রিকশা
সবাই জানেন, রিকশা দুই রকম। টানা রিকশা এবং সাইকেল রিকশা। টানা রিকশা কলকাতায় চলে আর সাইকেল রিকশা চলে মফস্বলে, গ্রামে-গঞ্জে, ছোট শহরে।
কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যাই মনে হোক এই দুই জাতের রিকশার প্রভেদ খুব সামান্য নয়। যদিও সামনের সাইকেলটা বাদ দিলে দু’রকম রিকশার মধ্যে তফাত কেউ খুঁজে পাবেন না এবং সত্যি সত্যি তফাত নেইও কিছু। পার্থক্যটা আসলে গাড়ির নয়, গাড়ির চালকদের, বিশেষ করে গাড়ির চালকদের মেজাজ ও আচরণের।
টানা রিকশার চালক হলেন একটু প্রবীণ, গভীর প্রকৃতির, জগৎ সংসারের সঙ্গে ঢিমে তেতালায় সায় দিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। সাধারণত তিনি প্রাসঙ্গিক এবং অপ্রাসঙ্গিক সমস্ত বিষয় সম্পর্কে, অবশ্য রিকশা ভাড়া ব্যতীত, রীতিমতো উদাসীন। রিকশা ভাড়া সম্পর্কেও তিনি উচ্চবাচ্য কম করেন। এবং এটাই তারঁ ব্যবসায়িক উন্নতির মূল সূত্র। তিনি সাধারণত একবার মাত্র কথা বলেন এবং সেটা রিকশা থেকে আরোহিনী নামবার পর। এইবার যেখানে ষাট পয়সা তাঁর প্রাপ্য হওয়া উচিত তার বদলে তিনি দেড় টাকা দাবি করেন, বর্ষার দিনে হলে আড়াই টাকা। যেহেতু ভাড়া আগে ঠিক করে নেয়া হয়নি, সওয়ারি অপ্রস্তুত। অধিকাংশ সময়েই সওয়ারি হয়তো আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়িতে দেখা করতে এসেছেন কিংবা বড় রাস্তার মোড়ে নেমেছেন, রিকশাওয়ালা ক্রমশই তাঁর ভাগলপুরি ভাষণভঙ্গি কঠিন ও অপমানজনক করে তুলেছেন—এ অবস্থায় একটা কিছু দিয়ে সওয়ারি সম্মান রক্ষা করার চেষ্টা করেন। অনেক সময় কোনও কোনও সওয়ারি তাঁর পছন্দমতো ও বিবেচনাসই ভাড়া রিকশার উপর দিয়ে দ্রুত পদে পালিয়ে যান। কিন্তু রিকশাওয়ালা সেই পলায়মান সওয়ারির দিকে তাকিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করতে থাকেন তাতে গায়ে মানুষের চামড়া থাকলে জ্বালা ধরে এবং ফিরে এসে পালটা জবাব দিতে ইচ্ছে হয় এবং রিকশাওয়ালা এটাই চান। কারণ ততক্ষণে তিনি তাঁর চারপাশে বেশ একটা মাঝারি আকারের জনতা সংগ্রহ করে ফেলেছেন এবং সবাইকে জ্ঞাপন করা শুরু করেছেন তাঁর প্রতি এই অবিচারের নির্মম কাহিনী।
সাইকেল রিকশা চালকের প্রকৃতি কিন্তু এ রকম নয়। অধিকাংশ সাইকেল রিকশাওলাই হলেন তরুণ বা যুবা বয়সি। তারা রিকশা চালাতে হিন্দি সিনেমার গান গুনগুন করেন। এমনকী কেউ বেশ উঁচু গলায় গাড়ি চালাতে চালাতে প্রাণের আনন্দে ‘হম তুম এক কামরামে’ কিংবা ‘ঝুম পারা পার…পয়সা মিলেগা’ মেজাজের সঙ্গে গেয়ে যান। আরোহীরা এ নিয়ে সাধারণত কিছু মনে করেন না। আর মনে করলেও চালকদের তাতে কিছু এসে যায় না। এই রিকশাচালকদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা মোটামুটি নিম্নবিত্ত, ভদ্র পরিবারের কেউ কেউ সামান্য বা কিছু বেশি লেখাপড়া শিখেছেন। আমার নিজের শহরে আমার দু’জন সহপাঠী ছিলেন যাঁরা রিকশা চালাতেন। কলকাতায় টানা রিকশাওলাদের মধ্যে কিন্তু এ রকম পাওয়া যাবে না, তারা প্রায় প্রত্যেকেই নিরক্ষর এবং দেহাতি। কলকাতার সঙ্গে তাঁদের চরিত্রের বা নাড়ির যোগ নেই।
কিন্তু মফস্বলে রিকশাওল হলেন একজন প্রভাবশালী নাগরিক, শহরের মূল জীবনের সঙ্গে তাদের প্রাণের যোগ রয়েছে। তার উত্থান-পতন আনন্দ-বিষাদের সঙ্গে তাঁরা জড়িত। তাঁরা শহরের গুণী-জ্ঞানী, চোর-বদমাস সবাইকেই এবং সবাইয়ের বাড়িঘর মোটামুটি চেনেন। কিন্তু কলকাতার রিকশাওলা বড় রাস্তার মোড় এবং বাজার ছাড়া আর কিছুই চেনেন না।
টানা রিকশার সঙ্গে সাইকেল রিকশার আরও একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। টানা রিকশা কখনও কখনও উলটে যায় কিন্তু সাইকেল রিকশা কদাচিৎ উলটোয়, যদিও কখনও-সখনও ড্রেনে বা খানাখন্দে পড়ে যায় না তা নয়।
টানা রিকশা উলটানোর ব্যাপারটি যেমন হাস্যকর তেমনিই দুঃখজনক। আমার পরিচিত অন্তত তিনটি দম্পতি টানা রিকশা উলটে পড়ে গিয়েছেন। এই তিনটি ক্ষেত্রেই অবশ্য স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যথেষ্ট স্থূলকায়-স্থূলকায়া। এই উলটে যাওয়ার দৃশ্যটি অদ্ভুত। আরোহী ও আরোহিনীর শরীরের যুগ্ম ওজনের চাপে হঠাৎ চলমান রিকশাচালক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং চলতে চলতে অতর্কিতে সামনের ডাণ্ডা ধরে শূন্যে উঠে যান এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই মুহুর্তের মধ্যে ডান্ডা ছেড়ে দিয়ে ভূতলে অবতীর্ণ হন। সঙ্গে সঙ্গে রিকশাটি উপরের দিকে একশো আশি ডিগ্রি মানে পুরো দুই সমকোণ ঘুরে সওয়ারিদের উপুড় করে মাটিতে ফেলে দেয়। সাধারণত এতে বিশেষ কোনও আঘাত লাগে না, কিন্তু পর্যদস্ত দম্পতি মাসখানেকের জন্যে একটু কাবু হয়ে পড়েন, তাঁদের নৈতিক সাহস কমে যায়।
সাইকেল রিকশা ঠিক এভাবে কখনও উলটোয় না। তবে তার দ্রুতগতি অনেক সময় তাকে কক্ষচ্যুত করে ফেলে এবং সেটা খুব বিপজ্জনকও বটে। সাইকেল রিকশার দুর্ঘটনা প্রবণতা ভয়ংকর বেশি, সাইকেল রিকশায় আহত হননি এমন লোক দেখা যায় না। আমরা একবার একটা ‘রিকশা দুর্ঘটনা দূরীকরণ সমিতি’ গঠন করেছিলাম, সেই সমিতির প্রথম অধিবেশনে যোগদান করতে গিয়ে আমি রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে বাঁ পায়ে একটা চোট পাই, আজও অমাবস্যা-পূর্ণিমায় পা-টা টনটন করে।