রাসূল (সাঃ) এর চারপাশ

রাসূল (সাঃ) এর চারপাশ

আশেপাশের পরিবেশ আমাদের প্রভাবিত করে। তবে সেটা পুরোপুরি আমাদের গড়ে দেয় না। কঠিন বা প্রতিকূল পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করতে থাকলে কোনো কাজ হয় না; বরং সক্রিয়ভাবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। আমার সমাজ আমার পাশে না দাঁড়ালে আমাদেরকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।

রাসূল (সাঃ) যখন কিশোর বা তরুণ, তখনো তিনি কিন্তু নবি হননি। তবে তাঁর মধ্যে একটা মজবুত বিশ্বাস ছিল। সে বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি বিদ্যমান সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়েছিলেন। নিজেকে বিকশিত করেছিলেন। সমাজ যখন আমাদের ওপর চেপে আসবে, বেশিরভাগ লোকদের মনমানসিকতার সাথে মিশে যেতে জোরাজুরি করবে, তখন নিজেদের ও আশপাশের পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ খাটাতে হবে। আমাদের সুবিধায় ব্যবহার করতে হবে।

আপন প্রভাব-বলয় বাড়ান

আগের অধ্যায়ে আমরা আট বছর পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) এর বাল্যকাল নিয়ে কথা বলেছি। তাঁর বেড়ে ওঠায় তাঁর মা, দুধ-মা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অবদান নিয়ে কথা বলেছি। এখানে আমরা কথা বলব মক্কায় রাসূল(সাঃ) যে পরিবেশে মানুষ হয়েছেন, সেই পরিবেশ, সেখানকার লোকজন আর সমাজের ব্যাপারে।

চৌদ্দ শ বছর আগে রাসূল (সাঃ) কোনো-না-কোনো পরিবেশে বড় হয়েছেন, তার সাথে আজকের জমানার লেনাদেনা কী? এমন প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। সময় তো এখন আর আগের মতো নেই। মূর্তি, উট কিংবা তলোয়ারের মতো বিষয়গুলো আধুনিক সমাজে অচল। আমরা এখানে সেই সময়ের মক্কার পরিবেশে খুব বেশি ভেতরে যাব না। তখনকার মানুষের মনমানসিকতা, চালচলন বুঝার জন্য যতটুকু প্রয়োজন আমরা শুধু সেটুকুর ব্যাপারে কথা বলব।

রাসূল (সাঃ) যে পরিবেশে মানুষ হয়েছেন, সে পরিবেশের অবস্থা ফুটিয়ে তোলা আমার উদ্দেশ্য। কারণ, কারও জীবন বুঝতে হলে এটা বুঝা জরুরি। আমি চাই, পাঠকরা যে পরিবেশে আছেন, তারা যেন সেটা নিয়েও ভাবেন। কীভাবে সেখানে নিজেদের গড়ে তুলতে পারেন সেটা নিয়ে ভাবেন।

নিজের পরিবেশকে ছাঁচ দেওয়া

রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবনের ৮৫ ভাগ সময় মক্কায় কাটিয়েছেন। ৬৩ বছরের মধ্যে ৫৩ বছর। বহু পরিবারে, বহু ঘরে, নানা পরিবেশে, নানা কাজে কাটিয়েছেন। বিয়ের পর তাঁর নিজের একটা পরিবার হয়। তাঁর বেশকিছু বন্ধুবান্ধবও ছিল।

প্রতিটা পরিবেশে এমন কিছু থাকে, যা সেখানকার মানুষের ওপর কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলে। তবে এখানে মজার বিষয় হচ্ছে, তখনকার পরিবেশে বড় হয়েও কীভাবে রাসূল (সাঃ) নিজেকে আলাদা করেছিলেন। অথচ সেই একই পরিবেশে বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল।

মানুষ তার পরিবেশের ফল। তবে এর মানে এই না যে, এ কারণে তাকে তার নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র হারিয়ে ফেলতে হবে। আমরা দেখব, কীভাবে রাসূল (সাঃ) আশেপাশের মানুষের সাথে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ বজায় রেখে চলেছেন। যেসব কাজ শুধু পুরুষদের কাজ বলে বিবেচিত, সেগুলোতে তখনকার কিছু নারীরা বাধা ঠেলে জয় করেছিলেন, উজ্জ্বল হয়েছিলেন। সেগুলোও দেখব। দেখব আরবদের মধ্যে থেকেও কীভাবে অনেক অনারব নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন। মূর্তিপূজারীদের শেকড় ছিল যেখানে, সেরকম প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও কীভাবে এক আল্লাহর দাসত্বকারীরা আলাদা হয়েছিলেন।

এরা সংখ্যায় কম ছিলেন। অনেকে এদের গোনায় ধরতেন না। কিন্তু সমাজের প্রচলিত আদর্শে তারা গা ভাসিয়ে দেননি। নিজের লোকজন বা সমাজের প্রতি অনুগত থেকেও কীভাবে নিজের বিবেক বিসর্জন দেবেন না, নিজের স্বাতন্ত্র ধরে রাখবেন এ ব্যাপারে এ অধ্যায় আপনাকে অনুপ্রেরণা দেবে।

অন্ধভাবে সমাজের রীতিনীতি গায়ে মাখবেন না। আপনি এ কাজটা কেন করেন, এ ধরনের কথা জিজ্ঞেস করলে দেখবেন বেশিরভাগ লোকই বলবে, লোকে করে, তাই করি। বা এভাবেই চলে আসছে। তারা এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না। আপনি এমন হবেন না। আপনার আদর্শ, আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে কোনটা খাপ খায়, সেভাবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। মক্কা আর মক্কার লোকজন দিয়ে শুরু করি।

মক্কা

মক্কার অবস্থান সাউদি আরাবিয়ার পশ্চিমে। মিশর থেকে সুদান পর্যন্ত বিস্তৃত লোহিত সাগরজুড়ে এর অবস্থান। আয়তন প্রায় ৫ শ বর্গকিলোমিটার। মক্কায় অনেক পাথুরে পাহাড় চোখে পড়ে। এগুলোর কোনো কোনোটার উচ্চতা ৬ শ মিটার। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের চেয়েও দ্বিগুণ। গরমকালে এখানে গড় তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতকালে ২৫ ডিগ্রি।

রাসূল (সাঃ) যখন মক্কায় পুনরায় ইসলামি জীবনব্যবস্থা চালু করেন, তার অনেক আগে থেকেই কিন্তু কাবাঘরের কারণে মক্কা সুপরিচিত ছিল। স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তা আর স্থিতিশীলতা বিরাজ করত সবসময়। আপনি দেখবেন, অন্যান্য শহরগুলো তখন নিজেদের নিরাপত্তার জন্য চারিদিকে শক্ত প্রাচীর বানাত। দুর্গ নির্মাণ করত। সম্ভাব্য শত্রুর হামলা থেকে বাঁচার জন্য এ রকম আরও অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি রাখত। কিন্তু মক্কার সুরক্ষায় এ রকম কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ঐতিহ্যগতভাবে এখানে লড়াই নিষিদ্ধ ছিল।

ইসলাম আসার আগে ওখানকার লোকজন বহু দেবদেবী, মূর্তির পূজা, করত। এসব মূর্তির একটা করে ভাস্কর্য মক্কায় রাখা থাকত যাতে যুদ্ধবিরতি বজায় থাকে। প্রত্যেক অঞ্চলে বা গোষ্ঠীতে আলাদা আলাদা ঈশ্বর ছিল। যেমন তায়েফের লোকদের প্রধান দেবীর নাম ছিল আল্লাত। মদিনার লোকেরা পূজা করত মানাতে। মক্কায় প্রায় ৩৬০টি ভাস্কর্য বা মূর্তি ছিল। এগুলো ছিল আরবদের দেবদেবীর প্রতীক। তো এ কারণে কলহপ্রবণ গোত্রগুলো মক্কাকে পবিত্র শহর হিসেবে সম্মান করত।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে মক্কায় প্রায় বিশ হাজারের মতো লোকজনের বসতি ছিল। আশেপাশের এলাকা গোষ্ঠী অনুযায়ী বিভক্ত ছিল। যাদের পূর্বপুরুষ এক তারা সবাই এক গোষ্ঠীর সদস্য। মক্কার প্রধান গোষ্ঠী ছিল কুরাইশ। রাসূল (সাঃ) এই গোষ্ঠীর। তাদের পূর্বপুরুষ নাযর। রাসূল (সাঃ) এর জন্মের প্রায় ১২ প্রজন্ম আগের। কাবার আশেপাশেই তাদের ঘরদোর ছিল। তারা কাবার রক্ষণাবেক্ষণ করত। তীর্থযাত্রীদের দেখাশোনা করত।

সমাজ

আমরা এখন দেখব সপ্তম শতকে মক্কার সামাজিক পরিবেশ কেমন ছিল সেটা। নারীদের ভূমিকা এবং সংখ্যালঘু অনারবরা কীভাবে সামাজিক বাধা টপকে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন সেটাও দেখব।

প্রতিটা গোষ্ঠীতে অনেকগুলো গোত্র ও বাড়তি পরিবার ছিল। যেমন কুরাইশ গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ নাযর। কিন্তু এর মধ্যে দশটা গোত্র ছিল। এসব গোত্রের প্রধান ছিল নাযরের দশ পুত্র। সমাজের প্রকৃতি ও মানুষের মনমানসিকতার ওপর গোষ্ঠীয় কাঠামোর বড়সড় প্রভাব ছিল। যে গোষ্ঠী যত শক্তিশালী, সেই গোষ্ঠীর মানুষজন নিজেদের তত বেশি নিরাপদ মনে করতেন। কেউ হামলা করলে সেই হামলাকারীর পুরো গোষ্ঠীকে তার দায় বহন করতে হতো। খেসারত হিসেবে সবাই মিলে রক্তমূল্য’ দিত।

কোনো ফুটবল দলের কট্টর সমর্থকরা যেমন সেই দলের চরম অনুগত, সেই সময়ের গোষ্ঠীর লোকদের বিশ্বস্ততা ছিল তেমন। গোত্রের প্রথম পূর্বপুরুষের সাথে যার সম্পর্ক যত কাছের, তার বিশ্বস্ততা তত বেশি। গোত্রবন্ধনের উদাহরণ নিয়ে একটা আরবি প্রবাদ আছেঃ আমি আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে, আমার ভাই ও আমি আমার চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি ও আমার চাচাতো ভাইয়েরা সবাই অপরিচিত লোকের বিরুদ্ধে। একই গোত্রের মধ্যে সহজেই মারামারি লেগে যেত। কুরাইশ গোত্রের নেতা কুসাইয়ের মৃত্যুর পর তার ছেলেদের মধ্যে মারামারি লেগে যায় কাবার দখল নিয়ে (পরের অধ্যায়ে এ ব্যাপারে আরও কথা আছে)।

তবে গোত্রের প্রতি বিশ্বস্ততার মানে এই না যে, কেউ আজীবন তার সঙ্গে থাকবে। গুরুতর কোনো অপরাধের কারণে গোত্রপতিরা মিলে কাউকে বের করে দিতে পারত। যে বের হয়ে যেত তার কপালে আরও শনি ছিল। কারণ, তখন কেউ আর তাকে নিরাপত্তা দিত না। ফলে যে কেউ চাইলে তার ওপর হামলা করতে পারত। সে হতো সহজ শিকার। চাইলে কেউ তাকে মেরেও ফেলতে পারত।

এই অঞ্চলের প্রধান উন্মুক্ত বাজারের নাম ছিল সুক উকাজ। কোনো কোনো গোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কৃত সদস্যের নাম সেখানে জানিয়ে দিত। মদ খাওয়া নিয়ে আল-বারাদ ইব্‌ন কাইস তার গোষ্ঠীর নামহানি করেছিল। তার গোষ্ঠী ৫৯০ সালে বাজারে তাকে ঘোষণা দিয়ে বহিষ্কার করে। কখনো কখনো কোনো কোনো সদস্য এক গোষ্ঠী থেকে বের হয়ে অন্য গোষ্ঠীতে যোগ দিতে পারত। সেক্ষেত্রে তারা তখন সেই গোষ্ঠীর পূর্ণ নিরাপত্তা ভোগ করত। অনেকটা আজকের যুগের সিটিজেনশিপ বা নাগরিকত্ব দেওয়ার মতো। তবে দ্বৈত নাগরিকত্বের মতো দুই গোত্রের অধীনে থাকার সুযোগ ছিল না।

পারস্পরিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য আজকাল যেমন আন্তর্জাতিক জোটচুক্তি হয় তখনও হতো। তখন আন্তগোষ্ঠীয় চুক্তি হতো। যেমন তীর্থযাত্রীদের ভালোভাবে দেখাশোনার জন্য কুরাইশরা মক্কার অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে জোট বেধেছিল। সিরিয়া ও ইয়েমেনে তাদের দুটো বাণিজ্য কাফেলা যেত। তো এগুলো যেন নিরাপদে যাওয়া-আসা করতে পারে, সেজন্য তারা আরব উপদ্বীপের অন্যান্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে বাণিজ্য চুক্তি করে। সূরা কুরাইশে এর উল্লেখ আছে।

গোষ্ঠী আর গোষ্ঠীর সদস্যের মধ্যে যেমন পারস্পরিক নিরাপত্তার অলিখিত চুক্তি ছিল, এসব জোটের মধ্যেও অনুরূপ চুক্তি ছিল। কোনো এক গোষ্ঠীর উপর হামলা মানে পুরো জোটের উপর হামলা। সেই সমাজে আরেক ধরনের সম্পর্ক ছিল- জাওয়ার। কোনো লোক যদি ভিন্ন কোনো অঞ্চলে সফরে যেত, তাহলে তার গোষ্ঠী সেই অঞ্চলের স্থানীয় কোনো গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে নিরাপত্তার আবেদন করতে পারত। আজকের দিনে আন্তর্জাতিক শরণার্থী ব্যবস্থা অনেকটা এর আদলেই তৈরি।

নারী

সমাজ নারীদের প্রতি নিষ্ঠুর ছিল। তখন লড়াই আর কাজেকর্মে পুরুষদের দাম দিত। ইসলাম আসার আগে কমন কিছু কাজের মধ্যে ছিল-

  • মেয়ে জন্ম দেওয়ার কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দিত।
  • বহুবিবাহের কোনো সীমা ছিল না। এক পুরুষ একাধিক বোনকে একসাথে বিয়ে করতে পারত।
  • বিয়ের পর অন্য নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য ছিল।
  • ছেলে সন্তানের আশায় যদি মেয়ে সন্তান হতো তাহলে সেই মেয়েকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হতো। কী নৃশংস! কুরআন পরে এই চর্চা নিষিদ্ধ করে। আত তাকভীর : আয়াত ৮-৯

নারীদের প্রতি সমাজে এত উল্টোস্রোত থাকার পরও কিছু নারী সমাজে নিজেদের আলাদা অবস্থান করে নিতে পেরেছিলেন। পুরুষরা তাদেরকে তাদের সমান ভাবত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন –

  • খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ: বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। যুবক মুহাম্মাদ (সাঃ) কে তার ব্যবসা দেখাশোনার কাজে নিয়োগ দেন। পরে তাকে বিয়ে করেন।
  • আরওয়া বিনতে হারব: আবু লাহারে স্ত্রী। তার প্ররোচনাতেই আবু লাহাব তার ভাতিজার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে ছিল। শুধু তাই না, তার প্রভাব এত বেশি ছিল যে, তিনি তার দুই ছেলেকে দিয়ে রাসূল (সাঃ) এর দুই মেয়েকে তালাক দেওয়ান।

ইসলামে এই দুই নারীর অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই প্রান্তে। তবে তারা দুজনই যে সমাজের প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে দুজনেই এক। ব্যবসায়ী হিসেবে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিচক্ষণ ছিলেন। ব্যবসাপাতির সবকিছুতে তখন ছিল পুরুষদের একচেটিয়া আধিপত্য। এ রকম পরিবেশেও তিনি তার বিচারবুদ্ধি ও পুঁজির সফল প্রয়োগ করেছিলেন। আপনার পরিস্থিতিও এমন হতে পারে। আপনার পরিবার, জীবনসঙ্গী বা বস আপনার সমর্থন -ই করতে পারে। ওসব গায়ে না মেখে আপনি বরং নিজের প্রতিভা বের করে সেটা কাজে লাগান।

বিদেশিরা

আফ্রিকা, সিরিয়া, মিশর, ইরাকের ব্যবসায়ী ও কারিগরদের অনেকে মক্কায় থাকতেন। এদের মধ্যে দাস ও স্বাধীন উভয় ধরনের মানুষ ছিলেন। তারা ছিলেন আরব অনারবের মিক্স। এদের বেশিরভাগই বাইজেন্টাইনের খ্রিষ্টানদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে এখানে পালিয়ে এসেছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে কেউ কেউ মক্কা ও তার আশেপাশের এলাকায় কাজের খোঁজে এসেছিলেন।

এদের সংখ্যা ঠিক কত সে ব্যাপারে জানা যায় না। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে ধারণা এদের সংখ্যা কয়েক শ হবে। ধর্মবিশ্বাসে এরা খ্রিষ্টান। কামার, ট্যানার, স্বর্ণকার ও অন্যান্য কারিগরি দক্ষতায় এদের কদর ছিল। তাছাড়া স্থানীয় জনগণের সাথে তাদের সম্ভাব ছিল।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের কিন্তু কোনো গোষ্ঠীয় নিরাপত্তা ছিল না। তারপরও এরা তাদের বিশেষ দক্ষতা আর প্রতিভার কারণে সমাজে সফল হয়েছিলেন। যেমন –

  • জাবরা আর-রুমি: তিনি পেশায় ছিলেন কামার। ধর্মগ্রন্থের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। রাসূল (সাঃ) এর ভালো বন্ধু ছিলেন। মূর্তিপূজারি আরবদের কেউ কেউ এজন্য দাবি করেছিল যে, এই লোকই নবিকে কুরআন শিখিয়েছে। কুরআনের এক আয়াতে এই অভিযোগের উল্লেখ আছে, ‘আমি ভালো করেই জানি তারা কী বলে। তারা বলে, নবিকে তো এক লোক এসব শিখিয়ে দেয়। তারা যে লোকের কথা বলে তার ভাষা তো অনারবি। অথচ এই কুরআন স্পষ্ট আরবিতে। আন নাহল : ১০৩
  • ইয়াসার আর রুমিঃ তিনি জাবরার বন্ধু। ধর্মগ্রন্থের প্রতি তারও বেশ আগ্রহ ছিল। দুজনের নামের শেষে রুমি আছে বলে ভাববেন না তাদের মধ্যে পারিবারিক কোনো সম্পর্ক আছে। রুমি নামে বিখ্যাত এক সুফি কবি আছেন। এর মানে আসলে ‘রোমান’ বা বাইজেন্টাইন। ঐ অঞ্চল থেকে যারা আসত তাদেরকে এই নাম দেওয়া হতো।
  • সুহাইব আর রুমি: মক্কায় এসেছিলেন এক কাপড়ে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেখানকার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লেখান।

এছাড়াও আরও অনেক বিদেশি ছিলেন। যেমন পারস্যের সালমান ফারসি। সিরিয়ার বালাআম সুরি। ইথিয়োপিয়ার বিলাল হাবশি। কপটিক এক কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। তার নাম জানা যায় না। সেই সময়ের আরবে ভাষাদক্ষতার আলাদা কদর ছিল। তাদের ভিন্ন মর্যাদায় দেখা হতো। কিন্তু অনারবরা কথা বলতেন ভাঙা ভাঙা আরবিতে। তবে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতার কারণে তারা অন্যদের ছাড়িয়ে যান।

ক্ল্যাসিকাল আরবি জানেন না বলে আজকাল অনেকে হীনমন্যতায় ভোগেন। কিন্তু মক্কায় ভিনদেশিদের সাফল্য আমাদের ভিন্ন কথা বলে। নিজের দুর্বল দিক নিয়ে পড়ে থাকার মানে হয় না; বরং নিজের শক্তির দিকগুলো ঝালাই করার দিকে অনুপ্রেরণা দেয়।

টম রুথ তার স্ট্রেনথস ফাইন্ডার ২.০ বইতে বলেছেন, নিজের কমতিগুলো পূরণ করার চেয়ে শক্তির দিকগুলো বিকশিত করার পেছনে শ্রম দিলে সাফল্যের সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন, যারা নিজেদের শক্তির দিকটাতে বেশি ফোকাস করেন, তারা তাদের কাজে ছয়গুণ বেশি মগ্ন থাকতে পারেন। সাধারণভাবে তাদের জীবনের মান তিনগুণ বেশি থাকে বলে তারা বলে থাকেন।

আমি কাউকে আরবি ভাষা বা অন্য কোনো দক্ষতা শিখতে নিষেধ করছি না। শুধু সতর্ক করছি, আপনি নিজে যাতে ভালো, সেটাকে উপেক্ষা করে বা সেটার কদর না করে অন্য কিছু নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন না।

উকাজ বাজারে মুহাম্মাদ, ব্যবসায় ও জনমণ্ডলে নারীরা এবং বিদেশি সংখ্যালঘুরা আমাদেরকে মানুষের আসল শক্তি দেখায়। উদ্বেগের জায়গা নিয়ে মাথা নষ্ট না-করে, তারা যাতে ভালো সেটা নিয়ে কাজ করেছেন। হাতের কাছে সব উপায় উপকরণ থাকুক কী না-থাকুক, সমাজের সাহায্য পান কী না-পান, যেখানেই থাকুন নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করুন। নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ধরে রাখুন।

অর্থনীতি

কৃষিকাজের জন্য মক্কার আবহাওয়া ছিল বৈরি। সেই সময়ে সেখানকার অর্থনীতি পুরোটাই ছিল বাণিজ্যনির্ভর। তৎলীন দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ইয়েমেন আর সিরিয়া ছিল মক্কার দুপাশে। অর্থনীতি চাঙা রাখতে তারা এর ভালো ব্যবহার করেছিল।

দেশিবিদেশি নানারকম পণ্য মক্কায় যেত। ভারত, মিশর, সিরিয়া, পারস্য ও ইয়েমেন থেকে পারফিউম, অলংকার, পোশাক, খাবার আমদানি করা হতো। সিরিয়া ও ইয়েমেনে বছরে গড়ে সাত সাতটা বাণিজ্য কাফেলা যেত। আরবের বাজারে এসব পণ্যের বিপুল চাহিদা তারা জানত। হাটবাজার ও হজ্জের মৌসুমে তাই এগুলো পাওয়ার সুব্যবস্থা করত।

ব্যবসায়ী হিসেবে কুরাইশদের তীক্ষ্ন বিচারবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় আমর ইবনুল আসের ঘটনায়। মুসলিম শরণার্থীরা ইথিয়োপিয়াতে গিয়েছিলেন। তাদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করার জন্য কুরাইশ মূর্তিপূজারীরা তাকে পাঠিয়েছিলেন বনিবনা করার জন্য। তিনি উপহার হিসেবে পোড়ানো চামড়া নিয়ে গিয়েছিলেন। ঝানু ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি জানতেন চামড়ার ব্যাপারে ইথিয়োপিয়ানদের দুর্বলতা।

ইরাক আর সিরিয়া থেকে মালামাল নিয়ে মক্কার ব্যবসায়ীরা নিয়মিত ইথিয়োপিয়া যাতায়াত করতেন। ফিরে আসতেন ইথিয়োপিয়ান পণ্যসামগ্রী নিয়ে। ব্যবসা খাতে সরাসরি অনেকে কাজ করতেন। নারীরা বা যারা বয়সের কারণে পরতেন না, তারা টাকা বিনিয়োগ করতেন। বা তাদের পক্ষে মালামাল বিক্রির জন্য অন্যদের ভাড়ায় খাটাতেন।

তো এই ছিল মক্কার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আমরা একটু-আধটু দেখেছি মক্কার লোকজনদের মনমানসিকতা। দেখেছি কীভাবে সেখানকার নারী ও বিদেশিরা প্রতিকূল পরিবেশে সফল হয়েছিলেন।

আমি এখন মক্কার বাজারের ভেতরে ঢুকব। দেখব সেখানে রাসূল (সাঃ) কী করতেন। আমরা খুব বেশি ভেতরে ঢুকব না। শুধু দেখার চেষ্টা করব, যে পরিবেশে তিনি জীবনযাপন করেছিলেন সেটা। আমার উদ্দেশ্য, পরিবেশের ভেতর ডুবে না-যেয়েও বা নিজের স্বাতন্ত্র না। হারিয়েও আপনি যে তার মনিব হতে পারেন সেটা দেখানো।

বাজার

পর্যটনশিল্প আজকের জমানায় একটি দেশের অন্যতম আয়ের উৎস। মক্কায় সেটা ছিল হজের মৌসুম। আরবদের কেনাকাটার ব্যাপারও ছিল। মক্কার প্রধান মার্কেটগুলো কোনো এক জায়গায় নির্দিষ্ট ছিল না। বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন জায়গায় বসত। নামকরা মার্কেটগুলোর মধ্যে ছিল মিজানা, যুল-মিজাজ, উকাজ।

সুক উকাজ মক্কার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মার্কেট। সুক মানে বাজার বা মার্কেট। সেটা শুধু মার্কেটই ছিল না। এটা ছিল বার্ষিক উৎসব। এখানে কবিতা পাঠের আসর বসত। অ্যাথলেটিকরা তাদের ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখাত। দেশিবিদেশি পণ্যের পসরা বসত।

সুক উকাজের সোনালি সময়টাতেই কিন্তু রাসুল (সাঃ) ওখানে কাটিয়েছেন। সেখান থেকে কেনাকাটা করেছেন। কিন্তু এর নোংরামি থেকে দূরে ছিলেন। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক জাঁকজমকপূর্ণ মার্কেটের মতো এখানেও জুয়া, পতিতালয়সহ অন্যান্য অশ্লীল কাজের আখরা বসত। রাসূল (সাঃ) ও বেশ স্মার্ট ছিলেন। তিনি শুধু তার ব্যবসা করতেন। এসব ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। সপ্তম শতকের আরবের বাজারে প্রতিদিনকার একটা চিত্রের বর্ণনা দিচ্ছি-

সুক উকাজ

কী হতো না সেখানে? কেনাবেচা, কবিতা প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর দান-খয়রাতমূলক কাজসহ কত কী। তারা গরিবদের খাওয়াত। ভিখারিদের ভিক্ষা দিত। মুক্তিপণ দিত। বন্দীদের মুক্ত করত। বিবাদ মীমাংসা, সন্ধিচুক্তি এগুলোও হতো।

মক্কা, তায়েফ, মদিনা থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠী ভিড় করত। বাহরাইন, উমান, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাকের মতো দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন আসত। মার্কেটের সীমানার বাইরে তাদের তাঁবু টাঙাত। প্রত্যেক গোষ্ঠী তাঁবুর সামনে তাদের ব্যানার ঝুলিয়ে রাখত। তারা তাদের সাথে পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসত বেচার জন্য। প্রত্যেক গোষ্ঠী তাদের সবচেয়ে প্রতিভাধর কবিকে নিয়ে আসত। তাদের কাজ ছিল নিজ নিজ গোষ্ঠীর স্তুতি করা।

নোংরামিও চলত পাল্লা দিয়ে। শারীরিকভাবে উত্যক্ত করা, হয়রানি করা নিয়ে কখনো কখনো গোলাযোগ বেধে যেত। জুয়া আর পতিতাবৃত্তির আখড়া ছিল অগণিত। শহরে প্রথমবারের মতো আসা বড় বড় চোখের বেদুইন ছেলেদের তারা আকৃষ্ট করার চেষ্টা করত। চুরিচামারি, ধোঁকাবাজি, সুযোগ গ্রহণের মতো বিষয় তো ছিলই।

বাজারে রাসূল (সাঃ)

সময়ের ঘড়িতে চড়ে আপনি যদি সেই সময়ের সুক উকাজে যেতে পারতেন, তাহলে অবাক করা কিছু ব্যাপারস্যাপার দেখতেন। সে সময়ের জন্য অবশ্য সেগুলো স্বাভাবিক ছিল। নারীরা তো বোরকা পরতই, অনেক পুরুষেরাও তাদের মুখ ঢেকে চলত।

অনেকে বলেন, তারা তাদের সুদর্শন চেহারা ঢাকার জন্য এমনটা করতেন। তবে সবার ব্যাপারে এমনটা হওয়া সংগত না। কেউ কেউ বলেন, তাদের ঘিরে রহস্যের জাল বোনার জন্য এমন করতেন। তবে যে কারণটা বেশি বাস্তবসম্মত তা হলো, তাদের যাতে চেনা না-যায়। নাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাদের অপহরণ করতে পারে।

আপনি হয়ত দেখতেন লোকজন এক জায়গায় জড়ো হয়ে গল্পগুজব করছে। কিচ্ছাকাহিনি রটাচ্ছে। কোনো গণক তির ছুড়ে হ্যাঁ-না’র মাধ্যমে কোনো কাজের ভবিষ্যত নির্ধারণ করছেন। আজকের যুগের ম্যাজিক এইট বলের মতো।

মানুষ, পণ্য আর কাজকর্মের এক রঙিন আনন্দবাজার ছিল সুক উকাজ। রাসূল মক্কার মার্কেটের এ রকম রমরমা সময়েই জীবনযাপন করেছেন। ব্যবসা করেছেন। কিন্তু ভালো-খারাপ আলাদা করে চলার মতো বোধবুদ্ধি তাঁর ছিল।

দেখে যদিও মনে হতো বাজারে সবাই বুঝি নোংরামিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে, রাসূল (সাঃ) কিন্তু বিচক্ষণতার সাথে তা এড়িয়ে চলতেন। নিজের মূলনীতি ও বিশ্বাস দিয়ে সমাজের কাজকর্ম যাচাই করতেন। সমাজ কোনোকিছুকে ভালো চোখে দেখে বলে অন্ধের মতো তিনি তা গ্রহণ করেননি। খারাপ জানলে ঠিকই এড়িয়ে যেতেন। মার্কেটে রাসূল (সাঃ) জিনিসপত্র বেচেছেন। কিনেছেন। এর বাইরে নিজের জীবন ও স্রষ্টার ব্যাপারে ভাবনা জাগানো বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন।

হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূল (সাঃ) এর বয়স যখন বিশ, তখন সুক উকাজে কিস্ ইব্‌ন্‌ সাদারের বিখ্যাত এক ভাষণ শোনেন। তিনি মানুষদের সতর্ক করে দিচ্ছিলেন যে, মানুষগুলো আল্লাহর ব্যাপারে বেখেয়াল। আশপাশের মানুষগুলো অযথা ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু তিনি মন দিয়ে তার কথা শুনেছেন। এ থেকে ধর্মের ব্যাপারে তার আদি উৎসাহের ধারণা পাওয়া যায়।

কিস তার ভাষণে যা বলেছেন তা নিম্নরূপ-

যারা একদিন বেঁচে ছিল, তারা আজ মারা গেছে। আর যারা মারা গেছে তাদের সব সুযোগ শেষ…। মানুষজন কি ভেবেছে দুনিয়াতে এসে আর ফিরে যাবে না? তারা কি তাদের কবর নিয়ে খুব খুশি? তারা কি সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নাকি সেখানে তাদেরকে ঘুমানোর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে? চুলোয় যাক খামখেয়ালি শাসক, পরিত্যাক্ত জাতি আর কালের খাতায় হারিয়ে যাওয়া শতাব্দী..। যারা উচু উচু অট্টালিকা বানিয়েছিল আজ তারা কোথায়? যারা সাজিয়েছিল, আরামের ব্যবস্থা করেছিল তারা আজ কোথায়…? তারা তোমাদের চেয়ে বড়লোক ছিল না? বেশিদিন জীবিত ছিল না…? এখন তাদের হাড্ডি ক্ষয় হয়ে গেছে। তাদের ঘরবাড়িগুলো পরিত্যক্ত। বেওয়ারিশ কুকুর এখন সেখানে থাকে। কেবল মহান আল্লাহ চিরজীবী। তিনি একজনই। শুধু তিনি উপাসনা পাওয়ার অধিকারী। তাঁর কোনো বাবা-মা নেই। বাচ্চাকাচ্চাও নেই।

এই কথা শোনারও আরও বিশ বছর পর রাসুল (সাঃ) নবিত্বের দায়িত্ব পান। কিন্তু তখনো এই কথাগুলো তাঁর মাথায় ছিল। এই কথার এত গুরুত্ব কী? বিশ বছর বয়সী এক তরুণের জন্য বাজারের নানা প্রলোভন ছেড়ে এ ধরনের বক্তব্য শোনা কি ব্যতিক্রম না? সমাজের দোহাই দিয়ে রাসূল কি গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন? তিনি কি ভালোটা বেছে নেননি? আমরা যারা প্রতিকুল সমাজে থাকি, যেখানে সবসময় খারাপ পথের ডাক, সেখানে থেকেও কীভাবে সঠিকটা বেছে নিতে পারি, সে ব্যাপারে এই ঘটনা থেকে আমরা অনেক উপকার নিতে পারি। তরুণ ভাইবোনেরা খেয়াল করছেন তো?

প্রভাব বলয়

আমাদের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে ঘ্যানঘ্যান না-করে আমাদের প্রভাব বলয় বাড়ানোর ব্যাপারে কাজ করা উচিত। উদ্বিগ্ন বলয় হচ্ছে, সেসব সমস্যা যেগুলো আমাদের উদ্বিগ্ন করে। যেমন- নীতিবোধ বিসর্জন, অন্যান্য লোকদের আচারআচরণ। প্রভাব বলয় হচ্ছে, যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমরা হয়ত অন্যের আচার-আচরণ না-ও বদলাতে পারি। কিন্তু আমরা নিজেদের নিয়ে তো ভাবতে পারি? নিজেদের নিয়ে আরও সক্রিয় ভূমিকা তো পালন করতে পারি?

রাসূল (সাঃ) এর বেলায় কী হয়েছিল দেখুন। সুক উকাজে কেউ লেকচার শুনতে আসত না। কিস্ ইব্‌ন্‌ সাদরের কথা মাথায় রাখা তো দূরের কথা, শুনতেই বা কজন দাঁড়াত! আর বাজারের যা পরিবেশ ছিল, তাতে ওদিকে কারও খেয়ালও হতো না। সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে লোকজন বাজারে আসত। (কিসের ভাষায় বেখেয়াল।) অন্যান্য তরুণেরা যেখানে বাজারের নোংরামিতে ঢলে পড়েছিল, রাসূল (সাঃ) সেখানে বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য শুনেছেন। জ্ঞান খুঁজেছেন। তিনি সেই সমাজ থেকে সরে পড়েননি। কিন্তু খারাপ পথ থেকে ঠিকই দূরে থেকেছেন। অন্যান্য তরুণদের মতো না।

মূর্তিপূজা

ষষ্ঠ শতকে আরব উপদ্বীপে বহু ধর্মীয় বিশ্বাসের অস্তিত্ব ছিল। মূর্তিপূজা বা বহু ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল অন্যতম। আরবের এই বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসের ধরন। আজ আর নেই। যে কারণে এটা বুঝতে অনেকের সমস্যা হয় আজ।

মক্কার মূর্তিপূজারিরা আল্লাহকে বিশ্বাস করত বটে। কিন্তু তাঁর সাথে অন্য অনেক কিছুকে পবিত্র মনে করে পূজা করত। যেমন- সূর্য। লোকজন সূর্যের সামনে মাথা নোয়াত। ছেলেপেলের নামও রখিত আবদুশ শাম্স্ অর্থাৎ, সূর্যদাস। যারা ফেরেশতা বা অ্যাঞ্জেলদের পূজা করত, তারা ভাবত এরা আল্লাহর মেয়ে। মানে তারা আল্লাহর ইবাদত করত। তবে সাথে সাথে অন্যান্য বস্তু বা দেবদেবীকে আরাধনার তুল্য মনে করত।

এই অধ্যায়ের বাকি অংশে আমরা কথা বলব ষষ্ঠ শতকের শেষ ও সপ্তম শতকের শুরুর দিকে মক্কার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে। মূর্তিপূজারিদের মাঝে কিছু লোক এমনও ছিল যারা শুধু আল্লাহর উপাসনা করত। এদের পরিচয় ছিল ‘হানিফ’। সমাজের বেশিরভাগের লোকের বিশ্বাসের চেয়ে এদের বিশ্বাস আলাদা ছিল। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, এমন বিরূপ পরিবেশে থেকেও রাসূল কীভাবে তাঁর প্রভাব বলয় বাড়াতে পেরেছিলেন। নিজের ব্যাপারে ভেবেছিলেন সেটা দেখা।

আল্লাহর উপাসনাকারীরা

মক্কার সবাই বহুদেবদেবীর পূজারি ছিল না। ওখানে কিছু ইহুদি, খ্রিষ্টান, মানদাইন (আজকেও এদের অস্তিত্ব আছে। বড়জোড় এদের সংখ্যা ষাট থেকে সত্তর হাজার। মূলত উত্তর ইরাকে থাকলেও ২০০৩ সালের পর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।) ও এক স্রষ্টায় বিশ্বাসীরা ছিল। এক স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্বাসের ধরনে তারতম্য ছিল। তবে তারা সবাই বিশ্বাস করত যে, নবি ইবরাহীম আলাইহিস-সালাম কাবাঘর তৈরি করেছেন। আর তিনি আল্লাহর দাসত্ব করতেন।

ইবরাহীম নবি কীভাবে আল্লাহর উপাসনা করতেন তা নিয়ে অবশ্য তারা একমত ছিলেন না। সম্ভবত তারা বিষয়টা ভালোভাবে জানতেন না। এদের কেউ কেউ ইহুদি বা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলামিক ইতিহাসবিদগণ এদেরকে আহনাফ’ নাম দিয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল বড় জ্ঞানী ব্যক্তি। হিব্রু ভাষা ও ধর্মীয় ইতিহাস সম্পর্কেও জানতেন। যাইদ আমর মক্কার সমাজের সমালোচনা করতেন। তার ধর্মবিশ্বাসের কারণে তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। হানিফরা সংখ্যায় ছিল খুব কম। তারপরও তারা তাদের বিশ্বাস ধরে রাখতে পেরেছিলেন।

দেখেন, তারা যে সমাজে ছিল সেখানে এ ধরনের বিশ্বাস ছিল উদ্ভট। অপমানের ব্যাপার তো আছেই। সমাজে যার চলন ছিল অন্ধের মতো, তারা তা অনুকরণ করেননি। নিজের বিশ্বাস দিয়ে তারা তাদের মূলনীতি গঠন করেছিলেন। তাতে অটল ছিলেন। আমাদেরও উচিত আমাদের বিবেকবুদ্ধি দিয়ে নিজের জন্য চিন্তাভাবনা করা।

নিজের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ

সে সময়কার মক্কার ব্যাপারে বলতে গেলে আরও অনেক কিছু বলা যায়। তবে আমরা এখানে সাধারণভাবে সমাজের একটা রূপ তুলে ধরেছি। সমাজের এ অবস্থাতেই রাসূল (সাঃ) বড় হয়েছেন। তবে সমাজ তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি; বরং তিনি তাঁর পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।

প্রকৃতি বনাম পরিচর্যা

পরের অধ্যায়ে আমি রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের বাড়তি সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলব। কীভাবে তারা রাসূলের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সেটা নিয়ে বলব। তবে এ অধ্যায়ে একটা বিশেষ দিকের কথা বলে শেষ করাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি।

প্রকৃতি বনাম পরিচর্যার বিতর্ক শতকের পর শতক ধরে চলে আসছে। কোনো সমাধান হয়নি। মানুষের বিকাশে প্রকৃতিই সব নাকি তার পরিচর্যা। এটা নিয়ে যত বিতর্ক। তবে আমার কাছে এর সবচেয়ে বাস্তবভিত্তিক সমাধান হচ্ছে, আমাদের পরিবেশ বা জিন কোনোটাই না। আমি নিজেই।

আপনার পরিবেশ, আপনার আশেপাশের লোকজনদের সাথে আপনার ব্যবহার কেমন হবে সেটা আপনারই হাতে। আপনার পরিবেশ ও জিন গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিষয়টাকে এমন ভেবে ভুল করবেন না যে, নিজের গতিপথ নির্ধারণে আমার কোনো ক্ষমতাই নেই।

এই অধ্যায়ে আমরা দেখেছি মানুষের বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা। অনেকে তাদের পরিবেশের ওপর কর্তৃত্ব করেছিলেন। অনেকে মুখোমুখি হয়েছেন কঠিন সব পরিস্থিতি ও অসহায়ক পরিবেশের। তারা এসব প্রতিবন্ধকতাকে মাড়িয়ে সমাজে জায়গা করে নিয়েছিলেন। নিচের টেবিলে এসব অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণগুলো আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো :

রাসূল (সাঃ) এর পরিবেশ থেকে আমাদের কী লাভ

রাসূল (সাঃ) এর পরিবেশআপনার পরিবেশ
তাঁর চারপাশে অনেক প্রলোভন ছিল। তবে ভালো কিছু বিকল্পও ছিল। যেমন : বাজারে কিস ইব্‌ন সাদার মন নাড়িয়ে দেওয়া লেকচার।নিজের চারপাশ নিয়ে অভিযোগ করবেন না। আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে উপযোগী সুযোগ ও বিকল্প খুঁজুন। এরপর নিজেকে বিকশিত করুন।
বহু দেব-দেবীর পূজো করার জন্য সেই সমাজে বহু চাপ ছিল। কিন্তু তারপরও এক আল্লাহর উপাসনাকারীরা সেই চাপ প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন।সমাজে সবাই কিছু একটা করছে, বা সেটাই প্রবল এই ভেবে সেগুলো অনুসরণ করতে যাবেন না। নিজের বিশ্বাস প্রত্যয় প্রকাশের চেষ্টা করুন।
রাসূল (সাঃ) এর আরব সমাজে অনারবদের নিচু চোখে দেখা হতো। কিন্তু তারপরও কেউ কেউ তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার গুণে সফল হয়েছিলেন।সংখ্যালঘু হলেও আপনি আপনার প্রতিভা ও দক্ষতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকুন। দেখবেন যে এজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠরা একদিন আপনাকে সম্মান করছে।
রাসূল (সাঃ) এর আরবসমাজ প্রচণ্ড নারীবিরোধী ছিল। তারপরও কেউ কেউ বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন।নিজের প্রতিভার প্রকাশ ঘটান। যদিও সমাজ আপনাকে যথেষ্ট সহযোগিতা না -করে বা উৎসাহ না দেয়।

.

১. ইসলামপূর্ব আরবের তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে, মুহাম্মাদ ইয্‌যাত দারু’র দ্য এজ অফ দ্য প্রফেট ও অ্যান্ড হিজ এনভায়রোনমেন্ট বিফোর দ্য মিশন বই থেকে।

২. বৈরী পরিবেশে মুসলিম সমাজে খ্যাতিলাভকারী নারীদের ব্যাপারে আরও জানতে ‘উইমেন ইন্সপায়ারভ বাই দ্য বিলাভড’ (লন্ডন, ২০০৭) নামে আমার অডিও লেকচার শুনুন।

৩. দেখুন- রুখ, স্ট্রেস ফাইন্ডার ২.০।

৪. উকায বাজারের বেশিরভাগ তথ্য নেওয়া হয়েছে হাম্মুর রচিত সুক উকা ওয়া মাওয়াসিফুল হজ্জ বই থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *