।

তার গাড়ির পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা রিকশা ভাড়া করবে বলে। রুদ্র কান পেতে রইলো সেদিকে মেয়েটার গন্তব্য জানবার উদ্দেশ্যে।

খানিক সময় বাদে গাড়িতে লাফিয়ে উঠলো রুদ্র। শুভকে তাড়া দিলো,

— “ঐ রিকশাটা ফলো করো।”

বিলম্ব না করে শুভও রিকশার পিছু নিলো।

ড্রাইভ করতে করতে শুভ জিজ্ঞেস করলো,

— “এটা কে? মতির নায়িকা?”

— “আমার।”

তৎক্ষনাৎ গাড়ির ব্রেক কষলো শুভ। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। হাসলো রুদ্র। ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে পেলো ঠিক পেছনের বাইক চালক, রিকশাওয়ালারা উত্তেজিত হয়ে তাদের কিসব যেন বলছে। গালি গালাজই করছে হয়তো!

শুভর পিঠ চাপড়ে রুদ্র বললো,

— “লোকজন ক্ষেপে যাচ্ছে, ঐ মেয়েটাও চলে যাচ্ছে। জলদি করো!” নিজেকে সামলে আবার গাড়ি স্টার্ট করলো শুভ। বললো,

— “কে উনি?”

— “উনি কে, সে খবর তুমি ভালো বলতে পারবে। তোমার প্রতিবেশী।”

— “আমি মুখটা খেয়াল করে দেখিনি।”

— “তোমার ফ্ল্যাট বরাবর নীল দেয়ালের বাড়িটা আছে না? সেটার তিনতলায় থাকে।”

— “আচ্ছা! কিন্তু আপনি চেনেন কেমন করে?”

— “চিনি না। মুখটাই চিনি শুধু। আর কোথায় পড়ে এইমাত্র জানলাম। হোম ইকোনমিক্সের স্টুডেন্ট। নাম কী, কিসে পড়াশোনা করে, বয়স কত, বাবা কে কিচ্ছু জানি না।”

রুদ্রের চোখের ভাষা শুভ পড়ে নিলো এক মুহূর্তেই। মেয়েটাকে সে পেতে চাইছে। চিরতরে একান্ত নিজের করে। তার নামের সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে দিতে চাইছে। প্রচন্ড খুশিতে আটখানা লাগছে শুভর। মুখ থেকে হাসি সরছেই না! এবার বুঝি এই মানুষটার জীবন গোছানোর পালা! নির্ঘুম রাত শেষ হবার পালা। নিজেকে ভেঙেচুড়ে কারো হাতে তুলে দেবার পালা। এত খুশি হয়তো নিজের প্রেমটা হবার সময়ও অনুভব হয়নি শুভর।

রুদ্রের দিকে একনজর তাকিয়ে, প্রশস্ত হাসিতে সে জানালো-

— “সন্ধ্যার মধ্যে সব ইনফরমেশন জানাচ্ছি।”

— “শুধু ইনফরমেশন না, এখন থেকে আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকদের মাঝ থেকে একজন ওর সঙ্গে ছায়ার মতো থাকবে।”

— “শিশিরকে কল দিচ্ছি আমি।”

— “তুমি খোঁজ নেয়ার পর বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো।”

— “মুরুব্বি লাগবে একজন। নিজের প্রস্তাব নিজে নিয়ে যাওয়া চলবে না। আপনি যেই ফ্ল্যাটের কথা বলছেন, জানামতে ঐ ফ্ল্যাটে বাড়িওয়ালা থাকে। জুম্মার নামাজে দুই তিনবার দেখা হয়েছিল উনার সঙ্গে। কথার প্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম ঐ বাড়ির বাড়িওয়ালা উনি। রিটায়ার্ড গভঃ অফিসার। এর বাইরে তেমন কিছু জানি না। পরিবার নিয়ে কথা হয়নি কখনো। ভদ্রলোক আদব কায়দার ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক। কিন্তু কথা বলেন খুব নরম স্বরে, হাসিমুখে। তাই বলছি আরকি, মুরুব্বি দিয়ে প্রস্তাব পাঠালে ভালো হয়। খালাম্মা আসতে পারবে না। আপনি আমি প্রস্তাব নিয়ে গেলে উনি হয়তো পজিটিভলি না-ও নিতে পারেন।”

— “মুরুব্বির অভাব?”

— “কাকে পাঠাবেন?”

— “ইকবাল মাহমুদ আছে কেন? উনি ছাড়াও আমার তো লোকের অভাব নেই। সেসব পরে ভাবা যাবে. আগে ইনফরমেশন নাও।”

১১

সন্ধ্যার দিকে মুড়িমাখা খাচ্ছিল রুদ্র। টিভিতে নিউজ দেখছে সে। আদনানের বিরুদ্ধে টিভিতে কোনো নিউজ এখনো দেখানো হয়নি। দুপুর থেকে তাই প্রতি ঘন্টার নিউজে খোঁজ রাখছে সে। আদনান তবে ভালোভাবেই সোমার পরিবারকে সামলেছে। আজগরের কানেও হয়তো এখনও খবর যায়নি। নয়তো একটা কারসাজি এতক্ষণে হয়েই যেত।

ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজছে। মেজবাহ গিয়ে দরজা খুললো। শুভ ফিরেছে। দুপুরে বেরিয়েছিল বাসা থেকে। বাসা থেকে বেরোবার আগে যতটা হাসিখুশি লাগছিল, এখন ততটাও হাসিখুশি লাগছে না। ক্লান্তও লাগছে বেশ।

রুদ্র সুমনকে ডেকে বললো,

— “ওকে এক গ্লাস পানি দাও তো।”

রুদ্রের পাশে এসে গা ছেড়ে বসলো শুভ। কৌতূহলী হয়ে রুদ্র জানতে চাইলো,

— “শরীর খারাপ নাকি তোমার?”

— “না।”

— “তাহলে?”

— “সুরভীর জন্ম থেকে আজ অব্দি যতটা জানা সম্ভব সব খোঁজ নিয়ে এলাম।”

— “ওর নাম সুরভী?”

— “হ্যাঁ।”

আবারও গত রাতের দৃশ্য মনে পড়তে লাগলো রুদ্রের। নাকের ডগায় স্বপ্নে সুরভীর গা থেকে ভেসে আসা সেই ঘ্রাণ টের পেল। হঠাৎ সে হারিয়ে যেতে লাগলো এই মুহূর্ত থেকে স্বপ্নে। চোখের সামনে থেকে মেজবাহ, শুভ ঘোলা হতে লাগলো। মাথা মৃদু ঝাঁকিয়ে লম্বা দু’টো নিঃশ্বাস নিলো রুদ্র। নিজের লাগাম টানা জরুরি ছিল, নয়তো মন হারিয়ে সুরভীর কথা আর শোনা হতো না মনোযোগ দিয়ে।

সুমন এল গ্লাস হাতে। শুভকে গ্লাসের দিকে ইশারা করে রুদ্র বললো,

— “পানিটা খাও।”

খেলো না শুভ। সুমনের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে টি টেবিলের উপর রাখলো সে।

— “ঝামেলা আছে ভাই। সুরভীকে পাওয়া সম্ভব না!”

ভ্রু কুঁচকালো রুদ্র।

— “কেন?”

— “সুরভীর বিয়ে ঠিক। ১৪ দিন পর বিয়ে।”

— “আচ্ছা!”

— “তার উপর বয়ফ্রেন্ড আছে। নেক্সট উইক পালিয়ে বিয়ে করার প্ল্যান করছে।”

— “ওহ্ হো, টুইস্ট!”

— “হ্যাঁ ভাই টুইস্ট!”

বড্ড হতাশ ভঙ্গিতে বললো শুভ। এসব খোঁজ খবরের পালা আসার আগ পর্যন্ত প্রচন্ড খুশিতে মনে মনে রীতিমতো লাফাচ্ছিল সে। রুদ্র ভাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভাবা যায়! প্রতিদিন নিয়ম করে মনে-প্রাণে যার সুখ কামনা করে, সেই মানুষটার সুখের একটা গতি হচ্ছে সে আনন্দেই কত কী ভেবে ফেলছিল মনে মনে। কত আনন্দ হবে বিয়েতে! নিজে দায়িত্ব নিয়ে বিয়ের সব কাজ দেখাশোনা করবে সে। অথচ হলোটা কী? জীবনে প্রথম যাকে চোখে ধরলো, সেই মেয়েটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।

শুভর হতাশা চোখ এড়ালো না রুদ্রের। গ্লাসটা ওর হাতে তুলে দিয়ে হাসলো রুদ্র। বললো,

— “টুইস্টময় জীবন সুরভীর! প্রেমিক আছে, বাগদত্তা আছে। সিরিয়ালে এখন

আবার আমিও আছি। বিয়েটা ওর হবে। নেক্সট উইকেই হবে, তবে আমার সঙ্গে। ওর লাইফের সবচেয়ে বড় টুইস্ট হলাম আমি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ওর জীবনটা সম্পূর্ণ অচেনা পথে মোড় নেবে। একেবারে আনএক্সপেক্টেডে কারো সঙ্গে ওর বিয়ে হতে চলেছে সেটা নিশ্চয়ই ও দুঃস্বপ্নেও কখনো দেখেনি।” রুদ্রের কথায় এক নিমিষেই হতাশা উড়ে গেল শুভর।

— “তার মানে আপনি ওকেই বিয়ে করবেন?”

— “কেন করবো না?” অবাক স্বরে জানতে চাইলো রুদ্র।

এক নিঃশ্বাসে পুরো পানির গ্লাসটা খালি করে ফেললো শুভ। হাতের তালুতে ঠোঁটের আশপাশ মুছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।

— “আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আর পা বাড়াবেন না। বয়ফ্রেন্ড আছে, ফিয়ন্সে আছে। এসব শুনে হয়তো ফিরে যাবেন।

— “সুন্দরী মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকা খুব নরমাল। আমিও মোটামুটি সিওর ছিলাম ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। এটা কোনো সমস্যাই না। লাইফ থেকে বয়ফ্রেন্ড দূর হবে, হাজবেন্ড আসবে। আর রইলো কথা ওর ফিয়ন্সের, সেটা তো আরো ঝামেলা ছাড়া বিষয়। কারণ সুরভী ওকে পছন্দই করে না। কোনো প্রকার ইমোশনাল এটাচমেন্টই নেই। তাই ওটাকে গোণায় ধরার কোনো মানে হয় না। লাথি মেরে দু’টোকে সরিয়ে দেয়া দুই মিনিটের কাজ।”

— “হয়ে যাবে। কোনো ঝামেলা, হল্লা ছাড়াই মিটিয়ে ফেলবো।”

— “ওকে আমার লাগবে শুভ। ওকেই লাগবে। অন্য কাউকে দিয়ে চলবে না। সুরভী যদি ডিভোর্সি কিংবা দুই বাচ্চার মা-ও হতো সেসবও আমার কাছে ম্যাটার করতো না।”

— “আপনি যতটুকু বলেছেন, এটাই যথেষ্ট। আর কিছু বলতে হবে না।”

— “ওর সম্পর্কে বলো কিছু।’

— “হোম ইকোনমিক্সের স্টুডেন্ট, তা তো আপনি দেখেই এলেন। ফ্যাশন ডিজাইনিং ডিপার্টমেন্ট, ফাইনাল ইয়ার।”

— “বাহ্!”

— “দুই ভাইবোনের মাঝে উনি ছোট। বড় ভাই পি.এই.ডির জন্য আপাতত জার্মানি আছে। আমার বাসার পেছনের যে দো’তলা বাড়িটা দেখছেন এটা উনার ফুফুর বাড়ি। তার পাশের বাড়িটা ছোট চাচার। উনার জন্ম, বেড়ে উঠা সব এখানেই। এলাকার পুরোনো বাসিন্দা সবাই উনাদের চেনে। এস.এস.সি কমপ্লিট করেছে ভিকারুননিসা থেকে। এইচ.এস.সি শেষ করেছে টাঙ্গাইল থেকে।’

— “কুমুদিনী কলেজ?”

— “না, ভারতেশ্বরী হোমস। ব্রাইট স্টুডেন্ট, মানুষ হিসেবেও চমৎকার। বেশ সহজ স্বভাবের। এলাকার মুরুব্বিদের ভাষায় লক্ষ্মী বাচ্চা। ছোটবেলায়ও কখনো খেলতে গিয়ে কারো সঙ্গে ঝগড়া করেনি, ঝগড়ার মুহূর্ত এলে নিজে চুপ হয়ে যেত। বিকেলে খেলার সময় উনার বাবা খাওয়ার জন্য হাতে কিছু দিলে সব বান্ধবীদের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে খেত। হাসি ছাড়া কখনো কেউ কথা বলতে দেখেনি। এলাকার কুকুর বিড়ালদেরও প্রিয় মুখ উনি। প্রতিদিন রাতে বাড়ির পাশে খাবার রেখে দেয় ওদের জন্য আলাদা করে। উনার দেখাদেখি এলাকার অনেক

ছেলেমেয়েরাও যার যার বাড়ির পাশে খাবার রাখে।”

— “কাইন্ড হার্টেড! ওর মাঝে এখনো চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার আছে। গত পরশু দেখলাম পেছনের বাড়ির ছাদে দুটো বাচ্চা নিয়ে হৈ হুল্লোড় করছে। বোধহয় বাচ্চা দু’টো ওর কাজিন।”

— “না। কাজিনের বাচ্চা ওরা।”

— “আচ্ছা! যাই হোক, এই বয়সী মেয়েরা সাধারণত এভাবে ছুটোছুটি করে খেলে না। বাচ্চামি করা মানুষগুলো হয়তো একটু বোকা হয় কিন্তু জটিলতা নেই। কাইন্ড হয় খুব!”

— “পুরো বাসার মানুষ ভালো। এলাকা জুড়ে কোথাও ওদের চারজনের নামে একটা বাজে কথাও শোনা যায়নি। উনার ভাইটাও বোনের মতোই। আন্টিও সহজ সরল। উনাদের বাসা থেকে কখনো কোনো মিসকিন খালি হাতে ফেরে না। মাসে অন্তত একদিন দুপুরে পাঁচ-দশজন গরীব ডেকে রীতিমতো পোলাও-কোর্মা রেঁধে মেহমানদের মতো আপ্যায়ন করেন উনি। কেউ বিপদে পড়লেও যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করেন। এই এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট পাবেন বহুদিন ধরে ভাড়া হচ্ছে না, কিন্তু শরীফ আংকেলের বাড়ি কখনো খালি হয় না। ভাড়াটিয়ারা বাসা ছাড়তে চায় না। কম ভাড়ায় ভালো ফ্যাসিলিটি পায় সবাই, উনাদের আচরণও অসম্ভব রকমে অমায়িক। শরীফ আংকেল বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন্ট ডিরেক্টর ছিলেন রিটায়ার্ড করেছেন তিন বছর হলো। সেখানেও উনার বেশ সুনাম। মোটকথা একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। কোথাও কোনো স্ক্যান্ডেল কিংবা ঝামেলার মাঝে এদের কাউকে পাওয়া যাবে না।”

হাসলো রুদ্র। বললো,

— “উপরওয়ালা কখনো কাউকে ঝামেলাহীন জীবন দেয়নি। দিবেও না। একটা না একটা ঝামেলা কাঁধে ঝোলাবেই।”

রুদ্রের কথার ইঙ্গিত বুঝে ফেললো শুভ। নিঃশব্দে মাথা দুলিয়ে হাসলো সে।

— “ঝামেলায় জড়াতে জড়াতে আমি নিজেই আপাদমস্তক একটা ঝামেলা হয়ে গেছি। এত ডিসেন্ট ফ্যামিলিতে এমন বদের হাড্ডি জামাই জুটছে, যার জীবনের মূল কাজই হলো ঝামেলা লাগানো আর ছুটানো। উপরওয়ালার হিসেব নিকেশ বোঝা বড় দায়! আমাকে জানার পর হয়তো ভদ্রলোক কোনো এক জুম্মাবারে মসজিদে বসে বসে হিসেব কষবে, কী এমন করেছিলাম যে এমন একটা পাত্ৰ আমাদের ঘরে এনে ঢুকালে মাওলা?”

অট্টহাসি হেসে উঠলো উপস্থিত চারজনই। রুদ্রকে ওভাবে সচরাচর হাসতে দেখা যায় না। ভালো লাগছে শুভর রুদ্রকে দেখতে। শুনেছিল, একটা সময় এই মানুষটা ভীষণ রসিক মেজাজের, সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিল। মা বলে, মেয়েরা নাকি পুরুষের জীবনে লক্ষ্মী। নিজের কর্মগুণে জীবনসঙ্গীর ভাগ্যদুয়ার খুলে দেয়। যত্নে পুরুষকে গড়ে দেয়। সুরভীও কি তবে আসার আগেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে রুদ্রের উপর?

— “এবার ওর বয়ফ্রেন্ডটাকে নিয়ে কিছু বলো তো?”

— “বয়ফ্রেন্ডের খোঁজ আলাদা করে নেইনি। ভেবেছিলাম এখানে আর কিছুই হবে না, তবে মালটাকে নিজ চোখে দেখে এসেছি আমি। দুপুরে শিশির আর আমি এক সঙ্গেই ছিলাম ওদের ঠিক পেছনের টেবিলে।”

— “আজ মিট করেছিল ওরা?”

— “হ্যাঁ। নেক্সট উইক পালিয়ে বিয়ে করবে, সে খবর তো ওখানেই জেনে এলাম।”

— “আচ্ছা, খোঁজ নাও। ওর ফুল ইনফরমেশনও প্রয়োজন। ইনফরমেশন ছাড়া কোন পাছায় লাথিটা মারতে হবে সেটা বোঝা যাবে না।”

— “ইনফরমেশন নাহয় নেয়া যাবে। তবে চোখে মেপে যা বুঝলাম ছেলে সুবিধার না।”

— “কেমন?”

— “কথা শুনে মনে হচ্ছিল চিটার। শিশির আর আমার দু’জনেরই মনে হলো। থাকে না কিছু পুরুষ, বউয়ের কাছ থেকে টাকা নিতে পছন্দ করে?”

— “হুম।”

— “ঐ ধাঁচের।”

— “সুরভীর কাছে টাকা চেয়েছে?”

— “টাকা চায়নি, টাকা নিয়ে হা হুতাশ করছিল। সেলারী হয়নি, বাবার ট্রিটমেন্টে প্রায় সব সেভিংস খরচ হয়ে গেছে। বিয়ের খরচটা আপাতত উঠানোর মতো এ্যাবিলিটি তার নেই।”

— “তাহলে বিয়ে হবেটা কিভাবে?”

— “সুরভী খরচ করবে। ওর সেভিংস আছে কিছু। সেসব নেবে পালানোর সময়, সঙ্গে গোল্ডও নেবে।

— “সর্বনাশ! এ তো দেখছি অন্ধ প্রেম।”

— “হ্যাঁ। এমনকি খাবারের বিলটাও সুরভীই দিলো।”

— “কিছু করে নাকি ও? পার্ট টাইম জব বা টিউশনি?”

— “টিউশনি করায় দু’টো।”

— “টিউশনের টাকা দিয়ে বয়ফ্রেন্ড পালে, তাই তো?”

— “তেমনই মনে হলো। ছেলেটাকে এক দেখাতেই মনে হয়েছে সুবিধার না। আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন। যাই হোক, খোঁজ নেই। সঙ্গে একটা ছবিও কালেক্ট করে দিচ্ছি। প্রয়োজনে ওকে ধরে নিয়ে আসবো।”

— “ঐ ছেলের ভালো গুণে আমার মিনিমাম ইন্টারেস্ট নেই। খুঁজে খুঁজে খারাপগুলো বের করো। যত খারাপ অভ্যেস বেরোবে, তত আমার জন্য সুবিধা। শিশির এখনো ফলো করছে না সুরভীকে?”

— “হ্যাঁ।”

— “কল দাও। জিজ্ঞেস করো, বাসায় ফিরেছে কি না?”

— “ফিরেছে হয়তো! বিকেলের দিকে রেস্টুরেন্ট থেকে সোজা স্টুডেন্টের বাসায় চলে গিয়েছিল। এই তো ৪ নাম্বার গলিতে। এতক্ষণে ফিরেছে বোধহয়!”

— “মাগরিবের সময়ও আমি চেক করলাম। ওর ঘরের বাতি নেভানো ছিল তখনও।”

— “আচ্ছা আমি দেখছি।”

ততক্ষণে তর সইলো না রুদ্রের। নিজেই উঠে গেল বারান্দায়। ঘরে বাতি জ্বলছে। সুরভী ফিরেছে। একটা গোলাপী গেঞ্জি আর কালো প্লাজো পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে ও। কোমর সমান লম্বা চুল ওর। রুদ্রের মনে পড়ে গেল গতরাতে চোখে মুখে লেগে যাওয়া ওর চুলের ঝাপটা। গা শিউরে উঠলো তার। ঠিক সেই অনুভূতিটাই পুরো গায়ে খেলছে! কেউ নেই তার আশপাশে, সুরভীও একা। দু’জনের মধ্যবর্তী এই দূরত্বটাকে ঠিক দূরত্ব মনে হলো না রুদ্রের। মনে হচ্ছে যেন, সুরভী তার সামনে দাঁড়ানো, একদম কাছাকাছি। নাকের ডগায় সেই শাওয়ার জেলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে বুঝি! এবার আর সুরভীকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো না ওর। থাকুক কিছুক্ষণ। মস্তিষ্কের ভেতর, শরীরের প্রতিটা লোমে লোমে গাঢ় অনুভূতি হয়ে।

১২

কলেজে এসেছে সুরভী। গতকালের মতো আজও শুভকে সঙ্গে নিয়ে ওর পিছু পিছু চলে এসেছে রুদ্র। আজ আর সুরভী ক্লাসে চলে যাওয়া মাত্র বাসায় ফিরে যায়নি রুদ্র। বিয়ের প্ল্যান আছে নেক্সট উইক। হয়তো আজও প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করবে। জরুরি কোনো আলাপ সারবে কিংবা টাকা পয়সা প্রেমিকের হাতে ধরিয়ে দেবে! ওর প্রেমিকটাকে একবার সামনাসামনি দেখার বড় সাধ হলো রুদ্রের, তাই বসে আছে সে সুরভীর অপেক্ষায়, কলেজের অপর প্রান্তে আজিমপুর কলোনীর ভেতর। কলেজ গেটের ঠিক বাইরেই বসিয়ে এসেছে শিশিরকে। সুরভী বের হওয়া মাত্র কল করবে তাকে। এদিকে বড় একটা আমগাছের গোড়া সিমেন্টের ঢালাইয়ে চওড়া করে পাকা করা। তারই উপর বসে ব্যক্তিগত আলাপ চলছিল রুদ্র আর শুভর। আশপাশে যাতায়াতরত মানুষেরা সন্দেহের নজরে দেখছে ওদের। মুখে মাস্ক, চোখে কালো চশমা পরে দু’টো লোক এভাবে গাছতলায় বসে নিচুস্বরে গল্প করছে! অনেকটা সময় বাদে দু’জন লোক এগিয়ে আসছিল ওদেরই দিকে। দূর থেকে রুদ্র, শুভ খেয়ালও করলো তাদের। উদ্দেশ্য কী, তা-ও ঠিক বুঝে নিল। মনে মনে উত্তরও গুছিয়ে নিচ্ছিল ওরা। কিন্তু তার ঠিক আগ মুহূর্তেই কল চলে এল শিশিরের।

শুভ রিসিভ করতেই শিশির ওপাশ থেকে জানালো, “উনি বের হয়ে গেছে। কলেজের বাইরে বয়ফ্রেন্ডও চলে এসেছে, রিকশা পেলেই উঠে পড়বে।” শুভ ছুটতে লাগলো। শুভর পিছুপিছু রুদ্রও দৌড়াতে লাগলো। লোক দু’টো হতভম্ব হয়ে ওদের দৌড়ে পালানো দেখলো। এভাবে দৌড়াতে দেখে তারা ধরেই নিলো মাস্কধারী লোক দু’টোর উদ্দেশ্য ভালো না, ধরা পরার ভয়েই এভাবে পালিয়েছে। মসজিদের মাইকে এনাউন্স করে এলাকাবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিতে হবে।

কলোনীর গেট দিয়ে বের হতেই রুদ্র, শুভ দু’জনেই দেখলো সুরভী ঠিক উল্টোদিকেই দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানেই। পাশের ছেলেটাই কি তবে ওর প্রেমিক? পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো রুদ্র। খানিকবাদেই শুভ এল গাড়ি নিয়ে। ততক্ষণে সুরভীরাও রিকশায় উঠে বসেছে। একটু পরেই রিকশার হুড উঠে গেল। ছেলেটার হাত দেখা গেল সুরভীর পিঠ জড়ানো অবস্থায়। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হলো রুদ্রের। শুভ আড়চোখে একবার দেখলো রুদ্রকে। ঠিক যেমনটা ভেবেছিল সে- প্রচন্ড রাগে কপালের দু’পাশের রগ স্পষ্ট হয়েছে রুদ্রের। চাইলেই ছেলেটাকে এখনি রিকশা থেকে ধরে আনা যায় কিংবা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কল করে সামনের সিগনালেই ট্রাফিক দিয়ে কোনো অযুহাতে তাকে বেদম পিটুনি খাওয়ানো যায়। কিন্তু আপাতত সেসব সমীচীন মনে হলো না শুভর। রুদ্রকে সামলানোও জরুরি। তৎক্ষনাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললো সে। আর যাবে না সুরভীর পিছু। রুদ্রও বুঝে নিলো গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার কারণ। অনেকটা সময় দু’পক্ষই চুপচাপ থাকার পর রুদ্র মুখ খুললো,

— “এই ছেলেটার ইতি বৃত্তান্ত চেয়েছিলাম।”

— “যোহর নাগাদ খবর চলে আসবে।”

বাসায় ফিরে রুমের দরজা লক করে পড়ে রইলো রুদ্র। অসহ্য লাগছে সবকিছু। পরশু রাত থেকে অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ছেয়ে ছিল, তার কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই আপাতত। হিংসায় পুঁড়ছে সে। তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটাকে ওভাবে কেউ ছুঁয়ে দিলো তারই সামনে, এই দৃশ্য মেনে নেয়া অসম্ভব! সুরভী তার। শুধুমাত্র তার। পরশু রাত থেকে সুরভীকে যতটা না নিজের মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি অধিকার খাটিয়ে নিজের বলে দাবি করতে ইচ্ছে করছে আজকের ঐ মুহূর্ত থেকে। সেই থেকে যন্ত্রণাও হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে সুরভীকে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তুলে এনে ওর সারা গায়ে ছুঁয়ে দিতে। তার হাতের স্পর্শে পুরোনো সব স্পৰ্শ মুছে দিয়ে নিজের একচ্ছত্র অধিকার খাটাতে। অথচ সম্ভব না! একদম না। সুরভীকে এখনই জোর করে তুলে আনা সম্ভব না, সেই সীমাবদ্ধতাটুকু যেন সারা গায়ে হুল ফোঁটাতে লাগলো। ক্রোধে অন্ধ হয়ে পারফিউমের বোতল ছুঁড়ে মারলো ড্রেসিং টেবিলের উপর।

ভেতর থেকে বিকট শব্দে গ্লাস ভাঙার আওয়াজ পেলো শুভ, সুমন আর মেজবাহ। সুমন, শুভকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “শেষবার ভাই ভাঙচুর করেছিল অফিসে। মনে আছে আপনার?”

— “ঐ ঘটনা ভুলি কেমন করে! উনার শান্ত হতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকদিন।”

— “দেড়বছর পর আবার ভাঙচুর! এবারে শান্ত হবে কতদিনে, কে জানে?” গালে হাত দিয়ে বসে রইলো শুভ। সঠিক সময়ের আগে সমাধানও সম্ভব না। অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত আর কিই বা করার আছে?

অনেকটা সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্র। এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল ভাঙা কাঁচের টুকরার দিকে। চোখের সামনে থেকে সরছিলই না সেই দৃশ্য। কল এল তার মোবাইলে, তখনি দেয়াল ছেড়ে খাটের গায়ে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসলো

সে। লন্ডন থেকে কল এসেছে। কলটা রিসিভ করে, সিগারেট ধরালো রুদ্র। শান্ত হতে হবে তাকে!

— “হুম। খবর কতদূর?”

ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট থাকার দরুন অস্পষ্ট শোনালো রুদ্রের কথা। তবুও স্পষ্ট বুঝে নিলো জামিল- রুদ্রের পুরোনো গুপ্তচর। রুদ্র রাজনীতিতে পা রাখার পর থেকেই কাজ করছে তার জন্য। ছেলেটা কাজ করতো আগে সি আই ডি-তে। ভীষণ চতুর আর বিশ্বস্ততার গুণ দেখেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে এনেছে রুদ্র। বিভিন্ন দেশে এমন বারোজন সদস্য ছড়িয়ে আছে তার। তাদের মাঝে জামিল একজন। মূলত লন্ডনে থিতু হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বিশ্বস্ত সব কাজ সামলে নেয়াই জামিলের কাজ। রুদ্রের ফরমায়েশ অনুযায়ী অদিতির সমস্ত খোঁজ নিয়েছিল সে। সেই খবর জানাতেই কল করেছে সে।

— “অল ডান।”

— “বলতে থাকো।”

— “এতদিন ছিল খালার বাসাতেই, কিন্তু এখন আলাদা থাকছে। খালার বাসা থেকে প্রায় দুই কি:মি: দূরে একটা অ্যাপার্টমেন্টে আজগর সাহেব ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন ওকে। সেখানে একাই থাকছে এখন।”

— “হুম।”

— “তবে মাঝেমধ্যে দু’জনও থাকে। আই মিন বয়ফ্রেন্ড। যতটা বোকা, চুপচাপ, ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারা টাইপ লুক সে পুরো দুনিয়াকে শো করে, আসলে সে ততটাও ভদ্র না। বয়ফ্রেন্ড আছে দু’জন। একটার সঙ্গে কমিটেড। সে ইন্ডিয়ান। বেশ বনেদী পরিবারের ছেলে। অন্যটা ওর ছুটা বয়ফ্রেন্ড। এই মহাশয় আবার আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে। এখানে পড়াশোনা করতে এসে খাতির হয়েছে ওর সঙ্গে। দু’জনের সঙ্গেই ও ফিজিক্যালি এটাচড।”

— “হাহ্” আওয়াজ তুলে ম্লান হাসলো রুদ্র। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জানতে চাইলো.

— “ওর প্রেমিকেরা জানে এই খবর?”

— “ওর রিয়েল বয়ফ্রেন্ড জানে না। তবে আমাদের মন্ত্রী সাহেবের ছেলে সব জানে।

— “ “কী নাম যেন ছেলেটার?”

— “ইমরান।”

— “ওটা একটা ছাগল জন্ম নিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘরে! বাংলা উচ্চারণটা পর্যন্ত স্পষ্ট করে করতে পারে না। ওকে আমার পুরুষ ভাবতেই ইচ্ছে করেনি কখনো। যাক, ড্রাগসের অভ্যেস আছে?”

— “না। এছাড়া আর কোনো সমস্যা দেখিনি। মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। সবসময় হাসিখুশি থাকছে, বয়ফ্রেন্ড দু’জনকেই খুশি রাখছে। মাসে এক দুইবার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে গোটা দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে চলে যাচ্ছে। এই তো! বেশি সুখী জীবনযাপন ওর। বয়ফ্রেন্ড ইস্যুটা ছাড়া চোখে পড়ার মতো আর কিছু নেই।”

— “আচ্ছা, দেখছি আমি।”

কল কেটে, খাটের উপর মাথা কাত করে ফেলে রাখলো রুদ্র। খুব সহজ একটা চাল একদম চোখের সামনেই আছে। জামিলের বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কিত ইনফরমেশনের মাঝেই আছে ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বারবার সে কথা বারবার জানান দিচ্ছে। অথচ ঠিক ধরতে পারছে না সে। মাথা কাজ করছে না একদম। অদিতির জায়গায় বারবার সুরভী চলে আসছে। পিঠের উপর হাত রাখার দৃশ্যটা চলে আসছে। মেজাজ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক শূন্য হবার এই মুহূর্তটা আলাদারকমে পীড়া দিতে লাগলো তাকে। শান্তি চাই তার। এক্ষুনি, এই মুহূর্তে। শেষবার তার বিক্ষিপ্ত মন সুরভী স্বপ্নে এসে শান্ত করেছিল। সুখের ভেলায় ভাসিয়ে স্থির করেছিল তার মন। এবারও সুরভীকেই করতে হবে। চোখ বুজে রুদ্র সেই স্বপ্নে আবার ডুব দিলো। একদম প্রথম থেকে স্মৃতিচারণ করতে লাগলো সুরভীর সঙ্গে তার বিশেষ মুহূর্তটার।

১৩

শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। শান্ত এবং স্থির। এখানে দাঁড়িয়েই আজগরের সঙ্গে পুরো খেলার ছকটা কষে নিয়েছে সে। সুরভীর প্রেমিকটাও আর পীড়া দিতে পারছে না তাকে। সুরভীর বাহুডোরে নিজেকে অনুভব করতেই মনে হলো এই মেয়েটা তার। শুধুই তার। দিন শেষে সুরভী তার হয়েই রয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো পুরুষ ওকে পাবে না। নিজেকে শান্ত করার জন্য এতটুকু যথেষ্ট ছিল। শাওয়ার অফ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল, মুখ মুছে নিচ্ছে সে। নিজেকে দেখতে দেখতে মনে হলো, শুধু স্বপ্ন কিংবা কল্পনার অনুভূতিতেই যদি একজন মেয়ে তাকে এতখানি স্বস্তি দেয়, তার অস্থির সত্তাকে স্থির করে, সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে কয়েকশো মাইল দূরে সরিয়ে আনতে পারে, তবে সত্যিকারের বাহুবন্দী যেদিন হবে সেদিন কতটা স্বস্তি দেবে ও? সে কথা মনে পড়তেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না রুদ্র। আধভেজা শরীরে কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এল সে। ততক্ষণে ঘর সাফ হয়ে গেছে, ভাঙা ড্রেসিং টেবিল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রুদ্রের ফরমায়েশ অনুযায়ী টাকা নিয়ে সুমন বেরিয়েও গেছে ড্রেসিং টেবিল আনতে। ডাইনিং রুমে

শুভ আর মেজবাহ তখন দুপুরের খাবার সাজাতে ব্যস্ত। একটা চেয়ার টেনে সেখানে বসে পড়লো রুদ্র

শুভ আর মেজবাহকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “এশার নামাজের সময় পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি আমি অফ চাই। রাস্তার একটা ল্যাম্পপোস্টও যেন না জ্বলে।”

— “জি ভাই” বলে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো দু’জনই।

— “শুভ, তুমি আর আমি ঐ সময়টায় সুরভীর বাসায় যাচ্ছি।”

রুদ্রের আবদারে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল শুভ। সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার মাথা দুলিয়ে রুদ্রের এই কথায়ও সায় দিলো। রুদ্র আর কিছু বলছে না। শুভ ভেবেই নিলো আজই সুরভীকে বাসা থেকে বের করে আনা হবে। তার পরবর্তী গন্তব্য কোথায় হবে জানতে চাইলো শুভ।

— “উনাকে নিয়ে তারপর কোথায় যাবো? আপনার বাসায় নাকি অন্য কোথাও?”

— “যাবো কেন? ওকে উঠাতে যাচ্ছি না। একটু প্রয়োজন আছে আমার।”

— “ওহ্!”

ক্ষীণ হলো শুভর স্বর। মেজবাহ চেয়ে আছে তারই দিকে। রুদ্রের প্রয়োজনটা ঠিক কী ধরণের হতে পারে, বুঝতে বাকি রইলো না কারো। একটুখানি গভীরেই ভাবনা চলে যাচ্ছে তাদের।

শুভ আর মেজবাহর মুখ দেখে তাদের মনে চলমান ধারণা স্পষ্ট বুঝে নিলো রুদ্র। হাতের ভাঁজে থাকা সিগারেটটা ঠোঁটের ভাঁজে নিতেই শুভ পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালিয়ে দিলো।

নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো,

তোমরা যতখানি ভাবছো তেমন কিছুই না। আই নো মাই লাইনস, এ্যান্ড আই ওন্ট ক্রস দ্যাট!”

হেসে ফেললো শুভ।

— “যে যেমন অন্যদের তেমন ভেবে নেয়াই স্বাভাবিক। পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি অফ করে হবু বউয়ের বাসায় যাবো অথচ একটু লিমিট ক্রস করবো না সেটা অন্তত আমাদের দিয়ে হবে না। লিমিট আমরা ক্রস করতামই।”

শুভর উত্তরে মুখে হাত চেপে হেসে ফেললো মেজবাহ্ত্ত। ডানে-বামে মাথা দুলিয়ে মুচকি হাসিতে রুদ্রও তাকালো দু’জনের দিকে।

— “ভাই, ঐ ছেলেটার ব্যাপারে সব খোঁজ নেয়া শেষ।”

— “অদিতির ব্যাপারেও।”

— “জামিল ভাই কল করেছিল?”

— “হ্যাঁ। ওটার ছক কষা শেষ। তুমি ঐ ছেলের খবর বলো।”

— “নাম আসিফ। পড়াশোনা বাদ দিয়েছে আরো বছর তিনেক হলো। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেনি। ভবঘুরে। কখনো-সখনো শখ করে এলাকার ছেলেদের সঙ্গে মিলে সিদ্ধি সাধনও করে, তবে রেগুলার না। বাবা-মা দুজনই সরকারী চাকরি করে। সুরভী জানে না ও পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে কিংবা ও আসলে চাকরি বাকরি কিছুই করে না। অন্য মেয়েদের নেশাও নেই। জীবনে নারী বলতে একমাত্র সুরভীই। ক্লাস টেন থেকে প্রেম ওদের। একই কোচিংয়ে পড়তো, সেখান থেকে আলাপ। সুরভী জান-প্রাণ দিয়ে এই ছেলেটার পেছনে পড়ে আছে কারণ ও চায় ছেলেটা জীবনে ভালো কিছু করুক। নিয়মিত ছেলেটা ওকে নিজের দুঃখগাঁথা শুনিয়ে মানসিকভাবে কাবু করে রাখে।”

— “কেমন দুঃখগাঁথা?”

— “ওর বাবা অসুস্থ। চাকরিটা আর নেই। মায়ের একার ইনকামে বাসা ভাড়া সংসার চলে না। বোনের খরচ তাকে উঠাতে হচ্ছে। টাকা-পয়সার ভীষণ টানাটানি। সুরভী লয়্যাল। বিবেক প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই কাজ করে। বয়ফ্রেন্ডের খারাপ সময়ে ছেড়ে চলে আসা ওর মতো মানুষকে দিয়ে সম্ভব না। প্রতিমাসে বেতনের অর্ধেক টাকা এই ছেলের পকেটে ঢোকে। তারপর সেই টাকা উড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছেলেটা আমোদ-ফূর্তি করে আর সুরভীর বোকামি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। থাকে না কিছু মেয়ে, একটা পুরুষের জীবন গুছিয়ে দেয়ার জন্য সবকিছু করে ফেলে, গোছানোর আগ পর্যন্ত থামে না- সুরভী সেরকম একজন। কিন্তু ভুল জায়গায় এতবছর নিজের ইমোশন, সময়, টাকা পয়সা সব নষ্ট করছে আর কি!”

— “মেয়েটার রুচি খুবই খারাপ শুভ! আমি ছেলেটাকে দেখার পর দুই সেকেন্ড নাম্ব ছিলাম। ওর মতো মেয়ে এমন একটা ছেলের সঙ্গে কেন ঘুরবে? ওকে দেখেই বোঝা যায় ক্লাসলেস ফালতু একটা ছেলে! ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস আর ক্লাসলেস হবার মাঝে তফাৎ আছে। ওকে দেখে আমার একবারও মনে হয়নি ও কোনো ক্রাইসিসে আছে। মনে হয়েছে, একটা ফালতু, ম্যানারলেস ছেলে। রুচি খারাপ না হলে, দেখেশুনে ২২-২৩ বছর বয়সী একটা শিক্ষিত মেয়ে এর মতো ছেলের সঙ্গে কিভাবে ঘুরবে!”

— “ছোটবেলার প্রেম তো! মায়া বসে গেছে হয়তো। তাই ছাড়তে পারে না।”

— “ছুটাচ্ছি প্রেম! রাতে ওটাকে অফিসে নিয়ে এসো। আজকেই ওর হিসেব শেষ করছি।”

— “হয়ে যাবে।”

— “অদিতির ব্যাপারটা কী হলো?”

— “লাঞ্চের পর রুমে এসো। বলছি।”

১৪

রুদ্রের হিসেব মোতাবেক এশার আজানের পরপরই নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে সুরভীর বাবা। বাসায় রইলো শুধু সুরভী আর ওর মা। মেজবাহ আর সুমন দাঁড়িয়ে আছে বাসার নিচে। সুরভীর দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। তিনতলার সিঁড়ি ঘরে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ। তার সঙ্গে লাইনে আছে বিদ্যুৎ অফিসের লোক। কে দরজা খুলবে জানা নেই রুদ্রের। সুরভীর মা-ও দরজা খুলতে পারে। তবুও এই ঝুঁকিটা নিলো রুদ্র। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সুরভীই দরজা খুলে বেরোবো। বাসার কলিংবেল চেপেই একপাশে সরে দাঁড়ালো রুদ্র। হালের জনপ্রিয় ইংরেজি গানের সুর গুনগুন করতে করতে এদিকে আসছে একজন। শুভকে ইশারা করলো রুদ্র। সুরভীই আসছে। ছিটকিনি খোলা মাত্র কারেন্ট চলে গেল পুরো এলাকার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো পুরো এলাকাবাসী। সুরভী তৎক্ষনাৎ হাতে থাকা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দরজার বাইরে ধরলো। চোখের পলকে সুরভীর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো রুদ্র। অন্য হাতে সুরভীর দুই হাতসহ শক্ত করে জড়িয়ে বুকের মাঝে আটকে রাখলো কয়েক সেকেন্ড। চুল থেকে ভেসে আসছে শ্যাম্পুর ঘ্রান। ওর চুলে এক মুহূর্তের জন্য নাক ডোবালো রুদ্র। চোখ বুজে, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। নেশা ধরে যাচ্ছে তার। মন লাগামহীন হবার আগে, আরো কিছু করে বসবার আগেই বুকের মাঝখানে ছটফট করতে থাকা সুরভীকে ছেড়ে দিলো রুদ্র।

সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েও আবার ফিরে এল রুদ্র। সুরভী এখনো হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর দুই বাহু ধরে কাছে টেনে মাথার উপর চুমু খেয়েই এক দৌড়ে শুভকে নিয়ে নিচে নেমে এল সে। এতক্ষণে উপর থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মা’কে ডাকছে সুরভী। মুখ হাত চেপে ফিক করে হেসে উঠলো দু’জনই।

দৌড়ে সুরভীর বাসার সীমানা পেরোতে পেরোতে রুদ্র শুভকে বললো,

— “এতক্ষণে গাধা মেয়েটার হুঁশ ফিরেছে।”

— “সাবধান! বিয়ের পর এসব গাধা-টাধা বলা যাবে না একদম। আপনার মগজ কলিজা সব চিবিয়ে খেয়ে নেবে। পারসোনাল এক্সপেরিয়েন্স থেকে বলছি।”

— “যেই মেয়ে বাটপার বয়ফ্রেন্ডের জন্য বাসা থেকে গোল্ড নিয়ে পালাবার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সেই মেয়ে আর কতটুকু মগজ কলিজা খাবার ক্ষমতা রাখে, নিজেই একটু আন্দাজ করে নাও না!”

— “তা ঠিক!”

— “বিদ্যুৎ অফিসে কল দাও। ইলেক্ট্রিসিটি অন করতে বলো। আর মেজবাহকে দিয়ে উনার পেমেন্টটা পাঠিয়ে দাও।”

— “মেজবাহর হাতে টাকা দেয়া আছে, কারেন্ট আসা মাত্র ও অফিসে গিয়ে দিয়ে আসবে।”

— “লোক পাঠিয়েছো আসিফের ওখানে?”

— “হ্যাঁ আধঘন্টার ভেতর অফিসে হাজির হবে।”

— “গাড়ি বের করো, টাকা রেডি আছে না?”

— “জি ভাই।”

বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্র। দুই মিনিট বাদেই পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি ফিরলো। শুভ গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে করতে একবার সুরভীর বারান্দায় তাকালো রুদ্র। এখান থেকে শুধু ঐ বারান্দা, আর রশিতে ঝোলানো কাপড়গুলোই শুধু দেখা যায়, ঘরের ভেতরটা না। নিজের বুকে একবার হাত বুলালো রুদ্র। শান্তি লাগছে ওখানটায়। বুকের মাঝখানে ওকে বেঁধে রাখার পর থেকে যেন সমস্ত শক্তি ফিরে এসেছে। এলোমেলো হিসেবনিকেশগুলো মাথার ভেতর সহজ হয়ে আসছে। বাবা সবসময় সবাইকে বলে বেড়াতো- ফেরদৌসী আমার পাওয়ার হাউজ। আমার সমস্ত ক্লান্তি, জড়তা, সলিউশন খুঁজে না পাওয়া সবকিছু ওর কাছে এসে ঘুচে যায়। বাবার সমস্ত দায়িত্ব ভাগ্যজোরে তার কাছে এসেছে। তবে বাবার মতন জীবনসঙ্গীও কি ভাগ্যজোরে তার হবে?

ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটলো রুদ্রের। পাশেই গাড়ি এসে থামলো। সুমন দ্রুত এগিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো। গাড়িতে চড়ে বসার সময়ও রুদ্রের চোখ আটকে রইলো সুরভীর বারান্দায়।

*****

রুদ্রের অফিসে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে আসিফ। এলাকায় এক বন্ধুর বাড়ির ছাদে বসে গাঁজার আসরে সুখটান নিচ্ছিল সে। প্রতিটানে একটু একটু করে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছিল। তখনই কোথা থেকে ছয় সাতজন লোক এসে পিস্তলের মুখে তাকে তুলে এনেছে এখানে। এটা কোথায়? ডিবি অফিস? এরা কি ডিবির লোক? সামান্য গাঁজার কারণে এভাবে তুলে আনবে তাকে? ড্রাগ ডিলারও তো সে নয়! শুধু মাঝেসাঝে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে একটুখানি ফূর্তির ছলে গাঁজার আসরে শরীক হয়। এ আসরে আরো তো বন্ধু বান্ধব ছিল, কই তাদের তো ধরা হলো না। শুধু তাকেই কেন? মন থেকে ভয় কাটছে না, মাথা থেকে প্রশ্ন দূর হচ্ছে না। জীবনে এবারই প্রথম এতটা ভয় লাগছে! কী আছে আজ তার ভাগ্যে? ছোটবেলায় হুজুর বিপদে পড়ার দোয়া শিখিয়েছিল। পড়া হয়নি কখনো। চর্চার অভাবে ভুলে গেছে সেই দোয়া ছোটবেলাতেই। শত চেষ্টায়ও কোনো সুরা, দোয়া কিচ্ছু মনে এল না। মনে আছে যা সৃষ্টিকর্তার এক নাম! তা-ই একমনে জপতে জপতে জিহ্বা গলা শুকিয়ে ফেলছে সে।

ঝড়ের গতিতে চারজন মানুষ এসে ঢুকলো অফিসে। সামনে যে জন দাঁড়িয়ে সে আঙুলে ইশারা করলো তাকে ভেতরে যেতে। সঙ্গে সঙ্গে এখান থেকে একজন তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরের এক রুমে। ইশারাকারী ব্যক্তিটা কে? ডিবির প্রধান? নাকি উচ্চপদস্থ কোনো অফিসার? কী করা হবে তাকে রুমে নিয়ে? রিমান্ডের পিটুনি দেয়া হবে না তো? ভয়ে, আশংকায় ওখানেই বসে পড়ল আসিফ। কান্নাকাটি জুড়ে বললো,

— “ভাই ভাই! আমি আর জীবনে গাঞ্জা টানমু না ভাই। আমারে ছাইড়া দেন ভাই। ওয়াদা করতাছি আমি জীবনেও ঐদিকে আর যামু না।”

কোনো প্রকার পাত্তাই দেয়া হলো না তাকে। এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না দেখে পেছন থেকে আরেকজন এল। দু’জনে মিলে হেঁচড়ে তাকে নিয়ে গেল রুদ্রের কেবিনে। তার মুখোমুখি এসে বসলো রুদ্র। আসিফের মুখ বরাবর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,

— “এখনি ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। আগে কথা শোনো, বুঝো, মানো। যদি মানতে ইচ্ছে না হয় তখন নাহয় ভয় পেও।”

একটু পর পর ঢোক গিলছে আসিফ। এসিতেও কাজ হচ্ছে না। দরদর করে ঘামছে সে। রুদ্রের কথার অর্থ কিছুই মাথায় আঁটলো না তার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।

— “সুরভীর সঙ্গে তো বহু বছরের প্রেম তোমার, তাই না?”

উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো আসিফ।

— “চাকরি বাকরি করো না, নেশা করো, পড়ালেখারও ভবলীলা সাঙ্গ করেছো। তোমার প্রেমিকা জানে সেসব?”

— “না।”

— “কেন?”

— “জানলেই জ্ঞান দেবে। সারাক্ষণ একটা মানসিক চাপে রাখে। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। তোমাকে ভালো একটা পজিশনে যেতে হবে। আমি গর্ব করে বলতে পারব আমার হাজবেন্ড অমুক প্রফেশনে আছে। আরো কত কী!”

— “তাই বলে এত এত মিথ্যা বলবে?”

— “দিনভর ক্যাচক্যাচ কান্নাকাটি শোনার চেয়ে দু’টো মিথ্যা বলে চুপ করে বসিয়ে রাখা ভালো।”

— “তোমার ভালোর জন্যই বলে।”

— “কিসের ভালো? আমার ভালো আমি বুঝি। আমার এত অফিসার হবার শখ নেই। আমি কী হবো না হবো সেটা ও কেন ঠিক করে দেবে?”

ধীরে ধীরে আসিফের ভয় কাটছে, কন্ঠ রূঢ় হচ্ছে।

সুরভীর প্রসঙ্গ টানতেই এত রূঢ় হবার কারণ কী? তাহলে কি ছেলেটার অপ্রিয় হয়ে গেছে সুরভী?

রুদ্র ভালোভাবে একবার তাকালো ছেলেটার চোখে।

— “কথা শুনে মনে হচ্ছে ব্যাপক তিক্ততা পুষে রেখেছো গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে!”

— “সারাক্ষণ জ্ঞান দিলে কার ভালো লাগবে? আমি জীবনে কী করবো না করবো সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

— “তো ছাড়ছো না কেন ওকে? বিয়ের সিদ্ধান্তও নিয়ে নিলে!”

— “বিয়ের সিদ্ধান্ত আমি নেইনি, ও একাই নিয়েছে।”

— “সায় তো দিচ্ছো!”

— “না দিয়ে উপায় কী? বিয়ে না করলে হাতছাড়া হয়ে যাবে।”

— “লস হয়ে যাবে?”

— “লসই বলতে গেলে প্রায়। কিছু করি টরি না। চাকরি করার ইচ্ছে নেই।

ব্যবসাপাতি করবো কিছু। কিন্তু বাসা থেকে টাকা দেবে না। সুরভী বলেছে কিছু গয়নাপাতি আছে, সেসব দেবে আমাকে ভালো একটা চাকরি হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যবসা করার জন্য।”

— “যাকে নিয়ে এত তিক্ততা তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে ভালো লাগবে তোমার?”

— “খারাপ লাগার কিছু নেই। এত বছর সময় দিয়েছি ওর পেছনে, বিনিময়ে এতটুকু ওর কাছ থেকে নিতেই পারি।”

— “তো সংসারে যাবার পর ও যখন জানবে তুমি এতসব মিথ্যা বলেছো তখন ঝামেলা করবে না?”

— “তখন বুঝে নেয়া যাবে।”

হাসলো রুদ্র। আসিফের খুঁতনি টেনে ধরলো সে।

— “আর বুঝতে হবে না খোকা! এতবছর সময় দিয়ে বড় ধন্য করেছো সুরভীকে। আর কিছুই করা লাগবে না। যত সময় দিয়েছো তার বিনিময় তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।”

টাকা ভর্তি ব্যাগের চেইন খুলে আসিফের সামনে রাখলো সুমন

রুদ্র বললো,

— “এখানে ৫০ লাখ আছে। এই শহর ছেড়ে, সুরভীকে ছেড়ে তুমি কালই চলে যাচ্ছো।”

স্তব্ধ হয়ে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইলো আসিফ। মানুষের জীবনে মিরাকেল হয় শুনেছিল, আজ নিজের সঙ্গে ঘটে যেতে দেখছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তার! কে এই লোক? সুরভীকে ছেড়ে যাবার বিনিময়ে এতগুলো টাকা কেন দিচ্ছে তাকে? আসিফের চোখে মুখে সন্দেহের ছাপ দেখে রুদ্র বললো,

— “তুমি টাকা গুনে নিতে পারো।”

— “আপনি এতগুলো টাকা কেন দিচ্ছেন আমাকে?”

— “সুরভীকে নিজের জীবনের মহামূল্যবান সময় তুমি দিয়েছো, তাই!”

— “কে আপনি?”

— “আমার পরিচয় জানা তোমার জন্য জরুরি কিছু না। টাকার কথা ভেবেই সুরভীকে নিয়ে পড়ে আছো। টাকা দেয়া হয়েছে তোমাকে। সুরভী তোমাকে যা দিতো তার দশগুণ বেশি দিয়েছি। এবার সুরভীকে কল করে জানাও তুমি ওকে বিয়ে করছো না, সম্পর্ক রাখতেও তুমি ইচ্ছুক না। তুমি এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছো।”

এখনও সন্দেহ দূর হচ্ছে না আসিফের। হিসেবটাও একদম মিলছে না। স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে সবটা। রুদ্রের যা কিছু বলার সব বলে ফেলেছে সে। এখানে রাতভর আসিফের সঙ্গে বসে, তাকে আর কিছু বুঝানোর সময় কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই তার নেই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

আসিফের কপালে আঙুল ঠেকিয়ে নিজের লুকোনো রূপে ফিরলো সে,

— “টাকা গুনে, বুঝে নিয়ে বিদায় হও। আজ রাতের পর সুরভীর জীবনে তোমাকে আমি আর দেখতে চাই না। আজ রাতের মধ্যে সব মিটিয়ে না নিলে কাল সকাল থেকে তোমাকে আর কেউ কোথাও কখনো দেখবে না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *