রুণু

রুণু

লালটু বৈরাগী ছিল জমিদারের মাহুত। বেশি বয়স নয় তার। বাইশ—তেইশ হবে, আর যে হাতিটায় সে মাহুত হয়ে চাপত সেটা ছিল বিশাল আকারের। রাস্তা দিয়ে যখন চলত মনে হত একটা পাহাড় হেঁটে যাচ্ছে।

বারবাড়ির মাঠে আমরা খেলতাম, খেলুড়িদের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু ছিল রুণু নামের একটা ছেলে, তার মতো বাঁদর ছেলে কমই হয়। ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়াগুলিকে গাড়োয়ানরা ওই মাঠে ছেড়ে দিয়ে যেত ঘাস খাওয়ার জন্য। রুণু নারকেলের দড়ি দিয়ে লাগাম বানিয়ে সেই ঘোড়াগুলোর পিঠে চড়ে উত্যক্ত করে মারত। তার পকেটে সবসময়ে থাকত গুলতি। কাকে যে টিপ করবে তার ঠিক নেই, ফকেরুদ্দিনকে এমন গুলতি মেরেছিল যে দম বন্ধ হয়ে সে চোখ উলটে ফেলেছিল। যার ওপর রাগ হত তাকে বিচুটি গাছ তুলে এনে তাড়া করত। স্কুলের ক্লাসে, পাড়ায় এবং বেপাড়ায় মারপিট লেগেই থাকত তার। প্রতিদিন তার শরীরে নতুন নতুন কাটা বা ফোলা বা কালশিটের দেখা পাওয়া যেত। যেমন মারত তেমনি মার খেতও প্রচুর।

সেই রুণু একদিন দৌড়ে গিয়ে জমিদারের হাতির সামনে দাঁড়িয়ে গেল। লালটু রাগ করে বলল, তোর আক্কেল নেই! হাতির পায়ের তলায় গেলে কী হত জানিস?

তা তুমি আছ কী করতে? হাতি সামলাতে পারো না?

না পারলে এতক্ষণে কী হত জানিস?

খুব জানি। একটু হাতিতে চড়াও না লালটুদা।

সে উপায় নেই। এখন যাচ্ছি হাতি চান করাতে, দেরি হয়ে গেলে মুশকিল।

একটু চড়াও না লালটুদাদা, ও লালটুদাদা গো, পায়ে পড়ি।

উরেব্বাস রে! বামুনের ছেলে হয়ে ওকথা বলতে আছে?

আমার যে পাপ হবে রে! আচ্ছা, হাতিতে বসাচ্ছি, সাবধানে চড়বি।

হাওদা নেই, বস্তা—টস্তা বাঁধা নেই, হাতির খোলা পিঠে চড়া কিন্তু ভারি শক্ত ব্যাপার, কারণ হাতির বেজায় চওড়া পিঠে দু—ধারে পা ঝুলিয়ে বসবার উপায় নেই, হাওদা না থাকায় ধরার মতোও কিছু থাকে না বলে সবসময়েই পড়ে যাওয়ার ভয়, কারণ হাতি চলে হেলে—দুলে, আর একটা অসুবিধে হল হাতির গায়ের লোম, যেগুলো ছুঁচের মতো গায়ে বেঁধে।

কিন্তু হাতি চড়ার আনন্দে ওসব অসুবিধে আর কী গায়ে মাখে। হাতি বসতেই হইচই করে ছেলেপুলেরা হাঁচড়ে—মাচড়ে উঠে পড়ল তার পিঠে, হাতি উঠে দাঁড়ানোর সময় সে যেন ভূমিকম্পের অবস্থা, সওয়ারিরা পড়ে যায় আর কী, উপুড় হয়ে হাতির লোম খামচে ধরে কোনোরকমে সামাল দেওয়া।

হেলেদুলে যখন হাতি চলছে তখন মনে হচ্ছে আমাদের চারদিকটাই দোল খাচ্ছে, সে এক আশ্চর্য অনুভূতি।

পড়া পারত না বলে স্কুলে প্রথম পিরিয়ড থেকেই রুণুকে নানারকম শাস্তি পেতে দেখতুম, হয় বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, নয়তো ক্লাসের বাইরে নীলডাউন, আর নাহলে নানুবাবুর ক্লাসে হাত পেতে বেত খাচ্ছে। কিন্তু ওসব ছিল তার গা—সওয়া। একবার ক্লাসে মারপিট করায় মনিটর তার নাম লিখেছিল লিস্টিতে। প্রাণেশবাবু ক্লাসে এসেই তার চুল ধরে মাথাটা নামিয়ে পিঠে বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় মারলেন। সেই শব্দে ক্লাস কেঁপে উঠল। রুণু নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে কানে আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে বলল, মেরে ভালোই করলেন স্যার। সকালে নদীতে চান করতে গিয়ে কানে জল ঢুকে গিয়েছিল, থাপ্পড়ের চোটে সেটা বেরিয়ে গেছে, আর যাবে কোথায়, এই কথা শুনে প্রাণেশবাবুর সে কী মার রুণুকে!

হ্যাঁ, ওই সাঁতার, স্কুলে যাওয়ার অনেক আগেই রুণু গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে নেমে পড়ত। জলের নেশা ছিল তার, অন্তত দু—ঘণ্টা ধরে সে সাঁতরাত। ডুবত, উঠত, চিৎসাঁতার, ডুবসাঁতার সবকিছুতেই ওস্তাদ ছিল সে, অতক্ষণ জলে থাকায় গা সাদা হয়ে যেত তার। তারপর দাদু বা দাদা কেউ এসে তাকে হাত ধরে টেনে তুলে বাড়ি নিয়ে যেত।

তাকে যিনি পড়াতে আসতেন সেই নীতিন মাস্টারমশাই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বলতেন, তোমার মাথা তো খারাপ নয়, তবে পরীক্ষায় কম নম্বর পাও কেন?

আমার বেশি লিখতে ভালো লাগে না।

বেশি লেখার তো দরকার নেই, কারেকট লিখলেই হল।

আমার ভালো ছেলে হতে ইচ্ছে করে না।

কী মুশকিল! তুমি কি ইচ্ছে করে ভুল লিখে দিয়ে আসো?

রুণু চুপ।

নিরীহ নীতিনবাবু বলেন, আমার কাছে যখন পড়া দিচ্ছ তখন ভুল হচ্ছে না, কিন্তু ইস্কুলে গেলেই ভুল! এরকম তো হওয়ার কথা নয়।

মা সব শুনে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, তুই এমন কেন করিস বাবা? তোকে লোকে ভুল বুঝলে যে আমার বড়ো কষ্ট হয়।

রুণু মাকে জড়িয়ে ধরে গায়ে মুখ গুঁজে বলে, আমি তো খারাপ ছেলে মা!

শোনো কথা! কে তোকে খারাপ বলে রে? দুষ্টু? সে তো অনেকেই ছেলেবেলায় দুষ্টু থাকে। দুষ্টু তো বুদ্ধিমানের লক্ষণ।

সেবারে রুণু পরীক্ষায় ফার্স্ট হল না বটে, কিন্তু সেকেন্ড হল। স্কুলের সবাই অবাক, যে ছেলে সারা বছর পড়া পারে না, সে কী করে এক ঝটকায় এত নম্বর তুলে ফেলল!

নাগমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই টুকেছে।

হেডস্যার এমদাদ আলি বিশ্বাস রাশভারি মানুষ। মাথা নেড়ে বললেন, টুকলে পাশ নম্বর হয়তো ওঠে, কিন্তু স্ট্যান্ড করা যায় না। কারণ টোকা দেখে কপি করতে অনেক সময় লাগে, টুকলিবাজরা কখনো ফার্স্ট—সেকেন্ড হয় না।

রুণুর একটু গুণও ছিল। সে কখনো কোনো ফড়িং—এর ডানা ছিঁড়ে দেয়নি, পাখি বা কুকুরকে ঢিল মারেনি, কানা—খোঁড়া কাউকে কখনো খ্যাপায়নি, সে কুকুর পোষে, তার একটা ডানা—কাটা বুলবুলি পাখি আছে। পাখিটাকে কেউ ডানা কেটে ছেড়ে দিয়েছিল, উড়তে পারছিল না। তাকে যত্ন করে সে খাঁচায় রেখেছে। আকাশের দিকে তাকালে তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে জেনেছে আকাশের নীল ছাদটা আসলে কোনো ছাদ নয়, আসলে আকাশের কোনো সীমানা নেই। এতবড়ো এত বিশাল যে ভাবতে গেলেই তার মাথা ঝিমঝিম করে, মনে হয়, বিশ্বজগৎটা একটু ছোটো হলে বড়ো ভালো হত। কেন যে হল না!

নদী আর দাদু, রুণুর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি হল দাদু। দাদুর কাছে রোজ রুণুর নামে কত নালিশ জমা হত। কার আম, কার জাম, কার লিচু বা পেয়ারা পেড়ে এনেছে। কার টিনের চালে ঢিল মেরেছে, কার ছেলেকে ঘুঁষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়ে এসেছে, দাদু গম্ভীর হয়ে শোনেন আর বলেন ‘হুঁ’। ওই ‘হুঁ—তেই সব শাসন থেমে থাকে। সেই আততায়ী নাতিকে নিয়েই দুপুরে এক পাতে খেতে বসেন তিনি। পরম স্নেহে নিজে হাত গুটিয়ে নাতিকে ইচ্ছেমতো পাত লণ্ডভণ্ড করতে দেন।

আর বহমান ওই নদী। নদীর কোনো নীরবতা নেই। চির প্রগলভ নদীর ভাষা বুঝবার কত চেষ্টা করেছে সে, পারেনি। কিন্তু তবু কখনো—সখনো খেলা ফেলে, দুষ্টুমি ভুলে, খিদে চেপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উদাস হয়ে বসে থেকেছে নদীর ধারে। যদি নদীর কথা বোঝা যায়। কত দূর থেকে কত গল্প বয়ে আনে নদী, কত শহরের প্রতিবিম্ব তার বুকে লুকিয়ে থাকে, কত মানুষের স্পর্শ।

জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে রেলগাড়িতে চেপে একবার কোথাও যাচ্ছে রুণু। তখন ছোটো, তার মন ভালো করার জন্য জ্যাঠামশাই একটা রসগোল্লা কিনে দিয়েছেন তার হাতে। রসগোল্লার মতো কিছুই হয় না। পেটুক রুণু হাঁ করে সবে কামড় বসাতে যাবে, ঠিক সেইসময়ে আকাশ থেকে লটপট করতে করতে একটা মস্ত চিল এক ঝটকা মেরে রসগোল্লাটা কেড়ে নিয়ে গেল। আর তার ধারালো নখের আঁচড়ে ডান হাতের একটা আঙুল কেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল। জ্যাঠামশাই অপ্রস্তুত, রুমাল বেঁধে হাতের রক্ত সামাল দিচ্ছেন।

রুণু কাঁদেনি, খুব অবাক হয়েছিল। চিলের দুষ্টুমির কথা সে জানে, আগেও কতবার দোকান থেকে কচুরি বা জিলিপি আনার সময় চ্যাঙারি কেড়ে নিয়ে গেছে। নতুন তো নয়, কিন্তু এই যে রসগোল্লাটা হাতে এই ছিল— এই নেই হয়ে গেল। এই বিস্ময়টাই তার যেতে চায় না। ডান হাতের সেই হঠাৎ শূন্যতা সে অনেকদিন ধরে টের পেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *