রিনেসাঁস গোড়ার কথা ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
বিনোস কথাটার শব্দগত অর্থ পুনর্জন্ম, অর্থাৎ পুরাতনে ফিরে যাওয়া, অথবা পুরাতনকে ফিরে পাওয়া; কিন্তু ভাবগত অর্থ নবজন্ম, মানে মানবমহিমা তথা বুদ্ধি ও কল্পনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রিনেসাঁসের ইতিহাস তাই জীবন-সূর্যের পুনরোদয়ের ইতিহাস–বুদ্ধি ও কল্পনার জয়যাত্রার ইতিহাস।
য়ুরোপের ইতিহাস থেকে কথাটি নেওয়া হয়েছে। অতএব একবার সেদিকে তাকানো দরকার।
য়ুরোপের মধ্যযুগ শাস্ত্রশাসনের যুগ–পোপের সর্বময় প্রভুত্বের যুগ। বুদ্ধিবিচার, অনুভূতি-কল্পনা প্রভৃতি মানবীয় গুণসমূহের প্রতি এ-যুগ আস্থাহীন। জগৎ ও জীবনের প্রতি এযুগের বিস্ময়-দৃষ্টি নেই, বরং এসবকে তা পতনের ফাঁদ বলেই গণ্য করে। সৌন্দর্যও প্রেম, এসব তো শয়তানের কারসাজি, সুতরাং এদের জব্দ করা আর শয়তানকে জব্দ করা এক কথা। তাই চলল আত্মবিকাশের পরিবর্তে নিদারুণ আত্মনির্যাতনের পালা। আর এই নির্যাতনে নির্যাতনে ক্ষীয়মাণ মানবাত্মা পরিণামে বিদ্রোহী হয়ে প্রশ্ন করলে এ কি সত্যি? এই জগৎ ও জীবন, এই প্রেম ও সৌন্দর্য এসব কি সত্যই মিথ্যা? এই সন্দিগ্ধ-দৃষ্টি তাকে নিয়ে গেল সত্যের সোনার সিংহদুয়ারে, সে বুঝতে পারলে জীবনচর্চাই জীবনের উদ্দেশ্য, আর প্রেম সৌন্দৰ্যকল্পনা ও বিচারবুদ্ধির অনুশীলনই জীবনের অনুশীলন। এই উপলব্বির সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিক যুগের সুপ্রভাত। মানবমহিমা মেঘমুক্ত সূর্যের মতো প্রকাশিত হয়ে এই উজ্জ্বল প্রভাতের সৃষ্টি করলে।
জীবনপ্রীতির এই সোনার ফসল ফল গ্রিক জ্ঞানচর্চার ফলে। গ্রিক সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পের গোড়ার কথা-যে দেহকেন্দ্রিক জীবনপ্রীতি, এ একরকম সাধারণ সত্য। কিন্তু তাই বলে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ফিরে পাওয়াকেই রির্সোস বললে ভুল করা হবে, যেমন ভুল করা হবে উপায়কে লক্ষ্য বা লক্ষণকে আসল বস্তু বলে গ্রহণ করা হলে।
অতএব পুরাতনে ফিরে যাওয়াই রির্সোস নয়, জীবনপ্রীতি তথা বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনাপ্রীতিই রিনের্সস। ওয়ালটার পেটার বলেন : রিনের্সাস কথাটা আজকাল কেবল পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রাচীন গ্রিক-সাহিত্যপ্রীতি না বুঝিয়ে এমন এক জটিল আন্দোলন বোঝায়, গ্রিক জ্ঞানপ্রীতি যার একটা দিক বা লক্ষণ মাত্র! তার মতে রিনের্সাসের যুগ বুদ্ধি ও কল্পনার বস্তুর প্রতি আগ্রহশীল এক উদার জীবনের যুগ। কি পুরাতন, কি নতুন, বুদ্ধি ও কল্পনার বস্তুর খোঁজে এ-যুগ চঞ্চল। অবশ্য গ্রিসের প্রতি এযুগের দৃষ্টি বিশেষ ও অধিক। তার হেতুও আছে জীবনপ্রীতির এমন উজ্জ্বল সূর্য গ্রিস ছাড়া আর কোথাও উদিত হয়নি। তাই জ্বলন্ত আদর্শের জন্য সেদিকে না তাকিয়ে তার উপায় ছিল না।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রিনেসাঁসের সূত্রপাত ধরা হয়, আর ইটালিকে তার জন্মভূমি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তার পূর্বেও রিনেসাঁসের খোঁজ পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ও ত্রয়োদশ শতকের প্রথমদিকের ফরাসি দেশেও রিনেসাঁসের মতো একটা কিছু ছিল।*[ * শুধু মধ্যযুগীয় ফরাসি দেশেই যে রিনেসাঁসের পূর্বাভাস দৃষ্ট হয় তা নয়, ইংলন্ড ও ইটালিতেও তার পরিচয় মেলে। প্রতি দেশেই যেন কয়েকটি কোকিল বসন্তের অগ্রদূতের মতো শীতের মরসুমেই গেয়ে উঠতে চেয়েছিল, দু-একটি ফুল আগেভাগেই ফুটে উঠে অনাগত বসন্তকে অভিনন্দিত করতে চেয়েছিল। (এরা যেন সেই অগ্রদূত যাদের লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘ওরে তোদের ত্বর সহে না আর ওরে চাপা ওরে উন্মত্ত বকুল।’) ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইংলন্ডে রোজার বেকন আধুনিক বিজ্ঞানের সম্ভাবনায় উল্ল হয়ে ওঠেন, আর তারও আগে ইটালিতে ফ্লায়ার যোয়াচিম মানবাত্মার ভবিষ্যৎ বিজয়ের কথা প্রচার করতে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হন। তাঁর সেই বিখ্যাত মরমী উক্তি : The Gospel of the Father was past, the Gospel of the son was passing, the Gospel of the spirit was to be : 64 ago রিনেসাঁসেরই আবাহনী।] শাস্ত্র-শাসনমুক্ত, হৃদয় ও প্রেমের প্রাধান্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটা জীবন দর্শন এ-যুগের আঁধার-আকাশে রাত্রিশেষের শুকতারার মতো উজ্জ্বল। প্রভেন্স কবিতায় তার দৃষ্টান্ত মেলে।
পণ্ডিতপ্রবর আবেলার্ডের প্রেমকাহিনী আর আমিস ও আমিলের প্রাবাদিক বন্ধুতার গল্প হৃদয় ও বুদ্ধির মুক্তির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত; অকাসিন ও নিকোলেতের প্রেমকাহিনীও তাই। প্রথম দুটি বীর্যে আর তৃতীয়টি মাধুর্যে মণ্ডিত। পঞ্চদশ শতাব্দীর আলোকপন্থীদের যে কঠোর বিরোধিতার ভেতর দিয়ে গিয়ে বীর্যবত্তার পরিচয় দিতে হয়েছিল মধ্যযুগের আবেলার্ডকে তার চেয়ে কম বিরোধিতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। আলোকপন্থীদের আলোর পিপাসায় যে দুঃখের আবির্ভাব, আবেলার্ডের জীবন সেই দুঃখে জর্জরিত, তবু অপরাজিত মন নিয়ে ঝড়ঝাঁপটা-বিধ্বস্ত মহীরুহের মতো তিনি দণ্ডায়মান। প্রেম ও জ্ঞানের এমন সুন্দর সমন্বয় স্বল্পই দৃষ্ট হয়। জ্ঞানী তিনি, প্রেমের জন্য নির্যাতনকে পরম বরণীয় বলেই গ্রহণ করেছিলেন।
প্রচলিত নীতিবিরোধিতা মধ্যযুগীয় রিনেসাঁসের একটি বিশেষ লক্ষণ। হৃদয় ও বুদ্ধির মুক্তির তাগিদে ধর্ম ও নীতির বেড়া অতিক্রম আলোকপন্থীরা জীবনপ্রীতিরই নিদর্শন বলে গ্রহণ করলেন। মানা নয়–জানা, বোঝা ও জয় করাই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে উঠল। ইন্দ্রিয়সুখ ও কল্পনাবিলাসের জয়যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে তারা ধীরে ধীরে খ্রিস্টানধর্মের সীমানার বাইরে এসে দাঁড়ালেন, আর তাঁদের প্রেম যেন একটা অদ্ভুত পৌত্তলিকতা একটা ভিন্ন ধর্মের রূপ গ্রহণ করল। আবার ফিরে এলেন ভেনাস, ফিরে এল দেহকেন্দ্রিক পূজা। এই নীতিবিরোধিতা (অ্যান্টিনোমিয়ানিজম) সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় অকাসিন ও নিকোলেতের গল্পে। অকাসিনকে যখন নরক-যন্ত্রণার ভয় দেখানো হয়েছিল, তখন তিনি যা বলেছিলেন তা সত্যই বুদ্ধি ও বীর্যে ভাস্বর। প্রেমপ্রবণ, সজাগ-ইন্দ্রিয় সেই যুবক স্বর্গের পথে একদল জরাজীর্ণ নিরানন্দ পুরোহিত ছাড়া আর কিছুই দেখতে না পেয়ে পণ্ডিত, বিলাসী ও রসিকদের সঙ্গে নরকের পথানুসরণই বাঞ্ছনীয় মনে করলেন। জীবনকে প্রচলিত নীতির ঊর্ধ্বে তুলে ধরার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল।
মানব-কল্পনা ও খ্রিস্টানধর্মের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা এ-যুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য; আর তা দেখতে পাওয়া যায় আমিস ও আমিলের গল্পে। খ্রিস্টান-সন্ন্যাসী রচিত এই গল্পে মর্ত-মানবের স্বর্গীয় বন্ধুতার এমন সুন্দর ছবি আঁকা হয়েছে যে, লোকেরা এই দুই বন্ধুকে শহীদরূপে গণ্য না করে পারেনি। মানবীয় কল্পনা এখানে পবিত্র ধর্মের শ্রদ্ধা লাভ করেছে। দুই বন্ধু খ্রিস্টান-জগতে সাধুকল্প পুরুষরূপে গৃহীত হয়েছিলেন। খ্রিস্টানধর্ম ও মানব-কল্পনার সুন্দর সমন্বয় সাধনই যেন এই গল্পের উদ্দেশ্য।
পঞ্চদশ শতাব্দীর ইটালীয় রিনেসাঁসেও সেই একই ব্যাপার। নানা আপাতবিরোধী ভাবকে একত্র করে সামঞ্জস্য-বিধানের দ্বারা একটি উদার বহুভঙ্গিম সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রয়াস এ-যুগের বিশেষ কীর্তি। পূর্বে গ্রিকদেবতাদের প্রতি তাকানো হত যে অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে, গ্রিকসাহিত্য চর্চার ফলে তা ধীরে ধীরে তিরোহিত হল, এবং গ্রিকদেবতা তথা গ্রিকপুরাণ ধর্মের বিষয়বস্তুরূপে না হলেও শিল্প ও কাব্যের বিষয়বস্তুরূপে সমাদৃত হল। তবে শিল্পের প্রতি পঞ্চদশ শতকের শ্রদ্ধা এতবেশি ছিল যে শিল্পের বস্তুতে ধর্মের মর্যাদা দিতে এ-যুগ কুণ্ঠাবোধ করেনি। জ্ঞান ও রসিকগণ ধীরে ধীরে গ্রিক ও খ্রিস্টানধর্মের বিরোধিতা সম্বন্ধে সন্দিহান হতে থাকেন। পরিশেষে তা একেবারে তিরোহিত হল এবং দুই ধর্ম কালভেদে একই মানবমনের বিভিন্ন প্রকাশ রূপে গৃহীত হল।
আধুনিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ধর্মে ধর্মে এই পারস্পরিক সম্বন্ধ সহজেই স্বীকার করেন এবং ধর্ম ব্যাপারটা-যে অন্যান্য ব্যাপারের মতো ক্রমবিকাশের ফল এ-কথায় সায় না দিয়ে পারেন না। মানবমনের সৃজনশীলতাই ধর্মের গোড়ায়। অতএব এই রহস্যময় সত্তার ভিতরেই প্রাচীন ও নবীন ধর্মের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়–যেমন শৈশবের কল্পনা আর পরিণত বয়সের চিন্তা খুঁজে পাওয়া যায় একই ব্যক্তির অভিজ্ঞতায়। (সাহিত্য-কাব্যকেও প্রাচীন ও নবীন দুই ভাগে ভাগ করে দেখা হয়, কিন্তু তাই বলে তারা সত্য-সত্যই আলাদা নয়–একই মনের সৃষ্টি বলে বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের ভেতর ঐক্য সুস্পষ্ট।) তাই উদার অ-ছুৎমার্গী রিনেসাঁসের কাজ হল খ্রিস্টানধর্ম ও গ্রিকধর্মের মধ্যে আত্মীয়তা সম্পর্ক খুঁজে বের করা–বিরোধমত্ত হয়ে এককে অপর থেকে দূরে ঠেলে ফেলা নয়। মধ্যযুগ অন্ধতার দরুন যে-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গিন উঁচিয়েছিল, এ-যুগে তার কোনো পাত্তাই পাওয়া যায় না, উদারতার আবহাওয়ার দরুন সকলে যেন ঘেঁষাঘেঁষি করে চলতে শিখেছে, আর তারই ফলে কৌণিকতা মসৃণতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই সহানুভূতি, মনুষ্যত্বে এই অপরিসীম শ্রদ্ধা, এ-ই রিনেসাঁসের গোড়ার কথা। ভেদনীতি নয়, মিলন-নীতির ওপরই এর প্রতিষ্ঠা। মানবমন এককালে যা আত্মপ্রকাশের উপায়রূপে গ্রহণ করেছিল, যা থেকে তা আনন্দ-বেদনার প্রেরণা পেয়েছিল, তা তুচ্ছ ও বাজে নয়, তার মধ্যেও খুশি হবার জিনিস রয়েছে, এই প্রত্যয়ে এ-যুগের আত্মা উজ্জ্বল। স্বাতন্ত্র ধ্বজা এ-যুগের আকাশে ওড়েনি; এ-যুগ বিলিয়ে দেওয়ার যুগ–সত্যের কাছে, সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার যুগ। যা ভালো, তা গ্রহণ করো, আপন-পরের চিন্তায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ো না–এ-ই এ-যুগের মর্মবাণী।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য এ-যুগের ছিল না, আর সেজন্য তাকে দোষও দেওয়া যায় না, কেননা তা নিতান্ত হালের জিনিস। তবু একটা মিলনাত্মক প্রেরণায় মুসার সঙ্গে হোমার ও প্লেটোর ঐক্য-সাধনের জন্য যুগের আত্মা ব্যাকূল। ঐক্যসাধনের উদ্দেশ্যে নানা ব্যাপারে গোজামিল দিতেও তা কুণ্ঠাবোধ করেনি। এ-যুগের আত্মার বাণী যেন, ‘মিলনধর্মী মানুষ মিলিবে, ভয় নাই, ভয় নাই। মিরাণডোলার পিকো এই মিল-প্রচেষ্টার জীবন্ত প্রতীক। তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল ‘To bind the ages each by natural piety. আপাতবিরোধ সত্ত্বেও গ্রিকধর্মের সঙ্গে যে খ্রিস্টানধর্মের মিল রয়েছে, উভয়ই রহস্যাভিসারী মানবমনের সৃষ্টি পিকোর চিন্তার গোড়ার কথা তা-ই, খ্রিস্টাননাপযোগী আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি তার কম ছিল না, তথাপি প্রাচীন দেবতাদের ভোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মানবমনের আলোক-পিপাসা থেকে সৃষ্ট বলে তারা তার কাছে আলোকেরই দূত। গ্রিকদেবতাদের পেছনে যে-কল্পনার সত্য রয়েছে, তা তিনি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করেছিলেন।
পিকোর রচনার উদ্দেশ্য, মানবপ্রকৃতির মহিমা ও মানুষের সৌন্দর্য প্রচার। মধ্যযুগে মানব-প্রকৃতির প্রতি যে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, পিকোর রচনা যেন তারই যোগ্য প্রতিবাদ। তারই ফলে রিনেসাঁসের যুগে দেহ, বুদ্ধি ও কল্পনার সহজ-স্বীকৃতি। প্রাচীন গ্রিসে এই স্বীকৃতির জ্বলন্ত স্বাক্ষর রয়েছে বলে তিনি তার প্রতি একান্ত আকৃষ্ট। মিলনের দূত তিনি, তাই প্রাচীন গ্রিস ও খ্রিস্টানজগতের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখাবার জন্য ‘হেপ্টেপ্লাস’ বা ‘ডিসকোর্স অন দি সেভেন ডেজ অব ক্রিয়েশন রচনা করলেন। প্লেটোর ‘টিমিয়াসের সঙ্গে মুসার ‘জেনেসিসের যে সাদৃশ্য রয়েছে, এ পুস্তকে তাই দেখাবার চেষ্টা হয়েছে। এরূপ প্রয়াসের ফলে রিনেসাঁসের যুগে দুই ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে এক ঐশ্বর্যময় নব পুরাণের সৃষ্টি। জেরুজালেম ও পিসার মাটির সংমিশ্রণে যেমন এক নব পুষ্পের সূচনা হয়েছিল, গ্রিস ও খ্রিস্টান পুরাণের সংমিশ্রণেও তেমনি এক নব-পুরাণের সৃষ্টি হল। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকের শিল্পে বিপরীতের যে-সুন্দর সংমিশ্রণ, পিকোর জীবন তারই বাস্তব প্রতিলিপি, আর এখানেই তার জীবনের মূল্য। জ্ঞানের জন্যই তিনি জ্ঞান খোঁজেননি, বরং জ্ঞানে জ্ঞানে মিল রয়েছে, নির্বুদ্ধিতার ফলে মানুষ তা ভুলে গেছে, এই সত্য প্রমাণিত করবার জন্যই তার জ্ঞানান্বেষণ। পিকো সত্যকারের হিউমানিস্ট বা মান্বতাবাদী, কেননা…”The essence of humanism is that belief of which he seems never to have doubted, that nothing which has ever interested living men and women can wholly lose its vitality–no language they have spoken, nor oracle beside which they have hushed their voices, no dream which has once been entertained by actual human minds, nothing about which they have ever been passionate, or expended time and zeal.”
রিনেসাঁসের মর্মকথা এই মানবতা। শুধু পিকো নয়, পঞ্চদশ শতকের অপরাপর জ্ঞানীগুণীর ভেতরেও তা পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিসি প্রমুখের রচনায় হিউম্যানিজমের প্রেরণা সুস্পষ্ট। উইকেলম্যান্ অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান সন্তান, তিনিও পুরোদস্তুর হিউম্যানিস্ট। গ্যেটে তার এই গুরু সম্বন্ধে বলেছেন যে, তিনি পুরোপুরি প্যাগান ছিলেন, আর খ্রিস্টানজগৎ সংক্রান্ত ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। ঈশ্বরের আদেশ নয়–মানবমন, মানুষের কল্পনা ও অনুভূতি, মানবদেহ গ্রিক সংস্কৃতির গোড়ার কথা বলে তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং আজীবন তার চর্চায় রত থাকেন। তাই পরবর্তীকালের লোক হলেও এই শিল্প-জহুরীকে রির্সোসের শেষ ফল বলে গণ্য করা যায়।
আমাদের দেশের প্রতি এখন তাকানো যাক। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রিনেসাঁসের কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়। এ-যুগ মুসলমানের সমৃদ্ধির যুগ (এখানে মুসলমানের সম্বন্ধেই শুধু বলা হচ্ছে), তাই তাদের সীমাহীন কৌতূহল। জোয়ারের নদীর মতো এখন তারা কেবলই মানুষকে আপন করতে চাচ্ছে। (ভাটার নদীর ভিন্ন ধারা, সে কেবলই ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না বলে সঙ্কুচিত হয়ে সরে যায়।) হিন্দুর রামায়ণ-মহাভারত মুসলিম নওয়াব ওমরাহদের মনে যে সহানুভূতি সৃষ্টি করেছিল তার কাছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য অনেকখানি ঋণী। স্রষ্টার গৌরবের অধিকারী না হলেও, পালকের মর্যাদা তাদের দেওয়া যায়। রিনেসাঁসের জন্য যে উদারতা বর্তমান, এ তারই নিদর্শন। গোরক্ষ বিজয়’ রচয়িতা ফয়জুল্লার অন্তরে যে-ভিন্নধর্মী গোরক্ষণাথের মাহাত্ম্য সাড়া জাগিয়েছিল, মানব-মহিমার অন্তর্গত বলে তা রিনেসাঁসের পর্যায়ভুক্ত। অহঙ্কার-পীড়িত মানবমন (সে অহঙ্কার ব্যক্তিগতই থোক, আর জাতিগতই হোক) অপরের মাহাত্ম্য ও কীর্তি উপলব্ধি করতে অক্ষম। ফয়জুল্লা যে পেরেছিলেন এতেই বুঝতে পারা যায়, প্রেমের প্রসাদে অহমিকামুক্তি তিনি লাভ করেছিলেন। শুধু ফয়জুল্লা নয়, অন্যান্য কবি ও গীতিকারের রচনায়ও এর নিদর্শন প্রচুর। হিন্দু দেব-দেবী, রাধাকৃষ্ণ, কামরতি প্রভৃতির নাম তো সকলের কাব্যেই বর্তমান। কবি বলে কল্পনার বস্তুর মর্যাদা দিতে তারা শিখেছিলেন। ছুত্যাগী তারা ছিলেন না–বৈশিষ্ট্যের তুষার প্রাচীর তাঁদের প্রেমের উত্তাপে গলে যাচ্ছিল।
রিনেসাঁসের দুটি দিক বুদ্ধি ও হৃদয়। এ-যুগে বুদ্ধির সাধনা বিশেষ হয় নি, কিন্তু প্রেমের সাধনা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের রূপকে বহু কবি আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটাবার চেষ্টা করেছেন। আউল-বাউলের রচনায় বিবাগী মনের যে-বেদনা তা সত্যই মহান, আর আজো তা বহু ভাবুকের অশ্রু-নিঝর। ধর্মের সম্পর্ক বর্জিত নিছক মানবীয় প্রেম-কাহিনী রচনার পথপ্রদর্শকও মুসলমান। দৌলত কাজি, আলাওলের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এঁদের রচনা থেকেই ‘টেল ফর টেলস্ সেকে’র শুরু। মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্যে যে মানবমহিমা গভীরভাবে উপলব্ধ হয়েছিল নিচের দুটি পদে তার পরিচয় পাওয়া যায় :
মোর পরে পয়গম্বর না জন্মিবে আর
মোর পরে হইবেক কবি ঋষিগণ।
প্রভুর গোপন রত্নে বান্ধিবেক মন।
শাস্ত্রসব ত্যাগ করি ভাবে ডুম্ব দি-আ।
প্রভু প্রেমে প্রেম করি রহিবে জড়ি-আ
আমার হৃদয় কমল চলতেছে ফুটে যুগ যুগ ধরি,
তাত্র তুমিও বাঁধা আমিও বাঁধা, উপায় কী করি?
ফোটে ফোটে ফোটে কমল ফোঁটার না হয় শেষ;
এই কমলের যে-এক মধু, রস যে তার বিশেষ।
ছেড়ে যেতে লোভী ভ্রমর, পায়রা না যে তাই।
তাই তুমিও বাঁধা আমিও বাধা, মুক্তি কোথাও নাই।
মিলন-স্পৃহার তাগিদে ঐতিহে ঐতিহ্যে গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টাও এ-যুগে কম হয় নি। প্রেমের জাদুতে পরকে আপন করবার জন্য এ-যুগ ব্যাকুল।
পুবেতে বন্দনা করি পুবে ভানুশ্বর
একদিকে উদয় ভানু, চৌদিকে পশরা।
দক্ষিণে বন্দনা করি ক্ষীরনদী-সাগর।
যেখানে বাণিজ্য করে চাঁদ সদাগর।
উত্তরে বন্দনা করি কৈলাস পর্বত
যেখানে পড়ি আছে আলীর মালামের পাথর
পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা হেন স্থান।
উদ্দেশে বাড়ায় সালাম মোমিন মুসলমান।
সভা করি বসছ ভাইরে হিন্দু-মুসলমান;
সভার চরণে আমি জানাই সালাম।
একই সভায় হিন্দু মুসলমান আসীন। অতএব কেবল মুসলমানের কথা বললে চলে না, হিন্দুর কথাও বলতে হয়; নইলে হিন্দু-মুসলমান উভয়কে সালাম জানানো অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। কবি তাই আগে থাকতে বিশ্বাস সৃষ্টি করে পরে সালাম জানিয়েছেন।
কিন্তু এই প্রেম, চিন্তার এই স্বাধীনতা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি, পরাজয়ের বিষাদের ছায়ায় মুসলমান যে শোচনীয় অস্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করলে, তাতে মানব মহিমা ব্যাহত হল। কল্পনা ও প্রেমকে বর্জন করে শুধু শাস্ত্রকেই জীবনের একমাত্র নিয়ামক বলে গ্রহণ করা হল বলে আনন্দ বিদায় নিলে, রুক্ষতা প্রবলপ্রতাপান্বিত হয়ে জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করলে। (আজো তার প্রতাপ কমেনি, ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্য থেকে গেছে, কিন্তু বুদ্ধি ও কল্পনার বিরুদ্ধে লড়াই সমান চলেছে।) স্বাতন্ত্রের অবতাররা বৈশিষ্ট্যের তুঙ্গ প্রাচীর তুলে আলাদা হয়ে বাস করাই জীবনের চরিতার্থতা মনে করলেন, আর তারই ফলে মানসিক ছুৎমার্গ মুসলমান সমাজে শিকড় গেড়ে বসল।
ওহাবী মনোভাবের কথা বলছি। এ কেবল গোসা করতে, কেবলি আলাদা হতে শিখেছে, প্রেমের অপরিমেয়তায় জীবনের ঐশ্বর্য উপলব্ধি করতে শেখেনি। অবশ্য এ মুসলমানকে যোচূবেশ দিয়েছে; বীরত্ব-প্রেমিকরা এইজন্য তার প্রতি বিস্মিত-দৃষ্টি। কিন্তু এই যোদ্ধৃবেশের পেছনের কোনো বড় লক্ষ্য নেই বলে মোটের ওপর তা অসার্থক। স্বাধীন দেশে মুসলমানের ও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীর মুখে হাসি ফুটুক (প্রতিবেশীর মুখে হাসি না ফুটলে মুসলমানের মুখে হাসি ফুটতে পারে না, কেননা ভাগ্যের একই তরীতে তারা ভাসমান), মুসলমানের জীবন সার্থক হোক, ফুলে ফুলে সুশোভিত হোক–এই আদর্শে প্রণোদিত হয়ে তার যুদ্ধোদ্যম নয়, ইসলামকে অবিকৃত অপরিবর্তিত রাখতে হলে স্বাধীনতার প্রয়োজন, এই চিন্তাই তার প্রেরণাকেন্দ্র। সুতরাং তা থেকে কোনো বড়কিছু আশা করা অন্যায়। ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্মচিন্তা-জগতের এই প্রাথমিক সাধারণ সত্যই মর্মগত হয়নি বলে তা ব্যর্থতারই আরাধনা করেছে।
তারপরে ইংরেজিশিক্ষার যুগ। কিন্তু সানন্দচিত্তে গৃহীত হয়নি বলে সংস্কৃতিজগতে তাও বন্ধ্যা প্রমাণিত হল। নব-শিক্ষা মানে নব-বিশ্বাস। মুসলমান নব-শিক্ষাকে গ্রহণ করলে সন্দিগ্ধচিত্তে–কেবলই টিকে থাকবার জন্যে। সুতরাং কতিপয় চাকুরে সৃষ্টি ছাড়া তা আর কিছুই করতে পারলে না। বুদ্ধি-অনুভূতি-কল্পনা, সাহিত্য-শিল্প-আনন্দ তখনো মুসলমানের মর্মগত হয়নি। সে কেবলই বৃদ্ধের মতো লাঠিতে ভর দিয়ে জীবনের ভার বয়ে চলেছে। সংস্কৃতির এই শীতের দেশে হঠাৎ এলেন নজরুল ইসলাম। বসন্তের মত্ততার মতো তাঁর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রিনেসাঁসের আবির্ভাব হল–বুদ্ধি অনুভূতি ও কল্পনার দ্বার খুলে গিয়ে মানব-মহিমা উপলব্ধ হল। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ মানব-মহিমারই কাব্য। বন্ধন-জর্জর মানবাত্মার যন্ত্রণা এখানে বিদ্রোহের বেশে আত্মপ্রকাশ করেছে। জরাজীর্ণ দৈন্য দুর্দশাময় পুরোনো পৃথিবী ভেঙে নতুন পৃথিবী গড়ার প্রয়াস-যে মানব-মহিমার চূড়ান্ত, তা সহজেই স্বীকার্য। বাঁচবার স্বাদ আমরা প্রথমে নজরুলের কাব্য থেকেই লাভ করি, জীবনের নিয়ামক যে জীবন নিজেই, আর কিছু নয়, শাস্ত্র-সংহিতা সেখানে শুধু মন্ত্রণা দিতে আসতে পারে, এ-বোধ সর্বপ্রথমে নজরুলের কাব্য থেকেই আমরা পাই। উপদেশ নিয়ে নয়, উচ্ছল সজীব জীবনের প্রতীক হয়ে তিনি তা প্রমাণিত করলেন। জীবনের আগ্রহে জীবনের প্রতিকূল আইনকে আমল দিতে তিনি চাননি–তাকে বন্ধনের রজ্জ্ব বলেই মনে করতেন। যে প্রচলিত নীতিবিরোধিতা (অ্যান্টিনোমিয়ানিজম) রিনেসাঁসের একটি বড় নিদর্শন, নজরুলের জীবনে ও কাব্যে তা সুপ্রচুর। আবেলার্ড, পিকো প্রভৃতি যে-বিরোধিতার ভেতর দিয়ে গিয়ে আত্মার ঐশ্বর্য প্রকাশ করেছিলেন নজরুল ইসলামেও তা বর্তমান। ঐতিহ্যে ঐতিহ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস নজরুলের কাব্যে সুস্পষ্ট। হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে তিনি ভিন্ন ভিন্ন কবিতা তো রচনা করেছেনই, ভাবসৌকর্যের জন্য একই রচনায় হিন্দু-প্রতীক ও মুসলমান মহাপুরুষের নাম গ্রহণ করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি। এটা চিত্তের বীর্যশালিতারই পরিচায়ক।
হিন্দু ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখবার এই-যে প্রয়াস, এর জন্য রিনেসাঁসকামী কোনো কোনো লেখক দুঃখ ও লজ্জাবোধ করেন। তাঁদের কথা : রবীন্দ্রনাথ মুসলমানী ব্যাপার নিয়ে কোনো কবিতা লিখলেন না, অথচ নজরুল ইসলাম কিনা বেহায়ার মতো (কথাটা অবশ্য তারা ব্যবহার করেন না, কিন্তু মনের কোণে ওরকম একটা কথা থেকে যায়। বহু হিন্দুয়ানি রচনা লিখলেন। এতে তাঁদের জাতীয়-সম্মানবোধ ক্ষুণ্ণ হয়, তাদের মাথা নুয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, তারা যে মনোভাবের দ্বারা পীড়িত, সে হচ্ছে প্রেসটিজ-বোধ, আর এ প্রেসটিজ-বোধ থেকে-যে জগতে কত অনাচার হয়েছে ও হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রসঙ্গত আজকাল লোকেরা প্রেসটিজের যতটা পূজা করে, ডিগনিটির ততটা পূজা করে না। তারই ফলে জগৎ অত্যাচার-অবিচার ও কলঙ্ক-কুশ্রীতায় পরিপূর্ণ। সত্য কি মিথ্যা, এ প্রশ্ন আজ বড় নয়, সম্মান রক্ষা হবে কি হবে না এ-প্রশ্নই বড়। এরই ফলে কয়েকটি বিভ্রান্তিকর শব্দের সৃষ্টি : ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স, সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স ইত্যাদি। বুলির মতো এরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু মনের ব্যাপার বলে এদের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া কঠিন। মুশকিল এই যে, যাকে সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স বলা হয় তার নিচে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স লুকিয়ে থাকে, আর প্রেম আর সত্যানুসরণকে যে অনেক সময় ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স বলে গাল দেওয়া হয়, এ তো প্রায় সব সময়েই দেখতে পাওয়া যায়। অতএব ইনফিরিওরিটি সুপিরিওরিটি প্রভৃতি কমপ্লেক্সের আবর্তে পড়ে সত্য-মিথ্যার প্রশ্নকেই বড় করে তোলা দরকার। কেননা, তা-ই আমাদের জীবনকে সারল্য তথা শক্তিমণ্ডিত করতে সক্ষম।
নজরুল ইসলাম যে হিন্দুর ঐতিহ্য নিয়ে রচনা লিখলেন, আর রবীন্দ্রনাথ যে মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লিখলেন না, তার কারণ সোজা। হিন্দুর ঐতিহ্যে নজরুল তথা মুসলমানের উত্তরাধিকার রয়েছে, কিন্তু মুসলমানের ঐতিহ্যে রবীন্দ্রনাথের তথা হিন্দুর উত্তরাধিকার নেই। প্রাণের যোগ নেই বলে বহিরাগত ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করা কষ্টসাধ্য, কিন্তু দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি একপ্রকার জলবায়ুর মতো সহজ। তা বোঝা কঠিন নয়, তাকে জানতে হয় না, সে নিজেই নিজেকে জানিয়ে যায়, আর আমরা জেনেও টের পাইনে যে জেনেছি। এই দিনের আলোর মতোই সহজ সত্যকে যারা অস্বীকার করেন, মাটির বাঁধনকে স্বীকার করতে চান না, শুকিয়ে মরা তাদের ভাগ্যলিপি। (ইউরোপীয় রিনেসাঁসকে এক হিসেবে মাতৃভূমির সাধনার সঙ্গে পিতৃভূমির সাধনার সংমিশ্রণ-প্রয়াস বলা যেতে পারে।) হিন্দু ঐতিহ্য, মুসলিম ঐতিহ্য এ-দুয়ের সংমিশ্রণের দায়িত্ব মুসলমানেরই, হিন্দুর নয়–কেননা, হিন্দুর দুই উত্তরাধিকার নয়। অথচ সে-মিলনের জন্য বারবার হিন্দুর দিকেই তাকানো হয়েছে; বলা হয়েছে হিন্দু বড়ভাই ও মুসলমান ছোটভাই, সম্প্রীতির কথাটি বড়ভাইয়ের তরফ থেকেই আসা উচিত। কিন্তু প্রশ্নটি আসলে সম্প্রীতির নয়, উত্তরাধিকারের; আর উত্তরাধিকারের ব্যাপকতায় মুসলমান হিন্দুর চেয়ে বড় মাতৃ-সম্পত্তি ও পিতৃ-সম্পত্তি উভয়েরই সে ওয়ারিশ। মুসলমান যদি এই দুই উত্তরাধিকার স্বীকার করে, তবে তার দ্বারা এক বড় সৃষ্টি সম্ভব–আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মন্থনদণ্ডে মন্থিত করে সে দুই সংস্কৃতিকে এক বিরাট নব-সংস্কৃতিতে পরিণত করতে পারে। এ গৌরব মুসলমানের জন্যই অপেক্ষা করছে, তবে সে তা চায় কি না, সেটাই প্রশ্ন। প্রতিভার স্বাদ পেতে হলে এই মিলন-সাধনা তথা জীবন-সাধনার সাধক হওয়া দরকার। বিরোধ অত্যন্ত সোজা, মিলন কঠিন, কঠিনের সাধনাই প্রতিভা-বিকাশের একমাত্র পথ, তা ভেতরের সুপ্তশক্তিকে জাগিয়ে তোলে, নিদ্রার অবকাশ দেয় না। (বিরোধ বলতে আমি অপর সম্প্রদায় বা অপর জাতির সঙ্গে বিরোধ বুঝেছি, নিজের সম্প্রদায় বা নিজের সঙ্গে নয়। নিজের জাতির সঙ্গে বিরোধ অত্যন্ত কঠিন, মহাপুরুষের জীবনেই তা দৃষ্ট হয়।)
হিন্দুর উত্তরাধিকার যে অনেকখানি মুসলমানের উত্তরাধিকার তার প্রমাণ, হিন্দুর অনেক কিছুই আমরা জানি, বুঝি ও উপভোগ করি এবং এইজন্য দুঃখও প্রকাশ করি। এই জানার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
১. সব মুসলমান আরব কি ইরান তুরান হতে আসে নি। অন্তত শতকরা পঞ্চাশজন হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে।
২. বিদেশাগত বাকি পঞ্চাশজনের প্রত্যেকে যে স্বদেশ থেকে পত্নী নিয়ে এসেছিলেন এমন মনে করা বাতুলতা। অন্তত বিশজন দেশী পত্নী গ্রহণ করেছিলেন।
৩. হিন্দুধর্ম উৎসবময়, আর উত্সব-ছোঁয়াচে। হিন্দুর নানা উৎসবের সংস্পর্শে এসে, বিশেষ করে যাত্রা-পাঁচালি, কবিগান ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে মুসলমান বেমালুম হিন্দুধর্মের অনেক কিছু জেনেছে ও পেয়েছে।
৪. কালচারের ব্যাপার হয়ে হিন্দুধর্ম সাধারণতা লাভ করেছে, আর তারই ফলে তা মুসলমানের মনে প্রবেশপথ খুঁজে পেয়েছে। সাহিত্য তথা আনন্দের বস্তু হয়ে (কাব্য কাহিনীময় বলে) তা আমাদের হৃদয়ের দুয়ারে আঘাত করেছে, আর আমরা বেদরদীর মতো দ্বার রুদ্ধ করে থাকতে পারিনি। (মুসলমান ধর্মও সাহিত্য তথা আনন্দের ব্যাপার হয়ে হিন্দুর অবচেতনে স্থান নিতে পারত, কিন্তু সে প্রচেষ্টা আজো বিশেষ হয়নি। আরবি ও ফরাসি ভাষার সিন্দুক হতে মাতৃভাষার সূর্যালোকে ইসলামকে মুক্তি না দিলে তা সম্ভব হবে না। সেজন্য ইসলাম-প্রীতির সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশ-প্রীতিও প্রয়োজনীয়। কেননা, রোগী-প্রীতি ব্যতীত চিকিৎসকের সার্থকতা অসম্ভব। কিন্তু যেরূপ আরবি-পারসি মিশ্রিত রচনার জন্য উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, তাতে সে ভরসাও হয় না। মনে হয়, রচনাগুলি কেবলি আরবি-পারসি জানা মুসলমান পাঠকের জন্য লেখা হচ্ছে, সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্য নয়)।
এইসব কারণে হিন্দুর উত্তরাধিকার অনেকটা মুসলমানেরও উত্তরাধিকার। অসূয়াপরবশ হয়ে মুসলমান জোর করে তা অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু তা হলেই তা মিথ্যা হয়ে যাবে না। আজো বাঙালি মুসলমান খাঁটি মুসলমান হয়নি। এ দুঃখের ভেতরেই আমার কথার সত্যতা জাজ্বল্যমান।
নজরুল ইসলামের হিন্দুয়ানি রচনা লিখবার কারণ এইখানে। এ তার উত্তরাধিকার প্রমাণিত করে, ব্যভিচার নয়। রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ না করে আরবদেশে জন্মগ্রহণ করতেন ও আরবি ভাষায় কাব্য রচনা করতেন তো আরবদেশের ‘রেস-কালচারের প্রভাব এড়িয়ে চলা তার পক্ষে অসম্ভব হত। মুসলমান না হলেও মুসলমানির প্রভাবযুক্ত তিনি হতেনই, এ এতই সহজ ও স্বাভাবিক যে, এ নিয়ে তর্ক চলে না, যেমন তর্ক চলে না নিশ্বাস-প্রশ্বাসের অস্তিত্ব নিয়ে।
নজরুল ইসলাম রিনেসাঁসের প্রেরণা : বুদ্ধি ও হৃদয়ের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তিনি অনুভব করেছিলেন। তাঁর রচনার মারফতে তা আমাদের জীবনে সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু শুধু ইসলামি রচনার জন্য তাঁকে ‘রেনেসা শুরু মনে করা ছেলেমি ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা এরূপ বলেন, তাঁরা রিনেসাঁস কথাটির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেননি। রিভাই-ভালইজমকে তাঁরা রিনেসাঁস বলতে চান। (রিভাইভালইজম ও রিনেসাঁসের পার্থক্য কী, এ প্রশ্ন অনেকে করেন। উত্তরে বলতে পারা যায় : রিনেসাস মূল্যবোধ, রিভাইভালইজম অহমিকা-বোধ, রিনেসাঁসের জন্য বিশেষ জাতি তার নিজের সৌন্দর্যের দিকেও তাকাতে পারে, সেটা অন্যায় নয়। কিন্তু শুধু সেদিকেই তাকানোর প্রবৃত্তি অন্যায়। কেননা, সেটা সৌন্দর্যপ্রেরিত নয়, অহঙ্কারপ্রেরিত। আর অহঙ্কার যে বহুল, সে জানা কথা।)
প্রাণের অন্ধ আবেগে নজরুল যা করতে চেয়েছিলেন মুসলমান সাহিত্য-সমাজ (ঢাকা) তারই জাগ্রত প্রচেষ্টা। বুদ্ধির মুক্তি ছিল এর লক্ষ্য। সচেতনভাবে দলবদ্ধ হয়ে সমাজের কর্মকর্তারা বুদ্ধির মুক্তির যে-আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন, তা সত্যই অপূর্ব–শুধু মুসলমান সমাজের নয়, বাংলার সংস্কৃতি-আন্দোলনে এর এক বড় স্থান। মানুষের জীবন ছিল এর সামনে; জীবনের বহুভঙ্গিম বিকাশকে সম্ভব করে তোলাই ছিল এর স্বপ্ন। রিনেসাঁসে বড় হয়ে উঠেছিল যে জীবন–পরকালমুখী ধর্মসাধনা নয়, ইহকালমুখী জীবন সাধনা, মানে জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্রয়াস, সাহিত্য সমাজেরও লক্ষ্য ছিল তাই। জীবন সুন্দর হোক, ঐশ্বর্যময় হোক, তার বিকাশের অন্তরায় দূরীভূত হোক, এ-ই ছিল তার অন্তর্নিহিত কামনা। জ্ঞান, প্রেম ও বুদ্ধির সন্নিপাতে জীবনের যে ঐশ্বর্যময় জয়যাত্রা, তার স্বপ্নে সমাজের নেতৃস্থানীয়দের চিত্ত আন্দোলিত হয়েছিল। সেজন্য কোনো ইজমের তাবিজে বিশ্বাসী না হয়ে গভীর জীবনানুভূতির আশ্রয় গ্রহণই এঁরা কল্যাণপ্রদ মনে করেছিলেন।
ধর্ম উপেক্ষা করা নয়, বুঝা ও উপলব্ধি করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। ধর্ম-যে মানবকল্যাণের এক অনুপম নিদান, প্রেমে-পুণ্যে জীবনকে ধন্য করার উপায়, অন্ধ অনুসরণের ব্যাপার নয়–এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন সমাজের কর্মকর্তারা। অথচ সেজন্য তাদের নিন্দিত ও নিপীড়িত হতে হয়েছিল; সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার সাক্ষী হয়ে তা ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে আছে। এই বিরোধিতার ভেতর দিয়ে গিয়ে তারা মানব-মহিমারই জয় ঘোষণা করলেন।
এটি রিনেসাঁসেরই লক্ষণ। রিনেসাঁসের অপর লক্ষণ-যে মিলনপ্রয়াস, ঐতিহ্যে ঐতিহ্যে মিলন সাধনের শুভচেষ্টা, সেও এই আন্দোলনের বিষয়বস্তু। ছুম্মাগী বৈশিষ্ট্যের বাণী প্রচার না করে তা মিলনের বাণীই প্রচার করেছিল। বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনার দ্বার খুলে দিয়ে দেশকে প্রেমের ও কল্যাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল এর লক্ষ্য।
(সাহিত্য-সমাজ সম্বন্ধে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। এই প্রবন্ধে সকল কথার ঠাই হতে পারে না। তাই সংক্ষেপে সেরে নিলাম)।
এর আরব্ধ কাজ শেষ হতে পারেনি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের আবির্ভাবে। তা না হলে এ বাঙালির জীবনে সোনা ফলাতে পারত। মুসলিম-সমাজে যদি কখনো সত্যিকারের রিনেসাঁসের আবির্ভাব হয়, তবে উপলব্ধ হবে যে তার প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করেছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। পঞ্চদশ শতাব্দীর রিনেসাঁস সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে : The Renaissance of the fifteenth century was in many things, great rather by what it designed than by what is achieved, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ সম্বন্ধেও তা বলা যেতে পারে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যা আকাঙ্ক্ষা করা হয়েছিল, অষ্টাদশ শতকে তা পূর্ণ হয়েছিল। বাংলার মুসলমান-সমাজে সেই ‘অষ্টাদশ শতাব্দী’ এখনো দূরে, কেননা পথে বহু অন্তরায়। দ্বন্দ্বের যুগ রিনেসাঁসের যুগ নয়, কারণ তাতে বুদ্ধির অপ্রমত্ততা রক্ষা করা কঠিন। বিদ্বেষাশ্ৰিত মন নিয়ে মানুষ কখনো সভ্যাভিসারী হতে পারে না। সত্যানুসরণ নয়, কেবলি শত্রুপক্ষের চালচলনের দ্বারা তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়। এইজন্য উগ্র রাজনৈতিক আন্দোলনের যুগ রিনেসাঁসের যুগ হতে পারে না। অসহিষ্ণুতার মন্ত্রে দীক্ষিত বলে অনেক সময় তা মনের উপর জবরদস্তি করে থাকে। আর রিনেসাঁস আর যাই হোক, জবরদস্তি বা অসহিষ্ণুতা নয়।* [ * *রিনেসাঁস বহুভঙ্গিম জীবন–একটি আদর্শের পিজরায় পুরে তোতাপাখিপনা শেখানো নয়। বিচিত্র জীবনের ডাকে মানুষ বিচিত্র পথের পথিক হয়; তাই সহজ সরল পন্থা জাতিগত বা সম্প্রদায়গত না হয়ে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। মুক্তি আসে নানান মূর্তি ধরে একজনের পক্ষে যা মুক্তির সরল পথ অপরের কাছে তা সরল নাও মনে হতে পারে। প্রবণতার বিভিন্নতাই এর হেতু। একই ব্যাপারে সকলের মনে সাড়া জাগবে, এমন আশা করা ভুল। ইরানের নার্গিসনয়না সাকির বিরহে কেউ দেওয়ানা হতে পারে, আবার কারো পক্ষে কালিদাসের নিপুণিকা চতুরিকার শোকে ম্রিয়মাণ হওয়া স্বাভাবিক। এই-যে বিভিন্ন রুচি, একে শুধু রক্ষা করা নয়, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করা এবং এদের পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য-বিধান করে। ঐক্য স্থাপন করা–এ-ই রিনেসাঁসের মূল প্রবৃত্তি, এর ব্যতিক্রম আর যা-ই হোক, রিনেসাঁস নয়।] অনেক সময় শত্রুর দুর্বলতা তার কাছে মনোহর মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়, আর অসহায়ের মতো সে তার অনুসরণ না করে পারে না। আমাদের সাম্প্রতিক সাহিত্যে তার প্রমাণ প্রচুর।
বাংলা সাহিত্য যদি হিন্দুয়ানি ও সংস্কৃত শব্দে বোঝাই হয়ে থাকে, তবে সেখানে তার দুর্বলতা, শক্তি নয়। হিন্দুর অহঙ্কার তাতে স্ফীত হতে পারে, কিন্তু রসিকের রসতৃষ্ণা তৃপ্ত হতে পারে না। কিন্তু দ্বন্দ্বের যুগের চিন্তাশীল মানুষকে সেই দুর্বলতার অনুসরণে উৎসাহিত করেন–যা বর্জনীয় তা-ই গ্রহণীয় বলে প্রচার করেন। তিনি বলেন : হিন্দু যে ওরূপ করেছে, তাতে তার অন্যায় হয়নি, মুসলমান যে করেনি সেইটেই তার অন্যায়। কী চমৎকার যুক্তি! বাংলা সাহিত্য মোটের ওপর উন্নত ও প্রগতিশীল হলেও তার বেশিরভাগই যে বোঝা ও বাজে, তা অনস্বীকার্য। অথচ এই বোঝা ও বাজের অনুসরণ করতে তাঁর উপদেশ।
হিন্দুয়ানি ও মুসলমানিতে সাহিত্য ভারাক্রান্ত করা অন্যায়। কেননা, সাহিত্য গভীর জীবনবোধের ব্যাপার, কোনো আনি’র ব্যাপার নয়। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে তা সেখানে মাঝে মাঝে আসতে পারে, কিন্তু সর্বময় প্রভু হয়ে তাকে গ্রাস করতে পারে না। আর মনে রাখা দরকার আনি’র প্রভাব থেকে জীবনকে রক্ষা করা যখন সাহিত্যের, বিশেষ করে আধুনিক চিন্তাসাহিত্যের অন্যতম উদ্দেশ্য তখন তা নিয়ে কোন্দল অনাধুনিকতারই প্রমাণ। আনি’র প্রভাবে নিয়ে যাওয়া আর জীবনকে কারাগারে বন্দি করা যে এক কথা, চিন্তাশীলের তা বুঝা উচিত। তবে না বুঝলে তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না (বুঝলে অবশ্য প্রশংসা করা যায়), কেননা তিনিও অন্যান্য মানুষের মতো যুগের সন্তান এবং অস্থির যুগে মতির প্রশান্তি রাখতে পারে কম লোকেই।
এই অস্থির দ্বন্দ্বময় যুগে রিনেসাঁসের সাধনা সহজ ব্যাপার নয়। রিনেসাঁসের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। কেননা, তা জীবনসূর্যের উপাসনা আর চিন্তামুক্ত না হলে তা সার্থকভাবে করা যায় না। মেঘলা দিনে সূর্য-উপাসনা চলে না, আর এ-যুগ সত্যই মেঘলা যুগ, এ-বিষয়ে সন্দেহের অবসর নেই। শুধু রাজনৈতিক বিরোধ নয়, এ-যুগের অর্থনীতি বা অর্থনীতিহীন যে নৈরাশ্যের সৃষ্টি করেছে, তা দূরীভূত না হলে রিনেসাঁস তথা বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনার সাধনা অসম্ভব।
অর্থনীতির ভিত্তি সুদৃঢ় হয়নি বলে মানবসভ্যতা বারবার ভেঙে পড়েছে এবং এবারও ভেঙে পড়তে চাচ্ছে। সুতরাং তাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। Man does not live by bread alone, he needs spritual food, এ-ধরনের বড় বড় কথা বহুবার বলা হয়েছে, কিন্তু ‘ব্রেডের চিন্তা থেকে মানুষকে রেহাই দেবার চেষ্টা হয়নি একবার। সুতরাং স্পিরিচুয়ালিটি শেষপর্যন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে কথার কথা। ব্রেডের ব্যাপারটি সুব্যবস্থিত করে এই ফাঁকি থেকে যারা মানুষকে মুক্তি দিতে চাচ্ছেন তারা রিনেসাঁসের তথা বুদ্ধি, কল্পনা ও অনুভূতির জয়যাত্রার পথই প্রশস্ত করছেন। তাঁদের হাতে হাত মেলাতে না পারলেও কণ্ঠে কণ্ঠ মেলানো দরকার।
রুটির কথায় বর্বরতার গন্ধ পেয়ে যে-সকল উন্নাসিক নাসিকা কুঞ্চিত করেন, তাঁদের জানাতে চাই, রুটিকে প্রধান বলে স্বীকার করা হয়নি বলেই তা বারবার সভ্যতাকে আক্রমণ করেছে। সেজন্য বর্বরতার গুটিকায় তার সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন হয়েছে। তার প্রতিকার টিকা। বর্বরতাকে প্রথমেই মৃদুভাবে মেনে নিয়ে নিয়ন্ত্রিত করাই হচ্ছে সে টিকা।
সমাজতন্ত্র তারই আয়োজনে ব্যস্ত, তাই বর্বরতার বাড়াবাড়ি থেকে মানুষকে রক্ষা করার ক্ষমতা তারই হাতে।
পৃথিবীর যে-দুঃখের কথা বলেছি তার কারণ অর্থনীতি, এ-বিষয়ে চিন্তাশীলরা একমত। কিন্তু অর্থনীতি বিজ্ঞানের এলাকার, সাহিত্যের নয়। তাই তা নিয়ে আলোচনা না করে বর্তমান অর্থনীতির পেছনে যে মনস্তত্ত্ব রয়েছে, অথবা তা থেকে যে মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়। কেননা, মনস্তত্ত্ব সাহিত্য ও বিজ্ঞান উভয়ের এলাকাভুক্ত।
একটুখানি তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়, আমাদের ভেতরের মানুষটি কুঅভ্যাসবশত নিজেকে খুশি করার নামে অপরকে অসুখী করতে চায়। (আমরা অট্টালিকা নির্মাণ করি নিজেরা সুখে থাকার জন্য নয়, অপরকে ঈর্ষান্বিত তথা দুঃখিত করার জন্য)। সমকক্ষের কালো মুখেই আমাদের আনন্দ। এই বিকৃত দৃষ্টির ভদ্র নামই কম্পিটিশন বা প্রতিযোগিতা। প্রয়োজন না থাকলেও ছেনে-ছুনে কেড়ে-কুড়ে সিন্দুক ভর্তি করার এই কদর্য স্পৃহা–একে বর্বরতা ছাড়া কিছুই বলা যায় না। নির্বোধ অথবা নিষ্ঠুর বলে (এ দুটো অপবাদের একটি আমাদের গ্রহণ করতেই হবে) আমরা বুঝতেই পারি না যে, সিন্দুকে কেবল অর্থকেই বন্দি করে রাখা হয় না, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরমায়ুকেও বন্দি করে রাখা হয়। তাই পৃথিবী মরণে-মরণে ও অস্বাস্থ্যে-অস্বাস্থ্যে ছেয়ে যায়।
এই দুর্ভোগ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজনীয়। পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা প্রতিযোগিতা তথা অপরকে পরাজিত ও দুঃখিত করা, নব দৃষ্টিভঙ্গির গোড়ার কথা নিজেকে খুশি করা। আর পরস্পরের স্বাস্থ্য ও সখ্য পানই নিজেকে খুশি করার উপায়। এ-যুগ তাই সখ্যরস আস্বাদনের জন্য এত ব্যাকুল।
দুস্থ পৃথিবীকে সুস্থ করাই এখন বড় কথা। বুদ্ধি-মুক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে রিনেসাঁস এ-ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করতে পারে। মুমূর্ষ পৃথিবী শুশ্রূষা চাচ্ছে, দানবের অত্যাচারমুক্ত হতে চাচ্ছে। এ-যুগের দুঃখ-ব্যথা, কলঙ্ক কুশ্রীতা চপেটাঘাত করে কবি-শিল্পীদের আত্ম-রতিবিরত করছে। তাই রবীন্দ্রনাথের মতো সৌন্দর্যধ্যানী-কণ্ঠে দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আকুল আহ্বান। শিল্পী ও কবি মন নিয়ে আজ পৃথিবীকে ঢেলে সাজানো দরকার। পৃথিবী আমাদের সমগ্র প্রতিভা চাচ্ছে–আমাদের কবিতার খাতা হতে চাচ্ছে–বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনা সমস্ত তার জন্য উজাড় করে দিতে হবে।
বুদ্ধিকে নিজের কাজে না লাগিয়ে নিজেকে বুদ্ধির কাজে লাগাবার যুগ এখনো আসেনি। তারই পথ নির্মাণে আমাদের প্রতিভা নিযুক্ত করা দরকার। তবেই প্রকৃত রিনেসাস তথা হিউম্যানিম সম্ভব হবে, সুন্দরের দানে জীবনের আনন্দভাণ্ডার পূর্ণ হবে।* [*হিউম্যানিজমে তেমন বিশ্বাসী নন কিন্তু রিনেসাঁস-প্রয়াসী একদল লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাদের প্রচেষ্টা যেন ডেনমার্কের রাজকুমারদের বাদ দিয়ে হ্যামলেট’ অভিনয়ের মতোই হাসাকর। তাদের মতে রিনেসাস হচ্ছে বাঁচার জন্য একটি নবজাত শিশুর চিৎকার। কিন্তু তা সত্য নয়, রিনেসাঁস বাঁচার জন্য শিশুর চিৎকার নয়; সৌন্দর্য প্রেম, আনন্দ ও বন্ধনমুক্তির জন্য তরুণের দাবি।]