রিপাবলিক আর পাবলিক
প্রজাতন্ত্র। সরল অর্থে প্রজাদের তন্ত্র। তন্ত্র মানে আইন? আমরা সাধারণ মানুষ যখন যে আইনে চলতে চাইব, রাষ্ট্র যদি বিনা বাধায় তা সমর্থন করে বা সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে তাকেই বলে প্রজাতন্ত্র? আমরা সবাই রাজা? সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এদেশে সফল প্রজাতন্ত্র প্রকৃতই প্রতিষ্ঠিত। এখানে বাঁচার অধিকার আছে, মারার অধিকার আছে। প্রচণ্ড ভোগের অধিকার আছে। দুর্ভোগের অধিকার আছে, দিনের পর দিন উপবাসে থাকতে পারি আবার খানাপিনায় ফেঁসে বসার অধিকার আছে।
এমন এক লিবারাল রিপাবলিকের সভ্য হতে পেরে মনে মনে ভীষণ গর্বিত এবং আনন্দিত। পৃথিবীর কোথায় এমনটি আছে। এই অপূর্ব উদ্দাম স্বাধীনতা। আমি ছাত্র হয়ে পয়লা বেঞ্চে বসতে পারি। আবার আন্দোলনকারী হয়ে অধ্যাপকের গালে নিম ঠোনাও মারতে পারি। ইচ্ছে হলে বেড়াতে বেড়াতে, পান চিবোতে চিবোতে, সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কর্মস্থলে একবার দর্শন দিতে পারি। ইচ্ছে হলে গোদা চেয়ারে বসে দু-একটা ফাইল খেলার ছলে ওলটাতে পারি। কলমে কালি সরলে দু-একলাইন নোট লিখে বড় সাহেবের ঘরে ভেজে দিতে পারি। আবার নাও পারি। ইডেনে যদি বড় ধরনের কোনও ব্যাট বলের লড়াই থাকে, কি ফুটবলের খেলা নয়, দলীয় যুদ্ধ থাকে, তাহলে হাজিরা খাতায় খুচুক করে সইয়ের ‘স্পার্ক’ মেরে সরে পড়তে পারি।
সংবিধানে ব্যক্তি স্বাধীনতা গ্যারান্টিড। যে বাধা দেবে সে প্রিমিটিভ। অসভ্য, বনমানুষ। দেশের এগনো, দেশের পেছনো, এ নিয়ে মাথা ঘামাবে কারা? যারা সাবেক কালের বুড়ো। পৃথিবী একটা অ্যাকসিসের ওপর অটোমেটিক ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ইলিপটিক কক্ষপথে বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। ন্যাচারাল মুভমেন্ট তো রয়েইছে। তখন অনাবশ্যক গতি, প্রগতি, অগ্রগতি নিয়ে ভেবে ভেবে অম্বল আর উদরাময়ে ভোগা কেন। ও সব টেকস্টবুকে ছাত্রদের জন্যে তোলা থাক। পল সায়েন্সের ছেলেমেয়েরা ভ্যাড় ভ্যাড় করে পড়ুক, মুখস্থ করুক। পরীক্ষা দিক। দেশ তো শিক্ষিত মানুষে চালাবেন না। চালাবে তারা। যারা রোজ রাতে হাতে গোলাকার বস্তু নিয়ে অ্যাকসানে নামে। ঘণ্টাখানেক এপক্ষে ওপক্ষে চালাচালি। তারপর দুপক্ষে গলাগলি ও মহাপ্রসাদ ভক্ষণ। প্রজাতন্ত্রের আরতি, অন্তে পুরোহিতদের বেসামাল ভুঁয়ে গড়াগড়ি।
শিক্ষা আবার কি? দাস হওয়ার শিক্ষা আমরা অতীতে যা নেওয়ার নিয়েছি। চোগা চাপকান পরে ব্রিটিশের সেরেস্তায় জজ মেজেস্টারি করেছি। কীসের জন্যে করেছি? টাকার জন্যে। আর উপরি পাওনা লোকে আমায় মান্য করবে, ভয় করবে। টাকা এখন আমরা অন্য রাস্তায় আরও সহজে রোজগার করতে পারি। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। আর মান, সম্মান, প্রতিপত্তি। সে তো আর তখমায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে, তাবড় তাবড় সিন্ডিকেট মেম্বাররা ঘেরাও হয়ে বসে থাকেন, ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে। জানালা দিয়ে দড়ি ঝুলিয়ে খাবার তুলে আনতে হয়। এই তো হায়েস্ট প্রফেসান, শিক্ষকের সম্মান। কথায় বলে, শতেক মারি ভবেৎ বৈদ্য। একশোটি রুগি ফিনিশ করলে হাত পাকে, তবে ডাক্তার হওয়া যায়। সেই রকম গোটা কতক লাশ ফিরিয়ে দিলেই, মানী ব্যক্তি। দুবার কাশলেই লোক ভড়কে যাবে। সব সার্ভিস ফ্রি। জনসেবা মানে ওমুখো নয়, এমুখো। জনতার সেবা কবজা করে সুখের ইমারতে দোর্দণ্ড প্রতাপে দু-দশ বছর বেঁচে থাকা। ইজম আবার কি? পলিটিক্যাল মাসলম্যান হয়ে ভড়কি দেখিয়ে কলাটা মুলোটা আদায় করো। দু-চারটেকে মাঝেমধ্যে আচমকা ভবসাগর পার করে দাও। সেই নীতিবাক্যটি স্মরণে রেখেঃ যে হাঁস সোনার ডিম দেয় তার পেট ফাঁসিও না। সোনার ডিম হল ভোট। প্রজাতন্ত্রের প্রজাহাঁসেরা পাঁচ বছর অন্তর একটি করে ভোট পাড়ে ব্যালট বক্সে। স্বামী বিবেকানন্দ দীর্ঘকাল আগে পরম ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে থাকে, আর দশ-বিশ লাখ সাধু আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ ওই গরিবদের রক্ত চুষে খায় আর তাদের উন্নতির কোনও চেষ্টা করে না, সে কি দেশ না নরক। সে ধর্ম না পৈশাচ নৃত্য।’ এই শোষকের দলে আরও নতুন একটি শ্রেণি যুক্ত হয়েছে। তাঁরা হলেন রাজনীতির পুরোহিত। গ্রামেগঞ্জে, শহরে নন্দী ভৃঙ্গীর দল ভিটে মাটি চাঁটি করে ছেড়ে দিলে। জনহিতকর কাজের কথা এঁদের মগজে স্থান পায় না। কেউ প্রত্যাশাও করে না। সাধারণ মানুষের বাঁচা মরায় কিছুই যায় আসে না। পার্টি বাঁচুক। ঝাণ্ডা বাঁচুক। ডাণ্ডা উঁচু থাক। স্বদেশি যুগের গান ছিল, ঝাণ্ডা উঁচা রহে হামারা। একালের গান ডাণ্ডা উঁচা রহে হামারা।
৮৪ সালে যে ঝড় বয়ে গেল, এই প্রজাতন্ত্র কি সেই ঘটনাবলী থেকে কোনও শিক্ষা আহরণ করবে? কে করবে? দেশের মৃত্তিকা। ইট, কাট, পাথর। হতশ্রী বিশালকায় সরকারি ইমারত সমূহ। শাসক গোষ্ঠী অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো। অসহায়। যুদ্ধ কৌরবে পাণ্ডবে নয়। কৌরবে কৌরবে। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন আর যাঁরা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন অথচ তখতে বসতে পারছেন না, এই উভয় গোষ্ঠী দেশমাতার গলায় কাছি পরিয়ে বেদম টানাটানি করে চলেছেন। মায়ের চোখ কপালে উঠে গেছে। জিভ সামনে ঝুলে পড়েছে আধহাত। জনসমুদ্র মন্থনে যে অমৃত উঠেছে সে মুষ্টিমেয়ের হাতে হাতে ঘুরছে। হলাহলের প্লাবনে হাবুডুবু খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ নিয়ে বিচ্ছিন্নতাকামীদের বাঁদরের পিঠে ভাগ শুরু হয়েছে। আমরা বসে আছি আগ্নেয়গিরির আসনে। মাঝেমধ্যেই ঠেলা খাচ্ছি পেছনে। উত্তপ্ত বিস্ফোরক ঠেলে ঠেলে তুলে দিচ্ছে ওপরে। দেশসেবার পুরস্কার বুলেট।
আরও একটি মারাত্মক দরজা অবারিত হয়েছে ভবিষ্যতের দিকে। ঘৃণা। যে দলই শাসনে থাকুন, বিরোধী গোষ্ঠী কাজের নয়, ধৈর্যের পুরস্কার পাবেই। একটা টার্ম দুটো টার্ম। মানুষের ঘৃণার ভোটে গদি টলবেই। একবার এ জোট, আর একবার ও জোট। এই ওঠাপড়ার ফাঁকে শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহন, প্রতিরক্ষার উন্নতি হয় হবে। না হয়, না হবে? শাসক আর বিরোধী পরস্পর হাত মিলিয়ে, সমালোচনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে দেশ গঠন করবেন, দেশের মানুষের জন্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করবেন, গণতন্ত্রের পথে প্রজাতান্ত্রিকের দৃষ্টিতে বিশ্বসভায় বরেণ্য দেশের আসনে এই উপমহাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এ যেন দুরাশা। মূঢ়, হতবাক দেশবাসীর চোখের সামনে শিক্ষিত, বিবেচক, স্বদেশপ্রেমী কর্মযোগীরা কর্মযোগের যে উদাহরণ তুলে ধরেছেন, তা অতুলনীয়। একটি দিকে সাম্য অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, জ্ঞানী, নির্বোধ সকলেই প্রায় একই আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এক সময় ‘কমান এনিমি’ ছিল ইংরেজ। দেশ তখন মোটামুটি একতাবদ্ধ হতে পেরেছিল। এখন আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের এনিমি। আমরা সকলেই সকলের মুখের গ্রাস কেড়ে খাচ্ছি। বাসস্থানে ভাগ বসাচ্ছি। যানবাহনে স্থান দখল করছি। পথে গুঁতোগুঁতি করছি। বিপুল জনসংখ্যা, সীমিত জীবনধারণ ব্যবস্থা। আমাদের সব পরিকল্পনাই হাফহার্টেড। ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু। পরিশেষে পরিত্যক্ত। পরিবার পরিকল্পনার কথা আর শোনাই যায় না। দপ্তর আছে। প্রথামত একটি দুটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। তারপর? তারপর সব ব্যাপারেই যা হয়। কল আছে জল নেই। আলোক স্তম্ভ আছে বাতি নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে শিক্ষার পরিবেশ নেই। থানা আছে নিরাপত্তা নেই। সরকারি দপ্তর আছে সেবা নেই। হট্টমালার দেশে ক্ষমতালোভী অট্টহাসি।
এদেশের একদল শিক্ষিত দামড়া যৌথ পরিবার ভেঙেছিল। একজনের আয়ে দশজন পাত পাড়ত। আর অখণ্ড অবসর ব্যয় করত ইন্দ্রিয় সেবায়, দলাদলি আর মামলায়। কুলাঙ্গার সন্তান পূর্বপুরুষ ‘লক-স্টকব্যারেল’ বেচে কাপ্তেনি করত। ভিটেয় ঘুঘু চরত অচিরে। একদল মদ্যপ ঘোরেল এদেশের যৌথ ব্যবসায় লালবাতি জ্বালিয়ে গেছে একের পর এক। কত সুন্দর, বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠান গত সাঁইত্রিশ বছরে শেষ হয়ে গেছে। শিল্প আর ব্যবসার কফিনে শেষ পেরেক মেরেছে ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলন। এদেশের নেতাদের দুটি কণ্ঠ। শাসনে বসলে জাপান জাপান। অপোজিশানে থাকলে ঝাণ্ডা আর ডাণ্ডা। আমরা শিল্প চাই না শিল্প বিরোধ চাই, বিশেষ কোনও ইজমের জয়জয়কার চাই, সেইটাই ঠিক হল না। উভয় পক্ষের সুন্দর পরিবেশে সহাবস্থান কাম্য, না শিল্পমালিকের রক্ত কাম্য কে বলবে। শ্রমিক এখন সুবিধাবাদী রাজনীতিকের দাবার ঘুঁটি। ছকে ইচ্ছেমতো এগিয়ে পেছিয়ে চাল চেলে কিস্তি মাত করে যাও। মূলধন যে বিনিয়োগ করবে সে-ই দেশের শত্রু। এমনকী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও যদি অর্থ লগ্নি করে থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানও শত্রু। শিল্প শ্রমিকের জঙ্গি আক্রমণের লক্ষ্যস্থল।
গঠনের সাধনার চেয়ে ভাঙনের সাধনাই চলেছে দেশ জুড়ে। আমাদের দীর্ঘ আত্মোন্নতির সাধনায় সবচেয়ে বড় বলি আমাদের ‘ডিসিপ্লিন’। সর্বস্তরে এত সাংঘাতিক ইনডিসিপ্লিন আত্মহত্যারই সামিল। বিশাল, বিপুল জনসংখ্যা, যার বেশির ভাগই অশিক্ষিত, জীবিকাহীন, দরিদ্র, যাদের মন্ত্রই হল, ভাঙো শুধু ভাঙো। যাদের কোনও বিশ্বাস নেই, কোনও গর্ব নেই, কোনও আত্মসচেতনতা নেই, যারা শুধু পাদুকার মতো ব্যবহৃত, প্রহৃত ও পরিত্যক্ত হয়, তাদের হাতে রিপাবলিক কেমন খুলবে? খুলেছেই বা কীরকম। ভাত, কাপড় আর সস্তা আমোদপ্রমোদ, সস্তা নেশা আর জৈব ক্ষুধার নিবৃত্তি এই যে দেশের বেশিরভাগ মানুষের লক্ষ্য সে দেশ জাপানের মতো, জার্মানির মতো, আমেরিকার মতো হবে কি করে। সে দাবি কোথায়। কোথায় সেই চাপ। এ দেশের মানুষের অবস্থা, কাঙালি ভাত খাবি আয়, না হাত ধুয়ে বসে আছি। যা দেবে, যে টুকু দেবে তাইতেই সন্তুষ্ট। না দিলেও কিছু যায় আসে না।
যাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন তৈরি করার ক্ষমতা ছিল যাঁদের তাঁরা চলে গেছেন। ধর্ম আছে। সেই ধর্ম এখন লোভী মানুষের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার। মূর্খ, সরল মানুষকে শোষণের হাইপোভারমিক সিরিঞ্জ। আমরা আজও নতুন কিছু কইতে পারলুম না। সেই একই আক্ষেপঃ
‘দাদা, এইসব দেখে বিশেষ দারিদ্র্য আর অজ্ঞতা দেখে আমার ঘুম হয় না, একটা বুদ্ধি ঠাওরালুম কেপ কমোরিনে যা কুমারীর মন্দিরে বসে —ভারতবর্ষের শেষ পাথর-টুকরোর ওপর বসে এই যে আমরা এতজন সন্ন্যাসী আছি, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, লোককে মেটাফিজিকস শিক্ষা দিচ্ছি, এসব পাগলামি। খালি পেটে ধর্ম হয় না—গুরুদেব বলতেন না? ওই যে গরিবগুলো পশুর মতো জীবন যাপন করছে, তার কারণ মূর্খতা; পাজি বেটারা চার যুগ ওদের রক্ত চুষে খেয়েছে, আর দু-পা দিয়ে দলেছে।
রিপাবলিক তোমার কাছে প্রশ্ন, মূর্খতা কবে যাবে। কবে আমরা শিক্ষিত হব। কবে আমরা শোষণমুক্ত হব। উন্নত দেশের মানুষের মতো বাঁচার অধিকার পাব।