রাসূল (সা.) আর আয়েশা (রা.) এর বিয়ে নিয়ে কথিত নাস্তিকদের কানাঘুষা
আমরা চারজন বসে টিএসসিতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রাকিব, শাহরিয়ার, সাজিদ আর আমি। আমাদের মধ্যে শাহরিয়ার হল খেলাপ্রেমিক। ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার চরম ভক্ত। কেউ পুরো সপ্তাহের কোন ম্যাচ না দেখে শাহরিয়ার কাছে আধঘন্টা বসলেই হবে। শাহরিয়ার পুরো সপ্তাহের খেলার আদ্যোপান্ত তাকে কাগজে-কলমে বুঝিয়ে দেবে। ইপিএলে কোন দলে আছে, ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব নিয়ে পেপ গার্দিওলা কিরকম দলটাকে পাল্টে দিল,
সিরিএ-তে জুভের অবস্থান কোথায়, ইব্রাকে ছেড়ে দিয়ে ফ্রেঞ্চ লীগে পিএসজির অবস্থান কেমন, বুন্দেসলীগাতে বায়ার্ন আর ডর্টমুন্ড কি করছে, লা-লিগাতে বার্সা-রিয়ালের দৌড়ে কে এগিয়ে, রোনাল্ডোর ফ্রম নাই কেন, মেসিকে ছাড়া বার্সা সামনের ম্যাচ গুলোর উতরে যেতে পারবে কিনা, নেইমার সেরা না বেল সুয়ারেজ নাকি বেনজেমা ইত্যাদি ইত্যাদি বিশ্লেষণের জন্য শাহরিয়ারের জুড়ি নেই। এত কঠিন কঠিন স্প্যানিশ, জার্মেইন, ফ্রেঞ্চ আর ইতালির নামগুলো সে কিভাবে যে মনে রাখে আল্লাহ মালুম। খেলার খবর বলতে শুরু করলে তার কোন থামাথামি নেই। ননস্টপ বলে যেতে পারে। এজন্য আমরা বন্ধু মহলে শাহরিয়ার ‘স্পোর্টস চ্যানেল’ নামে পরিচিত।
রাকিব হলো আগাগোড়া ‘পলিটিক্স স্পেশালিস্ট’।
দুনিয়ার রাজনীতি কখন কোথায় কিভাবে মোড় নিচ্ছে, তার সমস্ত রকম আপডেট থাকে রাকিব এর কাছে। গলির মুখ থেকে ট্রাম্পের বেঁচে আসা থেকে শুরু করে হিলারির ম্যালেরিয়া পর্যন্ত সব খবর তার নখ দর্পনে। তবে ইদানিং সে ব্যস্ত পাক-ভারতের যুদ্ধ নিয়ে। কাশ্মীরের উরিতে হামলা নিয়ে পাক-ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই যাচ্ছে সে। রাকিবের মনে হচ্ছে, ঊরি’র হামলাটা আসলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির একটি ‘ব্লাইন্ড গেম’। তার মতে ঊরিতে যারা হামলা করছে, তারা যদি সত্যি পাকিস্তানি হবে, তাহলে নিহত হামলাকারীদের মিডিয়ার সামনে না এনে রাতারাতি কবরস্থ করে ফেলা হলো কেন? সেই হামলাকারীদের ছবি আর পরিচয় মিডিয়ার সামনে এনে পাকিস্তানকে এক ঘরে করে দেবার একটি দারুন চান্স ছিল ভারতের হাতে। কিন্তু ভারত তা করল না কেন? কেন তারা রাতারাতি লাশগুলো সেনাক্যাম্পে দাফন করে ফেললো কেন? কেন পাকিস্তানের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলো না ইত্যাদি পয়েন্ট ধরে রাকিবের মনে সন্দেহ আছে।
যুদ্ধ যদি সত্যিই লেগেই যায়, কোন পক্ষ বেনিফিট হবে, কার কত সামরিক শক্তি, কে কোন দিক থেকে আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ চালাবে সেগুলোর পয়েন্ট বাই পয়েন্ট ব্যাখ্যা দিচ্ছে সে।
আলোচনার মাঝখানে হঠাত নিলয় দা’র আগমন। আমাদের চেয়ে সিনিয়র মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র ছিলো।
আমাদের চেয়ে ঢের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাথে তার বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এত সিনিয়র লেভেলের কেউ।
তার হাতে একটি পত্রিকা। পত্রিকা হাতে নিলয় দা আমাদের পাশে এসে বেঞ্চিতে বসলো।
নিলায় দাকে দেখে সাজিদ আরেক কাপ রঙ চা’র অর্ডার করলো।
চা চলে এলে নিলয় দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, -‘বাকস্বাধীনতার মূল্য পৃথিবীর কোথাও নেই, বুঝলি? কোথাও নেই।’
কথাগুলো এমনভাবে বলল যে নিলয় দাকে খুব মর্মাহত দেখালো। নিলয়দা কোন পয়েন্টে থেকে কথাগুলো বলল তা আমাদের কারো মাথাতে আসে নি তখনও। রাকিব বলে উঠল, -‘নিলয়দা কি পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় কটূক্তির দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া তারক বিশ্বাসের কথা বললে?’
নিলয়দা রাকিবের কথার প্রত্যুত্তরে কোন কিছু বলল না। তার মানে রাকিব এর ধারণা ঠিক। অন্য সময় হলে রাকিবের এরকম উপস্থিত বুদ্ধির বহর দেখে নিলয়দা তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলতো ‘সাবাস’। কিন্তু আজ খুব ফ্রাস্ট্রেটেড থাকায় নিলয়দা খুব অফ মুডে আছে বলে মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটা খুব শরটলি ব্যাখ্যা করলো রাকিব। পশ্চিমবঙ্গের একজন নাস্তিক তরুণ মহানবী সা. কে নিয়ে কটুক্তি করার ফলে সাইবার আইনে গ্রেফতার হয়েছে পরশুদিন। এটাকে নিলয়দা বলছে বাকস্বাধীনতার ওপর আঘাত।
সাজিদ তার চায়ের শেষ চুমুকটি দিয়ে বলল, -‘এতে দোষের তো কিছু দেখছি না দাদা। ছেলেটা দোষ করেছে, সে তার শাস্তি পাচ্ছে। What’s wrong?’
নিলয় দা মুখের রং পরিবর্তন করে বড় বড় চোখে সাজিদের দিকে তাঁকালো। বললো, -‘একজন পঞ্চাশোর্ধ বুড়ো লোক ৯ বছর বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করলে দোষ নেই, তা নিয়ে কথা বললেই দোষ হয়ে যায়।
সাজিদ বললো, -‘কথা বললে তো দোষ নেই দাদা। কিন্তু অশ্লীল ভাষায় কটুক্তি করাটা দোষের। একটি ধর্মের পবিত্র নবীকে নিয়ে এরকম খিস্তি করাটা মূল্যবোধ বিরোধী তো বটেই, এটা সংবিধান বিরোধীও।’
-‘গুষ্টি কিলাই তোমার এরকম মূল্যবোধ আর সংবিধানের।’
সাজিদ বুঝলো নিলয়দা খুব ক্ষেপে আছে। তাকে সহজে বোঝানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
সাজিদ বলল, -‘দাদা মনে আছে তোমার, আমি তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তোমার সাথে প্রথম পরিচয় হয় তখন। এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদের মেয়ের বয়সি শাওনকে বিয়ে করার ব্যাপারটা নিয়ে যখন আমি আপত্তি তুলে ছিলাম, তুমি কি বলেছিলে? তুমি বলেছিলে, বিয়ে হল একটি বৈধ সমাজিক বন্ধন। যখন তাতে দুটি পক্ষের সম্মতি থাকে, তখন সে তার বয়স, সামাজিক স্ট্যাটাস কোন কিছুই ম্যাটার করে না। হুমায়ূন আহমেদের বেলায় যে কথাগুলো প্রযোজ্য, সে কথাগুলো মুহাম্মদ সা. এর বেলায় কেন প্রযোজ্য হবে না?’
নিলয়দা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এরপর বলল, -‘তাই বলে বলতে চাচ্ছিস, ৯ বছরের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করা বৈধ হয়ে যাবে?’
সাজিদ হাসলো। বললো, -‘দাদা আমি মোটেও তা বলছি না। আমি প্রথমে বোঝাতে চাইলাম যে, বিয়ে একটা সামাজিক বন্ধন।’
-‘তো? সামাজিক বন্ধন ধরে রাখতে ৯ বছরের কিশোরী বিয়ে করতে হবে নাকি?’
সাজিদ উঠে দাঁড়ালো। আমি জানি এখন সে লেকচার শুরু করবে। রাসূল সাঃ এবং আয়েশা রা. এর বিয়ে নিয়ে একি নাতিদীর্ঘ লেকচার দেওয়ার জন্য সে মেন্টালি প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যা ভাবলাম তাই। সাজিদ বলতে শুরু করল-
‘দাদা প্রথমে বলে রাখি, যারাই রাসূল সা. আর আয়েশা রা. এর বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলে, তাদের প্রথম দাবি মোহাম্মদ সা. নাকি যৌন লালসা কাতর ছিলেন। সে জন্য তিনি নাকি কিশোরী আয়েশা রা. কে বিয়ে করেছিলেন।
তাদের এই দাবি যে কতটা বাতুলতা আর ভিত্তিহীন, তা ইতিহাস থেকে আমরা দেখব। আমরা জানি, মুহাম্মদ সা. বিয়ে করেছিলেন ২৫ বছর বয়সে। হযরত খাদিজা রাঃ কে।
বলাবাহুল্য, যখন মুহাম্মদ সা. ২৫ বছরের একজন টগবগে তরুণ, ঠিক সেই সময়ে তিনি বিয়ে করলেন চল্লিশোর্ধ একজন মহিলাকে, যিনি কিনা আবার একজন বিধবা ছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন মুহাম্মদ সা. আর কোন বিয়ে করেননি। তুমি হয়তো বলবে, খাদিজার রা. এর প্রচুর ধন সম্পত্তি ছিল। পাছে এগুলো হারানোর ভয়ে হয়তো তিনি আর বিয়ে করেননি। তোমার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, এটা ইতিহাস সম্মত যে সম্পদশালী খাদিজার রা. নিজে মুহাম্মদ সা. কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মুহাম্মদ সা. নিজে দেন নি। তারউপর খাদিজা রা. নিজেই যেখানে একজন বিধবা ছিলেন, সেখানে মোহাম্মদ সা.ও যদি সেই অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করতে চাইতেন, তাতে বাধা দেওয়ার অধিকার খাদিজা রা. এর থাকার কথা না।
তাহলে এখান থেকে আমরা কি বুঝলাম? আমরা বুঝলাম যে, মুহাম্মদ সা. যৌনকাতরতা থেকে কিশোরী আয়েশা রা. বিয়ে করেননি।
নিলয় দা প্রশ্ন করলো, -‘তাহলে কিশোরী আয়েশাকে বিয়ে করার হেতু কি?’
সাজিদ বলল, -‘Let me finish …… আয়েশা রা. কে বিয়ে করার একটা হুকুম রাসূল সা. আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কারণ জ্ঞানে-গুনে আয়েশা রা. ছিলেন তৎকালীন আরব কন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তার সেই প্রজ্ঞা, সেই জ্ঞান, সে বিচক্ষণতা যাতে পুরোপুরিভাবে ইসলামের কল্যাণার্থে ব্যবহার হতে পারে, তারজন্যই হয়তো এই হুকুম।’
স্পোর্টস চ্যানেল শাহরিয়ার এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার সে বলল, -‘সাজিদ, রাসূল সা. বিয়ে করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম প্রাপ্ত, এই কথার ভিত্তি কি?’
সাজিদ শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল, -‘নবীদের স্বপ্নও একপ্রকার ওহি। এটা জানিস তো?’
-‘বুখারির হাদিসে আছে, রাসূল সা. হযরত আয়েশা রা. কে একবার বললেন, (হে আয়েশা) আমি তোমাকে দুই বার স্বপ্নে দেখেছিলাম। একটি রেশমের উপরে একটি কারো একজনের মুখচিহ্ন। আমি যখন রেশনের উপর থেকে আবরণ সরালাম, আমি দেখলাম সেটা তোমার মুখাবয়ব। তখন কেউ একজন আমাকে বলল, -(হে মুহাম্মদ) এটা তোমার স্ত্রী। আমি বললাম, যদি এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়, তাহলে এটাই হবে।’
বুখারি এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আয়েশা রা. যে নবী মুহাম্মদ স. এর স্ত্রী হবে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সম্মতি।’
শাহরিয়ার আবার বলল, -‘কিন্তু তুই যে বললি, তার জ্ঞান-প্রজ্ঞা ইসলামের কল্যাণার্থে ব্যবহারের জন্যই এই হুকুম, তার দলিল কি?’
সাজিদ বলল, -‘এটাতো সর্বজনবিদিত সত্য কথা। সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. এর পর সবচেয়ে বেশি হাদীস মুখস্ত করে রেখেছিলেন, তিনি হযরত আয়েশা রা.। শুধু তাই নয়, কোরআনের অগাধ পাণ্ডিত্য। এমনকি বড় বড় সাহাবীরা পর্যন্ত তার কাছে ফতোয়ার জন্য আসতো। তার ফিক্বহী জ্ঞান ছিল অসামান্য।
আবু মুসা আল-আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন –‘এমন কখনো হয়নি (ফিক্বহী বিষয়ে) আমরা কোন কিছু সমাধানের জন্য আয়েশা রা. এর কাছে গেলাম কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি।’
অর্থাৎ, আয়েশা রা. এর এই যে জ্ঞান-প্রজ্ঞা, এর জন্য তিনি আল্লাহ কর্তৃক উম্মুল মুমিনীন হিসেবে সিলেক্টেড হয়ে যান।
এছাড়াও, তৎকালীন আরবে খুব ছোট বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। তখন তার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। এটা ঠিক যুগের সাথে সাথে সেটা পাল্টেছে। এখন মেয়েদের অনেক চিন্তা। ক্যারিয়ার গড়ো, পড়াশোনা কর, বিদেশ যাও, উচ্চ ডিগ্রির সার্টিফিকেট নাও।
তখন আরবের মেয়েদের চাকরি করার দরকার হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ার রীতি তখনও ছিল না। ঘরোয়া পরিবেশে তারা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করতো। এর জন্য খুব ছোট বয়সে তাদের বিয়ের রীতি ছিল।
তবে মেয়েদের ছোট বয়সে যে বিয়ের রীতি ছিল, তা আয়েশা রা. এর জীবনের আরেকটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। মুহাম্মদ সা. এর সাথে বিয়ের আগে, আয়েশা রাঃ এর আরেক জনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়। তার নাম ছিল জুবায়ের। কিন্তু, আবু বকর রা. ইসলাম গ্রহন করায় বিয়েটা ভেঙে যায়। এর থেকে কি প্রমান হয় না, তখন মেয়েদের ছোট বয়সেই বিয়ের প্রচলন ছিল ? তাছাড়া, তখনকার মক্কার কোন বিধর্মীরা এই বিয়ে নিয়ে আপত্তি তোলেনি। তারাও জানত, এটা খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
নিলয় দা বলল, -‘মোহাম্মদ তো এসেছিলেন রীতি ভেঙে রীতি গড়ার জন্য। তিনি এই অদ্ভুত রীতি ভাঙলেন না কেন?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, ঠিক বলেছ। মুহাম্মদ সা. এসেছিলেন রীতি ভেঙে রীতি গড়ার জন্য। কিন্তু তিনি সেসব রীতি ভাঙার জন্য এসেছিলেন, যা অনৈতিক। যেমন, কোন শিশুকে জীবন্ত দাফন। তিনি আরবের সেসব কালচার পাল্টে দিয়েছেন, যা জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু, ছোট বয়সে বিয়ে সেরকম কোনো ব্যাপার নয়। বিজ্ঞান আমাদের বলে, মেয়েরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ তাড়াতাড়ি ম্যাচিওর হয়। সেটা ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি দুইভাবেই। তাছাড়া, তখনকার আরবের ছোট বয়সে বিয়ে হবার পরও মেয়েরা খুব নরমালে সন্তান জন্ম দিতো। এটা কোন সমস্যা ছিল না। সেটা চেঞ্জ করার দরকার ছিল না। যা দরকার ছিল তা তিনি করেছেন। তুমি কি আশা কর যে, মুহাম্মদ সা. কেন তৎকালীন আরবদের উটের ব্যবসা তুলে দিয়ে, তাদের শেয়ার ব্যবসা শেখালেন না, কেন তিনি খেজুরের ব্যবসা তুলে দিয়ে সেখানে চকলেট আর রসমালাইয়ের ব্যবসার প্রচলন করলেন না? তুমি হয়তো ভাবছো, তৎকালীন আরবের বালকদের উট চরানো থেকে মুক্তি দিয়ে কেন তাদের হাতে একটি কম্পিউটার এবং একটি করে ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিলেন না?’
শাকিব আর শাহরিয়ার হা হা হা হা করে হাসতে লাগলো। সাজিদ বলল, -‘মানুষ মাত্রই তার সমাজের সুস্থ নিয়মগুলোর সাথে মিলিয়ে চলতে বাধ্য। মুহাম্মদ সা.ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাছাড়া এত অল্প বয়সে বিয়ে কেবল ১৫০০ বছর আগে ছিল তা নয়, শিল্প বিপ্লবের পরেও অনেক উন্নত দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের সর্বনিম্ন বয়স সীমা ১০ এর নিচে ছিল। তাছাড়া, ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, মুহাম্মদ সা. এর আরো ৫০০ বছর পরে ইংল্যান্ডের রাজা জন ৪৪ বছর বয়সে ১২ বছর বয়সী রানী ইসাবেলাকে বিয়ে করেছিলেন। এ ব্যাপারগুলো তখনকার সমাজে, যুগে খুব স্বাভাবিক ছিল, যেমন স্বাভাবিক সঙ্গম করে সন্তান উতপাদন করা। তাছাড়া, উপমহাদেশেও যে খুব ছোট বয়সে বিয়ে রীতি ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘হৈমন্তী’ থেকেই আমরা দেখতে পাই। লেখক সেখানে দেখিয়েছেন, তখনকার সময় ৮-১১ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে হত। হৈমন্তীর বিয়ের স্বাভাবিক বয়স পেরিয়ে যাওয়ায়, অর্থাৎ, ১৭ হয়ে যাওয়ায় তার শাশুড়ি সেটা সবার কাছ থেকে লুকোতে চাইছিলেন। হৈমন্তীকেও মিথ্যে বলার জন্য শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এখান থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের সময়েও ৮ থেকে ১১ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে ছিল একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
সেই গল্পে আমরা ‘পণ’ প্রথার কুফল সম্পর্কে একটি আভাস পেলেও, কোথাও কিন্তু বিয়ের বয়স নিয়ে উচ্চবাক্য দেখেনি। বরং, হৈমন্তীর বয়স বেশি হয়ে যাওয়াতেই কিছুটা আপত্তি দেখা গেছে। এখান থেকে বুঝতে পারি, রবীন্দ্র আমলেও ছোট বয়সে বিয়ের প্রচলন ভারতবর্ষেই মজুদ ছিল।
সাজিদের এই লেকচারে নিলয় দা সন্তুষ্ট না। বললো। -‘দেখো ভাই, যতই ত্যানা পেচাও, একজন বৃদ্ধ লোক ৯ বছর বয়সি কিশোরীকে বিয়ে করেছে, এটাকে তুমি কোন ভাবেই ডিফেন্ড করতে পারোনা। সে প্রফেট হোক আর যাই-ই হোক।’
আমি ভাবলাম, এইবার সাজিদ পরাজিত হবে। হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশ গলায় বলবে, -নাহ ! আর পারলাম না দাদা।’
কিন্তু না। সাজিদের মধ্যে আমি তেমন কিছুই দেখলাম না। সে খুব স্বাভাবিক মুচকি একটি হাসির রেখা তার ঠোঁটে। সে আর এক কাপ চায়ের অর্ডার করলো।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, -‘দাদা, ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে পদ পেয়েছে শুনলাম।’
নিলয় দা বললো, -‘হুম, সাহিত্য সম্পাদক।’
সাজিদ বলল, -‘নতুন একটি আইন হল শুনলাম। বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার নিয়ে কেউ কটুক্তি করলে ধরা হবে নাকি?’
-‘হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করলেই তো সেটা সহ্য করা হবে না।’
-‘তা ঠিক। বঙ্গবন্ধু তো তোমাদের আইডল।’
নিলয় দা বলল, -‘আমাদের আইডল কিরে? বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির আইডল।’
-‘আচ্ছা দাদা, তুমি জানো বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর নাম কি ছিল?’
নিলয় দা অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, -‘কি সব বলছিস তুই? জানবো না কেন? বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা বেগম।’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, তুমি জানো, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা’র জন্ম কোন সালে ?’
নিলয় দা কিছুক্ষণ ভাবলেন। বললেন, -‘ভুলে গেছি রে ! বিসিএস এর জন্য যখন প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম, তখন পড়েছিলাম।’
সাজিদ তার ফোন বের করে সেখান থেকে উইকিপিডিয়ার ‘বেগম ফজিলাতুন্নেসা’ লিখে সার্চ দিল। উইকিপিডিয়া রেজাল্ট দেখাল, বেগম ফজিলাতুন্নেসার ১৯৩০ সালে। সাজিদ সেটা নিলয় দা’কে দেখালো।
নিলয় দা বলল, -‘হুম, মনে পড়েছে। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? হঠাৎ এই ব্যাপারে চলে গেলি কেন?’
সাজিদ বলল, -‘দাদা, তুমি জানো, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা’র সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কত সালে বিয়ে হয়?
নিলয়দা ‘না’ সুচক মাথা নাড়ল। সাজিদ আবার উইকি থেকে দেখলো। বঙ্গবন্ধুর সাথে বেগম ফজিলাতুন্নেছা’র বিয়ে হয় ১৯৩৮ সালে।
সাজিদ বলল। -‘দাদা, ১৯৩৮ থেকে ১৯৩০ বাদ দিলে কত থাকে?’
নিলয় দা বলল, -‘জি দাদা, একদম ঠিক বলেছ। ১৯৩৮ থেকে ১৯৩০ বাদ দিলে থাকে ৮ বছর। ঠিক ৮ বছর বয়সের বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বঙ্গবন্ধুর বিয়ে হয়। আচ্ছা দাদা, আমি কি এটাকে বাল্যবিবাহ বলতে পারব? বলতে পারব, শেখ মুজিব একজন যৌনকাতর পুরুষ ছিলেন যার ফলে তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সের ফজিলাতুন্নেসাকে বিয়ে করেছেন? আমি এরকম বললে আমার বিরুদ্ধে কি মামলা হওয়া উচিত দাদা?
বলতো, একবিংশ শতাব্দীর শেখ মুজিবুর রহমান যেটা পেরেছেন, মাত্র ৮ বছর বয়সী একজন কিশোরীকে বিয়ে করে এতগুলো সন্তান জন্ম দিতে পারলে ১৫০০ বছর আগের মোহাম্মদ সা. কেন পারবে না? কেন তাকে ধর্ষক, যৌন কাতর, যৌন লিপ্সু ডাকা হবে? তাকে এবং আয়েশা রা. কে নিয়ে অশ্লীল কথা লিখে কেউ আইনের জালে ফাঁসলে তার জন্য কেন তোমার মন কাঁদবে যেখানে তুমি শেখ মুজিবের জন্য তৈরি করে রেখেছে সাইবার আইন।’
আকাশ থেকে পড়লে যা হয়, নিলয় দা’র অবস্থাও তখন তেমন। নিলয় দা এরকম একটা জবাব পাবেন তা হয়তো কল্পনাও করেননি।
-চায়ের বিল দেওয়ার জন্য সাজিদ এগিয়ে গেল। গম্ভীর, রাজনীতিপ্রিয় রাকিব এসে বলল, -‘দোস্ত, পরানটা ঠান্ডা করে দিয়েছিস একদম। বিলটা আমাকে দিতে দে, প্লিজ?’
সাজিদ মুচকি হাসলো।
রেফারেন্সঃ
1/ Jala-Ul Afhaam by Imam Ibnul Qaiyum
2/ Sahih Al bukhari, Volume 5, book 58, hadith 234
3/ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ –শেখ মুজিবুর রহমান
4/ Wikipedia
বিঃদ্রঃ (শেখ মুজিব বা উনার স্ত্রীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা আমার মোটিভ নয়। একটি যুক্তির খাতিরে উনাকে উদাহরণ হিসেবে তানা হয়েছে। কেউ এটাকে পলিটিক্যালি বা পারসোনাল এ্যাটাক মনে করে ভুল করবেন না। )