১
শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান চলছে। গেল কিছুদিন আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ নব্য সরকারী দলের মন্ত্রীরা শপথ গ্রহন করবেন। এই অনুষ্ঠানে আজই প্রথম এল রুদ্র। এর আগে আসা হয়নি কখনো। বাবা আসতেন সবসময়। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির মধ্যখানের আসনটাতে বাবা বসতেন। সেই পুরোনো রীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ রুদ্রকে বসাতে চেয়েছিলেন তার আর রাষ্ট্রপতি সাইফুল ইসলামের মাঝে। রুদ্র বসেছিল, কিন্তু মিনিট দুয়েক পর হঠাৎ উঠে এল সেখান থেকে।
বললো, “আমি এখানে বসবো না। আপনি মাঝে বসুন, আমি আপনার চেয়ারে বসি।”
বহুদিন ধরে বড্ড কাছ থেকে রুদ্রকে দেখছেন ইকবাল মাহমুদ। ওর মুখ দেখে একটু-আধটু আন্দাজ করতে পারেন কখন মন খারাপ হচ্ছে, কখন রেগে যাচ্ছে, কখন খুশি হচ্ছে। এখন, এই মুহূর্তে ওকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে। ভালো লাগছে না হয়তো! বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সাইফুল ইসলামকে ইশারা করলেন তিনি। তখনই হাসিমুখে জায়গা ছেড়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি।
দূরে দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্রের সহচরী শুভ। ওখান থেকেই রুদ্রকে দেখছে সে। তার চাহনী, চেহারার অভিব্যক্তি, একটু পর পর হাত কচলানো সবটা মিলিয়ে শুভ স্পষ্ট বুঝতে পারছে রুদ্রের মনে কী চলছে। মন খারাপ হলো শুভর। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে এই জীবন বয়ে যাচ্ছে মানুষটা। শত মন খারাপ, কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে বাবার রেখে যাওয়া সমস্ত দায়িত্ব যন্ত্রের মতো পালন করে যাচ্ছে। কেউ সেই কষ্ট দেখছে না, বুঝতে চাইছে না। নিজের চারপাশে এমনভাবে ভয়ের প্রাচীর গড়ে রেখেছে, লোকে শুধু তাকে ভয়ই পায়! ভাবে তার মাঝে মন নেই। আবেগ নেই। বিবেক নেই। আছে ক্ষুরধার বুদ্ধি, অঢেল টাকা, কয়েক সেকেন্ডে সবকিছু পিষে ফেলার ক্ষমতা। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও তার ক্ষমতাকে ভয় পায়। ব্যবসায় কিংবা রাজনীতির মাঠে সমান দাপটে দাপিয়ে বেড়ায় সে। তাদের কাছে রুদ্র মানে অসুর, দানব। অথচ তারা কেউ জানেই না, এই অসুরটা কতখানি যন্ত্রণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে আছে। এটুকু বয়সে এতখানি একাই বয়ে চলা, সাধারণ মানুষের
পক্ষে সম্ভব নয়। রুদ্র অসুর বলেই টিকে আছে, নয়তো পিষে যেত বাবার রেখে যাওয়া এই সাম্রাজ্যের যাতাকলে।
২
রোজকার মতো আজও সারাদিনের ছুটোছুটি শেষে বাসায় ফিরেই মা-বাবার ঘরে এল রুদ্র। গায়ের কোটটা সোফায় ছুঁড়ে মায়ের পাশে এসে বসলো সে। কাঁপা হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ফেরদৌসী মির্জা।
মুচকি হেসে ছেলেকে বললেন,
— “ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব!”
মায়ের হাত টেনে এনে চুমু খেলো রুদ্র। বললো,
— “একটু চাপ গেল আজ।”
— “খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই না?”
— “নাহ্! এ আর এমন কী। বাবা এরচেয়ে আরো বেশি দায়িত্ব মাথায় সামলে চলতো।”
— “খেয়েছিস?”
— “হ্যাঁ। খেয়েই ফিরলাম। আজ তো শপথ গেল।”
— “দেখেছি টিভিতে তোকে। মনে হলো, তোর বাবাই বসে আছেন।”
— “তুমি খেয়েছো আম্মু?”
মা-ছেলের কথোপকথন দীর্ঘ হতে থাকে। মায়ের মুখের কথা জড়িয়ে আসে। স্পষ্ট বোঝা যায় না অনেকসময়। কেউ কেউ বুঝেই না একদম। একই কথা ৩-৪ বার তাকে দিয়ে বলানো হয়। কিন্তু রুদ্র মায়ের সমস্ত কথা বুঝে নেয়। মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে পারে সেই ছোট্টবেলা থেকে। রুদ্রের বাবা বলতেন, “আমার পরে সবচেয়ে বেশি যে তোমাকে বুঝবে, সে হলো তোমার ছেলে’। মা হেসে বলতেন, ‘ও তো তোমারই অংশ। তোমার মতোই হবে’। অথচ স্বভাবে ছিল বাবা-ছেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এতগুলো বছর বাদে মায়ের কথাটা মিলে গেল। বাবার মতোই তাকে হতে হলো। ঠিক বাবার ছায়া! কেউ কেউ বলে আশরাফ মির্জার চেয়ে তার ছেলে শাহরিয়ার মির্জা আরো অনেক বেশি যোগ্য। নয়তো এত কম বয়সে এত সব সামলে চলা কেমন করে সম্ভব! সেসব শুনতে ভালো লাগে না রুদ্রের। যে জীবন কোনোদিন সে চায়নি. সে জীবনের সফলতা নিয়ে প্রশংসা করলে ভালো লাগা তো অনুভব হবে না! তার উপর বাবার সঙ্গে তুলনা! রুদ্রের কাছে বাবা অতুলনীয়। বাবাকে সে শুধু বাবার মতোই কাছে পেয়েছে। কখনো ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিবিদ আশরাফ মির্জা হিসেবে পায়নি। বাবার তুলনা কখনো হয়নি, কোনোদিন হবেও না; বুঝতে শেখার পর থেকে বাবা ছিল তার রিয়েল লাইফ হিরো। আজও তাই-ই আছে।
কথা বলতে বলতে এই ঘরের দেয়ালে ঝোলানো মা-বাবার বড় ফ্রেমের ছবিটায় চোখ গেল রুদ্রের। বাবা হাসছেন মায়ের দিকে তাকিয়ে। চাহনীতে তার অদ্ভুত মুগ্ধতা। প্রেম-ভালোবাসা কিংবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে বোঝাশোনা হবার পর থেকে মা-বাবার বন্ধন বরাবরই রুদ্রকে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে বাধ্য করতো। এত সুন্দর বন্ধন মা-বাবার মাঝে ক’টা সন্তান দেখতে পায়? কোন পুরুষটা তার স্ত্রীর দিকে ওভাবে মুগ্ধ নয়নে তাকায়? হোক মায়ের ঘামে ভেজা মুখ, অসুস্থতা বা ক্লান্তি লেপটানো চেহারা কিংবা মায়ের রাগে ভ্রু কুঁচকে থাকা… সবসময় বাবা ঐ একই মুগ্ধতা নিয়ে মাকে দেখতো। কোনোদিন সেই মুগ্ধতার হেরফের হয়নি। মাকে ওভাবে মুগ্ধ নয়নে দেখবার মতো আর কেউ নেই। বাবার ছবিটা দেখে সে কথা মনে পড়তেই হঠাৎ সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগতে শুরু করলো রুদ্রের। মায়ের সঙ্গে কথার মাঝেই উঠে দাঁড়ালো সে।
— “আম্মু, ক্লান্ত লাগছে। কাল সকালে কথা হবে।”
এক মুহূর্তও আর দাঁড়ালো না রুদ্র। বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
ফেরদৌসী মির্জা চেয়ে রইলেন দরজার দিকে। বুকচিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার। তিনি জানেন, বোঝেন একমাত্র ছেলের মনের অবস্থা অথচ কিচ্ছু করার নেই তার। তাকে সামলানোর মতো অবস্থায় তিনি আর নেই। তাই বলে কেউই কি নেই? কেন কেউ নেই তার রুদ্রকে সামলে রাখার মতো?
৩
গভীর রাতে ঘুমোনো রুদ্রের অভ্যেস। কোনো কোনো রাত নির্ঘুমও কেটে যায় তার। গতরাতেও ঘুম আসেনি। শেষরাতে কিচেনে গিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে, খেয়ে বিছানায় আধঘন্টা এপাশ-ওপাশ করে তারপর ভোরবেলায় চোখের পাতার ঘুম আনতে সক্ষম হয়েছে সে। বেলা এগারোটা কিংবা বারোটা পর্যন্ত ঘুমানোর কথা থাকলেও তা আর হলো না। সাড়ে নয়টা বাজতেই কানের কাছে ফোনটা বাজতে শুরু করলো। কোনোরকম একচোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো ইকবাল মাহমুদের কল। বড্ড বিরক্ত হলো সে। এই সকালে ইনি কেন! ঘুম জড়ানো কন্ঠে রিসিভ করলো সে।
— “জি আংকেল?”
— “ঘুমাচ্ছো তুমি? বিরক্ত করলাম তোমাকে?”
— “সমস্যা নেই। বলুন।”
— “একটু যে বাসায় আসতে হয়, বাবা।”
— “কেন?”
— “আজগর সাহেব এসেছেন। মতিউর আর হাবিব সাহেবও আসছে, সঙ্গে দু’চারজন চ্যালাও আছে।”
— “এইসব ঝামেলায় আমাকে কেন সশরীরে টানছেন আংকেল? এইটুকু কি আপনি সামলাতে পারছেন না?”
— “পারবো অবশ্যই। কিন্তু তুমি এলে ভালো হতো না?”
চটে গেল রুদ্র। ঘুমটাও কেটে গেল চোখ থেকে। শান্ত গম্ভীর স্বরে বললো,
— “ছোটখাটো ব্যাপারগুলোও কি এখন আমাকে সামলাতে হবে? বুঝলাম না বিষয়টা!”
— “ঝামেলা বহুদূর গড়াবে মনে হচ্ছে। ওরা তিনজন কোনো কাঁচা রাজনীতিবিদ না। বহুবছর দলের হয়ে কাজ করেছে, দলের গোপন অনেক কিছু ওদের জানা। তোমাকে নিয়েও কীসব থ্রেট করছে।”
— “তাতে কী?”
— “তুমিও রেগে যাচ্ছো!”
— “ঐ তিনটাকে আরো আগেই সাইজ করে দেয়া উচিত ছিল। তা না! দলে ঝুলিয়ে রেখেছেন এতবছর। আচ্ছা, আসছি আমি।”
— “নাস্তাটা আমার এখানেই করো।”
— “আচ্ছা!”
গতরাতে শুভ বাসায় ফিরেছে বেশ রাত করে। এখনও ঘুমুচ্ছে হয়তো! কল দিয়ে ওকে জাগাতে ইচ্ছে করছে না রুদ্রের। কিন্তু ওকে সঙ্গে নেয়াটাও জরুরি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুভকে কল করলো রুদ্র।
— “ঘুমাও?”
— “না ভাই, রেডি হচ্ছি। আপনার ওখানেই আসছি।”
— “ইকবাল সাহেবের ওখানে যেতে হবে।”
— “হঠাৎ! কোনো সমস্যা?”
— “হ্যাঁ সমস্যাই। আমি তৈরী হচ্ছি। তুমি এসো।”
— “আর কাউকে সঙ্গে নিতে হবে?”
— “নাহ্। আমি, তুমি আর গার্ড দু’জন। ব্যস! “ . “ওকে ভাই।”
*****
থ্রি কোয়ার্টার ট্রাউজার আর হাফহাতা টি-শার্ট পরে ইকবাল মাহমুদের বাড়ি যখন এসে রুদ্র পৌঁছালো, তাকে দূর থেকে দেখে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দুলালেন তিনি এই ছেলেটা আর ঠিক হলো না! এইসব গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে কেন যে খাটো প্যান্ট পরে আসে কে জানে! একবার কথার ছলে হাসতে হাসতে বলেছিল ওকে সে কথা। পাত্তাই দিলো না!
আদব কায়দা দেখাবার খুব একটা বালাই নেই রুদ্রের। কাজের কথা ছাড়া খুব একটা কথাও বলে না সে। মেপে কথা বলার অভ্যেস তার। আর এইসব পরিবর্তন হয়েছে আশরাফ মির্জা গত হবার পর থেকে। এর আগে দেখা হলে হাসিমুখে সালাম দিতো, মিষ্টি হেসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতো। এখন সেসবের ধারে কাছেও রুদ্রকে দেখা যায় না। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দরজায় ইকবাল মাহমুদকে দেখা সত্ত্বেও, কথা না বলে সোজা ভেতরে চলে গেল সে। এখানে ইকবাল সাহেবের ব্যক্তিগত ঘরেই এইসব রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা হয়। রুদ্র, শুভকে নিয়ে ভেতরে যেতেই দরজা আটকে দিলেন ইকবাল সাহেব। বাইরে দরজার দু’পাশে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তার দেহরক্ষী দু’জন।
সোফায় ধুপ করে গা এলিয়ে বসলো রুদ্র।
সিগারেট ধরিয়ে দলের তিনজন প্রাক্তন মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,
— “কী সমস্যা?”
রুদ্রের এসব বেয়াদবি দলের বহু মানুষের অপছন্দ। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের সদস্যদের। এই যে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চোখ ছোট করে জবাবের আশায় তাদের দিকে চেয়ে আছে এটা একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার অপমান নয়? মেজাজ হারিয়ে কথার বলার রুচিই হারালেন মতিউর সাহেব। দলের প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী তেড়ে উঠলেন প্ৰায়।
— “তুমি নিজেরে কী ভাবো?”
— “আপনাদের নিয়ে ভেবেই কূল পাই না। নিজেকে নিয়ে আর কখন ভাববো?”
— “ইকবাল ভাই, কথার ধরণটা দেখেন একটু! আপনার প্রশ্রয়ে এত বাড় বাড়ছে এই ছেলের।”
— “তুমিও তো কম যাও না হাবিব! আমি সামনে বসে আছি, আমার সামনে তোমরা দু’জন এভাবে বাড়াবাড়ি করবে?”
— “ওর উত্তরটা শুনলেন না?”
— “শুরুটা তুমি বাজেভাবে করেছো।”
— “আর কত ইকবাল ভাই? দুইদিনের ছেলে ছোকড়াকে চাটবেন এখন?”
প্রচন্ড রেগে গেলেন ইকবাল মাহমুদ। টেবিলে সজোরে লাথি মেরে বললেন, – “কারে কী বলো তুমি? এত সাহস তোমার!”
হাবিব কিছু বলার আগেই প্রায় মারমুখো হয়ে জবাব দিলো মতিউর।
— “সাহস না থাকলে দল টাইনা এই পর্যন্ত আনতে পারতাম না। রাজপথে দুপুরের কড়া রোদে শুইয়া আন্দোলন করছি, রিমান্ডে পুলিশের মাইর খাইছি। প্রয়োজনে খুন খারাবা, বিরোধী দলের লোকজনকে ফাঁসানো কী না করছি দলের জন্য। আর এখন সেই দল কিনা মন্ত্রীপদ দিতে অস্বীকার কইরলো!”
তখনও শান্ত হয়ে বসে রইলো রুদ্র। হাতের সিগারেটটা এখনো ফুরোয়নি তার। চুপ করে তাদের চেঁচামেচি শুনছে সে। শুভ দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রের মাথার কাছে। রুদ্র মুখ খোলার আগ পর্যন্ত এখানে কাউকে কিছু সে করবেও না, বলবেও না। সে অপেক্ষা করছে রুদ্রের সিগারেটটা শেষ হবার। আজ এই তিনজন একটা ঝামেলা করবে বলে মনস্থির করেই এসেছে। নয়তো সঙ্গে তাদের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্বস্ত, তাদের জন্য জীবন দিয়ে দেবে সেইসব চ্যালাপ্যালা আনতো না। কোথাকার জল রুদ্র আজ কতটুকু গড়াতে দেয় দেখা যাক!
গম্ভীর স্বরে দলের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আজগর সাহেব বললেন,
— “মন্ত্রীত্ব পাবার দাবিদার আমরা। অথচ সেই দায়িত্ব কিনা দেয়া হলো নতুন যোগ হওয়া কচি ছেলেপেেেলদর? রাজনীতির কী বোঝে ওরা? কী করেছে দলের জন্য?
এত বছর যাদের কাঁধে কাঁধ রেখে চললেন, দল বড় করলেন, আজ তাদের চেনেন না আপনি? সেদিনের আসা এই ছেলের কথায় মন্ত্রী পদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।” এ্যাশ ট্রেতে সিগারেটের শেষাংশ ফেললো রুদ্র।
মাঝারি দৈর্ঘ্যের চুলগুলো হাত দিয়ে উল্টে দিতে দিতে বললো,
— “বয়োজ্যেষ্ঠরা রাজপথ ছেড়েছে আজ কতবছর হলো হিসেব আছে?”
— “সিনিয়র মেম্বাররা কি রাজপথে নামবে?”
— “যদি দল করার সুবাদে সুযোগ ভোগ করতে পারেন তাহলে দলের প্রয়োজনে রাজপথে কেন নেমে আসবেন না?”
মতিউরের মেজাজ আজ নিয়ন্ত্রণে আসছেই না। ইকবালের পর এখন সে তেড়ে গেল রুদ্রের দিকে।
— “রাজনীতির নিয়ম বুঝো না, দলের সিনিয়র-জুনিয়র এক্টিভিটি বুঝো না। বালের রাজনীতিবিদ হইছো তুমি! তোমার বাপের নামে খালি তোমারে তোষামদ করা হয়। নয়তো তোমার মতো ছেলেরে গোনায় কে ধরে?”
— “এই যে আপনি, আপনারা। গোনায় ধরেন, প্রয়োজনে পায়েও ধরবেন। ইলেকশনের আগে তো আমার বাড়ির মাটি ছাড়েননি। সপ্তাহে দু’দিন তিনদিন করে আমার বাড়িতে আপনার আনাগোনা ছিলই।”
— “হ ছিল। কিন্তু তুমি তো সেটার সম্মান দাও নাই। আমি যে দলের একজন সিনিয়র সদস্য, প্রাক্তন মন্ত্রী তুমি কি সেটার লেহাজ রাখছো?”
— “দলকে যতটা দিয়েছেন তার চেয়ে তিনগুন চুষেও খেয়েছেন। আপনাদের কত কত ক্রাইম ঢেকে রাখা হয়েছে তা আপনাদের ধারণা আছে? ক্ষমতায় আছেন, দুর্নীতি করবেন ভালো কথা; কিন্তু একটা সীমা তো থাকা উচিত! দল করেছেন আপনারা নিজের স্বার্থে, দলের স্বার্থে না। আজগর সাহেব আপনি, দলের সবচেয়ে সিনিয়র পার্সন আপনি, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির ইতিহাসও আপনারই। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখান থেকেই কব্জি ডুবিয়ে টাকা সরিয়েছেন। রেল খাত ধ্বংস আপনার কারণে। চাইলে যখন তখন আপনার বিরুদ্ধে স্টেপ নেয়াই যেত। কত সাংবাদিক আপনার বিরুদ্ধে লেগেছে, সেসব সরকার থেকে সামলে নেয়া হয়েছে। তবুও আপনার মন ভরে না। এই বুড়ো বয়সেও পদ চাই আপনার, আরো চুরি করার সুযোগ চাই। মরার আগ পর্যন্ত যদি গদি ধরে বসে থাকেন, তাহলে বিগত ১০-১৫ বছর ধরে যারা দলে খাটছে তাদের কী হবে?”
আবারও উদ্যত হলো মতিউর। বললো,
— “কী হবে মানে? এইসব যুক্তি! কুকুর বিড়ালের মতোন আচরণ করা হইছে আমাদের সঙ্গে।”
বিরক্ত হলেন ইকবাল। বললেন,
— “মেয়েলোকের মতো বাড়িয়ে চড়িয়ে কেন বলছো মতিউর? কে তোমাদের সঙ্গে কুকুর বিড়ালের মতো আচরণ করেছে?”
— “মুখের উপর বলা হয় নাই মন্ত্রীপদে এইবার নতুন সদস্য দেয়া হবে?”
— “যথেষ্ট সম্মান রেখেই তোমাদের জানানো হয়েছে।”
ইকবাল মাহমুদ কথা শেষ করার আগে ফোঁড়ন কাটলো রুদ্র,
— “অথচ যে সম্মানটা আপনারা আসলে ডিজার্ভ করেনই না!”
সমস্বরে হুংকার ছাড়লো আজগর আর হাবিব সাহেব।
— “ডিজার্ভ করি না মানে?”
— “আপনাদের দুর্নীতির চিপায় পড়ে দলের কেমন বদনাম হয়েছে ধারণা আছে আপনাদের?”
— “দলের আর কেউ দুর্নীতি করে না? আর তুমি? তুমি কি একেবারে খুব সাধু? ক্রাইম করো না তুমি?”
— “করি তো আপনাদের বাঁচাতে গিয়ে। দল বাঁচাতে গিয়ে। আপনারা একটা করে অঘটন ঘটান, পুরো দলকে সেটা ভুগতে হয়। দলের প্রত্যেকেই দুর্নীতি করে। কেউ সাধু না। কিন্তু আপনাদের মতো বাড়াবাড়ি কেউ করে না। মতিউর সাহেবের কথাই বলি, যেখানে মেয়ে মানুষ সেখানেই তিনি। নারী কেলেংকারীতে উনার পুরো দেশ জুড়ে তুলনা নেই। কত মেয়েকে ট্র্যাপে ফেলে নিজের বেডরুম পর্যন্ত টেনেছে, হিসেব আছে? দেশের মানুষ সেসব জানে না ভেবেছেন? সবাই সব জানে। বলুন ক্ষমতার জোর দেখিয়ে সব ধামাচাপায় রাখা হচ্ছে। হাবিব সাহেবও একই পথের পথিক। মেয়ে দেখলে কারো হুঁশ থাকে না। দল এবার কিভাবে জিতেছে, কোন জেলায় কয় হাজার লোক খেটেছে সে খবর আছে আপনাদের? গত পাঁচবছর ধরে প্ল্যান করেছি পরবর্তী ক্ষমতা আমরা নেবো। স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়েছি। কখন কাকে পথ থেকে কৌশলে সরাতে হবে. সেই ডিসিশন নিয়েছি। গত ছয়মাসে যতরকম ঝামেলা হয়েছে আপনাদের তাতে কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল? আপনাদের একটা ছেলেও মাঠে নেমেছে? ইলেকশন ফান্ডিং কোথা থেকে কিভাবে হচ্ছে, তার কোনো খবর আছে? দলের কমবেশি সবাই সব খবর জানে। জানেন না শুধু আপনারা তিনজন। আমার মনে হয়েছে আপনারা দলের জন্য মিসফিট। দলের প্রধানকে আমি জানিয়েছি। উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, সবাই তাতে সম্মতি দিয়েছেন। এতবছর দলের সঙ্গে আপনারা ছিলেন, আমরা তাতে কৃতজ্ঞ। ব্যস! এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করবেন না।
— “উপদেষ্টা, দলের প্রধানের সঙ্গে আলোচনার কী কাজ? তুমিই দলের সব। তোমার কথাই শেষ কথা। তোমার ইশারাতেই, তোমার পছন্দমতো নতুন ছেলেপেলে পদে বসছে।”
— “তো আপনারা এখন কী চাচ্ছেন? ওদের সরিয়ে আপনাদের বসাই?”
— “মান সম্মান ধরে টান দিছো বাবা! শপথের অনুষ্ঠানে আমরা শপথ নেই নাই এরচেয়ে অপমান আর কী আছে? আমাদের সমর্থকরা পিঠ পিছে কানাঘুষা করে। ব্যাপারটা তো সুখের না, তা তুমিও বুঝো!”
— “এসেছেন তো সুখ আদায় করতেই। বলুন, সুখের জন্য কী করতে পারি?”
— “ক্ষমতা চাই।”
— “নয়তো?”
— “দল ডুবাইতে দ্বিতীয়বার ভাববো না।
রুদ্র তখনও শান্ত চোখে চেয়ে রইলো মতিউরের দিকে। ইকবাল মাহমুদ আর শুভ চেয়ে রইলো রুদ্রের উত্তরের আশায়। রুদ্রের শীতল চাহনী ভালো ঠেকছে না। আজগর সাহেবের। পরিস্থিতি খারাপ হবার আগেই বিকল্প প্রস্তাব পেশ করলেন তিনি।
— “অপমান যা করার করেছেন আপনারা। সম্মান ফেরত চাইছি, দিতে চাইছেন না। আমরা ঝামেলা চাইলে করতেই পারি কিন্তু ঝামেলা করে তো লাভ আসলে কারোই হবে না। তার চেয়ে আপোষ করে নেই।”
আজগর সাহেবের আপোষের প্রস্তাবটাও যে বাঁকাই হবে, তা জানা আছে ইকবাল সাহেবের। তবুও জানতে চাইলেন তিনি,
— “কী চান?”
— “তিনজনের একাউন্টে সম্মানী।”
— “কত?”
— “বাৎসরিক ৭২ কোটি। ২৪ কোটি করে প্রতিজনের একাউন্টে ট্রান্সফার করতে হবে। খুব একটা কিন্তু চাইনি। দলের সুবিধার্থে এইটুকু তোমরা করতেই পারো। দলের পুরানো লোক আমরা। আমাদের একেবারে বাদ দিয়াও কিছু করতে পারবা না। সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। বজায় রাখতে হলে এই সম্মানটুকু করাই লাগবে।”
বিরস বদনে আজগর সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন ইকবাল মাহমুদ।
ফাজলামির সমস্ত সীমা এই লোক পার করে ফেলেছে। শুভর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো রুদ্র। রুদ্রের হাসিতে যা বুঝার বুঝে নিয়েছে সে। এখানে আর কথা বাড়ানোর কিছু নেই। রুদ্রের তরফ থেকে সব কথা শেষ। এখান থেকে সরে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো সে। সোফা ছাড়লো রুদ্র।
ইকবাল মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “হলোই সমাধান। যা চায়, দিয়ে দিন।”
অবাক হলেন ইকবাল মাহমুদ।
— “মানে কী! তুমি এতে সম্মতি দিচ্ছো?”
— “দিলাম।”
আর কিছু বললো না রুদ্র। বলার সুযোগও দিলো না। বেরিয়ে এল ইকবাল
মাহমুদের বাড়ি ছেড়ে। গাড়িতে উঠে বসতেই শুভকে রুদ্র গুনগুনিয়ে সুর তুলে বললো,
— “মতি! মতি!”
— “আমিও ওকেই টার্গেট করেছিলাম। সবচেয়ে লাফাচ্ছিল ওটাই।”
— “বোকাগুলো এখনও নিজের পায়ের তলার মাটি আন্দাজ করতে পারেনি।”
— “প্ল্যান কী?”
— “সবচেয়ে বেশি যাতায়াত আজকাল যেটার কাছে চলছে, ওটাকে সরিয়ে দাও।”
— “একেবারে?”
— “হ্যাঁ।”
— “মার্ডার কেইসে?”
— “এটা দিয়ে শুরু করে, বাকিগুলো টানা হবে। একটাকে ধরলে বাকি দুটো
— “এমনিতেই মানুষ হয়ে যাবে। নাহলে ঐ দু’টোর জন্যও আলাদা প্ল্যান আছে।”
৪
টিভির স্ক্রিনে হতাশ ভঙ্গিতে চেয়ে আছে রুদ্র। ইকবাল মাহমুদের বাসা থেকে ফিরেছে এক ঘন্টা হলো মাত্র। এরই মধ্যে কল এল তার নাম্বারে, জলদি টিভি অন করো। দেশের প্রতিটা চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে আদনানের বিরুদ্ধে নারীঘটিত সংবাদ চলছে। ফেসবুক লাইভে এসে আদনানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে সোমা। এত কম সময়ে আজগর এভাবে জাল বিছিয়ে ফেলবে ভাবতেও পারেনি সে! বেছে বেছে সর্বকনিষ্ঠ, সবচেয়ে যোগ্য ছেলেটাকেই টার্গেট করেছে আজগর। ছেলেটার একটাই অপরাধ, রেলমন্ত্রীর জায়গায় আজগরের বদলে এই ছেলেকে রুদ্র দায়িত্ব দিয়েছে। প্রচন্ড রাগে হাসলো রুদ্র।
শুভকে বললো,
— “আজগরকে আন্ডারস্টিমেট করা উচিত হয়নি। পুরোনো খেলোয়ার; বিপক্ষের চোখ দেখে পরবর্তী চাল কী হবে সেটা বুঝে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক।”
— “আজগরই? আপনি সিওর?”
— “ও ছাড়া আর কারো মাথা থেকে এত কূটবুদ্ধি বেরোবে না। আমার নেক্সট প্ল্যান কী সেটাও আন্দাজ করতে পারবে না। ও পুরো ছক কষেই আমাদের থ্রেট করেছে।”
— “মতি যেভাবে লাফাচ্ছিল তবুও আপনি কিছু বললেন না। টাকা ডিমান্ড করলো। সেটা শুনেও চুপচাপ সায় দিয়ে চলে এলেন। এটাতেই ও সন্দেহ করেছে।”
— “হ্যাঁ। আমি মুভ করার আগে ও খেলে দিলো। শালা মাদারচোদ।”
— “আদনানের সঙ্গে কথা বলা দরকার না?”
— “কথা বলবো অবশ্যই। দলে নতুন। দায়িত্বও অনেক। চেয়ারে বসতে না বসতেই এসব ফেইস করতে হচ্ছে। ঘাবড়ে যাচ্ছে হয়তো! ওকে ওর পজিশনে রাখতেই হবে। এই ঘটনার সুরাহা করতে হবে সপ্তাহখানেকের মধ্যে। রেল ডিপার্টমেন্ট পুরো ধ্বংস করে দিয়েছিল আজগর। বিরোধী দলের যেটা দায়িত্বে ছিল সেটাও আরেক চোর। উন্নতির নাম করে কম টাকা সরায়নি। উন্নয়নের নামে ঘন্টা করেছে। প্রতিবছর চাকরির বাহানায় কত টাকা যে ঘুষ নিয়েছে, সে হিসেব আর না করি! এদিকে ইলেকশন আসলেই এরা হয়ে যায় ফকির। ফান্ড ম্যানেজ করতে হয় আমাদের। এবার আমি টার্গেট নিয়েই রেখেছি রেল, শিক্ষা, আর খাদ্য বিভাগের পুরোটা গুছিয়ে ফেলবো। দুর্নীতি ঠেকানো সম্ভব না। হবেই। তবে সেটা যেন বিলো দ্যান মিনিমাম হয়। এই ছেলেটা বেশ স্বচ্ছ। ওকে এই দায়িত্ব থেকে সরানো যাবে না।”
— “সেটা নাহয় সামলে নিলাম। কিন্তু আজগর সত্যিই পাগল হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারছেন তো?”
— “হুম।”
— “আরো ঝামেলা করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”
— “সেটা আমিও ভাবছি। কার কোন সিক্রেট হাতে ধরে বসে আছে কে জানে! বুড়ো হয়েছে তো। জানের ভয় টয় পাচ্ছে না আরকি! ভাবছে মরেই যাবো হুট করে। তারচেয়ে সবাইকে একটু নাকানি চুবানি খাইয়ে মরি।”
— “নেক্সট মুভ কী?”
— “জানি না। ব্রেইন কাজ করছে না। ইলেকশনের আগের তিনমাস কোনো শান্তি পেয়েছি আমি? বসেই ছিলাম ইলেকশন শেষ হলে কিছুদিন সবকিছু থেকে ব্রেক নেবো সেই আশায়।”
চুপ হয়ে গেল শুভ। ঠিকই তো বলছে। দিনভর যে যত কিছুই করুক, দিনশেষে একটুখানি শান্তি সবাই চায়। কিন্তু এই মানুষটার শান্তি কোথায়? কে আছে তাকে শান্তি দেবার? কাছে টেনে সব ক্লান্তি দূর করে দেবার? কেউ নেই তো! দিনভর যত চিন্তা এই ছোট্ট মাথায় নেয়, রাতের বেলা সেসব নিয়েই বিছানায় যায়।
কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর রুদ্র বললো,
— “মতির প্ল্যান আপাতত বন্ধ। কিন্তু সিনথিয়ার উপর যেন ২৪ ঘন্টা নজরদারি চলে। আর ঐ তিনটার উপরও নজরদারি চলবে।”
— “আচ্ছা।”
— “নাস্তা কোথায় আমার?”
— “দিতে বলবো?”
রুদ্র জবাব দেবার আগেই কল এল তার ফোনে। ইকবাল মাহমুদ কল করছে। আদনানের কথা বলতেই হয়তো! এই বিষয়ে আপাতত কথা বলতে ইচ্ছে হলো না রুদ্রের। শুভর হাতে ফোন দিয়ে বললো,
— “এটা সামলাও। আর আমার নাস্তা এখানে পাঠাতে বলো।
কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল শুভ। চোখ বুজে মাত্রই খাটে হেলান দিয়েছিলো রুদ্র। তখনই দরজায় নক করে বডিগার্ড সুমন বললো, – “স্যার, আদনান স্যার এসেছেন।”
— “পাঠাও। আর মেইডকে বলো এই ঘরে গেস্ট আছে। কিছু একটা তৈরী করে যেন পাঠায়।”
— “জি।”
উঠে বসলো রুদ্র। আড়মোড়া ভেঙে নিজেকে একটুখানি ফুরফুরে করতে চাইলো সে। হলো না। বিরক্তিতে সব ছেড়েছুড়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। আধমরা চেহারা নিয়ে ঘরে এল আদনান।
— “আরেহ মন্ত্রী সাহেব! খবর কী তোমার?”
ওকে দেখেই প্রাণখোলা হাসির মিথ্যে নাটক করলো রুদ্র। এমনভাবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে যেন আজ কিছুই ঘটেনি।
অবাক হলো আদনান। বললো,
— “খবর জানেন না ভাইয়া?”
— “সব জানি।”
— “আপনি বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?”
— “কেন বুঝবো না? তোমাকে সুপরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হচ্ছে।”
— “সোমা এটা করলো কেমন করে? একবারও ভাবলো না আমার ক্যারিয়ারের কী হবে?”
— “বসো এখানে।”
দাঁড়িয়েই রইলো আদনান। তার হাত টেনে খাটে বসালো রুদ্র। প্যাকেট থেকে দু’টো সিগারেট বের করে একটা আদনানের হাতে ধরিয়ে দিলো
খানিকটা সংকোচ হলো আদনানের। বললো,
— “আপনার সামনে?”
— “ভাই ব্রাদার আমরা। স্ট্রেস কিংবা ডিপ্রেশনে একসঙ্গে বসে নিকোটিন নেবো এটাই ভাই-ব্রাদারের নিয়ম।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদনান। লাইটারে সিগারেট জ্বালিয়ে মাথা নিচু করে রইলো ও। রুদ্র দেখছে ওকে। মনে মনে ভেঙে পড়েছে ভীষণ। হয়তো অঘটনটা ভালোবাসার মানুষকে দিয়ে করানো হয়েছে তাই ধাক্কা সামলাতে পারছে না। কিন্তু ওকে এভাবে ছাড়া যাবে না। সামলাতে হবে, বুঝাতে হবে, স্ট্রেস ফ্রি করতে হবে। আজগরকে প্ল্যান সাকসেসফুল করার একটুখানি সুযোগও দেয়া চলবে না। মুখের হাসি জারি রইলো রুদ্রের। বললো,
— “তুমি ভেঙে পড়ছো কেন বলো তো? রাজনীতিতে এসব চলে। এত কম বয়স থেকে রাজনীতি করছো, জানো না কিছু?”
— “জানি। কিন্তু নারীঘটিত ব্যাপারে দায়ী হবো, আমাকে নিয়ে নিউজ হবে… ভাবতে পারিনি কখনো! তাও কে অভিযোগ করলো? সোমা, যাকে আমি এত ভালোবেসেছি। ও ছাড়া কখনো কাউকে চোখ তুলে দেখিনি। সেই মেয়েটাই কিনা এখন আমার বিপক্ষে অভিযোগ করলো আমি তাকে ঠকিয়েছি?”
— “বিয়ে করেছো দু’জনে কতবছর হলো?”
— “তিনবছর।”
— “সোমা এখন কী করে?”
— “চাকরি করছে একটা মাল্টিমিডিয়া কোম্পানিতে।”
— “বয়স কেমন?”
— “২৫।”
— “মেয়েটা তো বোনের বাসায় থাকে, তাই না?”
— “হ্যাঁ।”
— “দেখো আদনান, তুমি সোমার অন্যায়টা দেখছো কিন্তু নিজের দায়িত্বে অবহেলা দেখছো না।”
— “কেমন?”
— “তুমি গোপনে একজনকে বিয়ে করেছো। সেই গোপন বিয়ের খবর, বউ, বউয়ের ইতিবৃত্তান্ত জানা তারপর সেই বউকে তোমার বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া এসব একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। তোমার বউ পর্যন্ত ওরা পৌঁছে গেল অথচ তুমি জানোই না, এটা কেমন কথা? তুমি এই মুহূর্তে কার জায়গা দখল করে আছো জানো? আজগরের। ও কেমন খারাপ সেটাও তোমার জানা। যখন তখন তোমার বা
তোমার পরিবারের ক্ষতি সে করতে পারে তা তুমি জানতে। তাহলে কেন তুমি
কী সোমার সিকিউরিটির কথা ভাবলে না? ও কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কথা বলছে, এসব খেয়াল রাখলে না। সোমাকে তোমার বিরুদ্ধে না উস্কে এমনও তো হতে পারতো ওরা সোমাকে ধরে নিয়ে কোনো ক্ষতি করে দিলো! পারতো কি না বলো?”
— “পারতো।”
— “তাহলে তুমি আমাকে বুঝাও, তোমার নাকের নিচে তোমারই বউকে কাজে লাগিয়ে তোমার বিরুদ্ধে ওরা খেলতে পারছে কিভাবে?”
— “তাই বলে সোমা ওদের কথা শুনে নেবে? আমাকে জানাবে না?”
— “তুমি এখনও সোমাকে ব্লেইম করছো? আমি তোমাকে বেশ ইন্টেলিজেন্ট ভাবতাম!”
ঘরে এল শুভ। তার পেছন পেছন নাস্তা নিয়ে এল গৃহকর্মী। দু’জনের সামনে নাস্তা সাজিয়ে চলে গেল সে।
আদনানকে তাড়া দিয়ে রুদ্র বললো,
— “খাও। খেতে খেতে কথা বলো।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু করে পুডিং মুখে নিলো আদনান। শুভর হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে রুদ্র বললো,
— “তোমার নাস্তা দিতে বলোনি কেন?”
— “খেয়ে এসেছি।”
— “শুধু কফিই খাবে?”
— “হ্যাঁ। সকালে এটাই খাওয়া হয়নি।”
— “তো আদনান, যা বলছিলাম… সোমার এখানে আমি দোষ তেমন দেখতে পাচ্ছি না। ওকে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে। মেয়েদের ব্রেইনওয়াশ করা তুলনামূলক সহজ। বিশেষ করে হাজবেন্ডের ব্যাপারে। অবশ্য সুযোগ তুমিই দিয়েছো!”
— “আমি?”
— “বিয়ে করেছো তিনবছর হয়েছে। মেয়ের পড়াশোনা শেষ। তুমি তো ভালোই বিজনেস করছিলে। বউ পালার মতো সামর্থ্য সেই ছাত্রজীবন থেকেই তোমার ছিল। তাহলে কেন তুমি ওকে এখনো ঘরে তোলোনি? এটলিস্ট সবাইকে জানিয়ে এঙ্গেজমেন্ট সেরে রাখা যেত।”
— “আমি চেয়েছিলাম পলিটিক্সে আমার ভালো একটা পজিশন হোক, তারপর সবাইকে জানিয়ে বিয়ের আয়োজন করবো।”
— “কেন? বিয়ের পর কি রাজনীতি করা যায় না? তিনবছর সময়টা কিন্তু কম না! তুমি এতদিন ধরে একটা মেয়েকে গোপনে বউ বানিয়ে রেখেছো, অথচ বউ ঘরে
তোলার মতো পরিস্থিতি তোমার অনুকূলেই ছিল। সেক্ষেত্রে সোমা নিজেকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করতেই পারে। এছাড়া তোমাদের মাঝে কমিউনিকেশন গ্যাপ আছে অবশ্যই, নয়তো এতবড় কান্ড ঘটে গেল তুমি কেন কিছুই আঁচ করতে পারলে না? আমার তো মনে হয় বেসিক কমিউনিকেশনও তোমাদের মাঝে ঠিকমত হয় না।”
— “হ্যাঁ! ঐ আরকি… ব্যস্ত থাকি।” আমতা আমতা করতে লাগলো আদনান। – “সেটাই আদনান! পুরো সমস্যাটা আসলে তোমার। মাঝ থেকে সুযোগ নিলো ওরা। একটা মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছো, দায়িত্ব পূর্ণ করতে শেখো।”
— “তুমি যা কিছু করছো তাতে সোমার এভাবে রিএ্যাক্ট করা খুব স্বাভাবিক। তার উপর ভালো পজিশনে আছো এখন। তোমার ওয়াইফ এমনিতেই তোমাকে নিয়ে দিনরাত এখন সন্দেহে ভুগবে যদি তুমি ওর প্রপার কেয়ার না করো। একটা মানুষের যত্ন নেয়ার জন্য দিনরাত তাকে নিয়ে পড়ে থাকতে হয় না। তুমি খাওয়ার সময় ওকে ডেকে পাশে বসিয়ে খাওয়াচ্ছো কিংবা কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছো সে খেয়েছে কি না এটাও যত্ন, আদনান। পুরো চাবি এখনও তোমার ওয়াইফের হাতে আছে। ওর কাছে যাও। ওকে কনভিন্স করো। প্লিজ মেজাজ দেখিয়ে না, যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় ওকে বুঝাও। এই ঝামেলাটা আর বাড়তে দেয়া যাবে না কোনোভাবেই।”
— “ও লাইভে এসে আমাকে এভাবে ধুয়ে দিলো। কতখানি বিগড়ে আছে বুঝতে পারছেন?”
— “হাজবেন্ড আরেক মেয়ে নিয়ে প্রেমে মেতেছে সে কথা জানলে সব মেয়ে এভাবেই বিগড়ে যাবে। আস্ত রেল সেক্টর সামলানোর দায়িত্ব হাসতে হাসতে নিয়ে নিলে অথচ বউ সামলাতে পারবে না? বাহানা করো না। আমি আজকের মধ্যে সব ঠিক দেখতে চাই।”
— “ও শান্ত হলো। তারপর?”
— “তারপরের হিসেব আমি বুঝবো। তুমি আগে ওকে দেখো।”
দ্রুত মগের কফিটা শেষ করে বেরিয়ে গেল আদনান।
হাসতে হাসতে দুষ্টুমির ছলে শুভ বললো,
— “সব পুরুষ ঘরের বউয়ের কাছে এসে ধরা! সব সামলাতে পারবে, কিন্তু বউ না।”
— “দেখি কী হয়।”
— “কিন্তু এত অল্পতে ঘাবড়ে গেলে চলবে? সামনে আরো কত কী ফেইস করতে হবে!”
— “আদনান একটু বউ উদাসী ছেলে। কিন্তু বউকে ভালোবাসে ও। সত্যিই সোমার বাইরে কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে ওকে দেখা যায়নি। সেই ছেলেকে যখন পুরো দেশবাসীর সামনে তারই বউ পরকীয়ার মতো একটা ব্যাপারে জড়িয়ে দিচ্ছে, ভালোবাসা-বিয়ের মিথ্যে নাটকের অপবাদ দিচ্ছে ওর খারাপ লাগা স্বাভাবিক। বাইরের লোকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জিতে আসা সহজ। প্রিয় মানুষ, পরিবারের সঙ্গে না। আমার বাবাকেই দেখো! সারাজীবন রাঘব বোয়ালদের মাঝে মাথা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কেউ বাবার একটা চুলও বাঁকা করতে পারেনি। অথচ সেই বাবা কিনা মারা গেল আপন ভাইয়ের গাদ্দারিতে। থাক সেসব কথা। এখন বলো তো, আমি তোমার ওখানে গিয়ে দুইদিন থাকতে চাচ্ছি। ভালো লাগছে না এখানে। দু’টো দিন সবকিছু থেকে ডিটাচড় থাকতেই হবে। নয়তো হচ্ছে না আসলে! থাকা যাবে?”
— “অবশ্যই যাবে!”
— “তাহলে অফিসের কাজ শেষ করে রাতে যাচ্ছি তোমার ওখানে।”