রাস্তায় খুন

রাস্তায় খুন

প্রথম পরিচ্ছেদ 

বর্ষাকাল। আকাশ প্রায় সর্ব্বদাই মেঘাচ্ছন্ন; মধ্যে মধ্যে অল্প ও মধ্যে মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি হইয়া এই কলিকাতা সহরের রাস্তা সকলকে একেবারে কদমময় করিয়া ফেলিয়াছে। আপন ঘর ছাড়িয়া বাহির হইতে সহজে কাহারও ইচ্ছা হয় না। তবে যাহারা পরাধীন, পরঅন্নে প্রতিপালিত, তাহাদিগের এই দুর্যোগে বাহির হইতে হয়। যাহারা পরের আদেশানুবর্ত্তী, নিজের ইচ্ছাধীনে যাহাদিগের চলিবার কিছুমাত্র ক্ষমতা নাই, তাহাদিগকেই এই দুর্যোগে বাহির হইতে হয়। যাহাদিগের বাহির না হইলে কোনরূপে উদরান্নের সংস্থান হয় না, তাহাদিগকেই এই দুর্যোগে বাহির হইতে হয়। আর বাহির হইতে হয় আমাদিগকে — পুলিস বিভাগের কর্মচারিদিগকে। 

রাত্রি নয়টা বাজিয়াছে। অন্ধকারে মেদিনীমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। অবিশ্রান্তভাবে টিপি টিপি বৃষ্টি পড়িতেছে। এমন সময়ে সংবাদ আসিল, কলিকাতা সহরের একটি প্রধান রাজবর্গের উপর এক ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সংসাধিত হইয়াছে, ও সেই সঙ্গে আদেশ পাইলাম, যেন শীঘ্র সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া, উহার অনুসন্ধানে লিপ্ত হই। 

টিপি টিপি বৃষ্টিই হউক বা অশনিপাতের সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারেই বৃষ্টি হউক, এই আদেশ পাইয়া আমাদিগের ক্ষণকালের নিমিত্তও স্থির থাকিবার উপায় নাই, সুতরাং একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া তৎক্ষণাৎ সেই ঘটনাস্থলে চলিলাম। 

গাড়ি শীঘ্রই সেই স্থানে উপস্থিত হইল। আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম ও মনে মনে বিশেষরূপ লজ্জিত হইলাম। কারণ দেখিলাম, আমি আমার যে ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট হইতে এই হত্যার অনুসন্ধানের আদেশ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তিনি ও তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্মচারী আমার পূর্ব্বেই সেই স্থানে উপস্থিত। 

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইবামাত্র যে ভয়ানক দৃশ্য আমার নয়নপথে পতিত হইয়াছিল, সেই ভয়ানক দৃশ্য, সেই লোমহর্ষকর, সেই হৃদয়ভেদকারী দৃশ্য সহজে প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। এই কলিকাতা সহরের সুপ্রশস্ত রাজবত্মের ফুটের উপর রক্তাক্ত বসনে ভূষিতা, অষ্টাদশবর্ষবয়স্কা সুরূপা গৌরবর্ণা রমণীর মৃতদেহ, পাঠক পাঠিকাগণের মধ্যে কয়জন দেখিয়াছেন, বলুন দেখি? 

টিপি টিপি বৃষ্টির মধ্য দিয়া অসংখ্য লোক সেই ফুটের উপর দিয়া যাতায়াত করায় উহা অতিশয় কৰ্দ্দমময় হইয়া পড়িয়াছে। সেই কদমের উপর উত্তমরূপ বেশভূষায় ভূষিতা সেই অষ্টাদশবর্ষীয়া যুবতী চিরশয্যায় শায়িতা। এদেশীয় বাঙ্গালী ভদ্রলোকগণ যেরূপ ভাবে পরিচ্ছদ ধারণ করিয়া থাকেন, তিনি সেইরূপ পরিচ্ছদে সমাবৃত ছিলেন না। ভদ্রঘরের ব্রাহ্মযুবতীগণ কোন ক্রিয়াকলাপে নিমন্ত্রণ বা উপাসনা উপলক্ষে যেরূপ ভাবে পরিচ্ছদাদি ধারণ করিয়া থাকেন, ইনিও সেইরূপ পরিচ্ছদে শোভিতা ছিলেন। তাঁহার সেই পরিচ্ছদ ভেদ করিয়া বক্ষস্থলে এক ভয়ানক ক্ষতচিহ্ন, ওই ক্ষতস্থান দেখিয়া অনুমান হয়, কোন এক তীক্ষ্ণ অস্ত্র তাঁহার হৃদয় ভেদ করিয়াছে এবং তথা হইতে এরূপ ভাবে রুধিরধারা বহির্গত হইয়াছে যে, তাঁহার সমস্ত পরিধেয় বস্ত্র রক্তাক্ত হওয়া দূরে থাকুক, সে ফুটের উপরিস্থিত কর্দ্দম পর্যস্ত রক্তবর্ণ ধারণ করিয়াছে ও রক্তধারা প্রবাহিত হইয়া ফুটের নিম্ন পর্য্যন্ত আসিয়া প্রস্তরের উপরিস্থ জলস্রোতের সহিত মিশিয়াছে। 

অন্ধকারের মধ্যে টিপি টিপি বৃষ্টি হইলেও ওই রাস্তা দিয়া লোক চলাচলের কিছুমাত্র বিরাম ছিল না। যে স্থানে ওই যুবতীর মৃতদেহ পতিত ছিল, তাহার সন্নিকটেই একটি প্রজ্বলিত গ্যাসালোক। যে সমস্ত লোক ওই রাস্তা দিয়া গমনাগমন করিতেছিল, ওই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র তাহাদের প্রত্যেকেরই গতি রোধ হইয়া যাইতেছিল। ওই হৃদয়বিদারক দৃশ্য তাহাদিগের সকলকেই সেই স্থানে আকৃষ্ট করিতেছিল, সুতরাং ওই রাস্তায় ক্রমে লোকের জনতা এত হইয়া পড়িয়াছিল যে, সহজে ওই রাস্তা দিয়া কাহারও যাতায়াতের উপায় ছিল না। গাড়ি-ঘোড়া চলা দূরে থাকুক, মনুষ্যের গমনাগমন পৰ্য্যন্তও অসাধ্য হইয়া উঠিয়াছিল। 

ওই মৃতদেহ ওইরূপ ভাবে ওই স্থানে রাখা আর যুক্তিসঙ্গত নহে বিবেচনা করিয়া, তৎক্ষণাৎ উহা মৃতদেহ পরীক্ষাগারে প্রেরণ করা হইল। 

মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইবার প্রায় একঘণ্টা পর পর্যন্ত ওই রাস্তায় পূর্ব্বের ন্যায় ভিড় রহিল। পরিশেষে সকলে নৈরাশ্যমনে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমরা যে সকল কর্ম্মচারী এই ভয়ানক হত্যা রহস্যের উৎঘাটনে নিযুক্ত ছিলাম, সকলে সেই স্থান হইতে যেস্থানে ওই যুবতী বাস করিতেন, সেই স্থানে গমন করিলাম। যে গৃহে তিনি বাস করিতেন, সেই গৃহ সেই স্থান হইতে দূরবর্তী নহে, বোধ হয় ৫০ হস্তের অধিক হইবে না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, ঠিক তাহার সম্মুখে একটি গলি আছে, ওহ গলি নিতান্ত অপরিসর, উহার ভিতর গাড়ি প্রবেশ করিতে পারে না। ওই গলির অধিবাসীবর্গকে কোন স্থানে গমন করিতে হইলে, ওই গলির মোড় পর্যন্ত অর্থাৎ যেস্থানে ওই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থান পর্যন্ত হাঁটিয়া আসিয়া তবে গাড়ি বা ট্রামওয়ে আরোহণ করিতে হয়। 

এই হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান উপলক্ষে আমরা যে বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম, সেই বাড়ীর অধিকারী একজন শিক্ষিত ও গণ্যমান্য ব্রাহ্মযুবক। তাঁহার নাম আমি এই স্থানে প্রকাশ করিব না। ইহার বাড়ীতেই ওই যুবতী এখন বাস করিতেন। তিনি ব্যতীত ওই ব্রাহ্মযুবকের বাড়ীতে আরও কয়েকটি অনাথা ব্রাহ্ম বালিকার আবাস স্থান ছিল। কোন অনাথা বিধবা বালিকাকে তাঁহার বাড়ীতে আনীত হইলে তিনি বিশেষ যত্নে তাহাদিগকে ভরণপোষণ ও বিদ্যাশিক্ষা করাইতেন, ও ক্রমে তাহাদিগকে ব্রাহ্মধৰ্ম্মে দীক্ষিতা করিয়া কোন ব্রাহ্ম যুবকের সহিত তাহাদের পরিণয়কার্য সমাপন করিয়া দিতেন। ইহা তাঁহার একটি কর্তব্যকর্ম্মের মধ্যে পরিগণিত ছিল। 

ওই ব্রাহ্মযুবক নিতান্ত ভদ্রলোক, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার সময় তিনি আমাদিগকে যে কতদূর সাহায্য করিয়াছিলেন, তাহা পাঠকগণ ক্রমে অবগত হইতে পারিবেন। তাঁহার নিকট হইতে যদি সমস্ত সংবাদ অবগত হইতে না পারিতাম, তাহা হইলে এই ভয়ানক হত্যাকারীর দণ্ড কোনরূপেই হইত না। 

সেই ব্রাহ্মযুবকের বাড়ীতে গমন করিয়া, সেই স্থানে আরও ৪/৫টি যুবতী ও বালিকাকে দেখিতে পাইলাম। উহাদিগের মধ্যে প্রায় সকলেই হিন্দু-বিধবা, কোন না কোন গতিকে তাঁহারা সেই স্থানে আনীত হন। তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ বা ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিতা হইয়াছেন, কেহ বা এখনও পর্য্যন্ত নূতন ধর্ম্ম গ্রহণ করেন নাই, কিন্তু সকলেই সেই ব্রাহ্মযুবকের দ্বারা প্রতিপালিত হইতেছেন। তাঁহাদিগের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, যে স্ত্রীলোকটি হত হইয়াছেন, তাঁহার নাম বিরাজমোহিনী। বিরাজমোহিনী ওই বাড়ীতে মাসাবধিকাল বাস করিতেছিলেন। সেই দিবস কোন নিমন্ত্রণ উপলক্ষে তাঁহাদিগের সকলের সন্ধ্যার পর ওই স্থান হইতে অন্য স্থানে গমন করিবার কথা ছিল। তাঁহারা সকলে সেই নিমন্ত্রণরক্ষার্থে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গাড়িতে আরোহণ করিবার মানসে যেমন ওই গলির মোড়ে আসিলেন, অমনি বিরাজমোহিনী হত হন। 

তাঁহাদিগের নিকট হইতে এই কয়েকটি কথা অবগত হইয়া তাঁহাদিগের মধ্যে যিনি বয়ঃজ্যেষ্ঠা ছিলেন, তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া অমি কহিলাম, এরূপ সংক্ষেপ উত্তরে আমাদিগের কার্য্যসিদ্ধি হইবার কোনরূপ উপায় হইবে না। যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল আপনারা তাহার আনুপূর্বিক বিবরণ আমার নিকট বর্ণন করুন, তাহা হইলে জানিতে পারিব যে, উহা হইতে আমি এই অনুসন্ধানের কোনরূপ সূত্র বাহির করিতে সমর্থ হইব কি না। 

আমার কথা শুনিয়া তিনি যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার সারমর্ম্ম নিম্নে প্রদত্ত হইল। 

“আমরা এই কয়েকটি স্ত্রীলোক এই বাড়ীতে অনেক দিবস হইতে বাস করিতেছি, ও আমরা পরস্পর পরস্পরকে আপনাপন ভগ্নীর ন্যায় দেখিয়া থাকি; আমাদিগের কয়েকজনের মধ্যে কিছুমাত্র ভেদাভেদ নাই। আমরা একস্থানে শয়ন, একত্রে উপবেশন, একত্রে পানভোজন করিয়া দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছিলাম। আমাদিগের মধ্যে কেহ কোন কার্য্য করিতে ইচ্ছা করিলে অন্যান্য সকলের পরামর্শ না লইয়া কখনই সে কার্য্য করেন না। কাহার মনের ভিতর কোন কথা উদিত হইলে, কেহ কোন বিষয় জানিতে পারিলে, তাহা আমাদিগের সকলের মধ্যে প্রকাশিত হইয়া থাকে। বলিতে কি, আমরা এই কয়েকটিতে মিলিত হইয়া—একই মন ও একই প্রাণ হইয়া কাল যাপন করিতেছিলাম। প্রায় একমাস হইল, বিরাজমোহিনীকে এখানে আনা হয়, তাহাকে যদিও আমাদিগের মধ্যে স্থাপিত করা হইয়াছিল, কিন্তু সে আমাদিগের সহিত বিশেষভাবে মিশিত না, সে তাহার মনের কথা আমাদিগের নিকট প্রকাশ করিত না। আমরা তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে তাহার যথাযথ উত্তরও দিত না, সে যেন সৰ্ব্বদাই চিন্তাযুক্ত থাকিত। তাহাকে দেখিলে বোধ হইত যেন, কোন প্রবল চিন্তা তাহার মনের মধ্যে সতত প্রবাহিত হইতেছে; অথচ কোন কথা খুলিয়া বলিত না। আমাদিগের সহিত একত্রে খাইতে হয় বলিয়া খাইত, বসিতে হয় বলিয়া বসিত, কিন্তু সে সৰ্ব্বদা নিৰ্জ্জনই ভাল বাসিত। একান্তে থাকিতে পাইলে সহজে আমাদিগের নিকট আসিত না। কেন যে সে ওইরূপ ভাবে থাকিত, কেন যে সে সৰ্ব্বদাই চিন্তায় দিন অতিবহিত করিত, তাহা আমরা তাহাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করিয়াছি, কিন্তু তাহার সন্তোষজনক উত্তর কখনও পাই নাই। তাহার মনের ভাব জানিবার নিমিত্ত অনেকবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। এরূপ অবস্থায় সে প্রায় একমাস কাল আমাদিগের সহিত বাস করিয়াছিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

তিনি বলিতে লাগিলেন, “আমরা যাঁহার বাড়ীতে বাস করিতেছি, যিনি আমাদিগকে প্রতিপালন করিতেছেন, তাঁহার এক বন্ধুর বাড়ীতে আমাদিগের নিমন্ত্রণ হয়। আজ সন্ধ্যার পর আমাদিগের সেই নিমন্ত্রণে যাইবার কথা ছিল। বিরাজমোহিনীকেও সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত তিনি বিশেষরূপ অনুরোধ করিয়াছিলেন। বিরাজমোহিনী কিন্তু আমাদিগের সহিত ওই নিমন্ত্রণে যাইতে অসম্মত হয়, কেন যে অসম্মত হয়, তাহা জানি না, কিন্তু পরিশেষে আমাদিগের সকলের অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া তাহার সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদিগের সহিত গমন করিতে সম্মত হয়। নিমন্ত্রণে যাইবার নিমিত্ত আমরা সকলে বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া সময়মত প্রস্তুত হইলাম। বিরাজমোহিনী তাহার বস্ত্রাদি পরিধান করিল। এমন সময় সংবাদ আসিল, গাড়ি আসিয়াছে। যাঁহার বাড়ীতে আমাদিগের নিমন্ত্রণ হইয়াছিল, তিনি আমাদিগকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া যাইবার নিমিত্ত তাঁহার নিজের গাড়ি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। গাড়ি গলির মোড়ে অপেক্ষা করিতে লাগিল। 

“গাড়িতে আরোহণ করিবার মানসে আমরা সকলে একত্রে বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম, সেই সময় আমাদিগের সহিত পুরুষ-মানুষ কেহই ছিল না, আমরা এই কয়েকটি স্ত্রীলোক একত্রে অগ্র পশ্চাৎ হইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম, ও ওই গলির মধ্য দিয়া বড় রাস্তার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম; বিরাজমোহনীও আমাদিগের মধ্যে গমন করিতে লাগিল। গলির মোড়ে উপস্থিত হইয়াই দেখিলাম, সম্মুখে গাড়িখানি আমাদিগের নিমিত্ত অপেক্ষা করিতেছে। আরও দেখিলাম, সেই স্থানে দেওয়ালের সন্নিকটে একটি লোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। উহাকে দেখিয়া ভাবিলাম, ওই ব্যক্তি ফুটের উপর দিয়া গমন করিতেছিল, আমাদিগকে আসিতে দেখিয়া পাছে আমাদিগের রাস্তা অবরোধ হয়, এই নিমিত্ত ভদ্রতা করিয়া একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়াছে। সহিস গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল, আমাদিগের মধ্যে কেহ গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল, কেহ গাড়ির সন্নিকটে আসিল; বিরাজমোহিনী ঠিক ফুটের মধ্যস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইল; কেহ বা তাহার পশ্চাতে রহিল। সেই সময় যে ব্যক্তি প্রাচীরের সন্নিকটে দাঁড়াইয়া ছিল, সে দ্রুতগতি বিরাজমোহিনীর সন্নিকটে আসিয়াই, তাহার বক্ষস্থলে একখানি সুদীর্ঘ শানিত অস্ত্র সবলে প্রবেশ করাইয়া দিল। বিরাজমোহিনী “মা গো” বলিয়া সেই স্থানে পতিত হইল, ও সেই ব্যক্তি ওই ছুরিকাখানি তাহার বক্ষ হইতে উন্মোচিত করিয়া লইয়া দ্রুতবেগে সেই স্থান হইতে পলায়ন করিল। এই দৃশ্য দেখিয়া আমরা এত ভীত হইয়াছিলাম যে, সেই সময় আমাদিগের কি কৰ্ত্তব্য তাহা আমরা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। অনন্তর আমরা সেই স্থান হইতে দ্রুতগতি প্রস্থান করিয়া, যে গলি দিয়া আমরা বাহিরে আসিয়াছিলাম, সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিলাম। আমাদিগের মনে এইরূপ আশঙ্কা হইয়াছিল যে, ওই ব্যক্তি যে কেবল বিরাজমোহিনীকেই হত্যা করিয়া নিশ্চিন্ত হইবে, তাহা নহে, আমাদিগেরও বিরাজমোহিনীর . অনুগমন করাইবে; তাই আমরা দ্রুতগতি সেই স্থান হইতে পলায়ন করিয়াছিলাম, ও চীৎকার করিয়াছিলাম। আমাদিগের চীৎকার শুনিয়া নিকটস্থ বাড়ীর প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানে উপস্থিত হইল। আমরা যাহার বাড়ীতে বাস করি, তিনিও আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। আমরা আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। তাহার পর কি ঘটিয়াছিল তাহা আমরা দেখি নাই, তবে শুনিয়াছিলাম, যখন সকলে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হন, তখন বিরাজমোহিনীর জীবনবায়ু শেষ হইয়া গিয়াছে।” 

তাঁহার নিকট হইতে এই সকল অবস্থা অবগত হইয়া আমি তাঁহাকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন করিয়াছিলাম। তিনি যেরূপ উত্তর দিয়াছিলেন, তাহা নিম্নে প্রদত্ত হইল। 

প্র। যে ব্যক্তি ফুটের উপর প্রাচীরের সন্নিকটে দাঁড়াইয়াছিল, সেই ব্যক্তিই কি বিরাজমোহিনীকে হত্যা করিয়াছে?

