রিভেঞ্জ

রিভেঞ্জ

অন্যদিন অফিস আসতে আসতে আমার প্রায় দশটা পনেরো-কুড়ি হয়ে যায়৷ পোষা পাখিগুলোকে খাইয়ে, অ্যাকোয়ারিয়ামের লাল-নীল মাছগুলোর সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করে তারপর আসি আমি৷ আমার প্রাসাদোপম বাংলোয় মালি, বাবুর্চি, খানসামা, বেয়ারা মিলিয়ে প্রায় জনা দশেক কর্মসহায়ক থাকলেও এই কাজ ক-টা আমি নিজের হাতে করতেই ভালোবাসি৷ আমার চব্বিশ ঘণ্টার ড্রাইভার রামলাল অন্তত তিনবার এসে উশখুশ করে, বিনীত গলায় বলে, ‘‘ম্যাডাম, স্টার্ট করি?’’

কিন্তু আজ সে-সব কিছুই করতে হয়নি৷

বরং ভোর ভোর উঠে নিয়মমাফিক হালকা ফ্রি-হ্যান্ড করে ব্রেকফাস্ট সেরে সাড়ে ন-টা নাগাদ আমি নিজেই গাড়ি বের করে ড্রাইভ করে আমার অফিসে চলে এসেছি৷

আমার কর্মচারীরা সবাই বেশ অবাকই হয়েছে আজ, কিন্তু নিজের মুখে কিছু বলতে সাহস পায়নি৷ বলা ভালো, সে সাহস আমি ওদের কোনোদিনই দিইনি৷ প্রবল ব্যক্তিত্বের আবরণটাকে মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করতে করতে কখন সেটাই আমার শরীরের অঙ্গ হয়ে উঠেছে, কর্ণের কবজের মতো৷ আর শুধুমাত্র জেলাশাসক বলে নয়, মাত্র আড়াই বছরেই আমি এই বিশাল মাপের ঝামেলাপ্রবণ জেলাটাকে নিজের নখদর্পণে নিয়ে এসেছি৷ শাসক দলের নেতা থেকে শুরু করে অপোনেন্ট পার্টি এমনকি এ-জেলার তাবড় তাবড় ক্রিমিন্যালরাও এখন একবাক্যে স্বীকার করে, ডি এম দিব্যদর্শিনী রায়চৌধুরীর জেলায় বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়৷

আমার বাংলো থেকে অফিসের দূরত্ব প্রায় দু-কিলোমিটার৷ ব্রিটিশ আমলের বিশাল বাংলো, অঢেল জায়গার ওপর সযত্নে গড়ে তোলা৷ লাল সুরকির পথ বাংলো ছেড়ে বেরিয়ে সোজা চলে গিয়েছে আমার অফিস অর্থাৎ জেলাশাসকের দপ্তরের দিকে৷ এই চত্বরটা পুরোটাই রেস্ট্রিক্টেড, তাই স্টিয়ারিং-এ হালকা হাত রেখে গতকাল রাতের বৃষ্টির ঠান্ডা আমেজটা উপভোগ করছিলাম, এমন সময় ফোন বাজল৷

হাতে নিয়ে দেখি মহুল৷ ফোন তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে মহুলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘‘কীরে? অফিস চলে গেছিস? আমার কথাগুলো মনে আছে তো? মালটা কিন্তু আজ আসবেই তোর কাছে, একদম পাক্কা খবর!’’

আমি হাল্কা হাসলাম৷ মহুল এখন হাওড়ার একটা ব্লকের বি ডি ও৷ পদমর্যাদায় মহুল আমার থেকে প্রায় তিন ধাপ নীচের অফিসার হলেও আমাদের মধ্যে তুই-তোকারির সম্পর্ক কারণ আমরা অনেকদিনের বন্ধু৷ অ-নে-ক দিনের, যখন আমি সবে কলেজ পাশ করে বেরিয়ে সিভিল সার্ভিসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম৷ মাঝে অনেক ঝড়ঝাপটা এলেও আমাদের বন্ধুত্ব এখনো অটুট৷

আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘‘আসুক না, চাপের তো কিছু নেই!’’

মহুল আবার উত্তেজিত গলায় বলল, ‘‘চাপের তোর কিছু নেই, কিন্তু সেই বাছাধনের আছে৷ তুই কিন্তু কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নিবি দিব্য!’’

আমি টুকটাক দুয়েকটা কথা সেরে ফোন রেখে দিলাম৷ গাড়ি ততক্ষণে ডি এম অফিসের গেটে ঢুকছে৷ দু-ধারে দাঁড়িয়ে থাকা উর্দিপরা দারোয়ান আজ ড্রাইভারের আসনে আমাকে দেখে বেশ অবাক, ঘন ঘন সেলাম ঠুকছে৷ আমি নিজের মনেই হাসলাম৷ এখনো দপ্তরের নব্বইভাগ লোকই আসেনি, আমি আগে এসে গেছি দেখে শুধু শুধু তারা টেনশনে পড়ে যাবে৷

আমি কিছু না বলে আমার কেবিনে ঢুকে গেলাম৷ মহুলের কাছে নিজেকে যতই নিরাসক্ত দেখাই না কেন, সত্যিই কি আমার ভেতরে কোনো ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয়নি? তাহলে কেনই বা সাত সকালে অফিসে ছুটে এসেছি আর কেনই বা কাল সারারাত ছটফট করেছি! নিজের চেয়ারে বসে আমার সেক্রেটারির রেখে যাওয়া ভারী ফাইলগুলো টেনে নিলাম৷ সব ফাইলই রেডি, শুধু আমার সই বাকি আছে৷ প্রথম ফাইলটা খুলে সই করতে যেতেই হঠাৎ কী করে যেন চোখের সামনে দশ বছরের পুরোনো স্মৃতিগুলো ছবির মতো ভেসে উঠল৷ কাল থেকেই উঠছে, এরকমই হঠাৎ হঠাৎ৷ স্পষ্ট দেখতে পেলাম বহুকাল আগের সেই সন্ধেটাকে যখন আমি সেজেগুজে উৎকণ্ঠা ভরা মুখে অপেক্ষা করছি কখন দেবব্রতর বাড়ির লোকেরা আসবে৷ মন্দিরা আমার মুখে ঝুঁকে পড়ে ওরই নিয়ে আসা মেক আপ লাগাচ্ছে, মা মাঝে মাঝেই একবার করে কারণে-অকারণে ঘুরে যাচ্ছে, বাবা বাইরের তদারকিতে ব্যস্ত৷ মন্দিরা একবার বলছে, ‘‘তোকে কী সাজাব বল তো! সাতজন্মে মুখে কিছু মাখিস না! ভুরুটাও তো প্লাক করতে পারিস!’’

আমি মৃদুস্বরে বলছি, ‘‘তুই ছাড় না এসব! দেবব্রত এসব পছন্দ করে না, ওর আমাকে সাজগোজ ছাড়াই দেখতে ভালো লাগে বুঝলি!’’ বলতে বলতে আমার মুখে কি একটু লজ্জার আভা দেখা দিচ্ছে?

কথাটা সত্যি৷ দেবব্রত কখনো আমাকে সাজতে বলেনি৷ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে একটা আই এ এস কোচিং সেন্টার ছিল, সেখানে পড়তে গিয়ে দেখা৷ নামে সেটা আই এ এস কোচিং হলেও আদপে ডব্লু বি সি এস হবার জন্যই লোকে যেত বেশি৷ যদিও প্রথম থেকে আমি নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিলাম যে আই এ এস আমি হবই, ক্লাসের বাকি প্রায় সবাই কিন্তু ডব্লু বি সি এস হতে পারলেই নিজেদের ধন্য মনে করবে এমনটাই ছিল, দেবব্রতও তার ব্যতিক্রম নয়৷ আসলে বাঙালি ছেলে-মেয়ে বাবা-মায়ের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার ইঁদুরদৌড়ে শামিল হতে গিয়ে ভুলতে বসেছে যে দেশের প্রথম আই এ এস অফিসার একজন বাঙালিই৷ আমার মনে পড়ল, প্রথম ক্লাস শুরুর দিন যখন ডিরেক্টর স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, সবাই ডব্লু বি সি এস বললেও আমি দৃঢ় গলায় বলেছিলাম, ‘‘স্যার, আমি আই এ এস হতে চাই৷’’ তখন বেশ কিছুজন অবাক আর কিছুজন অবিশ্বাস আর বিদ্রূপের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল৷

পরের বছরই যখন ডব্লু বি সি এস পাশ করে আমার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছি আই এ এসে বসার, তখন দেবব্রতকেও ইন্সপায়ার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওর সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না৷ হতাশ গলায় বলেছিল, ‘‘আই এ এস! শুনলেই গলা শুকিয়ে যায় দিব্য! ওসব ছাড়ো তো! দুজনেই ডব্লু বি সি এস পাশ করেছি, আর কী চাই? খুব শিগগির পোস্টিং পেয়ে যাব; বাড়িতে কবে বলছ বল তো আমাদের ব্যাপারটা?’’

যদিও আমার ইচ্ছে ছিল আরো দু-তিন বছর আই এ এসের জন্য চেষ্টা করে তারপর বাড়িতে বলব, তবু দেবব্রতর পীড়াপীড়িতে বলেছিলাম বাড়িতে৷ তা ছাড়া আরো একটা বিপদ হাজির হয়েছিল৷

বাবা-মা তো শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গিয়েছিল৷ ডব্লু বি সি এস মেয়ে, ডব্লু বি সি এস জামাই, আর কী চাই! আমার বাবা-মাও কল্পনা করতে পারত না যে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বাড়ি থেকে কেউ আই এ এস হতে পারে! বাঙালির তথাকথিত মানসিকতা৷ আমার স্কুলমাস্টার বাবা শুনে হাঁ করে তাকিয়েছিল, ‘‘আই এ এস দিবি!’’

আমি অধৈর্য হয়ে বলেছিলাম, ‘‘হ্যাঁ দেব৷ কেন যারা আই এ এস হয় তাদের কি চারটে হাত-পা থাকে, না দুটো নাক থাকে যে এরকম করছ? এই জন্যই ওয়েস্ট বেঙ্গলে বাঙালি আই এ এসের সংখ্যা এত কমে গেছে!’’

হঠাৎ আমার সেক্রেটারির ডাকে আমার হুঁশ এল, ‘‘ম্যাডাম, ঘাটালের এম পি এসেছেন দেখা করতে৷ ওঁদের এরিয়ার একটা এম পি তহবিলের রাস্তা কন্সট্রাকশনে গণ্ডগোল হয়েছে৷ কনট্রাক্টরের লেবাররা স্ট্রাইক ডেকেছে৷’’

আমি ভেতরে নিয়ে আসতে বলে চেয়ারে হেলান দিলাম৷ ঘাটালের এম পি একজন নামকরা ফিল্মস্টারও, সেদিনই তার একটা সিনেমা দেখছিলাম, একটা ছেলে প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে গিয়েছে৷

আচ্ছা আমিও কি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম? নিশ্চয়ই তাই? নাহলে কেনই বা মাথা থেকে নিজের ছোটবেলার স্বপ্ন ঝেড়ে ফেলে দেবব্রতকে বিয়ে করতে, নিজের একটা সংসার গড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম? কেনই বা দেবব্রতর কাছে বিশ্বাস করে নিজেকে তুলে দিয়েছিলাম!

মা আগে দু-একবার মিনমিন করে বারণ করেছিল, বলেছিল, ‘‘কী দরকার মন্দিরাকে নিয়ে দেবব্রতর সাথে সবসময় দেখা করতে যাওয়ার! সোমত্থ মেয়ে, ওর আজ এখানে থাকার প্রয়োজনটাই বা কী!’’

আমি মায়ের আপত্তির আসল কারণটা ঠিকই বুঝেছিলাম কিন্তু পাত্তা দিইনি৷ পড়াশোনোয় লবডঙ্কা হলেও মন্দিরা ছিল যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী, ওর দুধে-আলতা গায়ের রং আর টানা টানা ঘন চোখের প্রেমে প্রচুর ছেলে হাবুডুবু খেত৷ অন্যদিকে আমি ছিলাম চাপা রঙের লম্বা দোহারা ছোট কোঁকড়ানো চুলের একটা মেয়ে৷ পড়াশোনোয় মন্দিরা আমার ধারেকাছে না এলেও আমাকে ভারী ভালোবাসত৷ আমি ফুৎকারে মায়ের কথা উড়িয়ে দিয়েছিলাম, আমার দেবব্রত ওরকম ছেলেই নয়! দেবব্রত আমার রূপে আকৃষ্ট হয়নি, হয়েছে আমার গুণে, আমার মননে, আমার মানসিকতায়৷ সেখানে কোথায় লাগে ওই স্থূলবুদ্ধির মন্দিরা!

কিন্তু আমার ভাবনা আর বাস্তব সত্যিই সেদিন এক সুরে গান গায়নি৷ সেদিন সন্ধেটা শেষ হয়েছিল বেশ অন্যরকম ভাবে৷ আমার থেকে বেশি যখন মন্দিরাকে ইন্টারভিউ করছিলেন ওঁরা, মন্দিরার লজ্জা লজ্জা করে বলা কথায় ওঁরা যখন বিগলিত, আমার আই এ এস হতে চাওয়ার কথা শুনে দেবব্রতর বাবা যখন হাত উল্টে বলেছিলেন, ‘‘ছেলে ডব্লু বি সি এস অফিসার, সেখানে বউমা আই এ এস হলে সামলাব কী করে! না বাবা, ওসব আই এ এস-টাই এ এস আমাদের মতো ঘরে মানাবে না!’’, তখনই আমার বুকের পাঁজরগুলো একটা একটা করে ভাঙতে শুরু করেছিল৷

লজ্জা বা ন্যাকামি কোনোদিন আমার স্বভাবে ছিল না, পরিষ্কার স্পষ্ট কথা বলে সোজা চোখ তুলে দেবব্রতর মুখের দিকে চেয়েছিলাম, দেখেছিলাম অধোবদন পিতৃ-আজ্ঞা পালনে ভিরু মুখ৷

ঘাটালের এম পি সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, ‘‘নমস্কার ম্যাডাম, আসব?’’

আমি হেসে উঠে দাঁড়ালাম৷ বাংলা সিনেমার এই ইয়ং হিরো ঘটনাচক্রে রাজনীতিতে এসে পড়লেও মানুষ হিসেবে বেশ ভালো, একটা আন্তরিকতা আছে, আগেও এসেছেন দু-একবার৷ সৌজন্য বিনিময়ের পর কাজের কথা শুরু হল৷

আধঘণ্টা পর যখন এম পি মশাই বিদায় নিলেন, ততক্ষণে মহুলের মেসেজ এসেছে দু-বার, প্রতিশোধ নেবার কথা মনে করিয়ে দিয়ে৷ সত্যিই, কীভাবে শোধ নেব আমি সেই অপমানের? দেবব্রতর বাড়ির লোকেদের অপমানজনক কথাতেও আমি সেদিন ভেঙে পড়িনি, কিন্তু ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিলাম তার ঠিক তিন দিন বাদে বাড়ির কাছের এক পার্কে, যেখানে দেবব্রত আমাকে স্পষ্ট বলেছিল, ‘‘দিব্য, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম৷ কিন্তু….তুমি ঠিক ঘরের বউ টাইপ নও৷ বাবা-মায়ের ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো, ওঁরা পুরোনো দিনের মানুষ, ছেলের বউয়ের কাছ থেকে ওঁরা আগেরকার দিনের মতোই ব্যবহার চান৷’’ আমি সেদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম, আমার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চিৎকার-চেঁচামেচিও করিনি৷ কারণটাই যে ধরতে পারছিলাম না!

