রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

ধনীদের অর্থ বিনিয়োগ ক্ষেত্ৰ

প্রত্যেকটি শহরে বিত্তবান ধনীদের পাড়া, মধ্যবিত্তদের পাড়া ও দরিদ্রদের পাড়া রয়েছে; বিশ্বের সর্বত্র এমন শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট অর্থাৎ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এই শ্রেণীবিভাগ লক্ষণীয়।

আমি সকলকে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এ যোগ দিতে বলি। কারণ, এই ব্যবসা বিনিয়োগের ফলে কয়েকটি সুবিধা পাওয়া যায়। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা সফল ব্যক্তি অতি ধনীদের বিনিয়োগ ক্ষেত্রগুলোতেও অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে। ই এবং এস কোয়াড্রান্টের অধিকাংশ মানুষ যথেষ্ট অর্থোপার্জন করতে পারে না তাই তারা ধনীদের বিনিয়োগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অক্ষম।

আমেরিকান সিকিউরিটিস এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, এস ই সির শর্তানুসারে ব্যক্তিবিশেষের বাৎসরিক আয় কমপক্ষে ২০০,০০০ ডলার, দু’জনের বাৎসরিক উপার্জন ৩০০,০০০ ডলার এবং মোট উপার্জন ১,০০০,০০০ ডলারের বেশি হওয়া প্রয়োজন। একজন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিনিয়োগকারী অর্থাৎ অ্যাক্রোডিটেড ইনভেস্টার বিবেচিত হওয়া এবং ধনীদের ইনভেস্টমেন্ট ক্ষেত্রের যোগ্য মনোনীত হওয়ার জন্য এটা নূন্যতম প্রয়োজনীয়তা। সমস্ত আমেরিকাবাসীদের চার শতাংশের কমসংখ্যক মানুষ এই শর্ত পূরণ করতে পারে। অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা মাত্র কয়েকজন বিনিয়োগের সুযোগ পায়… যে কারণে ধনীরা ক্রমশ আরো বিত্তবান হয়ে উঠেছে।

বিনিয়োগের দুটি কারণ

রিচ ড্যাড ধারাবাহিকের তৃতীয় বই রিচ ড্যাডস গাইড টু ইনভেস্টিং-এ আমি দুটি প্রাথমিক আর্থিক সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করেছি… যথেষ্ট অর্থের অভাব এবং অতিরিক্ত অর্থ। তাই বিনিয়োগের দুটি প্রধান কারণ রয়েছে যথা :

যথেষ্ট অর্থের অভাববশত লোকেরা বিনিয়োগ করে ও
অতিরিক্ত অর্থ থাকায় লোকেরা বিনিয়োগ করে।

বহু বছর আগে আমার ধনবান বাবা এই দুটি মৌলিক আর্থিক সমস্যার বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলে। তিনি বলেছিলেন, ‘অর্থের সমস্যা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য… এমনকি ধনীদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। গরিব মানুষের সমস্যা হল-তার কাছে যথেষ্ট অর্থ নেই, ধনবান ব্যক্তির সমস্যাটা অন্যরকম, তার কাছে রয়েছে প্রচুর অর্থ। বড় হয়ে তুমি কি ধরনের আর্থিক সমস্যা বেছে নিতে চাও?’ অবশ্যই আমার পছন্দ ছিল অতিরিক্ত অর্থোপার্জন। আমার ধনবান বাবা আরও বলতেন, ‘যাদের পরিবারে অর্থাভাব থাকে তারা মনে করে অর্থাভাবই বুঝি একমাত্র সমস্যা।’

আমার ধনবান বাবা ও নির্ধন বাবা দু’জনের ক্ষেত্রে দু’রকমের আর্থিক সমস্যা দেখেছি, এতে আমার সুবিধা হয়। আমার নির্ধন বাবা প্রায়ই বলতেন, “আমার কাছে যথেষ্ট অর্থ নেই, থাকলে ইনভেস্ট করতাম।’ আবার এদিকে আমার ধনবান বাবার মুখে শুনেছি, ‘আমি অতিরিক্ত অর্থোপার্জন করছি, আরও কিছু ইনভেস্টমেন্টের উপায় খুঁজতে হবে, যদি অতিরিক্ত অর্থ ইনভেস্ট না করি, সরকার তা আয়কর হিসেবে আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবে।’

আপনার কাছে অতিরিক্ত অর্থ আছে তাই বিনিয়োগ করবেন

কয়েকমাস আগের কথা, একটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানির কর্তা ব্যক্তি ও তাদের পরিবারদের আমি ইনভেস্ট করার বিষয়ে বোঝাচ্ছিলাম। ক্লাসে প্রায় ২০০ জন ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত ছিলেন। ব্যবসার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা দলটিকে বিনিয়োগের বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এদের অনেকেরই সমস্যা ছিল প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ যা এরা বিনিয়োগ না করে অপচয় করছিল। এদের একজন নেতা আমাকে বললেন, ‘আমরা এদের খুব ভালমত শিখিয়ে দিই বি কোয়াড্রান্টে কীভাবে সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা যায়, তবে ঐ অর্থ আই কোয়াড্রান্টে কীভাবে কাজে লাগনো যায় তা আমরা শেখাই না।’

বিনিয়োগ

দলটি যখন বুঝল বি এবং আই কোয়াড্রান্ট দুটির সুবিধা থেকে কীভাবে লাভবান ও ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া যায়, তাদের জন্য এক নতুন, সম্ভাবনাময় জগতের দ্বার খুলে গেল। এদের মধ্যে অনেকেই ঐ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে কুবেরের ধন আবিস্কার করল।

ক্লাসের সকলের সূত্রটি ছিল সহজ সরল, নানা বিনিয়োগ কৌশলের সাধারণ বর্ণনাগুলো সকলের সামনে তুলে ধরি। এরপর তাদের আমার শিক্ষণীয় বোর্ড গেম ক্যাশফ্লো ১০১ খেলতে বলি। অনেকে ইতিমধ্যে ১০১ খেলায় সুদক্ষ হয়ে উঠেছেন, তারা খেললেন আরও উন্নত ইনভেস্টমেন্ট গেম ক্যাশফ্লো ২০২।

খেলা শেষ হওয়ার পর, খেলোয়াড়রা যা শিখেছে সে বিষয়ে বোঝালাম ঘন্টাখানেক। বেশ প্রাণবন্ত জমজমাট আলাপ আলোচনা হয়। কয়েকটি মন্তব্যের উল্লেখ করছি :

১. ‘আমার সম্পূর্ণ আর্থিক জীবন যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি অর্থোপার্জন করি বটে তবে সবটাই খরচ করে দিই। এখন আমি গরিব মানুষের অর্থ পরিচালনার উপায়গুলো ছেড়ে ধনীর অর্থ ব্যবস্থাপনার পন্থাগুলো শিখলাম।’

২. ‘আমার প্রয়োজন একটি ভাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আমার এখনকার অ্যাকাউন্ট্যান্ট ভাল তবে ইনভেস্টমেন্টে সুদক্ষ না।’

৩. ‘খেলাটা কঠিন…. তবে বাস্তব জীবনের প্রতীক। আমার বাস্তব জীবনটা যেভাবে কাটছে তা বদলাতে চাই, টাকা রোজগার করে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। যা রোজগার করছি তা সদ্ব্যবহার করতে চাই।’

৪. ‘আমি খুশী, শেষ পর্যন্ত কেউ আমায় শেখায়নি আমি অর্থের জন্য পরিশ্রম করব না বরং কীভাবে অর্থ আমার জন্য পরিশ্রম করবে। এই খেলা আমার জীবনটা পাল্টে দিয়েছে।’

৫. ‘খেলাটা খুবই ভাল, আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব দেখতে পেলাম… আমার ভবিষ্যৎ এই বর্তমান ও অতীত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে।’

বিনিয়োগ

দুপুরের সূত্রে আমরা আরো কিছু পরিকল্পনা ও রণকৌশল নিয়ে আলোচনা করলাম। ক্যাশফ্লো কোয়াড্রান্টে বি এবং আই কোয়াড্রান্ট দেখিয়ে বললাম, ‘এবার আমরা আলোচনা করব, এই দুটি কোয়াড্রান্টের ক্ষমতা কীভাবে কাজে লাগানো যায়।’

একজন অংশগ্রহণকারী হাত তুলে বললেন, ‘আপনি কি বলতে চান বিভিন্ন কোয়াড্রান্টের বিনিয়োগ কৌশল ভিন্ন?’

‘নিশ্চয়ই’, আমি বলি, ‘বহু বছর আগে আমার ধনবান বাবা কোয়াড্রান্ট এঁকে চিহ্ন দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, আমি এখন তা করে দেখাচ্ছি।’

‘এই নকশার অর্থ কি?’ ঐ অংশগ্রহণকারী আবার প্রশ্ন করেন।

‘বিভিন্ন কোয়াড্রান্টের বিনিয়োগ-পদ্ধতি বোঝায় এই নকশা। যাঁরা ই কোয়াড্রান্টের মানুষ, তাঁরা সুরক্ষিত নিরাপদ চাকরি ও ভাল পেনশন পরিকল্পনায় আগ্রহী, তাই প্রায়ই তাঁরা নিরাপদ বিনিয়োগ চান। তাঁরা নিজেরা বিনিয়োগ করলে মিউচ্যুয়াল ফান্ডে অর্থ বিনিয়োগ করেন। এরা প্রায়ই একাধিক বন্টন, দীর্ঘকালীন বিনিয়োগ ও গড়পড়তায় ডলারের মূল্য ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। আরেকটু বেশি রোমাঞ্চ চাইলে এরা হয়ত ক্যাসিনোতে যাবেন বা কয়েকটা লটারির টিকিট কাটবেন তবে প্রধানত এঁরা সুরক্ষিত বিনিয়োগ করেন অথবা অন্তত তাই করার প্রত্যাশা রাখেন।’

‘এবং এস কোয়াড্রান্টের বিনিয়োগ পদ্ধতি কি ভিন্ন?’ আরেকজন জিজ্ঞাসা করলেন।

‘সত্যিকার এস কোয়াড্রান্ট ইনভেস্টার অর্থাৎ স্ব-নিযুক্ত বা ছোট ব্যবসায়ী, আমার ভাষায় ‘নিজের হাতে’ বিনিয়োগ করেন। যেমন-যদি তাঁরা রিয়্যাল এস্টেটে বিনিয়োগ করেন তাহলে তাঁরা ‘ফিক্সার আপার’-এ ইনভেস্ট করেন… কারণ তাঁরা সব কাজ নিজের তাতে করতে চান। এঁরা নতুন আবিস্কারে আগ্রহী। এঁরা নিজেরাই রিয়্যাল এস্টেট পরিচালনা করতে, বিক্রি করতে চান, কারণ এঁরা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক ও কমিশন দিতে চান না। এসব বাড়ির টয়লেট মেরামত করার দরকার হলে তাও নিজের হাতে করেন। এঁরা ডুপ্লেক্স (দু’ইউনিট) বা ফোর প্লেক্স (চারটি ভাড়ার ইউনিট)-এর বেশি বড় এস্টেটে কমই বিনিয়োগ করেন। ৫০ ইউনিটের বেশি বিনিয়োগ এঁদের জন্য বিশাল বড় মাপের ইনভেস্টমেন্ট যা সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্তে রাখা, বিশেষ করে টয়লেট মেরামত ইত্যাদির পক্ষে কষ্টসাধ্য। এঁরা যদি শেয়ার বাজারে অর্থাৎ সৎভাবে ইনভেস্ট করেন তাহলে নিজের হাতে কাজ করায় আগ্রহী এঁরা নিজেরা শেয়ার বিকল্পগুলো বিবেচনা করে অর্থলগ্নী করে অথবা বাণিজ্য সংক্রান্ত খবরের কাগজ পড়ে, টেলিভিশনে ইনভেস্টমেন্টের খবর শুনে নিজেরা শেয়ার বেছে নেন, ‘আমি বললাম।’

“বি কোয়াড্রান্টের ব্যবসায়ী ও এস কোয়াড্রান্টের ব্যবসায়ীর বিনিয়োগ প্রণালীতে তফাৎটা কোথায়?’ আরেকজন অংশগ্রহণকারী জিজ্ঞাসা করলেন। ‘আমি আপনার কথায় খুশি নই তাই এই প্রশ্ন করছি।’

‘এমন কি বলেছি যে আপনি রেগে গেলেন?’ আমি জিজ্ঞাসা করি

‘কারণ, আমার কাছে ডুপ্লেক্স রয়েছে এবং টয়লেটও আমি নিজে মেরামত করি। বাণিজ্য সংক্রান্ত খবরের কাগজ পড়ে ও টেলিভিশনে বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক দেখে শেয়ার কেনার চেষ্টা করি। আপনি এইমাত্র বললেন, আমি যদিও বি কোয়াড্রান্টভুক্ত তা সত্ত্বেও এস-এর মত বিনিয়োগ করছি।’

অতি-ধনীদের মত ইনভেস্ট করা

‘হতে পারে আমি হেসে বলি, ‘অন্তত আপনি যথেষ্ট সক্রিয় ও বিনিয়োগ করছেন, তাছাড়া এস কোয়াড্রান্টের মানুষের মত ইনভেস্ট করা অন্যায় নয়। তবে আজ আমি আপনাকে বলছি, আপনার অতি-ধনীর মত বিনিয়োগের ক্ষমতা আছে … যেমন আপনার বি কোয়াড্রান্টে কাজ করার সাহস আছে।’

‘আপনি বলছেন, এভাবে বিনিয়োগ করে আমি নিজের সময় নষ্ট করছি’, তিনি মন্তব্য করলেন, ইতি স্বীকার করলেন যে ইনি এস কোয়াড্রান্টের ইনভেস্টার।

‘সময়ের অপব্যয় করছেন বলা হয়ত ভুল… কারণ আপনি অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, তবে আপনি নিজের ক্ষমতা সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছেন না।’

‘নিজের ক্ষমতার সদ্ব্যবহার বলতে কি বোঝাচ্ছেন?’ আমারই বয়সী এক মহিলা ঘরের পেছনের সারিতে বসেছিলেন, তিনি এ প্রশ্নটা করলেন।

‘নিজের চেষ্টায় অতি-ধনী হয়ে ওঠা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ বি ও আই কোয়াড্রান্টের ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগ করে বিত্তবান হয়ে উঠেছে।’

‘আপনি বলছেন কয়েকজন মানুষ শুধুই বি কোয়াড্রান্টভুক্ত আবার কয়েকজন শুধুই আই কোয়াড্রান্টে রয়েছে?’ ঐ ভদ্রমহিলা আবার প্রশ্ন করলেন।

‘নিশ্চয়ই,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘যেমন ই এবং এস-এ এমন মানুষ আছেন যাঁরা শুধু একটি কোয়াড্রান্টের সদস্য। বস্তুত, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা অনেকেই শুধু একটি কোয়াড্রান্টে কাজ করছেন… তাই আমাকে আজ এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কীভাবে উভয় কোয়াড্রান্টের ক্ষমতার সদ্ব্যবাহর করা যায়, এ কথাটা বোঝানোর জন্যই আমাকে ডাকা হয়েছে।’

‘আপনার মতে, আমরা আমাদের সম্পূর্ণ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করছি না?’ ঐ মহিলা প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ। যদি আরও বেশিসংখ্যক মানুষ আপনাদের নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার ও আই কোয়াড্রান্টের ক্ষমতা সম্বন্ধে বুঝতে পারত তাহলে আরও বেশি লোক এতে যোগ দিত। বি ও আই কোয়াড্রান্টের শক্তি দু’টি একত্রে করে তবেই অতি-ধনী হয়ে উঠেছেন। আপনার ব্যবসা গড়ে তোলার উপায়গুলো শেখান, মানুষ কীভাবে ধনী বা অতি-ধনী হয়ে উঠতে পারে তাও কিন্তু আপনারা শেখাতে পারেন।’ ‘অতি-ধনী বলতে কি বোঝাতে চাইছেন?’ একজন জিজ্ঞাসা করলেন।

‘অনেকেই মনে করেন, যে মানুষটি বছরে ১,৫০,০০০ ডলার আয় করেন এবং যার ৫ মিলিয়ন ডলারের পোর্টফোলিও বা অবসরগ্রহণ পরিকল্পনা আছে। সেই বুঝি খুব ধনী। তবে ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে, ধনীর অর্থ-যে ব্যক্তির বার্ষিক আয় ১ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি এবং সম্ভবত, যে কোনোরকম কাজ না করেই এই অর্থ উপার্জন করা হয়। আমার ধনবান বাবার মতে, অতি-ধনীরা মাসে কমপক্ষে ১ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি আয় করা উচিত। তিনি নিজে ঐ ধনীদের শ্রেণীভুক্ত হতে পারেননি, তবে খুব কাছাকাছি ছিলেন। আমি ফোর্বসে-র ধনীদের শ্রেণীতে পৌঁছে গিয়েছি, এখন অতি-ধনীর শ্রেণীতে পৌঁছনোর চেষ্টা করছি। যদি আপনারা বি ও আই কোয়াড্রান্টের আর্থিক ক্ষমতা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন তাহলে আপনারা সবাই অতি-ধনী হয়ে উঠবেন। আপনাদের জন্যই লেখা হয়েছে-রিচ ড্যাডস গাইড টু ইনভেস্টিং। ই ও এস কোয়াড্রান্টের অধিকাংশ ইনভেস্টারের কাছে এই ক্ষমতা নেই।’

সবাই চুপচাপ বসেছিলেন। কয়েক মিনিট পর এক সুদর্শন যুবক হাত তুললেন, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন সঠিক লোককে সঠিক কথাগুলো বলছি না আমরা?’

সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘আমি প্রায়ই এমন লোক দেখি যারা চাকরির খোঁজে বা টাকা-কড়ির প্রয়োজনে এই ব্যবসায় যোগ দেয়… আপনাদের সংগঠন তাদের উৎসাহিত করে তোলে, তাদের আশা-ভরসা দেয়-তাদের নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যা সত্যি প্রশংসনীয়। এ ব্যাপারে আপনাদের সংগঠন এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। তবে বেশিরভাগ সময় আপনারা এমন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে ভুলে যান যে হয়ত আর্থিকভাবে খুবই সফল তবে তার আয়ের ক্ষমতা সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছে। অনেকে হয়ত ১,৫০,০০০ ডলার থেকে ২,৫০,০০০ ডলার রোজগার করছেন অথচ তাদের মনে হচ্ছে তারা শীর্ষস্থানে পৌঁছে গিয়েছেন। এস কোয়াড্রান্টের অনেকেই এই শ্রেণীভূক্ত। এঁরা আরও বেশি আয় করতে পারছেন না, কারণ বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা যে শক্তি প্রদান করে তা এদের আয়ত্বে নেই।’

‘এমন অনেকের সঙ্গেই আমাদের কথাবার্তা হয়, কেউ কেউ আমাদের দলে যোগদানও করেছেন,’ নিজেদের আত্মরক্ষায় বলে উঠলেন একজন অংশগ্রহনকারী।

‘আমি তা জানি, আমি আপনার বা আপনাদের প্রচেষ্টার নিন্দা করছি না, তবে আমি নিজের কথা বলছি-যখন এই ব্যবসা আমাকে যোগ দিতে বলা হয় তখন আমাকে যা যা বলা হয়েছিল তাতে তেমন উৎসাহ বোধ করিনি। ইতিমধ্যেই আমি সফল ব্যবসা গড়ে তুলেছিলাম, মিলিয়নার হয়ে গিয়েছিলাম যদি আমাকে বোঝানো হতো যে অপরকে চাকরি দেওয়ার পরিবর্তে আমি তার ব্যবসা গড়ে তোলায় তাকে সাহায্য করতে পারব, তাহলে আমি আরও বেশি উৎসাহ পেতাম। সফল হয়ে ওঠায় অন্যদের সাহায্য করলে ব্যবসা অতি-ধনী হয়ে ওঠা সহজ হয়।’

আবার সব চুপচাপ। শেষে সাহস সঞ্চয় করে এক মহিলা হাত তুললেন, প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন কোটিপতি বা মিলিয়নার হওয়া কঠিন নয়?’

আমি উত্তর দিলাম, ‘তা বলতে পারেন।’ আরও বললাম, ‘মিলিয়নার হওয়া ভাল, তবে আজকাল তা অসাধারণ কিছু নয়। অনেক পেশাদার খেলোয়াড় যেমন ফুটবল খেলোয়াড় এখন মিলিয়নার। মিলিয়নার হয়ে উঠার এখন নানা পথ রয়েছে, তবে অতি-ধনী হয়ে ওঠার পথ মাত্র কয়েকটি… এবং আপনার কাছে সেই ক্ষমতা আছে।’

‘তাহলে, কোন জিনিসটা নেই আমাদের কাছে?’ যে মহিলাটি আগে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আপনার এই সংগঠনের কাছে এমন ক্ষমতা আছে যা মানুষকে সাইকেল ডেল-এর মত অতি-ধনবান করে তুলতে পারে।’ আরেকবার নিজের বই-রিচ ড্যাডস গাইড টু ইনভেস্টিং হাতে তুলে ধরে বললাম ‘আপনাদের মত লোকদের জন্য লিখেছি এই বই … যারা ধনী হতে চায় অথবা অতি-ধনী হওয়ায় আগ্রহী। তবে তার আগে আপনার বিশ্বাস করতে হবে এই ধনোপার্জন করা সম্ভব… তবে সেজন্য দুটো কোয়াড্রান্টই ব্যবহার করতে হবে।’

‘আমাদের বিশ্বাস করতে হবে কতখানি অর্থোপার্জন সম্ভব?’ এক যুবতী প্রশ্ন করলেন।

মাথা নেড়ে বললাম, ‘যদি আপনি তা বিশ্বাস না করেন, তার মানে আপনি তা মানতে অসম্মত, সুতরাং তা করা সম্ভব হবে না।’

‘তা সম্ভব এ কথা বিশ্বাস করার জন্য কি করতে হবে?’ ঐ তরুণী আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘শিখতে হবে। এই বইটি পড়ুন, বিশ্বাস করুন বইয়ে লেখা সবকটি কথা আপনার দ্বারা করা সম্ভব… যদি সঠিকভাবে পড়শুনা করেন ও এই কাজে সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন। অনেকে হয়ত বইটি পড়ে হতাশ হবেন। কারণ, অতি-ধনী হয়ে ওঠা তাদের জন্য অসম্ভব অলীক কল্পনা। আপনাদের কাছে যে আর্থিক শক্তি নিহিত আছে তা কিন্তু অনেকের কাছেই নেই।’

একজন প্রশ্ন করলেন, ‘কেন?’

উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষমতা

‘আগেও বলেছি, আবার বলব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ই ও এস কোয়াড্রান্টের মানুষের মধ্যে ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে… উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষমতার অভাব দেখা যায়।

‘উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষমতা-এর অর্থ কি?’

‘উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষমতার নানা অর্থ হতে পারে। এখানে আমি বলছি উদ্দেশ্যসাধনের ক্ষমতা মানে যৎসামান্য কাজ করে যথাসম্ভব বেশি অর্থোপার্জন করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ই ও এস কোয়াড্রান্টের লোকদের বেশি আয়ের জন্য বেশি পরিশ্রম করতে হয়। সমস্যটা হয়, ই এবং এস কোয়াড্রান্টের লোকেরা যে পণ্য বিক্রি করছে তা হল তাদের নিজস্ব সময়… যা সীমিত পণ্য। দিনে চব্বিশ ঘন্টার বেশি হতে পারে না, ই এবং এস দিনে অতটাই আয় করতে পারেন।’

‘আমরাও সবাইকে ঐ একই কথা বলি, তাহলে আপনার কথা আমাদের কথা থেকে কীভাবে ভিন্ন?’ সুদর্শন যুবকটি প্রশ্ন করলেন।

‘আপনাদের মধ্যে তিনজন আমাকে আপনাদের ব্যবসা ডেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন,’ আমি উত্তর দেই, ‘তিনজনকেই প্রশ্ন করেছিলাম-কেন যোগদান করব, এবং আপনারা সবাই ভাল মত বুঝিয়ে বলেন।তবে প্রত্যেকেই ব্যবসা গড়ে তোলার, প্রচুর অর্থলাভের কথা বলেন।’

‘এতে ভুল কোথায়?’ তরুণটির প্রশ্ন, ‘তাই তো আমাদের কাজ। আপনার কাজ। তাই নয় কি?’

‘হ্যাঁ, আমিও ব্যবসা গড়ে তুলি… তবে শুধুই অর্থলাভের জন্য নয়। ব্যবসা একটি সম্পদ। ব্যবসা গড়ে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় আর আমি পরিশ্রম করতে ভালবাসি না। আমার হাওয়াইয়ে জন্ম, সেখানেই বড় হয়েছি। আমি খুবই অলস প্রকৃতির ও অবসর সময় আমার প্রিয়। সমুদ্রতটে বসে থাকা ও ঢেউয়ের ওপর সাফিং আমার পছন্দ। এগুলো করে আনন্দ পাই। তাই আমি শুধু ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য কঠোর প্রশ্ন করি। ই ও এস কোয়াড্রান্টে কাজ করতে আমি রাজি না কারণ আমি অলস।’

‘আমি ঠিক বুঝলাম না,’ তরুণটি ভাবলেন আমি তাকে খেপাচ্ছি। ‘আমি অলস তাই ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। মানেটা ঠিক বুঝলাম না।

‘মনে রাখবেন আমি সত্যিকার ব্যবসায়ী না, তাহলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। আমি ইনভেস্টার এবং এই বিনিয়োগে যে জীবনশৈলী পাওয়া সম্ভব আমি তা সম্পূর্ণ উপভোগ করি।’

‘অর্থাৎ, একবার ব্যবসা গড়ে তোলার পর আপনি স্বাধীনভাবে রিয়্যাল এস্টেট, শেয়ার, বন্ড ও অন্যান্য ব্যবসা বিনিয়োগ করতে পারেন।’ শান্তভাবে বলে উঠল ঐ তরুণ, ‘ব্যবসা গড়ে তুলে আপনি ইনভেস্টার হিসাবে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হাতে পাচ্ছেন সময় ও অর্থ।’

‘প্রচুর সময় ও অর্থ, ধীরভাবে উত্তর দেই, ‘আমি আমার সময় ডুপেক্স নো, টয়লেট সারানো বা শেয়ার স্টক কেনায় অপচয় করি না। এগুলো তো এস অর্থাৎ ছোট ইনভেস্টারের ক্ষেত্র। অধিকাংশ ছোট ইনভেস্টাররা অর্থলাভের জন্য বিনিয়োগ করেন। এঁদের কাছে যথেষ্ট অর্থ নেই, তাই এঁরা বিনিয়োগের চেষ্টা করেন। আমার কাছে প্রচুর অর্থ তাই সরকার আমাকে এই অর্থ বিনিয়োগ করতে অথবা তা নাহলে কর দিতে বাধ্য করে। ই কোয়াড্রান্টের মানুষের কাছে খুব বেশি বিকল্প নেই। অর্থোপার্জনে আগেই সরকার তাদের আয় থেকে কর বাদ দিয়ে দেয় তাই তারা বিনিয়োগের তেমন সুযোগ পান না। যেহেতু আমার কাছে প্রচুর অর্থ আছে এবং কর দেওয়ার আগে বিনিয়োগের সুযোগ পাই, তাই আমি বড় বড় সম্পত্তি, স্টক ও অন্যান্য ব্যবসা অর্থ বিনিয়োগ করি। আমি ব্যবসা গড়ে তুলি, যাতে শুধুই ধনীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোতে অর্থলগ্নি করতে পারি।… এভাবেই তো অতি-ধনী হওয়া সম্ভব।’

‘আপনার বিনিয়োগের জন্য অর্থের প্রয়োজন তাই আপনি বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা গড়ে তোলায় আগ্রহী। তাই বলতে চাইছেন তো?’

‘ঠিক তা নয়। প্রথমে তাই মনে হয়, তবে ব্যাপারটা আরেকটু জটিল, বুঝিয়ে বলি।’ এর পর ক্যাশফ্লো কোয়াড্রান্টের নকশা এঁকে বললাম, ‘আমার ধনবান বাবা এই নকশা দেখিয়ে যে গল্পটা বলেছিলেন তা আপনাদের কারুর মনে আছে কি?’

বিনিয়োগ

সবাই মাথা নাড়লেন।

‘আর ১৯৪৩, ১৯৮৬, ১২১৫-এর তারিখগুলোর ব্যাপারে কারুর মনে আছে কি?’

‘১২১৫ সালে ম্যাগনা কার্টায় স্বাক্ষর করা হয়,’ এক অল্পবয়সী মহিলা বললেন, ‘এই বছর ধনীরা ইংল্যান্ডের রাজার হাত থেকে ক্ষমতাগুলো নিয়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে ধনীরাই সব নিয়ম-কানুন তৈরি করে।

‘বেশ বলেছেন,’ আমি বলি সুযোগ পেলে আমিও বিপক্ষ থেকে বিনিয়োগ করব, কারণ যেহেতু ব্যবসায় মালিক বিনিয়োগ নিয়ম তৈরি করে, তাদের হাতের মুঠোয় সেরা নিয়মগুলো আছে। তারপর বলুন।’

‘১৭৭৩ সালে বন্টন টি পার্টিতে কর-বিপ্লব ঘটে, যার ফলে আমেরিকার সূত্রপাত হয়। যেহেতু এটা নিঙ্কর দেশ ছিল তাই আমেরিকার দ্রুত বিকাশ হয়। ১৯৪৩ সালে আইনে পরিবর্তনের পরিণামস্বরূপ সব আমেরিকাবাসীদের বেতন থেকে কর আদায় করা হয়। অর্থাৎ কর্মচারীরা পারিশ্রমিক হাতে পাওয়ার আগেই সরকারের আয় হয়।’

‘ভাল বুঝেছেন,’ আমি বলি, কর-প্রথার ইতিহাস সম্বন্ধে আমার আলোচনা করা মনে রেখেছে জেনে আমি খুবই অবাক হলাম। ‘যেহেতু সেসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল তাই কর দেওয়া দেশভক্তির কাজ মনে করা হত… তবে ই কোয়াড্রান্টের লোকের খানিকটা নিয়ন্ত্রণ ছিল।’

ঐ তরুণী আবার বললেন, ‘১৯৮৬-এ করের আইনে পরিবর্তন আনা হয় যার ফলে ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট অর্থাৎ স্থপতি, অ্যকাউন্ট্যান্ট ও অন্যান্য পেশাদার অর্থাৎ এস কোয়াড্রান্টের লোকদের উপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। এতে মনে হয় ধনীরা নিজেদের কোয়াড্রান্ট সুরক্ষিত রাখার জন্য আবার নিয়মের পরিবর্তন করে। ধনীরা বি কোয়াড্রান্টে কাজ করে তাই তাদের বেশি আয় হয় অথচ কম কর দিতে হয়,’ তরুণী জানালেন।

বি কোয়াড্রান্টের সুবিধাগুলো আই কোয়াড্রান্টে আছে

‘মনোযোগ সহকারে শোনার জন্য ধন্যবাদ’, আমি বলি, ‘এর চেয়ে ভালভাবে আমিও বোঝাতে পারতাম না। তাই এস কোয়াড্রান্টে ব্যবসা না করে আমি বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা গড়ে তুলেছি। তবে আসল কথা হল শুধু কি কোয়াড্রান্টভুক্ত হওয়ার যথেষ্ট নয়। এতে বি কোয়াড্রান্টের সম্পূর্ণ ক্ষমতা আয়ত্তে আসে না।’

‘বি কোয়াড্রান্ট যথেষ্ট নয়?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন একজন।

‘না’, উত্তর দিলাম, ‘হয়ত অনেকেই বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করেছে তবে তারা সকলে বি কোয়াড্রান্টের ক্ষমতা আয়ত্তে আসে না’

‘কেন?’ ঐ একই ব্যক্তি আবার প্রশ্ন করলেন।

‘কারণ বি কোয়াড্রান্টের সত্যিকার ক্ষমতা বি কোয়াড্রান্টে নয়, আই কোয়াড্রান্টে পাওয়া যায়,’ আমি বলি।

ক্লাসের সকলেই চুপচাপ বসেছিলেন, হঠাৎ একজন প্রশ্ন করলেন, ‘মানেটা কি তা একটু বুঝিয়ে বলবেন?’

‘বলতে পারি’, আমি বলি, ‘তবে আজ আমার হাতে সেই আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় নেই। এখনকার মত মনে রাখবেন, আই-এর মাধ্যমে করের আইনগুলো বি কোয়াড্রান্টের সমর্থন করে। ‘

সবাই নিশ্চুপ, কয়েকজন অবশ্য উৎসাহিত ছিলেন, বাকিরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমার মনে হল অনেকে বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসার বাইরে আর কিছু চিন্তা করতে চান না। এক মহিলা হাত তুললেন, আমার চিন্তাধারাকে সত্য প্রমাণ করে বললেন, ‘কিন্তু আমি যদি শুধুই ব্যবসা দাঁড় করাতে চাই? তারপরও কি আমাকে ইনভেস্ট করতে হবে?’

‘না’, আমি বলি, ‘আজ হয়ত সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বোঝা মনে হচ্ছে। তবে যখন আপনিও ধনীদের মত অতিরিক্ত আয় করবেন, আপনি নিজেকে ধন্যবাদ জানাবেন যে, কোনসময় বি কোয়াড্রান্টে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

‘মানে, যখন অতিরিক্ত অর্থের সমস্যা দেখা দেয়?’ আরেকজন জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ, যখন অতিরিক্ত অর্থের সমস্যার সম্মুখীন হবেন তখন বুঝবেন বি কোয়াড্রান্টের ব্যবসা বেছে নেওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। যখন সরকার আরও বেশি কর দাবি করবে তখন সেই কর না দিয়ে অর্থটা বৈধভাবে বিনিয়োগ করার উপায়গুলো আপনার জানা থাকবে, যদিও বা কর দিতে হয় তাহলেও কম দরে অথচ বৈধভাবে তা দিতে পারবেন। ফ্লিপ চার্টের নিােক্ত নকশাটা বানালাম। এই উপায়গুলো অবলম্বন করেই ধনীরা সব সুবিধা থেকে লাভবান হয়।’

 ধনীদের বিনিয়োগ

দলটিকে সম্বোধন করে আবার বললাম, ‘কর্মচারী ও ব্যবসার মালিকের আর্থিক বর্ণনায় বিশাল পার্থক্য রয়েছে। রিচ ড্যাড পুওর ড্যাডে, ধনবান বাবার অধ্যায় # ২ এ আর্থিক স্বাক্ষরতার গুরুত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। স্কুলে আর্থিক স্বাক্ষরতা শেখানো হয় না, আমার মনে হয় তার কারণ আমাদের স্কুলগুলো ছাত্রদের কর্মচারী হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দেয়। যদি কর্মচারীরা আর্থিক বর্ণনাগুলো পড়ার সুযোগ পেতেন তাহলে বুঝতেন মালিকরা কেন ক্রমশ আরও বিত্তবান হয়ে ওঠছে অথচ কর্মচারীদের পরিশ্রম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বেশি মাত্রায় করও দিতে হচ্ছে। কর কর্মচারীর বৃহত্তম একক খরচ।’

অল্পবয়সী একটি মহিলা হাত তুলে বললেন, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন কর্মীদের সবার আগে কর দিতে হয় অথচ মালিকের কর সবার শেষে জমা হয়। এই পদ্ধতিগুলোর কথাই বলছেন তো?’

‘এটা একটা পদ্ধতি’, আমি উত্তর দিই, ‘এমন অনেক পন্থা আছে।’

‘এটা তো অন্যায়’, তিনি বললেন।

‘মানছি’, বলি আমি, ‘বি কোয়াড্রান্টে এমন অনেক রকমের সুবিধা আছে, তবে সেসব সুবিধা থেকে লাভবান হওয়ার জন্য কর-সংক্রান্ত আইন, কর্পোরেট আইন, বীমার আইনগুলো ভালমত জানা দরকার।

‘অর্থাৎ, আপনার মতে বি ও আই দুটো কোয়াড্রান্টের সুবিধা নেয়া শ্ৰেয়?’

‘হ্যাঁ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাই সবচেয়ে সেরা উপায়’, উত্তর দেই, ‘আমি কর বিশেষজ্ঞ উকিল না বা অ্যাকাউন্ট্যান্ট না, তবে তাই বলতে চাইছি।’

‘অর্থাৎ, বাজে খরচ করলে, বিনিয়োগের পদ্ধতি না বুঝলে আমরা বি ও আই কোয়াড্রান্টের শক্তিগুলো সদ্ব্যবহার করতে পারব না?’ আরেকজনের প্রশ্ন শুনতে পেলাম।

সম্মতি জানিয়ে আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, সে কথাটাই আমি বলতে চাই’ ক্যাশফ্লো-র গেমবোর্ড হাতে নিয়ে বোর্ডের প্রথম ও দ্বিতীয় ট্র্যাক বা পথ দুটো দেখালাম।

র‍্যাটরেস অর্থাৎ ইঁদুর দৌড়ের পথটা দেখিয়ে বললাম, ‘৯৫% মানুষ এই র‍্যাটরেসে আটকে পড়ছে। এবার ফাস্ট ট্র্যাক অর্থাৎ দ্রুত পথটা দেখিয়ে বললাম, ‘এই ফাস্ট ট্র্যাক ধনীদের বিনিয়োগ ক্ষেত্র।

ইঁদুর দৌড়

ক্লাসের সকলে গেম-বোর্ডটা নতুন আগ্রহে ইঁদুর দৌড় দেখলেন। ‘এই খেলাটা বাস্তব জীবনের প্রতিফলন, তাই না?’ একজন প্রশ্ন করলেন।

সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘যা যা শেখানো সম্ভব সে সব কিছু ভালমত বোঝানোর জন্যই এই খেলাটা তৈরি করেছি। অ্যাকাউন্টিং অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ, ক্যাশফ্লো অর্থাৎ অর্থস্রোত-এর পরিচালনা, বিনিয়োগ, বিনিয়োগের ভাষা, কীভাবে কর্মকৌশল শেখা যায় এবং বিনিয়োগের জগত… ধনীদের বিনিয়োগ পদ্ধতি ও ইঁদুর দৌড়ে বন্দী সাধারণ জনতার বিনিয়োগ পদ্ধতি। ফাস্ট ট্র্যাকেই পাবেন বিনিয়োগের সুলুক-সন্ধান … খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ ধনীদের মত বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়। এখানে যারা বসে আছেন, আপনারা সকলই সেই সুযোগ পেয়েছেন … তবে তার আগে নিজের ব্যবসা গড়ে তুলুন, অপরকে ব্যবসা গড়তে শেখান।’

একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ফাস্ট ট্র্যাকে বিনিয়োগের একমাত্র উপায় কি ব্যবসা গড়ে তোলা?’

‘তা নয়’ জবাব দিই আমি, ‘আগে বলেছি, যদি আপনি পেশাদার খেলোয়াড় হন ও প্রতি বছর প্রচুর উপার্জন করেন বা যদি আপনি সিনেমার নায়ক, রকস্টার, বড় কোনও সংগঠনের সি. ই. ও. হন, বা ডাক্তার হন এবং কয়েক মিলিয়ন উপার্জন করেন আপনিও সত্যিকার ফাস্ট ট্র্যাকে প্রবেশের সুযোগ পাবেন। অনেকে আবার পেশাদার ইনভেস্টার হয়ে আই কোয়াড্রান্টের মাধ্যমে ফাস্ট ট্র্যাকে প্রবেশ করেন। অথচ অধিকাংশ অতি-ধনীরা কিন্তু ব্যবসার মাধ্যমে … বিশেষত বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসার মাধ্যমে বাস্তবজীবনের ফাস্ট ট্র্যাকে প্রবেশের সুযোগ পান।’

‘হ্যাঁ’, খানিকটা থেমে বললাম, ‘তবে তার আগে বিশ্বাস করতে হবে যে এটা করা সম্ভব। এজন্যই আপনাকে বি ও আই কোয়াড্রান্টের ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।’

একজন হাত তুললেন, ‘ইঁদুর দৌড়ে, ছোটখাট বিনিয়োগ প্রচুর সময় দেওয়ার মানে সময়ের অপচয়, তাই না?’

‘যারা বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা গড়ে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট তাদের জন্য অর্থাৎ আপনাদের জন্য এটা অবশ্যই অপচয়,” আমি উত্তর দেই, ‘যখন আপনি ব্যবসা গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করে সরাসরি ফাস্ট ট্র্যাকে পৌঁছে যেতে পারেন, তাহলে ছোট ছোট বিনিয়োগে সময় নষ্ট করে কি লাভ বলুন?’

‘তবে ইঁদুর দৌড় থাকাকালীন বিনিয়োগের যে অভিজ্ঞতা হয়, তার কি কোনই গুরুত্ব নেই?’ এক তরুণ প্রশ্ন করলেন।

‘অবশ্যই আছে… তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তব জগতে ই ও এস কোয়াড্রান্টের মানুষ আই কোয়াড্রান্টের সাহায্যে ইঁদুর দৌড় থেকে পালাবার চেষ্ট করছে, এরা মিউচুয়াল ফান্ড কিনছে, শেয়ার কিনছে, স্টক ও ছোট ডুপেক্স কেনায় বিনিয়োগ করছে। অনেকের জন্য এটা খুব ভাল পরিকল্পনা তবে আপনারা এদের থেকে ভিন্ন। আপনাদের হাতে রয়েছে বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসার অফুরন্ত ক্ষমতা… এই ব্যবসা আয়ের কোনও সীমা নেই, কোনও আন্তর্জাতিক সীমারেখা নেই। ছোট ছোট লেনদেন থেকেই বড় ব্যবসার অভিজ্ঞতা হবে। তবে সর্বসাধারণ যেসব থেকে অর্থ বিনিয়োগ করে সেগুলোতে বিনিয়োগ করে ইঁদুর দৌড় থেকে পালাবার চেষ্টা বৃথা। বরং নিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ধনীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করুন… এদের কাছে রয়েছে প্রচুর অর্থ, তাই এরা বিশেষ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন। যাদের কাছে তেমন টাকাকড়ি নেই তারা যেভাবে বিনিয়োগ করেন, সেভাবে আপনারা বিনিয়োগ করবেন না… যেহেতু এদের কাছে বিশেষ অর্থ নেই তাই এরা বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থোপার্জন করতে চায়। সেবা বিনিয়োগ এদের নাগালের বাইরে। যাদের কাছে রয়েছে প্রচুর অর্থ তারাই সেরা বিনিয়োগ করতে পারে। ‘

আরেকবার সবাই চুপচাপ। একজন বলে উঠলেন, ‘আমাদের ছোটখাট বিনিয়োগের সাহায্যে ইঁদুর দৌড় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা কি বৃথা?”

‘ভাল প্রশ্ন’, আমি উত্তর দিলাম, ‘আপনাদের মধ্যে যারা ক্যাশফ্লো ১০১ খেলেছেন তাদের একটা প্রশ্ন করি, ‘বাস্তব জীবনে যারা ইঁদুর দৌড় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফাস্ট ট্র্যাকে প্রবেশের অধিকার পায় কি?’

দলটি কিছুক্ষণ চিন্তা করল। শেষে একজন তরুণী উত্তর দিলেন, ‘না’। অনেকেই ইঁদুর দৌড় থেকে বেরিয়ে আসে। তত্ত্বগতভাবে যিনি অবসরগ্রহণের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছেন তিনিও ইঁদুর দৌড় বহির্ভূত। তবে প্রকৃতপক্ষে যারা ইঁদুর দৌড় বহির্ভূত তাদের মধ্যে মাত্র অল্প ৫ কয়েকজন ফাস্ট ট্র্যাক বিনিয়োগের যোগ্য হয়, আপনি নিজেই তো একথা বলেছেন।’

আমার উত্তরের আগেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘আমি বলছি সারাজীবন পরিশ্রম করে সামান্য পেনশন নিয়ে অবসরগ্রহণ করে বিশেষ লাভ নেই। আমর কোম্পানি কত পেনশন দেয় জানেন? ঐ টাকায় স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন অসম্ভব। আমার অনেক বন্ধু অবসরগ্রহণের পর এত কম আয় করেন যে মনে হয় তারা আরেক মন্থর গতিতে অথচ আরও দুর্দশাগ্রস্থ ইঁদুর দৌড়ে ঢুকে পড়েছে।

সম্মতি জানিয়ে মৃদুস্বরে বললাম, ‘তাই আজ আমি এখন আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। যেহেতু আপনারা একদিন বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য সময় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই আপনাদের কাছে আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন ও আরও স্বাচ্ছন্দ জীবন-যাপনের ক্ষমতা আছে। অনেককেই সারাজীবন কাজ করে, সময় ও অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হয় না। ব্যাপারটা দুঃখজনক।’

কীভাবে অতি-ধনী হওয়া যায়

একজন অংশগ্রহণকারী হাত তুললেন, ‘আপনি যে বললেন আমরা অতি-ধনী হয়ে উঠতে পারি, আমরা বহু অভিনেতা, রকস্টার, খেলোয়াড় এমনকি এখন আমি যে কোম্পানিতে কাজ করছি সেকানকার প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি ধনবান হয়ে উঠতে পারি?’

‘ঠিক কথা’, আমি বললাম, ‘আপনার মনিবের তুলনায় আপনি বেশি আয় করতে পারেন।’ তাই তো চাই’, ঐ একই ব্যক্তি বলে উঠলেন, “এই ব্যবসায় অংশ নিয়ে কীভাবে অতি-ধনী হওয়া সম্ভব?’

‘প্রথমেই বিশ্বাস করতে হবে, এটা করা সম্ভব’, আমি বলি।

‘কেন, এর সম্ভাবনা সম্বন্ধে বেশিরভাগ মানুষ কি সন্দিহান?’ আরেকজন প্রশ্ন করলেন। ‘আমার মনে হয় অনেকেই মনে করেন, এটা সম্ভব, তবে তাদের দ্বারা করা অসম্ভব এরা মনে করেন, এরা পারবেন না, তবে অন্যরা পারবে। যতক্ষণ না আপনি নিজে বিশ্বাস করবেন যে এটা সম্ভব কতক্ষণ তা অসম্ভব মনে করে,’ মৃদুভাবে বললাম, ‘অনেকেই একদিন মিলিয়নেয়ার হয়ে উঠার স্বপ্ন দেখে, তবে খুব কম লোকের কাছে মাসে এক বিলিয়ন বা তার বেশি আয় করার ক্ষমতা থাকে। এই সত্যকে তারা নিজেদের জীবনের সত্য করে তুলতে পারে না।’

‘তা আপনার জীবনের সত্যটা কি তাই?’ একজন প্রশ্ন করলেন।

‘নিশ্চয়ই,’ উত্তর দিলাম।

‘আপনি আপনার বাস্তবজীবনে কীভাবে এই সত্য উপলব্ধি করেছেন?’

‘আমার ধনবান বাবার সাহায্যে পেয়েছি,’ আমি বললাম।

মুহূর্তকাল চুপ করে প্রশ্ন করি, ‘আপনাদের মা-বাবা টাকা-পয়সা সম্বন্ধে কোন সত্যগুলো শিখিয়েছিলেন?’

‘মাসে এক মিলিয়ন আয় করা অবশ্যই নয়,’ এক যুবক বললেন, ‘আমার মা-বাবা মনে করেন, কেউ যদি চাকরি করে বছরে ১,০০,০০০ ডলার আয় করে তাহলে সে ধনী। ‘

‘বেশিরভাগ মানুষ তাই মনে করেন,’ আমি বলি

‘তা, মাসে মাসে এক বিলিয়ন বা তার বেশি আয় করা যায়-এই সত্যটা কীভাবে সম্ভব বলে স্বীকার করা যায়?’ ঐ যুবক আবার প্রশ্ন করল।

‘আপনাকে স্বীকার করতে হবে,’ উত্তর দিলাম, ‘অন্য কেউ আপনার হয়ে এটা করতে পারবে না।’

‘একথা কেন বলছেন?’, এক অল্পবয়সী ভদ্রলোক বললেন।

‘কারণ, আমি আপনাদের চোখে দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছি। আপনাদের মধ্যে অনেকেই এই সত্যটাকে স্বীকার করতে চান না। কারণ, এই সত্য আপনাদের চিন্তা-ভাবনার বাইরে। আপনাদের অনেকের মতই আমার পরিবারও তেমনী ধনী নয়। আমার মা-বাবার মুখে প্রায়ই শুনেছি ‘এ আমার ক্ষমতার বাইরে, বা ‘টাকা কি গাছে ফলে?’ অথবা, ‘অর্থ মানুষকে আনন্দ কিনে দিতে পারে না,’ কিংবা ‘ধনীরা মোটেই সুখী নয়। আমার পরিবারের এই সত্যটি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমি এই সত্যের বাইরে অন্য সত্যের খোঁজে শুরু করি… আমার ধনবান বাবাও এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। বস্তুত আমার জন্য তিনিই প্রধান কাজটা করেন, তিনি আমায় এক নতুন সত্য উপলব্ধি করিয়েছিলেন, সেই সত্যের বাস্তব রূপায়ণ শিখিয়েছিলেন।’

‘আমাদের বলুন, সেই সত্যটি কি?’ বয়স্ক এক ভদ্রলোক বললেন।

‘এই তো বললাম,’ উত্তর দিলাম, ‘এখন প্রশ্ন হল এই সত্যকে স্বীকার করার জন্য আপনারা কি প্রস্তুত?’ মুহূর্তে আমাদের মধ্যে অনেকেই এই সত্য অস্বীকার করলেন, আবার কেউ কেউ এই ধারণাটি… অতি-ধনীর সত্যটি স্বীকার করে নিয়ে চাইছেন।’

সম্মতি জানিয়ে বলি, ‘বেশিরভাগ মানুষ এই সত্য স্বীকার করছেন না, অনেকেই এই সত্যকে অবাস্তব মনে করেন, অবাস্তব মনে করার নানা কারণ দেখায় অনেকে আমার উপর অসন্তুষ্ট হন, তারা বলেন আমি নাকি তাদের মিথ্যা আশা ভরসা দিচ্ছি। আমি কাউকেই মিথ্যা আশা বা আজগুবি প্রত্যাশা দিচ্ছি না। আমি শুধুই আমার নিজের প্রত্যাশা ও স্বপ্নগুলো আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এগুলো সত্যি না মিথ্যে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। ‘

‘আপনি এখনও তো অতি-ধনী শ্রেণীতে পৌঁছাতে পারেননি?’ বয়স্ক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা সত্ত্বেও আপনি বলছেন যে আপনি এখনও সে চেষ্টা করছেন।’

‘সত্যি কথা’, আমি বলি, ‘আমি এখন শুধুই ধনী। তবে একদিন অতি- ধনী হয়ে ওঠার লক্ষ্য আছে। ২৫ বছর আগে যে লক্ষ্য স্থির করেছিলাম, তা আজও ভুলিনি এবং প্রতিদিন চেষ্টা করে চলেছি।’

‘আপনি কি করে জানলেন যে তা বাস্তব করে তোলা যায়?’ এক তরুণী প্রশ্ন করলেন।

‘আমি জানি না কতখানি সফল হব …. কারণ এই প্রচেষ্টায় আমি দু’বার অসফল হই তা সত্ত্বেও আমি চেষ্টা করে চলেছি, আমি বললাম, ‘আমি জানি যে কয়েকজন এই সত্য বাস্তব করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন বিল গেটস, যেমন মাইকেল ডেল। আর এরা মাত্র তিরিশ চল্লিশ বছর বয়সে, কিংবা তার আগে তা করে দেখিয়েছেন।’

‘আপনি বলছেন আমাদের মধ্যেও এই ক্ষমতা নিহিত আছে?’ এক অল্পবয়সী মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং অনেক মানুষকে অতি-ধনী শ্রেণীতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। আমি তাদের দেখেছি। আমি জানি, কারণ তাদের ব্যবসার মাধ্যমে ইনভেষ্ট করতে দেখেছি। আমি তাদের বিশাল বিশাল অফিসগুলো দেখেছি, তাদের নিজেদের অফিস, বড় কর পরিসর নয়; তাদের দোকানপাট, তারা যে কোম্পানিতে বড় অংশভাগ নিয়েছেন, বিশালায়তন আবাসীর বিভাগ, র‍্যাঞ্চ, আরো অনেক কিছু দেখেছি। ই বা এস হিসাবে তারা এই ইনভেস্টমেন্টে করতে পারতেন না। বি কোয়াড্রান্টেই তা সম্ভবপর হয়েছে-যে ব্যবসা সীমাহীন আয়ের সুযোগ, শুধু সেই ব্যবসা ধনীদের মত ইনভেস্ট করা যায়। তাই আপনারও ঠিক পথে চলেছেন। যদি ব্যবসা গড়ে তোলায় পরিশ্রম করতে পারেন, পড়াশোনা করেন, ফাস্ট ট্র্যাকে ইনভেস্টমেন্ট সম্বন্ধে যথেস্ট তথ্য সংগ্রহ করেন এবং ভেতর থেকে নিজের উন্নতি করায় সচেষ্ট থাকেন, আপনিও সফল হবেন। তবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই… শুধু আপনি নিজে তা সম্ভব করতে পারবেন।’

এক যুবতী প্রশ্ন করলেন, “তা, আপনার ক্যাশফ্লে গেমের ফাস্ট ট্র্যাকে ইনভেস্টমেন্টের বিষয়ে কীভাবে জানা যায়?

‘এই ইনভেস্টমেন্টগুলোর বিষয়ে রিচ ড্যাডস গাইড টু ইনভেস্টিং-এ জানিয়েছি। আগেও বলেছি, বহু ই ও এস ঐ বই পড়ে হতাশ করেছিলেন। তবে আপনাদের কাছে ধনিদের ইনভেস্টমেন্টে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে। এই ইনভেস্টমেন্টগুলোতে অংশ নেওয়ার জন্য আইনত মিলিয়নার হতে হবে।’

‘আপনি কি পরামর্শ দেবেন?’ বয়স্ক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন। ‘আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমার সময়াভাব, আমায় কি করতে বলবেন? আমি কি পারব?’

‘প্রথমেই বলি, বয়সকে অজুহাত বানাবেন না, মনে রাখবেন সত্তর বছরের কাছাকাছি পৌঁছে কর্ণেল স্যান্ডার্স কেনটাকি ফ্যায়েড চিকেন শুরু করেন। আমার ধনবান বাবা সবসময় বলতেন, ‘যারা হেরে যায় তারা জীবনের পরিস্থিতিগুলোকেই অসফলতার কারণ মনে করে অথচ সফল মানুষ ঐ পরিস্থিতিগুলোতেই পাথেয় করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছায়। কর্ণেল তার বয়সটাকেই সাফল্যের কারণ করে তুলেছিলেন। যখন বেশিরভাগ মানুষ অবসর নেয়, সেই বয়সে তিনি অতি-ধনী শ্রেণীভূক্ত হয়েছিলেন।’

‘মানছি,’ বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, ‘তা আপনি কি পরামর্শ দেবেন?’

‘প্রথমত, ইনভেস্টমেন্টর জগত সম্বন্ধে একটা সামগ্রিক ধারণা গড়ে তোলার জন্য আপনাদের সকলকে রিচ ড্যাডস গাইড টু ইনভেস্টিং পড়তে বলব। এরপর, যদি অতি-ধনী হয়ে ওঠার স্বপ্ন সত্যি করে তুলতে চান তাহলে একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে একটি করে অধ্যায় পড়ুন, অধ্যায় ২০ থেকে শুরু করুন, এত ৯০/১০ ধাঁধাঁ আছে। যথেষ্ট সময় নিয়ে পড়ুন। মিটিং-এ আসার আগে সবাই ঐ অধ্যায় পড়ে আসুন। তারপর সকলে মিলে ঐ অধ্যায়ের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করুন। আবার বলি, যথেষ্ট সময় নিয়ে অধ্যয়ন করবেন। দেখবেন দলবদ্ধভাবে পড়াশোনা ও আলোচনা করলে ইনভেস্টমেন্ট সম্বন্ধে আপনার বর্তমান ধারণা আরো প্রসারিত হবে।’

‘আপনি বলছেন আমরা সাধারণত দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের ইনভেস্টমেন্টে কেন্দ্রীভূত?’ বয়স্ক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন। ‘ধনীরা যে সব ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করেন, আমাদের সে সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা উচিত। ধনীদের ইনভেস্টমেন্ট আমাদের সত্য করে তুলতে হবে।’

‘হ্যাঁ’, উত্তর দিল, ‘আমার ধনবান বাবার কাছ থেকে আমি তাই শিখেছি। তিনি বিনিয়োগের জগতের যে সত্য শিখিয়েছিলেন তা শুধু ধনীরা জানে। ঐ সত্য জানার পর আমার জীবনের পথ খুঁজে পেলাম, সেই পথে আজও চলছি।’

‘অর্থাৎ আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ শুধু মিউচ্যুয়াল ফান্ড, স্টক, ছোট রিয়্যাল এস্টেটগুলো ইনভেস্ট করার ব্যাপারে জানে-কারণ ইনভেস্টমেন্টের জগতে আমাদের জন্য এগুলোই ‘সত্য’। তাই বলছেন কি?’

‘হ্যাঁ, তাই বলছি, উত্তরে আমি বলি। ‘বেশিরভাগ মানুষ ই এবং এস কোয়াড্রান্ট থেকে ইনভেস্টমেন্টের কথা বিবেচনা করে। তারা মনে করে ইনভেস্টমেন্ট করার অর্থ ঝুঁকি নেওয়া, তাই যথাসম্ভব সুরক্ষিত থাকতে চায়। এরা দোকান থেকে যেমন দেখেশুনে মাছ মাংস কেনে তেমনি বুঝেশুনে নিরাপদ, প্রি পাকেজ ইনভেস্টমেন্টে লগ্নি করে। আর দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা যে ইনভেস্টমেন্টে অর্থলগ্নি করে সেগুলোকে প্রি-প্যাকেজ করে র‍্যাঞ্চ, এই র‍্যাঞ্চে ধনীরা বিনিয়োগ করে, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সত্য।”

‘তাই অধ্যায় ২০ থেকে পড়া শুরু করে, ক্রমশ সত্যের পরিধি বিস্তৃত করতে হবে। সবাইকে নিয়মিতভাবে একত্র হয়ে অধ্যায় ২০ থেকে শুরু করে বাকি অধ্যায়গুলো পড়তে হবে। এভাবে অধ্যয়নের ফলে মন প্রসারিত হবে, ধনীদের ইনভেস্টমেন্ট সম্বন্ধে আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে… আপনি বলছেন এই সব ক্ষমতাগুলো আমাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে।’

সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলি, ‘যদি একবার ফাস্ট ট্র্যাকে ইনভেস্টমেন্টের মজা ও রোমাঞ্চ উপলব্ধি করতে পারেন, আপনার মনে হবে বেশিরভাগ মানুষ কেন নিরাপদ, প্রি প্যাকেজ করা বোধহয় তখনই আসে যখন মানুষ নিজের মনের সত্যগুলো বুঝতে পারে। তাছাড়া ধনীদের ইনভেস্টমেন্ট কতটা ক্ষমতাশীল তা একবার বোঝার পর আপনি নিজেরও আরো দ্রুত বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তুলতে চাইবেন … আগেই বলেছি জীবনের মজা হল অর্থ বিনিয়োগ ও অর্থকে দিয়ে পরিশ্রম করানো।’

“আমাকে আরো কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেবেন?’ বয়স্ক ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম, ‘পদক্ষেপ ২, যা খুবই জরুরি। নিজেকে অগ্রসর করার জন্য আপনি এইসব তরুণ ও মধ্যবয়স্কদের শক্তি, ক্ষমতা ও সাহায্য চেয়ে নিন। নতুন সত্য উপলব্ধি করার পর, এদের সাহায্য দিয়ে গড়ে তুলুন আপনার জীবনের নতুন সত্য। এদের সাহায্য করতে বলুন। এরাও আপনাকে সাহায্য করতে চায়, আপনার সাফল্য চায়। তবে যতক্ষণ না নিজেকে সাহায্য করতে রাজি হবেন, যতক্ষণ না এদের সাহায্য নিতে রাজি হবে, ততক্ষণ এরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না।

বয়স্ক ভদ্রলোক চুপ করে বসেছিলেন, আমি বুঝলাম সাহায্য চাওয়া তার পক্ষে অস্বস্তিকর ব্যাপার। আমি জানি, কারণ ছেলেদের ছোট বয়স থেকে শেখানো হয় সাহায্য চাওয়া দুর্বলতার লক্ষণ। অনেক মেয়েরাও এমন মনে করে। বুঝলাম বয়স্ক ভদ্রলোক সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত, আমি তাকে দাঁড়াতে বললাম, ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখতে বললাম।

ভদ্রলোক ইতঃস্তত করছিলেন। শেষে উঠে দাঁড়ালেন। আমায় অনুরোধে বেশ বিপদে পড়েছেন তা বুঝলাম। সোজ দাঁড়িয়ে উনি চোখ তুলে তাকালেন, ঐ ঘরটিতে তখন কয়েক শ’মানুষ বসেছিলেন। সবাই হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়েছিলেন। চোখের ভাষায় তারা ঐ বয়স্ক ভদ্রলোককে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন।

আমি এবার প্রশ্ন করলাম, ‘আপনাদের মধ্যে কারা এঁকে সাহায্য করতে চান?

হুড়মুড় করে কয়েক শত হাত উঠল, সবাই নিজের সমর্থন জানাতে চায়। ভদ্রলোক চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, দেখলেন অজস্র হাত, তাদের চোখে মমতা ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। বয়স্ক ভদ্রলোক হঠাৎ আবেগপ্রবন হয়ে উঠলেন, তার চোখে জল দেখলাম, আর তিনি দেখলেন সাহয্যের এক বিশাল সমুদ্র তাকে ঘিরে রয়েছে। তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে সবার দিকে তাকিয়েছিলেন, যেন তাদের আত্মা একে অপরকে স্পর্শ করছিল। মাথা নেড়ে মৃদুভাবে তিনি বললেন, ‘ধনবাদ’। কাঁপতে কাঁপতে তিনি বসে পড়লেন, উপস্থিত সকলে জোরে হাততালি দিয়ে উঠল

হাততালির আওয়াজ ক্ষীণ হওয়ার পর আমি আবার আমার বইটা হাতে তুলে ধরে বললাম, ‘এই ব্যবসার বিশেষত্ব হল, আপনি নিজে যা পেতে চান তা পাওয়ার ব্যাপারে অপরকে সাহায্য করুন, তাহলে আপনিও সফল হবেন। আপনি কত আয় করছেন তার ভিত্তিতে এই ব্যবসা মূল্যায়ন করা হয় না, এই ব্যবসার মাপকাঠি হল, আপনি কতজনকে সাহায্য করছেন, কতজনের জীবনে পরিবর্তন আনতে পেরেছেন’। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বিদায় নিলাম।

নানারকমের কল্পনাপ্রবণ মানুষ

যখন হাই স্কুলে পড়ি, আমার ধনবান বাবা পাঁচ রকমের কল্পনাপ্রবণ মানুষের কথা বলেছিলেন :

১. যারা অতীতের স্বপ্ন দেখে-রিচ ড্যাড বলেন, ‘কয়েকজন মানুষ সহ সাফল্যের স্তর পেছনে ফেলে এসেছে।’ টি. ভি.-তে অ্যাল বান্তির বৈঠকি হাস্যরসের অনুষ্ঠান ‘ম্যারেড উইথ চিলড্রেন’-এর এক অন্যতম উদাহরণ, এতে এক ভদ্রলোক স্বপ্নকে অতীতে রেখে এগিয়ে গিয়েছেন। যারা এই শো দেখেননি তাদের জানাই, অ্যাল বাণ্ডি এক প্রাপ্তবয়স্ক ভদ্রলোক যিনি তার অতিথীদের হাই স্কুলের দিনগুলোতে বেঁচে আছেন, যখন ইনি ফুটবল স্টার ছিলেন, একবার একটা গেমে চারখানা টাচডাউন করেন। অতীতে বেঁচে আছেন, যখন ইনি ফুটবল স্টার ছিলেন, একবার একটা গেমে চারখানা টাচডাউন করেন। অতীত বেঁচে আছে এই মানুষটা, অতীতের স্বপ্ন দেখে। রিচ ড্যাড বলতেন, ‘যে অতীতের স্বপ্ন দেখে তার জীবন সমাপ্তির পথে। জীবন স্পন্দন ফিরে যাওয়ার জন্য তাকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে হবে।’

শুধু প্রাক্তন ফুটবল স্টার-বা অতীতে বেঁচে আছে তা নয়। অন্যান্য অনেকেই অতীতের দিনগুলোতেই বেঁচে রয়েছে। স্কুলে ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে, ‘প্রশ্ন-এ রাজা বা রানী হয়েছে, খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছে বা সামরিক সেবায় কাজ করেছে। অর্থাৎ তাদের সেরা দিনগুলো শুধু অতীতের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়।

২. যারা শুধুই ছোট ছোট স্বপ্ন দেখে- রিচ ড্যাড বলেছিলেন, ‘এ জাতীয় ভাবুক মানুষ শুধু ছোট স্বপ্ন দেখে, এদের মধ্যে শুধু ছোট স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার আত্মপ্রত্যয় আছে। সমস্যাটা হল, এরা জানেন সাফল্য পাওয়া সম্ভব, তা সত্ত্বেও এরা ব্যর্থ হয়।

এরকম কল্পনাপ্রবণ মানুষের মানসিকতাটা সঠিক ভাবে বোঝা গেল না। তারপর, একবার এক ভদ্রলোককে প্রশ্ন করি, ‘আপনি যদি প্রচুর অর্থ পান, তাহলে কোথায় ঘুরতে যাবেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘ক্যালিফোর্ণিয়া যাব, বোনের সঙ্গে দেখা করব, ১৪ বছর আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ নেই, তাই আমার বোনটির সঙ্গে দেখা করতে চাই, ওর বাচ্চারা আরও বড় হয়ে ওঠার আগে একবার তাদের দেখতে চাই। সেটাই হবে আমার যথার্থ ভ্রমণ।’

আমি বললাম, ‘সে তো আজ নয়, এখন আমি খুব ব্যস্ত।’

এই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বুঝলাম, এই রকমের ভাবুক মানুষ প্রায়ই দেখা যায়। এরা চোখে এমন স্বপ্ন দিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেন যা বাস্তবে পাওয়া মোটেই অসম্ভব নয়, তা সত্ত্বেও স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্য যে প্রয়াস করতে হয়, তা করতে এরা রাজি নন। জীবনের শেষে এরা বলেন, ‘ঐ কাজগুলো বহু বছর আগেই করা উচিত ছিল। কিছুতেই আর হয়ে উঠল না।’

আমার ধনবান বাবা বলতেন, ‘এই ধরনের ড্রিমার (ভাবুক মানুষ) সবচেয়ে বিপজ্জনক। এরা কচ্ছপের মত, নিজেদের নিরাপদ নিরালা আশ্রয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। তুমি যদি তাদের সুরক্ষা কবচটায় সামান্য টোকা দাও অথবা উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা কর, এরা তোমাদের কামড়ে দেবে।’ তাই এসব কচ্ছপদের নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দিন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ এগিয়ে যেতে রাজি না, তাই এদের খেয়ালখুশি মত বাঁচতে দিন।

৩. যেসব ড্রিমার কয়েকটি স্বপ্ন সত্যি করে তুলেছে তবে আর কোনও নতুন স্বপ্ন দেখেনি-একবার আমার বন্ধু বলেছিল, ‘২০ বছর আগে আমি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এখন আমি ডাক্তার, তবে এই একঘেয়ে জীবনে আমি আজ খুশি না। আমি ডাক্তার হিসাবে পরিতৃপ্ত, তবে কোথায় কি যেন নেই।’ এটা কিন্তু স্বপ্ন সত্যি হয়ে ওঠার একটি উদাহরণ-এই ভদ্রলোক স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলতে সফল হয়েছেন। তবে ঐ একঘেয়েমির অর্থ- এখন নতুন স্বপ্ন দেখতে হবে। আমার ধনবান বাবা বলতেন, ‘অনেকেই হাই স্কুলে পড়াকালীন যা স্বপ্ন দেখত, পরবর্তী জীবনে তাই হয়ে উঠেছে। সমস্যাটা হল, এরা বহু বছর আগে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছে। এখন প্রয়োজন নতুন স্বপ্ন, নতুন রোমাঞ্চ।’

৪. যারা বড় বড় স্বপ্ন দেখে, কিন্তু স্বপ্নকে সত্যি করে তোলার কোনও পরিকল্পনা থাকে না- তাই জীবনে কিছুই পায় না। আমরা সবাই এমন শ্রেণীর মানুষকে অল্পবিস্তর চিনি। অনেকে বলেন, ‘দারুণ একটা সুযোগ পেয়েছি। আমার প্ল্যানটা বলি শোন,’ অথবা ‘এবার নতুন কিছু হবে।’ কিংবা ‘এবার আমার জীবনে নতুন কিছু করছি।’ বা ‘এবার খুব পরিশ্রম করব, সব পাওয়া মিটিয়ে এবার ইনভেস্ট করব।’ অথবা ‘শুনলাম আমাদের শহরে একটি নতুন কোম্পানি আসছে। এরা আমার মত যোগ্য প্রার্থী খুঁজছে। এবার হয়ত একটি ভাল সুযোগ পাব।’

৫. যারা বড় বড় স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নগুলোকে সত্যি করে তোলে ও আরও বড় স্বপ্ন দেখে-আমার মনে হয় আমরা সকলেই এমন হতে চাই, অন্তত আমি তো তাই চাই-কয়েকটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা সম্বন্ধে অধ্যয়ন করার পর আমার মধ্যে যে নতুন পরিবর্তনগুলো দেখতে পাই, তার এটি হল আমি আগের চেয়েও বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। এই ব্যবসা মানুষকে বড় বড় স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নগুলোকে সত্যি করে তোলায় উৎসাহ দেয়। বেশিরভাগ চিরাচরিত ব্যবসা মানুষকে ব্যক্তিগত স্বপ্ন দেখতে দিতে চায় না। আমি বহুবার এমন অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছি যারা বা যাদের বন্ধুরা এমন ব্যবসা আমার সম্পূর্ণ সমর্থনের কারণ হল এরা মানুষকে বড় বড় স্বপ্ন দেখায়, উৎসাহ প্রদান করে, সেই স্বপ্ন সত্যি করে তোলায় সাহায্য করতে চান, তাহলে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বিজনেস আপনার জন্য। প্রথমে খণ্ডকালীন ব্যবসা শুরু করুন, ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও ঐ খণ্ডকালীন ব্যবসা যোগ দেওয়ার উৎসাহিত করে তুলুন। যে ব্যবসা ও যে মানুষ ও যে মানুষ অপরের স্বপ্নসত্যি করে তোলায় সাহায্য করে, সেই ব্যবসা ও মানুষগুলো সঙ্গে কাজ করলে অবশ্যই সুফল পাবেন।

পুরাতন অর্থব্যবস্থা বনাম নতুন অর্থব্যবস্থা

পুরাতন অর্থব্যবস্থার সঙ্গে নতুন অর্থব্যবস্থার তুলনা করলে রবার্ট মেটাকাফের আইনের বিপুল ক্ষমতা আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এওএল (আমেরিকা অনলাইন) এক নতুন অর্থব্যবস্থার ব্যবসা, এতে আক্ষরিকভাবে লক্ষ লক্ষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও মানুষ জড়িত রয়েছে। যেহেতু এওএলের নেটওয়ার্ক বিশাল, স্টক মার্কেটে এদের মূল্যও পুরানো অর্থব্যবস্থার ব্যবসা থেকে বহুগুণ বেশি… যেহেতু এই কোম্পানির মূল্য বেশি তাই এওএলের কাছে আছে বিপুল আর্থিক ক্ষমতা, যে ক্ষমতার সাহায্যে এরা এক সুপ্রতিষ্ঠিত তবে পুরাতনী অর্থব্যবস্থার ব্যবসা টাইম-ওয়ার্নারকে কিনে নিয়েছে।

লেখকের মন্তব্য : টাইম-ওয়ার্নার ট্রেড পাবলিশিং রিচ ড্যাড ধারাবাহিক বইগুলোর প্রকাশক। এই উল্লেখের উদ্দেশ্য হল, যদিও টাইম-ওয়ার্নার এক পুরানো অর্থব্যবস্থার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তবে এরা অংশীদার হিসাবে এক উৎকৃষ্ট ও প্রগতিশীল কোম্পানি।

পরিশ্রমী মানুষ বনাম নেটওয়ার্কার

আমার বাবার সময়কার সিনেমার হিরো ছিলেন জন ওয়্যান-এর মত মানুষ। ব্যবসা হিরো ছিলেন জন. ডি. রকফেলার ও জে. পি. মর্গ্যান-এর মত প্রবাদপ্রতিম ব্যবসায়ী। এঁরা ব্যবসা বিশালাকার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, এরা জন ওয়্যানের মত ছিলেন, শক্তিশালী, স্বাধীন… পরিশ্রমী মানুষ। ব্যবসায়ীর এই ভাবমূর্তি আজও প্রযোজ্য।

তবে ১৯৫০-এর দশকে এক নতুন ধরনের ব্যবসার মডেল ও ব্যবসায়ীর আবির্ভাব হয় এর মধ্যে একটি ছিল ‘ফ্র্যাঞ্চাইস’। ফ্র্যাঞ্চাইস এমন এক প্রকারের নেটওয়ার্ক যেখানে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী একত্র হয়ে কাজ করেন। যখন প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইসের আবির্ভাব হয়, অনেক পুরানো ব্যবসা- প্রতিষ্ঠান এর নিন্দা করেছিল, কেউ কেউ এগুলিকে অবৈধ ঘোষণা করে।

এখন আমরা সকলেই জানি, যে পরিশ্রমী মানুষটা এক নিজের হ্যামবার্গারের দোকান খুলে বসেছে, তার তুলনায় ম্যাকডেনান্ডের ফ্যাঞ্চাইসের মালিকের ক্ষমতা অনেকাংশে বেশি, যদি ঐ পরিশ্রমী মানুষটির হ্যামবার্গারের স্বতন্ত্র্য দোকানের পাশে ম্যাকডোনাল্ডের দোকান খোলা হয়, সম্ভবত ঐ ব্যক্তির দোকান ম্যাকডেনাল্ডের কাছে টিকতে পারবে না।

যে কোন ব্যবসা, নতুন ফ্র্যাঞ্চাইসের মূল্য তার সঙ্গী ফ্যাঞ্চাইসির উপস্থিতিতে বৃদ্ধি পায়। আমার মনে পড়ে, প্রথম যখন ‘মেল বক্স এক্সসেটরা দেখি, ভেবেছিলাম ‘এটা কি’, হঠাৎ ফ্র্যাঞ্চাইস বৃদ্ধির ফলে কোম্পানি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। কয়েক বছরের মধ্যে দেখলাম কয়েক মাইলের মধ্যে একটি করে মেল-বক্স দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘মেটকাফে’র আইনের এ আরেক উদাহরণ।

আমাদের পাড়ায় বহু বছর যাবৎ একটি ছোট প্যাকেজিং ডাকঘর ভাল ব্যবসা করছিল। ঐ শপিং সেন্টারে (বিপণন কেন্দ্রে) যেদিন মেল বক্স এক্সসেটরা-র ফ্র্যাঞ্চাইস খোলা হয়, আগেকার ডাক-ব্যবসা প্রতিযোগিতায় হেরে গেল। আরেকবার নেটওয়ার্কের কাছে হার মানতে হল এক পরিশ্রমী উদ্যোগী মানুষকে।

দ্বিতীয় প্রকারের নেটওয়ার্কের ব্যবসাকে বলা হয় নেটওয়ার্ক মার্কেটিং। ফ্র্যাঞ্চাইস ব্যবসা নেটওয়ার্কের পরিবর্তে এখন এসেছে একক ব্যক্তিবিশেষের ফ্র্যাঞ্চাইস নেটওয়ার্ক। এই নতুন ধরনের নেটওয়ার্ক ব্যবসার শুরুতেই নানারকম সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়, এখনও এদের বিরুদ্ধে নানারকম নালিশ শোনা যায়। অথচ এই ইন্ডাস্ট্রি এখন বহু পুরাতন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ক্ষেত্রকে ক্রমশ নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। মেটকাফের আইনের শক্তিশালী ক্ষমতার দরুণ এই ইন্ডাস্ট্রি অবিরাম বিকাশ করে চলেছে।

মেটকাফে-র আইনে ক্ষমতা সকলের আয়ত্তে আনার সুযোগ

নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর বৈশিষ্ট্য হল, এতে মেটকাফের আইনের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের, আপনার, আমার আয়ত্তে এসেছে… তবে এই আইন অমান্য করা চলবে না। যদি এই আইনের বিধি অনুসরণ করে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানিতে যোগ দেন, আপনিও সঠিক পথে পদার্পণ করবেন, তবে শুধুই কোম্পানিতে যোগ দিতে এই শক্তি আয়ত্তে আসবে না। যেমন- আপনি টেলিফোন কিনেছেন, অথচ অন্য কারুর কাছে ফোন নেই।

তাই ক্ষমতা আয়ত্তাধিন করার জন্য আপনাকে আপনার মতই কাউকে তৈরি করতে হবে। যখন আপনারা দু’জন ব্যবসা করবেন, আপনার আর্থিক মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আপনার নেটওয়ার্কের মূল্য ঐ চার থেকে নয় হয়ে যাবে। আপনি যে দু’জনকে ব্যবসায় অন্তর্ভুক্ত করবেন, তাদের প্রত্যেকে আরও দু’জন করে লোক আনলে আপনার নেটওয়ার্ক ব্যবসা দ্রুত আকাশ ছুঁয়ে যাবে। গণিতের সহজ হিসাবমাফিক কাজ না করে আপনার মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এটি নেটওয়ার্ককৃত ব্যবসার ক্ষমতা ও উপযোগিতা।

আমার মতে, একক প্রচেষ্টায় ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য পরিশ্রম করার পরিবর্তে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মনোনিবেশ করা বেশি লাভজনক। যেমন- আপনি একা ‘ক’ বিন্দু থেকে ‘খ’ বিন্দুতে যে কটা পাথর তুলে নিয়ে যেতে পারবেন, আপনারা ন’জন মিলে অনেক বেশি পাথর তুলে নিয়ে যেতে পারবেন, আপনি নিজে অন্য আটজনের তুলনায় যদি মাত্র ১০% আয় করেন, আপনার পক্ষ থেকে কোনোরকম পরিশ্রম ছাড়াই কিন্তু আপনি ৮০% আয় করেবেন।

যে কোনও পেশাদার যথা-ডাক্তার, উকিল, অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও অন্যান্য শক্তিসামর্থ্য পরিশ্রমী মানুষের তুলনায় একজন সফল নেটওয়ার্ক ব্যবসায়ী অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেটকাফের আইন।… এই আইনের সাহায্যে এই ক্ষমতার তফাৎটা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।

আমার বদ্ধমূল ধারণা

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এক বন্ধু আমায় এক নতুন ব্যবসার প্রেজেন্টেশন অর্থাৎ প্রস্তুতিতে আমন্ত্রণ জানায়। যেহেতু আমি নিয়মিতভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুযোগ সম্বন্ধে গবেষণা করছিলাম, তাই আমি এই মিটিং-এ যেতে রাজি হয়ে গেলাম। আমার আশ্চর্য লেগেছিল, এই ব্যবসায়িক মিটিংয়ের আয়োজন কোনো অফিসে না হয়ে একজনের বাড়িতে করা হয়েছিল, তা সত্ত্বেও আমি সেখানে যাই। ঐ মিটিং ছিল নেটওয়ার্ক মার্কেটিং জগতের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।

তিন-ঘন্টাব্যাপী প্রেজেন্টেশন শেষ করে বেরিয়ে আসার পর আমার বন্ধু ঐ ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা সম্বন্ধে আমার কি ধারণা তা জিজ্ঞাসা করেন। আমি উত্তর দেই, ‘রোমাঞ্চকর, তবে আমার জন্য নয়।’

আমি কেন আগ্রহী না, বন্ধু আমাকে এই প্রশ্ন করায় উত্তর দিয়েছিলাম, ‘ইতিমধ্যে আমি নিজের ব্যবসা গড়ে তুলছি। আমার অন্য কারুর সঙ্গে ব্যবসা করার দরকার কি?’ তারপর বললাম, ‘তাছাড়া, শুনেছি নেটওয়ার্ক ব্যবসাগুলো শুধুই পিরামিড প্রকল্প এবং বেআইনী।’ বন্ধু আর কিছু বলার আগেই আমি হাঁটতে শুরু করি ও গাড়িতে চড়ে সেখান থেকে রওনা হয়ে যাই। আমার কয়েকটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল, অন্য কিছু শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। বহু বছর বাদে আমার ঐ ধারণাগুলো বদলায়… যখন আমি শুনতে রাজি হই, এই ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে নিজের ধারণাগুলো বদলাতে রাজি হই। আমার জীবনের সেই সময়টায়, সত্তর দশকের মাঝামাঝি আমি আমার প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করছিলাম। তাই দিনের বেলার চাকরি বজায় রেখে বাকি সময়টায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করায় খুব ব্যস্ত ছিলাম। আমার ব্যবসা ছিল উৎপাদন ও বিপণনের, যা কেন্দ্রীভূত ছিল প্রথম নাইলন ও ভেলক্রোর সার্ফার, ওয়ালেট বাজারে উপস্থাপিত করায়। প্রথম নেটওয়ার্ক মার্কেটিং মিটিং- এর কিছুদিনের মধ্যেই আমার স্পোর্টস ওয়ালেটের ব্যবসা হঠাৎ শ্রীবৃদ্ধি করে। ক্রমশ দু’বছরের কঠোর পরিশ্রমের পরিণাম দেখতে পেলাম। আমার দুই অংশীদার এবং আমার ওপর সাফল্য, সুনাম ও সৌভাগ্যের বর্ষণ শুরু হয়। আমাদের লক্ষ্য ছিল ত্রিশ বছর বয়স হওয়ার আগেই আমরা মিলিয়নেয়ার হব, সে স্বপ্নও বাস্তবায়িত হল, তাছাড়া সত্তর দশকে এক মিলিয়নের অনেক মূল্য ছিল। সার্ফার, রাণার্স ওয়ার্ল্ড এবং জেন্টলম্যানস কোয়ার্টারলির মত পত্রিকায় আমার কোম্পানি ও পণ্যগুলোর বিষয়ে উল্লেখ করা হচ্ছিল। খেলাধুলার সরঞ্জামের জগতে আমরা ছিলাম লোভনীয় নতুন পণ্যসম্ভার এবং পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে ব্যবসা উপচে পড়ছিল। আমার প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবসা তখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আগামী পনেরো বছরে আমি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তাই করিনি।

মনোভাবে পরিবর্তন

নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকের কথা, আমার এক বন্ধু, যার অর্থ-সংক্রান্ত বোধবুদ্ধি ও ব্যবসায়িক সাফল্যকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি, আমাকে জানাল যে সে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং করছে। ভূ-সম্পত্তিতে বিনিয়োগ অর্থাৎ রিয়াল এস্টেট ইনভেস্টমেন্টে বিল প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিত্তবান হয়েছে তাই, শুনে অবাক হলাম যে, সে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং করছ। উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “তুমি এই ব্যবসা করছে কেন? তোমার তো আর টাকাকড়ির তেমন প্রয়োজন নেই, তাই না?’

জোরে হেসে বিল জবাব দিল, ‘তুমি তো জানোই আমি অর্থোপার্জন করতে ভালবাসি, তবে টাকার প্রয়োজনে আমি এই ব্যবসা করছি না। আমার আর্থিক অবস্থা খুবই সচ্ছল।’

আমি জানতাম গত দু’বছরে বিল এক বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের একটি বাণিজ্যিক ভূ-সম্পত্তি প্রকল্প সম্পূর্ণ করেছে, সুতরাং সে যে স্বচ্ছল তা ভালমত জানতাম। তা সত্ত্বেও ওর অস্পষ্ট উত্তরে আমি আরও উৎসুক হয়ে উঠি, আরও প্রশ্ন করি, ‘তাহলে কেন নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা করছ?’

‘এর নাম-কনজিউমার ডিস্ট্রিবিউশন বিজনেস’, উত্তর দেয়। ‘আমরা এখন একে আর নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বলি না।’

‘সে যাই হোক,’ আমি বললাম, ‘যাই বলো না কেন, এত লোক থাকতে তুমিই বা কেন এই ব্যবসা করছ?’

অনেকক্ষণ চিন্তা করে বিল তার মন্থর টেক্সাস স্টাইলে বলতে শুরু করে, ‘বহু বছর যাবৎ লোকেরা আমার কাছ থেকে রিয়্যাল এস্টেটে ইনভেস্ট করার টিপস চাইছে। এরা সকলেই জানতে চায় তারা আমার সঙ্গে ইনভেস্ট করতে পারবে কি না, অথবা কোনরকম অর্থ ছাড়াই কীভাবে রিয়্যাল এস্টেট পাওয়া যায়।’

সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললাম, ‘আমাকেও এরকম প্রশ্ন করা হয়।’

‘সমস্যাটা হল… ‘বিল বলতে থাকে, ‘বেশির ভাগ লোক আমার সঙ্গে ইনভেস্ট করতে পারে না, কারণ এই ইনভেস্টমেন্টের উপযুক্ত হওয়ার মত যথেষ্ট আর্থিক সংস্থান এদের কাছে নেই। আর টাকাকড়ি ছাড়া ব্যবসার অভিপ্রায়ের অর্থ, এদের কাছে টাকাকড়িই নেই। হয় আমার ব্যবসা যোগ দেওয়ার মত যথেষ্ট অর্থ তাদের কাছে নেই অথবা অর্থ বিনিয়োগের মত টাকাই নেই তাদের কাছে।’

‘তুমি বলতে চাও তাদের কাছে একেবারেই টাকাকড়ি নেই, যদিও-বা থাকে, যাতে তুমি তাদের সাহায্য করতে পারো তেমন সম্বল তাদের নেই? তোমার ব্যবসা ইনভেস্টমেন্টের মত ধনী তারা নয়।’ আমি জিজ্ঞাসা করি।

বিল সম্মতি জানায়। ‘তাছাড়া তাদের কাছে সামান্য টাকাকড়ি থাকলেও তা তাদের সারা জীবনের সঞ্চয়, সেই টাকা তারা হারাতে চায় না। আর তুমি ও আমি আমরা দু’জনেই জানি, যে হারাতে ভয় পায় সে প্রায়ই হারায়।

বিলের সঙ্গে আরও কয়েক মিনিট কথাবার্তা হয়, তবে সেদিন আমাকে শিগগির এয়ারপোর্টের জন্য রওনা হতে হয়। তখনও আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছিলাম না ও কেন নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা করছে, তবে আমার মনের জানালাগুলো ধীরে ধীরে খুলতে আরম্ভ করেছিল। ও কেন নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা, অথবা ওর ভাষায়, কনজিউমার ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসা করছে, তা জানার ইচ্ছেটা আরও প্রবল হয়ে ওঠে।

পরবর্তী কয়েক মাস যাবৎ বিলের সঙ্গে আমার কথাবার্তা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি ওর এই ব্যবসার উদ্দেশ্য কী। ওর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলঃ

১. সে অন্যদের সাহায্যে করতে চায়

এটাই ছিল তার এই ব্যবসার প্রধান কারণ। ধনী হওয়া সত্ত্বেও সে লোভী বা অহঙ্কাী ছিল না।

২. সে নিজেকে সাহায্য করতে চায়

‘আমার সঙ্গে ইনভেস্ট করতে হলে তোমাকেও ধনী হয়ে উঠতে হবে। আমি বুঝতে পারি যে যদি আরও বেশি লোকদের ধনী হয়ে ওঠার সাহায্য করতে পারি, আমি আরও বেশিসংখ্যক ইনভেস্টার পাবো।’ বিল বলতে থাকে, ‘বিস্ময়কর ব্যাপারটা হল, আমি যত বেশি লোককে ব্যবসা করা, ধনী হয়ে ওঠার সাহায্য করব, আমার নিজের ব্যবসাও তাই বৃদ্ধি পাবে… আমি আরও ধনী হয়ে উঠব। এখন আমার কনডিউমার ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসা আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, আমার ইনভেস্টার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমার কাছে বিনিয়োগের জন্য আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি অর্থ আছে। সবদিক দিয়েই আমার জিত হয়েছে। তাই গত কয়েক বছরে আমি আরও বড় বড় রিয়্যাল এস্টেট প্রজেক্টে ইনভেস্ট করতে শুরু করেছি। তুমি তো জানোই, ছোটখাটো রিয়্যাল এস্টেট ব্যবসা করে সত্যিকার বড়লোক হয়ে ওঠা খুব কঠিন। অসম্ভব নয়, তবে যথেস্ট অর্থ না থাকলে যে রিয়্যাল এস্টেটের কাজ হাতে পাবে তা ধনীরা চায় না।’

৩. সে শিখতে ও শেখাতে ভালবাসে

‘যারা শিখতে আগ্রহী, আমি তাদের সঙ্গে কাজ করতে ভালবাসি। যারা মনে করে সবকিছু জানা হয়ে গিয়েছে এমন লোকদের সঙ্গে কাজ করতে ক্লান্ত লাগে, তবে রিয়্যাল এস্টেট ইনভেস্টমেন্টের জগতে আমাকে এমন অনেক লোকের সঙ্গে কাজ করতে হয় যে সব প্রশ্নের উত্তর জেনে বসে আছে তার সঙ্গে কাজ করা কঠিন। আমার মনে হয়, যারা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এ যোগ দেয়, তারা সকলেই নিত্যনতুন উত্তর খুঁজেছে, তারা শেখার জন্য প্রস্তুত। যারা অবিরাম শিক্ষালাভের ব্যাপারে প্রকৃত উৎসাহী, আমি তাদের শেখানো, তাদের কাছ থেকে শেখা ও তাদের সঙ্গে নতুন ধ্যান-ধারণার আদান-প্রদান করা পছন্দ করি। তুমি তো জানো, আমার অ্যাকাউন্টিং-এর ডিগ্রি রয়েছে, ফিন্যান্সে আমি এম. বি. এ. করেছি। আমি যা জানি এই ব্যবসার মাধ্যমে তা অন্যদের শেখানোর সুযোগ পাই, আবার অন্য সকলের সঙ্গে নিজেও ক্রমাগত শেখার সুযোগ পাই। বিভিন্ন পটভূমি থেকে কত রকমের স্মার্ট সুশিক্ষিত মানুষ যে এই ব্যবসা করছে শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। আবার এখানে এমন লোকও আছে যাদের পুঁথিগত বিদ্যা নেই, যেহেতু এই জগতে চাকরির নিরাপত্তা ক্রমশ ম্রিয়মান, নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য এরা শিখতে চায়, তাই এই ব্যবসা করছে। আমরা এতদিন যাবত জীবন থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং এখন যা শিখছি সেসব চিন্তা-ভাবনার আদান-প্রদান করি। আমি শিখাতে ভালবাসি, শিখতে ভালবাসি, তাই এই ব্যবসা আমার প্রিয়। এটা একটা দারুণ ব্যবসা। বাস্তবজীবনের এক অভিনব বিজনেস স্কুল।’

উন্মুক্ত মন

নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে এক সময় আমার মনের জানালাও খুলতে শুরু করল, এই ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে আমার ধারণা বদলাতে আরম্ভ করল। আমার বন্ধ মন যা দেখতে পায়নি আজ উন্মুক্ত মন তা দেখতে পেল। এই ইন্ডাস্ট্রির না-ধর্মী জিনিসগুলোর পরিবর্তে হ্যাঁ-ধর্মী বিষয়গুলো আমি দেখতে পেলাম… যদিও এই ইন্ডাস্ট্রিতে না-ধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব নেই। তবে, সব জিনিসেরই কিছু মন আছে বৈ কি।

১৯৯৪-এ অবসর গ্রহণের পর, ৪৭ বছর বয়সে আর্থিক মুক্তিপ্রাপ্ত আমি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির বিষয়ে নিজে গবেষণা শুরু করলাম। যখনই কেউ তার প্রেজেন্টেশনে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতেন, আমি সাগ্রহে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতাম, শুধুমাত্র তার কথাগুলো শোনার জন্য। কারুর কোনো কথা পছন্দসই মনে হলে তেমন দু’একটি কোম্পানিতে যোগ দিতাম। তবে শুধুই আরও অর্থোপার্জনের জন্য আমি এতে যোগ দিইনি, প্রতিটি ব্যবসায় ভাল ও মন্দ দু’টি দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করাই আমার অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল। মনটাকে বদ্ধমূল ধারণায় আবদ্ধ না রেখে আমি নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাই। বেশ কিছু ব্যবসা আমি ও অন্যান্য পাঁচজনের মত মন্দগুলো দেখতে পেলাম যেমন, বিচিত্র সব মানুষ এই ব্যবসায় যোগ দিয়ে ব্যবসার উন্নতি করতে চায়। এও সত্যি যে, বহু কল্পনাপ্রবণ মানুষ, প্রতারক, ধুরন্ধর, পরাজিত ও চটজলদি ধনী হয়ে ওঠার প্রত্যাশী মানুষ এই ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল, এর ‘ওপেন ডোর পলিসি’ অর্থাৎ উন্মুক্ত দ্বার পন্থা, যে কেউ এতে যোগ দিতে পারে। অধিকাংশ সমাজতন্ত্রবাদীরা যে ন্যায্য এবং সমান সুযোগের দাবি করেন এই ‘ওপেন ডোর পলিসি’ তাদের সেই দাবির বাস্তব রূপায়ণ, তবে এই ব্যবসায় আমি তেমন কোন নির্ভেজাল সমাজতন্ত্রীর মুখোমুখি হইনি। এই ব্যবসা পুঁজিবাদীদের জন্য, অথবা যারা পুঁজিবাদী হতে চায় তাদের জন্য।

অর্থ-প্রত্যাশী, পতারক ও ভাবুক মানুষগুলোর ভিড় অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ব্যবসার কয়েকজন মহাথীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। যাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেলাম তারা ছিলেন আমার মনের প্রতিকূল ধারণাগুলো কাটিয়ে যখন এমন মানুষের সংস্পর্শে এলাম যাদের আমি শ্রদ্ধা করি, যাদের সঙ্গে আমার মতের মিল রয়েছে, তখন আমি ইন্ডাস্ট্রির হৃদয়স্পন্দন খুঁজে পেলাম। আগে যা চোখে পড়েনি তা এখন স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। ভাল-মন্দ দুই-ই আমার চোখে পড়ল।

তাই, আমাকে যখন প্রশ্ন করা হয় ‘আপনি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা করে বড়লোক হননি, অন্যদের এতে যোগ দিতে বলছেন কেন?’ সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যই এই বইটি লিখেছি। যেহেতু আমি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা করে ধনোপার্জন করিনি তাই আমি এই ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপারে বিষয়মুখী বিশ্লেষণ করতে পারি। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার সত্যিকার মূল্য… যে মূল্য শুধুই অর্থোপার্জনের ক্ষমতাকে অতিক্রম করে যায়… সে সব বিষয়ে এই পুস্তিকায় আলোচনা করা হয়েছে। আমার ধনবান বাবা যেমন বলতেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ নেটওয়ার্ক খোঁজ, নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে, বাকিরা শুধুই কাজ খোঁজে।’

নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা সকলের জন্য নয়, তবে এখন এই ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বে এক শক্তিশালী আর্থিক ক্ষমতা হয়ে উঠেছে। যাঁরা ভবিষ্যতে ব্যবসা করার কথা ভাবছেন এবং ব্যক্তিগত আর্থিক ভবিষ্যতের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন তাঁদের বিষয়মুখী হয়ে এই ইন্ডাস্ট্রির বিষয়ে বিবেচনা করে দেখা উচিত।

ধনীরা কীভাবে বিত্তবান হয়ে ওঠে

চির ড্যাড ধারাবাহিকের তৃতীয় বই ‘রিচ ড্যাডস গাইড টু ইভেস্টিং’-এ আমাদের ধনবান বাবার শেখানো সত্যিকার ধনী হয়ে ওঠার উপায়গুলোর বিষয়ে আলোচনা করেছি। ধনী ব্যক্তির এক অদ্ভুত ক্ষমতা হল, সে একটি আইডিয়া অর্থাৎ ধারণাকে বি কোয়াড্রান্টে রূপান্তরিত করতে পারে। বইটিতে আরও জানানো হয়েছে কীভাবে ধনীরা ঐ গড়ে তোলা ব্যবসা (সম্পত্তি) অন্যান্য সম্পত্তিতে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করে।

‘রিচ ড্যাডস গাই টু ইনভেস্টিং’- এ আমি আপনাদের জানিয়েছি কীভাবে আপনার ধারণাটি দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারেন অথবা বহু বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন। যদিও কাজটা করা তেমন কঠিন নয়, তবে ব্যবসা গড়ে তোলা কতখানি খরচসাপেক্ষ তা আপনি বুঝতে পারবেন। আবার বলছি, শুধুমাত্র ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রার ভিত্তিতে খরচের মূল্যায়ন করছি না।

তাই ‘বেশির ভাগ মানুষ বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা গড়ে তোলা না কেন?” প্রশ্নটির বিস্তারিত উত্তর আপনি ‘রিচ ড্যাডস গইড টু ইনভেন্টিং’-এ পাবেন। তবে এর সহজ উত্তরটি হল, ‘এটি খরচ সাপেক্ষ ও সহজ নয়।’

সাশ্রয়কর বি কোয়াফ্রান্ট ব্যবসা

সুতরাং উপযোগিতা ৩ হল- সহজসাধ্য দামে ও অনেক কম পরিশ্রমে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা আমাদের বি কোয়াড্রান্টে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করে। যখন আমি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা আমাদের বি কোয়াড্রান্টে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করে। যখন আমি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা ভালোমত পর্যবেক্ষণ শুরু করি, আমি দেখি যে আমার ধনবান বাবার পদ্ধতি এরাও অবলম্বন করে অর্থাৎ আগে থেকে ব্যবসা গড়ে তোলে তারপর যারা বি কোয়াড্রান্টে প্রবেশে ইচ্ছুক তাদের স্বাগত জানায়। আমি যে কটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা পরীক্ষা করে দেখি তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ইতিমধ্যে বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করেছে। আপনাকে মাত্র কয়েক ডলার, হয়ত $৫০০-এরও কম বিনিয়োগ করতে হবে এবং তৎক্ষণাৎ আপনার ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে।

একবার ব্যবসা প্রবেশের পর, আপনাকে শুধু পরিকল্পনা অনুসরণ করতে হবে এবং নিজের সুবিধামত গতিতে বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তুলতে হবে। এর চেয়ে বেশি আর কি চাই? যখন অতীতের কথা অর্থাৎ বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করার কষ্টকর ও খরচসাপেক্ষ শিক্ষা পদ্ধতির দিনগুলোর কথা মনে করি, তখন ভেবে অবাক হয়ে যাই। এখন যারা বি কোয়াড্রান্টে প্রবেশ করতে চায় তাদের জন্য নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপারটা কত সহজ ও সুবিধাজনক করে দিয়েছে।

বি কোয়াড্রান্টে চিরকালই ধনীদের স্বতন্ত্র একাধিপত্য ছিল। বস্তুত, ই এবং এস কোয়াড্রান্টে মানুষ বি কেয়াড্রান্টের লোকদের জন্য কাজ করে… অথচ তাদের কখনও বি কোয়াড্রান্টের বিষয়ে জানা হয় না। আমাদের স্কুলগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ই এবং এস কোয়াড্রান্টের জন্য সুদক্ষ করে তোলে অথচ বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তুলতে কি দরকার তা কখনই শেখায় না। এখন নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা সেই প্রবেশ দ্বার খুলে দিয়েছে। এর জন্য আপনাকে বিত্তবান হতে হবে না, অথবা দামী কলেজে শিক্ষালাভ করতে হবে না, যে শিক্ষা শুধুই ই এবং এস কোয়াড্রান্টের উপযুক্ত করে তোলার প্রশিক্ষণ দেয়। সম্পূর্ণ কর্মক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা এবং ইন্ডাস্ট্রি খুবই উপকার করেছে। সে এই ব্যবস্থা অনুসরণ করতে চায় এবং অত্যন্ত ধনীদের জগত বি কোয়াড্রান্টে প্রবেশ করতে চায়, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা তাদের সকলের জন্য প্রচুর অর্থপার্জনের সুযোগ নিয়ে এসেছে।

অর্থ দিয়ে সাফল্যের মূল্যায়ন করা যায় না

এই অধ্যায়ের শুরুতে যে সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করেছি সেখানে আরেকজন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যদি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার সাহায্যে বি কোয়াড্রান্টে প্রবেশ এত সহজসাধ্য ও সস্তা হয়, তাহলে বেশির ভাগ লোক শীর্ষে পৌঁছাতে পারে না কেন।’

ধন্যবাদ জানিয়ে উত্তরটা বলি, ‘অল্পসংখ্যক কয়েকজন মাত্র নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার শীর্ষ স্থানে পৌঁছায় একথা সত্যি নয়। প্রথাগত কর্পোরেট ব্যবস্থায় মাত্র একজন কোম্পানির শীর্ষস্থানটিতে পৌঁছাতে পারে, তবে এই ব্যবস্থায় সকলেই শীর্ষস্থানটিতে পৌঁছাতে পারে।’ এরপর আমি তাকে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলি যে, যদিও শীর্ষস্থানটি উন্মুক্ত, তা সত্ত্বেও লোকেরা শীর্ষে পৌঁছাতে পারে না-কারণ তারা শীঘ্রই হতোদ্যম হয়ে পড়ে।

তিনি শুনে মাথা নাড়েন, কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার প্রশ্ন করেন, ‘যদি শীর্ষস্থান সকলের জন্য উন্মুক্ত হয় তাহলে লোকেরা সহজে হাল ছেড়ে দেয় কেন? শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে সরে যাওয়ার কারণ কি?’

‘খুব ভল প্রশ্ন’, আমি উত্তর দেই। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ধীরে ধীরে উত্তরটা দেয়া শুরু করি, ‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার শীর্ষ স্থানে পৌঁছাতে না পারার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। আমি শুধু নিজস্ব মতামত ও নিজে যা বুঝেছি তা বলতে পারি।’

ঐ তরুণী প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি বুঝেছেন?’

নিজের চিন্ত-ভাবনাগুলো গুটিয়ে বলতে শুরু করি, ‘বেশির ভাগ লোক অর্থোপার্জনের জন্য এতে যোগ দেয়। প্রথম কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে যথেষ্ট অর্থলাভ না হলে এরা নিরুৎসাহ হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দেয় ও নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির দুর্নাম রটাতে শুরু করে। অনেকে আবার প্রথম ব্যবসা ছেড়ে আরও লাভজনক পরিকল্পনার কোম্পানি খোঁজে। চটজলদি কিছু অর্থোপার্জন করা এই ব্যবসায় অংশগ্রহণের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না।’

‘যদি অর্থের জন্য যোগদান করা না হয় তাহলে কিসের জন্য এই ব্যবসা অংশ নিতে বলবেন?’ আমার ক্লাসে অপর একটি ছাত্র প্রশ্ন করল।

‘দু’টি কারণে’, জবাব দিই, ‘প্রথম কারণ, নিজেকে সাহায্য করা, দ্বিতীয় কারণ অন্যদের সাহায্য করা। যদি শুধুমাত্র একটা কারণে এই ব্যবসায় যোগ দেন তাহলে এই ব্যবসা আপনার জন্য কার্যকর হবে না।’

‘একটা কারণ যথেষ্ট নয়?’, আরেকটি ছাত্র প্রশ্ন করে, ‘মানে, কি বলতে চাইছেন?’ ছোট্ট ক্লাসটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির কাজের ব্যাপারে আরও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল।

‘নিশ্চয়ই, আমি বলি, ‘প্রথম কারণ নিজেকে সাহায্য করা অর্থাৎ প্রধানত কোয়াড্রান্ট বদলানোর জন্য আপনি এই ব্যবসা অংশগ্রহণ করেন। আপনি ই বা এস কোয়াড্রান্ট থেকে বি কোয়াড্রান্টে যেতে চান।’

‘এটা করা এমন কঠিন কেন?’ এক তরুণ প্রশ্ন করেন, ‘আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে। আমার জন্য এই কাজটা তেমন কঠিন হবে কেন?”

‘আরেকটা ভাল প্রশ্ন’, উত্তর দিলাম। এই বইয়ের উপযোগিতা ১-এ যে বিষয়ে আলোচনা করেছি অর্থাৎ… জীবন পরিবর্তনকারী ব্যবসা শিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে বোঝাতে শুরু করলাম। একথাও বললাম,

একথাও বললাম, কোয়াড্রান্ট বদলানোর জন্য সামগ্রিক পরিবর্তন অর্থাৎ মানসিক, অনুভূতিগত, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক পরিবর্তন প্রয়োজন… এবং এই পরিবর্তন আনতে কলেজের ডিগ্রির চেয়েও বেশি সময় লাগে। আরও ব্যাখ্যা করে বললাম, আমার ধনবান বাবা ত্রিশ বছর যাবৎ আমায় বি এবং আই কোয়াড্রান্টের লোকদের মত চিন্তা-ভাবনা করতে শিখিয়েছেন, ঐ কোয়াড্রান্টে আরও স্মার্ট, কর্মদক্ষ হয়ে ওঠার জন্য এখনও আমি শিখছি। শেষে বলি, “তাই নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানির শিক্ষা পরিকল্পনা এদের পণ্য ও লাভের পরিকল্পনা থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ঐ ছাত্রটি আবার প্রশ্ন করে, ‘এই পরিবর্তন এত দুঃসাধ্য কেন?’

‘অর্থ’, আমি দ্রুত উত্তর দিই, ‘অর্থই ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য করে তোলে।’

‘কি বললেন?’ জোর গলায় প্রশ্ন তোলে আরেকজন ছাত্র, ‘ব্যবসা শুরু করতে যদি বেশি অর্থের প্রয়োজন না হয়, তাহলে অর্থ ব্যাপারটা কীভাবে কষ্টসাধ্য করে তোলে?’

‘কারণ, সত্যিকার ই এবং এস কোয়াড্রান্টের মানুষ শুধুই অর্থের জন্য কাজ করে। খাঁটি ই এবং এসের কেন্দ্রে রয়েছে অর্থ।’

‘বি আর আই-এর কেন্দ্রে কি আছে?’ এবার একটু রেগে প্রশ্ন করে ছাত্রটি, ‘আপনি বলতে চান এরা অর্থের জন্য কাজ করে না?’

‘এরা অর্থের জন্য কাজ করে তবে পদ্ধতিটা ভিন্ন’, শান্তভাবে উত্তর দিলাম, কারণ এই মুহূর্তে আমি কিছু গভীর মূল্যবোধের বিরুদ্ধে মতামত জানাচ্ছিলাম। যে কোনো মানুষের মূল মূল্যবোধে কোনোরকম আঘাত পড়লে স্বাভাবতই সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।

‘তাহলে বি অথবা আই কিসের জন্য পরিশ্রম করে?’ অপর এক ছাত্র, এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘বি সম্পত্তি গড়ে তোলে বা সৃজন করে এক্ষেত্রে সে ব্যবসা গড়ে তুলছে। তাই ঐ ব্যবসা অথবা সম্পত্তি বা সম্পূর্ণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করে।’

‘দু’টির মধ্যে পার্থক্য কি?’ এক তরুণী প্রশ্ন করলেন।

আমি ধীর স্থিরভাবে উত্তর দিলাম, ‘কখনও কখনও বছরের পর বছর যাবৎ কিছুই অর্থোপার্জন করা যায় না, কখনও আবার একেবারেই অর্থোপার্জন করা সম্ভব হয় না। অর্থলাভ না হলে প্রকৃত ই কোয়াড্রান্ট ও এস কোয়াড্রোন্টের মানুষ কখনই বছরের পর বছর কাজ করবে না। এবং কোনোরকম পারিশ্রমিক ছাড়া বছরের পর বছর তারা কঠোর পরিশ্রম করতে চাইবে না। এটা তাদের প্রধান মূল্যবোধের অনুরূপ নয়। বিপদের ঝুঁকি ও বিলম্বিত সন্তুষ্টি এদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে।’

‘বিলম্বিত সন্তুষ্টি?’ তরুণীটি আবার প্রশ্ন করে, “ঝুকিটা ভয়টা তো বুঝলাম, কিন্তু বিলম্বিত সন্তুষ্টির সঙ্গে অনুভূতির কি সম্পর্ক?”

‘আরেকটা ভাল প্রশ্ন’, আমি হেসে বললাম, ‘ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স অর্থাৎ অনুভূতিগত বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করলেন।’

‘ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স?’ যে ছাত্রটি নিজের কলেজের ডিগ্রির কথা বলেছিল, সে প্রশ্ন করল, ‘এটা কি প্রাতিষ্ঠানিক, বিদ্যাগত বুদ্ধিমত্তা থেকে ভিন্ন।’

‘অবশ্যই ভিন্ন’, আমি উত্তর দেই, ‘সাধারণত, প্রতিষ্ঠানিক ও বিদ্যাগত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অথচ স্বল্প ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স বিশিষ্ট ব্যক্তির তুলনায় পর্যাপ্ত ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স সম্পন্ন ব্যক্তি বেশি সফল হয় তাই প্রায়ই দেখা যায়, যারা স্কুলে খুব সফল ছাত্র তারা বাস্তব জগতে তেমন সফল হয় না, এর আংশিক কারণ ইমোশনাল ইনটেলিজেন্সের অভাব।’

কলেজের ডিগ্রিধারী ছাত্রটি হাত তুলল, ‘তাই অধিকাংশ ছাত্র স্কুল পাস করার পর তৎক্ষণাৎ ই কোয়াড্রান্টে মোট বেতনের চাকরি খুঁজতে শুরু করে। অথচ বি কোয়াড্রান্টের ব্যক্তি বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য অনেক বেশি সময় দেয় অথচ বছরের পর বছর হয়ত প্রতিদান পায় না একেই কি সন্তুষ্টি বলে?

সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললাম, ‘ঠিক তাই। যখন আমি ভিয়েতনাম থেকে ফিরলাম, আমার যে সব বন্ধু ও সাহপাঠিরা সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়নি তারা নিজেদের জীবিকার অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল। এরা মোটা মাইনের চাকরি করছিল। এদের পথ অনুসরণ না করে আমি আমার ধনবান বাবার সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করলাম, শিখলাম ব্যবসা গড়ে তোলার উপায়। এই সময় বেশ কয়েকবার আর্থিক দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত কঠোর সংগ্রাম করেছি, বহুবার অসফল হয়েছি। এই সময় এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় যে, তিন সপ্তাহ আমি ও আমার স্ত্রী গৃহহীন নিরাশ্রয় ছিলাম তা সত্ত্বেও আমরা ই বা এস কোয়াড্রান্টে ফেরত যাইনি। ১৯৮৬ থেকে সুদিন ফিরে আসে এবং ১৯৯৪ এ আমরা আর্থিক দায়ভার থেকে মুক্ত হয়ে যাই। ১৯৯৪ আমরা ব্যবসা থেকে অবসর নেই। তখন আমার বয়স ছিল ৪৭, আমার স্ত্রীর বয়স ৩৭। আমরা তখন মিলিয়নেয়ার হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, আমাদের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং আমরা আর্থিক স্বাতন্ত্র্যের লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছি। আমার সহপাঠিরা তখনও কাজ করছে, অনেক বছরে ১,০০,০০০ ডলার থেকে ২,৫০,০০ ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখছে। একেই বলে বি কোয়াড্রান্টের কঠোর পরিশ্রম ও বিলম্বিত সন্তুষ্টির দক্ষতা। পরের চাকরি করে কাজে নিরাপত্তার মোহ ত্যাগ করে নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তোলা। এখন আমরা বছরের কয়েক মিলিয়ন রোজগার করি অথচ পেশাগত পরিভাষায় আমরা আজও বেকার। আমরা শুধুই ব্যবসা গড়ে তোলা ও বিনিয়োগের কাজ করি।

যে ছাত্রটি নিজের কলেজের ডিগ্রির উল্লেখ করেছিল, সে হাত তুলল, ‘আপনি বলছেন যে, ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স ও ব্যবসার দক্ষতা অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা।’

সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং শিক্ষার বৈশিষ্ট হল এরা আপনার ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স বিকাশের সঙ্গে ব্যবসায় আপনার কর্মদক্ষতা বাড়ায়।’

‘অথচ স্বল্পকালীন লাভের জন্য পরিশ্রম না করে বরঞ্চ দীর্ঘকালীন লাভের জন্য পরিশ্রম করায়, আরেকজন ছাত্র বলে উঠল, ‘বিলম্বিত সন্তুষ্টির অর্থ কি তাই বলতে চাইছেন?’

‘যথার্থ বলেছেন, আমি উত্তর দিলাম, “ইমোশনাল ইনটিলিজেন্সের একটি সাম্প্রতিক অধ্যয়নে জানা গিয়েছে যে, যারা সন্তুষ্টি স্থগিত রাখতে পারে তারা প্রায়ই, যারা সন্তুষ্টি স্থগিত রাখতে পারে না তাদের তুলনায়, বেশি স্বচ্ছন্দ সফল জীবনযাপন করে।

‘তবে কি বিলম্বিত সন্তুষ্টির বিপরীত অর্থ আসক্তি?’ তরুণীটি প্রশ্ন করলেন।

‘সেটা একটা উদাহরণ মাত্র, বলি আমি, ‘আসক্ত ব্যক্তি বহির্জগতে উদ্দীপকের বিরুদ্ধে অনুভূতিগত প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন নয়। যাদের মদে আসক্তি তারা মাদকদ্রব্য দেখলে ‘না’ বলতে পারে না। অনুভূতি ও শারীরিক দিক দিয়ে তারা ঐ দ্রব্যটির প্রতি আকৃষ্ট, যদিও মনে মনে হয়ত নিজেকে বলছে, ‘ওটা খাবে না।’ সিগারেটের ব্যাপারেও এরকম দেখা যায়। যারা সিগারেটের প্রতি আসক্তি তাকে যদি বলেন, ‘সিগারেট খাবে না’ বা ‘সিগারেটে তোমার ও তোমার আশেপাশের মানুষের চরম ক্ষতি হতে পারে’, সে হয়ত মনে মনে তা স্বীকার করে তবে আবেগ ও শরীরের তাগিদে সেই আসক্তি থেকে নিবৃত হতে পারে না। এরা সন্তুষ্টির চাহিদা বিলম্বিত করতে অক্ষম বা আসক্তির ব্যাপারে এদের মনোবলের অভাব আছে। যারা সন্তুষ্টির ইচ্ছাকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করতে পারে। না বা যারা আসক্ত তারা খাবার, যৌনক্ষুধা, মাদকদ্রব্য, টিভি ইত্যাদির ব্যাপারে নিরুপায়। আসক্তি বা সন্তুষ্টি স্বেচ্ছায় বিলম্বিত করতে না পারা ইমোশনাল ইনটেলিজেন্সের অভাবের প্রতীক।’

‘অর্থের আসক্তি হতে পারে কি?’ আরেকজন ছাত্র প্রশ্ন করলেন।

‘হ্যাঁ… অনেকের ক্ষেত্রেই তা হয়। তা না হলে মানুষের অর্থের প্রতি গভীর আকর্ষণের মানসিকতা দেয়া যায় কেন? লোকেরা সারাজীবন অপছন্দের চাকরি করে, যতখানি প্রয়োজন বা যতটা চাই তার কম আয় করে। জীবনটা অপচয় করে। অনেকে আবার অন্যের অর্থ কেড়ে নেয়, যা মস্তিস্ক বিকার ছাড়া আর কি! কেউ কেউ অর্থলোভে বিয়ে করে, আবার কেউ সারাজীবন অর্থ সঞ্চয় করে, অথচ অপচয়ের ভয়ে সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। আমার মতে এসবই মনোবিকারের লক্ষণ।

‘সুতরাং আপনার মতে এই অর্থের জন্যই মানুষের ই ও এস কোয়াড্রান্ট থেকে বি কোয়াড্রান্টে যাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। এই অর্থই তাদের নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর ব্যবসার শীর্ষে পৌঁছাতে দেয় না। বছরখানেক বা দু’এক বচরে অর্থ লাভ না হলে এরা হতাশ হয়ে সরে পড়ে, মানসিক, অনুভূতিগত, শারারিক বা আধ্যাত্মিকভাবে কোয়াড্রান্ট পরিবর্তনের চেষ্টা করে না,’ তরুণটি সংক্ষেপে বললেন। ‘এরা কোয়াড্রান্ট বদলের চেয়ে অর্থোপার্জনে বেশি আগ্রহী।’

‘সত্যি কথা’, উৎসাহিত হয়ে বললাম, ‘এমন সুন্দরভাবে হয়ত আমি নিজে বোঝাতে পারতাম না। সবাই হয়ত এ বিষয়ে একমত নয়, আশাও করছি না যে সবই একমত হবে, এটা একান্তই আমার নিজস্ব মন্তব্য।

‘তাই আপনি মনে করেন নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানির শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের কর্মসূচির অনুভূতিগত শিক্ষা বা ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স আপনার সবচেয়ে বেশি পছন্দ।

“ঠিক বলেছেন” উত্তর দিলাম, “আমার স্কুল শিক্ষক বাবা সারা জীবন চাকরিতে নিরাপত্তা খুঁজেছেন এবং বিলের খরচ মেটানোর জন্য বেতনের অপেক্ষায় থেকেছেন। এগুলোতে কোনোরকম ব্যাঘাত ঘটলে তিনি স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। উনি রেগে বলতেন, ‘টাকাপয়সা খুব জরুরি। বিল ভরতে টাকা। পরিশ্রম করব অথচ অর্থলাভ হবে না, এটা কেমন কথা।

‘ওর দাতব্য ক্রিয়াকলাপে আস্থা ছিল?’ আরেকজন ছাত্র প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, তা ছিল, তাছাড়া উনি সময় দানে বিশ্বাস করতেন, আমার দুই বাবাই খুব উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তবে একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন, দাতব্য কাজকর্ম ও সময়দান থেকে ব্যবসা গড়ে তোলা ও বিলম্বিত আর্থিক পারিতোষিক সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘

আরেকটি ছাত্রের প্রশ্ন আসে, ‘আপনি বলছেন আপনার বাবার পে-চেক বা বেতনের প্রতি আসক্তি ছিল?’

‘হ্যাঁ,’ বলি আমি, ‘অর্থাভাবের ভয়েই আমার নির্ধন বাবা চাকরির নিরপত্তা ও ই কোয়াড্রান্টে পে-চেকের নিশ্চয়তার প্রয়োজন অনুভব করতেন, আমার ধনবান বাবার মত বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা গড়ে তোলার সময় কাটানোর তার আস্থা ছিল না।’

কলেজেরস্নাতক হাত তুলল, সে প্রশ্ন করেছি, ‘ব্যক্তি বিশেষের অনুভূতি কোয়াড্রান্টে প্রভেদ আনে, তার প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষানবিশ না, এ কথাটাই বলতে চাইছেন তো?’

‘হ্যাঁ, সাম্প্রতিক ইতিহাসে যদি বি এবং আই কোয়াড্রান্টে কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যক্তি যেমন ফোর্ড মোটর কোম্পানির স্থপতি হেনরি ফোর্ড; জেনারেল ইলেকট্রিকের প্রতিষ্ঠাতা টমাস এডিসন; সি. এস. এস-এর সৃষ্টিকারক টেড টার্নার; মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও ডেল কমপিউটারের সৃষ্টিকর্তা মাইকেল ডেল-এর জীবনী দেখেন, এরা সকলেই প্রচুর অর্থবান এবং এদের মধ্যে কেউই স্কুলের পড়াশোনার গণ্ডি পার হতে পারেননি; এদের কারুর কাছেই কলেজের ডিগ্রি ছিল না।’

‘আপনি কি বলতে চাইছেন স্কুলে পড়াশোনা করার প্রয়োজন নেই?’ কালেজের পাস করা ছেলেটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ল।

‘না তা নয়। আজকার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খুবই জরুরি। আমি শুধু বলতে চাই, যারা বিল গেটস বা মাইকেল ডেল অথবা বড়িশপের প্রখ্যাত অ্যানিটা রডিকের মত ব্যবসা সম্রাট হয়ে উঠতে চান, তাদের জন্য বহু নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানির বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রণালী রয়েছে যা প্রথাগত বিক্ষাব্যবস্থায় পাওয়া যায় না। এরা বি এবং আই কোয়াড্রান্টের প্রয়োজনীর মানসিক, অনুভূতিগত শারীরিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেয়।’

বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা গড়ে তুলতে কত অর্থব্যয় করতে হয়?

চার্চের ক্লাসটি তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমার কাছে আরও আধ ঘন্টা ছিল, শ্রোতাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে বললাম।

“তা, বি কোয়াড্রান্টে ব্যবসা গড়ে তুলতে কত খরচ পড়ে?’ আরেকজন প্রশ্ন করলেন, ‘ধরুন, আমি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর পথ অনুসরণ না করে নিজে বি কোয়াড্রান্ট কোম্পানি খুলতে চাই, তাহলে কত খরচ পড়বে?’

কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, ‘কমপক্ষে পাঁচ মিলিয়ন ডলার লাগবে। তবে এত ভাগ্য, পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, দক্ষতা ও সঠিক সময়জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত নয়।’

“আমার হাতে পাঁচ বছর সময় তো আছে, পাঁচ মিলিয়ন ডলার নেই। কোত্থেকে তা পাব?’ অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি প্রশ্ন করল।

‘নানাভাবে পেতে পারেন,’ আমি বললাম, ‘তবে তা ঐ বি ও আই কোয়াড্রান্টে শিক্ষার অংশ। আবার একটা কথা মনে করিয়ে দেই।’

‘কি?’ প্রশ্নকর্তা বললেন।

‘অর্থের বিষয়টা বেশির ভাগ লোকের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। আমি শুনতে পাচ্ছি আপনার মন ও অনুভূতি আঁতকে উঠছে ‘পাঁচ মিলিয়ন ডলার। খানিকক্ষণ থেমে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সকলের চোখে ঐ একই প্রশ্ন। ‘তাই নয় কি?’ প্রশ্ন করলাম, ‘অর্থই এখানে বাঁধা সৃষ্টি করছে। ‘

কয়েকজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। কেউ কেউ আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। শেষে যারা সম্মতি জানিয়েছিলেন তাদরে মধ্যেই এক ভদ্রলোক সাহস করে বলে উঠলেন, ‘আপনি বলছেন অর্থের প্রয়োজন আমাদের ই এবং এস কোয়াড্রান্টে আটকে রেখেছে? অর্থের প্রয়োজন আপনাকে কোনোমতেই বাঁধা দিতে পারে না?’

আমি সম্মতি জানালাম। কিছুক্ষণ থেমে শান্তভাবে বললাম, ‘তাই নেটওয়ার্ক মার্কেটিং শিক্ষা-ব্যবস্থা থেকে লাভবান হতে বলছি। আমার ধনবান বাবা যে পাঠগুলো শিখিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, জীবনে যা পেতে চাও তার পথে অর্থাভাব যেন কোনোরকম বাঁধা সৃষ্টি না করে। যদি এই উপায়টা শিখে নিতে পারেন তাহলে আসক্তির প্রবল আকর্ষণ থেকে মুক্তি পাবেন, যে আকর্ষণ শক্তি বেশির ভাগ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে।

‘অর্থাৎ অর্থাভাব সত্ত্বেও ব্যবসা করার জন্য পাঁচ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা যায়?’

‘আমি নিজে বেশ ক’বার তা করেছি। বস্তুত এখন আমি তাই করি। তফাৎ শুধু এই যে, এর জন্য আমার ধনবান বাবার কাছে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম। যদি আপনার জীবনের দশ থেকে কুড়ি বছর বিনিয়োগ করে, কয়েক মিলিয়ন ডলারের ঝুঁকি নিয়ে তা করতে চান, করে দেখুন। প্রথম থেকেই শুরু করুন। তবে যদি দৈনন্দিন চাকরি বজায় রেখে, অবসর সময়ে অনেক কম সময় ও অর্থ যারা আপনাকে বি ও আই কোয়াড্রান্টের মানুষের মত চিন্তা-ভাবনা করতে শেখাবে।’

আপনি আমার পথপ্রদর্শক হবেন?

আমার নোট ইত্যাদি নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একজন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার কোম্পানিতে আমায় একটা চাকরি দেবেন, তাহলে আপনাকে আমার পথপ্রদর্শক হিসাবে পাবো?”

নোটগুলো নামিয়ে রাখলাম। নিজের অনুভূতি যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে চুপ করে ছিলাম। একবার সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে, তারপর উত্তরটা দিলাম। ক্লাসের সকলেই অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ হয়ে গিয়েছে, সকলেই বুঝছে প্রশ্নটা আমার মনঃপুত হয়নি। “অনেকেই আমাকে চিঠি লিখে জানান, ‘আপনাকে জানাতে পারি, আপনি ও আমি ব্যবসার অংশীদার হয়ে যাব।’ অথবা তারা চিঠি লিখে এই ভদ্রলোকের মতই ইচ্ছা প্রকাশ করেন, ‘আমাকে একটা চাকরি দিন, আপনার সঙ্গে সময় কাটাবার সুযোগ পাব, আপনি আমার দীক্ষাগুরু হবেন। সে অংশীদার ১০০ ডলার চাইছে তাকে ঐ অর্থ প্রদান করতে আপত্তি কোথায়, যে চাকরি চায় তার পথপ্রদর্শক হতে কোথায় অসুবিধা?” দলটিকে প্রশ্ন করলাম।

দলটি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল, আমার প্রশ্নটা চিন্তা করে দেখছিল। শেষে এক সাহসী ভদ্রলোক হাত তুললেন, বললেন, ‘কারুর বুদ্ধি বা পরিকল্পনার জন্য অর্থব্যয় করতে আপত্তি কোথায়?”

‘ভাল প্রশ্ন,’ বললাম, ‘প্রথমত, অরেককম পরিকল্পনা বা বুদ্ধি থাকতে পারে। আমার পরিচিত সকলের কাছেই লক্ষ লক্ষ টাকার পরিকল্পনা আছে। সমস্যাটা হল ঐ পরিকল্পনা কাজে পরিণত করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জনের পথ কিন্তু কেউ জানে না। তা সত্ত্বেও, ঐ ব্যক্তিকে তাঁর নতুন পরিকল্পনার জন্য ১০০০ ডলার দেব না, কেন?’

গ্র্যাজুয়েট ছেলেটি এবার হাত তুলল, ‘কারণ, আপনি তার অংশীদার হতে চান না।

‘ঠিক তাই’, আমি বললাম, ‘যাদের অর্থের প্রয়োজন আছে তাদের অংশীদার হতে চাই না। যারা আগেই অর্থ দাবি করে তারা সাধারণত ই ও এস কোয়াড্রান্টের মানুষ। যারা ই বা এস তাদের আর্থিক সাহায্য করতে আমি রাজি তবে যারা বি ও আই-এ আমার অংশীদার হতে চায়, তাদের আমি আর্থিক সাহায্য দেব না।’

‘এটা তো অন্যায় কথা,’ জোর গলায় বলে উঠলেন আরেকজন, ‘ কেই কিছু যোগদান করলে তার পারিশ্রমিক দিতে হয় বৈকি?”

‘মানছি,’ আমি উত্তর দিলাম, ‘তবে প্রশ্ন হল- অর্থটা কখন পাবে। দেখুন, ই ও এস-কে প্রথমেই পারিশ্রমিক পাবে যখন তারা তার ব্যবসা গড়ে উঠবে ও সে সফল হবে।’

চিন্তা করার জন্য কিছুটা সময় দিয়ে, ধীরে ধীরে আমার চূড়ান্ত মতামত জানালাম, ‘দেখুন, অনেকেই চিঠি লিখে জানায় যে আমার বই রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড তাদের খুব ভাল লেগেছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত বইটির সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি অনেকেরই বোধগম্য হয় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমার ধনবান বাবার এক নম্বর পাঠে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম পাঠ তার মনে আছে?”

আবার সব চুপচাপ। শেষে এক অংশগ্রহণকারী বই বের করে প্রথম পাঠ দেখলেন। ৬টি অধ্যায়ের প্রথম অধ্যায় ‘ধনীরা অর্থের জন্য কাজ করে না।

সম্মতি জানালাম, ‘আপনাদের কি মনে পড়ে আমি দশ সেন্টের পারিশ্রমিকে কাজ করেছি? কখনও বেতন বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি? আপনাদের কি মনে পড়ে আমার ধনবান বাবা ঘন্টায় দশ সেন্টের পারিশ্রমিক নিয়ে বলেছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করত?’

অনেকেই মাথা নাড়লেন।

‘তবে, অর্থের জন্য কাজ না করলে, কিসের জন্য কাজ করব?’ একবার যথেষ্ট সম্পত্তি পেয়ে গেলে সেই সম্পত্তি আমার জন্য পরিশ্রম করবে, অর্থোপার্জন করবে শুধুই অর্থের জন্য আমি পরিশ্রম করব না। আমার সম্পত্তি চাই। তাই আমি শুধু সম্পত্তি গড়ে তোলা ও কেনার জন্য কাজ করি … যে সম্পত্তি অল্প পরিশ্রমে আমাকে আরও ধনী, আরও বিত্তবান করে তোলেন। ধনীরা তো তাই করেন, অথচ গরিব ও মধ্যবিত্তরা শুধু অর্থের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে, তারপর সেই অর্থ সম্মত্তি বিনিয়োগ না করে শুধু দায়বৃদ্ধি করে।

‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা কি ধরনের সম্পত্তি?’ এক তরুণী প্রশ্ন করলেন। ‘অশেষ ধন্যবাদ’, জোরে বলে উঠলাম, ‘মনে করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। যা বলতে শুরু করেছিলাম তা তো ভুলেই বসেছিলাম। আপনাদের কি মনে আছে, আমি বলেছিলাম সফল নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার জন্য দু’টি জিনিস প্রয়োজন।’

ক্লাসের সকলেই জানালেন যে, তাদের মনে আছে।

‘প্রথম প্রয়োজন বলেছিলাম- নিজেকে সাহায্য করার জন্য, তাই তো?’ আমি প্রশ্ন করলাম। কোয়াড্রান্টের বি দিকটায় ‘পৌঁছানোর জন্য নিজেকে সাহায্য করা, তাই না?’ একজন প্রশ্ন করলেন।

‘ঠিক তাই,” আমি উত্তর দিই, ‘আর, দ্বিতীয় প্রয়োজন কি?

‘অন্যদের সাহায্য করা,’ একসঙ্গে বলে উঠলেন অনেকে।

অন্যদের কিসে সাহায্য করা?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। শেষে একজন সাহস করে বলে উঠল, ‘অর্থোপার্জনের জন্য অন্যদের সাহায্য করা?’

হেসে সম্মতি জানালাম, আবার অর্থের বিষয়ে আলোচনায় ফিরে আসছি। অধিকাংশ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার বৈশিষ্ট্য হল-যতক্ষণ আপনি অন্যদের ই এবং এস কোয়াড্রান্ট থেকে বি ও আই কোয়াড্রান্টে আসায় ও সফল হওয়ার সাহায্য করবেন না ততক্ষণ আপনার নিজের যথেষ্ট অর্থলাভ হবে না। যদি অপরকে সাহায্য করার ব্যাপারে লক্ষ্য রাখেন তাহলে আপনি ব্যবসা সফল হবেন। কিন্তু যদি শুধুই নিজেকে বি ও আই কোয়াড্রান্টের উপযুক্ত করে তুলতে চান, তাহলে খাঁটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবস্থা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না। এর চেয়ে পুরোনো বিজনেস স্কুল-এ যান, তাঁরা আপনাকে বি কোয়াড্রান্টভুক্ত করে তুলতে সাহায্য করবেন।’

‘অর্থাৎ, আমি যদি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসায় যোগ দিই আমার কর্তব্য হবে বি ও আই কোয়াড্রান্টে পৌঁছানো ও অপরকে সেই কোয়াড্রান্টে পৌঁছাতে সাহায্য করা, তাই তো?’

‘যতক্ষণ না দু’টি দায়িত্বের প্রতি সমান মনোযোগ দেবেন ততক্ষণ এই ব্যবস্থা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার বৈশিষ্ট্য হল-আপনি সম্পত্তি লাভ করতে চাইবেন অর্থাৎ অন্যান্য বি-এরা আপনার অধীনে কাজ করবে, আবার আরও কিছু বি, ঐ বি-এদের নিচে কাজ করবে। পুরোনো ব্যবস্থায় বি-এর অধীনে শুধুই ই এবং এস-রা কাজ করে ‘ আমি বললাম।

কলেজের গ্র্যাজুয়েটটি আরও বলল, ‘অর্থাৎ পুরোনো কর্পোরেট ব্যবসা পিরামিডের মত। কারণ শীর্ষে খুব অল্পসংখ্যক বি ও আই আছে, অথচ নিচে বেশ কিছু ও এস আছে। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা সম্পূর্ণ উল্টো, আরও বেশিসংখ্যক বি-দের শীর্ষে নিয়ে আসা এদের মৌলিক উদ্দেশ্য।’

‘অতি উত্তম’, উত্তর দিই আমি, ‘আমাকে যে ব্যবসার ব্যাপারে শেখানো হয়েছে সেখানে আমি শীর্ষে থাকব, ই ও এস নিচে থাকবে, আমার ব্যবসায় খুব বেশি বি-দের জায়গা নেই। তাই আমি চাই আমার ব্যবসার কর্মচারীরা আমার কাজে পূর্ণকালীন চাকরি বজায় রেখে নিজস্ব খন্ডকালীন ব্যবসার জন্য নেটওয়ার্ক মার্কেটিং-এর সাহায্য নিয়ে অগ্রসর হোক।

‘আপনি নিজস্ব নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানি শুরু করছেন না কেন?’ এক তরুণ প্রশ্নটা করলেন।

‘সে কথা বিবেচনা করে দেখেছি, তবে আমি বুঝেছি যে নতুন সংগঠন গড়ে তোলার চেয়ে বর্তমানে উপস্থিত সংগঠনগুলোকে সাহায্য করা বেশি সহজ। আমি বার বার বলছি যদি নিজের ধ্যান-ধারণা ও পরিকল্পনার সাহায্যে নিজস্ব বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তুলতে চান তাহলে আমার বই রিচ ড্যাডস গাইড টু ইভেস্টিং পড়ে দেখুন, বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা গড়ে তুলতে কি প্রয়োজন তা জেনে নিন। তারপর নির্ণয় করুন, আপনি আপনার কয়েক মিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা সত্যিই কয়েক শব্দ মিলিয়ে পরিবর্তন করতে আগ্রহী কি না। সেই বিকল্প তো রয়েছেই।’

আরেকজন অংশগ্রহণকারী হাত তুললেন, ‘একটি পিরামিডের মূলদেশ মাটিতে এবং অপরটির মূলদেশ আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী… অনেকটা উল্টো পিরামিডের হতো; যা আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, নিচের দিকে টেনে আনবে না’

‘আমার ক্ষেত্রে তেমন ব্যবস্থাই কার্যকর হয়েছে,’ আমি বলি, ‘যা শুধু বিত্তবানদের আয়ত্তে ছিল, আজ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার সাহায্যে তা সকলের প্রাপ্তিসাধ্য, সবার জন্য উন্মুক্ত। এখন শুধু একটাই প্রশ্ন, “আপনি কি সত্যিকার ধনী হতে চান?’

মূল্যবোধ কীভাবে আপনার যথার্থ সত্য নির্ধারণ করবে

‘মূল্যবোধ এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?’ আমি যাদের ব্যবসা শুরু করা ও গড়ে তোলার ব্যাপারে বোঝাচ্ছিলাম, তাদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করলেন।

প্রশ্নটি জরুরি, খানিকক্ষণ চিন্তা করে উত্তর দিলাম, “কারণ এই মূল্যবোধগুলো আমাদের জীবনের সত্য নির্ধারণ করে।’

একটি হাত উঠল, পরের প্রশ্নটি ছিল, ‘কীভাবে?’

উত্তরে বললাম, ‘যাদের জন্য চাকরিতে নিরাপত্তা জরুরি, সম্ভবত তাদের জীবনের সত্য ই কোয়াড্রান্টের সত্যে অনুরূপ। এরা ই কোয়াড্রান্ট থেকে জগতকে দেখছে ও ভাবছে, এরা নিজেরা শুধুই কর্মচারী অথচ অনেকে ব্যবসার মালিক হয়ে ওঠে, এই পার্থক্যটা কেন? অনেকেই বোঝে না, তাদের মূল মূল্যবোধ তাদের জীবনের সত্য নির্ণয় করে। এরা যাদের জন্য কাজ করছে, সেই বি কোয়াড্রান্টের মানুষের মূল্য মূল্যবোধগুলো এরা দেখতে অক্ষম, কারণ মূল্যবোধ চোখে দেখা যায় না, তবে বিভিন্ন কোয়াড্রান্টের মানুষের মূল্যবোধ ভিন্ন।’

যে ব্যক্তি প্রশ্নটি করেছিলেন, চুপ করে বসে পড়লেন, শেষে বললেন, ‘ও’।

আমার আলোচনায় ফিরে এলাম, ‘যারা পরিশ্রমী, যারা নিজের হাতে কাজ করতে চায়, বা যারা বিশেষ এত চায়, তারা সাধারণত এস কোয়াড্রান্টের অনুগামী। এরা নিজেকে বলে, ‘কাজ ঠিকমত করতে হলে নিজের হাতে করা উচিত’, বা বলে ‘আকজাল ভাল, পরিশ্রমী কাজের লোক পাই না।

প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এদের মেধা অনেকেই মনে মনে নিজের মূল্যবোধ বিশ্লেষণ করছে।

‘অর্থাৎ মূল্যবোধে পরিবর্তন না আনলে কোয়াড্রান্ট বদলাতে অসুবিধা হবে?’ যিনি প্রথমে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

সামান্য হেসে উত্তর দিলাম, ‘আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তাই। অন্তত তাই তো মনে হয়। যদি চাকরির নিরাপত্তা আপনার মূল মূল্যবোধ হয় তাহলে আপনার পক্ষে স্বাধীনতাপ্রিয় বি কোয়াড্রান্টের মানুষ হয়ে ওঠা কঠিন। আগেও বলেছি, বি কোয়াড্রান্টের মানুষ অল্প পরিশ্রম করে, কারণ অন্যান্যরা তার জন্য পরিশ্রম করে। এস কোয়াড্রান্টের মানুষের পক্ষে বি কোয়াড্রান্টভুক্ত হওয়া কষ্ট সাপেক্ষ, কারণ তার দৃঢ়বিশ্বাস তিনি নিজে যত ভালোভাবে একটি দায়িত্ব পূরণ করতে পারেন তেমন ভালভাবে অন্য কেউ করতে পারবে না তার মূল মূল্যবোধ তার জীবনের সত্য নির্ধারণ করছে। যদি আপনার মনে হয় চাকরিতে নিরাপত্তা খুবই জরুরি, অথবা মনে করেন যে আপনার চেয়ে ভালমত আর কেউ কাজ করতে পারবে না, তাহলে এই মূল্যবোধগুলো আপনার জীবনের বন্ধমূল ধারণা, আপনার সত্য হয়ে উঠবে।’

এক অল্পবয়সী উকিল হাত তুললেন, বললেন, ‘আমার মনে হয় নিজের কাজটা আমি ছাড়া আর কেউই ঠিকমত করতে পারবে না, একমাত্র আমি তা পারব। একেই কি আমার মূল্যবোধ বলবেন, এটাই কি আমার জীবনের সত্য নির্ধারণ করছে?’

‘ভাল উদাহরণ দিয়েছেন’, উত্তর দিই আমি, ‘যথার্থ বি কোয়াড্রান্টের মানুষ সবসময় এমন লোক খুঁজে বের করে যে তার চেয়ে বেশি স্মার্ট, বেশি কর্মপটু। এমন স্মার্ট লোক কাজে নিযুক্ত করে সে নিজের অবসর সময়ে অন্যান্য কাজে মনোনিবেশ করতে পারে। এদিকে আপনি কঠোর পরিশ্রম করছেন, খুব ভাল কাজ করছেন এবং যেহেতু আপনি নিজের কাজে সুদক্ষ, আপনার মক্কেলরা তাদের বন্ধুদেরও আপনার কাছে পাঠাচ্ছে। সমস্যাটা হল, প্রতিটি নতুন মক্কেলের শুরুতে আপনাকেই চাই। তাই আপনি আরও পরিশ্রম করছেন, আর বেশি আয় করছেন, তা সত্ত্বেও আপনার আয় সীমাহীন না; আপনার বিশ্বাস, আপনার মত ভাল কাজ আর কেউ জানে না।’

তরুণ উকিল চুপ করে সব শুনলেন। তারপর বললেন, ‘মানে এস কোয়াড্রান্টের উকিল হওয়ার ফলে আমার আয়ের ক্ষমতা সীমিত কারণ আমর সময় সীমিত। যদি বি কোয়াড্রান্টের উকিল হতে চাই, আমার মূল মূল্যবোধ বদলাতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, অন্যরা আমার চেয়ে বেশি ভালমত কাজ করতে পারে।’

‘ঠিকই বুঝেছেন’, হেসে বলি আমি, ‘এখন একটাই সমস্যা-তা হল আপনার মূল মূল্যবোধগুলো চিনতে শেখা।’

‘কিন্তু তারা যদি আমার চেয়ে বেশি স্মার্ট হয়, আমার কাছে তাদের আসার দরকার কি?’ উকিল ভদ্রলোক বললেন।

‘মনে হচ্ছে এখন আপনার মূল্যবোধ নিজের যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে’, হেসে বলি, ‘এই দ্বন্দ্বও সন্দেহগুলো আপনার মূল্যবোধের যুক্তি ও আপনার জীবনের প্রত্যক্ষ সত্য। যেহেতু আপনার মনে ভয় রয়েছে যে আপনার তুলনায় স্মার্ট সুদক্ষ পেশাদারদের আপনার প্রয়োজন নেই, আপনি তাই আরও স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করবেন, আরও ফাঁদে আটকে পড়বেন। যেহেতু আপনি সবসময় সবার চেয়ে স্মার্ট হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন, তাই অন্যদের যথেষ্ট স্মার্ট ও আপনার কাজের দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত মনে করেন না। আপনার মত স্মার্ট মানুষ প্রায়ই আরও স্মার্ট হয়ে ওঠার তাগিদে নিজেদের জগতে আটকে পড়েন। আপনার হয়ত মনে আছে, এস কোয়াড্রান্টের ব্যাখ্যায় আমি বলেছিলাম এস-এর আরেকটি অর্থ স্মার্ট। তাই এস কোয়াড্রান্টে রয়েছে আপনার মত স্মার্ট মানুষ, আর বি কোয়াড্রান্টে পাবেন আমার মত কতগুলো বোকা মানুষ। একবার আমার স্কুলের শিক্ষক আময় মুর্খ বলেছিলেন, আমি ভাবলাম এই মূর্খামিকেই তাহলে জীবনের হাতিয়ার বানিয়ে এগাই। আপনি স্মার্ট হওয়াটাকে জীবনে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন তাই আপনার ও আমার মূল নীতিগুলো বদলাতে হবে।’

‘ঠিক বলেছেন’, আমি উত্তর দিলাম, কারুর সঙ্গে আমার মতভেদ দেখা দিলে তা প্রায়ই ঐ নীতি বা মূল্যবোধে মটনক্যের জন্যই হয়। তাই, প্রায়ই শুনতে পাই লোকে বলছে, ‘ব্যবসা করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয়।’ অথবা ‘আজকাল দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না।’ বা, অনেকে আমার সঙ্গে তর্ক করে, ‘আপনার ইনভেস্টমেন্টে একমাসে ১০০% কিছুতেই ফেরত পাবেন না’, এরকম আবেগতাড়িত কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারি বক্তার মূল মূল্যবোধগুলোতে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। তাই কোয়াড্রান্ট পরিবর্তন করার সময় মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।’

‘অর্থাৎ কেউ যদি বলেন, ‘ব্যবসা শুরু করা ঝুঁকির ব্যাপার’ ঐ ভদ্রলোক তার ব্যক্তিগত ধারণা, ব্যক্তিগত মূল্যবোধের কথা বলছেন, এ ক্ষেত্রে মূল্যবোধটি হল নিরাপত্তার অনুভূতি।’

সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলি, ‘আমার অভিজ্ঞতা তাই।’ এক মুহূর্তে চিন্তা করে আবার বলে উঠলাম, ‘আমি প্রায়ই লোকমুখে একটি কথা শুনেছি-’ব্যবসা শুরু করা ঝুঁকির ব্যাপার।’ এসব লোকদের যখন জীবিকার ব্যাপারে প্রশ্ন করেছি প্রায় সকলেই বলেছেন যে তারা হয় কর্মচারী তা নাহলে স্ব-নিযুক্ত। ব্যবসা আরম্ভ করা বা ইনভেস্টার হলে টাকাকড়ি বিনিয়োগ করা তাদের মূল নীতিবোধে বাঁধা সৃষ্টি করে।

ঘরের পেছন দিক থেকে হাত উঠল, ‘ব্যবসা ঝুঁকি তো রয়েছেই, তাই না? এও তো সত্যি যে প্রথম পাঁচ বছরে বেশিরভাগ ব্যবসা অসফল হয়,’ এই প্রশ্ন ভীতির প্রকাশ ছিল। ‘মনে হচ্ছে আপনার মূল মূল্যবোধ এ প্রশ্ন করছে?’ আমি বললাম।

‘কিন্তু কথাটা তো ভুল নয়,’ ভদ্রলোক জোর গলায় বললেন, তিনি দাবি করলেন, সব ব্যবসার অন্তত ৯৫% প্রথম পাঁচ বছরেই ব্যর্থ হয়।’

‘হ্যাঁ, কথাটা সত্যি, ‘উত্তরে বললাম, “আমি শুধু বলছি এ প্রশ্ন আপনার মূল মূল্যবোধের প্রশ্ন।’

‘যা সত্যি তা তো মেনে নিতেই হবে’, ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, ‘ব্যবসা আরম্ভ করার ব্যাপারে জানার জন্য আমি টাকা দিয়ে এই ক্লাসে শিখতে এসেছি, এখনও আপনি আমাকে জানাননি সত্যিকার তথ্যগুলো কীভাবে অতিক্রম করতে হবে। গত ২০ মিনিট যাবৎ আপনি শুধুই মূল নীতিবোধ ও জীবনের সত্য সম্বন্ধে বাজে বকবক করে চলেছেন।’

‘আমাকে তাহলে তথ্যগুলো আরেকবার বলুন,; শান্তভাবে প্রশ্ন করি। মনে হল ভদ্রলোককে আর উত্যক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়।

‘তথ্য এই যে, যারা ই থেকে বি কোয়াড্রান্টে গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন, তাদের মধ্যে ৯৫% প্রথম পাঁচ বছরেই অসফল হয়। আমি এখানে শুনতে এসেছি এই অসফলতা কীভাবে অতিক্রম করা যায়। আমি মূল্যবোধ সম্বন্ধে বক্তৃতা শুনতে চাই না। ‘

গভীর শ্বাস নিয়ে বললাম, ‘আপনার কথাগুলো সঠিক, স্বীকার করছি, তবে আপনি একটা বিষয় উপেক্ষা করছেন, নতুন কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৫% কিন্তু সফল হচ্ছে। যাদের নিরাপত্তার মূল্যবোধ সুগভীর তারা শুধু ৯৫% অসফল ব্যবসায়ীদের দেখছেন, ৫% সফল মানুষগুলোকে দেখছেন না।’

‘তা আমি যাতে ঐ ৯৫% অসফল মানুষগুলোর একজন না হই সেজন্য কি করতে হবে?’ একটু শান্ত হয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আপনার মূল মূল্যবোধ বদলে দিন,’ উত্তর দিলাম, ‘আপনার চাকরির নিরাপত্তার মূল্যবোধ আপনাকে ৯৫% অসফল মানুষগুলোকে দেখাচ্ছে এবং এটাই আপনার জীবনের সত্য, যা শুধু ঝুঁকি ও অসফলতাকে দেখাচ্ছে।’

‘আপনি দেখতে পাচ্ছেন সফল মানুষগুলোকে?’ ভদ্রলোক রেগে তর্ক শুরু করে দিলেন।

‘নিশ্চয়ই’, আমি বললাম, ‘আমি মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস- কে দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি ‘বডিশপ’-এর স্রষ্টা অ্যানিটা রডিক-কে। যারা জীবনে সফল হয়েছে তাদের সকলকেই দেখতে পাচ্ছি। আর যা দেখছি সেই তুলনায় ৯৫% ঝুঁকি নগণ্য।’

‘আপনার জন্য বলা সহজ, কারণ আপনি যে সফল’, ভদ্রলোক তর্ক করতে লাগলেন, ‘আপনি যে ৫% সফল মানুষের একজন।’

‘হ্যাঁ, আমি সফল’, আমি বললাম, ‘তবে আজ আমি সফল কারণ একদিন আমি ৯৫% ব্যর্থদের দলে স্বেচ্ছায় যোগ দিতে চেয়েছিলাম। যদি রিচ ড্যাডস ক্যাশফ্লো কোয়াড্রান্ট পড়েন, তাহলে দেখবেন প্রথম অধ্যায় আমি জানিয়েছি, প্রায় তিন সপ্তাহ যাবৎ আমি ও আমার স্ত্রী গৃহহীন, নিরাশ্রয় ছিলাম। কারণ, আমার ব্যর্থতা। সাফল্য পাওয়ার আগে দু-বার আমি ঐ ৯৫% এর একজন ছিলাম। আজও আমি ঐ অসফল ৯৫% এর একজন। কারণ সম্প্রতি আমার বেশ কয়েকটি বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা মার খেয়েছে। আমার ও আমার ইনভেস্টারদের কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যবসা হারিয়েছে … তা সত্ত্বেও আমার লক্ষ্য ঐ শতকরা পাঁচজন সফল মানুষ। এটাই আমার জীবনের সত্য। যেহেতু আমার দৃষ্টি ঐ পাঁচ শতাংশ নিবন্ধ তাই আমি সহজেই বাকি ৯৫% শতাংশের মহাসাগর পেরিয়ে যেতে পারছি। যারা বি কোয়াড্রান্টে পৌঁছায়, তারা ৯৫% শতাংশ এবং ৫% শতাংশ দুটো দলকেই দেখতে পায়। তবে যাদের জন্য চাকরির নিরাপত্তাই যথাসর্বস্ব, তারা শুধুই অসফল ৯৫% শতাংশদের দেখতে পায়।’

‘আপনার কি হেরে যেতে ভাল লাগে? অসফল হলে দুঃখ হয় না?’ ভদ্রলোক একটু শান্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

‘অনেকের থেকে অনেক বেশি দুঃখ হয়, ‘আমি বলি, ‘এতে দুঃখ হয় যে সেই অনুভূতি আমায় এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। প্রথম দুটো ব্যবসা ফেল হওয়ার পর অনেকদিন যাবৎ খুবই বিমর্ষ ছিলাম। হঠাৎ মনে হল এই দুঃখের জন্য আমার এগিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধা পড়ছে। হেরে যাওয়ার দুঃখ থেকে শিখলাম, জীবনে সংশোধনের চেষ্টা করলাম। পড়াশোনা করে আমার ব্যর্থতার কারণগুলো খুঁজতে শুরু করলাম। হেরে যাওয়ার দুঃখকে আমার জিতের কারণ করে তুললাম। তখন আমার ধনবান বাবা বলেছিলেন, ‘অসফল মানুষ হেরে যাওয়াটাকেই সাফল্যের কারণ করে তোলে।’ উনি একথাও বলেছিলেন, ‘যারা হারতে চায় না তারাই বারবার হেরে যায়।’ তিনি আরও বলতেন, ‘অসফল মানুষকে দেখলেই চেনা যায়। তুমি যে কাজটা করছ সে কাজে যে কখনও সফল হওয়া সম্ভব নয়, তোমার কাজটা যে কতখানি বিপজ্জনক তা বোঝানোর জন্য এরা উঠে পড়ে চেষ্টা করে।’

‘তা ঝুঁকির মোকাবিলা করার জন্য আপনি কি করেন?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।

‘ঝুঁকি তো শিক্ষার অংশবিশেষ,’ আমি বলি, ‘বেঁচে থাকাটাই তো একটা ঝুঁকি। প্রতিদিন আমরা গাড়িতে চড়ে কাজের জন্য রওয়ানা হই, সেটাই তো একটা ঝুঁকি বিরাট ঝুঁকি। যখন ছোট ছিলাম, আমার প্রতিবেশীর বাবা একদিন সকালবেলায় কাজের জন্য রওয়ানা হয়ে আর ফিরে এলেন না। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে চারটে গাড়ির দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। তা সত্ত্বেও আমরা সকলেই গাড়ি চালাই। যারা ঝুঁকি নিতে ভয় পায় তারা জীবনকে ভয় পায়, শিখতে ভয় পায়।’

‘আপনার প্রতিবেশীর মৃত্যুর ভয়াবহ ঘটনাটা আবার শোনাচ্ছেন কেন।’ ঐ ভদ্রলোক তখনও আমার সঙ্গে ঝুঁকির ব্যাপারে তর্ক করে চলেছে।

‘কারণ গাড়ি কি সাইকেল চালানোর তুলনায় বি কোয়াড্রান্টে যাওয়া ও ধনী হয়ে ওঠার ঝুঁকির সম্ভাবনা যৎসামান্য,’ আমি উত্তর দেই, ‘তা সত্ত্বেও, আপনার মূল মূল্যবোধ যেমন তাতে এই ধনবান হয়ে ওঠা হয়ত আপনার জন্য গাড়ি চালানোর চেয়ে বেশি বিপজ্জনক মনে হবে। এক কোয়াড্রান্ট থেকে অন্য কোয়াড্রান্টে যাওয়াটা মনের ব্যাপার, মনের যাত্রা। গাড়ি করে বাড়ি থেকে কাজে যাওয়াটা বাইরের ব্যাপার, আপনি খুব ভাল গাড়ি চালাতে জানলেও এখানে ঝুঁকির সম্ভাবনা খুবই বেশি।’

আপনার মূল মূল্যবোধের ভিত্তিটা কি?

ক্লাস প্রায় শেষের পর্যায়। ১০ মিনিট বাকি। যে ভদ্ৰলো ৯৫% অসফলতা নিয়ে তর্ক করছিলেন তিনি তখনও অসন্তুষ্ট। ক্লাসে আরও কয়েকজন ছিলেন যারা তখনও সন্দিহান। বুঝতে পারছিলাম, জীবনের সত্য নির্ধারণে মূল নীতিবোধের ভূমিকা সম্বন্ধে আজকের পাঠ্যবিষয়ক অনেকেই স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না।

একটি ছাত্রী অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ করে বসেছিলেন, হঠাৎ হাত তুললেন, ‘যদি মূল্যবোধ জীবনের সত্য নির্ধারণ করে, মূল্যবোধ কীভাবে নির্ধারণ করা হয়?’

‘ভাল প্রশ্ন,’ হেসে বলতে শুরু করলাম, ‘এরকম একটা প্রশ্ন আশা করছিলাম।’ ফ্লিপ চার্টে লার্নিং পিরামিডের নকশাটা আঁকলাম।

ফ্লিপ চার্টে লার্নিং পিরামিডের নকশা

দলটাকে বোঝতে শুরু করলাম, ‘আগেই বলেছি, জীবন পরিবর্তনকারী শিক্ষা মানুষের শিক্ষা পিরামিডের সবকটি অর্থাৎ চারটে বিন্দুকে প্রভাবিত করে। যেমন নিজের হাতে গাড়ি না চালালে কিছুতেই গাড়ি চালানো শেখা যায় না।’

‘গাড়ি চালানো আর কোয়াড্রান্ট বদলানো কি এক ব্যাপার?’ একজন অংশগ্রহণকারী প্রশ্ন করলেন। ‘হ্যাঁ … প্রায় একই প্রকারের,’ উত্তর দিই আমি, ‘মূল মূল্যবোধের পার্থক্য কোথায় বলি। ধরুণ আপনি গাড়ি চালাতে ভয় পান। ঐ ভয় থেকে কি জাতিয় মূল্যবোধ গড়ে উঠবে? মনে মনে আপনি চিন্তা করেন, শারীরিকভাবেই বা কি করবেন?’

ক্লাসের সকলে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, শেষে একজন বললেন, ‘যদি গাড়ি চালাতে খুব ভয় পাই, তাহলে বাড়িতে বসে সময় কাটাতে চেষ্টা করব। যেহেতু আমার মনে হবে গাড়ি চালানো বিপজ্জনক, তাই টেলিভিশনে ট্র্যাফিক অ্যাক্সিডেন্টগুলো দেখব। বিকালের খবরে ঐ সব দুর্ঘটনা দেখে আরো বেশি ঘরকুনো হওয়ার যুক্তি খুঁজে পাব, আরও বেশি দুর্ঘটনা দেখব।’

‘ধন্যবাদ,’ আমি বললাম, ‘খুব ভাল বর্ণনা দিলেন।’ ক্লাসের উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনাদের মধ্যে কে কে এ রকম জীবনযাপন করতে চান?’ কেউ হাত তোলেনি।

‘পরের প্রশ্নটা হল,’ আমি হেসে বলি, ‘ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আপনাদের মধ্যে ক’জন গাড়ি চালাতে ভালবাসেন?”

ক্লাসে এবার অজস্র হাত উঠল।

‘আপনাদের মধ্যে ক’জন সুন্দর সমুদ্রসৈকতে অথবা পাহাড়ের গায়ে লম্বা, আঁকাবাঁকা নির্জন পথে গাড়ি চালিয়েছেন ও অদ্ভুত, প্রায় আধ্যাত্মিক আনন্দ অনুভব করেছেন?’ আবার অনেকগুলো হাত উঠল। একটি অল্পবয়সী মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “গত গরমে আমার ছোট্ট লাল স্টোর্টস গাড়িটার হুড নামিয়ে সমুদ্র ধার দিয়ে এল. এ. থেকে সানফ্রান্সিসকো পর্যন্ত চালিয়ে গিয়েছিলাম, আমার জীবনে সে এক সেরা অভিজ্ঞতা।

আরেকজন হাত তুললেন, ‘সম্প্রতি পরিবারের সকলকে নিয়ে কি মাউন্টেনের পেছনদিকের পথটা ধরে ড্রাইভ করে গেলাম। মনে হচ্ছিল স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছি।’

আরো অনেকে অনেক কথা বলতে চাইছিলেন’ যারা নিজেদের অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে আবার আমার নকশার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। সময় শেষ, এবার সভা ভাঙ্গার পালা। লার্নিং পিরামিড দেখিয়ে বললাম, ‘যাদের জন্য চাকরির নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সেই ধারণায় শক্তিসঞ্চার করে লার্নিং পিরামিডের আবেগগত বিন্দুটি।’

ফ্লিপ চার্টে লার্নিং পিরামিডের নকশা

আবার একটা হাত উঠল, প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি বলছেন মূল্যবোধের মূলে রয়েছে মানুষের আবেগ অনুভূতি?’

‘সবসময় না’, আমি বলি, ‘যার জন্য চাকরির নিরাপত্তা জরুরি তার ক্ষেত্রে ভয়ের অনুভূতি তার মূল্যবোধ নির্ধারণ করছে এবং এই মূল্যবোধ তার সত্য নির্ধারণ করছে। খুব সরলভাবে বলতে গেলে চাকরির নিরাপত্তা ছাড়াতে যে ভয় পায় তার অবস্থা ঐ দুর্ঘটনার ব্যাপারে আতঙ্কিত লোকটির মত যে সারাদিন ঘরে বসে দুর্ঘটনার খবর দেখে।’

‘এস কোয়াড্রান্টের মূল মূল্যবোধেও কি ভয়ের অনুভূতি বিদ্যমান?’ আরেকজন জিজ্ঞাসা করলেন।

‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাই হয়,’ আমি বললাম, ‘তবে এটা আবার অন্যরকম ভয়। এটা হল আস্থার অভাব। এস-রা শুধুই নিজেদের বিশ্বাস করে …

বা যারা নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণিত করতে পেরেছে শুধু তাদের ওপর আস্থা রয়েছে। অবিশ্বাসের ফলে এরা অর্থাৎ এই পরিশ্রমী মানুষগুলো অন্যদের বিশ্বাস করতে পারে না, নিজেদের হাতে সব কাজ করে। অপরের প্রতি আস্থার অভাব এদের জীবনের সত্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, ই কোয়াড্রান্টের মানুষের আয়ের পথে যেমন চাকরির নিরাপত্তা বাঁধা সৃষ্টি করে তেমনি এই কোয়াড্রান্টের মানুষের উপারর্জনের পথে বাঁধা এদের বিশ্বাসের অভাব। মনে রাখবেন, খুব সরলভাবে ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি। এটা বিজ্ঞান নয়। আমাদের সবার মানসিক গঠন ভিন্ন, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। আমরা সকলেই জীবনে ভয় ও আস্থার অভাব দুটোই পেয়েছি, অনুভব করেছি। আলাদা আলাদা মানুষের মনে এই অনুভূতির ফলে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব পড়ে।’

একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি বলছেন আমার মূল মূল্যবোধের ভিত্তিতে রয়েছে আমর ভয়ের আবেগ ও বিশ্বাসের অভাব? আমার অনুভূতিগুলো আমাকে এস কোয়াড্রান্টের বেঁধে রেখেছে?’

‘এ প্রশ্নের উত্তর আপনাকেই খুঁজতে হবে,’ আমি বলি, ‘আমি তো বলেইছি এটা বিজ্ঞান নয়, আমরা প্রত্যেকেই আলাদা। ক্লাস শেষ হওয়ার পর শান্ত মনে নিজেকে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করুন। নিজের উত্তর আপনি নিজেই খুঁজে পাবেন।

ছাত্রটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। আমার উত্তরে সে সন্তুষ্ট হয়নি, আবার প্রশ্ন করল, ‘বি এবং আই কোয়াড্রান্টে আপনার মূল মূল্যবোধের পেছনে কি ধরনের অনুভূতি কাজ করে?’

‘আগে এই প্রশ্নই প্রত্যাশা করেছিলাম,’ আমি বললাম, ‘এই উত্তরটা জানানোর পর আমার ক্লাস শেষ, তারপর আপনাদের প্রত্যেককে নিজের উত্তর, নিজের মূল্যবোধ খুঁজে বের করতে হবে।’

‘আপনার উত্তরটা কি?’ একজন ছাত্র গত ১৫ মিনিট যাবৎ উঠে চলে যাওয়ার উদ্যোগ করছিল, সে এই প্রশ্নটা করল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, তবু

উত্তর না জেনে সে যেতে পারছে না।

‘আমার উত্তর হল’, বি কোয়াড্রান্টে আমার যে মূল্যবোধগুলো রয়েছে তার ভিত্তি লার্নিং পিরামিডের ইমোশনাল পয়েন্ট নয় অর্থাৎ আমার মূল্যবোধ আবেগতাড়িত নয়। আমার বি কোয়াড্রান্টের মূল্যবোধের ভিত্তি পিরামিডের আধ্যাত্মিক বিন্দু।’

‘আধ্যাত্মিক বিন্দু?’ দরজার পাশে দাঁড়ানো ছাত্রটি প্রশ্ন করল, ‘তা কেমন করে সম্ভব?’

কারণ আবেগের বিন্দু ও আধ্যাত্মিক বিন্দু দুটো বিপরীতমুখী,’ আমি বললাম, ‘যেমন চাকরির নিরাপত্তার বদলে আমি স্বাধীনতা খুঁজি। স্বাধীনতা এক আধ্যত্মিক বোধ, অথচ নিরাপত্তা এক আবেগতাড়িত বোধ। যারা এস কোয়াড্রান্টে কাজ করে তারা অপরকে বিশ্বাস করতে অক্ষম, তাই তারা কোয়াড্রান্টে বন্দী। তাই তাদের ভয়ের অনুভূতি তাদের মূল ধারণা বা মূল্যবোধ নির্ণয় করেছে। অথচ বিশ্বাস এক আধ্যত্মিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস থেকে স্বাধীনতা পাওয়া যায়, ভয় মানুষকে বন্দী করে দেয়।’

কথাটা শুনে ক্লাসের সবাই চুপচাপ বসেছিল। যে ছাত্রটা চলে যাচ্ছিল, সে আবার নিজের সীটে এসে বসল। সবচেয়ে সন্দেহপ্রবণ ছাত্রটি এবার প্রশ্ন করল, ‘ব্যবসা বারবার অসাফল্য সত্ত্বেও আপনার স্বাধীনতার স্বপ্ন, আপনার নিজের ও অপরের ওপর আস্থা আপনাকে এতটা এগিয়ে নিয়ে এসেছে।’

‘সত্যি কথা,’ আমি বললাম, ‘তবে আমার নিজের ওপর ও অপরের প্রতি আস্থা ছাড়াও আরেকটা জিনিষ আমার অফুরন্ত বিশ্বাস রয়েছে-যাকে লোকে আল্লাহ বলে। আপনাদের বলি, আমি কিন্তু তেমন ধার্মিক নই… তবে আল্লাহর ওপর আমার অসীম আস্থা, আল্লাহ নামের এই মুক্তি আমার সব চিন্তা ভাবনা, বৃদ্ধি বিবেচনার উর্দ্ধে আর যেহেতু আমার এই বিশ্বাস আছে তাই যতই কঠিন পরিস্থিতি হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস-আমি সফল হব। আল্লাহকে মেনে চলা ও আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের মধ্যেও বিস্তর তফাৎ আছে। আমার ধনবান বাব বলতেন, ‘অনেকেই আল্লাহর প্রতি আরও আস্থাবান হয়, তাহলে তার ভয় দূর হবে, বিশ্বাস সুদৃঢ় হবে।’ ঐ মহাশক্তি আল্লাহর ওপর আস্থাই আজ আমাকে কোয়াড্রান্ট বদলাতে যাহায্য করেছে।’

‘আপনি দু-দুবার ব্যবসার অসফল হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাস হারাননি?” একসময় সন্দেহপ্রবণ ছাত্রটি প্রশ্ন করল।

সম্মতি জানালাম। মুহূর্তখানেক থেমে উপসংহার টেনে বললাম, “আমার ধনবান বাবা বলতেন, ‘কল্পনাশক্তি ও বিশ্বাস সহযাত্রী। আরও উজ্জ্বল আরও উন্নত ভবিষ্যতের কল্পনা করার জন্য বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। বিশ্বাস দৃঢ় না হলে কল্পনাশক্তি সুদৃঢ় হয় না যদি কল্পনাশক্তি ও বিশ্বাস দুই-ই দুৰ্বল হয়, তোমার ভীবষ্যতেও এই এখনকার মতই থাকবে।”

ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ক্লাস থেকে রওনা হলাম। তখনও অনেকে বসেছিলেন। ফিরে গিয়ে বললাম, “শেষে আরেকটা কথা বলি, আমার দ্বিতীয় ব্যবসা ব্যর্থতার পর যখন দেউলিয়া হয়ে যাই, আমার ধনবান বাবা এই কথাগুলো বলেছিলেন, “সবসময় মনে রাখবে, তোমার মূল্যবোধ তোমার কোন একটি বেছে নিয়ে নিজের মূল্যবোধ নির্ণয় করতে পার।”

লেখকের মন্তব্য : নাইটিঙ্গেল কন্যান্টের সঙ্গে রিচ ড্যাড সিক্রেটস নামক অডিও ক্যাসেট টেপের একটা সেট প্রস্তুত করেছি। এতে ভীতি ও আস্থা, নিরাপত্তা ও স্বতন্ত্রতা, ব্যর্থতা ও সাফল্যের মধ্যে পার্থক্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমার ধনবান বাবার গোপন রহস্যটি ছিল তার আস্থা, তিনি দৃঢ়

আস্থাবান মানুষ ছিলেন এই বিশ্বাস তাকে দারিদ্র অতিক্রম করে হাওয়াই রাজ্যের সর্বাধিক বিত্তবান মানুষের একজন কর তুলতে পেরেছে। আমার ধনবান বাবা জানতেন তিনি কখনই অসফল হবেন না… এটাই ছিল তার গোপন শক্তি। তিনি জানতেন ব্যর্থতাও সাফল্যের অংশ।

যদি আপনি আমার মত শিক্ষণীয় ও প্রেরণাদায়ক এডুকেশনাল টেপ শুনতে ভালবাসেন তাহলে অডিও ক্যাসেটের এই সেটটা আপনার জন্য। এই অডিও টেপের সুবিধা হল নানা কাজ করতে এটা শুনতে পারেন, বার বার শুনতে পারেন।

নাইটিঙ্গেল কন্যান্টের সঙ্গে কাজ করার সুবর্ণসুযোগ

১৯৭৪ এ আমি প্রথম নাইটিঙ্গেল কন্যান্টের অডিও টেপের সেট শুনেছিলাম। আর্ল নাইটিঙ্গলের সুবিখ্যাত ও জনপ্রিয় টেপ ‘লীড দ্যা ফিল্ড’ আমার এক সেরা প্রাপ্তি ছিল। সেসময় আমি জেরক্স কর্পোরেশনে কর্মরত, সেলস-এ অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়াও আমি তখন বি কোয়াড্রান্টে পৌঁছানোর পথ খুঁজছি। আল নাইটিঙ্গেলের টেপ ও তার কোম্পানির অন্যান্য টেপস্টে আমার ভীতি ও দ্বিধার কঠিন দিনগুলোতে আমার মনোবল বাড়িয়েছে।

আপনারা জানেন যে আমাদের সকলকেই ভয়, দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়। এই ভীতি ও দ্বিধা দূর করার সামর্থ্য বা তার অভাব মানুষকে সফল বা ব্যর্থ করে। যখন আমার মনে ভয় ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয় আমার প্রিয় বক্তার ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে বার বার শুনি। টেপে সফল ব্যবসায়ীদের বক্তব্য আমার লার্নিং পিরামিডের আবেগগত বিন্দুর দুর্বলতা দূর করে আধ্যাত্মিক বিন্দু আরো সুদৃঢ় করে তোলে।

আর্ল নাইটিঙ্গেলের অডিও ক্যাসেট প্রথমবার শোনার প্রায় ২৬ বছর পর তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়। কোম্পানিটি অর্থাৎ নাইটিঙ্গেল ক্যান্ট তাদের সঙ্গে আমার সহযোগিতায় অডিও ক্যাসেট- সেট প্রস্তুত করার আমন্ত্রণ যানায়।

অন্যান্য মহান শিক্ষকদের অডিও ক্যাসেটে পরিবৃত এদের শিকাগোর অফিসের বিশাল বোর্ডরুমের টেবিলে বসে দলের সকলকে বলেছিলাম, ‘এখানে এসে আমি সম্মানিত, তবে তার কারণ এই নয় যে আপনাদের জন্য টেপের ধারাবাহিক করার সুযোগ পেয়েছি। আমি সম্মানিত, কারণ আমি যা শিখেছি তা আপনাদেরই পণ্য থেকে শিখেছি। আপনাদের শিক্ষণীয় পণ্যসম্ভার না থাকলে হয়ত আজ আমিও এখানে উপস্থিত হতে পারতাম না।

বিশেষভাবে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার জন্য একটি টেপ

আপনারা হয়ত বুঝেছেন, আমি জীবন ব্যাপিশিক্ষা… বিশেষত বি কোয়াড্রান্টে শিক্ষায় বিশ্বাসী। যেহেতু আমি বেশিরভাগ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসায় শিক্ষা ও ব্যক্তিগত বিকাশের বিষয়গুলোকে সমর্থন করি, নাইটিঙ্গেল কন্যান্ট ও আমি বিশেষ করে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ইন্ডাস্টির জন্য একটি ক্যাসেট প্রস্তুত করেছি। এই টেপটিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। আবার নিজেদের ব্যবসা যাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে চান তাদের জন্য সস্তা দামের মার্কেটিং উপাদান হিসাবেও ব্যবহার করতে পারেন।

যদি আপনিও আজিবন শিক্ষা সমর্থক হন তাহলে আপনাকে পরামর্শ দেব বি ও আই কোয়াড্রান্টে শিক্ষা সুত্র হিসাবে নাইটিঙ্গেল কন্যান্ট শুনে দেখুন। ১৯৭৪ সালে আমি এদের টেপগুলো শুনেছিলাম, আজও এদের শিক্ষা অনুষ্ঠানের মূল্যবোধ আমার মনে গেঁথে রয়েছে। আমার সাফল্যের জন্য অনেকাংশে দায়ি এই সব পণ্য, আমি আপনাদেরও সাফল্য কামনা করি। তাই এদের উৎকৃষ্ট সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য।

নেতৃত্বের উপযোগিতা

প্রতি বছর, আমার বাবা কয়েকশ’ নতুন স্কুলশিক্ষকদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্কুল এলাকায় তাদের স্বাগত জানাতেন। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, দেখতাম স্টেজে দাঁড়িয়ে প্রচুর আত্মবিশ্বাস ও আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলতেন। সবাই সজাগ হয়ে মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনতেন, দেখে মনে মনে গর্ববোধ করতাম।

বেশ কয়েকবার আমার ধনবান বাবাকেও কোম্পানির পার্টিতে কয়েকশ’ কর্মচারির সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। রিচ ড্যাড যখন তার বোর্ড অফ ডেরেক্টরস ও প্রধান ইনভেস্টারদের সম্বোধন করে অভিভাষণ দিতেন, ব্যবসার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা বলতেন, ঐ ঘরের পেছনের সারিতে বসে আমি তার কথা শুনতাম।

খুব অল্পবয়সেই আমি ভাল বক্তা হয়ে ওঠার গুরুত্ব বুঝতে পারি তবে ভাল বক্তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব ও প্রেরণা জোগান, একথাও উপলব্ধি করি। বেশ কিছু নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার শিক্ষানুষ্ঠানসূচি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর বুঝেছি যে এরা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার বিকাশ করে- নেতৃত্বের ক্ষমতা। আমাদের সকলের বেতন এই দক্ষতা নিহিত রয়েছে তবে আমাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন এই দক্ষতা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সময় ও সুযোগ পায়। তাই খুব কম মানুষ জীবনের এই প্রয়োজনীয় দক্ষতার সত্যিকার বিকাশ করতে পারে। আমার নির্ধন বাবা বলতেন, ‘অনেকেই কথা বলেন, তবে খুব কম লোকের কথা শোনা হয়।’ আমার ধনবান বাবা বলতেন, “টাকাকড়ি পথপ্রদর্শকদের হাতে গিয়ে পৌঁছায়। যদি আরও বেশি আয় করতে চাও, নেতা হয়ে ওঠ।’

নেতৃত্বের ক্ষমতা ঐচ্ছিক নয়

আমার ধনবান বাবা আরও বলতেন, ‘প্রত্যেকটি কোয়াড্রান্টে কযেকজন পথপ্রদর্শক থাকে। তবে বি কোয়াড্রান্ট ছাড়া অন্য কোনও কোয়ড্রান্টে সফল হয়ে ওঠার জন্য নেতৃস্থানীয় হয়ে ওঠা জরুরি নয়। বি কোয়াড্রান্টে নেতৃত্বের ক্ষমতা বাধ্যতামূলক।’ আবার বলতেন, ‘সবচেয়ে সেরা পণ্য বা সেরা ব্যবস্থা থাকলে সবচেয়ে বেশি অর্থপার্জন করা যায় একথাও ঠিক নয়। যে ব্যবসায় সবচেয়ে সেরা নেতা ও সবচেয়ে ভাল পরিচারক দল রয়েছে সেই ব্যবসা আয়ের সম্ভাবনা সর্বাধিক।

ক্যাশফ্লো কোয়াড্রান্ট দেখলে বুঝবে প্রতিটি কোয়াড্রন্টেই পথপ্রদর্শক আছে।

কোয়াড্রন্টেই পথপ্রদর্শক

উদাহরণস্বরূপ, আমার নির্ধন বাবা ই কোয়াড্রান্টে এক ক্ষমতাবান পথপ্রদর্শক ছিলেন, এদিকে আমার ধনবান বাবা বি ও আই কোয়াড্রান্টে নেতৃত্ব করেছেন। খুব অল্প বয়স থেকেই দুই বাবা আমার নেতৃত্বের ক্ষমতার বিকাশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই দুজনেই আমাকে বয়েজ স্কাউটসে নাম লেখানো, খেলাধূলা করা, সামরিক সেবায় যোগদানের পরামর্শ দেন। অতীতের দিনগুলো দেখে বুঝি আমার আর্থিক সাফল্যের মূলে যে প্রশিক্ষণ আমার সত্যিকার সহায়ক হয়েছে তা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের বিদ্যা নয়, বরং স্কাউট, খেলা ও মিলিটারি ট্রেনিং-কে সেজন্য কৃতিত্ব দিতে হয়।

১৯৭০-এর প্রথমদিকে যখন মিলিটারি ছেড়ে বি কোয়াড্রান্টের ব্যবসা জগতে প্রবেশের চেষ্টা করছি, আমার ধনবান বাবা বলেছিলেন, ‘প্রতিটি কোয়াড্রান্টে দলনেতা পাব। তবে প্রতিটি কোয়াড্রান্টে সফল হওয়ার জন্য নেতৃত্বের ক্ষমতার প্রয়োজন নেই… তবে বি কোয়াড্রান্টেই এর ব্যতিক্রম। বি কোয়াড্রান্টে এই নেতৃত্বের ক্ষমতা বাধ্যতামূলক।’ মনে পড়ে শেষ মিলিটারি বেসের গেট থেকে যখন বাইরে বেরিয়ে আসছি, আমার মনে হয়েছিল, ‘আমার মধ্যে নেতৃত্বের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে কি?’ মিলিটারি ছেড়ে আসার পর আমাকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তা যারা জানেন তারা বুঝবেন স্কাউট, খেলাধুলা ও মিলিটারিতে নেতৃত্বের যে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম তা বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসার বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করার উপযুক্ত ছিল না। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার এক গুরুত্বপূর্ণ উপযোগিতা হল এদের নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা… বি কোয়াড্রান্টে সফল হওয়ার জন্য একান্ত জরুরি ব্যবসায়িক দক্ষতা … নেতৃত্ব, এবং এই নেতৃত্বে বিকাশে এরা আপনাকে সঠিক প্রশিক্ষণ, যথেষ্ট শিক্ষা, সময় ও সুযোগ দেয়।

যখনি আমি ই বা এস কোয়াড্রান্টের এমন কোনও মানুষের সংস্পর্শে আসি যার বি কোয়াড্রান্টে স্থানান্তরণে অসুবিধা হচ্ছে অথচ তার মধ্যে সেরা প্রযুক্তি গত দক্ষতা ও পরিচালনার ক্ষমতা রয়েছে, তখন প্রধান যে জিনিসটা অভাব দেখতে পাই তা হল নেতৃত্বের ক্ষমতার অভাব। একটি উদাহরণ দিচ্ছি, এক বন্ধুর বন্ধু নিজের রেস্তোরাঁর খেলার জন্য আমার কাছে টাকা চাইতে এসেছিলেন, ইনি এক উত্তম ও সুশিক্ষিত পাচক ও খাদ্যবিশারদ এবং এক্ষেত্রে বহু বছরের অভিজ্ঞতা আছে। উনি রেস্তোরাঁর ব্যবসা এক নতুন কল্পনার উদ্ভব করেছেন, এর কাছে সুস্পষ্টভাবে তৈরি ব্যবসা পরিকল্পনা ছিল, আর্থিক পরিকল্পনা ছিল এমন কি রেস্তোরাঁর পরিসর পর্যন্ত বেছে রেখেছিলেন, এর মক্কেলরাও এর সঙ্গে নতুন রেস্তোরাঁয় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব-যদি বিনিয়োগের জন্য ৫০,০০০০ ডলার পেতেন, তার সপ্ন সত্যি হয়ে উঠত।

পাঁচ বছর আগে উনি আমার পরিকল্পনাটা দেখিয়েছিলেন, আমি তাকে প্রত্যাখ্যান করি, শুধু আমি নয় আরও অনেক ইনভেস্টার তাকে প্রত্যাক্ষাণ করেন। উনি এখনো আগের রেস্তোরাঁয় কর্মচারি হিসাবে কাজ করছেন, এখনো ব্যবসা শুরু করার জন্য ৫,০০,০০০ ডলার খুঁজছেন। যেহেতু সময়মত অর্থসংগ্রহ করতে পারেননি তাই আগেকার জায়গাটা তার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে, তবে আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, যদি ঐ অর্থের বন্দোবস্ত করা যায় তাহলে নিশ্চিত তিনি আরেকটা সেরা জায়গা খুঁজে বের করবেন।

দেখেশুনে সবকিছু ভাল মনে হওয়া সত্বেও তার ব্যবসায় আমি ইনভেস্ট করিনি। অন্যান্য ইনভেস্টাররা কেন তার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেননি তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, তবে আমি কেন করিনি তা আপনাদের জানাই। এমন নয় যে, এই বিনিয়োগে খুব ঝুঁকির সম্ভাবনা ছিল; ঐ ভদ্রলোকের সাফল্য সম্বন্ধে আমার সন্দেহও ছিল না। তাও, এই কারণগুলোর জন্য বিনিয়োগ করিনি :

১. যদিও তার অভিজ্ঞতা, আকর্ষণ শক্তি বা প্রতিভার অভাব ছিল না, তার মধ্যে অভাব ছিল নেতৃত্বের, তাই তার উপর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

২. যদিও ইনি রেস্তোরাঁ খুলে ভালমতো পরিচালনা করতে পারতেন তবুও ইনি রেস্তোরাঁর কোনও চেনা অর্থাৎ শৃংখলা গড়ে তুলতে পারতেন কি না সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। এর আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ছিল, তাই বলতেন, ‘আমি সফল হব তবে খুব একটা বড় হব না।

ক্যাশফ্লো কোয়াড্রান্টে এস এবং বি-এর আয়োতনে পার্থক্য রয়েছে।

কোয়াড্রন্টেই পথপ্রদর্শক

যেমন, যদি কেউ বলে, ‘আমি সিক্সথ স্ট্রিট ও ভাইন স্ট্রিটের মোড়ে একটি হ্যামবার্গারের দোকান খুলব’, বুঝবেন ঐ ব্যক্তি দীর্ঘ সময় যাবৎ এস কোয়াড্রান্টে আবদ্ধ থাকবেন। আবার যদি কাউকে বলতে শুনেন, ‘আমি বিশ্বের সব বড় বড় শহরগুলো বড় রাস্তার মোড়ে হ্যামবার্গার স্ট্যান্ড খুবল আর ঐ ব্যবসার নাম রাখব ম্যাকডোনাল্ডস, বুঝবেন ঐ ভদ্রলোক ঐ একই হ্যামবার্গারের স্ট্যান্ড খুলতে চায় তবে তা বি কোয়াড্রান্ট থেকে করতে চায়। অর্থাৎ ব্যবসা এক হওয়া সত্ত্বেও কয়োড্রান্ট ভিন্ন। আমার ধনবান বাবা এ কথা শুনলে নিশ্চই বলতেন,’ মোড়ের মাথায় যতগুলো দোকান খোলা হবে তা দেখে নেতৃত্বের ক্ষমতায় পার্থক্য বোঝা যাবে।

৩. তাই আমি ইনভেস্ট করিনি, আমার সন্দেহ ছিল ইনভেস্ট করা টাকা অদৌ ফিরে পাব কিনা। ব্যবসা হয়ত অসফল হতো না। তবে আমার সন্দেহের কারণ ছিল, সফল হলেও এই ভদ্রলোক কখনই বড় ব্যবসায়ি হয়ে উঠতে পারতেন না। আমার বিনিয়োগ করা টাকা যদিও ফেরত পেতাম, সেটা পেতে বহু বছর সময় লাগত এবং এধরনের মন্থরগতির বিনিয়োগ আমার নীতিবিরুদ্ধ। কেননা, আমার অর্থ অন্য কোথাও বিনিয়োগ করার বদলে এর ব্যবসা আটকে যেত। এই ধারণাকে বিনিয়োগকিত মূলধনের দ্রুতি অর্থাৎ ভেলসিটি অফ ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপিটালও বলা হয়।

বিনিয়োগ না করার আমার অপর কারণটি হল, যদি এই ভদ্রলোক সারাজীবন ছোট ব্যবসায়ী থাকতে চান, তাহলে আমি ইনভেস্ট করব কেন? যদি এর ব্যবসার আকার বড় হতো, আমার ৫,০০,০০০ ডলার যদি শতগুণ বেশি করে তুলতে পারতেন তাহলে হয়ত আমিও বিনিয়োগে উৎসাহ পেতাম। তবে যেহেতু রেস্তোরাঁ বড় করে তোলার উপযুক্ত নেতৃত্বের দক্ষতা এর আয়ত্তে ছিল না, তাই ইনি কখনই আমার ৫,০০,০০০ ডলার শতগুন বৃদ্ধি করতে পারতেন না। ব্যবসাকে এস কোয়াড্রান্ট থেকে বি কোয়াড্রান্টে নিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে তাকে এই মূল্য দিতে হয়। আমার ধনবান বাবা বলতেন, ‘সেরা পণ্য ও সেবা প্রদান করলেই ব্যবসা অর্থলাভ হয় না। যে ব্যবসা সেরা নেতৃত্ব ও পরিচালক দল রয়েছে, সেই ব্যবসাতেই অর্থ লাভ সম্ভব।

৪. এই ভদ্রলোকের ব্যবসা বিনিয়োগ না করার চতুর্থ কারণটি হল ইনি দলের সবচেয়ে স্মার্ট সদস্য হতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে তিব্র অহংকার বোধ ছিল। আমার ধনবান বাবা বলতেন, ‘যদি তুমি দলের নেতা ও সবচেয়ে স্মার্ট, কর্মপটু মানুষটি। যেমন, আপনি চিকিৎসার জন্য নিশ্চয়ই ডাক্তার বা ডেন্টিস্টের কাছে যাবেন, রিসেপশনিস্টের কাছে নয়।

বি কোয়াড্রান্ট ব্যবসা নেতৃত্বের ক্ষমতা বিষেশ প্রয়োজন, কারণ বি-কে সবসময় নিজের তুলোনায় আরও স্মার্ট, সুদক্ষ, আরও যোগ্য মানুষের সম্মুখিন হতে হয়। যেমন, আমার ধনবান বাবার কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা যোগ্যতা ছিল না, কাজের সুত্রে তাকে ব্যাঙ্কার, উকিল, একাউন্ট্যান্ট, ইনভেসমেন্ট উপদেষ্টা প্রমুখ সকলের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এদের মধ্যে অনেকের কাছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল, অনেকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি অর্থাৎ ডক্টরেটও ছিল। অর্থাৎ কর্মসূত্রে তাকে নিজের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষকতা, পেশাদার বিশেষজ্ঞদের পথ দেখাতে, পরিচালনা করতে হয়। ব্যবসায় অর্থসংগ্রহের জন্য নিজের তুলনায় অনেক বেশি বিত্তবান মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হতো।

অনেক ক্ষেত্রেই, এস কোয়াড্রান্টভূক্ত মানুষকে শুধুই নিজের মক্কেল সহকর্মী যেমন সমপেশাগত ডাক্তার ও উকিল এবং নিম্নপদস্থদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। বি কোয়াড্রান্টে যাওয়ার জন্য অসাধারণ নেতৃত্বের ক্ষমতার প্রয়োজন হয়।

তার জন্য নেতৃত্বের যোগ্যতা বাধ্যতামূলক ছিল না

একদিন ঐ বন্ধুর বন্ধু আমায় ফোন করলেন, জিজ্ঞাসা করলেন আমি কেন তার ব্যবসায় বিনিয়োগ করছি না। আগে আপনাদের যে চারটে কারণ জানিয়েছি সেগুলো বললাম। দুঃখিত ভদ্রলোক নিজের আত্মরক্ষায় বলে উঠলেন, ‘আমি বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ট্রেনিং পেয়েছি। আমি যে রান্নার স্কুলে পড়েছি সব শেফ-রা সেই সুবিখ্যাত স্কুলে পড়ার স্বপ্ন দেখে। শুধু রান্নাঘর নয়, রেস্তোরাঁ পরিচালনার ব্যাপারেও আমার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। আপনি কি করে বলছেন যে, আমার মধ্যে নেতৃত্বের ক্ষমতা নেই?’

ধৈয্যসহাকারে ভদ্রলোককে বোঝালাম -অর্থ, আত্মপ্রত্যয় ও নেতৃত্ব এই তিনটির একান্ত প্রয়োজন। কিছুটা বুঝলেন… অনেকাটাই বোধহয় বুঝলেন না। যখন আমি তাকে ব্যবসা শেখা ও নেতৃত্বের ক্ষমতার বিকাশের জন্য নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিলাম, ভদ্রলোক চটে উঠলেন, ‘আমি করছি রেস্তোরাঁর ব্যবসা। আর আমার কোনও ব্যবসা শেখা বা নেতৃত্বের বিকাশের প্রয়োজন নেই মশাই।’ বুঝলাম এই ভদ্রলোকের জন্য আজীবন ব্যবসা শেখা বা নেতৃত্বের ক্ষমতার ক্রমাগত বিকাশ-কোনটাই বাধ্যতামূলক না।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ

এই বইয়ের প্রারম্ভেই বলেছি, আমি কয়েকটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার এক অমূল্য উপযোগিতা পেয়েছি-এর জীবন পরিবর্তনকারী ব্যবসা শেখানো। এছাড়াও আমি বিশ্বের কয়েকটি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসা নেতৃত্ব বিকাশের কর্মসূচির খোঁজ পাই। আমার মনে হয়, এই কর্মসূচির উপযোগিতা দুষ্প্রাপ্য।

গবেষণা শুরু করা ও এই ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে আমার ভুল-ভ্রান্তি দূর হওয়ার পর অনেক সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সংস্পর্শে এসেছি, যারা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা থেকে ব্যাবসা-শিক্ষা পেয়েছে। সম্প্রতি এক তরুণের সঙ্গে দেখা হয়, ইনি কম্পিউটার ব্যবসা করে কয়েক হাজার মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন। ইনি বলেছিলেন, ‘বহু বছর যাবৎ আমি একটা সাধারণ কম্পিউটার প্রোগ্রামের কাজ করছি। একদিন এক বন্ধু আমাকে একটা মিটিংয়ে টেনে নিয়ে যায়, আমিও তার নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই। এরপর বেশ কয়েক বছর আমি মিটিং ও জনসমাবেশে উপস্থিত থেকেছি, বই পত্র পড়েছি, টেপ শুনেছি। সে সময়কার হাজার হাজার টেপ ও বই এখনও আমার কাছে আছে। শুধু যে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা সফল হয়েছি তাই নয়, যা শিখেছি তার ফলে প্রোগ্রামিং-এর কাজ ছেড়ে আমি নিজের কম্পিউটার ব্যবসার অংশীদারি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দিয়ে লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করি। এসব কিছুই সম্ভব হতো না, যদি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানি থেকে যথার্থ ট্রেনিং না পেতাম। আমি এদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ব্যবসা ও নেতৃত্ব বিকাশের প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম।’

পথ-প্রদর্শকরা আপনার অন্তরাত্মার সঙ্গে কথা বলেন

গবেষণা করার সময় আমি নানা মিটিংয়ে যাই, বহু বড় বড় সমাবেশে উপস্থিত থেকেছি। এসব অনুষ্ঠানে ব্যবসার সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতা শুনেছি… এরা নিজেদের বক্তৃতায় অন্যের জীবনের গুণগুলো অন্বেষণ করার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা দিতেন। এরা যখন নিজেদের সহায় সম্বলহীন অবস্থা থেকে কল্পনাতীত বিত্তবান হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য কাহিনী শোনাতেন, আমি অনুভব করতাম আমার ধনবান বাবার কথা… নেতা হয়ে ওঠার কথা। আগেও আমার ধনবান বাবার মন্তব্য জানিয়েছি, ‘নেতার হাতেই সব অর্থ পৌঁছায়। যদি আরও অর্থলাভ করতে চাও, দলের নেতা হয়ে ওঠ।’ আমি বুঝেছি বিশ্বের সেরা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানির শিক্ষাসূচি মানুষকে আরও ভাল সেলস্ম্যান নয়… আরও সুদক্ষ নেতা করে তোলে।

লার্নিং পিরামিডের এই নকশায় দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন সংযোগস্থাপনের ভঙ্গি লক্ষ্য করবেন :

কথোপকথন

ভয় ও লোভের আবেগতাড়িত কথোপকথন

আজকাল বেশিরভাগ বক্তা, এমনকি তথাকথিত নেতারাও আবেগতারিত কথাবার্তা বলেন। এরা প্রায়ই ভয় বা লোভের বশবর্তী হয়ে কথাবার্তা বলেন।

যারা আবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে কথা বলেন তাদের মুখে এসব কথা শুনবেন :

ভাল নম্বর না পেলে ভাল চাকরি পাবে না।

সময়মত কাজে পৌঁছাতে না পারলে তোমায় বরখাস্ত করা হবে।

আমাকে মনোনীত করলে আমি আপনাদের সোশ্যাল সিকিউরিটির সুবিধাগুলো সুরক্ষিত রাখব।

বুঝেশুনে কাজ কর। অযথা ঝুঁকি নিতে যেও না।

আমার ব্যবসায় যোগ দাও, প্রচুর অর্থলাভ হবে।

তোমাকে দ্রুত ধনী হয়ে উঠার উপায় শেখাতে পারি।

যা বলছি তা কর।

কোম্পানির এখন অবস্থা ভাল নয়। যদি চাকরি বাঁচাতে চাও, তাহলে বেতন বৃদ্ধির কথা বল না।

চাকরি ছাড়ার কথা একবারেই ভেব না। আমাদের মত বেতন আর কে দেবে তোমায়?

অবসরগ্রহণ করতে তোমার আর মোটে আট বছর বাকি। এখন গণ্ডগোল বাড়িয়ে লাভ নেই।

কথোপকথন

আত্মার সঙ্গে আত্মার কথোপকথন

পথ-প্রদর্শকের দায়িত্ব হল কতাবার্তার মাধ্যেমে নিজের আত্মা থেকে অপরের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করা। আজকাল গুণ বিরল। তবে বিরল হলেও অসম্ভব নয়, তেমন বক্তার কথায় মনে প্রভাব পড়ে বৈকি… কারণ তাদের কথা আমাদের আত্মাকে স্পর্শ করে, তাদের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষারে লেখা থাকে।

যেসব কথা আমাদের স্পর্শ করেছে, ইতিহাসে অমর হয়েছে তা হয়ত সবার অল্পবিস্তর মনে আছে।

‘নির্ণয়ের সুসময় এসেছে, আমেরিকাবাসী স্বাধীন হবে না, দাস হয়ে থাকবে।’-জর্জ ওয়াশিংটন

‘আমায় স্বাধীনতা দাও, তা না হলে মৃত্যু দাও।’ -প্যাট্রিক হেনরি

টেক্সাস যুদ্ধের মন্ত্র ‘রিমেমবার দ্যা অ্যালোমো’।

‘ফোর স্কোর এন্ড সেভেন ইয়ার্স অ্যাগো’।-আমেরিকার স্বাধীনতার অ্যাব্রাহাম লিংকনের সুবিখ্যাত বক্তৃতা এবং ‘শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে শত্রুদের নিপাত করছি, তাই না?’

‘অপরকে নিচু করতে হলে তোমাকেও নিচে নামতে হবে।’-বুকার টি. ওয়াশিংটন

‘দেশ তোমার জন্য কি করেছে সে প্রশ্ন করবেনা বরং…।’ জন কেনেডি ‘আমার স্বপ্ন…।’- মানি লুথার কিং

‘বিজয়ী হওয়ার অভ্যাসমাত্র। দুর্ভাগ্যের বিষয়, হেরে যাওয়াও তাই, ভিন্স লম্বার্ডি

‘স্বাধীনতায় আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসই একমাত্র আমাদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে’-ডওয়াইট আইসেনহাওয়ার।

‘কাপুরুষের নৈতিকতাবোধ থাকে না।’-গান্ধী

‘এত নম্র হচ্ছি কেন,তুমি তেমন মহান নও’-গোল্ডমেয়ার

‘শক্তিশালী হওয়া মহীয়সী নারীর মত। যদি সকলকে তা জানাতে হয়, তাহলে আপনি তা না।’-মার্গারেট থ্যাচার

‘যা করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়, তা যেন তোমার সম্ভব কাজগুলোর পথে বাঁধা না হয়।’-জন উডেন

‘সেই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু যে আমার সেরা গুণগুলো বের করে আনতে পারে।’-হেনরি ফোর্ড

‘সফল মানুষ না, নীতিবান মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর।’-অ্যালবার্ট আইনস্টাইন

প্রচুর বিত্তবান করে তোলাই নয়, বেশ কয়েকটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসা মানুষের নীতিবোধ জাগিয়ে তোলায় সচেষ্ট। তাই আমার মনে হয় এই ইনডাস্ট্রির কয়েকটি কোম্পানি সত্যি অসাধারণ।

ধনী হওয়ার বিজ্ঞান

রবার্ট কিয়োসাকির মতে ধনী হওয়ার জন্য শুধু কোম্পানি দিলেই হবে না, বরং মার্কেটিং বিষয়ে দক্ষতার পাশাপাশি বাজারে অন্যসব কোম্পানির পণ্য ও বাজার সম্পর্কে সচেতন হওয়া আবশ্যক। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেহম্যান ব্রাদার্স বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। সেটার বয়স হয়েছিল তখন ১৫৮ বছর। ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় টিকে থাকতে পারলেও আধুনিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রথম ১৩ মাসের ধকল সইতে না পেরে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যায়। সেটা ছিল আমেরিকার বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক খাতের কয়েক মাসের মধ্যকার উল্লেখযোগ্য সিরিজ পতনের একটি। সরকার ফ্যানি মায়ে ও ফ্রেডি ম্যাকের (Fannie Mae ও Freddie Mac) দায়িত্ব নেয়। আর্থিক সহায়তা দিয়ে এআইজিকে উদ্ধার করা হয়। ওয়াশিংটন মিউচুয়ালকে অধিগ্রহণ করে এফডিআইসি। ওয়াচোভিয়া (Wachovia) বিক্রি হয়ে যায়।

জেমস কলিনসের হাউ দ্য মাইটি ফল-এ এ জাতীয় পতন নিয়ে আলোচনা করা হয়। পতনের সময় কোম্পানিগুলোর যে সব স্তর অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা হয়, তা-ও বর্ণনা করা হয়। কলিনস বলেন, সফল কোম্পানিগুলো একেক সময় খুব বেশি উদ্ধত হয়ে ওঠে এবং ভাবে তারা অনেক কিছুই করতে পারে (স্তর ১), এবং আগ্রাসী বিকাশের দিকে ধাবিত হয় (স্তর ২)। ব্যর্থতার প্রথম সতর্ক সংকেত দেখতে পেলে তা না দেখার ভান করে (স্তর ৩), যতক্ষণ পর্যন্ত না পতনের বিষয়টা সাধারণ মানুষের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায় (স্তর ৪)। তারপরও যদি তারা সংস্কার না করে (স্তর ৫), তাহলে তাদের শেষ পরিণতি হয় দেউলিয়াত্ব (স্তর ৬)। এইসব স্তরে দেখা যায় আগ্রাসী আচরণ ও বাস্তবতার নিরিখে আগে থেকে নিজেদের লক্ষ্য ঠিক করার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় থাকার কারণে পতনের ট্রিগারে চাপ পড়ে যায়। কোম্পানি একেক সময় তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠার ব্যগ্রতার কারণে ঝুঁকির কথা না ভেবে একচোখা কাজ করে।

২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে, লেম্যান ব্রাদার্সের পতনের এক বছর পর এক সময়কার বিশ্বসেরা ধনী ওয়ারেন বাফেট ও লুই গাস্টনারসহ ২৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দ্য অ্যাসপেন ইন্সটিটিউটের সাথে এক যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে পুঁজি বাজারে শর্ট-টার্মইজমের সমাপ্তি ঘটিয়ে শেয়ার হোল্ডার ও সমাজের জন্য লং-টাইম নীতি লালন-পালনের মূল্যবোধ সৃষ্টির তাগিদ দেয়া হয়। তাতে স্বীকার করা হয় শর্ট-টার্মইজম ঝুঁকিপূর্ণ, তাতে অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে। বিবৃতিদাতারা একমত হন দীর্ঘ সময় ধরে চালিত পুঁজিবাদই কেবল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। অতএব তারা পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শেয়ার হোল্ডারদের আরও ধৈর্যশীল হতে উৎসাহ দেন।

শেয়ার হোল্ডারদের এই শর্ট-টার্ম ব্যবস্থাপনা সরকারেরও চোখে পড়ে যায়। ব্রিটেনের ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেসের সেক্রেটারি, লর্ড মাইনার্স সম্প্রতি একটি দুই-স্তর বিশিষ্ট এক শেয়ার হোল্ডিং কাঠামোর প্রস্তাব করেছেন, যার পক্ষে নিজেদের কোম্পানির কৌশলগত দিক নির্ধারণের উদ্দেশ্যে লং-টার্ম শেয়ার হোল্ডাররা বেশি ভোট দিয়েছেন শর্ট-টার্ম শেয়ার হোল্ডারদের চেয়ে। এই ব্যবস্থার অধীনে শর্ট-টার্ম শেয়ার হোল্ডারদের ভোটদানের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এখনও যদিও সে প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক চলছে, তারপরও অনেকের বিশ্বাস পরিবার-চালিত ব্যবসার স্রষ্টাদের মাঝে জন্ম নেয়া এই ব্যবস্থা কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করবে শর্ট-টার্ম সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত রাখবে।

আলফ্রেড রাপাপোর্টের মতে শেয়ার হোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে স্বল্প সময়ে অর্জিত লাভ তাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করে। রাপাপোর্ট দেখেছেন বেশিরভাগ কোম্পানি শেয়ার হোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে স্বল্প মেয়াদী নীতি অনুসরণ করে, এমনকি মূল্যবান লং-টার্ম বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও। শেয়ার হোল্ডারদের অবশ্যই মৌলিক অবস্থানে ফিরে যেতে হবে এবং অনুধাবন করতে হবে যে একটি কোম্পানির মূল্যবোধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় তার দীর্ঘ-মেয়াদী ভবিষ্যৎ নগদ টাকার প্রবাহ থেকে উৎসারিত এবং ভবিষ্যৎ রূপকল্পই কোম্পানির উল্লেখযোগ্য কাজকে চিহ্নিত করে।

একটি কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের সংজ্ঞা নির্ভর করে সেই কোম্পানির উন্নতির ধারার ওপর। কোটলার, কার্তাজায়া আর ইয়াং তাদের হিসেবে ‘অ্যাট্রাকটিভ ইনভেস্টর্স’ বা আকর্ষণীয় বিনিয়োগকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে কোম্পানির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শেয়ার হোল্ডারদের প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে। একদম শুরুর দিকে চলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যার সাথে লড়াই, পিছুটান। সেসব প্রতিকূলতা কাটিয়ে কয়েক বছর পেরিয়ে আসা সম্ভব হলে তারা এমনকি দেবতাদেরকেও আকর্ষণ করতে পারে-প্রথমদিকের একক বিনিয়োগকারী যারা নিজেদের পকেটের টাকা খাটিয়েছে ভবিষ্যতের বড় লাভের আশায় অথবা শিল্পোদ্যোগকে সমর্থন করে আত্মতৃপ্তি অর্জন করতে।

পরে এসব কোম্পানি প্রাইভেট শেয়ার, উদ্যোগী পুঁজিপতি, ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ একদল মানুষ আর পুঁজি আকর্ষণের চেষ্টা করে যার সাহায্যে আইপিও বা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংয়ের (IPO) আয়োজন করা যাবে। কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার ইসু করে যেগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে বিক্রি করা হয়। এতে আরও বেশি বেশি পুঁজি বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হয়। শেয়ার হোল্ডারদের কোম্পানিতে একটা ইকুইটি স্টেক (পণ বা বাজি) থাকবে। কোম্পানি বন্ড ইসু করার মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করতে পারে। যার মাধ্যমে শেয়ার হোল্ডাররা নিয়মিতভাবে লাভ পাবে এবং শেয়ার ম্যাচিউরিটির সময় রিপেমেন্টে পাবে। এ কাজে কর্পোরেশনগুলোকে টাকা জোগানোর জন্য বাড়তি সূত্র হিসেবে আছে ব্যাংক ও অন্যান্য টাকা লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিগুলোকে বুঝতে হবে যে তাদের আর্থিক শেয়ার হোল্ডারদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে কী করতে হবে।

নতুন এক ধারণার উদ্ভব হচ্ছে- ম্যানেজমেন্টের কাজ শেয়ার হোল্ডারদের তুলনায় আরও বেশি প্রতিদান আয় করতে হবে। স্মার্ট কোম্পানি এ ক্ষেত্রে সকল শেয়ার হোল্ডার, ভোক্তা, নিয়োগকর্তা, চ্যানেল পার্টনার, সরকার, ননপ্রফিটস এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের ওপর নজর রাখবে; কেবল শেয়ার হোল্ডারদের ওপরেই নয়। একটি সফল কোম্পানি কখনও নিজের একক চেষ্টায় সফল হয় না। সফল হয় শেয়ার হোল্ডারদের নিয়ে একটা উঁচু মানের নেটওয়ার্ক সাফল্যের সাথে গঠন করতে পেরেছে বলে। অতএব শেয়ার হোল্ডারদের সন্তুষ্ট রাখতে হবে। তাদেরকে বুঝতে দিতে হবে যে তারা সবাই বিনিয়োগ করে লাভবান হয়েছে। ফল হবে; শর্ট-টার্মে বা স্বল্প সময়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের দিকে দৃষ্টি থাকলেও প্রায় সময়ই কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদী মুনাফার পথেই এগিয়ে যাবে।

কলিনস আর পোরাসের মতো আমরাও বিশ্বাস করি কর্পোরেট ভিশন বা রূপকল্প হচ্ছে কর্পোরেট মিশন ও কোম্পানির ভবিষ্যৎ রূপকল্পের মূল্যবোধের ফলাফল। ভবিষ্যতের মানসিক মডেলই হচ্ছে কর্পোরেট ভিশন।

আমাদের বিশ্বাস কর্পোরেশনের সবচেয়ে শক্তিশালী ভবিষ্যৎ প্রবণতা হচ্ছে সাসটেইন্যাবিলিটি বা টিকে থাকতে পারা; বিশেষ করে ক্যাপিটাল মার্কেটে। কর্পোরেশনগুলোর জন্য এটাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ, কেননা এর ওপরই নির্ভর করে তাদের ভবিষ্যৎ শেয়ার হোল্ডার সৃষ্টির কার্যক্রম। কিন্তু তারও দু’টো সংজ্ঞা আছে। কানরেথারের মতে, কোম্পানিগুলোর দৃষ্টিতে সাসটেইন্যাবিলিটি হচ্ছে ব্যবসায় দীর্ঘ সময়ের জন্য টিকে থাকার মন্ত্র। অন্যদিকে সমাজ সেটাকে দেখে পরিবেশ ও সমাজ কল্যাণের দীর্ঘমেয়াদী রক্ষাকবচ হিসেবে।

সাম্প্রতিক কমোডিটাইজড় বা পণ্যদ্রব্যায়িত বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক নতুন অ্যাডভান্টেজ বা অগ্রগাম্যতা অর্জনের সন্ধানে থাকা কোম্পানিগুলো সেরকম সহযোগিতা অর্জনের সুযোগের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সম্পর্কিত দু’টো খুব গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের কথা বর্ণনা করব। সেগুলো হচ্ছে বাজার পোলারাইজেশন ও অপ্রতুল সম্পদ-যেগুলো আমাদেরকে সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাবে।

১৯৯০-এর দশকের শেষদিক থেকে যদি বড় ধরনের কোনো প্রবণতা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে অস্বস্তিতে ফেলে থাকে, তাহলে সেটা হচ্ছে বাজার মেরুকরণ। ওই সময় ওপরের ও নিচের বাজার ক্রমাগতভাবে মেরুকরণ করা শুরু হয় এবং মাঝের বাজার অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। ট্রেজার হান্ট বইয়ে সিলভারস্টাইন ও ব্যাটম্যান জানান, তাঁদের জরীপে মাঝের বাজারের ভোক্তা

পাওয়া গেছে যারা ৫০ হাজার ডলার থেকে দেড় লক্ষ ডলার রোজগার করে থাকে। নিজেদের সখ পূরণের জন্য তারা হয় সাধ্যের মধ্যে থাকা বিলাসিতা খোঁজে, অথবা দরদাম করে জিনিসপত্র কেনে, অথবা দুটোই করে। গবেষকদ্বয় হিসেব কষে দেখেছেন ২০০৬ সালে আমেরিকার ট্রেডিং আপ-এর আকার ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মত। অন্যদিকে ট্রেডিং ডাউনের আকার ছিল ১ ট্রিলিয়ন ডলারের মত। জাপান ও জার্মানিতেও একই ধারা লক্ষ করেছেন তাঁরা। কাডসেন, রান্ডেল ও রুহলমের বাছাই করা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ অন্য কয়েকটি দেশের ২৫ টি কারখানা ও উৎপাদনের ক্যাটাগরিতেও একই ধারা দেখা গেছে। তারা লক্ষ করেছেন, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মাঝের বাজারের উৎপাদিত পণ্যের রাজস্বের প্রতি বছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ।

বাজার কাঠামো আর প্রতিযোগিতা কিভাবে কাজ করে, সেসবের সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ আছে। কোম্পানিগুলোকে হয় টপ-এন্ড বাজার, নয়তো লো- এন্ড বাজার অনুসরণ করতে হবে। দু’টোর যেটাই করা হোক না কেন, সামাজিক ও পরিবেশগত যে সমস্ত অপরিহার্য বিধি-বিধান আছে, তা এড়িয়ে চলতে পারবে না তারা। কারণ সামাজিক ও পরিবেশগত পরিস্থিতি লো-এন্ড বাজারের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। পরে তা টপ-এন্ড বাজারের বিবেচ্য বিষয়েও পরিণত হয়।

আমরা বলি টপ-এন্ড বাজার পূর্ণতাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং হাই-এন্ড ভোক্তারাও কার পণ্য কতটা টেকসই সে সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেছে। যখন পণ্য বাজারজাতকারীরা টপ-এন্ড পণ্যসামগ্রী নিয়ে বাজারে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেবে, তখন নিজেদের পণ্যের টেকসই হওয়ার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করবে। আমাদেরকে ভোক্তার হৃদয় স্পর্শ করতে হবে টেকসই ব্যবসায়িক মডেল বাজারে আনার মাধ্যমে। প্রথম দিকে এ ধরনের কাজে নজির প্রতিষ্ঠা করে হোল ফুডস ( Whole Foods), প্যান্টাগোনিয়া (Pantagonia) ও হেরম্যান মিলার (Herman Miller) নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। তারা পণ্যের দাম নিত বেশি, কিন্তু তারপরও ভোক্তারা তাদের কাছ থেকেই জিনিসপত্র কিনত। তারা বরং আরও উন্নত মানের জিনিস দেয়া সম্ভব হলে আরও বেশি দিতেও প্রস্তুত থাকত।

অন্যদিকে বটম এন্ডেও অনেক বড় আকারের ভোক্তা গোষ্ঠী ছিল। সেটা হচ্ছে ভবিষ্যতে যেখান থেকে উঁচু প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মতে গরীবরা হলো নতুন বাজারের প্রাণ স্পন্দন। সি. কে প্রহ্লাদ ও স্টুয়ার্ট হার্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়ীক চিন্তাবিদ যারা বাজার পিরামিডের গোড়ার দিকের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে নজর রাখেন। প্রহ্লাদের দ্য ফরচুন আট দ্য বটম অব দ্য পিরামিড এবং হার্ট-এর ক্যাপিটালইজম অ্যাট দ্য ক্রসরোডস দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্রমবর্ধমান ভোক্তা ও উদ্ভাবনের উল্লেখযোগ্য গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে সনাক্ত করেছে। ক্লেটন ক্রিস্টেনসেনের মত হচ্ছে সংহতি নষ্ট করা প্রযুক্তি স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয় দরিদ্র সমাজের সমস্যা সমাধানে। ভারত গরীবদের ক্রয়সাধ্য বেশ কিছু পণ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠেছে। ফিলিপ কটলার ও ন্যান্সি লি তাদের আপ অ্যান্ড আউট অব পভার্টি বইয়ে দেখিয়েছেন সোশ্যাল মার্কেটিং বা সামাজিক বাজারজাতকরণ মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে ব্যবহার করা যায়।

গরীব জনগোষ্ঠী কিছু কিছু পণ্যের জন্য অতীতে লালায়িত থাকলেও পেত না। সেটা যে কেবল তাদের আয়ের সীমাবদ্ধতার জন্য, তা কিন্তু নয়। জোগাড় করার সমস্যাও ছিল তার অন্যতম। এ ধরনের ক্রেতা ধরা যে সব কোম্পানির লক্ষ্য থাকবে, তাদের উচিত হবে এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করে ক্রয়ের পথের বাধাসমূহ দূর করা।

২০০৮ সালের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূস দেখিয়ে দিয়েছেন ব্যাংক কীভাবে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে দরিদ্রদের আয় বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। বড় বড় কোম্পানি যেমন কোকা-কোলা, ইউনিলিভার ও অন্যান্য কোম্পানি দেখিয়ে দিয়েছে তাদের উৎপাদিত পণ্য কিভাবে দূর- দূরান্তের বিচ্ছিন্ন পল্লী অঞ্চলেও সাফল্যের সঙ্গে বাজারজাত করা যায়। এসব সমাধান নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আরও বেশি বেশি সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করবে।

সীমিত সম্পদ

ব্যবসায়ে টিকে থাকার ধারণা ছিল গত কয়েক দশকের মূল বিষয়। ১৯৮০-এর দশকে ম্যানুফ্যাকচারিং বা প্রস্তুতকারী ক্ষেত্র যখন দিন দিন বিস্তার লাভ করছে, তখন সবার নজর ছিল এর ফলে কারখানার গ্যাস প্রভৃতির নিঃসরণ রোধ করা ও তার ক্ষয়ক্ষতি সীমিত রাখার দিকে। ১৯৯০-এর দশকে যখন ভোক্তা- কেন্দ্রিক চর্চা বাড়তে শুরু করে, তখন বিষয় ছিল পণ্য পরিবেশন করা। কোম্পানিগুলো সেসব পণ্যই প্রস্তুত করত যেগুলো ছিল পরিবেশবান্ধব।

বর্তমানে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ সীমিত হয়ে আসছে এবং প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে হয়ত বেশিদিন তা সমর্থন জোগাতে পারবে না। বিশেষ বিশেষ সম্পদের মূল্য দিন দিন বাড়ছে এবং তা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর তথা ভোক্তাদের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কোম্পানিগুলোর উচিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্বালানীর মজুদে যাতে টান না পড়ে সে ব্যবস্থা করা, যাতে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। যারা সম্পদের ঘাটতি সত্ত্বেও কাজ চালিয়ে নিতে পারে, তারাই শেষ পর্যন্ত লাভবান হবে। অব্যাহতভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের সরবরাহ প্রাপ্তি ক্রমেই শক্তিশালী প্রতিযোগতামূলক অ্যাডভান্টেজে পরিণত হচ্ছে।

হোল ফুডসের মতো কোম্পানি যে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকার আইডিয়াকে ধারণ করেছে, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা হোল ফুডস প্রাকৃতিক ও জৈব পণ্য বাজারজাত করার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু যখন ওয়াল-মার্টের মতো বিশাল কোম্পানি ২০০৬ সালে ঘোষণা করে তারাও হোল ফুডসের পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছে, তখন আমরা বুঝতে পারি যে ব্যবসার জগতে আগের সেই সুবাতাস আর নেই। ওয়াল-মার্ট অঙ্গীকার করে নিজের উৎপাদনশীলতার উন্নতি ঘটাবে। এছাড়া তারা আরও যে অঙ্গীকার করে, তা হলো আরও বেশি উন্নত সূত্র থেকে পণ্য কিনবে। এটা হচ্ছে একটা সংকেত যে মানসম্মত পণ্য সরবরাহ না করায় বাজারজাতকারীদেরকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। এ থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সবুজের ওপর নির্ভরশীল হওয়া। এটা আরও এক ধরনের সংকেত দেয় যে মানসম্মত পণ্য সরবরাহের চেইন খুব শিগগিরই করপোরেশনগুলোর জন্য বড় একটা ইস্যু হয়ে উঠবে।

২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন আমেরিকার এক সময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর। তিনি গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের ওপর অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ নামে একটা ছবি তৈরি করেছিলেন এবং সে ছবি দু’টো অস্কার পুরষ্কারও জিতে নিয়েছিল। ছবিটিতে ব্যাখ্যা দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে পৃথিবীর বহন ক্ষমতার মাত্রা কত, এবং তা ব্যবসায়িক জগতকে কি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সঙ্কুচিত করে আনছে। আল গোর তাঁর ছবির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন বিশ্বের অর্থনৈতিক সঙ্কট ব্যবসায়ীদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে এবং সতর্ক করে দিয়েছে যে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ব্যবসার ধরণ বদলে যাবে পারিপার্শ্বিকতার মানকে কেন্দ্র করে।

দারিদ্র্য দূর হওয়ার বিষয়টির অগ্রগতিও সেটাই নিশ্চিত করবে। মান বজায় রাখার উভয় সঙ্কটকে কেউ মূল্যায়ন করতে পারে এভাবে: দারিদ্র্য দূর হওয়া উচিত সীমিত সম্পদের মাধ্যমে। যখন আগ্রাসী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার পদক্ষেপ নেয়া হয়, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার প্রায় সময়ই পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে। তাছাড়া গরীব মানুষদেরকে তারা বাধ্য করা হয় সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ- নিৰ্মল পানি ও বাতাস, এবং চাষযোগ্য উর্বর জমি তাদের হাতে তুলে দিতে।

এ অবস্থা পরিবেশের আরও বিপর্যয় ঘটাবে এবং গরীব জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার পরিবেশকে অসহনীয় করে তুলবে। এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে পরিবেশ-বান্ধব উদ্ভাবন যেগুলো করবে দারিদ্র্য কবলিত অঞ্চলের সামাজিক শিল্পদ্যোক্তারা। বিষয়টি নিয়ে আমরা অধ্যায় ৮-এ আলোচনা করব।

মান বজায় রাখা ও অংশীদার ভ্যালু

দুটি ধারা মেরুকরণ ও সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা, মান বজায় রাখার আন্দোলনকে জোরদার করবে। কোম্পানিগুলো একটা বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছে যে, যদি তারা মান বজায় রাখার প্রশ্নে আপোষহীন হয়, তাল মিলিয়ে চলে, তাহলে বাজার ধরে রাখার প্রতিযোগিতার সুযোগ তারা পাবে। জিই কোম্পানি বোঝে কেবল মূল্যবোধ-চালিত ব্যবসাই সুফল বয়ে আনে না। কোম্পানির সিইও জেফ ইমেল্ট জানেন, নিত্য পরিবর্তনশীল ব্যবসায়িক পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পণ্যের মান বজায় রাখাটা একেবারেই অপরিহার্য। তিনি বোঝেন পূর্ণতাপ্রাপ্ত বাজার ও উন্নয়নশীল বাজারের মধ্যে একটা ফাঁক আছে এবং সেই ফাঁকের ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারলে তা জিই-র জন্য ব্যবসার ভালো সুযোগ বয়ে আনবে। তিনি বলেন, সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করছে নতুন কিছু উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। জিই সেই সমাধান প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে চায়। দেখাতে চায় সে সামাজিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেও মুনাফা অর্জন করতে পারে, এবং কোম্পানিটি কাজের মাধ্যমে তা দেখিয়েও দিয়েছে নিজস্ব সোলার প্যানেল, উইন্ড টারবাইন ও পানির মান রিসার্চ প্রভৃতির মাধ্যমে। একটি বড় পাবলিক কোম্পানি হিসেবে জিই মনে করে নিজেদের মান বজায় রাখার চর্চা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে অংশীদারদের যথাযোগ্য মূল্য দেয়া।

কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান এ. টি. কিয়ার্নি আবিষ্কার করেছে যে নিজেদের মান ধরে রাখা কোম্পানিগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় তাদের প্রতিপক্ষকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার ধারা বজায় রেখেছে। এ সম্পর্কিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এ জাতীয় কোম্পানিগুলো ২০০৮ সালের মে থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ১৮ টি কারখানার মধ্যে ১৬ টিকে স্টক মূল্যমানের দিক থেকে গড়ে ১৫ শতাংশ পিছনে ফেলে দিয়েছে। ব্যবসায়িক পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে তারা তাল মিলিয়ে চলতে বেশি পারঙ্গম এবং তারা বেশি শেয়ারহোল্ডার ভ্যালু পরিশোধ করে থাকে।

২০০৮ সালে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার ১,২৫৪জন নির্বাহীর ওপর এক জরিপ চালিয়েছে ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। তাতে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে যে করপোরেট পণ্যের মান ধরে রাখা ও শেয়ার মূল্য বিষয়ক সাফল্য বা সম্পাদনের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। যে সমস্ত কোম্পানি তাদের সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে, সেসব কোম্পানির নির্বাহীদের মতে তাদের বাৎসরিক মুনাফার প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশ, এবং শেয়ার মূল্যের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৫ শাতংশ। অন্যদিকে যে সমস্ত কোম্পানি পণ্যের মান বজায় রাখার বিষয়টির দিকে নজর দেয়নি, সেগুলোর মুনাফার প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭ ও ১২ শতাংশ।

নির্বাহীরা বিশ্বাস করেন, নিজ নিজ পণ্যের মান বজায় রাখার বিষয়টা কর্পোরেশনগুলোর জন্য ভাল ফল বয়ে আনে। ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে ৩৭ শতাংশ নির্বাহী মত প্রকাশ করেন, মান বজায় রাখার বিষয়টা ভোক্তাদের আকৃষ্ট করে। ৩৪ শতাংশ বলেন এতে শেয়ার হোল্ডার মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং ২৬ শতাংশ দাবি করেন এর ফলে ভাল কর্মচারীরা ওইসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হন।

তাছাড়া নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে থেকে ৬১ শতাংশ জানিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছর তারা নিজেদের কোম্পানির সাফল্য সম্পর্কে শেয়ার হোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ও মান বজায় রাখার বিষয়টা রক্ষা করে চলবেন। ২৪ শতাংশ একে তাদের মূল উদ্দেশ্য বলেছেন। অন্যদিকে ৩৭ শতাংশ বলেছেন এটাই তাদের প্রধানতম কাজ। মান বজায় রাখার বিষয়টা দিন দিন পুঁজি বিনিয়োগকারীদের মাঝেও উৎসাহের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। এসব অনুসরণের ফলে যে মুনাফা হয়, তাতে ইনডেক্সেরও উন্নতি ঘটে। নিচের বিষয়গুলি বিবেচনা করুন :

* কেএলডি ব্রড মার্কেট সোশ্যাল ইনডেক্স (বিএসএমআই) সেগুলোকেই ভালো ব্যবসায়িক অনুশীলন বলে আখ্যা দেয়, যেগুলো পরিববেশগত, সামাজিক এবং পরিচালনার বিষয়টিকে বিবেচনা করে থাকে।

* এফটিএসই৪ গুড ইনডেক্সে ভালো কোম্পানি সেগুলো, যেগুলো পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখে, সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখে, মানবাধিকার সংরক্ষণে কাজ করে, যেগুলোর ভালো, মানসম্মত সরবরাহ ব্যবস্থা ও ঘুষ প্রতিরোধক ব্যবস্থা মেনে চলে।

* ডো জোনস সাসটেইনঅ্যাবিলিটি ইনডেক্সের (ডিজেএসআই) দৃষ্টিতে টেকসই ব্যবসায়িক অনুশীলন হচ্ছে টেকসই-সচেতন ভোক্তাকুলের আনুকূল্য অর্জনের মাধ্যমে বেশি মুনাফা অর্জনে সফল হওয়া এবং একইসঙ্গে টেকসই নয়, এমন মালামাল বিক্রির সাথে জড়িত ঝুঁকি কমিয়ে আনা। তাতে কর্পোরেট সাসটেইনঅ্যাবিলিটিকে বলা হয়েছে ‘একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ যা অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক উন্নয়ন খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী শেয়ার হোল্ডার মূল্যবোধ সৃষ্টি করে।’

* গোল্ডম্যান সাচস প্রবর্তন করেছে জিএস সাসটেইন ফোকাস লিস্ট। যে সব কোম্পানি সাসটেইনেবল বা টেকসই ব্যবসার অনুশীলন করে, এ তালিকায় সেগুলোর নাম আছে। পৃথিবী ক্রমে স্বচ্ছ হয়ে আসছে এবং প্রবৃদ্ধি ব্রিক সংস্থাভুক্ত দেশসমূহ তথা ব্রাজিল, রাশিয়া, ইরান ও চীনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এই সত্যকে সামনে রেখে গোল্ডম্যান সাকস তাতে বিএসএমআই-এর অনুরূপ নতুন একটি ইএসজি কনসেপ্ট অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব ছাড়াও উদীয়মান শিল্প, যেমন বিকল্প জ্বালানি, এনভায়রনমেন্টাল টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি ও পুষ্টি এবং সেসব শিল্পের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গও আছে সে তালিকায়।

এক কথায় এই সূচকগুলো কোম্পানিগুলোর তিনটি অন্তর্নিহিত বাস্তবতা যেমন, profit (প্রফিট), planet, (প্ল্যানেট) এবং people (পিপল)-এর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় কতখানি পারঙ্গম তা নির্দেশ করে। সমাজে কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব কতখানি পড়ে, এগুলোর মাধ্যমে তা পরিমাপ করা হয়। ডেভিড ব্লাড অবশ্য এসব সূচকের সমালোচনা করে বলেছেন, যৌথ প্রতিষ্ঠানের (করপোরেট) ব্যবসায়িক কৌশল (স্ট্রাটেজি) অখণ্ড চিত্র এগুলো তুলে ধরতে পারে না বলে। টিকে থাকার সূচকের উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করা নিয়ে এক টিম যা করে, স্ট্রাটেজি রিসার্চ ও প্ল্যানিং টিম তা কখনও কখনও ভিন্নভাবে করে। কাজেই সাসটেইনেবিলিটি ও স্ট্রাটেজির যোগসূত্রের বিষয়টা কখনও কখনও উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে।

মার্কেটিংয়ের দূরদর্শী কৌশল

রবার্ট কিয়োসাকি বলেন, উইলার্ডের মতে তিনটা কারণ আছে যে জন্য কোম্পানিগুলো টেকসই ব্যবসার অনুশীলনের পথ পছন্দ করে থাকে। একটা কারণ হচ্ছে এ ব্যাপারে কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতাদের ব্যক্তিগত আসক্তি। এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণগুলোর মধ্যে আছে বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর বেন কোহেন ও জেরি গ্রিনফিল্ড, বডি শপের অনিতা ও গর্ডন রডিক, এবং প্যাটাগনিয়ার ওয়াইভন চওনার্ড। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মাঝেমধ্যে মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়া বা রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য কোম্পানিগুলোর জনসংযোগের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। এরকম একটি উদাহরণ হচ্ছে ডুপন্ট, জনসংযোগের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়ায় এ কোম্পানি টেকসই ব্যবসার অনুশীলন শুরু করে। কোম্পানিগুলো টেকসই ব্যবসা অনুশীলনের পথ বেছে নিতে পারে আইনের নিয়ন্ত্রণের চাপের কারণে। নাইকি ও শেভরন কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের রেগুলেটরি বডির নজরদারির মধ্যে ছিল।

এসব যদিও ব্যবসায়ে টিকে থাকার গ্যারান্টি দেয় না। প্রতিষ্ঠাতারা নিজেদের কোম্পানি টেকসই ব্যবসার চর্চা আগের মতো বজায় রাখছে কি না, প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেয়ার পর সেদিকে নজর রাখতে পারে না। জনসংযোগের সমস্যার সমাধান করা আর রেগুলেটরি বডির চাপ কখনও এ সমস্যার দীর্ঘকালীন সমাধান হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে টিকে থাকতে হলে কোম্পানির মিশন (দায়িত্ব), ভিশন (রূপকল্প বা রূপরেখা), এবং ভ্যালু (মূল্যবোধ) প্রভৃতি হতে হবে কোম্পানির কৌশল। ম্যানেজমেন্টকে ব্যবসায়ে টিকে থাকাকে দেখতে হবে প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগামীতার সূত্র হিসেবে। এটাই হবে শেয়ারহোল্ডারদের কাছে করপোরেট ভিশন বাজারজাত করার মূল চাবিকাঠি।

শেয়ারহোল্ডারদের কাছে বাজারজাত করা আর ভোক্তা, কর্মচারী অথবা চ্যানেল মেম্বারদের কাছে করার ভিন্ন উপায়ের প্রয়োজন হয়। ব্র্যান্ড গল্প শুনে ভোক্তারা সহজে প্রভাবিত হলেও শেয়ারহোল্ডাররা হবে না। তারা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও নয় যে করপোরেট সংস্কৃতির প্রতি তাদের দৃঢ় কোনো বন্ধন থাকবে। শেয়ারহোল্ডারদের জন্য এক নম্বর বিবেচ্য হলো তাদের লগ্নিকৃত টাকা ফেরত দিতে হবে। যদিও তাদেরকেও ব্যবসায়ে টিকে থাকার বিষয়টা দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারা হচ্ছে ব্যক্তি এবং সংস্থা, যারা ব্যবসার খুঁটিনাটি দিকে নজর রাখার মাধ্যমে নিশ্চিত করে যে, করপোরেট নির্বাহীরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে।

আমরা জানি ভোক্তা ও কর্মচারীর বাজারে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারা হচ্ছে তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারার শামিল। ক্যাপিটাল মার্কেটে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করা অন্য জিনিস। মার্কেটিং নীতিসমূহের গুরুত্বের শেয়ারহোল্ডারদের প্রভাবিত করতে হলে প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে প্রতিযোগিতামূলক অগ্রগামীতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের শেয়ারহোল্ডার ভ্যালুর উন্নতি সাধন করা হবে।

শেয়ারহোল্ডাররা যখন পারফরমেন্স বা কার্য সম্পাদনের কথা ভাববে, তখন মুনাফাসক্ষমতা (Profitability), আর প্রত্যাহারসক্ষমতা (Retumability)-এর কথাও ভাববে। মুনাফাসক্ষমতা হচ্ছে শর্ট টাইম গোল বা অল্প সময়ে লক্ষ্য অর্জন। আর ভারবহনসক্ষমতা হচ্ছে লং টাইম গোল বা দীর্ঘ সময়ে লক্ষ্য অর্জন। Amazon.com বা eBay প্রথম কয়েক বছর লাভজনক ছিল না। কিন্তু সেখানে প্রত্যাহারসক্ষমতার প্রতিশ্রুতি ছিল বলে বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি তুলে নেয়নি। ইসু হচ্ছে মুনাফাসক্ষমতা, প্রত্যাহারসক্ষমতা ভারবহনসক্ষমতার মধ্যেকার যোগসূত্র খুঁজে বের করা।

শেয়ারহোল্ডারদের কাছে রূপকল্প বাজারজাত করতে প্রয়োজন নিটোল ব্যবসার। ২০০৮ সালে পরিচালিত এক সার্ভেতে দেখা গেছে যে, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন ব্যবসা ও সমাজের মধ্যে একটা চুক্তি আছে এবং টেকসই বা টিকে থাকতে সক্ষম ব্যবসায়িক শেয়ারহোল্ডার মূল্য বৃদ্ধি করে।

উন্নততর কস্ট প্রোডাক্টিভিটি

একটা ভাল মিশন ভোক্তাদের সমর্থন পাবে। মূল্য হবে তুলনামূলক কম কারণ কোম্পানিগুলো নেটওয়ার্কের ক্ষমতা দ্বারা লাভবান হবে। ভোক্তাদের মুখে মুখে কোম্পানির ব্র্যান্ডের সুনাম চারদিক ছড়াবে। ফলে কোম্পানির বিজ্ঞাপনী খরচও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।

যে সমস্ত কোম্পানি কঠোরভাবে নিজেদের মূল্যবোধ রক্ষা করে চলে, সেগুলো সবসময় কর্মচারী ও মধ্যস্বত্ত্বভোগী চ্যানেল পার্টনারদের সমর্থন পাবে। ফলে কর্মচারীরা কাজ করে যেমন মজা পাবে, তেমনি উৎপাদনশীলতাও অনেক বেড়ে যাবে কোম্পানির। অন্যদিকে কমবে বিভিন্ন খরচ। কর্মচারীরা ভাল আচরণ করবে ভোক্তাদের সঙ্গে, ফলে তাদের অভিযোগের পরিমাণও কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, চ্যানেল পার্টনাররা কোম্পানিকে আগের তুলনায় বেশি সহযোগিতা করবে এবং বেশি মুনাফা আদায় করা থেকে বিরত থাকবে।

কাউফমান, রেইমান, এহরগট ও রয়ের-এর ২০০ কোম্পানির ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে কোম্পানিগুলো যদি পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ব্যবসা পরিচালনা করে, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অ্যাডভান্টেজ বা অগ্রগামীতা লাভ করতে পারে। তাদের উৎপাদনশীলতা হয় অনেক বেশি। উৎপাদনের নিমিত্ত খরচ হয় কম, বর্জ্যও হয় কম। ক্লাসেন-এর ১০০ কানাডিয়ান কোম্পানির ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে যে সবুজ নিয়ে কারবার করলে টাকা বাঁচে প্রচুর।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও এনার্জি (গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতি) খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকে। উৎপাদন ব্যয় ও সাধারণ মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিও কম থাকে। কাঁচামাল সহজে সংগ্রহ করা যায়। স্বল্প আয়ের বাজারে উৎপাদিত মাল বিতরণে কমিউনিটি নেটওয়ার্কের সহায়তা পাওয়া যায়। ভোক্তারা অন্য ভোক্তাদের মধ্যে চ্যানেলের মতো কাজ করে, ফলে বাজারজাতকরণের খরচ কমে যায়। এছাড়া সমাজ ও পরিবেশ-বান্ধব অনুশীলন যেহেতু ভোক্তারা পছন্দ করে, সেহেতু অন্যান্য ব্যয়ও অনেক কমে যায়।

ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই বশীকরণ গল্প তৈরি করতে এবং উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ নিতে হবে শেয়ারহোল্ডারদের দীর্ঘ মেয়াদী খরচ বাঁচানোর স্বার্থে। ব্যবসায়ে যেখানে খরচ বাড়ে, সেখানে বেশি উৎপাদনশীলতা একটা উল্লেখযোগ্য অ্যাডভান্টেজ পেতে পারে। ব্যবসা পড়ন্ত হলে মূল্য সাশ্রয়মূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বোঝা যাবে প্রতিষ্ঠান মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না।

নতুন বাজার থেকে বেশি রাজস্ব

উচ্চতর মার্কেটিং অনুশীলনে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। ভাল মিশন, ভিশন আর মূল্যবোধওয়ালা কোম্পানি খুব সহজেই নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারে। তাদেরকে সবাই স্বাগত জানায়। এ ধরনের কোম্পানি উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধির বাজারে যোগ দেয়ার সুযোগও পাবে। সেসব দেশের সরকার এরকম করপোরেট বিনিয়োগকে স্বাগত জানাবে, কারণ তাদের নাগরিকরাই এ থেকে লাভবান হবে। তারা সেসব দেশের এনজিওসমূহের সহায়তাও পাবে যাতে তারা নিজেদের মিশন পুরো করতে সফল হয়। তারচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, যেসব বাজারে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা আছে, সেসব বাজারেও তারা বিশেষ সুবিধা লাভ করবে। ব্যবসা সাচ্চা হলে কোম্পানিগুলোর উদ্বেগের কোনো কারণ থাকবে না। নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারার অর্থ হলো রাজস্ব বৃদ্ধি এবং লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি, কারণ অন্যান্য বাজার থেকে এসব বাজারে প্রতিযোগিতা হয় কম।

যে সব করপোরেশন টেকসই ব্যবসা করে, তারা পূর্ণতাপ্রাপ্ত বাজার ও দরিদ্র বাজার, উভয় বাজারেই প্রবেশের সুযোগ পাবে। কোন-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অর্থনৈতিক সংকট থাকা সত্ত্বেও ৪৪ শতাংশ ভোক্তা সবুজ পণ্য কিনে থাকে। তাদের আনুমানিক ৩৫ শতাংশের মতে সংকটের পরে পর এ প্রবণতা বরং আরও বেড়েছে। ফরেস্টার রিসার্চের এক গবেষণার ফলাফলও নিশ্চিত করেছে যে, ৮০ শতাংশ ভোক্তা সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ব্র্যান্ডের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, এবং ১৮ শতাংশ তার জন্য বেশি টাকা দিতেও প্রস্তুত। একইভাবে পরিবেশগতভাবে দায়বদ্ধ ব্র্যান্ডসমূহ ৭৩ শতাংশ ভোক্তাকে আকৃষ্ট করে এবং ১৫ শতাংশ ভোক্তা তার জন্য বেশি দাম দিতেও প্রস্তুত। অন্যদিকে ভোক্তাদের মধ্যকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দরকার তাদের নিজেদের সমস্যার সমাধান। এর ভাল সমাধান দিতে পারে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ অনুশীলন। ফলে এসব কোম্পানির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়ে।

উচ্চতর করপোরেট ব্র্যান্ড ভ্যালু

হাচ ও শুলজের মতে করপোরেট ভিশন বা যৌথ রূপকল্প, ভাবমূর্তি আর ঐতিহ্য করপোরেট ব্র্যান্ড নির্মাণে সহায়তা করে। করপোরেট ব্র্যান্ড কোম্পানির। প্রস্তুতকৃত পণ্যের সাথে নিজেদের অনুমোদনের সিলও সরবরাহ করে এবং বাইরের হুমকি থেকে পণ্যকে সুরক্ষা দেয়। ২০০৮ সালে পরিচালিত একটি বিএসআর/কোন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮৪ শতাংশ পেশাজীবী এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি বা যৌথ দায়িত্বশীলতার রেপুটেশনাল বেনিফিট বা সুখ্যাতির সুযোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু করপোরেট সুখ্যাতির ধারণার বিষয়টা হচ্ছে অলীক। ফলে বেশিরভাগ সময় তা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য মেনে নেয়া সমস্যার কারণ হয়ে দেখা দেয়।

তবে সৌভাগ্যের কথা যে ইন্টারব্র্যান্ড ও ব্র্যান্ড ফাইন্যান্সের মতো কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান করপোরেট ব্র্যান্ড ও ব্র্যান্ড ন্যায়বিচার মূল্যায়নের কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে। ইন্টারব্র্যান্ড তার ইকোইমাজিনেশন এজেন্ডার অধীনে GE ব্র্যান্ডের মূল্যমান ২৫ শতাংশ বেড়েছে বলে রায় দিয়েছে। GE পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করেছে বলে এ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এই আবিষ্কার নির্দেশ করে টিকে থাকার চর্চা কোম্পানির সুখ্যাতি ও ব্র্যান্ডের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

শেয়ারহোল্ডারদের প্রভাবিত করতে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যা করা প্রয়োজন, তা হলো নিজেদের কোম্পানির করপোরেট ভিশন, মিশন ও ভ্যালু সূত্রবদ্ধ করে প্রকাশ করা। যৌথ রূপকল্পে টেকসই ব্যবসার বিষয়টা সংযুক্ত থাকতে হবে, যাতে তা ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাদি পেতে পারে। শেয়ারহোল্ডারদের বোঝাতে হবে কোম্পানি টেকসই ব্যবসা করার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমবে, মুনাফা বাড়বে এবং করপোরেট ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়বে।

ডুপন্ট : নতুনের উদ্ভাবক

দুই শতাব্দীর বেশিকাল যাবৎ আমেরিকার সবচেয়ে বড় পরিবেশ দূষণকারী কোম্পানি বলে পরিচিত ডুপন্ট আজ নিজেকে দেশের অন্যতম সেরা সবুজ কর্পোরেশনে রূপান্তরিত করেছে। ডুপন্ট নাইলন (Nylon), ড্যাকরন (Dacron), লুসাইট (Lucite), কেভলার (Kevler), কোরিয়ান (Corian), টাইভেক (Tyvek), টেফলন (Teflon), ও পলিমার কেমিস্ট্রির উদ্ভাবন করে মানবজীবন চিরকালের জন্য বদলে দিলেও ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস (সিএফসি)-এর স্রষ্টাও সে, অ্যান্টার্কটিকার ওপরের ওজোন স্তরে ছিদ্র সৃষ্টি করার দায় যার কাঁধে চাপানো যায়। যা হোক, সেই কোম্পানিই আজ ইউ. এস. ক্লাইমেট অ্যাকশন পার্টনারশিপ (USCAP) নামের সংস্থার অন্যতম পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটি দেশের আইন প্রণেতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে, তারা যেন কর্পোরেশনগুলোকে বাধ্য করেন গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর ব্যবস্থা করতে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৩-এর মধ্যে ডুপন্ট নিজের গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা ৭২ শতাংশ কমিয়েছে। ২০১৫ সাল নাগাদ এ মাত্রা আরও ১৫ শতাংশ কমিয়ে আনা যাবে বলে আশা করছে তারা

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানোর ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান আছে ডুপন্টের। তার ২৯ বিলিয়ন রাজস্বের ৫ বিলিয়নই আসে পরিবেশবান্ধব সূত্র ও পণ্য থেকে এবং সেসব জ্বালানি সাশ্রয়ী। ডুপন্ট বর্তমানে যে সব পণ্য তৈরি করে, সেগুলো দ্বারা এ গ্রহের কোনোরকম ক্ষতি হওয়ার সুযোগ নেই। তারা অতীতে গ্রহের যে সমস্ত ক্ষতি করেছিল, এসব পণ্যের মাধ্যমে সে ক্ষতি আপনাআপনি রিভার্স বা পূরণ হয়ে যাচ্ছে। হার্ট ও মিলস্টাইন একে আখ্যা দিয়েছেন, সবুজায়নের ছেদ পড়া উদ্ভাবন।

ডুপন্ট এমন কিছু পণ্য প্রস্তুত করেছে যা পরিবেশের ক্ষতির কিছুটা পূরণ করবে। তার অন্যতম হচ্ছে টাইভেক, যা এনার্জি-এফিশিয়েন্সি বা জ্বালানি-কার্যকরিতা উন্নয়নে ব্যবহার করা যাবে। ডুপন্টের বায়োফিউয়েল ইউনিট এমন শস্য উৎপাদনে কাজ করছে যা বেশি ইথানল দেবে, সস্তায় বেশি-এনার্জির সেলুলসিক-ইথানল উৎপাদনের উপায় খুঁজছে ডুপন্ট, এবং BP-র সঙ্গে পার্টানরশিপে বায়ো-বুটানল নামের নতুন জ্বালানি নিয়ে কাজ করছে। বায়ো-বুটানল উচ্চতর-এনার্জির জ্বালানি যা আজকালকার ইঞ্জিনের জন্য প্রয়োজন। এছাড়া বুলেটপ্রুফ ভেস্ট তৈরির জন্যও কেভলার প্রয়োগ করছে ডুপন্ট।

ডুপন্টের সাদ হলিডের (Chad Holliday) মতো GE-র জেফ ইমেল্টও সবুজ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। জেফ ইমেল্ট এনার্জি-সেভিং বাল্ব থেকে শুরু করে পানির ডিস্যালিনেশন বা লবণমুক্ত করার প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করছে। এ ধরনের অন্যান্য কোম্পানি যেমন টয়োটা তার হাইব্রিড গাড়ি নিয়ে, ডাউ কেমিক্যাল তার বায়োটেকনোলজির বিনিয়োগ নিয়ে এবং লা মডার্না ‘গ্রিন কেমিস্ট্র’ নিয়ে গবেষণা করছে সিনথেটিক কেমিক্যালের পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল কোনো বিকল্প পাওয়া যায় কি না তার খোঁজে।

উদ্ভাবকরা এখন যা যা গ্রহণ করছে, ওয়ালি ও হোয়াইটহেড তাদের হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ প্রবন্ধে সে প্রসঙ্গে বলেছেন, “সবুজ হওয়া সহজ নয়” : সবুজ হওয়া… উদ্ভাবনের একটি ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটক।”

বিনিয়োগকারী: ওয়াল-মার্ট কেস

বিশ্বের সববৃহৎ খুচরা বিক্রেতা ওয়াল-মার্টেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। অতীতে সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়সমূহের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা ছিল ওয়াল- মার্টের, তাই তাদের মর্যাদাও তেমন ছিল না। পরিবেশগত ইসুকে ক্রমাগতভাবে অবহেলা করে চলা ও কর্মচারীদের কম বেতন দেয়া নিয়ে অতীতে প্রায়ই সমালোচনার শিকার হতো ওয়াল-মার্ট। রবার্ট গ্রিনওয়াল্ড একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন ওয়াল-মার্ট: দ্য হাই কস্ট অব লো প্রাইস নামে। তাতে দেখানো হয় এক আন্দোলনকারী বলছে, ওয়াল-মার্টের মতো এমন মূর্খ কর্পোরেশন সে জীবনে দ্বিতীয়টা দেখেনি।

এমনকি পরিবেশগত বিষয়সমূহের প্রতি ক্রমাগতভাবে অবহেলা দেখিয়ে যাওয়ার কারণে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা করার পরও প্রতিষ্ঠানটির নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে হুঁশ হয়নি। আগের মতোই উদাসীন ছিল ওয়াল-মার্ট। ফলে ম্যাককিনসের মতে মানুষের মনে একটা নেতিবাচক ধারণা হয় প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে এবং নিয়মিত ভোক্তাদের মধ্যে থেকে ৮ শতাংশ ওয়াল- মার্ট থেকে তাদের নিত্য কেনাকাটা কমিয়ে দেয়। অবশেষে ২০০৫ সালে ওয়াল-মার্ট জানায়, এখন থেকে সে পরিবেশের রক্ষকের ভূমিকা পালন করবে।

ওয়াল-মার্টের প্রাক্তন সিইও স্কট লি ঘোষণা করেন, ব্যবসার মডেল ঢেলে সাজাতে এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রক্রিয়া ও ভাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে তার কোম্পানি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে। এ জন্য কিছু গ্রিন সুপার সেন্টার স্থাপন করে ওয়াল-মার্ট। সেখানে সবুজ লেবেল লাগানো পণ্য বিক্রি শুরু হয়। নিজের আকারের কারণে পরবর্তী এক বছরে ওয়াল-মার্ট পরিণত হয় জৈবিক বা অর্গানিক দুধ ও মাছের সর্ববৃহৎ খুচরা বিক্রেতায়। ছোটো একটা রূপান্তর বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি ওয়াল-মার্টের নিয়তি রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে দেখে অনেকেই উৎসাহিত হয়।

তবে সমালোচকরা বলছেন ওয়াল-মার্ট তার মূল নীতি ‘অলওয়েজ লো প্রাইস’ ভুলে শুধু দামের দিকেই তাকিয়ে থাকে। অনেকে একে তার স্বার্থপর অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হিসেবে দেখছে। নিজের বর্তমানের মূল নীতি ‘সেভ মানি, লিভ বেটার’ ভুলে ওয়াল-মার্ট সবুজকে পুঁজি করে রোজগার বাড়িয়ে চলেছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী, ওয়াল-মার্টের বিনিয়োগকারী কেনাকাটা বা খরচের ক্ষেত্রে, কিছু দেয়ার বিনিময়ে মুনাফা বা আয় করতে জানেন।

বিনিয়োগকারী কোম্পানি ও ব্যক্তিরা গবেষণা প্রজেক্টে টাকা যোগান দিয়ে থাকে। সেটা নিজেদের কোম্পানি বা আর কোনো কোম্পানি, দুটোই হতে পারে। যেমন ওয়াল-মার্ট ২০০৫ সালে নিজের স্টোরগুলোর জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে যাতে সেগুলো অল্প জ্বালানিতে কাজ চালিয়ে নিতে পারে, তার ট্রাক বেশি বিষাক্ত গ্যাস না ছাড়ে ইত্যাদির সমাধান খুঁজে নিতে। একজন পুঁজি বিনিয়োগকারীর মতো ওয়াল-মার্টও আগে লাভ-ক্ষতি, ঝুঁকির হিসেবে করে তবে টাকা খাটিয়েছে সে খাতে।

বিনিয়োগকারীদের এখনকার রূপকল্প হচ্ছে সবুজ, টেকসই বিশ্ব। আর্থিক লাভের সঙ্গে নিজেদের ভাবমূর্তি, ব্র্যান্ড ভ্যালুর উন্নতি চায়। পরিবেশবিদদের চাপ থেকে বাঁচতে এবং বাজারের চাহিদা মেটাতে সবুজ পণ্য বিক্রি করতে চায়। যখন বিনিয়োগকারী পণ্য উদ্ভাবন ব্যবসায় সরাসরি যুক্ত থাকে না, তখন পরিবেশবান্ধব প্রকল্প গ্রহণে সহায়তার জন্য তারা বড় বড় বিনিয়োগ করে থাকে।

পুনরুৎপাদনকারী : টিম্বারল্যান্ড কেস

স্টেকহোল্ডারদের প্রত্যেকের মতে টিম্বারল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম শ্রদ্ধেয় কোম্পানি। প্রিমিয়াম মানের জুতা, পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের ডিজাইন, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বনেতা। এমনকি ব্যবসা মন্দার সময়েও টিম্বারল্যান্ড তার পরিবেশবান্ধব কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্যুত হয় না।

নিজেদের জুতা প্রস্তুত ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে কড়াকাড়িভাবে সবুজ ব্যবসার মডেলের সঙ্গে যুক্ত থাকে টিম্বারল্যান্ড। এ কাজ তারা করে জ্বালানি- সাশ্রয়ী প্রস্তুতকারী প্রক্রিয়ায়, এবং সব সময় ব্যবহার করে পুনরুৎপাদিত ও নন- কেমিক্যাল সামগ্রী। প্রতি জোড়া জুতায় ‘পুষ্টি লেবেল’ চালু করেছে টিম্বারল্যান্ড। পণ্য সম্পর্কে ভোক্তার যা যা জানা প্রয়োজন, তার সব থাকে লেবেলে, যেমন কোথায় কিভাবে পণ্যটি প্রস্তুত হয়েছে, পরিবেশের ওপর এটি কেমন প্রাভাব ফেলেবে ইত্যাদি।

টিম্বারল্যান্ড চায় তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভোক্তা যেন লাভবান হয়। এ জন্য তার রয়েছে পাথ অব সার্ভিস, সার্ভিস স্যাবাটিক্যালস, ডিউরিং আর্থ ডে, এবং সার্ভ-এ-পালুয়া প্রোগ্রাম। পাথ অব সার্ভিসের অধীনে বিশ্বজুড়ে টিম্বারল্যান্ড কর্মচারীরা মানুষকে অর্ধ লক্ষ ঘণ্টা সেবা দিয়ে থাকে। তার ডিউরিং আর্থ ডে প্রোগ্রাম পরিবেশ সুরক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। যে সব ভোক্তা টিম্বারল্যান্ড থেকে ১৫০ ডলারের পণ্য কেনে, আর্থ ডে-র দিন তাদের সবার নামে একটা করে গাছের চারা রোপণ করে তারা।

পুনরুৎপাদনকারী কোম্পানি নন-কেমিক্যাল/ বায়োটেকনোলজি / এনার্জি/ হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রি ধরনের হয়ে থাকে সাধারণত। তার ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ডের পরিচয় থাকে যে পণ্য বাজারে ছাড়ে, তার ধরনের ওপর, যা তাকে নিজের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের কারণে বাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ দেয়। পুনরুৎপাদনকারীর ব্যবসা ছাড়া অপর উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবহারকারী, কর্মচারী ও জনগণকে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। পুনরুৎপাদনকারীরা চায় কর্মচারী ও ভোক্তাদের মধ্যে পৃথিবীকে বাঁচানোর মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিয়ে এনভায়রনমেন্টাল অ্যাম্বাসাডর বা পরিবেশগত দূত সৃষ্টি করতে।

এনভায়রনমেন্টাল অ্যাম্বাসাডর সৃষ্টির সাধারণ উপায় হলো সমাজ/ সম্প্রদায়ের মধ্যে পণ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। টিম্বারল্যান্ড বিশ্বের সেরা ইনভেন্টর বা পুনরুৎপাদনকারী বিবেচিত হতে পেরেছে তার ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। টিম্বারল্যান্ড পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য চায়, তার ওয়েব সাইটে তার সে কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এর আরেকটা উপায় হচ্ছে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যসমূহের মাধ্যমে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সফল হওয়া। টিম্বারল্যান্ডের লেবেল এ জন্য ভাল। পৃথিবীর উপকারার্থে টিম্বারল্যান্ডের পণ্য ভাল কেন, লেবেলে তার ব্যাখ্যা থাকে। এর মাধ্যমে সকল স্বেচ্ছাসেবামুলক কর্মকাণ্ডের কথা মানুষ জানতে পারে।

এরকম নামকরা কোম্পানিগুলোর মধ্যে আরও আছে প্যাটাগোনিয়া, হোল ফুডস মার্কেট, ফেটজার ভাইনইয়ার্ডস, ও হেরম্যান মিলার।

সহযোগিতা

উদ্ভাবক, বিনিয়োগকারী ও পুনরুৎপাদনকারীর মধ্যকার সহযোগিতা থাকা আবশ্যক। উদ্ভাবক, বিনিয়োগকারী ও পুনরুৎপাদনকারীরা পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে নিজ নিজ ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করে থাকে। গ্রিন টু গোল্ড-এ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, যে সব কোম্পানি সবুজ আন্দোলন করছে, তারা একাধিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে।

১. প্রকৃতিক সূত্রের ওপর নির্ভরতা

২. চলতি বিধি-বিধান উন্মুক্ত করা ৩. বিধি-বিধানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা

৪. মেধাবীদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার

৫. উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কম বাজার শক্তি

৬. ভাল পরিবেশগত অতীত রেকর্ড

৭. উচ্চ ব্র্যান্ড মেলে ধরা

৮. বড় পরিবেশগত প্রভাব

বিনিয়োগকারী ও পুনরুৎপাদনকারী, উভয়েই তাদের ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে তুলে ধরে। অন্যদিকে পুনরুৎপাদনকারী পরিবেশ-বান্ধব পণ্য উৎপাদন করে। পুনরুৎপাদনকারী একটা নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে কাজ করে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারী কাজ করে অনেকগুলো বাজার নিয়ে। প্রভাব জোরদার করার লক্ষ্যে তিন পক্ষের সবার বাজারে উপস্থিত থাকা চাই। এই সহযোগিতা পরিবেশ প্রশ্নে জনমত সৃষ্টি করে। হোল ফুডস মার্কেটের মতো পুনরুৎপাদনকারীর অনেক সময় লাগবে মুলধারায় সবুজ পণ্য নিয়ে আসতে। ওয়াল-মার্টের মতো বিনিয়োগকারীর প্রভাব ছাড়া সবুজ পণ্য নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই সীমিত থাকবে। পুনরুৎপাদনকারীদেরও উদ্ভাবকের প্রয়োজন হবে তাদেরকে সবুজ পণ্য সরবরাহ করার জন্য।

সবুজ পণ্য বাজারজাত করতে ক্রেতা টার্গেট করা

অনুধাবন করা জরুরি যে সবুজ পণ্যের বাজার সমপ্রকৃতির চেয়েও আরও বেশি কিছু। সবুজ পণ্য বাজারজাত করাকে চার ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন: ফ্যাশনপ্রবর্তক (ট্রেন্ডসেটার), মূল্য সন্ধানী (ভ্যালুসিকার্স), মানসম্মত পণ্যের জোড়া অনুসন্ধানী (স্ট্যান্ডার্ড ম্যাচার্স) ও সাবধানী ক্রেতা (কশাস বায়ার)। ট্রেন্ডসেটার হচ্ছে প্রথমদিকের বাজার, অন্যদিকে ভ্যালু-সিকার্স ও স্ট্যান্ডার্ড ম্যাচার্স হচ্ছে মূলধারার বাজার এবং সতর্ক ক্রেতা হচ্ছে উদ্যমহীন, ধীরে চলা ব্যক্তি। উল্লিখিত প্রতিটির পণ্যের মুনাফার প্রশ্নে তাদের প্রতিটির আলাদা আলাদা বিশ্বাস আছে, তাই তাদের বাজারে প্রবেশের পদ্ধতিও স্বভাবতই আলাদা হবে।

সতর্ক ক্রেতাদের ব্যাপারে বলতে হয় তাদেরকে বিব্রত না করলেই ভাল হবে। সবুজ পণ্য ভোক্তা সাধারণের কাছে পরিচিত করার স্তরে ট্রেন্ডসেটাররা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা নতুন পণ্যের প্রথম ক্রেতার ওপরেই শুধু নয়, বাজারের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারীও। তাদেরকে প্রমোটার বা উন্নতিবর্ধনকারী হিসেবে নিলে তারা নিজেদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়দের কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করতে সহায়তা করবে।

VALS-এর ওপর ভিত্তি করে ট্রেন্ডসেটারদের উদ্ভাবক অংশে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এরা কর্মঠ ভোক্তা, এদের কেনাকাটা থেকে সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পণ্য যদি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আটকে থাকে, তাহলে প্রবৃদ্ধি হবে না। সবুজ পণ্য যতক্ষণ পর্যন্ত না সবার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে, ততক্ষণ তার মুনাফা হবে সীমিত। এ জন্য বাজারে তাদের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্যই বড় বড় কর্পোরেশন তাদের মূল ব্র্যান্ডকে সবুজায়নের কাজ হাত দিয়েছে। টেক টাইড কোল্ড ওয়াটার ঠাণ্ডা পানিতে কাপড় ধোলাই করার জন্য।

সবুজ পণ্য কেনার বেলায় মূলধারার বাজার হয় যৌক্তিক। পণ্য সাশ্রয়ী মূল্যের হলে ভ্যালুসিকার্স বা উপযুক্ত মূল্যের খোঁজে থাকা দল পণ্য কেনে। এ জাতীয় ক্রেতারা সবুজ পণ্যের জন্য বেশি দাম দিতে রাজি হবে না। অতএব এই গোষ্ঠিকে ক্রেতা হিসেব পেতে হলে পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে হবে।

VALS-এর ব্যাখ্যায় যাদেরকে থিংকার বা চিন্তাশীল বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে বাজারের মূখ্য টার্গেট। তারা নতুন আইডিয়া গ্রহণ করতে প্রস্তুত। এমন এক ধরনের ক্রেতা তারা যে, কোনোরকম বাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ থেকে তাদেরকে সহজেই যুক্তির পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাই মার্কেটিয়ারদের এমনভাবে ছক সাজাতে হবে যাতে তাদের সামনে বিকল্প উপায় থাকে এবং

তারা বাজে পণ্য থেকে দূরে সরে যেতে পারে। সাধারণ পণ্যের সঙ্গে সবুজ পণ্য কেনার সুযোগ থাকলে উপযুক্ত মূল্যের খোঁজে থাকা দলটি সেদিকেই যাবে।

এরা রক্ষণশীল, বাস্তববাদী হয়ে থাকে। যা কেনে তার দাম ঠিক আছে কিনা, জিনিস কতদিন টিকবে ইত্যাদি প্রশ্নে নিশ্চিত হয়ে তবে কেনে। এই দলটিকে ক্রেতা হিসেবে পেতে হলে বাজারজাতকারীদেরকে লক্ষ রাখতে হবে তাদের পণ্য যেন সত্যিকারের মূল্যের চেয়ে মূল্যবান হয় এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া না ফেলে।

স্ট্যান্ডার্ড ম্যাচার্স বা মানসম্মত পণ্যের জোড়া অনুসন্ধানীরা বেশি রক্ষণশীল হয়। মানসম্মত হয়ে উঠতে পারেনি, এমন কিছু তারা কেনে না। পণ্যের জনপ্রিয়তাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। এই দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে সবুজ পণ্যকে বাজারের আর দশটা পণ্যের তুলনায় মানসম্পন্ন বলে বিবেচিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আজকাল পরিবেশ-বান্ধব যা কিছু হচ্ছে, তার বেশিরভাগই হচ্ছে সবুজ বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী।

এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাজ্য সরকার। আমেরিকান সরকারও বর্তমানে তা অনুসরণ করে চলেছে। এই দুটো দেশ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সরকারও নিজেদের গ্রিন বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ডের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সতর্ক-ক্রেতা বা কশাস-বায়াররা এত বেশি সন্দেহপ্রবণ যে তারা সবুজ পণ্য কেনা এড়িয়ে চলতে চায়। এদের মত পাল্টানো খুব কঠিন। যদিও সবুজ ব্যবসার বিষয়টি এখন সব মহলে স্বীকৃত।

একটা পণ্যকে বাজারে চালিত করতে পারার অর্থ হচ্ছে সেটিকে বাজারের সেগমেন্ট (খণ্ড) চেইনের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। পরিচিতি পর্বে বাজারজাতকারীদের উচিত সবুজ পণ্যকে পৃথকীকরণের মূল সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা। তবে প্রবৃদ্ধির স্তরে পৌঁছতে তাদেরকে মুখের কথার মার্কেটিং এবং প্রতারণা ও গোলক প্রবণতারও সৃষ্টি করতে হবে। জিওফ্রে মূরের ক্রসিং দ্য কাজম-এর মতে বাজারে ফাটল আছে, সেটাই পুরনো বাজারকে মূলধারার বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। সবুজ পণ্যকে এই ফাটল অতিক্রম করতে হবে এবং জনপ্রিয় হতে হবে। একটা পণ্য যখন পূর্ণতা প্রাপ্তির স্তরে পৌঁছে যায়, তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা জোরদার হয়। বাজারজাতকারীদের তখন সবুজ হওয়া ছাড়া আর কি উপায় ছিল, তা খুঁজে দেখতে হবে।

আমরা এই অধ্যায়ে মূল্যবোধ-চালিত কোম্পানিগুলোর কাম দামে পণ্য বিক্রি করে মুনাফা অর্জন, সুনামের অধিকারী হওয়া, এবং আরও বেশি কর্মঠ কর্মচারী নিয়োগ দেয়া প্রভৃতি নিয়ে সবুজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি। ডুপন্ট সবুজ আন্দোলনে উদ্ভাবকের ভূমিকা পালন করে অবদান রেখেছে। ওয়াল-মার্ট পালন করেছে বিনিয়োগকারীর ভূমিকা

অবদান রেখেছে পুনরুৎপাদনকারী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে। ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালনকারী এইসব কোম্পানি একই বাজারে যার যার পণ্য বাজারজাত ও সহযোগিতা করলে সবুজ বাজার অবশ্যই আরও শক্তিশালী হবে। বাজারে উল্লিখিত চার গ্রুপ- ট্রেন্ডসেটার, ভ্যালুসিকার্স, স্ট্যান্ডার্ড-ম্যাচার্স ও কশাস- বায়ারকে কোম্পানিগুলোকে পৃথক করতে হবে এবং সবুজ পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ সম্পর্কে জানতে হবে। যেসব কোম্পানি পরিবেশ টিকিয়ে রাখার অনুকূলে কাজ করে, তারা অবশ্যই বিষয়গুলো বিবেচনা ও অনুশীলন করে।

পণ্য মার্কেটিং কৌশল সকল ব্যবসায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। সরাসরি বিতরণের মডেল বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে ডেল কম্পিউটার শিল্পে একটা বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। ক্রেতা চাইলে তাদেরকে ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী কম্পিউটারের অর্ডার দিতে পারে এবং সরাসরি ঘরে বসে তা পেতেও পারে।

ডেল তার ভোক্তাদের সাথে, যারা তাদের মাল পুনরায় তাদের কাছে বিক্রি করত, তাদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। মিডলম্যানদের (দালাল বা কমিশনভোগী) এড়িয়ে চলার বিখ্যাত নীতির কারণে ডেলকে মিডলম্যান ও সাধারণ রিসেলাররা শত্রু বলে গণ্য করত। ডেলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রথমে তাদের ব্যবসার এই ধারাকে পাত্তা দিত না, কিন্তু পরে তাকে অনুসরণ করতে গিয়েও বিফল হয়। ডেলের এই একক, ব্যবসায়ীক পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সফল ও অপ্রতিদ্বন্দ্বি। ১৯৯৯ সাল নাগাদ ডেল ইন্টারনেটের এতবড় বিক্রেতা হয়ে ওঠে যে আমাজন.কম, ইবে আর ইয়াহু-র সম্মিলিত বিক্রির চেয়েও ডেলের বিক্রি ছিল অনেক বেশি।

কিন্তু ২০০৫ সালে সবকিছু অন্যরকম হয়ে যায়। ডেলকে হতবাক করে দিয়ে পৃথিবীও পাল্টে যায়। ব্যবসার বিকাশ থেমে পড়তে শুরু করে। ডেলের স্টক হোঁচট খায়। এর প্রথম কারণ, আমেরিকার বাজার সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। ধাক্কা সামাল দিতে বিশেষজ্ঞরা ব্যবসায় দালালদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ডেলের ওপর চাপ দিতে শুরু করে। তাদের অন্যতম ছিলেন সুনীল চোপড়া। তিনি যুক্তি দেখান, তখনকার বাজারে ক্রেতারা কম্পিউটারকে উপযুক্ত সম্পত্তি হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন এবং কাস্টমাইজেশন বা ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী জিনিস তৈরি করা নিয়ে তারা বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছেন না। চোপড়া পরামর্শ দেন ডেল হয় সরাসরি বা কারও মাধ্যমে, নয়ত রিসেলারদের মাধ্যমে হাইব্রিড মডেল বিক্রির চেষ্টা করুক। তবে যে মডেলই গ্রহণ করুক, মধ্যসত্ত্বভোগীদের মাধ্যমেই যেন করে।

ডেলের অগ্রগতি থেমে পড়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে কোম্পানিটি একমাত্র তার ভোক্তাদের সাথে সরাসরি সম্পর্কের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধের ওপরই বেশি নির্ভর করত। কিন্তু দেশের বাজার যখন আরও সম্প্রসারিত হয়; নতুন নতুন মডেলের কম্পিউটার বাজারে আসতে শুরু করে, ক্রেতারা সেসবের মধ্যে আকর্ষণীয় মডেলের অনেক কম্পিউটার খুঁজে পেল। ডেলের উচিত ছিল কম্পিউটার নির্মাতা অন্য সব দেশ; যেমন চীন, ভারতের সম্প্রসারণশীল বাজারের দিকে নজর রাখা। দুর্ভাগ্যবশত নতুন বাজারের বেশিরভাগ ক্রেতা অনলাইন কম্পিউটার কিনত না। হাই-টেক ইন্টারনেট ইন্টারফেসের চেয়ে তাদের হাই-টাচ হিউম্যান ইন্টারফেসের প্রতি আকর্ষণ বেশি ছিল। ফলে উঠতি বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলো শুধুমাত্র বিজনেস মডেল উৎপাদনকারী ডেল। তাছাড়া ডেলের জন্য অপরিহার্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বিজনেস মডেল; অপ্রত্যক্ষ (ইনডিরেক্ট) বিতরণ পদ্ধতি অনুসরণ করা।

২০০২ সালে কর্পোরেট ভোক্তাদের সমাধান প্রদানকারীদের’ মাধ্যমে ডেল তার অপ্রত্যক্ষ সরবরাহ শুরু করে, যদিও কর্তৃপক্ষ তা সে স্বীকার করেনি। কিন্তু ২০০৫ সালটি ছিল উগরে দেয়ার বছর। ডেল অনেক রাখঢাকের মাধ্যমে রিসেলারদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে, যদিও ডেলের ওপর প্রথমে আস্থা রাখতে পারেনি তারা। অবশেষে ডেলের এ উদ্যোগ ফল দিতে শুরু করে। ২০০৭ সাল নাগাদ বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে ডেলের বিক্রি যথেষ্ট বেড়ে যায়, যদিও কোনো অংশীদারিত্বের কথা অফিশিয়ালভাবে স্বীকার করা হয়নি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে ডেল তার অংশীদার- পরিচালিত ( পার্টনারডিরেক্ট) কর্মসূচির কথা প্রকাশ করে – তারা ১১,৫০০ জনকে নিয়ে অংশীদারী ব্যবসা শুরু করেছে এবং প্রতি সপ্তাহে আরও ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে নিচ্ছে।

এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে শেষের কয়েক বছর ডেল তার পুরনো ধারা, সরাসরি ভোক্তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার পুরনো পদ্ধতির রূপান্তর ঘটিয়ে চ্যানেল পার্টনারদের সাথে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক রিসেলারদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে ডেল, তাদের মতামত জানার চেষ্টা করে, নিজেদের পার্টনার অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের মিটিংয়ে যোগ দিতে আহবান জানায় তাদেরকে। সেসব মিটিংয়ে মাইকেল ডেল নিজে হাজির থেকে নিরলস ভাবে চ্যানেল পার্টনারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। আগে ডেল ভোক্তাদের যে গুরুত্ব দিত, ২০০৭ সালের শেষের দিকে চ্যানেল পার্টনারদেরকে সেই গুরুত্ব দিতে শুরু করে।

ডেলের এই তৎপরতা ব্যবসায়ীক বিশ্বের অস্তিত্বমান প্রতিপক্ষকে প্রতিফলিত করে। প্রযুক্তি ডেলকে সফল করে তোলে সরাসরি বিতরণের সুফল ঘরে তুলতে। কিন্তু প্রযুক্তি বৈশ্বিক প্রভাবকেও সক্ষম করে তোলে। মুনাফার সিংহভাগ তখন আর উন্নত বিশ্বে নয়, বরং উন্নয়নশীল বিশ্বের বাজারে চলে গেছে যেখানে প্রযুক্তি অ্যাডপশন বা পরিগ্রহণ তখনও মূলধারার সম্ভাবনায় পৌঁছতে পারেনি। উন্নয়নশীল বাজারে; যেখানে সনাতন বিতরণ পদ্ধতি কাজ না-ও করতে পারে, সেখানকার জন্য প্রয়োজন ছিল আলাদা ব্যবসায়ীক পদক্ষেপের। এইসব বাজারে সামাজিক, অর্থনৈতিক আর পরিবেশগত সমস্যা ছিল অন্তহীন এবং কোনো কোম্পানি একটা নতুন বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টায় হাত দেয়ার আগে সেগুলো চিহ্নিত করা জরুরি ছিল। অপরিচিত অঞ্চলে পা রাখতে গিয়ে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য হয়ে নতুন পার্টনারদের সাথে সহযোগিতা করতে হয়েছে।

উন্নত বিশ্বের বাজারও তখন সম্পূর্ণ আরেক ধরনের বাজারে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। পূর্ণ বিকশিত বাজার ছিল ঘটতে শুরু করা বিরাট পরিবর্তনের একটি ক্ষুদ্র সংকেত। সমাজ যত বেশি পরিশীলিত হচ্ছে, ভোক্তাদের চাহিদাও তত বেশি, ফলে মৌলিক প্রয়োজন হয়ে পড়ছে অমূখ্য বা গৌণ। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলোকে বেশি বেশি বিবেচনায় নিতে শুরু করে। জেমস স্পেথ এই পরিস্থিতিকে দেখেছেন ‘এরা অব পোস্ট-গ্রোথ সোসাইটি’ বা বিকাশ-উত্তর সমাজের যুগ হিসেবে। হতে পারে কাস্টমাইজেশন বা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী জিনিস সরবরাহের বিষয়টা আগামীতে আর আগের মতো গুরুত্ব বহন করবে না। এই বিকাশ-উত্তর পরিবর্তনের বিষয়টা ব্যবসার উন্নতির স্বার্থেই ডেল ও অন্যান্য কোম্পানির অনুধাবন করা জরুরি ছিল।

মার্কেটিং-এ চ্যানেল পার্টনার

চ্যানেল পার্টনার বা মাধ্যম অংশীদারদেরকে আমরা একটা জটিল সত্তা হিসেবে দেখি। সেগুলো হচ্ছে কোম্পানি, ভোক্তা আর কর্মচারীদের মিশ্রনে সৃষ্ট সঙ্কর। সেগুলো নিজ নিজ মিশন, রূপকল্প বা ভিশন, মূল্যবোধ ও ব্যবসার মডেলওয়ালা একেকটা কোম্পানিও বটে। তারা প্রয়োজন মেটাতে আসা ভোক্তা এবং নিজেদের চাহিদা মেটাতে চায়। সর্বোপরি তারা এন্ড-ইউজার বা ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রি করে এবং কর্মচারীদের মতো কাস্টমার ইন্টারফেস বা দুই ব্যবস্থার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া গঠন করে। তারা গুরুত্বপূর্ণ কেননা তারা একই সময়ে কোম্পানিসমূহের সহযোগী, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের এজেন্ট এবং সৃষ্টিশীল অংশীদারে পরিণত হয়।

সহযোগী হিসেবে চ্যানেল : জুটি নির্বাচন

চ্যানেল পার্টনারদের সাথে যে সব কোম্পানির ঠিকমত বনিবনা হয় না, তারা হয়ত পার্টনার বাছাই করার সময় সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করেনি। এমন চ্যানেল পার্টনার বাছাই করতে হবে যার উদ্দেশ্য-পরিচিতি-মূল্যবোধ প্রভৃতি হবে কোম্পানির নিজের উদ্দেশ্য-পরিচিতি-মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবি। উদ্দেশ্যের সম্পর্ক আছে উপযুক্ত ও সম্ভাবনাময় চ্যানেল পার্টনার খুঁজে বের করার সাথে এবং তা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা অপেক্ষাকৃত সহজ। পরিচিতির সম্পর্ক সম্ভাবনাময় চ্যানেল পার্টনার বাছাই করার সাথে, সে জন্য চাই একটু গভীর অনুসন্ধান। মূল্যবোধ নির্ণয় করা বেশ জটিল কারণ চ্যানেল পার্টনার সংস্থা নিজস্ব ধ্যান-ধারনা, বিশ্বাস ইত্যাদির ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করে।

বডি শপ তার শুরুর দিকে বেড়ে উঠতে পেরেছিল প্রধানত তার দোকানের বিশেষ সুবিধার কারণে। কোম্পানি গঠিত হয়েছিল পরলোকগত অ্যানিটা রডিকের সহজ-সরল চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে। প্রতিষ্ঠাতার সততা আর সরলতা কোম্পানির ব্যবসার প্রতিটি স্তরে স্তরে প্রতিফলিত হয়। এছাড়া তাদের পণ্যের নামকরণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার এবং সরবরাহকারীদের সাথে সৎ কাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমেও তা প্রতিফলিত হয়। রডিক যখন তাঁর দোকানে নিজের পণ্য বিক্রি করতেন, তখন কোনো সমস্যা হতো না কেননা মহিলা তখন প্রয়োজনে স্বাধীনভাবে ব্যবসার মূলস্রোত বহির্ভূত পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিন্তু যখন ব্যবসা সম্প্রসারণের অপরিহার্যতা দেখা দেয়, তখন তাকে চ্যানেল পার্টনারদের খোঁজে নামতে হয়।

অ্যানিটা রডিকের চ্যানেল পার্টনার নির্বাচনের কাজটিও ছিল একান্তই ব্যক্তিগত। চূড়ান্ত ইন্টারভিউ তিনি নিজে নিতেন এবং প্রতিটা ইন্টারভিউর সময় সম্ভাবনাময় চ্যানেল পার্টনারের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করতেন। তিনি বিশেষ করে এমন মানুষ খুঁজতেন যারা কেবল মুনাফাই নয়, ব্যতিক্রমী একটা কিছু করতে বেশি আগ্রহী। রডিক আবিষ্কার করেন, পুরুষদের চেয়ে নারীরা তাঁর মতো একই ধরনের সামাজিক ও পরিবেশগত মূল্যবোধে বেশি বিশ্বাসী। এ জন্য শুরুর দিকে বডি শপের ফ্র্যানচাইজ বা চ্যানেল পার্টনারদের ৯০ শতাংশই ছিল নারী। বডি শপের এই পদক্ষেপ ছিল প্রশ্নাতীত সফলতম। প্রথম এক দশকের মধ্যে বডি শপের বাৎসরিক বিকাশের হার ছিল ৫০ শতাংশ।

এর সাথে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বেন অ্যান্ড জেরি’স কোম্পানির ইউনিলিভারের অধিগ্রহণের আগেকার পার্টনারশিপের বিষয়টা তুলনা করে দেখুন। বডি শপের মতো বেন অ্যান্ড জেরি’সকেও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ঘরে তৈরি সাধারণ একটা পণ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল বেন অ্যান্ড জেরি’স, সেটা হলো আইসক্রিম। তাদের সুদূরপ্রসারী একটি ভিশন বা রূপকল্প ছিল পৃথিবীকে সুন্দর বাসস্থান করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানোর, তাই তারা ব্যবসার আগ্রাসী বিকাশে ততটা আগ্রহী ছিল না। তারা গুরুত্ব দিত কর্মচারীদের কারও ওপর দায়িত্ব দিতে যে কোম্পানির মূল্যবোধ বজায় রেখে ব্যবসা সম্প্রসারণে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

রাশিয়াতে আইসক্রিম যদিও খুবই জনপ্রিয় ছিল, তাই বলে সেই ব্যবসার লক্ষ্য নিয়েই বেন অ্যান্ড জেরি’স রাশিয়ায় যায়নি। মুনাফা করা আসল উদ্দেশ্য ছিল না তাদের, উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘদিনেরস্নায়ু যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও রাশিয়ার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সহায়তা করা। ১৯৯০-এর দশকে বেন অ্যান্ড জেরিস যখন সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়ার মাটিতে পা রাখবে, তখন তারা এমন একজনকে আমেরিকা থেকে নিয়োগ দেয় যার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়। তার নাম ডেভ মোরস। কিন্তু মোরসের একার পক্ষে কাজটা সম্ভব ছিল না। এ জন্য তার চ্যানেল পার্টনারের প্রয়োজন ছিল।

রাশিয়ায় সে সময় কোনো বিদেশী ব্র্যান্ডের বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করার মতো উপযুক্ত চ্যানেল পার্টনার খুঁজে পাওয়া ছিল খুব দুঃসাধ্য। সম্ভাবনাময় পার্টনারের অভাব ছিল না যদিও, কিন্তু তাদের কেউ বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ থাকার বিষয়টা বুঝত না। সম্ভাবনাময় চ্যানেল পার্টনাররা ছিল কেবলই উচ্চাভিলাষী, মুনাফালোভী কিছু প্রতিষ্ঠান। যেগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য আগ্রাসী প্রবৃদ্ধির পিছু ধাওয়া করা। বেন অ্যান্ড জেরি’স তাদের মূল্যবান পার্টনার হতে পারে এ বিশ্বাস তাদের ছিল, কিন্তু সেটারও যে কিছু মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল, তা তারা বুঝত না। অনেক বাছবিচারের পর তারা ইন্টারসেন্টার কো অপারেটিভকে শেষ পর্যন্ত পার্টনার করে। কিন্তু একদম শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাদের জুটি উপযুক্ত হয়নি। বেন অ্যান্ড জেরি’স ও তার চ্যানেল অংশীদার দু’টো ভিন্ন ভিন্ন পথে যাচ্ছে। তাদের ব্যবসায়িক মূল্যবোধ সঠিক লাইনে এগোচ্ছে না। ইন্টারসেন্টার কোঅপারেটিভ চায় তাৎক্ষণিক সাফল্য, মস্কোয় ব্যবসা শুরু করতে না করতে জেঁকে বসতে। কিন্তু বেন অ্যান্ড জেরি’স কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তারা যেমন আমেরিকার ছোটো শহর ভারমন্টে ব্যবসা শুরু করেছিল, রাশিয়াতেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল পেত্রোজাভদস্ক নামের ছোটো শহরে। এছাড়া ঘুষ দেয়ানেয়ার প্রশ্নেও তাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধীতা ছিল। রাশিয়াতে সে সময় ঘুষ ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক। তার ওপর ইন্টারসেন্টার কো অপারেটিভের আইসক্রিম তৈরির পরিবেশবান্ধব উপাদানসমূহও বেন অ্যান্ড জেরি’স ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশিত মানের চেয়ে অনেক নিচু মানের ছিল।

রাকহ্যাম, ফ্রিয়েডম্যান ও রাফ অংশীদারিত্বের মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অংশীদারী ব্যবসার সাফল্যের জন্য তারা তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। প্রথম, ব্যবসার দুই অংশীদারকে পরস্পরকে জিজ্ঞেস করতে হবে, তারা উভয়ই ব্যবসায় টিকে থাকার মতো মুনাফায় সন্তুষ্ট থাকতে চান কি না। ভাল অংশীদারিত্বের সৃষ্টি হয় আড়াআড়িভাবে, খাড়াভাবে নয়। উভয় অংশীদারকে লাভের সমান সমান ভাগ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে তদন্ত করে দেখতে হবে যে তারা নিজেদের প্রস্তুত পণ্যের মান যথাযথভাবে সংরক্ষণ করছেন কি না, এবং তৃতীয়ত, উভয় পক্ষকেই তার অংশীদারের মূল্যকে অনুধাবন করতে হবে।

টনি হাইতাও কাই, জগমোহন সিং রাজু ও জেড জন ঝাং, এরা তিনজনই নিজেদের গবেষণায় অংশীদারিত্বের মূল্যবোধের গুরুত্বকে নিশ্চিত করেছেন। যখন কোম্পানি ও তার চ্যানেল পার্টনারদের মধ্যে সততার মূল্যবোধের অস্তিত্ব বিরাজ করে, তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার প্রশ্নে একমত হওয়া যায়। একটা কোম্পানি যখন তার পণ্যের ন্যায্য দাম নির্ধারণ করে, তখন তার চ্যানেল পার্টনারদেরও উচিত বাজারে সেই মূল্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। এরকম পার্টনারশিপ কোম্পানি আর চ্যানেল পার্টনারদের মধ্যেকার স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়ক হবে।

মার্কেটিং করার ক্ষেত্রে একটা কোম্পানির প্রথম পদক্ষেপ হবে চ্যানেল পার্টনারদের কাছে নিজের মূল্যবোধকে স্পষ্ট করা, যাতে তাদের কাছে তাদের নিজেদের মূল্যবোধও স্পষ্ট হয়।

দুই ব্যবসায়িক অংশীদারের সহযোগিতা হচ্ছে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মতো। উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ ও পরিচিতির প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা এবং পরস্পরের মধ্যে আইনগত কন্ট্রাক্টে স্বাক্ষর করে নেয়া একান্ত জরুরি। এ জন্যই ব্যবসার ক্ষেত্রে অ্যানিটা রডিকের দৃষ্টান্ত; ব্যক্তিগত উদ্যোগই সবার সেরা।

চ্যানেল পার্টনার যেন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের এজেন্ট

ব্যবসা বিকাশের জন্য কোম্পানির প্রয়োজন তার চ্যানেল পার্টনাররা ভোক্তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। অর্থাৎ কোম্পানি নিজের পরিবেশকদের ওপর বেশিরকম নির্ভরশীল থাকবে নিজের মূল্যবোধ বাজারজাত করার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যখন কোম্পানি এসব বিষয় সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে না। উদাহরণ হিসেবে মারিয়া ই ইনকর্পোরেটেডের দিকে নজর দেয়া যেতে পারে।

২০০৭ সালে আমেরিকায় যত ফার্নিচার বিক্রি হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেকই হয়েছে মারিয়া ই-র চ্যানেল পার্টনার বা ফার্নিচার রিটেইলারদের মাধ্যমে। অন্যান্য আসবাব প্রস্তুতকারকদের মতো উচ্চ মধ্যবিত্তদের কাছে মারিয়া ই-র গুরুত্বপূর্ণ তিন খুচরা বিক্রেতা; ক্রেট অ্যান্ড ব্যারেল, রুম অ্যান্ড বোর্ড ও ম্যাগনোলিয়া হোম থিয়েটার, তারা সেসব বাজারজাত করেছে। কোম্পানির নজর ছিল একমাত্র পরিবেশ-বান্ধব পণ্য নির্মাণের দিকে। কোম্পানির ব্যবসার আদর্শ সবুজে বাঁচুন-এর মূল্যবোধ সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, বিশেষ করে টেকসই জিনিসপত্রের ব্যবহার ও পরিবেশ-বান্ধব সরবরাহকারীদের সাথে পার্টনারশিপ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।

দুর্ভাগ্য যে ক্রেতাদের সাথে মারিয়া ই-র সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না, তাই নিজের ‘সবুজ’ বার্তা পাঠাতে তাকে চ্যানেল পার্টনারদের ওপর নির্ভর করতে হতো। সবুজের মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং আসবাবপত্র শিল্পে পরিবেশ- বান্ধব আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মারিয়া ই স্বয়ং তার খুচরা বিক্রেতাদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। ভোক্তা সাধারণের কাছে মারিয়ার ব্র্যান্ড অবস্থান জানান দেয়াই একমাত্র দায়িত্ব ছিল না তার চ্যানেল পার্টনারদের, বরং পরিবেশ-বান্ধব আসবাব ব্যবহার করার লাভ ইত্যাদি বোঝানোর দায়িত্বও ছিল। সাধারণত সবুজ পণ্যের দাম বেশি বলে ধারণা ছিল ভোক্তাদের। কিন্তু মারিয়া নির্ভর করতেন তার চ্যানেল পার্টনাররা সবাইকে বোঝাবে যে তাদের ধারণা ঠিক নয়। চ্যানেল পার্টনারদেরও নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল যে মারিয়ার পণ্য দামের দিক থেকে অন্য আসবাবের সাথে প্রতিযোগিতামূলকই আছে।

এর বিপরীতে, একটি বড় কনজিউমার প্যাকেজড় গুডস (সিপিজি) কোম্পানি কখনও কখনও ভোক্তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখে, যদিও তাদেরকেও চ্যানেল পার্টনারদের ওপরেই নির্ভর করতে হয় মালামাল সরবরাহের জন্য। স্টোনিফিল্ড নামের এক জৈব দই জাতীয় পণ্য উপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তার সমস্ত মালামাল সরবরাহকারীদের মাধ্যমে প্রাকৃতিক খাদ্যের দোকান ও সুপার মার্কেটসমূহে বাজারজাত করে থাকে। তারপরও তারা ভোক্তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রেখে চলার চেষ্টা করে নিজেদের সামাজিক ও পরিবেশগত মিশন সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত রাখতে। কোম্পানিটি তার বক্তব্য প্রচার করতে ভোক্তাদের ইউটিউবের মাধ্যমে বার্তা পাঠায়।

চ্যানেল অংশীদারদের মাধ্যমে নিজেদের ব্র্যান্ডের কাহিনী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন বিরামহীন ব্যক্তিগত উদ্যোগ। যখন তা কাজ করে না, তখন কোম্পানির উচিত কোনো ধরনের সংকেতের মাধ্যমে পার্টনারদের প্রভাবিত

করা। নিজেদের কথা সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে প্রচার করতে কোম্পানিগুলো তাদের প্রতি ক্রেতার আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে পারে। যখন বেশি সংখ্যক ভোক্তা চ্যানেল পার্টনারদের শো রুমে কোম্পানির পণ্য দেখতে ভিড় জমাবে, তখন সেটা হবে পার্টনারদের জন্য একটা বড় ধরনের সংকেত- এই ব্র্যান্ড বাজারজাত করলে তারা লাভবান হবে।

অনেক ক্ষেত্রে ভোক্তারাই তাদের চ্যানেল পার্টনার হয়ে থাকে। এটা বিশেষ করে সত্যি হয় যখন উন্নয়নশীল বাজারে নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের মাঝে পণ্য বিতরণ করা হয়। উন্নয়নশীল দেশের গরীবদের মাঝে বাজারজাতকরণের সবচেয়ে বড় ইসু হচ্ছে প্রবেশাধিকার পাওয়া। প্রবেশাধিকারের দুটি আবশ্যিক উপাদান; যেগুলোর অভাব সবচেয়ে প্রভাবিত করে, তা হলো স্থান (বিতরণ) এবং প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমে উৎসাহ দেয়া (প্রমোশন)। অনেক পণ্য ও তথ্য বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের গরীব ক্রেতাদের মাঝে যখন খুশি তখন পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় না। চ্যানেলিংয়ের মাধ্যমে এসব ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়া বাজারে প্রভাব বিস্তার করবে ও একই সাথে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটাবে। ভাসানি ও স্মিথ এটাকে বলেন সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ বিতরণ বা সোশ্যালি রেসপন্সিবল ডিস্ট্রিবিউশন।

ইনডিয়া একটি দেশ যেখানে এই সোশ্যালি রেসপন্সিবল ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশটি দারিদ্র্য উৎপাটনের জন্য সর্বস্তরে কঠিন সংগ্রাম করে আসছিল। এ বিষয়ে দেশটির যে পরিসংখ্যান, তা রীতিমত সম্ভাবনাময়। দারিদ্র্যের মাঝে বসবাসকারী ইনডিয়ানদের সংখ্যা ১৯৮১ সালে ছিল ৬০ শতাংশ, ২০০৫ সালে তা হয়েছে ৪২ শতাংশ। দেশটির এই সাফল্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক নিহিত আছে গরীবদের কাছে পৌঁছানোর উপায় ক্রমবৃদ্ধির মাঝে। দেশটির ভোক্তা সাধারণ বছরে সব মিলিয়ে যা খরচ করে, তার ৮০ শতাংশই পল্লী অঞ্চল থেকে আহরিত, এই সত্য থেকেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় যে সব কোম্পানি ইনিডয়াতে কাজ করে, বিতরণের ক্ষেত্রে তারা হিউম্যান নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ITC ও হিন্দুস্তান লিভার। এই দুই প্রতিষ্ঠান দরিদ্রদের পার্টনার করে তাদের মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলে নিজেদের পণ্য বিতরণ করার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ITC তার e-Choupal উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। e- Choupal-এর মাধ্যমে কৃষকরা আবহাওয়া ও শস্যের বাজারদর জানতে পারে এবং দালালদের মধ্যস্থতা ছাড়াই নিজেদের ফসল সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে পারে। ওঞঈ ও নিজের কৃষক পার্টনারদের সুবিধার্থে ঈযড়ঢ়ধষ ঝধধমধ নামে একটা মিনি মল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে যার মাধ্যমে পণ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সেবাও দেয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে হিন্দুস্তান লিভার পল্লীর নারীদেরকে নিজেদের পণ্য বিক্রি করার সুযোগ করে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তা করেছে। তাদেরকে বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠান দু’টি নিজেদের সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ মূল্যবোধ বিক্রি করছে তাদেরই চ্যানেল পার্টনারদের কাছে, যারা মূলত তাদেরই ভোক্তা।

ITC ও হিন্দুস্তান লিভার যা করছে তা সহজেই বোধগম্য, কেননা ও দেশের ৮৭ শতাংশ ক্রেতা জিনিসপত্র কেনে তাদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের অনুমোদন সাপেক্ষে। এ জন্যই ইনডিয়াতে সাধারণভাবে সমকক্ষের মধ্যে পণ্যদ্রব্য বিক্রির কৌশল প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, বিশেষ করে লক্ষ্য যখন থাকে পল্লী অঞ্চলের বাজার।

নতুন বিকাশমান বাজারসমূহে পণ্য বিতরণ ব্যবস্থা নির্ভর করে বেশি বেশি চ্যানেল পার্টনারের নেটওয়ার্কের ওপর। উদ্ভাবনী বিতরণ ব্যবস্থার মডেল গেড়ে বসে আছে ভোক্তা সাধারণের উদীয়মান গোষ্ঠীবদ্ধতার মধ্যে। ভোক্তার ভূমিকা কেবল ব্র্যান্ডের অগ্রগতিতে সহায়তা করার মধ্যেই সীমিত থাকে না, তা বিক্রি পর্যন্তও প্রসারিত থাকে। ইনডিয়ার মতো বিশাল বাজারের বেলায় চ্যানেল পার্টনাররাই স্বতন্ত্র ভোক্তা। তারচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চ্যানেল পার্টনাররা হয় একেকটা ছোটো ছোটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যেগুলো স্থানীয় ভোক্তা সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখে এবং তাদের মাঝে সহজে গমনাগমন করতে পারে। এইসব চ্যানেল পার্টনার হচ্ছে সেরা মাধ্যম যারা ব্র্যান্ডের কাহিনী ভোক্তাদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে পারে কেননা তাদের যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। ভোক্তারা তাদের কথা শোনে। ডেলের মতো কোম্পানি, যারা বিকাশমান বাজারের খোঁজে থাকে, তারা এমন উদীয়মান ধারাকে আলিঙ্গন করবেই।

চ্যানেল সৃষ্টিশীল বন্ধুর মতো : সম্পর্কের ব্যবস্থাপক

উচ্চতর মার্কেটিং-এ ক্ষমতার মালিক ভোক্তা। তবে দুর্ভাগ্যবশত ভোক্তাদের সাথে সব কোম্পানির সরাসরি যোগাযোগ থাকে না। তাদের ও ভোক্তা শ্রেণীর মাঝখানে একটা মধ্যস্থতাকারী গ্রুপ থাকে যারা এই যোগাযোগ রক্ষার কাজটা করে থাকে। তারাই চ্যানেল পার্টনার। তারা কোম্পানি উৎপাদিত পণ্য বাজারে কেবল বিতরণই করে না, ভোক্তার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কেও কোম্পানিকে অবহিত করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চ্যানেল পার্টনারদেরকে প্রস্তুতকারকদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। নমুনা হিসেবে বলা যেতে পারে, আইটি শিল্পে প্রস্তুতকারকদের তুলনায় ভ্যালিউ-অ্যাডেড রিসেলারদের সাথে ভোক্তাদের সম্পর্ক ভাল আর ঘনিষ্ঠ থাকে। কারণ অনেকের ধারণা প্রস্তুতকারকরা কেবল প্রস্তুতই করে, আর রিসেলাররা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে।

স্বভাবতই রিসেলারদের শ্রমের ফসল হিসেবে কোম্পানির পণ্যের চাহিদা বাড়ে, তাই চ্যানেল পার্টনাররা দাবি করতে থাকে কোম্পানি যেন তাদের স্বার্থ আরও বেশি করে বিবেচনা করে। যেমন, পণ্যদ্রব্য বিক্রির পরিমাণ বাড়ানোসহ নানান ক্ষেত্রে চ্যানেল পার্টনারদের অবদান কতখানি, কোম্পানিগুলোর বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, খুচরা পর্যায়ের সমবায় ভিত্তিক বিক্রির প্রক্রিয়ায়, ইন-স্টোর প্রচারণায় এবং খুচরা বিক্রির প্রতিটা আউটলেটে ব্র্যান্ডের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তারা যেন তৎপর থাকে। সবশেষে কোম্পানিকে অবশ্যই তার চ্যানেল পার্টনারদের মনোভাব ও সন্তুষ্টির দিকটায় নজর রাখতে হবে।

কোম্পানি আর চ্যানেল পার্টনারদের মাঝে সমন্বয়ের এই ধারণা বিশেষ করে সেইসব ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেসব ক্ষেত্রে চ্যানেলসমূহ মূল্যবোধের শেকলের জোড়া হিসেবে ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করেছে- বিশেষ করে সেই কেন্দ্রবিন্দুতে, যেখানে চ্যানেল আর কোম্পানিগুলো ভোক্তার আস্থা অর্জন ও মালিকানা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে আছে। মূল্যবোধের শেকলে এরকম সমন্বয় না থাকলে কোম্পানি আর চ্যানেল পার্টনারদের মুনাফার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্ভবত পণ্ডশ্রমে পরিণত হতো লাভের ঘরে শূন্য থাকত বলে।

কোম্পানি-চ্যানেল সমন্বিত কার্যক্রম সাধারণত একটি কোম্পানি ও তার চ্যানেল পার্টনারদের পারস্পরিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। বিশেষ করে খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে। সম্পর্ক যত জোরদার হতে থাকে, ততই তারা সংশ্লিষ্ট শিল্পের শেকলের অন্যান্যদের সাথে সমন্বিত হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় আছে নিয়মিতভাবে তথ্য বিনিময় ও যৌথ কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ। উভয়ের পার্টনারশিপ যখন সামনের স্তরের দিকে এগোতে থাকে, তখন তাদের মূল্যবোধ এক হয়ে যায় এবং তখন আমরা কোম্পানি আর চ্যানেল পার্টনারের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পাই না।

যখন সৃষ্টিশীল চ্যানেল পার্টনারশিপের প্রশ্নে আসে, তখন আমরা চার স্তরের উৎকর্ষতা দেখতে পাই। একটা কোম্পানি, একেবারে প্রাথমিক স্তরের; নির্ভর করে থাকে একটিমাত্র চ্যানেলের ওপর। একে বলে সিঙ্গেল স্টেজ চ্যানেল। অনেক কোম্পানি বাজারে আসে মুষ্টিমেয় কিছু আঞ্চলিক সেটিং নিয়ে, যাতে তাদের সমস্ত বিক্রি তারা নিজেরাই করে অথবা তাদের একমাত্র চ্যানেল পার্টনার করে। কোম্পানির আকার যখন বড় হতে থাকে, তখন তার পরিবেশকের সংখ্যা ও তার ব্যবসার পরিধি, দু’টোই সম্প্রসারিত হতে থাকে। এ ব্যবস্থায় সাধারণত পরিবেশক ও চ্যানেল পার্টনারদের মাঝে সংঘাত সৃষ্টি হয়।

দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে মাল্টি চ্যানেল স্টেজ, যার অধীনে কোম্পানি একসঙ্গে অনেক পরিবেশক ও চ্যানেলের কাছে পণ্য বিক্রি করে, তবে সে ক্ষেত্রে পণ্য, পণ্যের খণ্ডিত অংশ বা ভৌগলিক সীমারেখা মানা হয় না। আরও অগ্রসর বিতরণ ব্যবস্থায় চ্যানেলের সাথে চ্যানেলের সংঘাতের সমস্যাকে মাথায় রেখে কোম্পানি তার বাজারকে অঞ্চল, কনজিউমার ও পণ্য অনুযায়ী ভাগ করে দেয়। প্রতিটি সরবরাহকারী বা চ্যানেলকে এলাকা ভাগ ভাগ করে দেয় ব্যবসার উন্নয়নে।

তৃতীয়টা হচ্ছে অঞ্চল ভিত্তিক চ্যানেল, যাতে কোম্পানি সুস্পষ্ট সীমানা ও বিতরণকারীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু আইন করে দেয় এবং চ্যানেলগুলোকে নির্দেশ দেয় সংঘাত এড়িয়ে চলতে। বেশিরভাগ অগ্রগামী বিতরণ ব্যবস্থায় একটি কোম্পানির বিভিন্ন চ্যানেলের ডিভিশন অব টাস্ক ভাগ করে দেয়া দায়িত্ব থাকে। এই ডিভিশন অব টাস্কের মধ্যে অনেকগুলো ভিন্ন ধরনের চ্যানেল সহাবস্থান করতে পারে একটা খণ্ডিতাংশ বা আঞ্চলিক বাজারে। একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করার পরিবর্তে চ্যানেলগুলো পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।

চতুর্থ স্তর হচ্ছে ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি-চ্যানেল স্টেজ বা সমন্বিত বহু-চ্যানেলের স্তর, যাতে একটি কোম্পানি বিভিন্ন চ্যানেলের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দেবে। মাল্টিপল বা বহুধা বিভক্ত চ্যানেল একটি আঞ্চলিক বাজার বা খণ্ডিত বাজারে ব্যবসার জন্য প্রতিযোগিতার বদলে একসাথে কাজ করার মাধ্যমেও সহাবস্থান করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে একটি কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বহুধা বিভক্ত চ্যানেলের মধ্যে কাজ বরাদ্দ করে দিতে পারে; একটা ওয়েব সাইটকে চাহিদা উৎপন্ন করতে, তার নিজস্ব ভাণ্ডারকে ভোক্তার অভিজ্ঞতা মঞ্চায়ন করতে, রিসেলারদের সরবরাহ ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে এবং একটি সেলস বাহিনীকে কর্পোরেট ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে এবং নিকটবর্তী রিসেলারদের হাতে তুলে দিতে। কোম্পানিগুলোর চেষ্টা করা উচিত সবচেয়ে অগ্রগামী এই সমন্বয় ব্যবস্থা অর্জন করার। এই সমন্বিত মাল্টি-চ্যানেল স্টেজে কোম্পানি ও তার চ্যানেল পার্টনাররা কোনোরকম সংঘাত ছাড়াই ভোক্তার সেবা করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে পাবে।

চ্যানেল ব্যবস্থাপনা শুরু হয় সঠিক চ্যানেল পার্টনার খুঁজে বের করার মধ্য দিয়ে যার উদ্দেশ্য, পরিচিতি এবং চূড়ান্ত মূল্যবোধ অভিন্ন। সুসংগত মূল্যবোধওয়ালা অংশীদাররা ভোক্তাদের কাছে কাহিনী পৌঁছে দিতে পারবে অনায়াসে। অংশীদারিত্বকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে কোম্পানিগুলোর উচিত অংশীদারদের সাথে সমন্বয় ঘটানোর যাতে কাহিনীতে সত্যশীলতা আনা যায়।

ধন্যবাদ সহ-

রবার্ট কিয়োসাকি
রীচ ড্যাড পুওর ড্যাড,
নিউ ইয়র্ক টাইমস্ ব্রেস্ট সেলার
বইয়ের লেখক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *