৯.
এক ইংরেজ সংবাদপত্র পড়িতে পড়িতে বাষ্পকুলকণ্ঠ অশ্রুমোচন করিয়া বলিল, হায় হায়, কোটিপতি স্মিথ ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন।
সখা সান্ত্বনা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি আপনার নিকট-আত্মীয় ছিলেন?
প্রথম ইংরেজ বলিল, না, আমার দুঃখ তো সেই জন্যই।
ডক্টর মুখোপাধ্যায় বাংলা দেশের ছোটলাট হওয়াতে আমার শোক বহুলাংশে সেই জাতীয়ই। বরঞ্চ বলিব, অনেক বেশি; কারণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে আমি বিলক্ষণ চিনিতাম কিন্তু হায়, তখন কি জানিতাম যে তিনি একদিন লাট সাহেবের গদিতে আরোহণ করিবেন! এই সরল শান্ত অমায়িক লোককে কি কখনও রাজ্যপালরূপে কল্পনা করিতে পারিয়াছি? তাহা হইলে কি তাহার এইরকম অবহেলা করিতাম? তিনি যখন সাদর আমন্ত্রণ করিয়া বলিতেন, আসুন, আসুন : বঙ্গদেশ হইতে কতিপয় সুপক্ক আম্র আগমন করিয়াছে; ভক্ষণ করিয়া আপনি তপ্ত হউন, আমিও আনন্দ লাভ করি, হায়, তখন জানিলে কি আমি ক্ষিপ্রগতিতে তাঁহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতাম না, অতিশয় সবিনয় তাহার কুশল সন্দেশ জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহার চিত্তজয় করিবার জন্য সচেষ্ট হইতাম না? হায়, কী মূর্খ আমি, ধিক্ আমাকে!
কিন্তু প্রলাপ বকিতেছি। রে রসনে, তুমি সংযত হও।
আমি বড়ই আনন্দিত হইয়াছি। মুখোপাধ্যায় অসাধারণ সজ্জন ব্যক্তি। যদিস্যাৎ সাক্ষাৎ হয় তবে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে রসাল ভক্ষণে পুনরপি সাদর আমন্ত্রণ জানাইবেন।
সত্যই বলিতেছি, আমি ও আমার প্রতিবেশীগণ সকলেই মুখোপাধ্যায়ের রাজ্যপালত্ব প্রাপ্তিতে অবিমিশ্র উল্লাস উপভোগ করিয়াছি। একে অন্যকে আনন্দ অভিনন্দন জানাইয়াছি এবং বলিয়াছি, কলিকাতায় আর বাসস্থানের দুর্ভাবনা রহিল না।
মুখোপাধ্যায় মহাশয় আজীবন আর্তসেবা, জ্ঞানসার এবং সত্যের অনুসন্ধান করিয়াছেন। ভগবানের সাহায্য ও গুরুজনের আশীর্বাদ তাহার উপরে নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু দৃষ্টত সর্বপ্রকার সঙ্কর্ম তিনি স্বীয় পুরুষকারের দ্বারাই সম্পন্ন করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি যে পদমর্যাদা ও তৎসংযুক্ত রাজদণ্ড হস্তে পাইলেন তাহার সাহায্যে প্রচুরতর সঙ্কর্ম সাধন করিতে পারিবেন এমত আশা নিশ্চয়ই দুরাশা নয়। আর যদি না করিতে পারেন তবে বুঝিব ফিরিঙ্গি-প্রবর্তিত এ পদ এখনও স্বদেশী হয় নাই। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস মুখোপাধ্যায় মহাশয়ও যদি এ পদের রূপ পরিবর্তন না করিতে পারেন তবে আর কেহই পারিবে না।
মুখোপাধ্যায় মহাশয় নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান, অগণিত মুসলমান তাঁহাকে অন্নদাতা বস্ত্রদাতারূপে ভক্তি করে আর হিন্দু সমাজের তিনি স্বজন ছিলেন তো বটেই। তিন সম্প্রদায়ই মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে সানন্দ অভিনন্দন জানাইবেন।
মুখোপাধ্যায় দীর্ঘজীবন লাভ করতঃ দেশের দশের মঙ্গল সাধন করুন।
শতং জীব, সহস্রং জীব।
***
শ্ৰীযুত কাটজুর বঙ্গত্যাগে বহু লোক তাহার অভাব অনুভব করিবেন। তিনি অমায়িক, নিরহঙ্কারী ও সুপণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি ধীরে ধীরে বঙ্গভূমির প্রতি বিলক্ষণ অনুরক্তও হইয়াছিলেন।
দিল্লিবাসী বাঙালিরা শ্ৰীযুত কাটজুর দিল্লি আগমনে উল্লসিত হইলেন। ধর্ম জানেন, আজ বাঙালির বেদনা বুঝিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মুরুব্বি নাই। বঙ্গদেশাগত বাঙালি প্রয়োজনবশত দিল্লিতে আগমন করিলে এক্ষণে অন্তত শ্ৰীযুত কাটজুর দ্বারস্থ হইতে পারিবে; দিল্লিবাসী বাঙালিও মনে মনে সে আশা পোষণ করে।
শ্ৰীযুত কাটজু নিশ্চয়ই তাহাদিগকে হতাশ করিবেন না।
***
সাংস্কৃতিক যোগসূত্র দৃঢ়তর এবং নবীন যোগসূত্র স্থাপনা করিবার জন্য কতিপয় চৈনিক বিদগ্ধ পুরুষরমণী মহানগরীতে পদার্পণ করিয়াছেন। ইঁহাদের শুভাগমনে সর্বসম্প্রদায়ের লোককে এক হইয়া ইহাদিগকে স্বাগত অভিবাদন জানাইতে দেখিলাম। কংগ্রেস সরকার যদিও প্রধান অতিথিসেবক, তবু দেখিয়াছি কম্যুনিস্ট ভ্রাতাদের আনন্দোল্লাস কিছুমাত্র কম নহে এবং অন্যান্য শ্রেণিও বিস্মৃতির ভয়ে যত্রতত্র ঘনঘন পদচারণা করিতেছেন।
চৈনিকমণ্ডলী উদয়াস্ত যেসব অভিনন্দন সভায় উপস্থিত হইতেছেন তাহার নির্ঘণ্ট দিতে গেলেই এ পত্রের অধিকাংশ ব্যয় হইয়া যাইবে। এই রবিবারেই দেখিতেছি তিনটি পর্বে এই অভাজনকেই উপস্থিত থাকিতে হইবে। অভিজাত প্রতিষ্ঠান অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস্ সোসাইটি, ব্রাত্য শিল্পীচক্র ওই দিন ইহাদিগকে সম্মান দেখাইবেন ও সন্ধ্যায় চৈনিক রাজদূত বিদেশাগত বিদগ্ধমণ্ডলী এবং দিল্লি নাগরিকদিগকে পানাহারে তৃপ্ত করিবেন। চৈনিকদের অতিথিবাৎসল্য তাহাদিগকে কতদূর মুক্তহস্ত করিতে পারে তাহার ভূরি ভূরি অভিজ্ঞতা আমার আছে– এই পর্বেও তাহার ব্যত্যয় হইবে না। তাহার বর্ণনা একদিন সুযোগ সুবিধামতো নিবেদন করিব।
বিদগ্ধমণ্ডলীকে অভর্থনা করিবার সময় নানা মহাজন নানা জ্ঞানগর্ভ বাণী উচ্চারণ করিয়াছেন; কিন্তু একটি বিষয়ের উল্লেখ কেহই করেন নাই বলিয়া অতিশয় সভয়ে তাহা নিবেদন করি।
সকলেই জানেন বৌদ্ধশাস্ত্রের বহু মূল সংস্কৃত এবং পালি গ্রন্থ চিরতরে লোপ পাইয়াছে; কিন্তু এইসব গ্রন্থের চীনা (এবং তিব্বতীয়) অনুবাদ এখনও চীন দেশে পাওয়া যায়। এইসব গ্রন্থ পুনরায় ভারতীয় ভাষাতে (কিংবা ইংরেজিতে) অনুবাদ না করিলে বৌদ্ধধর্মের সর্বাঙ্গসুন্দর স্বরূপ আমাদের সম্মুখে বিকশিত হইবে না এবং এই সুবৃহকর্ম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানবিশেষের পক্ষে সম্ভবপর নহে।
এই চৈনিক বিদগ্ধমণ্ডলীর সঙ্গে সংযুক্ত হইয়া যদি সরকার এই সুবর্ণ সুযোগে একটা সুব্যবস্থা করিয়া লইতেন তবে আমরা উচ্চকণ্ঠে সাধুবাদ জানাইতাম।
যে দুইটি ভারতীয় উপযুক্ত বিষয়ে আজীবন পরিশ্রম করিয়াছেন, কই, তাঁহাদের কাহাকেও তো এই উপলক্ষে দিল্লিতে দেখিলাম না।
***
ইন্দ্রলুপ্তজন বিল্ববৃক্ষতলে একাধিক বার যায় না–ইহা আপ্তবাক্য।
ক্রিকেট খেলা দেখিতে গিয়াছিলাম। আর যাই না।
রে রে পাষণ্ড শব্দোচ্চারণ করিয়া উভয় পক্ষ যুদ্ধে অবতরণ করিলেন না। মল্লপক্ষদ্বয়। একে অন্যকে ভীতনেত্রে পর্যবেক্ষণকরতঃ অতিশয় সন্তর্পণে ক্রীড়া আরম্ভ করিলেন। দর্শকমণ্ডলী ততোধিক সন্তর্পণে করতালিধ্বনি করিলেন। দশ মিনিট যাইতে না যাইতে যখন প্রথম মল্ল গতাসু হইলেন তখন যে হর্ষধ্বনি উত্থিত হইল সে ধ্বনি রক্তদুর্গ মস্তকে থাকুন দেহলি-তোরণ পর্যন্ত পৌঁছিল না। ক্রীড়ারম্ভেই অন্যতম মরে পরলোকগমন যে কী গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিস্থিতি তাহা কি দর্শকমণ্ডলী সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইলেন না? তবে কি মুহুর্মুহু মলুপতন না হইলে দর্শকজনমধ্যে আনন্দোল্লাসের সঞ্চার হয় না? বহ্বান্ন ভক্ষণই কি সুরুচির লক্ষণ? ভূমাতে সুখ তাহা জানি, কিন্তু অল্পেই বা কি কম? ঋষিবাক্য আছে, যাহা অল্প তাহাই মিষ্ট।
চক্রবর্তী রাজগোপালাচারী মহানগরী ত্যাগ করার পূর্বে বক্তৃতা-ভাষণে বিপুল শ্লেষ বর্ষণ করিয়া যান। প্রতি আমন্ত্রণে প্রত্যেকটি নিমন্ত্রণে তিনি সাতিশয় প্রাঞ্জল ভাষায় সর্ববিধ বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ বিতরণ করিয়া গিয়াছেন। তাহারই একটিতে তিনি জনগণকে উদ্দেশ করিয়া বলেন, হে দিল্লি যুবক সম্প্রদায়, যখনই দেখি তোমরা মাতা, কন্যা কিংবা প্রিয়াকে দ্বিচক্রযানের পশ্চাদ্দেশে বসাইয়া তাঁহাদের ভার আপন স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছ তখন আমি উল্লাস বোধ করি।
মল্লভূমির তোরণপ্রান্তে দণ্ডায়মান হইয়া দেখিলাম, অসংখ্য যুবক উপযুক্ত পদ্ধতিতে বহু বালাকে আনয়ন করিলেন।
এই দৃশ্য কলিকাতায় বিরল।
এক ইংরেজই বলিয়াছেন, দ্বাবিংশাধিক লোমাবৃত মূর্খ (টুয়েনটি টু ফ্ল্যানেলড় ফুলস) একটি চর্মাবৃত গোলক লইয়া জীবনমরণ পণ করিয়াছে, দেখিবার জন্য আসে আরও বিংশতি সহস্র মূর্খ! ইহারই নামান্তর ক্রিকেট।
ভদ্রলোক ক্রিকেটের মূল তত্ত্বটাই হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হন নাই। রথদর্শন এস্থলে অবান্তর।
এই যে কপোত-কপোতী তরুণ-তরুণী নানা ভঙ্গি নানা অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে আপন আপন আনন্দ প্রকাশ করিতেছে, তন্বঙ্গী কোমলাঙ্গীগণ অঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন অংশ– অধুনা উদরও অঙ্গ-স্বরূপ গণ্য করিতে হইবে– প্রদর্শনকরতঃ বিমলানন্দ উপভোগ করিতেছেন, উচ্চ হাস্যে প্রতিবেশীর দৃষ্টি আকর্ষণকরতঃ তাহাদের চিত্তে উৎসুক্য লহরির সঞ্চার করিতেছেন, তদ্বিনিময়ে তরুণগণ ক্রিকেট শাস্ত্রে তাঁহাদের গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিতেছেন যেন এক স্বয়ম্বরসভায় আপন গুণস্বরূপ সালঙ্কার বর্ণনা করিতেছেন, ইহাই তো মুখ্য, ইহাই তো তত্ত্ব, এষাস্য পরমাগতি।