তারও মাসচারেক বাদে যখন দেবব্রতর সাথে মন্দিরার বিয়ের কথা শুনেছিলাম সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আসল কারণটা৷ আমার মেধা, আমার রুচি, আমার গুণ সবই দেবব্রতর কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল মোটা মাথার মন্দিরার রূপের ঝলকে৷

তারপর আমি দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনো শুরু করি৷ তখনকার দিনে একজন অবিবাহিতা মেয়ের একা গিয়ে গর্ভপাত করানোটা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না৷ মহুল আমার পাশে ছিল৷ বাড়িতে আমি বাবা-মায়ের চোখে এমন একজন হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিলাম যে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরেছে৷ মা তো একদিন রাগে-দুঃখে বলেই ফেলল, ‘‘ভালো ছেলেটাকে পেয়েছিলি, তোর কপালে সইল না৷ এত কিসের দেমাক তোর?’’

আমি তখন কোনো উত্তর দিইনি৷ দিয়েছিলাম বছরদুয়েক পর৷

দু-বছর বাদে আই এ এসে যখন সারা ভারতের মধ্যে প্রথম দশের মধ্যে একমাত্র বাঙালি হিসেবে আমার নাম ওঠে, ততদিনে দেবব্রত আমার কাছে একটা পুরোনো ঘায়ে পরিণত হয়েছে, যার আর ব্যথা না থাকলেও দাগটা রয়ে গেছে, থেকে যাবে আজীবন৷

তাই গত পনেরোদিন ধরে মহকুমা শাসক দেবব্রত সেনের দীর্ঘদিন ধরে চালানো দুর্নীতি যখন এক এক করে প্রকাশিত হচ্ছে, টেলিমিডিয়ার স্টিং অপারেশনে যখন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোচ্ছে অবিরাম গতিতে, একে একে প্রকাশ হয়ে পড়ছে দেবব্রত সেনের অন্ধকার জগতের সাথে হাত মিলিয়ে টাকা খেয়ে অসঙ্গত, অন্যায় বিল পাশগুলো, তখনো খুব একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়নি মনে৷ শুধু তেতো মনে ভেবেছিলাম এই সব লোকেরা সিভিল সার্ভিসে আসে কেন! গরিব মানুষগুলোর জন্য বরাদ্দ করা টাকাগুলো আত্মসাৎ করতে যাদের বিবেকে বাধে না, তারা তো পশুরও অধম!

বিয়ের ইচ্ছা আমার আর ছিল না৷ তাই ছোটবেলার ইচ্ছেটাকে সত্যি করতে একজন সৎ কর্মঠ আই এ এস অফিসার হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কর্মযজ্ঞে, আমাদের দেশের একদম নীচের তলাকার মানুষগুলোকে রাজনীতির স্বার্থমাখা উপকারের বাইরে গিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম৷ ফলস্বরূপ এই আট বছরেই দেশের অন্যায়ের সাথে আপোশ না করা ইয়ং গুটিকয়েক আই এ এস-দের মধ্যে আমার নাম একদম ওপরের দিকে৷ বাবা-মা চলে গেছেন তাও ক-বছর হল৷ দেশের জন্য, মানুষের জন্য আমার জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়ে আমি সত্যিই লোহার মতো অনমনীয় হয়ে উঠেছি৷

কিন্তু সাতদিন আগে হেড কোয়ার্টার থেকে আসা আর্জেন্ট নোটিস আর মহুলের উপর্যুপরি ফোন আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে৷ দেবব্রত সেনের দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্তের জন্য যে হাই কম্যান্ড ইনভেস্টিগেশন কমিশন গঠন করা হয়েছে তার চেয়ারপার্সন আমি৷ একমাসের মধ্যে দেবব্রত সেনের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ কমিশনকে দিয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিতে হবে আমাকে৷ আর কাল মহুল ফোন করে জানাল আজ নাকি গোপনে দেবব্রত আমার কাছে ক্ষমা চাইতে আসবে, অনুনয়-বিনয় করবে আমি যাতে ওকে ক্লিনচিট দিই৷ ক্লিনচিট দিলে ও সাময়িক সাসপেন্ড হলেও চাকরিটা যাবে না৷

আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলেছিলাম, ‘‘সত্যি আসবে! তুই ঠিক জানিস! মানে এতটা মোটা চামড়া…!’’

মহুল বাধা দিয়ে বলেছিল, দেবব্রত নাকি নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে, সে নেতাদের পা চাটা হোক, বা দরকারে তাঁবেদারি করা! আর আমাকে ইমোশনাল সুড়সুড়ি দিয়ে কাজ হাসিল করাটা কোনো ব্যাপারই নয় ওর কাছে৷

সারাটা সকাল গড়িয়ে দুপুর পড়ে এল৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেল৷ দেবব্রত কিন্তু এল না৷ মহুলের ইনফরমেশন তাহলে ভুল ছিল, ভাবতে ভাবতে বাংলোয় ফিরলাম আমি৷ এসে সারাদিনের মানসিক চাপে বড় ক্লান্ত লাগছিল৷

অবশেষে রাত সাড়ে আটটার সময় দেবব্রত এসে হাজির হল আমার বাংলোয়৷ আমার আর্দালি এসে বলতে আমি ভেতরে আসার আদেশ দিলাম৷ বেশ মোটা কাতলামাছের মতো চেহারা হলেও চুল উশকোখুশকো, বোঝাই যাচ্ছে গত কয়েকদিনের ঝড়ে বেচারা কাহিল হয়ে পড়েছে৷ ফর্সা মুখের ওপর একটা পোড়া ক্লান্তির ছাপ বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট৷

আমি মনে মনে আপশোশ করলাম৷ আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল ও আমার অফিসে না গিয়ে বাংলোয় আসবে৷ মনে মনে ভাবলাম আমি, টেবিলের নীচ দিয়ে টাকা নেওয়া যাদের অভ্যাস, তারা মাথা উঁচিয়ে কোথাও যেতে অনেকদিন ভুলে গেছে৷

আমার বিশাল ড্রয়িঙের একটা চেয়ারে দেবব্রত কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল৷ আমিই নীরবতা ভাঙলাম, ‘‘কেমন আছ? মন্দিরা ভালো আছে?’’

দেবব্রত মুখ তুলে তাকাল, চোখে স্পষ্ট আশার আলো, ও হয়তো আশা করেনি আমি এত ভালোভাবে শুরু করব৷ বলল, ‘‘আমাকে বাঁচাও দিব্য! ছেলেটাকে লন্ডনে পড়তে পাঠিয়েছি, মন্দিরার কেমো চলছে, জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে, এর মধ্যে আমার চাকরিটা চলে গেলে আমাকে সুইসাইড করতে হবে!’’

আমি মনে মনে হাসলাম৷ ছেলেকে লন্ডনে পড়ানোর জন্য তাহলে কত গরিবের প্রাপ্য টাকা মেরেছে দেবব্রত? আমি আড়চোখে আমার ফোনের দিকে তাকালাম, তখনো মহুলের হোয়াটসঅ্যাপ ঢুকছে, ‘‘দেবব্রত শিয়ালের মতো চতুর দিব্য! খবরদার ওকে ক্ষমা করিস না! বরং তোকে ও যে অপমানটা করেছিল, সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে!’’

আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম, ‘‘সেদিন আমিও প্রেগন্যান্ট ছিলাম দেবব্রত! সুইসাইড করাটা বরং আমারই বেশি যুক্তিযুক্ত ছিল, কী বল!’’

দেবব্রত গুটিয়ে একটা কেন্নোর মতো হয়ে গেল৷ কিছুক্ষণ মাথা হেঁট করে থেকে হঠাৎ কেঁদে ফেলল৷ তারপর চেয়ার থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার পায়ের ওপর৷ আমি ঘটনার আকস্মিকতায় পা-টা সরিয়ে নিলাম৷ ও হাউমাউ করে উঠল, ‘‘আমাকে ক্ষমা করো দিব্য৷ তু-তুমি আমাকে বাঁচাও৷ আমি মরে যাব! তু-তুমি যা চাইবে আমি তাই করতে রাজি আছি৷’’

আমি চমকে উঠলেও ভেতরে জমে থাকা অনেকদিনকার কষ্টটা যেন কেমন কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছিল, নিজের সৌভাগ্যে নিজেই অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম! ভাগ্যিস এই অমেরুদণ্ডী অসৎ ক্লীবলিঙ্গটাকে আমি বিয়ে করিনি!

এর জন্য সত্যিই ওর একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য!

আমি ওর হাত ধরে তুলে চেয়ারে বসালাম৷

 * * * *

আমি নিরপেক্ষভাবে ইনভেস্টিগেট করিয়েছিলাম৷ সাক্ষ্যপ্রমাণ সবই দেবব্রতর বিরুদ্ধে যাওয়ায় ওর চাকরি তো যায়ই, বিচারে সাড়ে তিনবছর জেল হয়, সঙ্গে মোটা জরিমানা৷

না, নিজের প্রতিশোধস্পৃহার জন্য আমি আমার সততার সঙ্গে আপোশ করিনি৷

তবে আমার একসময়ের প্রাণের চেয়েও প্রিয় যে বান্ধবী, যাকে আমি নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসতাম, সেই মন্দিরার চিকিৎসার ভার যতটা সম্ভব নিয়েছিলাম আড়ালে থেকে৷

দেবব্রত যখন জেলে, তখন আমার সেক্রেটারিকে দিয়ে কলকাতার সেরা হাসপাতালগুলোর একটায় চিকিৎসা করিয়েছিলাম মন্দিরার৷ কিন্তু একবারও দেখা করতে যাইনি৷ ইচ্ছে হয়নি, কেন জানি না৷

আমার এক বন্ধু ইংল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাসের হাই কমিশনার তখন, তাকে অনুরোধ করে ওদের ছেলেটাকে ওর পড়ার খরচা চলে যাওয়ার মতো একটা স্কলারশিপেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম৷

মহুল হাজারবার বারণ করলেও কর্ণপাত করিনি৷ দিব্যদর্শিনী রায়চৌধুরীর কাছে কর্তব্যের ওপরে আর কিচ্ছু নেই৷

মহুল ফোন করে চিৎকার করছিল, ‘‘যে বন্ধু তোর এতবড় সর্বনাশ করেছিল, তাকেই ট্যাঁকের পয়সা খরচা করে সারাচ্ছিস? ভুলে গেলি দেবব্রতর বাপ-মা তোকে কী বলেছিল? ও তোকে কীরকম ভাবে ডিচ করেছিল? প্রতিশোধ তো নিলিই না, উল্টে ওর গুষ্টির পেছনে টাকা ঢালছিস! তুই কি পাগল?’

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, ‘‘আমি মানুষ৷ মান আর হুঁশ দুটোই তাই রাখার চেষ্টা করি মহুল৷ আর…প্রতিশোধ নিলাম তো! কেউ নির্মমভাবে রিভেঞ্জ নেয়, আবার কেউ সৎ পথে হেঁটে প্রতিশোধ নেয়৷ দুটোরই মোটিভ এক! দুটোতেই ভিক্টিমরা দগ্ধে দগ্ধে মরে বুঝলি!’’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *