রাসপুতিন

রাসপুতিন

এক-একটা দুঃখ মানুষ আমৃত্যু বয়ে চলে। আমরা নিজের কথা যদি বলার অনুমতি দেন, তবে নিবেদন করি, অধ্যাপক বদানফের আমাকে বলা তাঁর নিজের জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আমি যে কেন তখনই লিখে রাখিনি সেই নিয়ে আমার শোক, এ-শোক আমার কখনও যাবে না। তারই একটি ১৯১৭-র কম্যুনিস্ট বিপ্লব। তিনি অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং সমস্ত ঘটনাটি বর্ণনা করতে তাঁর লেগেছিল পুরো ন টি ঘণ্টা। শান্তিনিকেতনে আশ্রমের ইস্কুলের শোবার ঘণ্টা পড়ে রাত নটার সময়; আমি কলেজে পড়তুম বলে অধ্যাপকের ঘরে ওই সময়ে যেতে কোনও বাধা ছিল না। পরপর তিন রাত্রি ধরে রাত বারোটা-একটা অবধি তিনি আমাকে সে ইতিহাস বলে যান। অবশ্য অনেকেই বলতে পারেন, ওই যুগপরিবর্তনকারী আন্দোলন সম্বন্ধে বিস্তর প্রামাণিক পুস্তক লেখা হয়ে গিয়েছে এবং অধ্যাপক বদানফের পাঠটা খোয়া গিয়ে থাকলে এমন কীই-বা ক্ষতি। হয়তো সেটা সত্য, কিন্তু ওই বিষয়ে আমি যে কটি সামান্য বই পড়েছি তার সব কটাই বড়ই পাণ্ডিত্যপূর্ণ, বৈজ্ঞানিক। বদানফ তার কাহিনী বলেছিলেন একটি ষোল বছরের ছোকরাকে ঘটনার মাত্র চার-পাঁচ বৎসর পরে এবং সেটি তিনি তাই করেছিলেন সেই অনুযায়ী রসময়, অর্থাৎ সাহিত্যরসে পরিপূর্ণ। এস্থলে বলে রাখা প্রয়োজন মনে করি, অধ্যাপকের বর্ণনভঙ্গিটি ছিল অসাধারণ, তাই পরবর্তী যুগে তার ইরান ও আফগানিস্তান (এ দুটি দেশে তিনি দীর্ঘকাল বাস করেন) সম্বন্ধে লিখিত গবেষণামূলক পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধরাজি পণ্ডিতমণ্ডলীতে সাহিত্যিক খ্যাতিও পায়। মাতৃভাষা রাশানে তিনি লিখেছেন কমই– তাঁর পাণ্ডিত্যপ্রকাশ-যুগে রাশাতে এ ধরনের গবেষণার কোনওই মূল্য ছিল না বলে সেগুলো সেখানে ছাপানোই ছিল অসম্ভব। তিনি প্রধানত লেখেন ফরাসি, ইংরেজি ও ফার্সির মাধ্যমে। এবং সবচেয়ে বেশি সম্মান পান ফার্সি পণ্ডিতজন মধ্যে।(১)

তিনি যে দ্বিতীয় কাহিনী বলেন, সেটি রাসপুতিন সম্বন্ধে। প্রথমটির তুলনায় এটি অনেক হ্রস্ব। রাসপুতিনকে নিহত করা হয়, পুরনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর, নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩০ ডিসেম্বর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। এর প্রায় কুড়ি বৎসর পর রাসপুতিনকে নিয়ে আমেরিকায় একটি ফিলম্ তৈরি হয় (এবং আমার যতদূর মনে পড়ে লায়োনেল বেরিয়োর রাসপুতিনের অংশ কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেন) এবং ওই সময় রাসপুতিন-হন্তা রাশার শেষ জারের নিকটাত্মীয় গ্র্যান্ড ডিউক ইউসুপ (আরবি হিব্রুতে ইউসুফ, ইংরেজিতে জোসেফ) ইয়োরোপে। ১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের মধ্যে তিনি ও তার স্ত্রী সেই সব ভাগ্যবানদের দু জনা, যারা প্রাণ নিয়ে রাশা থেকে পালাতে সক্ষম হন। তিনি লন্ডন আদালতে মোকদ্দমা করেন ফিনির্মাতাদের (বোধ হয় MGM) বিরুদ্ধে যে, তারা যে ফিমের ইঙ্গিত দিয়েছেন, রাসপুতিন তার অর্থাৎ ইউসুপফের স্ত্রীকে পর্যন্ত তাঁর কামানলের দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি মোকদ্দমাটি হেরে যান বটে, কিন্তু ওই মোকদ্দমাটি তখন এমনই cause celebre কজ্ব সেহ্রে রূপে যেমন আমাদের ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মোকদ্দমা প্রখ্যাতি লাভ করে যে তার অল্প দু-এক বৎসর পর ওই মোকদ্দমায় প্রধান অংশগ্রহণকারী একজন উকিল মোকদ্দমাটি সম্বন্ধে একটি প্রামাণিক এবং আমি বলব– সাহিত্যিক উচ্চপর্যায়ের প্রবন্ধ লেখেন। তিনি যদিও ইউসুপফের বিরুদ্ধ পক্ষের উকিল ছিলেন, তবু আদালতে ইউসুফ দম্পতির খানদানি সৌম্য আচরণের অকৃপণ প্রশংসা করেন। তার পর হয়তো আরো অনেক কিছু ঘটেছিল। কিন্তু তার খবর আমার কাছে পৌঁছয়নি। হঠাৎ গত মাসের ‘আনন্দবাজারে’র এক ইস্যুতে দেখি, ইউসুপফ ফের মোকদ্দমা করেছেন– এবার কিন্তু আমেরিকায়, কলাম্বিয়া বেতার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাসপুতিন ও তাঁর জীবন নিয়ে নাট্যপ্রচার করার জন্য এবং আবার মোকদ্দমা হেরেছেন। সেই সুবাদে আমার মনটা চলে গেল ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে, যখন অধ্যাপক বদান রাসপুতিন-কাহিনী আমাকে ঘণ্টা তিনেক ধরে শোনান।

পরবর্তী যুগে ফিলম বেরুল, তার পর লন্ডনের উকিল তার বক্তব্য বললেন, এবং ‘আনন্দবাজার’ বিদেশ থেকে যে সংবাদ পেয়েছেন, তাই প্রকাশ করেছেন। এদের ভিতর পরস্পরবিরোধ তো রয়েইছে, কিন্তু আমার পক্ষ থেকে এ-স্থলে আসল বক্তব্য এই যে, বদানফ বলেছিলেন, সম্পূর্ণ না হোক, অনেকখানি ভিন্ন কাহিনী। আমি আদৌ বলতে চাইনে, তার বিবরণী, জবানি বা ভার্সন– যাই বলুন– সেইটেই নির্ভুল আপ্তবাক্য; বস্তুত তিনি নিজেই আমাকে বারবার বলেছিলেন, ‘মাই বয়! সেন্ট পেটেরসবুর্গে তখন এত হাজারও রকমের গুজব নিত্য নিত্য ডিউক সম্প্রদায় থেকে আস্তাবলের ছোকরাটা পর্যন্ত গরমাগরম এ-মুখ থেকে ও-মুখ হয়ে রাশার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে যে আমারটাই যে অভ্রান্ত সেই-বা বলি কোন সাহসে? তবে এটা সত্য আমার জীবনের সর্বপ্রধান কাজ “টেস্ট ক্রিটিসিজ্‌ম্‌” তখনও ছিল, এখনও আছে অর্থাৎ কোনও পুস্তকের পেলুম তিনখানি পাণ্ডুলিপি, তাতে একাধিক জায়গায় লেখক বলেছেন পরস্পর-বিরোধী তিনরকম কথা। আমার কাজ, যাচাই করে সত্য নিরূপণ করা, কিংবা সত্যের যতদূর কাছে যাওয়া যায় তারই চেষ্টা দেওয়া। অতএব, বুঝতেই পারছ, রাসপুতিন সম্বন্ধে গুজবগুলো আমি সরলচিত্তে গোগ্রাসে গিলিনি, আমার বুদ্ধিবিবেচনা প্রয়োগ করে যেটা সর্বাপেক্ষা সত্যের নিকটতম সেইটেই বলছি।’

অধ্যাপক রাসপুতিনের প্রথম জীবনাংশ সংক্ষেপে সারেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এই চাষি পরিবারের ছেলে রাসপুতিনের জন্য সাইবেরিয়াতে। ‘রাসপুতিন’ তাঁর আসল নাম নয়– সেটা পরে অন্য লোকে তাঁর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বিশেষ করে কামাদি ব্যাপারে জানতে পেরে তাঁর ওপর চাপায়। লেখাপড়ার চেষ্টা তিনি ছেলেবেলায় কিছুটা দিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু সেদিকে ছিলেন, ক্লাসের মামুলি চাষার ছেলেরও অনেক নিকৃষ্ট। এরপর তিনি তাঁর সমাজের দ্রঘরেই বিয়ে করেন– আর পাঁচটা ছেলের মতো। কিন্তু তার কিছুকাল পরেই হঠাৎ তাঁর ঝোঁক গেল ধর্মের দিকে, কিন্তু প্রচলিতার্থে আমরা ধর্মাচরণ বলতে যা বুঝি সেদিকে নয়। হিন্দুধর্মে যে-রকম একাধিক মতবাদ, শাখা-প্রশাখা– রুশের প্রচলিত (অর্থডক্স) সনাতন খ্রিস্টধর্মেও তাই। তারই একটার দিকে আকৃষ্ট হলেন গ্রেগরি (রাসপুতিন)। এস্থলে উল্লেখ প্রয়োজন বলে মনে করি, অধ্যাপক বগদানফ ছিলেন অতিশয় ‘গোঁড়া’–আমি সজ্ঞানে শব্দটি ব্যবহার করছি– রাশার সরকারি ধর্ম গ্রিক অর্থডক্স চার্চে বিশ্বাসী এবং আচারনিষ্ঠ খ্রিস্টান। শান্তিনিকেতনে তাঁর কামরায় (তখনকার দিনের অতিথিশালা, এবং বোধ হয় দর্শন-ভবন) দেয়ালে ছিল ইকন এবং তার নিচে অষ্টপ্রহর জ্বলত মঙ্গলপ্রদীপ এবং তারই নিচে তিনি অহরহ দাঁড়িয়ে স্বদেহে আঙুল দিয়ে ক্রশচিহ্ন অঙ্কিত করতে করতে–ঠিক আমাদের বুড়িদের মতো বিড়বিড় করে দ্রুতগতিতে মন্ত্রোচ্চারণ করতেন। বলা বাহুল্য রাসপুতিন যে খলিসতি (Khlisti) সম্প্রদায়ে প্রবেশ করলেন সেটাকে অধ্যাপক অপছন্দ করতেন। এ সম্প্রদায় উন্মত্ত নৃত্য, সঙ্গীত (এবং লোকে বলে যৌনাভিচার) ইত্যাদির মাধ্যমে পরমাত্মাকে মানবাত্মায় অবতীর্ণ করিয়ে স্বয়ং পরমাত্মায় পরিবর্তিত হওয়ার চেষ্টা করে। এ মার্গ বিশ্বসংসারে কিছু আজগুবি নতুন চিজ নয়। তবে এরা বলতে কসুর করতেন না যে, স্ত্রী-পুরুষের যৌনসম্পর্ক সম্বন্ধে এঁরা উদাসীন, অর্থাৎ এ বাবদে কে কী করে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। রাসপুতিন এটাকে নিয়ে গেলেন তার চরমে। তিনি প্রচার করতে লাগলেন, ‘পাপ না করলে ভগবানের ক্ষমা পাবে কী করে? অতএব পাপ করো!’ এছাড়া তাঁর আরেকটি বক্তব্য ছিল, তিনি পরমাত্মার অংশাবতার, এবং তার সঙ্গে দেহে মনে আত্মায় আত্মায় যে কেউ সম্মিলিত হবে তারই চরম মোক্ষ তদ্দণ্ডেই। তার শিষ্যাগণের সঙ্গে তার সেই সম্মিলিত হওয়াটা কোন পদ্ধতিতে হত সেটা বলতে শ্লীলতায় বাধে, এবং একথা প্রায় সর্বাদিসম্মত যে তিনি তার শিষ্য-শিষ্যাগণকে নিয়ে একই কামরায় যেসব ‘সম্মিলন’ ঘটাতেন সেটা শুধু তিনি নিজেতেই সীমাবদ্ধ রাখতেন না, শিষ্য-শিষ্যাগণ নিজেদের মধ্যেও সম্মিলিত হতেন। ইংরেজিতে একেই ‘অর্জি’ ‘সেটারনেলিয়া’ ইত্যাদি বলে থাকে।

এটা সত্য, রাসপুতিনের কথা আমিই উত্থাপন করেছিলুম এবং অধ্যাপকও রাসপুতিন সম্বন্ধে তাঁর যা জানা ছিল সেটি সবিস্তর বলেছিলেন, কিন্তু তিনি রাসপুতিনের ধর্মসম্প্রদায় সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তার পূর্ণ বক্তব্যের প্রায় অর্ধাংশ ব্যয় করেন ওই সম্প্রদায় নিয়ে, এবং বিশ্বের অন্যান্য ধর্মে কোথায় কোথায় এ প্রকারের অর্জি স্বীকৃত এবং কার্যে পরিণত হয়েছে তাই নিয়ে। এ বাবদে তার শেষ বক্তব্য আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে; ধর্মের নামে এ ধরনের অনাচার কেন যুগে যুগে হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, কিংবা গোপনে গোপনে বিশেষ কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে প্রাচীন ধারাটি অক্ষুণ্ণ রাখে, এ তত্ত্বটি সাতিশয় গুরুত্ব ধারণ করে এবং এর অধ্যয়ন প্রচলিত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মশাস্ত্রীয় পুস্তক অধ্যয়ন করে হয় না, এর জন্য প্রথমত প্রয়োজন নৃতত্ত্ব এবং পরে সমাজতত্ত্বের গভীর অধ্যয়ন (এর পূর্বে Anthropology ও Sociology এ দুটো শব্দ আমি কখনও শুনিইনি।)

আমি তখন বুঝতে পারিনি, পরে পারি যে আর পাঁচজনের মতো তিনিও রাসপুতিনের রগরগে কাহিনী কীর্তন করতে প্রস্তুত ছিলেন বটে, কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিল এরই মাধ্যমে– ফাঁকি দিয়ে শটকে শেখানোর মতো– আমাকে সাধারণ ভারতীয় ছাত্রের পাঠ্যবস্তুর গণ্ডি থেকে বের করে পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বলা বাহুল্য, এসব আমার সম্বন্ধে নিছক ব্যক্তিগত কথা হলে আমি এগুলো উল্লেখ করতুম না, আমার অন্যতম উদ্দেশ্য, এই সুবাদে তখনকার দিনের স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-চালিত বিশ্বভারতীয় (স্কুল ও কলেজ– যথাক্রমে ‘পূর্ব’ ও ‘উত্তর’ বিভাগ) অধ্যাপকগণ কী প্রকৃতি ধারণ করতেন তারই যৎকিঞ্চিৎ বর্ণনা।

অধ্যাপক বলেছিলেন, এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ অবাধে করা যাচ্ছে এবং তদুপরি সেটা ধর্ম নামে প্রচারিত হচ্ছে, এটা যে জনপ্রিয় হবে– অন্তত জনগণের অংশবিশেষে সেটা তো অতিশয় স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে এক অজানা-অচেনা অর্ধলুপ্ত ধূলিসৃতি সম্প্রদায় হঠাৎ নবজীবন লাভ করে খুদ জারের প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছে গেল, এটা তো আর একটা আকস্মিক অকারণ কর্তাবিহীন কর্ম নয়। এরকম একটা নব আন্দোলন আনয়নকারী পুরুষের কোনও না-কোনও অসাধারণ গুণ, আকর্ষণ বা সম্মোহনশক্তি থাকা নিশ্চয়ই প্রয়োজন।

পূর্বেই বলেছি, অধ্যাপক ছিলেন কট্টর ‘অর্থডকস গ্রিক চার্চ’-এর অন্ধ ভক্ত। কিন্তু এস্থলে এসে তিনিও স্বীকার করলেন, রাসপুতিন একাধিক অলৌকিক শক্তি ধারণ করতেন। তিনি যে কঠিন দুরারোগ্য রোগ কোনও প্রকারের ঔষধ প্রয়োগ না করে প্রশম করতে পারতেন সেটারও উল্লেখ করলেন। কী প্রকারে? কেউ জানে না।

ইতোমধ্যে জার-প্রাসাদের ওপর মৃত্যু যেন তার করাল ছায়া বিস্তার করেছে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বালক যুবরাজ আহত হন। তাঁর রক্তক্ষরণ আর কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। ভিয়েনা-বার্লিন থেকে বড় বড় চিকিৎসক এসেছেন। আমি অধ্যাপককে শুধিয়েছিলুম, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রে কি রাশা তখনও এতই পশ্চাৎপদ?’ তিনি বলেছিলেন, ‘বলা শক্ত, তবে সাহিত্যের বেলা চেখফ যা বলেছেন এস্থলেও হয়তো সেটা প্রযোজ্য: তোমার প্রিয় লেখক চেখফ বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আলবৎ আমরা রুশি সাহিত্য পড়ি। কিন্তু সেটা ওই যে রকম আমরা কুটিরশিল্পকে মেহেরবানি করে সাহায্য করি। আসলে মালের জন্য যাই ফরাসি সাহিত্যে।’ হয়তো চিকিৎসার বেলাও তখন তাই ছিল।’

.

দাসী না ডাচেস– সমাজের দুই প্রান্তের দু জনা– কে প্রথম রাসপুতিনকে নিয়ে গেল জারের রাজপ্রাসাদে?

সে কে? যুবরাজ মৃত্যুশয্যায়, আপন ‘কটেজ ইনডাসট্রি’র রাশান ডাক্তাররা তো হার মেনেছেনই, ভিয়েনা-বার্লিনের রাজবৈদ্যরাও, যারা কি না কাইজারের, এমপেরার ফ্রানৎস যোসেফের প্রাসাদের গণ্যমান্যদের চিকিৎসা করে করে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন তারা পর্যন্ত রাশা ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচেন। কারণ রুশ যুবরাজের যে রোগ হয়েছে সেটার নাম হ্যামোফিলিয়া– আমরা গরিবদের, না জানি কোন পুণ্যের ফলে, আমাদের হয় না– ব্যামোটা শব্দার্থেই রাজসিক, শুধু রাজা-রাজড়াদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। পূর্বে ছিল এই বিশ্বাস; পরে দেখা গেল, গরিবদেরও হয়। আমরা বললুম, সেই কথাই কও! ভগবান যে হঠাৎ খামোখা এহেন দুরারোগ্য ব্যাধি শুধু বড়লোকদের জন্যই রিজার্ভ করে রেখে দেবেন, এটা তো অকল্পনীয়। ব্যামোগুলো তো আমাদের মতন গরিবদের জন্যই তৈরি হয়েছে। ভগবান স্বয়ং তো রাজাদের দলে। কিংডম অব দি হেভেন বা স্বর্গরাজ্যে যাঁরা বাস করে, তিনি তো ফেভার করবেন তাঁর জাতভাই তাঁদেরই, যাঁদের কিংডম্ অব দি আর্থ বা পৃথ্বীরাজ্য আছে।(২) তাই যদি হয়, তবে স্বর্গরাজ্যই হোক, আর ভূস্বর্গই হোক, ভিয়েনা-বার্লিনের অশ্বিনীকুমারদ্বয় যেখানে রুগীকে হরিনামের গুলি দিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার তালে, সেখানে দাসী ‘ফার্সি’ পড়বে? হয়তো ঠিক সেইখানেই, কিন্তু অন্য কারণও আছে।

আমরা এ দেশে যত কুসংস্কারাচ্ছন্নই হই-না কেন, একাধিক বাবদে অন্তত সে যুগে, অর্থাৎ শতাব্দীর প্রারম্ভে জারের রাশা আমাদের অনায়াসে হার মানাতে পারত। সে রাশার গ্রিক অর্থডকস চার্চ ছিল শব্দার্থেই অর্থডক্স্ গোঁড়া, কট্টর কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আর চাষাভুষোদের তো কথাই নেই। তন্ত্রমন্ত্র, জড়িবড়ি, মাদুলি-কবচ থেকে আরম্ভ করে নিরপরাধ ‘প্রভু যিশুর হত্যাকারী ইহুদিদের সুযোগ পেলেই বেধড়ক মার, এবং সেখানেই শেষ নয়– আপন রক্তের আপন ধর্মের জাতভাই যারা এসব কুসংস্কার থেকে একটুখানি মুক্ত হয়ে, অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ স্বাধীনভাবে প্রভু যিশুর বাণী জীবন দিয়ে গ্রহণ করার চেষ্টা করত যেমন ‘দুখবর’, ‘স্তান্দিন্ত’ সম্প্রদায়– তাদের ওপর কী বীভৎস অত্যাচার।(৩) এবং চাষাভুষোদের এই অত্যাচার-ইন্ধনে কাষ্ঠ সরবরাহ করতেন জার-সম্প্রদায় এবং তাঁদের অনুগ্রহে লালিত-পালিত বিলাসব্যসনে গোপন পাপাচারে আকণ্ঠ নিমগ্ন অর্থডক্স চার্চ তার আপন ‘পোপ’–হোলি সিনডকে নিয়ে। যে ইউসুপফ এর কয়েক বত্সর পর রাসপুতিনের ভবলীলা সাঙ্গ করেন, তিনি বা তাঁর ভাই, আরেজ গ্রান্ড ডিউক প্রকাশ্য ‘ডুমা’ বা মন্ত্রণা-সভায় প্রস্তাব করেন এবং বহু বিনিদ্র যামিনী যাপন করে স্বহস্তে নির্মিত পরিকল্পনা সঙ্গে সঙ্গে পেশ করেন, ইহুদিদের সবংশে বিনাশ করার জন্য কী প্রকারে, স্তরে স্তরে শল্য প্রয়োগ দ্বারা তাদের পুরুষদের সন্তান-প্রজনন ক্ষমতা হরণ করা যায়? বগদান সাহেব বলেছিলেন, মাই বয়, হি সাবৃমিটেড় ইট ইন অল সিরিয়াসনেস্! অবশ্য তৎসত্ত্বেও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ভদ্রসন্তান অধ্যাপক বগদানফ ইহুদিদের। ঘৃণা করতেন– হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, ওই-জাতীয় আর পাঁচটি বর্বর রুশের মতো। বিশ্বভারতীতে তখন একটি সুন্দরী, বিদেশিনী, ইহুদি অধ্যাপিকা ছিলেন; কী প্রসঙ্গে তাঁর কথা উঠতে বগদানফ তিক্ত অবজ্ঞায় মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘আই উফ নট টাচ হার উইথ এ পেয়ার অব টংস!’– সাঁড়াশি দিয়েও তিনি তাঁকে স্পর্শ করতে রাজি হবেন না!

এ কথা সবাই বলেছেন, রাজধানী সেন্ট পেটেরসবুর্গে (তখন অবশ্য রাশা জর্মনির সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত বলে তাদের সভ্যতায় জর্মনদের যে শতকরা আশি ভাগ অবদান, মায় তাদের ভাষায় প্রবেশপ্রাপ্ত জর্মন শব্দ, যেমন সেন্ট পেটেরসবর্গের জর্মন অংশ ‘বুর্গ’– ‘প্রাসাদ’, ‘কাসল’–সমূলে উৎপাটিত করে নামকরণ করেছে ‘পেত্রোগ্রাদ’। সর্বশেষে এর নামকরণ হয় ‘লেনিনগ্রাদ’, কিন্তু ততদিনে রাজধানী চলে গেছে মস্কোতে। জারের ‘উইন্টার পেলেস’ প্রাসাদে বিরাজ করত কেমন যেন এক অদ্ভুত রহস্যময় (প্রধানত ধার্মিক– mysticism) বাতাবরণ। সম্রাজ্ঞী—জারিনা– ছিলেন অতিশয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আচার-অনুষ্ঠানে সদালিপ্ত, প্রতি মুহূর্তে পুত্রের পুনর্বার রক্তক্ষরণ রোগে আক্রান্ত হবার ভয়ে উদয়াস্ত সশঙ্কিত; বিশেষ করে যখন হৃদয়ঙ্গম করলেন যে, প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি এই কঠিন পীড়ার সম্মুখে সম্পূর্ণ পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে, তখন যে তিনি পাগলিনীর মতো রাজ্যের যত প্রকারের টোটকামোটকা, তাবিজমাদুলির সন্ধানে লেগে যাবেন সেটা অবাঞ্ছনীয় হলেও অবোধ্য নয়– এমনকি কট্টর বৈজ্ঞানিকও সেখানে সহানুভূতি দেখাবে। একেই তো শীত-প্রাসাদে বিরাজ করত রহস্যময় বাতাবরণ, যেন সেখানে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও প্রকারের অলৌকিক কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, তদুপরি নানাশ্রেণির কুটিল ভাগ্যান্বেষী সেই প্রাসাদে কোনও প্রকারের চতুরতা দ্বারা অর্থ সঞ্চয়ের জন্য গমনাগমন করছে, সেখানে যদি নিত্যসঙ্গিনী দাসীটিও বলে যে, সে একজন ‘হোলিম্যান’, ‘সাধুতপস্বী’কে চেনে যাঁর হৃদয়ে প্রভু যিশুর সামান্যাংশ প্রবেশ করার ফলে (‘সেই শাশ্বত সত্তার একটি কণা আমাতে অবতাররূপে অবতীর্ণ হয়েছে’- রাসপুতিনের আপন ভাষায়) তিনি প্রভুরই মতো বহু দুরারোগ্য ব্যাধি, কোনও ঔষধ প্রয়োগ না করে অবলীলাক্রমে আরোগ্য করতে পারেন, তবে মহারানি যে নিমজ্জমানার ন্যায় সেই তৃণখণ্ডকেও দৃঢ়-হস্তে ধারণ করবেন সেটা তো তেমন-কিছু অসম্ভব আচরণ নয়।

অন্যপক্ষ বলেন, দাসী নয় ডিউক।

রাসপুতিন দিগ্বিজয় করতে করতে পেত্রোগ্রাদ– সম্ভব হলে রাজপ্রাসাদ– জয় করবেন বলে মনস্থির করেছেন। এদিকে সেখানকার যাজক সম্প্রদায়ের কেউ-বা তাঁর জনপ্রিয়তার সংবাদ শুনে, কেউ-বা তাঁর ধর্মের নবজাগরণ প্রচেষ্টার খ্যাতি শুনে, কেউ-বা তাঁর অলৌকিক কর্মক্ষমতার জনরবে আকৃষ্ট হয়ে সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার জন্য, এক কথায় অনেকেই। অনেক কারণে তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে উদগ্রীব। রাসপুতিন সশিষ্য-শিষ্যা পেত্রোগ্রাদে প্রবেশ করে সে প্রবেশ প্রায় খ্রিস্টের পূতপবিত্র জেরুজালেমের পুণ্যভূমিতে প্রবেশ করার সমতুল– সাড়ম্বরে প্রতিষ্ঠিত হলেন এক প্রভাবশালী শিষ্যের গৃহে। শীঘই যোগসূত্র স্থাপিত হল পেত্রোগ্রাদের সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মশিক্ষাশালার সুপণ্ডিত অধ্যক্ষের সঙ্গে। ইনি আবার মহারানির আপন ব্যক্তিগত পুরোহিত অর্থাৎ এরই সামনে মহারানি প্রতি সপ্তাহে একবার ‘কনফেস’ করেন, ওই সপ্তাহে তিনি যেসব পাপচিন্তা করেছেন, কর্মে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, সেগুলো স্বীকার করে শাস্ত্ৰাদেশ অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্তাদেশ গ্রহণ করেন প্রায়শ্চিত্ত সাধারণত উপবাস ও মালাজপের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে। এই কনফেশন গ্রহণ করে যে পুরোহিত প্রায়শ্চিত্তাদেশ প্রদান করেন তার পদটি স্বভাবতই সাতিশয় গাম্ভীর্য ও গুরুত্ব ধারণ করে। তিনি সম্রাজ্ঞী-হৃদয় কন্দরের অন্তরতম রহস্য জানেন বলে– এমনকি স্বীকারোক্তির সময় তিনি প্রশ্ন জিজ্ঞাসার অধিকারও ধরেন– তাকে থাকতে হয় অতি সাবধানে।

তাঁর প্রধান কৌতূহল রাসপুতিন কোন কোন কারণে কীভাবে হৃদয়ে ভগবানের প্রত্যাদেশ পেয়ে সমস্ত জীবনধারা পরিবর্তিত করে ‘নবজন্ম’ পেলেন। গ্রিক অর্থড চার্চ, ক্যাথলিক তথা অন্যান্য সম্প্রদায়ের ইতিহাসে এই নব-জীবন লাভ, গৃহী খ্রিস্টানের সন্ন্যাস-গ্রহণের জন্য এই কনভার্সনের উপ-ইতিহাস এক বিরাট অংশ গ্রহণ করে আছে। খ্রিস্ট সাধু মাত্রই এটি মনোযোগ সহকারে বারবার পাঠ করে তার থেকে প্রতিদিন নবীন উৎসাহ, তেজস্বী অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করেন। মহারানির আপন যাজক ধর্ম-একাডেমির অধ্যক্ষরূপে এই উপ-ইতিহাসের অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন, সেই পুস্তক তাঁরা শিষ্যমণ্ডলীর সম্মুখে সটীকা প্রতিদিন পড়িয়ে শোনাতেন এবং স্বভাবতই সেই পুস্তকের ভিন্ন ভিন্ন সাধুসন্তদের নিয়ে গভীর এবং সূক্ষ্ম আলোচনা করতেন। কিন্তু কোনও পাপাত্মা কীভাবে অকস্মাৎ দৈবাদেশ পেয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করে ধর্মসংঘে প্রবেশ করে, কিংবা জনসেবায় আত্মনিয়োগ করে, অথবা পাণ্ডিত্য থাকলে সংঘে প্রবেশ করে নির্জনে নিভৃতে বাইবেল বা অন্য কোনও ধর্মগ্রন্থের এক নবীন টীকা নির্মাণে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয় এ সম্বন্ধে তার কোনও ব্যক্তিগত অব্যবহিত অভিজ্ঞতা ছিল না, এবং অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে, এরকম একটা আকস্মিক কনভার্সনের নায়ক যদি তার আপন কর্মস্থলে হঠাৎ এসে পৌঁছন তবে তিনি তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনা করবেন। পূর্বেই বলেছি, রাসপুতিনের ভিতর কেমন যেন একটা বৈদ্যুতিক আকর্ষণ শক্তি ছিল, তার স্বাভাবিক অবস্থায়ও তিনি সাধারণ কেন, অসাধারণ জনকেও মন্ত্রমুগ্ধবৎ মোহাচ্ছন্ন করতে পারতেন। খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্রে তাঁর শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছিল অতিশয় সীমিত, কিন্তু প্রভু যিশুর যে কটি সরল উপদেশ তিনি বহু কষ্টে কণ্ঠস্থ করতে পেরেছিলেন সেগুলো তিনি অতিশয় দৃঢ় বিশ্বাসের বীর্যশীল সরলতায় প্রকাশ করতে পারতেন। সঙ্গে সঙ্গে এ সত্যটিও নিবেদন করা উচিত যে, রাশায়, ধর্মশিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে যে পণ্ডিতকুলমান্য সর্বোত্তম শাস্ত্রজ্ঞ অধ্যয়ন অধ্যাপনা করেন তিনি এই অশিক্ষিত হলধরসন্তানের কাছে আসবেন না শাস্ত্রের টীকাটিপ্পনী শ্রবণার্থে। তিনি আসবেন অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে। এস্থলেও প্রভু যিশুর সঙ্গে রাসপুতিনের সাদৃশ্য আছে। ইসরায়েলের স্মার্ত পণ্ডিতরা যখন প্রভু যিশুর সঙ্গে তর্কযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তখন তিনি যেন তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন আমি শাস্ত্রকে কার্যে পরিপূর্ণভাবে দেখাব।

এসব কারণ অনুসন্ধান অপ্রয়োজনীয়। যা বাস্তবে ঘটে সেটা সর্ব তর্কের অবসান এনে দেয়। পণ্ডিতের পণ্ডিত রাসপুতিনকে দেখে, তাঁর আচার-ব্যবহার, তাঁর প্রতি শিষ্য-শিষ্যাদের সহজ ভক্তি ও সুদৃঢ় বিশ্বাস ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে বিস্মিত হলেন, কিন্তু মুগ্ধ হলেন যখন রাসপুতিনের কাছ থেকে শুনলেন, তার আবেগভরা কণ্ঠে তিনি বলে যেতে লাগলেন, কীভাবে এক দৈবজ্যোতি তার সম্মুখে আবির্ভূত হল আর তিনি ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে স্বর্গীয় প্রভুর পদপ্রান্তে আত্মসমর্পণ করলেন।

এ প্রকারের আকস্মিক পরিবর্তন ইতিহাস শাস্ত্রজ্ঞ অধ্যক্ষ পড়েছেন, পড়িয়েছেন প্রচুর কিন্তু এ-জাতীয় পরিবর্তনের একটি সরল সজীব দৃষ্টান্ত স্বচক্ষে দেখা, স্বকর্ণে শোনা সে যে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন, অভিনব, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যে কোনও অধ্যাপক, যে কোনও শিক্ষক এ প্রকারের অভিজ্ঞতাকে অসীম মূল্য দেন, কারণ পরের দিন থেকেই ছাত্রমণ্ডলীতে বেষ্টিতাবস্থায় তিনি অর্ধবিশ্বাসী তর্কবাগীশদের উদ্দেশে সবল, আত্মপ্রত্যয়জাত সুদৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারেন, ‘পবিত্র রুশ দেশের পবিত্রতর সন্তদের যে অলৌকিক পরিবর্তনের কথা তোমরা পড়ছ, সেগুলো কাহিনী নয়, ইতিহাস, এবং শুষ্ক পত্রে লিখিত জীর্ণ ইতিহাস নয়, নিত্যদিনের বাস্তব প্রত্যক্ষ সত্য; সে জিনিস ভাগ্যবান চক্ষুম্মান দেখতে পায়!’ অস্মদেশীয় প্রচলিত নীতিবাক্য আছে :

“অদ্যাপিও সেই লীলা খেলে গোরা যায়।
মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায় ॥”

এবং তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন, এই সাধুপুরুষকে তিনি রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে উদভ্রান্ত সম্রাজ্ঞীর সম্মুখীন করবেন। সর্ব ধর্মের সর্ব ইতিহাস বলে, সাধুজনের পক্ষে অসম্ভব কিছু। নেই। সম্রাজ্ঞীকে এই সাধু তাঁর অলৌকিক শক্তি প্রয়োগ করে এনে দেবেন সান্ত্বনা, আত্মপ্রত্যয় এবং ধর্মবিশ্বাস স্থাপন করবেন দৃঢ়তর ভূমিতে।

অতি সহজেই তিনি রাসপুতিনের গুণমুগ্ধ রাজপরিবারের একাধিক নিকটতম আত্মীয়-আত্মীয়ার সহানুভূতি ও সহযোগ পেলেন। রাসপুতিন রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন।

কেউ কেউ বলেন, সেটা ছিল আকস্মিক যোগাযোগ। অধিকতর বিশ্বাসীরা বলেন, ‘না, যুবরাজের কঠিনতম সঙ্কটময় অবস্থান, যখন রাজবৈদ্যগণ তার জীবন রক্ষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ হতাশ্বাস, তখন রাসপুতিন তাঁকে অনুরোধ করার পূর্বেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শিষ্যগণকে প্রত্যয় দেন, তিনি যুবরাজকে সম্পূর্ণ নিরাময় করতে পারবেন।’

এ তো কোনও হাস্যকর আত্মপ্রত্যয় নয়। অভিজ্ঞতর প্রবীণ চিকিৎসকও বারবার মস্তকান্দোলন করে স্বীকার করেন, কত অগুণিত রোগী যমদূতের দক্ষিণহস্ত ধরে যখন পরপারে যাত্রার জন্য প্রথম পদক্ষেপ করেছে, রূঢ় সরল ভাষায় ওইসব রোগীদের সম্বন্ধে যখন বহু পূর্বেই সর্ব বিশেষজ্ঞ একই বাক্যে আপন দৃঢ় নৈরাশ্য প্রকাশ করেছেন, ঠিক সেই সময় হঠাৎ অকারণে, চিকিৎসকের কোনও প্রকারের সাহায্য না নিয়ে সেই জীবন্ত ব্যক্তি শুশান-সঙ্কট উত্তীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে পুনরায় লুপ্ত স্বাস্থ্য ফিরে পায়।

***

সম্রাট এবং মহিষী উভয়েই নাকি সাধুর প্রথম দর্শন লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে যান। বিশেষ করে রাজমহিষী।

অধ্যাপক বগদানফের মতে, অর্থাৎ তিনি যে জনরব সর্বাপেক্ষা নির্ভরশীল বলে গ্রহণ করেছিলেন সেই অনুযায়ী রাসপুতিন নাকি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মহারানিকে আশ্বাস দেন, যুবরাজ রোগমুক্ত হবেন, এবং তিনিই তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। রাজমহিষী স্বয়ং তাঁকে নিয়ে রোগীর কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ উচ্চকণ্ঠে, তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। যে-ব্যক্তিকে সম্রাজ্ঞী নিয়ে যাচ্ছেন সে ব্যক্তি যে চিকিৎসাশাস্ত্রে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ সে কথা সে-ই একাধিকবার স্বীকার করছে, এমতাবস্থায় যখন তারা আশা করছেন যে, যে কোনও মানুষ বা ইতর প্রাণীর ন্যায় যুবরাজও প্রকৃতিদত্ত শক্তিবলে যে শক্তি সর্বজনের অলক্ষিতে জীবদেহে বেঁচে থাকার জন্য সর্বব্যাধির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম দ্বারা আপন কর্তব্য করে যায়– হয়তো নিরাময় হয়ে যেতে পারেন; সেই সঙ্কটজনক অবস্থায় এই নবাগত হয়তো আপন অজ্ঞতাবশত সেই শক্তির প্রতিবন্ধক হয়ে তার কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে।

তত্সত্ত্বেও মহারানি রাসপুতিনকে রোগীর কক্ষে নিয়ে গেলেন।

চিকিৎসকরাও সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করলেন। রাসপুতিন বললেন, তিনি কোনও তৃতীয় ব্যক্তির সম্মুখে চিকিৎসা করবেন না। তৃতীয় বলতে সম্রাজ্ঞীকেও বোঝায়; তিনি নিঃশঙ্কচিত্ত দৃঢ় পদক্ষেপে দেহলিপ্রান্ত উত্তীর্ণ হলেন।

অতি অল্পক্ষণ পরেই রাসপুতিন দোর খুলে রানির দিকে সহাস্য ইঙ্গিত করলেন। রানিমা কক্ষে প্রবেশ করে স্তম্ভিত। যেন কত যুগ পরে তিনি দেখলেন রাসপুতিনের দেওয়া কী যেন একটা জিনিস হাতে নিয়ে যে কোনও সুস্থ বালকের মতো যুবরাজ খেলা করছেন।

রাসপুতিন প্রকৃতই যুবরাজকে তাঁর রক্তমোক্ষণ রোগ থেকে নিরাময় করেছিলেন কি না সে বিষয়ে মতানৈক্য আছে। তবে এটাও স্মরণে আনা কর্তব্য বিবেচনা করি যে, এই শতাব্দীর প্রথম ভাগে গবেষণা, পাণ্ডিত্য, সত্যানুসন্ধান বললেই বোঝাত। অবিশ্বাস। এই মূলমন্ত্র ওই সময়ে সুদূরপ্রসারী হয় যে, তৎকালীন লিখিত পুস্তক, এনসাইক্লোপিডিয়াতে একাধিক যশস্বী লেখক স্বয়ং বুদ্ধ, মহাবীর, এমনকি তাদের আপন খ্রিস্টের অস্তিত্ব পর্যন্ত সন্দেহাতীতরূপে সপ্রমাণ না হওয়ায় (দু হাজার, আড়াই হাজার বৎসরের পরের একতরফা বা একস্পার্টি তদন্তে!) তাঁদের জীবনী এবং বাণীকে কাল্পনিক কিংবদন্তি আখ্যা দিয়েছেন, এবং কেউ কেউ তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করেছেন। অতএব সে যুগের পুস্তক যে রাসপুতিনের মতো চিকিৎসানভিজ্ঞজন যুবরাজকে রোগমুক্ত করেছেন সে কথা হয় অস্বীকার করে, কিংবা নীরব থাকে। তবে এ কথা সকলেই স্বীকার করেছেন, রাসপুতিনের প্রাসাদ গমনাগমনের পর থেকেই যুবরাজের স্বাস্থ্যোন্নতি দিনে দিনে সুস্পষ্টরূপে লক্ষিত হয়।

আর সে যুগে সম্রাজ্ঞীদের ভিতর ধনে-ঐশ্বর্যে খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে নিঃসন্দেহে সর্বাগ্রগণ্যা না হলেও যাকে ইয়োরোপের রাজন্যবর্গ রাজপরিবার সর্বাপেক্ষা সম্ভমের চক্ষে দেখতেন সেই জারিনা? তিনি তো কৃতজ্ঞতার প্রতিদানস্বরূপ রাসপুতিনের পদপ্রান্তে কী যে রাখবেন তার সন্ধানই পাচ্ছেন না, কারণ সাধারণজনের মতো ভবন-যানবাহন রজতকাঞ্চনে তার লোভ ছিল না– তাঁর আসক্তি কিসে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন– ওদিকে জারিনা আবার জাতমিস্টিক, অলৌকিক ক্রিয়াকর্মে তিনি বিশ্বাস করেন এবং যাদের এসব মিরাকল দেখাবার শক্তি আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন তাঁদের কাছে তিনি তাঁর দেহ-মন-আত্মা সর্বস্ব নিয়ে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত।

জিতেন্দ্রিয় পরোপকারী সাধুসজ্জনদেরই-না কত প্রকারে কুৎসা রটে দু হাজার বৎসর হয়ে গেল এখনও খ্রিস্টবৈরীরা বলে, তিনি নাকি অসচ্চরিত্রা যুবতীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন ও মদ্যপানে তাঁর আসক্তি ছিল ঈষৎ মাত্রাধিক– সেস্থলে রাসপুতিন! যিনি কি না তাঁর কামানল নির্বাপিত করার চেষ্টা তো করেনই না, তদুপরি ওই বিশেষ রিপুর চরিতার্থ তাকে তুলে ধরেছেন সর্বোচ্চ ধর্মের পর্যায়ে এবং ফলে শিষ্যশিষ্যাগণসহ বহুবিধ অনাচারে লিপ্ত হন– এসব অর্জি ‘সেটারনেলিয়া’র উল্লেখ আমরা পূর্বেই করেছি– তাঁর পূর্ববর্তী মফঃস্বল জীবনের তুলনায় রাজধানীতে তার বর্তমান কেলেঙ্কারির বিবরণ তথা পল্লবিত জনরব চতুর্দিকে যে অধিকতর ছড়িয়ে পড়বে তাতে আর কী সন্দেহ! কিন্তু ক্রমে ক্রমে মোক্ষমতর মারাত্মক কলঙ্ককাহিনী রটতে আরম্ভ করল চতুর্দিকে; এসব দলবদ্ধভাবে কৃত দুষ্কর্মের ‘অর্জি’ এখন নাকি রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে এবং সেখানে তো সবকিছুই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়– পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সম্ৰান্ততম ডিউক ডাচেস, অর্থাৎ সম্রাটের নিকটতম আত্মীয়-আত্মীয়ারাও নাকি এইসব অনাচারে অংশ নিচ্ছেন। এবং সর্বশেষে যে কলঙ্ককাহিনী পেত্রোগ্রাদে জন্মলাভ করে সর্ব রুশের সর্ব সমাজের উচ্চতম থেকে অধস্তন। শ্রেণি পর্যন্ত প্রচারিত হয়ে আপামর জনসাধারণকে দিল রূঢ়তম পদাঘাত সেটি আর কিছু নয়, স্বয়ং জারিনা তার দেহ সমর্পণ করেছেন রাসপুতিনকে। অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলাদের তো কথাই নেই।

গ্রান্ড ডিউক ইউসুপফের দুটি মোকদ্দমাই ছিল এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। এইসব কলঙ্ককাহিনীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকে জড়িয়ে প্রথমে ফিল্ম তৈরি করা হয়েছে, পরে টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, অথচ তাঁর মতে, তাঁর সতী-সাধ্বী স্ত্রী পূর্বোল্লিখিত পাপানুষ্ঠানের সঙ্গে মোটেই বিজড়িত ছিলেন না। সে কথা পরে হবে।

আমি এতক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা দিয়ে রুশ রাজনীতি এড়িয়ে গিয়েছি কিন্তু এখন থেকে আর সেটা সম্ভবপর হবে না, কারণ এই সময়েই কুটরাজনৈতিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হলধর-সন্তান রাসপুতিন হিস্যে নিতে আরম্ভ করেছেন দেশবিদেশের গুরুত্বপূর্ণ কঠিন কঠিন সঙ্কটসমস্যায়। ইতোমধ্যে যেসব সরল ধর্মযাজকগণ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁরা ধীরে ধীরে বিশ্বস্ততম সূত্রে তাঁর ‘কীর্তিকলাপে’র সম্পূর্ণ বিবরণ অবগত হয়ে তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছেন। কিন্তু স্বয়ং জারিনা এবং রাশার ‘পোপ’ হোলি সিনড যতক্ষণ তাঁর সম্মোহন-ক্ষমতায় অর্ধচেতন ততক্ষণ তাকে তো মুহূর্তের তরে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। পাঠক, স্মরণ করুন সেই সুপ্রাচীন আরবি প্রবাদ : কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু কাফেলা (ক্যারাভান) চলে এগিয়ে। রাসপুতিন এই কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউকে থোড়াই পরোয়া করেন।

কিন্তু রাসপুতিন কী করে এরকম নির্বিকারচিত্তে উপেক্ষা করলেন রুশ দেশের জনগণের রাজনৈতিক নবজাগরণকে! জার দ্বিতীয় নিকোলাস যত-না রক্ষণশীল সম্রাটের সার্বভৌমিকতু সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন, তার চেয়ে শতগুণ স্থবির জড়ভরত ছিলেন তাঁর আমির-ওমরাহ। ওদিকে রুশ-সিংহ যখন সদম্ভে মূষিক জাপানের সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে তার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে নির্মমরূপে পরাজিত হল, তখন আর ‘হোলি’ রাশার অন্তঃসারশূন্যতা গোপন রাখা সম্ভব হল না। জনমত নির্ভয়কণ্ঠে জারের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসন দাবি করল। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে যে বত্সর রাসপুতিন সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন, ঠিক সেই বৎসরেই জার প্রথম বিধানসভা (এরই নাম পূর্বোল্লিখিত ‘ডুমা’) নির্মাণের অনুমতি দিলেন। সে এক সত্যকার সার্কাস- নইলে তার কোনও সম্মানিত সদস্য সেখানে অস্ত্রোপচার দ্বারা ইহুদিকুলকে শিখণ্ডীরূপে পরিণত করার প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ গাম্ভীর্যমণ্ডিত পদ্ধতিতে পেশ করতে পারেন?

কিন্তু ‘ডুমা’ প্রতিষ্ঠান বন্ধ্যা হয়ে রইল কি না রইল সে তত্ত্ব রাসপুতিন-জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি যতদিন-না রাজপ্রাসাদচক্রের দু-একজন ধুরন্ধর অতিশয় রক্ষণশীল রাজনৈতিক মনস্থির করলেন যে, রাসপুতিনকে দিয়ে তারা এমন সব রাজকর্মচারী নিযুক্ত করিয়ে নেবেন, যারা ডুমার প্রতি পদক্ষেপের পথে লৌহপ্রাচীরবৎ দণ্ডায়মান হয়ে থাকবে। কূটনীতিতে আনাড়ি রাসপুতিনের হাত দিয়ে তামাক খাওয়াটা কিছুমাত্র দুঃসাধ্য হল না, কিন্তু এসব অপদার্থ নিয়োগের পশ্চাতে কে, সে তথ্যটিও গোপন রইল না। বস্তুত স্বয়ং রাসপুতিন প্রত্যেক পার্টিতে জালা জালা মদ আর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সুমিষ্ট কেখণ্ড (তাঁর জন্য বিশেষ করে কেকে তিন ডবল চিনি দেওয়া হত– এ বাবদে হিটলারের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ মিল) চাষাড়ে পদ্ধতিতে প্রচুর শব্দ আর বিরাট আস্যব্যাদানসহ চিবুতে চিবুতে দম্ভ করতেন, ‘এই যে দেখছ স্কার্ফখানা, এটি আপন হাতে বুনেছেন স্বয়ং জারিনা’, (কিংবা হয়তো তাঁর আদরের ডাকনাম সোহাগভরে উল্লেখ করতেন– আমার যেন মনে পড়ছে, তাই), কিংবা ‘জানো হে, ভরনাভাকে পাঠালুম তবলস্কের বিশপ করে।’ প্রভু রাসপুতিনের অন্ধভক্ত, অত্যধিক মদ্যপানবশত অর্ধমত্ত শিষ্যেরাও নাকি দ্বিতীয় সংবাদটি শুনে অচৈতন্য হবার উপক্রম! কারণ প্রভুর নিত্যসঙ্গী ওই ভরনাভা যে একেবারে আকাট নিরক্ষর! সে হবে বিশপ!

মরিয়া হয়ে অন্যতম প্রধান পাদ্রি নিযুক্ত করলেন গুপ্তঘাতক। রাসপুতিন শুধু যে অনায়াসে সঙ্কট অতিক্রম করলেন তাই নয়, এ সুবাদে রাজপ্রাসাদে তাঁর প্রভাব এমনই নিরঙ্কুশ হয়ে গেল যে, স্বয়ং জার পর্যন্ত আর এখন উচ্চবাচ্য করেন না। অবশ্য সমস্ত ইয়োরোপই বিলক্ষণ অবগত ছিল যে, জার অতিশয় দুর্বল চরিত্রের ‘যাকগে, যেতে দাও না’– ধরনের নিবীর্য ‘শাসক’। কার্যত তাঁকে শাসন করেন জারিনা। এবং তাঁর সম্মুখে রাসপুতিনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার মতো সাহস তখন কারও ছিল না।

রাসপুতিনকে হত্যা করার চেষ্টা নিষ্ফল হওয়ার পরই তিনি জারিনাকে সর্বজনসমক্ষে গম্ভীর প্যাকম্বরীকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন (বা শাসান), ‘আমার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যে গোষ্ঠীসুদ্ধ রমানৃষ্ণ পরিবার (অর্থাৎ সপরিবারে তখনকার জার) নিহত হবে।’ নিহত তাঁরা হয়েছিলেন, এবং অতিশয় নিষ্ঠুর পদ্ধতিতেই, কিন্তু সেটা ঠিক এক বৎসরের ভিতরই কি না বলতে পারব না, দু বৎসরও হতে পারে।

কিন্তু জারিনা? তাঁর শোচনীয় অবস্থা তখন দেখে কে? কুসংস্কারাচ্ছন্ন অতিপ্রাকৃতে অন্ধবিশ্বাসী এই মূঢ় রমণীর যত দোষই থাক, একটা কথা অতিশয় সত্য, তিনি তাঁর পুত্রকন্যাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিলেন পাগলিনীপারা। উদয়াস্ত তাঁর আর্ত সশঙ্ক দৃষ্টি, না জানি কোন অজানা অন্ধকার অন্তরাল থেকে কোন অজানা এক নতুন সঙ্কট অকস্মাৎ এসে উপস্থিত হবে, তাঁর কোনও একটি বসকে ছিনিয়ে নেবার জন্য!

অতএব প্রাণপণ প্রহরা দাও রাসপুতিনের চতুর্দিকে। তিনি একমাত্র মুশকিল্-আসান। এই ‘হোলিম্যান’ আততায়ীর হস্তে নিহত হলে সর্বলোকে সর্বনাশ!

কিন্তু বিশ্বসংসারের সকলেই রাসপুতিনের সাবধানবাণী বা শাসানোতে বিশ্বাস করেননি এবং ভয়ও পাননি। বিশেষ করে রাজপ্রাসাদের সর্বোচ্চস্তরের রাজরক্তধারী একাধিক ব্যক্তি। এরা ক্রমাগত জার-জারিনাকে রাসপুতিন সম্বন্ধে সাবধান হতে বলেছেন, এবং ফলে তাঁদের প্রতি বর্ষিত অপমানসূচক কটুবাক্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন। রাজপ্রাসাদে এঁরা হচ্ছেন। অপমানিত অথচ রাসপুতিনের ‘শুভাগমনে’র পূর্বে এঁরাই ছিলেন সেখানে প্রধান মন্ত্রণাদাতা। এখন তাদের এমনই অবস্থা যে, বাইরের সমাজে তাঁরা আর মুখ দেখাতে পারেন না। তাঁদের পদমর্যাদা, অভিজাত রক্ত প্রকাশ্য ব্যঙ্গপি থেকে তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে সত্য, কিন্তু ভেতরে বাইরে, ফুট-অস্ফুট নিত্যদিনের এ অপমান আর কাহাতক সহ্য করা যায়! ওদিকে ‘হোলি রাশা’ যে কোন জাহান্নমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন কে জানে!

অপমানিত সর্বোচ্চ অভিজাতবংশজাত তিনজন বসলেন মন্ত্রণাসভায়।

স্থির হল, ইউসুপফই হত্যা করবেন রাসপুতিনকে। তাই আজও লোকে বলে, ‘তোমার স্ত্রীকে রাসপুতিন ধর্ষণ করেছিল বলেই তো তুমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে, নইলে রাশাতে কি আর অন্য লোক ছিল না?’ ইউসুপফ এটা অস্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রধানদের আদেশানুযায়ীই তিনি ওই কর্মে লিপ্ত হন, আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় নিজেকে ভলন্টিয়ার করেন যদিও তাঁর স্ত্রী ধর্ষিতা হননি। এ সম্বন্ধে ইউসুপফের আপন জবানি পাঠক বিশ্বাস করতে পারেন, না-ও করতে পারেন; আমি শুধু বগদানফ সাহেবের জবানিটি পেশ করছি। না হয় সেটা ভ্রান্তই হল, তাতেই-বা কী? তদুপরি আমার স্মৃতিশক্তি আমার কলম নিয়ে কী যে খেলছে, জানব কী করে?

এবং আশ্চর্য! হত্যা করবেন আপন বাড়িতেই তাঁকে সসম্মান নিমন্ত্রণ করে! পুলিশকে ভয় করতেন এঁরা থোড়াই। কিন্তু জারিনা? তিনি যে শেষ পর্যন্ত হত্যাকারী কে, সে খবরটা প্রায় নিশ্চয়ই জেনে যাবেন, এবং তার ফলাফল কী হতে পারে, না পারে, সে নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এছাড়া গত্যন্তর নেই–নান্য পন্থা বিদ্যতে।

ইউসুপফ-পক্ষ যে রাসপুতিনের শত্রু, তিনি এটা জেনেশুনেও ইউসুপফের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে এলেন কেন? কেউ বলে, ইউসুপফের সুন্দরী স্ত্রী ইরেনে তাকে ‘বিশেষ’ প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেন, কেউ বলে, রাসপুতিন সত্যই আশা করেছিলেন, মুখোমুখি আলাপ আলোচনার ফলে হয়তো প্রাসাদের এই শত্রুপক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপিত হতে পারে, কেউ বলে রাসপুতিন প্রাসাদ জয় করেছিলেন বটে কিন্তু ইউসুপফের মতো অভিজাতবংশের কেউ কখনও তাকে নিমন্ত্রণ করা দূরে থাক, বাড়িতে পর্যন্ত ঢুকতে দিতেন না। ইউসুপফ-জয় অর্থই প্ৰেত্রোগ্রাদ-অভিজাতকুল জয়। তার অর্থ, নতুন শিষ্য, নতুন… একটা সম্পূর্ণ নতুন ভাণ্ডার।

প্রায় সবাই বলেছেন, মদে দেওয়া হয়েছিল প্রচুর পটাসিয়াম সায়েনাইড, কিন্তু অধ্যাপক বলেছিলেন, মধুভরা বিরাট কেকের সঙ্গে মিশিয়ে। আমার মনে হয় দ্বিতীয় পন্থাতেই আততায়ীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। মহামান্য অতিথি রাসপুতিনকে অবশ্যই দিতে হত বংশানুক্রমে সযত্নে রক্ষিত অত্যুকৃষ্ট খানদানি মদ্য; এবং ভদ্রতা রক্ষার জন্য অতিথি সেবককেও নিতে হত সেই বোতল থেকেই। এইটেই সাধারণ রীতি। পার্টিতে সবাই তো আর কে কিন্তু খায় না– তা-ও আবার তিন-ডবল মধুভর্তি স্পেশাল রাসপুতিন কে’ তদুপরি বিরাট কেকের দু আধা দুই পদ্ধতিতে নির্মাণ করে জোড়া দেওয়া অতি সহজ।

তা সে কেকই হোক আর খানদানি মদই হোক– রাসপুতিন তার বীভৎস অভ্যাসমতো সে-বস্তু খেয়ে গেলেন প্রচুরতম পরিমাণে, এবং তাজ্জব কী বাৎ! তার কিছুই হল না। চোখের পাতাটি পর্যন্ত নড়ল না। আমার সুস্পষ্ট মনে আছে এস্থলে অধ্যাপকও আপন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মাই বয়! দেয়ার উয়োজ ইনাফ পয়জন টু নক অফ সিকস্ বুলজ’। অর্থাৎ ওই বিষে ছ’টা আস্ত বলদ ঘায়েল হয়! কিন্তু রাসপুতিন নির্বিকার! ইউসুপফরা জানতেন না, রাসপুতিনকে ইতোপূর্বে একাধিকবার বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টা নিষ্ফল হয়। ম্যাজিশিয়ানরা যে রকম ব্লেড খায়, রাসপুতিন ঠিক সেইরকম হরেক জাতের বিষ খেতে তো পারতেনই, হজমও করতেন অক্লেশে।

ষড়যন্ত্রকারীরা পড়লেন মহা ধন্দে। তাঁদের সব প্ল্যান ভণ্ডুল।

তখন ইউসুপফ অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের ফিসফিস করে বললেন, ‘এ রকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। আমি ওকে গুলি করে মারব’।

পিছন থেকে ঠিক ঘাড়ের উপর, অর্থাৎ সবচেয়ে মারাত্মক জায়গায়, এক্কেবারে কাছে এসে ইউসুপ গুলি ছুড়লেন। রাসপুতিন রক্তাক্ত দেহে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।

সে তো হল। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এখন সম্মুখীন হলেন এক সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত নতুন সমস্যার। জখমহীন মৃতদেহ যত সহজে হস্তান্তর করা যায়, রক্তাক্ত দেহ নিয়ে কর্মটা তো অত সহজ নয়। এখন কী করা কর্তব্য সেটা স্থির করার জন্য দলের আর যারা সন্দেহ না জাগাবার জন্য পার্টিতে যোগ না দিয়ে উপরের তলায় অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের সঙ্গে ইউসুপফাদি যোগ দিলেন। তার পূর্বে তিনি লাশটা টেনে টেনে সেলারে (মাটির নিচে কয়লা এবং আর পাঁচটা বাজে জিনিস রাখার গুদোম) রেখে এলেন। পাছে হঠাৎ কেউ ডাইনিংরুমে ঢুকে লাশটা আবিষ্কার করে ফেলে।

স্থির হল, রাসপুতিনের লাশ ইউসুপফের বাড়ির কাছে নেভা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হবে। সেটা ডিসেম্বর মাস।(৫) নেভার উপরকার জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। সেইটে ভেঙে লাশ ভেতরে ঢুকিয়ে গায়েব করে দেওয়া কঠিন কর্ম নয়।

এইবার সবাই হলেন যাকে বলে বজ্রাহত! এবং ভুলবেন না, এদের অধিকাংশই ফৌজের আপিসার।(৬) এঁদের কাউকে হকচকাতে হলে রীতিমতো কস্ত করতে হয়, আর মৃত্যুভয়? ছোঃ!

তা নয়! সবাই সেলারে ঢুকে দেখেন, রাসপুতিনের লাশ উধাও! ঘাড়ের সবচেয়ে মারাত্মক জায়গায় গুলি খেয়ে যে-লোকটা পড়ে গিয়ে মরল, সে যে শুধু আবার বেঁচে উঠল তাই নয়, আপন পায়ে হেঁটে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গেল!

অবশ্য এ-কথা ঠিক, ইউসুপ সেলারের দরজা বাইরের থেকে তালাবদ্ধ করেননি, এবং খামোকা বেশি লোক যাতে না জানতে পারে তাই সে রাত্রে অধিকাংশ চাকর-বাকরকে ছুটি দিয়ে রেখেছিলেন।

রাসপুতিন যদি এখন কোনও গতিকে জারিনার কাছে পৌঁছে সব বর্ণনা দেন এবং নিশ্চয়ই তিনি করবেন বলে ইউসুপফের অবস্থাটা কী?

কিন্তু তিনি অতশত ভাবেননি– অন্যদের জবানি তাই। তাঁরা বলেন, তিনি পাগলের মতো পিস্তল হাতে নির্জন রাস্তায় ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দেখেন, চতুর্দিকের সেই শুভ্র শুভ্রতাময় বরফের ভিতর দিয়ে টলতে টলতে রাসপুতিন এগিয়ে যাচ্ছেন। রক্তক্ষরণও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার ইউসুপ আর কোনও চান নিলেন না। পিস্তলে যে কটা গুলি ছিল সবকটা ছুড়লেন তার ঘাড়ের উপর। তার পর সবাই মিলে তাঁকে টেনে নিয়ে নেভা নদীর উপরকার জমে যাওয়া বরফ ভেঙে লাশটা ঢুকিয়ে ঠেলে দিলেন ভাটির দিকে।

কিন্তু জারিনা সে দেহ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। চার্চেরই মতো একটি বিশেষ উপাসনাগারসহ নির্মিত চেপলে তার দেহ সযত্নে গোর দেওয়া হল একটি রমণীয় পার্কের ভিতর। মহারানি প্রতি রাতে যেতেন সেই গোরের পাশে, নীরবে অঝোরে অশ্রুবর্ষণ করার জন্য, রাসপুতিনের আত্মার সদগতি কামনা করে।
২২।১।৬৬

———-

১. এ’র উল্লেখ শ্রীযুক্ত প্রভাত মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্র জীবনী’তে করেছেন; আমিও ‘দেশে-বিদেশে’ বইয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করেছি।

২. স্বয়ং স্বামীজী নাকি বলেছেন, “যে ভগবান আমাকে এ দুনিয়ায় একমুঠো ভাত দেয় না, সে নাকি মৃত্যুর পর আমাকে স্বর্গরাজ্য দেবে—Why, even an imbecile would not believe it; much less I!” তবে এটা প্রক্ষিপ্তও হতে পারে। তবু এ কথা অতিশয় সত্য, তিনি এই পৃথিবীতেই স্বর্গরাজ্য স্থাপনা করতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিম নাকি বলতেন, মানুষকে ভগবান হতে হবে, আর তিনি নাকি বলতেন, মানুষকে মানুষ হতে হবে।

৩. সে অত্যাচার-সংবাদে কাতর হয়ে তলস্তয় ‘রেসারেকশন’ বই লিখে, টাকা তুলে এদের অনেককে কানাডা পাঠিয়ে দেন।

৪. এই কনফেশন বা পদস্খলন স্বীকারোক্তি একাধিক ধর্মে প্রচলিত আছে। এদেশে জৈনদের ভিতর সেটি নিষ্ঠা সহকারে মানা হয়, এবং এরই নাম পর্যষণ। তবে আমাদের যতদূর জানা, পর্যষণ বৎসরে মাত্র একবার হয় এবং সম্প্রদায়ের সকলেই সেটা একই সময়ে করেন বলে বর্ষার শেষে সেটা পৰ্বদিবস রূপে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ শ্রমণরাও বর্ষাকালে পর্যটন নিষিদ্ধ বলে কোনো সংঘে আশ্রয় নিয়ে বর্ষাযাপন-শেষে পাপ স্বীকারোক্তি করে পুনরায় পর্যটনে নেমে পড়েন। মুসলমানরা হজের সময় করে থাকেন, এবং মৃত্যু আসন্ন হলে তওবা করেন। তওবা’ শব্দার্থে ‘প্রত্যাবর্তন’। অর্থাৎ তওবাকারী আপন পাপ সম্বন্ধে অনুশোচনা করে ধর্মমার্গে প্রত্যাবর্তন করল।

৫. রাসপুতিনের মৃত্যুদিবস ১৫।১৬ ডিসেম্বর ১৯১৬ বলা হয়, আবার ৩০ ডিসেম্বরও বলা হয়। তার কারণ অর্থডক্স রুশ ক্যালেন্ডার ও কন্টিনেন্টের প্রাচীন ক্যালেন্ডারে ১৩১৪ দিনের পার্থক্য।

 ৬. অধ্যাপক আমাকে গল্পচ্ছলে একদা বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে রাশান অফিসারদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা (প্যাস্টাইম) ছিল প্রচুর মদ্যপানের পর লটারিযোগে দু জন অফিসারের নাম স্থির করা। তারপর একজন একটা ঘরে ঢুকে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থান বেছে নিয়ে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকবে অন্য অফিসার, হাতে সবচেয়ে ছোট সাইজের পিস্তল নিয়ে। প্রথম অফিসার আশ্রয়স্থল থেকে কোকিলের মতো ডাক ছাড়বে, “ক”; অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকারে সুদ্ধমাত্র ধ্বনির ওপর নির্ভর করে পিস্তল মারবে। তখন সেই অন্ধকারে ‘শিকার জায়গা বদলাবে, কিন্তু “কু” ডাক না ছাড়া পর্যন্ত পিস্তল মারা বারণ। কতক্ষণ পরে দু জনের পার্ট বদলায়, আমার মনে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *