সতেরই শ্রাবণ।
আজ আমার জন্মদিন। জীবনের পঁচিশটা বছর কাটিয়ে ছাব্বিশ বছরে পা দিলুম। শতাব্দীর সিকি ভাগ কেটে গেল। কী পেলুম? কী দিলুম?
বাইরে ঘনঘোর বষা নেমেছে। ঝরঝর ঝমঝম একটানা বৃষ্টি। রাত্রি এখন দশটা, এরই মধ্যে কলকাতা শহর নিঝুম হয়ে পড়েছে। রাস্তায় লোক নেই, গাড়ি চলাচল নেই, কেবল রাস্তার ধারের আলোগুলো নিজের নিজের মাথার চারপাশে জ্যোতির্মণ্ডল রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার জন্মদিনে প্রতি বছর বৃষ্টি হয়। ভরা শ্রাবণ মাসে যার জন্ম তার জন্মদিনে বৃষ্টি হলে আশ্চর্য কিছু নেই। কিন্তু আমার জীবনে এমন একটা জন্মদিন আসেনি যেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়েনি। বাবা বলতেন, আমি যেদিন জন্মেছিলুম সেদিনও নাকি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়েছিল। মা আমার নাম দিয়েছিলেনবাদল। যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাকে বাদল বলেই ডাকতেন। আমার মা! তিনি আজ কোথায়! আর আমার বাবা—তিনিও চলে গেছেন। আমাকে আর বাদল বলে ডাকবার কেউ নেই। এখন আমি মিস্ প্রিয়ংবদা ভৌমিক।
কিন্তু পঁচিশ বছর বয়সে প্রিয়ংবদা ভৌমিক ডায়েরি লিখতে আরম্ভ করেছে কেন? যাঁরা জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন, অনেক দেখেছেন, অনেক আজ করেছেন, তাঁরা নিজের জীবনচরিত বা ডায়েরি লিখলে শোভা পায়। কিন্তু প্রিয়ংবদা ভৌমিক সামান্য একজন নার্স, সে ডায়েরি লেখে কোন্ স্পর্ধায়? কী আছে তার জীবনে? রোগীর শুশ্রুষা করা তার জীবিকা; রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো, টেম্পারেচার নেওয়া, রাত জেগে পাহারা দেওয়া, এই তার কাজ। তবে সে ডায়েরি লেখে কেন?
এর উত্তর খুব জোরালো নয়, তবু একটা উত্তর আছে। আমি কাজের সময় মন দিয়ে কাজ করি, মনটা কাজেই লিপ্ত থাকে। কিন্তু কাজ যখন থাকে না তখন মনটাকে নিয়ে কী করব ভেবে পাই না। আমার বন্ধু শুক্লাও আমার মত নার্স; আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকি। কিন্তু দুজনে একসঙ্গে ছুটি পাওয়া ঘটে ওঠে না। তাছাড়া তার—তার মনের যাহোক একটা আশ্রয় আছে; আমার কিছুই নেই। দৈবাৎ যখন দুজনে একত্র হতে পারি তখন খুব গল্প করি। কিন্তু সে কতটুকু? বেশীর ভাগ সময় মনটা খালি পড়ে থাকে। তাই ঠিক করেছি ডায়েরি লিখব। নাই বা পড়ল কেউ; আমি নিজের মনের সঙ্গে কথা বলব। তবু তো একটা কিছু করা হবে।
ডায়েরির আরম্ভে নিজের জীবনের গোড়ার কথাগুলো লিখে রাখি। আমি কে সেটাও তো নিজেকে জানিয়ে রাখা দরকার।
জন্মেছিলুম পূর্ববঙ্গে; জীবনের প্রথম যোলটা বছর সেখানেই কেটেছে। বাবা ছিলেন কবিরাজ, খুব পসার ছিল। মা মারা যান যখন আমার বয়স পাঁচ বছর। বাবা আর বিয়ে করেননি। আমি তাঁর একমাত্র সন্তান; বাবা আমাকে নিজের হাতে মানুষ করেছিলেন। লেখাপড়াও শিখিয়েছিলেন। যোল বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেছিলুম।
ম্যাট্রিক পাস করবার কিছুদিন পরে হঠাৎ আমরা কলকাতায় চলে এলুম। তখনও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি আরম্ভ হয়নি। কিন্তু বাবা বুঝতে পেরেছিলেন প্রচণ্ড দুর্যোগ আসছে। তিনি বাড়ি-ঘর বিক্রি করে সঞ্চিত টাকাকড়ি নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। তার কয়েকমাস পরেই দুরন্ত কালবোশেখী ঝড়ের মত মহাদুযোগ এসে পড়ল; দেশ দুভাগ হবার সুত্রপাত হল। সেই সময় এই কলকাতার রাস্তাঘাটে যে বর্বরতা দেখেছি তা ভোলবার নয়।
বাবা এখানে এসে আবার কবিরাজী ব্যবসা খুলে বসেছিলেন, কিন্তু আর পসার হল না। পুঁজি ভেঙে সংসার চলতে লাগল। বাবা ভারি বিচক্ষণ ছিলেন, দূরদর্শী ছিলেন, তিনি আমাকে কলেজে ভর্তি করলেন না, বিয়ের চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি ভেবেছিলেন, পুঁজি ফুরোবার আগে যদি আমার একটা সদগতি করতে পারেন তাহলে তাঁর একলার জীবন কোনওরকমে কেটে যাবে।
যোগ্য ঘরবর কিন্তু জুটল না আমি সুন্দরী না হতে পারি, কিন্তু একেবারে স্যাওড়াগাছের পেত্নীও নই। রঙ ফরসা, মুখ চোখ গড়ন কোনওটাই নিন্দের নয়। তাছাড়া বাবা টাকা খরচ করতে রাজী ছিলেন। তবু আমাকে বিয়ে করতে কেউ এগিয়ে এল না। তার কারণ, আমার একটা মারাত্মক দোষ ছিল; আমি পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা মেয়ে। তখনকার দিনে পূর্ববঙ্গ থেকে যে-মেয়ে পালিয়ে এসেছে তার দৈহিক শুচিতা সম্বন্ধে সকলের মনেই সন্দেহ। আমি যে দাঙ্গা আরম্ভ হবার আগেই পালিয়ে এসেছিলাম, একথায় কোনও বরকতাই কান দিলেন না।
কলকাতায় আসার পর বাবার শরীর আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করেছিল। ছিলেন রোজগেরে মানুষ, এখানে এসে রোজগার নেই। তার ওপর আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। কলকাতার জলহাওয়াও তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। মাঝে মাঝে অসুখে পড়েন, আমি সেবা-শুশ্রুষা করি। তিনি সেরে ওঠেন, আবার কিছুদিন পরে অসুখে পড়েন। এইভাবে বস্ত্র দেড়েক কেটে গেল।
একদিন বাবা অম্বলের ব্যথা নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আমি পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলুম। তিনি একবার বালিশ থেকে মাথা তুলে আমার পানে তাকালেন, আস্তে আস্তে বললেন, তুই বেশ সেবা করতে পারিস। নার্সের কাজ শিখবি? এই বলে যেন একটু লজ্জিতভাবে আবার বালিশে মাথা রাখলেন।
বুঝতে পারলুম, রোগের মধ্যেও তিনি আমার কথাই ভাবছেন। হয়তো রোগের মধ্যে নিজের মৃত্যু-চিন্তা মনে এসেছে; ভাবছেন তিনি যদি হঠাৎ মারা যান তখন আমার কী গতি হবে। তাঁর মেয়ে নার্স হবে এ চিন্তা তাঁর কাছে সুখের নয়। কিন্তু উপায় কী? ভাল ঘরেবরে যখন বিয়ে দিতে পারলেন না তখন একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে তো, যাতে আমি ভদ্রভাবে জীবন কাটাতে পারি।
তাঁর প্রশ্নে আমার চোখে জল এল। কান্না চেপে বললুম, হ্যাঁ বাবা, শিখব। সেবা করতে আমার খুব ভাল লাগে।
বাবা নিশ্বাস ফেলে বললেন, সেই ভাল। সেরে উঠি, তারপর চেষ্টা করব। একটু থেমে আবার বললেন, নার্সের কাজ খুব ভাল কাজ। মানুষের সেবা, রুগ্ন মানুষের সেবা; এর তুল্য কাজ আছে! কিন্তু তাঁর কথায় খুব জোর পৌঁছল না।
মাসখানেক পরে পোবেশনার নার্স হয়ে নার্সদের কোয়ার্টারে উঠে এলুম। তিন বছরের কোর্স, তিন বছর পরে পাকা নার্স হয়ে বেরুব। নার্সদের হস্টেলে একটি ঘর পেলুম। আমাদের ওপর নিয়মের খুব কড়াকড়ি, সব কাজ কাঁটা ধরে হয়। কাজের সময় ছাড়া নার্সরা ছাত্রদের সঙ্গে মিশতে পারে না। হপ্তায় এক বেলা ছুটি। আমি ছুটির এক বেলা বাড়ি যেতুম, বাবার কাছে তিন-চার ঘণ্টা থেকে আবার হস্টেলে ফিরে আসতুম।
হস্টেলে শুক্লার সঙ্গে ভাব হল। সে আমার চেয়ে এক বছরের সীনিয়র। দেখতে এমন কিছু সুন্দর নয়, কিন্তু মুখখানি ভারি মিষ্টি আর মমতা-ভরা। এত মমতা নিয়েও জন্মেছিল পোড়ারমুখী, নিজের জীবনটা ভাসিয়ে দিলে।
হস্টেলে অনেক গোবেশনার মেয়ে ছিল, একজন টিউটর সিস্টার ছিলেন। আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে দাঁড়াল শুক্লা। লিখতে লজ্জা করে, কিন্তু এমন সময় এল যখন আমার মনে শুক্লা আমার বাবার চেয়েও বেশী জায়গা জুড়ে বসল। কেন এমন হয় কে জানে! হয়তো যৌবনে মানুষ চায় সমবয়সী মানুষের সঙ্গ। বুড়োরাও কি তাই চায়?
কী জানি! বাবাকে লক্ষ্য করেছি তাঁর কোনও সমবয়স্ক বন্ধু ছিল না; দু-চারজন পরিচিত লোক ছিল। সারা হপ্তা তিনি আমার পথ চেয়ে থাকতেন; যেন আমার জন্যই বেঁচে ছিলেন। তাঁর ভালবাসার কথা যখন ভাবি, নিজেকে বড় অকৃতজ্ঞ আর হৃদয়হীন মনে হয়। তাঁর স্নেহের কী প্রতিদান দিয়েছি আমি?
দিন কাটছে। হস্টেলে থাকি, ক্লাসে লেকচার শুনি, হাসপাতালে কাজ শিখি। রাত্তিরে যখন হস্টেলের আলো নিভে যায় তখন শুক্লা চুপিচুপি আমার ঘরে আসে, নয়তো আমি শুক্লার ঘরে যাই। দুজনে মুখোমুখি বিছানায় শুয়ে ফিসফিস করে গল্প করি। কি মাথামুণ্ডু গল্প করি তা জানি না। কোনও দিন গল্প করতে করতে রাত বারোটা বেজে যায়।
হাসপাতালে যখন কাজ করতে যাই, অনেক ছাত্র এবং ডাক্তারের সঙ্গে কাজ করতে হয়। তাছাড়া রোগী তো আছেই। রোগীরা বেশীর ভাগ গরিব বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। কী অবস্থায় পড়ে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাই ভেবে আমার বড় কষ্ট হত। ডাক্তারেরা বেশীর ভাগই তাড়াহুড়ো করে রোগী দেখে চলে যেতেন। ছাত্রেরা বেশ মন দিয়ে দেখত; কিন্তু তাদেরও ছিল নির্লিপ্ত ভাব। তারা যেন রোগটাকেই দেখত, রোগীকে দেখত না।
ছাত্রেরা ইউনিফর্ম-পরা নার্সদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে, কিন্তু নার্সদের যেন মানুষ বলে লক্ষ্য করে না। আমরা যেন কলের পুতুল। দুএকজন লক্ষ্য করে। তাদের চোখ ভোমরার মত এক নার্সের মুখ থেকে আর-এক নার্সের মুখে ঘুরে বেড়ায়, মধুর সন্ধান করে। এরা যেন কলার ব্যাপারী, রথের মেলায় কলা বেচতে এসেছে। রথ দেখা কলা বেচা দুই কাজ একসঙ্গে করে।
একটি ছাত্র ছিল, তার নাম মন্মথ কর। পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, শুনেছিম ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। লম্বা মানানসই গড়নের চেহারা, চটপটে স্বভাব; অন্য ছেলের যে কথা বুঝতে দশ মিনিট সময় লাগত, সে তা এক মিনিটে বুঝে নিত। তার চোখের দৃষ্টি ছিল আশ্চর্য রকমের উজ্জ্বল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সে একটু হাসত।
আমার তখন যে বয়স সেবয়সের মেয়েরা মনে মনে কল্পনার জাল বুনতে আরম্ভ করে। মন্মথ কর ভাল ছাত্র, তার চেহারা ভাল; সে আমার মত একজন প্রেবেশনার নার্সের পানে চেয়ে মুখ টিপে হাসে কেন? আমার মন আমাকে তার পানে টানতে থাকে। তার ওপর চোখ পড়লে শরীরের রক্ত চনমন করে ওঠে; চোখ তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, আবার নিজের অজান্তেই তার দিকে ফিরে যায়। কিন্তু সবই চুপি-চুপি, মনে মনে। দরকারের কথা ছাড়া ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলার হুকুম নেই; এমনকী তাদের পানে চেয়ে হাসলেও সেটা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। একবার আমাদের দলের একটি মেয়ে একজন ছাত্রের সঙ্গে হেসে কথা বলেছিল, সিস্টার নীলিমাদিদি দেখতে পেয়েছিলেন। নীলিমাদিদি ভীষণ কড়াপ্রকৃতির স্ত্রীলোক। তখন মেয়েটিকে কিছু বললেন না, কিন্তু কাজ সারা হবার পর তাকে অফিসে ডেকে নিয়ে যা বলেছিলেন তা আমরা পরে শুনেছিলুম। বলেছিলেন, ছাত্রদের মন ভোলাবার জন্যে তোমরা এখানে আসনি। ওসব বেহায়াপনা চলবে না। মনে রেখো একথা যেন দ্বিতীয়বার বলতে না হয়।
আমরা সবাই নীলিমাদিদিকে যমের মত ভয় করতুম। তাঁর কাছে বকুনি খায়নি এমন মেয়ে ছিল না। একদিন আমিও বকুনি খেলুম।
হাসি মস্করা বেহায়াপনার জন্যে নয়, কাজে ভুল করেছিলুম। দোষ আমারই। কিন্তু নীলিমাদিদি
এমন বিধিয়ে বিয়ে কথা বলেন যে, মনে হয় তার চেয়ে দু ঘা মারাও ভাল।
বকুনি খাবার পর হাসপাতালের পিছন দিকে নিরিবিলি একটা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলুম। চোখ ফেটে জল আসছিল। মন্মথ করের সামনে না বলে কি চলত না? এমন সময় পিছনে শব্দ শুনে ফিরে দেখি—মন্মথ কর। আমার কাছে এসে দাঁড়াল, চট করে একবার চারদিকে চেয়ে নিয়ে খাটো গলায় বলল, সিস্টার নীলিমাকে ধরে মার দিতে হয়।
আমিও ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকালুম। কেউ যদি দেখে ফেলে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছি, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না; নীলিমাদিদি জানতে পারবেন, আবার আমার মুণ্ডুপাত হবে।
সে তেমনি খাটো গলায় বলল, আপনাকে আমার বড় ভাল লাগে। কত নার্স তো রয়েছে, আপনি তাদের মত নয়। এই কথা বলতে বলতে তার উজ্জ্বল চোখ দুটি হেসে উঠল।
আমার মনের মধ্যে ভীষণ টানাটানি চলছে। একদিকে ইচ্ছে হচ্ছে পালিয়ে যাই, অন্যদিকে ইচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কথা শুনি।
আপনার নাম কী নার্স?
প্রিয়ংবদা—এইটুকু বলে আমি ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেলুম।
কিন্তু মনটা সারাদিন নেশায় টলমল করতে রইল। তখন জানতুম না সেটা কিসের নেশা। শরীর যখন যৌবনের ডাকে আস্তে আস্তে জেগে উঠতে থাকে তখন তার একটা নেশা থাকে, ঘুম ভাঙার নেশা। এসব তখন কিছুই জানতুম না। কীই বা জানতুম তখন! সে আজ আট-নয় বছর আগেকার কথা। কী ন্যাকা যে ছিলুম ভাবলে হাসি পায়।
তারপর থেকে যখনই ওর সঙ্গে দেখা হয়, ও মুখ টিপে হাসে, মনে হয় সে হাসিটা আরও ঘনিষ্ঠ, যেন ওর আর আমার মধ্যে একটা গোপন সম্বন্ধ হয়েছে। আড়ালে-আবডালে দেখা হয়ে গেলে চট করে দুটো কথা কয়ে নেয়—কেমন আছেন?…দুদিন দেখা পাইনি—এই ধরনের কথা।
এইভাবে দু-তিন মাস চলল। একদিন একটু বেশীক্ষণ কথা বলবার সুযোগ ঘটে গেল। দুপুরবেলা আমি দোতলার একটা ওয়ার্ডে কাজ সেরে বেরুচ্ছি, দেখি ও সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে
আছে। আমার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছে তাতে সন্দেহ নেই। একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলুম।
কাল তোত আপনার বিকেলবেলা ছুটি?
আমার গলা দিয়ে ধরা-ধরা আওয়াজ বেরুল, হ্যাঁ।
চলুন না, আমার সঙ্গে চা খাবেন।
অ্যাঁ-কোথায়?
কোন একটা সাহেবী হোটলে। আমি চারটের সময় এসে আপনাকে নিয়ে যাব।
কিন্তু—ছুটির দিনে আমি বাবাকে দেখতে যাই।
ও! আপনার বাবা বুঝি কলকাতাতেই থাকেন? তা বেশ তো। আমার সঙ্গে চা খেয়ে আপনি বাবার কাছে চলে যাবেন। ঘণ্টাখানেক দেরি যদি হয়ই তাতে ক্ষতি কী?
আমি কী উত্তর দেব ভেবে পেলুম না। এতক্ষণে আমরা সিঁড়ির নীচে পোঁছেছি। ও বলল, তাহলে ঠিক রইল। কাল চারটের সময় আমি আপনার হস্টেলের বাইরে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকব। কেমন? মুখ টিপে হেসে সে চলে গেল।
সারাদিন ওই কথাই মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল। আগে কখনও একজন পুরুষের সঙ্গে হোটেলে গিয়ে চা খাইনি। এই চা-খাওয়া অনুষ্ঠানের মধ্যে কত অজানা অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে। ভয়-ভয় করছে, আবার সেই নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ পাবার জন্যে মনটা ছটফট করছে।
রাত্তিরে আলো নিভে যাবার পর শুক্লা এল আমার ঘরে। শুক্লার কাছে আমি কোনও কথাই লুকোই না, কিন্তু কেন জানি না, এ-কথাটা তাকে বলতে পারলুম না, সঙ্কোচ হল, লজ্জা হল; এ যেন আমার একান্ত গোপনীয় কথা, কাউকে বলবার অধিকার নেই। চায়ের নেমন্তন্নের কথা মনে মনেই রাখলুম।
পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আজেবাজে গল্প হতে লাগল। নীলিমাদিদির মেজাজ আজকাল এমন হয়েছে যে কাছে যেতে ভয় করে।…হার্ট স্পেশালিস্ট ডক্টর লালমোহন সরকার কয়েক দিন হাসপাতালে আসেননি, তাঁর নিজেরই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।…তুই মেটার্নিটি শিখবি?…না ভাই, তার চেয়ে চাইল্ড নার্সিং…আজ মেটার্নিটি ওয়ার্ডে কী মজা হয়েছিল জানিস?–
হঠাৎ শুক্লা বলল, হ্যাঁরে মন্মথ কর তোর দিকে চেয়ে মুচকে হাসে কেন বল্ দেখি?
কিছুক্ষণের জন্যে কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেলুম। শেষে বললুম, তুই দেখেছিস?
শুক্লা বলল, দেখিনি আবার! আরও অনেকে হয়তো দেখেছে। কী ব্যাপার বল্।
তখন আর উপায় রইল না, শুক্লাকে বললুম। চায়ের নেমন্তন্নর কথাও শোনালুম। শুনে শুক্লা বিছানায় উঠে বসল, চাপা গলায় তর্জন করে বলল, খবরদার প্রিয়া, ওর ফাঁদে পা দিসনি। সাংঘাতিক ছোঁড়া ওটা, যাকে বলে উল—তাই।
আমি বললুম, উল! সে কাকে বলে? উল মানে তো নেকড়ে বাঘ!
শুক্লা বলল, মানুষের মধ্যেও নেকড়ে বাঘ আছে। তারা কাঁচা বয়সের মেয়েদের ধরে ধরে যায়। মন্মথ কর হচ্ছে সেই নেকড়ে।
বললুম, যাঃ! তুই ঠাট্টা করছিস। কী করে জানলি তুই?
শুক্লা বলল, আমাকেও ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল। লেখাপড়ায় যেমন ভাল ছেলে, বজাতিবুদ্ধিতেও তেমনি পাকা। আমাকে দেখে মুখ টিপে টিপে হাসত, তারপর একদিন আড়ালে পেয়ে বলল, তোমাকে বড় ভাল লাগে। নার্স তো অনেক আছে, কিন্তু তুমি তাদের মত নও।
কছুদিন পরেই চায়ের নেমন্তন্ন।
সবই মিলে যাচ্ছে। আমার বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল; তবু বললুম, ওর মতলব খারাপ তা ঝলি কী করে?
নমিতা বলেছিল। নমিতাকে তুই দেখিসনি, তুই আসবার আগেই সে নার্স হয়ে বেরিয়ে গেছে। দেখতে ভাল ছিল, মনে ছিল প্রেমের খিদে। মন্মথ-নেকড়ে প্রায় তাকে মুখে পুরেছিল, নেহাৎ কপাল জোর তাই বেঁচে গেল।
চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইলুম, তারপর আবার শুয়ে পড়লুম। মনটা যেন আঁতকে উঠে অসাড় হয়ে গেছে। এত বড় ধাক্কা জীবনে খাইনি। মনে হল যেন ফুল বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ একটা লতা-পাতায় মুখ ঢাকা কুয়োয় পড়ে যাচ্ছিলুম।
শুক্লাও আমার পাশে শুলো : কি ভাবছিস?
বললুম, কিছু না। আচ্ছা শুক্লা, তোর কখনও কারুর সঙ্গে ভালবাসা হয়েছে?
এবার শুক্লা একটু চুপ করে রইল, শেষে বলল, কী জানি! ভালবাসা কাকে বলে?
ভালবাসা কাকে বলে! কথাটা কখনও ভেবে দেখিনি। গল্পে উপন্যাসে পড়েছি, দুটি মানুষ পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হল, দুজনের দুজনকে ভাল লাগল, এই কি ভালবাসা? না, আর কিছু আছে?
বললুম, তুই বল না ভালবাসা কাকে বলে।
সে আস্তে আস্তে বলল, জানিনে ভাই। ভালবাসার কতখানি চোখের নেশা কতখানি মনের মিল, কতটা স্বার্থপরতা কতটা আত্মদান, বুঝতে পারি না। যাঁরা বড় বড় প্রেমের গল্প লেখেন, কবিতা লেখেন, তাঁরাও জানেন কিনা সন্দেহ। হয়তো আগাগোড়াই জৈব বৃত্তি।
শুক্লা বিছানা থেকে নামবার উপক্রম করল : যাই ভাই, অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুম পাচ্ছে।
আমি তার আঁচল টেনে বললুম, কাউকে ভালবাসিস কি না বললি না তো।
সে বলল, ভালবাসা কী তাই জানি না। কি করে বলব?
বললুম, তাহলে আছে কেউ একজন! কে রে শুক্লা?
সে একটু থেমে বলল, আজ নয়, আর-একদিন বলব। তুই নেকড়ে বাঘের সঙ্গে খেতে যাবি না তো?
না, যাব না। কিন্তু গেলেই বা কী ক্ষতি হত? আমার মন যদি শক্ত থাকে, ও কী করতে পারে?
তুই বুঝিস না। চড়ুই পাখি ভাবে, আমি উড়তে পারি, অজগর উড়তে পারে না, ও আমার কী করতে পারে? তারপর যখন অজগরের সম্মোহন দৃষ্টির সামনে পড়ে যায় তখন আর নড়তে পারে না।–আচ্ছা এবার ঘুমো, নইলে সকালে উঠতে পারবি না।
শুক্লা নিঃশব্দে চলে গেল। আমি একা শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলুম—নেকড়ে বাঘ…অজগর সাপ…সংসারে কত ভয়ঙ্কর জন্তুই না আছে! ভাবলে ভয় করে।
পরদিন থেকে মন্মথ করের সঙ্গে আর চোখাচোখি হয়নি। সে আসছে দেখলেই মনে হত—নেকড়ে বাঘ! অজগর সাপ। শুক্লা এমন ভয় আমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, সে-ভয় আজ পর্যন্ত যায়নি। কোনও পুরুষ হেসে কথা কইলেই মনে প্রশ্ন জাগে—অজগর, না নেকড়ে বাঘ?
শুক্লা কিন্তু একজনকে ভালবেসেছিল। অনেকদিন আমাকে তার নাম বলেনি। যেদিন বলল,শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম।
দুটো বছর কোন্ দিক দিয়ে কেটে গেল। প্রতি হপ্তায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার মনের যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বুঝতে পারিনি। প্রথম প্রথম মন পড়ে থাকত বাড়ির দিকে; এক হপ্তা পরে বাবাকে দেখব এই আশায় মন উৎসুক হয়ে থাকত। কিন্তু ক্রমে বাড়ির দিকে টান কমে যেতে লাগল, হস্টেল এবং হাসপাতালের পরিবেশ আমার মনকে টেনে নিল। তখন হপ্তায় হপ্তায় বাড়ি যাওয়া একটা কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল! বাবার শরীর যে ক্রমে আরও খারাপ হচ্ছে তা লক্ষ্য করেছিলুম কি? করেছিলুম বই কি। কিন্তু মনে কোনও আশঙ্কা জাগেনি। বাবা কি বুঝতে পেরেছিলেন, আমার মন তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে? হয়তো বুঝেছিলেন, হয়তো মনে দুঃখ পেয়েছিলেন; কিন্তু কোনওদিন একটি কথাও বলেননি। আজ সেকথা ভেবে চোখে জল আসে; তিনি তো আমার জন্যেই বেঁচে ছিলেন, আমি কেন আমার সমস্ত মন তাঁকে দিতে পারলুম না? কেন আমার মন অবশে তাঁর কাছ থেকে সরে গেল? আমার মন তখন বড় হাল্কা ছিল, শ্যাওলার মত জলের ওপর ভেসে বেড়াত। হয়তো সব ছেলে-মেয়েরই ওবয়সে অমন হয়, জীবনে নিত্য-নতুনের আবিভাব পুরনোকে ভুলিয়ে দেয়।
শুক্লার তিন বছরের কোর্স শেষ হল, সে পাস করে ডিপ্লোমা পেল। ইচ্ছে করলেই সে স্টাফ নার্স হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু সে থাকল না। স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস করবে। আমার তখনও এক বছর বাকী। শুক্লা চলে গেলে আমার এই এক বছর কী করে কাটবে?
যেদিন শুক্লা হস্টেল ছেড়ে চলে গেল তার আগের রাত্রে আমি তার ঘরে গেলুম। তার গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। সেও একটু কাঁদল, তারপর চোখ মুছে বলল, ভাবিসনি। এক বছর কাটুক না, তোকেও টেনে নিয়ে যাব। তোকে ছেড়ে আমি একলা থাকব ভেবেছিস!
সে রাত্রে কথায় কথায় শুক্লা তার মনের অন্তরতম কথাটি বলল, ডক্টর নিরঞ্জন দাসের কথা। তম্ভিত হয়ে গেলুম। আমি ভেবেছিলুম ছাত্রদের কারুর সঙ্গে শুক্লার ভালবাসা হয়েছে; ডক্টর দারে কথা একবারও মনে আসেনি।
ডক্টর নিরঞ্জন দাস ছিলেন আমাদের গাইনকোলজির প্রফেসর। হপ্তায় একদিন আমাদের পড়াতেন, তাছাড়া নিয়মিত হাসপাতালে আসতেন। নামজাদা ডাক্তার, বিপুল প্র্যাকটিস। বয়স বোধ হয় চল্লিশের আশেপাশে কিন্তু দেখলে মনে হত ত্রিশের বেশী নয়। চেহারাতে যেমন ছেলেমানুষি ছিল, স্বভাবেও তেমনই; সকলের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা রঙ্গ-তামাশা করতেন। তবু মাঝে মাঝে লক্ষ্য করেছি তাঁর চোখের মধ্যে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি লুকিয়ে আছে! তখন তাঁকে বড় ক্লান্ত নিষ্প্রাণ দেখাত।
আমরা সবাই নির্বিচারে তাঁকে ভালবাসতুম। সবাই ভালবাসতুম বলেই বোধ হয় শুক্লার ভালবাসা চোখে পড়ত না। যাকে সবাই ভালবাসে তাকে যে একজন বিশেষভাবে ভালবাসতে পারে একথা কারুর মনে আসে না।
ডক্টর দাস বিবাহিত, তাঁর স্ত্রী জীবিতা। এইটেই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।
তাঁর কথা বলতে বলতে শুক্লার গলা ভারী হয়ে বুজে এল, সে ঘন ঘন আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগল।
পঁচিশ বছর বয়সে ডক্টর দাস বিয়ে করেছিলেন। সুন্দরী বউ, বড় ঘরের মেয়ে। কিছুদিন ঘর করার পর বউয়ের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ল। অত্যন্ত মুখরা সে, কথায় কথায় অন্যের ছলছুতো ধরা তার অভ্যেস, ঝগড়ার একটা সুযোগ পেলে আর রক্ষে নেই, চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করবে। সবচেয়ে মারাত্মক তার হিংসে। স্বামীর প্রতি কিছুমাত্র স্নেহ নেই, কিন্তু নিজের অধিকার-বোধ আছে যোল আনা। স্বামী যদি অন্য কোনও স্ত্রীলোকের সঙ্গে হেসে কথা বলেন অমনি তেলে-বেগুনে জ্বলে যায়, দশজনের সামনে কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাধিয়ে বসে। স্বামী গাইনকোলজিস্ট, স্ত্রী-রোগের চিকিৎসা করেন, এটা তাঁর চরিত্রহীনতার লক্ষণ, এই নিয়ে অষ্টপ্রহর খিটিমিটি চেঁচামেচি।
ডক্টর দাসের সংসারে ছিলেন তাঁর বিধবা মা; আর এক পুরনো ঝি, যে তাঁকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। বউয়ের রকমসকম দেখে ঝি প্রথমে গেল, তারপর মা কাশীবাস করতে গেলেন। সংসারে রইলেন ডক্টর দাস আর তাঁর খাণ্ডার বউ।
ডক্টর দাসের অসীম ধৈর্য। তিনি যদি কড়াপ্রকৃতির মানুষ হতেন তাহলে বোধ হয় তাঁর এত দুর্দশা হত না। কিন্তু তিনি শান্তশিষ্ট মানুষ। ক্রমে ক্রমে স্ত্রীর অত্যাচার যত বাড়তে লাগল ডক্টর দাসের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ততই কমে আসতে লাগল। সারাদিন নিজের ডিস্পেন্সারিতে থাকতেন, কাজকর্ম করতেন, কেবলমাত্র রাত্রে বাড়িতে শুতে যেতেন। তাও বাড়ির আবহাওয়া যখন বেশী গরম থাকত তখন ডিস্পেন্সারিতেই রাত কাটাতেন, বাড়ি যেতেন না। কিন্তু তাতেই কি নিস্তার আছে। তিনি বাড়ি
গেলে স্ত্রী ডিস্পেন্সারিতে এসে হাঙ্গাম বাধাতেন; কম্পাউণ্ডারদের নানারকম বিশ্রী প্রশ্ন করতেন; কেলেঙ্কারির একশেষ হত। ডক্টর দাসের সহকর্মীদের মধ্যে এই নিয়ে হাসাহাসি চলত। তবে একটা উপকার হয়েছিল। সারাক্ষণ ডিস্পেন্সারিতে থাকার জন্য ডক্টর দাসের প্র্যাকটিস খুব শিগগির জমে উঠেছিল। স্ত্রীরোগের চিকিৎসক বলে তাঁর নামডাক শহরময় ছড়িয়ে পড়েছিল।
ডক্টর নিরঞ্জন দাসের বিবাহিত জীবনের প্রথম বারো-তেরো বছর এইভাবে কেটেছিল। রোগী। হাসপাতাল লেকচার রুম ডিস্পেন্সারি; ঘর-সংসার কেবল নামে। তপস্বীর জীবন।
শুক্লা যখন প্রোবেশনার হয়ে এসেছিল তখন সেও অন্য সকলের মত ডক্টর দাসের মধুর স্বভাবের কাছে ধরা পড়েছিল। কিন্তু শুক্লার মনটা বড় মরমী, দু-চার দিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারল যে, বাইরে ডক্টর দাস যতই হাসি-তামাশা নিয়ে থাকুন, অন্তরে তিনি বড় দুঃখী। শুক্লার সমস্ত মন তাঁর দিকে ঢলে পড়ল।
কিন্তু শুক্লার সবই মনে মনে। বাইরে কেউ কিছু বুঝতে পারল না, এমনকী ডক্টর দাসও না।
কিছুদিন পরে একটি ব্যাপার ঘটল।
পুরুষমানুষ মনের মত কাজ পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। ডক্টর দাসকে সামলাবার কেউ নেই। দিনরাত খেটে খেটে আর নাওয়া-খাওয়ার অনিয়ম করে তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল; একদিন লেকচার দিতে দিতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। অন্য ডাক্তারেরা তাঁকে পরীক্ষা করে। বললেন, রোগ কিছু নেই, কিন্তু ক্লান্তি আর অবসাদে জীবনীশক্তি কমে গিয়েছে। কিছুদিন হাসপাতালের কড়া নিয়মে থাকা দরকার। হাসপাতালের প্রাইভেট ওয়ার্ডে একটি কেবিনে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হল। একজন ডাক্তার বন্ধু বললেন, তোমার বাড়িতে খবর পাঠাব? তিনি ম্লান হেসে বললেন, পাঠাও।
ডক্টর দাসের সেবা করবার জন্যে নার্সদের মধ্যে কাড়াকাড়ি। যারা তাঁর সেবায় নিযুক্ত হয়েছে। তারা তো আছেই, যারা হয়নি তারাও ছুটি পেলে তাঁকে এসে দেখে যায়। ডাক্তারেরা তাঁর ঘরে উঁকি না-মেরে চলে যান না।
ডক্টর দাসের পরিচর্যার জন্যে যারা নিযুক্ত হয়েছিল, তাদের মধ্যে শুক্লা একজন। দুপুরবেলা তার পালা। তাকে ঠিক সময়ে খাওয়ানো, টনিক দেওয়া, খবরের কাগজ পড়ে শোনানো, গল্প করা, এই সব তার কাজ। দুপুরবেলা হাসপাতাল কিছুক্ষণের জন্যে ঝিমিয়ে পড়ে; তখন ডক্টর দাস বিছানায় বসেন, শুক্লাকে নানান প্রশ্ন করেন; তোমার বাড়িতে কে কে আছে?…কেউ নেই, মা বাবা মারা গেছেন।…কেউ নেই? তোমার খরচ জোগায় কে?…বাবা কিছু টাকা রেখে গিয়েছিলেন, তাছাড়া যা হাতখরচ পাই তাতেই চলে যায়। তোবেশনার নার্সের আর খরচ কী? এবার শুয়ে থাকুন, খাবার পর একটু বিশ্রাম করতে হয়। আপনারাই বলেন।
তিন-চার দিন যেতে না-যেতেই দুজনের মনে এক নতুন উপলব্ধি জেগে উঠল। এতদিন ডক্টর দাসের কাছে শুক্লা ছিল একশো মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে; এখন সে বিশিষ্ট একটি মেয়ে; এখন সে শুক্লা। মরমী শুক্লা, দরদী শুক্লা, শুধু নার্স নয়। শুক্লার মন আগে থেকেই উন্মুখ হয়েছিল, এখন ডক্টর দাসের মন তার কাছে এসে দাঁড়াল। যেন মনের সঙ্গে মনের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেল। বন্ধনহীন গ্রন্থি।
ডক্টর দাসের শরীর বেশ তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে লাগল। কিন্তু শরীর সারবার সঙ্গে সঙ্গে মনও বিষণ্ণ হতে লাগল। তাঁর স্ত্রী খবর পেয়েছেন, কিন্তু একবারও দেখতে আসেননি। দিন ছয়-সাত কেটে যাবার পর একদিন দুপুরবেলা ডক্টর দাস শুক্লার হাত ধরে করুণ হেসে বললেন, শুক্লা, তুমি জান না, আমার জীবন একটা মস্ত ট্র্যাজেডি।
তাঁর মুখের দিকে চেয়ে শুক্লার বুক কান্নায় ভরে উঠল, সে বলল, জানি। কিন্তু কী নিয়ে ট্র্যাজেডি তা জানি না।
ডক্টর দাস শুক্লার হাত ধরে খাটের পাশে বসালেন। নিজে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে আস্তে আস্তে নিজের দাম্পত্য জীবনের কাহিনী বললেন।
তারপরই বিচ্ছিরি কাণ্ড।
ঘরের দরজা ভেজানো ছিল, হঠাৎ যেন ঝড়ের ধাক্কায় খুলে গেল। দুদ্দাড় শব্দে ঘরে এসে ঢুকলেন ডক্টর দাসের স্ত্রী। রণচণ্ডী মূর্তি। মুখ দিয়ে যে-সব কথা বেরুচ্ছে তা ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে বেরোয় না, অন্তত বেরুনো উচিত নয়। মুহূর্ত মধ্যে দোরের কাছে লোক জমে গেল; ডোম মেথর ঝাড়দারনী, সবাই ছুটে এসে দোরের কাছে ভিড় করে দাঁড়াল।
শুক্লা থ হয়ে গিয়েছিল; তারপর রাগে তার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। সে উঠে গিয়ে দোরের কাছে দাঁড়াল, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, বেরিয়ে যান এখান থেকে, এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান। এটা রোগীর ঘর, মেছোহাটা নয়।
মিসেস দাস চোখ রাঙিয়ে অসভ্য অশ্লীল কথা বলতে আরম্ভ করলেন। শুক্লা তখন একজন মেথরকে ডেকে বলল, রামদীন, এঁকে বাইরে নিয়ে যাও।
রামদীন ঝাড় হাতে এগিয়ে এল। মিসেস দাস তখন বেগতিক দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ডক্টর দাস এতক্ষণ চোখ বুজে বিছানায় বসে ছিলেন, এবার চোখ খুলে শুক্লার দিকে তাকালেন। তাঁর চাউনির মানে—দেখলে তো আমার স্ত্রীকে!
কয়েকদিন পরে ডক্টর দাস সেরে উঠে আবার কাজকর্ম আরম্ভ করলেন। শুক্লার সঙ্গে তাঁর একটি নিভৃত সম্পর্কের সূত্রপাত হল। কিন্তু তাদের চোখে চোখে কখন কী কথা হত, কখন নির্জনে দেখা হত, কেউ জানতে পারল না।
আজ হস্টেলে শুক্লার শেষ রাত্রি। কাল সে চলে যাবে। ডক্টর দাস তার জন্যে সমস্ত ব্যবস্থা। করে রেখেছেন। ভাল পাড়ায় একটি ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছে। শুক্লা সেইখানে থাকবে, আর স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস করবে। ডক্টর দাসের অগাধ পসার, অগাধ প্রভাব, শুক্লাকে একদিনও বসে থাকতে হবে না।
রাত্রি বারোটা বোধ হয় বেজে গেছে। পাশাপাশি শুয়ে ভাবছি, ভালবাসার স্বরূপ কী রকম? যে ভালবেসেছে সে মনে মনে কী ভাবে? ডক্টর দাস শুক্লার চেয়ে বয়সে অনেক বড়; ভালবাসা কি বয়সের বিচার করে না? তবে কিসের বিচার করে? কী চায়? কী পায়?
একটা কথা মনে এল। শুক্লাকে জিগ্যেস করলুম, ডক্টর দাস তোকে বিয়ে করবেন তো? শুক্লা একটু চুপ করে থেকে বলল, উনি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, আমি রাজী হইনি। তুই রাজী হোসনি!
না। এক বউ থাকতে আবার বিয়ে করলে ওঁর বদনাম হত, প্র্যাকটিসের ক্ষতি হত। বিয়ের দরকার কী ভাই। ভালবাসাই তো বিয়ে।
কিন্তু—
কিন্তু নেই প্রিয়া। যদি কোনও দিন সত্যিসত্যি ভালবাসিস, বুঝবি ওতে কিন্তু নেই।
নিজের কথা ভাবলি না?
ভেবেছি। এই তো আমার গর্ব। আমি যা পেয়েছি তা কটা মেয়ে পায়?
কী পেয়েছিস? ভালবাসা। একটি মানুষের মন।
পরদিন শুক্লা চলে গেল। কয়েকদিন পরে আমি চুপিচুপি তার বাসা দেখতে গেলুম। কী সুন্দর বাসাটি! দোতলায় বড় বড় তিনটি ঘর, সামনে বারান্দা। একটি ঘর অফিসের মত সাজানো, টেলিফোন আছে, দ্বিতীয় ঘরটি শুক্লার শোবার ঘর; তৃতীয় ঘরটি একরকম খালিই পড়ে আছে, আমি এসে থাকব। শুক্লা জিগ্যেস করল, কেমন?
আমি তার গলা জড়িয়ে বললুম, আমার আর তর সইছে না, ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি চলে আসি।
শুক্লা বলল, আমিও পথ চেয়ে আছি। একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
দুজনে বিছানার পাশে বসলুম, প্রশ্ন করলুম, ডক্টর দাস আসেন?
শুক্লার মুখখানি নববধুর মত টুকটুকে হয়ে উঠল; সে ঘাড় নেড়ে একটু হাসল।
বললুম, কেমন লাগছে?
তার চোখ দুটি স্বপ্নাতুর হয়ে উঠল; আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, সখি কি পুছসি অনুভব মোয়!
শুক্লা গান গাইতে পারে। তখন পর্যন্ত জানতুম না, তারপর অনেকবার শুনেছি। ভারি মিষ্টি গলা।
সেদিন চলে এলুম। তারপর সুবিধে পেলেই গিয়েছি। শুক্লা বলেছিল একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তা গেল বটে, কিন্তু আমার অতীতকে একেবারে নির্মূল করে দিয়ে গেল। বছর শেষ না-হতেই বাবা মারা গেলেন।
বাবার মৃত্যু বড় আশ্চর্য। যেন আমার ডিপ্লোমা পাবার অপেক্ষায় তিনি বেঁচে ছিলেন। যেদিন ডিপ্লোমা পেলুম তার দুদিন পরে তিনি হার্ট ফেল করে মারা গেলেন। শরীর ভিতরে ভিতরে জীর্ণ হয়ে পড়েছিল, কেবল মনের জোরে বেঁচে ছিলেন।
বাবার কথা ভাবি। বাপ নিজের ছেলে মেয়েকে যত ভালবাসে, ছেলেমেয়েরা বাপকে তত ভালবাসতে পারে না কেন? প্রকৃতির নিয়ম! এ রকম নিয়মের মানে কী? স্নেহ শুধু নিম্নগামী না হয়ে ঊর্ধ্বগামী হলে কী দোষ হত? বুঝতে পারি না।…আমি যদি শৈশবে পিতৃহীন হতুম তাহলে কি ভাল হত? কিংবা বাবা যদি আরও অনেকদিন বেঁচে থাকতেন তাহলে ভাল হত? বুঝতে পারি না। মৃত্যুকালে তাঁর হাতে মাত্র সাতশো টাকা ছিল; বেশীদিন বেঁচে থাকলে হয়তো অর্থকষ্টে পড়তেন। আমি রোজগার করে তাঁকে খাওয়াব সে-ভাগ্য কি করেছি? মেয়ে খালি নিতেই পারে, দিতে পারে না।
শুক্লার বাসায় এসে উঠলুম। এই বাসা। এখানে পাঁচ বছর কেটেছে। একটা ঘরে শুক্লা থাকে, একটা ঘরে আমি; অফিস-ঘরটা ভাগের। একটি ছোট্ট রান্নাঘর আছে, তাতে যার যেদিন ছুটি সে রান্না করে, দুজনে মিলে খাই। যেদিন দুজনেরই কাজ থাকে সেদিন সামনের হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খাই। একটা শুকো ঝি দিনের বেলা কাজ করে দিয়ে যায়। কী সুখে আছি আমরা তা বলতে পারি না। এই ছোট্ট বাসাটি আমাদের স্বর্গ।
কাজের দিক দিয়েও সুবিধে হল। আগে শুক্লা একলা সব কাজ সামলাতে পারত না, এখন দুজনে মিলে সামলে নিই।
ডক্টর দাস মাঝে মাঝে আসেন। রোজ আসেন না, হপ্তায় একদিন কি দুদিন। একটু রাত করে আসেন। আমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন; রাত শেষ হবার আগেই চলে যান। নিজের জন্যে তাঁর ভাবনা নেই, কিন্তু পাছে শুক্লার বদনাম হয় তাই সতর্কভাবে যাওয়া-আসা করেন। তাঁর স্ত্রী জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হবে।
আমার সঙ্গে এ বাসায় যেদিন তাঁর প্রথম দেখা হল তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। বললেন, প্রিয়ংবদা, তুমি এসেছ খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু দেখো, শুক্লার মত কেলেঙ্কারি করো না, যাকে ভালবাসবে তাকে বিয়ে করো।
আমি ওকথার উত্তর না দিয়ে বললুম, আমি কিন্তু আপনাকে জামাইবাবু বলে ডাকব।
তিনি আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বললেন, আর আমি তোমাকে কী বলে ডাকব?—প্রিয়া?
আপনার প্রিয়া তো ওই—এই বলে আমি শুক্লাকে দেখালুম। শুক্লা পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হসছিল।
তিনি বললেন, তাহলে তোমাকে সখী বলব। তুমি যেমন শুক্লার সখী তেমনি আমারও সখী।
সেই থেকে তিনি আমাকে সখী বলে ডাকেন।
পুরনো কথা, লিখতে লিখতে অনেক পথে-বিপথে ঘুরে বেড়ালুম, এবার ফিরে আসি। আজ আমার জন্মদিন। বাইরে অবিশ্রাম ধারাবর্ষণ চলেছে। লিখতে লিখতে মন বসে গিয়েছিল, এদিকে রাত্রি এগারোটা। শুক্লা আটটা বাজতে-নাবাজতেই বেরিয়েছে, তার আজ সমস্ত রাত কাজ; সেই ভোরবেলা ফিরবে। বাসায় আমি একা।
শুক্লা আজ আমার জন্মদিনে একটি চমৎকার জিনিস উপহার দিয়েছে। একটি আয়না, চার ফুট লম্বা, আড়াই ফুট চওড়া। দুজনে মিলে আমার শোবার ঘরে টাঙিয়েছি, তার মাথায় ইলেকট্রিক বালব, নীচে আমার কাপড়চোপড় রাখার ক্যাবিনেট। ক্যাবিনেটের মাথায় প্রসাধনের তেল ক্রীম স্নোর শিশি সাজিয়েছি। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। ঘরের শ্রী ফিরে গেছে।
ডক্টর দাস পাঠিয়েছেন প্রকাণ্ড একটি কেক। আমরা আজ এ-বেলা রান্না করিনি, কেক খেয়েই পেট ভরিয়েছি। আজ ডক্টর দাস আসবেন না, তিনি জানেন শুক্লা কাজে বেরিয়েছে। কাল বোধ হয় আসবেন। তখন তাঁকে আমার জন্মদিনের কেক খাওয়াব।
শুক্লা বেরিয়ে যাবার পর আমি ডায়েরি লিখতে বসেছি। এখন এগারোটা বেজে গেছে। অনেক রাত হল—
কিড়িং কিড়িং–। পাশের ঘরে টেলিফোন বাজছে। এত রাত্রে কার দরকার হল!