রাসূল (সাঃ) এর পরিবার
শিশুদের বেড়ে ওঠায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। বাবা-মার ওপর থেকে চাপ কিছুটা কমাতে পারে। রাসূল (সাঃ) এতিম ছিলেন। বর্ধিত পরিবারে বড় হয়েছেন। আত্মীয়স্বজনদের কাছে বিভিন্ন ঘটনা শুনে তিনি দয়াশীলতা, নেতৃত্বগুণ, লেগে থাকার মতো বিষয়গুলো হাতেকলমে শিখেছেন।
আজকাল স্কুল, বন্ধুবান্ধব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। আবার উল্টো ফলও এনে দিতে পারে। তবে যাই হোক, বাবা-মার বাইরেও শিশুদের অনুকরণীয় আদর্শ বা রোল মডেল প্রয়োজন। বর্ধিত পরিবারের কাজটা এখানেই। বর্ধিত পরিবারের সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব না হলে শিক্ষক, প্রতিবেশীরা এর বিকল্প ভূমিকা পালন করতে পারেন। এটা শিশুদের চিন্তাভাবনার পরিধি বাড়ায়। বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা দেয়।
বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা
এই অধ্যায়ে আমরা কথা বলব রাসূল (সাঃ) এর বর্ধিত পরিবার নিয়ে। বর্ধিত পরিবার বলতে বাবা-মা ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে বুঝাচ্ছি। এই অধ্যায়ে আমরা রাসূল (সাঃ) এর দাদা ও চাচা-চাচী সম্পর্কে জানব। রাসূল (সাঃ) এর বেড়ে ওঠায় তারা বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বেশিরভাগ সীরাহ বইগুলোতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সামান্যই কথা হয়। তবে আমরা যদি তার জীবনকে বুঝতে চাই তাহলে তাদেরকে জানাটা জরুরি। কেউ কেউ ভাবেন বর্ধিত পরিবারের বিষয়টা অতিমাত্রায় জটিল। তারা বিষয়টার শাখা-প্রশাখায় নিজেদের হারিয়ে ফেলেন। আধুনিক আরবিতে সুদীর্ঘ নাম ব্যবহারের প্রচলন নেই। তো বর্ধিত পরিবার নিয়ে আলাপ করতে যেয়ে এত বড় বড় নামের তালিকা দিয়ে কী করবেন, সেটা হয়ত বুঝতে পারেন না কেউ কেউ। সুদীর্ঘ নামের বৃত্তে আমি ঘুরপাক খাবো না। কিংবা এগুলোর খুঁটিনাটিতে পড়ে থাকব না; বরং রাসূল (সাঃ) এর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অংশগুলো নিয়ে কথা বলব। এগুলো আমাদের গড়ে ওঠায় সাহায্য করবে। রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের সদস্যদের এমনভাবে তুলে ধরব, মনে হবে আপনি তাদের ব্যক্তিগতভাবে চেনেন।
পরিস্থিতি যা-ই হোক, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা নিয়ে আমরা প্রথম অধ্যায়ে কথা বলেছি। এখানে কথা বলব, আপনার বা আপনার সন্তানের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করতে বর্ধিত পরিবারের ভূমিকা নিয়ে। ঠিক যেমন প্রভাবময় ছিল রাসূল (সাঃ) এর বর্ধিত পরিবার।
দাদা-দাদি, নানা-নানী, ফুফু-খালা, মামা-চাচা এদের সবাই আপনার শিশুকে বেড়ে ওঠায় সহযোগিতা করতে পারে। রাসূল (সাঃ) এর বেলায় এই কাজটি করেছেন তাঁর দাদা ও চাচা। এতে বাবা-মা’র ওপর চাপ কমে। আর এতে অন্য লাভও আছে। একেকজনের জীবন-অভিজ্ঞতা ভিন্ন। যে কারণে শিশু একেকজনের কাছ থেকে একেক রকম অভিজ্ঞতার স্বাদ পায়। যদি বর্ধিত পরিবারে না-থাকেন, তাহলে ভালো বিকল্পের ব্যবস্থা করুন। যেমন- প্রতিবেশী বা শিক্ষক। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সন্তান লালন করার দায়িত্ব বাবা-মা একা পালন করবেন না। তাদেরকে বহু ধরনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মুখোমুখি করাবেন।
বর্ধিত পরিবার
বর্ধিত পরিবারে বাবা-মা, সন্তান, দাদা-দাদি, চাচা, ফুফু এবং কাজিনরা কাছাকাছি থাকেন। এ ধরনের পরিবারের গুরুত্বের বিষয়টা আরবি ভাষা থেকেও বুঝা যায়। ইংরেজিতে চাচা, মামা, ফুফা, খালু, সবকিছুর জন্য একটাই শব্দ: আঙ্কেল। আরবিতে আলাদা আলাদা চারটা শব্দ আছে। বাংলাতেও তা-ই। আবার কাজিনদের জন্যও আটটা ভিন্ন ভিন্ন আরবি শব্দ আছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বর্ধিত পরিবার সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর আবেদন হারিয়ে গেছে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর ধীরে ধীরে এর প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে যায়। কারণ এর আগে মানুষের জীবন কৃষি নির্ভর ছিল। ওখানে কাজেকর্মে একে অপরের সহযোগিতার দরকার ছিল। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর সেটার আর প্রয়োজন ছিল না।
আমাদের সমাজেও এই পরিবর্তনের ঢেউ লাগে। বর্ধিত পরিবারের বন্ধনগুলো ঢিলে হয়ে যায়। তৈরি হয় একক পরিবার। সন্তান লালনপালনের পুরো দায়িত্ব তারা একাই পালন করেন। মা যদি কর্মজীবী বা অন্য কোনো কারণে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে কাজের লোক এই দায়িত্ব নেয়।
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনাদের বলছি না যে চলুন, সবাই মিলে আবার এক ছাদের নিচে থাকা শুরু করি। পুরোনো সেই রোমান্টিক পরিবেশে ফিরে যাই। আমার মূল পয়েন্টটা হচ্ছে, সন্তান লালনপালনে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আবারও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করুক।
ইউরোপের কিছু দেশ কিন্তু বর্ধিত পরিবারের সেই ধারা ফিরিয়ে এনেছে। দ্যা টেলিগ্রাফ পত্রিকা ২০০৮ সালে একটা প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল। সেখানে তারা বলেছে যে, ব্রিটেনের সাড়ে আট লাখ পরিবারে বাড়তি সদস্য থাকেন। তাদের ধারণা ২০২৮ সালের মধ্যে সেটা শতকরা ৩০ ভাগে পৌছাবে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আলাদা থাকার কারণে সন্তান আর পিতামাতার দেখাশোনা করা অনেক স্বামী-স্ত্রীর জন্য কঠিন। সবাই মিলে যদি কাছাকাছি থাকেন, তাহলে এই কাজ সহজ হয়।
রাসূল (সাঃ) এর পরিবার
রাসূলের (সাঃ) এর পুরো নাম মুহাম্মাদ ইব্ন্ আবদুল্লাহ ইব্ন্ আবদুল মুত্তালিব ইব্ন্ হাশিম ইবনে আবদু মানাফ ইব্ন্ কুসাই। প্রথাগতভাবে আরবে সন্তানের মূল নামের শেষে বাবা অথবা মার বাবা, দাদা, বড় দাদার নাম যোগ করা হয়। আধুনিক আরবে এর কিছু কিছু নামের চল নেই। সংক্ষেপে তাই এগুলোর কিছু পরিচয় দিচ্ছি।
কুসাই
তার আসল নাম ছিল যাইদ। কিন্তু পরে কুসাই নামেই পরিচিতি হন। এ নামের অর্থ- ‘অনেক দূরে। অল্প বয়সে তিনি ঘর ছেড়ে গিয়েছিলেন বলে তাকে এই নামে ডাকা হতো।
আবদু মানাফ
আসল নাম আল মুগিরা। রাসূল (সাঃ) এর দাদার দাদার দাদা। তার নামের অর্থ মানাফের দাস’। আরব মূর্তিপূজারীরা ইসলামের আগে মানাফ নামে এক মূর্তির পূজা করত। সংগত কারণেই এ নামের আর কোনো অস্তিত্ব নেই এখন।
হাশিম
আসল নাম আমর। হাজিদের সাহায্য সহযোগিতার কারণে তিনি হাশিম নামে পরিচিত হোন। নামের অর্থ- রুটি বিতরণকারী।
আবদুল মুত্তালিব
তার আসল নাম শাইবা। মক্কার লোকেরা তাঁকে দেখে মুত্তালিব নামে এক ব্যক্তির দাস মনে করেছিল। সেজন্য তারা ঐ নামে ডেকেছিল। পরে ওই নামেই তিনি পরিচিত হন।
রাসূল (সাঃ) তাঁর বংশের লোকদের ব্যাপারে জানতেন। তাদের অর্জনের ব্যাপারে জানতেন। মক্কার লোকদের একটা ঐতিহ্য ছিল। তারা গল্প-কবিতা দিয়ে তাদের পরিবারের কাহিনি গল্পে সাথে বলে যেত। বর্ধিত পরিবারের ভূমিকা কেবল জীবিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। যারা মারা গিয়েছেন তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে তাদের যদি কোনো অনুপ্রেরণামূলক কীর্তি থাকে।
রাসূল (সাঃ) এর পূর্বপুরুষ আর তাদের যেসব অর্জন তাঁকে প্রভাবিত করেছিল, সে ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক। কুসাইকে দিয়ে শুরু করি।
কুসাইঃ মক্কায় কুরাইশ গোত্র একসময় দুর্বল ছিল। বিভক্ত ছিল। তিনি কুরাইশ গোত্রকে এক করেন। তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই মক্কার ইতিহাসে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ (Key Figure)। তার জন্ম মক্কাতে।
তবে বড় হয়েছেন মক্কার বাইরে। দীর্ঘ সময় পর সেখানে ফিরে খুযা গোত্রের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। তখন খুযা গোত্র কাবার দায়িত্বে ছিল। কুরাইশ গোত্র এই মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব পাক এমন এক আকাক্ষা তার মধ্যে জেগে ওঠে। এজন্য তিনি তার গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন এক একসময় খুযা গোত্রকে সরিয়ে মক্কার রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের হাতে চলে আসে।
তিনি তখন যেসব দায়িত্ব পালন করতেন-
১. মক্কায় ভ্রমণকারীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা।
২. হাজিদের পানি, দই, মধু সরবরাহ।
৩. কাবার রক্ষণাবেক্ষণ।
৪. প্রয়োজনে যুদ্ধের সময় হাল ধরা।
তিনি একা একা মক্কা শাসন করতে চাননি। ‘ফোরাম’ নামে তিনি একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখানে মক্কার অন্যান্য গোত্ররাও আলোচনায় বসত। নগর শাসন নিয়ে তাদের মতামত দিত। পরামর্শ দিত।
এখন সবচেয়ে মজার দিক হলো- কুসাই যে অবস্থায় ছিলেন, তাতে করে এ ধরনের স্বপ্ন ছিল দুঃস্বপ্ন। তার গোত্র বিভক্ত। তিনি বড় হয়েছেন মক্কার বাইরে। মক্কাবাসীদের কাছে তিনি বহিরাগতের চেয়ে বেশি কিছু না। তার তেমন কোনো সমর্থকও ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্কফী। প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে তিনি তার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। মক্কাবাসীদের শ্রদ্ধা অর্জন করে নিয়েছেন। ইতিহাসবিদ ইবেন হিশাম তাকে ধর্মের সাথে তুলনা করেছেন। মানুষ যাকে সারাজীবন অনুসরণ করতে পারে।
উনার এসব কৃতিত্বের কথা রাসূল অবশ্যই শুনে থাকবেন। পারিবারিক বিভিন্ন আলাপচারিতায় এসব প্রসঙ্গ উঠে আসা অস্বাভাবিক না। এ থেকে রাসূল যেটা শিখে থাকবেন সেটা হচ্ছে, কোনো কিছু পরিবর্তনের জন্য যে শক্তি দরকার সেটা নিজের থেকেই নিতে হবে। আশপাশ থেকে না। তা না হলে পরিবর্তন আনা সম্ভব না।
আবদে মানাফ: মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। কিন্তু আদর্শ চির অমলিন, চিরকালীন। অনুসারীরা যদি আদর্শের অনুসরণ না করে ব্যক্তিপূজা করে, তাহলে একসময় সেটা দ্বন্দ্বে রূপ নেবেই নেবে।
চেঙ্গিস খান, টেমারলেন, আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেটের সময়ের পর এমনটাই হয়েছে। কুসাইয়ের মৃত্যুর পর মক্কাতেও তাই হয়েছে। কাবার দখল কে নেবে- এ নিয়ে তার দুই ছেলে আবদুদ দার ও আবদু মনাফের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে যায়। এক পর্যায়ে তারা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়।
সমাবেশ আয়োজন, প্রতিরক্ষার জন্য সেনা প্রস্তুত ও কাবার চাবি রক্ষণের ভার নেন আবদুদ দার। আর হাজিদের খানাপিনার দায়িত্ব নেন আবদু মানাফ। পরে এটা তিনি তার ছেলে হাশিমকে দেন। হাশিম ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর দাদার দাদা।
হাশিম: গরিব আর হাজিদের খাওয়ানোর বিষয়টাকে তিনি বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। তিনি তাদের সেরা উটের মাংস দিতেন। তার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তবে তারপরও তিনি নিজের পকেট থেকে খরচ করতেন। কুরাইশদের কাছ থেকে দান নিতেন।
এক কবি হাশিমের প্রশংসায় বলেছেন,
মক্কার ভুখানাঙাদের জন্য আমর দুধে ভেজা খাবার তৈরি করেছে; শীত আর গ্রীষ্মের কাফেলা প্রতিষ্ঠা করেছে।
ক্ষুধার্তদের খানাপিনার ব্যবস্থা করায় কবি হাশিমের প্রশংসা করেছেন। শীতে ইয়েমেনে আর গরমে সিরিয়াতে বাণিজ্য কাফেলা পাঠানোর ঐতিহ্য পুনরায় চালু করায় তাকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। দান করতে হলে আপনার কাছে অনেক টাকা থাকতে হবে ব্যাপারটা এমন না। হাশিমের কাছ থেকে আমরা তো তা-ই শিখি। টাকাপয়সা ছাড়াও আপনি আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। অথবা সময় দিতে পারেন। এভাবেও মানুষের উপকার করা যায়। ‘দান’ করা যায়।
হজ্জের মৌসুমে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের সাথে তাকে চলতে হয়েছে। এত মানুষের সাথে চলতে যেয়ে তাকে নিঃসন্দেহে অনেক চাপ সামলাতে হয়েছে। কখনো কখনো মানুষের কটু ব্যবহার সহ্য করতে হয়েছে। অবশ্যই এগুলো তিনি ধৈর্যের সাথে করেছেন। মানুষ তার উদারতা ও সহনশীলতার কথা তার মারা যাওয়ার পরও মনে রেখেছে উপরের কবিতাটা তার প্রমাণ। সুতরাং রাসূল (সাঃ) ও যে এসব ঘটনা শুনে থাকবেন সেটা আশ্চর্যের না। হয়ত এসব ঘটনা থেকে তিনি অনুপ্রেরণাও নিয়ে থাকবেন।
রাসূল (সাঃ) এর পূর্বপুরুষদের মধ্যে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তার নানা ওয়াহাব আবদু মানাফ। তিনি মদিনার এক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি এবং গোত্র প্রধান ছিলেন। আমিনাকে তিনিই দৃঢ়চেতা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। যে কারণে আবদুল মুত্তালিব তার ছেলে আবদুল্লাহর সাথে তার বিয়ে দিতে রাজি হন।
আবদুল মুত্তালিব: আগেই বলেছি তার আসল নাম ছিল শায়বাহ। তিনি তার বাল্যকাল মদিনায় কাটিয়েছেন। মদিনার নাম তখন ইয়াসরিব। তার মায়ের নাম সালমা। তিনি তার উচ্চতা, সুদর্শন চেহারা আর স্বভাবজাত নেতৃত্বগুণের কারণে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। একসময় তিনি তার গোত্রের প্রধান হয়ে ওঠেন। মক্কার ইতিহাসে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তার সাথে সম্পর্কিত। যথা
১. যমযম কূপ পুনরায় খুঁজে পাওয়া
২. হস্তীবর্ষ
যমযম আবিষ্কার
জুরহুম গোত্র যমযম কুয়াকে ঢেকে ফেলেছিল। তারা ছিল নবি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ছেলে নবি ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর মামার গোত্র। মক্কাবাসীদের অনেক দিনের বাসনা ছিল আবার যদি কোনোভাবে তারা এই কূপের খোঁজ পেতেন। কিন্তু কেউ জানত না যে, এটা কোথায় হারিয়ে গেছে। পানির উৎস খুঁড়তে যেয়ে রাসূল (সাঃ) এর দাদা আবদুল মুত্তালিব এই কূপের মুখ খুঁজে পান। আনন্দে তার চোখমুখ ভরে গেল। মাটি থেকে তার দুহাতে পানি ফুলকে উঠল। ঠিক যেমন উঠেছিল মা হাজেরার হাতে।
যমযম কূপ খুঁজে পাওয়ার পর মক্কার পানি সমস্যার একটা সুরাহা হলো। বটে। কিন্তু কুরাইশ নেতাদের মধ্যে ঝামেলা লেগে গেল। আবদুল মুত্তালিবের হাতে এই কূপের নিয়ন্ত্রণে দেখে অনেকের ভালো লাগল না। তারা ঠিক করলেন সিরিয়ার এক যাজিকার মাধ্যমে এটার মীমাংসা হোক।
পথে যেতে যেতে নতুন বিপত্তি হলো। তাদের সঙ্গে নেওয়া সব পানি ফুরিয়ে গেল। পানির অভাবে সবাই ধরেই নিয়েছিল যে মৃত্যু সুনিশ্চিত। এমনকি তারা তাদের কবর পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলেছিল। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব তা করলেন না।
তিনি বললেন, ‘মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করা ব্যর্থতা’। যেভাবে কোমর বেঁধে তিনি যমযমের কূপ খুঁজায় লেগে ছিলেন, সেভাবে সেই অবস্থাতেও তিনি পানি খুঁজতে লাগলেন। একসময় পেয়েও গেলেন। সেই পানি খেয়ে সবার প্রাণ বাঁচল। তাদের মনে হলো পুরো ঘটনাটা আবদুল মুত্তালিবের পক্ষে মহান আল্লাহর বিধান। যমযম নিয়ে তারা তাদের আপত্তি ওখানেই ছেড়ে দেন।
যমযম কূপের মুখ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা নতুনভাবে বলা আমার উদ্দেশ্য না। এই ঘটনাটা শুনে বাল্যকালে রাসূল (সাঃ) এর মনে কী প্রভাব পড়েছিল সেটাই আমার উদ্দেশ্য। এই কাহিনিতে স্বপ্নপূরণে চোয়াল বাধা প্রতিজ্ঞার কথা বলা আছে। সমাজকে কিছু দেওয়ার কথা বলা আছে। পরিস্থিতি যা-ই হোক, আশেপাশের সব মানুষও যদি হাল ছেড়ে দেয়, তেমন পরিস্থিতিতেও হার না-মানা মানসিকতার কথা বলা আছে। কাহিনিটা আমাদের যেন বলছে, উঠে দাঁড়ান। চেষ্টা করুন। না পারলে আবার চেষ্টা করুন।’
রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবনে কতবার কত কঠিন কঠিন সব সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন। এরকম সময়ে এমন কিছু দরকার যা মানুষকে উৎসাহ দেয়। মনকে শক্ত করে। দাদার সেই ঘটনা নিঃসন্দেহে রাসূল (সাঃ) এর কঠিন সময়ে উৎসাহ দিয়েছে।
জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অনুপ্রাণিত করা পরিবারের বাড়তি সদস্যদের অন্যতম ভূমিকা। আপনার ও আপনার শিশু দুজনের জীবনেই তা প্রেরণা দিতে পারে। মানুষের পুরো জীবনই যে ঘটনাময়। কিন্তু দাদাদাদি, নানা-নানিদের এ ধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রভাব অনেক জোরালো।
হস্তিবর্ষ
কঠিন সময়গুলোতে মাথা ঠাণ্ডা রাখা, আতঙ্কিত না-হওয়া; বরং মহান আল্লাহর ওপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার বিষয়গুলো হস্তীবর্ষের শিক্ষা।
ইয়েমেনে অবিরাহা নামক এক খ্রিষ্টান শাসক ছিলেন। ইথিয়োপিয়ান। তিনি সেখানে একটি গীর্জা নির্মাণ করেন। তার ইচ্ছে ছিল, আরব উপদ্বীপের সব তীর্থযাত্রীর পুণ্যজায়গা হবে ইয়েমেনে তার বানানো এই গীর্জা। তার এই খায়েশপূরণে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কাবা। তাই তিনি ওটাকে মিটিয়ে দিতে চাইলেন। বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে তিনি মক্কার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। রাসূল (সাঃ) যে বছর জন্ম নেন এটা সে বছরেরই ঘটনা। আরবে হাতির দেখা পাওয়াটা অত্যন্ত বিরল ঘটনা। আবরাহার বাহিনীতে ছিল বিশাল হাতি। যে কারণে আরবেরা এই ঘটনাকে হস্তীবর্ষ নামে মনে রেখেছিল।
এই বিশাল বাহিনীর সামনে বিনা যুদ্ধে হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আরবদের কোনো উপায় ছিল না। তবে আবদুল মুত্তালিবের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়নি। তিনি আবরাহার সাথে দেখা করতে চাইলেন। আবরাহার সৈন্যরা মক্কায় প্রবেশ মাত্রই লুটপাট শুরু করে দিয়েছিল। তারা আবদুল মুত্তালিবের উট ছিনতাই করেছিল। সেগুলো ফিরিয়ে নিতেই তিনি তার সাথে দেখা করেন।
আবদুল মুত্তালিবের কথা শুনে আবরাহার চোয়াল খুলে পড়ল। এই বৃদ্ধ বলে কী? আমরা তার শহর দখল করে নিয়েছি, তার দায়িত্বে থাকা কাবা ধ্বংস করতে এসেছি, কোথায় সে ওগুলোর মীমাংসার ব্যাপারে কথা বলবে; তা না, তিনি এসেছেন তার উটগুলো ফিরিয়ে নিতে! তিনি তাকে বললেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি কাবার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলেন। উট নিয়ে না’। আবদুল মুত্তালিব ঝটপট জবাব দিলেন, কাবার একজন প্রভু আছেন। তিনিই একে রক্ষা করবেন।
আবরাহা কাবা ধ্বংস করার হুকুম দিলেন। কিন্তু তার হাতি এক চুলও নড়ল না। উপর থেকে পাখিরা নুড়িপাথর ফেলতে লাগল। সৈন্যদের দেহ গলে যেতে লাগল। বাকিরা পালিয়ে বাঁচল। আরবদের চোখে এই ঘটনা ছিল অলৌকিক। পবিত্র শহর হিসেবে মক্কার মর্যাদা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
কুরআনের ১০৫ নং সূরায় এই ঘটনা বলা আছে-
হস্তীবাহিনীর সাথে তোমার প্রভু কি করেছিলেন দেখেছ? তিনি কি তাদের পরিকল্পনাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেননি? তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকেঝকে পাখি পাঠিয়েছিলেন। পোড়া কাদামাটির নুড়ি বর্ষণ করেছেন। তাদের অবস্থা হয়েছিল ফসল তোলা খেতের মতো’।
আবদুল মুত্তালিব তার সন্তান আর নাতি-নাতনিদেরকে অসংখ্যবার এ ঘটনা বলে থাকবেন হয়ত। তিনি তাদের মধ্যে এই কথা গেঁথে দিয়েছিলেন যে, যেসব ঘটনা নিজের জীবনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে, সেসব ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ো না।
মাথা ঠাণ্ডা রাখো, বিশ্বাস রাখো আল্লাহ তোমার সাথে আছেন। তিনি তোমাকে ভুলে যাবেন না। অত্যাচারীদের ওপর তিনি কখনো খুশি নন। তার ঘরের অমর্যাদা তিনি কখনো বরদাশত করবেন না।
হতাশার কাছে হার মানবেন না। নিজের ন্যায্য অধিকার ছাড়বেন না; বরং ভদ্রভাবে সেগুলোর দাবি করুন। মনে রাখবেন, খারাপ সময়ের পর ভালো সময় আসে। কখনো উদ্ভটভাবে। কখনো-বা অপ্রত্যাশিতভাবে।
শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই করুন
যেসব অর্জন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই দুএকজনের কলিজার জোরে। টাকাপয়সা বা জনবলের আধিক্যের কারণে না। বলুন তো, কজন মিলে কাবাঘর বানিয়েছিলেন? ইব্রাহীম ও তাঁর ছেলে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। মাত্র দুজন। অথচ লাখ লাখ লোক এখন সেখানে হজ্জ করে। যে যমযম কূপ থেকে হাজিরা পানি খায়, সেই কূপ খুঁজে পেলেন আবদুল মুত্তালিব।
আমি চাই, এই ঘটনা আপনাকে অনুপ্রাণিত করুক। উপায়-উপকরণ যত কমই হোক না কেন, আপনার সামর্থ্য যত অল্পই হোক না কেন, জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই করুন। দেখবেন, আল্লাহ তায়ালার সাহায্য পেয়ে গেছেন। লড়াকুর কোনো পরাজয় নাই।
তিনি ও তার সঙ্গীরা যে চরম বিপাকে পড়েছিলেন, তাতে করে তিনি সহজেই হাল ছেড়ে দিয়ে বাকিদের মতো নিজের কবর খুঁড়তে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি পানির উৎস খুঁজেছেন। পরে পেয়েছেনও। সেই পানি খেয়ে তিনিসহ বাকিদের প্রাণ বেঁচেছে। সুতরাং হাল ছাড়বেন না। সাল আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে। আবদুল মুত্তালিব যে পানির উৎস পেলেন হয়ত তার নিরাশ সঙ্গীদের পায়ের তলাতেই তা লুকিয়ে ছিল।
‘নিদারুশ বেদনার সময় মনকে শক্ত করুন। এমনকি মৃত্যুমুখে হলেও। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আহত সিংহও জানে কীভাবে গর্জন করতে হয়।’
স্যামুয়েল হানাগিদ, দশম শতাব্দীর ইসলামিক স্পেনের হিব্রুভাষী কবি। জীবনের কঠিন দুখে মোকাবিলার সাহস রাখুন। ছোটগুলোতে ধৈর্য ধরুন। প্রচণ্ড খেটেখুটে প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ অর্জনের পর শান্তিতে ঘুমাতে যান’। ভিক্টর হুগো
রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের নারী সদস্যা
রাসূল (সাঃ) এর পরিবারে নারীরাও সমানতালে অনুপ্রেরণা ছিলেন। আসুন এবার তাদের কয়েকজনের কথা জেনে নিই
সালমা: হাশিমের স্ত্রী। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। রাসূল (সাঃ) এর দাদা আবদুল মুত্তালিবকে তিনিই বড় করেছেন।
বারা আবদুল উয্যা: রাসূল (সাঃ) এর নানী। আমিনার মতো বিশ্বস্ত স্ত্রী ও মমতাময়ী মা গড়ার কৃতিত্ব তার।
ফাতিমা আমর: রাসূলের দাদি। ছয় বছর বয়সে দাদার বাড়িতে পালিত হওয়ার সময় তিনিই রাসূল (সাঃ) এর দেখাশোনা করেছেন।
পরিবারের এসব সদস্যরা কখনো গল্প শুনিয়ে, কখনো-বা নিজেদের জীবন কাহিনি শেয়ার করে শিশুদের বেড়ে তোলায় শিক্ষণীয় ভূমিকা পালন করতে পারেন।
রাসূল (সাঃ) এর মা-বাবা
এখন আমরা কথা বলব, রাসূল (সাঃ) এর মা-বাবা তার জীবনে কী ভূমিকা পালন করেছেন তা নিয়ে।
আমিনা
তিনি মদিনাতে জন্মেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি চাইলে আবার সেখানে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু একমাত্র পুত্র মুহাম্মাদের জন্য যাননি। মক্কাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
রাসূল (সাঃ) এর বাবার মৃত্যুর সময় তার বয়স হবে বড়জোড় বিশের কোঠায়। চাইলে তিনি আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে পারতেন। সেটা না-করে তিনি বিশেষ গুণের পরিচয় দিয়েছিলেন। এটা অনেকের জন্যই অনেক বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে।
তার শাশুড়ি ফাতিমার সাথে তার আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর তা ছিড়ে যায়নি। যে কারণে মক্কাতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। বিধবা আমিনার সব খরচপাতির ব্যবস্থা করেছেন শ্বশুর আবদুল মুত্তালিব। এ থেকে বুঝা যায়, পুত্র আবদুল্লাহর মৃত্যুতেও তাদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক চমৎকার ছিল।
বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ নতুন কিছু না। গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোতেও এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। আজকাল তো এটা কৌতুকের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমিনার সাথে শ্বশুরবাড়ির সুন্দর সম্পর্ক আমাদের বর্তমান সময়ের শ্বশুরশাশুড়ি ও বউদের অনুপ্রেরণা দেবে।
আবদুল্লাহ
আমরা জানি তিনি ২৫ বছর বয়সে মারা যান। তবে তিনি কিন্তু এর আগেও মারা যেতে পারতেন! যমযম কূপের খোঁজ পাওয়ার পর আবদুল মুত্তালিবের সাথে কুরাইশের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। বিরোধের কারণ যমযম কূপের দখল কে নেবে। সেই বিরোধের মীমাংসা হলে তিনি চাইলেন, এই কূপের উত্তরাধিকার দখল প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার ছেলে-নাতিরা পাক। একবার মানত করলেন, আল্লাহ যদি তাকে দশটা ছেলে দেন, তাহলে তিনি তাদের মধ্যে একজনকে কুরবানী করে দেবেন।
আল্লাহ তাকে সত্যিই দশজন ছেলে দিলেন।একদিন তিনি তাদের সবাইকে খড়ের গাদা থেকে খড় টানতে বললেন। যে সবচেয়ে ছোট খড় টানবে তাকেই কুরবানী দেওয়া হবে। আবদুল্লাহ সবচেয়ে ছোট খড় টানলেন। তার বুক ধক করে উঠল। আবদুল্লাহকে কুরবানী দিতে হবে, এমনটা যে তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তিনি ছিলেন তার সবচেয়ে কাছের আর আদরের ছেলে। হয়ত এ কারণেই নাতি মুহাম্মাদের প্রতিও তার টান বেশি ছিল।
তো তার কিছু বন্ধু তাকে বললেন, গণকের কাছে যেতে। সে হয়ত তাকে মানসম্মান বাঁচিয়ে কোনো বিকল্প বলে দেবে। তিনি গেলেন। গণক বলল ছেলের বদলে ১০০ উট কুরবানী দিতে। তিনি তা-ই করলেন।
এই ঘটনাও তিনি তার নাতিদের কাছে বলে থাকবেন। কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমাদের কী ফায়দা?
- আপনাকে যারা সহযোগিতা করবে তাদের খোঁজ করুন (এক্ষেত্রে তার সন্তানেরা)।
- পরিবার দিয়ে অনুগৃহীত করায় মহান আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানান।
- অন্যের উপদেশ শুনতে একগুঁয়ে হবেন না (এই ঘটনায় তার বন্ধুরা)।
- নিজের আইডিয়াগুলো অন্যদের জানান। ভালো ভালো আইডিয়া নিয়ে চুপ করে বসে থাকবেন না। কে জানে, হয়ত এমন কোনো আইডিয়াই অন্যের জীবন বাঁচাতে পারে।
আবদুল্লাহর কথায় ফিরে আসি। তিনি বেশ সুদর্শন ছিলেন। সন্দেহ নেই, তিনি অনেকের নজর কেড়েছিলেন। তবে তার পারিবারিক মর্যাদা, কাবাঘরের দায়িত্ব আর পারিবারিক ব্যবসার কারণে সতর্ক থাকতে হয়েছে, যাতে তাকে দিয়ে এমন কোনো কাজ না-হয় যেটাতে বংশের মুখে চুনকালি পড়ে। যাহোক, তিনি আমিনাকে বিয়ে করলেন। কিন্তু সে বিয়ের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ফিলিস্তিন সফরের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। রাসূল (সাঃ) এর জন্মের আগেই সন্তানের মুখ না দেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
পরিবারের সুব্যবহার
রাসূল (সাঃ) এতিম ছিলেন। তবে একা ছিলেন না। পরিবারের অন্যান্যরা তাঁর বাবা-মা’র অভাব ঘুচিয়েছিলেন। তাদেরকে যারা চিনতেন তারা তাঁর কাছে তাদের গল্প করেছেন। এমনকি যারা সরাসরি তাদের চিনতেন না, তারাও তাদের কথা বলেছেন। তিনি মায়ের কাছ থেকে ত্যাগ শিখেছেন। বাবার কাছ থেকে ন্যায়পরায়নতা শিখেছেন। দাদার কাছ থেকে হার নামানা মানসিকতার পাঠ নিয়েছেন। বড়দাদা হাশিমের কাছ থেকে দানশীলতা আর বড়দাদার দাদা কুসাইয়ের কাছ থেকে নেতৃত্বের গুণ শিখেছেন। তাঁর বর্ধিত পরিবার এভাবেই তাঁকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
বর্ধিত পরিবার আজও আছে। কিন্তু ছেলেমেয়ে বড় করায় তাদের ভূমিকা আজ যেন হারিয়ে গেছে। সন্তান মানুষ করা আজ বাবা-মা’র একক দায়িত্ব হয়ে গেছে। এতে করে শিশুদের জগৎ ছোট হয়ে এসেছে। তাদের অভিজ্ঞতা সীমিত হয়ে পড়েছে।
মিশরীয় কবি আহমেদ শাওকি বলেন,
মা শিক্ষক। তবে পরিবার আরও বড় শিক্ষক। পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের আছে নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা। এগুলো ছেলেমেয়েদের বড় করতে সাহায্য করে। কিংবা শিশুর জীবন বদলে দিতে সাহায্য করে।
ইতিহাস জুড়ে অনেকে বড় বড় মানুষ তাদের সাফল্যের পেছনে কোনো চাচা-মামা বা দাদা-নানার কথা বলেছেন। বাবা-মা’র কথা বলেননি। তাই বর্ধিত পরিবারের সুব্যবহার করুন। তাদের সবাইকে সক্রিয় শিক্ষক বানান। আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনে এদের কার শিক্ষা কাজে লাগবে কে জানে!
সন্তানকে বর্ধিত পরিবারের সাথে জুড়বেন কীভাবে
অনেক পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা একসাথে থাকেন না। ভিন্ন শহরে বা ভিন্ন কোনো দেশে থাকেন। যে কারণে বাচ্চাকাচ্চারা তাদের প্রতি টান অনুভব করে না। সেক্ষেত্রে তাদের সাথে সন্তানদের ভালো সম্পর্ক করাটা একটা চ্যালেঞ্জ। এখানে আমরা কিছু বাস্তব আইডিয়া তুলে ধরছি
- মোবাইলে ছবি দেখিয়ে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। আর নাম, নামের অর্থ, তাদের ব্যাপারে অনুপ্রেরণামূলক কোনো ঘটনা শেয়ার করুন। যেভাবে রাসূল (সাঃ) এর বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের ঘটনা আমরা এ অধ্যায়ে বলেছি।
- সন্তানকে তার বংশগাছ দেখান। দেওয়ালে আঁকতে পারেন। কিংবা
- বড় আর্ট পেপারে। পরিবারের সদস্যদের কিমাত, কেন তাদের দরকার এগুলো তুলে ধরুন।
- অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আজকাল দূরের মানুষদের সাথে যোগাযোগ করা সহজ। স্কাইপে, মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপের মতো অ্যাপগুলোর সঠিক ব্যবহার করুন।
বর্ধিত পরিবারের বিকল্প
অনেক সময় এমন হয় যে, বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা কাছাকাছি থাকেন না। অথবা হতে পারে তারা সেই অর্থে সন্তানের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক নন। তাদের কাছে থাকলে সন্তান ভুল শিখবে। এক্ষেত্রে ভালো বিকল্প খুঁজতে হবে। ভালো বিকল্প হতে পারেন শিক্ষক, প্রতিবেশী। সন্তান বড় করার ভারটা যেন শুধু বাবা-মা’র একার ওপর না-পড়ে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এ অধ্যায়ে আমরা রাসূলের বর্ধিত পরিবারের ব্যাপারে কথা বলেছি। তাদের কারও কারও নাম, তারা কী করতেন সেসব জেনেছি। তাদের কোন কোন ঘটনা বা দিক রাসূল (সাঃ) এর জীবনে প্রভাব ফেলে থাকবে সেগুলোর উল্লেখ করেছি। নিচের টেবিলে আমরা দেখব কীভাবে আমরা রাসূল (সাঃ) এর জীবনের শিক্ষাগুলো বাস্তুবে আমাদের সন্তান বড় করতে কাজে লাগাতে পারি। যাতে করে আমাদের পরিবারের বর্ধিত সদস্যরা আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।
রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের সদস্যগণদের থেকে শিক্ষা
রাসূল (সাঃ) এর পরিবার | আপনার পরিবার |
রাসূল (সাঃ) এতিম অবস্থায় বড় হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে তিনি একাকী বেড়ে ওঠেননি। তার পরিবারের বর্ধিত সদস্যগণ তার বাবা-মা’র অভাব দূর করেছিলেন। | আপনার পরিবারের বর্ধিত সদস্যরা সন্তানের একাকিত্ব দূর করে। যখন সে একাকী অনুভব করবে, তখন তারা সাথে বেড়াতে যেয়ে, রাতে থেকে তার একাকিত্বের কষ্ট দূর করে দিতে পারে। |
শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ) কে তাঁর বর্ধিত পরিবার শিখিয়েছে। অনুপ্রেরণা দিয়েছে। | আপনার বর্ধিত পরিবার আপনার সন্তানকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বিশেষ করে তাদের অনুপ্রেরণামূলক বিভিন্ন কাহিনি শেয়ার করার মাধ্যমে। |
বর্ধিত পরিবার বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) কে অনেক কিছু শিখিয়েছে। দাদার কাছ থেকে নেতৃত্ব, মার কাছ থেকে মমতা, চাচার কাছ থেকে ব্যবসা ইত্যাদি। | আপনার বর্ধিত পরিবারের সদস্যরাও এরকম নানা কিছু শিশুকে শেখাতে পারেন। যেটা আপনার একার পক্ষে সম্ভব না। আপনিও এতে উপকৃত হতে পারেন। |
বর্ধিত পরিবার বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নিরাপত্তা দিয়েছিল। গরিব হলেও সম্ভ্রান্ত পরিবার। | আপনার শিশুকেও তারা অনুরূপ নিরাপত্তা দিতে পারে। বিশেষ সুবিধা পাওয়া সন্তান এরকম অনুভব করার চেয়ে সে যে ভালোবাসাময়, ঐক্যবদ্ধ পরিবারের অংশ সেটা অনুভব করা বেশি জরুরি। |