রালদুর্গার ব্রতকথা
চিত্রকূট পাহাড়ে বসে লক্ষ্মী-নারায়ণ পাশা খেলছিলেন। সেইখানে একজন বুড়ো ব্রাহ্মণ ফুল তুলতে আসতেই নারায়ণ তাঁকে ডেকে বললেন, ‘ওহে, তুমি পাশা খেলতে জানো?’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘জানি।’ তখন নারায়ণ বললেন, ‘আমায় যদি হারাও, তোমায় কুটে আতুর করে দেব।’ লক্ষ্মী বললেন, ‘আমায় যদি হারাও, তবে তোমায় ভস্ম করব।’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আমি ভস্ম হতে পারব না, বরং কুটে হব সেও ভালো।’ এই বলে লক্ষ্মীকে খেলা বলে দিতে লাগলেন। নারায়ণের হার হল। তিনি বুড়ো ব্রাহ্মণকে শাপ দেবামাত্র ব্রাহ্মণ কুটে আতুর হয়ে গেলেন। ব্রাহ্মণ হাতজোড় করে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘প্রভু দয়াময়, আপনি নিজে না হারলে আপনাকে কে হারাতে পারে? হরি! কেন আমাকে নিমিত্তের ভাগী করলেন? এখন কীসে আমি এই ঘোর যাতনা হতে মুক্ত হব?’ নারায়ণ বললেন, ‘যাও, এই পাহাড়ের নীচে রাজপথে গিয়ে শুয়ে থাকো। রাজার মেয়ে ইচ্ছামতী সূর্যের ব্রতদাসী, সেই রাজকন্যা যদি তোমার গলায় মালা দেয়, তা হলে তোমার দুঃখ দূর হবে।’
তখন বুড়ো ব্রাহ্মণ নারায়ণকে প্রণাম করে গড়াতে গড়াতে রাজপথে পড়ে গেলেন। তিনি রাজপথ জোড়া করে পড়ে থাকেন, কত লোক ডিঙিয়ে যায়, মাড়িয়ে যায়। একদিন রাজকন্যা ইচ্ছামতী শিবপুজো করতে যাচ্ছেন, হাতে পঞ্চপাত্র, ফুলের সাজি। ব্রাহ্মণকে বললেন, ‘ঠাকুর, একটু সরে যাও।’ ব্রাহ্মণ কোনও উত্তর দিলেন না। রাজকন্যা আবার বললেন, ‘ঠাকুর! পথ ছেড়ে দাও।’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘ওই যে সকলে ডিঙিয়ে যাচ্ছে, তুমিও যাও না, আমার নড়বার শক্তি নেই।’ রাজকন্যা বললেন, ‘ওরা অজ্ঞান, তাই তোমায় ডিঙিয়ে যাচ্ছে, আমি ব্রাহ্মণকে ডিঙিয়ে যেতে পারব না। দয়া করে আমায় একটু পাশ দাও, আমি চলে যাই।’ ব্রাহ্মণ বললেন, ‘তবে আমার কাছে একটি সত্য করো যে, ‘আমায় বিয়ে করবে,’ তাহলে তোমায় পথ ছেড়ে দেব।’ রাজকন্যা তিন সত্য করে বললেন, ‘আমি তোমার গলায় মালা দেব।’ ব্রাহ্মণ অতিকষ্টে একটু পথ দিলেন। রাজকন্যা শিবপুজো করে বাড়ি গেলেন।
ইচ্ছামতী সেদিন আর কিছুই খেলেন না, নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলেন। রাজকন্যার সখীরা অনেক সাধ্যসাধনা করাতে তিনি বললেন, ‘দেখো, আমার চোদ্দ-পনেরো বছর বয়েস হল, এখনও আমার বিয়ে হল না। আমায় যে দেখে সেই নিন্দে করে, আমি লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। তোমরা আমার বাবাকে বলো যেন শিগগির আমার স্বয়ম্বরের আয়োজন করেন।’ রাজা এই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ রাজ্যে রাজ্যে লোক পাঠালেন। কত রাজা, কত রাজপুত্র উপস্থিত হলেন। স্বয়ম্বরের দিন ধার্য হল। সেইদিন বুড়ো ব্রাহ্মণ অতি কষ্টে রাজসভার একটি পাশে গিয়ে পড়ে রইলেন। রাজকন্যা যখন মালাচন্দন নিয়ে রাজসভায় এসে দাঁড়ালেন, তখন রাজারা সব চিৎকার করে বলতে লাগলেন, দেখো, আমি রূপে বড়ো, কেউ বললেন আমি গুণে বড়ো, কেউ বললেন, আমি ধনে বড়ো, কেউ বললেন আমি মানে বড়ো। রাজকন্যা কারো পানে না চেয়ে একেবারে সেই বুড়ো ব্রাহ্মণের গলায় মালা দিয়ে হাত ধরে তুলে নিলেন। তখন যত রাজা হো হো করে হাততালি দিয়ে উঠে বললেন, ‘ছি: ছি:, রাজার মেয়ের এমন নীচ প্রবৃত্তি?’ এই বলে সভা ভঙ্গ করে যে যার দেশে চলে গেলেন। রাজা অপমানিত হয়ে মেয়ে-জামাইকে বনবাসে পাঠালেন।
ইচ্ছামতী বনে গিয়ে অতিকষ্টে দিন কাটাতে লাগলেন। প্রাণপণে কুটের সেবা করেন আর দিনান্তে যেমন জোটে তেমনি খান। একদিন মা লক্ষ্মী একটি অশোকপাতায় রালদুর্গার পুজো প্রণালীটি লিখে বুড়ো ব্রাহ্মণের গায়ে ফেলে দিলেন। ইচ্ছামতী কাঁদছেন আর বলছেন:
কুটে নাড়ি, কুটে চাড়ি, বারো বৎসর কুটের সেবা করি।
তবু না কুটে ভালো করতে পারি।।
আমি রাজার মেয়ে, কোথায় রাজার বউ হব, সোনার খাটে শোব, রুপোর খাটে পা দেবো, তা না হয়ে কুটে ব্রাহ্মণকে বিয়ে করে আজ আমার এই দুর্দশা! আর এত সেবা করছি তবু তো কুটে ভালো করতে পারলুম না, ভগবানের কী বিচার!’ বুড়ো ব্রাহ্মণ বলছেন, ‘ও ইচ্ছামতী, দেখতো আমার গায়ে কী একটা পড়ল।’ ইচ্ছামতী গিয়ে দেখেন একটা পাতা। সেটি নেড়েচেড়ে দেখলেন যে, তাতে রালদুর্গার ব্রত-মাহাত্ম্য লেখা আছে। ইচ্ছামতী সেটি পড়ে খুশি হলেন। তখন অঘ্রাণ মাস, অমাবস্যা এল। ইচ্ছামতী সতেরো ধান, সতেরো দুর্বা দিয়ে, কলা গাছের মাজ পাতার অর্ঘ করে, সিন্দুর, চন্দন, ওড় ফুল, জোড়া কলা, রক্তচন্দন, জবার মালা দিয়ে তাবার টাটে রাখলেন। প্রতিদিন তাতে জল দেন, ফুল দেন, এমনি করে একপক্ষ গেল। পূর্ণিমার দিন ষোড়শোপচারে রালদুর্গার পুজা করে সতেরো মুঠো চালের ওলি সুলি খেলেন। এমনি করে আবার পৌষ মাসের পূর্ণিমায় ঘট স্থাপনা করে রালদুর্গার পূজো করলেন। তাবার টাটে সূর্যের পুজো করে সতেরো মুঠো চালের পায়েস করে খেলেন। মাঘ মাসে পুজো করে সতেরো মুঠা চালের দই ভাত খেলেন।
ফাল্গুন মাসে পুজো করে সতেরো মুঠো চালের পুলি পিঠে করে খেলেন। ওড় ফুল, জোড়া কলা, রক্তচন্দন, জবার মালা, তাবার টাটে সূর্যকে অর্ঘ দিয়ে পাত্র নিয়ে জলে ভাসালেন। সূর্যদেব সাক্ষাৎ হয়ে বললেন, ‘ইচ্ছামতী! কী বর চাও?’ ইচ্ছামতী বললেন, ‘আমার কুটে স্বামীর কন্দর্পের মতো চেহারা হোক।’ দেখতে দেখতে কুটে ব্রাহ্মণের কাঞ্চন মূর্তি হল। আবার কিছুদিন পরে ইচ্ছামতী টাকার জন্যে দুঃখ করতে লাগলেন। তখন আবার দৈববাণী হল:
যে ব্রত করে তোমার সুন্দর হয়েছে পতি।
সেই ব্রত করো তোমার ঘুচিবে দুর্গতি।।
তখন আবার অঘ্রাণ মাস হতে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ওই রকম রালদূর্গার ব্রত করলেন। তাবার টাটে সূর্যকে অর্ঘ দিয়ে পাত্র নিয়ে জলে ভাসালেন। সূর্যদেব সাক্ষাৎ হয়ে বললেন, ‘কী ইচ্ছামতী! আবার কী বর চাও?’ ইচ্ছামতী বললেন, ‘আমার হাতিশালে হাতি হোক, ঘোড়াশালে ঘোড়া হোক, ঔরি চৌরি, দক্ষিণ দুয়ারি বাড়ি হোক, দাস-দাসী হোক, সোনা-দানা হোক, ধন-দৌলৎ হোক।’ সূর্যদেবের কৃপায় তখনি সেই সব হল। তারপর ইচ্ছামতী একদিন বললেন, ‘দেখো, আমার এত ঐশ্বর্য হল, কিন্তু একটি ছেলে হল না।’ তখন ব্রাহ্মণ বললেন:
যে ব্রত করে তোমার সুন্দর হয়েছে পতি,
যে ব্রত করে তোমার ঘুচেছে দুর্গতি,
সেই ব্রত করো তুমি হবে পুত্রবতী।
আবার অঘ্রাণ মাস। অমাবস্যা এল, ইচ্ছামতী নিয়মিত চার মাস ব্রত করলেন; তাবার টাটে সূর্যকে অর্ঘ দিয়ে পাত্র নিয়ে জলে ভাসালেন। সূর্যদেব সাক্ষাৎ হয়ে বললেন, ‘বলো ইচ্ছামতী! কী বর চাই?’ ইচ্ছামতী বললেন, ‘আমরা অপুত্রক আছি, আমাদের একটি পুত্রসন্তান হোক।’ ‘তথাস্তু’ বলে সূর্যদেব অন্তর্ধান হলেন। তারপর দশ মাস দশ দিনে ইচ্ছামতীর একটি চাঁদের মতো ছেলে হল। ইচ্ছামতীর আর কোনও কষ্ট নেই। ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লাভ হল, সোনার সংসারে সুখে স্বচ্ছন্দে দিন কাটতে লাগল।
একদিন রাজার মনে হল, ইচ্ছামতীকে যে বনবাস দিয়েছি—সে কি অবস্থায় আছে দেখি। এই মনে করে তিনি বললেন, ‘কোটাল সেই বনে ইচ্ছামতীর সন্ধান লও।’ কোটাল সেখানে গিয়ে কোনো সন্ধান না পেয়ে ফিরে এসে বললেন, ‘মহারাজ! সে বনে ইচ্ছামতী নেই, আর কুটে ব্রাহ্মণও নেই। কোনো রাজা সেখানে রাজ্য স্থাপনা করেছেন।’ সে কথা শুনে রাজার মুখ শুকিয়ে গেল, কাঁদতে লাগলেন। রাজা বললেন, ‘চল কোটাল, আমায় সেইখানে নিয়ে চল।’ কোটাল রাজাকে সঙ্গে করে নিয়ে সেই বনে গেলেন। রাজা যাকে দেখতে পান তাকেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘হাঁ বাপু! এ নগর কার?’ সকলেই বলে ‘এ এক বুড়ো ব্রাহ্মণের।’ দেবালয় কার? বুড়ো ব্রাহ্মণের। নহবতখানা কার? বুড়ো ব্রাহ্মণের। এ বাগান কার? বুড়ো ব্রাহ্মণের। এ দিঘি কার? বুড়ো ব্রাহ্মণের। শুনতে শুনতে রাজবাড়ির কাছে গেলেন, দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ বাড়ি কার?’ তারা বললেন, ‘বুড়ো ব্রাহ্মণের।’ রাজা বললেন, ‘বুড়ো ব্রাহ্মণ কে বাপু?’ দ্বারবান বললে, ‘আপনি কোথা থেকে এলেন মহাশয়? বুড়ো ব্রাহ্মণ কে জানেন না? এক রাজার মেয়ে ইচ্ছামতী সত্যপালনের জন্য কুটে ব্রাহ্মণের গলায় মালা দিয়েছিলেন। সেই অপরাধে আহাম্মক রাজা মেয়ে-জামাইকে বনবাস দিয়েছিল। সেই পতিব্রতা সতী ইচ্ছামতী আতুর স্বামীর সেবা করে পুণ্যের জোরে তাঁর এখন এই সকল সুখসম্পত্তি হয়েছে।’ এমন সময়ে ইচ্ছামতী এসে বললেন, ‘ওরে তোরা কার সঙ্গে কথা কচ্ছিস? ওঁদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে আয়।’
তখন রাজাকে আর কোটালকে সঙ্গে করে দ্বারবান বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ইচ্ছামতী রাজাকে প্রণাম করে নিজে হাত-পা ধোবার জল এনে দিলেন। রাজা বললেন, ‘মা ইচ্ছামতী, তোমার সুখ দেখে আমি অবশ্যই সুখী হয়েছি, কিন্তু আমি তোমার জলে পা ধোব না।’ ইচ্ছামতী বললেন, ‘কেন বাবা! আমি কী অপরাধ করেছি? আপনার যে সন্দেহ হচ্ছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। ওই দেখুন আপনার সেই কুটে জামাই। আমি রালদুর্গার ব্রত করে সূর্যদেবের কৃপায় আমার এই সব হয়েছে।’ জামাই এসে তখন শ্বশুরকে প্রণাম করলেন। রাজা জামাইয়ের সঙ্গে কোলাকুলি করে নাতিকে কোলে করে নিলেন। তারপর নানা কথার পর স্নানাহার করে বললেন, ‘মা ইচ্ছামতী, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। তোমার মা তোমার জন্য বড়োই ব্যাকুল হয়েছেন।’ এই বলে তিনি মেয়ে, জামাই, নাতি নিয়ে ধুমধাম করে বাড়িতে গেলেন। মেয়ে, জামাই ও নাতিকে দেখে রানির আর আহ্লাদের সীমা নেই। মেয়েকে বললেন, ‘মা! তুমি যদি এমন ব্রত জানো, তবে তোমার একটি ভাই হোক না।’
তখন ইচ্ছামতী মাকে রালদুর্গার ব্রত করালেন, তারপর তাঁর মায়ের একটি ছেলে হল। ইচ্ছামতী কিছুদিন থেকে নিজের বাড়ি চলে গেলেন। এখানে কতকদিন থাকেন, ওখানে কতকদিন থাকেন। ইচ্ছামতীর আর আদর ধরে না। ছেলেটি বড়ো হল, ভাইটিও বড়ো হল। তারপর তাদের বিয়ে দিয়ে ঘরকন্না বুঝিয়ে দিয়ে, রালদুর্গার ব্রত করালেন। উঠোনে আলপনা দিয়ে ঘট স্থাপনা করে রালদুর্গার পূজো করলেন, সূর্যের অর্ঘ দিলেন, লক্ষ্মী-নারায়ণকে স্মরণ করে পাত্র নিয়ে জলে ভাসালেন। লক্ষ্মী-নারায়ণ সাক্ষাৎ হয়ে বললেন, ‘তোমরা কী চাও?’ ইচ্ছামতী বললেন, ‘প্রভু, আপনাদের কৃপায় মর্ত্যের ভোগবাসনা সব পূর্ণ হয়েছে, এখন স্বর্গে যেতে বাসনা করি।’ তখন স্বর্গ থেকে রথ এল, চুয়া চন্দনের ছড়া পড়তে লাগল; রাজা, রানি, ইচ্ছামতী, বুড়ো ব্রাহ্মণ চারিজনে লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগল রূপ দেখতে দেখতে সশরীরের স্বর্গে চলে গেলেন। তখন ইচ্ছামতীর ছেলে ও ভাই দুজনে রালদুর্গার ব্রত রাজ্য মধ্যে প্রচার করলেন। সেই অবধি চতুর্দিকে রালদুর্গার পুজো হতে লাগল।
রালদুর্গা বা পূর্ণিমার ব্রতকথা সমাপ্ত।