উ। হাঁ। 

প্র। ইহাতে আপনার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই? 

উ। কিছুমাত্র না। 

প্র। সে কোনদিকে পলাইয়া গেল? 

উ। যে ফুটের উপর এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, সেই ফুটের উপর দিয়াই দক্ষিণদিকে দৌড়িয়া গেল। 

প্র। আপনি কতদূর পর্য্যন্ত যাইতে দেখিয়াছেন? 

উ। প্রায় ২০/২৫ হাত হইবে। 

প্র। তাহার পর সে কোনদিকে গেল, তাহা বলিতে পারেন না? 

উ। না। 

প্র। তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারিবেন? 

উ। ঠিক বলিতে পারি না, বোধ হয় চিনিলেও চিনিতে পারিব। 

প্র। তাহাকে ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দেখিয়াছেন? 

উ। দেখিয়াছি বলিয়া অনুমান হয়। 

প্র। কোথায় দেখিয়াছেন? 

উ। বোধ হয় আমাদিগের বাড়ীর পশ্চাৎভাগে তাহাকে যেন একদিবস দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছি। 

প্র। সে কত দিবসের কথা? 

উ। বোধ হয় এক সপ্তাহ হইবে। 

প্র। সেই সময় আপনাদের মনে কোনরূপ সন্দেহ হইয়াছিল কি? 

উ। না। 

প্র। উহার বয়স কত? 

উ। অনুমান ২৫ বৎসর। 

প্র। দেখিতে কেমন? 

উ। বর্ণ শ্যাম, নাতি দীর্ঘ, নাতি খৰ্ব্ব, দাড়ি নাই। 

প্র। আর কিছু? 

উ। আর বিশেষ কিছু মনে পড়িতেছে না। 

প্র। উহার পরিধানে কিরূপ বস্ত্রাদি ছিল? 

উ। গায় বোধ হইতেছে একটি কোট ছিল, কিন্তু ঠিক মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

অপরাপর স্ত্রীলোকগণ যাঁহারা বিরাজমোহিনীর সহিত নিমন্ত্রণ উপলক্ষে গমন করিতেছিলেন ও যাঁহাদিগের সম্মুখে বিরাজমোহিনী হত হন, তাঁহাদিগকেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু তাঁহাদিগের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠা স্ত্রীলোকটি যাহা বলিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা আর অধিক কোন কথা জানিতে পারিলাম না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

সেই স্ত্রীলোকদিগের সহিত আমার কথা শেষ হইয়া গেলে, তাঁহারা আমাদিগের অনুমতি লইয়া অন্দরে প্রবেশ করিলেন। যে যুবকের বাড়ীতে বিরাজমোহিনী বাস করিতেন, তখন আমি সেই যুবকের সহিত কথাবার্তায় নিযুক্ত হইলাম। তাঁহার সহিত দুই চারিটি কথা কহিবার সময়ই স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের অনেক সাহায্য তাঁহার দ্বারা পাইতে পারিব। তখন আমি তাঁহাকে একটি নির্জ্জন ঘরে লইয়া গেলাম ও সেই স্থানে উভয়ে উপবেশন করিলে পর আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “বিরাজমোহিনী আপনার বাড়ীতে কতদিন হইতে বাস করিতেছেন?” 

যুবক। প্রায় একমাস হইবে। আমি। বিরাজমোহিনী কে? 

যু। তাহা আমি জানি না। 

আ। তবে তিনি কিরূপে আপনার বাড়ীতে আসিলেন? 

যু। পূর্ব্ববঙ্গের কোন একটি প্রধান স্থানে আমাদিগের একটি সমাজ আছে। আমার একজন বিশেষ বন্ধু ওই স্থানে থাকেন, তিনিই ওই সমাজের প্রধান কর্তা। তাঁহার নিকট হইতে পত্র পাইয়া অবগত হই যে, হিন্দুঘরের একটি বিধবা বালিকা তাহার পিতামাতার তাড়নায় অস্থির হইয়া ওই সমাজের শরণাগত হয়, ও তাহাকে তাহার পিতামাতার হস্ত হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত ওই সমাজপতিকে পত্র লেখে। তিনি কয়েকটি ব্রাহ্মযুবককে প্রেরণ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনেন, ও আপন সমাজে তাহাকে স্থান প্রদান করেন। সেই স্থানে কিছুদিবস রাখিয়া, পরিশেষে তাহাকে এই স্থানে পাঠাইয়া দিতে মনস্থ করিয়া তিনি আমাকে পত্র লিখেন; পত্র পাইয়া আমি সেই স্থানে গমন করি ও তাহাকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আনিয়া আপন বাড়ীতেই তাহার থাকিবার স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিই। সেই পর্য্যন্তই সে আমার বাড়ীতে আমা কর্তৃকই প্রতিপালিত হইতেছিল। 

আ। সে যে কাহার কন্যা ও কোথা হইতে তাহাকে প্রথমতঃ আনা হয়, তাহার কিছুই আপনি অবগত নহেন?

যু। না, তাহার কিছুই আমি জানি না, জানিবার বিশেষ চেষ্টাও করি নাই। 

আ। তিনি কি ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিতা হইয়াছিলেন? 

যু। সে আমাদিগের আচার-ব্যবহার সমস্তই শিক্ষা করিয়াছিল, আমাদিগের ন্যায় পানভোজন করিতে শিখিয়াছিল, কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম্মে এখনও দীক্ষিত হয় নাই। সে আমাদিগের ধর্ম্মের মর্ম্মাবগত হইতে পারিয়াছিল, বোধ হয়, আর এক মাসের মধ্যেই সে তাহার নব ধর্ম্ম গ্রহণ করিত। 

আ। তিনি সদাসর্ব্বদা মনের আনন্দে দিন অতিবাহিত করিতেন কি? 

যু। না, সে কাহারও সহিত বড় মিশিত না, কোন স্থানে বসিয়া মন খুলিয়া কাহারও সহিত গল্পগুজব করিত না, কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর দিত মাত্র। তাহাকে দেখিয়া অনুমান হইত, যেন তাহার হৃদয় সদাই কোন এক ভীষণ চিন্তায় পূর্ণ, তাহার মনে সুখ ছিল না, মুখে হাসি ছিল না। তাহার মনের কথা জানিবার জন্য আমার স্ত্রী বিশেষরূপে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। কিন্তু ইদানীং তাহার মনের যে কি প্রবল কষ্ট তাহা আমরা কিয়ৎ পরিমাণে অনুমান করিতে পারিয়াছিলাম। 

আ। কি অনুমান করিয়াছিলেন? 

যু। আমার বাড়ীর ছাদে উঠিবার দরজা সদাসর্ব্বদাই খোলা থাকিত, বাড়ীর যাহার যখন ইচ্ছা হইত, তখন তিনি সেই স্থানে গমনাগমন করিতে পারিতেন, ইহাতে কারও কোনরূপ নিষেধ বা আপত্তি ছিল না। যে সকল বালিকা আমার বাড়ীতে বাস করিতেছেন, তাঁহারা সকলেই সন্ধ্যার প্রাক্কালে বায়ু সেবন করিতে প্রায়ই ওই ছাদে আরোহণ করিতেন। বলা বাহুল্য, আমার স্ত্রীও প্রায়ই সেই সঙ্গে থাকিতেন। একদিন সন্ধ্যার পর আমার স্ত্রী আমার হস্তে একখানি পত্র প্রদান করিয়া কহিলেন, তিনি কোন কার্য্য উপলক্ষে একাকী ছাদের উপর উঠিয়াছিলেন, সেই স্থানে দেখিতে পান, একটুকরা প্রস্তরের সহিত বাঁধা একখানি পত্র পড়িয়া রহিয়াছে। তিনি পত্রখানি উঠাইয়া লইয়া পাঠ করেন, ও অপর কাহাকেও কিছু না বলিয়া উহা আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করেন। আমি সেই পত্রখানি পাঠ করিয়া বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হই, ও স্পষ্টই বুঝিতে পারি, কেন বিরাজমোহিনী সদাসর্বদা বিষাদের সহিত দিনযাপন করিতেছিলেন। 

আ। সে পত্রখানি কোথায়? 

যু। বিশেষ যত্নের সহিত উহা আমি আমার বাক্সের মধ্যে চাবিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। 

আ। দেখুন দেখি, আপনার বাক্সে সেই পত্রখানি আছে কি না? 

যু। 

পত্রখানি অনুসন্ধান করিবার পূর্ব্বে আপনাকে আরও দুই-একটি কথা বলিতে ইচ্ছা করি, ইহা হইতেও বোধ হয়, আপনার এই অনুসন্ধানের অনেক সাহায্য হইতে পারিবে। 

আ। বলুন। 

যু। ওই পত্র পাইবার পর হইতে সকলকে ছাদে উঠিতে নিষেধ করিয়া দিই ও ছাদে উঠিবার সিঁড়ির দরজা একটি তালা দ্বারা আবদ্ধ করিয়া রাখি। ওই তালার চাবি আমার নিজের কাছেই থাকিত। যখন আমার স্ত্রীর ছাদে উঠিবার আবশ্যক হইত, তখনই কেবল তাঁহাকে ওই চাবি প্রদান করিতাম। বালিকাগণের মধ্যে কাহারও ছাদে উঠিবার প্রয়োজন হইলে আমার স্ত্রী তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া যাইতেন, এবং ছাদ হইতে অবতরণ করিয়া পুনরায় ওই দরজায় তালাবদ্ধ করিয়া দিতেন, ও চাবি আমার নিকট রাখিয়া যাইতেন। আজ কয়েকদিন হইল আমার স্ত্রী যখন একাকী ছাদে উঠিয়াছিলেন, তখন তিনি আর একখানি পত্র তথায় দেখিতে পান, এবং তৎক্ষণাৎ উহা আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করেন। আমি ওই পত্রখানি পাঠ করিয়া ভাবিয়াছিলাম যে, ভয়ানক বিপদ সমীপবর্তী। 

আ। সে চিঠিখানি কোথায়? 

যু। তাহাও আমার নিকট আছে। এই বলিয়া তিনি পত্র দুইখানি তাঁহার বাক্স হইতে বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। পত্র দুইখানিই বিরাজমোহিনীর উদ্দেশে বাঙ্গলায় লিখিত। আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত ওই পত্র দুইখানি পাঠ করিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

আমি প্রথম পত্রখানি অগ্রে পাঠ করিলাম, উহার লেখা এইরূপ – 

বিরাজ! 

তুমি আজকাল আমার উপর এরূপ নিদয় হইলে কেন? আমি তোমাকে যেরূপ অন্তরের সহিত ভালবাসি, তাহা তুমি উত্তমরূপে অবগত আছ; তোমার জন্য এই কয়েক বৎসর পর্য্যন্ত আমি না করিয়াছি কি, তাহাও তুমি উত্তমরূপে জান। এই সকল জানিয়া শুনিয়াও তুমি যে কেন আমার উপর এইরূপ নির্দয় হইলে, তাহা আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। তুমি একবার ভাবিয়া দেখ, তোমার প্রণয়ে পড়িয়া আমার কি সর্বনাশ হইয়াছে? তোমার নিমিত্তই আমার পূজনীয় পিতামাতাকে পরিত্যাগ করিয়াছি, প্রিয়তমা পত্নীকে ইহ-জীবনের নিমিত্ত হৃদয় হইতে বিতাড়িত করিয়াছি। তোমার নিমিত্ত আমি যে সকল মহাপাপ করিয়াছি, এখন বোধ হইতেছে, তাহার প্রায়শ্চিত্তের সময় সন্নিকটবৰ্ত্তী; নতুবা তুমি আমাকে বঞ্চনা করিয়া, তোমার বৃদ্ধ পিতামাতাকে দারুণ শোক সাগরে ভাসাইয়া, গভীর রাত্রে বাড়ী পরিত্যাগ করিবে কেন? জানি না, তুমি কাহার পরামর্শে এইরূপ কার্য্য করিয়াছ? জানি না, তুমি কি অপরাধে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যের শরণাগত হইয়াছ? জানি না, কে তোমাকে এইরূপ কার্য্য করিতে পরামর্শ দিয়াছে? জানি না, তুমি স্ব-ইচ্ছায় এই কার্য্য করিয়াছ কি না? জানি না, আমার উপর তোমার যে ভালবাসা ছিল, সেই ভালবাসা অপরের উপর অর্পিত হইয়াছে কি না? বুঝিতে পারিতেছি না, তুমি স্ব-ইচ্ছায় এই স্থানে রহিয়াছ, কি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপর কেহ তোমাকে এই স্থানে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে? ইহা যদি আমি জানিতে পারিতাম, তাহা হইলে তোমাকে এই পত্ৰ * লিখিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন হইত না। যাহা আমি ভাল বুঝিতাম, যাহা আমার বুদ্ধিতে আসিত, তৎক্ষণাৎ আমি তাহাই করিতাম। 

তুমি নিরুদ্দেশ হইবার পর জানিতে পারিয়াছিলাম, কয়েকটি যুবক তোমাকে একখানি নৌকা করিয়া লইয়া গিয়াছে। তাহারা যে কে, তাহা আমি এখনও পর্যন্ত জানিতে পারি নাই। তাই তাহারা বাঁচিয়া গেল, নতুবা তাহাদিগের অদৃষ্টে যে কি হইত, তাহা বলিতে পারি না। 

তোমার নিরুদ্দেশ হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও, যে ব্রাহ্ম সমাজে তুমি রক্ষিতা হইয়াছিলে, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হই, ও তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত বিশেষরূপে চেষ্টা করি, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারি নাই। পরে তুমি সেই স্থান হইতে এই স্থানে আনীত হও। আমিও সন্ধানে সন্ধানে এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হই, ও অনেক কষ্টের পর তুমি যে বাড়ীতে আছ, তাহার সন্ধান পাই, ও যাহাতে তোমাকে দেখিতে পাই, সেই মানসে তোমার বাসস্থানের অতি সন্নিকটে একটি ‘মেসে’ বাস করিতেছি। ওই মেসের ছাদের উপর হইতে তোমাকে, তোমাদিগের বাড়ীর ছাদের উপর আজ কয়েকদিবস হইতে দেখিতে পাইতেছি। জানি না, তুমি আমাকে দেখিতে পাইয়াছ কি না। আমাকে দেখিতে পাইয়া থাক বা না থাক, আমার এই পত্র পাইবামাত্র যেরূপ উপায়ে হউক, তুমি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া আসিবে। দিনমানে আসিতে পারিবে না জানি, কিন্তু সন্ধ্যার পর হইতে সমস্ত রাত্রির মধ্যে যখনই সুযোগ পাইবে, তখনই চলিয়া আসিবে। তোমাদিগের বাড়ীর গলি হইতে বাহির হইলেই, বড় রাস্তার উপর ওই গলির মোড়ের সন্নিকটে কোন না কোন স্থানে আমি তোমার অপেক্ষায় বসিয়া আছি দেখিতে পাইবে। যদি মঙ্গল চাও, আমার উপদেশমত কার্য্য করিবে। নতুবা জানিও, তোমার পৃষ্ঠপোষকগণকে ও তোমার আশ্রয়দাতাদিগকে ভয়ানক বিপদগ্রস্ত হইতে হইবে। আজ আমি তোমাকে আর অধিক কথা বলিতে চাহি না, আমার উপদেশ মত কাৰ্য্য না করিলে, আমি বুঝিতে পারিব যে, তুমি যে বিরাজ ছিলে, এখন আর সে বিরাজ নহ; – আমার উপর তোমার যেরূপ ভালবাসা ছিল, এখন আর তাহা নাই। তুমি কি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই স্থানে বাস করিতেছ, না অপর কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমাকে পরিত্যাগ করিয়া এই স্থানে আসিয়া বাস করিতেছ? আমি জীবিত থাকিতে তুমি তোমার অপর কোন উদ্দেশ্য সফল করিতে পারিবে না। কুপথে পদার্পণ করিয়া আপনি মজিয়াছ ও আমাকে মজাইয়াছ, কিন্তু জানিও, আমি জীবিত থাকিতে তুমি আর কাহারও প্রণয়পাত্রী হইতে পারিবে না। 

হরিশ। 

প্রথম পত্রখানি পাঠ করিবার পর দ্বিতীয় পত্রখানি পাঠ করিলাম। ইহা নিতান্ত সংক্ষেপ পত্র, উহাতে লেখা ছিল: – বিরাজ, আমি উপর্যুপরি প্রায় ১০খানি পত্র লিখিয়া তোমাদিগের ছাদের উপর ফেলিয়াছি, তাহার একখানি না একখানি তোমার হস্তগত হইয়াছে। কারণ, আমার পত্র তোমার হস্তগত না হইলে, তুমি কখনও তোমাদিগের ছাদে উঠা বন্ধ করিতে না। তোমাকে আমি এখন বেশ চিনিয়াছি, আমাকেও তুমি ভালরকম চিনিবে। তোমার সহিত আমার যে সম্বন্ধ ছিল, জানিও, এখন সেই সম্বন্ধ লোপ হইয়াছে। এখন হইতে তুমি আমাকে তোমার বিষম শত্রু বলিয়া জানিও। কেবল জানা নহে, এখন তুমি তোমার মৃত্যুর জন্য সর্ব্বদা প্রস্তুত থাকিও। জানিও, আমার হস্তেই তোমার অস্তিত্ব জগৎ হইতে বিলুপ্ত হইবে। কিন্তু তোমার মহাপাপের কথা, তোমার কলঙ্কের কথা যাহারা জানিত না, বা যাহারা কখনও শুনে নাই, তাহারা এখন জানিবে, ও লোকমুখে সর্ব্বত্র প্রচারিত হইবে। জানিও, এই আমার শেষপত্র। হরিশ। 

পত্র দুইখানি পাঠ করিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান সম্বন্ধে আর আমাদিগকে বিশেষ ভাবিতে হইল না। বেশ বুঝিতে পারিলাম, কাহার দ্বারা বিরাজমোহিনী হত হইয়াছে; সে কেও এখন কোথায় থাকে? 

এখন আমাদিগের প্রধান কার্য্য হইল, এই পত্র লেখককে বাহির করা। তাহাকে ধরিতে পারিলেই এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান একরূপ শেষ হইয়া যাইবে! মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া ওই পত্র-লেখকের অনুসন্ধানে সত্বর তথা হইতে বহির্গত হইলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

ওই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া নিকটবর্ত্তী কোন্ বাড়ীতে মেস্ আছে, তাহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। অতি সামান্য মাত্র অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, ওই বাড়ীর প্রায় শতগজ ব্যবধানে একটি দোতালা পাকা বাড়ীতে একটি মেস্ আছে। ওই মেসে কয়েকটি স্কুলের বালক ও কয়েকজন অফিসের কর্ম্মচারী বাস করেন। 

ওই মেসে গিয়া দুই-একজনকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, প্রায় ১০/১৫ দিবস হইল, হরিশ নামক এক ব্যক্তি ওই মেসে আসিয়া বাসা লইয়াছেন। তিনি সকলের নিকট প্রকাশ করিয়াছেন যে, তিনি রেলওয়ে অফিসে কার্য্য করেন, কিন্তু কোন রেলওয়ে অফিস তাহা কাহাকেও বিশেষ করিয়া বলেন নাই, এবং কেহ তাহা অবগত নহেন। তাঁহার পূর্ব্বপরিচিত কোন লোক ওই বাসায় থাকেন না, এবং তাঁহার বাসস্থান প্রভৃতির বিষয় কেহই কিছু অবগত নহেন। 

আরও জানিতে পারিলাম, প্রায় ২ ঘণ্টা পূর্ব্বে হরিশের অবস্থা দেখিয়া সকলে অনুমান করেন, তিনি কোন বিষাক্ত দ্রব্য পান করিয়াছেন। সেই অবস্থা দেখিয়া বাসার সকলেই অতিশয় শঙ্কিত হন, তাঁহাকে বারংবার জিজ্ঞাসা করিয়া কেবল এইমাত্র অবগত হন যে, কোন বিশেষ কারণ বশতঃ তাঁহার মন নিতান্ত খারাপ হইয়া গিয়াছিল, সেই জন্য তিনি আত্মহত্যা করিবার অভিপ্রায়ে অহিফেন সেবন করিয়াছেন। এই বাসায় কেম্বেল হাসপাতালের একজন ছাত্র বাস করেন, হাসপাতালের ডিউটী উপলক্ষে তিনি সেই সময় হাসপাতালে গমন করিতেছিলেন। হরিশের অবস্থা দেখিয়া, তিনি আর কালবিলম্ব না করিয়া, অপর দুই ব্যক্তির সাহায্যে একখানি গাড়ি করিয়া তখনই তাঁহাকে কেম্বেল হাসপাতালে লইয়া যান। অপর যে দুই ব্যক্তি তাঁহার সহিত গমন করিয়াছিলেন, তাঁহারা এইমাত্র হাসপাতাল হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। তাঁহাদিগের প্রমুখাৎ জানিতে পারিলাম যে, হরিশের অবস্থা ভাল নহে, বাঁচিবার আশা নিতান্তই অল্প তবে যেরূপ যত্নের সহিত তাঁহার সেই স্থানে চিকিৎসা হইতেছে, তাহাতে কি হয় বলা যায় না। 

যে বাসায় হরিশ বাস করিতেন, সেই স্থান হইতে আমরা ওই সমস্ত বিষয় অবগত হইলাম। আমরা যে কি নিমিত্ত হরিশের অনুসন্ধান করিতেছি, তাহা ওই বাসায় কাহাকেও না বলিলেও ক্রমে বাসার সকলেই জানিতে পারিলেন। ওই স্থান হইতে ওই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া, দ্রুতগতি আমরা কেম্বেল হাসপাতালে গমন করিলাম। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, বাসা হইতে আমরা যে সকল কথা অবগত হইয়াছিলাম, তাহার একটিও মিথ্যা নহে। হরিশ বাস্তবিকই অহিফেন খাইয়াছেন। হাসপাতালের ৪/৫ জন ডাক্তার ও ছাত্র তাঁহার চিকিৎসায় নিযুক্ত আছেন। তাঁহার অবস্থা অতিশয় শোচনীয় হইলেও তিনি এখনও একবারে অজ্ঞান হন নাই। কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি আস্তে আস্তে তাহার উত্তর প্রদান করিতেও সক্ষম। তাঁহার চিকিৎসাকারী ডাক্তারের অনুমতি লইয়া তাঁহারই সমক্ষে আমি তাঁহাকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি আমাকে তাহার নিম্নরূপ উত্তর প্রদান করিলেন। পাঠক পাঠিকাগণের সুবিধার নিমিত্ত আমি প্রশ্ন ও উত্তরগুলি যথাযথরূপে নিম্নে প্রদান করিলাম। 

আমি। তোমার নাম কি? 

হ। হরিশ্চন্দ্র দত্ত। 

আ। তোমার বাসস্থান? 

হ। —জেলার অন্তর্গত; গ্রামে। 

আ। তুমি কলিকাতার মেসে বাস কর? 

হ। হাঁ। 

আ। তুমি আফিং খাইয়াছ? 

হ। হাঁ, খাইয়াছি। 

আ। কেন? 

হ। আমার মনের কোন বিশেষ কষ্টের নিমিত্ত। 

আ। তোমার মনে এমন কি কষ্ট হইয়াছিল, যাহাতে তুমি আত্মহত্যা করিতে প্রস্তুত হইয়াছ? 

হ। যখন আমাকে মরিতে হইবে, তখন পরের হাতে না মরিয়া আত্মহত্যা করাই ভাল বলিয়া আমি আফিং খাইয়াছি।

আ। তুমি এমন কি করিয়াছ যে, তোমাকে মরিতে হইবে? 

হ। যে কার্য্য করিয়াছি, তাহাত আপনারা জানিতে পারিয়াছেন, জানিতে না পারিলে আপনারা এখানে আসিবেন কেন? 

আ। আমরা ত জানিতে পারিয়াছি, তথাপি তোমার মুখে একবার শুনিতে চাই। 

হ। কি শুনিতে চাহেন বলুন? 

আ। বিরাজমোহিনীকে তো তুমি প্রাণের সহিত ভালবাসিতে? 

হ। বাসিতাম, রাক্ষসীর মায়ায় ভুলিয়াছিলাম। 

আ। যাহাকে একবার ভালবাসিয়াছ, তাহার উপর অত্যাচার কেন? 

হ। বিশ্বাসঘাতিনীর উপর যদি অত্যাচার না করিব, তবে আর কাহার উপর করিব? সে আমার যে কি সর্বনাশ করিয়াছে, তাহা আপনারা জানেন না; যদি আমার সমস্ত অবস্থা আপনারা জানিতে পারিতেন, তাহা হইলে কখনই ওইরূপ কথা বলিতেন না। 

আ। বিশ্বাসঘাতিনীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ লইতে চেষ্টা করিয়াছ সত্য, কিন্তু কৃতকার্য হইতে পার নাই, তাহা জান কি? 

হ। কেন মহাশয়, সে কি তবে মরে নাই, আমার চেষ্টা কি ব্যর্থ হইয়াছে? 

আ। সে এখনও জীবিতা আছে, বোধ হয় বাঁচিলেও বাঁচিতে পারে। সে বলিয়াছে, সে ভাল হইলে তোমার নিকটেই গমন করিবে। 

হ। ওরূপ বিশ্বাসঘাতিনীকে হৃদয়ে আর কখনই স্থান দিব না, আমার নিকট পুনরায় আগমন করিলে পদাঘাতে তাহাকে দূর করিয়া দিব। উঃ! সে কি অবিশ্বাসিনী। 

আ। তাহা হইলে তাহার মৃত্যুতেই তুমি সন্তুষ্ট? 

হ। নিশ্চয়ই, তাহাকে শমনসদনে প্রেরণ করিবার নিমিত্তই আমি ওইরূপ ভাবে তাহাকে আঘাত করিয়াছি।

আ। তাহার নিমিত্ত আর তোমাকে চিন্তা করিতে হইবে না, সে ইহ-জীবন পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। হ। মরিয়া গিয়াছে? 

আ। হাঁ। 

হ। জগতের একটি মহাপাপী কমিয়াছে, এখন আমার মৃত্যু হইলেই মঙ্গল। 

আ। তাহা হইলে তুমি আত্মহত্যা করিবার নিমিত্তই কি আফিং খাইয়াছ? 

হ। হাঁ। 

আ। তুমি বিরাজমোহিনীকে কি অস্ত্রের দ্বারা আঘাত করিয়াছিলে? 

হ। ভোজালির দ্বারা। 

আ। ভোজালিখানি কোথায়? 

হ। ফেলিয়া দিয়াছি। 

আ। কোথায় ফেলিয়া দিয়াছ? 

হ। যে বাসায় আমি এখন বাস করি, সেই বাড়ীর প্রাঙ্গণের একপার্শ্বে একঝাড় কলাগাছ আছে, সেই কলাগাছের পার্শ্বে একটি ছাইর গাদা, সেই ছাই গাদার ভিতর আমি ভোজালিখানি নিক্ষেপ করিয়াছি। 

আ। উহা কি এখন সেই স্থানে আছে? 

হ। তাহা আমি জানি না, কেহ উঠাইয়া লইয়া না থাকিলে নিশ্চয়ই আছে। 

আ। ওই ভোজালিখানি তুমি কোথায় পাইলে? 

হ। যে সময় আমি বিরাজমোহিনীর অনুসন্ধানার্থ তাহার পিতার বাড়ী হইতে বহির্গত হই, সেই সময় উহা বহিৰ্ব্বাটীতে পড়িয়া আছে দেখিয়া আমি কুড়াইয়া লইয়া আসি। 

আ। তবে ওই ভোজালিখানি বিরাজমোহিনীর পিতার? 

হ। হাঁ। 

আ। তুমি আফিং খাইলে কেন? 

হ। নিজের জীবন নষ্ট করিতে। 

আ। নিজের জীবন নষ্ট করিতে তোমার ইচ্ছা হইল কেন? 

হ। ফাঁসি কাষ্ঠে না ঝুলিয়া, পরের হস্তে না মরিয়া, নিজ হস্তে মরাই ভাল, তাই আফিং খাইয়াছি। 

আ। তুমি কতদিন হইতে সংকল্প করিয়াছিলে যে, বিরাজমোহিনীকে হত্যা করতঃ নিজে আফিং খাইয়া আত্মহত্যা করিবে? 

হ। বোধ হয় তিন চারিদিবস হইতে। যখন দেখিলাম, বিরাজমোহিনী আমার নিকট আসিল না বা আমার এতগুলি পত্রের একখানিরও জবাব দিল না, তখনই আমি বুঝিতে পারিলাম যে, এখন আর সে আমার নয়। সেই সময়ই ভাবিলাম, তাহাকে হত্যা করিয়া শেষে নিজের জীবন বিসর্জ্জন দিব। 

আ। যদি ৩/৪ দিবস হইতে তোমার মনে এই সংকল্প হইয়া থাকে, তাহা হইলে এতদিবস পর্য্যন্ত ওই ভোজালি বহন করিয়া বেড়াইতেছিলে কেন? 

হ। যে সময় আমি ওই ভোজালি উহার পিতার বাড়ী হইতে লইয়া আসি, সেই সময় এ ভোজালির দ্বারা যে বিরাজমোহিনীকে হত্যা করিব, এ অভিপ্রায় আমার ছিল না; আত্মরক্ষার্থে উহা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম। 

আ। আফিং কতদিন হইতে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলে? 

হ। কল্য উহা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। 

আ। কোথা হইতে উহা সংগ্রহ করিলে? 

হ। বাসার একটু দূরে একটি দোকান আছে, ওই দোকান হইতে আফিং কিনিয়া রাখিয়াছিলাম।

আ। কতখানি আফিং কিনিয়া রাখিয়াছিলে? 

হ। এক ভরি। 

আ। কোথায় রাখিয়াছিলে? 

হ। আমার ঘরে একটি টিনের বাক্সের মধ্যে। 

আ। কখন উহা খাইলে? 

হ। বিরাজমোহিনীকে হত্যা করিয়াই আমি আমার বাসায় আসি ও উহা খাইয়া ফেলি। 

আ। কতখানি খাইয়াছিলে? 

হ। সমস্তই। 

হরিশ্চন্দ্রকে এই সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করিয়া পরিশেষে তাহাকে কহিলাম, কিরূপে বিরাজমোহিনীর পিত্রালয়ে তোমার স্থান হয়, কিরূপে বিরাজমোহিনীর সহিত অবৈধপ্রণয়ে আসক্ত হও, কিরূপে বিরাজমোহিনী তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যের সহিত পিত্ৰালয় হইতে চলিয়া আসে, কিরূপে তুমি তাহার অনুগমন করিয়া কলিকাতা পৰ্য্যন্ত আগমন কর, ও কিরূপেই বা তাহার নিকট পত্রাদি প্রেরণ কর, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ প্রকাশ করিয়া বল? হরিশ্চন্দ্র সমস্তই বলিলেন, আমিও তাহা লিখিয়া লইলাম। 

যে ডাক্তারবাবু তাহার চিকিৎসা করিতেছেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, একভরি আফিংএর অধিকাংশ তাহার পেট হইতে উঠাইয়া ফেলিতে তিনি কৃতকাৰ্য্য হইয়াছেন। এখন হরিশ্চন্দ্র বাঁচিলেও বাঁচিতে পারেন, তবে অহিফেনসেবনকারীদের কিছুমাত্র বিশ্বাস নাই। হঠাৎ তাহাদের অবস্থা পরিবর্ত্তন ঘটিয়া থাকে। 

ডাক্তারবাবুর নিকট এই অবস্থা অবগত হইয়া হরিশ্চন্দ্রের উপর উপযুক্তরূপ পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া আমরা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। বুঝিলাম, এই মোকদ্দমার একরূপ কিনারা হইল। 

হাসপাতাল হইতে বহির্গত হইয়া যে বাসায় হরিশ্চন্দ্র বাস করিতেন, সেই বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তিন যে কলাঝাড়ের পার্শ্বে ছাই গাদার কথা বলিয়াছিলেন, সেই ছাই গাদার ভিতর অনুসন্ধান করায় তাঁহার কথিত মত সেই ভোজালিখানি প্রাপ্ত হইলাম। 

যে দোকান হইতে হরিশ্চন্দ্র আফিং খরিদ করিয়াছিলেন, সেই দোকান অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, হরিশ্চচন্দ্র যেরূপ আকৃতির লোক, সেইরূপ আকৃতির এক ব্যক্তি প্রকৃতই তাহার দোকান হইতে আফিং খরিদ করিয়া লইয়া গিয়াছে। ওই দোকানদারের নিকট হইতে আরও জানিতে পারিলাম যে, সেই ব্যক্তিকে দেখিলে ওই দোকানদার অনায়াসেই চিনিতে পারিবে। 

অনুসন্ধানে এই দুইটি বিষয় অবগত হইতে পারিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, বিরাজমোহিনীকে হত্যা করা সম্বন্ধে হরিশ্চন্দ্র যাহা বলিয়াছে, তাহা প্রকৃত ও তাহার একটি কথাও মিথ্যা নহে। 

মনে করিয়াছিলাম, বিরাজমোহিনীকে হত্যা করিয়া, আপন জীবন নষ্ট করিবার অভিপ্রায়ে হরিশ্চন্দ্র যখন আফিং খাইয়াছে, তখন হয় ত তাহার জীবন শেষ হইলেও হইতে পারে, কিন্তু কাৰ্য্যে তাহা ঘটিল না; দুই একদিনের মধ্যে চিকিৎসার গুণে হরিশ্চন্দ্ৰ ভাল হইয়া উঠিল। অহিফেন সেবনে যদি তাহার মৃত্যু হইত, তাহা হইলে আমাদিগের অনুসন্ধানও সেই সঙ্গে শেষ হইয়া যাইত; কিন্তু তাহা হইল না। হরিশ্চন্দ্রের পরমায়ু শেষ হইয়া আসিয়াছে সত্য, কিন্তু আমাদিগের অদৃষ্টে ঈশ্বর যে ভোগ লিখিয়াছেন, তাহার কিছুমাত্র লাঘব হইল না, বরং সেই ভোগে প্রচুর মাত্রায় আমাদিগকে ভুগিতে হইল। 

হরিশ্চন্দ্র হাসপাতাল হইতে বহির্গত হইয়া আসিবার পর যে পর্য্যন্ত তাহার বিচার শেষ না হইল, সেই পৰ্য্যন্ত তাহাকে হাজত-গৃহে বাস করিতে হইল। হরিশ্চন্দ্র যে সকল কথা আমাদিগকে বলিয়াছিল, ও যাহা আমরা সেই সময় লিখিয়া লইয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্বিক অনুসন্ধানও আমাদিগকে করিতে হইল। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, তিনি যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই সত্য। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

হরিশ্চন্দ্র দত্ত আমাদিগকে যে সকল কথা বলিয়াছিল ও সেই সময় আমরা যাহা লিখিয়া লইয়াছিলাম, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ। 

—জেলার অন্তর্গত—গ্রামে আমার বাড়ী, সেই স্থানে আমার বৃদ্ধ পিতা ও মাতা এখনও বাস করিতেছেন। তাঁহাদিগের সাংসারিক অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়, সামান্য কয়েক বিঘা জমীর উপস্বত্ব হইতে কোনরূপ কায়ক্লেশে তাঁহারা জীবনধারণ করিয়া থাকেন। সাংসারিক অবস্থা মন্দ হইলেও যখন আমার বয়ঃক্রম ১৬ বৎসর, সেই সময় আমাকে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করিয়া দেন। আমার শ্বশুরের সাংসারিক অবস্থাও আমাদিগের ন্যায়, সুতরাং বিবাহের পর হইতেই আমার স্ত্রী আমাদিগের বাড়ীতে আমার পিতামাতার সহিতই বাস করিতেছেন। 

আমাদিগের গ্রামে একটি পাঠশালা আছে, বাল্যকাল হইতে আমি ওই পাঠশালায় বিদ্যাভ্যাস করিতে আরম্ভ করি। লেখা পড়ার দিকে আমার বিশেষ যত্ন দেখিয়া, ও আমার পিতামাতার হীন অবস্থা জানিতে পারিয়া, গুরুমহাশয় বিনা বেতনেই আমাকে লেখা পড়া শিখাইতে আরম্ভ করেন, আমিও সেই সুযোগ পরিত্যাগ না করিয়া, ওই পাঠশালায় যতদূর সম্ভব লেখাপড়া শিক্ষা করি। পাঠশালার শিক্ষা অপেক্ষা আমার আরও অধিক শিক্ষা করিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমাদিগের অবস্থার সংকুলান না হওয়ায় আমাকে সে আশা পরিত্যাগ করিতে হয় ও আমি কোন একটি বিষয়কার্য্যের চেষ্টা দেখিতে থাকি। 

সে জেলায় আমার বাসস্থান, সেই জেলার অন্তর্গত অথচ আমাদিগের গ্রাম হইতে প্রায় ২০ ক্রোশ ব্যবধানে একখানি বৰ্দ্ধিষ্ণু গ্রাম আছে। ওই গ্রামে অনেকগুলি ভদ্রলোকের বাস। তাঁহারা সকলে মিলিত হইয়া ওই গ্রামে একটি উচ্চশ্রেণীর স্কুল স্থাপিত করেন ও অনেক দিবস হইতে উহা সুচারুরূপে পরিচালিত করিতে থাকেন, কিন্তু সম্প্রতি তাঁহাদিগের মধ্যে ভয়ানক দলাদলি উপস্থিত হওয়ায়, গ্রামস্থ সমস্ত ভদ্রলোক দুই দলে বিভক্ত হইয়া পড়েন। ফলে ওই গ্রামের মধ্যে ওইরূপ আর একটি স্কুল স্থাপিত হয়, ও এক স্কুলের সমস্ত ছাত্র ক্রমে দুই স্কুলে বিভক্ত হইয়া যায়। সুতরাং উভয় স্কুলের ছাত্র সংখ্যা কম হইয়া পড়ায়, উহাদের বিশেষরূপ ক্ষতি হইতে আরম্ভ হয়। ছাত্রসংখ্যা কম হইয়া যখন উভয় স্কুলই উঠিয়া যাইবার উপক্রম হইল, সেই সময় নূতন স্থাপিত স্কুলের কর্তৃপক্ষগণ এইরূপ এক বন্দোবস্ত করেন যে, অপরাপর স্থান হইতে যে সকল ছাত্র এই স্কুলে পড়িতে আরম্ভ করিবে, তাহাদিগের থাকিবার স্থান, খোরাক ও বেতনের ভাবনা তাহাদিগকে ভাবিতে হইবে না, স্কুলের কর্তৃপক্ষগণ তাহার বন্দোবস্ত করিবেন। এই সংবাদ জানিতে পারিয়া আমি ওই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হই। স্কুলের কর্তৃপক্ষগণ আমাকে ভর্তি করিয়া লন। একজন ভদ্রলোক মাসে মাসে আমার স্কুলের বেতন প্রদান করিতে থাকেন, আর বিরাজমোহিনীর পিতা তাঁহার বাড়ীতে আমার থাকিবার স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দেন ও তাঁহার সংসারেই আমার আহারাদি চলিতে থাকে। আমার নিমিত্তই যে কেবল এইরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছিল তাহা নহে, অপর স্থানের যে সকল ছাত্র আসিয়া ওই স্কুলে ভর্তি হয়, তাহাদিগেরও বেতন ও আহারের বন্দোবস্ত ওইরূপ ভাবেই করা হয়। কেহ বেতনের ভার, কেহ বা আহারাদির ভার গ্রহণ করেন। একটি বালকের বেতন দিতে, বা একটি বালকের আহার দিতে কাহারও বিশেষরূপ কষ্ট হয় না, অথচ ওই উপায় অবলম্বন করায়, ওই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা অনেক বাড়িয়া যায় ও ক্রমে ওই স্কুলের শোচনীয় অবস্থা ভাল অবস্থায় পরিণত হয়। 

বিরাজমোহিনীর পিতার বাড়ী পাকা হইলেও উহাতে বাহিরের ঘর অধিক ছিল না, সুতরাং অন্দরের মধ্যস্থিত একটি ঘরে আমার থাকিবার স্থান নির্দ্দেশ হয়। আমিও তাহাদের পরিবারভুক্ত হইয়া পড়ি ও সেই স্থানে বাস করিতে থাকি। এইরূপে ক্রমাগত ওই স্থানে ৬ বৎসরকাল বাস করি। 

আমি যে সময় ওই বাড়ীতে বাস করিতে যাই, তাহার পূর্ব্বেই বিরাজমোহিনী বিধবা হইয়াছিল। তাহার পিতার তিনিই প্রথম কন্যা, উহার দুইটি কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিল। আমি ওই স্থানে থাকিয়া বিশেষ মনোযোগের সহিত লেখাপড়া শিক্ষা করিতে লাগিলাম, স্কুলের ভিতর আমি একজন ভাল ছেলে বলিয়া পরিগণিত হইলাম। আমিও বিরাজমোহিনীর পিতামাতাকে আপন পিতামাতার ন্যায় বিশেষরূপ ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতে আরম্ভ করিলাম, তাহারাও আমাকে তাঁহাদিগের পুত্রের ন্যায় দেখিতে লাগিলেন। এইরূপে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল; যে সময় স্কুলের অবকাশ হইত, সেই সময় বাড়ীতে গমন করিয়া পিতামাতার চরণ দর্শন করিতাম। 

বিরাজমোহিনীর পিতার বাড়ীতে বাস করিবার সময় তাঁহার পুত্র দুইটিকে বাড়ীতে পড়াইবার ভার ক্রমে আমার উপর ন্যস্ত হয়। আমি উহাদিগকে আমার সাধ্যমত শিক্ষা দিতে প্রবৃত্ত হই। ক্রমে বালবিধবা বিরাজমোহিনীও আসিয়া তাহাদিগের সহিত যোগ দেয়। আমি সেই সঙ্গে উহাকেও পড়াইতে আরম্ভ করি। বালকদ্বয় অপেক্ষা বিরাজমোহিনীর বুদ্ধি অতিশয় প্রখরা ছিল, সে বালকদ্বয় অপেক্ষা দিন দিন লেখাপড়ার অনেক উন্নতি করিতে লাগিল। আমারও ক্রমে তাহার উপর অধিক পরিমাণে ভালবাসা ও যত্ন আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। কিন্তু সে ভালবাসা ও যত্ন তখন অন্য প্রকারের ছিল। কনিষ্ঠ ভাই-ভগ্নীর উপর যেরূপ ভালবাসা, শিষ্যের উপর গুরুর যেরূপ ভালবাসা, তাহাদের উপর আমার সেইরূপ ভালবাসা। কিন্তু সেই ভালবাসা অধিক দিন রহিল না। দুই তিন বৎসরের মধ্যে বিরাজমোহিনীর যৌবনে পদার্পণ করিবার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভালবাসা রূপান্তর ধারণ করিল। 

পূর্ব্বে যাহাকে কেবল শিক্ষার সময় দেখিলেই একরূপ সন্তুষ্ট হইতাম, এখন তাহাকে সদাসর্বদা চক্ষুর সম্মুখে রাখিতে ইচ্ছা হইতে লাগিল, সে ক্ষণকালের জন্যও নয়নের অন্তরাল হইলে মনটা যেন কেমন করিয়া উঠিত। পূর্ব্বে নিজের পাঠাভ্যাস করিবার কালীন অপরের কথা মনে আসিত না, কিন্তু এখন নিজের পাঠে কোনরূপেই মন সংযোগ করিতে পারিতাম না। পুস্তকের ভিতর বলুন বা অন্তরের ভিতর বলুন, সৰ্ব্বদাই সেই মূৰ্ত্তিই দেখিতে পাইতাম। চক্ষুর সম্মুখে সেই মূৰ্ত্তি যেন সদা সৰ্ব্বদা ঘুরিয়া বেড়াইত। পূৰ্ব্বে যাহাকে কেবলমাত্র একঘণ্টা পড়াইয়াই সন্তুষ্ট হইতাম, এখন দিবসের অধিকাংশ সময় তাহাকে পড়াইয়াও তৃপ্তি লাভ করিতে পারিতাম না। কিন্তু কি যে পড়াইতাম, তাহা নিজেও বুঝিয়া উঠিতে পারিতাম না। তাহাকেও দেখিতাম, সেও যেন সদাসৰ্ব্বদা অন্যমনস্ক, সদাসর্বদা তাহার হৃদয়ও যেন ভীষণ চিন্তায় পূর্ণ। পূর্ব্বে অৰ্দ্ধঘণ্টা অধ্যয়ন করিয়া সে যাহা শিখিতে পারিত, এখন সমস্ত দিন পুস্তক হস্তে বসিয়া থাকিয়াও সে কিছুমাত্র শিক্ষা করিতে পারিত না। পূর্ব্বে যে সকল বিষয় অসঙ্কুচিতচিত্তে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিত, এখন আর সে, সে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিত না, বোধ হইত, বিষম লজ্জা আসিয়া তাহার মনের ভাব প্রকাশ করিতে প্রতিবন্ধক হইত। পূর্ব্বে সে যেরূপ ভাবে আমার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিত বা আমি তাহার উপর যেরূপ অসঙ্কুচিতচিত্তে দৃষ্টিপাত করিতাম, এখন কিন্তু আর সেরূপ ভাবে উভয়ে উভয়ের নয়নের উপর নয়নপাত করিতে পারিতাম না। 

এইরূপ কিছুদিবস অতিবাহিত হইতে না হইতে আমাদিগের উভয়ের কপালেই আগুন লাগিল। বিরাজমোহিনী তাহার অমূল্য রত্ন হেলায় হারাইল। আমিও বৃদ্ধ পিতামাতার আশাপথ রুদ্ধ করিয়া, যুবতী স্ত্রীকে চিরদিবসের জন্য চক্ষের জলে ভাসাইয়া পাপের প্রবল স্রোতে গা ভাসাইয়া দিলাম। 

ক্রমে কয়েক বৎসর কাটিল, পাপের কথা কখনও গোপন থাকে না, ক্রমে এককাণ দুইকাণ করিয়া এই ভয়ানক পাপের কথা সকলের কর্ণে প্রবেশ করিল। গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে, দেশ হইতে দেশান্তরে, এই পাপময় বাৰ্ত্তা রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। বিরাজমোহিনীর পিতামাতাও ক্রমে উহা জানিতে পারিলেন; প্রথম প্রথম বিরাজমোহিনীকে শাসন করিতে লাগিলেন কিন্তু সেই শাসন কোনরূপ ফলদায়ক হইল না, পরিশেষে আমাকে সেই বাড়ী হইতে বিতাড়িত করিবার চেষ্টাও করিলেন, কিন্তু বিরাজমোহিনীর নিমিত্ত তাহাও করিতে পারিলেন না। কারণ বিরাজমোহিনী তাহার মাতাকে স্পষ্টই বলিলেন যে, যদি আমি ওই বাড়ী হইতে চলিয়া যাই, তাহা হইলে হয় সে বাড়ী ছাড়িয়া তাহার সহিত চলিয়া যাইবে, না হয় আফিংসেবন বা যে কোন উপায় অবলম্বন করিয়া সে আত্মহত্যা করিবে। 

বিরাজমোহিনীর মাতা বিরাজমোহিনীকে অতিশয় ভালবাসিতেন, তিনি কন্যার ভয় প্রদর্শনে অতিশয় ভীত হইয়া পড়িলেন ও তাঁহার স্বামীর সহিত কি পরামর্শ করিলেন; তখন হইতে আমাকে আর কিছু বলিতেন না। আমি পূর্ব্বের ন্যায় ওই স্থানেই বাস করিয়া পাপের স্রোত যতদূর সম্ভব প্রবাহিত করিতে লাগিলাম। এইরকমে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গলে। এই কয়েক বৎসরের মধ্যে আমি আমার মাতাপিতার বা স্ত্রীর আর কোনরূপ সংবাদই লইলাম না। 

আমি জানিতাম, যদি জগতে আমার সুখ থাকে, তাহা হইলে ওই বিরাজমোহিনী। সুতরাং আমি বিরাজমোহিনীকে আমার প্রাণের অপেক্ষা ভালবাসিতাম, তাহার বাক্য আমি গুরুবাক্য সম গ্রহণ করিতাম, ও মনে জানিতাম, তাহার উপর আমার মনের যেরূপ ভাব, তাহার মনের ভাবও আমার উপর সেইরূপ, আমি তাহাকে যেরূপ চক্ষে দেখিয়া থাকি, সেও আমাকে সেইরূপ ভাবে গ্রহণ করিয়া থাকে। 

আমি একদিবসের নিমিত্তও বুঝিতে পারি নাই যে, তাহার হৃদয় হলাহলে পূর্ণ; যদি আমি তাহার কিছুমাত্র আভাষ ইতিপূর্ব্বে জানিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমার অদৃষ্টে আজ এ দশা ঘটিত না, আমার বৃদ্ধ পিতামাতা ও যুবতী ভাৰ্য্যা আমা কর্তৃক আজ চিরজীবনের নিমিত্ত অতল দুঃখ-সমুদ্রে নিমগ্ন হইত না। 

একদিবস অতি প্রত্যূষে জানিতে পারিলাম যে, বিরাজমোহিনী তাহার পিত্রালয় পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তাহার পিতামাতা তাহার অনুসন্ধান করিয়া কোন স্থানেই তাহাকে প্রাপ্ত হন নাই, ও কোনরূপ সন্ধানও করিয়া উঠিতে পারেন নাই। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমার হৃদয় যে কিরূপ হইল, তাহা আপনারা অনুভব করিতে পারিবেন না। আমি চতুর্দিক শূন্য দেখিলাম, কিছুক্ষণের জন্য ভাল মন্দ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। পরিশেষে আমিও বিরাজমোহিনীর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। 

যে সময় বিরাজমোহিনী হঠাৎ তাহার পিত্রালয় পরিত্যাগ করে, সেই সময় ওই গ্রাম একরূপ জলে ডুবিয়া গিয়াছিল, বিরাজমোহনীর পিতার বাড়ীর চতুর্দিক জলে বেষ্টিত হইয়া পড়িয়াছিল, বিনা নৌকায় এক স্থান হইতে অন্য স্থানে গমনাগমন করিবার কোনরূপ উপায় ছিল না। সুতরাং বিরাজমোহিনীর অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার সময় আমাকেও একখানি নৌকা ভাড়া করিতে হইল। আমি ইহাও বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, বিরাজমোহিনী যে স্থানে গমন করুক না কেন, তাহাকেও নৌকা করিয়া যাইতে হইয়াছে। সুতরাং যদি কোনরূপে ওই নৌকার অনুসরণ করিতে পারি, তাহা হইলে বিরাজমোহিনীকে নিশ্চিয়ই ধরিতে সমর্থ হইব। আমি আরও বুঝিতে পারিলাম, বিরাজমোহিনী কখনই ওইরূপ অবস্থায় একা বাটী পরিত্যাগ করিতে সাহসী হয় নাই, নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি তাহার সঙ্গে আছে। 

মনে মনে এই সকল ভাবিয়া একখানি নৌকা করিয়া আমিও বাহির হইলাম। আসিবার সময় ওই ভুজালিখানি বহির্বাটিতে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া আমি উহা সঙ্গে লই। উহা দ্বারা যে বিরাজমোহিনীকে হত্যা করিব, ইহা কিন্তু সে সময় একবারও ভাবি নাই; আত্মরক্ষার্থেই উহা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম। 

অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে, বিরাজমোহিনীর বাড়ী হইতে প্রায় অর্দ্ধক্রোশ ব্যবধানে একখানি নৌকা সন্ধ্যা হইতে বাঁধা ছিল, উহার ভিতর চারি পাঁচজন যুবককেও কেহ কেহ দেখিয়াছে। আরও জানিতে পারিলাম, রাত্রিযোগে ওই নৌকা সেই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে। 

ওই নৌকা যেদিকে গিয়াছিল, আমিও মাঝিদিগকে সেইদিকে আপন নৌকা চালনা করিতে কহিলাম, কিন্তু বিরাজমোহিনীর সহিত সেই নৌকা ধরিতে পারিলাম না। যখন উহা ধরিতে পারিলাম তখন উহা অরোহীশূন্য অবস্থায় ফিরিয়া আসিতেছে। উহার মাঝির নিকট হইতে জানিতে পারিলাম, চারি পাঁচজন যুবক একটি যুবতীকে লইয়া একটি মন্দিরের সম্মুখে অবতরণ করে। আমি তাহাদিগকে সেই স্থান দেখাইয়া দিতে কহিলে, তাহারা সেই স্থান ও যে বাড়ীতে যুবতী প্রবেশ করে, তাহা দেখাইয়া দেয়। 

আমি জানতে পারি যে, উহা একটি ব্রাহ্মসমাজ। আমি উহার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে থাকিয়া বিরাজমোহিনীর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই ও একদিবস তাহাকে দেখিতে পাই; কিন্তু সে আমাকে দেখিয়া তাহার মস্তক নত করিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে। সেই দিবস হইতে বুঝিতে পারি যে, বিরাজমোহিনী আর সেই বিরাজমোহিনী নহে, তাহার হৃদয় এখন অন্যভাবে পূর্ণ। 

ইহার দু-একদিবস পরেই আমি জানিতে পারিলাম যে, বিরাজমোহিনী কলিকাতায় গমন করিয়াছে। আমিও কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। অনেক অনুসন্ধানের পর সে যে বাড়ীতে আশ্রয় লইয়াছে, তাহা বাহির করিলাম। আমিও সেই বাটীর সন্নিকটস্থ এক মেসে বাসা লইলাম। আমার বাসা বাটার ছাদ হইতে বিরাজমোহিনীকে প্রত্যহ তাহাদের বাটীর ছাদে বেড়াইতে দেখি। ওই ছাদের উপর আমি ক্রমাগত দশ-বারখানি পত্র নিক্ষেপ করি, সে যে তাহার একখানি না একখানি পাইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যখন দেখিলাম, সে আমার একখানি পত্রেরও উত্তর দিল না, বা আমার উপদেশমত কার্য্য করিল না, তখন আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, সে এখন আর আমার নহে-অপরের হইয়াছে; সুতরাং তাহাকে হত্যা করাই স্থির করিলাম। আরও স্থির করিলাম, তাহার অস্তিত্ব লোপের সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের অস্তিত্বও লোপ করিব, এই ভাবিয়া উহাকে হত্যা করিলাম, ও নিজের হত্যা-বাণ নিজ হস্তে গ্রহণ করিলাম। কিন্তু এখনও বুঝিতে পারিতেছি না, উহাতে আমি কতদূর কৃতকার্য্য হইব। 

হরিশ্চন্দ্র ক্রমে ভাল হইয়া উঠিলেন। তিনি যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, সেই সম্বন্ধে আমাদিগের অনুসন্ধান করিতে হইল; তাঁহার দেশে পৰ্য্যন্ত আমাকে গমন করিতে হইয়াছিল। সেই স্থানে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, হরিশ্চন্দ্র যাহা যাহা বলিয়াছে, তাহার একবর্ণও মিথ্যা নহে। এখন তিনি খুনী মোকদ্দমার আসামী। নিম্ন আদালত হইতে উচ্চ আদালত পৰ্য্যন্ত তিনি একবাক্যে আপন দোষ স্বীকার করিলেন। তথাপি তাঁহার বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছিল, তাহা সপ্রমাণ করিতে হইল। এমন কি এখানে আসিয়া বিরাজমোহিনীর পিতাকে পর্য্যন্ত সাক্ষ্য প্রদান করিতে হইল। 

বিচারে হরিশচন্দ্র চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন। 

সম্পূর্ণ 

[ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *