রিপোর্টার
(এই উপন্যাসের কাহিনি ও ঘটনা কাল্পনিক)
ক্লাবের ফ্যাক্স মেশিন দিয়ে অফিসে একটা খবর পাঠাবার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় মালি তিনকড়ি এসে বলল, ”কালকেতুবাবু, একজন সাহেব— রিপোর্টার আপনাকে ডাকছে।”
প্রায় আধঘণ্টা ধরে চেষ্টা করছি, কিছুতেই ফ্যাক্সের নম্বর মেলাতে পারছি না। এমনিতেই যথেষ্ট বিরক্ত। ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ”কোন দেশের?”
”জিজ্ঞেস করিনি। টেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আসতে বললাম, এল না।”
”প্রেস পাস নিতে এসেছে?”
”জানি না। কাল বিকেলেও একবার এসেছিল। বলল, আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চায়।”
”ওকে বল, আমি ব্যস্ত। ওয়েট করুক।”
ক্লাবের তাঁবুতে এখন বেশ ভিড়। আগামীকাল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রদর্শনী ম্যাচ ইডেন গার্ডেন্সে। খেলবে ভারত আর বিশ্ব একাদশ। আমাদের স্পোর্টস জার্নালিস্টস ক্লাবে তাই প্রচণ্ড ব্যস্ততা। দেশ—বিদেশের বহু সাংবাদিক আর ফোটোগ্রাফার কলকাতায় এসেছেন। ম্যাচ ‘কভার’ করতে যাওয়ার জন্য প্রেস পাস দরকার। আর সেটা দেওয়া হয় আমাদের ক্লাব থেকে। ম্যাচের আগের দিন অনেকেই তাই প্রেস কার্ড দেখিয়ে পাস নিতে এসেছেন। কেউ হাজির একটু আড্ডা মারার জন্য। কেউ—কেউ আবার ক্লাব থেকেই খবর পাঠাতে ব্যস্ত তাঁদের অফিসে। ফ্যাক্স মারফত, অথবা টেলিফোনে।
ক্লাবে এসে রোজ আড্ডা মারার অভ্যেস আমার নেই। দিল্লি থেকে হঠাৎ আমার এক বন্ধু কলকাতায় হাজির, প্রদর্শনী ম্যাচটা দেখতে চায়। ওর জন্য একটা টিকিট দরকার। ঘুরতে—ঘুরতে বিকেলের দিকে তাই ক্লাবে এসেছি, যদি একটা টিকিট জোগাড় করা যায়। বন্ধুটা এসে উঠেছে হোটেলে। ডিনারে নেমন্তন্নও করেছে। ক্লাবের সেক্রেটারি অলোক দাশগুপ্তর কাছ থেকে কোনওরকমে একটা টিকিট ম্যানেজ করে, ফোনে সেই বন্ধুকে বলেছি, রাত আটটায় ডিনারে আসছি। অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে এখন নেই। আর সেই খবরটাই সহকর্মীদের দিতে চাইছি ফ্যাক্স মারফত।
দুপুরের দিকে একটা কাজে গিয়েছিলাম টলি ক্লাবের দিকে। হঠাৎ ওখানে দেখা ব্যারি রিচার্ডসের সঙ্গে। গলফ খেলে ফিরছেন। মিনিট পনেরো একা কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিশ্ব একাদশ টিম সম্পর্কে ব্যারি ভাল তথ্য দিয়েছেন। কথায়—কথায় বলে ফেললেন, ওপেনিং বোলার অ্যালান ডোনাল্ডের ফুড পয়জন মতো হয়েছে। প্রদর্শনী ম্যাচটা নাও খেলতে পারেন। ডোনাল্ড টিমের এক নম্বর বোলার। তিনি না খেললে ভারতের বিরাট সুবিধে। এই খবরটা আর কেউ জানে না। এমনকী, দক্ষিণ আফ্রিকার রিপোর্টারদেরও জানানো হয়নি।
বন্ধুর ওখানে ডিনার সেরে, রাতে অফিসে ফিরে ব্যারি রিচার্ডসের ইন্টারভিউটা বড় করে লিখব। এই কথাটা ক্লাব থেকে ফোনেও বলে দিতে পারতাম সহকর্মী ইন্দ্রনীলকে। কিন্তু ক্লাবের টেলিফোনের সামনে এখন এত ভিড়, কথাটা বলতে গেলে পাঁচকান হয়ে যাবে। ব্যারি কলকাতায়, সম্ভবত কোনও রিপোর্টার তা জানেই না। যদি কেউ শুনে ফেলে, তা হলে ঠিক খুঁজে বের করবে। আমার আর ‘স্কুপ’ করা হবে না।
এই কারণেই ফ্যাক্সে একটা ‘মেসেজ’ পাঠাচ্ছিলাম ইন্দ্রনীলের কাছে। অবশ্য সাঙ্কেতিক উপায়ে। মেসেজটা পড়ে কেউ বুঝতে পারবে না। এমনকী, আমাদের অন্য রিপোর্টাররাও না। ইন্দ্রনীলের সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে। মেসেজ পড়লেই ও বুঝে নিতে পারবে। আর সেভাবে তৈরি থাকবে। বাইরে কোনও টুর্নামেন্ট কভার করতে গেলে, আমরা যদি কোনও স্কুপ নিউজ পাই, তা হলে সাঙ্কেতিক একটা মেসেজ পাঠিয়ে আমরা পরস্পরকে সতর্ক করে দিই। খবরটা যাতে অন্য কাগজে পাচার না হয়ে যায়, সেজন্যই এই সতর্কতা।
ফ্যাক্স মেশিনে নম্বর মেলাতে আমি ব্যস্ত। ঘাড়ের কাছে অন্য একজনের মুখ। বলল, ”কী খবর পাঠাচ্ছিস রে কালকেতু?”
ঘাড় না—ঘুরিয়েই টের পেলাম, লোকটা কে। জগন্নাথদা, ‘দৈনিক বাংলা’ কাগজের রিপোর্টার। ঠিক এসে হাজির হয়েছেন। উঁকি মেরে অন্যের কপি দেখা জগন্নাথদার স্বভাব। দু—একটা লাইন পড়ে নিতে পারলেই হল! তারপর সেই খবর বের করে নিতে অসুবিধে হয় না। জগন্নাথদাকে সবসময় আমি এড়িয়ে চলি। আসলে জগন্নাথদার মতো রিপোর্টারদের ফাঁকি দেওয়ার জন্যই আমি আর ইন্দ্রনীল ওই সাঙ্কেতিক উপায়টা বের করেছি।
জগন্নাথদা উঁকিঝুঁকি মারছে। তাতে কিছু আসে—যায় না। একটু মজা করার জন্যই বললাম, ”একটা ‘ইমপর্ট্যান্ট নিউজ’ পাঠাচ্ছি। কাউকে বলবেন না।”
”কী নিউজ রে?”
”চুপ, কথা বলবেন না। শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিন।”
ফ্যাক্স মেশিনটার ওপর ঝুঁকে পড়ল জগন্নাথদা। বিড়বিড় করে আমার মেসেজটা পড়তে লাগল :
ইন্দ্র, ম্যাচটা দেখতে মুর্তাজা
ফিরোজি কলকাতায়। লোকটা চায়
না, এই খবর অন্য কেউ জানুক। গা
ঢাকা দিয়ে রয়েছে। আমি সারা
বিকেল খুঁজেছি। লোকটার মাখামাখি
যার সঙ্গে, তাকে তুই চিনিস।
সেই লোকটা আমাকে একটা ৫
তারা হোটেলে নিয়ে গেল। ১০
মিনিট ধরে কথা হল। আই সি সি
ওকে পাঠিয়েছে। তদন্তে। ই ও এম
পড়া শেষ করে জগন্নাথদা ফিসফিস করে জানতে চাইল, ”শেষে লিখেছিস ই ও এম। ওটার মানে কী?”
ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। সেটা চেপে বললাম, ”এন্ড অব মেসেজ।”
”ওফ, তাই বল। আচ্ছা, এই মুতার্জা লোকটাই বা কে?”
এবার কপট রাগে বললাম, ”এই এক মুশকিল জগন্নাথদা আপনাকে নিয়ে। কোনও খবরই রাখেন না। এ—মাসের উইজডেনে এই লোকটার সম্পর্কে একটা বড় আর্টিকেল বেরিয়েছে। অফিসের লাইব্রেরিতে গিয়ে সেটা দেখে নিন। প্লিজ জগন্নাথদা, একটা রিকোয়েস্ট, এই খবরটা অন্য কাউকে দেবেন না।”
”তোর মাথা খারাপ নাকি? নিশ্চিন্ত থাক, অন্য কেউ জানতেও পারবে না। থ্যাঙ্ক ইউ ভাই, থ্যাঙ্ক ইউ।” বলে জগন্নাথদা অন্য দিকে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
আমি নিশ্চিত, মিনিট দশেকের মধ্যেই সারা ক্লাবে কারও জানতে বাকি থাকবে না, মুর্তাজা ফিরোজি নামে একজন কলকাতায় এসেছেন। অতীতে এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
ফ্যাক্স মেশিনে নম্বর ‘পুশ’ করতে—করতে আমার আঙুল ব্যথা হয়ে গেল। অফিসের লাইন পাচ্ছি না। সন্ধের দিকে এই সময়টা খবরের কাগজের ফ্যাক্স মেশিন খুব ব্যস্ত থাকে।
বিরক্ত হয়ে ক্যান্টিনে এসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। মেসেজটা কারও হাত দিয়ে পাঠাতে পারলে ভাল হত! মালি তিনকড়ির হাত দিয়েও পাঠানো যেতে পারে। আমি অফিস না পৌঁছনো পর্যন্ত বাড়ি যাবে না ইন্দ্রনীল। সেটাই বাঁচোয়া। আসলে ওকে যে কথাটা জানাতে চাইছিলাম, সেটা হল ”জায়গা রাখিস। ৫০ সি এম।” আমার মেসেজের প্রতি লাইনের শেষ অক্ষরটা আলাদা করে নিলেই ইন্দ্রনীল বুঝতে পারবে। বেলা বারোটা—সাড়ে বারোটা নাগাদ অফিসে গিয়ে ম্যাচের প্রিভিউ লিখে এসেছি। ব্যারি রিচার্ডসের এই ইন্টারভিউটা হঠাৎ পাওয়া। প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার জায়গা নেবে। সেটা আগে জানিয়ে রাখা ভাল। না হলে পাতায় অন্য খবরগুলো বসানো হয়ে গেলে নাইট ডিউটির রিপোর্টার মুশকিলে পড়বেন।
ক্যান্টিনে চায়ের দাম মেটাতে যাচ্ছি। হঠাৎ গেটের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, তুঁতে রঙের একটা মারুতি থেকে নামছে দৈনিক জাগরণের তন্ময় দত্ত। গাড়ি থেকে নেমে এলেন দিলীপ বেঙ্গসরকরও। তন্ময়ের সঙ্গে ক্রিকেটারদের ভীষণ ভাব। ক্রিকেট নিয়ে নয়, ক্রিকেটারদের নিয়ে গালগল্প লিখে ছেলেটা ইদানীং নাম করেছে। ক্রিকেটারদের মশালা ম্যাচের বন্দোবস্তও করে দেয়। কমিশন নেয় সংগঠকদের কাছ থেকে। আরও অনেক গুজব আছে ওর সম্পর্কে। পারতপক্ষে ছেলেটাকে কাছে ঘেঁষতে দিই না।
ক্রিকেটারদের সঙ্গে মাখামাখি আমি একেবারেই পছন্দ করি না। বেরি সর্বাধিকারী আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। এখনকার ক্রীড়া—সাংবাদিকদের অনেকেই বেরিদার নাম শোনেনি। কিন্তু একটা সময় উনি ক্রিকেট—লেখক হিসেবে খুব বিখ্যাত ছিলেন। আমরা যখন সাংবাদিকতার পেশায় প্রথম ঢুকি, তখন কথায়—কথায় উনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ”কালকেতু, যারা কারেন্ট প্লেয়ার, তাদের সঙ্গে কখনও ‘হবনবিং’ করবে না। করলে, তার বিরুদ্ধে তুমি লিখতে পারবে না। সেই প্লেয়ার খারাপ খেললেও তোমাকে কলম গুটিয়ে রাখতে হবে। তবে হ্যাঁ, প্লেয়ার খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর তুমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারো।”
এখন অবশ্য এসব উপদেশ কেউ মানে না। আজহার বা শচীন কোনও সাংবাদিকের ঘাড়ে হাত রেখে কথা বললে সে ধন্য হয়ে যায়। এই তন্ময়কে আমি রবি শাস্ত্রীর ব্যাগ বইতে পর্যন্ত দেখেছি। সেজন্য ওর কোনও লজ্জা নেই। স্পোর্টস জার্নালিস্টস তাঁবুতে এসে মাঝেমধ্যে জুনিয়ার রিপোর্টারদের কাছে ও নাকি বারফাট্টাই মারে। আমাদের মতো কেউ থাকলে অবশ্য চুপ।
গাড়ির চাবি আঙুলে ঘোরাতে—ঘোরাতে, বেঙ্গসরকরকে নিয়ে তন্ময় তাঁবুর ভেতরে ঢুকল। ওদের এড়াবার জন্যই আমি আর ভেতরে গেলাম না। ইন্দ্রনীলকে না হয়, হোটেলে সেই বন্ধুর ঘর থেকেই ফোন করে খবরটা দেব, এই ভেবে, গেটের দিকে পা বাড়ালাম।
”আরে, যাও কই?”
ডান দিকে তাকাতেই দেখি, রুমি। নামকরা সাংবাদিক। বাইরে পোস্টিং। পুরো নাম অনেকেই জানে না। আসলে রুমি ডাকনাম। রুমির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অনেকদিনের। একসময়ে ক্রিকেটারও ছিল। ওকে দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। ও যে আসছে আমাকে জানায়ওনি।
প্রশ্ন করলাম, ”কবে এসেছ?”
”আইজই। তোমার অফিসে ফোন করসিলাম। ইন্দ্রনীল কইল, তুমি ক্লাবে থাকতেও পারো। তাই আইলাম।”
”এই ম্যাচে এলে? আরও আগে এলে না কেন?”
”কী হইব আইয়া। পুরা ওয়ার্ল্ড কাপ হইয়া গেল। কোম্পানি পাঠাইল না। এহানে পোলারে সাউথ পয়েন্টে ভর্তি করুম। সুযোগ পাইলাম। দুই কাজ একসঙ্গে হইয়া যাইব। এই এক্সিবিশন ম্যাচটা দেখা আর পোলারে স্কুলে ভর্তি করা।”
বললাম, ”প্রেস পাস নিয়েছ?”
”হ। কী মনে হইত্যাছে, ইন্ডিয়া জিতব, ম্যাচটা?”
”জেতা উচিত।”
”আমাগো নূতন প্লেয়ারটা তো ভালই খ্যালতাছে। হংকং থেইক্যা যারে আমরা ইমপোর্ট করছি।”
”মোহন চন্দ্রকুমারের কথা বলছ? হ্যাঁ, ছেলেটা দারুণ।”
”আমাগো কপাল ভাল। হঠাৎ একটা ওপেনার পাইয়া গ্যাছে। নাইলে অন্যেরে দিয়া ওপেন করাইতে হইত।”
”যা বলেছ।”
”এই মোহন ছেলেটার একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দিবা?”
”এখন নেবে?”
”দিলে ভাল হয়। আমার আবার নয়টার আগে খবর পাঠাইতে হইব।”
”তা হলে চল, খানিকক্ষণ লনে বসি।”
আমাদের ক্লাবের লনটা চমৎকার। সবুজ ঘাস। চারদিকে ফুলের গাছ। গাছে আলো দিয়ে বেশ সাজিয়েছে অলোক। মাঝে—মধ্যে রংবেরঙের বড়—বড় ছাতা। নীচে গোটাকয়েক চেয়ার পাতা। বিশ্বকাপের স্পনসর কোকাকোলা কোম্পানি সাংবাদিকদের জন্য প্রচুর বটল দিয়ে গেছে। ক্রেট থেকে দুটো বোতল তুলে আমরা ছাতার নীচে বসলাম। মার্চের মাঝামাঝি। তাই একটু ঠান্ডা—ঠান্ডা ভাব।
বোতলে চুমুক দিয়ে রুমি বলল, ”মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে তোমার কথা হইসে?”
”হ্যাঁ। হায়দরাবাদে। চ্যালেঞ্জার ট্রোফির সময়। পরে কটকেও কথা বলেছি।”
”এইর’ম কিন্তু কখনও হয় নাই। অন্য একটা দ্যাশ থেইক্যা আইয়া স্ট্রেট ইন্ডিয়া টিমে, ওয়ার্ল্ড কাপ টিমে…আনবিলিভেবল।”
”ঠিকই বলেছ। আসলে এই ছেলেটা হায়দরাবাদের। ওর বাবা—মা ইন্ডিয়ান সিটিজেন। কিন্তু গত পনেরো বছর ধরে হংকংয়ে।”
”তোমার, না কার লেখায় পড়লাম, আজহার মাসসাতেক আগে যখন হংকংয়ে সিক্স—এ—সাইড ম্যাচ খেলতে যায়, তখনই অরে প্রথম দ্যাখে। মোহন বোধ হয় হংকং বি টিমের হইয়া মাত্র কুড়ি বলে একটা সেঞ্চুরি করসিল।”
”হ্যাঁ। কথাটা আমিই লিখেছিলাম। নাগপুরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ওয়ান ডে ম্যাচের সময় আজহার অবশ্য বলেছিল, মোহন নাকি তার আবিষ্কার নয়। টিভি—তে কমেন্ট্রি দিতে প্রাক্তন এক ক্রিকেটার প্রায়ই হংকং যান। মোহনকে বছরদেড়েক ধরে চেনেন। ছেলেটা ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেটেও খেলে গ্লস্টারের হয়ে। সিক্স—এ—সাইড টুর্নামেন্টটার পর ক্রিকেটারটি ওঁর কলামে এই মোহন চন্দ্রকুমারকে ইন্ডিয়া টিমে নেওয়ার কথা প্রথম বলেন। আইনে নাকি আটকাবে না। উনিই লেখেন, চ্যালেঞ্জার ট্রোফিতে ডেকে মোহনের ‘ট্রায়াল’ নেওয়ার ব্যবস্থা হোক।”
”আমাগো এই একটা জিনিস আমাগো ভাল লাগে, বুঝলা। ফরমার ক্রিকেটাররা খুব ইন্টারেস্ট নেয়।”
”সেটা অবশ্য অন্য কারণ। সে—কথা থাক। মোদ্দা কথা হল, মোহনকে ইন্ডিয়া টিমে নেওয়াটা কাজে লেগেছে। দ্যাখো, চারটে ম্যাচে কিন্তু ছেলেটা তিনশোর ওপর রান দিয়েছে। লোকে তো এখন তুলনাই শুরু করেছে শচীনের সঙ্গে।”
”এটা তুমি ঠিক কইলা না। শচীন হইল গিয়া শচীন। ‘জিনিয়াস’। মোহনের খেলা আমরা টিভি—তে দেখসি। টেস্ট ম্যাচের ‘মেটিরিয়াল’ না। শচীনের সঙ্গে তুলনা কইরো না।”
রুমির মতো শচীন—ভক্ত আমি খুব কমই দেখেছি। শচীন সম্পর্কে সামান্য সমালোচনাও ও সহ্য করতে পারে না। মোহনের সঙ্গে শচীনের তুলনা করার কথাটা ইচ্ছে করেই বলেছি, যাতে ও চটে যায়। বছর দুয়েক পর ওর সঙ্গে দেখা। পরীক্ষা করে দেখলাম, ওর শচীন—প্রীতি একটুও কমেনি।
রুমিকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম, ফের তিনকড়ি সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, ”কালকেতুবাবু, সেই সাহেব এখনও আপনার জন্য ওয়েট করছে।”
শুনে একটু অবাকই হলাম। লোকটা কে? আমার সঙ্গে তার এমন কী জরুরি দরকার যে, ঘণ্টাখানেক ধরে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? নিশ্চয়ই দরকারটা ব্যক্তিগত, নাহলে লোকটা ভেতরে এসে কথা বলত। তিনকড়িকে বললাম, ”লোকটাকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়।”
”ডেকেছিলাম। এল না।”
”তা হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাক। লোকটা কে যে ডাকলেই আমাকে বাইরে যেতে হবে? যখন সময় হবে, তখন বেরোব।”
রুমি আমাদের কথা শুনছিল। কোকাকোলার বোতলটা খালি করে ও বলল, ”আরে, চেইত্যা (রেগে) যাও ক্যান। কেউ হয়তো তোমার কাছে টিকিটের জন্য পাঠাইছে।”
”টিকিট এখন কোত্থেকে পাব, বল।”
রুমি হাসল। তারপর বলল, ”যাউক গিয়া। ক্রিকেটের কথা তো হইল। অখন পার্সোনাল কথা জিগাই। তুমি নাকি শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দাগিরি করতাছ।”
আমি হাসতে—হাসতে বললাম, ”কে বলল তোমাকে?”
”’আনন্দমেলা’য় পড়সি। তোমাগো আনন্দমেলা কাগজটা খুব বিকায়। পড়লাম, পঙ্কজ রায়ের সেই ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের ব্যাটটা নাকি হারাইয়া গ্যাছিল। সেইটা স্মাগলাররা হংকং লইয়া যাইতাছিল। তুমি নাকি ধইরা ফেলছ?”
ঘটনাটা খুবই সামান্য। পঙ্কজ রায় যে ব্যাটটা দিয়ে ওপেনিং পার্টনারশিপে বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে বিশ্বরেকর্ড করেন, কিছুদিন আগে সেটা ওঁর কুমোরটুলির বাড়ির ‘শো—কেস’ থেকে চুরি হয়ে যায়। স্মাগলারদের একটা আন্তর্জাতিক চক্র সেটা হংকংয়ের এক পাগল ব্যবসায়ীর কাছে চালান করে দিচ্ছিল। অবশ্যই স্থানীয় একটি লোকের সাহায্য নিয়ে। কলকাতার এয়ারপোর্ট থেকে সেই অমূল্য ব্যাটটা আমি উদ্ধার করে দিই। সেই গল্পটা আনন্দমেলায় বেরিয়েছিল, কয়েক মাস আগে। রুমি সেই প্রসঙ্গ তোলায় আমি বললাম, ”ওই একটু শখের গোয়েন্দাগিরি আর কী! বম্বেতে ব্রায়ান লারার গ্লাভস চুরি গিয়েছিল ড্রেসিংরুম থেকে। সেটাও, বাজি রেখে আমি খুঁজে দিয়েছিলাম।”
রুমি ভীষণ সিরিয়াস, ”ওই ঘটনাটা পড়ার পরই আমরা তোমারে লইয়া খুব আলোচনা করসি। নেক্সট ক্রিকেট সিজনে একবার আমাদের ওখানে যাইতে পারবা?”
বললাম, ”কেন?”
”আর কইও না। ওখানে অহন ক্রিকেট খুব পপুলার হইসে। মহারানা, মহাদিগন্ত, এই ক্লাবগুলি অহন খুব বাইরের ক্রিকেটার আনতাছে। তোমাগো অনেক ক্রিকেটারও। কিন্তু হইল কী, তারপর থেইক্যা লিগে খুব আন এক্সপেক্টেড রেজাল্ট হইতাছে। আমাগো ধারণা, তলায়—তলায় বেটিং চলে। আর কোনও—কোনও প্লেয়ারও তাতে ইনভলভড। সেইটা বাইর করার জন্য তান্নাভাই তোমারে দাওয়াত দিতে চায়।”
তান্নাভাই হলেন ওখানকার ক্রিকেট সংস্থার কর্তা। আমার সঙ্গে ভাল আলাপ আছে। রুমির কথা শুনে হালকাভাবেই বললাম, ”তোমাদের ওখানেও বেটিং হচ্ছে? ইন্টারেস্টিং।”
”ওয়ার্ল্ড কাপের পরই আমাগো ওখানে ক্রিকেট শুরু হইব। চলো না। দিনকতক ছুটি লইয়া।”
”ঠিক আছে, যাব।”
হাতঘড়ি দেখল রুমি। তারপর ব্যস্ততার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বলল, ”প্রায় আটটা বাজে। অফিসে রিপোর্ট পাঠাইয়া, একবার আমাগো গেস্ট হাউসে যাইতে হইব। আমার এক বন্ধু এখানে প্রেস অফিসার। ডিনারে ডাকসে। কাইল মাঠে তোমার সঙ্গে দেখা হইব।”
একবার হাত মিলিয়ে রুমি গেটের দিকে এগোল। আমার হাতে তখনও সেই ফ্যাক্স মেসেজটা ধরা। অফিসে পাঠাবার শেষ চেষ্টা করে দেখি, ভেবে তাঁবুর ভেতরে ঢুকলাম। জনাতিরিশ—পঁয়ত্রিশ সাংবাদিক আর ফোটোগ্রাফার তখনও এদিকে—ওদিকে দাঁড়িয়ে অথবা বসে। বেঙ্গসরকরকে ঘিরে পাঁচ—ছ’জন। প্রায় গা ঘেঁষে তন্ময়। যেন আগলে রেখেছে।
দেখে মুচকি হাসলাম। কলকাতাতেই যত আগ্রহ ক্রিকেটারদের নিয়ে। বম্বেতে ওঁরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ ফিরেও তাকান না। বেঙ্গসরকররা অবশ্য কেউ হেঁটে যাওয়া—আসা করেন না। প্রত্যেকেই গাড়ি চাপেন। ক্রিকেটাররা আর যাই হোন, ফুটবলারদের মতো নন।
ফ্যাক্স মেশিনের দিকে এগোবার সময়ই চোখাচোখি হয়ে গেল বেঙ্গসরকরের সঙ্গে। হাত তুলে ডাকলেন। না ডাকলে যেতাম না। উনি এখন ‘কলাম’ লেখেন কাগজে। দূরত্ব রাখাই ভাল।
”আরে, ম্যানেজার তোমাকে বিকেল থেকে খুঁজছে। কোথায় ছিলে?”
ম্যানেজার, মানে টিম ম্যানেজার। বললাম, ”তোমার সঙ্গে ওঁর দেখা হল কোথায়?”
”এই তো হোটেলে। এখন তোমাদের এখানে আসছি শুনে বললেন, ক্যালকাটা দাদার সঙ্গে দেখা হলে বোলো, আমি খুঁজছি। বলবে, ওয়াতন কে লিয়ে।”
শেষের কথাটা শুনে হেসে ফেললাম। আমার কালকেতু নামটা শুনে টিম ম্যানেজার অবাক হয়ে প্রথমদিন বলেছিলেন, এটা কী নাম দাদা? কালকেটুর বদলে ক্যালকাটা রাখলেই তো ভাল করতেন। আমাদের ডাকতে সুবিধে হত। আর ‘ওয়াতন কে লিয়ে’ কথাটা আমাদের দু’জনের মধ্যে চালু একটা রসিকতা। এটা খুব ব্যবহার করেন আজহারউদ্দিন। সাংবাদিকরা কোনও কঠিন প্রশ্ন করলে, তা এড়াবার জন্য। ওয়াতন কে লিয়ে, মানে দেশের জন্য।
ক্লাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে কারও—না—কারও সঙ্গে আড্ডায় জমে যাব। তাড়াতাড়ি বেরোনো দরকার। তাই বেঙ্গসরকরকে বললাম, ”ঠিক আছে, ম্যানেজারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নেব। চলি। একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।”
হঠাৎ তন্ময়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বেঙ্গসরকর আমাকে এত সমীহ করে কথা বলছেন দেখে বোধ হয়। হয়তো জুনিয়ারদের সামনে কখনও বারফাট্টাই মেরেছিল, বোম্বাইয়ের ক্রিকেটাররা ওকে ছাড়া কলকাতার আর কোনও সাংবাদিককে চেনেই না।
ক্লাবের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমাকে বাঁ দিকে যেতে হবে। ভবানীপুর মাঠের পাশ দিয়ে। ইডেনের টাওয়ারগুলোতে ফ্লাড লাইট। বিশ্বকাপের দৌলতে ময়দানের চেহারাই বদলে গেছে। শহিদ মিনার ঘিরেও প্রচুর আলো। শর্টকাট রাস্তা নিলাম হোটেলে যাওয়ার জন্য। মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির পাশে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওদিক থেকেই কে যেন হঠাৎ আমাকে নাম ধরে ডাকল। ঘুরে তাকিয়ে দেখি, অপরিচিত একটা লোক।
”সার, আপনিই তো কালকেতু নন্দী?”
”হ্যাঁ।”
”সার, কাজারিয়া সাহেব আপনাকে এখুনি একবার দেখা করতে বলেছেন।”
”এন পি কাজারিয়া?”
”হ্যাঁ সার। উনি আপনার জন্য ক্লাব হাউসে অপেক্ষা করছেন। জরুরি দরকার।”
”দুপুরে ওঁর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। তখন তো কিছু বললেন না!”
লোকটা অসহায় মুখে বলল, ”কী জানি সার! আমাকে তো বললেন গাড়ি করে নিয়ে এসো।”
”কোথায় গাড়ি?”
”ওই তো। সাদা মারুতি।”
”কী মুশকিল! হোটেলের দিকে যতবার পা বাড়াচ্ছি, একটা না একটা বাধা পড়ছে। সি এ বি—তে গেলে আধঘণ্টা সময় তো লাগবেই। তারপর ডিনার সেরে অফিস পৌঁছতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে যাবে। বাড়ি ফিরতে রাত্তির সাড়ে বারোটা।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও লোকটার সঙ্গে এসে বসলাম মারুতিতে। লোকটা গাড়ি চালাচ্ছে, আমি বাঁ পাশের সিটে। নিশ্চয়ই কাজারিয়া কোনও খবর দেবেন। না হলে ড্রাইভার পাঠিয়ে আমাকে তলব দিতেন না। এর আগেও, কয়েকবার সমস্যায় পড়ে উনি এভাবে ডেকে নিয়ে গেছেন আমাকে। খুব ব্যস্ত লোক উনি। ফালতু কারণে গাড়ি পাঠাতেন না।
ইডেনের আশপাশটা আলোয় ঝলমল করছে। গোষ্ঠ পালের মূর্তির কাছাকাছি অঞ্চলটা আগে অন্ধকারে ডুবে থাকত। সেখানে এখন দিনের আলো। গাড়ির জানলা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে মনে—মনে একবার ভাবলাম, রাতে দিব্যি ওখানে ফুটবল খেলা যায়। একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম, মারুতিটা ডান দিকে ঘুরে যাচ্ছে। এ কী! সি এ বি—র দিকে তো যাচ্ছে না! আকাশবাণীকে বাঁ দিকে রেখে গাড়িটা সোজা দৌড়তে লাগল ডালহৌসির দিকে। প্রায় নাইনটি কিলোমিটার বেগে।
রেগেই ড্রাইভারকে বললাম, ”ডালহৌসির দিকে যাচ্ছ কেন ভাই?”
প্রশ্নটা করতেই পেছন থেকে কে যেন বলল, ”টেক ইট ইজি ম্যান।”
উচ্চারণ শুনে মনে হল বিদেশি। ঘাড় ঘোরাতেই পেছনের সিটে লোকটাকে আবছা দেখতে পেলাম। চুল কোঁকড়ানো, মোটা গোঁফ। মুখে বেশ কাঠিন্যের ছাপ। বয়স আন্দাজ করতে পারলাম না। তা হলে, এই সেই সাহেব—রিপোর্টার, আমার জন্য ঘণ্টাখানেকেরও বেশি যে অপেক্ষা করছিল। জানলার কালো কাচ তোলা ছিল। আলোও নেভানো। পেছনের সিটে যে একজন বসে আছে, গাড়িতে ওঠার সময় তা লক্ষই করিনি।
কড়া গলায় বললাম, ”তুমি কে?”
বলতে—না—বলতেই ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা একটা ধাতব স্পর্শ পেলাম। সম্ভবত পিস্তল। তারপরই লোকটার গলা, ”ডোন্ট বি সিলি। আদারওয়াইজ ইউ উইল বি ইন ট্রাবল।”
ঘটনাটা এত আকস্মিক ঘটল, বুঝে উঠতে পারলাম না, কী করব? মারুতি পেরিয়ে গেল জি পি ও, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ফেয়ারলি প্লেস। ডালহৌসিতে এই সময় লোকজন থাকে না বললেই চলে। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। জীবনে কখনও এইরকম অবস্থায় পড়িনি। এই দুটো লোক কি আমাকে কিডন্যাপ করছে? করে এদের লাভ? ঘাড় না ঘুরিয়ে, ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললাম, ”আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা?” প্রশ্নটা বিদেশিকে লক্ষ করেই।
সঙ্গে—সঙ্গে উত্তর, ”একটু পরেই তা জানতে পারবে। এখন চুপ করে বসে থাকো।”
কিন্তু চুপ করে বসে থাকার লোক তো কালকেতু নন্দী নয়। ডান পা সরিয়ে নিয়ে, ড্রাইভারের পায়ের ওপর দিয়েই চাপ দিলাম ব্রেকে। প্রচণ্ড একটা শব্দ…পুরো গাড়িটা কেঁপে উঠল। সঙ্গে—সঙ্গে মাথায় একটা আঘাত টের পেলাম। জ্ঞান হারাবার ঠিক আগের মুহূর্তে চাপাস্বরে হিস হিস, ”কন্ট্রোল দ্য কার। ডোন্ট স্টপ।”
।।২।।
রোজ খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা আমার অভ্যেস, যত রাতেই ঘুমোতে যাই না কেন, পৃথিবীর যে—প্রান্তেই থাকি না কেন! সাংবাদিকদের যে নিয়মিত শরীরচর্চা করা উচিত, এটা শিখেছি সোল ওলিম্পিক গেমস কভার করতে গিয়ে। ‘প্রেসভিলেজ’—এ রোজ দেখতাম, বিদেশি সাংবাদিকরা সকালে দৌড়ঝাঁপ করতেন। শরীর সুস্থ না থাকলে, ভালভাবে কাজ করা সম্ভব না। তা হলে মন ভাল থাকবে না। লেখাও ভাল হবে না।
কলকাতায় থাকলে রোজ সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলতে যাই। আর বাইরে গেলে হোটেলের জিমনাসিয়ামে বা সুইমিং পুলে কিছুক্ষণ সময় কাটাই। এতে শরীরটা সারাদিন খুব সতেজ থাকে। গত এক মাস বিশ্বকাপে ভারতের ম্যাচ কভার করতে গিয়ে বিভিন্ন শহরে থেকেছি। তারই মধ্যে যতটা সম্ভব শরীরচর্চা করেছি।
আজ ঘুম থেকে উঠতেই মাথাটা বেশ ভার—ভার লাগল। কিছুক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইলাম। মাথার ডান দিকে চিনচিনে একটা ব্যথা। সেটা কেন হচ্ছে, ভাবতেই গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। সাদা চামড়ার সেই বিদেশি লোকটা মারুতির ভেতর পিস্তলের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় মেরেছিল। কথাটা মনে হতে প্রচণ্ড রাগ হল সেই লোকটার ওপর।
আমাকে কেউ আঘাত না করলে, কাউকে আমি আঘাত করি না। কোথায় আছি, কীভাবে আছি, তা বুঝে ওঠার আগে ঠিক করে ফেললাম, বিদেশি লোকটাকে পালটা আঘাত না করা পর্যন্ত এখান থেকে বেরোব না।
বিছানায় শুয়েই এবার ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগলাম। গেস্ট হাউস ধরনের মনে হল। অথবা হোটেলের কোনও কামরা। ঝকঝকে, বেশ সুন্দর সাজানো। রঙিন ওয়াল পেপার মোড়া দেওয়াল, জানলায় ভারী পরদা, মেঝেতে কার্পেট। ড্রেসিংরুমের টেবিলের ওপর দেখলাম, একটা টেলিফোনও আছে। তার পাশে একটা বড় কোরিয়ান ‘ফ্লাওয়ার ভাস’। সেখানে সদ্য ফোটা ফুল। তার মানে, আমি ঘুমিয়ে থাকার সময়ই কেউ ফুল বদলে দিয়ে গেছে।
বিদেশি লোকটা আমাকে ‘কিডন্যাপ’ করেছে। এখন আমার কাছে এটা পরিষ্কার। কিন্তু কেন করল, সেটা বুঝতে পারলাম না। সাংবাদিকতার পেশায় আছি। অনেক সময় অনেকের বিরুদ্ধে লিখতে হয়। তাদেরই কেউ কি আমাকে কিডন্যাপ করল? কিন্তু কেন?
শবাসনে শুয়ে চিন্তা করছি। একবার মনে হল, পঙ্কজদার সেই ব্যাট চুরির কেসটা ধরে ফেলেছিলাম। স্মাগলাররা হংকংয়ের লোক। তাদের কেউ কি বদলা নিচ্ছে? হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। বদলা যদি নিতেই আসে, তা হলে কিডন্যাপ করবে কেন? ইচ্ছে করলে তো রাতের অন্ধকারে ‘মার্ডার’ করে, ডালহৌসি অঞ্চলে ফেলে দিয়ে পালাতেও পারত। যে—ই এই অপরাধটা করুক, যে কারণেই করুক, আমাকে দিয়ে কোনও কাজ করিয়ে নিতে চায়। অথবা চায় আমার কাছ থেকে কোনও খবর জানতে। না হলে জামাই আদর করে এইরকম একটা ঘরে শুইয়ে রাখত না।
আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম। আমাকে লোকটার দরকার। এবং তার ফয়দা হয়, এমন কোনও কারণে দরকার। যতক্ষণ না কেউ সামনাসামনি আসছে, ততক্ষণ বুঝতে পারব না। মনে—মনে উত্তেজনা কমাতে থাকলাম। মাথাটা ঠান্ডা রাখতেই হবে।
আর কয়েক ঘণ্টা পরে দুপুর দুটোয় বিশ্বকাপের প্রদর্শনী ম্যাচ ইডেনে। ম্যাচে পৌঁছতে না পারলে অফিসে হইচই পড়ে যাবে। কাল রাতে অফিসে যেতে পারিনি। ব্যারি রিচার্ডসের ইন্টারভিউটাও পকেটে রয়ে গেছে। আজকের ম্যাচে অ্যালান ডোনাল্ড যে খেলতে পারছেন না, সেটা জানা সত্ত্বেও বের করতে পারিনি। খুব আপসোস হতে থাকল। তেমনই রাগ, বিদেশি লোকটার ওপর।
ভাগ্যিস, কাল ফ্যাক্স মেসেজটা আর অফিসে পাঠাতে পারিনি। রাতে ‘পেজ রিলিজ’—এর সময় ইন্দ্রনীল তা হলে মুশকিলে পড়ে যেত। চিন্তাও করত আমার জন্য। বাড়িতে ফোন করে কাউকে পেত না। ফোন তোলার লোক বাড়িতে নেই। মা দিন—দুই হল,দিদির বাড়ি বেড়াতে গেছেন। ফিরবেন এই ম্যাচ শেষ হওয়ার পর।
বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বালিশে সামান্য রক্তের দাগ। মাথায় হাত দিয়ে বুঝলাম, সামান্য কেটেছে। ফের চিনচিনে রাগ হতে শুরু করল। সেটা দমাবার জন্যই বাথরুমে ঢুকে চোখে—মুখে জল দিলাম। পাশেই ঝোলানো সাদা তোয়ালে। মুখটা মুছতে নিজেকে একটু ‘ফ্রেশ’ লাগল। বাথরুমের জানলাটা কাচের। সেটা খুলে দিলাম। আশপাশের বাড়িগুলো দেখে একনজরে মনে হল, অন্তত পাঁচতলার ওপরে কোনও ঘরে আছি।
জানলা দিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দিলাম। নীচে ট্রামলাইন। রাস্তায় বেশ ভিড়। পুরনো আমলের সব বাড়িঘর। রাস্তার দু’পাশে প্রচুর দোকান। ফুটপাত—ভর্তি হকার। গাড়িগুলো দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই রাস্তাটা ওয়ান ওয়ে।
জানলাটা বন্ধ করে ফের ঘরে ঢুকে এলাম। আর তখনই খুট করে শব্দ হল দরজায়। নীল রঙের সাফারি সুট পরা এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন হাসিমুখে। বয়স চল্লিশের ওপরে। অসম্ভব ফরসা। কপালে চন্দনের সামান্য ফোঁটা। একঝলকে লোকটাকে বাঙালি বলে মনে হল না।
”গুড মর্নিং।” ভদ্রলোক বললেন, ”ওধমের নাম রাজু কেডিয়া।”
লোকটাকে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছিল। কোনও কথা বললাম না। ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইলাম।
”খুব গুসসা করেছেন মিঃ নোনদি?” কেডিয়া লোকটা সোফায় বসল। গলায় স্বাভাবিক ভদ্রতা, কিন্তু বেশ কর্তৃত্ব। এই লোকটাই মানুষজনকে এত বশ করে রাখে।
লোকটার চোখে চোখ রেখেই বললাম, ”স্বাভাবিক।”
”গুস্তাকি মাফ করবেন মোশাই। যে ছেলেটা আপনাকে আনতে গেছিল, একদম গিধধর। আপনি সোম্মানি লোক। সোম্মান দিয়ে আনতে বলেছিলাম।”
”আমাকে এখানে এনেছেন কেন?”
”কুছু ইনফরমেশন নেওয়ার জন্য।” বলেই কী যেন মনে পড়ল রাজু কেডিয়ার। বলল, ”আরে রাম রাম, আপনাকে চায়ে—কোফি কুছু দেয়নি। শরম কী বাত।”
কেডিয়া সাফারির পকেট থেকে একটা কর্ডলেস ফোন বের করে, একটু পরে বলল, ”এ ভাইয়া, গেস্ট রুমমে চায়ে ভেজ দেনা জলদি।”
লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। গলায় সোনার মোটা চেন। আঙুলে একটা হিরের আংটি। পায়ে সস্তার চপ্পল। মুখে বিনয়ের ছাপ। এবার বলল, ”মিঃ নোনদি, চার্লস যা করেছে, ফর দ্যাট আমি মাফি চাইছি। স্রিফ দু—চারটে ইনফরমেশান দিন, সোম্মানের সঙ্গে আপনাকে বাড়ি দিয়ে আসব।”
”কী ইনফরমেশান চান?”
”কিরকেট। আমার পান্টাররা সোব আপনার ফ্যান। উরা বোলেন, কিরকেট নিয়ে আপনি যা লিখেন, সোব সহি হয়ে যায়। সোবাই বলে, রাইটার হো তো নোনদি য্যায়সা।”
নিজের প্রশংসা শুনলে কার না ভাল লাগে! রাগ কমে আসছিল। বললাম, ”আমাকে কিডন্যাপ করলেন কেন? আর ওই চার্লস লোকটাই বা কে?”
”ওয়েট করুন মোশাই। আগে চায়ে মুখে দিন। নাস্তা করুন। গরম—গরম হালুয়া—কচৌরি খান। কাল রাতে তো একদম বেহুঁশ হয়ে ছিলেন।”
কেডিয়ার কথা শেষ হতে—না—হতেই দরজায় টকটক শব্দ। একটা লোক এক হাতে চায়ের ট্রে, অন্য হাতে গরম পুরি আর হালুয়ার প্লেট নিয়ে ঢুকল। লোকটার দুটো হাতই জোড়া। অথচ দরজায় শব্দ করল কী করে, মাথায় ঢুকল না। পরক্ষণেই মনে হল, দরজার বাইরে, নিশ্চয়ই আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে। দরকার পড়লে সে ঢুকবে। একটু সতর্ক হয়ে গেলাম।
চা মুখে দিতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও চুমুক দিলাম। মোষের দুধের চা, প্রচুর চিনি দেওয়া। এই ধরনের চা কলকাতার মাত্র একটা অঞ্চলেই পাওয়া যায়, বড়বাজার। সঙ্গে—সঙ্গে মাথায় এল, যেখানে আছি, সেই জায়গাটা বড়বাজার।
গরম চা পেটে যেতেই মাথাটা সাফ হতে শুরু করল। নিজের মধ্যে ফিরে আসছি। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ”আপনার নাম তো বললেন রাজু কেডিয়া। কাম কী করেন জানতে পারি?”
”জরুর, জরুর। আমার একটা বেটিং সিন্ডিকেট আছে।”
এইবার নামটা আগেও শুনেছি বলে মনে হল, রাজকুমার কেডিয়া! লালবাজারে আমার এক বন্ধু আছে সুদীশ নাগ। ‘অ্যান্টি রাউডি’তে ছিল এক সময়। সম্ভবত তার মুখেই শুনেছি। গত বছর কানপুরে মনোজ প্রভাকর আর নয়ন মোঙ্গিয়ার স্লো ব্যাটিং নিয়ে যখন অনেকে সন্দেহ করেছিলেন ওরা বেটিংয়ে জড়িয়ে, তখন সুদীশ আমাকে ক্রিকেট আর হর্স রেসিংয়ে বেটিং নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছিল। বড়বাজারে নাকি বেটিং চালায় জাবরু বলে একজন। থাকে গণেশ টকিজের সামনে। আর রাজু কেডিয়া বেআইনি বেটিং চালায় ঘোড়দৌড়ের। ক্রিকেটের সঙ্গে তো রাজু কেডিয়ার কোনও সম্পর্ক নেই?
এই কথাটাই প্রশ্নের আকারে মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় কেডিয়া বললেন, ”ঠিকই বলেছেন। কিরকেট বেটিং আমি চালাতাম না। আমার ক্লায়েন্ট, মানে, পান্টাররা আমাকে এক বরস আগে নামাল। ওঁরা সেদিন বললেন, মিঃ কালকেটু নোনদি বলে এক রাইটার আছে…ছোড়িয়ে ওহ সোব বাত। কুছু ইনফরমেশান দিন মিঃ নোনদি। আপনার নাফা হবে।”
”বলুন, কী জানতে চান?”
”আজ ওয়ার্ল্ড কাপের প্রদর্শনী ম্যাচ আছে। নাম্বার ওয়ান, কোন টিম জিতবে। মতলব, জিতার পসিবিলিটি আছে। নাম্বার টু, টোটাল কিতনা স্কোর হোগা। লো স্কোরিং হোবে, না টোটাল স্কোর অ্যাবাভ ফাইভ হান্ড্রেড হোবে।”
”আগে থেকে কি এসব প্রেডিক্ট করা যায়?”
”তাজ্জুব কি বাত! আপনি কী বোলছেন? আরে মোশাই, নিউজিল্যান্ড টিমটা যখন ইখানে খেলছিল, তখুন তো আপনিই প্রেডিক্ট করতেন। পান্টাররা তো আপনার লিখা পড়েই বেটিং করত। একটা ম্যাচে আপনি লিখলেন, বারিশ হোবে। সোব অড চেঞ্জ হোয়ে গেল। জাবরুর বহুত নুকশান হোয়ে গেল।”
কেডিয়ার কথা শুনে উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলাম। ম্যাচের আগের দিন আমাদের ‘প্রিভিউ’ লিখতে হয়। উইকেটের চরিত্র, আবহাওয়া, দু’ দলের শক্তি বিচার করে অনেক সময় ম্যাচ সম্পর্কে মন্তব্যও করতে হয়। আমার লাকটা ভাল, বেশিরভাগ সময়ই মন্তব্যগুলো ঠিক হয়ে যায়। আসলে আমাদের ক্রিকেটার ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভাল হওয়ায়, টিম সম্পর্কে কিছু তথ্য আমি আগে পেয়ে যাই। ওঁরাও আমাকে বিশ্বাস করে বলেন। ফলে ম্যাচ বিশ্লেষণ করতে আমার সুবিধে হয়।
রাজু কেডিয়ার প্রশ্নটা শুনে এবার আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। লোকটা আমাকে লোভ দেখাচ্ছে। একটা বেআইনি কাজে জড়াতে চাইছে। দুটো প্রশ্নের জবাবই আমি জানি। অ্যালান ডোনাল্ড বিশ্ব একাদশ টিমে খেলছেন না। ভারতের ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা বেশি। আর এই ম্যাচটায় কোনওমতেই পাঁচশোর বেশি মোট রান হতে পারে না। টেনশনের ম্যাচ হবে। ইডেনের ‘আউটফিল্ড’ বড়। চার রান, ছ’রান কম হবে। কোনও দলই দুশো—সওয়া দুশোর বেশি রান করতে পারবে না। রাজু কেডিয়াকে যদি এইসব তথ্য দিই, তা হলে লুফে নেবে।
তবু বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, ”আমাকে এসব ফালতু কাজে জড়াবেন না। আমাকে ছেড়ে দিন। ইডেনে যেতে হবে।”
”ধিরজ রাখিয়ে মিঃ নোনদি। আজকের ম্যাচে টু ক্রোর রুপিজ স্টেক হইয়েছে। বহুত টেনশন।”
”দেখুন মিঃ কেডিয়া, এসব কাজের জন্য অন্য লোক আছে। তাদের নাম বলে দিচ্ছি। তারাও খুশি হবে আপনার হয়ে কাজ করতে পারলে।”
”কার কোথা বোলছেন মিঃ নোনদি?”
”এই ধরুন, তন্ময় দত্ত।”
হোহো করে হেসে উঠলেন কেডিয়া। তারপর বললেন, ”ওহ, লোকটা বদমাশ আছে। কুছুদিন আগে পাকিস্তান যাবে বোলে আমার কাছ থেকে রুপিয়া নিয়ে গেল। বোলল, সোব পিলিয়ারদের সনে উনার দোস্তি আছে। আমি ভি ওর কথা বিশ্বাস করলাম। একটো সেলুলার ফোন ভি সনে দিয়ে দিলাম। ইকদম গ্রাউন্ড থেকে যাতে আধা ঘণ্টা বাদ বাদ আমাকে সোব নিউজ দিতে পারে। লোকটা ইমানদারি করল না। ইতো বদমাশ, পরে শুনলাম, জাবরুর কাছ থেকে ভি রুপিয়া লিয়ে গেছে। ওকেও নিউজ দিয়েছে।”
হট করে মনে পড়ল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হওয়ার আগে একবার তন্ময়ের হাতে একটা সেলুলার ফোন দেখেছিলাম বটে! ক্লাবের টেন্টে জুনিয়ার ছেলেদের সেই ফোনটা দেখিয়ে তন্ময় বারফাট্টাই মারছিল। বলেছিল, অফিস দিয়েছে। মরুকগে যাক, আমার কী! আমি জেনেশুনে এইসব বুক মেকারদের সাহায্য করতে রাজি নই। কেডিয়াকে বললাম, ”চার্লসও কি আপনার নিজের লোক?”
”বোলতে পারেন। লেকিন উর সনে আলাপ মাত্র মাস চারেক আগে। ইয়ে আদমি রহতা হ্যায় হংকংমে। পিলিয়ার মোহন চন্দ্রকুমারের গহরা দোস্ত।”
”ও এখানে কী করতে এসেছে?”
”ওহ তো ফোটোগ্রাফার আছে। পিকচার খিঁচে।”
”ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন কেন?”
”আরে মোশাই, উকে বোললাম এক…বেহুদা আদমি করে ফেলল আর এক। উকে বললাম, নিজের ইন্ট্রোডাকশন দিয়ে মিঃ নোনদিকে হোটেলে নিয়ে এসো। সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে। আপনি সাড়ে আট তক বিজি রইলেন। ব্যস, প্ল্যান মুতাবিক কুছু হল না। পাগল আদমি…আপনাকে ইনজিওর করে ইখানে নিয়ে এল। এ আমার গেস্ট হাউস কাম অফিস। চার্লস ভি ইখানেই, অলগ কামরায় আছে।”
”লোকটা ক্রিমিনাল অফেন্স করেছে মিঃ কেডিয়া।”
”আমি মাফি চাইছি।” কী যেন মনে পড়ল কেডিয়ার। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন। তারপর বললেন, ”বেটিংয়ের জন্য আমার এই ইনফরমেশান সোব দরকার। আপনি পাশে—পাশে লিখে রাখবেন। এক ঘণ্টা বাদ আমি আসছি। প্লিজ, আমাকে ডোবাবেন না। নোমোস্কার, মিঃ নোনদি, চলি।”
আর কোনও কথা না বলে রাজু কেডিয়া বেরিয়ে গেলেন। দরজায় ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল। তার মানে, লক করে দিল। এতক্ষণ বিছানায় বসে কথা বলছিলাম। এবার সোফায় এসে বসলাম। ভীষণ খিদে পাচ্ছে। গরম পুরি—হালুয়া, এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে। খালি পেট থাকলে চিন্তা করতে পারব না। তাই খেতে শুরু করলাম। চনমনে খিদে, মন্দ লাগল না।
সুদীশ এই কেডিয়া সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিল, তাতে চট করে ছাড়া পাব বলে মনে হল না। কিন্তু বেলা দুটোর মধ্যে আমাকে ইডেনে পৌঁছতেই হবে। আমার আবার ম্যাচ রিপোর্ট করার কথা। প্রদর্শনী ম্যাচে কোন রিপোর্টার কী করবে, সেইসব দায়িত্ব আমিই ভাগাভাগি করে দিয়েছি। ইডেনে আমাকে না দেখতে পেলে ইন্দ্রনীলরা ঘাবড়ে যাবে। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে লাগলাম, কী করা যায়!
রাজু কেডিয়া যে কাগজটা দিয়ে গেছেন, সেটাই পড়তে শুরু করলাম। পাঁচটা প্রশ্ন তাতে লেখা। (১) টস জিতলে ইন্ডিয়া ব্যাট করবে, না ফিল্ডিং। (২) ইন্ডিয়ার ব্যাটিংয়ে কে ওপেন করবে? (৩) কে খেলবে, যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে। (৪) শচীন ঠিক কত নম্বরে নামবে? (৫) কুম্বলে যদি ভাল বল করতে না পারে, তা হলে আর কেউ স্ট্রাইক বোলার হিসেবে সাকসেস পেতে পারে কি না।
বারবার পড়তে লাগলাম প্রশ্নগুলো। পাঁচটার মধ্যে তিনটে প্রশ্ন সত্যিই অদ্ভুত! অন্তত আমার কাছে তাই মনে হতে লাগল। কে ব্যাটিংয়ে ওপেন করবে এবং শচীন ঠিক কত নম্বরে নামবে, এই দুটো প্রশ্ন আপাতদৃষ্টিতে তেমন কঠিন নয়। কেননা মোহন চন্দ্রকুমার, মনোজ প্রভাকর আগের চারটে ম্যাচে ওপেন করেছে, আর শচীন নেমেছে চার নম্বরে। কিন্তু আমি জানি, ভারতের টিম ম্যানেজমেন্ট এই অর্ডারে ওদের প্রদর্শনী ম্যাচটা খেলাতে চাইছে না। আমি জানি বলেই, প্রশ্ন দুটো পড়ে আমার খটকা লাগল। টিমের দু—একজন ছাড়া এই ব্যাপারটা আর কেউ জানে না। শচীন ওপেন করবে মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে। মনোজ যাবে ছয় নম্বরে। রাজু কেডিয়ারা সম্ভবত এই খবরটা কারও মারফত পেয়েছেন। টিমের কাছাকাছি কেউ ওঁদের খবর দিচ্ছেন। আমার কাছে ঝালিয়ে নিয়ে কেডিয়া আরও নিশ্চিত হতে চান।
প্রশ্নগুলো পড়ে আরও দুটো ব্যাপারে খটকা লাগল। জাদেজা অসুস্থ হলে…আর কুম্বলে ভাল বল করতে না পারলে…এই দুটো প্রশ্নের মানেটা কী? মাথামুন্ডু বুঝতে পারলাম না। লালবাজারে সুদীশ আমাকে একবার বলেছিল, একদিনের ম্যাচে এখন হিউম্যান ফ্যাকটরের ওপর কেউ বাজি ধরে না। আগে ধরত। যেমন প্রথম বলে কেউ আউট হবে কিনা। কেউ সেঞ্চুরি পাবে কিনা। কোন ক্যাপ্টেন টস জিতবে…এইসব। এই ধরনের বাজি—তে গড়াপেটা করা সম্ভব। এখন একদিনের ম্যাচে স্রেফ দু’ ধরনের বাজি। কোন দল জিতবে এবং দু’ দল মোট কত রান করবে।
সোফায় বসে আকাশ—পাতাল ভাবছি, এমন সময় দরজায় ফের খুট করে শব্দ। দেখি, গতকালের সেই বিদেশি লোকটা। দেখেই প্রচণ্ড রাগ হল। কিন্তু লোকটার মনে কোনও অপরাধবোধ নেই। স্বাভাবিক গলায় বলল, ”কাল রাতে তোমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। তার জন্য ক্ষমা চাইতে এলাম।”
একটা ঘুসিতে চার্লসের চোয়াল আমি ভেঙে দিতে পারি। কিন্তু সেটা করার সময় পরে পাব। ঠান্ডা গলায় বললাম, ”তোমাকে ক্ষমা করার কোনও প্রশ্নই নেই।”
”তুমি রাগ করেছ বন্ধু। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই তোমার মনে হচ্ছে, লোকটার চোয়াল ভেঙে দিই।”
আরে, লোকটা কি থট রিডিং জানে নাকি? কী করে বুঝল, ঠিক ওই ইচ্ছেটাই আমার করছে? একটু রেগেই বললাম, ”যতক্ষণ না তোমাকে পালটা মারছি, ততক্ষণ আমি শান্তি পাব না।”
সোফায় পা ছড়িয়ে বসল চার্লস। হালকাভাবে বলল, ”সে চেষ্টা করতে যেয়ো না বন্ধু। আমি জানি, তুমি গজুকাই ক্যারাটের ব্লু বেল্ট। জানিয়ে রাখি, আমি কিন্তু কিওকুশিনে ব্ল্যাক বেল্ট করে রেখেছি।”
ফিকফিক করে হাসছে চার্লস। দেখে আমার গা জ্বলে গেল। লোকটা অসম্ভব বুদ্ধিমান। এর সঙ্গে লড়তে হবে বুদ্ধি দিয়েই। বললাম, ”কী চাও?”
”দ্যাটস লাইক আ গুড ম্যান। আর্জেন্ট দরকার। তোমাদের টিমের মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে এখুনি আমাদের একবার কথা বলতে হবে। কিন্তু প্রবলেমটা হচ্ছে, ও আমার বন্ধু, এ—কথাটা বারবার বলা সত্ত্বেও হোটেল থেকে ওর ঘরে লাইন দিচ্ছে না। বলছে, বাইরের কোনও ফোনই দেওয়া যাবে না। ওঁরা কিছুতেই কথা বলতে দিচ্ছেন না মোহনের সঙ্গে। লাইনটা বারবার কেটে দিচ্ছেন। তুমি ফোন করলে উনি না করতে পারবেন না।”
”এই কাজটা করে দিলে কি তোমরা আমাকে ছেড়ে দেবে?”
”এইট্টি পারসেন্ট, ইয়েস।”
”হান্ড্রেড পারসেন্ট নয় কেন?”
”আরও একটা কাজ তোমাকে দিয়ে আমরা করাতে চাই। বেলা বারোটা— সাড়ে বারোটার সময়। দেন ইউ আর ফ্রি।”
কী ভেবে বললাম, ”ঠিক আছে, কানেকশনটা দিতে বল।”
চার্লস পকেট থেকে একটা কর্ডলেস ফোন বের করল। তারপর নিজেই হোটেলে ডায়াল করে বলল, ”নাও, কথা বল।”
ম্যানেজারকে চাইলাম। এদিকে চার্লস উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলে রাখা প্যারালাল ফোনের রিসিভারটা তুলল।
”নমস্কার, কালকেতু বলছি।”
”আরে, কাঁহা থে তু দাদা। কাল থেকে তোমাকে খোঁজ করছি। কর্নেল তোমাকে কিছু বলেনি?”
কর্নেল মানে দিলীপ বেঙ্গসরকার। বললাম, ”হ্যাঁ বলেছে। এত ব্যস্ত ছিলাম যে, ফোন করার সময় পাইনি। আমাদের টিম কীরকম শেপ—এ আছে?”
”গুড, ভেরি গুড। তবে আজ সকালে ইন্টারেস্টিং একটা ডিভেলাপমেন্ট হয়েছে।”
”কী সেটা?”
”দাদা, ফোনে বলা যাবে না। একটু আসতে পারবে বেলা এগারোটা—সাড়ে এগারোটা নাগাদ।”
”না, ভাই। সোজা মাঠে যাব।”
”তুমি এলে ভাল হত। একটা ব্যাপারে ডিসকাশন করতাম।”
”অজয় জাদেজা আর মনোজকে দিয়ে কেউ—কেউ ওপেন করাবার কথা বলছে। জানি না, হঠাৎ কথাটা উঠল কী করে! একটু আগে একজন এসেছিলেন। আকারে—ইঙ্গিতে তিনিও একই কথা বলে গেলেন।”
”আজ্জুভাই কী বলছে?”
”ও তো চায়, মোহন আর শচীনকে খেলাতে।”
”শচীন কী চাইছে?”
”ওর কোনও আপত্তি নেই।”
”আর কী খবর?”
”তুমি কোনও খবর দেবে?”
”আমি একটা খবর দিচ্ছি, সাউথ আফ্রিকা টিমে আজ কিন্তু ডোনাল্ড খেলছে না। আর যদি খেলেও, খুব একটা এফেক্টিভ হবে না।”
”কেন?”
”কাল বিকেলের দিকে ওর ফুড পয়জন হয়েছে।”
”আজ কোনও কাগজে তো বেরোয়নি।”
”কেউ পায়নি।”
”তাই বল! তোমার কাগজেই তো আজ ডোনাল্ডের ইন্টারভিউ বেরিয়েছে, শচীনের উইকেটটা আমার চাই।”
”ওগুলো সকালের দিকে নেওয়া ইন্টারভিউ। যাকগে, আপনি কি ঠিক করলেন? জাদেজাকে দিয়ে ওপেন করালে, মোহনকে কোথায় নামাবেন?”
”তুমি যে খবরটা দিলে, তারপর তো আমাকে নতুন করে সব ব্যাটিং অর্ডার ভাবতে হবে।”
”বি কেয়ারফুল। খেলাটা ইডেনে। সারা ভারতের লোক এই ম্যাচটার দিকে তাকিয়ে আছে। খারাপ কিছু হলে, আপনি কিন্তু স্কেপগোট হয়ে যাবেন।”
”ঠিকই বলেছ। ফাইনাল ডিসিশনটা আমাকেই নিতে হবে। আচ্ছা, তোমার কী মনে হচ্ছে, কালকেতু?”
প্রশ্নটা এত আকস্মিক, কী উত্তর দেব চট করে ভেবে পেলাম না। বললাম, ”মোহন ছেলেটা এত আনঅর্থোডক্স, কী বলি বলুন তো!”
”দ্যাখো, টস যদি জিতি তা হলে ব্যাট নেব না। রান চেজ করে জিততে চাই। সেজন্য ওপেনিং পার্টনারশিপটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পনেরো ওভারের মধ্যে ৬০ বা ৬৫ রান তুলতেই হবে। এবং কোনও উইকেট না হারিয়ে। না হলে পুরো ছকটাই ভেস্তে যাবে।”
”মোহন ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
”শিওর। তবে ছেলেটা ঘরে আছে কি না, দেখতে হবে। কাল রাতে ছেলেটা ঘণ্টাদুয়েকের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল। পার্ক স্ট্রিটের একটা রেস্তরাঁয় নাকি ডিস্কো নাচছিল। এই ছেলেটা কোনও ডিসিপ্লিনের ধার ধারে না। হংকংয়ে মানুষ তো! বড্ড বেশি ফাস্ট লাইফ।”
হেসে বললাম, ”রেস্তরাঁয় যাক বা ডিস্কোতে। ম্যাচটা জেতাক।”
”প্রে টু গড কালকেতু। ওয়াতন কে লিয়ে। ফোনটা একটু ধরে থাকো। আমি দেখি ছেলেটা কাছাকাছি আছে কিনা।”
চার্লসের দিকে তাকাতেই ইশারায় ও কর্ডলেস ফোনটা চাইল। আমি বসে রইলাম সোফায়। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম ইংরেজিতে। বলাটা বোধ হয় ভুল হল। আগে খেয়াল হয়নি, চার্লস আমাদের প্রতিটি কথা শুনছে। অনেক খুঁটিনাটি খবর ও পেয়ে গেল। ও—প্রান্তে মোহন চন্দ্রকুমার ফোন ধরেছে। চার্লস ওর সঙ্গে কথা বলছে। চিনা ভাষায়। যার একবর্ণ আমি বুঝতে পারলাম না।
দু—তিন মিনিট কথা বলে, বেশ ব্যস্ততার সঙ্গে চার্লস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওর মুখে তখন যুদ্ধজয়ের হাসি। আদৌ বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ কেন ও এত উৎফুল্ল!
।।৩।।
সকাল থেকে একটা সিগারেটও খাইনি। খুব ইচ্ছে করছিল। অন্যদিন বেলা দশটার মধ্যে গোটাতিনেক সিগারেট খাওয়া হয়ে যায়। পকেট হাতড়ে দেখলাম, প্যাকেট নেই। তবে লাইটার আছে। কে এনে দেবে আমাকে সিগারেট?
মনে আশা নিয়েই টেলিফোনের রিসিভারটা তুললাম। ও—প্রান্তে সাড়া পেতেই জিজ্ঞেস করলাম, ”বিহারি আছে? উসকো জেরা ভেজ দেনা।” আধঘণ্টা আগে রাজু কেডিয়া এই লোকটাকেই নাস্তা আনতে ডেকেছিল।
”বিহারি নেহি হ্যায় সাব। আফজল কো ভেজ দুঁ?”
”চলেগা।”
”কেয়া চাহিয়ে সাব আপকো?”
”সিগারেট।”
”ঠিক হ্যায় সাব। আভি ভেজ দেতা।”
মিনিটপাঁচেক পর আফজল লোকটা একটা সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ঢুকল। লোকটা টেবিলের ওপর থেকে ডিশ আর চায়ের কাপগুলো গোছাতে—গোছাতে হঠাৎ চাপা গলায় বলল, ”সাব, আপ রিপোর্টার হ্যায় না?”
চমকে উঠে বললাম, ”কী করে জানলে?”
”আপনাকে মহমেডান মাঠে দেখেছি। আমি মহমেডান ক্লাবের সাপোর্টার। আপনাকে সেক্রেটারি খুব সম্মান করে।”
”হ্যাঁ, ওর সঙ্গে আমার খুব জানাশোনা আছে।”
”সাব, আমাদের টিমটা কি আই এফ এ শিল্ড জিততে পারবে?”
”জেতা খুব কঠিন। আফজলভাই, একটা কাজ করে দেবে?”
”বলুন।”
”এখান থেকে কীভাবে বেরিয়ে যেতে পারব, বলবে?”
”আমার নোকরি চলে যাবে, সাব।”
”তুমি পরে রিপোর্টারদের টেন্টে এসো। তোমার চাকরি আমি করে দেব।”
”ড্রেসিং টেবিলের পাশে একটা সুইচ আছে সাব। ওটা দাবিয়ে দিন। রাস্তা পেয়ে যাবেন। তবে এখন নয়, মিনিটদশেক পরে।”
ডিশ—কাপ নিয়ে আফজল বেরিয়ে গেল। পা চালিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেলাম। ভাল করে খুঁজতেই তলার দিকে একটা সুইচ দেখতে পেলাম। ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘণ্টাখানেক এই ঘরের সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেছি। কোনও কিছু চোখে পড়েনি। আফজল না বলে দিলে জানতেই পারতাম না, ঘরের একটা গোপন দরজা আছে। কেডিয়ারা ধান্দাবাজ লোক। কতরকম ব্যবস্থাই না এরা করে রাখে!
মিনিট সাত—আট পরে সুইচটা টিপলাম। একটা ঘর্ঘর আওয়াজ হল। কিছু একটা সরে গেল বলে মনে হল। কিন্তু ঘরের মধ্যে তার কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না। দেওয়াল, মেঝে, সিলিং—সব কিছু তন্নতন্ন করে দেখলাম। না, কোথাও কোনও সামান্য ফাঁকও নেই। কী হল ব্যাপারটা? আওয়াজটা যে নিজের কানে শুনেছি। কী ভেবে বাথরুমে ঢুকলাম। ঢুকেই দেখি, বেসিনের পাশে একটা দরজা হাঁ করে খোলা।
ছোট্ট একটা কাঠের সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে। মিনিটখানেক কান পেতে রইলাম। না, নীচ থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। খুব সাবধানে পা রাখলাম সিঁড়িতে। হাতের কাছেই একটা সুইচ। নিশ্চয়ই দরজাটা বন্ধ করার। কী ভেবে সেটা টিপে দিলাম। ঘর্ঘর শব্দে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে—সঙ্গে সিঁড়িতে রাতের অন্ধকার নেমে এল। কী ভেবে ফের সুইচ টিপে দরজাটা খোলা রাখলাম।
পকেটে লাইটার ছিল, জ্বালালাম। ফিকে আলোয় পা টিপে—টিপে নেমে এলাম নীচে। ছোট্ট ঘর, জানলা—দরজা বলে কিছু নেই। কয়েকটা স্টিলের আলমারি, একটা ইজিচেয়ার। মনে হল, অ্যান্টি চেম্বার গোছের কিছু। নিশ্চয়ই পাশের ঘরে যাওয়ার কোনও দরজা আছে। দেওয়ালে নজর বোলাতে—বোলাতে হঠাৎ একটা হ্যান্ডেল পেয়ে গেলাম। দরজার পাশেই একটা সুইচ বোর্ড। মাত্র দু’টি সুইচ। একটা টিপতেই উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল ঘরটা।
এই ঘরে একটু আগে নিশ্চয়ই কেউ ছিল। ইজিচেয়ারের লম্বা হাতলে একটা ফাইল রাখা। ঘরের বাতাসে মৃদু গন্ধ আতরের। হঠাৎ মনে পড়ল, রাজু কেডিয়ার কানের পেছনে আতর—ভেজা একটুকরো তুলো দেখতে পেয়েছিলাম। তার মানে রাজু কেডিয়া একটু আগে এই ঘরে এসেছিল। চেয়ারের হাতল থেকে ফাইলটা তুলে পাতা ওলটাতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
প্রথম পাতায় লেখা: বিয়ার্ড
১২/৩/৯৬ ৭০ পয়সা ইন্ডিয়া ৫০০০
১৩/৩/৯৬ ৩০ পয়সা বিশ্ব একাদশ ৭০০০
১৩/৩/৯৬ ৪৫ পয়সা ইন্ডিয়া ১০০০০
পরের পাতায় লেখা : লায়ন। তার নীচে তারিখ, পয়সার দর, দলের নাম ও সংখ্যা। এক—এক পাতায় এক—একটা অদ্ভুত নাম। ফাইলের পাতাগুলো কম্পিউটার থেকে ছেঁড়া। দেখলেই বোঝা যায়।
মাথা সাফ হতে শুরু করল। এগুলো সব ‘কোড’, যাঁরা বেটিং করেন অর্থাৎ পান্টারদের। কারও আসল নাম নেই। বিয়ার্ড মানে এমন একজন লোক, যার দাড়ি আছে। লায়ন মানে সম্ভবত, লোকটার পদবি সিংহ। এঁদের নাম ‘বুকমেকার’ ছাড়া আর কেউ জানতে পারবেন না। ফাইল উলটে দেখলাম, শ’পাঁচেক পাতা আছে।
লালবাজারে সুদীশ নাগ একবার গল্প করেছিল, বড়—বড় বুকমেকাররা দিনের দিন পেমেন্ট দেন না। পান্টাররা এমন পয়সাওয়ালা লোক, হিসেব—নিকেশ হয় সপ্তাহের শেষে। পান্টাররা টেলিফোনে বাজি ধরেই খালাস। সারা সপ্তাহেই বিশ্বের কোথাও—না—কোথাও ক্রিকেট সিরিজ বা একদিনের ম্যাচ হচ্ছে। সিডনি, জোহানেসবার্গ, বার্বাডোজ, অকল্যান্ড, যেখানেই ম্যাচ হোক না কেন, পান্টাররা কলকাতায় বসেই বাজি ধরেন। এটা একটা অদ্ভুত নেশা। সপ্তাহের শেষে হার—জিতের হিসেব—নিকেশ করে তাঁরা টাকা—পয়সা বুঝে নেন। সবকিছুই চলে মুখে—মুখে। কেউ কাউকে ঠকান না।
ফাইলটা যথাস্থানে রেখে পা টিপে—টিপে দরজার কাছে গেলাম। এখন থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। আলোটা নিভিয়ে হ্যান্ডেলটা ঘোরাতেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি, বিরাট একটা হলঘর। চমৎকার সাজানো—গোছানো। কোনও মার্কেন্টাইল অফিসের মতো। এক কোণে একটা এগজিকিউটিভ টেবিলের সামনে বসে আছেন রাজু কেডিয়া। টেবিলের ওপর গোটা দশেক ফোন। সাদা, লাল, সবুজ রঙের। পাশেই কম্পিউটার। কেডিয়ার উলটো দিকে বসে অন্য একজন। পাশ থেকে দেখে চেনা—চেনা মনে হল। পেটানো চেহারা, গায়ে লাল রঙের টি—শার্ট। বসার ঋজু ভঙ্গিতে বোঝা যায় ভদ্রলোক একসময় খেলাধুলো করতেন। তিনি কেডিয়াকে কী যেন বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কেডিয়া ঘাড় নেড়ে একবার অ্যান্টি চেম্বারের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আর তখনই ভদ্রলোক পেছন দিকে তাকলেন।
আরে, এ তো সুনীত রেড্ডি! দেখেই চিনতে পারলাম। প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার। উনি এখানে? রেড্ডিও কি বেটিং সিন্ডিকেটে জড়িয়ে? বছর দশেক হল খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেট মহলে এখনও ওঁর বেশ দাপট। প্রতি বছর রেড্ডি, কোনও—না—কোনও জায়গায়, কোনও—না—কোনও একটা কারণে বেনিফিট ম্যাচ বা মশালা ম্যাচের ব্যবস্থা করেন স্টার ক্রিকেটারদের নিয়ে। বোর্ড—কর্তারা মশালা ম্যাচের নিয়ম—কানুন বেঁধে দেওয়ার পরও রেড্ডিকে দমাতে পারেননি। মাসআটেক আগেও, প্লেয়ারদের নিয়ে তিনটে ম্যাচ উনি খেলে এসেছেন বিদেশে। প্রচুর টাকা—পয়সার ব্যবস্থা করে দেন বলে, ক্রিকেটারদের মধ্যে রেড্ডি খুব জনপ্রিয়। বিশ্বকাপের সময় উনি সব জায়গায় ভারতীয় দলের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছেন। নিজের খরচে থাকছেন বড়—বড় হোটেলে। চাকরি তো করেন হায়দরাবাদের এক ব্যাঙ্কে। তবু এত বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন কী করে, তা নিয়ে আমারও মাঝেমধ্যে কৌতূহল হয়। ওঁকে কেডিয়ার সঙ্গে দেখে, এখন মনে হচ্ছে, টাকাটা উনি পান কোত্থেকে!
দু’জনের কথাবার্তা কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, রেড্ডি কোনও একটা ব্যাপারে কেডিয়াকে কিছু বোঝাতে চাইছেন। অথচ কেডিয়া সেটা মানছেন না। রেড্ডি হঠাৎ ফোন করলেন কাউকে। খানিকক্ষণ কথা বলে কর্ডলেস ফোনটা এগিয়ে দিলেন কেডিয়ার দিকে। মিনিটখানেক পর দেখি, রেড্ডি উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর টেবিলের ওপর রাখা ব্রিফকেসটা নিয়ে গটগট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
দরজার ফাঁক থেকে চোখটা সরিয়ে নিলাম। আফজল বলেছিল, ড্রেসিং টেবিলের পাশের সুইচটা টিপলেই, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা পাব। কী পরামর্শ দিল ও? বেরোতে হলে কেডিয়ার সামনে দিয়েই বেরোতে হবে। যেটা সম্ভবই না। আর লোকটাও যেন জেঁকে বসে আছে। ফের চোখ লাগিয়ে দেখলাম, ঘন—ঘন টেলিফোন আসছে। কেডিয়া রিসিভার তুলছেন। হেসে কথা বলছেন। তারপর খসখস করে কী যেন লিখে নিচ্ছেন। খেলা শুরু হওয়ার সময় যত এগিয়ে আসে, বুকমেকারদের ব্যস্ততা নাকি ততই বেড়ে যায়। সুদীশ বলেছিল, পান্টাররাও নানা জায়গা থেকে ম্যাচ সম্পর্কে খবর জোগাড় করেন। আন্দাজ করেন, তারপর বেট ধরেন। তাই এই সময়টায় কেডিয়া সিট ছেড়ে উঠবেন বলে মনে হল না।
দরজা সামান্য ফাঁক করে সব দেখছি। এদিকটায় কেডিয়ার নজর পড়লেই সর্বনাশ! আস্তে—আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। অন্য কোনও উপায় খুঁজতে হবে, যাতে পাশের ঘরে নজর রাখা যায়। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাঠের দেওয়াল আর সিলিংয়ের মাঝে এক ফুট করে কাচের শো—কেস। তাতে ফাইলপত্র ঠাসা। পাশের ঘরে কী হচ্ছে, দেখা সম্ভব নয়। অগত্যা ‘কি—হোল’—এর মাঝে চোখ দিলাম।
উলটো দিকের দরজা দিয়ে একটা লোক ঢুকল। হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হল চার্লস। কেডিয়া কম্পিউটারের ‘কি—বোর্ড’—এ কী যেন করছেন। এত ব্যস্ত যে, ইঙ্গিত করে বসতে বললেন চার্লসকে। লোকটাকে দেখামাত্রই চিনচিনে রাগ হতে শুরু করল। এত বড় একটা ম্যাচের আগে, এই ঝামেলায় পড়ার জন্য দায়ী এই লোকটাই। বড় ম্যাচের দিন রোজ সকাল থেকেই আমি মনঃসংযোগ করি। কম কথা বলি। তাতে ম্যাচ রিপোর্টটা ভাল করা যায়। আজ তা তো কিছুই হল না। উলটে বন্দি হয়ে আছি এইরকম একটা জায়গায়।
মিনিটপাঁচেক ধরে কেডিয়া আর চার্লসকে লক্ষ করতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি, দু’জনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে, কথা বলতে—বলতে অ্যান্টি চেম্বারের দিকে আসছেন। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ওপরের দরজাটা খোলা। তবে ওই জায়গাটায় ঘন অন্ধকার। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। তা করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছতে—না—পৌঁছতেই নীচের দরজায় খুট করে শব্দ। একবার ভাবলাম, সুইচ টিপে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিই। কিন্তু সুইচ টিপলেই দরজাটা ঘর্ঘর শব্দ তুলে বন্ধ হবে। কেডিয়া আর চার্লস তা শুনতে পাবেন। তাই দরজাটা খোলা রেখেই বাথরুমের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কান পেতে রইলাম।
নীচে কেডিয়ার গলা, ”সকালে টিভি নিউজে বলেছে, অ্যালান ডোনাল্ড খেলবে না। ইজ ইট ট্রু?”
চার্লসকে বলতে শুনলাম, ”এই খবরটা আপনাকে কে দিল?”
”একজন পান্টার ফোন করে জানাল।”
”ভুল খবর মিঃ কেডিয়া। আমি একটু আগেই চেক করেছি। আপনার রিপোর্টার ন্যান্ডি এই খবরটা তখন ইন্ডিয়ান টিম ম্যানেজারকে ফোনে দিচ্ছিল। তারপরেই কথা বলে জানলাম, ডোনাল্ডের না খেলার খবরটা বিশ্ব একাদশ ক্যাম্প থেকে ইচ্ছে করে রটানো হচ্ছে।”
”তুমি কী করে এত নিশ্চিত হলে?”
”বললাম তো বিশ্ব একাদশ টিমের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি।”
”শুধু—শুধু ফালতু কথা রটবে কেন?”
”গেমসম্যানশিপ। আপনি এসব বুঝবেন না।”
”মোহন চন্দ্রকুমারের সঙ্গে কথা বলেছ?”
”বলেছি।”
”ও কাজটা করতে পারবে তো ঠিকঠাক?”
”পারবে।”
”কাজটা তো ব্রেকফাস্টের সময়ই করতে পারত।”
”সেটা রিস্ক নেওয়া হয়ে যেত।”
”কেন?”
”যে ওষুধটা আমরা দিচ্ছি, সেটা সত্যিই খুব দ্রুত কাজ দেয়। ইন্ডিয়ান টিম ব্রেকফাস্ট করেছে সকাল আটটায়। খেলা দুটোয়। সকালে ওই কাজটা করলে, ঘণ্টাছয়েক মাত্র ওষুধের অ্যাকশন থাকত। তার মানে বেলা দুটো নাগাদ ওই তিনটে প্লেয়ার কিছুটা ফিট হয়ে যেত। আমাদের এত প্ল্যান কোনও কাজেই লাগত না। তার চেয়ে লাঞ্চ টেবিলে…চেষ্টা করাই ভাল। আর ঘণ্টাদেড়েক পর টিম লাঞ্চ করবে।”
”কোন তিনটে প্লেয়ারকে টার্গেট করেছ?”
”সেরা তিনটে প্লেয়ারকে।”
”এই তিনটে প্লেয়ারই আসল। ঠিক আছে। ওষুধটা মোহনের কাছে পৌঁছে দিয়েছ?”
”হ্যাঁ। কাল রাতে পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁয় ও এসেছিল। ডিস্কো নাচার ফাঁকে ওর হাতে গুঁজে দিয়েছি। পুরো একটা ফাইল।”
”পরে ধরা পড়বে না তো?”
”কোনওমতেই না। যার সঙ্গে ট্যাবলেটটা ও মেশাবে, সেটা পরীক্ষা করলেও ওষুধের কোনও চিহ্ন কেউ খুঁজে পাবে না। তোমাদের চার্লস স্মাগলারের কথা মনে আছে? ব্যাঙ্ককে ওর সঙ্গে আমার একবার আলাপ হয়েছিল। একই নামের শুরুটা, তাই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তা, ওই ওষুধটাই সে খুব ব্যবহার করত, ওর শিকারকে কাবু করার জন্য।”
”দ্যাখো, পরে যেন কোনও গণ্ডগোল না হয়। আমি জড়িয়ে আছি, জানাজানি হলে কলকাতায় টিকে থাকতে পারব না। তোমার আর মোহনের কী! তোমরা তো কালই হংকং পালাবে।”
”মিঃ কেডিয়া, ন্যান্ডির কী হবে?”
”ওকে ঠিক খেলার আগে ছেড়ে দেব।”
”ঠিক আছে। আমাকেও মাঠে যেতে হবে। মোহনের সঙ্গে দেখাও হবে, মাঠে ওরা যখন খেলতে নামবে। আমি ফোটোগ্রাফার হয়ে মাঠের ভেতর থাকব। ওখান থেকে সেলুলার ফোনে তোমাকে শেষ খবরটা দিয়ে দেব। আমি একটু বেরোচ্ছি। আধঘণ্টা পর ফিরব।”
”ঠিক আছে। মাঠ থেকে ফিরে আসার পর না হয় তোমার আর মোহন চন্দ্রকুমারের হিসেবপত্র ‘সেটল’ করে নেব।”
”ও কে।”
কয়েক সেকেন্ড পর দরজায় খুট করে একটা শব্দ হল।
বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনে আমার প্রায় হার্টফেল হওয়ার অবস্থা। এ তো পরিষ্কার ষড়যন্ত্র! সিঁড়ির সুইচ টিপে, দরজা বন্ধ করে, বেসিনের কাছে গিয়ে আমি প্রথমে চোখে—মুখে জল ছেটালাম। উত্তেজনায় সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। মোহন চন্দ্রকুমারকে দিয়ে এরা ইন্ডিয়া টিমের চরম ক্ষতি করতে যাচ্ছে! দেশের ক্ষতি করবে। বেটিংয়ে লাভ করার জন্য!
টিম ম্যানেজারের কাছে এখনই খবরটা পৌঁছে দেওয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে? বসে—বসে ভাবতে লাগলাম। আর একটা মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করা যাবে না। মোহন চন্দ্রকুমার যাতে কোনওমতেই লাঞ্চ টেবিলে ওই তিন ক্রিকেটারের ধারে—কাছে না যেতে পারে, অথবা উলটোটা। হোটেলে ফোন করে ম্যানেজারকে বলে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কেডিয়ার ফোন তো ব্যবহার করা যাবে না। অপারেটর সব শুনে ফেলবে।
দ্রুত কী করা যায় ভাবছি। আফজলকে ডেকে এনে একটা চিঠি লিখে পাঠালে, সেটা পৌঁছবে না ম্যানেজারের কাছে। আফজলের মতো লোক কাছেই ঘেঁষতে পারবে না। আফজলকে আমাদের অফিসে পাঠানো যায়, ইন্দ্রনীলের কাছে। ইন্দ্রনীল এখন অফিসে পৌঁছে গেছে। ও ফোন করে দিতে পারে। কথাটা মনে হতেই ভাবলাম, আফজলকে অফিসে পাঠাব কেন? ইন্দ্রনীলের কাছে ফ্যাক্স মারফত এই মেসেজটা তো অনেক আগেই পৌঁছে যাবে। মেসেজটা অবশ্য লিখব আমাদের সাঙ্কেতিক ভাষায়। যাতে এখানে বা অফিসে কেউ না বুঝতে পারে।
কেডিয়ার টেবিলের পাশে আমি একটা ফ্যাক্স মেশিন দেখেছি। ও কি আমাকে মেসেজ পাঠাতে দেবে? চেষ্টা করে দেখিই না! এই ভেবে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা ফোনের রিসিভারটা তুললাম। একটু পরেই অন্য প্রান্ত থেকে অপারেটর বলল, ”বোলিয়ে সাব।”
”কেডিয়ার সঙ্গে কথা বলা যাবে?”
”জরুর।”
একটু পরেই কেডিয়ার গলা, ”বলুন মিঃ নোনদি। কী করতে পারি আপনার জন্য।”
”একটা ফ্যাক্স মেসেজ পাঠাব। আমার কলিগের কাছে।”
”আমাকে বিপদে ফেলবেন না তো?”
”না। ক্রিকেট নয়, ফুটবল ম্যাচ দিয়ে ‘ইনস্ট্রাকশন’ পাঠাব।”
”ঠিক আছে। লিখে ফেলুন। হামার লোগ গিয়ে নিয়ে আসবে।”
”না। আমি সামনে দাঁড়িয়ে পাঠাতে চাই।”
”ঠিক হ্যায়। যেমুন আপনার মরজি। দশ—পন্দরা মিনিট পর হামার লোগ যাবে আপনার কাছে।”
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে, টেবিলে রাখা রাইটিং প্যাড থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে লিখতে বসলাম। এই মেসেজটা যদি ইন্দ্রনীলের কাছে পৌঁছয় তা হলে বিরাট একটা কেলেঙ্কারির হাত থেকে আমাদের টিম বেঁচে যাবে।
ইন্দ্রনীল,
ডি সি এম ফুটবলে আজ মোহন
বাগানের ম্যাচ আছে। অমিতাভ চন্দ্র
টিমের সঙ্গে যায়নি। রবি কুমার
দিল্লিতে। বলবি ও যেন
ম্যাচটা লিখে পাঠায়। ইন্ডিয়া
টিমের নির্বাচন এবার দিল্লিতেই। টিমের
জন্য কে চান্স পাবে, নামী প্লেয়ারদের
মধ্যে কে বাদ যাবে, তার সঙ্গে
কোচ আক্রামভকেও আজ লাঞ্চ
টেবিলে ধরে একটা রিপোর্ট করতে
বলবি। আক্রামভ প্রথম দিকে না
বলতে পারে। এড়িয়ে যেতে পারে।
ও যা—ই বলুক, রবিকে বলবি জরুরি
এই ইন্টারভিউটা। ইন্ডিয়া ক্যাম্পের খবরটা
রোজ করা দরকার। আমি ফোনে ম্যানেজারকে
ধরছি।
মাঠে খবর দিবি।
—কালকেতুদা।
লেখাটা শেষ হতেই দরজায় খুট করে একটা শব্দ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আফজল। বলল, ”কেডিয়া সাব আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
দু’জনে মিলে নীচের তলায় নেমে এলাম। কেডিয়ার ঘরটা উলটো দিক থেকে একটু আগে দেখেছি। যত বড় মনে হয়েছিল, তত বড় নয়। ঘর থেকে বেরোলেই সিঁড়ি। নীচে নেমে যেতে অসুবিধে হবে না। এই তলায় কয়েকটা অফিসও রয়েছে। লোক ওঠা—নামা করছে সিঁড়ি দিয়ে।
দেখা হতেই কেডিয়া বললেন, ”আমার অপারেটর বসে আছেন। ওকে মেসেজটা দিন।” দেখি, ফ্যাক্স মেশিনের সামনে এক ভদ্রমহিলা বসে। হাত বাড়িয়ে তিনি কাগজটা নিলেন। পুরোটা পড়ে একবার রাজু কেডিয়ার দিকে তাকিয়ে তিনি ঘাড় নাড়লেন। তারপর নম্বর ডায়াল করতে লাগলেন আমাদের অফিসের। আমার বুকটা ঢিপঢিপ করছিল। এবার যে মেসেজটা পাঠাচ্ছি, তা একটু অন্য ধরনের। প্রতি লাইনের শেষ অক্ষর নয়, শেষ শব্দটা পরপর সাজিয়ে নিলেই ইন্দ্রনীল বুঝতে পারবে, কী বলতে চাইছি।
”ইন্দ্রনীল, মোহন চন্দ্রকুমার যেন ইন্ডিয়া টিমের প্লেয়ারদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে না পারে। জরুরি খবরটা ম্যানেজারকে দিবি। —কালকেতু।”
দমবন্ধ করে আছি। ভদ্রমহিলা ফ্যাক্স মেশিনের মধ্যে কাগজটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। নম্বর লেগে গেলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটা অফিসে পৌঁছে যাবে। এই একটা সময়, যখন আমরা সত্যিই টেনশনে ভুগি। ফ্যাক্স মেশিনটা তখন আমাদের কাছে দেবতা। তিনি তুষ্ট না হলে, সারাদিনের পরিশ্রমটাই বরবাদ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ পাতাটা ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল। অর্থাৎ কী না লাইন পাওয়া গেল। মেসেজটা অফিসে যাচ্ছে। উফ, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
রাজু কেডিয়া কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন। আমাকে বললেন, ”মিঃ নোনদি, আপনি একটু বসুন। আপনার সনে বাতচিত আছে।”
অগত্যা উলটোদিকের চেয়ারে বসলাম। আমার অন্তত কোনও দরকার নেই এই পাজি লোকটার সঙ্গে। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচি।
”হামার একটা পোরপোজাল আছে মিঃ নোনদি। গুসসা করবেন না। আপনি জেন্টলম্যান আছেন। আপনার সনে একটা ডিল করতে চাই। আপনি আমাদের অ্যাডভাইসর আছেন। আপনি আমাদের অ্যাডভাইসর হয়ে কাজ করুন।”
”মাফ করুন, আমার পক্ষে সম্ভব না।”
”কেনো মিঃ নোনদি?”
”আপনারা যা করছেন, বেআইনি।”
”আপনি ঠিক বলছেন না। আপনি উইলিয়াম হিল আর ল্যাডব্রোকের নাম তো নিশ্চিত জানেন। আমরা ওদের মতো কাজই করছি। তা হলে ইললিগ্যাল বলছেন কেনো?”
উইলিয়াম হিল আর ল্যাডব্রোক ইংল্যান্ডের নামী দুটি বেটিং সংস্থা। ওই দুটি সংস্থাই সরকার অনুমোদিত। কেডিয়া ওদের নাম করায় আমি বিরক্তি সহকারেই বললাম, ”ওদের সঙ্গে আপনার এই সিন্ডিকেটের তুলনা করবেন না।
”কেনো, ওদের মতো কেরডিবিলিটি হামারও আছে মোশাই। হামার ক্লায়েন্টদের জিজ্ঞাসা করুন, কেউ কখনও এক রুপিয়া ভি চিট হয়নি। পেমেন্ট সোব বাড়িতে পৌঁছে গেছে।”
”মিঃ কেডিয়া, আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। দয়া করে এবার আমাকে মাঠে যেতে দিন। গ্যারান্টি দিচ্ছি, গত রাতের কথা আমি ভুলে যাব।”
কেডিয়া কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় একটা মেয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকল। বছর তেরো—চোদ্দ বয়স। সুন্দর একটা স্কার্ট পরা। মেয়েটার এক হাতে একটা জাতীয় পতাকা। অন্য হাতে গোল করে গোটানো বড় একটা আর্ট পেপার। আদুরে গলায় মেয়েটা বলল, ”ড্যাডি, বিহারি আমাকে একটা ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ এনে দিয়েছে।”
কেডিয়া বললেন, ”বাঃ, কখন দিল?”
”এই একটু আগে। ইডেনে যাচ্ছি, ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ না নিয়ে গেলে হয়? দেখো, ইন্ডিয়া টিম আজ জিতবেই।”
”হ্যাঁ বেটা, তোর সঙ্গে আর কে—কে যাচ্ছে?”
”সুরযভাই আর আশা ভাবী। তোমাকে বললাম, ক্লাব হাউসের আরও টিকিট এনে দাও। তা হলে সহেলিকে নিয়ে যেতে পারতাম। তুমি তো দিতেই পারলে না!”
কেডিয়া হাসলেন মেয়ের আবদার শুনে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ”হামার মেয়ে কিরকেট ছাড়া আউর কোনও গেম ভালবাসে না। শচীনের বহুত ফ্যান।”
শচীনের কথা ওঠায় মেয়েটা গোটানো আর্ট পেপার খুলে দেখাল, ”এই ব্যানারটা মাঠে নিয়ে যাচ্ছি ড্যাডি। তুমি কিন্তু টিভি—র সামনে বসে থাকবে। যদি আমাকে দেখায়!”
আর্ট পেপারে নীল রঙে লেখা, ”শচীন, কনগ্রাটস ফর ইয়োর সুপার ব্যাটিং।”
কেডিয়া বললেন, ”কে লিখে দিল রে?”
”সকালে আমি লিখেছি।”
”খুব ভাল হয়েছে। আভি তু যা। মুঝে ইয়ে আঙ্কেল সে বাত করনা হ্যায়।”
বাপ—মেয়ের কথাবার্তা শুনে মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল। মেয়েটা বোধ হয় কোনও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। হিন্দিতে কথা বললেও দু—একবার ইংরেজি শব্দের উচ্চারণেই তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। মনে কত উৎসাহ নিয়েই না মেয়েটা আজ ইডেনে যাচ্ছে। ও জানে না, ওর বাবা আজ শচীন—আজহারদের হারাবার জন্য গোপনে চক্রান্ত করেছেন।
মেয়েটা আপনমনেই জাতীয় পতাকা নাড়াচ্ছে। পতাকাটা আলতোভাবে ছুঁয়ে গেল আমাকে। সঙ্গে—সঙ্গে শিউরে উঠলাম। সব কিছু জানার পরও কী করে বসে আছি, এই কেডিয়া লোকটার সামনে? যে করেই হোক, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার।
কেডিয়াও খুব ব্যস্ত। চোখে চোখ পড়তে এবার বলল, ”মিঃ নোনদি, রুমে গিয়ে জ্যারাসা রেস্ট নিন। ঠিক সাড়ে বারোটার সময় হামরা আপনাকে ইডেনে পাঠিয়ে দেব।”
সেই একই রাস্তা আর সিঁড়ি দিয়ে আফজলের সঙ্গে ফের ওপরের তলায় উঠে এলাম। ঘরে ঢোকার আগে, হঠাৎ কী মনে হতে ওকে বললাম, ”এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কী রাস্তা তুমি বাতলালে আফজল?”
”কেন সাব?”
”আরে, বেরোতে হলে তো কেডিয়ার ওই ঘরটা দিয়েই যেতে হবে।”
আফজল বিস্মিত, ”কেন সাব, অ্যান্টি চেম্বারের ভেতরেই তো আর একটা দরজা আছে। দুটো আলমারির ফাঁকে। লক্ষ করেননি?”
”না তো?”
”ভাল করে দেখবেন। সেই দরজাটা দিয়ে বেরোলেই দেখবেন, সামনে একটা লিফট আছে। সোজা একতলায় নেমে যাবেন। ওটা কেডিয়া সাহাবের পার্সোনাল লিফট।”
আফজলের কথা শুনে খুব আপসোস হল। অ্যান্টি চেম্বারে নামার পর আমার ভাল করে দেখা উচিত ছিল, বেরিয়ে যাওয়ার অন্য কোনও উপায় আছে কি না। উত্তেজনায় সেটা দেখা হয়নি। পার্স বের করে একটা একশো টাকার নোট গুঁজে দিলাম আফজলের হাতে।
আর এক মুহূর্তও দেরি করার সময় নেই আমার হাতে। ঘরে ঢুকে নিজেই ভেতর থেকে লক করে দিলাম দরজাটা। তারপর চারপাশটায় একবার নজর বুলিয়ে নিলাম। নাঃ, কোনও কিছু ফেলে যাচ্ছি না। বেলা এগারোটার মধ্যে যে করেই হোক, আমাকে হয় হোটেলে পৌঁছতে হবে, নয়তো ফোনে একবার কথা বলতে হবে টিম ম্যানেজারের সঙ্গে। মোহন চন্দ্রকুমার যেন কিছুতেই ওষুধ খাইয়ে না দিতে পারে সেরা তিন খেলোয়াড়কে।
দেশের প্রতি টান আমরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে টের পাই খুব সামান্যই। খেলার মাঠে যখন আমাদের জাতীয় দল খেলে, তখন সেই শেকড়ের টান হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠে। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। সোল এশিয়ান গেমসের প্রথম দশদিন আমরা কোনও সোনার পদক পাইনি। রোজ প্রেস সেন্টারে গিয়ে, দিনের শেষে খবর পাঠাবার সময়, ওখানকার টেলেক্স ঘরের কর্মীরা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ”আজ তোমরা কোনও সোনা পেয়েছ?”
হতাশভাবে ঘাড় নাড়তাম, ”না।”
কর্মীরা সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ”কাল নিশ্চয়ই পাবে, দেখো।” সত্যিই, যেদিন পি টি ঊষা প্রথম সোনাটা পেলেন, সেদিন আনন্দে নিয়ম—কানুন ভুলে প্রেস বক্স থেকে লাফিয়ে ভি আই পি ব্লকে চলে গিয়েছিলাম ক্রীড়ামন্ত্রী মার্গারেট আলভার কাছে। বিজয় মঞ্চে ঊষা যখন সেই সোনাটা গলায় ঝোলাচ্ছেন, স্টেডিয়ামে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বাজছে, সেই সময় আনন্দে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। সেদিন প্রবলভাবে অনুভব করেছিলাম, দেশটাকে আমি কত ভালবাসি।
সোলের সেই দিনটার কথা মনে হতেই চঞ্চল হয়ে উঠলাম। দ্রুত পায়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে সুইচ টিপে ঢুকে পড়লাম বাথরুমে। আবার সেই কাঠের সিঁড়ি। এবার স্বচ্ছন্দে নেমে এলাম নীচে, অ্যান্টি চেম্বারে। ঘরে অন্ধকার। লাইটার জ্বালিয়ে খুঁজতে—খুঁজতে ঠিক বের করে ফেললাম দুই আলমারির মাঝে প্রায়—গোপন একটা দরজা।
দরজাটা খোলার আগে বুকটা একবার ধড়াস করে উঠল। ওপাশে কী আছে জানি না। এই সময়ে কারও মুখোমুখি হয়ে গেলে মুশকিল। আফজল বলেছিল, কেডিয়ার পার্সোনাল লিফট দিয়ে সোজা নীচে নেমে যাবেন। এপাশের ঘরগুলোতে নিশ্চয়ই ওঁর ফ্যামিলি থাকে। কারও চোখে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।
হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আস্তে দরজাটাকে সামান্য ফাঁক করে বাইরে একবার উঁকি মারলাম। উলটোদিকেই একটা লিফট। অপরিসর করিডর। ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ডান দিকে পাশাপাশি তিনটি ঘর। কোনও একটা ঘরে টিভি চলছে। হিন্দি গান শোনা যাচ্ছে। লিফটের সুইচে আমি আঙুল ছোঁয়াবার আগেই হঠাৎ দেখি, মাঝের ঘরটা থেকে কেডিয়ার মেয়ে বেরিয়ে আসছে। তার হাতে তখনও সেই ফ্ল্যাগ। আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা হাসল।
খুব অস্বস্তিকর সেই মুহূর্ত। ভাল করে তাকাতেই বুঝলাম, মেয়েটার মুখে বিস্ময়ের কোনও চিহ্ন নেই। হঠাৎ ও বলল, ”আঙ্কেল, আপনি চলে যাচ্ছেন?”
ঘাড় নাড়লাম। আর ঠিক সেই সময়ই, নীচ থেকে খটাস করে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর গুঁইগুই ধরনের টানা আওয়াজ। সুইচ বোর্ডের দিকে চোখ পড়তে দেখি, লিফট নীচ থেকে উঠে উঠে আসছে। সর্বনাশ! যদি কেউ ঠিক এই ফ্লোরেই উঠে আসে? মেয়েটা হাতকয়েক দূরে দাঁড়িয়ে। অ্যান্টি চেম্বারে ঢুকে গেলে ও সন্দেহ করবেই। এদিকে, লুকোবার আর কোনও জায়গাও নেই। পলকের মধ্যে মন ঠিক করে নিলাম। কেউ যদি এই ফ্লোরে উঠে আসে, দরকার হলে বলপ্রয়োগ করতে হবে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার এই সুযোগ আমি নষ্ট করব না।
লিফটটা এসে থেমে গেল। কিন্তু তার আগেই ভেতরের লোকটাকে আমি দেখে ফেললাম। এইসব সময় আমার রিফ্লেক্স দারুণ কাজ করে। দরজা খোলার আগে, ঝট করে সরে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাতে উঠে আসা লোকটা সঙ্গে—সঙ্গে আমাকে দেখতে না পায়। সারা শরীরের শক্তি তখন আমার হাতের মুঠোয়। ঠিকই করে ফেলেছি, লোকটাকে আমার শক্তির আন্দাজ দিতে হবে।
লোকটা লিফটের বাইরে পা রাখতেই, ডান দিকে ঘাড়ের পেছনে মারাত্মক একটা আঘাত করলাম। ক্যারাটে শেখার ফলে, আমি জানি শরীরের কোথায় আঘাত করলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে কাবু করা যায়। ‘উক’ শব্দ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা। অন্য কেউ হলে, উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত থাকত না। কিন্তু লোকটা পারল। দু’হাতে দেওয়ালে ভর দিয়ে, চোখ—মুখ কুঁচকে, ব্যথা সহ্য করতে—করতে একবার ঘুরে তাকাল। আমি জানি, লোকটা ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট। ঘণ্টা দেড়—দুয়েক আগে বেশ গর্ব করে কথাটা ও শুনিয়েছে। পালটা মারার সুযোগ দিলে আমি দাঁড়াতে পারব না। ভেতর থেকে কে যেন সাবধান করে দিল। ওকে ছন্দে আসতে দিয়ো না। মনে হতেই, ডান পায়ে পুরো শরীরটা ঘুরিয়ে বাঁ পায়ে সপাটে লাথি মারলাম ওর পাঁজরে। সেটা সামলাবার আগে, ফের একটা লাথি। প্রচণ্ড একটা আক্রোশ তখন আমাকে কুরে—কুরে খাচ্ছে।
ডানদিকে সেই মেয়েটা তখনও দাঁড়িয়ে। বিস্ফারিত ওর চোখ। হাত থেকে ফ্ল্যাগটা মেঝেতে পড়ে গেছে। যে—কোনও মুহূর্তে মেয়েটা চিৎকার করে উঠতে পারে। ওর মুখটা দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, পালাতে হবে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, লোকটার পিঠ মেঝেতে। বড়—বড় শ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু তারই ফাঁকে গড়িয়ে সরে আসছে লিফটের দিকে। যাতে আমি লিফটে ঢুকে পড়ার আগে ও বাধা দিতে পারে।
ইচ্ছেটা বুঝতে পেরে, তলপেটে ফের লাথি মারলাম। ফের উক করে আর—একটা আওয়াজ। মুখের সাদা চামড়া লাল হয়ে গেল। আঘাতে আপনা থেকেই পুরো শরীরটা গুটিয়ে একটু সরে গেল দেওয়ালের দিকে। সেই সুযোগে আমি দ্রুত লিফটে ঢুকে পড়লাম। ঘণ্টা বারো আগে, এই লোকটা বিনা কারণে গাড়ির মধ্যে আমার মাথায় আঘাত করেছিল। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে, ওকে পালটা না মেরে গেলে খুব আপসোস হত।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লিফটটা নেমে এল একতলায়। গেটের সামনে ছোট্ট একটা লোক বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকল। লোকটার দিকে তাকাবার সময় আমার নেই। গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। উফ, এখন আমি মুক্ত। কেডিয়ার সাধ্য নেই আমাকে ফের ধরে।
বড়বাজার অঞ্চলে আমি খুব বেশি যাওয়া—আসা করিনি। সরু গলিটা দিয়ে হাঁটবার সময়, দোকানের সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা, পগেয়াপট্টি। লোক গিজগিজ করছে রাস্তায়। ভালভাবে হাঁটার পর্যন্ত উপায় নেই। খুপরির মতো ঘর, দোকান। কোটি—কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই অঞ্চলে। অথচ জায়গাটার কোনও উন্নতি হল না!
হাতঘড়িতে দেখলাম, প্রায় সাড়ে দশটা। যা কিছু করার, আর আধঘণ্টার মধ্যে আমাকে করতে হবে। জোরে পা চালিয়ে মহাত্মা গান্ধী রোডে পৌঁছে গেলাম। এখনই, এখনই টিম ম্যানেজারকে ফোন করতে হবে কোথাও থেকে। উলটো দিকের ফুটপাথে বড় একটা শো—রুম, কাপড়ের। নিশ্চয়ই ওখানে ফোন আছে। এই ভেবে শো—রুমে ঢুকলাম। দোকানে বেশ ভিড়। একজন সেলসম্যানকে ফোনের কথা জিজ্ঞেস করতেই কোণে ক্যাশিয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল।
উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। হোটেলের নম্বর ডায়াল করতেই ও প্রান্তে, ”গুড মর্নিং, হোটেল…।”
”দেখুন, আমি একজন রিপোর্টার। টিম ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
”কী নাম বলব?”
”কালকেতু নন্দী।”
”একটু ধরুন।”
যাক, নিশ্চিন্ত! ম্যানেজারকে ষড়যন্ত্রের কথা সব জানিয়ে দিলে, মোহন চন্দ্রকুমার ইন্ডিয়া টিমের কোনও ক্ষতি আর করতে পারবে না। ও—প্রান্তে রিং হচ্ছে। বেজেই চলেছে। কেউ ফোন তুলছে না। তবে কি ম্যানেজার ঘরে নেই? না থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। টিমের ম্যানেজারকে অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপার দেখতে হয়। হয়তো কোনও প্লেয়ারের ঘরে ঢুকেছেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়েই ফোনটা ছেড়ে দিলাম। নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। একটা ট্যাক্সিতে ওঁদের হোটেলে পৌঁছতে মিনিট পঁচিশ লাগবে। হোটেলে এখন প্রচণ্ড কড়াকড়ি। কিন্তু মাঝেমধ্যে যেতে হয় বলে, কর্মীদের অনেকেই চেনা। ঢুকতে আমার অসুবিধে হবে না। তাড়াহুড়ো করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা ট্যাক্সি ধরা দরকার। যেভাবেই হোক না কেন!
বেলা দশটা—সাড়ে দশটার সময় বড়বাজারে ট্যাক্সি পাওয়া এত কঠিন, তা ধারণায় ছিল না। সব ট্যাক্সিই হাওড়া স্টেশনের দিকে ছুটছে। ট্যাক্সি ছাড়া আলিপুরের দিকে যাওয়ার অন্য কোনও উপায় নেই। কী করি ভেবে, একটু ‘টেনশন’ বোধ করতে লাগলাম। সময় চলে যাচ্ছে হুহু করে। ঘড়ির কাঁটা যেন দৌড়চ্ছে কার্ল লুইসের মতো। জনবহুল ওই রাস্তায় অসহায় হয়ে আমি শেষ পর্যন্ত হাঁটতে শুরু করলাম।
সরু একটা গলি দিয়ে যখন ব্র্যাবোর্ন রোডের ফ্লাইওভারের নীচে আর্মেনিয়ান গির্জার কাছে পৌঁছলাম, তখন এগারোটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি। না, ইন্ডিয়া টিমকে আর ধরা যাবে না। ঠিক এগারোটায় সবাই লাঞ্চ করতে নামবে। মোহন চন্দ্রকুমার দুষ্কর্মটি করে ফেলবে। সব জানা সত্ত্বেও, আমি আটকাতে পারলাম না। ব্যাড লাক, সত্যিই ব্যাড লাক। চার্লসকে মেরে লিফটের পাশে ফেলে দিয়ে যতটা উৎসাহ নিয়ে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম, ক্রমশই তা কমতে শুরু করেছে। এই শহরেই, মাইল তিনেকের মধ্যে একটা লোককে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। আশ্চর্য, পারছি না। ক্রমেই মনটা দমে আসছে।
”আরে ভাই, তুমি এহানে?”
তাকিয়ে দেখি, রুমি। আমার সেই বন্ধু।
”তুমি!”
”হাওড়া স্টিশনে গেছিলাম। টিকিট কাটতে। ভাবলাম, এদিকে আইলামই যখন, টিকিটটা কাইট্যা লইয়া যাই।”
”টিকিট পেয়েছ?”
”হ, কিন্তু কনফার্ম না।”
”এখন যাচ্ছ কোথায়?”
”আমি তো তোমাগো অফিসেই যাইতাছিলাম। তারপর ইডেনে যামু। তোমারে দেইখ্যা ট্যাক্সি থেইকা নাইমা আইলাম।”
”কোথায় ট্যাক্সি?”
”ওই তো!”
”চল, চল। কথা বলার সময় নেই। আমাকে এখনই একবার হোটেলে যেতে হবে। তুমিও আমার সঙ্গে চল।”
”কিছু খবর আছে নাকি?”
”বড় খবর।”
কে বলে ব্যাড লাক? তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতে এসে বসলাম। ডালহৌসি দিয়ে আসার সময় মনে পড়ল, কাল রাতে এখানেই চার্লস আমার মাথায় আঘাতটা করেছিল। কোনও দরকার ছিল না। কী করছে এখন চার্লস? মার খাওয়ার পর নিশ্চয়ই কেডিয়ার কাছে গেছে। কীভাবে পালিয়ে এলাম, তা নিয়ে গবেষণা করছে। মাঠে খেলা দেখতে আসার সাহস ওর হবে না। তবে কেডিয়া অবশ্যই আমার হাবভাব লক্ষ করার জন্য লোক পাঠাবে।
যাক, ওসব নিয়ে ভাবার সময় এখন আমার নেই। কার্জন পার্কের কাছে ট্যাক্সিটা পৌঁছতেই পুলিশ আটকাল। সোজা রেড রোড ধরে যেতে দেবে না। বাঁ দিকে ঘুরে এসপ্ল্যানেড ইস্ট হয়ে মেট্রো সিনেমার পাশ দিয়ে সোজা যেতে হবে। পুলিশ এবার খুব তৎপর। ইডেনমুখী দর্শকদের জন্য নতুন ব্যবস্থা করেছে। কার্জন পার্কের কাছ থেকেই দর্শকদের গাড়িতে তুলে পৌঁছে দিচ্ছে ইডেনে।
এইজন্যই হোটেলে পৌঁছলাম বেলা সওয়া এগারোটা নাগাদ। রিসেপশনে গিয়ে খোঁজ করে শুনতে পেলাম, ইন্ডিয়া টিমের সবাই এখন লাঞ্চ টেবিলে। শুনেই মনটা দমে গেল। এত কষ্ট করে আসা সবই বৃথা? ম্যানেজারের কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে পারব না? এত কাছে এসেও?
হোটেলে তিন—চারটে রেস্তরাঁ। কোনটাতে ইন্ডিয়া টিম লাঞ্চ খেতে গেছে, জানি না। লবিতে এ—নিয়ে দু—একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সিকিউরিটির এক অফিসার এসে ধরলেন। একটু উদ্ধত সুরেই বললেন, ”রিপোর্টার হোন অথবা যা—ই হোন, প্লিজ প্লেয়ারদের এখন ডিসটার্ব করবেন না।”
আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম, ”শুনুন ভাই, খুব জরুরি দরকার। একটা খবর পৌঁছে দিতে হবে।”
”কী মেসেজ দিতে চান বলুন, আমরা পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
কী করে সব কথা বলব? চুপ করে তাকিয়ে রইলাম। তর্ক করে লাভ নেই। এটা এদের ডিউটি। অগত্যা লাউঞ্জের সোফায় গিয়ে বসলাম। যে রেস্তরাঁতেই অজিতভাইয়েরা লাঞ্চ করুন না কেন, লিফট দিয়ে তো ওপরে যেতেই হবে। তখন ধরব।
পাঁচ মিনিট…দশ মিনিট…আধঘণ্টা সময় কেটে গেল। কারও পাত্তা নেই। সোফায় বসে ছটফট করছি। একবার উঠে গিয়ে ইন হাউস ফোন থেকে ম্যানেজারের ঘরে যোগাযোগ করলাম। না, তিনি ঘরে নেই।
হঠাৎ দেখি সুনীত রেড্ডি লিফটের কাছ দিয়ে হেঁটে আসছেন। যখন খেলতেন, তখন থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়। ঘণ্টাদুয়েক আগে কেডিয়ার ওখানে ওঁকে যে পোশাকে দেখেছিলাম, পালটে ফেলেছেন। এখন কোট—টাই— সুট। একেবারে ফিল্মের নায়ক বলে মনে হচ্ছে। একটা ছবিতে নাকি একবার অভিনয়ও করেছিলেন রেড্ডি। বেশিদিন চলেনি।
”হাই নন্দী। কেমন আছ?”
ষড়যন্ত্রে কি এই লোকটিও আছেন? থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। একটু রাগ হল। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য দেশকে বিকিয়ে দিতে হবে? এই ধরনের মানুষকে গুলি করে মারা উচিত। মনে—মনে এসব কথা ভাবলেও মুখে কিন্তু বললাম, ”রেড্ডি, ম্যানেজারকে কোথাও দেখেছ?”
”তিনি তো নেই!”
”কোথায় গেছেন?”
”শুনলাম আধঘণ্টা আগে নার্সিংহোমে গেছেন।”
”কেন?”
”আমার নাম করে লিখো না। তিনজন খেলোয়াড় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
শোনামাত্রই আমার শরীরের সব রক্ত কে যেন শুষে নিল। যা ঘটবার, তা হলে তাই ঘটল? কোনওরকমে জিজ্ঞেস করলাম, ”কোন নার্সিংহোমে নিয়ে গেছে, জানো?”
”না। আমরা বাইরের লোক, জানব কী করে?” বলেই লাউঞ্জে বোধ হয় কাউকে দেখতে পেলেন রেড্ডি। হাত নেড়ে হাসতে—হাসতে সেদিকে চলে গেলেন।
একটু দূরে সোফায় বসে ছিল রুমি। ওকে বললাম, ”তুমি ইডেনের দিকে চলে যাও। আমি পরে যাচ্ছি।”
আমার মধ্যে অস্থির ভাব দেখে অবাক হচ্ছিল রুমি। বলল, ”কী হইসে কও তো।”
”পরে বলব। প্রেসবক্সে।”
দ্রুত বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। সব শেষ। কেডিয়ার অফিস থেকে পাঠানো আমার মেসেজটা বোধ হয় ইন্দ্রনীলের হাতে পড়েনি। ও তাই ম্যানেজারকে কিছু জানাতে পারেনি। সেরা তিন খেলোয়াড় যদি না খেলতে পারে, তা হলে ম্যাচ জেতার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই ভারতের। এত লোকের এত উৎসাহ, আশা সব মিলিয়ে যাবে আর কয়েক ঘণ্টা পর।
চিড়িয়াখানার উলটো দিকে রোজ প্রচুর ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। একটাতে উঠে পড়লাম। তারপর ঘণ্টাদুয়েক ধরে চষে ফেললাম মধ্য কলকাতার কয়েকটা নার্সিংহোম। নাহ, কোত্থাও ম্যানেজার যাননি। রিসেপশনে অনেকেই অবাক হচ্ছিল, আমার প্রশ্ন শুনে। প্রায় দু’দিন একই পোশাক পরে আছি। স্নান করিনি। চেহারায় এমনিতেই পাগল—পাগল অবস্থা। একটা নার্সিংহোমে একজন তো বলেই ফেললেন, ”পাগল নাকি! এখানে শচীনকে খুঁজতে এসেছেন। জগতে কতরকম লোকই না আছে!” বেলা আড়াইটা নাগাদ হাল ছেড়ে দিলাম। নাহ, ইডেনেই যাওয়া যাক।
আরও আধঘণ্টা পর যখন ইডেনে পৌঁছলাম, খেলা তখন শুরু হয়ে গেছে। বটতলার কাছে একজন পুলিশ অফিসার রেডিওতে কমেন্ট্রি শুনছিলেন। জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ”ইন্ডিয়া টিম ব্যাট করছে। টস হেরেছে।” শরীর অবসন্ন। সকালের দিকে কেডিয়ার বাড়িতে সেই যে পুরি—হালুয়া খেয়েছিলাম, তারপর থেকে পেটে আর কিছু পড়েনি।
ট্যাক্সি থেকে পুলিশ নামিয়ে দিয়েছে ফোর্ট উইলিয়ামের আইল্যান্ডের কাছে। মাঠ দিয়ে কোনাকুনি হেঁটে প্রায় টলতে—টলতেই ইডেনে পৌঁছেছি।
”কী ব্যাপার মিঃ নন্দী? এত দেরিতে?”
গেটের সামনে মেটাল ডিটেক্টরে প্রত্যেককে পরীক্ষা করে ঢোকাচ্ছিলেন এক পুলিশ অফিসার। প্রশ্ন তাঁরই।
গলা শুকিয়ে কাঠ। গেটের পাশে ঠান্ডা পানীয়ের প্যাকেট দিচ্ছিলেন একজন। একটা চেয়ে নিলাম হাত বাড়িয়ে। তারপর বললাম, ”একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।”
চারতলায় প্রেসবক্সে ওঠার জন্য প্রায় নব্বইটা সিঁড়ি ভাঙতে হয় রিপোর্টারদের। অন্যদিন অসুবিধে হয় না। শরীর ক্লান্ত বলে দেড়তলা পর্যন্ত উঠেই হাঁফিয়ে গেলাম। ল্যান্ডিংয়ের পাশে একটা দরজা আছে, ভি আই পি বক্সে যাওয়ার। হঠাৎ দেখি, সেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসছেন ম্যানেজার। দেখা হওয়াটা এত আকস্মিক যে, প্রথমে মুখ ফুটে কথা বেরোল না।
আমাকে দেখেই ম্যানেজার বলে উঠলেন, ”কী ব্যাপার দাদা? ইন্দ্রনীল ফোন করেছিল। ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই যে বুঝতে পারলাম না।”
উফ, আমার মন থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। বললাম, ”কখন ফোন করেছিল ইন্দ্রনীল?”
”এই দশটা, সওয়া দশটা নাগাদ।”
”আমাদের টিমের সবাই ফিজিক্যালি ঠিক আছে?”
”হান্ড্রেড পার্সেন্ট। আজ সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওয়াতন কে লিয়ে।”
ম্যানেজারের মুখে হাসি দেখে, আমার সব উদ্বেগ দূর হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ”আপনি কি নার্সিংহোমে গিয়েছিলেন?”
”কী বাজে বকছ? হোটেল থেকে সোজা এখানে এসেছি। আচ্ছা, মোহন চন্দ্রকুমারের ব্যাপারে ইন্দ্রনীল কেন বলল, লাঞ্চ টেবিলে ও যেন শচীনদের পাশে না বসে?”
খেলা শুরু হয়ে গেছে। এখন কি ষড়যন্ত্রের কথা ম্যানেজারকে বলা উচিত? মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘না। সব জানলে উনি মনঃসংযোগ হারাতে পারেন। উনি ভারতীয় দলের মস্তিষ্ক। এখন কোনও ভাবেই ওঁকে বিরক্ত করা উচিত নয়।’ ম্যানেজারকে দেখার জন্য ল্যান্ডিংয়ে কিছু লোক জমে গিয়েছিল। সেটা দেখে বললাম, ”এখন নয়, একটু পরে। খেলা শেষ হোক, বলব।”
শরীরে এখন অসুরের শক্তি। দুটো করে সিঁড়ি টপকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনতলায় উঠে গেলাম। ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চোখটা জুড়িয়ে গেল। ঝকঝকে রোদ্দুর। সবুজ মখমলের মতো মাঠ। গ্যালারি জুড়ে অসংখ্য লোক।
হঠাৎ চোখ গেল স্কোরবোর্ডের দিকে। ব্যাট করছেন শচীন তেন্ডুলকর আর অজয় জাদেজা। ওদের মাঝে একটা নাম, মোহন চন্দ্রকুমার কট ক্রোনিয়ে বোল্ড ডোনাল্ড ০। সাত ওভার চলছে। ভারতের স্কোর এক উইকেটে ৫৬। শচীন ৪৬, জাদেজা ৬।
স্কোর বোর্ড থেকে চোখ সরাবার আগেই ইডেন একবার গর্জে উঠল। মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি, কভার দিয়ে বল ছুটে যাচ্ছে বাউন্ডারির দিকে। শচীনের অসাধারণ একটা কভার ড্রাইভ। সারা ইডেন উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম জানাচ্ছে খুদে মাস্টারকে। হাফ সেঞ্চুরি হল। শচীন ব্যাট তুলে অভিনন্দনের প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন।
দৃশ্যটা দেখে চোখে জল এসে গেল। না, মোহন চন্দ্রকুমার পারেনি। ক্ষতি করতে পারেনি সুনীত রেড্ডিও। শচীনদের নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার একটা মিথ্যে খবর দিয়ে রেড্ডি শুধু একটা বিচ্ছিরি রসিকতা করেছে আমার সঙ্গে। মোহন আজকের ম্যাচটা খেলে নিক। আর যাতে ভবিষ্যতে খেলতে না পারে, পরে তার ব্যবস্থা করা যাবে। পকেট থেকে রুমাল বের করার ফাঁকে, ওই আনন্দ—উচ্ছ্বাস দেখে একবার মনে হল, ইডেনে জড়ো হওয়া লাখখানেক মানুষ কোনওদিন জানতেও পারবেন না, কত বড় দুঃখ পাওয়ার হাত থেকে আজ ওঁরা বেঁচে গেলেন!