রিরংসার জাল – দ্বৈপায়ন
ঘুমের ঘোরেই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন শামসুদ্দীন আহমদ শাহ। ঘুমটা ভেঙে যেতে অনেকক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলেন। নিজেকে দুর্বল মনে হল তাঁর। শীতের রাত্রে ঘামে শরীর ভিজে গেছে। স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
বিস্ফারিত দুই চোখ। কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে জমাট বেঁধে গেছে। নীল রঙের ক’টা মাছি উড়ছে। অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত নারীদেহটা হিমশীতল। দেখতে-দেখতে ক’টা মাছি তাঁর দিকে উড়ে এল। তবে কি…চিৎকার করে উঠলেন।
মৃদু কণ্ঠস্বর কানে এল তাঁর। শান্ত অথচ দৃঢ়।—ধর্ম আপনাকে মুসলমান করেছে, কিন্তু রাজা গণেশের রক্তধারা কি মুছে ফেলতে পেরেছেন দেহ থেকে?
—কে তুমি?—চিৎকার করে উঠেছিলেন রাজা গণেশের বংশধর জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহের পুত্র শামসুদ্দীন আহমদ শাহ।
—জাঁহাপনা।—খোজা রহিমের কণ্ঠস্বর।
—কে?—চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন শামসুদ্দীন।
—আমি রহিম, জাঁহা-পনা।
শয্যার ওপর উঠে বসলেন শামসুদ্দীন। সেজ-বাতির আলোয় কক্ষ আলোকিত। রহিমকে দেখলেন। বললেন, রহিম, কাফের জানানাটাকে কে খতম করেছে বলতে পারিস?
—গুনাহ যদি না নেন, বলতে পারি।—একটু চিন্তা করে বলল খোজা রহিম।
—কে?—খোজাটার দিকে চাইলেন শামসুদ্দীন।
—আপনি, জাঁহাপনা।
—রহিম!—চিৎকার করে উঠলেন শামসুদ্দীন।
—চিৎকার করবেন না, জাঁহাপনা। কোতল করার ভয় দেখাবেন না। খোজা আর মুর্দায় কোনও ফারাক নেই। নিয়ে যান, বাইরে পাহারা দিচ্ছি আমি।
খোজা রহিম চলে গেল। সাদী খান আওরতটাকে এনেছিল। তাঁরই গোলাম। হিন্দু আওরত। খুবসুরত। যৌবনের ঢল দেহের কানায়-কানায়। কিন্তু হিন্দু রক্তটা গোলমাল করে দিল। ছেড়ে দিলেন। ভুল করলেন। দেহটাকে ছিঁড়ে খেয়ে খতম করে গেছে কোনও কুত্তার দল।
—জানানাটাকে ভোগ করেছ তুমিই প্রথম। আমি খতম করেছি। কাফেরটাকে শেষ করতে হবে তোমাকেই।
—তুমি কী করবে? দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে?—সাদী খানের কণ্ঠস্বরটা অন্ধকারে ফিসফিসিয়ে উঠল।
—মসনদের ভাবী সুলতান তুমি।—বলল নাসির খান।—আমি তোমার গোলাম।
—গোলাম আমরা নবাবের। খোজাটাকে খতম করতে হবে আগে।
—কী করে তা সম্ভব?
—অসম্ভব সম্ভব হবে। আজ শেষ রাতেই একটা বাঁদি শেষ হবে আমার হাতে। তুমি হারেমে ঢুকবে তার পোশাক পরে। কাল শেষ হবে একটা খোজা। তারপর…।
—যদি ধরা পড়ি?—কেঁপে উঠল নাসির খানের কণ্ঠস্বর।
—ভয় নেই। বেগম সহায়।
কিছু বলতে যাচ্ছিল নাসির খান, বলা হল না। বাইরে লঘু পদশব্দ। আত্মগোপন করল নাসির খান। ভাগীরথীর তীরের জীর্ণ পরিত্যক্ত গৃহের দরজায় আওয়াজ উঠল। সঙ্কেতধ্বনি শেষে দরজা খুলে দিল সাদী খান।
—বেগমসাহেবা আমাকে পাঠিয়েছেন।—বলল নারী কণ্ঠস্বর।
—এসো।—হাত ধরল সাদী খান। আকর্ষণ করল নিজের দিকে।
—বড় অন্ধকার, বাতি জ্বালান।—কেঁপে উঠল কণ্ঠস্বর।
—হুকুম নেই। তোমার উমর কত?
—বেগমসাহেবা বলেছেন—আঃ।—একটু ছটফটিয়ে উঠল নারীদেহটা।
—তুমি কী সুন্দরী! উমর কত তোমার?
—আঠারা সাল…আঃ, এ কী করছেন, বেগমসাহেবা বলে…না-না ছিঃ।—বাধা দিতে চাইল বাঁদিটা।
—কেন, ভয় কী…! কোনও মরদ কি কোনওদিন তোমাকে…আমি জানি, দু-মাস আগে জাঁহাপনার কাছে একরাত ছিলে তুমি। বাঃ! সুন্দর!—পুরুষকণ্ঠ গাঢ় শোনাল, তোমাকে দেখা না গেলেও বুঝতে পারছি তুমি সুন্দরী।
—কিন্তু বেগমসাহেবা…না, শুনুন…আমার পোশাক সব…।
—ভয় নেই, পাবে। আমি নিজের হাতে তোমায় পোশাক পরিয়ে দেব।
—কাফের মেয়েটাকে কে খুন করেছে বলতে পারেন? আঃ…।
—থাক, ও-কথা থাক এখন। বেগমসাহেবার চেয়েও তোমার দেহটা খাসা। তোমাকে আমি…।
একদিনে দুটো নারীর মৃতদেহ। কাফের মেয়েটাকে চেনা গিয়েছিল। দ্বিতীয়টার মুখটা ক্ষত-বিক্ষত। চেনার কোনও উপায় নেই। দ্বিতীয় রাতশেষে নারী নয়, একটা পুরুষের দেহ। এবার শুধু মুখ নয়, সমস্ত দেহটা একটা মাংসপিণ্ড। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়েছে প্রাসাদ ঘিরে। শীতের সন্ধ্যা। ধোঁয়ার মতো কুয়াশা নেমেছে আশমানের গা বেয়ে। পাইকের দল সদা সতর্ক। শুরু হয়েছে রাতের পাহারা।
জানানা মহলের প্রবেশদ্বারে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন শামসুদ্দীন আহমদ শাহ। একটা ধূসর রঙের বিল্লি তীরগতিতে ছুটে এল ভেতর থেকে। শিউরে উঠলেন তিনি। একটু দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা করলেন। ফিরে চললেন আবার।
একটা আর্তনাদ ভেসে এল বাতাসে। নারীকণ্ঠ। শামসুদ্দীনের পাগলি ধাই। না, আজ আর জানানা মহলে যাবেন না। বেগমরা আজও প্রতীক্ষায় থাক। প্রধানা বেগম, যাকে তাঁর পাইকের দল লুঠে এনেছিল একদিন, খবর যদি মিথ্যা না হয়—সাদী খানের সঙ্গে একদিন আশনাই ছিল তার। কী যেন নামটা? মনে করতে পারলেন না। একটু শরাব চাই।
—কে?—চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
—আমি রহমান।
—কী করছিস এখানে তুই?
—একটা বাঁদি জাঁহাপনার খোঁজে গিয়েছিল। তাকে খুঁজছিলাম।
—কেন, বাঁদিকে খুঁজছিলি কেন?
—আমাকে সে জড়িয়ে ধরেছিল। ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠতেই পালিয়ে গেল কোথায়। খুঁজে হয়রান হচ্ছি।
খোজা রহমানের কথা শুনে গম্ভীর হতে গিয়েও পারলেন না শামসুদ্দীন। হেসে উঠলেন হো-হো করে। শুনতে পেলেন না রহমানের শেষ কথাগুলো, লেকিন জাঁহাপনা, বড় শক্ত তার দেহটা।
শরাবের নেশায় রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল। ভোরে পাখির ডাক শুনতে পাননি সুলতান শামসুদ্দীন আহমদ। সূর্যের আলো চোখে পড়তে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। স্বপ্ন দেখছিলেন। মনটা তাজা। মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন, রহমান!
সাড়া নেই। ছুটে এল না কেউ। প্রৌঢ় মানুষটা তাঁর বড় সহায়। খোজার ভালোবাসা তাঁর প্রতি। তীক্ষ্ন বুদ্ধি, সামলে দেয়। আবার ডাকলেন, রহমান!
কেউ সাড়া দিল না। বিস্মিত হলেন। উঠলেন। দুরন্ত ভয়ে শিউরে উঠল তাঁর সব দেহ। একটা ছোট পাহাড়ের মতো খোজা রহমানের বিশাল দেহটা কক্ষের দ্বারপথ জুড়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে গেছে চারিদিক। মৃতের একহাতে তরবারি, অন্য হাতের শক্ত মুঠিতে ধরা একটা ওড়নার কিছুটা অংশ।
—সাচ বলছি, আমি তোমাকে পেয়ার করি।—প্রধানা বেগমের ব্যাকুল কণ্ঠস্বর। আয়ত দুই সুন্দর আঁখি ছলছল : আমি সাচ বলছি তোমাকে।
—কেন আমাকে পেয়ার করবে?—সাবধানী শামসুদ্দীন : আমি তোমাকে লুঠ করে এনেছি।
মৃদু হাসি ফুটে উঠল সুন্দর ওষ্ঠে। ঘন হল নবাবের বুকের কাছে। অস্ফুট স্বরে বলল, তাতে কী!
—বটে!—বেগমের মুখটা তুলে ধরলেন শামসুদ্দীন। তাজা জওয়ানি-ভরা দেহ। তিন সালের নবাবি। বেগম এসেছে সাল পুরা হয়নি। দেখতে-দেখতে নেশা লাগল চোখে। নিশ্বাস ঘন হল। বুঝল বেগম। ঠোঁটে মোহিনী হাসি। একটানে খুলে ফেলল বুকের কাঁচুলি। শঙ্খধবল দু-হাতে বুক ঢাকল বেগম। যেন বাধা দিতে চায়। বাধা মানল না দুরন্ত পুরুষ। দেখতে-দেখতে যুবতী-দেহটা বসনমুক্ত। ঝড়ের তাণ্ডবে প্রকৃতি থরথর।
রাত বাড়ছে বাইরে। পরিশ্রান্ত নবাব। ঘুম-ঘুম। ঘুমের ঢল নামছে দু-চোখ জুড়ে। সেজবাতির শিখা কাঁপছে থরথর।
রাত্রি গভীর। বাইরে মৃদু পদশব্দ। কে যেন এগিয়ে আসছে। নিভে গেল বাতিটা।
—কে-কে?—চিৎকার করে উঠলেন শামসুদ্দীন। পাশে রাখা তলোয়ারটা টেনে নিলেন মুহূর্তে।
—আমি, আমি।—ঝাঁপিয়ে পড়ল বেগম।
—তুমি?—কণ্ঠে বিস্ময় নবাবের।
—আলোটা জ্বেলে দিতে উঠেছিলাম।
—লেকিন…।—স্খলিত কণ্ঠস্বর নবাবের।
—কোনও ভয় নেই, তুমি ঘুমোও। আমি জেগে আছি।—শামসুদ্দীনের দেহটাকে নিজের নগ্ন বুকে পাকে-পাকে জড়িয়ে নিল বেগম। খোজা রহমানের বিশাল দেহটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। আজানের ধ্বনি ভেসে এল দূরের মসজিদ থেকে।
কে যেন পাশে রাখা তলোয়ারটা টেনে নিল। ঘুমের মধ্যেই চোখ মেললেন শামসুদ্দীন। একটা বাঁদির মুখ। নিভে গেল ঘরের বাতি।
—কে?—ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল বেগম।
ধপ করে একটা আওয়াজ হল। একটু আর্তনাদ। উষ্ণ স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল শামসুদ্দীনের। হাত রাখলেন বেগমের গায়ে। দেহটা চটচট করছে। মুখটা…মুখটা কোথায় গেল!
আলো জ্বলে উঠল। একটা হিংস্র মুখ। ভয়ঙ্কর। সাদী খান! ঝলসে উঠল একখানা তলোয়ার। পাগলি ধাই কোথাও হাসছে। একটু যন্ত্রণাবোধ। আঃ, না…স্থির হয়ে গেল শামসুদ্দীন আহমদ শাহের দেহটা।
—দোস্ত!—মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেল মৃত্যুপুরীতে।
—বলো!
—জানানাটাকে…।
বিকৃত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যা দেখছ এর পরেও…।
দেখল নাসির খান। শিউরে উঠল। বন্ধ করল দুই চোখ। নগ্ন দেহ দুটো বীভৎস-ভয়ঙ্কর।
রাজা গণেশের শেষ বংশধর। গণেশ, মহেন্দ্রদেব, জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (যদু), শামসুদ্দীন আহমদ শাহ। দুই ক্রীতদাস সাদী খান আর নাসির খান। শামসুদ্দীনকে হত্যা করে শেষ করে দিল রাজা গণেশের বংশের রাজত্ব (৮৪০ হিজরি)।
পরবর্তী নবাব নাসির খান—নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ। সাদী খানকে হত্যা করে নতুন সুলতান হয়ে বসল বাংলার মসনদে। শামসুদ্দীনের সমাধি আজও রয়েছে পাণ্ডুয়ার একলাখী প্রাসাদে। সমাধির গঠন শহিদের সমাধির অনুরূপ।
মাসিক ক্রিমিনাল
জুন, ১৯৭৬