রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড – ১

প্রথম পরিচ্ছেদ

ধনীদের অর্থ আবিষ্কারের কাহিনি

ধনীদের অর্থ আবিস্কারের বিষয়ে সবচাইতে বেশি শিক্ষা পেয়েছিলেন রবার্ট কিয়োসাকি। তিনি দুই বাবার কাছ থেকে জেনেছিলেন অর্থোপার্জনের শিক্ষা মূলত কেমন হওয়া আবশ্যক। তাঁর উল্লেখিত দুই বাবার একজন ছিলেন ধনবান এবং অন্যজন ছিলেন গরীব। অর্থোপার্জন বিষয়ে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ ফারাক লক্ষ্য করছিলেন কিয়োসাকি। আমরা তাঁর বাচনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সেই সব কাহিনি শুনব- যাতে অর্থ আবিষ্কারের নানা কৌশল সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।

রবার্ট কিয়োসাকি একজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ, লেখক, শিল্পোদ্যোক্তা, অর্থ আবিষ্কারের বিষয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস্ বেস্ট সেলার্সের ‘রীচ ড্যাড পুত্তর ড্যাড’ সিরিজের প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক। তিনি অতি সহজ ও সাবলীল উপস্থাপনার মাধ্যমে অর্থ আবিস্কারের বিষয়ে চমকপ্রদ কৌশলের বর্ণনা দিয়েছেন। ১৯৯৫ সালের শুরুতে সিঙ্গাপুরের একটি কাগজে যখন তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ঠিক তখনকার অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি উদ্ধৃতি টেনেছিলেন। যখন ১৯৯৫ সালে আমি সিঙ্গাপুরের এক খবরের কাগজে একটা ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছিলাম। অল্পবয়েসী মহিলা রিপোর্টারটি ঠিক সময়ে এসেছিলেন এবং তক্ষুণি ইন্টারভিউ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমরা একটি বিলাসবহুল হোটেলের লবিতে বসেছিলাম আর কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আমার বিঙ্গাপুরে আসার কারণ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমার জিগ জিগলারের সাথে একই জায়গায় বক্তৃতা দেবার কথা ছিল। তিনি প্রেরণার বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, আর আমি ‘ধনীদের গোপন রহস্য’র বিষয়ে বলছিলাম।

‘একদিন আমিও আপনার মত সবচেয়ে বেশি- বিক্রীত লেখক হতে চাই’-উনি বলেছিলেন। আমি তাঁর কাগজে লেখা কয়েকটি রচনা দেখেছিলাম এবং প্রভাবিত হয়েছিলাম। ওঁর একটা দৃঢ় এবং স্বচ্ছ লেখার কায়দা ছিল। তার লেখাগুলো পাঠকের উৎসাহ ধরে রাখতে পারতো।

‘আপনার লেখার কায়দা তো দারুণ,’ আমি উত্তরে বললাম। ‘আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে আপনাকে কে বাধা দিচ্ছে?’

‘আমার কাজ মনে হয় কোথাও পৌঁছায় না,’ উনি ধীরে ধীরে বললেন। ‘সবাই বলে আমার উপন্যাসগুলো দারুণ কিন্তু কিছু হয় না। আমি তাই কাগজের সাথে চাকরিটা করে চলেছি। অন্ততপক্ষে এটা আমার বিল ভরতে সাহায্য করে। আপনি কি কিছু পরামর্শ দেবেন?’

‘হ্যাঁ, বলছি।’ আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম। ‘আমার এক বন্ধু সিঙ্গাপুরে একটা স্কুল চালান ঐ স্কুলে লোকেদের বিক্রি করতে শেখায়। তিনি সিঙ্গাপুরের অনেক বড় করপোরেশানের জন্য বিক্রিতে প্রশিক্ষণের কোর্স চালান আর আমার মনে হয় তার কোনো একটা কোর্সে যোগদান করলে আপনার কেরিয়ার খুব ভালভাবে বিকশিত হবে।’

তিনি একটু অস্বস্তি বোধ করছিলেন।

‘আপনি কি বলছেন আমি বিক্রি করা শেখার জন্য আবার স্কুলে যাবো?’

আমি মাথা নাড়লাম।

‘আপনি আন্তরিকভাবে বলছেন?’

আবার আমি মাথা নাড়লাম ‘এতে ভুল কোথায়?’ এবার আমি একটু পিছিয়ে গেলাম। উনি কোনও কারণে বিরক্ত হয়েছেন আর আমার মনে হচ্ছে আমি কিছু না বললেই পারতাম। আমি ওঁকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম, এখন দেখছি আমি নিজের বক্তব্যকেই বাঁচানোর চেষ্টা করছি।

‘আমার ইংরাজি সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রী আছে। বিক্রেতার কাজ শিখতে আমি স্কুলে যাবো কেন? আমি একজন পেশাদার। আমি স্কুলে একটা পেশায় প্রশিক্ষণ নেবার জন্য গিয়েছিলাম বিক্রেতা হতে চাইনি। আমি সেলসের লোকেদের ঘৃণা করি। তারা শুধু অর্থ চায়। তাহলে বলুন আমি বিক্রি করা শিখবো কেন?’ তিনি জোরে জোরে তার ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। ইন্টারভিউ শেষ।

কফি টেবিলের উপর আমার আগে লেখা একটি সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বই পড়েছিল। আমি ওটা তুলে নিলাম সাথে সাথে ওর লিগ্যাল প্যাডে লেখা নোটগুলোও।

‘আপনি কি এটা দেখতে পাচ্ছেন?’ আমি তাঁর নোটগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

তিনি নোটগুলো দেখে একটু বিভ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘কি?’

আবার আমি ইচ্ছা করেই তার নোটের দিকে ইঙ্গিত করলাম। তাঁর প্যাডে উনি লিখেছিলেন, ‘রবার্ট কিওসাকি, সবচেয়ে বেশি বিক্রীত লেখক।’

‘এটাতে লেখা আছে সব থেকে বেশি বিক্রীত লেখক, সব থেকে ভাল লেখক নয়’-ওর চোখ তক্ষনি বড় বড় হয়ে গেল।

“আমি একজন অতি বাজে লেখক। আপনি একজন মহান লেখিকা। আমি সেলস স্কুলে গেছি। আপনার মাস্টার ডিগ্রী আছে। এগুলোকে একসাথে করুন, আর আপনি একজন ‘সব থেকে বেশি বিক্রীত লেখক,’ আর ‘সব থেকে ভাল লেখার লেখক’ পেয়ে যাবেন।”

তাঁর চোখে রাগ জ্বলে উঠলো। ‘আমি কোনদিন বিক্রি করতে শেখার জন্য অত নিচু হতে পারবো না। আপনাদের মত লোকেদের লেখার কোনো অধিকার নেই। আমি একজন পেশাগত শিক্ষাপ্রাপ্ত লেখিকা আর আপনি একজন বিক্রেতা। এটা ঠিক নয়।’

তাঁর বাকি নোটগুলো তিনি সরিয়ে রাখলেন আর তাড়াতাড়ি বিরাট কাচের দরজা ঠেলে সিঙ্গাপুরের আর্দ্র সকালে বেরিয়ে গেলেন।

পরের দিন সকালে তিনি আমার অনুকূল সুন্দর লেখাই লিখেছিলেন।

এই পৃথিবী বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান শিক্ষিত আর সহজাত গুণসম্পন্ন মানুষে পূর্ণ। আমরা তাদের প্রতিদিন দেখি। তারা আমাদের চারপার্শেই আছে।

কয়েকদিন আগে, আমার গাড়িটা ভাল চলছিল না। আমি একটা গ্যারেজে দাঁড়িয়েছিলাম, এক অল্পবয়সী মিস্ত্রী সেটা নিমেষেই ঠিক করে দিয়েছিল। সে শুধু ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনেই গোলমাল কোথায় তা বুঝতে পেরেছিল। আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। দুঃখের কথা হল প্রতিভাই যথেষ্ট নয়।

স্বপ্ন প্রতিভার লোকেদের উপার্জন করতে দেখে আমি সবসময় বিস্মিত হয়ে যাই। আমি কদিন আগেই শুনেছিলাম পাঁচ শতাংশের চেয়ে কম আমেরিকানরা বছরে ১,০০,০০০ ডলারের চেয়ে বেশি রোজগার করে। আমি বেশ কিছু উজ্জ্বল, উচ্চশিক্ষিত লোকেদের জানি যারা বছরে ২০,০০০ ডলারের চেয়ে কম রোজগার করেন। একজন ব্যবসার কনসালটেন্ট, যিনি ডাক্তারী ব্যবসায় বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন, আমায় বলেছিলেন বেশ কিছু ডাক্তার, ডেন্টিস্ট আর কাইরোপ্র্যাকটররা (ফোঁড়া ইত্যাদির ডাক্তার) আর্থিক সংগ্রাম করে চলেছেন। আমি এতদিন ভাবতাম এরা গ্র্যাজুয়েশন করার পর প্রচুর রোজগার করবে। এই বিজনেস কনসালন্টেই আমায় এই শ্লোকটা শোনালো, ‘প্রচুর ধনপ্রাপ্তির জন জরুরি একটা দক্ষতা তাদের মধ্যে নেই।

এই শ্লোকটার মানে বেশির ভাগ লোকের প্রয়োজন শুধু আর একটা দক্ষতা আয়ত্তে আনা তাহলেই তাদের রোজগার বহুগুণ বেড়ে যাবে। আমি আগে উল্লেখ করেছি যে আর্থিক জ্ঞান হল অ্যাকাউনটিং, ইনভেস্টিং, মার্কেটিং, আর ল’-এর সম্মিলন। এই চারটি প্রায়োগিক দক্ষতার সমন্বয়ে অর্থ দিয়ে অর্থোপার্জন আরও সোজা হয়ে যাবে। অর্থের প্রসঙ্গে একমাত্র যে দক্ষতাটা বেশিরভাগ লোক জানে তা হল আরও পরিশ্রম করে কাজ করুন।

দক্ষতার মিলনের সনাতন উদাহরণ হচ্ছে ঐ খবরের কাগজের অল্পবয়সী লেখিকাটি। তিনি যদি ধৈর্য ধরে বিক্রি করার দক্ষতা শিখতেন তাহলে তাঁর রোজগার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেত। আমি যদি মেয়টি হতাম আমি বিক্রি করার কোর্সের সাথে সাথে বিজ্ঞাপন লেখার কোর্সও লিখতাম। তারপর কাগজে চাকরি করার বদলে আমি বিজ্ঞাপনের এজেন্সিতে চাকরি খুঁজতাম। যদি এতে তার মাইনে কমও হতো তাহলেও তিনি সফল বিজ্ঞাপনের মূল কথা অর্থাৎ সংক্ষেপে ব্যক্ত করার বিষয়ে শিখতে পারতেন। জনসংযোগ আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। এটা শেখার জন্যও আরও সময় দেওয়া উচিত। কি করে বিনামূল্যের প্রচারে মিলিয়ন রোজগার করা যায় তাও তিনি শিখতে পারতেন। তারপর রাত্রিরে আর সপ্তাহান্তে বসে তিনি তাঁর মহান উপন্যাস লিখতে পারতেন। বই লেখা সম্পূর্ণ হলে তিনি তার বই আরও ভালভাবে বিক্রি করতে পারতেন। তারপর, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সবচেয়ে বেশি- বিক্রীত লেখিকা’ হতে পারতেন।

যখন আমি আমার প্রথম বই If you want to be rich and happy, Don’t go to school (ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি রিচ অ্যান্ড হ্যাপি, ডোন্ট গো টু স্কুল) ছাপাই, একজন পাবলিশার আমার বইয়ের নাম পরিবর্তন করে The Economics of Education (দ্য ইকনমিক্স অফ এডুকেশন) রাখতে বলেছিলেন, আমি প্রকাশকটিকে বলেছিলাম ঐ রকম একটা নাম দিলে আমি মাত্র দুটো বই বিক্রি করতে পারবো : একটা আমার পরিবারকে অন্যটা আমার প্রিয় বন্ধুকে। মুশকিল হচ্ছে, তারা এটা বিনামূল্যেই আশা করবে। ঐ বিরক্তিকর নাম, If you want to be rich and happy, Don’t go to school (ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি রিচ অ্যান্ড হ্যাপি ডোন্ট গো টু স্কুল) এই জন্য বাছা হয়েছিল কারণ আমরা জানতাম এটা প্রচুর প্রচার পাবে। আমি শিক্ষার সমর্থক এবং শিক্ষার আমূল পরিবর্তনে বিশ্বাসী। তা না হলে আমি আমাদের পুরোনোপন্থী শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করার জন্য ক্রমাগত চাপ দেব কেন? আমি বিতর্কিত হতে চাই তাই আমি এমন একটা নাম বেছে নিয়েছিলাম যেটা আমাকে অনেক বেশি টি.ভি আর রেডিও-শোতে অংশ নিতে সুযোগ দেবে। অনেক লোক আমাকে ফ্রুট কেক ভেবেছিল কিন্তু বইটা বিক্রি উত্তরোত্তর বাড়তে থাকলো।

যখন আমি ইউ.এস. মার্চেন্ট মেরিন একাডেমি থেকে ১৯৬৯ এ গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরোলাম আমার শিক্ষিত বাবা খুশি হয়েছিলেন। আমি স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অফ ক্যালিফোর্নিয়ার অয়েল ট্যাঙ্কারের নৌ-বহরে চাকরি পেলাম। আমি থার্ড মেট ছিলাম এবং আমার মাইনে আমার সহপাঠীদের তুলনায় কম ছিল। শুরুতে ওভারটাইমসহ আমার মাইনে ছিল বছরে ৪২,০০০ ডলার। আমাকে শুধু সাত মাসের জন্য কাজ করতে হতো। বাকি মাসগুলো আমার ছুটি ছিল। আমি যদি চাইতাম, আমি এটা সহায়ক শিপিং কোম্পানির সাথে এই পাঁচ মাস ছুটি নেবার বদলে ভিয়েতনাম যেতে পারতাম এবং অনায়াসেই আমার মাইনে দ্বিগুণ করাতে পারতাম।

আমার সামনে একটা খুব ভাল কর্মজীবনের প্রতিশ্রুতি ছিল তবুও আমি ছয় মাস পরে কোম্পানি থেকে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম আর প্লেন চালানো শেখার জন্য মেরিন ক্যার্সে যোগদান করেছিলাম। আমার শিক্ষিত বাবা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আমার ধনবান বাবা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

স্কুলে আর কাজের জায়গায় এখন জনপ্রিয় মত হচ্ছে ‘বিশেষজ্ঞ হওয়া’। অর্থাৎ আপনার আরও বেশি অর্থ পেতে হলে বা পদোন্নতি করাতে হলে আপনার সেই বিষয়ে বিশষজ্ঞ প্রয়োজন। তাই ডাক্তাররা পাস করার পরেই অর্থোপেডিক বা পেডিয়াট্রিকস্ ইত্যাদি বিশেষ শাখা খুঁজতে থাকে বিশেষজ্ঞ হবার জন্য। অ্যাকাউন্টেন্ট, আর্কিটেক্ট, আইনজীবী, পাইলট আর অন্যদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।

আমার শিক্ষিত বাবাও একই মতে বিশ্বাস করতেন। তার জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করতে পেরে পুলকিত হয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই স্বীকার করতেন যারা কম বিষয় নিয়ে বেশি করে পড়ে স্কুল তাদের পুরস্কৃত করে।

আমার ধনবান বাবা আমাকে ঠিক উল্টো জিনিস করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তার মত ছিল, ‘তুমি নানা বিষয় সম্পর্কে অল্প অল্প করে জেনে রাখো।’ তাই আমি বহু বছর ধরে তার কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছি। কিছুদিনের জন্য, আমি তার অ্যাকাউন্টিং বিভাগে কাজ করেছি। যদিও আমি হয়তো কোনদিনই অ্যাকাউন্টেন্ট হব না তিনি আমাকে ‘অসমোসিসের’ (আস্রবণ) মাধ্যমে শেখাতে চেয়েছিলেন। ধনবান বাবা জানতেন আমি এর ফলে বিশেষ শব্দাবলি শিখে যাবো এবং আমার গুরুত্বপূর্ণ ও অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন বিষয় সম্পর্কে একটা বোধ জাগবে। আমি বেসবয়, কনস্ট্রাকশানের কর্মী হিসাবে যেমন কাজ করেছিলাম তেমনই সেলস, রিজার্ভেশান আর মার্কেটিং বিভাগেও কাজ করেছিলাম। তিনি মাইককে আর আমাকে নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। তাই তিনি আমাদের ব্যাঙ্কার, ল’ইয়ার, অ্যাকাউন্টেট আর ব্রোকারদের সাথে মিটিং এ নিশ্চয়ই উপস্থিত থাকতে বলতেন। তিনি আমাদের তার সাম্রাজ্যের সব বিষয় সম্পর্কে একটু একটু জানাতে চেয়েছিলেন।

যখন আমি স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের উচ্চ বেতনযুক্ত চাকরি ছেড়ে দেই, আমার শিক্ষিত বাবা আমার সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছিলেন। তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। এমন একটা কেরিয়ার যেটা মোটা বেতন, প্রচুর সুবিধা, প্রচুর সময় এবং পদোন্নতির প্রস্তাব দিচ্ছে তা থেকে আমার ইস্তফা দেবার সিদ্ধান্ত তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এক সন্ধ্যায় তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন তুমি ছেড়ে দিচ্ছ?’ উত্তরে আমি যতই চেষ্টা করি ওঁকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমার যুক্তি আর ওঁর যুক্তির কোনো মিলই ছিল না। সব থেকে বড় সমস্যা হল’ আমার যুক্তিগুলো আসলে আমার ধনবান বাবার যুক্তি ছিল।

আমার শিক্ষিত বাবার কাছে চাকরির নিরাপত্তাই সব ছিল। আর ধনবান বাবার শেখার সুযোগই ছিল সব।

শিক্ষিত বাবা ভেবেছিলেন জাহাজের অফিসার হওয়া শিখতে আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। ধনবান বাবা জানতেন আমি স্কুলে গিয়েছি আন্তর্জাতিক ব্যবসা সম্বন্ধে শিখতে। তাই আমি সুদূর পূর্ব আর দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরগামী মালের জাহাজ, বড় মালের জাহাজ, অয়েল ট্যাঙ্কার আর যাত্রীবাহী জাহাজে ছাত্রের মত কাজ শিখেছিলাম। কারণ ধনবান বাবা জোর দিয়েছিলেন আমি ইউরোপগামী জাহাজে যাত্রা করার বদলে যেন প্রশান্ত মহাসাগরগামী জাহাজে থাকি। তিনি জানতেন এশিয়া মহাদেশে রয়েছে ‘উত্থানশীল দেশ’, ইউরোপে নয়। যখন মাইকসমেত আমার বেশির ভাগ সহপাঠী, তাদের বাবার বাড়িতে পার্টি করছে তখন আমি জাপান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, তাহিতি, সেমেআ, আর ফিলিপিনের ব্যবসা, মানুষ, বাণিজ্যিক স্টাইল আর সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করছি। আমিও পার্টি করছিলাম কিন্তু কারোর বাবার বাড়িতে নয়। আমি দ্রুত বড় হয়ে উঠছিলাম।

শিক্ষিত বাবা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, আমি সব রেখে কেন মেরিন কোর্স যোগ দেওয়া ঠিক করেছি। আমি তাকে বলেছিলাম আমি বিমান চালানো শিখতে চাই কিন্তু আসলে আমি দেখতে চেয়েছিলাম কি করে দলের নেতা হয়ে পরিচালনা করা যায়। আমার ধনী বাবা আমায় বুঝিয়েছিলেন একটা কোম্পানি চালানোর সব থেকে কঠিন অংশ হচ্ছে মানুষদের পরিচালনা করা। তিনি সামরিক সেবায় তিন বছর কাটিয়েছিলেন। আমার শিক্ষিত বাবার তা প্রয়োজন হয়নি। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে লোকেদের পরিচালনা করতে শেখার মূল্য আমার ধনবান বাবা আমায় বুঝিয়েছিলেন। ‘এরপর তোমার যা শেখা দরকার তা হচ্ছে নেতৃত্ব। তুমি যদি ভাল নেতা না হও, তুমি পিছন থেকে গুলি খাবে, ঠিক যেমন- ওরা ব্যবসায় করে।’

ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৩ এ ফিরে আসার পর আমি কমিশন থেকে ইস্তফা দিয়েছিলাম যদিও আমি প্লেন চালাতে যোগ দিয়েছিলাম, আর সেটা সুবিধার জন্য নয়। আমি লাজুক ছিলাম আর কোনো কিছু বিক্রি করার চিন্তা আমার কাছে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে ভীতিকর ব্যাপার ছিল। জেরক্সের সেলস ট্রেনিং প্রোগ্রাম আমেরিকার অন্যতমদের একটা ছিল।

ধনবান বাবার আমাকে নিয়ে গর্ব ছিল। শিক্ষিত বাবা লজ্জিত ছিলেন নিজে শিক্ষাবিদ হওয়ায় তিনি বিক্রির লোকজনদের নিজের থেকে হেয় মনে করতেন। দোরে দোরে গিয়ে দরজার কড়া নাড়া ও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত অর্থাৎ চার বছর পর্যন্ত আমি জেরক্সে কাজ করেছিলাম। আমি যখন সবচেয়ে বেশি বিক্রির প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে নিয়মিতভাবে থাকতে শুরু করলাম আমি আবার ইস্তফা দিলাম আর একটা ভাল কোম্পানির সাথে দারুণ কর্মজীবন পিছনে ফেলে আমি এগিয়ে চললাম। ১৯৭৭-এ আমি আমার প্রথম কোম্পানি তৈরি করলাম। ধনবান বাবা মাইক আর আমাকে কোম্পানি অধিগ্রহণ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছিলেন। তাই আমার এখন সেগুলো তৈরি ও একত্র করা শিখতে হবে। আমার প্রথম উৎপাদন, নাইলন আর ভেলক্রোর ব্যাগ সুদূর পূর্বে উৎপাদিত হতো আর নিউইয়র্কে, আমি যে স্কুলে যেতাম তার কাছে, একটা গুদামে জাহাজে করে আসতো। আমার নিয়মমাফিক প্রচলিত শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল, তখন আমার ক্ষমতা পরীক্ষার সময়। যদি আমি অসফল হই তাহলে সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যাবো। ধনবান বাবা মনে করতেন দেউলিয়া হতে হলে তিরিশ বছরের আগেই তা হয়ে যাওয়া ভাল। তার উপদেশ ছিল ‘তোমার তখনও সামলে ওঠার সময় থাকে।’ আমার তিরিশ বছরের জন্মদিনের আগে আমার প্রথম শিপমেন্ট কোরিয়া থেকে নিউইয়র্ক রওয়ানা হয়েছিল। আজ আমি এখনও আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যবসা করি। আর আমার ধনবান বাবা আমাকে যেমন উৎসাহ দিয়েছিলেন, আমি উত্থানশীল দেশের সন্ধানে থাকি। আজ আমার বিনিয়োগ কোম্পানি সাউথ আমেরিকা, এশিয়া, নরওয়ে আর রাশিয়ায় বিনিয়োগ করে।

একটা পুরোনো প্রচলিত কথা আছে ‘JOB’ কথাটি ‘JUST OVER BROKE’-এর (অর্থাৎ দেউলিয়া থেকে সামান্য উন্নত স্তরের) আদ্যাক্ষরগুলো দিয়ে তৈরি। আমি বলবো দুর্ভাগ্যক্রমে এই কথাটি লক্ষ লক্ষ লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেহেতু স্কুল আর্থিক জ্ঞানকে কোনো জ্ঞান মনে করে না, তাই বেশির ভাগ কর্মী তাদের আর্থিক সংস্থানের পরিধিতে থেকে জীবনধারণ করে। তারা কাজ করে আর তাদের বিলের টাকা জমা দেয়।

কর্ম পরিচালনায় আরেকটা সাংঘাতিক ধারণা হল, ‘কর্মীরা ঠিক ততটাই পরিশ্রম করে কাজ করে যাতে তাদের চাকরি না যায়, আর মালিকরা ঠিক ততটাই মাইনে দেয় যাতে কর্মীরা চাকরি না ছাড়ে।’ আর আপনি যদি বেশির ভাগ কোম্পানির বেতনের স্কেলের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তাহলে আমি বলবো এই বক্তব্যে কিছু সত্যতা আছে বই কি।

এর মোট পরিণাম হল, বেশির ভাগ কর্মীরা কখনও এগোতে পারে না। তাদের যা শেখানো হয়েছে তারা তাই করে : ‘একটা নিরাপদ চাকরি নেয়।’ বেশির ভাগ লোক বেতন এবং সুবিধার জন্য কাজে মনোনিবেশ করে। এগুলো তাদের সাময়িকভাবে পুরস্কৃত করে। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে প্রায়ই এগুলো ক্ষতিকারক হয়ে থাকে।

এর পরিবর্তে আমি অল্পবয়সীদের এমন কাজ খুঁজতে বলবো যাতে তারা রোজগারের পরিণাম না দেখে কিছু শিখতে পারে। বিশেষ কোনো পেশা বেছে নেবার আগে এবং ইঁদুর দৌড়ে ধরা পড়ার আগে তাদের দেখা উচিত তারা কিসে দক্ষ হতে চায়।

লোকে সারাটা জীবন বিল দেবার ফাঁদে ধরা পড়লে তারা ছোট ধাতব চাকার চারপাশে দৌড়ে বেড়ানো হ্যামস্টারের মত হয়ে যায়। তাদের ছোট্ট পা চক্রাকারে সাঙ্ঘাতিক ভাবে, আবার কাল সকাল হোক, তারা তখনও সেই এক খাঁচার বন্দী : চাকরির খাঁচায়।

টম ক্রুস অভিনীত জেরী ম্যাগোয়ার সিনেমাতে ভারি সুন্দর কয়েকটি পংক্তি আছে। সবচেয়ে স্মরণীয় বোধহয়, ‘টাকা কোথায়।’ এছাড়াও আর একটা পংক্তি আছে যেটা আমার মনে হয় খুব সত্যি। একটি দৃশ্যে টম ক্রুস কারখানা ছেড়ে যাচ্ছে। তার এক্ষুনি চাকরি গেছে আর সে পুরো কোম্পানিকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘আমার সাথে কে আসতে চাও?’ সম্পূর্ণ পরিবেশটা নিঃস্তব্ধ আর জমাট। শুধু একজন মহিলা বলে ওঠে, ‘আমি আসতাম কিন্তু আমার তিন মাসে একটা প্রোমোশন পাওয়া আছে।’

এই বক্তব্যটাই বোধহয় পুরো সিনেমাটাতে সবচেয়ে বাস্তবিক মন্তব্য। বিলের অর্থ জমা দেওয়ার জন্য গলদঘর্ম হয়ে পরিশ্রম করে তারা এই ধরনের বক্তব্যই। ব্যবহার করে। আমি জানি আমার শিক্ষিত বাবা প্রতি বছর তার মাইনে বাড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন আর প্রতি বছরই নিরাশ হতেন। তাই তিনি আবার আরও যোগ্যতা অর্জন করার জন্য স্কুলে যেতেন যাতে তার আরেকবার মাইনে বাড়ে, কিন্তু আবার আরেকটা নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো।

আমি লোকেদের প্রায়ই যে প্রশ্ন করি, এই নিত্যনৈমিত্তিক কাজ আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমি ভাবি ঠিক ঐ হ্যামস্টারের মত লোকেরা দেখতে পায় কি তাদের এই কঠিন পরিশ্রম কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ভবিষ্যতে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করে আছে?

আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ রিটায়ার্ড পিপল-এর পূর্বতন এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর, সিরিল ব্রিকফিল্ড রিপোর্টে লিখেছেন, “প্রাইভেট পেনসনের এখন সাঙ্ঘাতিক বিশৃঙ্খল অবস্থায়। প্রথমতঃ কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ৫০ শতাংশ আজকাল কোনো পেনসন পায় না। সেটা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। বাকি ৫০ শতাংশের মধ্যে ৭৫-৮০ শতাংশের পেনসন মাসে মাত্র ৫৫,১৫০ অথবা ৩০০ ডলার, যা কোনই কাজের না।’

ক্রেগ এস কারপেল তার বই The retirement myth (দ্য রিটায়ারমেন্ট মিথ্)-এ লিখেছেন, ‘আমি একটা জাতীয় পেনসন কনসাল্টিং ফার্ম-এর হেড কোয়ার্টার দেখেছি আর একজন ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সাথে দেখা করেছি, উনি শীর্যস্থ পরিচালক দলের জন্য দারুণ রিটায়ারমেন্ট পরিকল্পনা তৈরি করায় বিশেষজ্ঞ। আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, যাদের বড় অফিস নেই তারা পেনসনে কি প্রত্যাশা করতে পারে, তিনি একটা আত্মবিশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, ‘দি সিলভার বুলেট।’

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সিলভার বুলেট কি?’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে তিনি বললেন, ‘যদি বেবী বুমার-রা আবিষ্কার করে বুড়ো বয়সে তাদের বাঁচার জন্য যথেষ্ট পয়সা নেই, তারা তাদের নিজেদের মগজই উড়িয়ে দিতে পারে।’ পুরানো ডিফাইড বেনিফিট রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান আর নতুন 401k প্ল্যানের তফাত এবং এটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ কার্পেল তা বোঝালেন। এটা আজকে যারা কাজ করছে তাদের বেশির ভাগের জন্যই খুব একটা সুন্দর ছবি নয়। আর এটা শুধু অবসর গ্রহণের জন্য প্রযোজ্য। এতে যদি মেডিক্যাল ফি আর দীর্ঘদিন নার্সিং হোম সেবা যোগ করা হয়, ছবিটা ভয়াবহ দেখায়। আর ১৯৯৫-র বইয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে নার্সিং হোমের খরচ বছরে ৩০,০০০ থেকে ১,২৫,০০০ ডলার দাঁড়ায়। অথচ তিনি তাঁর এলাকার একটি পরিষ্কার আর সাধারণ নার্সিং হোমে গিয়ে দেখেন ১৯৯৫ এর দাম বছরে ৮৮,০০০ ডলার।

আজও দেশে বেশ কিছু হাসপাতালে সমাজবাদী ব্যবস্থায় ‘কে বাঁচবে আর কে মরবে’ সে বিষয়ে বেশ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কত পয়সা আছে এবং রোগীর কত বয়স শুধু তার উপর নির্ভর করে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। যদি রোগী বয়স্ক হয় তাহলে তারা মেডিক্যাল সেবা প্রায়ই কোনো অল্পবয়স্ককে দেয়। বয়স্ক গরীব রোগীরা পিছনের সারিতে পড়ে থাকে। তাই ধনীরা যেমন বেশি ভাল শিক্ষা পেতে সক্ষম ঠিক তেমনি তারা বেশিদিন বেঁচে থাকারও ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে যাদের ধন কম তাদের মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই। তাই আমি ভাবি কর্মীরা কি ভবিষ্যৎ দেখছে নাকি তাদের পরের বেতনের চেকটাই দেখছে, তারা কোথায় চলেছে তা কখনও ভেবে দেখে কি?

আমি যখন আরও উপার্জনে আগ্রহী বয়স্কদের সাথে কথা বলি আমি সবসময় একই পরামর্শ দেই। আমি জীবনটাকে একটা দীর্ঘ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরামর্শ দেই। আমি স্বীকার করি অর্থ আর নিরাপত্তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তবে শুধু এর জন্য কাজ না করে আমি তাদের একটা দ্বিতীয় চাকরি নিতে বলি যা তাদের একটা দ্বিতীয় দক্ষতার শিক্ষা দেবে। তারা যদি বিক্রির দক্ষতা শিখতে চায় আমি প্রায়ই তাদের একটা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানিতে অর্থাৎ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানিতে যোগ দিতে বলি। এর মধ্যে কিছু কোম্পানিতে দারুণ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম থাকে, যা লোকদের বিফলতার মূল কারণ, অসফলতা আর প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়কে কাটাতে সাহায্য করে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষাই অর্থের চেয়ে বেশি মূল্যবান।

আমি যখন এই প্রস্তাব দেই, প্রায়ই প্রতিক্রিয়ায় শুনি ‘ওঃ ওটা বড় ঝামেলার ব্যাপার,’ অথবা, ‘আমি তাই করতে চাই যাতে আমার আগ্রহ আছে।’

‘এটা বড় ঝামেলার ব্যাপার’ এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘তাহলে তুমি বরং সারাজীবন কাজ করে যা রোজগার করবে তার ৫০ শতাংশ গভর্নমেন্টকে দেবে?’ অন্য বক্তব্যটাতে,-”আমি তাই করি যাতে আমার আগ্রহ আছে’-আমি বলি, ‘আমার জিমে যাবার কোনো আগ্রহ নেই কিন্তু আমি যাই কারণ আমি আরও সুস্থ বোধ করতে চাই আর বেশিদিন বাঁচতে চাই।’

দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ পুরানো কথায় কিছু সত্যি আছে, ‘তুমি একটা বুড়ো কুকুরকে নতুন কৌশল শেখাতে পারবে না।’ যদি কেউ পরিবর্তনে অভ্যস্ত না হয়, তাকে পরিবর্তন করা খুব কঠিন।

কিন্তু আপনারা যারা নতুন কিছু শেখার জন্য কাজ করতে উৎসুক, আমি তাদের উৎসাহ দিয়ে বলতে চাই : জীবন অনেকটাই জিমে যাবার মত। সব থেকে কঠিন অংশ হচ্ছে যাওয়া স্থির করা। একবার সেটা কাটাতে পারলে ব্যাপারটা সোজা। অনেকদিন এরকম হয়েছে আমি জিমে যেতে বিরক্ত হয়েছি কিন্তু একবার সেখানে গিয়ে ব্যায়াম শুরু করলে তা আনন্দদায়ক মনে হয়। ব্যায়ামের পর আমি সবসময় ব্যায়াম করেছি বলে পরিতৃপ্ত অনুভব করতাম।

আপনি যদি কিছু নতুন শেখার জন্য কাজ করতে অনিচ্ছুক না হন আর তার পরিবর্তে নিজের বিষয়ে আরও বিশারদ হয়ে উঠতে চান তাহলে আপনি যে কোম্পানিতে কাজ করেন সেখানে ইউনিয়ন আছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেবেন। কারণ শ্রমিক ইউনিয়নগুলো এমনভাবে বানানো হয় যাতে তারা বিশেষজ্ঞদের রক্ষা করতে পারে।

আমার শিক্ষিত বাবা গভর্নরের বিরাগভাজন হওয়ার পর হাওয়াইর শিক্ষকদের ইউনিয়নের প্রথম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমায় বলেছিলেন তিনি যে ক’টা কাজ করেছেন তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমার ধনবান বাবা, অন্যদিকে, তার কোম্পানিগুলোতে যাতে ইউনিয়ন গঠিত না হয় সেই চেষ্টায় সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন। তিনি সফলও হয়েছিলেন। যদিও বার বার ইউনিয়ন গঠনের প্রয়াস করা হয় তবে তিনি সেগুলোকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে, আমি কোনো পক্ষ নেই না, কারণ আমি দু’দিকেরই প্রয়োজন আর সুবিধা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। আপনি যদি স্কুলের সুপারিশমাফিক কাজ করেন এবং ঘোরতর বিশেষজ্ঞ হয়ে যান তাহলে ইউনিয়নের সুরক্ষা

সুরক্ষা নিন উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি আমার প্লেন চালানোর কেরিয়ার চালিয়ে যেতাম আমি এমন একটা কোম্পানি খুঁজতাম যেখানে পাইলটদের দৃঢ় ইউনিয়ন আছে। কেন? কারণ আমার জীবন তাহলে একটা দক্ষতা শিখতেই উৎসর্গীকৃত হতো যা একটা ব্যবসাতেই কেন্দ্রীভূত। আমায় যদি সেই ব্যবসা থেকে ঠেলে বের করে দেওয়া হয়, আমার জীবনের শেখা দক্ষতা অন্য কোনো ক্ষেত্রে এত দাম পাবে না। যদি কোনো পাইলটের কাছে ১,০০,০০০ ঘণ্টা প্লেনে ওড়ার রেকর্ড আর বছরে সে ১,৫০,০০০ ডলার রোজগার করে তার চাকরি থেকে বিতাড়িত হয় তাহলে তার পক্ষে একই রকম মোটা বেতনের অথচ স্কুল শিক্ষকের কাজ পাওয়া খুব কঠিন হবে। দক্ষতা সাধারণত এক ব্যবসা থেকে আরেক ব্যবসায়ে হস্তান্তরিত হয় না কারণ এয়ারলাইনস্ েব্যবসায় যে দক্ষতার জন্য পাইলটকে অত মাইনে দেওয়া হয় স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই দক্ষতা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আজকাল ডাক্তারদের জন্যও একই কথা সত্যি। ওষুধে এত পরিবর্তন হবার দরুণ, অনেক মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞদের এইচ.এম.ও-র মত মেডিক্যাল সংস্থার অনুগামী হওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। স্কুল শিক্ষকদের অবশ্যই ইউনিয়নের সদস্য হওয়া প্রয়োজন। আজ আমেরিকায় শিক্ষকদের ইউনিয়ন সবচেয়ে বড় আর সব থেকে ধনী শ্রমিক ইউনিয়ন। এন.ই.এ. ‘ন্যাশনাল এডুকেশন এসোসিয়েশন’-এর রাজনৈতিক প্রভাব খুব বেশি। শিক্ষকদের ইউনিয়নের সুরক্ষার প্রয়োজন কারণ তাদের শিক্ষার বাইরে অন্য কোনো ব্যবসায়ে তাদের দক্ষতার মূল্য সীমিত। সুতরাং নিয়ম হচ্ছে, ‘কোনো বিষয়ে বিশেক্ষজ্ঞ হলে ইউনিয়ন কর।’ এটা করা একটা বুদ্ধিমানের কাজ। আমি যে ক্লাসে পড়াই তাদের একবার প্রশ্ন করলাম, ‘তোমাদের মধ্যে ক’জন ম্যাকডোনাল্ডের চেয়ে ভাল হ্যামবার্গার বানাতে পার?’ প্রায় সব ছাত্ররাই হাত তুললো। আমি তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে তোমরা প্রায় সকলেই যখন বেশি ভাল হ্যামবার্গার বানাও, ম্যাকডোনাল্ড তোমাদের চেয়ে বেশি পয়সা করে আয় করে কিভাবে?’

উত্তরটা স্পষ্ট। ম্যাকডোনাল্ডের ব্যবসা প্রণালী খুব ভাল। বেশ প্রতিভাধর লোকেরাও গরীব থাকে কারণ তারা হ্যামবার্গার বানানোর দিকেই তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, তারা ব্যবসাপ্রণালী সম্পর্কে যৎসামান্য জানে বা কিছুই জানে না।

হাওয়াইয়ে আমার এক বন্ধু বেশ বড় আর্টিস্ট। তিনি মোটামুটি অর্থ উপার্জন করেন। একদিন তাঁর মা-র অ্যাটর্নী তাকে ফোন করে জানালেন যে, তিনি তার জন্য ৩৫,০০০ ডলার রেখে গেছেন। ঐ মহিলার স্টেটের সম্পত্তি থেকে অ্যাটর্নী আর গভর্নমেন্ট তাদের ভাগ নিয়ে নেবার পর ঐ টুকুই বাকি আছে। তিনি তৎক্ষণাৎ ঐ অর্থের খানিকটা ব্যবহার করে, বিজ্ঞাপন দিয়ে তাঁর ব্যবসা বাড়ানোর একটা সুযোগ দেখতে পেলেন। দু’মাস পরে, চারটে রঙের, পুরো পাতাজোড়া প্রথম বিজ্ঞাপন বেরোলো এক দামী পত্রিকায়, খুব বিত্তবানরা সেই পত্রিকায় লক্ষীভূত ছিল। বিজ্ঞাপনটা চললো তিন মাস। ঐ বিজ্ঞাপনের তিনি কোনো উত্তর পেলেন না তবে তাঁর সব পৈতৃক সম্পত্তি ফুরিয়ে গেল। তিনি ভুল উপস্থাপনার ভিত্তিতে এখন পত্রিকাটার বিরুদ্ধে মামলা করতে চান।

সুস্বাদু হ্যামবার্গার বানানো সত্ত্বেও ব্যবসা সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞানের এ এক উৎকৃষ্ট ও প্রচলিত উদাহরণ। যখন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি কি শিখলেন তাঁর একমাত্র উত্তর ছিল, “বিজ্ঞাপন বিক্রেতারা জোচ্চোর।’ আমি তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি সেলস্ এবং ডিরেক্ট মার্কেটিং-র কোর্স নিতে ইচ্ছুক কি না। তাঁর উত্তর, ‘আমার সময় নেই, আর আমি অর্থ নষ্ট করতে চাই না।’

এই পৃথিবী গরীব প্রতিভাধর মানুষে পরিপূর্ণ। প্রায়ই তারা গরীব হয় অথবা আর্থিকভাবে লড়াই করে অথবা তাদের ক্ষমতার চেয়ে কম রোজগার করে, কারণ তারা কি জানে তা নয়। তাদের যা জানা নেই সেটাই তাদের ব্যর্থতার কারণ। তারা তাদের ভাল হ্যামবার্গার বানানোর দক্ষতাকে নিখুঁত করায় মনোযোগ দেয়, হ্যামবার্গার বিক্রি করা বা পৌঁছে দেওয়ার দক্ষতা বাড়ানোয় গুরুত্ব দেয় না। হয়তো ম্যাকডোনাল্ড সবচেয়ে সেরা বার্গার বানায় না, কিন্তু তারা একটা সাধারণ বার্গার বিক্রি করা আর পৌঁছে দেওয়ায় সবার সেরা।

নির্ধন বাবা চেয়েছিলেন আমি বিশেষজ্ঞ হব। সেটা তাঁর মতে বেতন বৃদ্ধির উপায় ছিল। হাওয়াইয়ের গভর্নর যখন বাবাকে বললেন যে তিনি আর রাজ্য সরকারের কাজ করতে পারবেন না, তা সত্ত্বেও আমার শিক্ষিত বাবা আমাকে বিশেষজ্ঞ হতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আমার শিক্ষিত বাবা তখন শিক্ষক ইউনিয়নের হয়ে সংগ্রাম শুরু করলেন অত্যন্ত বিশেষজ্ঞ আর উচ্চশিক্ষিত পেশাদারদের জন্য আরও সুরক্ষা আর সুবিধা দাবি করে প্রচার চালালেন। আমরা প্রায়ই তর্ক করতাম, কিন্তু আমি জানতাম যে তিনি কখনো মেনে নিতে পারেননি যে অতিরিক্ত বিশেষজ্ঞতার জন্য ইউনিয়নের সুরক্ষার প্রয়োজন হয়। তিনি কখনো বুঝতে পারেননি যে আপনি যত বিশেষজ্ঞ হবেন আপনি তত বিশেষজ্ঞতায় নির্ভরশীল হবেন আর ফাঁসে পড়ে যাবেন।

ধনবান বাবা মাইক আর আমাকে ‘চটপটে করে তোলার উপদেশ দিয়েছিলেন। বেশকিছু করপোরেশান এই কাজ করে। তারা বিজনেস স্কুল থেকে একজন উজ্জ্বল অল্পবয়স্ক ছাত্র খুঁজে বের করে আর তাকে এমনভাবে তৈরি করে যাতে সেই ছেলেটি একদিন তাদের কোম্পানির ভার নিতে পারে। এই সব বুদ্ধিপ্রাপ্ত অল্পবয়স্ক কর্মীরা একটা বিভাগেই বিশেষজ্ঞ হয় না। তাদের এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ব্যবসার প্রণালীর সমস্ত কিছু শেখানো হয়। ধনীরা অনেকসময় তাদের নিজেদের সন্তানদের অথবা অন্যদের সন্তানদের তৈরি করে। এভাবে তাদের সন্তানরা ব্যবসা চালনার একটা সামগ্রিক জ্ঞান লাভ করে এবং বিভিন্ন বিভাগ কিভাবে একে অন্যের সাথে যুক্ত তা বুঝতে শেখে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রজন্মের মতে একটি কোম্পানি থেকে অপর কোম্পানি যাওয়া ‘খারাপ’ মনে করা হতো। অথচ আজ তাই বিচক্ষণতার লক্ষণ। আরও বেশি বিশেষজ্ঞতার বদলে লোকে কোম্পানি পরিবর্তন করে তাই ‘রোজগার’- এর চেয়ে ‘জ্ঞান’ অর্জনের পরিধি বাড়ানো ভাল নয় কি?

অল্প সময়ে, এটা হয়তো আপনাকে কম আয় দেবে। কিন্তু দীর্ঘসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটা অনেক বেশি লাভজনক হবে।

সাফল্যের জন্য যে প্রধান ম্যানেজমেন্টের দক্ষতার প্রয়োজন তা হল :

১। ক্যাশফ্লো ম্যানেজমেন্ট বা ক্যাশফ্লো পরিচালনা।

২। সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট বা (আপনার জীবনের সঠিক পরিচালনার আর আপনার পরিবারের জন্য সময় দেওয়া)।

৩। লোকেদের ম্যানেজমেন্ট বা লোকেদের সঠিকভাবে পরিচালনা।

বিক্রি-কৌশল জানা ও বাজার সম্বন্ধে জ্ঞান গুরুত্বপূ ও বিশেষ দক্ষতা। বিক্রি করার ক্ষমতাই ব্যক্তিগত সাফল্যের মূল্যকথা-অর্থাৎ ক্রেতা, কর্মী, বস, স্বামী বা স্ত্রী বা সন্তানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা। সুদক্ষ লেখক বা বক্তা হওয়া এবং আপোষ-মীমাংসার সমত সংযোগস্থাপনের ক্ষমতা সফল জীবনের চাবিকাঠি। নানা কোর্সে যোগদান করে, শিক্ষনীয় টেপ শুনে জ্ঞানবৃদ্ধি করে আমি ক্রমাগত এই দক্ষতা আরও শাণিত করে তুলি।

যেমন-আমি আগেই উল্লেখ করেছি আমার শিক্ষিত বাবা যতই পরিশ্রম করছিলেন তত উপযুক্ত হয়ে উঠছিলেন। তিনি যত বিশেষজ্ঞ হচ্ছিলেন ততই ফাঁদে আটকে পড়ছিলেন। যদিও তার বেতন বেড়ে গিয়েছিল তবে তার বিকল্প কমে গিয়েছিল। তার গভর্নমেন্ট কাজ করা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি বুঝলেন পেশাগতভাবে তিনি কতটা নিরূপায়। এটা অনেকটা পেশাদার খেলোয়াড়ের মত অবস্থা, যে হঠাৎ আঘাত পেয়েছে অথবা বেশি বয়স্ক হয়ে গেছে। তাদের এক সময়ের উচ্চ বেতনযুক্ত পদ এখন চলে গেছে আর তাদের কাছে আছে শুধু সীমিত কিছু দক্ষতা। সেই কারণে আমার মনে হয় আমার শিক্ষিত বাবা ইউনিয়নের এত পক্ষপাতি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন একটা ইউনিয়ন তাদের কতখানি উপকার করতে পারে। ধনবান বাবা মাইক আর আমাকে সব বিষয়ে অল্পস্বল্প জ্ঞান লাভ করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমান লোকেদের সাথে আগের কাজ করতে বলতেন আর বুদ্ধিমান লোকেদের একত্র করে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে প্রেরণা দিতেন। আজকাল একে পেশাদার বিশেষজ্ঞদের যৌথ ক্রিয়া বলা হয়।

আজকাল, আমার এমন কয়েকজন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষকদের সাথে দেখা হয় এঁরা বছরে শত সহস্র ডলার রোজগার করেন। তাঁরা অত রোজগার করতে পারেন কারণ তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার সাথে সাথে অন্য দক্ষতাও আছে। তাঁরা শিক্ষা দিতেও পারেন আবার বিক্রি আর মার্কেটিং এর কাজও করতে পারেন। সেলিং এবং মার্কেটিং দক্ষতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো দক্ষতার খবর আমার জানা নেই। বেশির ভাগ লোকের সেলিং আর মার্কেটিং দক্ষতা দুঃসাধ্য মনে হয় কারণ তারা প্রত্যাখ্যাত হতে ভয় পায়। আপনার লোকের সাথে যোগাযোগ, দরদস্তুর করা বা প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়ের সম্মুখীন হওয়ার দক্ষতা যত বাড়বে, জীবন তাই সহজ হবে। সেই কাগজের লেখিকাটি, যিনি ‘সবচেয়ে বেশি বিক্রীত’ লেখিকা হতে চেয়েছিলেন তাকে যে উপদেশ দিয়েছিলাম, আমি আজ প্রত্যেককেই সেই একই উপদেশ দেই। প্রয়োগিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের ভাল-মন্দ দুই-ই আছে। আমার এমন বন্ধু আছেন যারা এমনিতে প্রতিভাধর কিন্তু খুব কম উপার্জন করেন, কারণ তারা অন্য মানুষের সাথে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে পারেন না। আমি তাদের শুধু একটা বছর ‘বিক্রি’ বিষয়ে শিক্ষা নিতে বলি। যদি তারা কিছু রোজগার নাও করেন, তাদের পরস্পরের সাথে আদান-প্রদান করার ক্ষমতার উন্নতি হবে। আর সেটা অমূল্য।

ভাল শিক্ষার্থী, বিক্রেতা, আর মার্কেটার হওয়া ছাড়াও আমাদের ভাল শিক্ষক আর ভাল ছাত্র হওয়া প্রয়োজন। সত্যিকারের ধনী হতে হলে আমাদের দেবার ক্ষমতা থাকার সাথে সাথে গ্রহণ করার ক্ষমতাও থাকা দরকার। প্রায়শই দেখা যায় আর্থিক আর পেশাদার সংগ্রামের কারণ সঠিক দেয়া নেয়ার অভাব। আমি অনেক লোকেদের জানি যারা ভাল ছাত্রও নয় আবার ভাল শিক্ষকও নয় তাই তারা গরীব। আমার দু’জন বাবাই উদার প্রকৃতির লোকছিলেন। দু’জনেই প্রথমে দেবার অভ্যাস করেছিলেন। শিক্ষাদানও তাদের দেওয়ার একটা নমুনা ছিল। তারা যত দিয়েছিলেন, ততই পেয়েছিলেন। অর্থ দেবার ব্যাপারে অবশ্য তাদের মধ্যে বিস্তর তফাত ছিল। আমার ধনবান বাবা প্রচুর টাকাকড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার চার্চ, দাতব্য সংস্থা এবং তার নিজের ফাউন্ডেশনে দান করেছিলেন। তিনি জানতেন অর্থাগরের জন্য অর্থদান জরুরি। দান করা বেশির ভাগ মহান ও ধনী পরিবারগুলোর গোপন রহস্য। সে জন্যই রকফেলার ফাইন্ডেশন আর ফোর্ড ফাইন্ডেশন ইত্যাদি সংস্থা গড়ে উঠেছে। এই সংস্থাগুলো এমনভাবে তৈরি যে তারা ক্রমাগত বুদ্ধি করতে থাকবে এবং চিরকাল ধরে দান করতে থাকবে।

আমার শিক্ষিত বাবা সবসময় বলতেন, ‘আমার কাছে যখন অতিরিক্ত অর্থ থাকবে, আমি দেব।’ সমস্যা হচ্ছে কখনোই অতিরিক্ত কিছু থাকতো না। তাই তিনি আরও কঠিন পরিশ্রম করতেন বেশি অর্থ পাবার জন্য। অথচ অর্থ- সংক্রান্ত আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক তিনি উপেক্ষা করতেন : ‘দাও তাহলে তুমি পাবে’। এর পরিবর্তে তিনি বিশ্বাস করতেন ‘আগে পাও আর তারপর দাও।’

উপসংহারে বলবো দু’জন বাবাই আমায় প্রভাবিত করেছিলেন। আমার একাংশ পুঁজিপতি যে পয়সার থেকে পয়সা বানানোর খেলা ভালবাসে। আরেক অংশ এক সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল শিক্ষক যে গরীব আর বড়লোকের এই ক্রমবর্ধমান এই ক্রমবর্ধমান ফারাক দিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে ফারাকের জন্য আমাদের প্রাচীনপন্থী শিক্ষা ব্যবস্থাকেই দায়ী মনে করি।

আর্থিক জ্ঞান ও দক্ষতা আমাদের কেন প্রয়োজন?

এখানে রবার্ট কিয়োসাকি তাঁর সেই বন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছিলেন। ১৯৯০ সালে আমার প্রিয় বন্ধু মাইক তার বাবার সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিল,

বস্তুত সে তার বাবার থেকে ভাল কাজ করছিল। আমরা বছরে একবার কি দু-বার গলফ কোর্সে দেখা করি। সে এবং তার স্ত্রী এত ধনী যে আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। ধনবান বাবার সাম্রাজ্য এখন মহান হস্তে সুরক্ষিত। মাইক এখন তার সন্তানকে তার জায়গা নেবার জন্য তৈরি করছে- যেমনভাবে তার বাবা আমাদের তৈরি করেছিলেন।

১৯৯৪ সালে ৪৭ বছর বয়সে আমি অবসর গ্রহণ করেছিলাম, তখন আমার স্ত্রী কিমের বয়স ছিল ৩৭। অবসর গ্রহণের অর্থ কাজ না করা নয়। আমার স্ত্রী এবং আমার কাছে এর মানে কোনো অভাবিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটলে আমরা কাজ করতেও পারি আবার নাও করতে পারি কারণ আমাদের অর্থ স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা মুদ্রাস্ফীতি থেকে অনেক নিজে বৃদ্ধি পাবার পক্ষে যথেষ্ট বড়। এটা ঠিক একটা গাছ রোপণ করার মত। আপনি বছরের পর বছর এতে জল দিন আর তারপর হঠাৎ আপনার পরিচর্যার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। এর মূলগুলো ততদিনে যথেষ্ট গভীরে পৌঁছে গেছে। বরং গাছটাই তখন আপনাকে ছায়া দেয়, ভোগ করার জন্য।

মাইক সাম্রাজ্য পরিচালনা করা বেছে নিয়েছিল আর আমি অবসর গ্রহণ বেছে নিয়েছিলাম।

যখনই আমি একদল লোকের সঙ্গে কথা বলি তারা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে আমার উপদেশ কি অথবা তারা কি করতে পারে? “তারা কিভাবে শুরু করতে পারে?” ‘কোনো ভাল বই আছে কি যেটা আমি অনুমোদন করতে পারি?”

“তাদের সন্তানদের প্রস্তুত করার জন্য কি করা উচিত?” “সাফল্যের গোপন চাবিটি কি?” “আমি কি করে কোটি কোটি ডলার রোজগার করি?” এক্ষেত্রে আমার সবসময় একটি প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে যা আমাকে একসময় দেওয়া হয়েছিল। এটা নিচে দেওয়া হল।

সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীর অর্থ আবিষ্কারের কৌশল

রবার্ট কিয়োসাকির সহজ আলোচনায় আমরা ধনী ব্যবসায়ীর অর্থ উৎপাদনের ইতিহাস জানতে পারি। ১৯৩২ সালে শিকাগোর এজওয়াটার বীচ হোটেলে আমাদের সবচেয়ে মহান নেতা এবং ধনী ব্যবসায়ীদের একটি সম্মেলন হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন চার্লস স্বোয়ার, সর্ববৃহৎ স্বাধীন স্টিল কোম্পানি প্রধান; স্যামুয়েল ইনসাল, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ইউটিলিটির প্রেসিডেন্ট; হাওয়ার্ড হপসন, বৃহত্তম গ্যাস কোম্পানির প্রধান; ইভার ক্রেগার, সে সময়কার পৃথিবীর বৃহত্তম কোম্পানিগুলোর একটি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ কোম্পানি তার প্রেসিডেন্ট, লিওন ফ্রেজিয়ার, ব্যাংক অফ ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্টের প্রেসিডেন্ট; আর্থার কটন আর জেসী লিভারমোর এঁরা দু’জন অত্যন্ত সুদক্ষ স্টক্ স্পেকুলেটর; এবং প্রেসিডেন্ট হার্ডিং এর ক্যাবিনেটের সভ্য অ্যালবার্ট ফল। ২৫ বছর পর উপরোক্ত ন’জনের এইভাবে সমাপ্তি ঘটেছিল। স্বোয়ার পাঁচ বছর যাবৎ ঋণে জর্জরিত জীবনযাপনের পর কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। ইনসালের মৃত্যু হয় বিদেশে, টাকাকড়িবিহীন অবস্থায়। ক্রেগার আর কটনও সহায়সম্বলহীন অবস্থায় মারা গেছিলেন। হপসন পাগল হয়ে গেছিলেন। হুইটনি আর অ্যালবার্ট ফল সবে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ফ্রেসার আর লিভারমোর আত্মহত্যা করেছিলেন।

আমার সন্দেহ এই লোকগুলোর বাস্তবিকভাবে কি হয়েছিল কেউ হয়ত বলতে পারবে না। আপনি যদি ১৯২৩ সালটা দেখেন তাহলে এটা ১৯২৯ সালের মার্কেট ক্র্যাশ আর গ্রেট ডিপ্রেশানের (বিরাট আর্থিক মন্দা) ঠিক আগেকার সময়, আমার মনে হয় এই সব লোকেদের এবং তাদের জীবনের উপর ওই মন্দাবস্থা বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। এখন কথা হচ্ছে আমরা আজকাল এইসব লোকেদের থেকে আরও বেশি এবং আরও দ্রুত পরিবর্তনের যুগে বাস করি। আমার মনে হয় আগামী ২৫ বছরে অনেক স্ফীতি আর মন্দা আসবে, এবং এইসব লোকেদের যে ওঠানামার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তারই সমান্তরাল হবে। আমি চিন্তিত এই জন্য যে বেশির ভাগ লোকেরা অর্থের দিকেই প্রধানত দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে, তাদের মূলধন অর্থাৎ শিক্ষাকে উপেক্ষা করছে। যদি লোকেরা নমনীয় হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে, মন খোলা রাখে শিখতে চায়, তারা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ ধনী হয়ে উঠবে। কিন্তু তারা যদি মনে করে অর্থ তাদের সমস্যার সমাধান করে এবং অর্থ উৎপাদন করে। আর্থিক বুদ্ধির প্রয়োগ ছাড়াই যে অর্থাগম তা শীঘ্রই চলে যায়।

বেশির ভাগ লোক বুঝতে পারেন না যে আসলে জীবনে আপনি কত অর্থ করেছেন সেটা কিছু না। আপনি কত অর্থ রাখতে পেরেছেন সেটাই আসল। আমরা সবাই গরীব লটারি বিজেতাদের গল্প শুনেছি, যারা হঠাৎ ধনী হয়ে আবার গরীব হয়ে গেছে। তারা কোটি কোটি ডলার জেতে কিন্তু শীঘ্রই ফিরে যায় আগেকার অবস্থায়। অথবা সেই পেশাদারী খেলোয়াড়ের গল্প, যে ২৪ বছর বয়সে বছরে কোটি কোটি ডলার রোজগার করেছিলেন অথচ ৩৪ বছর বয়সে তাঁকে ব্রিজের তলায় শুয়ে ঘুমোতে হচ্ছে।

১৯৯৭ সালে আমি অনেক লোককে জানি যারা অতি দ্রুত কোটিপতিতে পরিণত হয়েছেন। এটা ১৯২০-এর আতিশয্যের কথা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়। যেমন- আমি লোকেদের আরও বেশি ধনী হয়ে উঠতে দেখে খুশি হয়েছি তবে আমি তাদের সাবধান করছি যে আপনি কত অর্থ উপার্জন করেছেন তার মূল্য নেই, আপনি কতটা অর্থ এবং কতগুলো প্রজন্মের জন্য অর্থ সংরক্ষিত করতে পারছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে, “আমরা কোথায় শুরু করব?” অথবা “কি করে দ্রুত ধনী হওয়া যায় বলুন” তারা প্রায়ই আমার উত্তর শুনে খুব নিরাশ হয়। বহুদিন আগে অর্থাৎ ছেলেবেলায় আমার ধনবান বাবা আমাকে যা বলেছিলেন আমিও তাদের ঐ একই কথা বলি। “তুমি যদি ধনী হতে চাও, তোমার আর্থিক বিষয়ে শিক্ষা থাকা প্রয়োজন।”

যখন আমরা একত্র হয়েছি আমার ধনবান বাবা এই ধারণাটা আমার মনে গেঁথে দিয়েছেন। আগেই বলেছি আমার শিক্ষিত বাবা বই পড়ার গুরুত্বের উপর জোর দিতেন, আমার ধনবান বাবা জোর দিতেন আর্থিক শিক্ষা আয়ত্তে আনার প্রয়োজনীয়তার উপর।

আপনি যদি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং তৈরি করতে চান, আপনাকে প্রথমেই একটা গভীর গর্ত খুঁড়তে হবে এবং একটা দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। আপনি যদি শহরতলিতে বাড়ি বানাতে চান একটা ৫ ইঞ্চি কংক্রীটের স্ল্যাব ঢালাই করলেই চলবে। বেশির ভাগ লোক তাদের ধনী হবার তাড়নায় ৬ ইঞ্চি স্ল্যাবের উপর এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

আমাদের স্কুলের শিক্ষাপ্রণালীগুলো কৃষিযুগে সৃষ্টি হয়েছিল তাই এখনও তারা ভিত্তি ছাড়াই বাড়ি নির্মাণে বিশ্বাস করে। মাটির মেঝে এখনও জনপ্রিয়। তাই এখনও শিশুরা স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরোয় প্রায় কোনো আর্থিক শিক্ষার বুনিয়াদ বা ভিত্তি না নিয়েই। নিদ্রাহীন শহরতলির জীবনযাত্রা ঋণে আকণ্ঠ ডুবে থাকা মন, আমেরিকান ঋণে-বিভোর মন স্থির করে যে তাদের আর্থিক সমস্যার উত্তম হচ্ছে চট্ করে ধনী হবার রাস্তা খুঁজে বার করা।

শুরু হয় স্কাইস্ক্রেপারের নির্মাণ। এটা দ্রুত বেড়ে ওঠে আর শিগগিরই এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের পরিবর্তে এটা ‘লিনিং টাওয়ার অফ সাবার্বিয়ার রূপ নেয়। আবার ফিরে আসে নিদ্রাহীন রাত।

আমরা যখন শিশুমাত্র তখন থেকেই তিনি আমাদের শেখানোর এক সরল উপায় সৃষ্টি করেছিলেন। বছরের পর বছর তিনি শুধু সরল ছবি এঁকে আর কথা বলে ওগুলো বোঝাতেন। মাইক আর আমি যখন ঐসব সরল ছবি, পারিভাষিক শব্দ (জার্গন) আর পয়সার খেলা বুঝতে শিখলাম তখন তিনি তার সঙ্গে সংখ্যার ব্যবহার যোগ করলেন। আজ, মাইক আরও অনেক জটিল আর সূক্ষ্ম অ্যাকাউন্টিং-এর বিশ্লেষণ আয়ত্তে আনতে পারে কারণ তাকে তাই করতে হচ্ছে। তাকে বিলিয়ান ডলারের সাম্রাজ্য চালাতে হয়। আমি হয়তো তেমন সুদক্ষ নই কারণ আমার সাম্রাজ্য অপেক্ষাকৃত ছোট। যদিও আমরা দু’জনেই সেই এক সরল ভিত্তি থেকেই এসেছি। পরবর্তী পাতাগুলোয় আমি আপনাদের সেই একই চিত্র তৈরি করে দিচ্ছি যা মাইকের বাবা আমাদের জন্য সরল রেখাচিত্র তৈরি করা শিখিয়েছিলেন। সরল এই চিত্রগুলো দুটি বালককে বিশাল অঙ্কের অর্থ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল- যার ভিত্তি ছিল দৃঢ় আর গভীর।

নিয়ম এক : আপনার সম্পত্তি (অ্যাসেট) আর দায়ের (লায়াবিলিটি) মধ্যে তফাত বুঝে সম্পত্তি কেনা দরকার। আপনি ধনী হতে চান, এটুকুই আপনার জন্য যথেষ্ট। এটা প্রথম নিয়ম এবং এটাই একমাত্র নিয়ম। এটা অদ্ভুত সরল শোনাতে পারে, কিন্তু এই নিয়ম যে কতটা নিগূঢ় বেশিরভাগ লোকের ধারণাই নেই। বেশিরভাগ লোক আর্থিক বিষয়ে সংগ্রাম করে কারণ তারা সম্পত্তি আর দায়ের তফাত জানে না।

“ধনী ব্যক্তিরা সম্পত্তি সংগ্রহ করে। গরীব আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী দায় সংগ্ৰহ করে তারা এগুলোকে সম্পত্তি মনে করে।’

যখন ধনবান বাবা মাইক আর আমাকে এটা বুঝিয়ে বলেছিলেন আমরা ভেবেছিলাম উনি বুঝি মজা করছেন। তখন আমরা প্রায় তরুণ, ধনী হবার গোপন তথ্য জানার আমাদের অধীর আগ্রহ। আর এই ছিল তার উত্তর। জবাবটা এত সরল যে আমাদের ভাবতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল।

“সম্পত্তি কি? মাইক জিজ্ঞাসা করেছিল।

“এখন এ নিয়ে দুশ্চিন্তা কর না”, ধনবান বাবা বলেছিলেন, “ভাবনাটা মাথায় ঢুকে যেতে দাও। তুমি যদি এই সরল সত্যটা উপলব্ধি করতে পারো,

তোমার জীবনে একটা পরিকল্পনা থাকবে, আর্থিক সচ্ছলতা থাকবে। এটা সরল বলেই এই ভাবনাটা বাদ চলে যায়।”

“আপনি বলতে চাইছেন আমাদের শুধু জানতে হবে সম্পত্তি কি, আর সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে, আর তাহলে আমরা ধনী হব?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম ধনবান বাবা মাথা নাড়লেন।

“এটা এতই সরল।“

“এটা যদি এত সরলই হয় তাহলে সবাই ধনী নয় কেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ধনবান বাবা মিটিমিটি হাসলেন।

“কারণ লোকেরা সম্পত্তি আর দায়ের মধ্যে প্রভেদ কি তা জানে না।”

আমার মনে আছে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “বড়রা এত বোকা কেন? এটা যদি এতই সোজা, এটা যদি এত গুরুত্বপূর্ণ, সবাই এটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করে না কেন?”

আমাদের ধনবান বাবার মাত্র কয়েক মিনিট লেগেছিল, সম্পত্তি আর দায়ের মধ্যে প্রভেদ কি তা বোঝাতে।

একজন পূর্ণবয়স্ক হিসাবে, অন্য পূর্ণবয়স্কদের এটা বোঝাতে আমার অসুবিধা হয় কেন? কারণ পূর্ণবয়স্কদের বুদ্ধি বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই চিন্তাধারার সারল্য পূর্ণবয়স্কদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় কারণ তারা অন্যরকম শিক্ষা পেয়েছে। তারা শিক্ষা পেয়েছে অন্যান্য শিক্ষিত পেশাদার ব্যক্তি, যেমন- ব্যাঙ্কার, অ্যাকাউন্টেন্ট, রিয়াল স্টেট এজেন্ট, ফিনানশিয়াল প্ল্যানার ইত্যাদির কাছ থেকে। পূর্ণবয়স্কদের সেইসব শিক্ষা ভুলে যেতে বলতে অথবা আবার শিশুর সারল্য ফিরে পাওয়ার কথা বলতে হয় যা খুব মুশকিল। একজন বুদ্ধিমান পূর্ণবয়স্ক লোক প্রায়ই এত সরল সংজ্ঞার প্রতি মনোযোগ দেওয়াকে বোকামি মনে করেন।

ধনী বাবা KISS আদর্শে বিশ্বাস করতেন- ‘Keep It Simple Stupid’ (সরল রাখে)- তিনি দু’জন তরুণ ছেলের জন্য সরল বিষয়টি সহজ-সরল করে দিয়েছিলেন আর সেটাই তাদের আর্থিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল।

তাহলে গণ্ডগোলের আসল কারণ কি? অথবা কি করে এত সরল একটা জিনিস এত কঠিন হয়ে ওঠে? কেনই বা মানুষ এমন একটা সম্পত্তি কিনবে যেটা আসলে একটা দায়? উত্তরটা প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতিতে খুঁজে পাওয়া যায়।

আমরা ‘স্বাক্ষরতা’ বা শিক্ষা কথাটার উপর জোর দেই ‘আর্থিক স্বাক্ষরতা’ বা ‘আর্থিক শিক্ষা’ নয়। শব্দ দিয়ে সম্পত্তি আর দায়ের সংজ্ঞা বোঝানো যায় না। বস্তুত, আপনি যদি সত্যিই বিভ্রান্ত হতে চান অভিধানে ‘সম্পতি’ আর ‘দায়’ এর মানে দেখুন। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অ্যাকাউন্টেটের জন্য এই সংজ্ঞা হয়তো ভাল শোনায় কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এর কোনো অর্থ নেই। কিন্তু আমাদের বড়দের অহংবোধ এত বেশি যে কোনো অর্থ বুঝতে না পারলেও সেটা স্বীকার করতে দ্বিধা হয়।

ধনবান বাবা বলেছিলেন, “শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা হয় না, সংখ্যা দিয়ে বোঝাতে হয়। আর তোমার যদি সংখ্যজ্ঞান না থাকে তাহলে জমিতে একটা গর্ব ও ভূ-সম্পত্তির মধ্যে প্রভেদ কোথায় তাই বুঝে উঠতে পারবে না। “অ্যাকাউন্টিং-এ”, ধনবাব বাবা বলতেন, “শুধু কথা নয়, কিন্তু কথার মধ্যে দিয়ে যে গল্পটা বলা হচ্ছে সেটাই বক্তব্য।”

অনেক লোক বই পড়ে কিন্তু বিশেষ কিছু বাঝে না। পড়ে উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকা চাই। আমাদের সবার পড়ে উপলব্ধি করার ক্ষমতা ভিন্ন। যেমন- আমি সম্প্রতি একটা নতুন ভিসিআর কিনেছি। এতে একটা নির্দেশক বই দেওয়া আছে যাতে ভিসিআর-এ প্রোগ্রাম করার পদ্ধতি বোঝানো আছে। আমি শুধু শুক্রবার রাত্তিরে আমার প্রিয় টিভি শোটা রেকর্ড করতে চেয়েছিলাম। ম্যানুয়েলটা পড়তে পড়তে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মনে হচ্ছিল জগতে ভিসিআর প্রোগ্রাম শেখার চেয়ে জটিল আর কিছুই নেই। আমি কথাগুলো পড়তে পারছি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। আমি অক্ষরগুলো চেনার জন্য যদি ‘এ’ গ্রেড পেতাম তার মানে বোঝার জন্য বোধ হয় ‘এফ’ গ্রেড পেতাম। আর বেশির ভাগ লোকের জন্য আর্থিক স্টেটমেন্ট বা বক্তব্যগুলোও অনেকটা এইরকম।

“তুমি যদি ধনী হতে চাও, তোমাকে সংখ্যা পড়তে আর তার অর্থ উপলব্ধি করতে হবে।” আমার ধনবান বাবার কাছে হাজার বার এই কথা শুনেছি। আমি আরও শুনেছি, “ধনীরা সম্পত্তি সংগ্রহ করে আর গরীব আর মধ্যবিত্তরা দায় সংগ্রহ করে।”

এবার সম্পত্তি আর ‘দায়’ এর তফাত কোথায় তা বলি। বেশির ভাগ অ্যাকাউন্টেট আর আর্থিক বিষয়ে পেশাদাররা এই সংজ্ঞায় বিশ্বাস করে না, তবে এই সরল ছবিগুলো দুটি বালকের মনে আর্থিক শিক্ষার দৃঢ় বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিল।

তের বছরের কমবয়সী ছেলেদের শেখাবার জন্য ধনবান বাবা, যথাসম্ভব ছবি ব্যবহার করে, যত কম সম্ভব শব্দ ব্যবহার করে এবং বেশ কয়েক বছর কোনোরকম সংখ্যা ব্যবহার না করেই সব কিছু খুব সরলভাবে বুঝিয়েছিলেন।

“এটা একটা সম্পত্তির ক্যাশফ্লো প্যাটার্ন”

আয়ের বিবৃতি

উপরের বাক্সটা একটা ইনকাম স্টেটমেন্ট (আয়ের বিবৃতি) যাকে প্রায়শই লাভ আর ক্ষতির স্টেটমেন্টও বলা হয়। এটা নিয়ে আয় এবং ব্যয় পরিমাপ করা হয়। অর্থের প্রবেশ এবং বহির্গমন। নিচের নক্সাটা ব্যালেন্স শীটের। একে এরকম বলা হয় কারণ এতে সম্পত্তি আর দায় এর তুলনামূলক বিচার করার কথা। অর্থসংক্রান্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত বেশ কিছু নতুন ছাত্র-ছাত্রী ইনকাম স্টেটমেন্ট আর ব্যালেন্স শীটের সম্পর্ক জানে না। এই সম্পর্কটা বোঝা খুব জরুরি।

সম্পত্তি ও দায়বদ্ধতার প্রভেদ কোথায় সেটা বোঝার অক্ষমতাই আর্থিক সংগ্রামের মুখ্য কারণ। দুটো কথার সংজ্ঞাতেই এই

বিভ্রান্তির কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি যদি আরও বিভ্রান্ত হতে চান তাহলে অভিধানে ‘সম্পত্তি’ আর ‘দায়’ এই শব্দ দুটির অর্থ খুঁজে দেখুন।

একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অ্যাকাউন্টেটের কাছে হয়ত শব্দগুলোর অর্থ সুস্পষ্ট হতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এটা দুর্বোধ্য ভাষায় লেখার সামিল। কথাগুলোর সংজ্ঞা পড়া যায় কিন্তু এর যথার্থ উপলব্ধি করা কঠিন।

তাই আমি আগে যেমন- বলেছি, আমার ধনবান বাবা দু’জন অল্পবয়স্ক ছেলেকে সরল ভাষায় বুঝিয়েছিলেন, বলেছেন, ‘সম্পত্তি তোমার পকেট গরম করে।’ সুন্দর, সহজ এবং ব্যবহারযোগ্য

‘এটা একটা ‘দায়’ এর ক্যাশফ্লো প্যাটার্ন”

এখন যেহেতু সম্পত্তি আর দায় ছবি দিয়ে বোঝানো হয়ে গেছে, কথা দিয়ে সংজ্ঞার বর্ণনা এবার হয়তো অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।

সম্পত্তি এমন জিনিস যা আমার পকেটে অর্থাগম করে।

দায় এমন জিনিস যা আমার পকেট থেকে অর্থ নিয়ে নেয়।

পকেট থেকে অর্থ নিয়ে নেয়

শুধু এটুকু জানাই যথেষ্ট। যদি আপনি ধনী হতে চান, সারাজীবন ধরে সম্পত্তি কিনে যান। যদি আপনি গরীব বা মধ্যবিত্ত হতে চান সারাজীবন দায় কিনে যান।

বাস্তবজগতে এই তফাতটা না জানাই অধিকাংশ আর্থিক সংগ্রামের কারণ।

শব্দ ও সংখ্যাজ্ঞানের অভাবই আর্থিক সংগ্রামের ভিত্তিস্বরূপ। যদি কারুর আর্থিক দিক দিয়ে অসুবিধা হয় তার মানে সে সংখ্যা বা শব্দ বুঝতে বা পড়তে অক্ষম। কিছু ভ্রান্ত ধারণা হয়। ধনীরা ধনী কারণ তারা নানা বিষয়ে আর্থিক সংগ্রামরত মানুষের চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন। সুতরাং আপনি যদি ধনী হতে চান আর ধন রক্ষা করতে চান তাহলে শব্দ এবং সংখ্যায় দুটোতেই জ্ঞান অর্থাৎ আর্থিক স্বাক্ষরতা একান্ত জরুরি।

নক্সায় তীর চিহ্নটি অর্থের গতি বা ‘ক্যাশফ্লো’ বোঝাচ্ছে। শুধু সংখ্যা দিয়ে প্রায় কিছুই বোঝা যায় না। যেমন- শুধু শব্দ যথেষ্ট নয়। বক্তব্যটাই আসল। আর্থিক রিপোর্টে সংখ্যা পড়া, গল্পের রেখাচিত্র খোঁজার সঙ্গে তুলনীয়। ক্যাশ কোথায় যাচ্ছে সেই গল্প। আশি শতাংশ পরিবারে আর্থিক গল্পটা হচ্ছে তারা ধনী হবার জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করছেন। এমন নয় যে তারা অর্থোপার্জন করছে না। কিন্তু সম্পত্তি কেনার বদলে তারা শুধু সারাটি জীবন দায়বৃদ্ধি করে যাচ্ছে।

এক তরুণের ক্যাশফ্লো

উদাহরণস্বরূপ, এটা এক গরীব মানুষ অথবা বাড়িতে থাকে এমন এক তরুণের ক্যাশফ্লো :

এই সমস্ত নকশাগুলো খুবই সরলীকৃত, বোঝাই যাচ্ছে। কারণ প্রত্যেকের জীবন ধারণের জন্য খাবার, বাসস্থান আর পোশাকের প্রয়োজন আছে। এই নক্সাগুলো এক গরীব, মধ্যবিত্ত অথবা ধনী ব্যক্তির জীবনে অর্থের…দেখাচ্ছে। এই ক্যাশফ্লো-ই গল্পটা বলছে। কিভাবে একজন ব্যক্তি অর্থ ব্যবহার এবং হাতে অর্থ এলে তিনি কি করেন এই গল্প তা শোনায়।

আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের গল্প দিয়ে শুরু করার কারণ আমি দেখাতে চেয়েছিলাম এতগুলো লোকের চিন্তাধারায় কোথায় ত্রুটি ছিল। ত্রুটিটা হচ্ছে অর্থই সব সমস্যার সমাধান করবে। এইজন্যই যখন লোকে আমায় জিজ্ঞাসা করে কি করে চটপট ধনী হওয়া যায় অথবা কোথায় তারা শুরু করবে, আমি মাথা নিচু করে থাকি। আমি প্রায়ই শুনি, ‘আমার দেনা হয়ে গেছে তাই আমার আরও অর্থ রোজগার করা প্রয়োজন।’

কিন্তু প্রায়ই আরও অর্থ সমস্যার সমাধান করে না। বস্তুত এটা হয়ত সমস্যাটা আরও বাড়িয়ে দেয়। অর্থ প্রায়ই আমাদের দুঃখজনক ত্রুটিগুলো স্পষ্ট করে দেয়। অর্থ প্রায়ই আমরা যা জানি না সেটাকে সুস্পষ্ট করে তোলে। এজন্য প্রায়ই যখন কোন ব্যক্তির কাছে ঝড়ের মত প্রচুর অর্থ এসে যায়- পৈতৃক সম্পত্তি, মাইনে বাড়া অথবা লটারি জেতা সেটা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। তিনি দ্রুত আগের আর্থিক অবস্থায় ফিরে যান, কখনও কখনও আর্থিক বিশৃঙ্খলা আগের চেয়েও বেড়ে যায়। আপনার মস্তিষ্কে যে ক্যাশফ্লো-র নকশা বিদ্যমান অর্থ সেটাই প্রকাশ করে। আপনার যদি যা পান তা সমস্ত খরচ করার প্রবণতা থাকে, তাহলে অর্থ বাড়লে আপনার শুধু খরচই বাড়বে। সেজন্যই বলা হয় ‘মূর্খ আর তার অর্থ মানেই একটা বিশাল বড় পার্টি।’

আমি অনেকবার বলেছি আমরা পুঁথিগত দক্ষতার আর পেশাদারী দক্ষতা শেখার জন্য স্কুলে যাই, দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পেশাদারী দক্ষতা দিয়েই আমরা রোজগার করতে শিখি। ১৯৬০ সালে, যখন আমি হাই স্কুলে ছিলাম কেউ স্কুলে পড়াশোনায় ভাল হলে লোকে ধরেই নিত যে এই মেধাবী ছাত্রটি ডাক্তার হবে। প্রায়ই ছাত্রটিকে কেউ জিজ্ঞাসাও করত না সে আদৌ ডাক্তার হতে চায় কি না। যেহেতু এই পেশাতেই সবচেয়ে বেশি অর্থোপার্জনের প্রতিশ্রুতি ছিল তাই সকলের এ রকমই ধারণা সৃষ্টি হতো।

আজকাল ডাক্তাররা এমন আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে যে আমি আমার শত্রুরও এমন বিপদ চাইব না : ইনসিওরেন্স কোম্পানি পরিচালিত ব্যবসায়, স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নিয়ন্ত্রণ, সরকারি হস্তক্ষেপ, অপচিকিৎসার অভিযোগ, আরও কত কি। আজকাল ছোট ছেলেমেয়েরা বাস্কেটবল তারকা, টাইগার, উডের মত গলফার, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, মুভি স্টার, বুক স্টার, বিউটি কুইন অথবা স্ট্রিটের ব্যবসায়ী হতে চায়। কারণ এখন ঐসবেই নামযশ, অর্থ আর সম্মান। তাই আজকাল শিশুকে স্কুলে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলা কঠিন। তারা জানে পেশাদারী সাফল্য এখন আর শুধুমাত্র শিক্ষাগত সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত নয়, একদিন যেমন- ছিল। যেহেতু ছাত্ররা কোনো আর্থিক দক্ষতা ছাড়াই স্কুল থেকে বেরোয়, কোটি কোটি শিক্ষিত লোক তাদের পেশায় সফল হয়েও শেষ অব্দি আর্থিক সংগ্রামের পদ্ধতিটা সম্মুখীন হয়। তারা আরও পরিশ্রম করে, কিন্তু এগোতে পারে না। তাদের অর্থোপার্জনের পদ্ধতিটা দেখানো হয়েছে তবে অর্থোপার্জনের পর আপনি কি করবেন, কি করে অন্যদের কাছ থেকে সুরক্ষিত রাখবেন, কতদিন এটা নিজের কাছে রাখবেন, আর সেই অর্থের জন্য কতটা পরিশ্রম করতে পারে। বেশির ভাগ লোক বলতে পারে না তাঁরা কেন অর্থের জন্য সংগ্রাম করছে, কারণ তাঁরা ‘ক্যাশফ্লো’ বোঝে না। একজন ব্যক্তি উচ্চশিক্ষিত হতে পারে, পেশায় সফল হতে পারে অথচ আর্থিক বিষয়ে সে হয়তো নিরক্ষর। এইসব লোকেরা প্রায়ই তাদের প্রয়োজনের চেয়েও বেশি খাটে কারণ তাঁরা শিখেছে পরিশ্রম করে কাজ করতে হয় কিন্তু অর্থকে দিয়ে পরিশ্রম করে কাজ করাতে শেখেনি। অর্থ লাভের সুখস্বপ্ন কিভাবে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে তারই গল্প পরিশ্রমী মানুষের জীবনযাত্রার একটা নির্দিষ্ট ছক থাকে। সদ্যবিবাহিত, সুখী উচ্চশিক্ষিত অল্পবয়সী দম্পতি সহবাসের জন্য দু’জনের মধ্যে একজনের ভাড়া করা ছোট ঘরে থাকতে যায়। তৎক্ষণাৎ তারা বুঝতে পারে যে তারা সঞ্চয় করছে কারণ তারা দু’জনে একসঙ্গে থাকছে। সমস্যাটা হচ্ছে, ঘরটা ছোট। তারা সন্তান চায়, তাই তারা তাদের স্বপ্নের বাড়িটা কেনার জন্য অর্থসঞ্চয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এখন রোজগার দ্বিগুণ, দু’জনেই নিজের নিজের কর্মজীবনে মনোনিবেশ করে। তাদের রোজগার বাড়তে শুরু করে। তাদের আয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের খরচও বাড়তে থাকে।

বেশির ভাগ লোকদের সর্বপ্রধান কাজ খরচ করে যাওয়া

বেশির ভাগ লোকদের সর্বপ্রধান কাজ খরচ করে যাওয়া। অনেকে মনে করেন ইনকাম ট্যাক্সই বুঝি সবচেয়ে খরচাসাপেক্ষ, কিন্তু বেশিরভাগ আমেরিকানদের জন্য সোস্যাল সিকিউরিটি (সামাজিক নিরাপত্তা) ট্যাক্সই সবচেয়ে বেশি হয়। একজন কর্মীর মনে হতে পারে যে সোস্যাল সিকিউরিটি ট্যাক্সের সঙ্গে মেডিকেয়ার (চিকিৎসা ও পরিচর্যার) ট্যাক্স যোগ করলে মোটামুটি ৭.৫ শতাংশ দাঁড়ায়, কিন্তু বাস্তবে এটা দাঁড়ায় ১৫ শতাংশ কারণ মালিককেও সোস্যাল সিকিউরিটির সমতুল্য দিতে হয়। সংক্ষেপে, এই টাকাটা মালিক আপনাকে দিতে পারেন না। তার উপর, আপনার মাইনে থেকে যে সোস্যাল সিকিউরিটি ট্যাক্স কেটে নেওয়া হয়েছে তাতেও ইনকাম-ট্যাক্স দিতে হয়, আয়ের এই অংশটা কখনই আপনার হাতে পৌঁছায় না, কারণ এটা সোজাসুজি সোস্যাল সিকিউরিটিতে চলে গেছে।

তারপর তাদের দায় বাড়তে থাকে।

দায়

এটা সবচেয়ে ভাল বোঝান যায় আবার সেই অল্পবয়সী দম্পতির জীবনে ফিরে গিয়ে। তাদের আয় বেড়ে যায় তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের স্বপ্নের বাড়ি কিনবে। নিজেদের বাড়িতে এবার তাদের একটা নতুন ট্যাক্স, সম্পত্তি ট্যাক্স দিতে শুরু করতে হয়। তারপর তারা বাড়িতে এবার তাদের একটা নতুন গাড়ি কেনে, বাড়ির সঙ্গে মানানসই নতুন আসবাব আর নতুন জিনিসপত্র কেনে। হঠাৎ তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয় তারা দেখে মর্টগেজের দেনায় আর ক্রেডিট কার্ডের দেনায় জর্জরিত তাদের দায়-এর আতঙ্ক গ্রাস করে।

তারা এবার ইঁদুর দৌড়ে বন্দী হয়ে পড়েছে। একটি সন্তান জন্ম নেয়। তারা আরও পরিশ্রম করে। এই প্রক্রিয়ায় পুনরাবৃত্তি হয়। আরও অর্থ আরও বেশি ট্যাক্স, যাকে ‘ব্র্যাকেট ক্রীপ’ বলে। ডাকে একটা ক্রেডিট কার্ড এসে পৌঁছায়। তারা সেটা ব্যবহার করে। কার্ড ঋণের সীমা স্পর্শ করছে। একটা বন্ধকী কোম্পানি ফোনে জানায় তাদের সবচেয়ে বড় ‘সম্পত্তি’ তাদের বাড়ির মূল্য বেড়েছে। কোম্পানি থেকে তাদের ‘বিল কনসলিডেশান’ লোন-এর প্রস্তাব দেয়। কারণ তাদের রেকর্ড খুব ভাল। কোম্পানি তাদের আরও বলে, গ্রাহকদের চড়া সুদের ঋণ ক্রেডিট কার্ড দিয়ে চুকিয়ে দেওয়াই ভাল। আর তাছাড়া তাদের বাড়ির সুদে একটা করে ছাড় আছে। তারা এইরকমই করে এবং চড়া সুদযুক্ত ক্রেডিট কার্ডের পাওনা চুকিয়ে দেয়। তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তাদের ক্রেডিট কার্ডের পাওনা চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের গ্রাহকের ঋণ এখন ‘হোম মর্টগেজ’-এ বদলে গেছে। তাদের কম ঋণশোধ করতে হচ্ছে কারণ তাদের দেনা ৩০ বছরের কিস্তিতে বাড়ানো হয়েছে। এটা খুবই বুদ্ধিমানের মত কাজ হয়েছে।

তাদের পড়শী তাদের কেনাকাটা করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, তখন ‘মেমোরিয়াল ডে’-এর সেল চলছে। অর্থসঞ্চয়ের এ এক সুযোগ। তারা নিজেদের বোঝায়, ‘আমরা কিছু কিনবো না। শুধু যাবো আর দেখবো।’ কিন্তু যদি হঠাৎ কিছু চোখে পড়ে তাই ধার চুকিয়ে দেওয়া পরিষ্কার ক্রেডিট কার্ডটিও ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।

আমার এই ধরনের তরুণ দম্পতির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। তাদের নাম পাল্টে যায় কিন্তু তাদের আর্থিক উভয়সঙ্কট একই থাকে। তারা আমার বক্তব্য শুনতে কোনো একটা বক্তৃতায় আসে। তারা আমায় জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কি আমাদের আরও অর্থোপার্জনের উপায় বলতে পারেন?’ তাদের খরচ করার অভ্যাস আরও রোজগারের সন্ধানের প্রধান কারণ।

তারা একথাও জানে না যে তাদের যে অর্থ আছে তা তারা যেভাবে খরচ করছে সেটাই আসল সমস্যা, সেটাই অর্থ নিয়ে সংগ্রামের মূল কারণ। আর্থিক নিরক্ষরতা ও সম্পত্তি এবং দায়বদ্ধতার প্রভেদ না বোঝাই এর কারণ।

প্রায়ই, আরও বেশি অর্থলাভ আর্থিক সঙ্কট দূর করতে পারে না। তার জন্য চাই বুদ্ধি। যারা দেনায় ডুবে আছে তাদের সবার উদ্দেশ্যে আমার বন্ধু প্রায়ই একটি কথা বলেন, ‘যদি দেখো একটা গর্ত খুঁড়ে তুমি নিজেকেই তাতে ফেলে দিয়েছে, তাহলে গতটা খোঁড়া বন্ধ করো।’

ছেলেবেলায় আমার বাবা প্রায়ই আমাদের বলতেন জাপানিরা তিনটে ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন ছিল : তলোয়ার, গয়না আর আয়না।’

তলোয়ার অস্ত্রসস্ত্রের ক্ষমতার প্রতীক। আমেরিকা শতসহস্র ডলার অস্ত্রশস্ত্রে খরচ করেছে তাই তার সামরিক শক্তি সমগ্র পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ।

‘গয়না অর্থের ক্ষমতার প্রতীক।’ এই প্রচলিত কথায় কিছু সত্যতা আছে। ‘শ্রেষ্ঠ নিয়মটা জেনে রাখো। যার কাছে সোনা আছে সে নিয়ম-কানুন তৈরি করে।

আয়না আত্মজ্ঞানের ক্ষমতার প্রতীক। তিনটি জিনিসের মধ্যে, জাপানিদের মধ্যে এই আত্মজ্ঞানই সবচেয়ে মূল্যবান।

গরীব আর মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রায়ই অর্থের ক্ষমতাকে তাদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার দেয়। তারা সকালে উঠেই অর্থ রোজগারের জন্য, আর ও পরিশ্রম করবে বলে কাজে দৌড়ায়। তারা নিজেদের একবার প্রশ্নও করে না এসবের কোনো অর্থ আছে কি না। এরা অর্থের বিষয়ে সম্পূর্ণ বুঝতে পারে না। তাই অর্থের ভয়াবহ ক্ষমতাকে তাদের উপর নেতৃত্ব করতে দেয়। এইভাবে অর্থের ক্ষমতা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।

কিন্তু তারা যদি আয়নার ক্ষমতাকে ব্যবহার করতো তাহলে হয়তো নিজেদের জিজ্ঞাসা করত, ‘এর কি কোনো অর্থ আছে?’ বেশির ভাগ লোক প্রায়ই নিজেদের অন্তরের জ্ঞানকে, ভিতরকার প্রতিভাকে বিশ্বাস না করে জনতার সঙ্গে চলতে ভালবাসে। তারা কাজ করে কারণ সবাই তাই করে। তারা প্রশ্ন করার বদলে মেনে নেয়। প্রায়ই তারা বুদ্ধি না খাটিয়ে তাদের যা বলা হয়েছে তার পুনরাবৃত্তিত করে। যেমন- ‘একাধিক বিনিয়োগ করুন’ অথবা ‘আপনি বাড়ি একটি সম্পত্তি’, ‘আপনার বাড়ি আপনার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ’, ‘আপনি বেশি ধার নিলে ট্যাক্সে একটা ছাড় পাবেন’, ‘একটা নিরাপদ চাকরি খুঁজুন, ‘ভুল করবেন না’, ‘ঝুঁকি নেবেন না।’

বলা হয় যে বেশির ভাগ লোকের জন্য সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা মৃত্যু ভয়ের চেয়েও বেশি ভয়াবহ। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, জনসমক্ষে বলার ভয়ের কারণ সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হবার ভয়, সবার থেকে আলাদা হবার ভয়, সমালোচনার ভয়, হাস্যস্পদ হবার ভয় এবং নির্বাসিত হবার ভয়। বাকিদের থেকে ভিন্ন হবার ভয় মানুষের জন্য সমস্যার নতুন সমাধান খোঁজার পথে বাধা সৃষ্টি করে।

সেই জন্য আমার শিক্ষিত বাবা বলেছিলেন যে জাপানিরা আয়নার ক্ষমতাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়। কারণ আমরা যখন মানুষ হিসাবে আয়নার ভিতরে দেখি তখনই সত্যকে দেখতে পাই। বেশির ভাগ লোক যে ‘সাবধানে খেলো’ কথাটা বলে তার প্রধান কারণ হচ্ছে ভয়। এটা খেলাধুলা, সম্পর্ক, কর্মজীবন ও অর্থ সবেতেই প্রযোজ্য।

সেই একই ভয়, সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হবার ভয়ে সব মেনে নেয়। সর্বসাধারণের মতামতে অথবা জনপ্রিয় ধারার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করে না। ‘আপনার বাড়ি একটা সম্পত্তি।’ ‘বিল কনসোলিডেশান লোন নিন আর ধার থেকে মুক্ত হোন’, ‘আরও পরিশ্রম করুন।’ ‘এটা পদোন্নতি।’ ‘একদিন আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট হব’। ‘অর্থ সঞ্চয় করুন’, ‘মাইনে বাড়লে আমি একটা বড় বাড়ি কিনব’, ‘মিউচুয়াল ফান্ডে ‘টাকা রাখা নিরাপদ’, ‘টিকল মি এলমো ডল এখন স্টকে নেই কিন্তু আমার কাছে একটা রয়ে গেছে যার জন্য এখনও কোনো ক্রেতা আসেননি।’

নানা আর্থিক সমস্যা জনতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, তাদের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার চেষ্টার ফলে নানা আর্থিক সমস্যা হয়েছে। মাঝে মাঝে আমাদের সবারই আয়নাতে নিজের প্রতিফলন দেখা উচিত এবং বাইরের ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ না করে আমাদের অন্তরের জ্ঞান যা বলছে তার প্রতি সততা দেখানো প্রয়োজন।

মাইক আর আমার বয়স যখন ১৬ বছর তখন আমাদের স্কুলে সমস্যা দেখা দিল। আমরা মন্দ ছিলাম না। তবে জনতা থেকে আলাদা হতে শুরু করেছিলাম। স্কুলের পরে আর সপ্তাহান্তে আমরা মাইকের বাবার জন্য কাজ করতাম। মাইক আর আমি কাজের পর প্রায়ই তার বাবার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতাম যেখানে তিনি ব্যাঙ্কার, ইনভেস্টার, ম্যানেজার আর কর্মীদের সঙ্গে মিটিং করতেন। আমরা ঐ একই টেবিলে চুপচাপ বসে দেখতাম। এই একজন মানুষ যিনি ১৩ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে আজ এই শিক্ষিত মানুষগুলোকে পরিচালনা করছেন, শেখাচ্ছেন, অর্ডার দিচ্ছেন এবং প্রশ্ন করছেন তারা সবসময় তার আজ্ঞাধীন থাকছেন এবং তাঁর অনুমোদন না পেলে মাথা নিচু করে কুঁকড়ে যাচ্ছেন।

এই একজন মানুষ যিনি জনতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেননি। তিনি স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। ‘আমাদের এভাবে কাজ করতে হচ্ছে কারণ এভাবেই সবাই করেছে’ এসব কথা তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। তিনি ‘পারি না’ এ কথাটাও ঘৃণা করতেন। আপনি যদি ওঁকে দিয়ে কিছু করাতে চান তাহলে শুধু বলুন, “আমার মনে হয় না আপনি এটা করতে পারবেন।’ মাইক আর আমি স্কুল আর কলেজে যা শিখেছিলেন তার থেকে অনেক বেশি ওঁর মিটিং এ বসে শিখেছি। মাইকের বাবার স্কুলের শিক্ষা ছিল না কিন্তু তিনি আর্থিক বিষয়ে সুশিক্ষিত ছিলেন আর তাই সফল হয়েছিলেন। তিনি আমাদের বারবার বলতেন, ‘একজন বুদ্ধিমান লোক নিজের চেয়েও বুদ্ধিমান মানুষকে চাকরিতে নিযুক্ত করে।’ তাই মাইক আর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুদ্ধিমান লোকেদের কথা শোনা আর তার সঙ্গে শেখার সুযোগ পেতাম।

কিন্তু এই কারণে মাইক আর আমি আমাদের শিক্ষকদের শেখানো বন্ধমূল ধারণা মেনে নিতে পারতাম না। আর তাতেই সমস্যা হতো। যখনই আমাদের শিক্ষক বলতেন, ‘তোমরা যদি ভাল নম্বর না পাও, তোমরা বাস্তব জগতে সফল হবে না,’ মাইক আর আমি সংশয় নিয়ে থাকতাম। যখন আমাদের বাঁধাধরা কার্যপ্রণালী মেনে নিতে বলা হতো। আর নিয়মের বাইরে যেতে বারণ করা হতো আমরা বুঝতে পারতাম স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে সৃষ্টিধর্মী কাজকে নিরুৎসাহিত করে। আমরা ধনী বাবার কথাগুলো বুঝতে শুরু করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন স্কুলের পাঠ্যক্রম রচনা করা হয় ভাল কর্মী তৈরি করার জন্য, ভাল মালিক নয়।

কখনও কখনও মাইক আর আমি আমাদের শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করতাম কি করে পাঠ্যবিষয় কি করে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করা যায় অথবা আমরা কেন অর্থ সম্বন্ধে বা অর্থের কাজ করার পদ্ধতি সম্বন্ধে কেন পড়ি না। প্রায়ই পরের প্রশ্নটার উত্তর পেতাম- কারণ অর্থ গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা যদি পড়াশোনায় ভাল করতে পারি অর্থলাভ সুনিশ্চিত। আমরা অর্থের ক্ষমতা সম্পর্কে যত বেশি জানতে পারছিলাম ততই আমরা শিক্ষক এবং সহপাঠিদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছিলাম।

আমার উচ্চশিক্ষিত বাবা কখনও আমাকে ভাল নম্বরের জন্য চাপ দেননি। আমি প্রায়ই ভাবতাম কেন দেননি। তবে অর্থ নিয়ে আমাদের মতভেদ সুস্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আমার যখন ১৬ বছর বয়স, আমার বাবা-মার চেয়ে আমার অর্থের বিষয়ে বেশি ভাল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। আমি লাভ-ক্ষতির হিসাব রাখতে পারতাম, ট্যাক্স অ্যাকাউন্টেট, কর্পোরেট অ্যাটর্নি, ব্যাঙ্কার, রিয়্যাল স্টেট ব্রোকার, ইনভেস্টার ইত্যাদিদের বক্তব্য শুনতাম। আমার বাবা শুধু শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতেন। একদিন আমার বাবা আমায় বলছিলেন আমাদের বাড়িটাই আমাদের সব থেকে বড় বিনিয়োগ কেন। আমি তাকে বোঝালাম বাড়িটা তেমন ভাল বিনিয়োগ নয়, এক অপ্রিয় তর্ক শুরু হয়ে গেল।

নিচের চিত্রটা আমার ধনবান বাবা আর নির্ধন বাবার নিজেদের বাড়ি সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির প্রভেদ দেখাচ্ছে। এক বাবা ভেবেছিলেন বাড়িটা তার সম্পত্তি আর অন্য বাবা ভেবেছিলেন এটা একটা দায়।

এটা একটা দায়

আমার মনে আছে আমি নিচের ছবিটা এঁকে আমার বাবাকে ক্যাশফ্লোর গতিটা বুঝিয়েছিলাম। এ ছাড়াও আমি তাকে দেখিয়েছিলাম একটা বাড়ির মালিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ কত বেড়ে যায়। একটা বড় বাড়ির মানে আরও বেশি খরচ, এবং খরচের সারি দিয়ে ক্রমাগত ক্যাশফ্লো হতে থাকে।

আজও বাড়িটা সম্পত্তি যে নয় এই বিষয়ে আমার তর্ক হয়। আমি জানি অনেক লোকের ক্ষেত্রেই বাড়িটা তাদের স্বপ্ন এবং সব থেকে বড় বিনিয়োগ এবং নিজের বাড়ি থাকা কিছু না কিছু না থাকার চেয়ে ভাল।

একটু অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গিতে এই জনপ্রিয় মতকে আমি দেখবার প্রস্তাব দিতে চাই। আমার স্ত্রী এবং আমাকে যদি একটা আরও বড় আর ঝকঝকে বাড়ি কিনতে হয় আমরা বুঝতে পারব এটা একটা সম্পত্তি হবে না বরং একটা দায় হয়ে উঠবে। কারণ এটা আমাদের পকেট থেকে পয়সা নিয়ে নেবে।

তাই আমার যুক্তি রাখছি। আমি জানি বেশির ভাগ লোক এতে একমত হবে না কারণ সুন্দর বাড়ির সঙ্গে এক গভীর আবেগ যুক্ত থাকে। আর অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে অতিরিক্ত আবেগ আর্থিক বুদ্ধি কমিয়ে দেয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অর্থ প্রতিটি ফয়সালাকে আবেগপ্রবণ করে তুলতে পারে।

আয়

১। বাড়ির প্রসঙ্গে, আমি একটা কথা বলব। বেশির ভাগ লোক সারাজীবন কাজ করে তাদের বাড়ি কেনার খরচ মেটায়, অথচ সে বাড়িটা কখনই তাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন হয় না। অন্যভাবে বলা যায়, বেশিরভাগ লোক কয়েক বছর পর পর নতুন বাড়ি কেনে, আর আগেকার ঋণশোধ করার জন্য প্রত্যেকবার নতুন করে তিরিশ বছরের ঋণ নেয়।

২। যদিও মর্টগেজ পাওনা মেটালে সুদের ট্যাক্সের ছাড় পাওয়া যায়, তাদের ট্যাক্স বাদ দিয়ে বকেয়া ডলারে বাকি খরচ চলে। এমনকি মর্টগেজ শোধ হয়ে যাবার পরও এমন ব্যবস্থাই চলে।

৩। সম্পত্তির ট্যাক্স। আমার স্ত্রীর বাবা- মার সম্পত্তি ট্যাক্স মাসে ১,০০० ডলার হয়ে যাওয়ায় তাঁরা খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁদের অবসর গ্রহণের পর এমনটি হয়। যার ফলে এই বৃদ্ধি তাদের অবসরের বাজেটের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, তাই তারা অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

৪। সবসময়ই যে বাড়ির দাম বাড়ে তা নয়। আমার এখনও এমন কয়েকজন বন্ধু আছে যাদের বাড়ির মূল্য ১৯৯৭ সালে মিলিয়ান ডলার ছিল কিন্তু এখন সেগুলো ৭,০০,০০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।

৫। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সুযোগের সদ্ব্যবহার না করতে পারলে। যদি আপনার সব অর্থ বাড়তি আটকে পড়ে, আপনি প্রচুর পরিশ্রম করতে বাধ্য হবেন কারণ আপনার অর্থ ক্রমাগত খরচের খাতে বেরিয়ে যাচ্ছে, সম্পত্তির খাতায় কিছুই যোগ হচ্ছে না। এটা মধ্যবিত্তদের ক্যাশফ্লো-র ধাঁচ। যদি একজন অল্পবয়সী যুবক-যুবতী শুরু থেকে সম্পত্তির খাতায় বেশি অর্থসঞ্চয় করে, পরবর্তী বছরগুলো তাদের সহজ হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন তারা ছেলেমেয়েদের কলেজে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত হবে। তাদের সম্পত্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অন্য খরচ বহন করতে সাহায্য করবে। প্রায়ই একটা বাড়ি শুধু ‘হোম লোনে’র বোঝা টানার গাড়িতে পরিণত হয়, যার ফলে পর্বত প্রমাণ খরচ চলতেই থাকে।

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রথম জীবনে বিনিয়োগের পোর্টফোলিও শুরু করার পরিবর্তে একটা অত্যন্ত মূল্যবান বাড়ির মালিক হবার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত অন্ততপক্ষে তিন রকম প্রভাব ফেলে :

১। সময়ের অপচয়, এসময়ে অন্যান্য সম্পত্তির দাম বাড়তে পারত।

২। অতিরিক্ত পুঁজি নষ্ট, যা বাড়ি-সংক্রান্ত রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর মাত্রায় খরচ না করলে অন্য কোথাও বিনিয়োগ করা যেত।

৩। শিক্ষা নষ্ট। প্রায়ই লোকেরা তাদের বাড়ি, সঞ্চয় এবং অবসর গ্রহণ পরিকল্পনাকে তাদের সম্পত্তি মনে করে। যেহেতু তাদের অর্থাভাব তাই তারা বিনিয়োগই করে না। ফলে তাদের বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা হয় না। তারা কেউই বিনিয়োগের ‘সফিসটিকেটেড ইনভেস্টা’র হতে পারে না। সবচেয়ে ভাল বিনিয়োগ প্রথমে ‘সফিসটিকেটেড ইনভেস্টা’র হতে পারে না। সবচেয়ে ভাল বিনিয়োগ প্রথম ‘সফিসটিকেটেড ইনভেস্টা’র কাছেই বিক্রি করা হয়। তারপর তিনি সতর্ক বিনিয়োগকারীদের বিক্রি করেন।

আয়
আয়

আমার শিক্ষিত বাবার ব্যক্তিগত আর্থিক বিবৃতি ইঁদুর দৌড়ে আটকে পড়া মানুষের জাজ্বল্য প্রমাণ। তার খরচ ও রোজগার সমপরিমাণ, তাই তিনি কখনই সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে পারেন না। ফলে তার দায়গুলো, যেমন- মর্টগেজ বা ক্রেডিট কার্ডে ঋণ, সম্পত্তির চেয়ে বেশি হয়ে যায়। নিচের ছবিটা এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আমার ধনবান বাবার ব্যক্তিগত আর্থিক বিবৃতিতে প্রতিফলিত হয় এমন এক জীবন যা ন্যূনতম দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণ বিনিয়োগেই উৎসর্গীকৃত।

আয়

আমার ধনী বাবার আর্থিক বিবৃতি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় কেন ধনীরা আরও ধনী হতে থাকে। সম্পত্তির সারি থেকে যথেষ্ট রোজগার যাতে খরচের সব ভার বহন করা যায়, এবং বকেয়া অর্থ সম্পত্তিতেত বিনিয়োগ করা যায়। সম্পত্তির সারিও বাড়তে থাকে আর তাই এর থেকে যা রোজগার হয় তাও বাড়তে থাকে।

মধ্যবিত্তরা সবসময় আর্থিক সংগ্রামের মুখোমুখী থাকে। তাদের প্রধান রোজগার হয় বেতন থেকে, আর যেমন- তাদের বেতন করও বাড়ে। তাদের খরচও তাদের বেতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। শুরু হয় ইঁদুর দৌড়। তারা তাদের বাড়িকে প্রধান সম্পত্তি মনে করে, আয় হতে পারে এরকম সম্পত্তিতে তারা বিনিয়োগ করে না।

আয়

আজকের ঋণ-অধ্যুষিত সমাজের ভিত্তি হল আপনার বাড়িকে বিনিয়োগ হিসাবে গণ্য করা আর বেতন বাড়লে আপনি আরও বড় একটা বাড়ি কিনতে পারেন অথবা আরও খরচা করতে পারবেন এমন কল্পনা করা। এই ক্রমবর্ধমান খরচের প্রণালী পরিবারগুলোকে আরও বেশি দেনায় ঠেলে দেয়, ফলে আরও আর্থিক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, অথচ তাঁরা হয়তো তাদের কাজে উন্নতি করছেন এবং তাদের নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবনাত্রার কারণ দুর্বল আর্থিক শিক্ষা।

১৯৯০-র দশকে বিপুলসংখ্যায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করা-ব্যবসার সংক্ষেপীকরণ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আর্থিক দুর্বলতার উপর আলো ফেলেছে। হঠাৎ কোম্পানির পেনসন প্ল্যান 401k প্ল্যান-এ পরিবর্তিত হচ্ছে। স্পষ্টতই সোস্যাল সিকিউরিটিরও বিপজ্জনক অবস্থা এবং অবসরের পুঁজি হিসাবে সেটা গণ্য করা যাবে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ভয় দেখা দিচ্ছে। ভাল কথা এই যে আজকাল এই লোকেরা এই সমস্যাগুলো ভালমত বুঝতে পারছেন এবং মিউচুয়াল ফান্ড কেনা শুরু করছেন। এই বিনিয়োগ বৃদ্ধিই স্টক মার্কেটের স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান সুদীর্ঘ লাইনের জন্য দায়ী। আজকাল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দাবি মেটানোর জন্য ক্রমশ নিত্যনতুন মিউচুয়াল ফান্ড সৃষ্টি হচ্ছে।

মিউচুয়াল ফান্ডগুলো তাই জনপ্রিয়। সাধারণ মিউচুয়াল ফান্ডের ক্রেতারা ট্যাক্স আর মর্টগেজ টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের কলেজের জন্য সঞ্চয় করা আর ক্রেডিট কার্ডের দেনা মেটানোয় ব্যস্ত থাকে। কি করে বিনিয়োগ করা যায় তা তাদের শেখার, পড়াশোনা করার সময় নেই। তাই তারা মিউচুয়াল ফান্ডের ম্যানেজারের পারদর্শিতার উপর ভরসা করেন। তাছাড়া, যেহেতু মিউচুয়াল ফান্ডে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ করা যায়, তারা মনে করেন সেহেতু তাদের অর্থ তাই সুরক্ষিত আছে।

একদল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী মিউচুয়াল ফান্ড ব্রোকার আর ফিনানসিয়াল প্ল্যানারদের এই ‘ডাইভারসিফই’-নীতিতে বিশ্বাসী। সাবধানে খেলুন। ঝুঁকি এড়িয়ে চলুন।

আসল কথা এই যে প্রথম জীবনে আর্থিক শিক্ষার অভাবেই সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকের ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। তাদের সাবধানে খেলতে হয়, কারণ তাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল থাকে। তাদের ব্যালেন্স শীটে ভারসাম্যের অভাব থাকে, তাতে দায়ের বোঝা বড় বেশি, অথচ আয়ের কোনো উৎস বা সম্পত্তি থাকে না। তাদের বেতনই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। তাদের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে তাদের মালিকের উপর নির্ভরশীল থাকে।

আয়

তাই যখন জীবনের একটা সুবর্ণ সুযোগ আসে এই একই লোকেরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন না। তাদের সাবধানে খেলতেই হবে, কারণ তারা পরিশ্রমী, তাদের সর্বোচ্চ ট্যাক্স দিতে হচ্ছে আর তারা দেনার বোঝায় ডুবে আছেন।

আমি এই বিভাগের শুরুতে যেমনটি বলেছি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হচ্ছে সম্পত্তি এবং দায়- এর মধ্যে তফাত জানা। একবার আপনি তফাতটা বুঝতে পারলে শুধু আয় হতে পারে এমন সম্পত্তি কেনায় মনোনিবেশ করুন। এটাই ধনী হবার পথে প্রথম ও সেরা পদক্ষেপ। এটা করে দেখুন, আর আপনার সম্পত্তির তালিকা বাড়তে থাকবে। দায় আর খরচ কম করার দিকে দৃষ্টি দিন। এর ফলে সম্পত্তির তালিকায় আরও অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে। শিগগির আপনার সম্পত্তির বুনিয়াদ এত গভীর হবে যে আপনি আরও দূরকল্পী বিনিয়োগ করতে সমর্থ হবেন। এমন বিনিয়োগ যা ১০০ শতাংশ থেকে সীমাহীন লাভ দিতে পারে। ৫,০০০ ডলারের বিনিয়োগ দ্রুত এক মিলিয়ান বা তারও বেশি হয়ে উঠতে পারে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই বিনিয়োগকে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ বলবে। বিনিয়োগটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। সরল অথং-সংক্রান্ত বুদ্ধি যার প্রারম্ভ আর্থিক স্বাক্ষরতা, সেই স্বাক্ষরতার অভাবে এটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়।

জনতা যা করে আপনি যদি তাই করেন তাহলে নিচের ছবিটা পাবেন।

একজন কর্মী এবং একই সঙ্গে বাড়ির মালিক হিসাবে আপনার পরিশ্রমের ফল সাধারণত এইরকম দেখায় :

১। আপনি অন্য কারোর জন্য কাজ করেন। বেশির ভাগ লোক, যারা বেতনের জন্য কাজ করে, মালিক এবং শেয়ার হোল্ডারদের আরও ধনী করে তোলে। আপনার চেষ্টা আর সাফল্য মালিককে অবসর গ্রহণ করতেও সফল হতে সাহায্য করবে।

২। আনি গভর্নমেন্টের কাজ করেন। আপনার চোখে দেখার আগেই গভর্নমেন্ট তার ভাগটা আপনার বেতন থেকে নিয়ে নেয়। আরও পরিশ্রম করে কাজ করে আপনি শুধু গভর্নমেন্টের নিয়ে নেওয়া ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়ান- বেশির ভাগ লোক জানুয়ারি থেকে মে অবধি শুধু গভর্নমেন্টের জন্যই কাজ করে।

৩। আপনি ব্যাংকের জন্য কাজ করেন। ট্যাক্স কেটে নেবার পর আপনার সব থেকে বড় খরচ সাধারণত মর্টগেজ আর ক্রেডিট কার্ডের দেনা শোধ করার।

শুধুমাত্র খেটে কাজ করার সমস্যা হচ্ছে এই তিনটে স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপনার অতিরিক্ত পরিশ্রমের বেশির ভাগটা নিয়ে দেয়। কিভাবে আপনি এবং আপনার পরিবার সোজাসুজি আপনার অতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে লাভবান হতে পারেন সেটা আপনার শিখতে হবে।

একবার নিজের কাজ নিজে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কিভাবে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন? অধিকাংশ মানুষ নিজের জীবিকা বাঁচিয়ে বেতনের টাকা দিয়ে অর্জিত সম্পত্তির মূল্য শোধ করে।

সম্পত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে তারা কি করে নিজেদের সফলতা পরিমাপ করবেন? মানুষ কখন বুঝতে পারে যে ধনী, যে তাঁর অর্থসম্পদ আছে? সম্পত্তি এবং দায়বদ্ধতার বিষয়ে নিজস্ব সংজ্ঞার মতই ‘ধন’ বিষয়েও আমার নিজস্ব সংজ্ঞা আছে। আসলে আমি এটা বাকমিনস্টার ফুলার নামে এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে ধার করেছি। কেউ তাকে হাতুড়ে বলে, কেউ বলে এক জীবিত, অনন্য প্রতিভাশালী ব্যক্তি। কয়েক বছর আগে তিনি স্থপতিজগতে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিলেন কারণ তিনি ১৯৬১-এ ‘জিওডেসিক ডোম’ নামক কিছু পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছিলেন। আবেদনপত্রে ফুলার ধন সম্বন্ধেও কিছু উল্লেখ করেছিলেন। প্রথমে এটা হয়তো বেশ বিভ্রান্তিকর লাগে কিন্তু কিছুক্ষণ পড়ার পর এর একটা অর্থ আছে মনে হয় : ধন মানুষ আগামী কতদিন বেঁচে থাকতে পারবে সেই ক্ষমতা…অথবা আমি যদি আজ কাজ করা বন্ধ করে দেই আমি আর কতদিন বাঁচতে পারব?

নেটওয়ার্ক অর্থাৎ সম্পত্তি ও দায়ের প্রভেদ যা প্রায়শই মানুষের মহামূল্য বাজে জিনিস ও সে সব জিনিস সম্বন্ধে মতামত দিয়ে পরিপূর্ণ। এই নেটওয়ার্ক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই সংজ্ঞা, এতে একটি সত্যিকারের ও সঠিক মাপ নেবার সম্ভাবনা থাকে। এখন আমি আমার আর্থিক স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে কোথায় দাঁড়িয়ে তা বুঝতে, মাপতে উপলব্ধি করতে পারি।

অনেক সময় নেট মূল্যের মধ্যে যে সম্পত্তি এখন টাকা দিচ্ছে না যেমন- কোনও জিনিস যা কেনা হয়েছে আর এখন গারেজে পড়ে আছে, তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, ধন দিয়ে শুধু মাপা হয় আপনার অর্থ কত উপার্জন করছে আর আপনার আর্থিক আয়ু কত।

ধন-সম্পত্তির অর্থ সম্পদের সারি ও খরচের সারি থেকে ক্যাশফ্লো-র তুলনামূলক পরিমাপ।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আমার সম্পত্তি থেকে প্রতি মাসে ১,০০০ ডলার ক্যাশফ্লো হয়। আর আমার মাসিক খরচ ২,০০০ ডলার। আমার ধন কতখানি?

বামিনস্টার ফুলারের সংজ্ঞায় ফিরে যাওয়া যাক। তার সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি আর কতদিন বাঁচতে পারি? ধরা যাক, মাসটি ৩০ দিনের। ঐ সংজ্ঞা অনুযায়ী আমার অর্ধেক মাসের উপযুক্ত ক্যামফ্লো আছে।

আমি যখন আমার সম্পত্তি থেকে ২,০০০ ডলার ক্যাশফ্রো পাব আমি ধনী হব।

কাজেই আমি এখনও বড়লোক নই কিন্তু আমার ধন আছে। আমার এখন সম্পত্তি থেকে যা আয় হয় তা আমার পুরো মাসের খরচ চালাতে পারে। আমি যদি আমার খরচ বাড়াতে চাই, প্রথমে আমার সম্পত্তি থেকে ক্যাশফ্লো বাড়াতে হবে এতটা উদ্বৃত্ত ধন আমি বজায় রাখতে পারি। লক্ষ্য করে দেখলে ঠিক এই সময়ে আমি আর আমার বেতনের ওপর নির্ভরশীল নই। আমি মনঃসংযোগ করে এমন একটা সম্পত্তি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছি যা আমাকে আর্থিক স্বাধীনতা দিয়েছে। আমি যদি আমার চাকরি আজ ছেড়ে দেই, আমি আমার মাসের খরচ আমার সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত ক্যাশফ্লো দিয়ে চালাতে পারব।

আমার পরবর্তী উদ্দেশ্য হবে আমার সম্পত্তি থেকে অতিরিক্ত ক্যাশফ্লো বিনিয়োগ করে সম্পত্তির তালিকায় আবার ঢোকানো। আমার সম্পত্তির তালিকায় যত অর্থ যাবে তত আমার যাবতীয় সম্পত্তি বৃদ্ধি পাবে। আমার সম্পত্তি যত বাড়বে, তত আমার ক্যাশফ্লো বাড়বে। আর যতদিন আমি আমার খরচ সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত ক্যাশফ্লো থেকে কম রাখছি, আমি ধনী হতে থাকব। আর সাথে আরও অন্যান্য আয়ের উৎস আমি উপার্জন করব যার জন্য আমাকে শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে না।

এই পুনর্বিনিয়োগ প্রথা যেমন- চলতে থাকবে আমি উত্তরোত্তর ধনী হয়ে উঠব। আসল ধনীর সংজ্ঞা কিন্তু যে দেখছে শুধু তার চোখে পড়বে। অতিরিক্ত ধনী হওয়া যায় না।

এই সরল শিক্ষাগুলো মনে রাখবেন : ধনীরা সম্পত্তি কেনে।

গরীবদের শুধু খরচ হয়।

মধ্যবিত্ত শ্রেণী দায় কেনে আর সেগুলোকে সম্পত্তি ভাবে।

তাহলে কি করে আমি নিজের কাজ নিজে করব?

এর উত্তর কি? ম্যাকডোনাল্ডের প্রতিষ্ঠাতা কি বলছে শুনুন।

নিজের ব্যবসায়ে মনোযোগ দিন

নিজের ব্যবসায়ে মনোযোগের বিষয়ে রবার্ট কিয়োসাকির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ১৯৭৪ সালে অস্টিনের টেক্সাস ইউনিভার্সিটির এমবিএ ক্লাসে ম্যাকডোনাল্ডের প্রতিষ্ঠাতা রে ক্রককে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল। আমার এক প্রিয় বন্ধু কেথ ক্যানিংহাম তখন ঐ এমবিএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। তাঁর অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং প্রেরণাদায়ক বক্তৃতার শেষে ছাত্ররা রে-কে তাঁদের প্রিয় স্থানটিতে একসঙ্গে বিয়ার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। রে রাজি হলেন।

যখন দলের সবাই তাদের বিয়ারের গ্লাস হাতে নিয়েছে, রে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন “আমার ব্যবসা কিসের?”

“সবাই হেসে উঠেছিল” কেথ বলেছিলেন। বেশির ভাগ এমবিএ-এর ছাত্ররা ভেবেছিল রে মজা করছেন।

কেউ উত্তর দিল না দেখে রে আবার প্রশ্ন করলেন। “তোমরা কি মনে কর আমার কিসের ব্যবসা?”

ছাত্ররা আবার হেসে উঠল, আর শেষ অবধি একজন সাহসী ছাত্র চিৎকার করে বলল, “রে এই পৃথিবীতে কে না জানে তুমি হ্যামবার্গারের ব্যবসা কর।” রে মুখ টিপে হাসলেন।

“আমি জানতাম তোমরা একথা বলবে।” তিনি একটু থামলেন আর তাড়াতাড়ি বললেন, “ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলারা, আমি হ্যামবার্গারের ব্যবসা করি না। আমার ব্যবসা রিয়েল স্টেটের।”

কেথ বলেছিলেন, রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাবার জন্য অনেক সময় নিয়েছিলেন। রে জানতেন ব্যবসার প্ল্যানে তাঁদের ব্যবসার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হবে হ্যামবার্গারের ‘ফ্যাঞ্চাইস’ বিক্রি করা, কিন্তু প্রতিটি ‘ফ্রাঞ্চাইসের অবস্থান কোথায় হবে তা কখনও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি জানতেন প্রতিটি ‘ফ্যাঞ্চাইসে’র সাফল্যের মূলকথা হল রিয়্যাল স্টেট ও সেটার অবস্থান। মূলত যিনি ‘ফ্যাঞ্চাইস’ কিনবেন তিনি রে ক্রকের সংগঠনের ‘ফ্র্যাঞ্চাইসে’র জমির দামও দিচ্ছে।

ম্যাকডোনাল্ড আজ সম্পূর্ণ পৃথিবীতে অন্যান্য দেশেরও সবচেয়ে দামী চৌরাস্তা এবং রাস্তার কোণাগুলোর মালিক। কেথ বলেছিলেন এটা তাঁর জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আজ কেথ গাড়ি ধোয়ার গ্যারেজের মালিক কিন্তু এই গ্যারেজের মূলে তার আসল ব্যবসা রিয়্যাল স্টেটের।

আগের পরিচ্ছদ শেষ হয়েছিল ছবির মধ্যে দিয়ে, তাতে দেখানো হয়েছিল যে বেশির ভাগ লোক সবাইয়ের জন্য কাজ করে, নিজের জন্য ছাড়া। তারা প্রথমে কোম্পানির মালিকের জন্য কাজ করে, তারপর গভর্নমেন্টের জন্য, ট্যাক্স দেবার মাধ্যমে কাজ করে আর সবশেষে ব্যাংকের জন্য কাজ করে, যারা তাদের মর্টগেজ দিয়েছে।

আমরা যখন অল্পবয়সী ছিলাম আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কোনও ম্যাকডোনাল্ড ছিল না। তাও আমার ধনী বাবা মাইক আর আমাকে একই রকম শিক্ষা দিয়েছিলেন যা রে ক্রক টেক্সাস-র ইউনিভার্সিটিতে বলেছিলেন। এটাই ধনীদের গোপন রহস্য নম্বর ৩।

আয়

রহস্যটা হচ্ছে : ‘নিজের কাজে মন দাও।’ সারাজীবন অন্য কারও জন্য কাজ করার সঙ্গে প্রায়ই আর্থিক সংগ্রাম সরাসরিভাবে যুক্ত থাকে। অনেক লোকেরই চাকরি জীবনের শেষে তাদের নিজের জন্য কিছুই থাকে না।

আবার বলি, একটা ছবি হাজার কথার সমান। এখানে ছবিতে দেখানো হচ্ছে একটা আয়ের স্টেটমেন্ট আর ব্যালেন্স শিট যা দেখে রে ক্রকের উপদেশ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থা ছাত্রদের ভাল চাকরি পাবার জন্য, পাণ্ডিত্যের দক্ষতার সুযোগ্য করা তৈরি করায় মন দেয়। তাদের জীবন তাদের বেতনের চারপাশে আবর্তিত হতে থাকে। অথবা যেন আগে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাদের আয়ের তালিকার চারপাশে আবর্তিত হয়। পাণ্ডিত্যে দক্ষ হওয়ার পর তারা আরও উচ্চশিক্ষার স্কুলে যায় পেশাদারী দক্ষতা বাড়াবার জন্য। ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, রন্ধনবিশারদ, পুলিশ অফিসার, আর্টিস্ট, লেখক ইত্যাদি হবার শিক্ষা পায়। এই পেশাদারী দক্ষতা তাদের কাজ করার সুযোগ দেয় এবং তারা অর্থের জন্য কাজ করে। আপনার পেশা আর আপনার ব্যবসার মধ্যে একটা বিরাট তফাত আছে। প্রায়ই আমি লোকেদের জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি কি ব্যাংকটার মালিক?’ তারা সাধারণত উত্তর দেন, ‘না, আমি ওখানে কাজ করি।’

সেই মুহূর্তে তাঁরা তাঁদের পেশার সঙ্গে ব্যবসা গুলিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের পেশা ব্যাঙ্কারের হতে পারে কিন্তু তাঁদের এখনও নিজের ব্যবসার প্রয়োজন রে ক্রমের পেশা আর ব্যবসার পার্থক্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল। তাঁর পেশা সবসময় একই ছিল। তিনি একজন বিক্রেতা। একসময় তিনি মিল্কশেকের জন্য মিক্সার বিক্রি করেছেন এবং তারপরে হ্যামবার্গারের ‘ফ্যাঞ্চাইস’ বিক্রি করেছেন। তাঁর পেশা ছিল হ্যামবার্গার ‘ফ্যাঞ্চাইস’ বিক্রি করা, তেমনি তাঁর ব্যবসা ছিল উপার্জনক্ষম রিয়্যাল স্টেট সংগ্রহ করা।

স্কুল সম্বন্ধে একটা সমস্যা হচ্ছে আপনি যা পড়েন প্রায়ই তাই হয়ে যান। তাই আপনি যদি রান্না-বান্না নিয়ে পড়েন আপনি ‘শেফে’ পরিণত হন। আইন নিয়ে পড়লে আইন-বিশেষজ্ঞ হয়ে যান আর গাড়ির মেশিন নিয়ে পড়লে ‘মেকানিক’ হয়ে যান। যা নিয়ে পড়ছেন তাই হয়ে যাবার মস্ত সমস্যাটা হল বেশির ভাগ লোক তাদের নিজেদের ব্যবসায় মন দিতে ভুলে যায়। তাঁরা জীবন কাটিয়ে দেয় অন্য কারোর ব্যবসা সামলিয়ে এবং তাঁকে ধনী করে।

আর্থিকভাবে সুরক্ষিত হবার জন্য যে কোনও ব্যক্তিকে তার নিজের ব্যবসায় মন দিতে হয়। আপনার ব্যবসায় আপনার সম্পত্তির তালিকার চারদিকে আবর্তিত হয়, এটা আপনার আয়ের তালিকার বিপরীতমুখী। যেমন-টি আগে বলা হয়েছে যে এক নম্বর নিয়ম হচ্ছে সম্পত্তি আর দায়ের তফাত জানা, সম্পত্তি কেনা। ধনীরা তাদের সম্পত্তির তালিকায় মনোনিবেশ করে অথচ বাকিরা তাদের আয়ের বিবৃতিতে মন দেয়।

সেজন্য আমরা প্রায়ই শুনি : ‘আমার বেতন বাড়া দরকার।’ ‘আমার যদি একটা প্রোমোশন হতো!’ ‘আমি আরও ট্রেনিং নেবার জন্য স্কুলে ফিরে যাচ্ছি, যাতে আমি আরও ভাল একটা চাকরি পাই।’ “আমি সময়ের পরেও ‘ওভারটাইম’ করতে চাই।” ‘হয়ত আমি আরেকটা চাকরি পেতে পারি।’ ‘আমি দু’সপ্তাহের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেব।’ ‘আমি একটা চাকরি পেয়েছি, ওরা আমাকে বেশি বেতন দেবে।’

কোনও কোনও ক্ষেত্রে এইগুলো বিচক্ষণ ধ্যান-ধারণা। তাও রে ক্রকের মতে আপনি কিন্তু এখনও নিজের ব্যবসায় দেখছেন না। এই ভাবনাগুলো এখনও আয়ের তালিকায় কেন্দ্রীভূত এবং এটা তখনই একজন ব্যক্তিকে আরও আর্থিকভাবে সুরক্ষিত হতে সাহায্য করবে যদি এই অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন- সক্ষম সম্পত্তি কিনতে ব্যয় করা হয়।

বেশির ভাগ দরিদ্র আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীরা ব্যবসার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হয়। তার প্রধান কারণ তাদের কোনও আর্থিক ভিত্তি নেই। তারা মনে করে, ‘আমি ঝুঁকি নিতে সমর্থ নই।’ তাদের চাকরিতে নির্ভরশীল থাকতে হবে। তাদের সাবধানে খেলতে হবে।

যখন কোম্পানির আকার ছোট করাটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন কোটি কোটি কর্মীরা দেখছে যে, তাদের তথাকথিত সবচেয়ে-বড়- সম্পত্তি অর্থাৎ বাড়ি তাদের জীবন্ত খেয়ে ফেলছিল। তাদের সম্পত্তি, অর্থাৎ বাড়ির জন্য এখনও তাদের প্রতিমাসে অর্থ দিতে হচ্ছিল। গাড়ি তাদের আরেকটা ‘সম্পত্তি’ যেটা তাদের জ্যান্ত খেয়ে ফেলছিল। গ্যারেজে রাখা ১,০০০ ডলারের ভরসা করার মত কিছুই ছিল না। তারা যেগুলোকে সম্পত্তি ভেবেছিল, আর্থিক সঙ্কটের সময় সেগুলো তাদের কোনোভাবেই বাঁচতে সাহায্য করছিল না।

আমার মনে হয় আমার বেশির ভাগই একটা বাড়ি বা একটা গাড়ি কেনার জন্য ব্যাঙ্কারের কাছে ঋণের আবেদনপত্র ভরেছি। এর ‘নেটওয়ার্ক’ বিভাগটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, কারণ এর থেকে ব্যাঙ্কিং আর অ্যাকাউন্টিং-এর নিয়মানুসারে কোন্ জিনিসটা সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয় তা জানা যায়।

একদা আমার আর্থিক পরিস্থিতি এমন ছিল যে, কেউ আমাকে ঋণ দিতে রাজি ছিল না। তাই আমি আমার নতুন গলফ ক্লাব, আর্টের সংগ্রহ, বই, স্টিরিও, টেলিভিশন, আর্মানী স্যুট, হাতঘড়ি, জুতো আর অন্য ব্যক্তিগত জিনিস সম্পত্তির তালিকা বৃদ্ধির জন্য যোগ করেছিলাম। কিন্তু আমাকে ঋণ না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হল, কারণ আমার রিয়্যাল স্টেটে অত্যন্ত বেশি বিনিয়োগ ছিল। আমি এ্যাপার্টমেন্ট হাউসে বিনিয়োগ করে এত উপার্জন করছি সেটা ‘ঋণদান কমিটি’র পছন্দ হয়নি। তারা জানতে চেয়েছিল আমার একটা বেতনসহ স্বাভাবিক চাকরি নেই কেন? তারা আর্মানী স্যুট; গলফ ক্লাব অথবা আর্ট সংগ্রহের বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি। ‘স্ট্যান্ডার্ড প্রোফাইল’ অর্থাৎ আদর্শ প্রতিমূর্তির অনুরূপ না হতে পারলে জীবন এক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।

যখন কেউ বলে যে তাদের ‘নেট ওয়ার্ক’ মিলিয়ন ডলার অথবা ১,০০,০০০ ডলার অথবা আরও বেশি আমি আশ্চর্য হই। নেট ওয়ার্ক সঠিক না হবার একটা প্রধান কারণ যে মুহূর্তে আপনি সম্পত্তি বিক্রি করতে শুরু করবেন আপনাকে সমস্ত লাভের ওপর ট্যাক্স দিতে হবে।

কত লোক যে বেকার হয়ে গেলে নিজেদের গভীর আর্থিক সংকটে ফেলে টাকা তোলার জন্য তার সম্পত্তি বিক্রি করে। প্রথমতঃ তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি সাধারণত তাদের ব্যক্তিগত ব্যালেন্স শিটে লেখা দামের ভগ্নাংশ দামে বিক্রি করতে পারে। অথবা যদি সম্পত্তি বিক্রিতে কোনও লাভ হয়, তাহলে লাভের ওপর আবার ট্যাক্স দিতে হয়। তাই আবার, সরকার তার লাভের ভাগটা নিয়ে নেয়, এইভাবে তাদের ঋণশোধের টাকা কমে যায়। তাই আমার মতে, মানুষ নিজের যা নেটওয়ার্ক বা মূল্য ধার্য করে তার থেকে কমই হয় তার দামটা।

নিজের ব্যবসায় নিজেই শুরু করুন। আপনার দিনের বেলার চাকরি বজায় রেখে রিয়্যাল স্টেট কিনতে শুরু করুন, দায় অথবা ব্যক্তিগত জিনিস যা একবার বাড়ি পৌঁছালে আর কোনও সত্যিকারের মূল্য থাকে না, তাও বাড়াবেন না। একটা নতুন গাড়ির দাম প্রায় ২৫% কমে যায় একবার আপনি গাড়িটা কিনে চালিয়ে নেওয়ার পর। এটা একটা সত্যিকারের সম্পত্তি নয়, আপনার ব্যাঙ্কার যদি এটা সম্পত্তি বলে তাও নয়। আমার ৪০০ ডলারের নতুন টাইটানিয়াম ড্রাইভার কেনার পর চালানো মাত্রই তা ১৫০ ডলার মূল্যের হয়ে গিয়েছিল।

বড়দের জন্য বলা যায় আপনাদের খরচ কমান, দায় কমান আর পরিশ্রম করে নির্ভেজাল সম্পত্তির ভিত্তি তৈরি করুন। অল্পবয়সীরা, যারা এখনও বাড়ি থেকে বেরোয়নি, তাদের বাবা-মার উচিত তাদের সম্পত্তি আর দায়-এর মধ্যে তফাত বোঝানোর। তাদের বাড়ি ছাড়ার, বিয়ে করার, বাড়ি কেনার, সন্তান হবার ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক অবস্থা, চাকরিতে জড়িয়ে পড়ার এবং সবকিছু ধারে কেনার আগে তাদের দিয়ে একটা খাঁটি সম্পত্তির সারি প্রস্তুত করান। আমি অনেক অল্পবয়সী দম্পতিকে দেখি যারা বিয়ে করে এবং নিজেদের এমন এক জীবনযাত্রার জালে জড়িয়ে ফেলে যার ফলে তারা তাদের কর্মজীবন বেশির ভাগ সময়টাই দেনার দায়ে বন্দী হয়ে পড়ে

বেশির ভাগ লোকের ক্ষেত্রে, সন্তান যখন বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, বাবা-মার খেয়াল হয় যে তারা অবসর গ্রহণের জন্য যথেষ্টভাবে প্রস্তুত নয়, তখন তারা কিছু পয়সা আলাদা রাখতে থাকে। কিন্তু তখন তাদের নিজেদের বাবা- মা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর তাদের নতুন দায়িত্ব এসে পড়ে।

তাহলে আমি কি ধরনের সম্পত্তি বলছি তা আপনাকে এবং আপনার সন্তানদের সংগ্রহ করার প্রয়োজন? আমার জগতে রিয়্যাল এস্টেটের বিভিন্ন শ্রেণী রয়েছে :

১। এমন ব্যবসায় যাতে আমার উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। আমি ওগুলোর মালিক কিন্তু ওগুলো পরিচালনা করে অন্য লোকে। আমার যদি ওখানে কাজ করতে হয় তাহলে ওটা আমার ব্যবসায় থাকবে না। আমার চাকরি হয়ে যাবে।

২। স্টক

৩। বণ্ড

৪। মিউচুয়্যাল ফান্ড

৫। অর্থ উৎপাদক রিয়্যাল স্টেট

৬। নোট (আই.ও.ইউ.অর্থাৎ ধার দেওয়া)

৭। গানবাজনা, স্ক্রিপ্ট, পেটেন্ট ইত্যাদি বুদ্ধিগত (ইনটেলেকচ্যুয়াল) সম্পত্তি থেকে রয়্যালটি।

৮। আর যে কোনও জিনিস যার মূল্য আছে, যেগুলো থেকে আয় হয় অথবা যার দাম বাড়ে এবং বিক্রির বাজার ভাল।

তরুণ বয়সে আমার শিক্ষিত বাবা আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন একটা নিরাপদ চাকরি খুঁজতে। আমার ধনবান বাবা অন্যদিকে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন আমার মনের মত সম্পত্তি যোগাড় করতে। ‘তুমি যদি এটা ভাল না বাস তুমি এটার যত্ন করবে না।’ আমি রিয়্যাল স্টেট সংগ্রহ করি কারণ সোজা কথায় আমি বাড়ি আর জমি ভালবাসি। আমি ওগুলোর জন্য বাজার করতে ভালবাসি। আমি সারাদিন ওগুলো নিয়ে কাটাতে পারি। যখন সমস্যা দেখা দেয় তা কখনই অত খারাপ লাগে না, তাতে আমার রিয়্যাল স্টেটের প্রতি ভালবাসায় কোনও পরিবর্তন আসে না। যারা রিয়্যাল স্টেট ঘৃণা করে, তাদের এটা না কেনাই ভাল।

আমি ছোট কোম্পানির স্টক ভালবাসি, বিশেষ করে স্টার্ট আপ অর্থাৎ প্রারম্ভিক কোম্পানির। কারণ, আমি একজন অন্ট্রেপ্রেনর কর্পোটের ব্যক্তি নাই। শুরুতে আমি বড় সংস্থা যেমন- স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অফ ক্যালিফোর্নিয়া, দি ইউ.এস. মেরিন ক্যারস এবং জেরক্স কর্প-এ কাজ করেছিলাম। আমি এইসব সংস্থায় ভাল সময় কাটিয়েছি এবং আমার অনেক প্রিয় স্মৃতিও আছে, কিন্তু মনের গভীরে আমি ‘কোম্পানিম্যান’ নই। আমি কোম্পানি শুরু করতে ভালবাসি সেগুলো চালাতে নয়। তাই আমি সাধারণত ছোট কোম্পানির স্টক কিনি আবার কখনও কখনও আমি কোম্পানিটা শুরু করি তারপর পাবলিক লিমিটেড-এ পরিণত করি। নতুন স্টক জারি করেই সৌভাগ্য গড়ে তোলা যায় আর আমি সেই খেলাটা ভালবাসি। অনেকে ছোট কোম্পানিকে ভয় পায় আর ঝুঁকিপূর্ণ বলে; কথাটা ঠিকই। যদি বিনিয়োগ করতে ভালবাসেন, ব্যাপারটা বোঝেন, আর খেলাটা জানেন তাহলে ঝুঁকিয়ে আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়। ছোট কোম্পানির ক্ষেত্রে আমার বিনিয়োগ কৌশল হল এক বছরের মধ্যে সব স্টক বিক্রি করে দেওয়া। অন্যদিকে আমার রিয়্যাল স্টেট কৌশল হল ছোট দিয়ে শুরু করা আর ক্রমশ ছোট সম্পত্তি বিক্রি করে আরও বড় সম্পত্তির ব্যবসায় চালানো, আর এইভাবে লাভের ওপর ট্যাক্স দেওয়ার বিলম্ব করা। এর ফলে সম্পত্তির মূল্য হঠাৎ খুব বেড়ে যায়। আমি সাধারণত সাত বছরের কম সময় যাবৎ রিয়্যাল স্টেট নিজের কাছে রাখি

যখন আমি ‘মেরিন ক্যারস্’ বা জেরেক্স কাজ করতাম তখন বেশ কয়েক বছর আমার ধনবান বাবার উপদেশমত কাজ করেছি। আমি দিনে চাকরি করতাম ঠিকই, কিন্তু তবুও নিজের ব্যবসা নিজে চালাতাম। আমার সম্পত্তির তালিকা সম্বন্ধে আমি সজাগ ও সক্রিয় ছিলাম। আমি রিয়্যাল স্টেট আর ছোট স্টকের ব্যবসা করতাম। ধনী বাবা সবসময় আর্থিক শিক্ষা বা স্বাক্ষরতার গুরুত্বের ওপর জোর দিতেন। আমি জানতাম অ্যাকাউন্টিং আর ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ নগদ পরিচালনা যত ভাল বুঝব তত বিনিয়োগ বিশ্লেষণে পটু হয়ে উঠব এবং শেষে নিজের কোম্পানি শুরু করতে এবং গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

সত্যিকার আগ্রহী না হলে আমি কাউকে কোম্পানি শুরু করতে উৎসাহ দেব না। আমি জানি একটা কোম্পানি কিভাবে চালাতে হয়, তাই সেটা কারও ওপর চাপাতে চাই না। অনেক সময় লোকেরা যখন চাকরি পায় না তখন একটা কোম্পানি শুরু করা তাদের কাছে একটি সমস্যার সমাধান বলে মনে হয়। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতি সাফল্যে বাধা দেয়। দশটা কোম্পানির মধ্যে ন’টা পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যর্থ হয়, যে ক’টা প্রথম পাঁচ বছর বেঁচে থাকে, তারও দশটার মধ্যে ন’টা শেষ অবধি ব্যর্থ হয়। তাই যদি আপনার সত্যি কোম্পানির মালিকানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে তবেই আমি এর অনুমোদন করছি। অন্যথায় আপনার দিনের চাকরিটা বজায় রাখুন আর নিজের কাজে মন দিন।

যখন আমি নিজের কাজে মন দিন বলি, আমি বলতে চাই আপনার সম্পত্তি মজবুত করুন। এতে একটি ডলার যোগ হলে কখনও সেটা বাইরে বেরিয়ে যেতে দেবেন না। মনে করুন, একবার একটি ডলার আপনার সম্পত্তির সারিতে ঢুকলে সে আপনার কর্মচারী হয়ে যায়।

অর্থ সম্বন্ধে সব থেকে সুসংবাদ হল এটা চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে এবং পুরুষানুক্রমে কাজ করতে পারে।

আপনার দিনের বেলার চাকরি বজায় রাখুন, একজন মহান পরিশ্রমী কর্মচারী হন কিন্তু আপনার সম্পত্তির সারি গড়ে তুলতে থাকুন।

আপনার ক্যাশফ্লো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি কিছু বিলাসদ্রব্য কিনতে পারেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ তফাত হচ্ছে ধনীরা বিলাসদ্রব্য সবশেষে কেনে আর গরীব আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রথমেই এসব কেনার প্রবণতা দেখা যায়। গরীব আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রায়ই বিলাসদ্রব্য যেমন- বড় বাড়ি, হীরে, ফার, গয়না অথবা বোট ইত্যাদি কেনে কারণ তারা নিজেদের ধনী দেখাতে চায়। তাদের ধনী দেখায় বটে তবে বাস্তবে তারা আরও গভীরে ক্রেডিট কার্ডের দেনায় ডুবে যায়। পুরোনো ধনী ব্যক্তি বা দীর্ঘসময় যাবৎ ধনীরা প্রথমে তাদের সম্পত্তি তৈরি করে। ঐ সম্পত্তির সারি থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে বিলাসদ্রব্য কেনে। গরীব বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীরা নিজেদের রক্তজল করা পরিশ্রম থেকে প্রাপ্ত অর্থ আর পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বিলাসদ্রব্য কেনে।

নির্ভেজাল সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করে বিলাশ করাই সত্যিকার বিলাসিতা। উদাহরণস্বরূপ, যখন অ্যাপার্টমেন্ট হাউস থেকে আমার স্ত্রী আর আমার অতিরিক্ত অর্থোপার্জন হচ্ছিল, আমার স্ত্রী, তার মার্সেডিজ গাড়িটা কেনে। এজন্য তার দিক থেকে কোনও অতিরিক্ত কাজ করতে হয়নি বা ঝুঁকি নিতে হয়নি, কারণ অ্যাপার্টমেন্ট হাউস-এর ব্যবসায়েই গাড়িটা কিনেছিল। তাকে অবশ্যই এর জন্য চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, ততদিন রিয়্যাল স্টেট পোর্টফোলিও বাড়ছিল এবং শেষে গাড়ির দাম দেওয়ার মত যথেষ্ট অতিরিক্ত ক্যাশফ্লো দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু এই বিলাসদ্রব্যটা, মার্সেডিজ গাড়িটা, একটি সত্যিকারের পুরস্কার ছিল, কারণ সে প্রমাণ করেছিল যে সে জানে কিভাবে সম্পত্তি বাড়াতে হবে। এই গাড়িটার মূল্য এখন তার অন্য যে কোন সুন্দর গাড়ির চেয়ে অনেক বেশি, অর্থাৎ সে তার অর্থজ্ঞান ব্যবহার করে এটা পেয়েছিল।

বেশির ভাগ লোকেরা আবেগতাড়িত হয়ে ঋণে গাড়ি অথবা অন্য কোনও বিলাসদ্রব্য কেনে। হয়ত তাদের একঘেয়ে লাগছিল অথবা তারা শুধু একটি নতুন খেলনা চাইছিল। ঋণে বিলাসদ্রব্য কিনলে কখনও না কখনও সেই ব্যক্তি ঐ বিলাসদ্রব্যটির ওপর বীতস্পৃহ হয়ে যায় কারণ সেই ঋণ তখন একটি আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

যখন আপনি সময় নিয়ে বিনিয়োগ করে নিজের ব্যবসা গড়ে তুলছেন তখনই আপনি সেই যাদুস্পর্শের ছোঁয়া লাগানোর জন্য প্রস্তুত- এটাই ধনীদের সবচেয়ে বড় গোপন রহস্য। যে রহস্য ধনীদের, জনতার দল থেকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যায়। এমন এক পুরস্কার, যা আপনার নিজের ব্যবসায় মন দিয়ে গড়ে তোলার পর ধৈর্যসহকারে আপনার জন্য পথের শেষে অপেক্ষা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *