রিক্তের বেদন
[ ক ]
বীরভূম
আঃ! একী অভাবনীয় নতুন দৃশ্য দেখলুম আজ? …
জননী জন্মভূমির মঙ্গলের জন্যে সে-কোন্-অদেখা-দেশের আগুনে প্রাণ আহুতি দিতে একী অগাধ-অসীম উৎসাহ নিয়ে ছুটছে তরুণ বাঙালিরা, – আমার ভাইরা! খাকি পোশাকের ম্লান আবরণে এ কোন্ আগুনভরা প্রাণ চাপা রয়েছে! – তাদের গলায় লাখো হাজার ফুলের মালা দোল খাচ্ছে, ওগুলো আমাদের মায়ের-দেওয়া ভাবী বিজয়ের আশিস-মাল্য, – বোনের দেওয়া স্নেহ-বিজড়িত অশ্রু গৌরবোজ্জ্বল-কমহার!
ফুলগুলো কত আর্দ্র-সমুজ্জ্বল! কী বেদনা-রাঙা মধুর! ওগুলো তো ফুল নয়, ও যে আমাদের মা-ভাই-বোনের হৃদয়ের পূততম প্রদেশ হতে উজাড়-করে দেওয়া অশ্রুবিন্দু! এই যে অশ্রু ঝরেছে আমাদের নয়ন গলে, এর মতো শ্রেষ্ঠ অশ্রু আর ঝরেনি, – ওঃ সে কত যুগ হতে!
আজ ক্ষান্ত-বর্ষণ প্রভাতের অরুণ কিরণ চিরে নিমিষের জন্য বৃষ্টি নেমে তাদের খাকি বসনগুলোকে আরও গাঢ়-ম্লান করে দিয়েছিল। বৃষ্টির ওই খুব মোটা ফোঁটাগুলো বোধ হয় আর কারুর ঝরা অশ্রু! সেগুলো মায়ের অশ্রু-ভরা শান্ত আশীর্বাদের মতো তাদিগে কেমন অভিষিক্ত করে দিল!
তারা চলে গেল! একটা যুগবাঞ্ছিত গৌরবের সার্থকতার রুদ্ধবক্ষ বাষ্পরথের বাষ্পরুদ্ধ ফোঁস ফোঁস শব্দ ছাপিয়ে আশার সে কী করুণ গান দুলে দুলে ভেসে আসছিল,–
বহুদিন পরে হইব আবার আপন কুটিরবাসী,
হেরিব বিরহ-বিধুর-অধরে মিলন-মধুর হাসি,
শুনিব বিরহ-নীরব কণ্ঠে মিলন-মুখর বাণী, –
আমার কুটির-রানি সে যে গো আমার হৃদয়-রানি।
সমস্ত প্রকৃতি তখন একটা বুকভরা স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছিল! বাংলার আকাশে, বাংলার বাতাসে সে বিদায়-ক্ষণে ত্যাগের ভাস্বর অরুণিমা মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছিল। কে বলে মাটির মায়ের প্রাণ নেই?
এই যে জল-ছলছল শ্যামোজ্জ্বল বিদায়-ক্ষণটুকু অতীত হয়ে গেল, কে জানে সে আবার কত যুগ বাদে এমনই একটা সত্যিকার বিদায়-মুহূর্ত আসবে?
আমরা ‘ ইস্তক নাগাদ্’ ত্যাগের মহিমা কীর্তন পঞ্চমুখে করে আসছি, কিন্তু কাজে কতটুকু করতে পেরেছি? আমাদের করার সমস্ত শক্তি বোধ হয় এই বলার মধ্য দিয়েই গলে যায়!
পারবে? বাংলার সাহসী যুবক! পারবে এমনি করে তোমাদের সবুজ, কাঁচা, তরুণ জীবনগুলো জ্বলন্ত আগুনে আহুতি দিতে, দেশের এতটুকু সুনামের জন্যে? তবে এসো! ‘এসো নবীন, এসো! এসো কাঁচা, এসো!’ তোমরাই তো আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আশা, ভরসা, সব! বৃদ্ধদের মানা শুনো না। তাঁরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে সুনাম কিনবার জন্য ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তোমাদের উদ্বুদ্ধ করেন, আবার কোনো মুগ্ধ যুবক নিজেকে ওই রকম বলিদান দিতে আসলে আড়ালে গিয়ে হাসেন এবং পরোক্ষে অভিসম্পাত করেন। মনে করেন, ‘এই মাথা-গরম ছোকরাগুলো কী নির্বোধ!’ ভেঙে ফেলো, ভেঙে ফেলো ভাই, এদের এ সংকীর্ণ স্বার্থ-বন্ধন!
অনেকদিন পরে দেশে একটা প্রতিধ্বনি উঠছে, ‘জাগো হিন্দুস্থান, জাগো! হুঁশিয়ার!’
মা! মা! কেন বাধা দিচ্ছ? কেন এ-অবশ্যম্ভাবী একটা অগ্ন্যুৎপাতকে পাথর চাপা দিয়ে আটকাবার বৃথা চেষ্টা করছ? – আচ্ছা, মা! তুমি বি-এ পাশকরা ছেলের জননী হতে চাও, না বীর-মাতা হতে চাও? এ ঘুমের নিঝুম-আলস্যের দেশে বীরমাতা হওয়ার মতো সৌভাগ্যবতী জননী কয়জন আছেন মা? তবে, কোন্টি বরণীয় তা জেনেও কেন এ অন্ধস্নেহকে প্রশ্রয় দিচ্ছ? গরিয়সী মহিমান্বিতা মা আমার! ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও – তোমার এ জনম-পাগল ছেলেকে ছেড়ে দাও! দুনিয়ায় সব কিছু দিয়েও এখন আমায় ধরে রাখতে পারবে না। আগুন আমার ভাই – আমায় ডাক দিয়েছে! সে যে কিছুতেই আঁচলচাপা থাকবে না। আর, যে থাকবে না, সে বাঁধন ছিঁড়বেই। সে সত্যসত্যই পাগল, তার জন্য এখনও এমন পাগলা-গারদের নির্মাণ হয়নি, যা তাকে আটকে রাখতে পারবে!
পাগল আজকে ভাঙরে আগল
পাগলা-গারদের,
আর ওদের
সকল শিকল শিথিল করে বেরিয়ে পালা বাইরে.
দুশমন স্বজনের মতো দিন-দুনিয়ায় নাইরে!
ও তুই বেরিয়ে পালা বাইরে॥
* * * * *
আজ যুদ্ধে যাওয়ার আদেশ পেয়েছি! … পাখি যখন শিকলি কাটে, তখন তার আনন্দটা কীরকম বেদনা-বিজড়িত মধুর।…
আহ্, আমায় আদেশ দিয়ে শেষ আশিস করবার সময় মার গলার আওয়াজটা কী রকম আর্দ্র-গভীর হয়ে গিয়েছিল! সে কী উচ্ছ্বসিত রোদনের বেগ আমাদের দুজনকেই মুষড়ে দিচ্ছিল! … হাজার হোক, মায়ের মন তো!
আকাশ যখন তার সঞ্চিত সমস্ত জমাট-নীর নিঃশেষে ঝরিয়ে দেয়, তখন তার অসীম নিস্তব্ধ বুকে সে কী একটা শান্ত সজল স্নিগ্ধতার তরল কারুণ্য ফুটে উঠে!
মার একমাত্র জীবিত সন্তান, বি-এ পড়ছিলুম; মায়ের মনে যে কত আশাই না মুকুলিত পল্লবিত হয়ে উঠেছিল! আমি আজ সে-সব কত নিষ্ঠুরভাবে দলে দিলুম! কী করি, এ দিনে এরকম যে না করেই পারি না।
আমার পরিচিত সমস্ত লোক মিলে আমায় তিরস্কার করতে আরম্ভ করেছে যেন আমি একটা ভয়ানক অন্যায় করেছি। সবাই বলছে, আমার সহায়-সম্বলহীন মাকে দেখবে কে!… হায়, আজ আমার মা যে রাজরাজেশ্বরীর আসনে প্রতিষ্ঠাতা, তা কাউকে বুঝাতে পারব না!
কাকে বুঝাই যে, লক্ষপতি হয়ে দশ হাজার টাকা বিলিয়ে দিলে তাকে ত্যাগ বলে না, সে হচ্ছে দান। যে নিজেকে সম্পূর্ণ রিক্ত করে নিজের সর্বস্বকে বিলিয়ে দিতে না পারল, সে তো ত্যাগী নয়। মার এই উঁচু ত্যাগের গগনস্পর্শী চূড়া কেউ যে ছুঁতেই পারবে না। তাঁর এ গোপন বরেণ্য মহিমা একা অন্তর্যামীই জানে!
এই তো সত্যিকারের মোসলেম জননী, যিনি নিজ হাতে নিজের একমাত্র সন্তানকে যুদ্ধসাজে সাজিয়ে জন্মভূমির পায়ে রক্ত ঢালতে পাঠাতেন।
এ বিসর্জন না অর্জন?
সালার
জননী আর জন্মভূমির দিকে কখনও আর এত স্নেহ এত ব্যথিত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখিনি, যেমন তাঁদিকে ছেড়ে আসবার দিনে দেখেছিলুম। … শেষ চাওয়া মাত্রেই বোধ হয় এমনই প্রগাঢ় করুণ!…
নাঃ, আমাকে হয়রান করে ফেললে এদের অতি ভক্তির চোটে। আমি যেন মহামহিমান্বিত এক সম্মানার্হ ব্যক্তিবিশেষ আর কী! দিন নেই, রাত নেই, শুধু লোক আসছে আর আসছে। যে-আমাকে তারা এইখানেই হাজার বার দেখেছে তারাও আবার আমায় নতুন করে দেখছে। এ এক যেন তাজ্জব ব্যপার। আমি আমার চির পরিচিত শৈশব-সাথি বন্ধুদের মাঝে থেকেও মনে করছি যেন ‘আবু হোসেনের’ মতো এক রাত্তিরেই আমি ওই রকম একটা রাজা বাদশা গোছ কিছু হয়ে পড়েছি! সবচেয়ে বেশি দুঃখ হচ্ছে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের ভক্তি দেখে। বন্ধুরা যদি ভক্তি করে, তাহলে বন্ধুদের ঘাড়ে পড়ল একটা প্রকাণ্ড মুদগর! তাগিদে যতই বলছি, ভো ভো আহম্মকবৃন্দ, তোমাদের এ চোরের লক্ষণ, ওরফে অতিভক্তি সম্বরণ করো, ততই যেন তারা আমার আরও মহত্ত্বের পরিচয় পাচ্ছে! … বাইরে তো বেরোনো দায়! বেরোলেই অমনি স্ত্রী-পুরুষের ছোটো বড়ো মাঝারি প্রাণী আমার দিকে প্রাণপণে চক্ষু বিস্ফারিত করে চেয়ে থাকে, আর অন্যকে আমার সবিশেষ ইতিবৃত্ত জ্ঞাত করিয়ে বলে, ‘ওই রে, ওই লম্বা সুন্দর ছেলেটা যুদ্ধে যাচ্ছে।’
তারা কোন্টা দেখে আমার, – ভিতর না বাহির?
[ খ ]
রেলপথে
(অণ্ডালের কাছাকাছি।)
যাক, এতক্ষণে লোকের ভক্তিশ্রদ্ধার আক্রমণ হতে রেহাই পাওয়া গেল! – উঃ, যুদ্ধের আগেই এও তো একটা মন্দ যুদ্ধ নয়, রীতিমতো দ্বন্দ্ব যুদ্ধ! এখন একটু হাঁফ – ছেড়ে বাঁচি। …
একটা ভালো কাজ করে যা আনন্দ আর আত্মপ্রসাদ মনে মনে লাভ করা যায়, তার অনেকটা নষ্ট করে দেয় বাইরের প্রশংসায়।
সব চেয়ে বেশি ভিড় হয়েছিল কলকাতায় আর হাবড়ার স্টেশনে। – ওঃ, সে কী বিপুল জনতা আর সে কী আকুল আগ্রহ আমাদিগকে দেখবার জন্যে! আমরা মঙ্গলগ্রহ হতে অথবা ওই রকমের স্বর্গের কাছাকাছি কোনও একটা জায়গা হতে যেন নেমে আসছি আর কী! যাঁদের সঙ্গে তখনও আলাপ করবারও সুযোগ পাইনি, তাঁরাও আমাদের সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন আর অশ্রুগদগদ কণ্ঠে আশিস করেছেন। – ওই যে হাজার হাজার পুর-মহিলার হৃদয় গলে সহানুভূতির পূত অশ্রু ঝরছে, ওতেই আমাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গল সূচিত হচ্ছে! – সকলেরই দৃষ্টি আজ কত স্নেহ-আর্দ্র কোমল! … …
স্টেশনে স্টেশনে এই যে উপহারের আর বিদায়-সম্ভাষণের ধুমধাম, এতে কিন্তু বড্ডো বেশি ব্যতিব্যস্ত করে ফেলছে! – এ সব রাজ্যের জিনিস খাবে কে? – আহা, না, না, এই রকম উপহার দিয়েই যদি ওরা তৃপ্ত হয়, একটা অশ্রুময় গৌরবে বক্ষ ভরে ওঠে, তবে তাই হোক!
মন! বুঝে নাও কী জন্যে এত ভক্তি-শ্রদ্ধা। ভেবে নাও কী ঘোর দায়িত্ব মাথায় করছ!
আমার কম্পিত বুকে থেকে থেকে এখনও সেই আর্ত বন্দনার ঘন প্রতিধ্বনি হচ্ছে, ‘বন্দে মাতরম্ – বন্দে মাতরম্।’
রেলগাড়ি
(নিশি ভোর)
কী সুন্দর জলে-ধোয়া আকাশ! কী স্নিগ্ধ নিঝুম নিশি-ভোর! সারা প্রকৃতি এখনও তন্দ্রালস নয়নে গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে রয়েছে। গোলাবি রং-এর মসলিনের মতো খুব পাতলা একটা আবছায়া তার ধূমভরা ক্লান্ত দেহটায় জড়িয়ে রয়েছে। আর একটু পরেই এমন সুন্দর প্রকৃতি বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে জেগে উঠবে, তারপরে সেই তেমনই নিত্যকার গোলমাল!
(ওই প্রত্যুষে)
এখন বোধ হচ্ছে যেন সমস্ত দেশটা এইমাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে উদাস-অলস নয়নে তার চেয়েও উদার আকাশটার দিকে চেয়ে রয়েছে! এখনও তার আঁখির পাতায় পাতায় ঘুমের জড়িমা মাখানো! হাইতোলার মতো মাঝে মাঝে দমকা বাতাস ছুটে আসছে!
পাকা তবলচির মতো রেলগাড়িটা কী সুন্দর কারফা বাজিয়ে যাচ্ছে, ‘পাঁটা কেটে ভাগ দিন – পাঁটা কেটে ভাগ দিন!’ ইচ্ছে করছে রেল-চলার এই কারফা তালের তালে তালে একটা ভৈরোঁ কী টোড়ি রাগিণী ভাঁজি, কিন্তু গান গাইবার মতো এখন আদৌ সুর নেই যেন আমার কণ্ঠে।
মধুপুর
নিশি শেষের গ্যাসের আলো পড়ে আমাদের মুখগুলো কী করুণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ওই ফ্যাকাসে আলোর পাণ্ডুর আভা প্রতিভাত হয়ে আমার ঘুমন্ত সৈনিক-বন্ধুদের সিক্ত নয়ন-পল্লবগুলি কীরকম চকচক করছে! ও কীসের অশ্রুবিন্দু! বিদায়-ব্যথার? – কে জানে! ….
আজ এই প্রভাতের গ্যাসের আলোর মতোই পান্ডুর রক্তহীন একটি তরুণ মুখ ক্ষণে ক্ষণে আমার বুকের মাঝে ভেসে উঠছে। এখন যেন একটা বাষ্পময় কুয়াশার মতো আধো-আলো আধো-আঁধার ভাব দেখা যাচ্ছে, কদিন ধরে তার দৃষ্টিটিও এই রকম ঝাপসা সজল হয়ে উঠেছিল! সে কিন্তু কখনও কিছু বলেনি – কিছু বলতে পারেনি – আমিও কখনও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি – হাজার চেষ্টাতেও না! কী যেন একটা লজ্জামিশ্রিত কিছু আমায় প্রাণপণে চোখমুখ ঢেকে মানা করত – না, না, না, তবু কী করে আমাদের দুটি প্রাণের গোপন কথা দুজনেই জেনেছিলুম। ওঃ, প্রথম যৌবনের এই গোপন ভালোবাসাবাসির মাধুর্য কত গাঢ়! আমার বিদায় দিনেও আমি একটি মুখের কথা বলতে পারিনি তাকে! শুধু একটা জমাট অশ্রুখণ্ড এসে আমার বাকরোধ করে দিয়েছিল! সেও কিছু বলেনি, যতদিন বাড়িতে ছিলুম, ততদিন শুধু লুকিয়ে কেঁদেছে আর কেঁদেছে! তার পর বিদায়ের ক্ষণে তাদের ভাঙা দেয়ালটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রক্তভরা আঁখিতে ব্যাকুল বেদনায় চেয়েছিল! আর তার তরুণ সুন্দর মুখটি এই ভোরের গ্যাসের আলোর মতোই করুণ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল! – মা যেন আমার গোপন-ব্যথার রক্ত ক্ষরা দেখেই সেদিন বলেছিলেন, ‘যা বাপ, একবার শাহিদাকে দেখা করে আয়। সে মেয়ে তো কেঁদে কেঁদে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে!’ – আমি তখন জোর করে বলেছিলুম, ‘না, মা, মরুকগে সে, আমি কিছুতেই দেখা করতে পারব না।’ – হায় রে, খামখেয়ালির অহেতুক অভিমান!
আজ বড়ো দুঃখে আমার সেই প্রিয় গানটা মনে পড়ছে, –
‘দুজনে দেখা হল মধু-যামিনীরে –
কেন কথা কহিল না – চলিয়া গেল ধীরে?
নিকুঞ্জে দখিনাবায়, করিছে হায় হায় –
লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে! –
দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে –
দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে –
আর তো হল না দেখা জগতে দোঁহে একা,
চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনা-তীরে!’ –
উঃ, কী পানসে উদাস আজকার ভোরের বাংলাটা! – সদ্যসুপ্তোত্থিত বনের বিহগের আনন্দ-কাকলি আজ যেন কী রকম অশ্রুজড়িত আর দীর্ঘ ব্যথিত।
এই গাড়ি ছাড়ার ঘন্টার ঢং ঢং শব্দটা কত অরুন্তুদ গভীর! ঠিক যেন গির্জায় কোনো অতীত হতভাগার চির বিদায়ের শেষ ঘন্টাধ্বনি!
লাহোরের অদূরে
(নিশীথ)
একটা বিরাট মহিষাসুরের মতো কী একরোখা ছুট ছুটছে এই উন্মাদ বাষ্প-রথটা! … ছোটো, … ওগো আগুন আর বাষ্প-পোরা-দানব, ছোটো! আর দোল দাও – দোল দাও এই তরুণ তোমার ভাইদের! ছোটো, ওগো খ্যাপা দৈত্য, ছোটো, – আর পিষে দিয়ে যাও তোমার এই লৌহময় পথটাকে! তোমার পথের পাশে ঘুমিয়ে যারা, তাদের জাগিয়ে দিয়ে যাও তোমার এই ছোটার শব্দে!…
নিশীথের জমাট অন্ধকার চিরে শান্ত বনশ্রীকে চকিত শঙ্কিত করে কত জোরে ছুটেছে এই খামখেয়ালি মাথাপাগলা রাক্ষসটা, – কিন্তু তার চেয়েও লক্ষ গুণ বেগে আমার মন উলটোদিকে ছুটেছে – যেখানে আমার সেই গোপন আকাঙ্ক্ষিতার বাষ্পরুদ্ধ চাপাকান্নার আকুলতা গ্রামের নিরীহ অন্ধকারকে ব্যথিত ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে! মন আমার তারই সাথে শ্বাস ফেলাচ্ছে, সে হতভাগিনির ফুলে-ফুলে-উঠা দীর্ঘশ্বাস সরল-মেঠো বাতাসটিকে নিষ্ঠুরভাবে আহত করছে! আলুথালু আকুলকেশ, ধূলি-লুণ্ঠিত শিথিল-বসন, উজাড় করে দেওয়া আঁশুয়ে ভেজা উপাধান, – সব যেন মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি আর এই মধু-কল্পনার স্নিগ্ধকারুণ্য আমার বুকে কেমন একটি গৌরবের ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে!
সমস্ত শাল আর পিয়াল বন কাঁপিয়ে যেন একটা পুত্রশোকাতুরা দৈত্য-জননী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে ‘ওই – ওই – ওই!’ আর মাতৃহারা দৈত্যশিশুর মতো এই খ্যাপা গাড়িটাও এপার থেকে কাতরে কাতরে উঠচে উ – উ – উঃ!
[ গ ]
নৌশেরা
এসো আমার বোবা সাথি, এসো! আজ কতদিন পরে তোমায় আমায় দেখা! তোমার বুকে এমনি করে আমার প্রাণের বোঝা নামিয়ে না রাখতে পারলে এতদিন আমার ঘাড় দুমড়ে পড়ত!
আহ্ কী জ্বালা! এতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম, এত গাধাখাটুনির মাঝেও সেই একান্ত অন্ধস্মৃতিটার ব্যথা যেন বুকের উপর চেপে বসে আছে!… আজ তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে! হৃদয়, শক্ত হও – বাঁধন ছিঁড়তে হবে। যে তোমার কখনও হয়নি, যাকে কখ্খনো পাও নি, যে তোমার হয়ত কখ্খনো হবে না, যাকে কখ্খনো পাবে না, যার অজানা ভালোবাসার স্মৃতিটাই ছিল – তোমার সারা বক্ষ বেদনায় ভরে, সেই শাহিদার স্মৃতিটাকেও ধুয়ে মুছে ফেলতে হবে! উঃ! তা … পারবে? সাহস আছে? ‘না’ বললে চলবে না, এ যে পারতেই হবে! মনে পড়ে কি আমাদের দেশের মা ভাই-বোনের দেওয়া উপহার? বুঝেছিলে কী যে, ওগুলি তাঁদের দেওয়া দায়িত্বের, কর্তব্যের গুরুভার? আমাদের কাজের উপর আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কষ্টিপাথরের মতো সহ্যগুণ আমাদের থাকা চাই, তবে না জগতের লোকে যাচাই করে নেবে যে, বাঙালিরাও বীরের জাতি। এ সময় একটা গোপন স্মৃতি-ব্যথা বুকে পুষে মুষড়ে পড়লে চলবে না। তাকে চাপা দিতেও পারবে না নিঃশেষে বিসর্জন দিতে হবে! একেবারে বাইরের ভিতরের সব কিছু উজাড় করে বিলিয়ে দিতে হবে, তবে না রিক্ততার – বিজয়ের পূর্ণরূপ ফুটে উঠবে প্রাণে! অনেকে জীবন দিয়েছে, তবু এই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকা মধু-স্মৃতিটুকু বিসর্জন দিতে পারেনি। তোমাকে সেই অসাধ্য সাধন করতে হবে! পারবে? সাধনার সে জোর আছে? – যদি না পার, তবে কেন নিজেকে ‘মুক্ত’, ‘রিক্ত’, ‘বীর’ বলে চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছ? যার প্রাণের গোপনতলে এখনও কামনা জেগে রয়েছে, সে ভোগী-মিথ্যুক আবার ত্যাগের দাবি করে কোন্ লজ্জায়? সে কাপুরুষের আবার বীরের পবিত্র শিরস্ত্রাণের অবমাননা করবার কী অধিকার আছে? দেশের জন্য প্রাণ দিবে যারা, তারা প্রথমে হবে ব্রহ্মচারী, ইন্দ্রিয়জিৎ! –
মাথার ওপর মা আমার ভাবী-বিজয়ী বীর-সন্তানের মুখের দিকে আসা-উৎসুক নয়নে চেয়ে রয়েছেন, আর পায়ের নীচে এক তরুণী তার অশ্রুমিনতি-ভরা ভাষায় সাধছে, ‘যেয়ো না গো প্রিয়, যেয়ো না।’ কী করবে? … নিশ্চয়ই পারবে! তুমি যে মায়ামমতাহীন কঠোর সৈনিক। …. শক্ত হয় হৃদয় আমার, শক্ত হও! আজ তোমার বিসর্জনের দিন! আজ ওই কাবুল নদীর ধারে ঊষর প্রান্তরটার মতোই বুকটাকে রিক্ত শূন্য করে ফেলতে হবে। তবে না তোমার সমস্ত তৃষ্ণা, সমস্ত সুখ-দুঃখ বৈরাগ্যের যজ্ঞকুণ্ডে আহুতি দিতে পূর্ণ রিক্ততার গান ধরবে, –
‘ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ
আরো কি তোমার চাই?
ওগো ভিখারি, আমার ভিখারি, –
পলকে সকলই সঁপেছি চরণে আর তো কিছুই নাই। –
আরও কি তোমার চাই?’
* * *
কুর্দিস্তান
পেয়েছি, – পেয়েছি! ওঃ, আজ দীর্ঘ এক বৎসর পরে আমার প্রাণ কেন পূর্ণ-রিক্ততায় ভরে উঠেছে বলে বোধ হচ্ছে! … এই এক বৎসর ধরে সে কী ভয়ানক যুদ্ধ মনের সাথে! এ সমরে কত কিছুই না মারা গেল!… বাইরের যুদ্ধের চেয়ে ভিতরের যুদ্ধ কত দুরন্ত দুর্বার! রণজিৎ অনেকেই হতে পারে, কিন্তু মনজিৎ ক-জন হয়? – সে কেমন একটা প্রদীপ্ত কাঠিন্য আমাকে ক্রমেই ছেয়ে ফেলেছে! সে কী সীমাহীন বিরাট শূন্য হয়ে গেছে হৃদয়টা আমার! – এই কি রিক্ততা? … ভোগও নেই – ত্যাগও নেই; তৃষ্ণাও নেই – তৃপ্তিও নেই; প্রেমও নেই – বিচ্ছেদও নেই; – এ যেন কেমন একটা নির্বিকার ভাব! না ভাই, না এমন রিক্ততা-ভরা তিক্ততা দিয়ে জীবন শুধু দুর্বিষহই হয়ে পড়ে! এমন কঠিন অকরুণ মুক্তি তো আমি চাইনি! এ যেন প্রাণহীন মর্মর-মন্দির! …
তবু কিন্তু রয়ে রয়ে মর্মরের শক্ত বুকে শুক্লা চাঁদিনীর মতো করুণ মধুর হয়ে সে কার স্নিগ্ধশান্ত আলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়? – হায় ছুঁয়ে যায় বটে, কিন্তু আর তো নুয়ে যায় না! … দেখেছ? আমার অহংকারী মন তবু বলতে চায় যে, ওটি নিজেকে নিঃশেষ করে বিলিয়ে দেওয়ার একটা অখণ্ড আনন্দের এক কণা শুভ্র জ্যোতি! – তবু সে বলবে না যে ওটা একটি বিসর্জিতা প্রতিমার প্রীতির কিরণ! …
আঃ, আজ এই আরবের উলঙ্গ প্রকৃতির বুকে-মুখে মেঘমুক্ত শুভ্রজ্যোৎস্না পড়ে তাকে এক শুক্লবসনা সন্ন্যাসিনীর মতো দেখাচ্ছে! এদেশের এই জ্যোৎস্না এক উপভোগ করবার জিনিস। পৃথিবীর আর কোথাও বুঝি জ্যোৎস্না এত তীব্র আর প্রখর নয়। জ্যোৎস্না রাত্রিতে তোলা আমার ফটোগুলো দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, এগুলো জ্যোৎস্নালোকে তোলা ফটো। ঠিক যেন শরৎ প্রভাতের সোনালি রোদ্দুর।
হাঁ, – এতে মস্ত আর এক মুশকিলে পড়লুম দেখছি। … ডালিম ফুলের মতোই সুন্দর রাঙা টুকটুকে একটি বেদুইন যুবতি পাকড়ে বসেছে যে, তাকে বিয়ে করতেই হবে! সে কী ভয়ানক জোর-জবরদস্তি। আমি যত বলছি ‘না’, সে তত একরোখা ঝোঁকে বলে, ‘হাঁ, নিশ্চয়ই হাঁ!’ সে বলেছে যে, সে আমাকে বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছে, আমি বলছি যে, আমি তাকে একদম ভালোবাসিনি। সে বলছে, তাতে কিছু আসে যায় না, – আমাকে ভালোবেসেছে, আমাকেই তার জীবনের চিরসাথি বলে চিনে নিয়েছে – বাস! এই যথেষ্ট! আমার ওজর-আপত্তির মানেই বোঝে না সে! আমি যতই তাকে মিনতি করে বারণ করি, সে ততই হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে বলে, ‘বাঃ – রে, আমি যে ভালোবেসেছি, তা তুমি বাসবে না কেন?’ – হায়, একী জুলুম!
ওরে মুক্ত! ওরে রিক্ত! তোর ভয় নেই, ভয় নেই! এই যে হৃদয়টাকে শুষ্ক করে ফেলেছিস, হাজার বছরের বৃষ্টিপাতেও এতে ঘাস জন্মাবে না, ফুল ফুটবে না! এ বালি-ভরা নীরস সাহারায় ভালোবাসা নেই।
যে ভালোবাসবে না, তাকে ভালোবাসায় কে? যে বাঁধা দেবে না, তাকে বাঁধবে কে? – “আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন, সে কি অমনি হবে?” …
কারবালা
এই সেই বিয়োগান্ত নিষ্করুণ নাটকের রঙ্গমঞ্চ, – যার নামে জগতের সারা মোসলেম নরনারীর আঁখি-পল্লব বড়ো বেদনায় সিক্ত হয়ে ওঠে! এখানে এসেই মনে পড়ে সেই হাজার বছর আগের ধর্ম আর দেশ রক্ষার জন্যে লক্ষ লক্ষ তরুণ বীরের হাসতে হাসতে ‘শহিদ’ হওয়ার কথা! তেমনই বয়ে যাচ্ছে সেই ফোরাত নদী, যার একবিন্দু জলের জন্য দুধের ছেলে, ‘আসগর’ কচি বুকে জহর-মাখা তিরের আঘাত খেয়ে বাবার কোলে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটি চিরতরে মুদেছিল! ফোরাতের এই মরুময় কূলে কূলে না জানি সে কত পবিত্র বীরের খুন বালির সঙ্গে মাখানো রয়েছে। আঃ, এ বালির পরশেও যেন আমার অন্তর পবিত্র হয়ে গেল।
কয়েকটা পাষাণময় নিস্তব্ধ গৃহ খাড়া রয়েছে জমাট হয়ে, – উদার অসীম আকাশেরই মতো বিব্রত মরুভূমি তার বালুভরা আঁচল পেতে চলেই গিয়েছে, – ছোট্ট দুটি তৃষ্ণাতুর দুম্বা-শিশু ‘মা’ ‘মা’ করে চিৎকার করতে করতে ফোরাতের দিকে ছুটে আসছে, – শিশির-বিন্দুর মতো সুন্দর কয়েকটি বুভুক্ষু বালিকা ফোরাতের এক হাঁটু জলে নেমে আঁজলা জল পান করে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা করছে, – বালিতে আর বাতাসে মাতামাতি, – এইসব মিলে কারবালার একটি করুণ চিত্র চোখের সামনে ফুটে উঠছে!
কারবালা! কারবালা!! আজ তোমারই আকাশ, তোমারই বাতাস, তোমারই বক্ষের মতো আমার আকাশ বাতাস বক্ষ সব একটা বিপুল রিক্ততায় পূর্ণ!…
সেদিনও সেই বেদুইন যুবতিগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। – এই অবাধ্য অবুঝ তরুণী সে কী উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল আমার পিছু পিছু ছুটছে। আমি বাইরে বেরোলেই দেখতে পাই, সে একটা মস্ত আরবি ঘোড়ায় চড়ে ফোরাতের কিনারে কিনারে আরবি গজল গেয়ে বেড়াচ্ছে! সে সুরের গিটকারি কত তীব্র – কী তীক্ষ্ণ। প্রাণে যেন খেদং তিরের মতো এসে বিঁধে!
আমি বললুম, ‘ছিঃ গুল, এ কী পাগলামি করছ? – আমার প্রাণে যে ভালোবাসাই নেই, তা ভালোবাসব কী করে?’ সে তো হেসেই অস্থির। মানুষের প্রাণে যে ভালোবাসাই নেই, তা সে নতুন শুনলে। – আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘আমায় ভালোবাসবার তোমার তো কোনো অধিকার নেই গুল!’ – সে আমার হাতটা তার কচি কিশলয়ের মতো কম্পিত ওষ্ঠপুটে ছুঁইয়ে আর মুখটা পাকা বেদানার চেয়েও লাল করে বললে, ‘অধিকার না থাকলে আমি ভালোবাসছি কি করে হাসিন? – এ সরল যুক্তির পরে কি আর কোনো কথা খাটে?
[ ঘ ]
আজিজিয়া
কী মুশকিল! কোথায় করবালা আর কোথায় আজিজিয়া! আর সে কতদিন পরেই না এখানে এসেছি! … তবু গুল এখানে এল কী করে?
শুনেছি এদেশের সুন্দরীরা এমনই মুক্ত স্বাধীন আবার এমনই একগুঁয়ে। একবার যাকে ভালোবাসে, তাকে আর চিরজীবনেও ভোলে না। এদের এ সত্যিকারের ভালোবাসা। এ উদ্দাম ভালোবাসায় মিথ্যে নেই, প্রতারণা নেই! – কিন্তু আমি তো এ ‘সাপে-নেঙুলে’ ভালোবাসায় বিলকুল রাজি নই। তা হলে আমার এ রিক্ততার অহংকারের মাথা কাটা যাবে যে।….
কাল যখন গুল আমার পাশ দিয়ে ঘোড়াটা ছুটিয়ে চলে গেল. তখন তার ‘নরগেস’ ফুলের মতো টানা চোখ দুটোয় কী একটা ব্যথা-কাতর মিনতি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তার সেই চকিত চাওয়া, মৌনভাষা যেন কেঁদে কেঁদে কয়ে গেল, ‘বহুত দাগা দিয়া তু বেরহম!’ …
আমি আবার বললুম, ‘আমি যে মুক্ত আমায় বাঁধতে পারবে না! … আমি যে রিক্ত, আমি তোমায় কি দিব?’ সে তার ফিরোজা রং-এর উড়ানিটা দিয়ে আমার হাতদুটো এক নিমেষে বেঁধে ফেলে বললে, ‘এই তো বেঁধেছি! … আর তুমি রিক্ত বলছ হাসিন? তা হোক, আমার কুম্ভভরা ভালোবাসা হতে না হয় খানিক ঢেলে দিয়ে তোমার রিক্ত চিত্ত পূর্ণ করে দেব!’
আমি বলছি, ‘না – না’, সে তত হাসছে আর বলছে, ‘মিথ্যুক, মিথ্যুক, বেরহম!’
সত্যিই তো, এ কী নতুন উন্মাদনা জাগিয়ে দিচ্ছে প্রাণে গুল? কেন আমার শুষ্ক প্রাণকে মুঞ্জরিত করে তুলছ – নাঃ, এখান হতেও সরে পড়তে হবে দেখছি, – আমার কী একটা কথা মনে পড়ছে, ‘সকল গরব হায়, নিমেষে টুটে যায়, সলিল বয়ে যায় নয়নে।’
ওরে আকাশের মুক্ত পাখি, ওরে মুগ্ধ বিহগী! এ কী শিকলি পরতে চাচ্ছিস তা তুই এখন কিছুতেই বুঝতে পারছিসনে। – এড়িয়ে চল – এড়িয়ে চল সোনার শিকল! ‘মানুষ মরে মিঠাতে, পাখি মরে আঠাতে!’
* * *
কুতল-আমারা
(শেষ বসন্তের নিশীথ রাত্রি)
আঃ, খোদা! কেমন করে তুমি এমন দু দুটো আসন্ন বন্ধন হতে আমায় মুক্তি দিলে, তাই ভাবছি আর অবিশ্রান্ত অশ্রু এসে আমাকে বিচলিত করে তুলছে! এ মুক্তির আনন্দটা বড়ো নিবিড় বেদনায় ভরা! রিক্তের বেদন আমার মতো এমনই বাঁধা আর ছাড়ার দোটানার মধ্যে না পড়লে কেউ বুঝতে পারবে না। … হাঁ, এই সঙ্গে একটা নীরস হাসির বেগ কিছুতেই যেন সামলাতে পারছিনে এই দুটো ব্যর্থ-বন্ধনের নিষ্ঠুর কঠিন পরিণাম দেখে। তাই এই নিশীথে একটা পৈশাচিক হাসি হেসে গাইছি, ‘নিঠুর এই করেছ ভালো! এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো! এই করেছ ভালো!’ কী হয়েছে, তাই বলছি।–
সেদিন চিঠি পেলুম, শাহিদার, আমার গোপন ঈপ্সিতার বিয়ে হয়ে গেছে, – সে সুখী হয়েছে! … মনে হল, যেন এক বন্ধন হতে মুক্তি পেলাম। – না, না, আর অসত্য বলব না, আমার সেই সময় কেমন একটা হিংসা আর অভিমানে সারা বুক যেন আলোড়িত হয়ে উঠেছিল, তাই এই কদিন ধরে বড়ো হিংস্রের মতোই ছুটে বেড়িয়েছি, কিন্তু শান্তি পাইনি! এই আমাদের রক্তমাংসময় শরীর আর তারই ভিতরকার মনটা নিয়ে যতটা অহংকার করি, বাইরে তার কতটুকু টিকে? – যেমনি মনটাকে পিটিয়ে পিটিয়ে এক নিমেষের জন্য দুরস্ত করে রাখি, অমনি মনে হয় ‘এই তো এক মস্ত দরবেশ হয়ে পড়েছি!’ তারপরেই আবার কখন কোন্ ক্ষণে যে মনের মাঝে ক্ষুধিত বাসনা হাহাকার ক্রন্দন জুড়ে দেয়, তা আর ভেবেই পাই না! আবার, পেলেও সেটাকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে চাই! – হায়রে মানুষ! বুঝি বা এই বন্ধনেই সত্যিকার মুক্তি রয়েছে! কে জানে? … ভুলে যাও অভাগিনি শাহিদা, ভুলে যাও – সকল অতীত, সব স্মৃতির বেদনা, সব গোপন আকাঙ্ক্ষা, সব কিছু। সমাজের চারিদিকে অন্ধকার খাঁচায় বন্দিনী থেকে কেন হতভাগিনি তোমরা এমন করে অ-পাওয়াকে পেতে চাও? কেন তোমাদের মুগ্ধ অবোধ হিয়া এমন করে তারই পায়ে সব ঢেলে দেয়, যাকে সে কখ্খনো পাবে না? তবে কেন এ অন্ধ কামনা? … বিশ্বের গোপনতম অন্তরে অন্তরে তোমাদের এই ব্যর্থপ্রেমের বেদনা-ধারা ফল্গুনদীর মতো বয়ে যাচ্ছে, প্রাণপণে এই মূঢ় ভালোবাসাকে রাখতে গিয়ে তোমার হৃদয় ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে আর সেই বিদীর্ণ হৃদয়ের খুনে সমাজের আবরণ লালে-লাল হয়ে গেছে, তবু সে তোমাদের এই আপনি-ভালোবাসার, পূর্বরাগের প্রশ্রয় দেয়নি। তাই আজও পাথরের দেবতার মতো বিশাল দণ্ডহস্তে সে তোমাদের সতর্ক পাহারা দিচ্ছে।
ভুলে যাও শাহিদা, ভুলে যাও, নতুনের আনন্দে পুরাতন ভুলে যাও! তোমাদের কোনো ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসবার অধিকার নেই, জোর করে স্বামিত্বকে ভালোবাসতে হবেই!…
আঃ, আজ কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদের চাঁদের ম্লান রশ্মি পাতলা মেঘের বসন ছিঁড়ে কী মলিন করুণ হয়ে ঝরছে! – গত নিশির কথাটা মনে পড়ছে আর গুরুব্যথায় নিজেই কেঁপে কেঁপে উঠছি! –
কাল রাত্তিরে এমনি সময়ে যখন এখানকার সান্ত্রিদের অধিনায়করূপে রিভলভার হাতে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করে বেড়াচ্ছি, তখন শুনলুম, পেছনের সান্ত্রি একবার গুরুগম্ভীর আওয়াজে ‘চ্যালেঞ্জ’ করলে, ‘হল্ট, হু কামস দেয়ার?’ আর একবার সে জোরে বললে, ‘কৌন হ্যায়? খাড়া রহো! হিলো মত! – মাগো! – উঃ!’ তারপর আর কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না। শুধু একটা অব্যক্ত গোঙানি হাওয়ায় ভেসে এল! আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে দেখলুম, লাল পোশাক-পরা একটি আরব রমণী সান্ত্রির রাইফেলটা নিয়ে ছুটছে আর সান্ত্রির হিমদেহ নিস্পন্দ হয়ে পড়ে রয়েছে। আমার আর বুঝতে বাকি থাকল না কেন এতদিন ধরে আমাদের রাইফেল চুরি যাচ্ছে আর সান্ত্রি মারা পড়ছে। ওঃ কী দুর্ধর্ষ সাহসী এই বেদুইন রমণী! আমি পলকে স্থির হয়ে রমণীকে লক্ষ্য করে গুলি ছাড়লুম, তার গায়ে লাগল না। আর একটি গুলি ছাড়তেই বোধ হয় নিজের বিপদ ভেবেই সে সহসা আমার দিকে মুখ ফিরে দাঁড়াল, তার পর বিদ্যুদ্বেগে পাকা সিপাইয়ের মতো রাইফেলটা কাঁধে করে নিয়ে আমার দিকে লক্ষ্য করল, খট করে ‘বোল্ট’ বন্ধ করার শব্দ হল, তারপর কী জানি কেন হঠাৎ সে রাইফেলটা দূরে ছুড়ে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল! – আত্মরক্ষার্থে আমি ততক্ষণ ‘বোল্ট’ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলুম। এই সুযোগে এক লাফে রিভলভারটা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে যা দেখলুম, তাতে আমারও হাতের রিভলভারটা এক পলকে খসে পড়ল। – তখন তার মুখের বোরকা খসে পড়েছে আর মেঘ ছিঁড়ে পূর্ণিমা-শশীর পূর্ণ শ্বেত জোছনা তার চোখে মুখে যেন নিঃশেষিত হয়ে পড়েছে! আমি স্পষ্ট দেখলুম, জানু পেতে বসে বেদুইন যুবতি ‘গুল’। তার বিস্ময়চকিত চাউনি ছাপিয়ে জ্যোৎস্নার চেয়েও উজ্জ্বল অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। একটা বেদনাতুর আনন্দের আতিশয্যে সে থরথর করে কাঁপছিল। তার প্রাণের ভাষা তারই ওই অশ্রুর আখরে যেন আঁকা হয়ে যাচ্ছিল, ‘এতদিনে এমন করে দেখা দিলে নিষ্ঠুর! ছি, এত কাঁদানো কি ভালো!’ পাথর কেটে সে কে যেন আমার চোখে অনেকদিন পরে দু-ফোঁটা অশ্রু এনে দিল!
এ কী পরীক্ষায় ফেললে খোদা? আমার এ বিস্ময়মুগ্ধ ভাব কেটে যাওয়ার পরই মনে হল, কী করা উচিত? ভয় হল আজ বুঝি সব সংযম, সব ত্যাগ-সাধনা এই মুগ্ধা তরুণীর চোখের জলে ভেসে যায়! – আবার এই সঙ্গে মনে পড়ল শাহিদার কথা, এমনই একটি কচি অশ্রুস্নাত মুখ!…
সমস্ত কুতল-আমারার মরুভূমি আর পাহাড়ের বুকে দোল খাইয়ে কার জলদমন্দ্র আওয়াজ ছুটে এল, ‘সেনানী – হুঁশিয়ার!’
আবার আমি যেন দেখতে পেলুম, আশিস-বারির মঙ্গলঝারি আর অশ্রুসমুজ্জ্বল বিজয়মাল্য হস্তে বাংলা আমাদের দিকে আশা-উত্তেজিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে! – প্রেমের চরণে কর্তব্যের বলিদান দেব? না, না, কক্ষনো না!
আপনা-আপনি আমার কঠিন মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘খোদা, হৃদয়ে বল দাও! বাহুতে শক্তি দাও! আর কর্তব্য-বুদ্ধি উদ্বুদ্ধ করো প্রাণের শিরায় শিরায়!’…
নিমেষে আমার সমস্ত রক্ত উষ্ণ হয়ে ভীমতেজে নেচে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে বজ্রমুষ্টিতে পিস্তলটা সোজা করে ধরলুম! সমস্ত স্তব্ধ প্রকৃতির বুকে বাজ পড়ার মতো কড় কড় করে হুকুম এল, ‘গুলি করো!’ …
দ্রুম! দ্রুম!! দ্রুম!!! … একটা যন্ত্রণা-কাতর কাতরানি – ‘আম্মা!– মাঃ!! আঃ!’ …
তারপরেই সব শেষ।
* * *
তারপরেই আমি আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়লুম!… ছুটে গিয়ে গুলের এলিয়ে-পড়া দেহলতা আমার চিরতৃষিত অতৃপ্ত বুকে বিপুল বলে চেপে ধরলুম! তারপর তার বেদনাস্ফুরিত ওষ্ঠপুটে আমার পিপাসী ওষ্ঠ নিবিড়ভাবে সংলগ্ন করে আর্তকণ্ঠে ডাকলুম, ‘গুল–গুল–গুল!’ – প্রবল একটা জলো-হাওয়ার নাড়া পেয়ে শিউলি ঝরে পড়ার মতো শুধু একরাশ ঝরা অশ্রু তার আমার মুখে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল!
অবশ অলস তার ভুজলতা দিয়ে বড়ো কষ্টে সে আমার কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরলে, তারপর আরও কাছে – আরও কাছে সংলগ্ন হয়ে নিঃসাড় নিস্পন্দ হয়ে পড়ে রইল!…, মেঘের কোলে লুটিয়ে-পড়া চাঁদের পানসে জ্যোৎস্না তার ব্যথা-কাতর মুখে পড়ে সে কী একটা স্নিগ্ধ করুণমহিমশ্রী ফুটিয়ে তুলেছিল!… সেই অকরুণ স্মৃতিটাই বুঝি আমার ভাবী জীবনের সম্বল, বাকি পথের পাথেয়। …অনেকক্ষণ পরে সে আস্তে চোখ খুলে আমার মুখের পানে চেয়েই চোখ বুজে বললে, ‘এই ‘আশেকের’ হাতে ‘মাশুকের’ মরণ বড়ো বাঞ্ছনীয় আর মধুর, নয় হাসিন?’ আমি শুধু পাথরের মতো বসে রইলুম। আর তার মুখে এক টুকরা মলিন হাসি কেঁপে কেঁপে মিলিয়ে গেল। শেষের সে তৃপ্ত হাসি তার ঠোঁটে আর ফুটল না, শুধু একটা ভূমিকম্পের মতো কীসের ব্যাকুল শিহরণ সঞ্চরণ করে গেল! … তার বুকের লোহুতে আর আমার আঁখের আঁশুতে এক হয়ে বয়ে যাচ্ছিল! সে তখনও আমায় নিবিড় নিষ্পেষণে আঁকড়ে ধরে ছিল আর তার চোখে-মুখে চিরবাঞ্ছিত তৃপ্তির স্নিগ্ধ শান্তশ্রী ফুটে উঠেছিল! – এই কি সে চাচ্ছিল? তবে এই কি তার নারী-জীবনের সার্থকতা? … আর একবার – আর একবার – তার মৃত্যু-শীতল ওষ্ঠপুটে আমার শুষ্ক অধরোষ্ঠ প্রাণপণে নিষ্পেষিত করে হুমড়ি পড়ে ডাক দিলুম, – ‘গুল, গুল, গুল!’ বাতাসে আহত একটা কঠোর বিদ্রুপ আমায় মুখ ভেংচিয়ে গেল, ‘ভুল–ভুল–ভুল!’ …
আবার সমস্ত মেঘ ছিন্ন করে চাঁদের আলোর যেন ‘ফিং’ ফুটছিল। গুলের নিঝুম দেহটা সমেত আমি মূর্ছিত হয়ে পড়ছিলুম, এমন সময় বিপুল ঝঞ্ঝার মতো এসে এক প্রৌঢ়া বেদুইন মহিলা আমার বক্ষ হতে গুলকে ছিনিয়ে নিলে এবং উন্মাদিনীর মতো ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, ‘গুল–আম্মা–গুল!’
* * *
প্রৌঢ়া তার মৃতা কন্যাকে বুকে চেপে ধরে আর একবার আর্তনাদ করে উঠতেই আমি তার কোলে মূর্ছাতুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাকলুম, ‘আম্মা – আম্মা!’ মার মতো গভীর স্নেহে আমার ললাট চুম্বন করে প্রৌঢ়া কেঁদে উঠল, ‘ফর্জন্দ ফর্জন্দ!’ কাবেরীর জলপ্রপাতের চেয়েও উদ্দাম একটা অশ্রুস্রোত আমার মাথায় ঝরে পড়ল। …
আঃ! কত নিদারুণ সে কন্যাহীনা মার কান্না!
* * *
আমি আবার প্রাণপণে গা ঝেড়ে উঠে কাতরে উঠলুম, ‘আম্মা–আম্মা–মা!’ – একটা রুদ্ধ কণ্ঠে চাপা কান্নার প্রতিধ্বনি পাগল হাওয়ায় বয়ে আনলে – ‘ফর্জন্দ’।…
অনেক দূরে … পাহাড়ের ওপর হতে, … সে কোন্ শোকাতুরা মাতার কাঁদনের রেশ, ভেসে আসছিল, ‘আহ – আহ আহ!’ … আরবি ঘোড়ার ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটার পাষাণে আহত শব্দ শোনা গেল–খট্ খট্ খট্!!!
* * *
[ ঙ ]
করাচি
(মেঘম্লান সন্ধ্যা, – সাগর বেলা)
আমি আজ কাঙাল না রাজাধিরাজ? বন্দি না মুক্ত? পূর্ণ না রিক্ত?….
একা এই ম্লান মৌন আরব সাগরের বিজন বেলায় বসে তাই ভাবছি আর ভাবছি। আর আমার মাথার ওপর মুক্ত আকাশ বেয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টি ঝরছে – রিম ঝিম ঝিম!