রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : জীবনপঞ্জি
১৯৫৬ : ১৬ অক্টোবর (২৯ আশ্বিন ১৩৬৩) রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্ম। পিতা ডা. শেখ ওয়ালীউল্লাহ (১৯৩০-১৯৯৬), মাতা শিরিয়া বেগম (১৯৩৯-২০০৪)। পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার সাহেবের মেঠ গ্রামে। অবশ্য তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জের রেডক্রস হাসপাতালে।
১৯৬২ : শৈশবের অধিকাংশ সময় তাঁর কেটেছে নানাবাড়ি মিঠেখালি গ্রামে (বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার অন্তর্গত)। এখানকার পাঠশালাতেই তাঁর পড়াশুনার শুরু।
১৯৬৪ : সাহেবের মেঠ গ্রামে তাঁর নানার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘ইসমাঈল মেমোরিয়াল স্কুল’ দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৬৬ : মোংলা থানার ‘সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়’-এ চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়া ও কবিতা আবৃত্তির প্রতি তাঁর ঝোঁক দেখা যায়। এ স্কুলে পড়াকালীন নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্ৰথম স্থান অধিকার করেন।
১৯৬৮ : মামাতো ভাইদের সঙ্গে নিয়ে নানীর ট্রাংক থেকে টাকা চুরি ক’রে গ’ড়ে তোলেন ‘বনফুল’ নামের লাইব্রেরি। এ সময় তিনি কাঁচা হাতে লিখতে শুরু করেছেন। খেলাধুলায় খুব আগ্রহ। ভালো খেলেন। মোংলায় প্রথম ক্রিকেট দল তৈরি করেন তাঁর কিশোর বন্ধুদের নিয়ে।
১৯৬৯ : উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান। কিশোর শহিদুল্লাহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দেন। হরতাল, মিছিল, মিটিংয়ে নিয়মিত অংশ নেন। :
১৯৭০ : ‘কালো টাইয়ের ফাঁস’ নাটকে অভিনয়। ভাইবোন ও পাড়াপ্রতিবেশীদের নিয়ে অভিনীত এ নাটকের নির্দেশকও ছিলেন তিনি।
১৯৭১ : মুক্তিযুদ্ধ শুরু। শহিদুল্লাহ নবম শ্রেণীর ছাত্র। যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর বাবাকে পাকসেনারা ধ’রে নিয়ে গেলে তাঁর মা প্ৰথম সন্তান শহিদুল্লাহকে কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দেন নি। যুদ্ধে যেতে না-পারার বেদনা, সেই সঙ্গে চারপাশের নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ, দেশব্যাপী পৈশাচিক হত্যা-নির্যাতন তাঁর ভাবনা-জগৎকে তুমুলভাবে আন্দোলিত করে। পিতার আকাঙ্ক্ষা ছিল শহিদুল্লাহ ডাক্তার হবে। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত শহিদুল্লাহরও স্বপ্ন ছিল তাই। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁর স্বপ্নের পটভূমি বদলে দেয়।
১৯৭২ : ঢাকায় এসে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হন ‘ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল’-এ। থাকতেন ৫০ লালবাগে, সেজমামার বাসায়। এ সময় থেকেই নিয়মিতভাবে কবিতা, গান, গল্প ও নাটক লিখতে শুরু করেন।
২৬ নভেম্বর (রবিবার) ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা ‘আমি ঈশ্বর আমি শয়তান’।
১৯৭৩ : ফেব্রুয়ারিতে সহযোগী সম্পাদক হিশেবে (সম্পাদক –মিয়া মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান) প্রকাশ করেন একুশের সংকলন ‘দুর্বিনীত’। প্রকাশক—দুর্বিনীত শিল্পসাহিত্য গোষ্ঠী, ৫০ লালবাগ, ঢাকা। সংকলনের প্রচ্ছদ করেন তিনি।
১৩ ফেব্রুয়ারিতে বেতারে ‘এখনো বেঁচে আছি’ নামে স্বরচিত কবিতাপাঠ।
এস. এস. সি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনে মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামের সঙ্গে যুক্ত করেন ‘রুদ্র’। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
চার বিষয়ে লেটার মার্কস-সহ এস.এস.সি-তে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ। এইচ.এস.সি-তে মানবিক শাখায় ভর্তি হন ‘ঢাকা কলেজ’-এ।
১৯৭৪ : ফেব্রুয়ারিতে সম্পাদনা করেন কবিতাপত্র ‘অনামিকার অন্য চোখ এবং চুয়াত্তোরের প্রসব যনত্রনা’। ‘আমরা পদাতিক সম্প্রদায়’-এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত এ সংখ্যার কবিরা ছিলেন— শহীদুল্লাহ কায়সার, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শামসুর রাহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবদুল গনি হাজারী, আবু কায়সার, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, উমাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দাউদ হায়দার, মখদুম মাশরাফী, মিয়া মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ওমর আলী ও রুদ্র।
১৯৭৫ : ফেব্রুয়ারিতে সম্পাদনা করেন কবিতাপত্র ‘অশ্লীল জোৎস্নায়’। সম্পাদকীয়তে ‘উপলিকা’ নামে ‘না-কবিতা, না-গল্প’ আঙ্গিকের প্রস্তাবনা।
দুই বছরে মাত্র ১৮টি ক্লাশে উপস্থিত হয়েও মানবিক শাখায় দ্বিতীয় বিভাগে এইচ. এস. সি পাশ করেন।
১৯৭৬ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি।
১৯৭৮ : মে মাসে আলী রীয়াজ ও মঈনুল আহসান সাবের-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন প্রবন্ধ সংকলন ‘স্বরূপ অন্বেষা’। আবিদ রহমান, সলিমউল্লাহ খান, আলী রীয়াজ ও মোরশেদ শফিউল হাসান-এর প্রবন্ধ নিয়ে এ গ্রন্থটি প্রকাশ করে তিতাশ প্রকাশনী। গ্রন্থে ‘প্রবেশক’ শিরোনামে সম্পাদকীয়টি লেখেন রুদ্র।
কবিবন্ধু কামাল চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ, রেজা সেলিম, মোহন রায়হান, আলী রীয়াজ, বদরুল হুদা প্রমুখকে নিয়ে গঠন করেন ‘রাখাল’ নামে সাহিত্য ও প্রকাশনা সংস্থা।
১৯৭৯ : ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় রুদ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’। প্রকাশক— আহমদ ছফা, বুক সোসাইটি, বাংলাবাজার, ঢাকা। তরুণ পাঠক ও কাব্যপ্রেমীদের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগায় বইটি।
২১ ফেব্রুয়ারিতে আবিদুর রহমান-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত গল্প সংকলন ‘প্রেক্ষাপট ৭১’। গ্রন্থের প্রকাশক–রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, রাখাল প্রকাশনী, সিদ্ধেশ্বরী সড়ক, ঢাকা।
মার্চে রাখাল প্রকাশনীর পক্ষে রুদ্র কর্তৃক প্রকাশিত হয় ‘সাহস’ কবিতাপত্ৰ। সম্পাদনায় ছিলেন আলী রিয়াজ ও সাজ্জাদ হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত পরিষদে সাহিত্য সম্পাদক পদপ্রার্থী হন। নির্বাচনে বন্ধু আলী রীয়াজের কাছে পরাজয় বরণ করেন।
স্নাতক (সম্মান) শেষ পর্বের পরীক্ষা দেবার কথা থাকলেও, ক্লাশে উপস্থিতির হার কম থাকায় বিভাগীয় সভাপতি রুদ্রকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেন নি।
১৯৮০ : জানুয়ারিতে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা-র সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনায় বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে ‘Poiema’ নামক (ইংরেজি ভাষায়) কবিতাপত্ৰ প্ৰকাশ।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও কামাল চৌধুরীকে নিয়ে ‘দ্রাবিড়’ প্রকাশনা সংস্থা গঠন। পরবর্তীকালে এ প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন বন্ধু, কথাসাহিত্যিক ইসহাক খান।
‘উপদ্রুত উপকূল’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘সংস্কৃতি সংসদ’ থেকে ‘মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ।
‘লেখক ইউনিয়ন’-এর যুগ্ম আহ্বায়ক মনোনীত হন।
দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৮১ : ২৯ জানুয়ারি তসলিমা নাসরিন-এর সঙ্গে বিয়ে।
ফেব্রুয়ারিতে দ্রাবিড় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’। ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থের জন্য যুগ্মভাবে ‘মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’ প্রাপ্তি।
১৯৮২ : ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে ৪২টি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে গঠিত হয় ‘সংগ্রামী সাংস্কৃতিক জোট’। পরবর্তীকালে এটি ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। রুদ্র ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
১৯৮৪ : এপ্রিলে সব্যসাচী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষের মানচিত্র’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন।
১৯৮৬ : ফেব্রুয়ারিতে চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘ছোবল’ প্রকাশিত হয় দ্রাবিড় প্রকাশনীতে থেকে।
১৯৮৭ : ফেব্রুয়ারির ০১ ও ০২ তারিখে ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে কবিতা’ শ্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসব’। স্বৈরাচারী সরকারের ‘এশীয় কবিতা উৎসব’-এর প্রতিবাদে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে রুদ্র অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। তিনি কার্যনির্বাহী পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। উৎসবের উদ্বোধনী সঙ্গীতটিও (‘শৃংখল মুক্তির জন্যে কবিতা আজ’) লেখেন তিনি। ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘গল্প’ প্রকাশ করে নিখিল প্রকাশন।
তসলিমা নাসরিন-এর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ।
১৯৮৮ : দ্বিতীয় জাতীয় কবিতা উৎসবে কবিতা পরিষদের নেতৃবৃন্দের কয়েকজনের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয়। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত জাতীয় কবিতা পরিষদের ভেতরেও স্বৈরাচারী প্রক্রিয়া ঢুকে পড়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন এবং সকল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে মঞ্চে কবিতা পাঠ করেন। ফলে মতবিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। সৃষ্টি হয় পারস্পরিক দূরত্ব। অভিমানে, ক্ষোভে রুদ্র নিজেকে গুটিয়ে নেন প্রিয় সংগঠন থেকে।
আগস্টে ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ প্রকাশিত হয় মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে।
১৯৮৯ : গান রচনা ও সুরারোপে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর বিখ্যাত ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটি এ সময় লেখা [উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে এ গানটির জন্য তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি প্রদত্ত ১৯৯৭ সালের শ্রেষ্ঠ গীতিকারের (মরনোত্তর) সম্মাননা লাভ করেন]।
গ্রামের বাড়ি মিঠেখালিতে গোলাম মহম্মদ, আবু জগলুল মঞ্জু, মাহে আলম, ফারুক হোসেন, নাজমুল হক প্রমুখকে নিয়ে গ’ড়ে তোলেন গানের সংগঠন ‘অন্তর বাজাও’। মিঠেখালিতে প্রতিষ্ঠা করেন ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন ‘অগ্রদূত ক্রীড়া চক্র’।
১৯৯০ : ১৪ ফেব্রুয়ারি সপ্তম কাব্যগ্রন্থ ‘মৌলিক মুখোশ’ প্রকাশিত হয় সংযোগ প্রকাশনী থেকে। এসময় কবিতা ও গানের পাশাপাশি লিখেছেন একাধিক গল্প, কাব্যনাট্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’ ও একটি চলচ্চিত্র কাহিনী।
১৯৯১ : ‘বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ’-এর প্রকাশনা সচিব নির্বাচিত হন।
০৬ মে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শিল্পী তালিকায় গীতিকার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে স্মরণকালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে (২৯ এপ্রিল) দুর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ সংগীত পরিষদের ‘মানুষের জন্য মানুষ ‘ সংকলনটি সম্পাদনা করেন। ১৮ মে এটি প্রকাশিত হয়।
১০ জুন পাকস্থলিতে আলসারজনিত অসুস্থতায় ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন। খানিকটা সুস্থ হয়ে ২০ জুন বাসায় ফেরেন।
২১ জুন, শুক্রবার (০৭ আষাঢ় ১৩৯৮) সকাল সাড়ে সাতটায় দাঁত ব্রাশ করার সময়ে Sudden cardiac Arrest-এ আক্রান্ত হন। এর ১০/১৫ মিনিট পর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, ঢাকার ৫৮/এফ পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।