রিক্শাওয়ালা – সজনীকান্ত দাস
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হইয়াছে। সকাল হইতেই থাকিয়া থাকিয়া ঝুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি নামিয়া জনসঙ্কুল শহরের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত জন্মাইতেছিল। পথিকেরা আকাশের খামখেয়ালিপনায় বিরক্ত হইতেছিল; পথ চলিতে চলিতে বৃষ্টি নামে; কোন বাড়ির গাড়িবারান্দায় আশ্রয় লইয়া তাহারা কোন রকমে একটু মাথা বাঁচাইয়া লয়; বৃষ্টি ধরিয়া আসে। ভরসা করিয়া গাড়িবারান্দার আশ্রয় ছাড়িয়া তাহারা যেমনই একটু অগ্রসর হয় অমনই আবার একপশলা বৃষ্টি শুরু হয়।
সমস্ত দিন মেঘ করিয়া ছিল, একটানা না হইলেও বৃষ্টির বিরাম ছিল না। তবুও কেমন একটা গুমোট গরমের ভ্যাপসানিতে কলিকাতার সিক্তসন্ধ্যা থমথম করিতেছিল। এমন দিনে সাধারণত কেহ ঘরের বাহির হয় না। নেহাত প্রয়োজনে ছোট ভাই বিনোদকে সঙ্গে লইয়া স্ট্র্যান্ড রোড ধরিয়া কুমারটুলী অভিমুখে চলিতেছিলাম। তখন বৃষ্টি একটু ধরিয়া আসিয়াছে। শীকরভারাক্রান্ত বায়ুস্তর ভেদ করিয়া গঙ্গার ওপারের কারখানাগুলির আলো মাতালের চোখের মত ঘোলাটে দেখাইতেছিল; ল্যাম্প-পোস্ট ও টেলিগ্রাফ পোস্টগুলির গায়ে কিংবা টেলিগ্রাফের তারে তারে সঞ্চিত জলের উপর গ্যাসের আলো পড়িয়া চকচক করিতেছে। পথে লোকজন বা যানবাহনাদির বিশেষ বালাই ছিল না; ক্কচিৎ কদাচিৎ একআধখানা ট্যাক্সি কিংবা ছ্যাকরা গাড়ি ঊর্ধ্বশ্বাসে কাদা ছিটাইয়া ছুটিতেছিল; দূরে একখানা রিক্শা ঠুনঠুন ঘণ্টা বাজাইয়া মন্থরগতিতে চলিয়াছে—পিছনের আলোটি চোখের সম্মুখে একটি লাল রেখা টানিয়া দিতেছে।
বৃষ্টির ভয়ে দ্রুত চলিতে লাগিলাম। নিমতলা পার হইতেই বেশ সমারোহসহকারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। একটি গাছতলা আশ্রয় করিয়া কোন রকমে মাথা রক্ষা করিতেছি। দেখি, সেই রিক্শাওয়ালা বিশেষ শ্ৰান্তভাবে সেখানে উপস্থিত হইয়া হাঁপাইতে লাগিল। রিক্শাখানা খালি। রিক্শাওয়ালা সম্ভবত বহুদূরের সওয়ারী লইয়া তাহাকে গন্তব্য স্থলে পৌঁছাইয়া ফিরিতেছে।
বৃষ্টি থামিবার গতিক দেখিলাম না। তবু ভাল, একখানা রিক্শা পাওয়া গেল। এই সামান্য পথটুকু—কয় পয়সাই বা দিতে হইবে! পরিশ্রান্ত রিক্শাওয়ালা ততক্ষণে মুখ মাথা মুছিয়া সুস্থ হইয়াছে। কষাকষি করিয়া দুই আনা ভাড়া স্থির হইল। বিনুকে উঠাইয়া দিয়া নিজে উঠিতে যাইতেছি, রিক্শাওয়ালা বলিল, হুজুর, দুজনকে পারব না।
বলিলাম, সে কি রে, এই রোগা রোগা দুজন লোক, আর কতটুকুই বা রাস্তা!
আজ্ঞে না হুজুর, পারব না।
একটু আশ্চর্য হইলেও চটিয়া গেলাম। বলিলাম, দুনিয়াসুদ্ধ রিক্শাওয়ালা দুজন তিনজন লোক নেয়। তুই ব্যাটা নিবি না কেন? অমন ষাঁড়ের মত শরীর তোর—
শকেগা নেহি বাবু।—বলিয়া সে সেই বৃষ্টির মধ্যেই বৃক্ষতল ছাড়িয়া গাড়ি লইয়া বাহির হইয়া পড়িল। অমন শক্ত-সমর্থ লোকের ব্যাকুলতাপূর্ণ ‘শকেগা নেহি’ শুনিয়া মনটা নরম হইল। তাহার দৃষ্টিতে এমন একটা অদ্ভুত শঙ্কা ও কাতরতা মাখানো ছিল যে, আমার মন অস্বস্তিতে ভরিয়া গেল।
বৃষ্টি আর গাছের পাতার আচ্ছাদন মানিল না। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ভিজিতে লাগিলাম। রিক্শাওয়ালা তখন কিছুদূর চলিয়া গিয়াছে। হাঁকিয়া বলিলাম, দশ পয়সা দিব। সে একবার মুখ ফিরাইয়া দেখিল এবং পরমুহূর্তেই গাড়ি লইয়া দৌড়াইতে শুরু করিল।
বহুদূর হইতে রিক্শাখানার ঠুনঠুন আওয়াজ কানে আসিতে লাগিল। পিছনের লাল আলোটি তখনও বর্ষাস্নাত অন্ধকার পথে একটি গতিশীল সিঁদুরটিপের মত দেখাইতেছিল।
সিক্তদেহে পথে নামিয়া পড়িলাম। সেদিন শ্রাবণ-নিশীথিনীর গাঢ় তমিস্রা ভেদ করিয়া একটি কঠোর মুখের মলিন বেদনাকাতর দৃষ্টি আমার মনে ঘুরিয়া ফিরিয়া জাগিতে লাগিল।
কিছুদিন পরের কথা। এল্ফিন্স্টোন পিক্চার প্যালেসে ছবি দেখিয়া একটি পরিচিত লোকের অপেক্ষায় হগ সাহেবের বাজারের কোণে দাঁড়াইয়াছিলাম। হঠাৎ এক রিক্শাওয়ালার সহিত দুই বিপুলকায় মাড়োয়ারীর বিশুদ্ধ হিন্দিতে বচসা হইতেছে শুনিতে পাইলাম। মাড়োয়ারীযুগলের গলা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে দেখিয়া ব্যাপার কি জানিবার জন্য একটু ঔৎসুক্য হইল। কাছে গিয়াই দেখি, স্ট্র্যান্ড রোডের সেই রিক্শাওয়ালা। বচসার কারণ—সে দুইজনকে লইতে পারিবে না। ওই দুইটি বিপুলকায় বস্তাকে একসঙ্গে গাড়িতে উঠিতে দিতে যে কোনও রিক্শাওয়ালার আপত্তি হইতে পারিত এবং তাহাতে আশ্চর্য হইবার বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু পূর্বের কথা স্মরণ করিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। সেই লোক তাহাতে সন্দেহ নাই। মাড়োয়ারী দুইজন অন্য যানের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করিল। রিক্শাওয়ালাকে পরীক্ষা করিবার কৌতূহল হইল। তাহার সহিত ভাড়া স্থির করিয়া তাহাকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিয়া বলিলাম, আমার আর একজন সঙ্গী আছে। করুণ ভাবে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সে আমাকে অন্য গাড়ি দেখিতে অনুরোধ করিল—দুইজনকে সে লইতে পারিবে না। আমি এতদূর বিস্মিত ও কৌতূহলাক্রান্ত হইলাম যে, বন্ধুর অপেক্ষা না করিয়াই রিক্শাতে চড়িয়া বসিলাম।
সেদিনও আকাশ ব্যাপিয়া মেঘ করিয়া আসিতেছিল; ঘন ঘন মেঘগর্জন ও বিদ্যুৎচমকে কলিকাতার চঞ্চল আকাশ স্তব্ধ হইয়া আসিয়াছিল। আসন্ন দুর্যোগের আশঙ্কায় রাস্তায় লোক-চলাচল অনেকটা কম। রিক্শাওয়ালাকে তাড়া দিলাম, অবিলম্বে বৃষ্টি নামিবে, শীঘ্র বাড়ি পৌঁছানো চাই। জোরে টানিতে গিয়া রিক্শাওয়ালা গলদঘর্ম হইয়া উঠিল; অবাক হইলাম। আমার মত ক্ষীণকায় পুরুষকে টানিতে এতটা পরিশ্রম হইবার কথা নয়। আগের দিনের মত একটা অজানা অস্বস্তিকর অনুভূতি মনে জাগিতে লাগিল। অমন বিপুলকায় একটা লোক আমার মত একটি সামান্য বোঝাকে টানিতে পারিতেছে না, ইহার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাইলাম না। একটা অস্পষ্ট অলৌকিক ভয় মনকে পীড়া দিতে লাগল।
বেচারার দুরবস্থা দেখিয়া মায়া হইল। শুধু বোঝা টানার পরিশ্রম ছাড়াও অন্য কোনও যন্ত্রণা তাহার হইতেছিল, তাহারও আভাস পাইতেছিলাম। নানা কল্পনা করিয়া কোনও কিনারা করিতে পারিলাম না। তাহাকে যথেচ্ছ রিক্শা টানিতে বলিয়া একটা সিগারেট ধরাইলাম। কৌতূহল নিবৃত্তি করিবার যথেষ্ট ঔৎসুক্য হওয়া সত্ত্বেও চুপ করিয়া কি ভাবে কথাটা পাড়িব ভাবিতে লাগিলাম।
হঠাৎ চড়বড় করিয়া বৃষ্টি নামিল। রিক্শাওয়ালা চকিত হইয়া উঠিল। একটা বাড়ির গাড়িবারান্দার ধারে আসিয়া তাহাকে থামিতে বলিলাম। দুজনে গাড়িবারান্দার নিচে আসিয়া মাথা। মুছিয়া বৃষ্টি থামিবার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
রিক্শাওয়ালাকে একটা সিগারেট দিলাম। সে বিনীত সেলাম করিয়া সিগারেট লইয়া ফুটপাথের উপর উবু হইয়া বসিয়া সেটিকে ধরাইল। আমি দাঁড়াইয়া রহিলাম। মনের অদম্য কৌতূহল আমাকে ভিতর হইতে ঠেলা দিতে লাগিল, কিন্তু পাছে বেফাঁস কিছু জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলি—এই ভয় হইতে লাগিল। তাহার নাম কি, কোথায় থাকে, তাহার কে আছে, এগুলি বেশ সহজ ভাবেই জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম। তাহার নাম মকবুল, হাতিবাগানের বস্তিতে থাকে, এক বৃদ্ধা ফুফু ছাড়া তাহার কেহ নাই; শিশু অবস্থা হইতেই সে পিতৃমাতৃহীন—ফুফুর হাতেই মানুষ হইয়াছে। বিবাহ হইয়াছে কি না জিজ্ঞাসা করাতে সে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বাবু, যে বোঝা তাহাকে নিরন্তর টানিয়া বেড়াইতে হইতেছে, তাহা লইয়াই সে অস্থির—ইহার উপর জরুর বোঝা বহিতে সে অক্ষম। বলিলাম, বুড়ী ফুফু ছাড়া তাহার কেহ নাই, অথচ অহরহ বোঝা বহিতে হইতেছে, ইহার অর্থ তো বুঝিলাম না। মকবুল চুপ করিয়া রহিল। আমি তাহাকে চিন্তা করিবার অবসর না দিবার জন্য বলিলাম, একটা বিষয়ে আমার ভারি কৌতূহল আছে। কিছুকাল আগে নিমতলাঘাটের কাছে তাহাকে দেখিয়াছিলাম, আজও দেখিলাম; দুই দিনই সে একজনের অধিক সওয়ারী লইতে অস্বীকার করিয়াছে। অথচ সে দুর্বল নয়। ইহার নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। যদি বিশেষ আপত্তি না থাকে তাহা হইলে—
মকবুল চমকিয়া উঠিল। তাহার মুখ অস্বাভাবিক রকম বিবর্ণ হইয়া গেল। হাত দিয়া মাথার রগ টিপিতে টিপিতে সে বলিল, বাবু, সে বড় ভয়ানক কথা। যে কথা মনে হইলেই সে আতঙ্কে শিহরিয়া উঠে, তাহার বুকের তাজা রক্ত হিম হইয়া যায়, মুখে সে-কথা সে প্রকাশ করিবে কেমন করিয়া?
বলিতে বলিতে সে সভয়ে রিক্শাখানির দিকে চাহিল। কি যেন একটা ভয়াবহ কিছু দেখিয়া সে শিহরিয়া উঠিল। পরক্ষণেই সে উম্মত্তের মত ছুটিয়া গিয়া তেরপলের পর্দা দিয়া রিক্শাখানি মুড়িয়া ফেলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে আসিয়া হতাশভাবে বসিয়া পড়িল। তখনও ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ-ঝলকে কি যেন একটা অনন্ত রহস্যের ক্ষণিক আভাস মাত্র পাইতেছিলাম; জলভারাক্রান্ত বাতাস কলিকাতার পাষাণ-প্রাচীরে প্রতিহত হইয়া একটা একটানা উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করিতেছিল। রাস্তায় জনমানবের চিহ্ন ছিল না।
তাহাকে আর একটা সিগারেট দিয়া আমি তাহার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইলাম। কি যেন একটা অজানা ভয়ে আমার মনও পীড়িত হইতে লাগিল। ব্যাপারটা আগাগোড়া এমন অস্বাভাবিক—মাঝে মাঝে সমস্তটা স্বপ্ন বলিয়া উড়াইয়া দিতেছিলাম; কিন্তু সম্মুখে উপবিষ্ট রিক্শাওয়ালার অস্বাভাবিক-দীপ্তি-সম্পন্ন চোখ দুইটি আমার মনে এক অলৌকিক ভয় জাগাইতেছিল—আমি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলাম।
কিন্তু এভাবে বসিয়া থাকা চলে না, বাড়ি যাইতে হইবে। এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে বিস্তারিত না জানিয়াও যাওয়া যায় না। বলিলাম, মকবুল, এসব কথা ভাবিতে যদি তোমার কষ্ট হয়, কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই—বৃষ্টি অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে—এখন যাওয়া যাইতে পারে।
সজোরে আমার পা দুইটি চাপিয়া ধরিয়া অধীরভাবে সে বলিয়া উঠিল, আর একটু দাঁড়ান বাবু। যে-কথা তিন বছর ধরিয়া বলিবার জন্য আমি ব্যাকুল, অথচ কাহাকেও মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিলাম না, আজ আমাকে বলিতে দিন; এ যন্ত্রণা আর সহিতে পারিতেছি না।
নিবিড় সহানুভূতিতে চিত্ত ভরিয়া গেল। ভূলিয়া গেলাম, আমি মকবুল অপেক্ষা সামাজিক হিসাবে শ্রেষ্ঠ লোক; তাহার সহিত এভাবে কলিকাতার রাস্তার ফুটপাথে দাঁড়াইয়া আলাপ করাটা আমার পক্ষে হীনতাসূচক। সেই ব্যথাক্লিষ্ট মানুষটির গোপন কথা শুনিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া রহিলাম।
মকবুল অতি ধীরে ধীরে থামিয়া থামিয়া হিন্দিমিশ্রিত বাংলায় যাহা বলিল এবং যাহা বলিল না—সবটুকু মিলাইয়া যাহা বুঝিলাম, তাহাই ভাষায় লিপিবদ্ধ করিতেছি। মকবুল বলিল, বাবু, আমি আপনাকে ব্যাপারটা ঠিক বুঝাইতে পারিব কি না জানি না। ঘটনাটা এমন অসম্ভব আর এমনই ভয়াবহ যে, বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু খোদার কসম বাবু, আমি একটিও মিথ্যা বলিব না। আমি আজ তিন বৎসর ধরিয়া এই গাড়িতে এক মৃতদেহের বোঝা টানিয়া বেড়াইতেছি। একজনের অধিক লোককে গাড়িতে তুলিয়া টানিতে পারিব কেমন করিয়া? আর একজন যে নিরন্তর আমার গাড়িতে বসিয়া আছে! তাহার নড়িবার শক্তি নাই। আমি তাহাকে বহন করিয়া লইয়া ফিরিতেছি। ইহার হাত হইতে আমার নিস্তার নাই। মৃতদেহ পচিয়া ভারী হইয়া গিয়াছে; আমি অহরহ দুর্গন্ধে অস্থির হইতেছি। মৃতদেহের ভার টানিয়া টানিয়া আমার সবল দেহ জীর্ণ হইয়া আসিল—এই অদৃশ্য শবদেহের ভারে আমি জর্জরিত হইয়া পড়িয়াছি, আমি আর বাঁচিব না বাবু।
মনে হইল, উপকথা শুনিতেছি; মনে হইল, কলিকাতার আবেষ্টনী ধোঁয়া হইয়া কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে—জনশূন্য মরুভূমির মাঝখানে আমরা দুইজনে পড়িয়া আছি। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে আমার সমস্ত চেতনা বিলুপ্তপ্রায় হইল। আমি স্তব্ধ হইয়া শুনিতে লাগিলাম—
তিন বছর আগেকার কথা। সেদিন প্রবল বর্ষণে কলিকাতা শহর জলধারার আবরণে বিলুপ্ত হইয়াছিল। রাত্রি নয়টা দশটার সময় আমি এই গাড়িখানা লইয়া হাওড়া স্টেশনে সওয়ারীর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। সেখানে দুই-চারখান মাত্র গাড়ি ছিল, লোকের ভিড় ছিল না বলিলেই হয় অমন দিনে সাধারণত কুকুর-বিড়ালেরাও বাড়ির বাহির হয় না। কিন্তু অভাব যাহাদিগকে পীড়া দেয়, তাহারা কুকুর-বিড়ালেরও অধম। আমি বিবাহ করিবার লোভে অর্থ সঞ্চয় করিতেছিলাম। বহিঃপ্রকৃতির সহস্র বাধাও আমার সঙ্গিনীপিয়াসী মনকে দমাইতে পারে নাই। বিবাহ করিবার কি অদম্য স্পৃহা আমার ছিল বাবু, তাহা আপনাকে বুঝাইতে পারিব না—নহিলে অমন দিনে মানুষে ঘরের বাহির হয় না। আজ বিবাহ করিবার বিন্দুমাত্র প্রবৃত্তি আমার নাই; প্রতি মুহূর্তেই আমার শরীরের রক্ত জল হইয়া আসিতেছে; আমি আর বেশিদিন বাঁচিলে পাগল হইয়া যাইব। শুধু ফুফুর মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেছি। সে আমার এই অবস্থার কথা জানিতে পারিলে কষ্ট পাইবে।
মকবুল আবার চুপ করিল। যাহা শুনিতেছিলাম, তাহা পরিষ্কার ধারণা করিবার মত শক্তি আমার ছিল না। জলের ঝাপটা লাগিয়া সর্বাঙ্গ ভিজিয়া গেল; অন্ধকার আকাশে তীব্র বিদ্যুৎস্ফুরণ হইতে লাগিল। —কলিকাতার ঘরবাড়ি লেপিয়া মুছিয়া গিয়াছে; আকাশের নিচে গ্যাসের স্তিমিত আলোকে আমরা দুইটি প্রাণী এক অজানিত রহস্যলোকের দ্বার উন্মোচন করিবার ব্যর্থ প্রয়াস করিতেছি—
—সওয়ারী জুটিল দুইজন। প্রচুর ভাড়া চাচ্ছিলাম, তাহারা তাহাতেই স্বীকৃত হইল। দুইজনের কেহই প্রকৃতিস্থ ছিল না—একজন নেশায় একেবারে চুর হইয়া ছিল, অন্যজনের তখনও হুঁশ ছিল! এই ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যেই বাগবাজার পর্যন্ত যাইতে হইবে।
সওয়ারী দুইজন ভিতরে বসিল। আমি ভাল করিয়া পর্দা মুড়িয়া দিলাম।
গঙ্গার ধারে ধারে সোজা উত্তর দিকে চলিতে লাগিলাম; দোকানপাট সব বন্ধ হইয়া গিয়াছে। একটা পানের দোকানে এক উড়িয়া বামুন সুর করিয়া কি পড়িতেছিল, রাস্তায় এখানে-ওখানে দুই-একজন লোক চলিতেছিল, গাড়িঘোড়া একেবারেই ছিল না। আমি নির্বিঘ্নে পথের মাঝখান দিয়া রিক্শা টানিয়া লইয়া চলিলাম। কুমারটুলীর কাছাকাছি গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আর কতদূর যাইতে হইবে? উত্তর পাইলাম, সিধা চালাও।
আমার সর্বাঙ্গ ভিজিয়া গিয়াছিল। পরিশ্রমে আর ক্লান্তিতে চোখ ঘুমে জড়াইয়া আসিতেছিল। মনে হইতেছিল, আর টানিতে পারিব না। এমন সময়ে পর্দা ঠেলিয়া এক বাবু আমার হাতে পয়সা দিয়া এক বাক্স সিগারেট আনিতে বলিলেন। একটা গাছতলায় গাড়ি রাখিয়া সিগারেট আনিতে গেলাম। কাছাকাছি দোকান ছিল না। এদিক-ওদিক ঘুরিয়া একটি বিড়ির দোকানের সন্ধান পাইলাম। সিগারেট কিনিয়া ফিরিয়া আসিয়া হাঁকিয়া বাবুদের সিগারেটের বাক্সটা লইতে বলিলাম। কেই উত্তর দিল না। ভাবিলাম, মাতাল বাবুরা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তেরপলের পদা তুলিয়া সিগারেট দিতে গিয়া এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখিয়া মূৰ্ছিতপ্রায় হইলাম। বাবু, সেই মুহূর্ত হইতে আমার জীবনের সমস্ত শান্তি অন্তর্হিত হইয়াছে; কাহার পাপের বোঝা মাথায় লইয়া আমি আজ তিন বৎসর কাল, প্রায়শ্চিত্ত করিয়া ফিরিতেছি জানি না। আর কতকাল এ যন্ত্রণা সহিতে হইবে খোদাতালাই বলিতে পারেন।
সামান্য আলো আসিতেছিল; দূরে গ্যাস-পোস্ট। গাছের তলে বেশ একটু অন্ধকার, বৃষ্টির বিরাম ছিল না। পর্দা তুলিয়া সেই অস্পষ্ট আলোকে দেখিলাম, গাড়িতে একজন মাত্র লোক—মুখ বাঁধা, বুক দিয়া দরদর ধারে রক্ত পড়িতেছে, সর্বাঙ্গ রক্তে ভিজিয়া গিয়াছে। প্রাণ আছে বলিয়া মনে হইল না! কেমন করিয়া কি হইল প্রথমটা কিছু ঠাহর করিতে পারিলাম না, বিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া ঘামিতে লাগিলাম। ধীরে ধীরে চেতনা ফিরিয়া আসিল। মনে বিষম ভয় হইতে লাগিল। চোখের সম্মুখে ফাঁসিকাষ্ঠের ভয়াবহ দৃশ্য ফুটিয়া উঠিল। সমস্ত দোষটা আমার ঘাড়ে যে চাপিবে তাহাতে সন্দেহ। নাই—আমার কথা কে বিশ্বাস করিবে?
বুঝিলাম, অন্য লোকটি মুখ বাঁধিয়া ছোরার আঘাতে এই লোকটিকে হত্যা করিয়া পলাইয়াছে। তাহাকে ধরিবার কোনও উপায় নাই, তাহার চেহারাটাও মনে আসিল না।
লোকটা নিশ্চয়ই মরিয়া গিয়াছে। গায়ে হাত দিয়া দেখিলাম, তখনও গরম। ভাবিলাম, কোনও হাসপাতালে লইয়া যাই, চিৎকার করিয়া লোক জড়ো করি, কিন্তু সাহস হইল না। তাজা খুন দেখিয়া ভয়ে আমি তখন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য—আত্মরক্ষা করার কথাটাই আমার প্রথমে মনে হইল। সভয়ে চারিদিকে চাহিয়া মৃত বা মরণাপন্ন দেহটি সেই বৃক্ষতলে ফেলিয়া রাখিয়া গাড়ি লইয়া উর্ধ্বশ্বাসে পলায়ান করিলাম।
কেমন করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম, কেমন করিয়া সেই রাত্রিতেই গাড়িখানি ধুইয়া মুছিয়া আস্তাবলে রাখিলাম, আমার কিছুই স্মরণ নাই। তারপরে সাত আট দিন ধরিয়া আমি দারুণ জ্বরে বেহুশ হইয়া পড়িয়াছিলাম। ফুফুর মুখে শুনিয়াছি, সে কয়দিন আমি খুন রক্ত ফাঁসি ইত্যাদি নানা ভুল বকিয়াছিলাম।
সম্পূর্ণ আরোগ্য হইবার পরও গাড়ি লইয়া বাহির হইতে সাহস হইতেছিল না, গাড়িখানির দিকে নজর দিতেও ভরসা পাইতেছিলাম না। কিন্তু পেট তে চালাইতে হইবে। আবার একদিন সকালে মনের সহিত অনেক যুদ্ধ করিয়া গাড়িখানি বাহির করিতে গেলাম। গাড়িতে হাত দেওয়ামাত্র মনটা ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল। রক্তের চিহ্নমাত্র ছিল না, তবু যেন রক্ত দেখিতে পাইলাম। মনের দুর্বলতা জোর করিয়া উড়াইয়া দিয়া গাড়ি লইয়া বাহির হইলাম। সওয়ারী জুটিল। মাঝে মাঝে গা ছমছম করিতেছিল বটে, কিন্তু দিনের আলোয় লোকের ভিড়ে সে ভাব বেশিক্ষণ মনে থাকিতে পায় নাই। থাকিয়া থাকিয়া মনে হইতেছিল, অন্যায় করিয়াছি—হয়তো লোকটা বাঁচিতে পারিত। বিপদের ভয় না করিয়া যদি তৎক্ষণাৎ কোনও হাসপাতালে তাহাকে লইয়া যাইতাম হয়তো সে বাঁচিয়া উঠিত। লোকটা যদি মরিয়াই থাকে, নিজেকে তাহার মৃত্যুর কারণ বলিয়া মনে হইতে লাগিল। সে ভাবটাও কাটাইয়া উঠিলাম। কে জানে, পরের দিকে নজর দিতে গিয়া হয়তো মহা ফ্যাসাদে পড়িয়া যাইতাম! বাঁচিবার নসীব থাকিলে সে এমনই বাঁচিবে। এইভাবে নানা মানসিক দ্বন্দ্বে প্রথম দিনটা কাটিয়া গেল। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।
সমস্ত রাত্রি কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে কাটিল; ঘুমাইতে পারিলাম না। ভয় হইল, আবার বুঝি জ্বর হইবে। সেই রক্তাক্ত-দেহ মুখ-বাঁধা লোকটিকে যেন চারিদিকে দেখিতে লাগিলাম। মাথা গরম হইয়াছে ভাবিয়া চোখেমুখে জল দিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিলাম, ঘুমও আসিল। কিন্তু ভোরবেলায় আবার একটা দুঃস্বপ্ন দেখিয়া ভীষণ ভয়ে ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া আমার কানে কানে বলিয়া গেল—তুই আমাকে খুন করিয়াছিস! আমি আল্লা নাম স্মরণ করিয়া উঠিয়া বসিলাম।
সেদিন গাড়ি লইয়া বাহির হইতে যাইব—মনে হইল কে যেন আমার পিছু লইয়াছে, পিছনের পথের উপর যেন রক্তের দাগ দেখিলাম। হায় আল্লা! এ কি হইল! কাহার পাপের বোঝা কাহার ঘাড়ে চাপাইলে তুমি! আমি যেখানে যাই, সেখানেই যেন কোনও অদৃশ্য কেহ আমার পিছু লইতে লাগিল। ভাবিলাম, আমি কি পাগল হইয়া গেলাম!
বুঝিলাম, আমাকে ভূতে পাইয়াছে। ওঝার কাছে গেলাম, সে অনেক ঝাড়ফুঁক করিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না—সে আমার পিছু ছাড়িল না।
মকবুল চুপ করিয়া গামছা দিয়া কপালের ঘাম মুছিল। আমার কাছে একটা সিগারেট লইয়া সেটা ধরাইয়া আবার বলিতে লাগিল—
দুই-একদিন পরে সন্ধ্যার সময় হেদুয়ার মোড়ে দাঁড়াইয়া ছিলাম, এমন সময়ে বৃষ্টি নামিল। বৃষ্টি হইতে বাঁচাইবার জন্য গাড়িখানা তেরপল মুড়ি দিতে যাইতেছি, দেখি পিছনে পিছনে কে যেন আসিতেছে! ফিরিয়া তাকাইলাম, কেহ নাই। তাড়াতাড়ি গাড়িখানা ঢাকিয়া বাড়ি ফিরিবার ইচ্ছা হইল। গাড়ির হর হইতে পর্দাখানা ফেলিতে যাইব, দেখি গাড়ির ভিতরে সে বসিয়া—মুখ বাঁধা, বুক দিয়া রক্ত গড়াইতেছে! ভয়ে শিহরিয়া উঠিয়া পর্দা ফেলিয়া দিয়া মূর্ছিতের মত সেখানে বসিয়া পড়িলাম।
আমার এই অদ্ভুত যন্ত্রণার কথা আপনাকে কেমন করিয়া জানাইব বাবু? আপনি কি বুঝিতে পারিবেন? গাড়ির ভিতর রক্তাক্ত কলেবরে সে নিশ্চয়ই বসিয়া আছে। সেই হইতে আজ পর্যন্ত ওই গাড়িতেই বসিয়া থাকে সে; আমার পিছনে আর তাহাকে দেখি না—সে নিশ্চিন্ত হইয়া গাড়ির ভিতরেই থাকে, আমি তাহাকে টানিয়া লইয়া বেড়াই।
মকবুল চোখ বুজিয়া চুপ করিয়া রহিল। অনেকক্ষণ ওই ভাবে থাকিয়া আবার বলিতে লাগিল—
বাবু, সেই দিন হইতে আজ পর্যন্ত ওই মড়ার বোঝা আমি টানিয়া ফিরিতেছি। একজনের অধিক সওয়ারী তাই আর টানিতে পারি না। মড়া পচিয়া দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে—আমাকে তাহাই সঙ্গে করিয়া ফিরিতে হইতেছে। অথচ আল্লার দোহাই বাবু, ওই লোকটার মৃত্যুতে জ্ঞানতঃ আমার কোনও অপরাধ নাই।
আমি ওই নিরক্ষর লোকটিকে কি সান্ত্বনা দিব। চুপ করিয়া রহিলাম।
—বাবু, বোঝা সব সময়েই বহিতে হয়, কিন্তু বর্ষারাত্রি ছাড়া অন্য সময়ে ওই মৃতদেহ আমি দেখিতে পাই না। দেখিয়া দেখিয়া বোঝা টানিয়া টানিয়া অনেকটা সহিয়া গিয়াছে, কিন্তু আজিও মাঝে মাঝে ভয় পাইয়া উঠি। ভিতরে ভিতরে আমার শরীর জীর্ণ হইয়া আসিয়াছে; এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমি আর বেশিদিন সহ্য করিতে পারিব না।
এই গাড়িখানি ছাড়িয়া দিবার সামর্থ্য আমার নাই বাবু—এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে ইহার সহিত জুড়িয়া দিয়াছে, আমি তাহার কাছে সম্পূর্ণ শক্তিহীন। আজ তিন বৎসর ধরিয়া আমার এই ভীষা কর্তব্য আরম্ভ হইয়াছে; কবে শেষ হইবে খোদাতালাই জানেন!
মকবুল উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, বৃষ্টি ধরিয়া আসিয়াছে বাবু, আপনি গাড়িতে বসুন। আমি পরদিন তাহাকে আমার সহিত দেখা করিতে বলিব কি না ভাবিতে ভাবিতে গাড়ির নিকট গেলাম। মরুল মুখ ফিরাইয়া কম্পিত হস্তে পর্দাখানি তুলিয়া ধরিল। আমি ভিতরে বসিতেই সে পর্দাখানি ফেলিয়া দিয়া গাড়ি টানিতে শুরু করিল।
পর্দা-ফেলা অন্ধকার রিক্শাখানির ভিতর বসিতেই আমার গা ছমছম করিতে লাগিল। আমিও যেন আমার অত্যন্ত গা ঘেঁষিয়া এক অদৃশ্য রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখিতে পাইলাম; একটা পচা দুর্গন্ধও নাকে আসিতে লাগিল। সভয়ে পর্দা তুলিয়া ফেলিয়া মকবুলকে রিক্শা থামাইতে বলিয়া বলিলাম, আমার বাড়ি বেশি দূর নয়, আমি হাঁটিয়াই যাইতে পারিব। রিক্শাখানির ভিতরে চাহিবার আর সাহস হইল না।
মকবুল বুঝিল। একটু শীর্ণ হাসি হাসিয়া গাড়িখানি তুলিয়া ধরিয়া মন্থর গতিতে চলিতে লাগিল। আমি সেখানে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। রিক্শাখানির দিকে চাহিবার সামর্থ্য পর্যন্ত আমার হইল না। বহুক্ষণ পর্যন্ত রিক্শাখনির ঠুনটুন আওয়াজ কানে আসিতে লাগিল। সে-রাত্রে ভাল করিয়া ঘুমাইতে পারিলাম না।